প্রলয়ের স্বপ্ন নিয়ে – উপেন মান্না
স্কাইস্ক্রেপার। আকাশছোঁয়া সব বড়-বড় বাড়ি। নীচে দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকালে অস্পষ্ট দেখায়। অতদূর দৃষ্টি পৌঁছয় না। ওপরতলা থেকে নীচের দিকে তাকালে মাথা ঘোরে। নীচের যানবাহন কিছুই নজরে পড়ে না। কেমন যেন একটা কুয়াশাচ্ছন্ন আলো-আঁধারির মতো দেখায়।
এইরকম একটি নব্বইতলা বাড়িতে বিজ্ঞান উন্নয়ন সংস্থার দপ্তর। প্রফেসর উপানন্দ বিশেষ একটা জরুরি সভার কাজ শেষ করে একসময় নেমে এলেন নীচে। সহকারী লিলি অপেক্ষা করছিল গাড়িতে। প্রফেসরকে দেখতে পেয়ে উদ্বিগ্নচিত্তে প্রশ্ন করল, ‘কিছু কি বুঝতে পারলেন, স্যার! আমরা কি কিছু ব্যবস্থা করতে পারব?’
গাড়িতে উঠে প্রফেসর উপানন্দ ম্লান হাসি হেসে বললেন, ‘না লিলি, কোনও ব্যবস্থাই গ্রহণ করা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। মূল উৎসই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই গুরুতর পরিস্থিতির উৎপত্তি জানতে না পারলে আমরা অগ্রসর হব কোন পথ ধরে, বলো?’
এরপর আর কী জবাব দেবে লিলি! ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। গাড়ি ছুটল প্রফেসর উপানন্দের বাড়ির দিকে। মাইল-দুই চলে আসার পর লিলি পিছন ফিরে একবার তাকাল—পিছনে ফেলে আসা সেই আকাশচুম্বি সৌধের দিকে। আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা অব্যক্ত বিস্ময়-ধ্বনি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। লিলির কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হয়ে প্রফেসর উপানন্দ পিছনে তাকিয়েই হতবাক হয়ে গেলেন।
এতদিন ভারতের কোনও শহরই এ-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারেনি, কিন্তু আজ এই প্রথম সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বহন করল আমাদের এই সুন্দরী কলকাতা।
‘উঃ, কী ভীষণ! আমি যে ভাবতেই পারছি না, স্যার! এতদিন কেবল শুনেছি মাত্র, স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু যা দেখছি, তা যে ভাবাই যায় না, স্যার!’ আতঙ্ক-বিহ্বল কণ্ঠে লিলি বলল।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে প্রফেসর যাত্রা করলেন বিজ্ঞান উন্নয়ন সংস্থার দপ্তরের দিকে। কয়েকটি ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স ওঁদের গাড়ি ওভারটেক করে ছুটছে অকুস্থলের দিকে।
কোথায় দপ্তর! কোথায় কী! প্রফেসর উপানন্দ নেমে এলেন গাড়ি থেকে। চারদিকে তখন জনতার জটলা। পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড, অ্যাম্বুলেন্স… সব কিছুই এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু তাদের কাজ কী কেউ বলে দিচ্ছে না। কারণ, তাদের করবার কিছুই ছিল না।
লিলি ও প্রফেসর উপানন্দ নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন ফাঁকা জমিটার দিকে। এই একটু আগেই ফাঁকা জমিটার ওপর নব্বইতলা বাড়িটা ছিল। যার পঁচাশিতলায় ছিল বিজ্ঞান উন্নয়ন সংস্থার অফিস, প্রফেসর কিছুক্ষণ আগেই যেখানে জরুরি সভায় মিলিত হয়েছিলেন।
নব্বইতলা বাড়িটা সম্পূর্ণভাবে উড়ে গেছে। একটুকরো সিমেন্ট-বালি পর্যন্ত সেখানে পড়ে নেই। মনে হল, কেউ যেন বিরাট এক ইস্পাতের করাত দিয়ে তলা থেকে কেটে বাড়িটাকে আকাশপথে কোনও অজানা দেশে নিয়ে গেছে। একখণ্ড ফাঁকা জমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না সেখানে।
মুহূর্তের মধ্যে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ল। বড়-বড় বহুতল বাড়ির বাসিন্দারা যে-যার প্রাণভয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটল। এতদিন সকলেই কাগজে পড়ে এসেছে যে, পৃথিবীর বড়-বড় শহরগুলি থেকে বড় বহুতল বাড়িগুলি চক্ষের পলকে কোথায় যেন উধাও হয়ে যাচ্ছে। নিউ ইয়র্কের ওপর আর একটি বাড়িও অবশিষ্ট ছিল না। মস্কো, প্যারিস, টোকিও, মেলবোর্ন, সিডনি, হামবুর্গ, জাকার্তা, ব্যাংকক কোথাও বাদ ছিল না। একমাত্র ভারতই ছিল ব্যতিক্রম, যেহেতু ভারতের কোনও শহরই এতদিন এভাবে কোনও বাড়ি হারায়নি।
কলকাতায় হঠাৎ এই অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণ অথবা এক অলৌকিক উপায়ে নব্বইতলা বাড়িটি উধাও হয়ে যাওয়ায় সকলেরই একটা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল। সারা ভারতে ঘোষণা করা হল জরুরি অবস্থা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে একজন প্রফেসরকে জানাল, সে তখন সামনের রেস্তোরাঁতে বসে কফি খাচ্ছিল, হঠাৎ একটা কুয়াশার মতো ধোঁয়ার আবরণে বাড়িটা ঢাকা পড়ে গেল। অমন ধোঁয়া বা কুয়াশা তো হামেশাই লেগে থাকে, তাই তেমন গুরুত্ব দিয়ে সে ব্যাপারটা দেখেনি। কিন্তু সেই কুয়াশার আবরণ সরে যেতেই সে দেখতে পেল, অতবড় বাড়িটা আর নেই। কে যেন উধাও করে দিয়েছে। অথচ মজার কথা যে, কোনওরকম শব্দ না করেই বাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তার হাত থেকে কফির কাপটা খসে পড়ল মাটিতে। সে ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে।
এ যেন যুদ্ধের সময় যুদ্ধের খবর পড়া। দূরে যুদ্ধ হচ্ছে, অজস্র বোমা পড়ছে, লক্ষ-লক্ষ লোক হতাহত হচ্ছে। খবরের কাগজে সেসব খবর পড়তে-পড়তে আমরা কিছুটা আলোচনা করি এবং তারপরই ভুলে যাই। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু যখন সত্যিকারের বোমা আমাদের সামনে পড়ে এবং আমরা রণক্ষেত্রের মধ্যে হঠাৎ পড়ে যাই, তখন তার ভয়াবহ রূপ দেখে আমরা অবাক হই, থমকে যাই। আজকের ঘটনাটা ঠিক সেইরকমভাবেই সবাইকে স্তব্ধ করে দিল।
মুখে কারও কথা ছিল না। অতবড় প্রকাণ্ড বাড়িটা চোখের নিমেষে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার চিন্তাটাই ছিল বিস্ময়কর। কীভাবে এর ব্যাখ্যা করা যায় কেউই বুঝতে পারছিল না। তবে এ-কথাটা সকলেই অনুভব করল যে, এক ভয়ানক বিপদ পৃথিবীর ওপর শাণিত খড়্গ নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রফেসর উপানন্দ চিন্তাকুটিল মুখে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন, লিলিও অনুসরণ করল তাঁকে। গাড়ি ছুটল বাড়ির দিকে। সারাটা পথ আত্মস্থ হয়ে রইলেন তিনি। সহস্র চিন্তায় তাঁর মন আচ্ছন্ন।
আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল প্রফেসরের জন্য। বাড়িতে পৌঁছতেই টেলিফোনটা বেজে উঠল। লিলি গিয়ে টেলিফোনটা ধরেই রিসিভারটা এগিয়ে দিতে-দিতে বলল, ‘দিল্লি থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়, স্যার! খুবই নাকি জরুরি।’
রিসিভার কানে লাগাতেই ওপার থেকে ভেসে এল ব্যাকুল কণ্ঠস্বর, ‘আমি কি প্রফেসর উপানন্দের সঙ্গে কথা বলছি?’
‘হ্যাঁ, আপনি কে?’
‘আমি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলছি।’
‘বলুন, আমাকে হঠাৎ তলব করলেন কেন?’
‘অবস্থা খুবই জটিল, প্রফেসর! কিছুক্ষণ আগে কলকাতায় নব্বইতলা বাড়িটার বেমালুম অদৃশ্য হওয়ার খবর পৌঁছতে-না-পৌঁছতেই তামিলনাড়ু, বোম্বাই, কোচিন, নাগপুর ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি শহর থেকেই খবর আসতে শুরু করেছে যে, সেখানকার বহুতল বাড়িগুলিও চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই বেমালুম উধাও হয়ে যাচ্ছে। এমনকী দিল্লিরও কয়েকটি বাড়ি এইমাত্র মুছে গেল দিল্লির জমি থেকে। এতদিন আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম এই কথা ভেবে যে, ভারতে এমন অঘটন ঘটবে না। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি আমাদের ভাবনার বিপরীত হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা কী করব, আমাদের কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, একমাত্র আপনিই এই ঘোরতর দুর্বিপাক থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারেন।’
‘মাননীয়!’ প্রফেসর উপানন্দ বললেন, ‘আমার প্রতি আপনার এই আস্থা দেখে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। কিন্তু ঘটনাগুলো এতই জটিল যে, এ-বিষয়ে চট করে কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, এর উৎস যে কোথায় তা খুঁজে না পাওয়া অবধি কিছুই বলা যাবে না। আমি এই ভয়ঙ্কর রহস্যের মূলে পৌঁছনোর যথাসাধ্য চেষ্টা করব এবং যথাসময়ে আপনাকে জানাব—অবশ্যই যদি সফল হতে পারি।’
টেলিফোনটা রেখে দিয়ে প্রফেসর উপানন্দ তাকালেন লিলির দিকে। লিলি বলল, ‘কিছু কি অনুমান করছেন, স্যার?’
‘অনুমান? না লিলি, তেমন কিছু নয়,’ প্রফেসর উপানন্দ চিন্তাকুটিল মুখে বললেন, ‘তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত যে, পৃথিবীর কোনও রাষ্ট্র অথবা কোনও ব্যক্তি এই ঘটনায় লিপ্ত নয়। তাই যদি হত, তাহলে পৃথিবীতে প্রতিটি রাষ্ট্রই আক্রান্ত হত না। শুধু বাড়িগুলি নিশ্চিহ্ন হলে না হয় চিন্তার কিছু ছিল না, কিন্তু বাড়ির সঙ্গে-সঙ্গে সেই বাড়ির বাসিন্দারাও উধাও হয়ে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি কমতে থাকবে।’
এ-রহস্যের কিনারা করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা উঠে পড়ে লাগলেন এর একটা বিহিত করতে। কিন্তু দিনের পর দিন অতিবাহিত হয়ে চলে, আর একের-পর-এক আকাশচুম্বি সৌধরাজি পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। একসপ্তাহের মধ্যে পৃথিবীতে এমন কোনও শহর রইল না, যেখানে চার-পাঁচতলার বেশি উঁচু বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। শেষ যে-শহর দুটিতে তখনও কয়েকটি আকাশচুম্বি বাড়ি অবশিষ্ট ছিল তাও আজ শেষ হয়ে গেল। সে-দুটি শহর হল জাপানের টোকিও আর কোরিয়ার সিওল।
বাড়িগুলির সঙ্গে কোটি-কোটি লোকও শেষ হয়ে গেল। আতঙ্কে ভরে উঠল চারিদিক। কখন যে কার মাথায় নেমে আসবে এই অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণ, কেউ জানে না।
গবেষণাগারে বসে প্রফেসর উপানন্দ বর্তমান পরিস্থিতির চিন্তায় মগ্ন। কার দ্বারা এমন কাজ সম্ভব? যদি ধরে নেওয়া যায় মহাকাশ থেকে কেউ, যারা অন্য কোনও উন্নত গ্রহের জীব, এমন কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে, তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায় অযথা তারা এভাবে পৃথিবীবাসীদের উত্ত্যক্ত করবে কেন? বিশেষ করে, বেছে-বেছে আকাশচুম্বি বাড়িগুলি ধ্বংস করেই বা তাদের কী উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে! আর, যদি ধরে নেওয়া যায়, পৃথিবীতেই কেউ এমন কাজ করে যাচ্ছে, তবে এখানেও একটা প্রশ্ন উঁকি মারে বিজ্ঞান কি পৃথিবীতে এতদূর এগিয়ে গেছে? এবং এমন শক্তি কি কেউ অর্জন করেছে যা দিয়ে শত-শততলাবিশিষ্ট বাড়িগুলোকে একনিমেষে হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়া যায়? দুটোর কোনওটাই মনঃপূত হয় না প্রফেসরের। অথচ একটা কিছুকে কেন্দ্র না করে অনুসন্ধানে মনোনিবেশও করা যায় না।
মনটা হালকা করে নেওয়ার জন্য প্রফেসর উপানন্দ খবরের কাগজটা নিয়ে চোখ বোলাতে লাগলেন। একটা খবর নজরে পড়তেই তিনি চমকে উঠলেন। খুবই সাধারণভাবে খবরটি পৃষ্ঠার এককোণে ছাপা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, ‘এম-ভি-ফ্যান্টাস’ নামক একটি পণ্যবাহী জাহাজের ক্যাপ্টেন যখন জাহাজটিকে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের ইলোইলো বন্দর থেকে মাল বোঝাই করে হাওয়াই দ্বীপের হনলুলু বন্দরের দিকে পরিচালিত করেন, তখন মাঝপথে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পান। জাহাজ থেকে আনুমানিক পাঁচকিলোমিটার দূরে মহাশূন্য থেকে সমুদ্রের বুকে নেমে এসেছে একটি বিরাট কালো ছায়া। ভালো করে কিছু দেখবার আগেই সেই ছায়াটি মিলিয়ে যায় আকাশের গায়ে। জাহাজের ক্যাপ্টেন সঙ্গে-সঙ্গে ইলোইলো বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেতারে সংযোগ স্থাপন করে ঘটনাটি জানিয়ে দেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ কয়েকটি দ্রুতগামী বিমানকে পাঠান ব্যাপারটি সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য। কিন্তু তারা এ-বিষয়ে কোনও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। বন্দর কর্তৃপক্ষের ধারণা, জাহাজের ক্যাপ্টেন হয়তো কিছুই দেখেননি। সম্ভবত ব্যাপারটা তাঁর মনের ভুল।
প্রফেসর উপানন্দ আর একটি দিনও বিলম্ব না করে ইলোইলো যাওয়ার সঙ্কল্প করলেন। লিলিকে ডেকে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে বললেন, সম্ভব হলে আজ রাত্রেই যেন একটা বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করা হয়।
কর্তৃপক্ষ কালবিলম্ব না করেই প্রফেসরের জন্য একটি বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রফেসর উপানন্দ ও সহকারী লিলি সেইরাত্রেই রওনা হয়ে গেলেন ইলোইলো অভিমুখে। প্রফেসর উপানন্দের স্থির বিশ্বাস, জাহাজের ক্যাপ্টেন ভুল দেখেননি। এখন প্রথম কর্তব্য হচ্ছে ইলোইলো থেকে খবর সংগ্রহ করা, ‘এম. ভি. ফ্যান্টাস’-এর ক্যাপ্টেন কোন পজিশনে সেই কালো ছায়াকে দেখেছিলেন।
ইলোইলো বন্দরে যাওয়ার আগে বিমানটি একবার রাজধানী ম্যানিলাতে নামল। ওঁরা প্লেন থেকে নেমে লাউঞ্জের দিকে অগ্রসর হলেন। আর, ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখলেন দূরের একটি বহুতল বাড়িকে ঘিরে যেন জমাট কুয়াশার সৃষ্টি হয়েছে এবং তার কয়েকসেকেন্ড পরে কুয়াশা সরে যেতেই দেখা গেল বাড়িটি বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেছে।
প্রফেসর উপানন্দ মাঝপথ থেকেই ফিরে এলেন প্লেনে। প্লেনটি উড়ে চলল ইলোইলোর দিকে। এখন আর একমিনিটও সময় নষ্ট করা চলে না। এরপর হয়তো ছোট-ছোট তিনতলা, চারতলা বাড়িগুলোও ওদের কবলে পড়বে!
বন্দর কর্তৃপক্ষ তেমন কোনও সংবাদ পরিবেশন করতে পারলেন না, তবে ‘এম. ভি. ফ্যান্টাস’-এর ক্যাপ্টেন কোন জায়গা থেকে সেই কালো ছায়া দেখেছিলেন তার অবস্থানটুকু জানালেন। কর্তৃপক্ষ আরও বললেন যে, ফ্যান্টাসের ক্যাপ্টেন গুয়াম দ্বীপ পার হয়ে যখন হনলুলুর দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই সেই ছায়াটি দেখতে পান—২০ ডিগ্রি উঃ দ্রাঘিমাংশের কাছাকাছি।
লিলি বলল, ‘আমাদের গুয়াম থেকে একটা লঞ্চে এগুতে হবে, স্যার! প্লেনে করে ঘুরলে আমাদের কাজ সফল হবে বলে মনে হয় না!’
‘তুমি ঠিকই অনুমান করেছ লিলি,’ প্রফেসর উপানন্দ বললেন, ‘আমরা গুয়াম থেকে লঞ্চে করেই রওনা হব।’
গুয়ামে পৌঁছেই প্রফেসর উপানন্দ ও লিলি সোজা গিয়ে উঠলেন লঞ্চে। ইলোইলো কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই গুয়ামে সংবাদ পাঠিয়ে সব কিছু তৈরি রাখতে বলেছিলেন। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে নির্দিষ্ট নিশানা লক্ষ করে লঞ্চটি ছুটে চলল।
সাতদিন সাতরাত একটানা জল কেটে এগিয়ে চলল ক্ষুদ্রকায় লঞ্চটি। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে রাখলেও প্রফেসর উপানন্দের তেমন কিছু নজরে পড়ল না। ম্যাপ নিয়ে দেখলেন নিজেদের অবস্থান। ওঁদের লঞ্চটি এখন এমন এক জায়গায় রয়েছে যেখান থেকে পাঁচশো মাইলের মধ্যে কোনওদিকেই কোনও দ্বীপ বা স্থলভাগ নেই। প্রফেসর উপানন্দ লঞ্চটিকে সেখানেই রাখবার মনস্থ করলেন।
এমনসময় রেডিও অপারেটর এসে খবর দিল, ‘এইমাত্র মেসেজ পেলাম, এইপথ দিয়েই ”ক্লিওপেট্রা” আসছে। হাতে মাত্র দু-ঘণ্টার মতো সময় আছে। তার আগেই নিরাপদ দূরত্বে পালিয়ে যেতে হবে।’
সকলের মুখ শুকিয়ে উঠল। ‘ক্লিওপেট্রা’ নামধারী যে-ঝড় এগিয়ে আসছে, তার কবলে পড়ে বড়-বড় জাহাজ এক নিমেষে ডুবে যায়। আর এটা তো সামান্য একটা লঞ্চ মাত্র!
‘ক্লিওপেট্রা’-র কবলমুক্ত হওয়ার অভিপ্রায়ে লঞ্চটি যতদূর সম্ভব তীব্রগতিতে উত্তরাভিমুখে ছুটল। কিন্তু সম্পূর্ণরূপে বিপন্মুক্ত হতে পারল না। নিক কালো এক ভয়ঙ্কর দৈত্য সারা আকাশ জুড়ে ছুটে আসতে লাগল, উত্তাল হয়ে উঠল জলরাশি। আর মিনিট-পনেরো সময় পেলে প্রফেসর উপানন্দের লঞ্চটি ‘ক্লিওপেট্রা’-র আওতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে যেতে পারত, কিন্তু তা আর হল না। ঝড়ের একাংশ এসে আছড়ে পড়ল লঞ্চটির ওপর। সকলেই লাইফ-জ্যাকেট পরে প্রস্তুত হয়েছিল। লঞ্চটি ঝড়ের ধাক্কায় অকল্পনীয় গতিতে ছুটে গিয়েই উলটে গেল। লঞ্চের আরোহীরা ছিটকে পড়ল সমুদ্রের জলে। অবাক হয়ে সকলেই লক্ষ করল, যেখানে ওরা ছিটকে পড়েছে সমুদ্রের জল সেখানে শান্ত। ‘ক্লিওপেটা’ সরে যাচ্ছে দিকচক্রবালের দিকে। লঞ্চটি তখন জলের তলায় অকূল সমুদ্রে। এখন ওদের কে দেবে কূলের ঠিকানা!
লিলি হঠাৎ ‘দ্বীপ!’ বলে চিৎকার করে উঠল। সকলের দৃষ্টি সেদিকে গিয়ে পড়ল। ওরা পৌঁছে গেছে একটা ছোট্ট দ্বীপের উপকূলে।
প্রফেসর উপানন্দ অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার, লিলি! প্রশান্ত মহাসাগরের এ-অঞ্চলে তো কোনও দ্বীপ থাকার কথা নয়! আমরা কি তবে একটি অনাবিষ্কৃত দ্বীপকে আবিষ্কার করলাম?’
লিলির বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। ও জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘তাই তো দেখছি, স্যার!’
লঞ্চের চালক বলল, ‘দ্বীপটি যে আমাদের জীবন রক্ষা করল শুধু সেই কথাটাই ভাবুন, স্যার। নয়তো এতক্ষণে সমুদ্রের নোনা জল খেয়েই প্রাণটা বেরিয়ে যেত। এখন চলুন, দ্বীপে গিয়ে উঠি, তারপর অন্য চিন্তা করা যাবে।’
চালকের কথায় সকলে বাস্তবে ফিরে এল। সকলেই দ্বীপটির দিকে এগিয়ে চলল।
দ্বীপটি খুবই ছোট। ওরা যেখান দিয়ে দ্বীপের মধ্যে প্রবেশ করবে সেখানটা ঘন জঙ্গলে ভরা। প্রফেসর উপানন্দ সবাইকে সমুদ্রতটে অপেক্ষা করতে বলে লিলিকে নিয়ে দ্বীপটিকে পর্যবেক্ষণ করতে অগ্রসর হলেন। কে জানে, কোথাও হয়তো লুকিয়ে আছে মানুষখেকো জংলি মানুষ! অথবা অজানা কোনও হিংস্র প্রাণী। জঙ্গল দু-হাত দিয়ে সরিয়ে পরিষ্কার করে কিছুটা এগোতেই নজরে পড়ল একটা পাহাড়। তার গা বেয়ে নেমে এসেছে সুস্বাদু জলের ঝরনাধারা।
তৃষ্ণা যেন বেড়ে উঠল ঝরনা দেখে। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে আকণ্ঠ জলপান করে লিলি ও প্রফেসর উপানন্দ যেন নতুন প্রাণ পেলেন। লঞ্চের অন্যান্য লোকজনকে ডেকে এনে আপাতত ঝরনার ধারেই বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন।
ক্লান্ত লঞ্চ-চালক, রেডিও অপারেটর ও অন্যান্য কর্মীরা কয়েকমিনিটের মধ্যেই নাক ডাকাতে লাগল। প্রফেসর উপানন্দ পাহাড় বেয়ে ওপর দিকে উঠতে লাগলেন। লিলিও তাঁর সঙ্গ নিল।
কয়েক ফুট উঠতেই ভেসে উঠল প্রশান্ত মহাসাগরের সীমাহীন নীল সমুদ্র। যে-দিকেই চোখ যায়, সে-দিকেই দৃষ্টি গিয়ে থামে দিকচক্রবালের সীমায়। হঠাৎ সামনের দিকে একটা অদ্ভুত দৃশ্য প্রফেসরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বিরাটকায় একটি কালো ছায়া ভেসে উঠেছে অদূরে। ছায়াটি সমুদ্রের বুক থেকে সোজা উঠে গেছে মহাশূন্যের দিকে। দূরবিন চোখে লাগাতেই প্রফেসর উপানন্দ দেখলেন, ওই কালো ছায়ার মধ্যে দিয়ে টুকরো-টুকরো জিনিস ঠাসাঠাসি হয়ে নেমে আসছে মহাসমুদ্রের বুকে। জিনিসগুলি শেষ হওয়া মাত্রই ছায়াটা অস্পষ্ট হয়ে গেল।
লিলি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল প্রফেসর উপানন্দের দিকে। গম্ভীর মুখে প্রফেসর উপানন্দ বললেন, ‘আমার অনুমান যদি সত্য হয়, লিলি, তবে জেনে রাখো, ওই ছায়া-ঘেরা সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে বহুতল বাড়িগুলি টুকরো-টুকরো হয়ে নেমে আসছে। যে-বাড়িগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে আমাদের সেই অদৃশ্য আততায়ী সেই বাড়িগুলিকে ভেঙেচুরে সমুদ্রের বুকে নিক্ষেপ করছে। সম্ভবত, মহাকাশের কোথাও তার ঘাঁটি থাকা সম্ভব। আমাদের খুঁজে পেতে হবে সেই ঘাঁটি। কিংবা আর-একটা সম্ভাবনার কথাও মনে আসছে। মহাকাশ থেকে এসব জঞ্জাল কেন ওরা সমুদ্রের বুকে নিক্ষেপ করতে যাবে! ওরা মহাশূন্যেই ছড়িয়ে দিতে পারে এইসব টুকরোগুলোকে! এমনও হতে পারে, পৃথিবীর বুকে বসেই কোনও বিজ্ঞানী এইভাবে তার জিঘাংসা চরিতার্থ করছে।’
কথা বলতে-বলতে ওঁরা আরও ওপর দিকে উঠছিলেন। লিলি কীসে পা জড়িয়ে পড়ে যেতে-যেতে প্রফেসর উপানন্দকে ধরে টাল সামলে নিল। নীচে নজর যেতেই প্রফেসরের মুখের রেখা কুঁচকে গেল। লিলি হোঁচট খেয়েছে পাহাড়ের ওপর পড়ে থাকা অ্যালুমিনিয়ামের তারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে। এই নামহীন, অনাবিষ্কৃত একটি দ্বীপে সভ্যজগতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে দেখে উভয়েই প্রচণ্ড বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। বিশেষ করে, এই দ্বীপ থেকে উদ্ধারের উপায়ও বের করতে হবে। সুতরাং, ওই তার দেখে ওঁরা এগিয়ে চললেন। একসময় ওঁরা এসে পাহাড়ের অন্য পাশে পৌঁছলেন। এখানে আরও নতুন-নতুন চিহ্ন দেখা গেল। যেমন শুকনো খাবারের খালি টিন, সিগারেটের প্যাকেট ইত্যাদি। একটা আশার কথা যে, এই দ্বীপে তাহলে মানুষের যাতায়াত আছে—অথবা মানুষ এখনও এই দ্বীপে বাস করছে! যাই হোক, আরও কিছুটা এগোতেই প্রফেসর উপানন্দ ও লিলির চোখ কপালে উঠবার জোগাড়। এ তাঁরা কী দেখছেন! এ যে এক অকল্পনীয় দৃশ্য ফুটে উঠেছে তাঁদের সামনে!
দু-পা পিছিয়ে এলেন প্রফেসর উপানন্দ। লিলিকে বললেন, ‘চুপ করে বোসো, কোনও শব্দ কোরো না।’ প্রফেসর উপানন্দ গাছগাছালির ঘন ঝোপের আড়াল থেকে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন সামনের দিকে।
পঁচিশ-তিরিশ হাত দূরে একটি উন্মুক্ত স্থান। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বিরাট-বিরাট কয়েকটি টান্সফরমার বসানো আছে। আর আছে কতকগুলি রাডার জাতীয় কিছু—যা থেকে মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের স্ফূরণ ঘটছে। একটি মানুষ যন্ত্রগুলির সামনে ধীর পায়ে পায়চারি করছে। দূর থেকে দেখে লোকটিকে চেনার উপায় ছিল না। কোনদেশের লোক তাও ঠিক করা কষ্টসাধ্য ছিল। রুদ্ধশ্বাসে প্রফেসর উপানন্দ ও লিলি লোকটিকে নিরীক্ষণ করতে থাকলেন।
লোকটি পায়চারি করতে-করতে হঠাৎ অট্টহাস্য করে উঠল। তারপর আপনমনেই সভ্যজগতকে কুৎসিত ভাষায় আপ্যায়িত করল। কথাগুলি লোকটি ইংরেজিতেই বলছিল। কিন্তু বলার ভঙ্গি দেখে ওকে ইংরেজ বলে মনে হল না।
প্রফেসর উপানন্দ অতি সন্তর্পণে প্রায় বুকে হেঁটেই লোকটির দিকে এগিয়ে চললেন। কিন্তু লোকটি তখন ঢালু পাহাড় বেয়ে নামতে শুরু করেছে নীচের দিকে। সুতরাং তার চেহারাটা ভালো করে দেখা গেল না। তবে একদিক দিয়ে সুবিধে হল। জায়গাটি ভালো করে দেখবার সুযোগ পাওয়া গেল।
দেখতে-দেখতে প্রফেসর উপানন্দের বিস্ময়ের মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই নির্জন দ্বীপে এইসব জটিল যন্ত্রপাতি দিয়ে কে তৈরি করল এইসব অকল্পনীয় জিনিস! একটা শব্দে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলেন নীচ থেকে সেই লোকটি উঠে আসছে এইদিকে।
প্রফেসর উপানন্দ সঙ্গে-সঙ্গে ঢুকে পড়লেন একটা ছোট্ট কুটিরে। সম্ভবত, এই কুটিরেই লোকটি থাকে। ভিতরেই ঢুকতেই দেখা গেল থরে-থরে সাজানো আছে টেলিভিশন সেট, সুইচবোর্ড এবং নানাধরনের কিবোর্ড। দেওয়ালে পৃথিবীর একটা বিরাট মানচিত্র শোভা পাচ্ছে।
লোকটি তখন উঠে এসেছে এবং ঘরের দিকেই হেঁটে আসছে। এই মুহূর্তেই ভদ্রলোকটির সঙ্গে মোলাকাত করতে ইচ্ছে হল না প্রফেসরের। একটা কৌতূহল চেপে বসেছিল মনের মধ্যে লোকটির কার্যকলাপ গোপনে নিরীক্ষণ করতে হবে। সুতরাং, তাঁরা পাশের একটি ঘরে ঢুকে পড়লেন। ঘরটি নানারকম টুকরো-টুকরো যন্ত্রপাতিতে ভরা। দেখে স্টোররুম বলেই মনে হয়।
ভদ্রলোক আপনমনে শিস দিতে-দিতে ঘরে এসে ঢুকল। কয়েকটি সুইচ নাড়াচাড়া করতেই সামনের পরদায় কয়েকটি জায়গার ছবি ভেসে উঠল। কপাটের ফাঁক দিয়ে প্রফেসর উপানন্দ ভদ্রলোকের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলেন। তবে তার মুখখানা এখনও ভালো করে দেখতে পাননি। কারণ, সে তখন স্টোররুমের দিকে পিছন ফিরে ছিল।
একটি ছবি ফুটে উঠল পরদার বুকে। মহাশূন্যের মধ্যে দিয়ে একটি অতিকায় উপগ্রহ ছুটে যাচ্ছে। একটা সুইচ অন করা মাত্রই উপগ্রহ থেকে বলয়াকৃতি একটা কালো ছায়া বিদ্যুৎগতিতে ছুটে চলল মহাশূন্যের পথে। লোকটি ‘হাঃ-হাঃ’ করে আকাশ-কাঁপানো অট্টহাসি হেসে আর-একটি সুইচে হাত দিতেই দেখা গেল, পাশের পরদায় ফুটে ওঠা একটি শহরের ছবিতে একটি বহুতল বাড়ি ঢেকে গেছে কুয়াশার আস্তরণে। লোকটি আর-একটি সুইচে হাত রাখতেই উপগ্রহ থেকে সৃষ্টি হল এক প্রচণ্ড ঘূর্ণাবর্ত। আর মুহূর্তের মধ্যে সেই বহুতল সৌধ ওই বলয়ের কালো নলের মধ্যে দিয়ে, চুম্বকের আকর্ষণে যেমন একটি পিন ছুটে এসে আটকে যায়, ঠিক তেমনি ভাবেই শহর থেকে সমূলে উৎপাটিত হয়ে উপগ্রহে এসে আটকে গেল। পরদায় দেখা গেল শত-শত মানুষের বিস্ময়-বিহ্বল আতঙ্কের ঢেউ! পরক্ষণেই আর-একটি পরদায় ভেসে উঠল নীল সমুদ্রের ছবি। উপগ্রহ থেকে নেমে এল তেমনি এক কালো বলয়াকৃতি ছায়া। আর সেই ছায়াকে অবলম্বন করে উপগ্রহ থেকে সমুদ্রের বুকে সবেগে নেমে এল সেই বহুতল বাড়ি, টুকরো-টুকরো হয়ে ভাঙাচোরা অবস্থায়।
এত সহজেই যে নাটের গুরুকে ধরা যাবে প্রফেসর উপানন্দ স্বপ্নেও ভাবেননি। স্টোররুম থেকে বেরিয়ে প্রফেসর উপানন্দ চিৎকার করে বললেন, ‘বন্ধ করুন, বন্ধ করুন! আপনার এই অমানবিক খেলা বন্ধ করুন!’
ভদ্রলোক যেন বজ্রাহতের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। এই অনাবিষ্কৃত দ্বীপে অন্য কেউ যে আসতে পারে এ যে বিশ্বাসের অযোগ্য ঘটনা! মুহূর্ত পরেই ত্বরিৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াল ভদ্রলোক। প্রফেসর উপানন্দের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চমকে উঠল।
‘ডক্টর অভিজিৎ! আমি মুগ্ধ!’ প্রফেসর উপানন্দ সপ্রশংস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার সাধনা সফল হয়েছে। তুমি আজ অজেয়। কিন্তু মানুষকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েছ কেন? যেখানে মানবসমাজের কল্যাণে নিয়োজিত হবে তোমার সাধনা, তোমার শ্রম, সেখানে তুমি নির্বিচারে লক্ষ-লক্ষ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে চলেছ! কেন?’
‘স্যার! গুরুদেব, আপনার আশীর্বাদেই আমি সব কিছু জয় করেছি,’ ডক্টর অভিজিৎ বলল, ‘কিন্তু স্যার! কার কল্যাণে নিয়োজিত হবে আমার এই শ্রম? আজ সমস্ত দুনিয়াব্যাপী অন্যায়-অনাচারের স্কাইস্ক্রেপার আকাশ ছুঁতে চলেছে। কোথাও সুবিচার নেই। হিংসা-দ্বেষে মানুষ আজ অন্ধ। মানুষ আজ মনুষ্যত্বহীন। সেই মানুষদের বাঁচিয়ে রাখার কোনও যুক্তি নেই, স্যার! আজ আমি আপনার আদর্শেই বলীয়ান। পৃথিবীতে যখন আর কোনও পাপ বা অন্যায় থাকবে না, একমাত্র তখনই আমি বন্ধ করব আমার অভিযান। কিন্তু…কিন্তু…আপনি এ-দ্বীপের সন্ধান পেলেন কী করে, স্যার?’
‘সব কথাই তোমাকে জানাব, অভিজিৎ,’ প্রফেসর উপানন্দ সস্নেহে বললেন, ‘তার আগে তুমি কথা দাও, তোমার অভিযান বন্ধ রাখবে।’
‘অসম্ভব! আপনার এ-অনুরোধ রাখা সম্ভব নয়, স্যার!’ দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করল ডক্টর অভিজিৎ।
‘তাহলে আমি বাধ্য হব তোমাকে নিরস্ত করতে।’ বললেন প্রফেসর উপানন্দ।
‘হাঃ হাঃ’ করে হেসে উঠে ডক্টর অভিজিৎ বলল, ‘প্রয়োজন হলে পরশুরাম হতে আটকাবে না, স্যার!’
‘স্তব্ধ হও। তুমি একটা নীচ বিজ্ঞানী,’ লিলি হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল।
‘তুমি অপমান করছ আমাকে! কিন্তু ভুলে গেছ যে, তুমি সম্পূর্ণরূপে আমার এক্তিয়ারে চলে এসেছ—দরকার হলে তুমিও রেহাই পাবে না।’ রাগত চক্ষে অভিজিৎ চিৎকার করে বলল।
‘তোমরা দুজনেই ছেলেমানুষ। চুপ করো তোমরা।’ ধমক দিলেন প্রফেসর উপানন্দ। তারপর বললেন, ‘অভিজিৎ, তোমার কথা আমাকে কিছু শোনাও—কীভাবে তুমি এই অসাধ্যসাধন করলে।’
‘স্যার! সবই আপনার কৃপায়…’ ডক্টর অভিজিৎ বলল, ‘আমার ইতিহাস আপনাকে অন্য আর-একদিন শোনাব। আমার নিজস্ব একটা উপগ্রহ রয়েছে। সেই উপগ্রহটি ভ্যান অ্যালেন বলয় থেকে জোর করে কিছুটা চৌম্বকক্ষেত্র নিজের কট্রোলে রাখে, আর সেই চৌম্বকক্ষেত্রটিকে উপগ্রহের মাধ্যমে সোজা নামিয়ে আনা হয় যে-বস্তুটিকে আকর্ষিত করা হবে সেই বস্তুটির ওপর। উপগ্রহ থেকে যে-চ্যানেল সৃষ্টি হল, তাকে মুহূর্তে বায়ুশূন্য করে ফেলা হল, আর তখুনি সেই চ্যানেলের মধ্য দিয়ে এক অবিশ্বাস্য গতিতে সেই বস্তু উপগ্রহে গিয়ে উপনীত হল। এবং ওই একই উপায়ে উপগ্রহ থেকে ওগুলোকে সমুদ্রের বুকে ফেলে দেওয়া হয়। যা কিছু করবার তা আমি এই কট্রোল রুমে বসেই করে থাকি। আপনারা যেভাবেই এখানে এসে থাকুন, ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়া পাবেন না।’
‘তার মানে?’ লিলি বিরক্তির সুরে বলল।
‘খুবই সোজা! পৃথিবীতে একতলা বাড়ি ছাড়া আর অন্য কোনও বাড়ি থাকবে না। আমি ধ্বংস করব মানুষের আকাশচুম্বি সৌধরাজি…আর তারই সঙ্গে ধ্বংস করব ছারপোকার মতো বংশবৃদ্ধির দৌরাত্ম্যকে। মানে, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ ধ্বংস হবে আমার হাতে। আশা করি, বুঝতে অসুবিধে হয়নি আপনাদের?’ আত্মপ্রসাদের হাসি হাসতে থাকে ডক্টর অভিজিৎ।
‘ধ্বংস করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে, অভিজিৎ?’ গর্জে উঠলেন প্রফেসর উপানন্দ। বললেন, ‘আমি কিছুতেই তা বরদাস্ত করব না।’
প্রফেসর উপানন্দ এগিয়ে গেলেন ডক্টর অভিজিতের দিকে। অভিজিৎ টেবিল থেকে একটা ইস্পাতের ফলা নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আর এক পা-ও এগোবেন না, স্যার! কয়েকহাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ রয়েছে ইস্পাতের ফলায়।’
লিলি সেই মুহূর্তে রিভলভার থেকে গুলি ছুড়ল অভিজিতের হাত লক্ষ করে। গুলির আঘাতে ইস্পাতের টুকরোটা ছিটকে গিয়ে পড়ল কট্রোল বোর্ডের ওপর। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। অভিজিৎ উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘কী সর্বনাশ! এ তুমি কী করলে, লিলি! আমার সারা জীবনের সাধনাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিলে? উঃ! এ কী করলে তুমি?’
চক্ষের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই আগুন ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত ঘরে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওঁরা দাঁড়ালেন নিরাপদ দূরত্বে। ডক্টর অভিজিৎ তখন দু-হাতে নিজের চুল ছিঁড়ছে আর বকে চলেছে প্রলাপ, ‘ওঃ! সারাজীবনের সাধনা আমার নষ্ট হয়ে গেল!’
‘শান্ত হও, অভিজিৎ।’ স্নেহমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন প্রফেসর উপানন্দ, ‘একটিমাত্র লোকের সাধনা নষ্ট হয়েছে মাত্র, তাতেই তুমি উদভ্রান্তের মতো প্রলাপ বকে চলেছ! কিন্তু তুমি কি একবারও ভেবেছ, অভিজিৎ, লক্ষ-লক্ষ মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, সাধনা—সব কিছুকে তুমি একলহমায় ধ্বংস করছিলে? লক্ষ-লক্ষ মানুষ কি তোমারই মতো চুল ছিঁড়ে প্রলাপ বকছে না? অন্যায়, অনাচার, দুরাচার, অত্যাচার এইভাবে কি তুমি রোধ করতে পারবে, অভিজিৎ? যারা শোষিত, অত্যাচারিত তারা তো নিজেরাই মেনে নিয়েছে শোষণ আর অত্যাচারকে। আর সেই নিয়েই বেঁচে রয়েছে তারা। সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে ওই মানুষরাই তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তাই বলে তুমি সৎ-অসৎ সকলকেই নির্বিচারে নিশ্চিহ্ন করতে পারো না।’
ডক্টর অভিজিৎ দু-হাতে মাথা রেখে সর্বহারার মতো বসে রইল। প্রফেসর উপানন্দের কথার কোনও উত্তর দিতে পারল না।
মাসিক গোয়েন্দা
পুজো সংখ্যা, ১৯৭৪