প্রসন্ন পাষাণ – ৩০

৩০

বৃষ্টি আর বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বিছানা, মেঝে, আসবাব সব ভিজে গেল। তবু আমি চুপ করে বসেই আছি। আমার চোখমুখ, শাড়ি-ব্লাউজ, সব ভিজে গেল, তবু আমার হুঁশ নেই। কেবল একটানা ঝমঝমঝম শব্দ শুনতে পাই, আর কিছুই চোখে পড়তে চায় না। পথঘাট জনশূন্য। ল্যাম্পপোস্ট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে, পাঠশালার ছেলে যেভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খায়। কুকুরটি সামনের বাড়ির রাস্তার দিকে বারান্দার ওপর উঠে লেজ গুটিয়ে বসে আছে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা যেন হঠাৎ গেছে স্থগিত হয়ে। সমস্ত সংসারটাই হাত গুটিয়ে আছে বসে। এ যেন বহির্বিশ্বের কোনো এক শত্রুর অতর্কিত আক্রমণ—কবে তার তাণ্ড বলীলা শেষ হবে কে জানে।

কিন্তু এ এমন এক আক্রমণ যা ভালো লাগে। সবকিছু হাতের কাজ ফেলে রেখে চুপটি করে বসে থেকে এই ঝমঝমঝম শব্দ শুনতে ইচ্ছে করে। মনে হয় সংসারের কাজের মতো অমন অকাজ আর কিছুই নেই। কেবল চলা আর চলা আর ছুটে বেড়ানো। এই ব্যস্ততার মধ্যে বৃষ্টির স্বপ্নাবেশ চুপ করে বসে থাকার একটা দ্বীপ সৃষ্টি করে। বেগে ছোটে হাওয়া, জোরে তালগাছের মাথা দোলে, ফটাফট শব্দে দরজা-জানালা আছাড় খায়, আঙিনায় একটা ছোটখাটো প্লাবন আসে, কনিজ হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে মাথায় ছাতা নিয়ে এদিকওদিক ছুটোছুটি করে।

আমিই কেবল চুপটি করে থাকি বসে।

এমন সময় দেখি একটা ফিটন গাড়ি এসে দরজার কাছে থামল। অবিশ্রান্ত বর্ষণের কুয়াশা ভেদ করে সহিসের কালো ছাতাটা একটা ছোট তাঁবুর মতো চোখে পড়ে। সহিসের খাকি জামাটার খানিকটা পিঠ শুধু দেখা যায়। ঘোড়াটি স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া লোকোমোটিভের মতোই একরকম আওয়াজ করতে থাকে, যার মধ্যে তার সমস্ত অসন্তোষ প্রকাশ পায়। এবং সবকিছুর ওপর বৃষ্টি তার লম্বা লম্বা সরু সরু পা মেলে দিয়ে নেবে আসে।

কে এলো তাতে আমার কি প্রয়োজন? আমি তেমনি চুপ করে বসেই থাকলাম। সকালবেলা; ক্রমে ক্রমে বেলা বাড়বে, আলো ফুটবে; কিন্তু তাতো নয়, আজ যতই বেলা বাড়তে লাগল, চারদিকে আঁধারও ততই ঘনিয়ে আসে। দমকা ঝোড়ো হাওয়া দু’হাত দিয়ে আমাকে জানালার কাছ থেকে ফেলে দিতে চায়। একটুখানি যদি বৃষ্টির বেগ কমে আসে তো তারপরই আরো জোরে ঝেপে আসে।

কতক্ষণ যে সেইভাবে কাটল জানি না।

একতলা থেকে এক প্রকার অস্পষ্ট গোলমাল কানে এলো। অনেকে মিলে কি যেন বলাবলি করছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার আওয়াজও শুনতে পাই। একরকম অস্থিরতা আর চঞ্চলতা।

আমি দরজা খুলে চৌকাঠের ওপর এসে দাঁড়ালাম।

জাফর, কনিজ আর ছোট ফুপু মিলে ছোট চাচাকে ধরাধরি করে ওপরে নিয়ে আসছেন। জাফর ছোট চাচার মাথা আর দুটি হাত ধরে আছে, ছোট ফুপু দুটি পা, এবং কনিজ এক হাত দিয়ে ছোট ফুপুকে এবং অন্য হাত দিয়ে জাফরকে সাহায্য করছে। আমি একেবারে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েই থাকলাম। ছোট চাচার হয়েছে কি? আমার দৃষ্টিতে ছোট ফুপু এই প্রশ্নটি পড়লেন কিন্তু কোনো জবাব দিলেন না। দৃষ্টি নাবিয়ে নিলেন।

ছোট চাচার ধবধবে পাঞ্জাবি-পাজামা স্থানে স্থানে কাদামাখা, যেন কাদা দিয়ে কে খাবলে দিয়েছে। পাঞ্জাবি হাতের কাছে ছিঁড়ে গেছে। কপালের কাছে গেছে কেটে, সেখানেই রক্তের একটা ধারা পুরু হয়ে আছে। তাঁর চোখ দুটি বন্ধ। একটি পায়ে কালো পামশু ঝুলছে, মনে হয় এখুনি পড়ে যাবে। অন্য পা-টি খালি।

এত সকালে ছোট চাচা গিয়েছিলেন কোথায়। তারপর এক অসহচিন্তা বাজের মতো আমার মাথার ওপর ভেঙে পড়ল। ছোট চাচা কি সারারাত বাইরে ছিলেন? কিছুদিন থেকে ছোট চাচার সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে কম। কতদিন এমন হয়েছে আমি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি, তারপর বহুরাতে ছোট চাচা ঘরে ফিরছেন। আমার সঙ্গে দেখাই হয় নি। কিন্তু সারারাত বাইরে এমন কখনো হয় নি।

ছোট ফুপু তাড়াতাড়ি দু’হাত দিয়ে ছোট চাচার বিছানা পরিষ্কার করে দিলেন। পরিষ্কার করবার দরকারই ছিল না। কারণ রাত্রে সে বিছানায় কেউ শোয় নি। তারপর সবাই মিলে ছোট চাচাকে বিছানায় শুইয়ে দিল।

ছোট ফুপু মাথার ওপর ঘোমটা টেনে দিলেন। এখন তাঁকে দেখে মনে হয়, তাঁর চোখমুখ কে যেন পাথর দিয়ে গড়ে দিয়েছে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। তারপর সেখানেই বসে পড়লেন।

আমি অবাক হয়ে তাঁকে দেখতেই থাকলাম। আমি বেরিয়ে যাব কি না ভাবছি এমন সময় ছোট ফুপু ইশারা করে কাছে ডাকলেন।

—মা, একটা ন্যাকড়া, চায়ের পেয়ালায় পরিষ্কার পানি, আর আয়োডিনের শিশিটা নিয়ে এসতো। একটু জলদি।

আমি বেরিয়ে গেলাম। ফিরে এসে দেখি, ছোট ফুপুর দুটি কাতর চোখ স্থির হয়ে আছে ছোট চাচার মুখের ওপর।

ন্যাকড়া ভিজিয়ে, আয়োডিন মাখিয়ে তিনি ধীরে ধীরে ছোট চাচার ফাটা কপালের রক্ত দিলেন মুছে।

আঁচলের ভিতর থেকে মৃণালের মতো তাঁর দুটি হাত বেরিয়ে এসে ছোট চাচার কপালের ওপর স্থির হলো। ও দুটি হাত যে এত আশ্চর্য সুন্দর কোনোদিন তা মনে হয় নি।

কিছুটা সময় আমি পালংয়ের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর তেমনি নীরবে সেখান থেকে সরে এসে দরজার কাছে ফিরে এলাম। এক পলক আমাকে দেখে ছোট ফুপু যেন মানা করতে চাইলেন—কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বাধা দিলেন না।

দরজার কাছ থেকেই বললাম : জ্ঞান হলে আমাকে খবর দিও।

ছোট ফুপু মুখে কিছুই বললেন না। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।

বাইরে এসে আমি দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু একটু পরই ফিরে এসে আবার দরজা খুলে দিলাম। কেবল পর্দা ভালো করে টেনে দিলাম।

কামিল বাড়ি নেই। সে কোন সকালে বেরিয়ে গেছে। ক’দিন থেকে রোজই এমন যায়। সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এরপর? অজ্ঞান কি কেবল ছোট চাচাই হয়েছেন, ছোট ফুপুই কি সজ্ঞানে আছেন।

বিচিত্র এই সংসারের লীলাখেলা। চিরটাকাল অপেক্ষা করলেও যে বাধা যে ব্যবধান কোনোদিন ঘুচত না, আজ সকালের এক দুর্ঘটনায় তা নিমেষেই নিশ্চিহ্ন হলো। অগ্র-পশ্চাৎ‍ ভেবে দেখবার পরিণাম চিন্তা করবার অবসরটুকু পর্যন্ত যখন পাওয়া যায় না, হয়তো তখনই মানুষ তার স্বভাবের ডাকে পুরাপুরি সাড়া দেয়।

কিন্তু পরিণামের কথা মানুষ ভুলে গেলেও, পরিণাম মানুষকে ভোলে না। সেও তার অদৃশ্য আর অনিবার্য পদক্ষেপে মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। তখন ছোট ফুপু কি করবেন?

এই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম, দেখলাম কনিজ আর জাফর রান্নাঘরে ফিসফিস করে আলাপ করছে। আমাকে দেখেই কনিজের দুটি চোখে কৌতূহল নেচে উঠল। জাফরই কি একটা তির্যক হাসি গোপন করল না?

একদিন এই ফিসফিস আলাপ মুখর হবে। তির্যক হাসিটুকু কেউ আর গোপন করতেও চেষ্টা করবে না। সেদিন ছোট ফুপু কি করবেন?

আর কামিলকেও তো এখন একটু একটু করে চিনতে শিখেছি। সেই-বা কি করবে? আর কিছু যদি বলেই তাকেই-বা দোষ দেব কেমন করে?

আর সবকিছুর ক্ষমা আছে। কিন্তু একতলা থেকে দোতলায় উঠবার বাইশটা সিঁড়ি পেরিয়ে আসবেন—ছোট ফুপুর এই অপরাধের কোনো ক্ষমাই নেই। ছোট ফুপুই কি নিজেকে ক্ষমা করবেন? কি বলে তিনি তার আচরণের কৈফিয়ত দেবেন—নিজের কাছেই? আর ছোট চাচা? তাঁকে তো আমি চিনি। আমি কি আর জানি না, কেন তিনি দিনের পর দিন আমাকে না দেখলেও আর কাছে ডাকেন না। সকালবেলা আমার হাতের তৈরি চা না হলে তাঁর কোনোদিনই চলত না—এখন তাও কেন দিব্যি চলে যায় সেও কি আমি জানি না? আমার কোনো কোনো আচরণ অনুমোদন না করলেও কোন অপরাধের লজ্জা তাঁর গলা টিপে ধরে তাও আমি জানি। সত্যিই যেটাকে অন্যায় মনে করবেন শেষ পর্যন্ত সেই অন্যায়বোধ ছোট চাচাকে একেবারে নিঃস্ব করে ফুরিয়ে দেবে, সকলের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরিয়ে এক দুঃসহ একাকিত্বের গহব্বরের মধ্যে তাঁকে ঠেলে দেবে, এসবই আমি জানি। তাই ভাবছিলাম—এরপর?

ন্যায়-অন্যায়-দোষগুণ এসব বিচার না হয় নাই করলাম, কিন্তু মুহূর্তের ভুল তো আর মুহূর্তেই ফুরিয়ে যাবে না। সারা জীবন ধরে তার জের টানতে হবে।

বৃষ্টি গেছে থেমে। কিন্তু আকাশ সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয় নি। কালো মেঘের দু’একটি খোলা জানালা দিয়ে সূর্যের হলুদ কিরণ ধরণীর দিকে তার শাণিত দৃষ্টি মেলে ধরেছে। পিচের রাস্তা একটা লম্বা স্লেটের মতো পড়ে আছে, তারই ওপর দিয়ে বিভিন্ন গাড়ি-ঘোড়া পথের দুই বিপরীত দিক দিয়েই ছুটে এসে তাদের পদচিহ্ন এঁকে দেয়—যুগপৎ জোয়ার ও ভাটার মতো পথস্রোতকে স্ফীত করে তোলে।

পথে তো বেরিয়ে পড়লাম, কিন্তু যাব কোথায় কিছুই ঠিক করি নি। বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। ছোট চাচার জন্য আপাতত চিন্তা ছিল না, জানি তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমার করবারই-বা কি আছে? ছোট ফুপুর চাইতে ভালো সেবা কি আর আমি করতে পারব?

ছোট চাচার জীবনের কক্ষপথ থেকে আমি ছিটকে দূরে সরে আছি; সেইখানে আগেকার সেই আসনটি কি আর কোনোদিন ফিরে পাব? ছোট ফুপুর পাশে যে স্থানটুকুর ওপর লোভ ছিল তাও কায়েম হতে পারল না। চারদিকে তাকিয়ে দেখি, কোথাও বসবার ঠাঁই নেই। হঠাৎ এভাবে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম। যে কটি অবলম্বন নিয়ে জীবনটা গড়ে উঠছিল, আজ দেখি তার সবকটিই সরে গেছে।

ফ্লুরিতে এসে এক পট হট চকোলেটের ফরমায়েশ দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। বেয়ারা গোটা কয়েক পেস্ট্রিও দিয়ে গেল। একেবারে শার্সির কাছে বসে পথের লোক আর যান চলাচল দেখতে লাগলাম, এবং অন্যমনস্কভাবে নখ দিয়ে পেস্ট্রি ভেঙে খেলা করতে লাগলাম! সম্মুখের দৈত্যের মতো বিরাট অট্টালিকার কোনো একটি ফ্ল্যাটে পিয়ানো বাজছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক সুসজ্জিত মেম সাহেব বারবার চঞ্চল দৃষ্টিতে পথের দিকে তাকিয়ে দেখছে, বোধ করি কারো অপেক্ষায়। মিডিলটন রোর লরেটোর মেয়েরা ফুটপাত দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তাদেরই পিছনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্রও চোখে পড়ে। মোটর হর্ন বাজিয়ে মনটিকে চকিত করে দিয়ে ছুটে পালায়। সবাই ব্যস্ত, কারো এতটুকু অবসর নেই।

কেবল আমার অবসরই অশেষ।

আমার জীবননাট্যের এক একটি দৃশ্য শেষ হয়, আবার পর্দা ওঠে। কিন্তু আজ পর্যন্ত স্থান ও পাত্র মোটামুটি একই গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। আজ এইভাবে বসে থেকে মনে হতে লাগল, এবারকার পরিবর্তনটা কিছু ব্যাপকই হবে। কেবল কালেরই পরিবর্তন নয়। এবার মঞ্চ আর পাত্র, এমনকি নাট্যেরও বুঝি পরিবর্তন আসন্ন।

একটি পনের-ষোলো বছরের তরুণী দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল; কাচের দরজাটা কয়েকবার সামনে-পিছনে নড়তে নড়তে স্থির হয়ে গেল। এক পাউন্ড চকোলেট কিনে তরুণী তেমনি দ্রুত বেরিয়ে চলে গেল।

একটা অদৃশ্য আর নিঃশব্দ হাসি আমার মনের মধ্যে ফুলের কুচিকুচি পাপড়ির মতো ছড়িয়ে পড়ল। চকোলেট দেখলেই শৈশবের কথা মনে পড়ে। এবং অনিবার্যভাবে আলীমের কথা। ছায়া কি কায়ার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারে?

ফুপুজান কি হয়রানটাই-না হতেন। এবং আলীমটাও ছিল এমন নাছোড়বান্দা।

আজকের আলীমকে দেখে কি সেই কিশোরটিকে কল্পনা করতে পারবে? আজকের আলীম এক শীর্ণ চঞ্চল নদীর শেষে এক স্তব্ধ সমুদ্র।

আরো মনে পড়ল সেই দিনকার কথা—সেই মুরগি কাটার দৃশ্য। আলীমের সেই হাহ হাহ হাহ হাসি। সেই হাসি বুঝি শেষ হতে চায় না। আশ্চর্য লাগে ভাবতে, এক একটি ঘটনা কিভাবে মানুষের মনের চিরস্মরণীয়াগারে আবর্জনার মতো জমে থাকে। এবং অনেক সময় সারাটা জীবনই সেই তাৎপর্যহীন ঘটনাটিকেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এবং চোখে সেই ঘটনাটিরই চশমা পরে সেই লোকটিকে দেখতে থাকি।

আরও অনেক কথাই এখানে বসে মনে পড়তে থাকে। এইমাত্র একটি এরোপ্লেন উড়ে চলে গেল। ছেলেবেলায় কতবার ভেবেছি, আহা, আমার চোখের সামনেই যদি একটি এরোপ্লেন কোনো বাড়ির দেয়ালে ধাক্কা লেগে টুকরো টুকরো হয়ে যেত, কি মজাটাই-না হতো। আমি বসে বসে দেখতে পারতাম মানুষগুলো কিভাবে ছটফট করে। এমন কথাও মনে হয়েছে, মোড়ের বাড়িটা আগুন লেগে পুড়ে যাক, আমি দূর থেকে বসে তাই দেখি। ছেলেবেলায় এরোপ্লেনে আগুন লাগার দৃশ্য কল্পনা করে আমি কতবার মনে মনে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠেছি। এমনকি এখনো—কিন্তু থাক সে কথা, আমার সম্পর্কে তোমাদের ধারণা যতটা খারাপ হয়েছে তার চাইতে আরো পতিত হতে চাই না।

একটা কথা মনে করে আজ বড় লজ্জা পাই। রোজ স্কুলে যেতে ভালো লাগত না। একদিন আমার এক প্রিয় সহপাঠী স্কুলে এলো না। শুনলাম তার বাবা মারা গেছেন। এ মৃত্যুতে আমরা কেউ শোক পাই নি। দুঃখ পাই নি, অথচ শোকের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াব, ছেলেবেলায় এইটেরও কোনো প্রয়োজন ছিল না। বরং আমার মনে হয়েছিল, ফুপুজান যদি মারা যান তো বেশ হয়। আমাকেও একদিন তাহলে স্কুলে যেতে হবে না।

এ ধরনের কত চিন্তাই যে আসত মাথায়। খোদা আমাকে মাপ করুন।

মানুষ যদি অন্য মানুষের মনের সব কথা জানতে পারে, তাহলে সমাজ-সংসার কিছুই কি টিকবে? স্বামী যদি জানতে পারে স্ত্রীর মনের সব কথা, এবং স্ত্রী স্বামীর—আত্মীয়স্বজন, বন্ধু- বান্ধব পরস্পরের কথা? ভেবে দেখেছ, মুখের স্মিত হাসিটুকু, আচরণের সুদৃশ্য সৌজন্যটুকু, তাহলে থাকত কোথায়?

এখানে যে এইভাবে বসে সাতপাঁচ ভাবছি, তারও এক নেশা আছে। কিছুতেই আর উঠতে ইচ্ছে করছিল না। আর এখান থেকে উঠে যাবই-বা কোথায়? সেই বাড়িতো! আপাতত বাড়ি ফিরতেই ইচ্ছে করছে না।

একটা ফিটন এসে ফ্লুরিরই দরজায় থামল। দেখলাম, ফিটনের দুটি সিটেই সওদা বোঝাই। সেই গোলগাল ফর্সা ভদ্রমহিলা—এবার আর চিনতে ভুল হলো না—গাড়ি থেকে নাবলেন। আর সেই ছেলেটি, যাকে চন্দ্রিমা ডিগনিফাইড বলেছিল।

আমি এবার তাড়াতাড়ি বিল চুকিয়ে উঠে পড়লাম। কিন্তু দেখলাম, একেবারে সামনেই তাঁরা। এবার আমিই প্রথম হাত তুলে সালাম করলাম। পাশ কাটিয়ে চলে যাব—খপ করে ভদ্রমহিলা আমার হাত ধরে ফেললেন। সে স্পর্শ অবশ্য কোমল, কোথাও জবরদস্তি নেই।

—মা, একটু বসবে না! এটি আমার ছেলে, আলমগীর। কুষ্টিয়ার এস ডি ও হয়ে বদলি হয়েছে। আর এই মেয়েটিই তিশনা ইয়াসমিন।

সালাম বিনিময় হলো।

আমি বললাম : মাপ করবেন। আমাকে এখুনি যেতে হবে। বাড়িতে দু’চারজন বন্ধু আসবে।

এই বলেই ভদ্রভাবে আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম।

ভদ্রমহিলা বললেন : তাহলে মা তোমাকে আর ধরে রাখব না। তবে তোমার ঠিকানা আছে আমার কাছে। একদিন এসে হাজির হব, এই বলে রাখলাম।

পথে নেবে পড়লাম। ‘এই মেয়েটিই তিশনা।’ কবে থেকে এমন বিশ্ববিখ্যাত হয়ে পড়লাম, যে পরিচয়ের জন্য নাম ছাড়া আর কিছু বলবার প্রয়োজন হয় না? তাছাড়া ঐ যে বললেন : ঠিকানা আছে সঙ্গে। একদিন এসে উপস্থিত হব! ভদ্রমহিলার এই কথাটি এমন শোনালো যেন আমার নামের ওয়ারেন্ট আছে তাঁর কাছে। তারই জোরে আসবেন আমাকে গ্রেফতার করতে!

আলীমকে এখন আর বাড়ি পাব না। এবং তার আপিসটা যে কোথায় তা পর্যন্ত জানি না। তবু আলীমদের বাড়ি যেতে হবে। মরিয়ম চাচিকে বলে আসি, আলীম আপিস থেকে এসেই যেন আমাদের এখানে চলে আসে।

ছেলেটি কিন্তু বাস্তবিকই ডিগনিফাইড। সবচাইতে আকর্ষণ করে তার কণ্ঠস্বর। একটি মাত্র শব্দ : আদাব। কিন্তু এমন মন্দ্র যে কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করে; তার কণ্ঠস্বরেই যেন নিহিত আছে তার ব্যক্তিত্বের মূল সূত্র। তার পদক্ষেপ আর নেত্রপাতের মতোই তা অচঞ্চল গম্ভীর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *