চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

প্রশ্নোত্তরে দুর্গোৎসব

প্রশ্নোত্তরে দুর্গোৎসব

দুর্গাপুজোর সবচেয়ে বড় আতঙ্ক বিজয়া দশমী। দশমী বাদ দিয়ে যদি পুজো হত, তাহলে মন্দ হত না। অর্থাৎ, মা আসবেন, মা যাবেন না। নবমী পর্যন্ত এসে, মাইকেলের প্রার্থনা! ‘যেও না নবমী নিশি, লয়ে তারা দলে’, শুনে মা আমাদের দোলাই হোক, গজই হোক আর নৌকাই হোক, তার বাহক। মাহুত। মাঝিদের ডেকে বললেন, পুজো কমিটির পাণ্ডাদের খুঁজে বের করে, ভাড়া বুঝে নিয়ে সোজা চলে যাও, আমি আর ফিরছি না। আমার হিমালয়ান কিংডামে গিয়ে বলে দাও, বছরে একবার এসে চারদিন থাকলে, সামলানো যাবে না। এ দেশ আর সে দেশ নেই। কেস সিরিয়াস। লাগাতার মহিষাসুর মারতে হবে, ডেলি অন্তত এক ডজন করে। অসুরের প্রভাব টেরিফিক বেড়ে গেছে। সুরা সেবন করে, জিন্স পরে দেশ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় লাগে আমার মহেশ্বরের নন্দী ভৃঙ্গী।

মাতা দুর্গাদেবী এমন সিন্ধান্ত নিলে, আমরা যারা অসুর, না দেবতা, একত্রে একটি নতুন শব্দ ‘নাসুরাদেব’, তারা দুহাত তুলে নৃত্য করবে আর বলবে, জয় মা, জয় মা। কারণ?

প্রথম কারণ, বিভিন্ন বাহনে মায়ের আগমন আর গমনে নানারকম দুর্যোগের সম্ভাবনা। হোক, না হোক মানুষ বড় দুশ্চিন্তায় থাকে। আমরা এক অদ্ভুত জিনিস। আমরা হলুম প্রিমিটিভ মর্ডান মানে। সোনার পাথরটি কিম্বা কাঁঠালের আমসত্ব। ঈশ্বর হয়তো মানি না। সাজে পোশাকে আহারে বিহারে আচারে আচরণে, অ্যাংলো-আমেরিকান-অস্ট্রাল-হাঙরো-রাশিয়ানো-জার্মান। সিন্নি খাই, শূকর খাই, অশৌচ অবস্থায় হবিষ্য করি, মণ্ডিত মস্তকে চুল না গজাতেই চিকেন রেশমি চালাই। দীক্ষা নিয়ে মালা জপ করি বেবিফুডে ভেজাল মেশাই। শনিবার-শনিবার কালীঘাট কি দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে মা-মা করি? নিজের মাকে শুকিয়ে মারি। যুক্তি দেখাই বিলেতের সভ্য মানুষের ধারায় ওয়াইফ ফার্স্ট, মাদার নেকস্ট। সূর্য গ্রহণে পৃথিবী উলটে যাবে ভেবে উত্তেজনায় ছটফট করি। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গিয়ে হরতালের চেহারা নেয়। অষ্টগ্রহ সম্মেলন ঠেকাতে হুমন হয়। আশি মন গব্যপুড়ে যায়। যাঁরা পোড়ান, অর্থানুকুল্যে আধুনিক বিজ্ঞানের সুযোগ সুবিধে তাঁরাই নেন বেশি। স্টিরিও, কালার টিভি, ফ্রিজ, পোলারাইজড ক্যামেরা। চোখে তুলসীপাতা স্পর্শ করিয়ে ভিডিও ক্যাসেটে বিদেশি নগ্ন শরীর দেখেন। স্কচ খান এক চিমটে গঙ্গামাটি ফেলে। রামজি কি জয় বলে বিদেশের মাল চোরা পথে স্বদেশে, স্বদেশের মাল বিদেশে পাচার করেন। হুমনে আসি মন ঘেঁউ পোড়াতে কষ্ট হয় না। বুক ফেটে যায় কর্মচারীদের মাইনে দিতে। দেড়শো টাকায় একজন খেটে চলেছে সকাল আটটা থেকে রাত দশটা। মানুষ মারো মুনাফা লোটো, তুলসী রামায়ণ পড়ো, জনসেবার প্রতিষ্ঠান করে দেশের দরিদ্রদের ম্যালনিউট্রিসনে দূর করার নামে বিদেশ থেকে সাহায্যের গুঁড়ো দুধ ব্ল্যাকে ঝেড়ে দাও। ফ্লাডের কম্বল ফ্ল্যাটে তুলে দাও। মাঝরাতে পার্ক স্ট্রিটের বার-এ দুশো টাকা টিপস মেজাজে লে যাও বলে কুকুরের মুখে ডগ বিস্কুটের মতো তুলে দাও। আর কারখানায় সেফটিরুলস না মানার জন্যে, না রাখার জন্যে যে শ্রমিকের হাত, কি পা, কি চোখ গেল, তার কমপেনসেসানের টাকা মারার জন্যে ব্যারিস্টারের পেছনে তিন হাজার টাকা ঢালো। এ দেশে জীবনের দাম সরকারি অ্যাসেসমেন্ট অনুসারে পাঁচশো টাকা। কি করে বললুম! ট্রেন দুর্ঘটনার পর মৃতের আত্মীয়ের হাতে ওইরকমই একটা অঙ্ক তুলে দেওয়া হয়, পাঁচশো থেকে হাজারের মধ্যে। বিমানে একটু বেশি। মানুষ দেখতে এক, ভোটের হিসেবেও মূল্য এক। ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট কিন্তু অন্য সব ব্যাপারে এক একজনের এক-এক রকম দাম। যেন কাপ ডিশ, কাঁচের গেলাস। ফুটপাথে শুয়েছিল, মাঝরাতে মাতাল ট্রাক ড্রাইভার পিশে দিয়ে গেল, যেন ব্যাঙ-চেপটে গেছে। নো কমপেনসেসান। ও জীবনের কোনও দাম নেই। স্টাফড ম্যান। বিমান-দুর্ঘটনায় মৃত, তাঁর দাম অনেক বেশি। মানুষে মানুষে কত তফাৎ। কেউ ‘বোন-চায়না’ কেউ পোর্সিলেন, কেউ ভাঁড়। কারুর ঠোঁটে সোনালি বর্ডার, গায়ে ফুল। কেউ শুধুই কাজ চলা গোছের একটি পাত্র। চায়ের দোকানের নর্দমার সামনে যখন পাঁক তোলে তখন উঠে আসে রাশি-রাশি ছুড়ে ফেলা ভাঁড়।

মায়ের যদি কথা বলার ক্ষমতা থাকত, দশভুজার দশটি হাত যদি সচল হত, তা হলে প্রথমেই শুরু করতেন ভক্ত নিধন। প্রশ্ন করতেন, আমাকে কি তোমরা পুতুল ভেবেছ? রাংতা আর শাটিন জড়িয়ে নিজেদের খুশিমতো পোজে চারদিন খাড়া করে রেখে হুল্লোড় হচ্ছে! প্যান্ডেলে বাহার দিতে গিয়ে হাজার-হাজার টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে। ওদিকে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভূতের নৃত্য। সেরা কলেজের প্রাঙ্গণে দারুসেবী অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের বেলেল্লাপনা। ছাত্রীদের দিকে অশ্লীল ইঙ্গিত ছুঁড়ে মারা। ছাত্রদের সাধনা ছেড়ে পারস্পরিক রাজনৈতিক কোঁদল। দলাদলি, হানাহানি। নেতৃস্থানীয়দের জাগ্রত নিদ্রা। দেশের ভবিষ্যত যারা তারা এখন দাবার ছকের বোড়ে। তোমাদের এই পুজো তমসাচ্ছন্ন মানুষের অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন, উল্লাস!

খুব বাঁচা আমারা বেঁচে গেছি, মৃন্ময়ী ভাষাহীনা, জড়প্রতিমা। তিনি সবাক হলে প্রশ্ন করতে পারতেন, তোমাদের হাসপাতালে আজকাল চোলাই তৈরি হয়, সেবিকারা ধর্ষিতা হয়, রুগিরা যত্ন পায় না, ওয়ার্ডে কুকুর ঘোরে, মাঝরাতে ইঁদুরে পায়ের আঙুল কুরে-কুরে খেয়ে যায়, খাদ্য, ওষুধ চোরাপথে বাইরে চলে যায়, স্যালাইন আর গ্লুকোজে ঘোরে মৃত্যুর বীজ। প্রতিকার চাইলে ক্লাস ফোরের দোহাই পাড়া হয়। কেন তোমাদের এই অবস্থা? ধর্মের দেশ। তাই না? বারো মাসে তেরো পার্বনের স্রোত বইছে। কেন এই পুজো? শক্তির না তামসিকতার?

এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, রবীন্দ্রনাথ :

তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি

বুঝতে নারি কখন তুমি দাও যে ফাঁকি।।

দেবী যদি আবার প্রশ্ন করেন, তোমাদের সবই কেন এত হাস্যকর, ছল-চাতুরিতে ভরা, সাপও মরে না, লাঠিও ভাঙে না। যেমন পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন। গোটা কতক ব্যানার, চটকদার স্লোগান, একটি লাউড স্পিকার, উদ্যত হস্ত পথ পুলিশ, কিছু সেবক-সেবিকা। সাত দিনের লোক দেখানো, লোক ঠকানো পথ নাটিকা। হকারদের ঠেঙিয়ে বিদায়। তারপর আবার পুনর্মূষিক ভব। কুকুরের বাঁকা ন্যাজ আবার বেঁকে যায়। কি বিচিত্র সরলীকরণ পদ্ধতি সাতদিনের তামাশা! এক সপ্তাহ শৃঙ্খলা, একান্ন সপ্তাহ চরম বিশৃঙ্খলা।

সাতদিন, শিশু সপ্তাহের শিশু প্রাোটিন মাখানো, সেবা সংস্থার বিস্কুট, পাউরুটি, আর গুঁড়ো দুধ গোলা খাবে, আর বাকি তিনশো আটান্ন দিন অর্ধাহারে, অনাহারে থাকবে। কেন? তোমাদের এমন কোনও পরিকল্পনা নেই, যাতে সব শিশুই একদিন সুস্থ নাগরিক হয়ে উঠতে পারে! সকলেই জীবনযাত্রায় একটা সুস্থ মানে পৌঁছতে পারে। স্বাধীনতা তো অনেক বছর ভোগ করলে, তবু দুর্ভোগ তো ঘুচল না। যে তিমিরেই সেই তিমিরেই পড়ে রইলে।

দেবী, এর উত্তরে আমরা মাথা চুলকোব আর মাইকের মুখটা তোমার দিকে ঘুরিয়ে দোব।

প্রশ্ন শেষ হয়নি। তোমাদের শহরের সিনেমা হলে স্লাইড পড়ে, শহরকে জঞ্জালমুক্ত রাখুন, পরিষ্কার রাখুন, সুন্দর করে তুলুন। আমি বসে আছি আস্তাকুড়ে। কার দায় পড়েছে, শহর পরিষ্কার রাখার। আমি তো প্রতি বছরেই চারদিনের জন্যে আসি। এসে দেখি আর অবাক হয়ে যাই। তোমাদের একটি পরিকল্পনার বিস্ময়কর অগ্রগতি কাজ না করার আর ভাগাড় বাড়িয়ে চলার। ভাগাড়ের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে বাছা! ওই তো আলোর মালা ঝুলিয়েছ, টালা থেকে টালিগঞ্জ, শহর যেন ডাইনির মতো দাঁত বের করে হাসছে।

দেবী! এর উত্তর, কিনু গোয়ালার গলিকে আমরা ভুলতে চাই না, আমাদের গর্ব। পড়ব আর মেলাব,

 বর্ষা ঘন ঘোর।

 ট্রামের খরচা বাড়ে

 মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়

 গলিটার কোণে কোণে

 জমে ওঠে পচে ওঠে

 আমের খোসা ও আটি, কাঁঠালের ভূতি

 কাছের কানকা

 মরা বেড়ালের ছানা

 ছাইপাঁশ আরও কত কী যে।

মাতা দুর্গা, তুমি আর প্রশ্ন কোরো না মা। আমরা সব পড়া না করে আসা স্কুলের ছাত্র। কোনও প্রশ্নেরই উত্তর জানা নেই। জানি, তুমি এবার প্রশ্ন করবে, তোমাদের সব পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে গেল কেন? সেচ পরিকল্পনায় কোটি-কোটি, অর্বুদ-অর্বুদ টাকা খরচ হয়ে গেল, তবু তোমরা খরায় শুকিয়ে মরো, ঝরায় ডুবে মরো। কেন বাছা?

মা, পরিকল্পনা যে উঠে গেছে। ঝাঁপে লাঠি পড়ে গেছে। সব জ্যাম তৈরি হয়নি।

তোমাদের ঘরে সন্ধের বাতি জ্বলে না কেন বাছা?

সে তো মা অনেক স্টোরি। মন্ত্রীদের নম্বরি বক্তৃতার মতো। আজ টিউব লিক, কাল কয়লা ভিজে, পরশু টিউব লিক, তরশু কয়লা ভিজে। আমরা ঠিক জানি না মা। দুষ্ট সমালোচক বলেন, রাজনীতি। দেশ জুড়ে গদির লড়াই চলেছে মা, তোমার মহিষাসুর মা, অনেক নিরীহ প্রাণী। এই গদি অসুর সন্ধি করে গদ্যসুরদের জ্বালায় প্রাণ যায় মা। চামুণ্ডা বাহিনী ছেড়ে দিয়েছে, এ পাড়ায় ও পাড়ায় বোমাবুমি চলেছে। সারারাত চলেছে মরণের উৎসব। উপদ্রুত এলাকায় পুলিশ যেমন চেক-পোস্ট বসায় তুমিও মা তেমনি চেক পোস্ট বসিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে যাও।

বাছা, আমি হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করছি, সিমিলি সিমিলিবাস, বিষে বিষে বিষক্ষয়। অসুর দিয়ে অসুর নিধন। বিগ পাওয়াররা কি করছে দেখছ না? ছোট-ছোট দুটো দেশকে লড়িয়ে দিয়ে, একপাশে বসে-বসে মৃদু-মৃদু হাসছে, এটা ওটা সাপ্লাই দিচ্ছে, ধ্বংসের চিতায় ঘৃতাহুতি। সব শেষ হলে আবার শুরু হবে। এখন অসুরে-অসুরে আবার ফাটাফাটি চলুক।

ইতিহাস ফিরে-ফিরে আসে। যুগসন্ধির এই লক্ষণ। স্যাঁতসেঁতে মানুষের দল কি করে চলেছে নিজেরাই জানে না। ঢাউস প্যান্ডেলে অপশক্তির বোধন চলেছে। বাসে ট্রামে বাজারে প্রতিদিন আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের পরিচয় পাওয়া যায়। পরস্পর পরস্পরকে দাঁত খিঁচিয়ে চলেছি। দুই বাঙালির দেখা মানেই, হয় তৃতীয় আর এক বাঙালির ছিদ্র অনুসন্ধান, না হয় নিজেদের মধ্যেই টুসটাস। বিজয়ার দিন এঁরাই বেরোবেন নেচে-নেচে। দেহের কোলাকুলি হবে, মনের কোলাকুলি হবে না। ও বস্তু বাঙালির কোষ্ঠিতে লেখা নেই।

তারপর প্লেটে -প্লেটে নেমে আসবে সেই আতঙ্ক। কুড়ুল কাটা বনস্পতিতে ভাজা সাংঘাতিক নিমকি গোটা দুই খাওয়ালেই লটকে পড়বে। আসবে ঘুঘনি। কেন আমেরিকার ক্লাস্টার-বম্ব। মটর প্যাট-প্যাট করে চেয়ে আছে, অসংখ্য মৃত মাস্তানের চোখের মতো। দাঁত বের করে আছে নারকেল কুঁচি। গুঁড়ো হলুদে, লঙ্কার দাপটে কোনও স্যাম্পল জবা লাল। কেউ আবার প্রেসারে ছেড়েছেন, গলে পাঁক। কোনওটি চাটনির মতো মিষ্টি, কোনওটি বৃক্ষতালু ভেদকারী প্রচণ্ড ঝাল, প্রাত:স্মরণীয়। যাওয়ার বেলায় এ যেন তোমার ঝাড়া লাথি! তুমি থেকে যাও মা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *