প্রসন্ন পাষাণ – ২৩

২৩

মানুষের হৃদয় থেকে যে কখন কি কারণে বিস্ফোরণ দেখা দেয় কে বলতে পারে। মনে মনে আমি স্থির সঙ্কল্প করে নিয়েছিলাম, কামিলের সঙ্গে অত্যন্ত সহৃদয় ব্যবহার করব। সে অলক্ষ্যে দূরে সরে যাচ্ছে কি যেন একটা মতলব করে—কিন্তু আমি কি তা হতে দিতে পারি? মনের মধ্যে ভালোবাসা যখন সবচাইতে গভীর, আঘাতটাও তখনই সবচাইতে কঠোর হয়ে বাজল। এই আমিই সেই নিদারুণ বাদ্যি বাজিয়ে দিলাম।

ঠিক কথাটি বলবার জন্য সঠিক মুহূর্তটিও বেছে নিতে হয়। সেই কাকডাকা ঘাম ঝরা মাথা ধরা দুপুরে কামিল আমার কাছে নিয়ে এলো তার হৃদয় পদ্ম—তার মূল্য কি আমি দিতে পারি? সে যদি অপেক্ষা করত বকুল গন্ধে ভরা এক ফুরফুরে সন্ধ্যার জন্য! মনে কর না আমি ঠাট্টা করছি! আমিও ভেবেছি, প্রেম কি কেবল বিকেলবেলা গা ধুয়ে খোঁপায় গুঁজবার বেল ফুল যে অন্য সময় তার আদর থাকবে না। প্রেম কি এক খাপছাড়া সৃষ্টিছাড়া বিলাসসামগ্ৰী যে মনের বিশেষ বিশেষ অবস্থাতেই কেবল তার প্রয়োজন—অন্য সময় না হলেও চলে? এমনকি অন্য সময় মনে চটচট করে?

তা নয়। আমি জানি গো জানি, কেন সেদিন খ্যাপার মতো ব্যবহার করেছিলাম। সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতাম বলেই হৃদয়ের সমস্ত হলাহল ওভাবে উগলে দিতে পেরেছিলাম। তা না হলে পারতাম না। যাকে ভালোবাসি না, তার সম্পর্কে কঠোর হতে পারি, নির্লিপ্ত উদাসীন থাকতে পারি—কিন্তু নির্মম নৃশংস হতে পারি নে। আমার নির্মমতার নির্বুদ্ধিতার দায় আর কে সইবে যদি সেই না সয় যাকে সব দিতে পারি?

সেদিন দুপুরে আমি কল্পনা করেছিলাম, আমার নিয়তি আমাকে দস্যুর মতো কেড়ে নিতে আসবে। মনে যত ভয়ই থাক, এক শিহরিত প্রত্যাশাও ছিল। কিন্তু যখন দেখলাম তারই বেশ দীন, কণ্ঠে মিনতি, তখন আমার সমস্ত হিসাব বেঠিক হয়ে গেল। আর তখুনিই আমার মনের মধ্যকার অন্ধকারটাই কেবল বেরিয়ে এলো।

কিন্তু কামিল যে বলে গেল, আসছে সোমবার আমরা চলে যাচ্ছি। মাঝখানে যে আর মাত্র পাঁচটি দিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *