প্রসঙ্গ কোরআন-এ প্রজনন ও প্রজন্ম : রূপান্তর
মানুষের আদি উৎস কি? এ প্রশ্নের জবাবে বিজ্ঞান জানাচ্ছে যে, মানুষের এই রূপান্তরের কাজটি সম্পাদিত হয়েছে জেনেটিক কোড বা বংশগতির-ধারায় তথা সুনির্দিষ্ট এক নিয়মে। বিজ্ঞান আরো তথ্য দিচ্ছে যে, বংশগতির এই সুত্রটি প্রতিটি নবজাতক লাভ করে তার পিতা ও মাতার প্রজনন-কোষ থেকে। যে মুহূর্তে পুরুষের বীর্য মাতৃজরায়ুতে নিক্ষিপ্ত হয়, সেইমুহূর্ত থেকেই বংশগত উত্তরাধিকার নির্ধারণের কাজটি শুরু হয়ে যায়। প্রথম পর্যায়ে এই কাজটি শুরু হয় ভ্রূণের একান্ত প্রাথমিক স্তরে (গর্ভধারণের ২ মাসের মধ্যে); এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজটি শুরু হয় ভ্রূণের ২ মাস বয়সের পরে। (প্রথম স্তরে জণকে বলা হয় ‘এমব্রাইও’; দ্বিতীয় স্তরে ভ্রূণের বৈজ্ঞানিক নাম হল, ‘ফিটাস’। এই দুই স্তরে বা পর্যায়েই নির্ধারিত হয়ে যায় গর্ভস্থ শিশু পিতামাতা থেকে কি রকম দৈহিক গঠন-কাঠামো লাভ করবে? অর্থাৎ শিশুর ভবিষ্যৎ চেহারা-সুরত কি রকম হবে, পিতামাতা থেকে কতটা আলাদা হবে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মানুষের দেহ-কাঠামো তথা অবয়বের ক্ষেত্রে এই যে পরিবর্তন কিংবা সংশোধন –যাই বলা হোক, তাই কিন্তু সুনির্দিষ্ট একটা রূপ লাভ করে সন্তান জন্মগ্রহণের পর। শুধু তাই নয়, প্রতিটি নবজাতকের দেহের গঠন-কাঠামোগত এই সংশোধন পরিবর্তন তথা রূপান্তরের কাজটা চলে তার গোটা শৈশব জুড়ে– শরীরের বাড়ন্ত অবস্থা অব্যাহত থাকা পর্যন্ত।
পিতামাতার নিকট থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার সত্ত্বেও সন্তানের এই যে দেহগত আলাদা বৈশিষ্ট্য আলাদা চেহারা, তার কারণ কি? এ বিষয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে এমন একটি উপাদান, যা ‘জিন’ নামে খ্যাত।
এই ‘জিন’-এর আবিষ্কার মানব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাধন করেছে এক বিপ্লব। বংশগতির ধারায় ‘জিন’-এর ভূমিকা এতই অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর যে, তা ইতিপূর্বের এতদসংক্রান্ত বহুতত্ত্ব ও ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। যাহোক, সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই ‘জিন’-এর দ্বারা সংশোধিত ও পরিমার্জিত কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে বিকৃত হয়ে ভ্রূণের বেলায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুর বেলায় যে পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটে, তা সেই সন্তানটিকে দান করে দৈহিক কাঠামোগত এমন এক বৈশিষ্ট্য–যা এককথায় একক এবং অনন্য।
শুধু একটি ডিম্বকোষ ঘটনাচক্রে যদি (এবং তা অবশ্যই ব্যতিক্রম) দুটি পৃথক শুক্রকীট দ্বারা নিষিক্ত হয় এবং তার ফলে যে জমজ সন্তানের জন্ম হয়, সেই বিশেষ শ্রেণীর জমজ ছাড়া কোন-একজন মানুষই কোন দিক দিয়েই অপর কোন মানুষের মত হয় না। না চেহারা সুরতে, না আচার-আচরণে। একেবারে প্রাথমিক স্তরে জিন-এর এই ভূমিকা মানুষের দেহাবয়বগত পার্থক্য প্রদানের। ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে তার ভূমিকা দাঁড়ায় ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর।
এভাবেই বংশপরম্পরায় মানবজাতির মধ্যে সার্বিক ও সামগ্রিকভাবে পরিবর্তনের যে ধারা চলে এসেছে, সময়ের ধারাবাহিকতায় সেই পরিবর্তনই’ ক্রমান্বয়ে একটি একটি করে গোটা মানব-প্রজন্মকে বদলে দিয়েছে সম্পূর্ণভাবেই। আধুনিক জীবাশ্ম-বিজ্ঞান এখন অতীতের মানব-প্রজন্মের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজাতির অস্তিত্বের যে প্রতিষ্ঠিত তথ্য-প্রমাণ পেশ করছে, তা মূলতঃ পুরুষানুক্রমে বিভিন্ন মানব-প্রজাতির মধ্যে জিন-এর এই ভূমিকাজাত রূপান্তরেরই ইতিবৃত্ত।
এই পর্যায়ে কোরআনে মানব-প্রজনন সম্পর্কে যে বক্তব্য রয়েছে তার বিচার-বিশ্লেষণ অনিবার্য হয়ে দেখা দেবে স্বাভাবিকভাবেই। সুতরাং, বিষয়টি কোরআনের মত একটি ধর্মগ্রন্থের বাণী ও বক্তব্যের তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কয়েকটি কথা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। যেমন:
কোরআন নাজিল হয়েছিল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে।
তখন রচিত যেকোন পুস্তকের মানব-প্রজনন-সম্পর্কিত যেকোন তথ্যই আধুনিক বিজ্ঞানের নিরিখে ভ্রান্তিপূর্ণ হতে বাধ্য।
কেননা, বিজ্ঞান তখন মোটেও তেমন কোন উন্নতি বা উৎকর্ষতা লাভ করেনি।
তখন বিশ্বের সর্বত্র মানব-প্রজনন সম্পর্কে মানুষের চিন্তা-ভাবনা এমনকি জ্ঞান-প্রজ্ঞাও যতসব উপকথা ও কুসংস্কারজাত ধ্যান-ধারণাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত। যা হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।
এখন আমরা দেহবিজ্ঞান, জণতত্ত্ব ও ধাত্রীবিদ্যা সম্পর্কে যে অত্যাধুনিক তথ্য-জ্ঞান অর্জন করেছি, তা মূলত মানবদেহ-সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণার অবদান।
এমতাবস্থায় সপ্তম শতাব্দীর কোন পুস্তকে মানবদেহযন্ত্রের মত জটিল একটি বিষয়ে কতটুকু জ্ঞান আমরা আশা করতে পারি? এবং তা থেকে মানব-প্রজননের মত জটিলতর বিষয়ের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানার ও বুঝার মত কতটুকু তথ্য আমরা পেতে পারি?