‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ : একটি অংশাবলোকন

‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ : একটি অংশাবলোকন

বাংলা ভাষার যে ব্যাকরণখানি সর্বপ্রাচীন বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন তার প্রকাশকাল ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ। প্রকাশস্থান পোর্তুগালের লিসবন শহর। রচয়িতা একজন পোর্তুগিজ পাদরি। রচনার ভাষামাধ্যমও পোর্তুগিজ। এরপর ভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণখানি প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি ভাষায়, রচয়িতা একজন ইংরেজ। তবে মুদ্রণ ও প্রকাশস্থান বাংলাদেশের হুগলি। অর্থাৎ বাংলা ব্যাকরণ রচনার সূচনা অষ্টাদশ শতাব্দীতে, যদিও বাংলা ভাষার বিকাশ মোটামুটি দশম শতাব্দীতে। এ থেকে বোঝা যায় বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা হলেও গোটা মধ্যযুগে বাঙালি বাংলা ব্যাকরণ রচনার কোনো প্রেরণা বা প্রয়োজন অনুভব করেনি।

বাংলা ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনার যে পরম্পরা তার সূত্রপাত কলকাতায় উনিশ শতকের গোড়ায়। এই পর্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। রচয়িতা রামমোহন রায়। প্রথম দিকে বাংলা শিক্ষাজগতে এই বইয়ের সাগ্রহ সমাদর হলেও প্রায় একদশকের মধ্যেই বইটির প্রচারের ব্যাপ্তি সংকুচিত হয়ে আসে। এর কারণ এই বই প্রকাশের পাঁচ বছরের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের ভাষানীতির পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত সরকারি ভাষা ছিল পারসি, কিন্তু ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি প্রচলনের আদেশ প্রচারিত হল। তবে এই সঙ্গে বলা হল কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলনও চলবে, কিন্তু সেই বাংলা হবে আরবি-পারসিবর্জিত ও যথাসম্ভব সংস্কৃতঘনিষ্ঠ। বলা বাহুল্য এই নীতির পেছনে বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতিই সক্রিয় ছিল। ফলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃতঘনিষ্ঠ সাধু বাংলার অনুশীলন শিক্ষিত সমাজে প্রসারিত হল। তার জন্য সংস্কৃতানুসারী সাধুভাষার ব্যাকরণও দ্রুত রচিত হতে লাগল (বাক্যে আরবি-পারসি শব্দ বর্জন করে সেই জায়গায় যাতে অনায়াসে সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করা যায় তারজন্য এই সময়ে ব্যাকরণের পাশাপাশি একাধিক বাংলা-পারসিক অভিধানও প্রকাশিত হয়েছিল)। ভাষাচর্চা ও ভাষাশিক্ষায় এই সংস্কৃত-প্রাধান্যের পরিমন্ডলে ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণে’রও অনাদর অনিবার্য ছিল, কারণ রামমোহন তাঁর ব্যাকরণে বাংলা ভাষার সংস্কৃত উপাদানের চেয়ে তার লৌকিক উপাদানগুলির বিশ্লেষণের ওপরই বেশি জোর দিয়েছিলেন। ফলে সাধুভাষার বাংলা ব্যাকরণ লিখতে এগিয়ে এলেন সংস্কৃতব্যবসায়ী পন্ডিতেরা। তাঁরা বাংলা ব্যাকরণের নামে মুগ্ধবোধ ইত্যাদি সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রায় বঙ্গানুবাদ প্রচার করলেন। এমনকি বাংলা ব্যাকরণের ক্লাসে বিদ্যাসাগরের ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ (১৮৫১) পড়াবার ব্যবস্থাও তখন চালু হয়েছিল (বিদ্যাসাগর পরবর্তী জীবনে অবশ্য এই ব্যবস্থার ঔচিত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন)। বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের এই প্রচ্ছন্ন আগ্রাসন গোটা উনিশ শতক ধরেই অব্যাহত ছিল। শতাব্দীর শেষদিকে কেউ কেউ এই প্রথা ভেঙে বাংলা ভাষার লৌকিক উপাদানকে গুরুত্ব দেবার চেষ্টা করলেও তাঁদের প্রয়াস সফল হয়নি। তবে পাঠ্যজগতের বাইরে শিক্ষিত বাঙালি সমাজের একটি অংশে এই সংস্কৃতানুগামিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠছিল। এরই পরিণামে বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ব্যাকরণের রূপ ও স্বরূপ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিতর্ক শুরু হল। এই বিতর্কে নব্যপন্থীদের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। এই বিতর্ক অবশ্য স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ রচনার প্রচলিত ধারাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারেনি। তবে এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অধুনা-বিস্মৃত একটি উদ্যোগ ঐতিহাসিক কারণে স্মরণীয়। তাঁর ‘শব্দতত্ত্ব’ (১৯০৯), ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ (১৯৩৫) এবং ‘বাংলাভাষা পরিচয়’ (১৯৩৮)-এর কথা এ প্রসঙ্গে অবশ্যই স্মরণীয়। তবে আমাদের লক্ষ্য ছাত্রপাঠ্য ব্যাকরণের ধারায় তাঁর দান। তিনি তাঁর ব্যাকরণচিন্তাকে শুধু কতকগুলি নিবন্ধ ও গ্রন্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর নিজস্ব চিন্তা অনুযায়ী একখানি আদর্শ ছাত্রপাঠ্য ব্যাকরণ প্রকাশেও তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। উপলক্ষ্য ছিল শান্তিনিকেতনের আশ্রমবিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা। এক্ষেত্রে কখনও তিনি নিজে কতকগুলি পাঠ্যবই লিখেছেন, কখনও বা অন্যকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে তার পরিমার্জন ও সংশোধন করেছেন। বাংলা ভাষায় পাঠ্যবই রচনার ব্যাপারে তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী (১৮৯২-১৯৭২)। গোঁসাইজিকে দিয়ে তিনি প্রথমে ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ নামে একটি সাহিত্যের ইতিহাস লিখিয়ে আদ্যন্ত তার সম্পাদনা করেন। এর পর গোঁসাইজিকে দিয়ে একখানি বাংলা ব্যাকরণও লিখিয়ে তিনি তার আদ্যন্ত সংযোজন ও পরিমার্জন করেন। এই বইতে সমকালীন অন্যান্য স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের অবরোহী পদ্ধতির বদলে আরোহী পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছিল—অর্থাৎ প্রথমে সাহিত্যপাঠ, তারপর পাঠের ওপর প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে ব্যাকরণের সূত্রসন্ধান। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ‘রবীন্দ্র-সম্পাদিত ঐ বাংলা ব্যাকরণ পরহস্তগত হইয়া নষ্ট হইয়াছে’ (দ্রষ্টব্য : বিশ্বভারতী পত্রিকা, ১৮৮০ শক শ্রাবণ-আশ্বিন সংখ্যা)। গোঁসাইজি বর্তমান লেখকের পত্রোত্তরে (১৭/৩/১৯৬৮) জানান: ‘‘পূজনীয় গুরুদেব কথ্যভাষাকে ভিত্তি করে তার ওপর সাধুভাষার দিকে লক্ষ করিয়ে ব্যাকরণখানি লেখান’’। বিশ্বভারতী পত্রিকার পূর্বোল্লিখিত সংখ্যায় গোঁসাইজির সৌজন্যে ‘বাংলা ব্যাকরণের খসড়া’ ও ‘ব্যাকরণের ভূমিকা : অন্যান্য নির্দেশ’ নামে রবীন্দ্রনাথের যে দুটি বিচ্ছিন্ন রচনা প্রকাশিত হয়েছে তার ইঙ্গিত থেকেই অনুমান করা যায় ছাত্রপাঠ্য ব্যাকরণের রূপাদর্শ সম্পর্কে তাঁর ধারণা কী ছিল। এই বই লুপ্ত হলেও তার ইঙ্গিত বাংলা ব্যাকরণের পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

এই প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে প্রকাশিত একটি ছাত্রপাঠ্য ব্যাকরণ বইয়ের কথা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। বইটি হচ্ছে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’। প্রকাশকাল ১৯৩৯। প্রকাশক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লেখককে এই বহুপ্রতীক্ষিত ‘Comprehensive Grammar’-এর জন্য তার ‘grateful blessing’ জানান (২৪/১০/১৯৩৯)। এর আগের দশকে সুনীতিকুমারের বিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থ ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ (সংক্ষেপে ODBL) প্রকাশিত হয় (১৯২৬)। সুনীতিকুমার বলেছেন, ‘‘ODBL বইখানি ১৯২৬ সালে বাহির হইবার পরে ইস্কুলের ছাত্রদের উপযোগী একখানি সম্পূর্ণ বাঙ্গালা ব্যাকরণ লেখার কথা বহুবার মনে উঠিয়াছে’’ (ভূমিকা, নবীন সংস্করণ ১৯৫১)। কিন্তু এই বই স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের প্রচলিত ধারা অনুসারে রচিত হয়নি। প্রাথমিকভাবে এই বইয়ের যে দুটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে নজরে পড়ে তা হল:

১. রচনায় ‘নূতন দৃষ্টিভঙ্গী’

২. বাংলা সাধুভাষা ও চলিত ভাষার বর্ণনাত্মক ও সর্বাঙ্গীণ বিশ্লেষণ। ‘নূতন দৃষ্টিভঙ্গী’ কথাটি ব্যাখ্যা করে সুনীতিকুমার বলেছেন, ‘‘প্রস্তুত পুস্তকে বাঙ্গালা ভাষার ঐতিহাসিক আলোচনা নাই, কিন্তু ঐতিহাসিক বিচারের আধারেই আধুনিক বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ ইহাতে করিবার চেষ্টা করিয়াছি।’’ এই ‘ঐতিহাসিক বিচারের আধারে’ বিশ্লেষণই হচ্ছে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির নূতনত্ব। প্রচলিত ব্যাকরণগুলিতে সাধারণত গতানুগতিক ধরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মাবলি বাংলা ভাষার প্রেক্ষিতে সংক্ষেপে নির্দেশ করা হয়। কিন্তু সুনীতিকুমার সংস্কৃত নিয়মগুলি সরাসরি গ্রহণ না করে ভাষার ইতিহাস ও ভাষাশিক্ষার উপযোগিতার সূত্রে গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে বাংলা ভাষার নিজস্ব উপাদানগুলির যথাযথ বর্ণনা করেছেন। এই বইতে তাঁর লক্ষ্য নিয়ম-স্থাপন ও নিয়ম-আরোপ নয়, নিয়ম-আবিষ্কার ও নিয়ম-বর্ণনা। বিভিন্ন সময়ে তাঁর ব্যাকরণের নানা সংস্করণ হয়েছে, কিন্তু তাতে তাঁর মূল দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই কারণে বর্ণনাত্মক রীতিতে বাংলা ব্যাকরণ রচনার উত্তরোত্তর প্রয়াস চলতে থাকলেও তাঁর বইটি কারও পক্ষেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি এবং আজও হয় না। ‘নাসৌ মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নম’—এই সূত্রানুসারে পন্ডিতে পন্ডিতে মতানৈক্য অনিবার্ষ হলেও এই বই তাই উভয়পক্ষেরই প্রধান অবলম্বন বা আশ্রয়স্থল। একবিংশ শতাব্দীতেও এই কথা অযৌক্তিক বা অবান্তর নয়।

যাই হোক, পাঠকেরা এতক্ষণ নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে এ পর্যন্ত যা আলোচনা হয়েছে তাতে কিছু ব্যক্তি ও বইয়ের নামোল্লেখ ছাড়া ব্যাকরণ সম্পর্কে কোনো প্রগাঢ় আলোচনা স্থান পায়নি। এর একমাত্র কারণ ব্যাকরণের মতো একটি তত্ত্বভূয়িষ্ঠ, দুরবগাহ ও ‘দুর্দান্ত পান্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত’-বহুল শাস্ত্রে প্রবেশ করার মতো ব্যুৎপত্তি, পান্ডিত্য, বিদ্যাবত্তা এবং দুঃসাহস বর্তমান আলোচকের নেই। তবু ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ (২ খন্ড:ডিসেম্বর ২০১১) বইটি নিয়ে আলোচক যে নাড়াচাড়া করছেন, তার কারণ সম্পাদকেরা তাঁদের ‘সম্পাদকীয় ভূমিকা’য় অভয় দিয়েছেন: ‘‘এ ব্যাকরণ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা সাধারণ শিক্ষিত মানুষ পড়ে বুঝতে পারবেন, ব্যাকরণের বিশেষ জ্ঞানের দরকার হবে না।’’ সম্পাদকদের এই অভয়বাণীই এই ভীরু ও ভিতু আলোচকের মনে কিছুটা সাহস জুগিয়েছে। তবু গোটা দুইখন্ড নিয়েই চর্চা করার মতো মুরোদ যে বর্তমান লেখকের নেই তা স্বীকার করা ভালো। এই জন্যই এই আলোচনায় এই বইয়ের অংশাবলোকন অর্থাৎ বইয়ের উপর আংশিকভাবে দৃষ্টিপাত। আলোচনায় প্রথম খন্ডের অন্তর্গত শুধু তৃতীয় পর্বের ‘প্রমিত বাংলা ভাষার রূপতত্ত্ব’ অংশটি নিয়েই বর্তমান আলোচক নাড়াচাড়া করবেন। বলা বাহুল্য এই নাড়াচাড়ার লক্ষ্য কোনো প্রগাঢ় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়, তার বদলে কিছু ভাসা-ভাসা তাত্ত্বিক নিরীক্ষণ।

দুই

ক. মুখবন্ধ :

‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’—গ্রন্থনামের ‘প্রমিত’ পদটি পশ্চিমবঙ্গে তেমন পরিচিত বা প্রচলিত নয়। এখানে তার বদলে ‘মান্যচলিত বাংলা’ পদবন্ধটি বহুপ্রচলিত। তবে ‘প্রমিত’ পদটি অনেক বেশি ব্যাকরণসম্মত, কারণ পদটি ‘প্রমাণ’ পদের বিশেষণ। ‘প্রমাণ’ শব্দ তথা পদের অন্যতম অর্থ হল ইংরেজিতে যাকে বলে Standard। এই কারণে পশ্চিমবাংলাতেও Standard শব্দের আধারে পোশাক-আশাকের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয় প্রমাণ-সাইজের গেঞ্জি বা জুতো ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে ‘প্রমিত’ শব্দটি অল্পপরিচিত হলেও Standard Colloquial Bengali পদবন্ধটির বঙ্গানুবাদ এপার বাংলায় হয়েছে ‘মান্যচলিত বাংলা’। যাই হোক ব্যাকরণের দিক থেকে ‘প্রমিত’ শব্দটিই প্রশস্ততর—পশ্চিমবঙ্গেও এর প্রচার ও প্রসার চলুক এটাই কাম্য।

আরও একটি দিক থেকে এই বইয়ের আবির্ভাব অভিনন্দনযোগ্য। সেটা বাংলা ব্যাকরণরচনার পরম্পরার দিক থেকে। এ পর্যন্ত যত বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলির প্রকাশনার পেছনে কোনো না কোনো প্রকাশন প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলির চরিত্র প্রাতিষ্ঠানিক নয়, ব্যক্তিগত। প্রকৃত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাকরণ বলতে বোঝায় যে-ব্যাকরণ রচনার পেছনে কোনো গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের সমবেত চেষ্টা আছে। এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ওই সময়কার পুরোনো কার্যবিবরণী দেখলে জানা যায় সাহিত্য পরিষদ থেকে একটি বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশের জন্য ওই সময়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ‘কমিটি-পলাতক’ সদস্যদের উৎসাহের অভাবে কাজ কিছু হয়নি, ফলে পরিষদ শুধু সভাবদ্ধ ব্যাকরণ-বিতর্কের রসদ জুগিয়েছে। এর পর বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষে অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির উদ্যোগে বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠিত হয়েছিল (বর্তমান আলোচক তার অন্যতম সদস্য ছিলেন), কিন্তু প্রারম্ভিক মতানৈক্য ও সমন্বয়ের অভাবে আকাদেমির সেই চেষ্টাও ফলপ্রসূ হয়নি। সেদিক থেকে ঢাকা বাংলা একাডেমী যে বহুজনকে (তার মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পন্ডিতরাও আছেন) নিয়ে দুইখন্ডে কাজটি সম্পন্ন করল তার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।

খ. ‘প্রমিত বাংলা ভাষার রূপতত্ত্ব’ (প্রথম খন্ড) :

‘রূপতত্ত্বের ভূমিকা’ শীর্ষক ১৬নং পরিচ্ছেদ দিয়ে রূপতত্ত্বের আলোচনার সূচনা। এই অংশে ‘শব্দ’ ও ‘পদ’-এর পার্থক্য সুন্দর করে বোঝানো হয়েছে, কিন্তু একটু গোলমাল দেখা দেয় ১৭নং পরিচ্ছেদের ‘শব্দশ্রেণি’ অংশে। এখানে বলা হয়েছে: ‘‘প্রচলিত ব্যাকরণে বাংলা ভাষার শব্দগুলিকে পাঁচটি শব্দশ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে।…..এ ব্যাকরণে বাংলা শব্দের…..আটটি শ্রেণিকে গ্রহণ করা হয়েছে।’’ কিন্তু বিশেষ্য, বিশেষণ ইত্যাদি শব্দের শ্রেণি না পদের শ্রেণি? কারণ বিশেষ্য, বিশেষণ ইত্যাদি তো বাক্যে ব্যবহৃত শব্দ তথা পদের কার্যগত (functional) পরিচয়। সুতরাং এগুলিকে সরাসরি শব্দের শ্রেণিবিভাগ বলা কতদূর সংগত? এইজন্য সুনীতিবাবু তাঁর ব্যাকরণে (১৯৩৯) শব্দ ও পদ-এর পার্থক্য বজায় রেখেই পদের শ্রেণিবিভাগের শিরোনাম দিয়েছেন ‘বাক্যগত বিভিন্ন প্রকারের পদ [Parts of Speech]’ (পৃ.১২৭)।

এই ব্যাকরণের ‘শব্দশ্রেণি’তে বাংলা শব্দের যে আটটি শ্রেণি নির্দেশ করা হয়েছে, সেখানে প্রচলিত ‘অব্যয়’ নামটি বর্জিত হয়ে তার জায়গায় এসেছে ‘যোজক’ নামটি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও দুটি নাম : অনুসর্গ ও আবেগ শব্দ। ‘অব্যয়’ বর্জনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে : ‘‘প্রচলিত ব্যাকরণের অব্যয় কথাটিকে এ ব্যাকরণে গ্রহণ করা হয়নি। কারণ শব্দশ্রেণি হিসাবে অব্যয় কারক-বিভক্তি-বহুল সংস্কৃত ব্যাকরণের ধারণা।’’ কিন্তু এটাই কি প্রধান বা একমাত্র কারণ? মনে হয় অন্য অসংগতিও আছে এই বর্জনের পেছনে। আসলে বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়াবিশেষণ, ক্রিয়া—এই শ্রেণিনামগুলি সার্থকনামা। কারণ এদের মাধ্যমেই জানা যায় পদটি বাক্যে কী কাজ করে। এই জন্য আগেই বলা হয়েছে এই নামগুলি বাক্যে পদের কার্যগত (function) পরিচয়। কিন্তু ‘অব্যয়’ শব্দে বোঝা যায় না সংশ্লিষ্ট পদটি বাক্যে কী কাজ করছে। অব্যয়-কে যে বলা হয় যার ব্যয় বা পরিবর্তন নেই—সেটা পদটির রূপের পরিচয়, কার্য (functional)-এর পরিচয় নয়। অথচ তথাকথিত অব্যয়-নামধারী পদগুলিও বাক্যে কিছু কাজ করে, যা করে তা হল বাক্যের মধ্যে কিছু সংযোজন বা যোজন—কোথাও দুটি শব্দের, কোথাও দুটি বাক্যাংশের, কোথাও বা দুটি বাক্যের সংযোজন। এ ছাড়া এই ধরনের পদ কোথাও কোথাও বাক্যের অবয়বে বক্তার কোনো মনোভঙ্গিকেও যুক্ত করে। এই জন্য এই ধরনের পদের কার্যগত (functional) নামকরণ হিসাবে ‘যোজক’ নামটি খুবই যুক্তিযুক্ত। ঐতিহাসিক কারণে এখানে উল্লেখ থাক যে ‘অব্যয়’-এর বদলে ‘যোজক’ নামটি দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের পাঠ্যবই ‘কিশলয়ে’ (অধুনালুপ্ত) ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। জানি না, নতুন সিলেবাসে তা জায়গা পাবে কি না।

এখানে আরও বলা দরকার, এই ব্যাকরণে শব্দশ্রেণি হিসাবে যে ‘আবেগ শব্দ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে ‘যোজক’ শব্দের আরও একটু অর্থব্যাপ্তি ঘটালে তার মধ্যেই তথাকথিত আবেগ-শব্দের স্থানসংকুলান হয়ে যাবে। আগেই বলা হয়েছে, তবু বক্তব্যকে জোরালো করার জন্য আবারও বলা যায় এই ধরনের শব্দ তথা পদগুলি বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে বাক্যে নানারকম মনোভঙ্গির সংযোজন ঘটায়। সেদিক থেকে এগুলিও যোজক পদ। সুতরাং শব্দ তথা পদের শ্রেণির সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ কী? তাতে শুধু জটিলতাই বাড়ে। তারচেয়ে শ্রেণিনামের জন্য যথাসম্ভব কমসংখ্যায় অন্য-নিরপেক্ষ নাম ব্যবহার করে, তাতে উপবিভাগের ব্যবস্থা রাখলে কাজ মিটে যায়। এজন্য আমাদের প্রস্তাব ‘আবেগ শব্দ’—এই শ্রেণি বা শ্রেণিনামটি বাদ দেওয়া হোক। সেক্ষেত্রে এই শ্রেণির শব্দ তথা পদগুলিকে এই ব্যাকরণে যোজক শব্দের ‘বিশেষ’ শ্রেণি নামে যে উপবিভাগ করা হয়েছে (পৃ.২১১) তার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তাতে ২১২নং পৃষ্ঠায় ‘আবেগ-শব্দে’র যে ২ও ৩ নং উদাহরণ দেওয়া হয়েছে পদবন্ধ ও বাক্যখন্ড হিসাবে সেগুলিও এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

অনুসর্গ : প্রাথমিক বিবেচনায় শব্দশ্রেণি/শ্রেণিনাম হিসাবে ‘অনুসর্গ’ কথাটি গ্রহণ করা গেলেও চূড়ান্ত বিচারে একে পদনির্মাণের এলাকায় স্থান দেওয়াই সংগত। কারণ অনুসর্গে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয় তাদের নিজস্ব স্বাধীন অর্থ থাকলেও বাক্যে প্রযুক্ত হবার পর শব্দগুলির সেই অর্থগত স্বাধীনতা আর থাকে না, সেগুলি তখন সংশ্লিষ্ট পদের অন্বয়সূচক বিভক্তির কাজ করে। কাজেই অনুসর্গের আলোচনা পদনির্মাণের এলাকাতেই করা অধিক সমীচীন। তবে ব্যাকরণের ২১১নং পৃষ্ঠায় ‘অনুসর্গ-নির্মাণ’ অংশের একটি বাক্যে চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা আছে ‘‘বাক্যে ব্যবহৃত অধিকাংশ অনুসর্গে সপ্তমীর একটি -এ বিভক্তি লাগিয়ে প্রযুক্ত হয়।’’ বাক্যের এই ‘সপ্তমীর’ পদটির তাৎপর্য কী? কী বোঝাচ্ছে এই পদে? অনেক আগে অবশ্য বাংলা ব্যাকরণে ‘এ’-কে অধিকরণ বিভক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে সংস্কৃতের অনুকরণে তাকে সপ্তমী বিভক্তি বলা হত। কিন্তু এ প্রথা তো বহুদিন আগেই বাতিল (নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ ১৮৯৮; সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯৫৯) হয়েছে এবং এখন বিভক্তির চাক্ষুষ পরিচয়েই তার নামকরণ করা হয়। অর্থাৎ ‘জলে মাছ থাকে’—এখানে ‘জলে’ পদে যে বিভক্তি যুক্ত হয়েছে এখন তার নাম সপ্তমী বিভক্তি নয়, ‘এ’ বিভক্তি। প্রমিত ব্যাকরণকারেরা কি সেই পুরোনো প্রথাকেই ফিরিয়ে আনতে চান? কিন্তু কেন?

‘শব্দদ্বিত্ব’-এর আলোচনায় (পৃ. ২১৫-২২৮) সূত্রকারের গভীর অভিনিবেশ আছে, তাই পড়তে পড়তে মন স্বভাবতই আরও কৌতূহলী ও খুঁতখুঁতে হয়ে ওঠে। এই কারণেই ২২২নং পৃষ্ঠায় ৪নং ও ৫নং অনুচ্ছেদে যেসব উদাহরণ আছে তাদের পরিচয়জ্ঞাপক শিরোনামের সঙ্গে তাদের সংগতি নিয়ে একটু প্রশ্ন জাগে। ৪নং অনুচ্ছেদের ‘নৈকট্য’ (proximity) শিরোনামের অধীনে যেসব উদাহরণ আছে তার সবগুলোই কি নৈকট্যসূচক? ‘ওপর ওপর কথা’—নৈকট্যসূচক না অগভীরতা/অস্পষ্টতাসূচক? ‘ভাসাভাসা জ্ঞান’ একই প্রশ্নের অধীন, ‘উড়ু উড়ু মন…. উদাস উদাস দৃষ্টি’—এইসব কয়টি উদাহরণই কি নৈকট্যসূচক না সারূপ্যসূচক? আবার ৫নং অনুচ্ছেদের উদাহরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে—‘গাটা গরম গরম লাগছে’ নৈকট্যের অর্থ ইঙ্গিত করে। কিন্তু এতে সত্যিই কি নৈকট্যের অর্থ প্রকাশ পাচ্ছে, না ‘ঈষদ্ভাব’-এর অর্থ? এ প্রসঙ্গে সূত্রকারের মন্তব্য ‘এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান প্রয়োজন’। আমাদের মন্তব্য: এটা খুবই ঠিক-ঠিক কথা।

শব্দদ্বিত্ব-এর পর ‘পদের নির্মাণ’। কিন্তু তাতে আলোচনার প্রক্রমভঙ্গ হল না তো? কারণ শব্দনির্মাণের আরও কিছু প্রকরণ তো বাকি রয়ে গেল। বিশেষ করে এই পর্যায়ে ‘সমাসে’র আলোচনা তো আশু প্রত্যাশিত ছিল। যাই হোক, পন্ডিতেরা এটা ভেবেচিন্তেই করেছেন, বুদ্ধির স্বল্পতায় তা এই আলোচকের বোধগম্য হচ্ছে না। যাই হোক, এই পর্যায়ে পদনির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণ ‘কারক ও বিভক্তি’ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি অবশ্য ব্যাকরণের একটি বহুলপ্রচলিত প্রকরণ। বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাসে দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ বিষয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতিপদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে, তবে কোনো কোনো ব্যাকরণকার বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। যেমন, রামমোহন তাঁর ব্যাকরণে ‘কারক’ শব্দটিই ব্যবহার করেননি। Case-এর জায়গায় তিনি ইংরেজি বইতে ‘পরিণমন’ ও বাংলা বইতে ‘পরিণাম’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে বাংলা ‘পরিণাম’-এর সংখ্যা চারটি, তার মধ্যে ‘সম্বন্ধ’ অন্যতম। আলোচ্যমান প্রমিত ব্যাকরণে অবশ্য এতটা পরিবর্তন দেখানো হয়নি, ‘সম্বন্ধ’কে কারক ধরে এই ব্যাকরণে কারকের সংখ্যা ছয়—কর্তা, কর্ম, করণ, অপাদান, সম্বন্ধ ও অধিকরণ। আলোচনায় অবশ্য নতুন কোনো দিকনির্দেশ নেই।

তবে আলোচকের পক্ষ থেকে এখানে একটা নির্বোধ প্রস্তাব আছে যে, আলোচনায় কারক-নাম ও কারক ব্যাপারটিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে বলা হোক, বাক্যে ব্যবহৃত শব্দ তথা পদের পরিচয় দু-রকম: (১) কার্যগত (functional) পরিচয়: বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া, ক্রিয়াবিশেষণ ও যোজক; (২) অন্বয়গত পরিচয়: কর্তা, কর্ম, করণ, অপাদান, সম্বন্ধ, অধিকরণ ও সম্বোধন। শেষোক্ত বা ২নং নামগুলির মাধ্যমে জানা যায় বাক্যে ব্যবহৃত শব্দগুলির পারস্পরিক অন্বয় বা সম্পর্ক। সবগুলিই পদ, তবে ক্রিয়ার সঙ্গে যেসব পদের সম্বন্ধ আছে প্রকারান্তরে তাদের বলা যেতে পারে কারক-পদ। এদিক থেকে বলতে হবে কর্তা কারক নয়, কর্তা পদ; কর্মপদ, করণপদ ইত্যাদি। এই অন্বয়গত পরিচায়নে ক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদটির সম্পর্কের ব্যাপারটি প্রধান নয়। বাক্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদের পারস্পরিক অন্বয় বা সম্পর্কই প্রধান। তাতে সম্বন্ধ পদ বা সম্বোধন পদ কারক না হলেও তাদের গুরুত্ব কমে যায় না। আমাদের দৃষ্টিতে ‘কারক’ শব্দটি বাক্যে ব্যবহৃত কয়েক ধরনের পদের একটি অ-সাধারণ নামকরণ। তাই আমাদের প্রস্তাব—আলোচনায় প্রথাগত কারককে প্রাধান্য না দিয়ে বাক্যের বিভিন্ন পদের পারস্পরিক অন্বয় বা সম্পর্ককেই প্রাধান্য দেওয়া হোক। পন্ডিতেরা ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন।

এই প্রসঙ্গে বিভক্তি ও অনুসর্গ-এর ব্যাপারটিও এসে পড়ে। সংজ্ঞা অনুসারে বিভক্তি একটি লগ্নক, যা শব্দ বা ধাতুর সঙ্গে লগ্ন হয়ে বা লেগে থেকে পদ গঠন করে। অনুসর্গও তারই একটি প্রকারভেদ। ‘অনুসর্গ’ শব্দটিতে একটু স্বচ্ছতার অভাব আছে, তাই এটি পালটাতে পারলে ভালো হয়। কী হবে সেই পরিবর্ত বা বিকল্প শব্দ? আমাদের প্রস্তাব: এ জন্য নতুন কোনো শব্দ নির্মাণ বা সন্ধানের প্রয়োজন নেই। বিভক্তি ও অনুসর্গকে তাদের প্রয়োগের দিক থেকে একটু অন্যভাবে দেখা যাক। বাক্যে বিভক্তি যা করে, অনুসর্গও তাই করে। শুধু তাদের চেহারায় ও প্রয়োগে কিছু পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যকে মনে রেখেই যদি বলি যে-লগ্নক শব্দের সঙ্গে বসে পদগঠন করে তার সাধারণ নাম বিভক্তি। এই বিভক্তি দু-রকম: (১) বদ্ধ বিভক্তি ও (২) মুক্ত বিভক্তি। প্রচলিত বিভক্তিগুলি শব্দের সঙ্গে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ থাকে এবং তাদের কোনো আলাদা ব্যবহার নেই। তাই সেগুলি বদ্ধ বিভক্তি। যেমন- এ, কে, য়, তে ইত্যাদি বদ্ধ বিভক্তি। কিন্তু অনুসর্গরূপে চিহ্নিত পদগুলির ভাষায় নিজস্ব অর্থ ও স্বাধীন প্রয়োগও যেমন আছে তেমনি পদগঠনের সময় সেগুলি শব্দের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে যায় না, একটু আলগা থাকে (যথা, গাছ থেকে), কখনো কখনো আবার কোনো বদ্ধ বিভক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বসে (যথা, জলের মধ্যে), তাই এগুলি মুক্ত বিভক্তি। জানি না, আমাদের এই প্রস্তাব পন্ডিতেরা কীভাবে নেবেন। তবে প্রমিত-ব্যাকরণকারেরা সবটাই নতুন করে ভাবছেন বলে তাঁদের কাছে এই প্রস্তাব তুলে ধরা হল।

সবশেষে ‘সমাস’-এর প্রসঙ্গে আসা যাক। তার আগে ক্রিয়াপদের সংগঠন নিয়ে সুবিস্তৃত আলোচনা আছে। এটি এই বইয়ের উজ্জ্বল অধ্যায়। তবে সমাসের পরে যে ‘শব্দভান্ডার’-শীর্ষক পরিচ্ছেদটি আছে তার শেষ বাক্যটি হচ্ছে: ‘এ বিষয়টি বিস্তৃততর গবেষণার অপেক্ষা রাখে।’ আমাদের প্রশ্ন সেই গবেষণা ব্যাকরণকার করেননি কেন? খুব বিস্তৃত না করেও নানা দিক থেকে দেখে বিষয়টিকে সংহতভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। তার মধ্যে ইতিহাসের একটা দিক তো আছেই। তাছাড়া শব্দপ্রয়োগের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতটাও উল্লেখ করলে আলোচনায় একটা নতুন মাত্রা আসে। এই সঙ্গে মনে রাখা দরকার বাংলায় শুধু ভাঙা-সংস্কৃত শব্দাবলিই গৃহীত হয়নি, অনেক ভাঙা-আগন্তুক বা বিদেশি শব্দও (ইংরেজি ছাড়াও) ব্যবহৃত হয়েছে। এরও তো সোদাহরণ উল্লেখ দরকার। ব্যাকরণের সূত্রকার তাঁর আলোচনায় ‘অন-আর্য উৎসের শব্দ’—এই শিরোনামে শুধু দ্রাবিড় উৎস ও অস্ট্রিক উৎসের উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু বাংলায় তো আরও একটি অন-আর্য উৎস—ভোট-চীনীয়/ভোটবর্মী উৎসের শব্দবলিও আছে। যথাস্থানে খুঁজলে সেগুলির সন্ধান পাওয়া যায়। তার কিছু কিছু দৃষ্টান্ত তো এখানে না দিলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকে। তবে দৃষ্টান্ত নির্বাচনের ক্ষেত্রে বোধহয় আর একটু সতর্কতা দরকার। কারণ, বইতে ‘কমরেড’ শব্দাটিকে রুশ শব্দ বলা হয়েছে, সত্যিই কি তাই? যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে ‘কমরেড’ শব্দটি যুক্ত, সেই সংস্কৃতির উদ্ভব ও প্রসারক্ষেত্র অবশ্যই প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া, কিন্তু শব্দটির উদ্ভব যে রুশ-ভিন্ন অন্য উৎস থেকে তা অভিধান দেখলেই জানা যায়। আমাদের বিশ্বাস, পরিচ্ছেদটির পুনর্লিখন করলে তা এই বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে। বিশেষত প্রমিত ব্যাকরণের দ্বিতীয় খন্ডের দ্বিতীয় পর্বে ‘ভাষা সম্পর্ক’ নিয়ে যে আলোচনা আছে, পুনর্লিখনের সময় তার কিছু উপাদান এখানে গ্রহণ করলে ভালো হয়।

সবশেষে এবার সমাস প্রসঙ্গ। প্রসঙ্গটি আমাদের পক্ষে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। আলোচনার সূচনায় বলা হয়েছে: ‘‘এ অধ্যায়ে মূলত বাংলা ভাষায় শব্দসংহতি বা সমাসের প্রক্রিয়াটি আলোচনা করা হবে। এতে সংস্কৃত পরিভাষা এবং বিশ্লেষণের সহায়তা অবশ্যই নেওয়া হবে, সেই সঙ্গে নতুন পরিভাষারও প্রস্তাব থাকবে সংস্কারমুক্ত আলোচনার জন্য’’ (পৃ. ৩০৪)। খুবই সাধু প্রস্তাব। কারণ বাংলা ভাষার সমাস-প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করতে গেলে সব সময় সংস্কৃত পরিভাষা দিয়ে কাজ হয় না। এর কারণ সমাস-সংক্রান্ত সংস্কৃত পরিভাষাগুলি অনেক ক্ষেত্রেই স্বচ্ছ নয়। এজন্য স্বচ্ছ বা স্বচ্ছতর পরিভাষা নির্মাণ করা দরকার এবং বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়াকেও আরও প্রণালীবদ্ধ করা দরকার। পরিভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে পরিভাষাটি একদিকে যেমন স্বচ্ছ অর্থাৎ দেখামাত্র তার তাৎপর্য বোঝা যাবে এমন হবে, অন্যদিকে তেমনি নির্বিকল্প ও সহজে উচ্চারণযোগ্য হবে। সেই সঙ্গে পরিভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আর একটি নীতিও ঠিক করতে হবে যে, আলোচনায় শুধু নতুন পরিভাষাটিই ব্যবহৃত হবে, না পুরোনো পরিভাষাটিও পাশাপাশি থাকবে। প্রমিত ব্যাকরণে পুরোনো পরিভাষার পাশে নতুন পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- দ্বন্দ্ব বা বন্ধন সমাস, তৎপুরুষ বা কারকলোপী সমাস, কর্মধারয় বা বর্ণন সমাস এবং বহুব্রীহি বা অন্যার্থক সমাস। তবে নতুন পরিভাষাগুলির প্রযোজ্যতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

প্রথমে দ্বন্দ্ব বা বন্ধন সমাস—নতুন পরিভাষাটি কিছুটা স্বচ্ছ ও সহজে উচ্চারণযোগ্য হলেও নির্বিকল্প নয়। কারণ ‘বন্ধন’ তো যে-কোনো সমাসেরই সাধারণ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমস্যমান পদগুলিকে একটি বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়। এইজন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাংলাভাষা পরিচয়’ বইতে (পরিচ্ছেদ ২১) এ প্রসঙ্গে ‘ব্যবস্থা বন্ধন’ কথাটিও ব্যবহার করেছেন। সুনীতিবাবু (১৯৩৯, পৃ.১৭৬) একে ‘সংযোগমূলক সমাস’ বলেছেন। আরও স্বচ্ছ করার জন্য আমরা যদি একে ‘মিলন-সমাস’ বলি তাহলে কেমন হয়? তবে শব্দদ্বৈতের কোনো শ্রেণিকে ‘সমাস’ বলে চিহ্নিত করার প্রবণতা এই ব্যাকরণেও লক্ষ করা যায়। ‘প্রতিধ্বনিজাতীয় শব্দদ্বৈত্বগুলিকে (বইটই, ঘরটর) একরকমের সমাসই বলা যায় (পৃ.২১৫)। কিন্তু আমরা একমত নই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শব্দতত্ত্ব’ (১৯০৯) ও ‘বাংলাভাষা পরিচয়’ (১৯৩৮, পরিচ্ছেদ ২১)-এর বিভিন্ন অংশে সমাসের সঙ্গে এই জাতীয় জোড়া শব্দের সূক্ষ্ম পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। ভাষার একজন সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে তিনি যখন এ বিশ্লেষণ করেছেন তখন ব্যাকরণকারদের তা শিরোধার্য করা উচিত।

এবার আরও স্পষ্টতার জন্য আমরা ‘তৎপুরুষ’কে অন্বয়লোপী সমাস এবং তার বিভিন্ন বিভাগকে অন্বয়লোপী কর্মসমাস, অন্বয়লোপী করণসমাস অন্বয়লোপী অপাদান সমাস, অন্বয়লোপী সম্বন্ধ সমাস ও অন্বয়লোপী অধিকরণ সমাস নামে অভিহিত করতে চাই। অলোপ সমাসের নাম হোক অন্বয়-অলোপী সমাস। কর্মধারয়কে শুধু বর্ণনসমাস বললে অস্পষ্টতা দূর হয় না। যেহেতু এই সমাসের পূর্বপদটি পরপদের বিশেষত্ব বর্ণনা করে, সেজন্য একে ‘বর্ণনপূর্ব সমাস’ এবং এর বিভাগগুলিকে বর্ণনপূর্ব সাধারণ সমাস, বর্ণনপূর্ব মধ্যপদলোপী সমাস, বর্ণনপূর্ব উপমান সমাস, বর্ণনপূর্ব উপমিত সমাস, বর্ণনপূর্ব রূপক সমাস নামে অভিহিত করলে আরও স্বচ্ছতা আসে। দ্বিগু সমাসের নাম হোক সংখ্যাপূর্ব সমাস। বহুব্রীহি-র নামান্তর ‘অন্যার্থক সমাস’ চলতে পারে। এর বিভিন্ন বিভাগ হোক: অন্যার্থক সাধারণ সমাস, অন্যার্থক ব্যতিহার সমাস, অন্যার্থক মধ্যপদলোপী সমাস (পাঁচহাতি ধুতি, চাঁদবদন, দশবছুরে ইত্যাদি), অন্যার্থক অলোপ সমাস (গায়েহলুদ, ছড়ি-হাতে-বাবু, মাথায়-পাগড়ি ইত্যাদি)। অন্যার্থক ব্যতিহার সমাসের ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে বলতে হবে একমাত্র ক্রিয়ার পারস্পরিকতা বোঝালেই ব্যতিহার সমাস হবে। ক্রিয়ার পৌনঃপুনিকতা বোঝালে তা ব্যতিহার সমাস হবে না (অর্থাৎ লাঠালাঠি, চুলোচুলি, হানাহানি ব্যতিহার সমাস, কিন্তু হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি ব্যতিহার সমাস নয়)। যে ব্যাকরণ গবেষক বা পন্ডিতদের বদলে সাধারণ পাঠকরা পড়বেন সেখানে যথাস্থানে উদাহরণসহ বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা দরকার। শব্দদ্বৈত্ব প্রসঙ্গে আগে আলোচনা হয়েছে বলে বিষয়টি ছেড়ে দিলে সাধারণ পাঠকদের প্রতি সুবিচার করা হবে না। এ জন্য আমাদের মত এই যে ‘সমাস’ অংশটি সবদিক ভেবে আবার লেখা হোক। এ প্রসঙ্গে আরও একটা ব্যাপার ভাবতে হবে। সেটা হল ব্যাসবাক্যের বাংলাত্ব। প্রচলিত ব্যাকরণে অনেক সময় সংস্কৃত ব্যাকরণের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ব্যাসবাক্য তৈরি করা হয়। যেমন: সাহায্যপ্রাপ্ত = সাহায্যকে প্রাপ্ত (কর্মসমাস), গৃহহীন = গৃহের দ্বারা হীন (করণ সমাস) ইত্যাদি। কিন্তু এগুলি বাংলা বাক্য নয়। কী করলে ভালো হবে সেটাও বৈয়াকরণকেই এ প্রসঙ্গে করে দেখাতে হবে।

সব শেষে প্রমিত ব্যাকরণকারদের আর একটি ব্যাপারে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সেটা ব্যাকরণে ‘পক্ষ’ নিয়ে বিশদ আলোচনা করার জন্য। আমাদের মতো পশ্চিমবঙ্গবাসী সাধারণ পাঠকদের দুর্ভাগ্য এই যে কয়েক বছর আগে এখানকার স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের সিলেবাসে ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘পক্ষ’ ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষিত সমাজের একটি প্রভাবশালী রক্ষণশীল অংশের তৎপরতায় সেই নির্দেশ প্রত্যাহৃত হয় এবং স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। অবস্থা এখনও সেইরকম আছে। জানি না এর পর কী হবে! তবে ভারতের অন্য একটি বাংলাপ্রধান রাজ্য ত্রিপুরাতে এই বিজ্ঞানসম্মত পরিভাষা ‘পক্ষ’ বিনা প্রতিবাদে চালু আছে। প্রমিত ব্যাকরণেও তা স্থান পাওয়ায় আমাদের আবার আশা জাগছে।

তবে ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘পক্ষ’ কেন ব্যবহার্য এবং ‘পক্ষ’ ব্যাপারটি আসলে কী তা সাধারণ পাঠকদের একটু বুঝিয়ে দেওয়া দরকার (আগে যখন ‘পুরুষ’ ব্যবহৃত হত তখনও তার বৈশিষ্ট্য বোঝানো হত না।) প্রমিত ব্যাকরণে বলা হয়েছে ‘‘ ‘পক্ষ’ হল নামশব্দের…..এক ব্যাকরণিক বৈশিষ্ট্য’’ (পৃ. ১৬৯), কিন্তু পক্ষ কি শুধু নামশব্দের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক, না ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা আছে? আসলে ‘পক্ষ’ কোনো পদের বৈশিষ্ট্য নয়। এটি বাক্যনির্মাণের একটি ব্যাকরণিক ব্যবস্থা যার প্রভাবে বাক্যের নির্দিষ্ট অভিমুখ তৈরি হয় অর্থাৎ বাক্যের অভিমুখ বক্তাকে নিয়ে, না শ্রোতাকে নিয়ে, না বক্তা-শ্রোতার বাইরে কোনো তৃতীয় পক্ষকে নিয়ে তা নির্ধারিত হয় এবং তার ফলে বাক্যে নামপদ ও ক্রিয়াপদের রূপ-রূপান্তর ঘটে। প্রমিত ব্যাকরণে বাক্যের তিন ধরনের অভিমুখের দিকে লক্ষ রেখে তিনরকম পক্ষের কথা বলা হয়েছে: বক্তাপক্ষ, শ্রোতাপক্ষ ও অন্যপক্ষ। বিকল্পে আমরা যথাক্রমে ‘প্রথমপক্ষ’, ‘দ্বিতীয়পক্ষ’ ও ‘তৃতীয়পক্ষ’ শব্দবন্ধগুলিও ব্যবহার করতে পারি (একটি বিস্ময়কর, কৌতুককরও বটে, ঘটনা এই যে উনিশ শতকের সংস্কৃতব্যবসায়ী বাংলা ব্যাকরণকার ভগবচ্চন্দ্র বিশারদ তাঁর ‘সাধুভাষার ব্যাকরণসার সংগ্রহ’ গ্রন্থে [১৮৪০ খ্রি:] ‘পুরুষ’-এর বদলে ‘ব্যক্তি’ [person-এর বঙ্গানুবাদ] ব্যবহার করেছেন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রথম-মধ্যম-উত্তম ক্রমের বদলে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় ক্রম নির্দেশ করেছেন)। প্রমিত ব্যাকরণে শ্রোতাপক্ষ ও অন্যপক্ষের আরও উপবিভাগ করে পক্ষের সংখ্যাবৃদ্ধি করা হয়েছে: শ্রোতাপক্ষ–সাধারণ, অন্তরঙ্গ ও মানী এবং অন্যপক্ষ–সাধারণ ও মানী। এই উপবিভাজন অনুসারে ‘পক্ষ-বিভক্তি অনুযায়ী বাংলা সর্বনামের পাঁচটি পক্ষ দাঁড়ায়’ (পৃ.১৭০); আবার তারপরেই বলা হয়েছে: ‘ব্যক্তিবাচক সর্বনামের পক্ষরূপ ছয়টি’ (পৃ. ১৭০)। কিন্তু ‘সাধারণ’, ‘অন্তরঙ্গ’, ‘মানী’—এইসব ভেদ তো সামাজিক ভেদ, ব্যাকরণিক ভেদ নয়। কাজেই এগুলোকে ‘পক্ষ’-এর অন্যনিরপেক্ষ শ্রেণিভেদের কাজে লাগানো ঠিক নয়। সংশ্লিষ্ট পক্ষের আলোচনার সময়েই এইসব সামাজিক ভেদের কথা বলে দিলে কাজ চলে যায়। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে এইসব সামাজিক ভেদ চূড়ান্ত নয়, কখনও ব্যক্তিসাপেক্ষ, কখনও বা পরিস্থিতিসাপেক্ষ।

তিন

পরিশেষে বইয়ের অভ্যন্তরীণ কোনো আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা নয়, শুধু প্রশ্ন উত্থাপন। সেটা উৎসর্গপত্রের দিকে তাকিয়ে। এই পত্রে জানানো হয়েছে: ‘দেশবিদেশের অগণিত ভাবুক যাঁরা বাংলা ব্যাকরণের রূপ নির্মাণে স্মরণীয় কাজ করেছেন, তাঁদের শ্রদ্ধার্হ স্মৃতিতে’ এই গ্রন্থ উৎসর্গ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কিছু নামের তালিকা পেশ করা হয়েছে। প্রশ্ন এই তালিকা নিয়েই। কারণ বর্তমান আলোচকের বিবেচনায় এই তালিকায় অন্তত দুটি যোগ্য নাম বাদ পড়েছে এবং একটি অনুপযুক্ত নাম যুক্ত হয়েছে। অনুপযুক্ত নামটি হচ্ছে লোহারাম শিরোরত্ন (১৮২৩-১৯০৪)। লোহারামের ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ প্রথম কৃষ্ণনগর থেকে ২৮ জ্যৈষ্ঠ সংবৎ ১৯১৭ (ইং ১৮৬০) তারিখে প্রকাশিত হয়। তখনকার শিক্ষাজগতের সঙ্গে লোহারামের ভালো যোগাযোগ ছিল, তাই তখনকার পাঠ্যবইয়ের জগতে এই বই বহুপ্রচলিত ছিল। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বইয়ের ৩২টি সংস্করণ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এই সংস্করণ থেকেই লোহারামের পুত্র ললিতমোহন শর্মা এই বইয়ের আদ্যন্ত পরিবর্তন করেন। কিন্তু শুধু বহুপ্রচলিত হওয়ার জন্যই কি লোহারামের বইটিকে ‘বাংলা ব্যাকরণের রূপ নির্মাণে স্মরণীয় কাজ’ বলে গণ্য করা যায়? এখনকার পাঠকদের কতজন তাঁর বই দেখেছেন তা জানি না। তবে বর্তমান আলোচকের এই বইয়ের কয়েকটি সংস্করণ দেখার সুযোগ হয়েছিল। তাতে মনে হয়েছে লোহারাম তখনকার সংস্কৃতপ্রবণ বৈয়াকরণদেরই দলভুক্ত। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লোহারাম লিখেছেন: ‘‘এ পুস্তক ব্যাকরণ বিশেষের অনুবাদ নহে। প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ ভালো ব্যাকরণ আদর্শ করিয়া লিখিত হইয়াছে। কোন কোন স্থানে কোন কোন ব্যাকরণের কোন কোন অংশ অবিকল উদ্ধৃত হইয়াছে।’’ তাহলে তাঁর কাজের মৌলিকতা কোথায়? তা যদি না থাকে তাহলে কি এই তালিকায় তাঁকে গণ্য করা সমীচীন?

তালিকায় অনুল্লিখিত দুটি নাম হচ্ছে জন বীমস (১৮৩৭-১৯০২) এবং নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ (১৮৩৮/১৮৪০-১৯৪১)। প্রমিত ব্যাকরণের নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জিতে বীমসের তুলনামূলক ব্যাকরণের (প্রথম প্রকাশ-প্রথম খন্ড ১৮৭২, দ্বিতীয় খন্ড ১৮৭৫ ও তৃতীয় খন্ড ১৮৭৯) উল্লেখ আছে, সুতরাং বীমসের কাজকর্মের ব্যাপারে তো বর্তমান ব্যাকরণকারেরা অবগত আছেন। তবে এ প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন: বীমসের বইগুলির পুরোনো সংস্করণগুলিতে গ্রন্থকারের পদবি ‘Beames’ বানানে ছাপা হয়েছে, কিন্তু প্রমিত ব্যাকরণের নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জিতে ‘Beams’ বানান । এটা কি অসতর্কতা না সচেতন অযত্ন?

বীমস বহিরাগত হলেও বাংলাদেশের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ বেশি ছিল। এদেশে এসে তিনি প্রথম কলকাতার বুকে পদার্পণ করেন (১৮৫৮), তারপর সরকারি কাজে অন্যান্য প্রদেশে যেতে হলেও কর্মজীবনের শেষ দিকে (১৮৭৮-১৮৯৩) তিনি বাংলাদেশেই কাটান। এ জন্য বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর একটা আকর্ষণ গড়ে উঠেছিল। তাঁর উপন্যাসের চেয়েও সুখপাঠ্য তাঁর আত্মজীবনী ‘Memoirs of a Bengal Civilian’ পড়লে তার কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। তখন বাংলা ভাষার লেখকদের মধ্যে সাধুভাষা ও কথ্যভাষার ব্যবহার নিয়ে সংঘাত গড়ে উঠেছিল। এই পরিস্থিতিতে বীমস বিদেশি হলেও বাংলা ভাষার অন্যতম শুভার্থী হিসাবে একটা প্রতিকারের পথ দেখাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই উপলক্ষ্যে তিনি ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা গদ্যভাষাকে প্রণালীবদ্ধ করার জন্য ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমির আদর্শে বাংলা ভাষা নিয়ে একটি সাহিত্য-সমাজ গঠনের প্রস্তাব জানিয়ে ‘Treatment of the Nexus’ নামে একটি পুস্তিকা প্রস্তুত করেন। প্রস্তাবিত এই সাহিত্যসমাজের উদ্দেশ্য হবে ‘Consolidating the language and giving it a certain uniformity, or in short, for creating a literary language’। এই পুস্তিকার কথা বঙ্কিমচন্দ্র অবগত ছিলেন এবং এই প্রস্তাবের প্রতি হয়তো তাঁর কিছুটা সমর্থনও ছিল। তাই পুস্তিকাটি প্রকাশের আগেই তিনি এর একটি বঙ্গানুবাদ ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ১২৭৯ বঙ্গাব্দের (১৮৭২) আষাঢ় তৃতীয় সংখ্যায় ‘বঙ্গীয় সাহিত্যসমাজ। অনুষ্ঠানপত্র’ নামে প্রকাশ করেন এবং শেষে সম্পাদকীয় মন্তব্য যোগ করেন। ‘‘…..বীমস সাহেব দেশবিখ্যাত পন্ডিত এবং বঙ্গদেশের বিশেষ মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। তাঁহার কৃত প্রস্তাব যে পন্ডিতসমাজে বিশেষ সমাদৃত হইবে, ইহা বলা বাহুল্য। তাঁহার কৃত প্রস্তাবের উপর অনুমোদনবাক্য আবশ্যক নাই, এবং বলিবার কথাও তিনি কিছু বাকি রাখেন নাই। আমরা ভরসা করি, যেসকল বঙ্গপন্ডিতেরা দেশের চূড়া তাঁহারা ইহার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হইবেন।’’ পুস্তিকা প্রকাশিত হবার পর বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী মহলে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। রাজনারায়ণ বসু তাঁর ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে বীমসের বাংলা ভাষাপ্রীতির সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন। তবে বীমস শুধু বাংলা ভাষার ওপর আলোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি সরাসরি ইংরেজিতে বাংলাভাষার একটি ব্যাকরণও রচনা করেছিলেন: Grammar of the BENGALI LANGUAGE, Literary and Colloquial। প্রথম সংস্করণ ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে এবং ‘new and enlarged’ দ্বিতীয় সংস্করণ ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণের দুটি আলোচনা হয়। প্রথমটির রচয়িতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৬৮-১৯৪২)। এতে তিনি বইটিকে ‘admirable works of Beames’ বলে উল্লেখ করেন। দ্বিতীয় সমালোচক রবীন্দ্রনাথ। তিনি ১৩০৫ বঙ্গাব্দের পৌষসংখ্যা ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘বীমসের বাংলা ব্যাকরণ’ নামে আলোচনাটি প্রকাশ করেন। আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ বীমসের সম্পূর্ণ বইটি ধরেননি। তাঁর লক্ষ যেহেতু বাংলা উচ্চারণবিধি তাই বীমসের বইয়ের মূলত প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ অর্থাৎ উচ্চারণ পর্যায়ের অংশটুকুতেই তিনি সীমাবদ্ধ থেকেছেন। বীমসের আলোচনায় অনেক অসংগতি ছিল, রবীন্দ্রনাথ সেগুলি বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু বীমসের উদ্যোগকে তিনি ছোটো করে দেখেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে, এই ভ্রমসংকুল ব্যাকরণটি লিখিতে গিয়াও বিদেশীকে প্রচুর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় অবলম্বন করিতে হইয়াছে। শুদ্ধমাত্র জ্ঞানানুরাগ দ্বারা চালিত হইয়া তিনি এ কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন। জ্ঞানানুরাগ ও দেশানুরাগ এই দুটোতে মিলিয়াও আমাদের দেশের কোনো লোককে এ কাজে প্রবৃত্ত করিতে পারে নাই।….বীমস সাহেব তাঁহার ব্যাকরণে যে সমস্ত ভুল করিয়াছেন, সেইগুলি আলোচনা ও বিশ্লেষণ করিলেও মাতৃভাষা সম্বন্ধে আমাদের অনেক শিক্ষালাভ হইতে পারে। অতি-পরিচয়বশত ভাষার যেসমস্ত রহস্য সম্বন্ধে আমাদের মনে প্রশ্নমাত্র উত্থাপিত হয় না, সেইগুলি জাগ্রত হইয়া উঠে এবং বিদেশীর মধ্যস্থতায় স্বভাষার সহিত যেন নবতর এবং দৃঢ়তর পরিচয় স্থাপিত হয়।’’ এই অকপট রবীন্দ্রোক্তির পরেও কি বীমস অপাঙক্তেয়?

এর পর নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণের কথা। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায় তাঁর পৈতৃক পদবী ছিল ভট্টাচার্য। পিতা বনমালী বিদ্যাসাগর। শিক্ষা সংস্কৃত কলেজের স্কুল ও কলেজ বিভাগে। কলেজ থেকে ‘বিদ্যাভূষণ’ উপাধিলাভ। কর্মজীবনে সংস্কৃত কলেজে গ্রন্থাগারিক। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সংস্কৃত শিক্ষক ও পরে অধ্যক্ষ। তবে বংশগত পান্ডিত্যের ঐতিহ্য ও স্বোপার্জিত সংস্কৃত ভাষাজ্ঞান তাঁর বঙ্গীয় রসদৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। পাঠ্যবই রচনা ছাড়াও সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যরচনাতেও তিনি উৎসাহিত ছিলেন। তাঁর ‘আকবর’ এবং ‘কুমুদানন্দ’ নামের দুখানি উপন্যাস এবং ‘সন্ন্যাস’ নামক ভ্রমণকাহিনিটিতে খাঁটি বাংলা রচনায় তাঁর দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় সর্বজনপাঠ্য কথাসাহিত্য রচনায় উৎসাহী ছিলেন বলেই হয়তো বাংলা ভাষাকে প্রচলিত ব্যাকরণপ্রথার বাইরে রেখে সহজ ও মুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলেন। ছাত্রজীবনেই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে পরিচিত হলেও ছাত্রজীবনের পর তিনি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে আলোচনা করতেন। এ ছাড়া উনিশ-বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে বুদ্ধিজীবী সমাজে বাংলা ব্যাকরণের রূপরীতি নিয়ে যেসব আলোচনা হত তিনি সেসম্পর্কে জাগরূক থাকতেন। ফলে তাঁর ব্যাকরণচিন্তা এইসব আলোচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘ভাষাবোধ বাংলা ব্যাকরণে’ তার প্রমাণ আছে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় এ কথা তিনি স্পষ্টভাবে স্বীকারও করেছেন। বলা বাহুল্য তাঁর ব্যাকরণ পন্ডিতসমাজে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কিন্তু বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে তখন যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁদের কাছে তিনি মান্যতা পেয়েছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ১৩০৮ সালের পঞ্চম মাসিক অধিবেশনে (২৮সেপ্টেম্বর ১৯০১) রবীন্দ্রনাথ-পঠিত ‘বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত’ শীর্ষক প্রবন্ধের আলোচনায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নকুলেশ্বরের ব্যাকরণের সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন। এর পর ২৭ মে ১৯০৪ তারিখে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত এক সভায় ‘ভাষার ইঙ্গিত’ নামে যে প্রবন্ধটি পাঠ করেন, সেখানে প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণের আদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি নকুলেশ্বরের ব্যাকরণখানির কথা উল্লেখ করে বলেন: ‘‘আমরা বাংলা ব্যাকরণ নাম দিয়া সংস্কৃত ব্যাকরণ পড়িয়া থাকি। তাহাতে অতি অল্প পরিমাণ বাংলার গন্ধমাত্র থাকে। এরূপ বেনামিতে বিদ্যালাভ ভালো কি মন্দ তাহা প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে বলিতে সাহস করি না, কিন্তু ইহা যে বেনামি তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। কেবল দেখিয়াছি শ্রীযুক্ত নকুলেশ্বর ভট্টাচার্য মহাশয় তাঁহার রচিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণে বাংলা ভাষার বাংলা ও সংস্কৃত দুই অংশকেই খাতির দেখাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। ইহাতে তিনি পন্ডিতসমাজে সুস্থ শরীরে শান্তিরক্ষা করিয়া আছেন কিনা সেসংবাদ পাই নাই।’’ আমাদের প্রশ্ন : আলোচ্য উৎসর্গপত্রে নকুলেশ্বরের যে অনুল্লেখ তা কি পন্ডিতসমাজে শান্তিরক্ষার জন্যই?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *