প্রসন্ন পাষাণ – ৩৩

৩৩

আমাকে আবার আলীমের কাছে যেতে হলো। সে বাড়িতেই ছিল। কিন্তু আমাকে দেখে অভ্যর্থনা করলেও ব্যস্ততা দেখাল না।

—আলীম, রাগ করবার সময় নেই। তোমাকে আমাদের বাড়ি আসতে হবে। এখুনি।

—তোমাদের বাড়ি? দোরগোড়ায় যে ডালকুত্তা বসিয়ে রেখেছ, তারপর কোনো ভদ্রলোক যাবে তোমাদের বাড়ি?

—অন্তত একটি ভদ্রলোক যাবে আমি জানি। আজ সকালেই তুমি বলছিলে, কামিলের ওপর রাগ করবার কোনো অর্থ হয় না। আমি এখন তোমার কথাই তোমাকে মনে করিয়ে দিতে চাই। একজন ভালো ডাক্তার নিয়ে তুমি এখুনি আমাদের এখানে চলে এসো।

—ডাক্তার? কেন কার জন্য? ছোট চাচার অসুখ কি সারে নি?

—না। কামিলের জন্য। সে অত্যন্ত অসুস্থ।

পরদিন বিকেলে আলীম আপিস থেকে সোজা আমাদের বাড়ি চলে এলো। দোতলা থেকে একতলায় যাবার সিঁড়ি যেখানে শুরু হয়েছে, সেখানেই অল্প একটু বারান্দার মতো জায়গা আছে। সবসময় ওঠাবসা করার জন্য কিছুদিন হলো সেখানে কয়েকটি চেয়ার পাতা হয়েছে। এইখানটায় বসলে ঘরের ওপরে-নিচে কোথায় কি হচ্ছে সব দেখা যায়।

আমি সেখানেই বসে একটি মাসিক পত্রিকায় মন দেবার চেষ্টা করছিলাম। আলীম কতক্ষণে আসে মনে মনে সে প্রতীক্ষাও ছিল। ছোট চাচার ঘরটিও এখান থেকে দেখা যায়। দরজার পর্দা ঝুলছে; হাওয়ায় পর্দা নড়লে ফাঁক দিয়ে ছোট চাচার মাথার পিছন দিকটা দেখা যায়। তিনি একটি আরাম কেদারায় বসে আছেন চুপচাপ। বোধ করি তিনিও কিছু পড়বার চেষ্টা করছেন। এমন সময় আলীম এলো। আমি হাতের পত্রিকাটি পাশের টেবিলে রেখে দিলাম।

আলীম ক্লান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল : ওটা কি পড়ছিলে?

কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে তার ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারের ওপর মেলে দিল।

—ডাক্তার কৈ?

—আসবে। ঠিকানা দিয়ে এসেছি।

—তুমি একটু আরাম কর। আমি এখুনি আসছি। এক পেয়ালা চা-ও যে তোমার কপালে জোটে নি বেশ বুঝতে পারছি।

এই বলে আমি উঠে পড়লাম।

মিনিট পনের পর ফিরে এলাম। ট্রে-তে মাখন, রুটি, জেলি, আন্ডার পোচ আর গরম চা।

—যাও। হাতমুখে পানি দিয়ে এসো। তারপর একটু নাশতা করে নাও।

—আবার মুখ ধুতে হবে!

আলীম ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে পড়ল।

আলীম চুপ করে নাশতা করছে। আমি সামনে বসে আছি, অন্যমনস্কভাবে সেই পত্রিকাটিরই পাতা উল্টাচ্ছি। এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের মৃদু আওয়াজ শুনে দু’জনেই সেদিকে তাকালাম।

কামিল উঠে আসছে। দু’দিন সে দাড়ি কামায় নি। নিশ্চয় ঘুমুতেও পারে নি। চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। কামিজের বোতাম ছেঁড়া পায়ে জুতো নেই। এতো কামিল নয়, কামিলের প্রেতাত্মা।

আমার পাশেই একটি চেয়ারে কামিল বসে পড়ল।

—আলীম ভাই, তুমি এসেছ?

—হ্যাঁ। তুমি আছ কেমন?

—আছি কেমন? হাহ হাহ হাহ। ওকি উঠছ কেন?

—এবার আমাকে যেতে হবে।

—যেতে হবে? হাহ হাহ হাহ। তোমার রুটি যে পড়ে রইল।

তিশনা যে মনে দুঃখ পাবে। তাছাড়া আমাদের এমন বিপদ, আর তুমি চলে যাবে? তাও কি হয়!

এই বলে কামিল আলীমের হাত শক্ত করে ধরে সেইখানে বসিয়ে দিল। ইচ্ছা করলে আলীম হাত ছাড়িয়ে নিতে পারত; কিন্তু সে বলপ্রয়োগ করল না। সেই চেয়ারেই আবার স্থির হয়ে বসে পড়ল। আমার সঙ্গে একবার মাত্র দৃষ্টি বিনিময় করে আলীম পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো।

—আমাকেও একটা সিগারেট দাও।

আলীম একটি কথাও না বলে কামিলের দিকে একটা সিগারেট আর দিয়াশলাই বাড়িয়ে দিল। একটি দুটি তিনটি কাঠি জ্বালিয়েও কামিল সিগারেট ধরাতে পারল না। আলীম কামিলের সিগারেট ধরিয়ে দিতে উঠে এলো। কামিল ফস করে আলীমের মুখের সিগারেটটি টেনে নিয়ে বললো : আমাকে এইটেই দাও। তোমার মুখের গ্রাস আমার কিন্তু খুব মিঠে লাগে।

বসে বসে কামিল সিগারেট টানতে লাগল। এবং একবার আমাকে ও একবার আলীমকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। মুখে বিচিত্র হাসি।

—তিশনা, আমি এবার উঠি।

—উঠবে কি আলীম ভাই। বোসো। তোমার দুটি পায়ে পড়ি বোসো। বোসো না ভাই আলীম। আমি একটা কবিতা লিখেছি— শুনবে না?

কামিল এবারো আলীমকে যেতে দিল না। পকেটে হাত পুরে একটি কাগজ বের করল। —শোনো ভাই আলীম। এত কষ্ট করে লিখেছি। একটু শুনবে না?

কামিল পড়তে শুরু করল :

এই পৃথিবীর ছায়া আর রোদ
অবুঝ মনকে দিচ্ছে প্ৰবোধঃ
জীবনের সব খুচরো প্রশ্নে
ওরে হঠকারী অধীর হোসনে!
পিতৃহন্তা ভাগ্যের তূণ
জীবনে ছড়ায় নিদারুণ ঘুণ
প্রেম বটে এক ব্যঙ্গ অপার
লোক-হাসানোই সমারোহ তার।
নারীর শরীরে মায়াবী অগ্নি
জ্বলছে নিয়ত। জননী, ভগ্নী
যেই হোক তবু অশান্ত মন
ফণা মেলে ধরে যখন-তখন।

এখন কিছুতে নেই বিশ্বাস,
বিষাক্ত ঘরে টানি নিশ্বাস
চারিদিকে শুধু ভ্রান্তির ফাঁদ,
প্রেতের নৃত্যে হই উন্মাদ।

জননীর চোখে জটিল সড়ক
উঁকি দেয় শুধু। জীবন নরক।
প্রেমিকা দো-মনা স্থূল ক্রীড়নক
কবরে নড়েন ক্ষুব্ধ জনক!

কবিতা আবৃত্তি করতে করতেই কামিল সিঁড়ি দিয়ে নেবে চলে গেল। এদিকে আলীমের চোখে-মুখে বিপুল বিস্ময়।

—দেখ তিশনা, হয় কামিল সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে, নয়—। কিন্তু সে যাই হোক ও যেভাবে ঘূর্ণি হাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখন কার ওপর ঝড়ের মতো ভেঙে পড়ে কিছুই বলা যায় না। তুমি কিছুদিনের জন্য তোমার আব্বার কাছে চলে যাও না?

—কিন্তু আলীম, ওকে যে ভালো করে তুলতেই হবে। তুমি মনে করছ ওর পাগলামিটা একটা ভান। ওর ওপর এত বড় অবিচার করো না। সেদিন রাত্রে যদি ওকে দেখতে বুঝতে পারতে দু’তিন মিনিটে মানুষ এমনভাবে বদলে যেতে পারে যে তাকে চেনাই যায় না।

একটু চুপ থেকে আবার বললাম : তাছাড়া ওর সেয়ানা হবার প্রয়োজনটা কি? ওকে অদেয় তো আমার কিছুই ছিল না।

আলীমের সিলভার সিগারেট কেস বন্ধ হলো শুনতে পেলাম। সে একটি সিগারেট ধরিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো।

বললো : তোমার মনে যদি দুঃখ দিয়ে থাকি, মাপ চাইছি। কাল আবার আসব।

—তুমি চলে যাচ্ছ।

–হ্যাঁ।

—তুমি থাকলে কিন্তু ভালো হয়। ডাক্তার আসবে!

—আপাতত রুগী আমি নই। সুতরাং আমার অবর্তমানে কোনোই ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। তাছাড়া এমনকি আমাদেরও মাঝে মাঝে একা থাকার দরকার হয়।

আলীম চলে গেল।

ছোট চাচার ঘরের পর্দা একটু একটু নড়ছে, উঠছে আর পড়ছে। আমিও সেইভাবেই ইতস্তত করছি, ভিতরে যাব কি না। কতদিন যে ছোট চাচাকে ভালো করে দেখি নি। ‘খিল কে বন্ধ করল’?—ছোট চাচার এই প্রশ্নের উত্তরে ‘আমি’ এই একটিমাত্র কথা উচ্চারণ করে আমি যেভাবে দর্প ভরে চলে গেলাম, ছোট চাচার বুকে সে কথা যে কিভাবে বেজেছে সে কি আর আমি জানি না? এই একটি কথা দিয়ে ছোট চাচার নিজের আচরণের যে কঠোর সমালোচনা করলাম, তার অর্থই কি আর ছোট চাচা বোঝেন নি? তারপর ছোট চাচারই ঘরের সামনে বসে কামিল আর আলীমের সঙ্গে আমার এই কথাবার্তার বেপরোয়ার মধ্যে যে বিদ্রোহ ছিল তার তাৎপর্যই যে কি তাই কি ছোট চাচা জানেন না? তিনি সব জানেন তিনি সব বোঝেন কিন্তু মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু বলবেন না। এর গ্লানি তাঁর মনকে কালো করে দেবে তবু তিনি কিছুই বলবেন না।

বাতি জ্বলছে। ছোট চাচা চুপ করে বসে আছেন। জানালার ভিতর দিয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে চোখ মেলে দিয়েছেন।

আমি চুপ করে তাঁর পিছনে এসে দাঁড়ালাম।

–কে? ময়না? তুমি আবার এসেছ! আর এসো না। সেদিন রাত্রে কামিলকে আমি বিয়ের কথা বলেছিলাম। ভেবেছিলাম, যে অপরাধ তুমি কোনোদিন কর নি, তার লজ্জা থেকে বাঁচবার এই বুঝি উপায়। ভাবি নি, ঢের বেশি লজ্জা তোমার মাথায় চেপে বসবে। তবে একটা কথা জেনে যাও, ময়না। ঝোঁকের মাথায় বিয়ের কথা বললেও তা আমার মুহূর্তের ভুল নয়। তোমার সম্মতি থাকলে, আমাকে শুধু একবার ইশারা করতে হবে।

আমি আর দাঁড়ালাম না। তেমনি নিঃশব্দে বেরিয়ে চলে এলাম। ছোট চাচা জানতেও পারলেন না।

ডাক্তার কামিলকে দেখে গেল। বললো : শরীর ঠিকই আছে। তবে কোনো আকস্মিক “শক’ নিশ্চয়ই তার মানসিক ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। এখন তার ‘কমপ্লিট রেস্ট’ দরকার। চেঞ্জ অফ এনভাইরোনমেন্ট। বাট হি মাস্ট নট ব্রুড। এন্ড হি মাস্ট স্লিপ। তা না হলে, শরীর নয়, মন বিকল হয়ে যাবে। এই বলে কামিলকে মরফিয়া ইনজেকশন দিয়ে ডক্টর হেনরি প্যাটারসন বিদায় নিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *