পনেরো
ছোট ফুপুকে তাঁর ঘরেই পেলাম। চৌকির ওপর চুপ করে বসে আছেন। করছেন না কিছুই। আমি একটু অবাক হলাম। ছোট ফুপু জেগে আছেন অথচ তাঁর হাতে একটা কোনো কাজ নেই
এমনটা আগে হতে দেখি নি। আমিও পাশে বসে পড়লাম।
ছোট ফুপু শরীরটা কি তেমন ভালো নেই?
ছোট ফুপু একটুখানি ম্লান হাসলেন।
শরীর ঠিকই আছে। এমনিতেই ভালো লাগছে না।
তারপর বহুক্ষণ কোনো কথাই হয় না। অনেক সময়ই এমন হয়। কিছুতেই কথা এগোতে চায় না। অন্য সময় কোথা থেকে অনর্গল কথা আসে শেষই হতে চায় না। আবার এমন কতগুলো অবরুদ্ধ মুহূর্ত আসে যখন অতি চেনা অতি আপন মানুষটিকেও অপরিচিত মনে হয়। ঠিক কোন কথাটি বললে সঠিক সুরটি বেজে উঠবে তা যদি কিছুতেই মনে পড়ে!
কাল কিছু পিঠা বানিয়েছিলাম। খাবে?
ছোট ফুপু আমাকে কখনো তুমি কখনো তুই বলতেন। তাঁর ডাক শুনেই আমি বুঝতে পারতাম কখন তাঁর মন কি অবস্থায় আছে।
আমি বিশেষ উৎসাহ না দেখিয়েই বললাম : দাও।
—মা তোকে উঠতে হবে। ঐ হাঁড়িতে আছে।
আমি আদেশ পালন করতে উঠলাম।
—আর শোন, ঐ সঙ্গে যদি একটুখানি চা–
তাই বলো, চা খেতে চাও। পিঠা তোমার ঘুষ।
ছোট ফুপুও হাসলেন।
—হ্যাঁ তাই। তুই যে ঘুষ ছাড়া এক পা নড়তে চাস না। সেই সঙ্গে ইচ্ছে করলে এক পেয়ালা চাও তুই উপরি পেতে পারিস।
—সে আর তোমাকে বলতে হবে না।
তারপর আবার আমাদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। স্টোভ জ্বালিয়ে কেটলি চড়িয়ে সলতেটি উস্কে দিয়ে আমি সেইদিকেই এক দৃষ্টে তাকিয়ে বসে থাকলাম। ছোট ফুপুর দিকে আমার পিঠ। তবু বুঝতে পারছিলাম ছোট ফুপুর দৃষ্টি আমারই ওপর লুটিয়ে পড়ছে।
—তিশনা, এবার তুই একটা বিয়ে কর। তুই ভারি সুন্দর হয়ে উঠেছিস।
—দাও না একটি বর খুঁজে।
ছোট ফুপু এবার আর কিছু বললেন না।
কথা আবার বন্ধ।
তখনো ছোট ফুপুর দৃষ্টি নিশ্চয়ই আমারই ওপর। দৃষ্টির এই সেতুবন্ধনের দ্বারা ছোট ফুপু আমার খুব কাছাকাছি—আমার সারাটা মন অন্তরঙ্গতার এই উত্তাপে উষ্ণ হয়ে উঠছিল। অথচ এক অকারণ অভিমানও আমাকে পীড়িত করছিল।
—আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নাও মা। আঁচল খুলে আগুনের কাছে যেতে নেই।
আঁচলটা নিলাম জড়িয়ে।
—ভাবছি আমরা আবার দেশের বাড়িতে ফিরে যাব।
আমি চায়ের পেয়ালায় ফুঁ দিতে দিতে ছোট ফুপুর কাছে ফিরে এলাম।
—কি রে। তুই যে পিঠা খাচ্ছিস না।
আমি কোনো জবাব দিলাম না। কিন্তু এবার একটি প্রশ্ন করলাম : কি হয়েছে বলবে না!
ছোট ফুপু হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে নিলেন।
—অত সহজে ভুলবার পাত্রী তিশনা নয়। কি হয়েছে বলতে হবে।
—দূর পাগলি। হবে আবার কি।
–হবে আবার কি যদি তো দেশে ফিরে যাবার কথা বলছ কেন।
—সারা জীবন তোদের এখানেই থাকতে হবে না কি!
—থাকলেই-বা।
—খুব তো বললি, থাকলেই-বা। আজ বাদে কাল শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি—তখন?
—এ বাড়িতে আমি ছাড়া আরো লোক আছে।
—তারা থাকতে দেবে কেমন করে জানব?
–সে তুমি ভালো করেই জানো।
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা।
এক সময় ছোট ফুপুই বললেন : জানি বলেই যাচ্ছি মা। এখানে থাকা চলবে না।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছোট ফুপুর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে একটু হেসে তিনি আবার বললেন : বড়বুবুর সংসারে আমি নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছি না। দোষ তাঁর নয়— আমারই। বহুদিন একভাবে থেকে সেইভাবেই জীবনযাত্রাটা অভ্যাস হয়ে যায়। নতুন মানুষ এলে অসুবিধা হয়।
—তুমি এখন আর নতুন নও। তোমাকেও আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। বরং অভ্যাসের চাইতে কিছু বেশিই হয়েছে।
ছোট ফুপুকে নানাভাবে প্রশ্ন করেও ঠিক কি যে হয়েছে বুঝতে পারলাম না। তিনি কিছুই বলতে চান না। তবে জেনেছিলাম পরে। কিছুটা ছোট ফুপুই বলেছিলেন, বাকিটা শুনেছিলাম কনিজের কাছে। ব্যাপারটা হয়েছিল এই।
ফুপুজানের এক দেবর, নাম তাঁর বৈরাম খান, প্রায়ই নানা কাজে কলকাতা আসতেন। তিনি বরাবরই এসে উঠতেন পাইচ হোটেলের সমশ্রেণীর কোনো হোটেলে। এ নিয়ে ফুপুজানের মনে কোনো দুঃখ ছিল বলে কখনো মনে হয় নি; থাকলে আশ্চর্য নিপুণতার সঙ্গেই তিনি তা গোপন রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেবার যখন দেবর ভ্রাতৃজায়ার সঙ্গে বৈকালের অবসরে সাক্ষাৎ করতে এলেন তখন অকস্মাৎ ফুপুজান তাঁর শ্বশুরকুলের এই সুযোগ্য প্রতিনিধির প্রতি এতদিনকার সঞ্চিত অবহেলার কথা স্মরণ করে বড়ই বিচলিত হয়ে পড়লেন; বেশ ঘটা করে অঞ্চল প্রান্তে অশ্রু, মার্জনা করে তিনি অশান্ত চিত্তকে তখনকার মতো সংযত রাখলেন। দেবরকে অনেকবার করে অনুনয়-বিনয় অনুরোধ-উপরোধ করা হলো তিনি যেন অনুগ্রহ করে কল্যই এ বাড়িতে থাকবার জন্য পদধূলি দেন।
পাবনায় বৈরাম সাহেবের সাইকেলের দোকান আছে; সেই ব্যবসা সংক্রান্ত কাজেই তিনি কলকাতা আসতেন। এবার কাজ সেরেই তিনি ফুপুজানের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কালই আবার তাঁকে পাবনা ফিরে যেতে হবে বৈরাম খান এ কথা বলতেই ফুপুজানের অশ্রু প্রপাতে অঝোরধারা নেবে এলো। তিনি তাঁর স্নেহের দেবরকে এই কথাটি বুঝিয়ে দিলেন যে অবসরকালটাই সামাজিকতার সুবর্ণ সময়। ফুপুজানের পীড়াপীড়িতে বৈরাম সাহেব বিস্মিত হলেন কিন্তু পরদিন সকালেই টিনের বাক্সটি হাতে করে তিনি উপস্থিত। বৈরাম সাহেবকে আমি আসতে দেখেছি, চলে যেতেও দেখেছি; কিন্তু মাঝামাঝি সময়টার ইতিবৃত্ত আমার ভালো জানা ছিল না। বস্তুত লোকটাকে আমার একেবারেই ভালো লাগে নি। তাই তিনি যে ক’দিন ছিলেন, আমি তাঁকে এড়িয়েই চলতাম।
গোলগাল বেঁটে মানুষ, মাথায় কদমছাঁট চুল। গায়ের রঙ কেবল কালোই নয়, মেটে কালো। ছবিতে এক জাতের সাপের এই রঙ দেখেছি। চোখ দুটি ছোট ছোট; হাতের আর পায়ের আঙুলগুলো এত ছোট যে মনে হতে পারে সৃষ্টির মাঝপথে সৃষ্টিকর্তা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। সবচাইতে দর্শনীয় তাঁর ভুঁড়িটি। ভুঁড়িটি যে দর্শনীয় বোধ করি বৈরাম সাহেব নিজেও তা জানতেন—সুন্দরী রমণী যেমন তার গালের তিল সম্পর্কে সচেতন থাকে। বৈরাম সাহেব তাঁর লুঙ্গিটিকে ভুঁড়ির নিচে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখতেন। গায়ে একটি গেঞ্জি পর্যন্ত তিনি রাখতেন না। ভুঁড়ি দিব্যি এক চলন্ত জালার মতো সর্বত্র ঘুরে বেড়াত। তিনি যখন হাঁটতেন, ভুঁড়িটি চলত তাঁর আগে আগে।
সেদিন দস্তরখান সাজিয়ে তাঁকে খেতে দেওয়া হয়েছে। ফুপুজান হাত পাখা দিয়ে হাওয়া করছেন। বৈরাম সাহেব খেতে বসেছেন।
ছোট ফুপুর দরজার কাছেই দস্তরখান বিছানো হয়েছে। যাতায়াত করতে হলে এঁদের চোখের সামনে দিয়েই তা করতে হবে।
ছোট ফুপু মাথার ওপর লম্বা ঘোমটা টেনে ওপরে আসছিলেন কোনো কাজে—ফুপুজান এমন সময় তাঁকে ডাকলেন।
—ময়না যাচ্ছ কোথায়? এখানে একটু বোসো। তোমার বৈরাম ভাইয়াকে একটু হাওয়া করতো। আমার হাত ধরে এসেছে।
ময়না বুঝি নাম। বাঃ বেশ তো।
বৈরাম সাহেবের মুখে ছিল মাছের মুড়ো। ঠিক বোঝা গেল না কোন বস্তুটি বেশ। তবে তাঁর অবিরাম হস্তচালনা আপাতত স্থগিত থাকল।
ছোট ফুপুর পা দুটি কে যেন শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। তিনি না পারেন নড়তে না পারেন বসতে।
ছোট ফুপু তখনো লজ্জায় জড়সড় হয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বৈরাম সাহেব ভাতের থালা থেকে একবার চোখ তুলে সেদিকে তাকালেন।
আবার শুধু বললেন: বাঃ বেশ।
ছোট ফুপু লজ্জায় ঘামতে লাগলেন—শরীরটাকে বিন্দু পরিমাণ করতে পারলে বাঁচেন। কোনোমতে বললেন : বুবু আমার কাজ আছে। তারপর দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন।
—গলার আওয়াজটিও তো বেশ মিষ্টি।
বেশ বোঝা গেল যেখানে যতটা প্রশংসা প্রাপ্য সেখানে তা পৌঁছে দিতে বৈরাম সাহেব কৃপণতা করেন না।
ফুপুজানের হাতের পাখা নড়তে লাগল—এবং বৈরাম সাহেবের জিহ্বা।
তারই মাঝখানে ফুপুজান আর একবার বললেন : আহা বেচারি। বড় ভালো মেয়ে। তেরয় পা না দিতেই বিধবা হলো। এখনই-বা বয়স কত! সাধ-আহ্লাদ কিছুই পুরা হলো না। ওর জন্য বড় দুঃখ হয়।
ছোট ফুপু তখনো বৈরাম সাহেবের চক্ষু কর্ণের পরিধির বাইরে যেতে পারেন নি। এবার দু’কানে হাত দিয়ে সম্ভ্রম বাঁচিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব সেখান থেকে পালালেন।
বৈরাম সাহেব আরো একবার বললেন : বেশ বেশ।
ব্যাপারখানা তাহলে এই? কিন্তু আরো একটুখানি বাকি আছে।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা ফুপুজান তাঁর পানের ডিবা হাতে নিয়ে ছোট ফুপার ঘরে এলেন। বাড়িতে ইলেকট্রিক লাইট আছে কিন্তু ছোট ফুপু কদাচ বিজলি বাতি ব্যবহার করেন। তাঁর অন্য বহু আচরণের মতো এটারও সঠিক কারণ আমি আজও জানি না। তাঁর ঘরে জ্বলন্ত হারিকেন লণ্ঠন। হারিকেনের চিমনিটি কিছুদিন হলো হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে, নতুন চিমনি এখনো কেনা হয় নি। ফুপুজান খাটের ওপর বেশ জাঁকিয়ে তাঁর বসাটুকুতে অন্তরঙ্গতা ও কল্যাণকামনার এক সৌধ গড়ে তুললেন। ডিবা খুলে এক খিলি পান মুখে পুরে আর একটি ছোট ফুপুর দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন : আহা ময়না, তোমার মুখটি কেমন শুকিয়ে গেছে।
ছোট ফুপু সে পান নিলেন না; কোনো কথাও বললেন না। কিন্তু সংলাপ যেখানে চলে না সেখানেও স্বগতোক্তি দিব্যি চলতে পারে। ছোট ফুপু বসে বসে শুনলেন, তাঁকে শুনতেই হলো : বৈরাম সাহেব পাবনার এক বিশিষ্ট ব্যক্তি। পাবনায় সাইকেলের দোকান, ঈশ্বরদীতে মুদির দোকান আর সিরাজগঞ্জে কেরোসিনের এজেন্সি আছে। কাপড়ের কলেও আছে শেয়ার। মোটের ওপর ফুপুজান কথার সিঁড়ি তৈরি করে বৈরাম সাহেবকে এতটা উচ্চে তুলে ধরলেন যেখানে মানুষের দৃষ্টি পৌঁছায় ঈর্ষার বর্ণে রঞ্জিত হয়ে। কিন্তু ছোট ফুপুর দৃষ্টি অতটা ঊর্ধ্বে কিছুতেই পৌঁছতে পারছে না লক্ষ্য করে ফুপুজান এক সময় হঠাৎ চুপ করলেন।
—আচ্ছা। এবার উঠি। তা বাছা, হারিকেনের চিমনিটা বদলে নাও। যেভাবে আলোটা দপদপ করে দেখলে মনটা কেমন ঘাবড়ে যায়।
এই বলে ফুপুজান তাঁর পানের ডিবা, কথার সুধা ও উপদেশের ঝুলিসমেত বিদায় নিলেন।
ছোট ফুপু আঁধারে তেমনি চুপ করে বসে থাকলেন।
তারপর আরো একটু বাকি আছে।
রাত্রিবেলা ছোট ফুপু খাওয়াদাওয়ার পর খাটে শুয়ে আছেন। কামিল তখনো ফেরে নি। তার জন্য দরজা আছে খোলা। দরজার আড়ালে লণ্ঠনটা জ্বলছে।
এমন সময় ঘরে এসে ঢুকলেন বৈরাম সাহেব। ছোট ফুপু ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসলেন।
–হেঁ হেঁ এই নতুন চিমনিটা নিয়ে এলাম।
হাতে চিমনিটা ধরা আছে, চোখ দুটি ছোট ফুপুর ওপর।
ছোট ফুপুর তো গলা কাঠ, মুখে একটি কথা নেই।
বৈরাম সাহেব সেইভাবেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, ওষ্ঠে বিগলিত হাস্য। একটু পর শুধু বললেন : বেশ বেশ।
তারপর তাঁর নতুন কামিজটির একটি কোণ দিয়ে নতুন চিমনিটি লেগে গেলেন পরিষ্কার করতে।
সেই মুহূর্তে ঘরে এলো কনিজ।
–পোড়া কপাল আমার। এইখানে ছেঁড়িয়ে আপনি কি করছা গা। কুটুম মানুষ কুটুমের মতো-
কনিজের কথা শেষ হতে পারল না। পিছন থেকে ফুপুজান এলেন ঝড়ের মতো ছুটে।
—সব কথায় তোর সরদারি করবার দরকারটা কি রে! সর এখান থেকে। মেহমানের ইজ্জত রাখতে জানিস না।
—ওমা। তুমি যে অবাক করলে। মেহমানের ইজ্জত করতে হবে মেয়েমানুষের ঘরে টেনে এনে!
কনিজ তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফুপুজানের মাথা থেকে পা পর্যন্ত বুলিয়ে নিল—যেভাবে সে ঝাঁটা দিয়ে ঘর সাফ করে—তারপর বৈরাম সাহেবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত।
—আমি এই দাঁড়িয়ে থাকলাম। এখান থেকে এক পাও নড়ছি না। তোমাকে হাজার সালাম। ঢের ঢের দেখেছি বাবা কিন্তু তোমার জুড়ি দেখি নি।
কনিজের দিকে ফুপুজান কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন; কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মেহমানসহ ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। বাড়িতে এই একমাত্র কনিজকেই তিনি একটু ডরাতেন।
বৈরাম সাহেবের মুখেও এবার আর ‘বেশ বেশ’ শোনা গেল না।