প্রসন্ন পাষাণ – ১৭

সতেরো

কিছুদিন থেকে আমি একটা নতুন কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কলেজের বার্ষিক সম্মিলনীতে চিত্রাঙ্গদা অভিনয় হবে। প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন; গভর্নরও থাকতে পারেন। নাম ভূমিকায় কে অভিনয় করবে তা নিয়ে কিছুদিন বেশ তর্ক-বিতর্ক চলল—কিছুতেই সকলের মনঃপূত নায়িকা পাওয়া যাচ্ছে না। আমার সহপাঠী জিন্নত আরা সেদিন আমাকে কমন রুম থেকে ডেকে এক পাশে নিয়ে এলো।

—তিশনা, চিত্রাঙ্গদা তোকে করতেই হবে। এমনিতে আমি চাই না হিন্দু দেবদেবীদের নাটকে আমাদের কোন অংশ থাকে। পরীক্ষায় পাস করবার জন্য বাধ্য হয়ে পড়তে হয় সে অন্য কথা। ভুলেও যদি কখনো ওরা আমাদের ইতিহাসের পাতা খুলে দেখে।

সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম : তাহলে আমাকে অভিনয় করতেই-বা বলা কেন?

—তার কারণ আছে। এটা হচ্ছে ইজ্জতের সওয়াল। রুচিরা আর চন্দ্রিমা বলাবলি করছিল—আমি নিজের কানে শুনেছি—যে মুসলমান মেয়েদের দিয়ে এসব কোনো কাজই হবে না। আমাদের না আছে শিক্ষা না আছে কালচার।

—বলেছে এ কথা!

—আমি নিজের কানে শুনেছি।

—চুপ করে আছিস যে।

—আমি চিত্রাঙ্গদা হতে চাইলেই আমাকে তারা হতে দেবে কেন? কমিটির সকলেই তো তারা।

—তা না দিতে পারে। কিন্তু তুই একবার বলে দেখলে পারিস। অন্তত একজন এগিয়ে এসেছিল তা তো জানবে।

—আচ্ছা আমি বলব। আর ওরা যদি রাজি হয়, আমি অভিনয়ও করব।

—হ্যাঁ ভাই। একটু দেখিস। একমাত্র তুইই আমাদের মুখ রাখতে পারিস।

আমি প্রিন্সিপালের কাছে এলাম। আগে কোনোদিনই এ ঘরে আসি নি। প্রিন্সিপাল চিঠিপত্র সই করছিলেন। মুখ তুলে বললেন : কি চাও?

—আমি চিত্রাঙ্গদায় অভিনয় করতে চাই।

—অভিনয়! কিসের ভূমিকায়? সখির কোরাসে?

–নায়িকার ভূমিকায়।

প্রিন্সিপাল চিঠিপত্র এক পাশে সরিয়ে রাখলেন। তাঁর চোখ দুটিও বিস্ফারিত।

—নায়িকার ভূমিকায়! আগে কখনো অভিনয় করেছ?

—দেখুন অভিনেত্রী আমরা কেউই নই। কিন্তু কলেজের সখের থিয়েটারে অভিনয় চালিয়ে নিতে পারব বলেই আশা করি। আর দশজন মেয়ে যদি পারে, আমিও পারব!

—আশা করছ, তাই না? কিন্তু যত সহজ মনে করছ তা নয়। আর সখের বটে কিন্তু খামখেয়ালের নয়। গভর্নর আর প্রধানমন্ত্রীও আসবেন। তাছাড়া আমাদের কলেজের নাট্যশাখার একটা সুনাম আছে, সেটা বড় কম কথা নয়।

এই বলে প্রিন্সিপাল চুপ করলেন। তারপর একটুখানি হেসে নিয়ে আবার বললেন : তুমি বলছিলে আশা করার কথা। আমার নিজেরই কি আশার অন্ত আছে! কিন্তু সাধ আর সাধ্য এক জিনিস নয়।

—আমার দিক দিয়ে চেষ্টার ত্রুটি হবে না।

—চেষ্টার ত্রুটির কথা বলছি না। কিন্তু চেষ্টায় ত্রুটি না থাকলেও কাজে ত্রুটি থেকে যায়।

—আমি পারব।

প্রিন্সিপাল এবার আমাকে আপাদমস্তক দেখলেন।

—তুমি আবৃত্তি করতে পার?

—পারি।

—লছমিয়া, চন্দ্রিমাকে বলতো, নাটকের বইটা নিয়ে এখানে একবার আসতে। চন্দ্রিমা একটু পরেই এসে পৌঁছল। হাতে তার চিত্রাঙ্গদা।

—আবৃত্তি করে শোনাও তো।

—ভেবেছিলাম আপনি সজ্জন।

—আমি সজ্জন? জানো এত রাতে ছিলাম কোথায়? যাকে বলে পণ্যাঙ্গনা, তারই অঙ্গনে

আমি ওপরে রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে এক নাটক দেখছিলাম। আজও একটি কথা ভালো করে বুঝতে পারি না। এতই যদি ছোট ফুপুর বিরাগ তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন না কেন। কি দরকার ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাঞ্ছনা সইবার। কিন্তু সরে তো তিনি গেলেন না। ছোট চাচার মাথায় সমস্ত অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিতে তিনি তাঁকে সেই অপরাধই করতে দিলেন।

ছোট চাচা হঠাৎ ছোট ফুপুর পায়ের কাছে বসে পড়লেন। আজ সত্যিই তাঁর কি যেন হয়েছে। সারা জীবনে তিনি যেন এই একটি ছুটির দিন পেয়েছেন। এই দিনটি শিগগিরই ফুরিয়ে যাবে। নিজেকে ছড়িয়ে দেবার, বিলিয়ে দেবার, মনের রাস আগলা করে ধরবার, লগ্নটি যাবে চলে।

—ময়না, এবার তুমি যাও। আমি এখানেই একটু শোবো।

আশ্চর্য, ছোট ফুপু গেলেন না। অদূরেই তিনিও বসে পড়লেন। বৃষ্টি তখন নেই।

—দেখলে তো ময়না, যেতে পারলে না।

একটু চুপ থেকে ছোট চাচা আবার বললেন : Lady shall I lie in your lap?

ছোট ফুপু কি বুঝলেন জানি না। কিন্তু এবার তিনি উঠে পড়লেন।

ছোট চাচার মুখে আবার সেই বিচিত্র হাসি। বললেন : Do you think I meant country matters?

ছোট চাচাও এবার উঠে পড়লেন।

—বলতে পার ময়না, কোন কুক্ষণে তুমি এ বাড়ি এসেছিলে?

—কথা দিচ্ছি—এবার চলে যাব।

—চলে তো যাবে। কিন্তু আমি কি আর আগের দিনগুলো ফিরে পাব!

লণ্ঠনের আলোটি অনেকক্ষণ থেকে দপদপ করছে। কখন যে নিভে যাবে।

—আপনাকে অনুরোধ করব সে অধিকার আমার নেই। তবু মনে রাখবেন, আপনি তিশনার অভিভাবক। আর কিছু যদি নাও পারে, অন্তত এই চিন্তাটি আপনাকে যেন সংযত রাখে। আর—

—আর?

—আর—আমি থাকব না। কিন্তু তিশনারই দুটি চোখ দিয়ে আপনার ভালোমন্দ সব কিছুর ওপর দৃষ্টি রাখব।

—দৃষ্টি রাখবে! ঠিক বলছ ময়না?

লণ্ঠনের শিখাটি এইবার দপ করে নিভে গেল।

সেইখানেই সেইভাবেই অন্ধকারে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কিন্তু পুরা এক মিনিটও হবে না, সিঁড়িতে ছোট চাচার পায়ের শব্দ শুনতে পাই। তিনি উপরে উঠে আসছেন। ছোট ফুপুর ঘরে খিল দেবার শব্দও কানে আসে।

এখন চারদিকে একেবারে নিঃশব্দ। কেবল আমার বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ আওয়াজ করতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *