প্রবন্ধ : ছন্দ ও আবৃত্তি

ছন্দ ও আবৃত্তি

বাংলা ছন্দ সম্পর্কে এ কথা স্বচ্ছন্দে বলা যেতে পারে যে, সে এখন অনেকটা সাবালক হয়েছে। পয়ার-ত্রিপদীর গতানুগতিকতা থেকে খুব অল্প দিনের মধ্যেই বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের প্রগতিশীলতায় সে মুক্তি পেয়েছে। বলা বাহুল্য, চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির আমল থেকে ঈশ্বর গুপ্ত পর্যন্ত এতকাল পয়ার-ত্রিপদীর একচেটিয়া রাজত্বের পর রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবই বাংলা ছন্দে বিপ্লব এনেছে। মধুসূদনের ‘অমিত্রাক্ষর’ মিলের বশ্যতা অস্বীকার করলেও পয়ারের অভিভাবকত্ব ঐ একটি মাত্র শর্তে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বিহারীলাল প্রভৃতির হাতে যে-সম্ভাবনা লোহা ছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে তা ইস্পাতের অস্ত্র হল। রবীন্দ্রনাথের হাতে ছন্দের ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষতার পরিচয় দেওয়া এখানে সম্ভব নয়, তবু একটি মাত্র ছন্দ রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কাব্য জীবনে অদ্ভুত ও চমকপ্রদ ভাবে বিকাশ লাভ করে এবং ঐ ছন্দেরই উন্নত পর্যায় শেষের দিকের কবিতায় খুব বেশী রকম পাওয়া যায়। সম্ভবত এই ছন্দই রবীন্দ্রনাথকে গদ্য-ছন্দে লেখবার প্রেরণা দেয় এবং তার ফলেই বাংলা ছন্দ বাঁধা নিয়মের পর্দা ঘুচিয়ে আজকাল স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারছে। বোধহয়, একমাত্র এই কারণেই বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে বলাকা-ছন্দ ঐতিহাসিক।

সত্যেন দত্তের কাছেও বাংলা ছন্দ চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে। নজরুল ইস্‌লামও স্মরণীয়। নজরুলের ছন্দে ভাদ্রের আকস্মিক প্লাবনের মতো যে বলিষ্ঠতা দেখা গিয়েছিল তা অপসারিত হলেও তার পলিমাটি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে সোনার ফসল ফলানোয় সাহায্য করবে। এঁরা দু’জন বাদে এমন কোনো কবিই বাংলা ছন্দে কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন না, যাঁরা নিজেদের আধুনিক কবি বলে অস্বীকার করেন। অথচ কেবলমাত্র ছন্দের দিক থেকেই যে আধুনিক কবিতা অসাধারণ উন্নতি লাভ করেছে এ কথা অমান্য করার স্পর্ধা বা প্রবৃত্তি অন্তত কারো নেই বলেই আমার মনে হয়।

আধুনিক কবিদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য প্রেমেন্দ্র মিত্র। প্রমাণের আবশ্যক বোধহয় নেই। তারপরেই উল্লেখযোগ্য বিষ্ণু দে, বিশেষ করে আজকাল। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছন্দের ঘোড়ায় একজন পাকা ঘোড়-সওয়ার, যদিও সম্প্রতি নিষ্ক্রিয়। অমিয় চক্রবর্তী খুব সম্ভব একটা নতুন ছন্দের সূত্রপাত করবেন, কিন্তু তিনি এখনো পর্যন্ত গবেষণাগারে। গদ্য-ছন্দে সমর সেন-ই দেখা যাচ্ছে আজ পর্যন্ত অদ্বিতীয়। ইতিমধ্যে অন্নদাশঙ্কর রায়ের একখানা চটি বইয়ে ছড়ার ছন্দের উন্নত-ক্রম কত উপভোগ্য হতে পারে তার একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল। বিমলচন্দ্র ঘোষের ঐ ধরনের একখানা বই ঐ কারণেই অতি সুপাঠ্য হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অধুনা আত্ম-সম্বরণ করেছেন, কিন্তু অজিত দত্তের খবর কী? বুদ্ধদেব বসুর ছন্দের ধার দিন দিন কমে যাচ্ছে। তিনি গদ্য-ছন্দে লেখেন না কেন ?

অতঃপর অভিযোগ-প্রসঙ্গ—ভাল ছন্দ ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য মনে হচ্ছে। এর প্রতিকারের কোনো উপায় কি নেই? আহার্যের সঙ্গে সঙ্গে ভাল ছন্দ দুর্লভ হওয়ায় দুটোর মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনে দুরভিসন্ধি মনের মধ্যে অদম্য হয়ে উঠছে, সুতরাং ভীতি-বিহ্বল-চিত্তে কবিদের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপ লক্ষ্য করব। কোনো কোনো কবির ছন্দের আশঙ্কাজনক প্রভাব অধিকাংশ নবজাত কবিকে অজ্ঞাতসারে অথবা জ্ঞাতসারে আচ্ছন্ন করছে, অতএব দুঃসাহস প্রকাশ করেই তাঁদের সচেতন হতে বলছি। খ্যাতনামা এবং অখ্যাতনামা প্রত্যেক কবির কাছেই দাবি করছি, তাঁদের সমস্তটুকু সম্ভাবনাকে পরিশ্রম করে ফুটিয়ে তুলে বাংলা ছন্দকে সমৃদ্ধ করার জন্যে। এ কথা যেন ভাবতে না হয় রবীন্দ্রনাথের পরে কারো কাছে আর কিছু আশা করবার নেই।

এইবার আবৃত্তির কথায় আসা যাক। ছন্দের সঙ্গে আবৃত্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, অথচ ছন্দের দিক থেকে অগ্রসর হয়েও বাংলা দেশ আবৃত্তির ব্যাপারে অত্যন্ত অমনোযোগী। আমি খুব কম লোককেই ভাল আবৃত্তি করতে দেখেছি। ভাল আবৃত্তি না করার অর্থ ছন্দের প্রকৃতি না বোঝা এবং তারও অর্থ হচ্ছে ছন্দের প্রতি উদাসীনতা। ছন্দের প্রতি পাঠকের ঔদাসীন্য থাকলে ছন্দের চর্চা এবং উন্নতি যে কমে আসবে, এতো জানা কথা।

সুতরাং বাংলা ছন্দের উন্নতির জন্য সুষ্ঠু আবৃত্তির প্রচলন হওয়া দরকার এবং এ বিষয়ে কবিদের সর্বপ্রথম অগ্রণী হতে হবে। অনেক প্রসিদ্ধ কবিকে আবৃত্তি করতে দেখেছি, যা মোটেই মর্মস্পর্শী হয় না। বিশুদ্ধ উচ্চারণ, নিখুঁত ধ্বনি-বিন্যাস, কণ্ঠস্বরের সুনিপুণ ব্যঞ্জনা এবং সর্বোপরি ছন্দ সম্বন্ধে সতর্কতা, এইগুলি না হলে আবৃত্তি যে ব্যর্থ হয় তা তাঁদের ধারণায় আসে না।

আগে আমাদের বাংলা দেশে কবির লড়াই, পাঁচালি, কথকতা ইত্যাদির মধ্যে ছন্দ-শিক্ষার কিছুটা ব্যবস্থা ছিল, যদিও তার মধ্যে ভুল-ত্রুটি ছিল প্রচুর, কিন্তু তার ব্যাপকতা সত্যিই শ্রদ্ধেয় এবং উপায়টাও ছিল সহজ। এখন যদি সেই ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন না-ও হয়, তবুও কবিরা সভা-সমিতিতে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে সাধারণকে ছন্দ সম্বন্ধে জ্ঞান-বিতরণ করতে অনায়াসেই পারেন। এ ব্যবস্থা যে একেবারেই নেই তা নয়, তবে খুবই কম। রেডিও-কর্তৃপক্ষ যদি প্রায়ই কবিদের আমন্ত্রণ ক’রে (নিজেদের মাইনে করা লোক দিয়ে নয়, যাদের থিয়েটারী ঢঙে আবৃত্তি করাই চাকরি বজায় রাখার উপায়) আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে ছন্দ-শিক্ষার ব্যবস্থা করেন তা হলেও জনসাধারণ উপকৃত হয়। সিনেমায় যদি নায়ক-নায়িকা বিশেষ মুহুর্তে দু’চার লাইন রবীন্দ্রনাথের কি নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে তা হলে কি রসভঙ্গ হবে?

যদি সত্যিই ছন্দ সম্বন্ধে কাউকে সচেতন করতে হয় তা হলে তা কিশোরদের। তারা ছড়ার মধ্যে দিয়ে তা শিখতে পারে। আর তারা যদি তা শেখে তা হলে ভবিষ্যতে কাউকে আর আবৃত্তি-শিক্ষার জন্যে পত্রিকায় লেখা লিখতে হবে না। কাজেই ভাল আবৃত্তি ও ছন্দের জন্যে একেবারে গোড়ায় জল ঢালতে হবে এবং সেইজন্যে মায়েদের দৃষ্টি এই দিকে দেওয়া দরকার। তাঁরা ঘুম-পাড়ানি গানের সময় কেবল সেকেলে ‘ঘুম-পাড়ানি মাসি পিসি’ না ক’রে রবীন্দ্রনাথ কি সুকুমার রায়ের ছড়া আবৃত্তি ক’রে জ্ঞান হবার আগে থেকেই ছন্দে কান পাকিয়ে রাখতে পারেন। এ হবে এস্‌রাজ বাজানোর আগে ঠিক সুরে তার বেঁধে নেওয়ার মতো। প্রত্যেক বিদ্যায়তনের শিক্ষকের দায়িত্ব আরো বেশী, কেবলমাত্র তাঁরাই পারেন এ ব্যাপারে সঠিক শিক্ষা দিতে। প্রতিদিন কবিতা মুখস্থ নেওয়ার মধ্য দিয়ে, পুরস্কার বিতরণ কি সরস্বতী পূজো উপলক্ষ্যে ছাত্রদের আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে কি করে ছন্দ পড়তে হয়, আবৃত্তি করতে হয় তা তাঁরা শিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু অন্যান্য শিক্ষার মতো এ শিক্ষায়ও তাঁরা ফাঁকি দেন।

পরিশেষে আমার মন্তব্য হচ্ছে, গদ্য-ছন্দের যে একটা বিশিষ্ট সুর আছে, সেটাও যে পদ্যের মতোই পড়া যায়, তা অনেকেই জানেন না। কেউ কেউ গল্প পড়ার মতোই তা পড়েন। সুতরাং উভয়বিধ ছন্দ সম্বন্ধে যত্ন নিতে হবে লেখক ও পাঠক উভয়কেই। কবিরা নতুন নতুন আবৃত্তি-উপযোগী ছন্দে লিখলে (যা আধুনিক কবিরা লেখেন না) এবং পাঠকরা তা ঠিকমতো পড়লে তবেই আধুনিক কবিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে, উপেক্ষিত আধুনিক কবিতা খেচর অবস্থা থেকে ক্রমশ জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *