প্রবাসে
কয়েক সেকেন্ড হল মারা গেছি। সময়টা ভোর। সূর্য সবে উঠছে। দিন শুরু হওয়ার আগেই আমার দিন শেষ হয়ে গেল। মৃত্যুর সময়টাতে আমার একটু কষ্ট হয়েছিল। বুকের কাছটায় সামান্য অস্বস্তি। খেতে খেতে জলের অভাবে উদগার আটকে গেলে যেমন হয় অনেকটা সেইরকম কষ্ট। পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীকে অল্প ঠেলা মেরে বলেছিলুম—হ্যাঁগা এক ঢোঁক জল খাওয়াবে। কিছুই না, দুহাত দূরেই কুঁজো, গেলাস। দিলেই পারত। তবু শেষ সময়ে মুখে জল দেওয়ার পুণ্য অর্জন করে আমার পরেই ন্যাজ নেড়ে নেড়ে স্বর্গে আসত। সুযোগ দিয়েছিলুম। ইউটিলাইজ করতে পারলে না। লেপের ভেতর থেকে ঘুম জড়ানো গলায় বলেছিল, একটু পরেই তো চা খাবে, সাতসকালে খালি পেটে জল খেয়ে কী হবে! কলকাতার জল না বিষ! যত কম খাওয়া যায়—হ্যাঁ-ই। সেই বিখ্যাত হাই। গত ষোলো বছর ধরে হাই, হাঁচি আর ঢেঁকুর তুলে তুলে আমাকে অতিষ্ঠ করে মেরেছে। সারা শীত সকালে মিনিমাম সত্তরটা হাঁচি। তাও মাঝে মাঝে একটা একটা করে নয়। সব জোড়া জোড়া। যেন মেল-ফিমেল পেয়ার। প্রথমটা মদ্দা হাঁচি, দ্বিতীয়টা মাদি হাঁচি—ফিঁচিত। কখনও একটা মদ্দার পেছনে দুটো মাদি। রান্নাঘর থেকে বসার ঘর সামান্য দূরত্বে। চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে আসছে। হাঁচি। ভঙ্গিটা দেখতে পাচ্ছি। হাতে ধরা কাপটা সামনে এগিয়ে ধরেছে দেবতাকে ফুল দেওয়ার মতো করে। মুখটা যে কোনও একপাশে ঘোরানো। এক-একটা হাঁচি বেরিয়ে আসছে, শরীরটা দুলে দুলে উঠছে। ছলকে ছলকে চা পড়ছে ডিশে। অর্ধেক ডিশে, অর্ধেক কাপে। সকালের চায়ের এই ছিল ছিরি। বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকে কোরা বউয়ের সবকিছুই মধুর লাগত। ইদানীং সব কিছুই অসহ্য মনে হত। ঠুকঠাক, ঢিসঢাস সারাদিন একটা না একটা নিয়ে লেগেই থাকত।
অকাতরে ঘুমন্ত স্ত্রীর পাশে খুব একটা হাঁকডাক না করেই আমি বেশ সহজেই মরে গেলুম। তেমন কোনও বড় লোক হলে আমার মৃত্যু সংবাদটা এইভাবে লেখা হত—পাসড অ্যাওয়ে পিসফুলি। জল না পেয়ে দু-চারবার খাবি খাওয়ার মতো হল। তারপর ফস করে মুখ দিয়ে কী-একটা বেরিয়ে গেল। তখন বুঝিনি ওটা আমার শেষ নিশ্বাস। আমি যে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলাম তা বুঝিনি। এখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করছি। বুকের কাছে যন্ত্রণাটা নেই দেখে হাত দুটো ভাঁজ করে বুকের ওপর রাখার ইচ্ছে হল। ইচ্ছেটাই হল। হাত দুটো নড়ল না। দেহের দুপাশে এলিয়ে পড়ে রইল। অনেকদিন আগে আমার রেডিয়োর টিউনিং কর্ডটা কেটে গিয়েছিল। নবটা ঘোরাই, ফসফস ঘুরেই যায়, কাঁটাটা আর নড়ে না। আমার ইচ্ছেটাও কেমন যেন ফসফসে হয়ে গেছে। তারপর মনে হল পা দিয়ে বউয়ের পায়ে পায়ে একটু খোঁচা মারি। পাটাকে নাড়াতেই পারলুম না। মনে হল বউয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলি—জল দিলে না তো বয়েই গেল, আমার পরাণ পাখি বেরিয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না।
যাক দেহটা তাহলে ইউসলেস হয়ে গেছে। এর মধ্যে চুপ করে বসে থাকলে পুড়ে মরতে হবে। আমি মিশরের কোনও ফারোয়া নই যে আমাকে আমচুরের মতো মশলা দিয়ে কাচের বয়ামে সরষের তেলে জারিয়ে রেখে দেবে। ওষুধের শিশির গায়ে যেভাবে লিখে রাখে সেই ভাবে লিখে রাখবে—’নট টু বি টেকন, ফর একস্টর্নাল অ্যাপালিকেশান ওনলি’। সতী হওয়ারও ইচ্ছে নেই যে আমার শরীরটার পেছন পেছন প্রাণনাথ, প্রাণনাথ করতে করতে সহমরণে ছুটবে। শয্যাত্যাগের মতো দেহটা ত্যাগ করতেই হবে দেখছি। কীর্তনীয়াদের মতো গাইতে ইচ্ছে করছে—’ভবের খেলা সাঙ্গ হল পারের খেয়া ধরি’। কোন রাস্তায় বেরোই। নবদ্বারের কোন দ্বারটি প্রকৃষ্ট হবে! নীচের দিকের দরজা দিয়ে বেরোব না। বেরোতে হলে ঢাকা খুলেই বেরোব, যেভাবে যুদ্ধ বিমানের বৈমানিক ককপিটের আবরণ খুলে বেরিয়ে আসে, যেভাবে সৈনিক বেরিয়ে আসে আন্ডার গ্রাউন্ড শেল্টার থেকে গোল ফোকরের ঢাকা খুলে।
বা:, কী সুন্দর লাগছে। অ্যা…ছি ছি, এতকাল কোথায় ঢুকে বসেছিলুম! ওই কী একটা বসবাসের উপযুক্ত ভদ্রগোছের বাসস্থান ছিল? যেন সরকারি আবাসন প্রকল্পের নিম্নআয়ের ফ্ল্যাট। আমকাঠের জানালার পাল্লার মতো দুটো কেলে ঠোঁট ফাঁক হয়ে আছে। দাঁতের গ্রিলে বহুকাল রং পড়েনি। দেহের বাইরেটা নোনাধরা, পলেস্তারা খসা দেওয়ালের মতো। কোনও রাজমিস্ত্রীর ক্ষমতা নেই—এ বস্তুর কিছু করে? এর যেমন প্ল্যান, তেমনি গঠন, তেমনি মালমশলা। ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ঠিকই বলেছিলেন—ও আর কিছু হওয়ার নয় মশাই। ওষুধে কি আর যৌবন ফেরে? যাহা যায়, তাহা যায়। ভালোই হয়েছে। ঝলঝলি, খলখলি জিনিসটা গেছে বাঁচা গেছে। সেকেন্ড হ্যান্ড, থার্ডক্লাস একটা জিনিস বয়ে বেড়াবার মেলা খরচ। সাধুবাবার সেই সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িটার মতো। দিনকতক পুষে বাপ বাপ করে জলের দরে ঝেড়ে দিয়ে এল। বাড়ি বিক্রি হয়, গাড়ি বিক্রি হয়, মরা গাছ কেটে বিক্রি হয়, মরা দেহ তো আর বিক্রি হয় না। হলে গেরস্থের কিছু সুবিধে হত। শুনেছি হাড়ের খাঁচাটার কিছু দাম আছে।
আমি এখন আমার পরিত্যক্ত দেহটার ওপর ভাসছি। ইংরেজিতে যাকে বলে হোভারিং, শীতকালে পল্লির মাথার ওপর ঝুলে থাকা খোলা উনুনের ধোঁয়ার মতো। যখন জীবিত ছিলুম তখন অবশ্য রোজ সকালে ছোট একটা আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে বাধ্য হতুম। প্রমাণ মাপের আয়না ছিল না তাই মাঝেমধ্যে গ্র্যান্ড টেলার্সের বড় আয়নার প্যান্টের ট্রায়াল দিতে গিয়ে গোটা শরীরটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মনের সুখে দেখে নিতুম। সে দেখা ছিল ভেতর থেকে নিজের প্রতিফলন দেখা। ছায়া দেখা। এমনভাবে দেখার সুযোগ কোনওদিন পাইনি। দ্রষ্টা আর দ্রষ্টব্য এখন আলাদা, এক নয়। যৌবনে স্ত্রীর শরীরের ওপর যেভাবে ঝুঁকে থাকতুম ঠিক সেইভাবে আমি ঝুঁকে আছি আমার শরীরের ওপর। আমার এই অবস্থাটা আমি ঠিক ধরতে পারছি না, বোধ হয় বায়বীয় অবস্থা। সারা মশারিতে আমি ছড়িয়ে আছি খুব হালকা একটা গ্যাসের মতো।
খুব মায়া হচ্ছে। এতদিন তেমন করে কেউ দেখল না এই শরীরটাকে। চোখের কোণে একপুরু কালি। মুখটা ভেঙে গেছে। চামড়া কুঁচকে গেছে। চুল উঠে গেছে, কাঁচাপাকা একখাবলা রোঁয়া। গলকম্বলটা ঠেলে উঠছে। দুটো কণ্ঠা বেরিয়ে পড়েছে। বিধ্বস্ত বিপুল চট্টোপাধ্যায় বসবাস করতেন এই বোনহাউসে। জীবনের হাতে খুব মার খেয়েছে বেচারা, বেধড়ক মার। বোকা, সেন্টিমেন্টাল, অপদার্থ। লোকটার কোনও চরিত্রই ছিল না, না ভালো, না খারাপ। বিষয়বুদ্ধিও ছিল না।
বিপুলের বউ হঠাৎ শুয়ে মশারি তুলে একটা পা খাটের বাইরে ঝুলিয়ে দিল। এইবার উঠছে। আমার বউ আর বলি কী করে। মহিলা এখন মৃত বিপুলের বউ। ভাগ্যিস পাশ থেকে খসে পড়ার মতো খাট থেকে উঠে গেল তাই। তা না হলে যদি ধরে ফেলত যে আমি মরে গেছি, অ্যায়সা চমকে উঠত! ভয়েই মরে যেত। একটু জল চেয়েই তো আমি মরে গেছি। যেই ভাবত একই লেপের তলায় মৃতদেহ নিয়ে শুয়ে আছে, হাঁউমাঁউ করে সাতসকালেই লোক জড় করে ফেলত। ভদ্রমহিলার হাঁউমাউটা চিরকালই একটু বেশি। কাণ্ডজ্ঞান নেই বললেই চলে। জীবনটা কেবল একসার অভ্যাস।
সূর্যোদয়ের মতো সংসারকাশে চন্দ্রোদয় হল। কাজের চেয়ে হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকিটাই বেশি। সব সময়ই বিরক্ত। এই বস্তুটিকে সুখী করতে গিয়েই বিপুলবাবু কাহিল হতে হতে এই কিছুক্ষণ হল পটল তুলেছেন। এইবার মজাটা বেশ জমবে। উনুনে আগুন দিয়েই বাথরুমে ঢুকবে। বেরিয়ে এসেই চা বসাবে কেরোসিন স্টোভে। চায়ের খরচ কমাবার জন্যে পাতা আর জল একসঙ্গে ফুটিয়ে একটা পাঁচন মতো তৈরি করবে। তাগড়া একটা গেলাসে সেই মাল ধরে দিত বছরের প্রতিটি দিন। কখনও অল্প তেঁতো, কখনও হাকুচ। বিপুলের সবই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। কখনও বলত না—অ্যা:, কি যাচ্ছেতাই চা যে করেছ? গরমজল ভেবে, ওষুধ ভেবে খেয়ে নিত।
ওই যে আবার ফিরে আসছে। এবার আর খাটের কাছে আসবে না। দরজার গোড়া থেকে হেঁকে বলবে—’কি উঠলে? চা ঠান্ডা হয়ে গেলে জানি না।’ একি হল? আজ যে বড় ঘরে ঢুকে সোজা খাটের দিকে এগিয়ে আসছে। কে জানে, কিছু বোধহয় মনে পড়েছে! অমঙ্গল, মৃত্যু, শুনেছি ছায়া ফেলে। বাথরুমে ঢুকে হয়তো মন বলেছে—একবার দেখে আয় তো, লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে। কাল রাত দেড়টা অবধি লোকটার সঙ্গে ধুম ঝগড়া হয়েছে। বারে বারে বলেছে—শরীরটা আজ বড় খারাপ। একদিন অন্তত ঝগড়াটা বন্ধ থাক না। কাল হবে, কাল হবে, ফুল স্ট্রেংথ নিয়ে।
কে কার কথা শোনে? গত ষোলো বছর বিপুল নাকি বউয়ের ওপর কেবল অত্যাচারই করেছে। জীবনের কোনও সাধ আল্হাদই মিটল না। অন্য কোনও মহিলার হাতে পড়লে বিপুলের বারোটা বাজিয়ে দিত। পেছনের কাপড় খুলে নিত। মাঝরাতে আদর করে বিপলু গায়ে একটা হাত রেখেছিল। সেই হাত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তেজ করে সরে শুতে শুতে বলেছিল, একতরফা কিছু হয় না। পেতে হলে ছাড়তে হয়। তোমার সুখের শরীর, ঘুমের ব্যাঘ্যাত কোরো না।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলছে—বেড়ে আছে! বেলা আটটা অবধি পড়ে পড়ে ঘুম। উঠেই চিৎকার, দেরি হয়ে গেল, দেরি হয়ে গেল। উঠে পড়ো, চা হয়ে গেছে।
মশারির কোণটা তুলে, বালিশের তলা থেকে দুকানের দুটো রিং খুঁজে নিয়ে পরতে পরতে ঘরের বাইরে চলে গেল। মনে হল ডেকে বলি—ওহে চায়ের আর তাড়াও নেই, চাহিদাও নেই। বিপুল মারা গেছে। আমার কোনও কণ্ঠস্বর নেই। অনুভূতিটাই কেবল আছে। বিপুলের গলাটা পেলে হয়তো বলা যেত। কিন্তু দেহ থেকে আমি যে বহিষ্কৃত।
কাল রাতে বিছানায় শখ করে নতুন একটা ফ্ল্যানেলের বেডকভার পাতা হয়েছিল। সেই চাদরটার সম্মানে বালিশে নতুন ওয়াড়ে লেপেও তাই। মশারিটাও প্রায় নতুন। কাটা ডি এ ফেরত পেয়ে তৈরি করিয়েছিল ছোবড়ার পুরু গদি। সমস্ত নষ্ট করে ফেলেছে বিপুল। বুঝতেই পারেনি মরতে চলেছে। বমি যেমন চাপা যায় না, বেগ যেমন ধারণ করা যায় না, মৃত্যুও তেমনি চাপা যায় না। শীতকাল না হলে গড়িয়ে মেঝেতে গিয়ে দুম করে পড়ত। ঠান্ডার ভয়ে লেপ ছাড়তে ইচ্ছে করেনি। বেচারা লেপের তলায় মজা করে মরেছে। অনেকগুলো টাকা জলে গেল। সব মাল পাবে শ্মশানের মানুষরা। খাটটা কী করবে কে জানে! সাংঘাতিক ভালো খাট। সাবেককালের জিনিস। বার্মা টিক। বাজারে এখন হাজার বারোশো দাম তো হবেই। কোনও ছোঁয়াচে অসুখে যখন মৃত্যু হয়নি তখন একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে রেখে দিলেই পারে। কতরকমের কুসংস্কার আছে। বলবে মড়ার খাটে শুতে গা-টা কীরকম ছমছম করে। মনে হয় মাঝরাতে মাথার কাছে লোকটা এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ভীষণ লোভ ছিল তো। সহজে ছেড়ে যেতে পারছে না। অদ্ভুত আত্মা ভূত হয়ে ঘুরছে। ‘পারো তো গয়ায় গিয়ে একবার পিণ্ডি দিয়ে এসো। পিণ্ডিকে পিণ্ডি হবে, বুদ্ধগয়াটাও দেখা হবে।’ বিপুলের বউ এখন বলবে, প্রভিডেন্ট ফান্ডে কত টাকা রেখে গেছে দেখি। বেশি উৎপাত করলে যত খরচই হোক ছেলেমেয়েদের কল্যাণে পিণ্ডি দিতেই হবে।
বিপুলের বউ রান্নাঘরে খুব চিৎকার করছে—এত করে বলে দিলুম, আসার সময় চিনি আনবে তবে সকলের চা হবে। ঝগড়া করবে, না সংসার করবে! মুখোমুখি হলেই তো চুলোচুলি। শুভা, শুভা, বাবাকে ঠেলে তোল। বল চিনি এনে দিতে। হয়ে গেল চা।
ইস মনে রেখে রেখেও ফেরার পথে সেই ভুলেছে, চিনি আনতে! ঘরমুখো গোরু একবার ছুটতে শুরু করলে নিজের গোয়ালটি ছাড়া সব ভুলে যায়। ভাগ্যিস বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে বিছানা ছেড়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠতে হত। বউয়ের সদা-বিরক্ত মুখটা দেখতে আরও বিরক্ত। চটি গলিয়ে মোড়ের দোকানে ছুটতে হত চিনি কিনতে। মরে বেঁচেছে।
শুভা আসছে বাবাকে ডাকতে। ভারী ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। বিপুল কাল রাতে যখন ফিরেছে তখন শুভা ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিপুলের প্যান্টের পকেটে গোল করে জড়ানো রয়েছে দুরকম রংয়ের চুলের ফিতে। অনেক দিনের আবদার। আজ আনব মা, কাল ঠিক এনে দেব মা করতে করতে যদিও বা কেনা হল, দেওয়ার সুযোগ আর পাওয়া গেল না। সঙ্গে দুটো চকোলেটও আছে। পকেটের গরমে গলতে থাকবে। সারি সারি পিঁপড়ে মার্চ করে পকেটে ঢুকে ঝাঁঝরা করে দেবে। ওই জন্যেই বলে ভবিষ্যতের জিন্মায় কিছু ফেলে রেখো না। সঙ্গে সঙ্গে করে ফেল। এখন আর ভেবে কী হবে! বিপুলবাবু পটল তুলেছেন। সমস্ত সমালোচনার ঊর্ধ্বে এখন বায়বীয় অবস্থায় ভাসছে।
—বাবা, ও বাবা। বাবা, ওঠো।
আজকে এত সুন্দর জামা পরেছিস কেন মা! ও তোর যে আজ জন্মদিন। বিপুলের না বাজার যাওয়ার কথা ছিল! ধপাস করে একটা শব্দ। জানালা গলিয়ে রোজকার মতো খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে গেল। শুভা কাগজটা তুলে নিয়ে টেবিলে রাখছে। বাবা ঘুম থেকে উঠে চায়ে চুমুক দিতে দিতে চোখ বুলোবে।
—বাবা, ও বাবা। তুমি মটকা মেরে পড়ে আছ। দাঁড়াও ঠান্ডা হাতে কাতুকুতু দি। তবে যদি তোমার ঘুম ভাঙে।
উঁহু তোর বাপের গায়ে আজ আর হাত দিসনি মা। তোর আবার ঘাড়ে চেপে দামালপনা করার অভ্যাস আছে। মৃতদেহ ছুঁলেই ওই সুন্দর জামাটা ফেলে দিতে হবে। হাতের মাদুলিটা নষ্ট হয়ে যাবে। শীতের সকালে চান করতে হবে।
—কী হল রে শুভা? তোদের রঙ্গ রেখে এদিকে এসে মর না।
—বাবা যে উঠছে না।
—গায়ে ঠান্ডা জল ঢেলে দে না।
—বাবা, ও বাবা, মা আসছে।
কে ভয় করে মা তোর মাকে? জানি ওই দেহটার কোনও ব্যক্তিত্ব ছিল না। মাঝে মাঝে আমি ওই খোলের মধ্যে থেকে চিৎকার করে উঠতুম—নিনকমপুপ, ভীতু, স্ত্রৈণ, ব্যাকবোন লেস। তবু কি তার স্বভাব পালটে ছিল? কম কষ্ট দিয়েছে আমাকে। কখনও সাহস করে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি। মাথা উঁচু করে একটা পুরুষ মানুষের মতো দাঁড়াতে পারেনি। ভয়ে ভয়েই আধমরা হয়ে থাকতে সবসময়। কী করবে, কেমন করে করবে ভেবে পেত না। এমন একটা অসহায় মানুষ খুব কমই দেখা যায়। ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ করেই জেরবার হয়ে যেত। রাগের চেয়ে মেয়েদের মতো অভিমানটাই ছিল বেশি। ব্রহ্মাচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখত, আবার মেয়েছেলে দেখলেই ল্যাল্যা করে ন্যাজ নাড়ত। তোদের বাপকে তোরা চিনতিস না, আমি চিনতুম হাড়ে হাড়ে, মজ্জায় মজ্জায়।
শুভা এইবার মশারি তুলে বিছানায় ঢুকেছে। হয়ে গেল মা, তোর ষাট টাকা দামের জামাটা গেল। কে আর আদর করে কিনে দেবে। এর পরই তো পথে বসবি।
দাঁড়াও তোমার গা থেকে লেপটা টেনে খুলি। বাবা ও বাবা। আজ কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এরপর মা এলে বিপদে পড়ে যাবে। ওঠো শিগগির!
বিপুল পড়ে আছে বাঁ দিকে কাত হয়ে। লেপের একটা কোণ চেপে আছে বাঁ দিকের দেহের তলায়। শুভা দু-হাত দিয়ে লেপের আর একটা পাশ তুলে ফেলেছে। বিপুলের দেহটা এখন দৃশ্যমান। গায়ে আধময়লা গেঞ্জি। পা-জামাটা রোজ লোহা জলে কেচে কেচে লালচে। পৈতের একটা অংশ কাঁধের কাছে গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে। কয়েকদিন হল নতুন একটা পাজামা আর গেঞ্জি কিনেছে। ভেবেছিল রবিবার দুপুরে ভাঙবে। আজ শুক্রবার। মাঝে আর মাত্র একটা দিন ছিল। বিপুলকে আমি প্রায়ই মনে করিয়ে দিতুম—ধবধবে পরিষ্কার বিছানায় ধবধবে পোশাক পরে শোবে। পরিচ্ছন্ন লোকের চালচলন আমি শেখাবার চেষ্টা করতুম। থাকার চেষ্টাও করত। ইদানীং সংসার নিয়ে একেবারেই ল্যাজেগাবরে হয়ে থাকত।
শুভা দু-হাত দিয়ে বাপের মুখটা ঘোরাবার চেষ্টা করচে আর বলছে,—ঘাড়টা অত শক্ত করে রেখেছ কেন বাবা। এদিকে তাকাও। তুমি নিজেই তাকিয়ে দ্যাখো রোদ কতটা চড়ে গেছে। বেলা কতটা বেড়ে গেছে। তুমি বুঝি আজ অফিসে যাবে না ভেবেছ।
শুভার জন্যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। শুভা আমার কে? কেউ না। বিপুলের মেয়ে। বিপুল মারা গেছে। অনুভূতিতে শুভা তার দাবি নিয়ে এখনও লেগে আছে। কিছুতেই উদাস হতে পারছি না, মায়া শূন্য হতে পারছি না। নৌকো যেমন নোঙর ফেলে জলের ওপর দোলে, আমিও তেমনি দুলছি বিপুলের দেহের ওপর। ভয় হচ্ছে শুভা যদি ঝুঁকে পড়ে বাপের মুখটা দেখার চেষ্টা করে, ভীষণ ভয় পেয়ে যাবে।
—বোকা মেয়ে তুই বুঝতে পারছিস না তোর বাপের শরীরটা কী রকম অসাড় হয়ে গেছে, কাঠ হয়ে গেছে। ঘাড়টা কী ভীষণ শক্ত। তোর এক ডাকে তোর বাপ তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেনি, এমন কখন হয়েছে!
শুভা ঝুঁকে পড়েছে বাপের মুখের ওপর। এইভাবে ঘাড়ে পড়াটা তার বড় পরিচিত ভঙ্গি। নরম নরম হাত দুটো দিয়ে বাপের দাড়ি ভরতি গালে ঘষতে ঘষতে শুভা বলত—তোমার গালটা কী খসখসে বাবা, একটু নরম করতে পারো না।
—একি বাবা, তোমার চোখ দুটো তুমি উলটে রেখেছ কেন? আবার তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ অমন করে। তুমি না বলেছিলে আর ভয় দেখাব না। ইস, তোমার খুব ক্রিমি হয়েছে গো আমার মতো, নাল গড়িয়েছে। আজ থেকে রোজ রাতে আমার ওষুধটা খাবে শোওয়ার সময়।
—শুভা, শুভা।
শুভার মা তারস্বরে ডাকেছ। মহিলা আজ ষোলো বছর ধরে বিপুলকে রোজ সকালে অফিস-এর ভাত ধরাচ্ছে। সকাল ন’টা পর্যন্ত তারা চালচলন ডেলি-প্যাসেঞ্জারের মতো।
—তুই চলে আয়, তোর বাবা চা না দেখলে বিছানা ছাড়বে না। তুই দয়া করে চা-টা নিয়ে যা। বল, বাজার হলে রান্না হবে। গুড়ের জায়গাটা ধুয়ে দে। বলবি একটু বেশি করে নতুন গুড় আনতে আর পায়েসের চাল আনতে।
—তখন থেকে ঠেলছি, একভাবে শুয়েই আছে বলবটা কাকে? তুমি একবার এসো না মা।
ভাতের জল ফুটে যাচ্ছে, আমার কি এখন ওসব দেখার সময় আছে রে! এক্ষুনি তো হুকুম হবে দাড়ি কামাবার গরম জল। বাবুর রাগ হয়েছে, অভিমান হয়েছে। ষোলো বছর ধরে দেখছি তো! জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হাড়মাস কালি কালি করে দিলে। তুই এদিকে এসে একটু দাঁড়া আমি যাচ্ছি। মুখপোড়া হুলোটা তখন থেকে ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছে।
—ঠিক আছে, আমার ডাকে সাড়া দিলে না তো। এইবার মা আসছে। এখন যদি সাড়া দাও, তোমার সঙ্গে আর কোনওদিন কথা বলব না। আমাকে তুমি চেনো না।
শুভা মন খারাপ করে চলে যাচ্ছে। কী করব মা, বিপুল যে মারা গেছে রে! তোর মা এলেও জাগাতে পারবে না। তোর মা কি মরা মানুষ বাঁচাতে জানে? জানে না। জ্যান্ত মানুষটাকেই ঠোকরাতে ঠোকরাতে মেরে ফেললে। বিপুলটা যদি তেমন হাঁকডাকওয়ালা মানুষ হত তাহলে কি এত তাড়াতাড়ি মরত! বেচারার শক এবসর্বারটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
—কী হল কী তোমার? ক্ষণে ক্ষণে কে তোমার মান ভাঙাবে বলতে পারো! তোমার না হয় কোনও কাজ নেই, আমার তো সৃষ্টি সংসার পড়ে আছে।
আবার সেই শাড়িতে হাত মুছছে। বিপুল বড় অপছন্দ করত। স্বভাব না যায় মলে।
—কি উঠবে তুমি! এই নাও তোমার চা। রাগ দেখাতে গিয়ে চাকরিটা যে খাবে! না:, লোকটা দেখছি আজ মহা ভোগাচ্ছে। মশারির দড়িটা খুলতে পারিসনি শুভা!
মশারি খুলেটুলে বিপুলকে যতই উদোম করে দাও ম্যাডাম, বিপুলের মুখ কিন্তু আর খুলবে না।
—অ্যাই কী করছ কী, ওঠো না গো। এ কি তোমার কপালটা এমন খ্যাসখেসে ঠান্ডা কেন! চোখ দুটোকে অমন উলটে রেখেছ কেন? ভাবচ মড়ার মতো পড়ে থাকলেই সংসার তোমাকে ছেড়ে দেবে। যা করার ঠিক সময়ে করতেই হবে। বাজারও যেতে হবে, অফিসেও ঠিক সময়ে হাজিরা দিতে হবে। কেউ শুনবে না বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে লেট হয়েছে। ওঠো ওঠো, উঠে পড়ো।
বিপুলের বউ কখনও মড়া দ্যাখেনি না কি! বুঝতে পারছে না কেন বিপুল মরে কাঠ হয়ে আছে। আচ্ছা ইডিয়ট তো। ওহে তোমার স্বামী মরে গেছে। এ ঘুম আর ভাঙবে না, এর নাম মহানিদ্রা!
—এই তুমি উঠবে না। মাইরি বলছি অফিস থেকে ফিরলেই আর কোনওদিন ঝগড়া করব না। তুমি আর আমাকে ভয় দেখিও না। তোমার সব কেরামতি আমার জানা আছে। কী সব যোগবিয়োগ করো, কুম্ভক-মুম্ভক করো। চোখ উলটে দম বন্ধ করে তুমি সারদিন পড়ে থাকতে পারো, তাতে আমার কী বলো, তোমারই দেরি হয়ে যাবে, চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। লেপ, মশারি খুলে দিয়েছি, একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে পড়ে আছ, ঠান্ডা লেগে যাবে যে। ওঠো না।
ব্যর্থ চেষ্টা বউমা, বিপুল আর উঠবে না। ওকে কাঁধে করে ওঠাতে হবে, নির্বাণ লাভ করেছে। রাইগার শুরু হয়ে গেছে।
—না:, সুবিধে মনে হচ্ছে না। শুভা এদিকে একবার আয় তো!
—-কী মা?
—একবার ভালো করে দ্যাখ তো, তোর কী মনে হচ্ছে।
—বাবা বোধহয় মরে গেছে মা।
—আ মোলো, কাঁদছিস কেন! ওলুক্ষণে কান্না! হঠাৎ মরতে যাবে কেন, জলজ্যান্ত লোকটা। মরা অত সহজ নাকি! মরলেই হল। ও মরলে আমরা যাব কোথায়? ইয়ার্কি না কি!
—জানি না মা, বাবা বোধহয় মারাই গেছে।
—তুই যা তো, চট করে একবার কাকুকে ডেকে নিয়ে আয়।
এই রে সেই পরেশকেই ডাকতে পাঠাল। কী কাণ্ড! বিয়ের বছর না ঘুরতেই ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই করে দিয়ে এখন পরেশেরই দ্বারস্থ! এমনি মুখ দেখাদেখি নেই। এখন তোমার প্রেসটিজে লাগল না। বেশ বাবা! স্বাবলম্বিনী হয়েছ, দেখি এখন ঠ্যালা সামলাও।
পরেশ আসছে। যাক খবর পেয়েই ছুটে এসেছে। আসতে কতক্ষণ, পাঁচিলের এপাশ আর ওপাশ। পরেশকে যখন আলাদা করেছিলে, তখন পরেশ ছিল বেকার, বিয়ে-থা করেনি। বলেছিলে পরেশের চরিত্রদোষ আছে। বউদি, বউদি করে কী সব করার চেষ্টা করে। অনেক কেচ্ছা হয়েছিল। সব ভুলে গেছ বুঝি। একেই বলে স্বার্থ!
—কী হয়েছে বউদি?
—তোমার দাদা…
এইবার কেঁদে ফেলেছে। হে হে, কেঁদে ফেলেছে। যতই কাঁদো, মরা মানুষ জ্যান্ত হবে না। বিপুলের হাওয়া বেরিয়ে গেছে।
—আহা আগেই কেন কাঁদছ। সরো আমাকে দেখতে দাও।
দু-কোমরে দু-হাত রেখে পরেশ ঝুঁকে পড়ে বিপুলকে দেখছে। ইদানীং বেশ মুটিয়েছে। ভুঁড়িটুরি হয়েছে। হবেই তো, ব্যাচেলার মানুষ, রমরমিয়ে ব্যাবসা চলছে। বিপুলের সংসার থেকে সরে গিয়ে শাপে বর হয়েছে। নিজের পায়ে বেশ ভালোই দাঁড়িয়েছে। এইবার হয় তো বিয়েটিয়ে করবে কিংবা করবেই না। উড়ে উড়ে জীবনটা ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে দেবে।
—বউদি আমি খুব ভালো বুঝছি না। শ্যাম ডাক্তারকে একবার ডেকে আনি। তুমি খ্যামোখা আগে থেকেই কেঁদো না। কাঁদার সময় অনেক পাবে। এখন এই মুহূর্তে একটু শক্ত হও।
পরেশ ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছে। তা যাক ডাক্তার তো একজন লাগবেই। শেষ কথা যে তিনিই বলবেন। ওহে মহিলা, তুমি বলছিলে কুম্ভক। ধরেছ ঠিক, তবে পুরক কুম্ভক নয়, শূন্য কুম্ভক। বাবু আমাকে ছেড়ে দিয়ে দেউলে হয়ে কেতরে আছে। বিশ্বাস করো, ও তোমাকে জব্দ বা বিব্রত করার জন্যে মরেনি। আমি ওকে তোমার চেয়ে অনেক বেশি জানি। সেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি ছিলুম বিপুলের অন্তরঙ্গ সঙ্গী। ও তোমাদের ভালোবাসত, তোমাদের ওপর নির্ভরশীল। তোমাদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যেতে চেয়েছিল। হঠাৎ বেরিয়ে গেলে, কী হবে বলো। তুমি ভীষণ ভয় পেয়েছ দেখছি। খুব ঘাবড়ে গেছ। অনেক দিনের একটা সাজানো অভ্যস্ত ব্যাপার হঠাৎ ভেঙে গেল, তাই না? ওরে বাবা একদিন তো যেতই, কিছু আগে আর কিছু পরে। মনে আছে, আমি যখন বিপুলের মুখ দিয়ে তোমাকে বলতুম—মেয়েমানুষ না হয়ে একটু মানুষ হওয়ারও চেষ্টা করো, একটু সাঁতার-টাঁতার শেখো, হঠাৎ জলে পড়লে তলিয়ে না গিয়ে তবু ভাসতে পারবে। সংসারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছু নেই মালক্ষ্মী। এ বড় সাংঘাতিক জায়গা তুমি তখন কুঁইকুঁই করে হাসতে। তোমার হাসি দেখে বিপুল গুনগুন করে গাইত—শ্যামাপদে আশ, নদীর তীরে বাস, কখন কী ঘটে ভেবে হই মা সারা। তুমি পান চিবোতে চিবোতে বলতে, মাছঝাল দিয়ে আজ কেমন জমিয়েছিলুম বলো তো? তিনটে কাঁচা লঙ্কা। তোমার আগে আমিই চলে যাব ড্যাং ডেঙিয়ে। শুভাটার একটু ভালো ঘরে বিয়ে দিও। ইচ্ছে হলে, তারপর তুমি আর একবার পিঁড়েতে বোসো। তোমাদের কথা শুনে শুভা অমনি প্যাঁ করে কেঁদে ফেলত। তোমরা অমনি দুপাশ থেকে মেয়েকে সামলাতে, দূর পাগলি, তুই মজা বুঝিস না, আমরা কেউই যাব না রে বোকা, তোর সঙ্গেই থাকব। এই হয় গো, এই হয়, হঠাৎ বাঁধন আলগা হয়ে যায়। সব গোরুই কি আর সন্ধের পর মাঠ থেকে ফিরে আসে! কালের রাখাল একটা দুটো রেখে দেয়!
ডক্টর শ্যাম ব্যানার্জি ঢুকছেন। পশার তেমন ভালো জমাতে পারেননি। কাজ চলা গোছের ডাক্তারিটা জানেন। মধ্যবিত্তদের ওইতেই সন্তুষ্ট করা যায়। জ্বরজাড়ি, পেটের অসুখ, হাম-বসন্ত যা হোক উতরে দিতে পারেন। পরনে সেই রংজ্বলে যাওয়া নীল গরমের স্যুট। গলায় মরচে ধরা স্টেথিসকোপ। হাতে ধসকে যাওয়া আদ্দিকালের কালো চামড়ার ব্যাগ। থলথলে চেহারা। ফোলাফোলা মুখ।
ঘরে ঢুকেই ডক্টর শ্যাম দূর থেকে বিপুলের পড়ে থাকার ভঙ্গিটা দেখে থমকে গেলেন, তারপর ঘরের সিলিঙের দিকে তাকিয়ে এক নিশ্বাসে বললেন—হি ইজ ডেড। পরেশের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, ডেড হি ইজ। সব শেষ। বিপুলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, হে হে, মারা গেছে। এ অবস্থায় আই হ্যাভ নাথিং টু ডু। ঈশ্বরের হাতে চলে গেছে। ভেরি স্যাড। ভেরি ভেরি স্যাড। আমার সঙ্গে কালও তো দেখা হয়েছিল।
বিপুলের বউ এতক্ষণে ফোঁস ফোঁস করছিল। ডেড শব্দটা শুনেই ভোঁও করে কেঁদে সোজা গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল বিপুলের ঘাড়ে। শাড়ির আঁচল লুটোচ্ছে মাটিতে। চুল এলোমেলো। মন্দ দেখাচ্ছে না। বেপমান রমণী। আমি তো তেমন করে একে কখনও দেখিনি। বিপুলের চোখ দিয়ে যেটুকু দেখতুম তাকে পরিষ্কার দেখা বলে না। মধ্য বয়সের মেদ জমেছে নিম্নাঙ্গে। পা দুটি বেশ নধর। গোড়ালি দুটো অমার্জিত। চুলের তেমন যত্ন নেই। কোমরটি ভারী। কী আশ্চর্য, কাল রাত দুটো পাঁচ মিনিটে এই মহিলাই বিপুলের এগিয়ে আসা হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়েছিল। আর আজ?
পরেশ একটু রুক্ষ গলায় বলল—সরো সরো। ডাক্তারবাবুকে দেখতে চাও।
—ওর আর দেখার কী আছে। মনে হচ্ছে আনন্যাচারাল ডেথ। দেখছেন না মুখটা কী রকম কালো হয়ে গেছে। দম বন্ধ করেই মারা হয়েছে। পোস্ট মর্টেমে পাঠিয়ে দিন।
—কী বলছেন আপনি? মারা হয়েছে মানে? দাদার মৃত্যু হয়েছে।
—আহা ওই হল। না মারলে মরবেন কী করে!
—কী অদ্ভুত কথা বলছেন আপনি। দাদাকে কে মারবে! মারবার কারণটাই বা কী? সাধারণ মানুষ, ধনী নন, নেতা নন, অভিনেতা নন, প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী নন, চোরাকারবারী নন, এঁরা মার খান কিন্তু অপঘাতে মরেন না।
—সে তো আমিও জানি। বিপুলবাবুকে তো আজ নয় অনেক দিন ধরে দেখছি। গোবেচারা মানুষ। নর্দমার ধার দিয়ে ভয়ে ভয়ে গুটিগুটি হাঁটতেন। কারুর সঙ্গে দেখা হলেই মুচকি হাসতেন। ক্রনিক আমাদের রুগি। বদহজম ছিল। রক্তে নিম্নচাপ। নার্ভাস ব্রেকডাউন। নিম্ন মধ্যবিত্তের যা যা হওয়া উচিত সবই হয়েছিল। পাতলা চুল, পাতলা দাস্ত, পাতলা ঘুম, ঘন প্রস্রাব, কিন্তু কোনটাই কিলিং ডিজিজ নয়। তবে মারল কে?
কেন থ্রম্বোসিস?
—ধ্যার মশাই! থ্রম্বোসিস তো রিচ ম্যানস ডিজিজ। এ সব ব্যাপারে ডেথ সার্টিফিকেট হঠাৎ লেখা যায় না। রিসকি ব্যাপার। দায়িত্ব অনেক!
এই রে শ্যাম ডাক্তার প্যাঁচে ফেলে দিয়েছে। পয়সা খ্যাঁচবার তাল। বিপুল যদ্দিন বেঁচে ছিল, হাজার হাজার টাকা ঝেঁপেছে। এখন মড়ার ওপরেও খাড়ার ঘা। কী জিনিস! আসতে কাটে যেতেও কাটে। বিপুল অবশ্য কাল রাতে ঝগড়ার সময় বলেছিল—বুঝলে মানুষকে শুধু ভোজালি দিয়েই যে খুন করা যায় তা নয়, কথা দিয়েও মারা যায়। এই জন্যেই বলে বাকবাণ! তিলতিল না মেরে একবারেই ফিনিস করে দাও! ল্যাঠা চুকে যাক। তোমারও চিরশান্তি, আমারও চিরশান্তি। জিওল মাছের মতো আর বাঁচতে চাই না। বাক্যবাণে মৃত মানুষকে কি কেউ পোস্ট মর্টেমে পাঠায়?
না:, পরেশটার বুদ্ধি আছে। প্যাঁচটা ঠিক ধরে ফেলেছে। বলছে
—কেন ম্যালা রেলা করছেন ডাক্তারবাবু। দেখছেন আমরা বিপদে পড়েছি। আমরা আপনার বাঁধা রোগী। ব্যবস্থা একটা হবেখন।
শ্যাম ডাক্তারের মুখটা আরও গম্ভীর হল। ভগবানদত্ত বোয়াল মাছের মতো মুখ। এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে বিপুলের বউয়ের শরীরের দিকে। বউটা তো খারাপ ছিল না। স্ত্রৈণ হওয়ার মতোই জিনিস। এখন যেভাবে উপুড় হয়ে পড়ে আছে, শোকার্ত হলেও যে কোনও মাঝবয়সি লোককে কামার্ত করার ক্ষমতা রাখে।
ডক্টর শ্যাম মহিলার কোমরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কাল রাতে কি খেয়েছিল?
পরেশ প্রশ্নটাকে উঁচু গলায় আর একবার হাঁকল—কি খেয়েছিল বউদি?
—যা খায়। গলা ভাত আর ঝোল।
শ্যাম ডাক্তার : ঝোলে টিকটিকি পড়েছিল?
পরেশ : টিকটিকি?
শ্যাম : হ্যাঁ হ্যাঁ টিকটিকি। বড় বিষাক্ত জিনিস। অনেক সময় সিলিং থেকে পা স্লিপ করে ফুটন্ত কড়ায় পড়ে যায়।
পরেশ : দাদার ঝোলে কি টিকটিকি ছিল?
বিপুলের বউ : না ঠাকুরপো। আমরা সবাই তো সেই ঝোল খেয়েছি। কই শেষ পাতে তো টিকটিকি দেখিনি।
শ্যাম : জেনে নেওয়া দরকার। মৃত্যু বড় সাংঘাতিক জিনিস। বেঁচে আছে তো আছে হঠাৎ মরলে আর রক্ষে নেই। ঘুমের ওষুধ খেত?
বিপুলের বউ : মাঝেমধ্যে।
শ্যাম : কাল খেয়েছিল?
বিপুলের বউ : খাব খাব করছিল। আমি জোর করে কেড়ে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছিলুম।
শ্যাম : কেন?
বিপুলের বউ : যদি বেশি খেয়ে ফেলে।
শ্যাম : আই সি। তার মানে বেশি খাবার কারণ ঘটেছিল? দেখছেন পরেশবাবু? দেখি ডেডবডিটাকে চিত করুন তো। একে লো-প্রেসার তার ওপর ঘুমের বড়ি। আত্মহত্যার কেস? কমিটেড সুইসাইড। এ জিনিস তো ছেড়ে দেওয়া যায় না।
ও:, শ্যামটা কি সাংঘাতিক লোক। সদ্য বিধবাকে কীভাবে নিঙড়োচ্ছে। বিপুলের বউ কোনও রকমে দেহটাকে টানা-হ্যাঁচড়া করে আকাশ মুখো করেছে। পরেশ এতক্ষণে কথা ফিরে পেয়েছে ঃ
—ধ্যার মশাই, আত্মহত্যা করতে যাবে কোন দু:খে। সুইসাইড করতে হলে মনের জোর থাকা চাই। দাদার মতো মেনিমুখো লোকেরা ও সব ভাবে, কিন্তু করে না। নিন তো, ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখে ফেলুন। এখনও অনেক কাজ বাকি? বউদি কিছু টাকা বের করো।
মাসের শেষ। সংসার খরচের টাকা ক’টাই বা পড়ে আছে। শেষ সপ্তাহের রেশনের টাকা গোটাকুড়ি থাকতে পারে। রোজ তিনটাকা হিসাবে পাঁচদিনের বাজার খরচ পনেরো টাকা। তাও পনেরো আছে কিনা সন্দেহ। একদিন কাটা পোনা, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি, টোম্যাটো কেনা হয়েছে এই সপ্তাহেই। মরেও শান্তি নেই। কোথা থেকে এক শ্যাম ডাক্তার আমদানি হল। বিপুলের কোনও অসুখেরই যিনি দায়িত্ব নিতে পারলেন না, তিনি হঠাৎ মড়ার পথ আগলে যমদূতের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়ালেন।
বিপুলের জামার বুকপকেটে পথ খরচের কিছু টাকা আছে। পথই যার ফুরোল তার আর পথ খরচে কী হবে। ভেতরের পকেটে হাত ঢোকাও। আহা, ওপরের নয়, ভেতর দিকে, ভেতর দিকে। কী বেরোল? একটা একশো টাকার নোট। হয়ে গেল। পুরোটাই ডাক্তারের পকেটে যাবে। সঙ্গে ওটা কী লাল মতো। সিনেমার টিকিট! মরেছে! বিপুলের কাণ্ড দেখ। বুড়ো বয়সে ঘোড়া রোগ। বউকে নিয়ে বাস ঠেঙিয়ে কলকাতায় সিনেমা দেখতে যাওয়ার ছেলে সে ছিল না। সম্প্রতি ওর একটু প্রেম করার শখ হয়েছিল। বিপুলের কাণ্ড দেখে হাসতুম। উদাসীন আমি, আমার বলার কিছু ছিল না। বললেও শুনত না। প্রবৃত্তি। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়। রূপসী নয় তবে গুণবতী। বিয়ের সাধারণ বাজারে অচল। তবে গুণ দেখে যদি কোনও গুণমুগ্ধ এগিয়ে যেত তবে হয় তো সংসার-টংসার হত। অবশ্য পঁয়ত্রিশ বছর অপেক্ষায় অপেক্ষায় পার হয়ে গেছে। বিপুল বোকার মতো তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন। এক বউ থাকতে আর একবার বিয়ে হয় না। সম্পর্কেও আটকায়। ছি ছি পড়ে যায়। সাহস না থাকলে লম্পট হওয়া যায় না। তবু ভাবত, একদিন, একদিন। সে পালাবে। অজানা জায়গায় একটা নতুন মন নিয়ে মেতে উঠবে। কর্তব্য-টর্তব্য সব ভুলে একটা নতুন নেশা নিয়ে নতুন ধরনে বাঁচবে। এ তার একতরফা ভাবনা। মরে আসা জীবনে জীবনের লাথি। বিপুল বেঁচে থাকলে আজ সন্ধের শোতে পাশাপাশি বসে দুজনে সিনেমা দেখত। একটি রোগা রোগা শ্যামলা মেয়ে, শিল্পী মেয়ে।
বিপুলের বউ টিকিট দুটো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। কান্নাটা আবার উথলে উঠছে। বোকা মেয়ে। ভেবেছ একটা টিকিট ছিল তারই জন্যে। অবশেষে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিপুল আজ তাকে নিয়ে সিনেমায় যেত। ভাবো, তাই ভাবো। মরা মানুষটার দিকে আকর্ষণের পাল্লাটা আর একটু ঝুঁকুক। তার সমস্ত অক্ষমতা মুছে দিতে সে মৃত্যুকে টেনে এনেছে। বড় জোরদার প্রতিদ্বন্দ্বী। মৃত্যুর সামনে সব অভিমান ডাহা জব্দ।
টাকাটা হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে পরেশ ফিসফিস করে বললে—বোকা মেয়ে। নোটটা দেখালে কেন, হাফে রফা হত, পুরোটাই যাবে। আকাশের মতো উদাস, জলে ভেজা দুটো চোখ তুলে বিপুলের বউ বললে—আর সবই তো গেল ঠাকুরপো। বিপুল বেঁচে থাকলে এই কথাটা শুনে তার খুব আল্হাদ হত। কী সুন্দর কথা! যাক এরা তাহলে স্বীকার করছে সেই ছিল নায়ক।
এইবার একে একে লোক জমছে। ঘরে, ঘরের বাইরে প্রতিবেশীদের দেখা যাচ্ছে। শুভা বিপুলের পায়ের দিকে মেঝেতে বসে বসে কাঁদছে। দু-হাঁটুর মধ্যে মাথাটা গোঁজা। চুল এলোমেলো। জন্মদিন বলে সকালেই চান সেরেছে। একটু পরেই মন্দিরে যেত পুজো দিতে।
পাশের বাড়ির মোহন উকিলের মা ক্রমান্বয়ে প্রশ্ন করে চলেছে—হ্যাঁগো, ও শুভার মা, কী হয়েছিল ছেলের। হ্যাঁগা ও শুভার মা…? শঙ্করের বউ রান্নাটান্না ফেলে চলে এসেছে। মায়ের আঁচল ধরে পেছন পেছন এসেছে কোলের ছেলেটা। দামাল ছেলে। শঙ্করের বউ বিপুলের বউয়ের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলছে—শক্ত হও, শক্ত হও দিদি। বাচ্চাটা চেয়ারে উঠেছে। আর কেঁদো না দিদি, আর কেঁদো না। বাচ্চাটা এবার চেয়ার থেকে টেবিলে ওঠার চেষ্টা করছে। কেউ দেখছে না। বেওয়ারিশ ব্যাপার। টেবিলে উঠে গ্যাঁট হয়ে বসেছে। জলের গেলাসের প্ল্যাস্টিকের চাপাটা কচি কচি হাত দিয়ে ধরেছে। গেলাসটা টাল খেয়ে পড়ে গড়াতে শুরু করেছে? গেল, গেল, পড়ল পড়ল। একেবারে কিনারায় এসে পড়ো পড়ো হয়ে আটকে গেছে। যে কোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। প্ল্যাস্টিকের ঢাকাটা কামড়াচ্ছে। পাশেই বিপুলের সদ্য কেনা সাধের ট্রানজিস্টার। সুইচটার দিকে হাত বাড়িয়েছে। খুব মোচড়ামুচড়ি করছে।
সাধনের বউ এসেছে। বেশ স্বাস্থ্যবতী। সে কেবল বলছে, অ্যাঁ এ কী হল! অ্যাঁ এ কী হল! ও বাবা, কী দিনকাল পড়ল গো। আমার কত্তার আলু খাওয়াটা কমাতে হবে দেখছি। আলুকাবলি খাব, আর আলুকাবলি খাব। এরচে আমাদের ফুচকা ঢের ভালো। অ্যাঁ এ কী হল!
সবাই চমকে উঠেছে। সারা ঘরে হিন্দি গান ফেটে পড়েছে—দাগাবাজ তেরা বাতিয়ানা মানু, না মানু না মানু। মা এমনি দৌড়ে এসেই ছেলের পিঠে গুমগুম করে এক কিল। টেবিলটা নড়ে উঠতেই গেলাসটা মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল। ছেলে টেবিলে দাঁড়িয়ে তারস্বরে কাঁদছে—অ্যা মা এ আবার কি রেডিও রে, বন্ধ করা যায় না। মুখপোড়া ছেলে, মরে যমের বাড়ি গেলেও পেছু ছাড়বে না।
বাইরে জানালার ওপাশে সোমেন এসে দাঁড়িয়েছে। বেরোচ্ছে। বাইরে থেকেই বারকতক উঁকিঝুঁকি মেরে বিপুলকে দেখার চেষ্টা করল। মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য। সোমেনের বউ ঘরে মেয়েদের মধ্যেই বসে আছে। বসে বসে বিকাশের বউকে ফিসফিস করে বলছে—কিছুতেই টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না রে! শেষে ওর এক বন্ধুকে ধরে কোনও রকমে ম্যানেজ হয়েছে। আমরা কালই যাচ্ছিরে! রাত আটটা দশ। সোমেন বউকে যেন একটু ধমকের সুরেই বলছে—তোমার হয়নি? মেয়েটা একলা আছে। আমি বেরোচ্ছি।
বিপুলের বউকে ডেকে বললে—বউদি অফিসে খবরটা দিয়ে দেব। আজ হাফ হলিডে হয়ে যাবে। দেখি আজ বাদে কালই তো মাইনে। পেমেন্ট নিয়ে বেশ ঝামেলা হবে। কিছু করা যায় কিনা দেখতে হবে! মাসের শেষে ডেথ হলে ফ্যামিলি ভীষণ সাফার করে। সোমেন ব্যাগ হাতে চলে গেল। মুখটা যতই গম্ভীর করুক আসলে দু:খ-দু:খ তেমন কিছুই হয়নি। একটা সাধারণ লোকের মৃত্যুতে কার কী এসে যায়।
গৌরীবাবু এসেছেন বাজার যাওয়ার পথে। হাতে ভাঁজ করা চটের ব্যাগ। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নিলামদারের গলায় বললেন—বিপুল দেহ রেখেছে। ভেরি স্যাড। মেয়েটার কী হবে? বিয়ে দিতে হবে তো! বউমা কি বিপুলের অফিসে চাকরি পাবে? না মনে হয়। এই বাজার! ছেলেটা ইচ্ছে করে মরল। এত করে বলতুম কবিরাজি করাও। সেই শ্যাম ডাক্তারটাকে ধরে বসে রইল। যাক যা হওয়ার কেউ তো রোধ করতে পারবে না। আমার রঙের দামটা কিন্তু এখনও বাকি আছে। ঠিক আছে, পরে দিলেও চলবে, তাড়া নেই, তবে হ্যাঁ মনে করে যেন দেওয়া হয়। তাগাদা জিনিসটা আমি পছন্দ করি না।
গৌরীবাবুর দোকান থেকে বিপুল চার লিটার রং কিনেছিল ধারে—ভেবেছিল পয়লা মাইনে পেয়ে শোধ করে দেবে। ও:, ব্যাবসাদার লোকগুলো কী সাংঘাতিক। চোখের চামড়া নেই নাকি!
গৌরীবাবু দরজার কাছ থেকে ফিরে এলেন। একটু ইতস্তত করে জিগ্যেস করলেন, তা আমাদের বউমার বয়েস কত হল?
এ প্রশ্নের কে জবাব দেবে! অদ্ভুত প্রশ্ন। সকলে চুপ করে আছে দেখে গৌরীবাবু প্রশ্নটার একটু ব্যাখ্যা করলেন, কলকাতা শহরটা তো ভালো নয়, যুবতী মহিলাদের চরিত্র ঠিক রাখা বড় শক্ত। ওটাকে ধর্ম দিয়ে বেশ শক্ত করে বাঁধতে হবে। তাই ভাবছিলুম একটা দীক্ষাটীক্ষা নিলে বোধ হয় ভালো হত। আমার সন্ধানে ভালো গুরু আছে। আচ্ছা কাজকম্ম মিটে যাক তারপর দেখা যাবে। শোকটা কেটে যাওয়ার আগেই কানে মন্তরটা দিয়ে দিতে হবে।
গৌরীবাবু এখন ঘরের বাইরে। জুতোয় পা গলাতে গলাতে বললেন, খাটটা তোমরা ফেলো না। কুসংস্কারে আটকালে আমাকে বোলো নগদ দাম দিয়ে আমি কিনে নেব। ঠিক আছে পরে খবর নেব।
বিপুলের বউ ফুলে ফুলে কাঁদছে। এখন আর তেমন শব্দ হচ্ছে না। চোখ দুটো লাল। বিপুল আমাকে নিয়ে এই মহিলার সঙ্গে ষোলো বছর সংসার করেছে। বিপুল জানত না, এই মহিলাও জানত না তারা কীভাবে একটু একটু করে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি বিপুলের মৃত্যুতে এই পাড়ার কোনও মানুষেরই কিছু এসে যায় না। ছিল, চলে গেছে, এই পর্যন্ত। বিপুল সবচেয়ে বড় নাড়া দিয়ে গেছে তার পরিবারকে। অবশ্য বিপুল না হয়ে একটা সুধেল গোরু মরলেও হয়তো গোলাকার এইরকমই শোকটোক হত। যতই হোক লোকটা রোজগেরে ছিল তো। দুম করে মরে গেল।
পরেশ এসেছে। ফুল-টুল এনেছে। ধূপ এসেছে। চারটে জোয়ান ছেলে জোগাড় করেছে। নতুন কাপড় কিনেছে। একটা কালোপাড় শাড়িও এনেছে। ছেলেরা বলছে, পরেশদা আমরা তাহলে খাটটার সঙ্গে বাঁশ বাঁধতে থাকি, তুমি ততক্ষণ ডেডবডিটা রেডি করে ফ্যালো। বড় ভালো সময় মরেছে। বেলাবেলি শেষ হয়ে যাবে।
—হ্যাঁ, যা তোরা খাটটা রেডি করে ফ্যাল। একটু ভালো করে বাঁধিস বাবা। যাওয়ার আগে চা খাবি নাকি? চা তেলেভাজা।
—শুধু চা একচিলতে টেনে নিলে মন্দ হত না।
পরেশ জামার পকেট থেকে টাকা বের করল। বিপুলের বউ উঠে এসে ধরা ধরা গলায় বললে, তুমি কেন খরচ করবে ঠাকুরপো। আমাদের হাতে সংসার খরচের টাকা এখনও কিছু আছে।
—সংসারটাও তো রয়েছে বউদি! আর আমার টাকা, দাদার টাকায় তফাত কী, সবই তো এক। নাও ও-সব টাকাপয়সার ব্যাপার তোমাকে এখন ভাবতে হবে না। তুমি কাজের কাজ করো।
—তুমি যদি খুব একটা বড় ব্যাপার করে ফ্যালো পরে শোধ করব কী করে?
—শোধের কথা আসছে কেন? তোমরা আমাকে পর করে দিলেও সত্যিই তো আমি পর হয়ে যায়নি। নাও নাও দাদাকে আমি রাজবেশে নিয়ে যাব, কোথায় আছে দাদার সেই বিয়ের সময়ের সিল্কের পাঞ্জাবি, গরদের জোড়!
খাটের বাজু ধরে বিপুলের বউ আবার কাঁদতে শুরু করেছে। ঘরভরতি লোক। মনে হচ্ছে কোনও এক বিয়োগান্ত নাটকের মহড়া চলছে। পরেশ পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ মানিয়েছে দুজনকে। পরেশের আরক্ত চোখে টলটল করছে জল।
সধবা এক বৃদ্ধা এসেছেন। সম্পর্কে বিপুলের মাসি। এ-পাড়ার অনেক মৃত্যুর সাক্ষী। ঘটনার ওপর এইবার একটা ঠিকঠাক ব্যক্তিত্ব আরোপিত হবে। মহিলা ঘরে ঢুকেই বললেন, কী রে বিপুল তুইও চলে গেলি! তুই না বলেছিলি এবার পুজোর সময় আমাকে কাশী নিয়ে যাবি! জানি জানি এই বুড়িকে কথা দিয়ে কেউই কথা রাখতে পারেনি!
আঁচলে চোখ মুছে বললেন—তোমরা সব চুপ করে দাঁড়িয়ে কেন? এখনও যে অনেক কাজ বাকি। যাত্রা করাতে হবে তো। বউমা শক্ত হও! এই তো জীবন! কেউ পরে থাকে কেউ চলে যায়।
বড় শান্ত, চারপাশ বড় শান্ত। নীল আকাশে ঝলমল করছে রোদ! গোল হয়ে উড়ছে একঝাঁক চিকচিকে পায়রা। বিদ্যাপীঠের সেই প্রশান্ত শিক্ষিকা সাইকেল রিকশা চেপে বাড়ি ফিরছেন। পিওন বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করছে। দরজার পাশেই সেই বেড়ালটা ভয়ে ভয়ে বসে আছে। খুব চাপা গলায় শবযাত্রীরা বিপুলের চিঠির বাকসে টুক করে একটা চিঠি ফলে দিয়ে গেল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল ফুলে ঢাকা একটা খাট ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। তিনবার হরিবোল বললে। একরাশ সাদা সাদা ফুল। বিপুলের মুখটা কেবল বেরিয়ে আছে। খাড়া নাক, চওড়া কপাল। ধূপের ধোঁয়া উঠছে অসংখ্য সুতোর মতো এলোমেলো।
আমিও ধীর পায়ে সেই সুরভিত খাটে গিয়ে উঠলুম। ওরা কার বউ, কার মেয়ে? আমারই তো? অনাথের মতো একপাশে দাঁড়িয়ে। আমি তাহলে আসি। আর হয়তো কোনওদিন দেখা হবে না। একসঙ্গে দু:খে-সুখে কিছুকাল কাটিয়ে গেলুম তোমাদের সঙ্গে। বিপুলের অনেক ত্রুটি ছিল, সব ভুলে যাওয়া। অনেক কাজ বাকি থেকে গেল, পারত শেষ কোরো। মেয়েটার একটু ভালো জায়গায় বিয়ে দিও। আমি চললুম, তোমারা রইলে।
দূরে দূরে, আমার বাড়িটা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে। পথের বাঁক ঘুরতেই আর দেখা গেল না। অসম্ভব আলো চারদিকে, হালকা বাতাস বইছে। একটি শিশুকে তার মা বলছে—নম করো বাবা নম করো, ঠাকুর।