৩৪
সকাল সকাল খাওয়াদাওয়া সেরে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কামিল ক’দিন থেকে আর ছোট ফুপুর ঘরে শোয় না। বাইরে চাকরদের ঘরে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকে। চাকররা আপাতত রান্নাঘরেই আশ্রয় নিয়েছে। ইনজেকশনের পর কামিল এখন ঘুমুচ্ছে।
ছোট ফুপুর ঘরের দরজা খোলা ছিল। ছোট ফুপুর সেই লণ্ঠনটি জ্বলছে। বোধ করি তেল নেই যথেষ্ট। ধিমে বাতি দপদপ করছে। ছোট ফুপু নামাজ পড়ছেন। আমার হঠাৎ হাসি পেল। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ছোট ফুপু নামাজ শেষ করে, বাতিটি আরো ধিমে করে দিয়ে দরজার আড়ালে রেখে দিলেন। সেই মুহূর্তেই তিনি আমাকে দেখতে পেলেন। কিন্তু কাছে ডাকলেন না। খাটের ওপর গিয়ে শুয়ে পড়লেন। দরজা অবশ্য খোলাই থাকল।
আমি নিঃশব্দে ভিতরে এসে দাঁড়ালাম।
কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু চৌবাচ্চা কানায় কানায় ভরে গেছে। কল বন্ধ করা হয় নি। পানি গড়িয়ে পড়ছে। কেবল তারই ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ ভেসে আসে।
—তিশনা, কিছু বলবে?
–হ্যাঁ। সেদিন রাত্রে কি হয়েছিল?
ছোট ফুপু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন।
—বলবে না ছোট ফুপু? কি ঘটেছিল?
—বললে কি তুমি বিশ্বাস করবে?
—এতদিন তো তোমাকে বিশ্বাস করেই এসেছি।
—তাহলে শোনো। সে রাতে আমার ঘুম আসে নি। রাত কত হবে জানি না, তবে নিশ্চয়ই গভীর রাত। তোমার ছোট চাচার ঘর থেকে একটা কাতরানির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। সকালে গায়ে জ্বর ছিল। মনে করলাম, জ্বর বুঝি বেড়েছে। কতবার ভাবলাম, তুমি উঠে গিয়ে খবর নেবে! বহুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। এও ভাবলাম, কনিজ বা জাফর গিয়ে খোঁজ নেবে তাঁর কি দরকার। কিন্তু তারাও কেউ এলো না। এদিকে সেই কাতরানি বেড়েই চলল। তখন অনেক ইতস্তত করে আমাকেই উঠতে হলো। তাঁর কামরার দরজা খোলাই ছিল। ভিতরে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যাবেলা যে জ্বালানো হয়েছে, নিভিয়ে দেবার কথা কারো মনেও হয় নি। তোমার ছোট চাচা চোখের ওপর হাত রেখে পড়ে আছেন। এক গেলাস পানি চাইলেন। এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত তাঁর টেবিলে ছিল না। আমি নিচে এসে এক জগ পানি নিয়ে আবার উপরে উঠে এলাম। পানি দিয়ে, বাতি নিভিয়ে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে নিচে নেবে আসব, এমন সময় কামিল বাতি জ্বালালো। তারপরের সব ঘটনা তুমি জানো।
—আর?
—আর কিছু না। তুমি আমাকে হয়তো ভালো চেন না; কিন্তু তোমার ছোট চাচাকে তো চেন! তাঁর ওপর অবিচার করো না। আমার আর কিছু বলবার নেই।
আমি সে কথার কোনো জবাব দিলাম না।
চৌবাচ্চার পানি তেমনি ছলছল করছিল, তাছাড়া চারদিক তেমনি নিঃশব্দ।
আমি ছোট ফুপুর আরো কাছে সরে এলাম।
বললাম : তুমি আমাকে বাঁচালে। কামিলও বাঁচবে। আমি জানি সে আমার কথা অবিশ্বাস করবে না।
ছোট ফুপু তেমনি বিছানায় পড়ে থাকলেন। আমি চলে এলাম।
সে রাত্রে কামিল অচেতনের মতো ঘুমিয়েছিল। সকালে সে যখন উঠল তখন দেখি ডাক্তারের কথা আশ্চর্য রকম ফলে গেছে। কামিল স্থির শান্ত, শুধু একটু অন্যমনস্ক। গত দু’দিনতিন আমরা যে কামিলকে দেখেছি, সে যেন অন্য লোক। হাতে-পায়ে রঙ-খড়ি মেখে মুখে মুখোশ এঁটে সে যেন এ ক’দিন সবাইকে ভয় দেখিয়েছে। তাই তাকে ঠিক চেনা যাচ্ছিল না। এখন সে যাত্রার সাজ খুলে ফেলেছে। এক রাতের সুনিদ্রা তাকে পুনর্জন্ম দিয়েছে। সেই আগেকার কামিলকেই এখন দেখতে পাই, তবে আগের চাইতেও গম্ভীর। সে যেন এইমাত্র এক আজব দেশ ভ্রমণ করে এলো।
কে জানত এটা সাময়িক সূর্যোদয়! সেদিন দুপুরে তার জ্বর এলো। দুপুর না গড়াতেই সে জ্বর থার্মোমিটারের মাথায় গিয়ে চড়ল। তারপর বিকার। এখন চৈতন্য আছে তো এখন নেই। ছোট ফুপু কাছে বসে থাকেন। বিকারের ঘোরে কামিল বলতে তাকে: মা, বড় কষ্ট!
অসুখ আরো বাড়ল। কামিল মা-কে আর ডাকে না। মাঝে মাঝে ‘তিশনা’ নামটিই কেবল তার মুখে শোনা যায়। একদিন দু’দিন করে দশ দিন পেরিয়ে গেল। অসুখ তবু সারে না। রাত্রে ডাক্তার বলে গেলেন : আজকের রাতটি দেখুন। কেস সিরিয়াস সন্দেহ নেই।
রাতের ক’টি ঘণ্টার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেই রাত শেষ হয়। কিন্তু সেই রাত আমরা যে কিভাবে কাটিয়েছি আমরাই জানি। এই একটি রাত আমাদেরকেও ফুরিয়ে দিতে চায়।
রাত ভোর হলো। কামিলের জ্বরও ছেড়ে গেল। ডাক্তার বললেন : হি ইজ নাউ অল রাইট। দি ক্রাইসিস ইজ কমপ্লিটলি ওভার। নাউ, ইউ নিড সাম লিটল রেস্ট, ইয়ং লেডি।
কনিজ বললো : বুবু, তুমি এত শিখলে কোথায়?
ছোট ফুপুও আমার গালে একটা চুমু দিলেন।
এবার আমি নিজের ঘরে ফিরে এলাম। বড় ক্লান্ত। হে বিশ্ব-বিধাতা, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমাকে আর যদি কিছু নাও দাও, আমি নালিশ করব না।’
শুধু আমার ক্লান্তি তুমি রক্ষা করো!