প্রসন্ন পাষাণ – ২৬

২৬

আমার ঘরের এই জানালা দিয়ে কত কিছুই দেখা যায়। সবচাইতে বেশি দেখি সম্মুখের বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে তারই ভিতরকার বিশ্বটিকে। সেই নতুন-মা, যে এখন আর নতুন নয়, কোলের সেই শিশুটি এখন যে আর কোলে নয়, যে হাঁটতে শিখেছে, মুখে যার বুলি ফুটেছে—তাদেরকেই দেখি। ঐ ছোট্ট সংসারটি বিচিত্র। একদিন শিশুটির কি এক শক্ত অসুখ হলো, তার মায়ের কান্না শুনতে পেলাম। ডাক্তার এলো। ক’দিন খুবই সঙ্কটের মধ্যে তাদের দিন কাটল। মা টেম্পারেচর নেয়, বোতলের দাগ মেপে ওষুধ খাওয়ায়, বাপ চিন্তিত মুখে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আত্মীয়স্বজন আসে, প্রবোধ দেয়, তারপর একদিন শিশু সেরে ওঠে। স্বামী-স্ত্রী সেজেগুজে ম্যাটিনি শোতে সিনেমা দেখতে যায়।

স্বামীকে বেশি দেখা যায় না। সকাল থেকে বেরিয়ে যায়, কখন ফেরে জানিও না। তবে আর একটি ছেলেকে প্রায়ই সেখানে দেখি। মেয়েটির কেমন যেন আত্মীয় হয়। সাদা প্যান্ট- শার্ট পরে থাকে, কাঁধে ঝুলতে থাকে একটি স্টেথিসকোপ। ক্যাম্বেল হাসপাতালে না কি ডাক্তারি পড়ে। হাসিখুশি থাকে সারাক্ষণ। মেয়েটির নিঃসঙ্গ দ্বিপ্রহরগুলোকে এই ছেলেটি প্রায়ই দেখি গল্প-গুজবে মাতিয়ে রাখে।

একদিনের একটি ঘটনার কোনো মানে বুঝি নি।

দুপুরবেলা ছেলেটি এসেছে। মেয়েটিও বোধ করি এইমাত্র স্নান সেরে উঠল। তার ভেজা চুল পিঠের ওপর খোলা। একটি চিরুনি নিয়ে সে ধীরে ধীরে জট ছাড়াচ্ছে। বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়েছে।

হঠাৎ দেখি ছেলেটি দেয়ালের সেই স্বামী-স্ত্রীর ছবিটির দিকে এগিয়ে গেল। তারপর সেটিকে দেয়ালের দিকে মুখ করে উল্টে দিল।

আমার ওপর চোখ পড়তেই সে ঝট করে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। কি হবে মানে বুঝে। আমিও সেখান থেকে সরে এলাম। এইভাবে অন্যের বাড়ির সংসারযাত্রা দেখতে থাকাটাই অন্যায়।

সেই পানঅলাকেও চোখে পড়ল। তাকে বহুদিন পর দেখলাম। আমার মনের মধ্যে একটি হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল চন্দ্রিমার কথা। কলেজ ছেড়ে দেবার পর তার সঙ্গে বহুদিন দেখা হয় নি। কি হবে রোজ কলেজ গিয়ে, ডিগ্রি নিয়ে, আমাকে তো আর চাকরি করতে হবে না। মিস্ মজুমদারের জীবনের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। তাই কলেজ ছেড়ে দিয়েছি। ছোট চাচা আমাকে গ্রীক ট্রাজেডি, শেপীয়র আর শাহনামা পড়ান। কিছুদিন থেকে এসব পড়তেও আর ভালো লাগছে না। ছোট চাচাও আজকাল আর নিয়মিত পড়তে ডাকেন না। যখন ইচ্ছে করে আমি নিজেই একটি বই খুলে বসি। তবে সবসময় শাহনামা বা শেপীয়র নয়। বাজে বইও পড়ি। বস্তুত মনের অলস অবস্থায় বাজে বইই বেশি পড়ি।

চন্দ্রিমার কাছে আজকালের মধ্যে একবার যেতে হবে। এর মধ্যে সে আরো কি সব পাগলামি করেছে কে জানে।

জাফর আর কনিজকে এখন প্রায় সবসময়ই এক সঙ্গে দেখা যায়। কনিজ জাফরের বিরুদ্ধে আর কোনো নালিশ নিয়ে আসে না। জাফর কনিজ সম্পর্কে কখন কি বলেছে আর তার মানেই-বা কি এ কথা জানতে কনিজ আর আমার কাছে আসে না। বোধ করি জাফর নিজেই মানে বলে দেয়; অথবা হয়তো এমন ভাষায় বলে কনিজ নিজেই যার অর্থ বোঝে। যাত্রার দলে থেকে জাফর বেশ সৌখিন বাবুটি হয়েছে এবং পালার ভালো ভালো কথা সে যা শিখেছে তা সে যাত্রাদলের ভাঙা চৌকির বাইরেও বেশ দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। খোদা তাদের সুখী করুন। আশা করি তার আগেই তারা বিয়েটা করে নেবে।

কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ে করি কি?

কত রকম চিন্তাই যে সবকিছু গোলমাল করে দেয়। আমি কি নিজেকে ভালো করে বুঝেছি?

শেষ পর্যন্ত কি আমার চোখ পৌঁছায়?

পৌঁছায় না! কারই কি পৌঁছায়? না। তাহলে?

কামিলের সঙ্গে সকালবেলা এক সঙ্গে খেতে পারি নি। কিন্তু ডেকেছিলাম আমিই। তাই বিকেলবেলা আর এক রেস্টুরেন্টে কামিলকে আসতে বলেছি। হ্যারিসন রোডে একটা অপেক্ষাকৃত অখ্যাত দোকান আছে—খাবার দোকান—সেখানকার মাটন কাটলেট আর মোগলাই পরটা বিখ্যাত। বড় ভিড় হয় সেখানে। কলেজ আর ইউনিভার্সিটির ছেলে- ছোকড়াই বেশি—কিছু কিছু মেয়েও দেখা যায়। তাছাড়া বড্ড গরম আর হট্টগোল। মনে হয় হাট বসেছে। অনেকগুলো ছোট ছোট টেবিলের চারপাশে বসে খদ্দেররা ফরমায়েশিত ভোজ্যের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। প্রতীক্ষা যখন আর সহ্য হয় না তখন অসন্তোষের বহ্নি মুখ দিয়ে প্লাবিত হয়ে কক্ষটিকে তপ্ত করে দেয়। প্রতিবাদ জানিয়েও কোনো লাভ হয় না— তখন নিছক ক্লান্তিতেই আবার সকলে সহনশীলতার অবতারের মতো চুপ করে থাকেন। তবু তারই ফাঁকে ফাঁকে আবার হুঙ্কার শোনা যায় : আরে মশাই, আমার চেহারাটা কি পছন্দ হলো না, কবে থেকে বসে আছি চিংড়ি-কাটলেটের জন্য। আর একজন বলেন : আমি এসেছি আপনারও আগে। একটা ভেজিটেবল চপের জন্য বসে বসে নিজেই ভেজিটেবল হয়ে গেলাম। অথচ আমার পরে যারা এসেছেন তাঁরা খাওয়া-দাওয়া সেরে এখন মুখে সুপুরি পুরছেন। এর রহস্যটা একবার জানতে হয়। তারপর আসে চিংড়ি-কাটলেট আর ভেজিটেবল চপ। অমনি রহস্য সন্ধানের সমস্ত প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।

আর শোনা যায়, রূপবাণীতে কাননবালার ছবি হচ্ছে সে কথা; বিজয় মার্চেন্ট পেন্টাঙ্গুলারে সেঞ্চুরি করেছেন সে আলোচনা; ইলিশ মাছের দাম চড়েছে, তাও।

এবং এ সবেরই ফাঁকে ফাঁকে বেয়ারারা গরম চায়ের পেয়ালা নিয়ে করে ছোটাছুটি। পেয়ালা থেকে ওঠে ধোঁয়া, তাদের গা দিয়ে ঝরে ঘাম।

বলা বাহুল্য, বসে আলাপ করবার জন্য জায়গাটা আদর্শ নয়। তাছাড়া এমন এক আবহাওয়া যে দু’মিনিটেই হাঁফ ধরে যায়। তবু এইখানেই আমাদের আসতে হবে। কলেজ স্ট্রিটে কামিলের কি এক কাজ আছে। পাঁচটার মধ্যে সে অন্য কোথাও আর পৌঁছতে পারবে না। ওয়াই-এম-সি এতে যেতে পারতাম, বসন্ত কেবিনও এর চাইতে ভালো; কিন্তু মোগলাই পরটা এখানেই ভালো হয়। এবং কামিল মোগলাই পরটা ভালোবাসে।

তৈরি হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেবে আসছি, দেখি তারই এক পাশে ছোট চাচা অপেক্ষা করছেন। তিনি কি জানতেন আমি এই সময়টা আবার বের হবো?

—আবার চললি কোথায়?

–বাইরে যাচ্ছি। আমার একটু কাজ আছে।

ছোট চাচা এক মুহূর্ত কি যেন চিন্তা করলেন তারপর বললেন : আচ্ছা যা। ফিরতে দেরি করিস নে।

আমি সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে তরতর করে নেবে গেলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম, ছোট চাচা তখনো সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছেন।

কামিল বুদ্ধি করে একটি কেবিন দখল করে বসেছিল। কেবিনের পর্দা ছিল তোলা। আমি আসতেই পর্দা নাবিয়ে দিলাম।

কামিলের মুখ অপ্রসন্ন।

—এই বিচিত্র চিড়িয়াখানার ঠিকানা তোমাকে কে দিল?

আমি সে কথার কোনো জবাব দিলাম না। চেয়ারে ভালো করে নড়েচড়ে ঠিকমতো বসলাম। একটু পরই গরমে আমার সারা গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে লাগল।

—তোমাকে দেখে আমারই কষ্ট হচ্ছে। এই দুর্ভোগের কি দরকারটা ছিল বল?

আমি তবু নিরুত্তর।

কামিল তারপর অনেকক্ষণ কোনো কথা বললো না। সে কি চিন্তা করছিল। পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে সে কপালের ঘাম মুছে ফেলল। তারপর আমার ওপর তার দুটি চোখের স্থির দৃষ্টি রেখে বললো : তিশনা, ক’দিন থেকেই ভাবছি তোমাকে একটা কথা বলব।

এই ক্ষুদ্র ভূমিকার পর সে আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। আমি অপেক্ষা করে আছি আগ্রহ ভরে একবার তাই দেখে নিয়ে সে আবার বললো : আমাদের এই মেলামেশা বন্ধ করতে হবে।

—কেন?

—তোমার সাময়িক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমি এমন কিছু করতে চাই না, যা তোমার বাকি জীবনটাকে বিগড়ে দিতে পারে। তুমি যখন আমার ওপর রাগ কর সে আমার সহ্য হয়। কারণ আমি জানি, তার মধ্যে কতখানি ভালোবাসা আছে। কিন্তু তুমি যখন প্রেমের রক্তগোলাপ নিয়ে আস তখন আমার ভয় হয়। কারণ আমি জানি তা গ্রহণ করবার আমার কোনো অধিকারই নেই—তবু বড় লোভ হয়।

মাথার ওপর পাখা তার নিজের নিয়মে ঘুরছে। মনে হয় চুলোর ওপর থেকে গরম হাওয়া তুলে এনে আমাদের মাথার ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছে। অসহ্য ঠেকছে এই গরম।

একবার ভাবলাম আমি কোনো জবাবই দেব না। তবু না বলে পারলাম না : তোমার ওপর জুলুম তো করতেই চাই না। তোমার যা মন চায় তাই করো। কিন্তু বারবার সাময়িক দুর্বলতার কথা বলে আমাকে আর অপমান করো না।

—তুমি বুঝছ না, তিশনা। তোমার আব্বা ছোট চাচা কিছুতেই মত দেবেন না।

—তবু যদি আমি মত দিই। তাহলে?

—তাহলেও না। কারণ আমি জানি তুমি কিছুতেই সুখী হবে না। উপস্থিতির লোভে তুমি ভবিষ্যৎ খুইয়ে বসবে, তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে এটা কি করে হতে দেব?

—তুমি কি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের লোভে আমাকে উপস্থিতিটাও খোয়াতে বল?

—তিশনা, আজ তুমি কিছুতেই বুঝবে না। কিন্তু তবু তোমাকে কালকের একটি ঘটনা বলি। আমি বাড়ি ফিরছিলাম। দুপুরবেলা। রাস্তায় ঠেলাগাড়িঅলা খেলনা বিক্রি করছে। পাড়ার অনেক ছেলেমেয়েই খেলনা কিনল, হাসিমুখে আবার বাড়ি ফিরে গেল। সেই বাড়িরই ঝিয়ের চার বছরের মেয়েটি হঠাৎ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কান্না জুড়ে দিল। সে যে কি কান্না তোমাকে বোঝাতে পারব না। তারও একটি লাল পুতুল চাই। হঠাৎ তার মা সেই মেয়েটিকে ধরে মারতে শুরু করল। সে মারই-বা কি তোমাকে তাও বোঝাতে পারব না। মেয়েটি চুপ করল। খেলনার কথা সে ভোলে নি; কিন্তু মার খেয়ে তার বায়না ভুলে গেল।

—তারপর?

—তারপর আর কিছুই না।

—তুমি বলতে চাও কি?

—ঝি কি তার মেয়েকে ভালোবাসত না? নিশ্চয়ই অন্য মায়ের মতোই সেও তার চার বছরের সন্তানটিকে ভালোবাসত। তবু সেই মেয়েরই এক স্বাভাবিক আর সামান্য ইচ্ছা পূরণ করতে না পেরে তাকে পশুর মতো মারধর করতে হলো। মা-র মনে এই দুঃখ যে কিভাবে বেজেছে আমি তা অনুমান করতে পারি। আমি নিজে এইরকম দুঃখ সইতে পারব না, তাই তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাই।

—তুমি কি সত্যিই সোমবার চলে যাবে না কি?

—হ্যাঁ।

—আমাদের সঙ্গ এতই দুঃসহ?

—না, দুঃসহ নয়। একটা কারণ তো বললাম। আরো কারণ আছে।

—সেটা কি?

কামিল জবাব দিল না।

—কৈ বললে না, আর একটি কারণ কি?

এবার কামিলের শরীরের সব কটি পেশি অকস্মাৎ দড়ির মতো শক্ত হয়ে গেল। মুখে এক বিচিত্র হাসি দেখলাম। এমন আর কোনোদিনই দেখি নি। কামিলকে কে যেন মুখোশ পরিয়ে দিয়েছে, ঠিকমতো চেনা যায় না।

–জানো তিশনা, আর বেশি দিন তোমার সঙ্গের লোভ করলে, আমি আমার মা-কে হারাব।

—কি বলছ আবোলতাবোল।

কামিল একবার ক্রূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখে নিল, মুখে সেই বিচিত্র হাসি। তারপর বললো : বলতে চাও, কিছুই তোমার চোখে পড়ে নি?

এই বলে কামিল সজোরে হাত দিয়ে টেবিল চাপড়ে উঠে পড়ল।

কামিল কিছুতেই আমার সঙ্গে আসতে চাইল না। বললো, কোথায় তার কি কাজ আছে। আমিও আর পীড়াপীড়ি করলাম না। সেই মুহূর্তে একটু একা থাকতেই আমার ভালো লাগছিল।

ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছি, কোথা থেকে চন্দ্ৰিমা উপস্থিত।

—শপিং করতে বেরিয়েছিলাম রে। তুই এখানে কি করছিস?

ট্রাম কবে দয়া করে আসবেন, তারই অপেক্ষা করছি। মনে হয় আধঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।

—আমিও তোদেরই পাড়ার কাছাকাছি যাব। ধর না মেয়ে, শাড়ির এই বাক্সটা! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস, আমি সবগুলো সামলাতে পারছি না!

—দে দে ভাই। রাগ করিস কেন!

আমরা ট্রামের জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় চোখে পড়ল, সামনের ফুটপাতে একটি ফলের দোকানের সামনে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে চব্বিশ পঁচিশ বছরের এক ছেলে। ফর্সা, চোখে চশমা, মাথায় সোলা-হ্যাট।

ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে হাত তুলে সালাম করলেন। তাঁকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, তবু ঠিক চিনতে পারছিলাম না। অবশ্য আমিও সালামের জবাব দিলাম।

এমন সময় ট্রাম এলো। আমি আর চন্দ্রিমা উঠে পড়লাম।

—ভদ্রমহিলাটি কে রে?

—ঠিক চিনলাম না।

—সঙ্গের ছেলেটি কিন্তু ভারি ডিগনিফাইড।

–হবে। আমি ভালো করে দেখি নি।

—আর কত ভালো করে দেখতে চাও, পোড়ারমুখী!

ট্রাম বেনিয়াপুকুরের কাছে আসতেই চন্দ্রিমা উঠে পড়ল।

—আমি এখানেই নাবব। কাজ আছে একটা। দেখা করিস। চন্দ্রিমা নেমে গেল।

ট্রাম ছেড়ে দেবার পর পথ থেকেই এই কথাগুলো ছুঁড়ে মারল : তুই দেখতে আরো সুন্দর হয়েছিস। আর হ্যাঁ, ভালো কথা। তোদের সেই পানঅলা কেমন আছে রে? Give him my love. কিছুতেই ভুলিস নে।

ট্রাম সার্কুলার রোডের মোড়ে আসতেই একেবারে হঠাৎ মনে পড়ে গেল : কলেজের নাটকের দিন এই ভদ্রমহিলাই আমার ঠিকানা চেয়ে নিয়েছিলেন।

রাস্তার অপ্রচুর আলোয় দুই পাশের দোকানপাট আবছা আবছা দেখা যায়। মেঘ করে এসেছে। যে-কোনো মুহূর্তে মাথার ওপর বৃষ্টি ভেঙে পড়বে। ঢং ঢং ঢং আওয়াজ করে ট্রাম এগিয়ে চলেছে। আমি বসে আছি একেবারে সামনের আসনে। জানালা দিয়ে বাদলা হাওয়া এসে মুখে লাগছে। এইভাবে চুপ করে বসে থেকে নিজের মনের সাথে একটা সরগড় সহজ মনে হয়।

সেই মুহূর্তে কিছুতেই এই চিন্তাটিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না, কামিলের সঙ্গ আমাকে আনন্দ দেয় সত্য; কিন্তু তবু এক সূক্ষ্ম অপরিচয়ের অস্বাচ্ছন্দ্যেও মনটিকে ভার করে রাখে। তার সান্নিধ্যে মাঝে মাঝে এক দুয়ে অসোয়াস্তি বোধ করি। আমাদের দু’জনের হৃদয় একই সুরে বাজতে থাকে; কিন্তু আবার একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে ছন্দপতনও হয়। আমাদের দু’জনের মাঝখানে একটা কিছু ব্যবধান আছেই, পদে পদে যার অস্তিত্ব উপলব্ধি করেছি। যতই অস্বীকার করতে চেয়েছি, সেই পার্থক্যটুকু ততই কঠিন হয়ে বাধা দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *