প্রসন্ন পাষাণ – ২৮

২৮

ট্রাম চলেছে ধর্মতলা দিয়ে। আমি বসে বসে চন্দ্রিমার কথাই ভাবছিলাম। সে যেন একটা সুরের তরঙ্গের মতো এসে হারিয়ে গেল। মেয়েটির মধ্যে কোথাও অস্পষ্টতা নেই; সে যা তাই। অন্য কোনোরকমভাবে নিজের পরিচয় দিতে কোনোদিনই চেষ্টা করে নি। যখন অন্যায় করেছে, ন্যায়ের যুক্তি দিয়ে তা সমর্থন করে নি। এই তার স্বভাব। সে একবার বলেছিল : আমি ভাই সবসময় হিসাব মিলিয়ে চলতে পারি নি। আমি আমিই—টেক ইট অর লিভ ইট।

—পাশে একটুখানি বসতে পারি!

—আরে, আলীম যে। বোসো বোসো। এতদিন ছিলে কোথায়?

আলীম এতটা সাদর অভ্যর্থনা আশা করে নি। তাই সে একটু আশ্চর্য হয়ে গেল। অবাক আমিও কিছু কম হই নি। আলীমের জন্য এই সহৃদয় অভ্যর্থনা যে আমার মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে—বা ছিল—সে কি আর জানতাম।

আলীমকে বহুদিন দেখি নি। কবে সে আমার পথ থেকে নিঃশব্দে সরে দাঁড়িয়েছে বুঝতেও পারি নি। কিছুদিন থেকে প্রায়ই তার কথা মনে পড়ছিল। সে ভালোই হোক আর মন্দই হোক, আমার ছেলেবেলার সাথি। তার বহু স্মৃতিই আমার জীবনের নানান অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িত। আমার জীবনে কোথায় তার একটা স্থান আছে, যেখানে অন্য কারো আসন থাকতে পারে না।

তাছাড়া আরো একটা কারণ ছিল। সেদিন তার প্রতি যে অবিচার করেছি তার কোনো ক্ষমা নেই। জানালার ফুটোয় দুটি চোখ দেখেই সর্বপ্রথম তারই নাম মনে এলো, অথচ দেখা গেল সে ত্রিসীমানায় নেই, আমার এই অন্ধ অবিশ্বাস সেদিন থেকেই আমাকে নিরন্তর বিদ্ধ করছিল।

–তোমাকে যে আর চেনা যায় না ভাই। কত মোটাসোটা ভারিক্কি হয়ে গেছ। দিব্যি একটা জেন্টলম্যান।

—কাস্টমসে একটা চাকরি জুটে গেছে। এখন দশটা-পাঁচটার বন্দিশালায় আটক পড়েছি।

—তোমার বন্দিদশা যাবজ্জীবন হোক; কিন্তু এত বড় খবরটা তুমি একেবারে চেপেই গিয়েছিলে!

—তোমার কাছেও যে এটা একটা খবর তা ভাববার দুঃসাহস হয় নি।

তারপর কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথাই বলতে পারলাম না।

এক সময় আলীমই বললো : তুমিও তো বদলেছ কম না।

—কে আমি?

এই বলে আমি নিজেকে একবার আপাদমস্তক দেখে নেবার ভান করলাম। তারপর কি জানি কেন? হঠাৎ ভারি লজ্জা পেলাম।

এই লজ্জাটুকু ঢাকবার জন্যই বললাম : আলীম, তুমি চাকরি পেলে। খাওয়াবে না?

—যখন বল!

—এক্ষুণি নয় কেন?

—তথাস্তু!

ট্রাম থেকে নেবে পড়লাম। আলীম হাতের ইশারায় একটা ট্যাক্সি দাঁড় করালো।

ট্যাক্সিতে পাশাপাশি বসে আছি। একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। অমন হুট করে খাওয়ানোর প্রস্তাবটা না করলেই পারতাম; কিন্তু এখন টু লেট। কি হবে ওকথা ভেবে। অস্বস্তিকর নীরবতাকে দু’হাত দিয়ে সরিয়ে দেবার জন্য প্রশ্ন করলাম : তুমি কামিলের উপন্যাস পড়েছ?

আলীম সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। একটু ইতস্তত করল। তারপর বললো : হ্যাঁ পড়েছি।

—কেমন লাগল?

এমন সময় একটা ল্যাম্পপোস্টের আলো আলীমের মুখের ওপর এসে পড়ল। আলীম বললো : ভালোই।

আমি হেসে ফেললাম।

—হাসলে যে!

—নাঃ আলীম, তুমি সত্যিই বদলে গেছ।

—কি রকম?

—সব কথা শুনতে হয় না। এবার ড্রাইভারকে বল কোথায় যেতে হবে।

—তুমি বল।

—আমজাদিয়া। কিন্তু আমি কি ভাবছিলাম জানো? আজ চলো একটা ছবি দেখে আসি। মেট্রোতে গ্যারি কুপারের একটি ছবি চলছে।

—চলো। আমার আপত্তি নেই।

আলীম টিকিট কাটবার পর বললো : তুমি লাউঞ্জে একটু অপেক্ষা কর। আমি তোমাদের বাড়িতে একটা টেলিফোন করে আসি। তাঁরা চিন্তা করবেন।

আমি হেসে জবাব দিলাম : কেবল জেন্টলম্যান নয়, রীতিমতো একটা রেস্পন্সিবিলম্যান হয়ে উঠেছ।

আলীম একটু হেসে টেলিফোন করতে চলে গেল।

আমরা যখন হলে এসে বসলাম তখন ইন্টারভ্যাল হয়ে গেছে। চারদিকে কেবল কাঁধ থেকে মাথার সারি দেখা যায়। স্বামী-স্ত্রী, প্রণয়ী-প্রণয়িনী, বালক-বালিকা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কেউ বাদ নেই। মৃদু আলোর স্বপ্নাবেশে অস্পষ্ট গুঞ্জন শোনা যায় মাত্ৰ।

ট্রে-তে করে বেয়ারা পটেটো চিপস আর চকলেট নিয়ে এলো।

আলীম দুটি নেসেলস-চকোলেটের স্ল্যাব কিনে একটি আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম; হাতটি একবার কেঁপে উঠল। সেই লাল মোড়কের চকোলেট!

হঠাৎ লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। নাকের ওপর রুমালটি তুলে নিলাম।

বাতিগুলো একে একে নিভে গেল। এখুনি ছবি শুরু হবে।

এক সময় আস্তে বললাম : একটা কথা জিগ্যেস করব, আলীম, কিছু মনে করবে না তো? —মনে করব! কি যে বল।

প্রায় কানের কাছে মুখ এনেই কথা বলতে হচ্ছিল। তা না হলে দর্শকদের প্রতিবাদ শুনতে হবে।

—তোমার মুখ থেকে একটা গন্ধ বের হচ্ছে। সেটা কি মদের নয়?

—এ বয়সে তোমাকে মিথ্যা বলব না। তোমার অনুমানই ঠিক।

—কবে ধরলে?

—কাস্টমসে ঢুকবার পর থেকেই এক মাড়োয়ারি মাসে মাসে হুইস্কি দিয়ে যায়।

–কি ঘুষ?

আলীম হেসে ফেলল।

—ছিঃ, ও নামে ডাকতে নেই। ভালোবাসার উপহার বলতে পার।

—অভ্যাসটা ছেড়ে দেওয়া কি খুব কঠিন?

—তুমি বললে কঠিন নয়।

—আচ্ছা আমি বলছি।

—তথাস্তু!

—তথাস্তু বলবার মুদ্রাদোষ তোমার এখনো যায় নি?

আলীম আবার হেসে ফেলল।

অনেকক্ষণ পর আবার আলীমের গলা শোনা গেল। তার আওয়াজ আশ্চর্য গম্ভীর আর্দ্র।

—তিশনা, এই যে তুমি মানা করলে—এত বড় সম্মান জীবনে আর কোনোদিন পাই নি। কেউ কোনোদিন আমাকে ভালো হতে বলে নি। জীবনে ভালো হবার কোনো তাগিদও তাই কখনো বোধ করি নি। তাই নিষেধ করে তুমি যে উপহার দিলে তা আমার মনে থাকবে। আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে আজ আমার জন্মদিন।

—তাই না কি। তাহলে তো তোমাকেই আমার খাওয়ানো উচিত। তাছাড়া নিষেধের কথা বলছ? আমরা ছেলেবেলা থেকে এক সঙ্গে বড় হলাম। অথচ তোমার ভালো-মন্দ সম্পর্কে উদাসীন থাকব, আমাকে এতই হৃদয়হীন মনে কর?

ছবি শেষ হলে আলীমকে কিছুতেই ছেড়ে দিলাম না। আসন ছেড়ে উঠছি, আলীম বললো : ভ্যনিটি ব্যাগটা যে ফেলেই চললে?

ব্যাগটা তুলে নিলাম।

—আরো কিছু ফেলে যাচ্ছি না কি?

আলীম জবাব দিল : আর যা ফেলে যাচ্ছি তা চোখে দেখা যায় না।

আমি মুখটা ফিরিয়ে নিলাম। আলাপটা কেমন করে যেন এক বিপজ্জনক এলাকায় ঘোরাফেরা করতে শুরু করে দিল। সেটা আমার অভিপ্রায় ছিল না।

রাস্তায় এসে আমি বললাম : চলো দেখি, তোমার জন্য একটা উপহার কেনা যায় কিনা।

—দোহাই তোমার। আর কোনো উপহার দিতে চেও না।

—তাহলে বাড়ি চলো। দেখা যাক তোমার পট-লাক কেমন।

—না গেলেই নয়?

—না গেলেই নয় হবে কেন; কিন্তু এলেই-বা ক্ষতি কি।

আলীম আর কিছু বললো না।

বাড়িতে পৌঁছেই দেখি কামিল তার মা-র ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। আমাদের দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আমাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বেরিয়ে চলে গেল।

আমিও দৃঢ়পদে উপরে উঠে এলাম।

—আলীম এসো। আমরা বহুদিন এক সঙ্গে বসে খাই নি।

বেশ রাত হয়ে গেছে। ছোট চাচা এখনো বাড়ি ফেরেন নি। কনিজকে বলেছিলাম, আমারই ঘরে দস্তরখান বিছিয়ে খাবার দিতে। কি রান্না হয়েছে কিছুই জানি না। বস্তুত কোনোদিনই রান্নাঘরের খবর রাখতাম না। যখন যা জুটত বিনা প্রতিবাদে খেয়ে উঠে পড়তাম। আহারে অবশ্য আমার অরুচি নেই, তবে তার জন্য কাঠখড় পোড়াতে রাজি ছিলাম না। কনিজের হেফাজতে দক্ষিণ হাতের কাজটি মোটের ওপর ভালোই চলত।

আজকের আয়োজন অন্যদিনের তুলনায় আরো ভালো। সব কটি পদ দস্তরখানে সাজিয়ে দেবার পর কনিজ পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। এক গাল হেসে বললো : তোমাকে তো বাবু আজকাল দেখতেই পাই না। আস না কেন?

আলীম অল্প একটু হাসল, কোনো জবাব দিল না।

—বাবু, শুনলাম চাকরি হয়েছে। তা তনখা কত? আচ্ছা আচ্ছা নাই শুনলাম। আল্লাহ্ তোমাদের আরো বড় করুক। ছেলেবেলা থেকে দেখছি; কিন্তু আমরাও তো কতদিনের পুরানো লোক। একটু বকশিশও দেবে না।

আলীম আবার হেসে ফেলল। পকেট থেকে পাঁচটা টাকা বের করে কনিজের প্রসারিত হাতে গুঁজে দিল।

—আর বাবু, জাফরের জন্যও একটা চাকরি দেখ। তার কাছেই তো শুনলাম তোমার বড় চাকরি হয়েছে।

—আচ্ছা সে দেখা যাবে।

এবার কনিজ বেরিয়ে গেল।

আমি বললাম : কার মুখ দেখে আজ সকালে উঠেছিলে? সন্ধ্যা থেকে কেবল লোকসানের পাল্লায় পড়েছ।

আলীম কিন্তু কোনো জবাবই দিল না। একবার চোখ পর্যন্ত তুলল না। জানি না কেন সে আমার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। এইভাবেই নীরবে আমাদের আহার চলল।

অনেকক্ষণ পর আলীম বললো : আজ সকালে বায়রনের বায়োগ্রাফি পড়ছিলাম। ভালো কথা, বায়রনের কবিতা তুমি পছন্দ কর?

—বায়রনের একটি মাত্র জিনিস আমি পছন্দ করি আর সেটা হচ্ছে লেমনেড।

আলীম হেসে ফেলল।

আমি আবার বললাম : কিন্তু তাই বলে তার বায়োগ্রাফি সম্পর্কে আমার কৌতূহল নেই তা মনে কর না। বললে না, পড়ছিলে সকালে?

—এমন কিছু নয়।

—তবু শুনিই না।

—বায়রন তাঁর এক জন্মদিনে একটা ছোট্ট কবিতা লিখেছিলেন। সেটা ভালো লাগল।

—আমরাও একটু শুনি।

আলীম আবৃত্তি করে গেল :

Through life’s road so dim and dirty,
I have dragged to three and thirty.
What have these years left to me? Nothing except thirty three.
আমি স্থির চোখে আলীমের দিকে তাকিয়েছিলাম। এমন সময় কনিজ এসে খোঁজ করল : আর কিছু লাগবে না কি? আমি কনিজকে এক জগ পানি এনে দিতে বললাম।

আর আলীমকে বললাম : তুমি তো এখনো three and thirty-তে পৌঁছাও নি।

—তা অবশ্য পৌঁছাই নি।

—তাহলে এখুনি দুশ্চিন্তা কেন? তোমার আঁধার গলিতে লণ্ঠন হাতে কেউ তো এগিয়ে আসতেও পারে।

—পারে। কিন্তু তাতে কি যথেষ্ট আলো থাকবে!

আমি উঠে পড়লাম। খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

গোসলখানায় এসে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে সেখান থেকেই বললাম : আমি উঠে পড়লাম।

কিছু মনে করো না। তোমার সঙ্গে তো আর ভদ্রতার সম্পর্ক নয়। বরং চিরটাকাল অভদ্রতাই করে এসেছি।

আলীমও ততক্ষণে উঠে এসেছে। বললো : আর যাই হোক। পট-লাক আমার ভালোই।

আলীম চলে গেছে। একটু পরই কামিল আমার ঘরে উপস্থিত হলো। তার চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি।

—বেশি সময় নেব না তোমার। আলীম যে কবিতাটি তোমাকে শুনিয়ে গেল—তার অনুবাদ করেছি। শুনবে?

আমার অনুমতির অপেক্ষা না করেই কামিল পড়ে গেল :

পেরিয়ে মলিন জীবনের গলি
পৌঁছে গেলাম তিন ও তিরিশে।
কি দিল আমায় এতগুলো দিন?
কিছু নয়। শুধু তিরিশ ও তিন।

কবিতাটি শুনিয়েই কামিল আবার সিঁড়ির আঁধারে মিলিয়ে গেল।

আমি অনেকক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *