মোগলমারির আবিষ্কৃত বৌদ্ধমহাবিহার : প্রত্নকথা
উৎখননের ইতিবৃত্ত ও সংবাদ শিরোনামে মোগলমারি
ইতিহাস ও পর্যটন
বৌদ্ধ প্রভাব

প্রসঙ্গ : শ্রীবন্দক মহাবিহার-এর দেয়াল-প্রতিমা

প্রসঙ্গ : শ্রীবন্দক মহাবিহার-এর দেয়াল-প্রতিমা – জ্ঞানবজ্র রেপা (রামকৃষ্ণ দাস)

আরাধ্যের মন্দির সুশোভিত করার জন্য ভাস্কর্য ব্যবহারের ধারাটি অতিপ্রাচীন। পৃথিবীর যেকোনো সভ্যতার বিকাশে তা দেখা যায়। তবে মন্দিরগাত্র অলংকরণে সৌন্দর্য বৃদ্ধিই একমাত্র উদ্দেশ্য কখনো হয়নি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা মত, দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি থেকে জ্যামিতিক বিজ্ঞানচর্যা ছুঁয়ে মহাকাশ বিদ্যাচর্যা পর্যন্ত। শুধু ধর্মের মহত্ত্ব ও মাহাত্ম্যেই মন্দিরের সৌন্দর্যায়ন সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্থান পেয়েছে লোক থেকে লোকাতীতে যাবার ইঙ্গিতবাহী নানা চিহ্ন, নকশা ও ভাস্কর্য। সাধারণ উদাহরণ হিসেবে স্বস্তিকা চিহ্নটির কথাই ধরা যাক। এর Spiral Motion-এর ভাবনার সঙ্গে চলন ও মহাজাগতিক নীহারিকার গতির সঙ্গে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ তুলনা করেছেন। তেমনই মহাযান-বজ্রযানের কালচক্রযানের মন্ডল। তার মধ্যেও কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছেন মহাকাশ বিদ্যাচর্যার সঙ্কেতার্থ। ভারতের যেকোনো পরম্পরার মন্দির, বিশেষ করে মহাযান পরম্পরার বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরগুলি এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এই প্রবন্ধের কেন্দ্রবিন্দু ঐতিহাসিক প্রত্নগ্রাম মোগলমারি। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন ১নং ব্লকের অন্তর্গত। মোগলমারিকে নিছক ঐতিহাসিক বলা ভুল হবে। গ্রাম ও আশেপাশের অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রস্তরযুগের হাতিয়ার ও তাম্রযুগের উপকরণ দ্ব্যর্থহীনভাবে গ্রামটির প্রাগৈতিহাসিক অস্তিত্বও প্রমাণ করে। গ্রামের সখিসোনা ঢিবিতে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে উৎখনন কার্য শুরু হয়। তাতে আবিষ্কৃত হল একটি বৌদ্ধমহাবিহার। উৎখননে প্রাপ্ত সিলমোহর অনুযায়ী এর নাম ‘শ্রীবন্দক মহাবিহার আর্য ভিক্ষু সংঘ’। মহাবিহারটি অতিপ্রাচীন। আবিষ্কারক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অশোক দত্ত মহাশয়ের মতে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে এটি নির্মিত। সেইসঙ্গে দীর্ঘকাল পর তার পুনর্নির্মাণের প্রমাণও পাওয়া গেছে। ৬০ × ৬০মি আয়তনবিশিষ্ট বিহারের এখনও পর্যন্ত মাত্র এক-তৃতীয়াংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই মহাবিহার পশ্চিমবঙ্গে এযাবৎ প্রাপ্ত যেকোনো বৌদ্ধবিহার থেকে আয়তনে বড়ো।

মহাবিহারের বহি:দেওয়ালের কুলুঙ্গিগুলিতে এখনও পর্যন্ত যে ধরনের স্টাকো নির্মিত অলংকরণ ও মূর্তি পাওয়া গেছে তা অসাধারণ। নালন্দা ও তৎসমকালীন পরম্পরার সঙ্গে যথেষ্ট মিল আছে। মহাবিহারের পশ্চিমদিকের দেওয়ালের কুলুঙ্গিগুলিতে এখনও পর্যন্ত সতেরোটি মূর্তি উন্মোচিত হয়েছে। সাধারণত এই ধরনের ভাস্কর্যধর্মী অলংকরণ মন্দিরের চারদিকেই থাকে। তবে সম্মুখভাগে অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়। এই সতেরোটি মূর্তির বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। সঠিক বিশ্লেষণ করার মতো উপাদান কালের অমোঘ নিয়মে আজ অন্তর্হিত। কিছুটা অনুমান ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য ও সাদৃশ্য নির্ভর করে এগুলির বিচার-বিশ্লেষণ করে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছোতে হবে। মূর্তি নির্মাণের উপাদান এখানে আলোচ্য বিষয় না হলেও একটু ছুঁয়ে যাওয়া উচিত। চুন, মার্বেল পাথরেরগুঁড়ো, শঙ্খচুর্ণ, আঠা ইত্যাদি মিশিয়ে প্লাস্টার বানিয়ে এরকম মূর্তি বা অলংকরণের ধারাটি মধ্যপ্রাচ্য হয়ে এদেশে এসেছে প্রায় দু-হাজার বছর আগে। গুপ্ত ও পাল যুগে সমগ্র উত্তর ও পূর্বভারতে এই রীতির কাজ ব্যাপকভাবে আদৃত হয়েছে। যাই হোক মূর্তিগুলির উপবেশন মুদ্রা একান্তই বৌদ্ধ পরম্পরানুসারী। শ্রীনালন্দা ও তার সমসাময়িক অন্যান্য মহাবিহার ও মন্দিরগাত্রে যে ধরনের মূর্তি পাওয়া গেছে, এগুলি সেসবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত যে ক-টি প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের অবশেষ পাওয়া গেছে তার মধ্যে মালদহের নিকটবর্তী জগৎজীবনপুরের নন্দদীর্ঘী মহাবিহার অন্যতম। ‘নন্দদীর্ঘী আর্য ভিক্ষু সংঘ’ নামক বিহারটি নবম শতকে পাল সম্রাট দেবপালপুত্র মহেন্দ্রপালের দানে প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দিরগাত্রের বহি:ভাগের অলংকরণে ভিতের উপরিভাগের মূর্তিগুলি প্রায় অবিকৃত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেগুলির নির্মাণশৈলী ও বিষয়বস্তুর সঙ্গে মোগলমারির শ্রীবন্দক মহাবিহারে প্রাপ্ত মূর্তির অদ্ভুত সাযুজ্য লক্ষ করা যায়। প্রথমত, নির্মাণের উপাদান স্টাকো। মিশ্রণ প্রায় একরকম। দ্বিতীয়ত, এর বিষয় ও বিন্যাস। ব্যাঘ্রমুখ নরাবয়ব ও বানরমুখী নারীমূর্তির পাশাপাশি অবস্থান উভয় স্থানেই দেখা যাচ্ছে। তৎকালীন বঙ্গভূমি ব্যাঘ্রভূমি বললেও অত্যুক্তি হবে না নিশ্চয়ই। তাই তন্ত্রযানোক্ত রক্ষক দেবতা বিরাট ভীষণাকৃতি ধর্মপালক এখানে হয়েছেন ব্যাঘ্রানন। তন্ত্রযান মতে ধর্মপালকের মুখ একাধিক হয়। প্রধান মস্তক ব্যতীত তার মুখ উদর ও বক্ষেও থাকতে পারে। এই মূর্তিটি নি:সন্দেহে ধর্মপালক দেবতা। কুবের নন। বানরীমুখী নারী সম্ভবত যক্ষিনী বা কোনো স্থানীয় দেবী। বৌদ্ধ মহাযান-বজ্রযান পরম্পরায় হিন্দু পরম্পরা ও কোনো কোনো সময় স্থানীয় দেব-দেবীগণও সাদরে পূজিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিব্বতের বহু স্থানীয় দেবতা বজ্রযানে গৃহীত হয়েছে। একটি মূর্তির ডান হাতের করতলে পদ্মচিহ্ন বর্তমান। তিনি নি:সন্দেহে অবলোকিতেশ্বর। অবলোকিতেশ্বরের দক্ষিণদিকের মূর্তিটি কৌতূহলোদ্দীপক। মূর্তিটির বাম হস্তে ধৃত শূল বা দন্ডের অগ্রভাগে অস্পষ্ট করোটি আকৃতি বিদ্যমান। যদি এটা করোটি হয় তবে তিনি কোনো সিদ্ধাচার্য হতে পারেন। মহাসিদ্ধাচার্য গুরুপদ্মসম্ভারের প্রাচীন চিত্রপটে বাম হস্তে ধৃত শূলে করোটি গাথা রয়েছে এমনটি দেখা যায়। হিমালয় অঞ্চলের প্রাচীন মন্দির ও তিব্বতি থাঙ্কায় এর প্রমাণ রয়েছে। সে-সময়ের শ্রীনালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী ও সোমপুরী মহাবিহারের তন্ত্রাচার্য মহাসিদ্ধরা গহনা পরিধান করতেন। এই মূর্তিটিতেও গলায় হার ও কুন্ডলের চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। বাম কাঁধ থেকে কটিদেশ পর্যন্ত উপবীতের মতো সাধন- ডোরটিও এই ইঙ্গিত করে। বজ্রযান সাধকগণ কাঁধ থেকে পৈতের মতো শক্ত সুতো বা কাপড়ের ফালি পরতেন। তপস্যাকালে হাঁটু যাতে খুলে গিয়ে সাধনায় বিঘ্ন না ঘটায় তার জন্যে এই সাধনডোর দিয়ে হাঁটু বেঁধে রাখতেন ওঁরা।

এ ছাড়া অপর দু-টি মূর্তিও যথেষ্ট অনুসন্ধানের দাবি রাখে। মূর্তি দু-টি প্রায় অক্ষত। একজনের গলার হার এখন মাদুলির মতো দেখা যায়। হাতে বালা ও কানে কুন্ডল। বঁা-হাত ভূমি স্পর্শ করে বসে আছেন। শিরোভূষণের ছাপ অস্পষ্ট হলেও বোঝা যায়। এই মূর্তিটির ডানপাশের মূর্তিটি আরও বেশি চিত্তাকর্ষক। ডান হাতের অভয় মুদ্রায় কিছু একটা ধরে ছিলেন। বঁা কাঁধে সাধনডোর। অতি প্রাচীন তিব্বতি পটচিত্র থাঙ্কায় মহাসিদ্ধাচার্য ও মহাপন্ডিত তিলোপাদ ও নারোপাদকে এই ভঙ্গিমায় পাশাপাশি দেখানো হয়েছে। ছবিতে আচার্য তিলোপা ডান হাতে মাছ ধরে আছেন দেখান হত। তবে লাডাক ও হিমাচলের কিছু দেওয়াল চিত্রে তিলোপার ডান হাতে সবসময় মাছ দেখানো হত। সকল থাঙ্কাতেও আঁকা হয়নি। অন্যত্র আঁকা হয়েছে। মহাসিদ্ধ তিলোপার প্রধান শিষ্য মহাসিদ্ধ নারোপাদ অলংকার ও মুকুট ধারণ করতেন। এই মূর্তিটিও অনেকটা তেমনই। এই দু-টি মূর্তি মহাসিদ্ধ তিলোপা ও নারোপা হতে পারে।

যেমনটি বলা হয়েছে, নন্দদীর্ঘী বিহারের মূর্তির গড়ন ও বিষয়ের সঙ্গে এই মহাবিহারের মূর্তিগুলির সাযুজ্য রয়েছে। নন্দদীর্ঘীর নির্মাণকাল নবম শতকের মাঝামাঝি। মহাসিদ্ধ তিলোপাদ (জন্ম—৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ, প্রয়াণ—১০৬৯ খ্রিস্টাব্দ) ও মহাসিদ্ধ নারোপাদ (জন্ম ১০১২ খ্রিস্টাব্দ)-এর কিছুটা পরবর্তী সময়ের। তবে এর আবিষ্কর্তা ড. অশোক দত্ত মহাশয় ও তাঁর সহযোগী বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত যে, এই বিহারের সর্বশেষ সংস্কার হয় দ্বাদশ শতকে। তাই উপরিউক্ত সিদ্ধাচার্যদের মূর্তি হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। পশ্চিমদিকের কোণের মূর্তিটিও কোনো সিদ্ধাচার্যের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে যেভাবে কোনো কোনো মূর্তির মাথা কুলুঙ্গির নির্দিষ্ট মাপ ছাড়িয়ে বিসদৃশভাবে উপরে উঠে গেছে তাতে মন্দিরের আদিনির্মাণের পরেই যে এগুলি বানানো হয়েছে তা প্রতীয়মান হয়। জাঙ্গুলী মূর্তির বঁাদিকের মূর্তিটি সম্ভবত লোকেশ্বর। ইনিও অবলোকিতেশ্বরেরই রূপবিশেষ। মঞ্জুশ্রী নন। কারণ মঞ্জুশ্রী প্রতিমার দক্ষিণ হস্তে উদ্যত খড়্গ এখানে অনুপস্থিত।

এই বিহারের খননকার্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র সতেরোটি মূর্তি পাওয়া গেছে। কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত মতামত দেওয়ার জন্য এইটুকু যথেষ্ট নয়। তবে মহাযান-বজ্রযান পরম্পরার অন্তর্গত তন্ত্রযানের কয়েকটি দেব-দেবীমূর্তি ও সিদ্ধাচার্যদের মূর্তি নি:সন্দেহে প্রমাণ করে এই মহাবিহার মহাযান পরম্পরার ভিক্ষুগণ কতৃক পরিচালিত হত। এটি ছিল তন্ত্রযানী সাধকদের তপস্যাস্থল। খননকালে পোড়ামাটির বজ্র পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলি খেলনা ভেবে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। রাজ্য সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে অনেক অনুসন্ধান করেও এসবের খোঁজ পাইনি। বজ্র তন্ত্রসাধনার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। তাই বজ্রের প্রাপ্তি তন্ত্রসাধনাকেন্দ্রের তত্ত্বকে জোরালোভাবে সমর্থন করে।

সমগ্র উত্তর ভারত এবং শ্রীনালন্দা ও সমকালীন অন্যান্য মহান বজ্রযান-তন্ত্রযান পীঠগুলিতে এক ধরনের যুগলমূর্তি দেখা যায়। উপবিষ্ট পুরুষদের অঙ্কে নারী মূর্তি। হিন্দু পরম্পরা অনুসরণে তা হরগৌরীর মূর্তিরূপে প্রচলিত। এ ধরনের মূর্তি নন্দদীর্ঘী বিহারে পাওয়া যায়নি। এখনও পর্যন্ত শ্রীবন্দক মহাবিহারেও পাওয়া যায়নি। তবে প্রায় একই রকমের দন্ডায়মান (অলংকৃত) নারী ও পুরুষের যুগল মূর্তি দু-টি বিহারেই দেখা যাচ্ছে। একি মৈথুন মূর্তি ত্যাগ করে বাঙালি পরিশীলিত মানসের প্রাথমিক ভাবনার প্রতীক? ভবিষ্যতের উৎখনন আরও নতুন নতুন প্রশ্ন ও উত্তরের খোঁজ দেবে।

শ্রীবন্দক মহাবিহারসহ সম্পূর্ণ গ্রামটির উৎখনন যদি সম্ভব হয় তবে এযাবৎ অজানা বহু ঐতিহাসিক তথ্যের ভান্ডার সর্বসমক্ষে উন্মোচিত হবে, তা নি:সন্দেহে বলা যায়।

তথ্যসূত্র:

 • বৌদ্ধদের দেবদেবী—ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য

 • বাঙ্গালায় বৌদ্ধধর্ম—নলিনীনাথ দাশগুপ্ত

 • Excavations at Moghalmari— Dr. Ashoke Datta

 • এবং সায়ক,মোগলমারি বিশেষ সংখ্যা

 • মোগলমারি তরুণ সেবা সংঘ ও পাঠাগার, এবং মিউজিয়াম

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *