প্রমোদকুমারের বিবাহ উৎসব
প্রমোদকুমারের বিবাহ উপলক্ষে তাঁর জ্যেঠামশাই মাননীয় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সি এস আই ১৮৮০ তে জানুয়ারীর খুব জাঁকজমকপূর্ণ নাচের আয়োজন করেন। সমগ্র প্রাসাদ আলোক উদ্ভাসিত করা হয়েছিল; নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন দেশীয় সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত সকল ব্যক্তি। কনে ছিলেন সিমলার সাময়িকভাবে ভাড়া নেয়া একটা বাড়ীতে–পাথুরিয়াঘাটা থেকে সিমলা পর্যন্ত সমগ্র রাজপথ বিজলী বাতি দিয়ে আলোকোজ্জ্বল করা হয়–এজন্য অবশ্য ব্যয়ও হয়েছিল বিপুল। বিবাহ অনুষ্ঠিত হল ১৮৮০-র ৩১ জানুয়ারী। বিবাহের শোভাযাত্রার জন্য সরকারের বিশেষ অনুমতিতে পঞ্চাশ জন খোলা তলোয়ারধারী সৈনিক ছিল মহারাজার অস্ত্রধারী নিজস্ব সিপাহীদের ঠিক পিছনেই। এই সৈনিক সিপাহীদের প্রত্যেককে সেদিক নতুন পোষাকে সাজানো হয়েছিল। সুদৃশ্য জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিহিত সৈনিক-সিপাহীদের কুচকাওয়াজটি হয়ে উঠেছিল যেমন মনোরম তেমনি অসাধারণ। দেশীয় বাদ্যভাণ্ডের সঙ্গে ছিল দুটি ব্যাণ্ড; দৃশ্যটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল গোরাদের আর একটি ব্যাণ্ড পার্টির জন্য। কলকাতা, শহরতলী এবং অন্যান্য স্থানের সম্ভ্রান্ত পরিবারের কর্তাগণ মাননীয় দুই ভাইয়ের প্রতি সম্মান জানাতে হেঁটে পাথুরিয়াঘাটা থেকে সিমলায় কনের (অস্থায়ী) বাড়ি অবধি গিয়েছিলেন।
বিয়ের প্রায় ঠিক পরেই মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সি এস আই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা বিপুলসংখ্যক দুঃস্থ মানুষকে ভোজন করান, জেলা দাতব্য-নিধিতে ৮,০০০ টাকা দান করেন এবং দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের জন্য জেলা কর্তৃপক্ষকে প্রচুর পরিমাণে নতুন জামাকাপড় পাঠিয়ে দেন।
এই বিবাহ উপলক্ষে রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, সি আই ই ইত্যাদি স্বদেশ এবং ইউরোপের বহু রাজা-সম্রাট ও জ্ঞানীগুণীদের কাছে থেকে তাঁর পুত্রের বিবাহের জন্য অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন। সবগুলি ছাপাতে গেলে এই সংক্ষিপ্ত জীবনীর কলেবর অনেক বৃদ্ধি পাবে আশঙ্কায় আমরা নিচে সামান্য কয়েকটির উল্লেখমাত্র করছি (মূল পুস্তকে পত্রগুলি মুদ্রিত হয়েছে–অনুবাদক)
১. জার্মানীর মহামান্য সম্রাট ও রাজা
২. লণ্ডনস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূত
৩. রোম থেকে কার্ডিন্যাল নিনা
৪. স্যাক্সনির মহামান্য রাজা (তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কর্তৃক প্রেরিত)
৫. নেপালের প্রধানন্ত্রী মারফত নেপালের মহামান্য রাজা
৬. নেপালের প্রধান সেনাপতি
৭. নেদারল্যান্ডের মহামান্য রাজা
৮. উট্রেক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব কিউরেটস”-এর সম্পাদক পৃথক পৃথক পত্রে পিতা ও পুত্রকে অভিনন্দন জানান।
ভারত ও ইউরোপের এত সম্রাট, রাজা, জ্ঞানীগুণীদের পত্রে রাজা শৌরীন্দ্রমোহনের প্রতি যে ঘনিষ্ঠ প্রীতির পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে, খুব কম দেশীয় রাজাই এমন পত্র প্রাপ্তির গৌরব করতে পারেন।
শেষ করার আগে একথা না বললে ভুল হবে যে, মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ও রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর পরিবারের সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত ব্যক্তি। সভ্য জগতের সকল শ্রেষ্ঠ মানুষই এই দুই ভাইকে সর্বাপেক্ষা সুশিক্ষিত, সম্মানিত এবং উল্লেখযোগ্য ভারতীয় হিসাবে গণ্য করেন।
জগতের অন্যান্য দেশে ভারতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে যে সব কুসংস্কার প্রচলিত ছিল রাজা শৌরীন্দ্রমোহনের একক প্রচেষ্টায় সে বদ্ধমূল ধারণা দূর হয়েছে–ভারতীয় সঙ্গীতের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য সম্পর্কে জগৎ অবহিত হয়েছে এ দিক থেকে দেশ তাঁর কাছে যে কতখানি ঋণী তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ভারতীয় সঙ্গীত মানেই ঢাক ঢোল পেটান বা মাঝিমাল্লার গান, তাঁর সাধনার ফলে এ ধারণা দূর হয়েছে।
এই কারণে রাজা শৌরীন্দ্রমোহন জগতের বিভিন্ন দেশ থেকে যে সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছেন, অন্য কোন ব্যক্তি তা পান নি। তাঁর এই সম্মানে দেশ ও দেশবাসীও গৌরবান্বিত হয়েছেন।
হিতোপদেশের নিম্নোদ্ধৃত বিখ্যাত শ্লোক এই দুই আদর্শস্থানীয় ভাইয়ের প্রতি সমভাবে প্রযোজ্য :
গুণিগণগণনারন্তে ন পততি কঠিনী সম্ভ্রামাৎ যস্য।
তেনাম্বা যদি সুতিনী বদ বন্ধ্যা কীদৃশী ভবতি
(অপর গুণিসমূহের গণনারম্ভে সম্ভ্রমেতে যার নামে খড়ি না পড়ে, সেইরূপ পুত্রে মাতা যদি পুত্রবতী হন, তবে বল বন্ধ্যা কেমন হয়?)
ধনবান ও গুণবান এই দুই পুত্রের জন্য তাঁদের বৃদ্ধা মাতাও গৌরবান্বিতা হয়েছেন, গৌরবান্বিতা দেশমাতাও। উল্লেখযোগ্য যে, এঁদের শ্রদ্ধেয়া মাতৃদেবীও কয়েকখানি গ্রন্থের রচয়িত্রী–এগুলি তিনি রচনা ও প্রকাশ করেছিলেন আত্মীয়া, বান্ধবীদের মধ্যে বিতরণের জন্য, যাতে তাঁদের মধ্যে লেখাপড়া করার স্পৃহা জাগে। তাঁর লেখা ‘তারাবতী’ (বাংলায়) এবং ‘স্তবমাল্য’ (সংস্কৃতে) বিশেষ সুপরিচিত। এছাড়া মণিরত্ন বিষয়ে তিনি বিশেষ জ্ঞানের অধিকারিণী–রাজা শৌরীন্দ্রমোহন মায়ের কাছে এই বিদ্যায় শিক্ষা লাভ করে তাঁর ‘মণি-মালা’ পুস্তকখানি রচনা করেন।
এযুগে হিন্দু সমাজে যেখানে ভাইয়ে ভাইয়ে চলছে ঝগড়া-বিবাদ, মামলা- মোকদ্দমা, সেই যুগে সেই সমাজে আদর্শ এই দুই ভাই মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ও রাজা শৌরীন্দ্রমোহন প্রীতির বন্ধন, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অপেক্ষা অনেকবেশি আদর্শ স্থানীয় ৷ ১৮৫৮ তে পিতার মৃত্যুর পর জৌষ্ঠ যতীন্দ্রমোহন কনিষ্ঠ শৌরীন্দ্রমোহনের দায়িত্ব নেন–সেই সময় থেকে এখনও দুই ভাইয়ের বিস্তৃত জমিদারী, ভূসম্পত্তি, গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিতে জমানো বিপুল বিত্ত ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সোনাদানা এবং অত্যন্ত মূল্যবান হীরাজহরৎ একত্রেই উভয়ের পরিচালনাধীনে ও ভোগ-দখলে আছে ৷ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তাঁদের উল্লেখযোগ্য জমিদারীগুলির মধ্যে আছে ফরিদপুর জেলার পরগণা হাবিলী, হাকিমপুর, বসন্তপুর, কুতুবপুর প্রভৃতি। কলকাতার সম্পত্তির মধ্যে আছে ডিহি পঞ্চান্ন তালতলা বাজার; আছে চন্দননগর ও অন্যান্য স্থান।
বাস্তব বুদ্ধি ও দক্ষ পরিচালনার গুণে মাননীয় মহারাজা তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি বহু গুণ বৃদ্ধি করেছেন। নবার্জিত সম্পত্তিগুলির মধ্যে আছে রামপুর সহ লস্করপুর, বেউলিয়া সহ গড়ের হাট, তিলবেড়িয়া, হাতিশালা, কাগজপুকুর, জঙ্গীপুরসহ রোকনপুর এবং এইরূপ অন্যান্য মহাল। অতি সম্প্রতি মাননীয় মহারাজা প্রায় চৌদ্দ লক্ষ টাকা মূল্যে বালুচরের রায় লছমীপৎ বাহাদুরের কাছে থেকে বিখ্যাত মহাল পলাদসি, শ্যামবাটী, সাদুল্লাপুর, ফতেপুর, সুখসেনা এবং মহম্মদ আমিনপুর (সাধারণ্যে শেওড়াফুলি নামে পরিচিত) ক্রয় করেন। সমগ্র এই যৌথ সম্পত্তি আছে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর সি আই ই- র পরিচালনাধীন।
এ ছাড়া, তাঁদের কাকা অনারেবল প্রসন্নকুমার ঠাকুর সি এস আই-র উইল অনুযায়ী মহারাজা যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর সি এস আই কাকার পাতিলাদহ, ঘোড়ারহাট, উথৈ, লাট, মান্ডা, বাসুদেবপুর প্রভৃতি মূল্যবান মহালের আয় আগের মতো এখনও ভোগ করছেন। নিচের সারণি থেকে মহালের নাম, কোন জেলায় অবস্থিত এবং সরকারকে দেয় রাজস্বের পরিমাণের একটি সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে।
সারণি–ক
মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সি এস আই এবং রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর সি আই ই-র যৌথ জমিদারী-
মহালের নাম যে জেলায় অবস্থিত রাস্তা ও পূর্ত শেষ বাদে সরকারকে দেয় পরিমাণ (ভগ্নাংশ বর্জিত)
পরগণা হাবিলী ফরিদপুর ৩৫,০৯২ ০ ০
পরগণা হাকিমপুর ঐ ৭,১৬৪ ০ ০
পরগণা বসন্তপুর ও কুতুবপুর মেদিনীপুর ৫৩,৮১৬ ০ ০
শিখরবাটী দেবোত্তর সম্পত্তি ২৪ পরগণা ২১০০০
শান্তিপুর, সোনাটিকরী ও মূলাজোড় নদীয়া, হুগলী ও ২৪ পরগণা ২২,১৭৭ ০ ০
পরগণা লস্করপুর ও গড়েরহাট রাজশাহী ৪৩,১০৩ ০ ০
পরগণা তিলবেড়িয়া, হাতিশালা ও কাগজপুকুর নদীয়া ৯,৭০২ ০ ০
পরগণা রোকনপুর মুর্শিদাবাদ ৩৫,১৬৯ ০ ০
পরগণা ফতেপুর পূর্ণিয়া ১০,৬৫৫ ০ ০
পরগণা পলাদসি, শ্যামবাটী এবং সাদুল্লাপুর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া ১৩,৩৩৮ ০ ০
পরগণা সুখসেনা (বা জুমুনি) নয়া দুমকা ৭, ৬২৮ ০ ০
পরগণা মহম্মদ আমিনপুর (বা শেওড়াফুলি) হুগলী ও বর্ধমান ৪০, ১৫৬ ০ ০
মোট টাকা ২,৭৮,২১০ ০ ০
(আনুমানিক জনসংখ্যা ২,৮০,০০০ জন )
সারণি–খ
অনারেবল মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সি এস আই-র ভোগদখলে অবস্থিত অনারেবল প্রসন্নকুমার সি এস আই-র সম্পত্তি :
মহাল জেলা সরকারে দেয় রাজস্ব
পরগণা পাতিলদহ রংপুর ৬৪,৩৪৯ ০ ০
পরগণা ঘোড়ারহাট ইত্যাদি দিনাজপুর ৮,৮৭৪ ০ ০
পরগণা উথৈ, লাটমান্ডা বগুড়া ৫৯৮ ০
পরগণা বাসুদেবপুর মুঙ্গের ৪,৪৬৮ ০ ০
ঢাকুরিয়া এবং অন্যান্য ২৪ পরগণা ১,১২৫ ০ ০
মোট ৭৯,৪১৪ ০ ০
(আনুমানিক জনসংখ্যা–৩,০০,০০০ জন)