প্রসন্ন পাষাণ – ১৩

তেরো

ছোট ফুপু সম্পর্কে কিছু বলতে গিয়ে আমার ভঙ্গিতে যদি বিহ্বলতা প্রকাশ পায়, সে অপরাধ আমি স্বীকার করে নেব।

ছোট ফুপুকে আমি যতই দেখি ততই আশ্চর্য হই। যদিও তাঁর ছেলেরই বয়স আঠারো, তবু তাঁর এমন নয়ন জুড়ানো রূপ যেই দেখবে তারই দৃষ্টি ছলছল করবে। ছোট ফুপু ফর্সা এ কথা বললে কিছুই বলা হয় না, কারণ ফর্সা অনেকেই হয়। কচি কলা পাতার মতো তাঁর ত্বক। মুখের ডৌলটিতে এমন এক ভরপুর পূর্ণতা ছিল যা স্থির নীরে পূর্ণচন্দ্রের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠত; আকাশের চাঁদের সুদূরতা তাতে ছিল না; এবং একটু আবেগেই দিঘির চাঁদের মতো সে মুখও উঠত নড়ে। তিনি যখন হাসতেন, তাঁর দুটি গালে টোল পড়ত; সে যে কি দৃশ্য যে দেখে নি বুঝবে না। তাঁর নাকের পাশে একটা ছোট কালো তিল; আমার কেবলই ইচ্ছে করত খামচে দি। কখনো তাঁর কাঁধে কখনো-বা নীবীবন্ধে চাবির গুচ্ছটি ঝুলত; চলবার সময় পদক্ষেপের সঙ্গে তার ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ মনের মধ্যে বাজাত বাঁশি।

এমন মানুষকে ভালো না বেসে উপায় আছে।

সুন্দর অনেকেই হয় কিন্তু ছোট ফুপু একজনই দেখেছি। বিশেষ করে তাঁর চলাটুকু আমার চোখের পাতার সঙ্গে মিশে আছে। চলায়, হাতের আক্ষেপে, কপালের উদ্যত একটি রেখায়, অধর কামড়ে ধরে চিন্তা করবার সেই ভঙ্গিটুকুতে এমন কিছু ছিল যাকে এক কথায় সুন্দর বললে সবটুকু বলা হয় না।

বিশেষ করে মনে পড়ে তাঁর চলাটুকু। আগেই বলেছি, তিনি পায়ে কিছু রাখতেন না। হাঁটতেন অতি ধীরে, মাটির ওপর পায়ের স্পর্শটুকু ঝরেপড়া ফুলের পাপড়ির মতোই নম্ৰ। তার সারা শরীর ভরা জোয়ার—কানায় কানায় ভরা রূপরস কলকল ছলছল করে উছলায়। এই রূপের কল্লোল কেবলই কান পেতে শুনতে থাকি।

সেদিন সকাল দশটা হবে, ছোট ফুপু সামনে একটি কুলো এক বোতল সর্ষের তেল কমলালেবুর খোসার একটা ছোটখাট পাহাড় এবং পেষা দাল নিয়ে রোদে বসেছেন। শিলনোড়ায় কমলালেবুর খোসাও পিষ্ট হচ্ছে। ছোট ফুপুর মাথায় ঘোমটা নেই। সকালবেলার রোদ তাঁর মাথার চুল হাতে-লাগা পেষা দাল সম্মুখের শিলনোড়া স্পর্শ করে চৌবাচ্চার পিছনের দেয়াল টপকে কোথায় ছুটে চলেছে জানি না।

আমি তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম।

—এ দিয়ে কি হবে ছোট ফুপু?

—তোকে শিখিয়ে দেব।

—দেব না, এখুনি দাও।

—এই নে খানিকটা হাতে ভালো করে ঘষতে থাক।

হাতে ঘষে দেখলাম, ময়লা উঠে আসছে।

—এ জিনিসটা কি, ছোট ফুপু!

—আমরা একে উটটান বলি। তোরা শহরের মেয়েরা বিলিতি সাবান মাখিস। আজকে গোসলের আগে এটা সারা গায়ে একবার মেখে দেখ। তোর জন্যই বানাচ্ছি।

—তাই বুঝি তোমার গায়ের চামড়া অমন।

—আমার গায়ের চামড়া বুঝি ভালো নয়!

—আহা তুমি যেন বোঝ না, আমি কি বলতে চাই।

—বুঝেছি মা বুঝেছি। আমি মরলে আমার গায়ের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চাস— এইতো! তা আমি লিখে দিয়ে যাব যাতে তোর ইচ্ছে পুরো হয়।

সামনের পাঁচিলে একটি কাক এসে বসল। তার মুখে একটি মরা ইঁদুর। কনিজ কোথা থেকে ছুটে এসে ঢিল ছুঁড়ে কাকটিকে তাড়িয়ে দিল। শিলের ওপর নোড়ার ঘষা লেগে এক আওয়াজ হতে থাকে—বসে বসে তাই শুনতে থাকি। দোরগোড়ায় এক ভিখিরি এসে অনেকক্ষণ ধরে অনেক দোয়া-দরুদ পড়ল, তারপর অনেকখানি চাল পেয়ে চলে গেল। গলিতে ছেলেরা টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলছে, সেটা এসে পড়ল চৌবাচ্চার পানিতে। বলের পরই ছুটে এলো দু’একটি ছেলে; কনিজ দূর দূর করে আবার তেড়ে এলো এবং বলটি ছুঁড়ে আবার পথে ফেলে দিল।

পরক্ষণেই ছেলেরাও উধাও।

—একটা কথা বলব ছোট ফুপু?

—কি কথা মা!

—তুমি যদি আমার মা হতে।

ছোট ফুপু তাঁর সেই তেল আর নেবুর খোসা মাখা হাত তুলে আমার মাথাটি তাঁর কোলের ওপর টেনে নিলেন।

আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই।

সেই রমজান মাসের পয়লা তারিখ থেকেই ছোট ফুপুর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। এখন রীতিমতো অন্তরঙ্গতা। বয়স এবং সম্পর্কের দিক দিয়ে ছোট ফুপু আমার উপরের সোপানে; তবু আমাদের কথায়-আলাপে দুই সখির সখ্যের সুর বাজত। মাঝে মাঝে আমার মুখ দিয়ে এমন দু’একটা বেফাঁস কথা বেরিয়ে যেত যা সখিকে বলা চলে কিন্তু ফুপুকে বলা চলে না। ছোট ফুপু ঠিক যে পছন্দ করতেন তা নয়। কিন্তু গায়েও মাখতেন না। তাঁর মুখের হাসিটি অম্লান থাকত; সহনশীলতাও অনেক সময় হাস্যের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়।

শীতের দুপুর। ছোট ফুপু উঠোনের এক ছায়াশীতল অংশে বসেছিলেন কেবল দুটি পা সম্মুখের রৌদ্রের দিকে প্রসারিত। শীত-দুপুরের রোদ তাঁর পায়ের ওপর আচ্ছাদনের মতো লম্বিত। আমি তাঁর পিছনে বসে তাঁর মাথায় উকুন আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলাম।

—ছোট ফুপু, ফুপাকে তোমার মনে পড়ে?

–পড়ে বইকি মা।

—মানে, আমি বলছিলাম কি। তোমার বয়স তো খুব কম। ফুপাও বছর না ঘুরতেই গেলেন মারা। বেশি কথা জমতে পারল কোথায় যে মনে পড়বে।

—বয়স কম কেন হবে মা। এক ছেলের মা, তার বয়সের কি গাছপাথর আছে।

—আচ্ছা। তাহলে আজ ফুপার কথাই বল। তার আগে বল তোমাদের গ্রামের কথা।

ধান মিয়া ফুপার নাম। তাঁর দেশ শিরগাঁ; কিন্তু তিনি ফরিদপুরের একটি গ্রামের মাদ্রাসায় মৌলবী ছিলেন। বিয়ের পর ছোট ফুপু সেই গ্রামেই থাকতেন; সঙ্গে ছিলেন শাশুড়ি।

গ্রামটা ছোট। কিন্তু কি কারণে কেউ বলতে পারবে না, সেখানে একটা রেল স্টেশন ছিল। সারা দিনে একটি আপ আর একটি ডাউন ট্রেন সেই স্টেশনে দাঁড়াত। লোক ওঠানামা করে, চেনা মুখই বেশি।

—রাজবাড়ির হাকিমের আদালতে মালা-মোকদ্দমা-সাক্ষীসাবুদ, এইসব কাজ সেরে ফিরে আসে। মাঝে মাঝে কেরোসিন কোম্পানির সাহেবদেরকেও যাতায়াত করতে দেখা যায়। তাঁরা এজেন্সি পরিদর্শন করেন—ডিপোর তদারকি। বাড়িতে বসেই মুদির দোকানে চাবি মার্কা কেরোসিনের সাইন বোর্ড দেখা যায়। ট্রেনের যাতায়াত আর যাত্রীদের আনাগোনা একটা উৎসবের মতো মনে হয়। গ্রামে একটি ছোটখাটো হাসপাতালও আছে। আশেপাশের বহু গ্রাম থেকে আসে ম্যালেরিয়া রোগী, বেঞ্চির ওপর বসে হাঁপায়। হাতে কুইনাইন এবং কখনো-বা লাল নীল হলুদ বর্ণের মিকশ্চার নিয়ে আবার ফিরে যায়। গ্রামে একটা মাদ্রাসা আছে, একটা পাঠশালা আছে। ছেলেরা সেখানে মাথা দোলাতে দোলাতে আমপারা আর ধারাপাত মুখস্থ করে।

গ্রামের প্রধান সড়ক দুটিও কাঁচা। সেখানে দিনের বেলা বড় বড় চাকার দাগ কেটে গরুর গাড়ি চলে। সন্ধাবেলা গরুর পাল ধুলা উড়িয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে গোয়ালে ফিরে আসে। মাঝে মাঝে সেই সড়ক দিয়েই সকাল-সন্ধ্যায় কেরোসিন কোম্পানির সাহেবদের মোটর গাড়ি ছুটে যায়। ট্রেন আসবার কিছু আগে স্টেশন মাস্টারকেও দেখা যায়, গেঞ্জির ওপর কোট চড়াতে চড়াতে ব্যস্ত হয়ে ছুটছেন। দু’ক্রোশ দূরে একটি থানা আছে। আসামিদের কোমর বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের পিছনে পিছনে বহুদূর পর্যন্ত কৌতূহলী ছেলেমেয়ের দল ছুটে যায়। বাড়ির মেয়েরাও দরজার কাছে এসে ভিড় করে দাঁড়ায়। ঘোষাল সকালবেলা বাঁশের দুই পাশে দড়িতে হাঁড়ি ঝুলিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে; ছোট ফুপুরা তাকে ডেকে এনে মাঠা কিনবেন গল্প করবেন। গল্প করাটাই ছোট ফুপুর আসল উদ্দেশ্য; বিকিকিনিটা অছিলা মাত্র। ঘোষাল সহজে ছুটি পেত না। কাছাকাছি ছিল এক বাঁশবন। এখন আছে কি না বলা যায় না; সেখানে ধান ভাঙার কল বসবে কথা হচ্ছিল। সেই বাঁশবনের মাথায় বর্ষাকালে বাজ পড়ত আর গোটা বনটাই পানিতে থৈ-থৈ করত। সাপ তাড়া করত ব্যাঙকে; ব্যাঙ মারত লাফ। ছোট ছোট গাছের পাতার নিচে ফড়িং থাকত লুকিয়ে। বর্ষাকালে বাগ্দী পাড়ার ছেলেরা ডিঙি বেয়ে এই বাঁশবন পর্যন্ত আসতে পারত।

—ফুপা থাকতেন কোথায়?

—ঐ যে বললাম হাসপাতালের পাঁজর বের করা বেঞ্চিগুলোর কথা—সেইখানে।

হাসি নয়, সত্যি করে বল।

সত্যিই বলছি। উনি ছিলেন বাতের রোগী। তার ওপর ছিল হাঁপানি।

তাঁকে সকাল-সন্ধ্যা হাসপাতালে যেতে হতো।

তুমি কি করতে?

আমি? বাঁশবনের কাছে একটা গাছের গুঁড়িতে চুপ করে বসে থাকতাম। পায়ের নিচ দিয়ে বর্ষার পানিতে খড়কুটা ভেসে যেত। পা দিয়ে তাই নাড়তাম।

এইভাবেই সারা দিন কাটত?

এইভাবেই বহু সময় কাটত। মাঝে মাঝে তোমার ফুপা সন্ধ্যাবেলা হাসপাতাল থেকে ফিরবার সময় আমাকে ঐভাবে চুপ করে বসে থাকতে দেখতেন। বলতেন : বউ বাড়ি ফিরবে না!

ফস করে আমার মুখ দিয়ে এই প্রশ্নটি বেরিয়ে এলো : একটা সত্যি কথা বলবে? ফুপার মুখের বউ ডাক তোমার ভালো লাগত?

ছোট ফুপু, একটু অবাক হলেন; কিন্তু আমার প্রশ্নের কোনো জবাবই দিলেন না। তাঁর পূর্ব কথারই খেই ধরে বললেন : এই স্মৃতিটুকু নিয়েই তো বেঁচে আছি।

আবার এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলাম : সত্যি তুমি বেঁচে আছ?

ছোট ফুপুর চোখমুখ চকিত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল।

চৌবাচ্চার পানি একটি কোণ দিয়ে উপচে গড়িয়ে একটি ক্ষীণ ধারার মতো ছোট ফুপুর প্রসারিত পায়ের কাছ দিয়ে বয়ে নর্দমায় গিয়ে পড়ছে।

সেই ক্ষীণ স্রোতের পথে শ্যাওলা পড়ে গেছে।

ছোট ফুপু আর কোনো কথা বললেন না। তাঁর পায়ের একটি আঙুল দিয়ে সেই সিক্ত ধারার ওপর আঁচড় কাটতে লাগলেন।

আমাদের এমন ধারা সভা প্রায়ই বসত। ছোট ফুপু আর ছোট ফুপা সম্পর্কেও অনেক কথা একটু একটু করে জেনে নিলাম। ছোট ফুপু আরবি আর ফার্সি পড়েছেন—ইংরেজি একেবারেই না; বাংলা তিনি ভালোই জানেন। প্রথম বয়সে যেসব বই পড়েছেন আজও সেগুলোর কথা তাঁর মনে পড়ে। মেঘনাদবধ কাব্য, বায়াজিদ বোস্তামি, হুতোম প্যাঁচার নকশা, বিষাদ সিন্ধু, আনোয়ারা, আবদুল্লা, বিষবৃক্ষ, উদ্‌ভ্রান্ত প্রেম, বিষের বাঁশি—এবং এ সব কটি গ্রন্থই নির্বিশেষে তাঁর সমান ভালো লেগেছিল।

ছোট ফুপা ছিলেন মাদ্রাসার মৌলবী সাহেব। তাছাড়া তিনি বাড়িতে বাড়িতে মিলাদও পড়তেন। ফুপার আরবি, ফার্সির জ্ঞান, মান মর্যাদা, শ্মশ্রুগুঙ্কের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-সিন্দুকে রাখা টাকাকড়ি এবং সর্বোপরি বয়স—সবকিছুই ছোট ফুপুর প্রয়োজনের তুলনায় বড্ড বেশি ছিল।

অবশ্য ছোট ফুপুকে তিনি সর্বপ্রযত্নে সর্বপ্রকার অভাবের ঊর্ধ্বে ধরে রাখবার চেষ্টা করেই গিয়েছেন। নতুন শাড়ি রঙবেরঙের চুড়ি, সোনাদানা সবকিছুই দিনের পর দিন আসতেই থাকে; ছোট ফুপুর মনের বস্তায় একটা একটা করে তা জমাও হতে থাকে। কখনো যে তার বেশি কিছু হয়েছে আমার মনে হয় না।

রাত্রি যখন তার কালো ছায়া ফেলে আসত মৃত্যুর মতো অনিবার্য নিয়মে, মাটির ঘরে একটি খাটের ওপর প্রদীপের সামনে পা গুটিয়ে বসে থেকে ছোট ফুপু তখন শুধু কাঁপতে থাকতেন; প্রদীপ শিখাটির মতো কাঁপতেন, পিছনের বাঁশ ঝাড়ের মতো কাঁপতেন, কাঁপতেন অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এক বালিকার মতো।

নিত্য ঠিক সেই সময়টাতেই দরজার কাছে ফুপার লম্বা ছায়া পড়ত। ফুপা দাড়িতে নিয়মিত মেহেদি লাগাতেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাড়িতে আস্তে আস্তে হাত বুলাতে থাকতেন, আর স্থির চোখে চুপ করে বসে থাকা ছোট ফুপুর সারা শরীরের ওপর তাঁর নজর নিতেন বুলিয়ে। মুখে তাঁর এক বিচিত্র হাসি।

খাটে ভয়ের এক কুণ্ডলীর মতো ছোট ফুপু আছেন বসে আর দরজার কাছে ফুপা স্থির হয়ে আছেন দাঁড়িয়ে—তাঁর মুখে সেই হাসি তাঁর চোখে সেই দৃষ্টি—এইভাবেই বহুক্ষণ যেত কেটে।

তারপর এক সময় ধান মিয়া ফুঁ দিয়ে বাতি দিতেন নিভিয়ে।

ঠিক এইভাবেই কি ছোট ফুপু তাঁর বিবাহিত জীবনের গল্প করতেন? না। তবু তাঁর শতপ্রকার সতর্কতার বেড়া সত্ত্বেও, যে ছবিটি আত্মপ্রকাশ করত তা এই। গল্প করতে করতে তাঁর মুখের ওপর একটি কালো ছায়া ঘনিয়ে আসত; তখনো-বা কপালে দেখা দিত বিন্দু ঘাম।

তবে গ্রামের একটি অভিজ্ঞতা তাঁর খুবই ভালো লাগত। সে হচ্ছে পূর্ণিমা রাত।

কেমন করে বড় বড় গাছের মাথার ওপর, বাড়ির ছাতে, চোখে-মুখে, পাকা ধানের মরাইয়ে তাল গাছের পাতার ফাঁকে পূর্ণিমার আলো গলিত স্বর্ণের মতো ঝরঝরঝর করে ঝরতে থাকে সে কথা বলতে গিয়ে তাঁর দুটি চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। মাটির ঘর, পাশ দিয়েই একটা নৰ্দমা চলে গেছে। সেখানেই একটি গরু বাঁধা থাকত। নর্দমার কালো পানিতেও জ্যোৎস্না চকচক করত। সেই নোংরা পানিও যেন তখন গরুর দুটি শান্ত চোখের মতোই গভীর; গরুর চোখ দুটিতে, তার মুখের খড়েও জ্যোৎস্না সোনার মতো লেগে থেকে চিকচিক করত। গরু নিরুপদ্রব শান্তিতে দাঁড়িয়ে থাকত, শুধু মাঝে মাঝে পা ঠুকে তাকে মশা তাড়াতে হতো।

ছোট ফুপু এবং অন্য গ্রাম্যবধূরা অনেক রাত পর্যন্ত আঙিনায় বসে গল্প করতেন। কারো মুখে রূপকথা; কেউ-বা শোনাতেন শৈশবের স্মৃতিকথা। কারো নিন্দা নয়, অমঙ্গল চিন্তা নয়; পরচর্চা নয়—সেসব দ্বিপ্রহরের প্রখর মুহূর্তগুলোর জন্য। গৃহস্বামীরা আহারের জন্য তাড়া দিতেন না। তাঁরা একটু দূরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকতেন দল বেঁধে, মুখে হুঁকো বা বিড়ি এবং মাঝে মাঝে একটি কি দুটি অলস মন্তব্যের বুদ্বুদ। মেয়েদের কানে পুরুষদের আধখানা কথা ভেসে আসত; পুরুষরাও শুনতেন চুড়ির একটুখানি শব্দ। তাঁদের মাঝখানে জ্যোৎস্নার মসৃণ আস্বচ্ছ পর্দা ঝুলতে থাকত—এবং তারই আবরণ ভেদ করে দিনের কর্মব্যস্ত ঘর্মাক্ত- কলেবর উষ্ণমেজাজ মানুষটিকে এই সময় একটু কোমল রহস্যময়, একটু কাঙ্ক্ষিতই মনে হতো। ডোমপাড়ার শূকরও চারদিক ঘুরে এসে এই নর্দমার পাশে দাঁড়াত, চুকচুক করে নর্দমার পানি খেত। এই চুকচুক শব্দটিও নিস্তব্ধ রাত্রে কানে বড় মিঠে লাগত। আমগাছের ঘন পল্লবের মধ্যে বসে হঠাৎ একটি কাক উঠত ডেকে। সুপুরি গাছটির ওপর জ্যোৎস্নার বন্যা চুইয়ে চুইয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে পানিতে। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সাদা বিড়ালটিকে মনে হয় পিতলের।

ভালো লাগে, সবকিছু ভালো লাগে।

তবু ধান মিয়াকে ছোট ফুপুর ভালো লাগে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *