প্রসন্ন পাষাণ – ২২

২২

কিছুদিন হলো আমার কামরাটির পাশেই একটি গোসলখানা তৈরি করা হয়েছে—একমাত্র আমারই ব্যবহারের জন্য। উপরে উঠে এসেই আমি গেলাম গোসলখানায় হাত ধুতে। কামিল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে জানালার পাশে বসে পড়ল। আসলে আমার হাত ধোবার কোনো দরকার ছিল না। কামিলকে আবার বহুদিন পর এত কাছে পেলাম। অতি প্রিয়জন বহুদিনের অসাক্ষাতের পর যখন আবার কাছে এসে দাঁড়ায় তখন হঠাৎ মুখে কথা জোগায় না। হাত ধোবার অছিলায় মনটিকে তৈরি করবার জন্য আমি কিছুটা সময় চেয়ে নিলাম। হাত ধুতে কখনো এত সময়ও লাগে না। তবু আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, কামিলও এই সাময়িক বিরামটুকুর জন্য মনে মনে কৃতজ্ঞ ছিল। বেশ কিছুটা সময় এইভাবেই কেটে গেল। কেবল ওয়াশ বেসিনে কলের পানি গড়িয়ে পড়বার ছড়ছড় শব্দটুকু কামিলেরও কানে যাচ্ছিল, আমিও শুনছিলাম। এই শব্দটুকুই আমাদের দু’জনকে পরস্পরের কাছে ধরে রেখেছিল।

এক সময় আমাকে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে হলো।

কামিল তখনো তেমনিভাবে চেয়ারে বসা, তার দৃষ্টি আকাশের গায়ে এলিয়ে পড়া তাল গাছগুলোর ওপর। একটি নতুন জিনিস এই দেখলাম যে তার মুখে সিগারেট।

খাটের পাশে এসে দাঁড়ালাম। মশারিটা একদিকে ঝুলে ছিল, সেই দিকটা ঠিকমতো তুলে দিতে দিতে বললাম : সিগারেট ধরলে কবে?

কামিল একটুখানি মুচকি হাসল।

—মুখে সিগারেট পুড়ছে বহুদিন থেকেই; তুমি ধোঁয়া দেখলে এই প্রথম

—আরো কিছু আছে কি যা আমি এখনো দেখি নি?

—থাকাই তো স্বাভাবিক।

—তা বটে। আমারই ভুল।

—রাগ করলে?

বস্তুত সত্যিই আমি রাগ করেছিলাম। কামিল সিগারেট ধরেছে, রাগ এ কারণে নয়। পুরুষ মানুষের মুখে সিগারেট আমার চোখে ভালোই ঠেকে। তবু হঠাৎ রাগ হলো। কেন যে হলো জানি না।

—রাগ করতে যাব কেন!

কামিল স্থির হয়ে আমাকে দেখছিল। আমার জবাব শুনে তার মুখের ওপর একটা ছায়া পড়ল। বললো : ভুল আমারই। তুমি আমার ওপর রাগ করতে যাবে কেন!

এরপর আমাদের সব কথা ফুরিয়ে গেল। দুটি সজাগ প্রাণী একই কামরায় কাছাকাছি উপস্থিত অথচ তাদের মুখে একটি কথা নেই, এই অভিজ্ঞতাটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর। অথচ একবার কথা থেমে গেলে আর শুরুও হতে চায় না। সেখান থেকে উঠে চলে যাওয়া সেও অসম্ভব।

এইভাবেই অনেকটা সময় কেটে গেল।

—আমি ছোট একটি বাড়ির খোঁজ পেয়েছি। ভাবছি সামনের মাসে মাকে নিয়ে—এ কি তুমি কাঁদছ?

—কাঁদব কেন। চোখে কি যেন পড়েছে।

আঁচল দিয়ে আমি চোখের অশ্রুই ঢাকতে পারি—কণ্ঠস্বরে যে কান্না বেজে উঠল তা গোপন করব কেমন করে!

—বেশ। সেই ভালো। তুমি যাও।

এই বলে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

—তিশনা, আমার সব কথা শুনবে না?

–না না তুমিও যাও।

কামিল তবু সেইখানেই বসে থাকল। আমি পালিয়ে এলাম নিচে। তারপর আবার যখন ওপরে উঠে এলাম তখন মনস্থির করে নিয়েছি : কামিলকে যদি দুঃখ দিয়ে থাকি তাহলে নিজেই তার প্রায়শ্চিত্ত করব। এ কথা ভাবতেই মনটা হালকা হয়ে গেল।

ফিরে এসে দেখলাম, ঘরে কেউ নেই।

আরো কিছুদিন গড়িয়ে গেল।

একদিন দুপুরে আমি শুয়ে আছি। পাখাটা খারাপ হয়ে গেছে। গরমে ঘেমে উঠেছি। বারান্দার রেলিংয়ে বসে কাক অবিশ্রান্ত ডেকে চলেছে; তাছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু আমাদের বাড়িটাই নয়, আশপাশের সকলেও গরমে আর ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়েছে। যারা এখনো বাড়িতেই আছে, দরজায় খিল দিয়ে রৌদ্রের দুঃসহ পীড়নকে বাহির দ্বার থেকেই ফিরিয়ে দেবার অসাধ্য চেষ্টায় হয়রান হচ্ছে।

—আসতে পারি?

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম।

কামিলও মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল। আর আমি? কি যে করি আর কি যে বলি কিছুই ঠিক করতে না পেরে কিছুই বললাম না আর কিছুই করলাম না। তেমনি হাঁটুর ওপর হাত রেখে বিছানার ওপর বসে থাকলাম।

কামিল এবার ঘরের মধ্যে এসে পড়ল। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

সে এভাবে কতই এসেছে গেছে, কখনো তো এমন অস্থির লাগে নি। আজ আমার হলো কি? ভয়ে বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করে যে। আমার মনে হতে লাগল, নিয়তির মতো অনিবার্য এক পদধ্বনি শুনেছি—অসহায়ের মতো বসে থেকে তাকে এগিয়ে আসতে দিতে হবে, তার কাছে নিরুপায়ের মতো আত্মসমর্পণ করতে হবে। সে এমনই নাছোড়বান্দা দস্যু।

কামিল আজ সেই চেয়ারে বসল না। একটুখানি ইতস্তত করল, তারপর আমারই খাটের এক পাশে বসে পড়ল।

—তুমি রাগ করতে পার আমি জানি; কিন্তু না এসে পারলাম না।

—রাগ করব যদি জানই, তাহলে এলে কেন?

কামিল কোনো জবাব দিল না।

—মেয়েমানুষের ঘরে চোরের মতো আসতে পার; কিন্তু এতটুকু সাহস নেই যে কথার জবাব দেবে? বললে, আমি রাগ করব তুমি জানতে। সত্যিই যদি তা জানতে-আসতে?

কামিল একবার শুধু তার চোখ তুলল, আবার তেমনি অধোমুখে বসে থাকল। —আসলে তুমি ভেবেছিলে, রাগ নয়, তিশনা অনুরাগের রঙে এই অলস দুপুরটিকে রাঙিয়ে দেবে। সত্য কি না বল?

কামিল তবু নিরুত্তর।

এবং তার এই নীরবতাই আমাকে একেবারে উন্মত্ত করে দিল।

—তাহলে শুনবে সত্য কথাটি? তোমার দুঃখ দেখে আমার দুঃখ হতো তোমার লজ্জা দেখে আমিই লজ্জা পেতাম। তা কেন জানো? এ বাড়িতে তুমি আত্মীয়ের দাবিতে থাকবে অথচ আত্মীয়ের মতো থাকবে না, তা হতে পারে না। তাই তোমার হেঁট মাথাটিকে উঁচু করে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম, যাতে কোনোদিন মানুষ হতে পার।

এইবার কামিল মুখ তুলল। সেখানে সংশয় নেই, সঙ্কোচ নেই, সুখ নেই, দুঃখ নেই; কোনো প্রকার অনুভূতির লেশটুকু নেই। তার মুখের ওপর একটু আগেই মেঘের মতো যে ছায়া দেখেছিলাম, তাও সরে গেছে। তার মুখটি একটি সাদা কাগজ; আমি কি বলি তারই মসিটুকু মেখে নেবার জন্য প্রস্তুত।

—মানুষ কি হতে পেরেছি?

কথার শেষে কামিল একটুখানি হাসল। তারপর উঠে পড়ল।

—তিশনা, আসতে আমি চাই নি। কিন্তু কি যে হলো, কিছুতেই না এসে পারলাম না। তোমার পায়ের কাছে যে জিনিসটা রেখে গেলাম সবার আগে তোমার কাছে পৌঁছে দেবার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। বিশ্বাস কর, অন্য কোনো মতলবই ছিল না।

অল্পক্ষণ কামিল চুপ করে থাকল। তারপর আবার বললো : যদি কোনোদিন সত্যি মানুষ হতে পারি সবার আগে তোমার দয়ার ঋণ স্মরণ করব। আর যদি নাও পারি, তাও মনে রাখব। আসছে সোমবার আমরা চলে যাচ্ছি।

কামিল আর অপেক্ষা করল না। তার পদধ্বনি একটু একটু করে দূরে সরে যেতে থাকে, আমি কান পেতে তাই শুনি।

আমি হতবুদ্ধি হয়ে বসেই থাকলাম। এটা কি ঘটে গেল! আমার মধ্যে এ কোন দৈত্য বসে ছিল, যে সব কিছু এভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিল। আমি যেন আমি নই, অন্য কেউ। নিজের প্রতি নিজেই বারবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ফিরে ফিরে দেখতে লাগলাম—কিন্তু তবু আমার এই নতুন সত্তাটিকে অত্যন্ত অপরিচিত ঠেকল। হঠাৎ কোথা থেকে এ কি হয়ে গেল।

পায়ের কাছে কামিল যে বস্তুটি রেখে গেল, এবার তা হাতে তুলে নিলাম। ব্রাউন রঙের মোড়কটি খুলে ফেললাম। কামিলের প্রথম উপন্যাস, কানাগলি।

উপন্যাসটিকে দু’হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *