৩২
তারপর অবশ্য আর ঘুমুবার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ভালো করে সূর্য না ওঠা পর্যন্ত বিছানায় পড়েই থাকতে হলো। আঁধার কেটে যেতেই আমিও পথে বেরিয়ে পড়লাম।
আমি যখন বেরিয়েছি তখনো পথে ভালো করে লোক চলাচল শুরু হয় নি। সকালবেলাকার ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শ মাতৃস্নেহের মতো চোখমুখ ভরে গ্রহণ করলাম। এইটের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।
আলীমদের বাড়ির সদর দরজা খোলা; দেখলাম, চৌকাঠের ওপর সেদিনের খবরের কাগজ পড়ে আছে। সেটি হাতে তুলে নিয়ে ভিতরে চলে এলাম। ফুপু নামাজে বসেছেন। ঘরদোর বেশ পরিচ্ছন্ন। কিছু কিছু নতুন আসবাবও এসেছে। সব মিলে একটা শ্রী খুলেছে।
আলীম খাটের ওপর শুয়ে শুয়েই বেশ কৌশলের সঙ্গে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছিল।
আমাকে দেখেই সে লাফিয়ে উঠে বসল। বিছানার ওপর খানিকটা চা-ও উছলে পড়ল।
—তুমি? এত সকালে? খবর সব ভালো তো?
—না। কাল তুমি এলে না?
গায়ে একটা পাঞ্জাবি চড়াতে চড়াতে আলীম বললো : না। কৈ আর যেত পারলাম। তুমি আসতে বলেছিলে বিকেলে। আমি বাড়িই ফিরলাম রাত এগারোটায়। কিন্তু কথা পরে হবে। আগে এক পেয়ালা চা খাও।
এই বলে আলীম বেরিয়ে গেল। দু’মিনিট পরই নিজের হাতে করে এক পেয়ালা গরম চা নিয়ে এলো।
—তারপর খবর কি বল?
এই বলে আলীম আমার পাশেই বসে পড়ল।
চায়ের পেয়ালা ঠোঁটের কাছে তুলে নিয়ে আমি বললাম : কি করে আর কোথা থেকে যে শুরু করব, তাই ভাবছি।
—ব্যাপারখানা কি?
এক এক করে কাল রাত্রের ঘটনা যা দেখেছি আর যা শুনেছি সব বললাম। কিছুই গোপন করলাম না।
আলীমের মুখে একটি কথাও নেই; স্থির হয়ে সে সমস্ত শুনল। তার মুখ দেখে বুঝবার উপায় নেই তার মন কি বলছে।
আমার কথা শেষ হলে সে আবার উঠে পড়ল।
—আগে আর এক পেয়ালা চা খাও।
বস্তুত আলীমও মনে মনে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। তাই আরো এক পেয়ালা চায়ের প্রস্তাব। চা নিয়ে অল্পক্ষণ পরই সে আবার ফিরে এলো।
—আজ আর আমি আপিস যাব না।
এই বলে পিছনে দুটি হাত রেখে সে পায়চারি শুরু করে দিল।
আমি বললাম : তোমার নতুন চাকরি। কামাই করা কি ভালো হবে?
—খুব নতুন নয়। কিন্তু আপিস গিয়ে কাজে ভুল করাও ঠিক হবে না। সে যা হোক হবে। কিন্তু তুমি কি ঠিক করলে বল?
—আমি কি ঠিক করতে পারি? একা মেয়েমানুষ!
–শেষ পর্যন্ত ছোট ফুপু…
–শেষ পর্যন্ত ছোট চাচা…
—আমার কি মনে হয় জানো? কোথায় যেন একটা ভুল হচ্ছে!
—ভুল তো হচ্ছেই।
—সে কথা নয়। ছোট ফুপু রাত্রিবেলা ছোট চাচার কামরা থেকে একা বেরিয়ে আসছেন, এমন কথা বিশ্বাস করতে হলে, তিশনা, তোমাকেই কি আর—
—বিশ্বাস করতে পারবে? কিন্তু আমি নিজে বিশ্বাসভাজন হবার জন্য আসি নি। তবে আমি নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারি না। তাছাড়া সকালবেলা মূর্ছিত ছোট চাচাকে ধরাধরি করে শোবার ঘরে নিয়ে আসা—এসবও কি ভুল?
—ছিঃ তিশনা!
—আমি ছোট ফুপুকে ধিক্কার দেবার জন্য কথাগুলো বলি নি। নীতি-কথার ঝাঁপি খুলে বসাও আপাতত আমার উদ্দেশ্য নয়। শুধু একটা সঙ্কটের কথা বলছিলাম।
—আমাকে ভুল বুঝ না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, হিসেব মিলছে না। কি জানো, ছোট ফুপুকে যতবার দেখেছি, শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে গেছে। তাই আমার এত খটকা লাগছে। তোমার কথা আমি অবিশ্বাস করছি না। এখন থেকে অবিশ্বাস করতে হবে গোটা মানব সম্প্রদায়কেই।
—তাও ভালো যে কেবল মানবী সম্প্রদায়কে নয়। ‘হ্যামলেটের’ যে মৌসুম শুরু হয়ে গেছে, তুমিও যে হাত-পা ছুঁড়ে বললে না Frailty! thy name is woman তাতেই আমি অবাক হচ্ছি।
আলীম চুপ করে বসে থাকল। আলীমের আম্মা আমাকে এত সকালে এখানে দেখে যে পরিমাণ বিস্মিত ততোধিক পুলকিত হয়ে উঠলেন। সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি আমাকে নাশতা করে যেতে বললেন।
—দুটো গরম দালপুরি ভেজে দি। তুইতো মা খুব ভালোবাসিস।
আমি আর আপত্তি করলাম না।
আলীম তখনো চিন্তার মধ্যে ডুবে ছিল।
এবার বললো : কামিলের ওপর রাগ করো না। তার মনের অবস্থা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। তার জন্যই আমার চিন্তা সবচাইতে বেশি। খোদা জানেন, কার কপালে কি আছে।
—আলীম, লঘুভাবে কথা বললাম বলেই মনে করো না, কোনোরকম গুরুতর চিন্তা আমার মনের মধ্যে নেই। না থাকলে তোমার কাছে এভাবে ছুটে আসতাম না। জানি, তোমার করবার কিছুই নেই। তবু অন্তত একজনকে সব কথা বলতে না পারলে আমিও পাগল হয়ে যাব। তোমার কাছে একটা অনুরোধ। আপিস থেকে ফিরেই তুমি রোজ আমাদের এখানে চলে এসো। অন্তত কিছুদিন এসো। তা না হলে, সত্যি আমি পাগল হয়ে যাব। আসবে তো?
বাড়ি ফিরে এসেই আমি গোসল করে নিলাম। তারপর দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। এবং তৎক্ষণাৎ ঘুম।
কতক্ষণ শুয়েছি জানি না। যখন উঠলাম তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে মনে হলো। জানালাটা খুলে দিতেই মুঠি মুঠি রোদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আকাশ একেবারে পরিষ্কার; রৌদ্র আদিগন্ত তার সোনালি আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে। দূরের মাঠটিতে দু’একটি গরু চরে বেড়াচ্ছে। একটা বটগাছের তলায় একটি মহিষ বসে আছে। তার দুটি শিং-এ দুটি কাক নিরুপদ্রব শান্তিতে বসে বিশ্রাম করছে। আরো দূরে ধোপা একটা পুকুরের ধারে দড়িতে ধোয়া কাপড়ের সারি নেড়ে দিয়েছে। সেই দূর থেকেই পাথরের ওপর ধোপার কাপড় আছাড় দেবার শব্দ ভেসে আসে। কাপড় আছাড় দেবার একটানা শব্দের সুর কেটে যায় ক্বচিৎ একটি মোটরের হর্নের শব্দে। দু’তিনজন ছোট ছোট ছেলে মাঠের ওপর ছুটোছুটি করে খেলা করে। তাদের কোমরে একটি করে নেংটি ছাড়া গায়ে আর কিছুই নেই। ঐটি ধোপাদেরই বস্তি। পাশেই একটি মরা কুকুর পড়ে আছে। আর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে ডজন খানেক শকুন। শকুনের দল ছেলেদের খেলায় উৎপাত করে না। ছেলেরাও শকুনদের কাজে কোনো উপদ্রব সৃষ্টি করে না।
সামনের বাড়িতে বিকেলের ছায়া দোতলার জানালা পর্যন্ত উঠে এসেছে। বেলা যে পড়ে এলো বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু জানালার কাছ থেকে সরতে একটুও মন চাইছিল না। দূরের দৃশ্য কেবল বসে বসে দেখতে ইচ্ছে করে। এত ভালো লাগে যে বলতে পারি না। ধোপার হাতের কাপড় একবার শূন্যে উঠছে, আবার সবেগে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি, আর অচৈতন্যের মতো ঘুমিয়েছি। এখন শরীর মন হালকা ঠেকছে, আর মনে হচ্ছে, আত্মীয় বিয়োগের পর অনেকক্ষণ কেঁদে আমি যেন ক্লান্ত আর নিঃস্ব হয়ে গেছি। তবু যে শূন্য মনে এইভাবে বসে থাকতে কেন যে এত ভালো লাগছে তা কে জানে। ছায়া যে কখন আরো উপরে উঠে এলো, কখন যে গোটা বাড়িটাকেই মুড়ে দিল জানতেও পারি নি। পথেঘাটে লোক চলাচল আবার শুরু হয়েছে, কয়েক ঘণ্টা বিরামের পর যান চলাচলের মুখরতাও পথঘাট সচকিত করে তুলছে। কিন্তু আমাদের বাড়িটা তখনো মূর্ছিতের মতো নির্জীব হয়ে পড়ে আছে।
উঠে গিয়ে আলোটা জ্বেলে দেব, সে কথা পর্যন্ত একবার মনে হয় নি।
আমার ঘরটি সায়ংকালের খোপের মধ্যে অদৃশ্য প্রায়। হঠাৎ ঘাড়ের ওপর ঠাণ্ডা শ্বাসের স্পর্শ লাভ করে চমকে উঠলাম
আমি জানালার তাকে বসে আছি। কামিল তার দু’হাত দিয়ে সেই জানালারই দুই শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটি একেবারে আমার ঘাড়ের কাছে শেষ রাত্রের চাঁদের মতো হেলে পড়েছে। চাঁদের মতোই সে মুখ স্থির অচঞ্চল। চোখ দুটিতে অতল সমুদ্রের শান্তি। চোখে একটি পলক নেই। তার সেই দুটি চোখের দৃষ্টিতে যে কি আশ্চর্য মমতা, স্নেহ আর ভালোবাসা মুদ্রিত হয়েছিল কিছুতেই তা বোঝাতে পারব না।
সে যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে, কেনই-বা এসেছে, কিছুই জানি না। দু’হাত দিয়ে এভাবে আমার পথ রোধ করে আছে, আমার ভয় পাবার কথা। ত্রিসীমানায় কেউ আছে বলেও মনে হয় না। কিন্তু বিস্ময়ের কি শেষ আছে—আমি এতটুকুও ভয় পাই নি। আমাকে নড়তে দেখে কামিলের ওষ্ঠও সামান্য নড়ে উঠল। সে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো : তিশনা, তোমার ঐ আলীমটা এসেছিল। আমি তাকে দরজা থেকেই বিদায় করে দিয়েছি। বলেছি, তুমি তাকে চলে যেতে বলেছ। বেশ করেছি—তাই না?
এইবার কামিল সেইভাবে আবার হাহ হাহ হাহ করে হেসে উঠল
—ঠিক করেছি—তাই না?
আবার সেই বীভৎস অট্টহাসি।
আশেপাশে কেউ নেই। আমি একেবারে একা। এবং এতক্ষণ যা চোখে পড়ে নি, এইবার তাই চোখে পড়ল। কামিল ভিতর থেকে দরজার খিল বন্ধ করে দিয়েছে। আমার রক্ত এবার হিম হয়ে গেল।
কামিল জানালার কাছ থেকে সরে এসেছিল। আমি সাবধানে একটু একটু করে দরজা দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম।
কামিল খপ করে আমার হাত ধরে ফেলল।
—যাচ্ছ কোথায়? দাঁড়াও। আমি তোমাকে যেতে দেব না। ওকি, তোমার চোখ দুটি ওভাবে ঠিকরে পড়ছে কেন? আমি কি এতই ভয়ানক যে Make thy two eyes, like stars, start from their spheres? আবার চললে কোথায়? বলছি দাঁড়াও!
এই বলে কামিল আবার স্থির হয়ে গেল। তার চোখে আবার চন্দ্রকিরণের মতো সেই কোমল দৃষ্টি ফিরে এলো। পরম স্নেহে সে আমার চিবুক স্পর্শ করে বললো : তিশনা, ভয় পেও না, লক্ষ্মীটি। আমি কি তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারি? তুমি শুধু আমাকে দেখে ভয় পেও না, চলে যেও না!
কিন্তু আবার সেই উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি ফিরে আসতেও দেরি হলো না।
কামিল বললো : তোমার কাছে কেন এসেছিলাম জানো? একটি কবিতা লিখেছি। তোমাকে শোনাবো।
তারপর পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে সে পড়তে শুরু করল :
আমার জীবন যেন ধোঁয়ায় প্যাচানো কানাগলি,
যেখানে দেয় না উঁকি সূর্য, যেখানে স্বপ্নের কলি
কখনো মেলে না চোখ ভয়ে। ভাবি তুমি সূর্যোদয়
সহজেই পারো হতে দ্বিধাহীন সেখানে বোধ হয়।
অথচ তোমার আলো অন্য কোন মুখে দেয় তাপ,
রঙের উল্লাস আনে, আমি শুনি আত্মার বিলাপ।
সব কিছু মুছে গেলে তবু কলকাতার কলরবে—
ক’দিনের কিছু শান্ত বেলা চিরদিন মনে রবে।।
তাইতো আমি ওপরে উঠে এলাম। বাইরে চাকরদের ঘরে মেঝের ওপর লুটোচ্ছিলাম। কত যে কেঁদেছি। কিন্তু আর তো কাঁদব না।
এই বলে কামিল দু’হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সেই বন্ধনে আর কিছুই ছিল না, ছিল শুধু অসহায় বালকের আত্মসমর্পণ।
তারপর ডুকরে কেঁদে উঠল কামিল।
—জানো নিশনা, তোমার ছোট চাচা এইভাবে ওঃ ওঃ ওঃ ওঃ।
আমি দু’হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরলাম।
ঠিক তক্ষুণি দরজার ওপর বারবার ধাক্কা পড়তে লাগল। আমি বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। উঠে গিয়ে খিল খুলে দরজা বাইরের দিকে ঠেলে দিলাম।
ছোট চাচা দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর চোখে শঙ্কিত দৃষ্টি।
বললেন : খিল বন্ধ করল কে?
জবাব দিলাম : আমি।
এবং আর একটি কথাও না বলে সেখান থেকে চলে গেলাম।
ছোট চাচা কোনোদিনই বোধ করি এত বিস্মিত হন নি।