প্রসন্ন পাষাণ – ২৭

২৭

সেদিন ওয়াসেল মোল্লা থেকে কিছু সপিং সেরে নিউ সিনেমার সামনে ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছি। এমন সময় দেখি পাশের গ্রামোফোনের দোকান থেকে চন্দ্রিমা বেরিয়ে আসছে। তার হাতে অনেকগুলো গ্রামোফোন রেকর্ড।

সাবধানে রাস্তাটা পেরিয়ে এসে চন্দ্রিমা আমার পাশে দাঁড়ালো।

আমি বললাম : তোর সাথে আজকাল যা একটু দেখা-সাক্ষাৎ হয় তা পথে-ঘাটেই।

চন্দ্রিমা জবাব দিল : ঘরকে করেছি বাহির বন্ধু-

—তোর মুখ দিয়ে যে কাব্যের ফোয়ারা ছুটছে। ব্যাপারখানা কি, মিস চোনড্রিমা!

—কলেজের যে কটি দিন জীবনে কাব্য আছে, থাকতে দে। কলেজের এই দিন কটি পেরিয়ে এলে, কাব্যও জীবন থেকে উধাও হবে। আর তো কোথাও কাব্য নেই, এক বইয়ের পাতা ছাড়া!

—তোর তত্ত্বকথা তো শুনলাম। কিন্তু এত সওদা নিয়ে কি হবে, এবার তাও একটু শুনি।

আমার সাম্প্রতিক ইতিহাস পরে শোনাবো। এখন একটু তাড়া আছে। কফি হাউসে আমার সঙ্গকাতর এক রসপিপাসু বসে আছে। জিরো-আওয়াজের পরও আধ ঘণ্টা উতরে গেছে। আরো দেরি হলে হয়তো কফির পেয়ালার মধ্যেই ঝাঁপ দেবে। ভালো কথা, তুইও চল না!

–না ভাই। আর একদিন।

—তবে শোন। কাল বিকেল পাঁচটায় মিউজিয়মের গেটের কাছাকাছি কোথাও তোর জন্য আমি অপেক্ষা করব। সময়মতো আসবি কিন্তু

এই বলে চন্দ্রিমা চলে গেল।

অপেক্ষা অবশ্য আমাকেই করতে হলো। পাঁচটা বেজে গেল, সাড়ে পাঁচটা বাজতে চলল, তবু চন্দ্রিমার দেখা নেই। আমি বাড়ি ফিরে যাব কি না যখন ভাবছি, এমন সময় দুই হাত ভরা জিনিসপত্তরসহ চন্দ্রিমা উপস্থিত।

আমার ভয়ানক রাগ হয়েছিল। বললাম : এই তোর পাঁচটা?

—আমাকে কি পাঁচটা-বাজার বাঁদী পেয়েছিস, যে তারই পায়ে পায়ে চলতে হবে!

—তুই বাঁদী হবি কেন! এদিকে আমার দুটি পায়ে বেড়ি পরিয়ে যে পথের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখলি, তার বেলা?

—যার খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই, সেই কেবল বসে বসে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে চলাফেরা করে। আমাকে দশ রকমের কাজ করতে হয়।

—এক-আধটার নমুনা আমরা শুনতে পাই না?

—পাই। কিন্তু আপাতত একটু মেহনত করে ফিটন পর্যন্ত উঠে আসুন।

—আপনার ফিটন শরিফ কোথায় যাবেন?

—এক নিরুদ্দেশ যাত্রা। এবার চল।

আমরা গঙ্গার ধারে এসে বসলাম। চপলতা দিয়ে আজকের আলাপ শুরু করলেও, চন্দ্ৰিমা এখানে এসে স্থির গম্ভীর হয়ে পড়ল। দু’জনে পাশাপাশি বসে আছি, মনে মনে এক নীরব কথোপকথন চলছে—নিবিড় অন্তরঙ্গদের মধ্যেই যেটা সম্ভব। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেবে আসে। গঙ্গার বুকে বড় বড় জাহাজগুলোর আলো একটি একটি করে জ্বলে উঠছে। একেবারে নদীর তীরে আমরা যেখানে বসে আছি, তারই নিচে, ছোট ছোট ডিঙি বাঁধা আছে। তীরে ভেঙে পড়া ঢেউয়ে সেগুলো মোচার খোলের মতো আছাড় খাচ্ছে। আজ রাত্রে এরা বোধ করি আর কোথাও যাবে না। এই ডিঙিগুলোকে কেমন যেন মনে হয় নীড় আঁকড়ে থাকা পাখির মতো। পাটাতনে উনুন ধরানো হয়েছে। ভাত ফোটে টগবগ করে। ছইয়ের নিচে লণ্ঠনর আলো কুমারীর বুকের মতো ঢিপঢিপ করতে থাকে। মাঝিদের শ্রান্ত কণ্ঠের আলাপও শোনা যায়।

চন্দ্রিমা আর আমি বসে আছি। আমাদের পিছনে অন্ধকারের দেয়াল।

হাওয়া এসে চুল উড়িয়ে আঁচল খসিয়ে চলে যায়। ভেজা ঘাসের স্পর্শটুকু বড় অন্তরঙ্গ মনে হয়।

চন্দ্রিমা হাতে একটি ছোট্ট পাথর তুলে তাই নিয়ে খেলা করছিল। হঠাৎ সেটি জোরে নদীর বুকে ছুঁড়ে মারল। টুপ করে একবার আওয়াজও হলো। কেমন যেন মনে হয় চোখ দিয়ে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

—আসছে মাসে আমার বিয়ে।

—আর তুই এতক্ষণ চুপ করে আছিস! আমাকে এতদিন কিছুই বলিস নি। তাই যখনই দেখি, তোর দুটি হাত যতসব নতুন জিনিসের দোকান!

চন্দ্রিমা আঙুল দিয়ে অন্যমনস্কভাবে ঘাস ছিঁড়তে লাগল। আমার উৎসাহে যোগ দিল না।

—ব্যাপারখানা কি, চন্দ্রিমা? বিয়েতে তোর মত নেই?

—মত তো দিয়েছি।

—তবে? ছেলেটি কে? সেই যার কথা একদিন বলেছিলি?

–না।

—না?

এবার আমিও চুপ হয়ে গেলাম। সামনেই একটি জাহাজের ডেকে সাদা প্যান্টপরা নাবিকেরা চলাফেরা করছে, অনেকের আবার খালি গা। কেউ কেউ রেলিং-এ ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। সেই দিকে চোখ রেখেই এক সময় জিগ্যেস করলাম : তাহলে যে বড় মত দিলি?

—তোদের অমিত রায়ই-বা কেন মত দিয়েছিল, বল?

—আমাদের অমিত রায়? সে আবার কে?

–পড়িস নি তুই শেষের কবিতা!

—ওঃ সে কথা!

অমিত কেন এক ভেজা কম্বল কাঁধে চড়িয়ে নিল? লাবণ্য তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে- কিন্তু কেটির ঘাটে ভিড়িয়ে দিল কেমন করে? লাবণ্যই-বা শোভনলালের ঘর বাঁধল কেন?

—লাবণ্যর ভয় ছিল প্রত্যহের ম্লানস্পর্শে অমিত বুঝতে পারবে মর্তের মৃত্তিকা দিয়েই সে লাবণ্যর অমৃত মুরতি গড়ে তুলছিল। সেই অমৃত মুরতি ভেঙে যাক, লাবণ্য তা চায় নি।

—কিন্তু অমিত কেটিকে বিয়ে করে দেখিয়ে দিল, প্রত্যহের ম্লান স্পর্শকে সে ভয় করে না।

—তাই কি? কেটিকে নিয়ে তো সে কোনো বড় স্বপ্ন গড়ে নি। তাই স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কাও তার ছিল না। কিন্তু লাবণ্যর কথা আলাদা।

—আলাদা? তুই ঠিক বলছিস? কেটিকে ‘ঘড়ায় তোলা জল’ আর লাবণ্যকে ‘দিঘির’ সঙ্গে তুলনা করে অমিত যে রূপক সৃষ্টি করল—তার মধ্যে কি একটা বড় ফাঁকি নেই, সততার অভাব? লাবণ্যকে পেল না, তাই অমিত সেকেন্ড-বেস্ট কেটিকে গ্রহণ করল, এটা আমার কাছে আশ্চর্য ঠেকে। কারণ অমিতর স্বভাবে এই হিসেবটুকু তো ছিল না! আমি ভেবেছিলাম, হয় সে সব নেবে, নয় কিছুই নেবে না। তাই শেষে যখন দেখলাম ‘দিঘি’ পেল না বলে ‘ঘড়ায়-তোলা জল’ নিয়েই সে সুখী তখন সেটা আমার কাছে তার চরিত্রের এক বিষম ছন্দপতন বলেই মনে হলো। অধঃপতনও বলতে পারিস।

—তা হতে পারে। আমি ভালো করে কিছুই ভাবি নি। কিন্তু এই সাহিত্য আলোচনার উদ্দেশ্য কি?

—তুই একটা প্রশ্ন করেছিলি। তারই জবাব দিতে চেষ্টা করলাম।

—বিয়েতে মত দিলি কেন—সেই কথা?

—হ্যাঁ। কাব্যলোকেই যে ঘটনা ঘটল না, আমরা যারা সত্যিই মর্তের মৃত্তিকা, তারা কতক্ষণ আর সেই বুনো হাঁসের পিছনে ছুটে বেড়াব—কবি যাকে ‘দিঘি’ বলেছেন।

—এ কি। তুই কাঁদছিস!

চন্দ্রিমা আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে তার মুখ ঢাকল।

—চন্দ্রিমা, বলবি নে ভাই, তার সঙ্গে তোর বিয়ে হলো না কেন?

—না, বলব না।

এই বলে চন্দ্রিমা উঠে পড়ল।

তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে বললো : চললাম। আর বুঝি তোর সাথে দেখাই হবে না।

–সে কি, কেন?

—আমার মন বলছে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার কথা মনে করিস।

আমি আস্তে তার হাতে একটু চাপ দিলাম।

চন্দ্রিমা বললো : ওঠ ফিটনে। তোকে এসপ্ল্যানেডে ট্রামের কাছে নাবিয়ে দেব।

ফিটন দাঁড়িয়েছিল। আমরা উঠে পড়লাম।

–তোকে বিয়েতে ডাকলাম না কেন জানতে চাইলি নে?

আমি বললাম : আমাকে এতই বেহায়া ঠাওরেছিস!

–না রে। তোকে আমি কি ঠাওরেছি তুই ভালোই জানিস। সে কথা নয়। তোকে যখন অমিত রায়ের কথা বললাম তুই প্রথমে বুঝতেই পারলি নে কার কথা বলছি। অথচ তুইও শেষের কবিতা পড়েছিস এবং আমার মনে হয় সাহিত্য হিসাবে আমার চাইতে ভালো বুঝেছিস। কিন্তু অমিত রায় আমাদের সংসারে উপন্যাসের একটি চরিত্র মাত্র নয়। আমাদের ঘরেরই একটি লোক। প্রতি কথায় প্রতি কাজে সে নানাভাবে আমাদের সংসারে প্রবেশ করে। আমাদের সাহিত্যের পাত্রপাত্রীরা আমাদের সকলের মুখের জবানে, আমাদের বেশবাসে, আচার ব্যবহারে, পালায় পার্বণে মিশে আছে। তোরা তাদের দেখিস, কাচের বাইরে থেকে; অনেকটা সিনেমার পর্দায় চলচ্চিত্রের মতো।

সে কথা ঠিক। তা তুই কি প্রস্তাব করতে চাস শুনি? তোকে আমিও একটি সত্য কথা বলব। তুই প্রশ্ন করেছিলি, লাবণ্য এমন করল কেন, অমিত অমন করল কেন। তার একটা উত্তরও আমি দিয়েছি। কিন্তু তোদের উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা কোন কাজটি কেন করে আমি সবসময় বুঝি না। যেমন বুঝি না, রমা কেন রমেশকে বিয়ে করল না!

—এক বিধবার সাদা থানের পবিত্রতা লেখক নষ্ট করতে চান নি।

—রমেশকে দেখে মনেই যদি রঙ ধরল, সাজের শুভ্রতা বজায় রাখাটা সেখানে ভণ্ডামি নয় কি? আমাদের বিধবা ঐ অবস্থায় বিয়ে করত। সে ভিতরটিকে সাদা রাখতে পারলেই বাহিরটিকেও সাদা রাখত।

—তিশনা, তোর সাথে তর্ক করবার জন্য প্রসঙ্গটা তুলি নি। তোর মনে একটা প্রশ্ন উঠে থাকতে পারে যেটা মুখে আনা তুই বেহায়াপনা মনে করেছিস। তারই উত্তর দিতে চেষ্টা করছিলাম। তুই আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধু, চিরকাল তাই থাকবি, তাই তোকে এই অপ্রিয় কথাটি বলতে বাধল না।

—থাক সে কথা। তুই সুখী হ— এই আমার সর্বান্তকরণের শুভেচ্ছা।

—তা জানি।

এসপ্ল্যানেড এসে পড়ল। আমি সেখানেই নেবে পড়লাম।

হঠাৎ মনে পড়ল, চন্দ্রিমার সাথে আমার দেখা হয়েছে কলেজে, সিনেমায়, পথে-ঘাটে, দোকানে, ট্রামে-বাসে,—ঐ যে চন্দ্রিমা বললো, অনেকটা চলচ্চিত্রের মতো।

তারপর চন্দ্রিমার সাথে আর কোনোদিনই দেখা হয় নি। সে কোথায় আছে—কেমন আছে—আছে কি না—কিছুই জানি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *