প্রসন্ন পাষাণ – ৩৬

৩৬

সকাল দশ সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছলাম কুষ্টিয়া কোর্ট। শীত এসে গেল প্রায়। আকাশ ও বাতাসের কুয়াশা এত বেলাতেও কেটে যায় নি

এমন শান্ত শহর আর দেখি নি। কাঁকর বিছানো উঁচু প্লাটফর্মে ট্রেনযাত্রীর চঞ্চলতা শরৎকালের সকালে ঘুম থেকে জেগে ওঠা মুখরতার মতো মনে হতে লাগল। খবরের কাগজের বড় বড় বান্ডিল নাবল প্লাটফর্মের ওপর। সংবাদপত্রের এজেন্টদের কেন্দ্র করে কিছু কিছু লোক ভিড় করে দাঁড়িয়েছে সেদিনের টাটকা খবরের জন্য। লোকগুলো দিব্যি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শান্ত ধীর। স্টেশনের পিছনে একটা ছোট চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চির ওপর বসে কয়েকজন মাঝবয়সী লোক ছোট ছোট গ্লাসে চা খাচ্ছেন, গায়ে তাঁদের সাদা চাদর মোড়া। এখানে বুঝি শীত একটু বেশি। আমারও সারা গা কবোষ্ণ আবহাওয়ায় শিরশির করতে লাগল। গায়ে চাদর জড়িয়ে নেব, অত ঠাণ্ডা নয়। আবার বিনা চাদরেও আরাম পাই না। প্লাটফর্মে কয়েকজন তরুণকে দেখা যায়। হাতে তাদের নোটবুক, বোধ করি হাইস্কুলের ছাত্র।

প্রথম দৃষ্টিতেই কুষ্টিয়া আমার ভালো লাগল। একটি শান্ত লক্ষ্মী মেয়ের মতোই কুষ্টিয়া কোর্ট আমাকে অভ্যর্থনা করল। বড় বড় ঝাউ আর দেবদারু গাছ হঠাৎ দমকা হাওয়ায় কানাকানি করতে থাকে। সামনেই দেখতে পাই লাল সুরকির পথ। ডান দিকে আদালত, ট্রেজারি, তার দিয়ে ঘেরা—সেখানে সেন্ট্রির রাইফেলের বাঁট আর পায়ের বুট আওয়াজ করতে থাকে।

আব্বা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। আর আশ্চর্য, তাঁর পাশে সেই ডিগনিফাইড ছেলেটি। তাঁদের পিছনে আরদালি-কনস্টেবল।

ট্রেন স্থির হয়ে দাঁড়াতেই আব্বা এগিয়ে এলেন। আমরা ট্রেন থেকে একে একে নাবলাম। আরদালিরা আমাদের মালপত্র ও কুলি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আব্বার পা ধরে সালাম করে আমি এক পাশে সরে এলাম। তিনি একটি হাত দিয়ে আমার মাথা স্পর্শ করলেন। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারলেন না। এক অপরাধের সঙ্কোচ তাঁকে বাধা দিতে লাগল। কেন জানি না।

ছোট চাচাও আব্বার পা ধরে সালাম করলেন। বললেন : খবর সব ভালো? টেলিগ্রামে খোলাসা করে কিছুই বলা হয় নি। আমরা তো চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম।

–খবর ভালোই। তোমাকে বড্ড রোগা দেখছি?

ছোট চাচা সে কথা এড়িয়ে গিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন : হঠাৎ টেলিগ্রাম কেন, আমরা কিন্তু বুঝতে—

আব্বা কি বলেন শুনবার জন্য আমিও উদ্‌গ্রীব হয়েছিলাম। আব্বা সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বললেন : এর সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দি। এখানকার এস.ডি.ও। নাম আলমগীর।

এই বলে তিনি সেই ডিগনিফাইড ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলেন।

টেলিগ্রামের উদ্দেশ্য একটু একটু করে আমার কাছে পরিষ্কার হতে লাগল।

কুলি আর আরদালির পল্টন মাল নিয়ে চলে গেছে। আমরাও হাঁটতে শুরু করলাম।

দুই পাশে বড় বড় গাছের সারি প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। লাল সুরকির পথের ওপর দিয়ে লেভেল-ক্রসিং পেরিয়ে এলাম। লেভেল-ক্রসিংয়ের কাছেই একটি পাঁচ-ছয় বছরের মেয়ে, গা খালি, নাকে নোলক, দু’কানে পিতলের দুল, দু’হাত দিয়ে বাতাসা একবার মুখে পুরছিল, একবার তালুর ওপর চেপে ধরছিল। আমাকে দেখে তার দুটি চোখ বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল। ডোবার পাশে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এক গ্রাম্য-বধূ, মাথায় মস্ত ঘোমটা, শুধু তার চোখ দুটি বের করে ছিল। গরুর গাড়ি অলস মন্থর গতিতে ধুলা উড়িয়ে চলেছে। গরুর গলার ঘণ্টা ঠুনঠুন করে বাজতে থাকে। বাঁ পাশের হাই স্কুলের মাঠে সার্কাসের তাঁবু পড়েছিল। আজকেই উঠে যাচ্ছে। পিঁজরা থেকে বাঘ আর সিংহের গর্জন শোনা যায়। উঁচু উঁচু হাতিগুলোর পায়ে ঘুঙুর। তারা এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। সার্কাসের চারপাশে লোকজনের ভিড়। একজন ক্লাউন দেখতে পাই। সে সঙ সেজে মুখে রঙ মেখে তার ন্যাজ দিয়ে মাঠের ওপর পটাপট শব্দ করতে থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেই আনন্দে আর উল্লাসে হাততালি দিতে দিতে জায়গাটিকে মুখরিত করে রেখেছিল। আমাদেরকে দেখে ক্লাউন তার খেলা বন্ধ করে তাঁবুর মধ্যে চলে গেল। আনন্দ বিধাতা বুঝি ঠিক করলেন, আনন্দে আমাদের প্রয়োজন নেই।

পাশেই এস.ডি.ওর বাংলো। আমরা সেখানে উপস্থিত হলাম।

উঁচু নিচু গাছের তলায় বেতের টেবিল-চেয়ার পাতা আছে। চায়ের পট, পেয়ালা, দুধ-চিনি, চামচ, কেক বিস্কুট, পিঠাসাপটা থরে থরে সাজানো। আমরা সবাই সেখানেই বসে পড়লাম। এক পেয়ালা গরম চায়ের জন্য আমিও ভূষিত ছিলাম। আলমগীর সাহেবের আম্মার পীড়াপীড়িতে একটা পিঠাও খেলাম। তারপর অনুরোধের অপেক্ষা না করে, আরো একটি নিলাম।

জয়নাব বিবি, অর্থাৎ এস.ডি.ও সাহেবের আম্মা, বললেন : পিঠা ভালো লাগল, মা? বলেই তিনি একটু হাসলেন।

—জি হাঁ।

দেখলাম, আমি কি বলি শুনবার জন্য আব্বাও উৎকর্ণ ছিলেন। তাঁর চা খাওয়া শেষ হয়েছিল। তিনি উঠে পড়লেন।

—তিশনা আমার সঙ্গে একটু এসো তো!

এই বলে আমার হাত ধরে আব্বা ভিতরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। বারান্দায় পৌঁছে আব্বা বললেন—খুব সহজে বলতে পারলেন না : তোমার কাছে একটা কথা গোপন করেছি।

তারপর একটি হাত দিয়ে পর্দা তুলে তিনি আমাকে নিয়ে এলেন ঘরের ভিতর। দেখলাম, সেখানে খাটের ওপর বসে আছেন- -এক ভদ্রমহিলা!

—তিশনা, ইনি তোমার নতুন মা!

আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকলাম নতুন মা-র দিকে। তিনিও অপেক্ষা করতে লাগলেন। কোনো এক কঠিন পরীক্ষার ফলাফলের প্রতীক্ষা।

একটি ট্রেন ঝক ঝক ঝক আওয়াজ করে চলে গেল। তার ভারি ভারি লোহার চাকার ভারে রেললাইনি পিষ্ট হতে থাকল।

নতুন মা ঘোমটা দিলেন নাবিয়ে। আমার দু’চোখ তখন ঝাপসা হয়ে গেছে। তিনি কেমন দেখতে, বয়স কত, কালো না ফর্সা, কিছুই চোখে পড়ল না।

নতুন মা বললেন : অপরাধ যদি হয়ে থাকে, সে আমার নয়। শাস্তি তুমি আমাকে দিও না। গলার আওয়াজটি বেশ মিষ্টি। এবার ভালো করে চোখ তুলে দেখলাম।

বললাম : না। অপরাধ কিসের।

সকলেই তখনো সেই গাছগুলোর নিচে বসে আছেন। কারো মুখে একটি কথা নেই। গোটা আদালত বিচারপতির রায় শুনবার জন্য যেন অপেক্ষা করে আছে। আলীম একটু তফাতে বসে আছে। আমি তারই পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।

তাকেই জিগ্যেস করলাম : এখানে আমার থাকবার জায়গাটি কোথায় বলতে পার?

জয়নাব বিবি ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন : এসো মা এসো আমার সঙ্গে। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *