প্রসন্ন পাষাণ – ২১

২১

সেদিন শরীরটা ভালো ছিল না। বাইরে আর যাই নি। খাটের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে পড়েছিলাম। কিছুই করবার ছিল না। কিন্তু এই অবসর সময়টুকু বড়ই দুঃসহ মনে হচ্ছিল। সম্মুখের বাড়ির সেই মেয়েটি, কিছুদিন আগেই যে মা হয়েছে,—তাকে দেখলাম ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রসাধনের শেষ প্রলেপগুলো সেরে নিচ্ছে। তার মুখে এক মিষ্ট তৃপ্ত হাসি, শরীরের প্রতিটি রেখায় এক পূর্ণতা আর ফুল্লতা। জানালার পর্দাটা তোলাই ছিল, ঘরের ভিতর অনেকটাই দেখা যায়। বেশ পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি করে কক্ষটি সজ্জিত। আসবারের বাহুল্য নেই। কিন্তু দেয়ালে অনেকগুলো ক্যালেন্ডার ঝুলছে। এই দম্পতির ফোটোও দেয়ালের শোভাবর্ধন করছিল। নিশ্চয়ই বিবাহের অব্যবহিত পরের সেই অনিবার্য যুগল মূর্তি। দু’জনের সেই কাছাকাছি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা, স্বামীর বুকের কাছে স্ত্রীর মাথা পাতা, এবং উভয়ের ওষ্ঠের সেই হাস্যটুকু যা কেবল ফোটোর প্রয়োজনেই বিকচিত।

বেতের একটি ঝুড়ি দড়ি থেকে ঝুলছে, তারই ওপর বাচ্চাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মা প্রসাধন সেরে ঝুড়ির দিকে এগিয়ে গেল। হাসি দিয়ে তুড়ি দিয়ে গান গেয়ে কতভাবে যে সে ছোট্ট মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে লাগল। শিশু কিন্তু ঝুমঝুমি পেয়ে দুনিয়া ভুলে গেছে—মার দিকে তার নজরই নেই। অনেক চেষ্টার পর বাচ্চা হঠাৎ দ্রুত হাত-পা ছুঁড়ে ফিক করে একটুখানি হেসে ফেলল। মার সাধনা পুরস্কৃত হলো। মা তার কপালে একটা ছোট্ট চুমু এঁকে দিয়ে ঝিয়ের হেফাজতে বাচ্চাকে রেখে তার হাতে ব্যাগটি তুলে চলে গেল।

একখণ্ড মেঘের মতো এই দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে গেল। পথে দু’তিনজন বালক মার্বেল খেলছে। হাতে চোখে মুখে তাদের নর্দমার পানি; তারও হল্লা শুনতে পাই। এই বিড়িঅলা, পরনে খাটো লুঙ্গি ও রঙিন গেঞ্জি, কোমরে মোটা বেল্ট, কানে বিড়ি, নগ্ন পা, ঝাঁকড়া চুল, বলিষ্ঠ গড়ন—গান গাইতে গাইতে চলে গেল : পিয়া মিলন কো যানা।

আমি জানালার কাছে থেকে সরে এসে আবার বিছানার ওপর শুয়ে পড়লাম। খাটের পায়ের দিকে উঁচুমতো কাঠের ওপর পা দুটি তুলে দিয়ে অন্যমনস্কভাবে তাই নাড়াত লাগলাম। হঠাৎ আমার সমগ্র অস্তিত্বটাই আমার কাছে এক বৃহৎ অর্থহীন পিণ্ডের মতো মনে হতে লাগল। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠা, সেই কলেজ যাও-আসো, সেই নিত্যকার চক্র সেরে আবার শয্যায় আশ্রয়, এর সমস্তটাই এক বৃহৎ ফাঁকের গর্ভে ঘুরে ঘুরে হয়রান হওয়ার মতোই বিফল মনে হতে লাগল। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক চিহ্নিত পথ ধরে জীবনের বৃত্তটিকে সাঙ্গ করে ফেলার জন্যই কি আমার অস্তিত্ব? আমার নিজের ইচ্ছা বলে যদি কোনো বস্তু থাকে, তিলে তিলে তাকে নাশ করেই কি সার্থকতা লাভ করব?

ঐ যে বিড়িঅলা গান গেয়ে চলে গেল, ওর প্রতিও আমি এক প্রকার ঈর্ষা বোধ করতে লাগলাম। ঠিক ওরই মতো আমার সবরকম ইচ্ছাকে আমি যদি বাধাহীন করে দিতে পারতাম; কিন্তু তার কি উপায় আছে। নেই বলেই এই সময় খাটের ওপর পড়ে থেকে অলসভাবে পায়ের আঙুল নাড়াতে হয়।

সর্বপ্রকার ভ্রম থেকে মনটিকে বাঁচিয়ে অক্ষত রাখাই মেয়েদের শিক্ষা। কিন্তু বড় ক্ষত ছাড়া বৃহৎ সুখই কি সম্ভব? চন্দ্রিমার কথাই ধরি না কেন। তাকে দেখলেই মনে হয় সে তার মনোগত ইচ্ছা পূরণের জন্য পতঙ্গের মতো পুড়ে মরবে, তবু আগুন দেখে ডরাবে না। আমি আগুনের পাশ কাটিয়ে শীতল ছায়ে বসব, সে ছায়া হয়তো আমার শ্রান্তি দূর করবে না,কিন্তু পুড়বার ঝুঁকি আমি কিছুতেই নেব না। একাকী কোণের এই নিঃসঙ্গ খাটই আমার ভালো। এখানে সুখ যদি নাও থাকে, নিরাপত্তা আছে; ইংরাজিতে যাকে বলে ‘রেসপেকটেবিলিটি’ তাও আছে। তারই জন্য আমাদেরকে, এই মেয়েদেরকে বিশেষ করে—কতই-না দাম দিতে হয়।

—কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুম চয়নে।

–তোর মুণ্ডপাত করণে। এলি কখন?

—এই মাত্ৰ।

—এমন মধ্যরাত্রে সূর্যোদয়?

—কারণ মধ্যদিনে চন্দ্রালোকে অন্য ব্যক্তির প্রয়োজন আছে।

চন্দ্রিমার এই অপ্রত্যাশিত আগমনে অবাক হবারই কথা। এই প্রথম সে আমার বাড়ি এলো।

—নিচে এক ভদ্রমহিলাকে দেখলাম। কে রে?

—আমার ফুপু।

—ফুপু? সে আবার কি?

—এক দ্বিপদ জন্তু। যাকে তোরা পিসি বলিস।

–তো তাই বল না। যাই হোক, মাইরি বলছি, শি ইজ এ পিচ। একটা কথা বলব তোকে। তোদের মুসলমান ঘরের মেয়েরা বাস্তবিকই সুন্দরী। আমাদের মধ্যে এমন বড় একটা দেখা যায় না।

—ফুপুকে মেয়ে বলা কি ঠিক হবে? তাঁর একটি ছেলে আছে।

–ছেলে তো মেয়েদেরই হয়। তাছাড়া মাথা থেকে পা পর্যন্ত যতগুলো উঁচুনিচু টক্কর দেখলাম,—মেয়ে বলেই তো মনে হলো।

—তাঁর শিশুটির বয়স উনিশ কি বিশ।

এবার চন্দ্রিমা অবাক হলো।

সে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল : ছেলেটির বয়সই উনিশ বিশ?

— জি হ্যাঁ।

—বিশ বছরের যুবকের মাতাকেই যদি ষোড়শী মনে হয়, তো সন্তানটি কেমন?

—গ্লাস্কো বেবি।

—শ্রীমতী, ব্যাপারখানা কি?

—বড়ই গুরুতর।

—বলবিন, পোড়ার মুখী!

বলেই চন্দ্রিমা সজোরে আমার গাল টিপে দিল। এমন সময় পথ থেকে আবার সেই গানের কলিটা ভেসে এল : পিয়া মিলন কো যানা।

চন্দ্রিমা খানিকক্ষণ কান পেতে শুনল।

—বাঃ ভারি মিষ্টি গলা তো! কিন্তু মিলনাকাঙ্ক্ষীটি কে?

—যেই হোক, তাকে একবার দেখলে গলাটাও আর মিষ্টি মনে হবে না।

—কেন?

চন্দ্রিমা জানালার কাছে এগিয়ে এলো।

সেই বিড়িঅলাই ফিরে আসছে। চন্দ্রিমা স্থির হয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল। কেবল যে তার কণ্ঠই মৌন তা নয়, তার চোখে-মুখে লঘু পরিহাসের কোনো চিহ্নই নেই। দৃষ্টিও অনিমেষ।

একটু পর সে বললো : ইটস্ এ রেভেলেশন। দ্যাটস ওয়াট আই কল এ ম্যান।

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। চন্দ্রিমার কণ্ঠ কেমন সিক্ত থমথমে

‘দ্যাটস ওয়াট আই কল এ ম্যান!’ সেই ম্যানটিকে আমি বহুবার এই পথেই আনাগোনা করতে দেখেছি কিন্তু কখনোই মনে হয় নি সে দেখবার যোগ্য। আজ চন্দ্রিমার কথা শুনে একটু ভালো করে লোকটিকে লক্ষ করলাম। আগেই বলেছি : পরনে খাটো লুঙ্গি, রঙিন গেঞ্জি, তাও সিল্কের, কোমরে চওড়া বেল্ট। কণ্ঠে ফিল্মি গান, কানে দুটি বিড়ি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল— তৈলবিহীন; স্ফীত ওষ্ঠ, নির্ভীক দুটি চোখ। দৃঢ় পেশি, বলিষ্ঠ বাহু। গায়ের রঙ কালো। ওষ্ঠের কোণে এক প্রকার হিংস্র নৃশংসতা, দেখে মনে হয় তার হাসির সঙ্গে রক্তবিন্দুর মতো যেন ঝরে ঝরে পড়ছে; এবং সত্য কথা বলতে কি, দেখলে যা ভালোই লাগে। ফোঁড়ার ওপর চাপ দিলে যেমন ব্যথাও করে আর ভালোও লাগে।

চন্দ্রিমা বললো : আই উড গিভ এনিথিং টু বি হিজ ওম্যান!

—হি মে বি উইলিং, ফর অল আই নো।

—হাসি নয় তিশনা। ঐ লোকটিকে পথ থেকে তুলে আন, একটু-আধটু শিক্ষা দে, আদব-কায়দা শেখা, ভব্য করে নে, দেখবি হি উইল বি এন এডোরেবল হাসবেন্ড। আমাদের সমাজের এই শিক্ষিত ‘সিসিরা’ আমার দু’চক্ষের বিষ।

—কিন্তু আমার কি মনে হয় জানিস চন্দ্রিমা। ঐ লোকটিকে ঘষামাজা করলে ওর মধ্যে যে আরণ্য আকর্ষণ তুই দেখছিস, তা আর থাকবে না।

চন্দ্রিমা অল্পকাল চুপ করে থাকল। তারপর হেসে ফেলল।

বললো : ইউ হ্যাভ মোর ইনসাইট দ্যান আই গেভ ইউ ক্রেডিট ফর। ইউ মে বি রাইট। কিন্তু লোকটা থাকে কোথায় রে?

–থাকে কোথায় রে! তুই কি পাগল হলি না কি।

চন্দ্রিমা আবার হাসল।

—আহা, শুনিই না।

—খুঁজে দেখ, পথের মোড়ে তার পান-বিড়ির দোকান আছে।

—লোকটা কিন্তু আমাদের দিকে ফিরেও দেখল না।

—চন্দ্রিমার জীবনের প্রথম পরাজয়!

—ঠিক বলেছিস। এবার আমাকে যেতে হয়। আমার দাদার বিয়ে। কিছু শপিং করতে হবে। দাদা এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে বলতে পারিস ব্যাপারটা তার কাছে A matter of wife and death.

যেতে হয় কি রে! এলি কিসের জন্য তাই তো শোনা হলো না।

—ভুলে গেছি। আমি নতুন গাড়ি চালাতে শিখেছি। বোধ করি তারই অনুশীলন করতে করতে চলে এলাম।

বলেই চন্দ্রিমা বিদায় নিল। দোরগোড়া থেকে এই কথাগুলো ছুঁড়ে মারল :

—ফিরবার পথে তোদের গলির মোড়টা একবার দেখেই যাব।

চন্দ্রিমা চলে গেল। আমিও নিচে নেবে এলাম।

ছোট ফুপুকেও দেখলাম তাঁর খাটে চুপ করে শুয়ে আছেন। এমন হতে আমি আরো দেখেছি। যখন কোনো অকারণ পুলক বা বিষাদ বাড়ির একটি কি দুটি প্রাণীকে আচ্ছন্ন করে তখন কেমন করে, যেন সারা বাড়িটাই তার দ্বারা সংক্রমিত হয়ে পড়ে। বোধ করি হাওয়াতেই এমন কিছু থাকে যা সকলকেই স্পর্শ করে যায়।

আমাকে আসতে দেখেও ছোট ফুপু উঠলেন না।

–ছোট ফুপু, শরীরটা কি ভালো ঠেকছে না!

—এমন কিছু না। গায়ে একটু ব্যথা।

বলেই ছোট ফুপু পাশ ফিরে শুলেন। আমার দিকে তাঁর পিঠ।

এমন কোনো কোনো মুহূর্ত আসে যখন কথা বলতে ভালো লাগে না। একেবারে এক থাকতে পারলেই যেন বেঁচে যাই। প্রিয়জনের সঙ্গও তখন অবাঞ্ছিত মনে হয়। ছোট ফুপুও এই সময়টা একা থাকতে চান অনুমান করে আমি আবার আস্তে উঠে পড়লাম।

—চলে যেও না। বসো আমি এখুনি উঠছি।

কিন্তু ছোট ফুপু তেমনি পাশ ফিরে পড়েই থাকলেন।

আমি ধীরে ধীরে তাঁর কোমরে-পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। এইভাবে কিছুকাল কাটবার পর ছোট ফুপু এক সময় আস্তে আমার হাতটি তাঁর মুঠির মধ্যে টেনে নিলেন। সেইভাবেই সেই দিকেই মুখ ফিরিয়ে তবু তিনি পড়ে থাকলেন। মুখে একটি কথা নেই, কিন্তু তাঁর হাতের সেই স্পর্শের এক প্রকার ভাষা ছিল। সে ভাষার অর্থ আমি যে ঠিক বুঝলাম তা নয়; কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে এক আবেগের বাষ্পোচ্ছ্বাস আমি কিছুতেই দমন করতে পারলাম না। এক সময় আমার দু’চোখের তপ্ত অশ্রু ছোট ফুপুর সেই মুঠির ওপর গড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো, ছোট ফুপুর সেই মুঠিটি এক নিষ্প্রাণ দস্তানার মতো আমার হাতটিকে জড়িয়ে আছে। সেখানে কোনো স্পন্দন নেই। তখন ছোট ফুপুর মুখটি সেই দেয়ালের দিকে ফেরানো; কিন্তু এবার মুখটিকে আরো একটু ঘুরিয়ে বালিশের মধ্যে গুঁজে দিলেন। তাঁর শরীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রথমে অল্প একটু নড়ে উঠল; শায়িত ব্যক্তির নাকের ওপর মাছি বসলে সে যেভাবে নড়ে ওঠে সেইভাবে। তারপর অকস্মাৎ এক অদম্য অবাধ্য প্লাবনের মতো তিনি বারবার স্ফীত উদ্বেলিত হতে লাগলেন, তাঁর গোটা শরীরই বুঝি টুকরো টুকরো খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে।

মানুষ তার দুর্বলতার সাক্ষী চায় না। আমি উঠে চলে এলাম। কাঁদুন, ছোট ফুপু প্রাণ ভরে কাঁদুন। প্রবল ভূমিকম্প দিঘির শান্ত পানিকে তোলপাড় করুক। তাঁকে শান্ত করবার ক্ষমতা আর যারই থাক, আমার যে নেই জানতাম।

ছোট ফুপু বোধ করি দেশে ফিরে যেতে পারলেই ভালো করতেন। কিন্তু ফুপুজানের মৃত্যু সব আবার ওলটপালট করে দিল। খোদার কি মর্জি তিনিই জানেন।

ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখি কামিল বাইরে থেকে এলো। এখুনি তাদের কামরায় প্রবেশ করবে। আমি বাধা দিয়ে বললাম : চল, ওপরে চল।

আমার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যা অন্যমনস্ক কামিলের কানেও বেসুরো ঠেকল। সেই আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল : ব্যাপারখানা কি!

—ব্যাপার আবার কি হবে। ওপরে চল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *