এক
That is my home of love; if I have ranged,
Like him that travels, I return again-
Shakespeare
জীবনের লেনদেন সবকিছু চুকিয়ে-বুকিয়ে অস্তাচলের কাছে যখন পৌঁছে গেছি, তখন অকস্মাৎ আত্মকাহিনীর অলিখিত পাণ্ডুলিপিটি চোখের সম্মুখে মেলে ধরে আজ কত প্রকার দ্বিধাই-না বাধা দিচ্ছে। বলবার মতো কথা যে একেবারেই কিছু নেই তা নয়, তবু আমার জীবনের ঘটনাবলি সাধারণ মানব জীবনের সুখ-দুঃখকে কোথাও অতিক্রম করে নি।
এক মুসলিম পরিবারের কন্যা আমি। অন্যান্য আর দশটি মেয়ের মতোই শৈশবের ক্রীড়ায়, কৈশোরের স্বপ্নচয়নে, এবং যৌবনে সমর্পিত চিত্তে স্বামীর ক্রোড়ে আমার এই জীবন তরীটি সুখ-দুঃখের জোয়ার-ভাটায় আছাড় খেয়ে সহজেই তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারত। কিন্তু বয়স যখন অল্প, বুদ্ধি অপরিপক্ক, তখন থেকেই কেমন করে যেন আমার জীবনের সহজ ঘটনাগুলো একটির পর একটি জটিল পাঁকে জড়িয়ে যেতে লাগল। পরিণামে অলক্ষ্যে বহু অশ্রুপাত করতে হয়েছে, বুকের মধ্যে বহু গোপন কথা দুঃখের পাহাড়ের মতো বসে থেকেছে। তবু জীবনের কাছে আমার দেনা আর পাওনার হিসাব-নিকাশ যখন মিলিয়ে দেখি তখন মনে হয়, এই বুঝি ভালো হয়েছে। দুঃখের দহনে আমাকে পুড়তে হয়েছে আর দশজনের চাইতে বেশি; কিন্তু বিধাতা তারই তুল্য সহনশক্তিও আমাকে দিয়েছিলেন। আমার কোমল বক্ষের কম্পান্বিত তন্ত্রীগুলো জীবনের কোনো কোনো অভিজ্ঞতায় শুষ্ক তৃণের মতো নির্জীব হয়ে গিয়েছিল সত্য। সেসব অভিজ্ঞতার বেদনা যে কি সে আমিই জানি; কিন্তু তার মধ্যে কি সুখ একেবারেই ছিল না? ছিল!
সে কথাই আজ বলতে বসেছি। এবং বলতে বসে বারবার এই কথাই আজ মনে হচ্ছে, স্বচ্ছন্দ সার্থকতায় মণ্ডিত জীবন আমি চাই নে। আমি যা পেয়েছি সেই আমার ভালো।
আজকের এই শিথিল চর্ম বিরল কেশ অর্ধবৃদ্ধার ছবি দেখে তার যৌবনের রূপ তুমি কল্পনাই করতে পারবে না। বলবে—এটা রূপের দেমাক? তা বল। কিন্তু রূপ যে আমার ছিল গো। কপালে এত দুঃখ ছিল বলেই অঙ্গে এত রূপ ছিল। একই অঙ্গে এত রূপ কি করে ধরতে পারে মনে করে কবি অবাক হয়েছিলেন। আমার পরিমণ্ডলে যাদের বিচরণ ছিল তারা কেউ বৈষ্ণব ছিল না; তাই হয়তো তাদের মধ্যে বাক্যের কিছু আধিক্যই পরিলক্ষিত হতো। আত্মীয়মহলের যুবক সম্প্রদায় ভাবের যেসব ফানুস উড়িয়ে দিত, নিশ্চয়ই আমিই ছিলাম সেগুলোর মাধ্যাকর্ষণ; কারণ ফানুসগুলো আমারই পদপ্রান্তে এসে লুটিয়ে পড়ত। এবং তার ভাবসম্পদকে অন্য যে নামই দেওয়া যাক, নির্মল আধ্যাত্মিকতা দোষ তার ছিল না। বরঞ্চ বলতে পারি, সে ভাবের মধ্যে সোমরসেরই কিছুটা আতিশয্য থাকত।
এই বাহুল্যতে কি আমার অরুচি ছিল? এই প্রশ্নের যে উত্তরটি শোভন হবে সেটি সত্য হবে না। কিন্তু সত্য কথা বলবার অঙ্গীকারেই এই কাহিনী শোনাতে বসেছি।
না—অরুচি আমার ছিল না। স্তাবকের দলটির যে বস্তুটিকে আমি এড়িয়ে চলতাম সেটি হচ্ছে তাদের নিকট সান্নিধ্য। এবং যে বস্তুটিকে এড়িয়ে না চললেও ক্ষতি ছিল না, এমনকি মনে হতো এড়িয়ে চললেই ক্ষতি, সে হচ্ছে তাদের গুণগ্রাহিতা। আমাদের দৃষ্টি বা কর্ণের পরিধির মধ্যে দেখতে পেলেই, তাদের পিরান ও চাপকানের জেবের ভিতর দিয়ে যেসব কাব্যকণিকা স্ফুলিঙ্গের মতো বেরিয়ে আসত, যদিচ আমিই ছিলাম সেগুলোর প্রেরণাস্থল, আমার বক্ষকে দগ্ধ করাই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য।
হাতের মুঠি কতটা আলগা করলে লোকসানের আশঙ্কা নেই আমি জানতাম; এবং ততটা আলগা না করলে আমার ভালোও লাগত না। সত্য কথাটি হচ্ছে এই। কিন্তু একথা ঠিক, আমি আমার অনুগ্রহ প্রার্থীদেরকে এক কঠিন ঔদাসীন্যের পারাবারের নিরাপদ পার্শ্বটিতেই দাঁড় করিয়ে রাখতাম। তাদের মধ্যে এত বড় দুঃসাহসী কাণ্ডারি কেউ ছিল না যে সেই ব্যবধান পেরিয়ে আসবে।
তোমরা বলবে, বেশ মেয়ে যা হোক। ধরবে কিন্তু ধরা দেবে না। অন্যকে কাছে টানবে, নিজে যাবে দূরে সরে।
মুখে যাই বল না কেন, কিন্তু বুকে হাত রেখে বলতে পার, তোমরাও এ খেলা খেল নি? আমিও তো মেয়েমানুষ। আমার চোখকেই-বা কি করে ফাঁকি দেবে? স্বজাতিকে কি আমি চিনি নে।
দুই কুড়ি পাঁচের চৌকাঠে পা দিয়ে আজ বলতে পারি, মেয়েমানুষের অতটা স্বাধীনতা ভালো নয় যতটা আমার ছিল। এ স্বাধীনতায় আজ আর আমার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এককালে, সেই বহুদিন আগে, যখনকার কথা দিয়ে এই আখ্যান শুরু করেছি, তখন এই বস্তুটিতে আমার বড়ই প্রয়োজন ছিল। সেকালে নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে আমার কোনো সু-পরিস্ফুট মতামত হয়তো ছিলই না; থাকলে আজকের এই মতটির সঙ্গে তার কোনো সদ্ভাব থাকবার কথা নয়। কিন্ স্বাধীনতা বস্তুটিই এত অধিক পরিমাণে উপস্থিত ছিল যে অনুপস্থিত মতামত কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে নি।
আমার আব্বা ছিলেন জিলা ম্যাজিস্ট্রেট। আজ এখানে তো কাল সেখানে এইভাবে তাঁর বদলি হতে থাকত। বিদ্যাভ্যাসের জন্য এই সদা সঞ্চরণশীল অবস্থাটা খুব উপযোগী নয়, তাই আমি থাকতাম আমাদের কলকাতার বাড়িতে। আমার মাথার ওপর ছিলেন চাচা—এবং পশ্চাতে ছায়ার মতো আমার বিধবা ফুপু। যখনকার কথা বলছি তখন আমি সেয়ানা হয়ে গেছি। তাই আমার প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে জাহান্নামের পথে নিয়ে যাচ্ছে কি না এই দুশ্চিন্তায় আমার ফুপুর দ্বিপ্রহরগুলো অনিদ্রার পীড়নের মধ্য দিয়েই অপরাহ্ণের ঘণ্টা বাজাত। অপরাহ্ণ যখন আমাদের বাড়ির বারান্দায় আলোছায়া—আলিমপনের মাদুর বিছিয়ে দিত, তখন কোলের কাছে পানের বাটা আর চারপাশে পড়শিদের বসিয়ে রেখেও নিশ্চিন্ত মনে তিনি সঙ্গসুধা পান করতে পারতেন না। অমন যে বস্তু তাম্বুল তাও বিস্বাদ হয়ে যেত সেই একই কারণে। তারপর আসত রাত্রি—তার আড়াল নিয়ে তার আঁধার নিয়ে তার গোপনীয়তা নিয়ে। আর ফুপুজানের দুটি চোখ এই অন্ধকারেও বিড়ালের মতো জ্বলতে থাকত—আমার গতিবিধির ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে। অবশ্য এই সময়টা আমার গতির দৌড় ছিল স্নানঘর পর্যন্ত, এবং বিধির খবর একমাত্র বিধাতাই জানেন।
অবশ্য শতপ্রকার প্রাকার তুলেও নরজগতের স্পর্শ থেকে আমাকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করা ফুপুজানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ আমার নরলোকের নাগরিকেরা ছিল আমারই চাচা মামা ফুপা খালা ভাইয়েরা। তাদের যাতায়াত সম্পর্কে ফুপুজানের মনোগত অভিপ্রায়টা যাই হোক না কেন তা অব্যক্তই থাকত। মুখ ফুটে তিনি কিছুই বলতে পারতেন না; কারণ ছেলেরা ভাইয়ের বা বোনের বা কুটুমের সন্তান। এই সন্তান সম্প্রদায়টিও গুরুজনের প্রতি ভক্তিতে আদর্শস্থানীয় ছিল। বিনা ব্যতিক্রমে তারা সকলেই ফুপুজানকে সাড়ম্বরে ভক্তি প্রদর্শন করত, এবং একদিনের অদর্শনেও নিরতিশয় বিচলিত হয়ে পড়ত। তবু এ কথা বলতে পারব না, সন্তানস্থানীয়দের সঙ্গে স্বয়ং ফুপুজানের আচরণে কোনোপ্রকার আর্দ্র কোমলতার পরিচয় থাকত।
যতসব বিস্ফোরণ আর বিপ্লব সবই ফুপুজানের বুকের মধ্যেই আলোড়ন সৃষ্টি করত। দৃষ্টির এলাকায় যখনই তিনি কোনো পিসিসঙ্গকাতর যুবাকে দেখতে পেতেন, তখনি পাশে পড়ে থাকা হাত-পাখাটি তিনি তুলে নিতেন। তরুণ যতই নিকটবর্তী হতো, ফুপুর পাখাও ততটাই দ্রুত সঞ্চালিত হতে থাকত। গ্রীষ্মকাতরতা এই প্রাণপণ পক্ষ সঞ্চালনের কারণ নয়।
এই গোলগাল ফর্সা স্নেহপ্রবণ বিপদাশঙ্কাদীর্ণ মানুষটি কিছুই বলতে পারতেন না, কেবল তাঁর হাতের পাখা নড়ত, তাঁর হৃৎপিণ্ড লম্ফ দিত, আর তাঁর শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ত।
ছেলেদের মধ্যে সবচাইতে চৌকস ছিল আলীম। ফর্সা ছেলে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখ দুটিতে দুষ্টুমির স্ফুলিঙ্গ।
বৈকালের ছায়া যখন সম্মুখের লোহার গেটের মাথা পর্যন্ত উঠে আসত, তখুনি আলীমকে আমাদের বাড়িতে দেখা যেত। সন্তর্পণে সেই গেটটি খুলেই সে অন্দরে প্রবেশ করত। লক্ষ্য করবার বিষয়, আলীমের কোনো আচরণেই অকারণ দ্রুততার হঠকারিতা ছিল না। যেন তার সব কাজের পিছনেই দীর্ঘকালের চিন্তা আছে। অন্য ছেলেদের মতো সে গেট খোলা রেখেই চলে আসত না। খুব সাবধানে দুটি হাত দিয়ে গেট খুলত, ততোধিক সাবধানে বন্ধ করত, তারপর মন্থর পায়ে এগিয়ে আসত। তার ভব্যতা আর সুবিবেচনায় সকলেরই খুশি হবার কথা; কিন্তু অন্তত ফুপুজান হতেন না। আলীমকে এইভাবে এগিয়ে আসতে দেখে তাঁর চোখ কান হাত মুখ সবকিছুই কঠিন আকার ধারণ করত। অবশ্য তরুণ সম্প্রদায়ের যে-কোনো প্রতিনিধিই তাঁর শিরঃপীড়ার কারণ; তবু আলীমের যে অভ্যর্থনা হতো তার এক বৈশিষ্ট্য ছিল।
আলীমের পরনে কালো রঙের ফুটবল খেলার হাফ প্যান্ট, গায়ে সাদা রঙের স্পোর্টস শার্ট—এবং বগলে একটা নতুন টি-শেপড ফুটবল।
—ফুপুজান, সালাম আলায়কুম।
আলীম প্রত্যহ এইভাবে সম্মুখে এগিয়ে এসে বিচিত্র ভঙ্গিতে পা দুটির ওপর এইভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে, ফুটবল থাকলে তা ঠিক এইভাবেই বগলের নিচে চেপে, এই একই সম্ভাষণ দিয়ে তার আলাপ শুরু করে, এই অনিত্য সংসারে তার চরিত্রের নিত্যতার পরিচয় দিত। মাতৃস্থানীয়ার প্রতি তার এই সম্ভাষণ বা আচরণে অতি বড় ছিদ্রান্বেষীও কোনো ত্রুটি আবিষ্কার করতে পারবেন না। তার দুটি চোখের দৃষ্টির অন্তরালে যে পরিমাণ কৌতুকই নৃত্য করতে থাকুক না কেন, ফুপুজান যে দুটি চোখ দেখতে পেতেন তার দৃষ্টি শ্রদ্ধায় তাঁরই পদপ্রান্তে অবনত।
ফুপুজান অবশ্য কোনো জবাবই দিতেন না—সেইভাবেই বসে থাকতেন। কেবল তাঁর হাতের পাখা যেভাবে নড়তে শুরু করত তা দিয়ে তামাম দুনিয়া থেকে গ্রীষ্মকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা চলত।
ফুপুজানকে এইভাবেই তার সম্মান জানিয়ে আলীম তার মনোযোগের উপঢৌকন আমার কাছে নিয়ে আসত। কিন্তু ফুপুজানের সীমান্ত থেকে আমার মনোরাজ্যের দুয়ার পর্যন্ত পথটুকু দৃষ্টির শরের দ্বারা আকীর্ণ থাকত। সেই শর মনকে বিদ্ধ করলেও শরীরের কোনো হানি ঘটাতে পারে না। তাই আলীম বারংবার তার সেই পরিমিত পদক্ষেপে অগ্রসর হয়ে তার চর্মের অপরিমিত স্বাস্থ্যের পরিচয় দিত। ফুপুজানের দৃষ্টির বিষক্রিয়া তার কোনোই ক্ষতি করতে পারত না।
বাজে কথা খরচ করাও আলীমের স্বভাব ছিল না। আমার টেবিলে নেসেলস চকোলেটের একটা মোড়ক রেখেই সে নীরবেই ফিরে যেত। এই ছিল তার ধরন।
কেবল হাতের ফুটবলটিকে সে একবার উপরের দিকে নিক্ষেপ করে আবার লুফে নিত, আর একবার মাটিতে সজোরে আছাড় দিয়ে ধরে ফেলত। এইভাবেই সে গেটের দিকে ফিরে যেত।
কোনোদিন হয়তো গেটের কাছ থেকেই আবার ফিরে আসত।
—ফুপুজান আপনার বাগান থেকে একটা ফুল নিতে পারি?
—বাপ আমার, কোন কাজটির জন্যই তুমি আমার অনুমতির অপেক্ষা রাখ যে এখন এত ঘটা করে জিগ্যেস করতে এসেছ।
—নেব একটা ফুল?
যাচ্ছ খেলতে ফুটবল, ফুল কি কাজে আসবে?
আলীমের ঘাড় নিচু, কণ্ঠে সেই একই প্রশ্ন।
—ফুপুজান, নেব একটা ফুল?
এরপর ফুপুজানের রাগের তাপমাত্রা এত বেড়ে যেত যে তাঁর মুখে আর কথা জোগাত না।
কিন্তু আলীম কি সেই ছেলে যে পরের দ্রব্য বিনা অনুমতিতেই নিয়ে চলে যাবে! সুতরাং আবার সেই প্রশ্ন : নেব?
—নাও বাছা নাও। নিয়ে আমাকে রেহাই দাও।
আলীম কোনোরকম আবেগ প্রকাশ করত না। বৃত্ত থেকে একটি লাল গোলাপ ছিঁড়ে নিত
—ফুপুজান, আসসালাম আলায়কুম।
সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে ঠিক দস্তুর মতোই সে সালাম করত।
ফুপুজান তার সালামের কোনো জবাব দিতেন না, এ নিয়ে আলীমের মনে কোনো দুঃখ বা বিকার ছিল না।
গেট খুলবার শব্দ হতো, ঝনাৎ করে বন্ধ হলো তাও বোঝা যেত আর আলীমের পদশব্দ একটু একটু করে মিলিয়ে যেত।
যাবার আগে আলীম গোলাপটিকে তার প্যান্টের পকেটে পুরে ফেলত। লাল গোলাপের উপযুক্ত স্থান ফুটবল খেলার প্যান্ট নয়; কিন্তু আলীমের স্থূল হস্তে পুষ্পের এই পরিণামই হতো।
ফুপুজানের সঙ্গে আলীমের সংলাপের যে নমুনা তোমরা শুনলে বিশ্ব সাহিত্যে স্থান পাবার যোগ্য উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা সেভাবে কথা বলে না আমিও জানি; কিন্তু কি করব বল? এমন ধারা কথাই যে হতো। বিশ্ব সাহিত্যের স্বার্থে আমার সততার আদর্শটিকে খাটো করে না হয় অন্য প্রকার সংলাপের অবতারণাই করতাম; কিন্তু তোমাদের কি মনে হয় না, তাতে সততাই কেবল খাটো হতো, বিশ্ব সাহিত্যের কোনোই উন্নতি হতো না? প্রথম কথা—উপন্যাসের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিরা যেসব চিরস্মরণীয় কথা বলেন তা উদ্ভাবন করবার মতো সৃজনীশক্তিই আমার নেই। আমি যা দেখেছি আর শুনেছি, মোটা করে কেবল তাই বলতে পারি। সে কথা যদি তোমরা শুনতে না চাও, আমিও পীড়াপীড়ি করব না; কিন্তু অপরের কথা আবৃত্তি করে হাস্যাস্পদ হতে চাই নে।
একে ফুপুজান চোখে ভালো দেখতেন না; তার ওপর গোধূলিবেলায় আমার প্রায়ান্ধকার কক্ষটিতে কি ঘটল সেই অনিশ্চয়তা সম্পর্কে কোনো প্রকার তদন্ত না করেই স্থির থাকবেন ফুপুজান সে ধাতেই তৈরি নন। আলীম আমার কক্ষে প্রবেশ করেছে, এবং টেবিলের ওপর কি যেন একটা রেখেই চলে গেল, কেবল এইটুকুই ফুপুজানের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি তোমার ছায়াসঙ্গিনী, কেবল এইটুকু দেখলেই তার চলবে কেন?
অবশ্য আমার গতিবিধির স্বাধীনতা কোনো গণ্ডির দ্বারা চিহ্নিত ছিল না। কেবল তাই নয়, যাবতীয় ব্যাপারে আমার মতের মূল্য যাই হোক না কেন, আমার মর্জি সকলকে মেনে চলতে হতো। সংসারে যে এরই মধ্যে আমার ব্যক্তিত্ব এভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল বিনা আন্দোলনে তা সম্ভব হয় নি। তবে স্বয়ং আমাকে আমার অধিকারের জন্য কোনোদিন সংগ্রাম করতে হয় নি; আমার হয়ে এই দুরূহ কাজটি সেরে নিয়েছিলেন আমার ছোট চাচা। আমার বয়স ছিল সবে বারো, তবু আমার শুভবুদ্ধির ওপর ছোট চাচার অগাধ আস্থা ছিল। তাছাড়া তিনি বলতেন, জীবনে ভুল না করলে ঠিক জিনিসটি কি মানুষ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে না। তাই ভুল করবার অধিকার তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। তবে যতটা সহজে বললাম, অত সহজে এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এই নিয়ে তাঁকে বিস্তর কথা-কাটাকাটি করতে হয়েছে, অজস্র তিক্ত কটাক্ষ হাস্যমুখে অগ্রাহ্য করতে হয়েছে। আমার শিক্ষাদীক্ষা চালচলন সম্পর্কে যখনই কোনো আলোচনা হতো সেই আলোচনার প্রধান নিয়ন্তা আমার ছোট চাচা, প্রথম হন্ত্রী ফুপুজান—এবং আব্বা একেবারে তৃতীয়, ধর্তব্যের মধ্যেই নয়, কারণ তাঁকে কোনো ঝক্কিই পোহাতে হতো না। তবে দ্বিতীয় ব্যক্তিটি কমজোর ছিলেন না; তাই একদিকে ফুপুজানের শাসন এবং অন্যদিকে ছোট চাচার প্রশ্রয় এই দুই বিপরীত শক্তির মাঝখানে থেকে আমার অবস্থাটা গোড়ার দিকে খুব সুখের ছিল না। ফুপুজান শতপ্রকার অভিযোগে বারবার আমাকে অভিযুক্ত করতেন; ছোট চাচার হাইকোর্টে প্রতিবার আমি বেকসুর খালাস হয়ে যেতাম। শেষ পর্যন্ত ছোট চাচারই জয় হলো। ফুপুজান ঠিক করলেন আমার কোনো কাজেই আর বাধা দেবেন না। কেবল ছোট চাচাকে বলেছিলেন : বেশ, মেয়েকে তোমার হাতেই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু বাচ্চু, দেখ মেয়ে যেন মানুষই হয়।
ছোট চাচা সে কথার কোনো জবাবই দিলেন না। অল্প একটু হাসলেন, তারপর আমাকে একেবারে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আমার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলেন।
ছোট চাচা কথা বলতেন খুব কম। তখনো কিছুই বললেন না। কেবল আড় চোখে ফুপুজানের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। পক্ষী যেভাবে তার নীড় আঁকড়ে থাকে, আমি সেইভাবে ছোট চাচার বুকের ওপর মাথা গুঁজে দিলাম।
তাই বলছিলাম, ফুপুজানের অনিচ্ছাশক্তির সঙ্গে যখন আমার ইচ্ছাশক্তির ঠোকাঠুকি হতো তখন আমিই জয়ী হতাম।
কিন্তু চোখেরও এক প্রকার ভাষা আছে এবং তার এমনই তেজ যে মুখের ভাষা তার কাছে শিশু। দুটি চোখের দৃষ্টি কি না বলতে পারে। স্নেহ মমতা প্রেম ভালোবাসা ক্রোধ রোষ কোন ভাবের কথাটাই-না মানুষের দুটি চোখ ব্যক্ত করতে পারে। জবাব খামোশ রেখে ফুপুজান আইন বাঁচিয়ে চলতেন; কিন্তু চোখের নীরব ভাষার পীড়নকে তো কোনো আদালতই জুলুম বলবে না। এবং এই নীরব ভাষার ওপর ফুপুজানের দখল ছিল পাকা
আমার কামরাটির সামনে একটি সরু বারান্দা ছিল, যেখান থেকে একতলায় যাবার সিঁড়ি নেবে গেছে। আলীম চলে যাবার পর ফুপুজান সেইখানেই উঠে আসবেন। তারপর তাঁর অস্থির মনের অধীরতা তাঁর দুটি পায়ের ওপর নেবে আসবে। সেই বারান্দায় তিনি পায়চারি করে বেড়াবেন।
আলীম রেখেটা গেল কি? যতক্ষণ পর্যন্ত না এই সংশয়াকীর্ণ প্রশ্নটির সদুত্তর পাওয়া যেত ততক্ষণ পর্যন্ত তার পদচালনাও ক্ষান্ত হতো না।
কিন্তু এমন একটি বৃহৎ প্রশ্নের উত্তর কি অত সহজেই পাওয়া যায়? উত্তরটি আমারই হাতে; কিন্তু হাতের মুঠি আলগা করে রহস্যটিকে অত সহজেই খাঁচা থেকে বের করে দেব আমিই কি সেই পাত্রী?
এবং আলীম যা রেখে গেল তা অত্যন্ত অশোভন বা গর্হিত এক বস্তু, এইটেই প্ৰমাণ করবার জন্য আমি চট করে ব্লাউজের মধ্যে মোড়কটি লুকিয়ে ফেলতাম।
এরপর ফুপুজা নের আর সন্দেহই থাকত না যে বুকের ভিতর প্রেমপত্র জাতীয় কোনো বিস্ফোরক পদার্থ লুকিয়ে রাখলাম। আমার ভবিষ্যৎ চিন্তায় তাঁর রাত্রি অনিদ্রায় অতিবাহিত হচ্ছে এ কথা নিশ্চিত জেনে গহন ঘুমের ঘোরে আমি সুখস্বপ্ন দেখতাম।
পরদিন সকালে ফুপুজানের অনিদ্রাক্লান্ত রক্তিম চোখমুখ দেখে আমার বুকের ভিতর বিবেক কামড় দিত। সম্মুখে যাঁকে দেখতাম তিনি তো ফুপু নন—তাঁর প্রেতাত্মা। এভাবে তাঁর জীবনকে বিষিয়ে তুলবার অধিকার কি আমার আছে?
সকালে হাত-মুখ ধুয়ে আমি যে মুহূর্তে নাশতা করতে যাব, তদ্দণ্ডেই ফুপুজান আমার কক্ষে প্রবেশ করবেন, এটা আমার জানা ছিল। সারা রাত তাঁকে জ্বালিয়েছি—এবার নিষ্কৃতি না দিলে জাহান্নামেও আমার স্থান হবে না। ফুপুজানের তল্লাশিকে সংক্ষিপ্ত করবার জন্য, নিষিদ্ধ ব্যক্তির উপহারটিকে চোখের সম্মুখেই রেখে যেতাম।
ফুপুজানের চোখমুখের কঠিন-পণ কাঠিন্য ঝরনার মতো ঝরে পড়ত। চকোলেট? সে আর এমন কি। কিন্তু তাঁর সদ্যলব্ধ প্রশান্তি স্বল্পক্ষণই স্থায়ী হতো। পরক্ষণেই দুশ্চিন্তার রেখা আবার তাঁর ললাটে একটির পর একটি প্রশ্ন চিহ্নের মতো ভিড় করে দাঁড়াত। বাঃ, চকোলেট। এক নাবালিকার সুপ্ত হৃদয়টিকে জাগ্রত করার জন্য চকোলেটের লাল মোড়কটি তাঁর চোখের সামনে বিপদ সঙ্কেতের মতো জ্বলতে থাকত।
এইসব নানান কারণে আমার অনিশ্চিত মতিগতিকে বিবাহের সুনির্দিষ্ট পথে রওয়ানা করে দেবার জন্য ফুপুজান এরই মধ্যে সচেষ্ট হয়ে উঠলেন।
সেদিন দুপুরবেলা ছোট চাচা ভাত খেতে বসেছেন। আজ ফুপুজানের পরিবেশন কার্যে যত্নের কিছুটা আধিক্য লক্ষ্য করে ছোট চাচা কিছু বললেন না বটে; তবে এক কৌতুকহাস্য গোপন করলেন।
—মাছের মুড়োটা কেমন হয়েছে রে?
—তোফা।
—আর হাড়িয়া কাবাব?
—খেলাম কখন! তবে একটু সবুর কর। শেষ পর্যন্ত কতটা পড়ে থাকে তাই দিয়েই তোমার হাতযশ বোঝা যাবে।
ফুপুজান আর কিছু বললেন না। কাছাকাছি বসে থেকে ছোট চাচাকে হাওয়া করতে লাগলেন। তারপর কোনোরকম নোটিশ না দিয়েই এক বৃহদাকার দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে হাত- পাখাটি পাশে সরিয়ে রাখলেন।
ছোট চাচা বুঝতে পারলেন এই দীর্ঘশ্বাসের কুজ্ঝটিকার পিছনে আসল কথাটি এখনো অবগুণ্ঠিত আছে।
–তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে। বেঁচে আছি আর কোন সুখে বল?
-–তা তো বটেই।
—তাই বলছিলাম, তিশনার জন্য এবার একটি পাত্র দেখলে হয় না।
হাড়িয়া কাবাব যতই ভালো হয়ে থাক না কেন ছোট চাচার গ্রাস মাঝপথেই থেমে গেল।
কার জন্য পাত্র দেখব?
কার জন্য আবার—তিশনার কথা বলছিলাম।
ছোট চাচা হেসে ফেললেন।
—হাসলি যে।
—কাঁদতে পারলাম না তাই।
—সব তাতেই তামাশা। বারো বছর বয়সে আমার কোলে ছেলে এসেছিল।
এই বলে ফুপুজান আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। ঠিক কি কারণে বুঝবার উপায় নেই— বোধ করি তাঁর বিগত পুত্রের শোকে।
ছোট চাচা উঠে পড়লেন। একটি কথাও বললেন না।
সুতরাং চকোলেটের দৌরাত্ম্য থেকে আমার জীবনটিকে রক্ষা করা গেল না। বরং আরো নানান দিক দিয়ে বিপদাশঙ্কা উপস্থিত হলো। আমার টেবিলে চকোলেটের পাশে একটি লাল গোলাপও এরপর থেকে স্থান কায়েম করে নিল। লাল পাপড়িতে ফুটবল মাঠের পাঁকের অভিজ্ঞান দেখে বুঝতে কোনো অসুবিধাই হতো না, পুষ্পরসিকটি কে; কেবল এই কথাটিই ফুপুজান কিছুতেই বুঝতে পারতেন না কখন কোন পথে এইসব অবাঞ্ছিত প্রভাব অনুপ্রবেশ করছে। তাহলে কি তাঁর কর্তব্যে ত্রুটি হচ্ছে?
এই রহস্য সমাধানের গুরুভার চিন্তায় ফুপুজান যখন মুখ অন্ধকার করে বারান্দায় বসে আছেন, হয়তো ঠিক সেই মুহূর্তেই মধুর সম্ভাষণ শোনা যেত : ফুপুজান, আসসালামো আলায়কুম।
ফুপুজান কোনো জবাব দিতেন না; কিন্তু তাঁর চোখ দুটিতে যে ভাবোদয় হতো তার মধ্যে আর যাই থাক, এক সন্তানস্থানীয়র প্রতি কল্যাণ কামনার বাড়াবাড়ি ছিল না।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, আমারই বাগানের ফুল আমার টেবিলে পড়ে আছে— মাঝখানে অন্য একটি হাত ঘুরে এসেছে—তা নিয়ে এত অশান্তি কেন?
তোমরা নিশ্চয়ই অবিশ্বাসের হাসি হাসছ। বলাবলি করছ : খুকী এতো বোঝ, এটুকু বোঝ না—এইটেই কি বিশ্বাস করতে হবে।
কিন্তু আমার সব কথা তোমাদের বিশ্বাস করতে বলছেই-বা কে?
সেই সময় আমার বয়স ছিল বারো। আলীম ষোলো।