২৯
পরদিন খুব ভোরে আমি বাগানে একা বসে আছি। দেখলাম, এরই মধ্যে তৈরি হয়ে নিয়ে কামিল কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছে। একবার ইচ্ছা হলো ডাকি; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি মনে করে আর ডাকলাম না। গেট অবধি পৌঁছে কামিল তার দুটি হাত পকেটে পুরে কি যেন খুঁজতে লাগল। বোধ করি দরকারি কোনো জিনিস সঙ্গে নিতে ভুলে গেছে। গেট থেকে ফিরে সে যেমনি আবার ভিতরের দিকে ফিরে আসবে অমনি আমার ওপর তার চোখ পড়ল। একবার বুঝি ইতস্তত করল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার দিকেই এগিয়ে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। পাশে জায়গা ছিল কিন্তু বসল না।
—কাল রাত্রে কোথায় গিয়েছিলে?
—রাত্রে তো বাড়িতেই ছিলাম। সন্ধ্যাবেলা সিনেমা গিয়েছিলাম।
—অবশ্য আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তোমাদের সভ্য সমাজে সন্ধ্যার মেয়াদ একটু বেশি। আমরা কিন্তু ওকেই রাত বলি। তা শুনতে পাই, কে কে গিয়েছিলে?
–কেউ না। শুধু আমি আর আলীম।
—একা আলীমের সাথে সিনেমা দেখলে?
—ঠিক একা বলতে পারি না। কারণ হাউস-ফুল ছিল।
কামিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
—তুমি অত অবাক হচ্ছ কেন? একা তো তোমার সঙ্গেও বহুবার বাইরে গেছি।
–সে কি একই কথা?
—নয় কেন? আলীম আমার ছেলেবেলার সঙ্গী। তাছাড়া তোমার কাছে আমার সব কাজের
জবাবদিহি করতে হবে না কি?
–শুধু কি ছেলেবেলার সঙ্গী? প্রথম নাগরও। তাই না?
আমি এবার উঠে পড়লাম।
কামিল চিৎকার করে উঠল।
—যেও না। দাঁড়াও।
—তোমার সঙ্গে আমি ইতরের মতো কথা-কাটাকাটি করতে পারব না। সভ্য সমাজে কিভাবে কথা বলতে হয় আগে তাই শিখে এসো।
কামিল আমার আরো কাছে এগিয়ে এলো।
বললো : সেদিন তো খুব বললে, দারিদ্র্যকে ডরাও না। এখন কি মতটা পাল্টে গেছে?
—একটা কথা তোমার জানা উচিত। দারিদ্র্য অনেক রকমেরই হয়।
একটা কাঠবিড়ালি গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। সেই দিকে
তাকিয়ে কামিল এবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
আমি বললাম : আর কিছু বলবে?
—তিশনা, আমার এ ভুল আর কখনো হবে না। আমি তোমার গতিবিধির স্বাধীনতার ওপর আর কোনোদিনই হস্তক্ষেপ করব না। কিন্তু তুমি আমাকে ত্যাগ করো না। তুমি কি ভুলে গেলে, আমাকে তোমার হৃদয়ের চাবি দিয়েছিলে?
—সেই চাবি দিয়ে তুমি আমাকে গারদে পুরে রাখতে চাইবে কে জানত?
কামিলের চোখে আবার সেই হিংস্র দৃষ্টি ফিরে এলো, যে দৃষ্টি দেখেছিলাম হ্যারিসন রোডের চা-খানায়। বক্রকণ্ঠে সে আবৃত্তি করে গেল : Love is not love, which alters when it alteration finds…
—তুমি কি সখের থিয়েটারের নায়ক হয়েছ না কি?
—কি বললে? সখের থিয়েটার?
বলেই কামিল সজোরে আমার হাত চেপে ধরল।
সেই স্পর্শে আমার প্রতিটি স্নায়ু বিদ্রোহী হয়ে উঠল। কামিলও বোধ করি তা বুঝল।
—ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও বলছি।
আমার দু’চোখ তখন পানিতে ভরে গেছে।
কামিল আস্তে হাত ছেড়ে দিল। তারপর ঝড়ের মতো সেখান থেকে চলে গেল।
তোমরা অবাক হচ্ছ।
অবাক আমরা নিজেই কিছু কম হই নি।
আমি কামিলের একটি ছবি মনে মনে খাড়া করেছিলাম। কামিলও তারই ছায়াতে তারই আদলে গড়ে উঠতে চাইছিল। তবু তার সান্নিধ্যে কোথায় যেন একটা বাধা পাচ্ছিলাম। মন যেন পুরাপুরি সাড়া দিতে পারছিল না। সাড়া দিয়েও দেখেছি, তবু কামিলের আচরণে ঠিক সুরটি বাজে না। এ যেন সেতারের ছেঁড়া তারে সুর তুলবার চেষ্টা; কিংবা একতারা বাজিয়ে বীণার ঝঙ্কারের জন্য কান পেতে থাকা।
তবে কি কামিল আমার জীবন থেকে এখন বিদায় নেবে? কে বিদায় নেবে আর কে ফিরে আসবে এখনো আমি জানি না। তবে একটা কথা এখন বুঝতে পারছি।
এখন আমি বড় হয়েছি। নিজের মনকে বুঝতে হবে। এখন যা দান করব তা নিঃশেষেই দান করব। যা গ্রহণ করব কোনোদিন আর তা ফিরিয়ে দেব না। মনের ভাবনাচিন্তা স্বপ্নবিলাস প্রভৃতি নিয়ে আর পুতুল খেলা চলবে না। ভালোবাসলে ভালোই বাসব, প্রেম প্রেম খেলার বয়স আর নেই।
একজন পুরুষকে নিয়ে খেলার কথা বলছি না। একটি পুরুষকে পুতুল মনে করে আর প্রেমকে একটা খেলা মনে করে সময় কাটাবার দিন চলে গেছে। আমি বুঝতে পারছি, কোনো পুরুষকেই পুতুল মনে করা ঠিক নয়। হঠাৎ সেই পুতুলের মধ্যে কখন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় কেউ বলতে পারে না। কখন সেই খেলনার মতো প্রেম হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায় তাও কেউ বলতে পারে না। হঠাৎ বয়সটা কখন কৈশোরের সীমানা পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে তার হিসাবটাও ঠিকমতো রাখা যায় না।
তোমরা ভাবছ, সেই যে খালি পায়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো, লেকের ধারে বসে থাকা— সেসব কি মিথ্যা? না মিথ্যা নয়। মানুষের জীবনে আর আচরণে এমন বহু স্ববিরোধিতা থেকে যায়, তার কোনো ব্যাখ্যাই নেই। তাছাড়া পথে পথে ঘুরে বেড়াবার কথা বলছ? ঘুরতে ঘুরতে যদি দেখতেই পাই, সামনে এক কানাগলি, তখন কি করব?
তোমরা বলবে, এও একটা কথা হলো! বিয়ের পরও যদি দেখতে পাও সামনে একটা কানাগলি। তখন কি করবে?- -তোমার মনটা কি চিরকাল দ্বিচারিণী হয়ে থাকবে?
সামনে কানাগলিই যদি দেখব, তাহলে বিয়ে করব কেন? এবার আমাকে জেনে নিতে হবে, জীবনের কাছে আমি কি পেতে পারি। জীবনকে দেবারই-বা কিছু আছে না কি। কার সঙ্গে যাত্রা শুরু করলে বিষম ছন্দপতনের আশঙ্কা নেই। তার পরও যদি হিসাবে ভুল করি? সে আমার নসিব। কিন্তু এই শান্তিটুকু থাকবে, পরিণত মন যতটা দেখতে পায় তার শেষ অবধি দেখে নিয়েছিলাম। তার পরও যদি অসুখী হই তো বুঝতে হবে সুখ আমার কপালে নেই। বোধ করি কোনো মানুষের কপালেই নেই।
আমি ছাতে বসে এইসব নানা চিন্তার মধ্যে ডুবেছিলাম। বিকেলবেলা। কনিজ আমাকে এক গেলাস কাগজি লেবুর সরবত এনে দিল।
তারপরই দেখলাম কামিল আলীমের হাত ধরে সেইখানেই উপস্থিত। ওদের দু’জনকে বহুদিন একসাথে দেখি নি। বিশেষ করে এই হাত ধরাধরিটা নতুন ঠেকল।
কামিল বললো : আলীম ভাইকে একরকম জোর করেই নিয়ে এলাম। কিছুতেই আসতে চায় না। আমি কিছু বললাম না। ওরা দু’জনেই মাদুরের এক পাশে বসে পড়ল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। যেন সব কথাই বেসুরো ঠেকবে।
আলীমই প্রথমে কথা বললো, তার কণ্ঠ দ্বিধার সঙ্কোচে ম্লান খণ্ড-বিখণ্ড।
—আমি আসতে চাই নি। কামিল জোর করে ধরে নিয়ে এলো।
তারপর আবার সব চুপচাপ।
হঠাৎ কামিল এক সময় গা ঝাড়া দিয়ে বসল। মুখে এক গাল হাসি এনে বললো : জানো তিশনা, তোমার কথাই থাকল। নতুন বাড়িতে এখন আর যাব না।
আমি বিস্মিত হয়ে একবার কামিলের দিকে তাকালাম। আলীমও একবার তার দুটি চোখ তুলেই আমাকে দেখল। তারপর আমরা তিনজনেই চোখ নাবিয়ে নিলাম। বসে বসে হাতের এক আঙুলে আঁচলের একটা প্রান্ত জড়াতে লাগলাম।
আবার কামিলেরই কণ্ঠ শোনা গেল।
সে বললো : তিশনা, এই রুমালটা কিনে আনলাম। এতে আমার নামটা লিখে দিও।
একটি কথাও না বলে এবার আমি উঠে পড়লাম। রুমালটি সেখানেই পড়ে থাকল।
বিকেলের রোদ একটু একটু করে মিলিয়ে গেল। খাটের ওপর বসে থেকে লক্ষ করতে লাগলাম সন্ধ্যার মন্থর পদক্ষেপ। ধীরে ধীরে কামরাটি অন্ধকার হয়ে গেল। উঠে আলোটা পর্যন্ত জ্বালাবার কথা মনে হলো না। এইভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল।
হঠাৎ অন্ধকারেই আমার ঘরের ভিতর সাদা পাঞ্জাবি-পাজামার অস্পষ্ট রেখা চোখে পড়ল। এ যে আলীম তা বুঝতে পারলাম।
–তিশনা, কামিলের এই রুমালটি রেখে দাও। আমাকে দেখে ওভাবে লজ্জা পাবে ভাবি নি।
আলীম খাটের ওপর রুমালটি রেখে দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।
আমি তখনো ঠিক তেমনি করেই খাটের ওপর চুপ করে বসে থাকলাম। নিজের এই দুটি হাত দিয়েই যেন নিজের হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেলেছি। নড়বার আর শক্তি নেই।