প্রমিথিউস
প্রমিতের ঘরে সাল্ভাদর দালির বিশাল একটা ছবি আছে। তার নবম জন্মদিনে তরু আন্টি গিফট করে ছিল। দালির মত আর্টিস্ট হবে প্রমিত। তার এলোমেলো ক্রেওন ঘষা কাগজগুলো দালির ছবির পাশে শোভা পেত। প্রমিতের অনেক শখ ছিল, ডালির মত গোঁফ রাখবে। কিন্তু কোথায় যেন একটা গন্ডগোল ছিল। প্রমিতের গোঁফ গজাত না। প্রমিত তরু আন্টিকে জিজ্ঞাসা করত, “আন্টি আমার গোঁফ হবে কবে?” তরু আন্টি মিষ্টি হেসে প্রমিতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, “আর একটু বড় হলেই তোমার বিড়ালের মত ইয়া বড় বড় গোঁফ গজাবে।” প্রমিতের বড় হওয়ার মত ধৈর্য্য নেই। সে চিকন তুলিতে কালো রঙ নিয়ে নাকের নিচে একটা সরু গোঁফ এঁকে নিত মাঝে মাঝে। তারপর চুরি করে মায়ের অন্তর্বাসগুলো পরত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে নিজেকে দেখত। একদিন রাতে প্রমিতকে প্রমিতের বাবা এই অবস্থায় দেখে ফেলেন। তারপর কি হয়েছিল প্রমিত আর ভাবতে চায় না।
বাবা ছিলেন ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ। আজ এখানে জনসভা, কাল পার্টির মিটিং। পরশু ব্যবসায়ী সমিতির মিলাদ মাহফিল। তাই প্রমিতের সাথে প্রমিতের বাবার দূরত্ব ছিল সূর্য থেকে প্লুটোর মত।
প্রমিতের কোন আবদার অপূর্ণ থাকত না। ম্যানেজার কাকাকে বললেই কাকা সব এনে দিত। এই সপ্তাহে প্লে-স্টেশন ফোর কেনার পরে ওই সপ্তাহে একটা মিনি হোম-থিয়েটারের বায়না করলেও সেটা পূরন হয়ে যেত। প্রমিত সবকিছু চাইলেও কখনও বাবাকে চাইত না। দুটো কারণে চাইত না। প্রথম কারণ, প্রমিত জানত চাইলেও বাবাকে পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় কারণ, বাবা যেদিন বাড়ি থাকত, সেদিন বাবা মদ খেয়ে প্রমিতকে খুব পেটাতেন। প্রমিতকে পেটানো শেষ হলে প্রমিতের মাকে পেটানো শুরু করতেন। চিৎকার করে বলতেন, “এইটা তুই কি পয়দা করলি।” প্রমিত কোন আওয়াজ করত না। কিন্তু প্রমিতের মায়ের আর্ত চিৎকারে পুরো তিনতলার ডুপ্লেক্স বাড়িটার ইটের ভাঁজ দিয়েও অশ্রু ঝরত।
বাবা কেন এমনটা করতেন প্রমিত জানে না। তার কাছে বাবা মানেই এমন একজন লোক, যে সপ্তাহে একরাত বাসায় থাকবেন। বাদামী রঙের পানীয় খেয়ে নিজের ছেলেকে আর স্ত্রীকে আচ্ছামত পেটাবেন। তারপর বুয়াকে পা টিপে দিতে বলে বসার ঘরের সোফায় বেঘোরে ঘুমাবেন।
প্রমিত কখনও জানতে চায়নি কেন তার বাবা তাকে আর মাকে এইভাবে ধরে পেটান। যখন মা কোন প্রশ্ন করেননি, তখন প্রমিত কেন করবে? এত কিছুর পরেও প্রমিতের কাছে বাবা ছিলেন অতিমানব গোছের একজন মানুষ। বাবাকে টিভিতে দেখায়। সবার বাবাকে টিভিতে দেখায়? বাবা কেমন সানগ্লাস চোখে দিয়ে বজ্রকণ্ঠে ভাষণ দিতেন। সেই ভাষণের মানে বুঝত না প্রমিত। কিন্তু বাবার সেই কণ্ঠস্বর তাকে শিহরিত করত।
প্রমিত নিজের মত করেই নিজের জগতটা সাজিয়ে নিয়েছিল। একটা চাপাকান্নার জগত। স্কুল থেকে বাসা। বাসা থেকে স্কুল। স্কুলে যাওয়াটা ছিল প্রমিতের জন্য দুঃস্বপ্নের মত। তার বন্ধুটন্ধুতে মন ছিল না। শুধু শৌভিক বাদে ক্লাসের সবাই তাকে হাফলেডিস বলে ডাকত। কেউ পেনসিল দিয়ে প্রমিতের পাছায় খোঁচা দিত। সিনিয়র ছাত্ররা তার শার্টে লিখে দিত ‘মাইগ্যাপোলা’। প্রমিত বাথরুমে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদত। শৌভিক এসে নরম সুরে প্রমিতকে ডাকত, “ও প্রমিত। প্রমিত। দরজা খোলো। শুনছ?” প্রমিত পানির কল ছেড়ে দিত। যাতে তার কান্নার শব্দ আর কেউ শুনতে না পারে। শৌভিকও না। নিজের ক্লাসের কারও কাছ থেকে সে কোন সহানুভুতি চায় না। সে ওদের থেকেও অনেক অনেক বড়।
এসব কথা শোনার মত কেউ ছিল না প্রমিতের আশেপাশে। তরু আন্টিরও না। একদিন সন্ধ্যাবেলা তরু আন্টি তাকে পড়িয়ে বিদায় নিল। প্রমিত দেখল, তরু আন্টি ফোন ফেলে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি নিচে গিয়ে তরু আন্টিকে খোঁজে প্রমিত। খুঁজে পায় বাসার পেছনে অন্ধকার বাগানে। তরু আন্টি বাবার সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিল। আর বাবা বিরক্ত হয়ে বলছিল, “খসায়া ফেলাও। ঝামেলা কইরো না তো। টাকাটুকা পাঠায়ে দিবোনে। আর কাল থিকে প্রমিতকে পড়ানোর দরকার নাই। ওই ছেলেরে দিয়ে কিছু হবে না। তুমি আর এই বাড়ির আশেপাশে আসবা না।” তরু আন্টি ঠাস করে একটা চড় মারল প্রমিতের বাবার গালে। তারপর গটগট করে বেরিয়ে গিয়েছিল। দৃশ্যটা এখনও প্রমিতের চোখে ভাসে। বাবা তরু আন্টিকে তাড়িয়ে দিল কেন? তরু আন্টিই বাবাকে ওভাবে চড় মারল কেন? প্রথমে বাবার ওপরে খুব রাগ হয়েছিল প্রমিতের। তারপর তরু আন্টির জন্য মন খারাপ হতে শুরু করল। নিজেকে সেনাপতিহীন রাজার মত অসহায় মনে হল। তরু আন্টি চলে যাওয়াতে প্রমিত বড় একা হয়ে গেল। তাই স্কুলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আর কাউকে বলা হল না। মুখ চেপে ঘটনাগুলো গিলে ফেলতে শুরু করল।
কিছু কিছু ঘটনা তাকে সহজেই ছেড়ে দিত। কিছু ঘটনা তাকে তাড়া করত।
বাইশে ফেব্রুয়ারী। রোজকার মত প্রমিত স্কুলে গিয়েছিল সেদিন। ক্লাস নাইনের তিনটা ছেলে সিঁড়িতে বসে একটা সিনেমা নিয়ে গল্প করছিল। হঠাৎ তাদের ভেতরেই একজন সিনেমার ব্যাপারে একটা ভুল কথা বলে বসে। সিনেমাটা প্রমিতের দেখা। প্রমিত হাসিমুখেই ছেলেটার ভুল ঠিক করতে এগিয়ে যায়। তার ফলে যেটা হল সেটা প্রমিত একেবারেই আশা করেনি। অহেতুক জ্ঞান দেওয়ার’ অপরাধে ছেলেগুলো প্রমিতকে ধরে স্কুলের পেছনে নিয়ে যায়। প্রমিতের প্যান্ট আর শার্ট খুলে নেওয়া হয়। টিফিন পিরিয়ডে মেয়েরা তাকে একটা ছোট হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় গার্লস টয়লেটে বন্দী অবস্থায় পায়। প্রমিতের সেই প্রথম মনে হয়েছিল, যদি সে মরে যেতে পারত তাহলে ভালো হত। শৌভিক সেদিন প্রমিতকে নিজের শার্ট খুলে পরিয়ে দিয়েছিল।
এর পর কয়েকদিন প্রতিটা মুহূর্ত শৌভিক প্রমিতের সাথে ছিল। তারপরেও সেই ছেলে তিনটা একদিন প্রমিতকে ধরে পেটাল। শৌভিক পালটা বাধা দেওয়ায় শৌভিকের কপালেও জুটল পিটুনি। শৌভিকের ক্যাথলিক দাদী স্কুলে এসে ছেলে তিনটাকে খুব করে শাসিয়ে গেল। আর শৌভিকের সাথে প্রমিতের মেলামেশা বন্ধ করে দিল। প্রমিত একেবারে একা হয়ে গেল।
ছেলে তিনটে প্রমিতের ওপরে পাশবিক অত্যাচার শুরু করল। রোজ স্কুল শেষে খেলার মাঠের পেছনে নিয়ে যাওয়া হত প্রমিতকে। তারপর তিনজন পালা করে প্রমিতের গায়ে ফুটবল মারত। ফুটবলের আঘাতে প্রমিত কাপড় নষ্ট করে ফেলত প্রায়ই। প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করল প্রমিত। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে আর সারাদিন ছেলে তিনটার পাশবিক অত্যাচার সয়ে প্রমিত কেমন যেন পাথরের মত হয়ে যেতে শুরু করল। প্রমিত আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল, মা বাবা মরা শৌভিকের জন্য তার দাদী থাকলেও তার বাবা মা বেঁচে থেকেও তার পাশে নেই।
প্রমিত কখনওই ভালো ছাত্র ছিল না। মাঝারি রেজাল্ট নিয়েই সে সন্তুষ্ট থাকত। তার রেজাল্ট নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রমিতের রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করল। ক্লাস ফাইভে প্রমিত ফেল করল। বাসায় জানানো হল। প্রমিতের বাবা বাদামী পানি খেয়ে প্রমিতকে বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেললেন। গভীর রাতে ম্যানেজার কাকু এসে প্রমিতকে তার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসে।
পরদিন ভোরবেলা প্রমিতের জ্ঞান ফিরলে প্রমিত তার জীবনের সব থেকে অদ্ভুত জিনিস দেখতে পায়। দালির ছবি আর ক্রেওন ঘষা কাগজগুলো কুঁচি কুঁচি করে ছেড়া। আর মায়ের ঘরে মায়ের লাশ। সোফার ওপরে নিথর দেহটা পড়েছিল। কপালে একটা কালো গর্ত। সোফার বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে মায়ের ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মায়ের মাথার চুল, মায়ের মগজ। মায়ের স্পর্শ পায়নি সে বহু দিন। প্রমিত আশেপাশে দেখে নিল ভালো করে। তারপর মায়ের মৃতদেহটাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মায়ের শরীরের স্পর্শ কেমন প্রমিত অনেক আগেই ভুলে গিয়েছিল। অনেকদিন পরে মায়ের শরীরটাকে অনেক শক্ত মনে হল, যেন একটা খড়ের পুতুল। একটু পরেই সকাল হবে। তারপর মাকে আর দেখতে পাবে না প্রমিত। আর কখনও মাকে মারতে পারবেন না বাবা এগুলো ভাবতে ভাবতেই প্রমিত পাগলের মত কাঁদতে লাগল। তারপর মায়ের বাম হাতে আলগোছে ধরা রিভলভারটা নিজের পকেটে ঢুকাল সে। চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরদিন তেইশে ফেব্রুয়ারী। আরেকটা দিন। টিফিন পিরিয়ডে ছেলে তিনটা প্রমিতকে ধরে স্কুলের পেছনের বাগানে নিয়ে গেল। প্রমিতের প্যান্ট খুলে ওরা স্কুল বাউন্ডারীর বাইরে ফেলে দিল। তারপর তিনজনই প্যান্ট খুলতে শুরু করল। সেদিনের অত্যাচারটা অনেক নোংরা হত, অনেক বেশি নোংরা হত। হয়নি। প্রমিত স্কুল ব্যাগ থেকে রিভলভার বের করে এলোপাতাড়ি গুলি করে। তিনজনের মধ্যে একজনের মাথার খুলি উড়ে যায়। একজনের বাম উরুতে গুলি লাগে। আর একজন পালিয়ে যায়। পিস্তলে আরও একটা গুলি ছিল। স্কুলের দপ্তরী দেখতে পায়। ক্লাস ফাইভের একটা ছেলে নগ্নাবস্থায় রিভলভার হাতে মেয়েদের বাথরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সেই থেকে প্রমিতের শুরু। থানা পুলিশের কথা প্রমিত জানত না। সে শুধু জানত তার বাবা তাকে মেরে ফেলবে। তার বাবা তাকে মারতে পারেনি। স্ত্রী হত্যার দায়ে তার ছয় বছরের জেল হয়। জামিনও হয়। রাজনীতিবিদের ছেলে বলে প্রমিতেরও জামিন হয়। কিন্তু প্রমিত আর বাড়ি ফিরে যায়নি। চলে গিয়েছে অন্ধকার জগতে। সাল্ভাদর দালি তার হওয়া হয়নি। প্রমিতকে তার বাবা শিকারী কুকুরের মত খুজেছিলেন। তারপর কয়েকদিন যেতেই তার গোপনে বিয়ে করা স্ত্রীকে ঘরে এনে সব ভুলে গিয়েছেন।
প্রমিত একটা হিজড়া বাহিনীর দল গড়ে তোলে। সমাজের বিচারে এইসব উচ্ছিষ্ট আর মানসিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত মানুষগুলো প্রমিতের দলে ভিড়তে শুরু করে ধীরে ধীরে। বহরমপুর আর মতিনগরের দক্ষিণ অংশের ত্রাস হতে প্রমিতের ছয় মাস সময় লাগেনি। বহরমপুর মিনিসিপিউলিটি বাজার থেকে শুরু করে মতিনগরের নেশাদ্রব্যের বাজার পুরোটাই দখল করে নেয় প্রমিতের হিজড়া বাহিনী।
ঘুষ খেয়ে জমি দখলের জন্য দিনে দুপুরে মতিনগরের ভূমি অফিসারকে জবাই করে প্রমিত। প্রমিতের একটা অদ্ভুত নেশা ছিল। লাশের যৌনাঙ্গ কেটে রেখে দিত সে। গোলগলা গেঞ্জি, বাবরি চুল আর লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁট মানেই মৃত্যুদূত। প্রমিত হিজড়া শিশুদের জন্য একটা স্কুলও খোলে। হিজড়াদের জন্য একটা বুটিক শপ খোলার চিন্তা করছিল।
চিন্তা বাস্তবায়ন হল না। সতেরোটা হত্যা মামলা, বাইশটা পুলিশ হত্যা মামলা আর সাতটা হত্যা চেষ্টার মামলা মাথায় নিয়ে প্রমিত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ষোলই জুলাই। তারপর একদিন সংবাদপত্রের হেডলাইন আসে, এনকাউন্টারে শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রমিতের অধ্যায়ের সমাপ্তি। সবার অলক্ষ্যে প্রমিতকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই পাহাড়ি জেলখানায়। বাকি কয়েদীর সাথে স্থান হয় তার। বেঁচে থাকার শর্ত, তাকে যেটা বলা হবে সেটাই শুনতে হবে। তারপর থেকে প্রমিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরু করে। সেগুলোর সবগুলোই সংবাদপত্রে স্থান পায় রহস্যময় হত্যাকাণ্ড হিসাবে। সে হয়ে যায় সরকারি দলের গুপ্তঘাতক।
সতেরো বছর পরে প্রমিতের বাবার লাশ ঝুলতে দেখা যায় বহরমপুর শিশু পার্কের সামনে। গলায় দুইটা প্ল্যাকার্ড ঝোলানো। প্রথমটায় লেখা, “ শৈশবখেকো রাক্ষস “। আর দ্বিতীয়টায় লেখা,
“নিজের পাপের কারণ বিনাশ করাই সব থেকে বড় প্রায়শ্চিত্ত।”