প্রশাসনিক ও রাজস্ব-ব্যবস্থা
আধুনিক সভ্য জগতে বলিষ্ঠ ও নিখুঁত প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রথম চিহ্ন হচ্ছে, শাসন-সংক্রান্ত কর্মসমূহের সুষ্ঠু পরিচালনার্থে প্রয়োজনীয় দফতর সমূহে বিভক্ত করা এবং সেগুলির মাধ্যমে শাসনযন্ত্র সক্রিয় রাখা। মুসলিম রাষ্ট্রের শৈশব অবস্থায় ওমরের খেলাফত আমলেই এরূপ প্রয়োজনীয় দফতরসমুহের সৃষ্টি হয় এবং তাঁর কৃতিত্ব হচ্ছে উপযুক্ত নির্বাচন দ্বারা প্রত্যেক দফতরের ভারার্পণ করা।
শাসন ব্যবস্থার প্রথম পদক্ষেপে ওমর সমগ্র মুসলিম রাজ্যকে আধুনিক মতে প্রদেশে, জিলায় ও মহকুমায় বিভক্ত করেন। তাঁর আমলেই প্রায় সাড়ে বাইশ লক্ষ বর্গমাইল বিস্তৃত বিরাট ভূভাগ অধিকৃত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে ওমর মুসলিম রাষ্ট্রকে আটটি প্রদেশে বিভক্ত করেন: মক্কা, মদীনা, সিরিয়া, জাজিরা, বস্ত্রা কুফা, প্যালেস্টাইন। ফারস্, খোজিস্তান, কিরমান প্রভৃতি ইরাক-আযমের প্রদেশগুলি অবশ্য এ- হিসাবের মধ্যে নয়। শাসনকার্যের সুবিধার্থে ওমর অধিকৃত দেশসমূহের প্রাদেশিক ও জিলাওয়ারী বিভাগ পূর্বাপর অধিকৃত রেখেছিলেন। মুসলিম অধিকারের পূর্বে মিসরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কিরূপ ছিল সঠিক জানা যায় না। ওমর সুশাসনের উদ্দেশ্যে মিশরকে আটাশটি জিলা-সম্বলিত উচ্চ-মিসর প্রদেশে ও পনেরটি জিলা-সম্বলিত নিম্ন-মিসর প্রদেশে বিভক্ত করেন। উচ্চ-মিসর প্রদেশে আবদুল্লাহ-বিন্-সা’দ শাসনকর্তা ও নিম্ন মিসরে অপর একজন শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেও আমর-বিন্-আস ছিলেন সমগ্র মিসরের গভর্নর-জেনারেল।
প্রত্যেক প্রদেশে একটি সরকারী বালাখানা বা দারুল ওমারা ও স্থায়ী দফতরখানা বা দিওয়ান্ থাকতো। প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে ওয়ালী, তাঁর খামুনশী বা চি সেক্রেটারীকে কাতিব, সেনাবিভাগের প্রধান সচিবকে কাতিব-উদ্-দিওয়ান, রাজস্ব- সচিবকে সাহিব-উল্-খারিয, প্রধান খাজাঞ্চীকে সাহিব-উল্ বায়তুল-মাল ও প্রধান বিচারককে কাযী বলা হতো। প্রত্যেক প্রদেশে পৃথক সৈন্যাধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেও ওয়ালীই প্রাদেশিক সিপাহসালার থাকতেন। পুলিশ-প্রধানকে সাহিব-উল্-আহ্দাস্ বলা হলেও এ-বিভাগের কর্ম অন্য আমিল দ্বারাই নির্বাহ করা হতো। প্রত্যেক জিলায় একজন জিলা প্রধান বা আমিল ও একজন কাযী থাকতেন। পরগনায় তহসীলদারের অনুরূপ কর্মচারী থাকতেন। খলিফার নির্দেশে ওয়ালী ও তাঁর কর্মচারীবৃন্দ সরাসরি নিযুক্ত হতেন। কুফায় আম্মার শাসনকর্তা নিযুক্ত হলে তাঁর সঙ্গে দশজন কর্মচারীও নিযুক্ত হন। খাস্-মুশী নিযুক্ত হতেন বাগ্মীতা ও রচনাশক্তির পারদর্শিতাগুণে। বসরার শাসনকর্তা আবু মুসা আশারীর খাস্ মুনশী যিয়াদ-বিন্-সামিয়া বাকশক্তিতে স্বয়ং ওমর পর্যন্ত অভিভূত ও তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করতেন। আবদুল্লাহ্ বিন্-আরকাম ছিলেন খোদ বিশ্বনবীর লিপিকার এবং লিপিকৌশলে মুগ্ধ ওমর খলিফা হয়ে তাঁকে নিজের খাস্-মুনশী নিযুক্ত করেন।
প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও রাষ্ট্রের অন্যান্য বিশিষ্ট কর্মচারী সাধারণত মজলিস-ই-সূরা কর্তৃক প্রকাশ্য নির্বাচন দ্বারা নিয়োজিত হতেন। ব্যক্তিত্বের মূল্যায়নে ছিল ওমরের বিশেষ দক্ষতা এবং তার দরুন কে কোন কর্মে বিশেষ পারদর্শী তার নির্ণয়নে ও সঠিক ব্যক্তি নির্বাচনে তাঁর কৃতিত্ব ছিল অসাধারণ। এজন্যে যুদ্ধের সৈন্যাধ্যক্ষ নির্বাচনের জন্যই হোক কিংবা বেসামরিক প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগের জন্যেই হোক, জনমত নির্ধারণের হেতু মজলিস-ই-শুরার অধিবেশন ডাকা হলো প্রায় ক্ষেত্রেই মজলিস ওমরের মতানুযায়ী নির্বাচন করতো। তৎকালে সারা আরবের মধ্যে শাসকার্যে ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বাপেক্ষা দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন চারজন-আমির মু’আবিয়া, আমর-বিন্-আস, মুগিরাহ-বিন্-শুরাহ্ ও যিয়াদ বিন-সামিয়াহ্। তাঁদের প্রথম তিনজন উচ্চ শাসনকার্যে নিয়োজিত হন এবং তরুণ যিয়াদ আবু মুসা আশারীর খামুনশী নিযুক্ত হন। মজলিস ব্যতীত প্রত্যেক নাগরিকের রাষ্ট্রীয় শাসনকার্যে মতামত দেওয়ার অধিকার স্বীকৃত হতো এবং অনেকক্ষেত্রে প্রাদেশিক ওয়ালী কিংবা জিলার আমিল নাগরিকদের দ্বারাও নির্বাচিত হতেন। কুফা, বসরা ও সিরিয়ার সাহিব-ই-খিরাজ নিয়োগের সময় ওমর এই তিনটি প্রদেশের নাগরিকদেরকে নির্দেশ দেন, তাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে সাধু ও দক্ষ নির্বাচিত হবেন, তাঁকেই নিজ নিজ প্রদেশের প্রধান রাজস্ব-সচিব নির্বাচিত করে মদীনায় তাঁদেরকে প্রেরণ করতেন। এভাবে ওসমান-বিন্-ফরকাদ্ কূফায়, হুজ্জাজ আল্লাত বসরায়, ওসমান-বিন ইয়াযিদ সিরিয়ায় নির্বাচিত হন এবং ওমর তাঁদের নির্বাচন অনুমোদন করে তাঁদেরকেই নিয়োগপত্র দান করেন।
সরকারী কাজে নিয়োগের সময় প্রত্যেককে একখানি উপদেশলিপি দেওয়া হতো। তাতে তাঁর পদাধিকার, দয়িত্ব ও ক্ষমতার সীমা লিখিত থাকতো। মজলিসে উপস্থিত সাহাবাগণ উপদেশলিপি তস্দীক করতে। কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে কর্মচারীকে সর্বসমক্ষে এখানি পাঠ করতে হতো, যাতে জনগণ তাঁর পদাধিকার ও দায়িত্ব সম্বন্ধে অবহিত হয় এবং সীমা লঙ্ঘন করলে তাঁর কৈফিয়ত তলবও করতে পারে। প্রত্যেক কর্মচারীকে নিয়োগকালে এ প্রতিশ্রুতি দিতে হতো যে তিনি তুর্কী ঘোড়ায় চড়বেন না, মিহি বস্ত্ৰ পরবেন না, মিহি আটা খাবেন না এবং দরওয়াজায় প্রহরী রাখবেন না। তিনি সকলের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবেন এবং সর্বদা সকলের অভিযোগ শুনতে প্রস্তুত থাকবেন। নিয়োগের সময় প্রত্যেককেই নিজ নিজ সম্পত্তির হিসাব দাখিল করতেন। সম্পত্তির অসঙ্গত বৃদ্ধি দেখা গেলে তাকে কৈফিয়ত দিতে হতো এবং সন্তোষজনক না হলে বাজেয়াক্ত করা হতো। আবু হোরায়রাহ্ একটি কবিতায় হুজ্জাজ, নাফিস, আসিম প্রভৃতি বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারীর অসংযত সম্পত্তি বৃদ্ধির ইঙ্গিত করেন। ওমর এ সম্বন্ধে তদন্ত করেন ও প্রত্যেকের সম্পত্তির অর্ধেক বাজেয়াক্ত করে বায়তুল মালে প্রেরণ করেন। প্রত্যেক বছর হজের সময় প্রত্যেক কর্মচারীকে মক্কায় উপস্থিত থাকতে হতো। তখন তাঁদের প্রত্যেকের কর্মের খতিয়ান হতো, অভিযোগ শ্রবণ ও সরাসরি প্রতিকার করা হতো। একবার একজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে এক ব্যক্তি অভিযোগ করে যে, বিনা দোষে তাকে একশত বেত্রাঘাত করা হয়েছে। বিচারে অভিযোগ সাব্যস্ত হয় ও ওমর নির্দেশ দেন, দোষী কর্মচারীকে প্রকাশ্যে একশত বেত্রাঘাত দেওয়া হোক। আমর-বিন্- আস্ আপত্তি তুলে বলেন, এর ফলে কর্মচারীদের মনোবল ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। কিন্তু ওমর বলেন, অপরাধীকে শাস্তি নিতেই হবে। তখন আমর ফরিয়াদিকে অনুনয় করেন প্রত্যেক বেত্রাঘাতের দরুন দুটি সোনার মোহর ক্ষতিপূরণ হিসেবে গ্রহণ করতে।
কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে খলিফার নিকট যে-সব অভিযোগ উপস্থিত হতো সে সবের তদন্তের জন্য মুহম্মদ বিন্-মস্লেমাহ্ নামক একজন প্রাচীন ও সর্বজনমান্য সাহাবা নিযুক্ত হন। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থিত হলে তিনি প্রকাশ্য তদন্ত করতেন। ২১ হিজরীতে কুফাবাসীরা কাদিসিয়ার সমরবিজয়ী সা’দ-বিন্-ওক্কাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। তখন সঙ্কটজনক মুহূর্ত হলেও ওমর মুহম্মদ-বিন্-মস্লেমাকে তদন্তে কুফায় প্রেরণ করেন। কখনও কখনও তদন্ত-সভা গঠিত হতো কয়েকজন সমবায়ে এবং তদন্ত শেষে রিপোর্ট পেশ করা হলে খলিফা অভিযুক্ত কর্মচারীকে মদীনায় উপস্থিত হতে নির্দেশ দিতেন ও নিজে তাঁর কৈফিয়ত শ্রবণ করতেন। বসরার শাসক আবু মুসা আশারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থিত হলে ওমর নিজেই সাক্ষ্য প্রমাণ লিপিবদ্ধ করেন এবং প্রমাণিত অভিযোগের প্রতিকার করেন। মিসরের ওয়ালী আইয়াহ্ বিন্ ঘানামের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়, তিনি মিহি বস্ত্র পরিধান করেন ও দৌবারিক রাখেন। মুহম্মদ বিন্-মসলেমাহ্ তদন্ত পূর্বক আইয়াযকে মিহি বস্ত্র পারহিত অবস্থার মদীনায় উপস্থিত করেন। ওমর নির্দেশ দেন : আইয়াযকে কোরা পশমের বস্ত্র পরে জঙ্গলে মেষচারণ করতে হবে। আইয়াহ্ এরূপ শাস্তিকে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন বলে আক্ষেপ করলে ওমর বলেছিলেন : যার পিতা ছিল মেষের রাখাল এবং তার দরুন তার উপাধি ছিল ঘানাম, তার পুত্রের এ আক্ষেপ সাজে না। সাদ-বিন্-ওক্কাস কুফায় একটি বিশাল বালাখানা নির্মাণ করে দারওয়ানেরও ঘর রাখেন। ওমরের নির্দেশে সেটি ভস্মীভূত করা হয়।
এ সব ব্যবস্থা থেকে লক্ষণীয় যে, ওমর সরকারী কর্মচারী ও জনগণের মধ্যে কোন শ্রেণীগত বৈষম্য রাখতে চান নি, যার দরুন জনগণের মনে হীনমন্যতার ভাবোদ্রেক হয়। কারণ এ রকম উচ্চ-নীচ ভেদ জ্ঞান থেকেই শাসক শ্রেণীর মধ্যে যথেচ্ছাচার ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ উপস্থিত হয় এবং শাসক শ্রেণী জনগণের রক্ষক ও সেবক না হয়ে ভক্ষক ও প্রভু হয়ে উঠে। ওমর বারবার কর্মচারী শ্রেণীকে সাবধান করে বলছেন: স্মরণ রেখো! আমি তোমাদের জনগণের প্রভু ও শোষক নিযুক্ত করি নি। তোমরা তাদের নেতৃত্ব দেবে, যাতে তারা তোমাদের আদর্শ হিসেবে তাদের অযথা প্রশংসাবাদ করো না, তার ফলে তারা আত্মম্ভরী হয়ে উঠবে। মুসলিমদের অধিকার সর্বদাই রক্ষা করবে, এবং পীড়ন করে ঘৃণ্যাবস্থায় ফেলে দিও না। তোমাদের দ্বার কখনও বন্ধ করো না, তার দরুন সবল কখনও দুর্বলের উপর অন্যায় অত্যাচার করতে পারবে না। আর কখনও তাদের উপর প্রভুত্ব খাটাতে যেয়ো না, কারণ সেটা স্বেচ্ছাচারেরই নামান্তর।
কর্মচারীদের সৎ, নির্লোভ ও দুর্নীতিহীন হওয়ার একটি প্রধান কারণ ছিল তাঁদের উপযুক্ত বেতন দেওয়া। ওমর এ সত্য অনুধাবন করেছিলেন যে, রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদেরকে উপযুক্ত বেতন দেওয়া হলে তাঁরা স্বভাবতই সৎ ও নির্লোভ হবেন এবং ঘুষ রেশওয়াৎ প্রভৃতি দুর্নীতি থেকে দূরে থাকবেন। প্রশাসনিক এই অত্যাবশ্যকীয় নিয়মটির কার্যকারিতা আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ বহু শতাব্দী পরেও যথার্থ অনুধাবন করতে পারছে না। এবং তার দরুন উৎকোচ গ্রহণ ও দুর্নীতিপ্রবণতা কর্মচারী মহলে অন্যায়রুপেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে। সেকালে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ছিল অবিশ্বাস্যরূপে সস্তা, খাওয়া পরার খরচ অত্যন্ত কম এবং টাকাকড়িও ছিল কম। তবু তুলনামূলকভাবে ওমরের আমলে কর্মচারীদের বেতন দেয়া হতো উচ্চহারে। প্রত্যেক প্রাদেশিক শাসনকর্তার বেতন ছিল এক হাজার দিনার; এ ছাড়াও তিনি মালে গনিমাতের একটা মোটা অংশ প্রাপ্ত হতেন। উল্লেখযোগ্য যে, এক হাজার দিনার পাঁচ হাজার টাকা অনুরূপ। আমির মুআবিয়া এরূপ বেতনে সিরিয়ার ওয়ালী হিসাবে যেরূপ শান-শওকতের সঙ্গে থাকতেন, তাতে খোদ ওমর আক্ষেপ করতেন, মুআবীয়া খসরু অর্থাৎ ইরান-সম্রাটের সমারোহে বাস করে।
আরবসমাজে ভূমি-রাজস্ব কথাটা প্রায় অজানিত ছিল। প্রাক-ইসলাম যুগের ইতিহাসে এ সম্বন্ধে কোন তথ্যই মেলে না। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুগে জানা যায়, খায়বর যুদ্ধের পর ইহুদীরা প্রার্থনা করে যে, তারা কৃষিকর্মে সুপটু, অতএব জমি তাদের দখলেই রাখা হোক! বিশ্বনবী এ প্রার্থনা মন্যুর করেন এবং উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক কর হিসেবে নির্ধারিত করেন। তার পর যে সব অঞ্চলের সমস্ত অধিবাসী ইসলাম গ্রহণ করতো, তাদেরকে যাকাতের অনুরূপ একটা ভূমি কর দিতে হতো। আবুবকরের সময় ইরাকের যে অংশ অধিকৃত হয়েছিল, তার জন্যে একটা থোক হিসেবে কর স্থিরীকৃত হয়েছিল।
ওমরের আমলে বিশাল ভূভাগ ইসলামের অধিকারে আসে এবং তখনই ভূমি-কর নির্ধারণের একটা সুস্পষ্ট নির্দিষ্ট নীতি গ্রহণের প্রয়োজন দেখা যায়। ইরাক সিরিয়া ও মিসর দেশ একের পর এক অধিকৃত হলে ওমর ভূমি-কর বিষয়ে প্রথম মনোনিবেশ করেন। এ বিষয়ে যে সমস্যা উদ্ভুত হয়, তা হলো, এই : আঁ-হযরতের নীতি অনুযায়ী এ-সব নতুন অধিকৃত দেশ সেনাদের মধ্যে খণ্ডিতভাবে বন্টন করে দেওয়া হবে, না সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়নীতির ভিত্তিতে অন্য নীতি গৃহীত হবে? সব সৈন্যাধ্যক্ষ দাবী করেন, অধিকৃত অঞ্চলসমূহ সেনাবাহিনীর মধ্যে পৃথক জোতে এবং চাষীদেরকে ভূমিদাস হিসেবে বণ্টন করে দেওয়া হোক। তাঁদের এ দাবী সমর্থন করেন আবদুর রহমান বিন্-আউফ প্রমুখ কয়েকজন মশহুর সাহাবা এবং তাঁদের যুক্তি হলো: সুন্না অনুযায়ী যুদ্ধে-অধিকৃত ভূমিতে মুজাহিদদেরই দাবী, এ পর্যন্ত এ নীতিই প্রচলিত আছে। বিলাল ওমরকে এ বিষয়ে এরূপ চাপ দিতে থাকেন যে, ওমর বিরক্ত হয়ে খেদোক্তি করেন, ‘আল্লাহ্! আমাকে বিলালের হাত থেকে বাঁচাও।’ ওমরের যুক্তি ছিল আরবসেনারা ভূম্যধিকারী হয়ে গেলে তাদের ক্ষাত্রশক্তি লুপ্ত হয়ে হীনবল হয়ে পড়বে। তা ছাড়া দেশের পর দেশ যখন আরবসেনাদের করতলগত হচ্ছে, তখন অগণিত জনগণকে ভূমিদানে পরিণত করে দিলে এমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসবে এসব ভূমিখণ্ডে, যা ইসলামী ন্যায়নীতির ঘোরতর পরিপন্থী। তাঁর আরও যুক্তি ছিল, যদি সমস্ত অধিকৃত ভূ-খণ্ড সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়, তা হলে সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের এবং রাষ্ট্রীয় শাসন ও শৃঙ্খলা রক্ষার বিপুল ব্যয়ভার কীভাবে পূরণ হবে? তিনি সা’দ বিন্-ওক্কাসকে নির্দেশ দেন, অধিকৃত দেশসমূহের ভূমির পরিমাণ নির্ধারণ করতে এবং আদম-শুমারী গ্রহণ করতে। আদম-শুমারীতে দেখা গেল, প্রত্যেক সেনার ভাগে তিনজন চাষী পড়ে। ওমর মনস্থির করেন, ভূমি বাসিন্দাদের দখলেই থাকবে, তারা কারও অধীন হবে না।
কিন্তু এ-বিষয়ে জনমত গ্রহণের জন্যে ওমর মজলিই-ই-শুরার অধিবেশন আহ্বান করেন। কয়েকদিন ধরে দীর্ঘ আলোচনা চলে, কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় না তখন ওমরের সহসা সূরা আল-হাশরের এই আয়াতসমূহ স্মরণ হয়:
ইহা দুঃখীদের, যারা পলায়ন করেছে, যারা বাসগৃহ ও সম্বল থেকে বিতাড়িত হয়েছে…. এবং যারা ভবিষ্যতে আসছে……(৫৯:৮-১০)।
এই বাণী থেকে ওমর যুক্তি গ্রহণ করেন: বিজয়াধিকারে ভবিষ্যৎ বংশধরদের হক্ স্বীকৃত হয়েছে, কিন্তু ভূমি যদি সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়, তা হলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে কি থাকে? আর এ মহাবাণীর মধ্যেই নিহিত আছে বিশ্বের জাতি সমূহের ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি যা-নিঃসন্দেহে ইসলামের একটি আদর্শিক মৌল শিক্ষা। উল্লেখযোগ্য যে, ওমরের এই যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মেলে-কাল ও যুগধর্মের প্রভাবে উত্থিত সমস্যার সমাধানে কোরআন ও সুন্নার বিধানসমূহের ব্যাখ্যা কোন্ আলোকে ও কী পন্থায় করা উচিত। ওমর বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন, আঁ-হযরতের সীমিত গোত্রের ও পরিবেশের ক্ষেত্রে যে নীতি গ্রহণ করা সমীচীন মনে করেছিলেন, বিশাল ভূ-খণ্ডের বহু জাতির ভাগ্য নির্ধারণে সে নীতি অনুসরণ করলে ন্যায়নীতির মর্যাদা রক্ষিত হয় না-অথচ আঁ-হযরত এরই প্রতিষ্ঠার আজীবন আপোষহীন সংগ্রাম করে গেছেন। এ বিষয়ে তাঁর আরও সুদৃঢ় যুক্তি ছিল যদিও তিনি একটি সুন্নার আপাত-বিপরীত নীতি গ্রহণ করছেন, তা আঁ- হযরতের মৌল শিক্ষার অনুসরণহেতুই করছেন এবং আর একটি সর্বযুগমান্য সুন্নার পাবন্দ হয়েই করছেন। বাস্তবিক, আঁ-হযরতের মহৎ শিক্ষার এরূপ সৃষ্টিধর্মী শাশ্বত বাস্তবায়ন ওমরের ন্যায় অতি অল্পলোকের দ্বারা সম্ভব হয়েছে। জীবন্ত প্রগতিশীল সমাজের কল্যাণার্থে এ রকম বলিষ্ঠ যুক্তি ও মত গ্রহণের প্রয়োজন যুগে যুগে দেখা দেয়। ওমরের যুক্তির সারবত্তা সেদিন মজলিস-ই-শুরা বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করে এবং এই নীতি গৃহীত হয়: বিজিত অঞ্চলসমূহ রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে গৃহীত হবে, সেনাবাহিনীর তাতে অধিকার থাকবে না এবং ভূমির উপস্থিত মালি-দের উৎখাত করা হবে না।
ওমর এই নীতি প্রথমে ইরাক-আরবে প্রবর্তন করতে অগ্রসর হলেন। স্মরণাতীত কাল থেকে নওশেরওয়ার শাসনকাল পর্যন্ত উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক রাজকর হিসেবে নির্দিষ্ট ছিল এবং তিন কিস্তিতে আদায় করা হতো। খসরু পারভেজ এ হারের বৃদ্ধি করেন এবং ইয়েগির্দের আমলে আরও উচ্চহার নির্ধারিত হয়। ওমর প্রথমে জমি- জরিপের নির্দেশ দেন, এবং নিজেই মাপকাঠি প্রস্তুত করে দেন। ওসমান-বিন্-হানিফ ও হুদায়ফা বিন্-আল-ঈমান্ নামক দুই মশহুর সাহাবা কয়েক মাস পরিমাপ কাজ চালান। কিতাবুল-খারাজ নামক পুস্তকে কাযী আবু ইউসুফ বলেছেন, এ-পরিমাণ বস্ত্রখণ্ড মাপার মতো নির্ভুল হয়েছিল। সারা ইরাকের আয়তন ছিল প্রায় ত্রিশ হাজার বর্গ মাইল। তা থেকে পার্বত্যভূমি, মরুভূমি, নদীনালা প্রভৃতি বাদ দিয়ে তিন কোটি আট লক্ষ ‘জরীব’ কৃষিযোগ্য জমি পাওয়া গেল। রাজবংশের নিজস্ব সম্পত্তি, অগ্নি মন্দিরের সম্পত্তি, উত্তরাধিকারহীন, পলাতক ব্যক্তি ও রাষ্ট্রদোহীদের সম্পত্তি এবং নদী ও বনভূমি থেকে আহৃত সম্পত্তিসমূহ রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়, এবং সে সবের আয় থেকে ডাক, সরকারী ইমারতাদি ও পথঘাট রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কেউ ইসলামের সেবায় মহৎকাজ করলে এ-সব সম্পত্তি থেকে ইনাম দেওয়া হতো, কিন্তু কোন জমিই নিষ্কর দান করা হতো না। বাকী সব জমি পূর্বতন মালিকদের অধিকারে দেওয়া হয় ও এরূপ হারে প্রতি ‘জরীব’ জমিতে কর নির্ধারিত হয়: গমের দরুন দুই দিরহাম, যবের দরুন এক দিরহাম, ইক্ষুর দরুন ছয়, তুলার পাঁচ, আঙ্গুরের দশ, তিলের আট, সজীর তিন ও খেজুর-বাগানের দরুন দশ দিরহাম। উচ্চ শ্রেণীর জমির জন্যে এ হার দ্বিগুণ পর্যন্ত ধার্য হতো। পড়ো-জমির প্রতি জরীবের কর ছিল এক দিরহাম। এভাবে সমগ্র ইরাকের রাজস্বের পরিমাণ ছিল আট কোটি আট লক্ষ দিরহাম। ক্রমে ক্রমে পড়ো জমি আবাদ করা হলে এই রাজস্বের পরিমাণ তাঁর আমলেই বৃদ্ধি পেয়েছিল দশ কোটি আটাশ লক্ষ দিরহামে।
মিসরে টলেমিরা ফেরাউনদের অনুসৃত রাজস্ব-ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। ফেরাউনী আমলে ভূমির জরীপ করা হয় এবং চার বছরের চুক্তিতে কয়েক বছরের ফসলের গড় ধরে কর নির্ধারণ হয়। সে কর আদায় হতো অর্থে কিংবা ফসলে। রোমকরাও এ-নিয়ম বজায় রেখেছিল। তবে তারা ভূমি কর ছাড়াও রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের ও সেনাবাহিনীর জন্যে প্রতি বছর অতিরিক্ত খাদ্যশস্য আদায় করতো। ওমর ভূমি-কর প্রথা বজায় রাখেন, কিন্তু অতিরিক্ত খাদ্যশস্য আদায় বন্ধ করে দেন। তিনি করধার্যের ও আদায়ের সুবিধাজনক নীতি প্রবর্তন করেন। গীর্জা, স্নানাগার ও সরাইখানা সমূহের কোন কর ছিল না। তবে গ্রামীণ কারিগরদিগকেও কুটির শিল্পের জন্যে কর দিতে হতো। ভূমি-করের হার ছিল সাধারণত জরীব প্রতি এক দিনার। এভাবে মিসর থেকেও ওমরের আমলে এক কোটি কুড়ি লক্ষ দিনার (যার বর্তমান মূল্য পাঁচ কোটি ছয় লক্ষ টাকা) ভূমি-কর আদায় হতো। সিরিয়ার গ্রীকদের প্রবর্তিত ভূমি-কর ব্যবস্থা ওমর অপরিবর্তিতরূপে গ্রহণ করেন। তাঁর আমলে সিরিয়ার ভূমি-রাজস্বের পরিমাণ ছিল এক কোটি চল্লিশ লক্ষ দিনার। ফারস্, কিরমান, আর্মেনিয়া প্রভৃতি অন্যান্য বিজিত দেশের ভূমি-রাজস্ব সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। অনুমান হয়, মিসর ও সিরিয়ার মতো চলিত ব্যবস্থাই ওমর গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কেবল প্রচলিত কর-ব্যবস্থাই গ্রহণ করেন নি, রাজস্ব বিষয়ক সরকারী দলিলপত্র ও প্রচলিত ব্যবস্থায় ও স্থানীয় ভাষায় রক্ষিত হতো। প্রাক-ইসলাম যুগে ইরাক ও পারস্যে ফারসী ভাষায়, সিরিয়ায় ল্যাটিন ভাষায় ও মিসরে কপ্ট ভাষায় সরকারী কাগজপত্র লিখিত হতো। ওমরের আমলে এ-সব ভাষাতেই যথাযথ দলিল-দস্তাবেজ রক্ষিত হতো এবং পারসিক, গ্রীক ও কপ্ট কর্মচারীর রাজস্ববিভাগে যথাপূর্ব বহাল থাকতো।
কিন্তু ভূমি-রাজস্ব-ব্যবস্থায় ওমরের সবচেয়ে বড় সংস্কার হচ্ছে, প্রাচীন ও সমকালীন রাষ্ট্রসমূহের ন্যায় আবাদী জমি বাজেয়াত পূর্বক সেনাবাহিনী ও রাজকর্মচারীদের মধ্যে বন্টন না করে দিয়ে কৃষককুলের মালিকানা স্বত্ব বহাল রাখা। রোমকরা মিসর ও সিরিয়া জয় করে সমস্ত আবাদী জমি বাজেয়াক্ত করেছিল; এক অংশ সেনাবাহিনী ও রাজকর্মচারীদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছিল, এক অংশ সম্রাটের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং এক অংশ চার্চের জন্যে নির্দিষ্ট করেছিল। তার ফলে প্রকৃত চাষীরা উৎখাত হয়ে যায় এবং নয়া মালিকেরা ভূমিদাসে পরিণত হয়। ওমর এ-প্রথা রহিত করে দেন, এবং কঠোর নির্দেশ দেন যে, মুসলিমরা আবাদী জমির মালিকানা গ্রহণ করতে পারবে না, এমন কি ক্রয় মূল্যেও না। তিনি প্রাদেশিক শাসকদের বিশেষভাবে নির্দেশ দেন, কোন আরব যেন বিজিত দেশের কোনও প্রান্তে কৃষিকাজে লিপ্ত না হয়। শুরাইক ঘাতকী নামক জনৈক আরব মিসরে কৃষিকাজ আরম্ভ করলে ওমর তাকে মদীনায় তলব করেন এবং এরূপ কঠিন ভাষায় ভর্ৎসনা করে শাসন করেন যে, তার পর আর কেউ এ নিয়ম লঙ্ঘন করতে সাহসী হয় নি। পূর্বতন চাষীরা উৎখাত না হওয়ায় দেশের উৎপাদন-নীতিতে রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন হেতু কোন বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় নি। তার উপর ওমর প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দেন, যে কেউ পড়ো-জমি আবাদ করবে, সে সে-জমির মালিক হবে। কিন্তু কেউ জমি তিন বছরের বেশি অনাবাদী রাখলে মালিকানা স্বত্ব হারাবে। এই নীতির ফলে বহু অনাবাদী জমি অত্যল্পকাল মধ্যে ফসল উৎপাদন করতে থাকে। যারা যুদ্ধবিগ্রহের সময় দেশ ত্যাগ করেছিল, তারা প্রত্যাবর্তন করে নিজ নিজ জমিতে অধিকার লাভ করে ও নির্বিবাদে ফসল উৎপন্ন করতে থাকে। জমিতে সেচন প্রথার জন্যে খাল খনন, বাঁধ নির্মাণ ও পানি সরবরাহের জন্যে একটি পৃথক দফতরের সৃষ্টি হয়। এক মিসরেই এই দফতরে প্রায় এক লক্ষ তিন হাজার লোক সরকারী ব্যয়ে বহাল ছিল। খোজিস্তান ও আয়ায্ অঞ্চলে জুমা-বিন-মাবীয়া ওমরের নির্দেশে কয়েকটি খাল খনন করে সেচনের ব্যবস্থা করেন, তার ফলে লক্ষ লক্ষ একর জমি আবাদী হয়ে ওঠে। ওমরের কঠোর আদেশ ছিল, সৈন্য চলাচলকালে বা অন্য কোন কারণে যেন জমির ফসল নষ্ট করা না হয়। সিরিয়ায় অভিযানকালে জনৈক কৃষক ওমরের নিকট নালিশ করে, আরব সৈন্য তার জমির মধ্য দিয়া যাতায়াতকালে সমস্ত ফসল নষ্ট করে ফেলেছে। ওমর তখনই তাকে দশ হাজার দিরহাম ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন।
ভূমিকর নির্ধারণ ও আদায় ব্যবস্থায় ওমর এই ন্যায়নীতি অনুসরণ করেন: তিনি স্থানীয় পারসিক ও খ্রিস্টান জিম্মীদের মধ্য থেকে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করতেন এবং তাঁদের অভিমত ও প্রস্তাবসমূহ সহৃদয়ভাবে বিবেচনা করতেন। ইরাকের ভূমি-কর ব্যবস্থা নিরূপণকালে প্রত্যেক প্রদেশের দুজন অভিজ্ঞ ইরাকীকে, আহ্বান করে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছিল। মিসরের ক্ষেত্রে প্রাক্তন শাসক মুকাকুস্ ও একজন কন্ট্ রাজনীতি বিশারদের পরামর্শ গৃহীত হয়েছিল।
খেরাজ প্রবর্তনে উপরোক্ত নীতি গৃহীত হলেও উদ্রী বা মুসলিম দখলীকৃত ভূমির কর নির্ধারণে পৃথক নীতি গৃহীত হয়। এ-উদ্দেশ্যে উরি জমি তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়: মদীনা ও অন্যান্য খাস আরবদেশে আরব মুসলিমদের জমি; ফৌৎ জিম্মীদের যে- সব জমি মুসলিমদের দখলে আসে এবং মুসলিমরা যে-সব অনাবাদী জমি আবাদ করেছিল। এ-সব উরি জমির উপর খেরাজের পরিবর্তে যাকাত হিসেবে উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ কর বসানো হয়। কিন্তু জমিতে সেচনের সুবিধা থাকলে খেরাজের হারে কর দিতে হতো। তাছাড়া মুসলিমদেরকে গৃহপালিত পশু, ঘোড়া ও নগদ সঞ্চিত অর্থের উপর যাকাত দিতে হতো, অথচ জিম্মীদের দিতে হতো না। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্বনবী ঘোড়ার উপরে কোন যাকাত ধরেন নি, কারণ তাঁর আমলে অশ্ব শুধু আরোহণের জন্যেই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ওমরের আমলে অশ্ব ব্যবসায় খুবই লাভজনক হয়ে উঠে; এজন্য আরোহণের ব্যবহৃত অশ্ব ব্যতীত অন্য সব অশ্বের উপর ওমর যাকাত ধার্য করেন।
ওমর উত্তর নামে আর একটি মাসুল ধার্য করেন। যে-সব মুসলিম বিদেশে ব্যবসা করতো, তাদেরকে আমদানি-কর হিসেবে মালের এক-দশমাংশ মূল্য সে-সব দেশের ইনানুযায়ী রাজসরকারে আদায় দিতে হতো। ওমরও তুল্যরূপে মুসলিম দেশসমূহে আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্যের উপর মূল্যের এক দশমাংশ মাসুল হিসেবে ধার্য করেন। এই মাসুল আদায়ের জন্যে ওমর পৃথক পৃথক বহিঃশুল্ক বিভাগও স্থাপন করেন। এই মাসুল আমদানিকৃত পণ্যদ্রব্যের উপর এক বার মাত্র আদায় করতে হতো। ব্যক্তিগত মালপত্রের উপর কিংবা দুইশত দিরহামের ন্যূন মূল্যের পণ্যের উপর মাসুল ধার্য হতোনা।
রাজস্ব-নীতির আমূল সংস্কারের ফলে প্রভূত পরিমাণে টাকা-কড়ি আমদানি হতে থাকে। এবং তার দরুন আনুষঙ্গিক সরকারী খাজাঞ্চীখানা স্থাপনের প্রয়োজনও দেখা দেয়। বলা বাহুল্য ওমরের পূর্বে মুসলিম রাষ্ট্রের এটির প্রয়োজন অনুভূত হয় নি। আঁ- হযরতের জীবদ্দশায় শেষবার বাহ্রায়েন থেকে আট লক্ষ দিরহাম পাওয়া যায় ভূমি-কর হিসেবে, কিন্তু এক বৈঠকেই সমুদয় অর্থ বিলিয়ে দেন। মালে-গনিমাত বা অন্যবিধ যা কিছু অর্থ সামগ্রী আমদানি হতো আবুবকর সে-সমস্তই বিলিয়ে দিতেন, কিছুই উদ্বৃত্ত থাকতো না।
১৫ হিজরীতে আবু হোরায়রাহ্ ওমর কর্তৃক বাায়েনের শাসক নিযুক্ত হন, এবং সালতামামীতে পাঁচ লক্ষ দিরহাম মদীনায় প্রেরণ করেন। এই বিপুল অর্থ নিয়ে কি করা যায়, মজলিস-ই-শুরায় তার আলোচনা হয়। আলী বলেন, সারা বছরে যা কিছু অর্থ পাওয়া যায়, সবই বিলিয়ে দেওয়া উচিত, জমা রাখার দরকার নেই। ওসমান এ মতের বিরোধিতা করেন, এবং ওলিদ-বিন্ হিশাম বলেন যে, তিনি সিরিয়ায় খাজাঞ্চীখানা ও হিসাব-দফতর দেখেছেন। এ প্রস্তাব ওমরের পছন্দ হয়, এবং তিনি মদীনায় একটি কেন্দ্রীয় কোষাগার স্থাপন করেন। আবদুল্লাহ-বিন্-আরকাম নামক মশহুর সাহাবা ইসলামের প্রথম খাজাঞ্চী নিযুক্ত হন। ক্রমে ক্রমে কুফা, ইস্পাহান প্রভৃতি প্ৰত্যেক প্রাদেশিক রাজধানীতে ও অন্যান্য কেন্দ্রস্থলে খাজাঞ্চীখানা স্থাপিত হয়। এ উদ্দেশ্যে মজবুত ইমারত প্রস্তুত হয় ও নিরাপত্তার জন্যে সর্বক্ষণ লোক-সমাগম সম্ভব মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে কোষাগার হারার জন্যে একদল সৈন্য মোতায়েন রাখা হতো। প্রাদেশিক বা জিলার কোষাগার থেকে স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যয়-নির্বাহ হ’তো এবং বছর শেষে সমগ্র উদ্বৃত্ত অর্থ মদীনায় কেন্দ্রীয় কোষাগারে প্রেরিত হতো। মদীনাবাসীদের মাসোহারা প্রভৃতিতে সালানা তিন কোটি মুদ্রা কোষাগার থেকে ব্যয়িত হতো।
যাকাত ও জিয়া ধার্যের জন্যে আদম শুমারী অনুষ্ঠিত হয়। আরবে আদমশুমারী গৃহীত হয় সুষ্ঠুভাবে মাসোহারা বন্টনের জন্যে। উম্মুল মুমেনীন বিবি আয়েশার বার্ষিক বৃত্তি ছিল বারো হাজার দিরহাম। আল-বায়েত বা নবী বংশীয়রা এবং মুহজেরীন ও আনসারগণ ইসলাম গ্রহণের দিন হিসেবে অগ্রাধিকার লাভ করতেন এবং প্রত্যেক সালানা পাঁচ বা চার হাজার দিরহাম প্রাপ্ত হতেন। তাঁদের পর আরবের সাধারণ বাসিন্দাদের নামোল্লেখ থাকতো সেনাবিভাগের কর্মদক্ষতার গুণে কিংবা কোরআন হাফিজ হওয়ার দক্ষতার জন্য। একজন যোদ্ধার বার্ষিক বরাদ্দ ছিল পাঁচ থেকে ছয় শত দিরহাম। নারী, শিশু ও মাওলী বা সেবকদের জন্যেও বার্ষিক নির্দিষ্ট বরাদ্দ ছিল। এ সব আদম-শুমারী ও বৃত্তিধারীদের তালিকা প্রস্তুত হতো একটি পৃথক দিওয়ানে। ওমর নিঃসন্দেহে ইসলামে এরূপ দিওয়ান সৃষ্টির জন্য কৃতিত্বের হদার।
সরকারী আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ ওমরের আমল থেকে আরম্ভ হয়। সেনাবাহিনীর অধিনায়কদেরকেও যুদ্ধের ব্যয় ও মালে-গনিমাতের সঠিক হিসাব রাখতে হতো ও খলিফার নিকট পেশ করতে হতো। উল্লেখযোগ্য যে, খালিদের পদচ্যূতি হয়েছিল হিসাব দাখিল করতে অস্বীকার করার দরুন।
এরূপ নানাবিধ হিসাব সংরক্ষণ এবং সরকারী কাজকর্মের ও নথিপত্রের ক্রম-রক্ষার প্রয়োজনেই পঞ্জিকার উদ্ভব। প্রাক-ইসলাম যুগে আরবে কোনও অব্দ বা সাল গণনার রীতি ছিল না। ১৬ই হিজরীর কোন এক দিনে ওমরের নিকট একটি খসড়া পেশ করা হয়, তাতে কেবল ‘শাবান’ শব্দের উল্লেখ ছিল। ওমর জিজ্ঞাসা করেন, উক্ত শাবান গত বছরের, না চলতি বছরের, কিন্তু কোন সদুত্তর মেলে না। তখন তিনি মজলিসে-ই-শুরার নিকট সন ধার্যের মীমাংসা চাইলেন। অনেকেই মত প্রকাশ করেন, পারসিকদের পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। মহাজ্ঞানী আলী প্রস্তাব করেন, হিজরত অর্থাৎ আঁ-হযরতের মক্কা থেকে মদীনায় অমর বিদায়ের ঘটনা থেকে গণনা করা উচিত। সকলেই এ প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। মহানবী হিজরত করেছিলেন রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখে। কিন্তু আরবী বছরের প্রথম মাসের নাম মহররম এবং এ হিসেবে হিজরত হয় বছর আরম্ভের দুই মাস আট দিন পরে। সকলেই একমত হন, বছরের প্রথম দিন থেকে হিজরী সন গণনা করা হবে, এবং এ হিসেবে সনটি দুইমাস আট দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়।
ওমরের আর একটি কৃতিত্ব আরবী মুদ্রার প্রচলন। অনেক ঐতিহাসিক এ কৃতিত্ব খলিফা আবদুল মালেক-বিন্ মারওয়ানকে (৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে) দিয়ে থাকেন, কিন্তু মাকরিজি বলেন, ওমরই প্রথম আরবী মুদ্রা জারী করেন। ১৮ হিজরীতে ওমর নির্দেশ দেন, জনপ্রতি এক জরীব মাপের খাদ্যশস্য ও দুই দিরহাম কমপক্ষে মাসিক বরাদ্দ পাবে। এই সময়েই তিনি খুসরু নওশেরওয়ার অনুরূপ দিরহাম প্রবর্তন করেন। ওমরের শাসনের শেষের দিকে দশ দিরহাম মুদ্রার ওজন ছিল ছয় মিকাল। মারওয়ান্দী বলেন, সেকালে পারস্যে তিন শ্রেণীর দিরহামের প্রচলন ছিল, আট দাঙের বাঘালি দিরহাম, চার দাঙের তাবারী দিরহাম ও তিন দাঙের দাঙের মাগরিবী দিরহাম। বাঘালি ও তাবারী দিরহাম অধিক জনপ্রিয় থাকায় ওমর নির্দেশ দেন, এ দুয়ের মোট মূল্যের অর্ধেক ধরে ইসলামী দিরহামের মূল্যমান স্থিরীকৃত হবে। তার দরুন ছয় দাঙ মূল্যের দিরহাম নির্দিষ্ট হয়।