প্রফেট
প্রফেট হবার আগেই জগদীশ পালিয়ে গেছিল৷
একদিন রাতে আমাকে বা আর কাউকে না জানিয়েই গ্রাম ছেড়েছিল অন্ধকারে গা বাঁচিয়ে৷ ওর মা-বাপ ততদিনে আর কেউই বেঁচে নেই৷ ফলে সে কোথায় পালিয়েছে কী বৃত্তান্ত সেই নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায়নি৷ কিন্তু আমি জানতাম, আর কিছুটা কষ্ট সহ্য করতে পারলেই ও প্রফেট হতে পারত৷
তারপর এই বাইশ বছর তার আর কোনও খোঁজ পাইনি আমি৷ সত্যি বলতে জগদীশের কথা সারাজীবনে আর কোনওদিন মনেও পড়ত না আমার, যদি না মেয়ের জন্য অতগুলো ভারী খেলনা কিনতাম৷
আমরা যারা ছোট থেকে গুছিয়ে আজগুবি গল্প বলতে পারা মা পেয়েছি, তাদের রূপকথার ঘোর ভাঙতে দেরি হয় ঢের৷ ততদিনে আমাদের মা গত হয়েছেন৷ অন্য কোথাও রূপকথার খোঁজ করতে করতে অবশেষে হতক্লান্ত আমরা মাতৃবিয়োগের যন্ত্রণার কাছে হাঁটু মুড়ে বসি৷ তার কাছে ভিক্ষা চাই আর একটি রূপকথার৷ গলা ফেড়ে তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘তাহলে কি আমাদের ভিতরেই বেঁচে আছে মা?’
কিন্তু আমরা কবেই বা মায়ের মতো করে গল্প বলতে পেরেছি নিজেদের? নিজেদের বুকে মুখ গুঁজে নিজেরা কবেই বা নিরাপত্তার আশ্রয় পেয়েছি? পেয়েছি শুধু ভয়…
লোকে বলে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই নাকি আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছিল৷ বোকাগুলো জানে না, এ দুনিয়ার সব লোকেরই মা মারা যাওয়ার পর থেকে মাথা খারাপ হয়ে যায়৷ মাতৃহীন গোটা জীবনটাই কেবল একটা অস্থিরতা আর অস্বস্তি!
বরং আমি মা-কে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম নিজের মধ্যে৷ মা বলেছিল আমাদের গ্রামের এককোণ দিয়ে বয়ে যাওয়া অম্বি নদীর নিচে নাকি এক তিমি মাছের হাঁয়ের মতো পুরনো কুয়ো আছে, একদিন সেখান থেকে এক রাজকন্যা বেরিয়ে আসবে৷ আরেকটু বড় হয়ে ভেবেছি একদিন না একদিন বিদেশের বিজ্ঞানীরা অমৃত বলে কিছু একটা আবিষ্কার করবে৷ আমার বাবা-মা বেঁচে থাকবে আজীবন৷ আরেকটু বড় হতে ভেবেছি দেশে শ্রমিক বিপ্লব আসবে, সেই বিপ্লবের মিছিল থেকে হাতছানি দেবে লাল আবির মাখা স্বপ্নকুমারী, তার কপালে লাল আবির আর সিঁদুর মাখামাখি হবে আঙুলের স্পর্শে, নাহ, এসব কিছুই হয়নি৷ এসব কিছু হবার আগেই জগদীশ প্রফেট না হয়ে পালিয়ে গেছিল৷
শিলিগুড়ি থেকে ফিরছিলাম৷ শিয়ালদা স্টেশনে নামতেই কুলিগুলো ঘিরে ধরল, ‘লাগেজ সো রুপিয়া বাবু, ডিকি তক উঠিয়ে দেব…’
ফালতু পয়সা খরচ আমার ধম্মে নেই৷ কিন্তু আমার মেয়ে অনিন্দিতার জন্য গুচ্ছের খেলনা কিনেছি৷ কাল সকালেই ফোন করে হুমকি দিয়েছিল সে, ‘আমার জন্য ডোরেমন পুতুল আনবে কিন্তু বাপি, আর তাড়াতাড়ি আসবে, আই মিস ইউ…’
সেইসব খেলনাতেই ভারী হয়ে আছে সুটকেসটা৷ কিছুটা এগনোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম৷ প্ল্যাটফর্মের ধার ঘেঁষে একটা কুলি আয়েস করে বসে সিগারেট টানছিল৷ তাকেই হাঁক পাড়লাম, ‘এই কুলি, ট্যাক্সি অবধি কত নেবে?’
লোকটা আমার দিকে একবার উদাসীন দৃষ্টি বুলিয়ে বলল, ‘দুটো লাগেস, দুশো টাকা!’
‘চলো…’
লোকটার গলা শুনে বোঝা যায় তার পেটে শিক্ষাদীক্ষা আছে৷ চেহারাপাতিও একেবারে কুলিসুলভ নয়৷ তামাটে চামড়া৷ সমস্ত গা ঘামে ভেজা৷ পরনে একটা লালচে স্যান্ডো গেঞ্জি৷ মাথায় পাগড়ি জাতীয় একটা কাপড় গোল করে জড়ানো৷
লোকটা সুটকেসদুটো মাথার উপর তুলে নিল৷ তারপর সামনের দিকে হাঁটা শুরু করতে করতে বলল, ‘আপনি ধীরে ধীরে আসুন৷ হারিয়ে ফেলবেন না৷’
লোকটার কথা শুনে বোঝা যায় তার মাতৃভাষা বাংলা নয়৷ তবে বহু বছর এদেশে থেকে থেকে ভাষাটা রপ্ত হয়ে গেছে৷
আমি তার পিছন পিছন যাচ্ছিলাম৷ খানিকদূর এগিয়ে যেতেই খেয়াল করলাম ব্যাপারটা৷ লোকটার স্যান্ডো গেঞ্জির ফাঁক গলে কাঁধের কাছে একটা উল্কি দেখা যাচ্ছে৷
ঠিক এমন একটা উলকি বাইশ বছর আগে দেখেছি আমি৷ আমার প্রিয় বন্ধুর কাঁধে৷ অবশ্য দুটো মানুষ একই উলকি করে থাকতে পারে, কিন্তু এ লোকটার মুখটাও যেন চেনা চেনা লাগছে আমার৷ যেতে যেতেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা নাম কী তোমার?’
‘জগদীশ যাদব স্যার…’
‘বকুলপুর গ্রামে বাড়ি ছিল তোমার?’
কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা৷ কথাটা শোনা মাত্র একটা অদ্ভুত কাজ করে ফেলল জগদীশ৷ লাগেজদুটো একরকম ছুঁড়েই মাটিতে নামিয়ে রাখল সে৷ তারপর আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল সামনের দিকে৷
শিয়ালদা স্টেশনে তখন গিজগিজ করছে সদ্য ট্রেন থেকে নাম মানুষের ভিড়৷ প্রথমটা হকচকিয়ে গেছিলাম৷ হঠাৎ করে হল কী লোকটার?
পিছন পিছন দৌড়াব!
সে ক্ষমতা আমার ছিল না৷ তবে হঠাৎ করে সুটকেস ফেলে দৌড়াতে দেখে আশপাশের লোকজন ওকে পকেটমার বা ছিনতাইবাজ গোছের কিছু একটা ঠাওরে নিল৷ ভিড়ের মধ্যে থেকেই জনাদশেক লোক প্রায় ধাক্কা মেরে প্ল্যাটফর্মের উপর ফেলে দিল জগদীশকে৷ মুহূর্ত কাটার আগেই সম্মিলিত জনতার কিল চড় লাথি এসে পড়ল ওর শরীরে৷ যন্ত্রণায় কাতরে উঠল লোকটা৷
‘শালা পকেটমারি করিস, আজ দেখাচ্ছি মজা!’
‘হার ছিনতাই করে ভেগেছে, মার শালাকে…’
‘এই বিহারী মালগুলোর জন্যেই… হয় গাঁটিয়া ভাজে, নাহয় গাঁট কাটে!’
আমি কোনওরকমে ছুটে গিয়ে যখন তাদের নিরস্ত করলাম৷ ততক্ষণে ওর শরীরের উপর অফিসযাত্রীদের ফ্রাস্ট্রেশনের ঝড় বয়ে গেছে৷
‘আরে পকেটমার হবে কেন, ও আমার বন্ধু…’
‘বন্ধু!’ ভিড়ের মধ্যে হোমরাচোমরা গোছের একজন ভুরু তুলে তাকাল আমার দিকে, ‘বন্ধু তো পালাচ্ছিল কেন?’
আমি ঢোঁক গিলে বললাম, ‘ক-টা টাকা ধার নিয়েছিল তো, তাই আমাকে দেখেই…’
‘এইসব বিহারী ফিহারিদের ধার-বাকি দেন কেন? এ শালারা এরকমই৷’
গোলগোল চোখ করে সামনে এগিয়ে গেল লোকটা৷ মারধরের চোটে ততক্ষণে জগদীশের নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই৷ আমি একরকম ঘেঁটি ধরে তাকে তুলে শিয়ালদা স্টেশনেরই একটা বেঞ্চে নিয়ে এসে বসালাম৷ তার ঠোঁটের কোল বেয়ে সরু রক্তের ধারা নেমেছে৷ নিজের পেট চেপে ধরে হাঁসফাঁস করছে লোকটা৷
‘আর কতদিন পালিয়ে বেড়াবি জগু? সব ছেড়ে শেষে স্টেশনের কুলি!’
আমার কথাটা কানে গেল না লোকটার, তেমন হাঁপাতে হাপাতেই বলল, ‘আমাকে দুশোটা টাকা দেবেন বাবু?’
‘কী হবে তাতে?’
‘মদ খাব…
পকেট থেকে শ’পাচেক টাকা বের করে ওর পকেটে গুঁজে দিলাম৷ মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘থাকিস কোথায় এখন?’
‘স্টেশনের কাছেই একটা বস্তিতে…’
‘সংসার?’
দু-দিকে মাথা নাড়ায় জগদীশ, ‘করিনি৷’
‘আমাকে দেখে পালালি কেন?’
জামার হাতায় ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত মোছে জগদীশ, ‘এ দুনিয়ায় কারও সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখি না৷ যোগাযোগ রাখলেই শালা ক্যাচাল হয়… বিশেষ করে গ্রামের লোক চিনে ফেললেই ভয় লাগে…’
হাত বাড়িয়ে ওর ডানহাতটা নিজের হাতে তুলে নিই আমি৷ মোট বইতে বইতে কড়া পড়ে গেছে৷ নখের মাথাগুলোও প্রায় মিশে গেছে চামড়ার সঙ্গে৷ অথচ এই হাতেই…
‘তোর সেই ক্ষমতাটা…’
আমি কথা শেষ করার আগেই টেনে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় জগদীশ, ‘ওসব আর পারি না৷ মদের টাকা দিয়েছেন, সুটকেস বয়ে দেব৷ চলুন…’
আমার বুকের ভেতর একটা পুরনো নদী বইতে বইতে যেন হঠাৎ করে স্থির হয়ে গেল৷ আমার ছেলেবেলার গ্রামের বন্ধু জগদীশ৷ আর কেউ না জানুক, আমি জানতাম, একদিন জগৎজোড়া প্রফেট হওয়ার সব মালমশলা যার মধ্যে মজুত ছিল সে আজ স্টেশনে মধ্যবিত্ত বাঙালির মোট বয়, আর রাত হলে দুশোটাকার বাংলা মদ খায়?
জগদীশ উঠতে যাচ্ছিল৷ ওর কাঁধে একটা হাত রাখলাম আমি, ‘চল আমার সঙ্গে…’
‘কোথায়?’
‘আমার বাড়ি, এতদিন পর দেখা হল, তোকে শিয়ালদা স্টেশনেই আমি ছেড়ে দেব ভেবেছিস? তাছাড়া সংসার করিসনি যখন দু-তিনটে দিন আমার বাড়িতে কাটিয়ে আসতে অসুবিধা কী তোর?’
অবশ্য জগদীশ যে সংসার করবে না সে আমি আগেই জানতাম৷ প্রফেটরা সংসার করে না৷ আমার মায়ের গল্প মিথ্যে হতে পারে না৷ ওই বিশেষ ক্ষমতাটা এখনও বয়ে চলেছে জগদীশের হাতের শিরায়৷ যে ক্ষমতার প্রথম পরিচয় পেয়েছিলাম আজ থেকে বাইশ বছর আগে, আমাদের স্কুলের মাঠে…
(২)
জগদীশের বাপ বিহারী হলেও ওর জন্ম বকুলপুরেই৷ ফলে ভোজপুরির থেকে বাংলার দিকেই একটু বেশি ঝুঁকেছিল ওর জিভটা৷ তিনবছর বয়সে ওর মা বসন্তে ভুগে মারা যায়৷ সেই থেকে বাপের কাছেই মানুষ৷ তারও শরীরটা ভালো যেত না৷ জগদীশ আর আমি স্কুলে হরিহর আত্মা ছিলাম৷ অন্য ছেলেপুলের দল বিশেষ একটা আমাদের সঙ্গে মিশত না৷
তখন ক্লাস ইলেভেনের প্রায় শেষের দিক৷ সিদ্ধেশ্বরীর মাঠে স্কুলের টিফিনবেলায় বউ বসন্ত খেলতাম আমরা৷ আমি আর জগদীশ ছাড়া সেখানে আমাদের ক্লাসেরই আরও কিছু ছেলেপেলে ভিড় করত৷ জগু চিরকালই বউ হত৷
ছোট থেকেই রোগে ভোগার ফলে খুব বেশি দৌড়াদৌড়ি করার মতো শারীরিক জোর তার ছিল না৷ তাছাড়া হাজার হোক জাতে বিহারী ছিল বলে ছেলেপিলের দল ওকে একটু আলাদা করেই রাখতে চাইত৷
যে দিনের কথা বলছি সেদিনও জগদীশ বউ হয়েই মাঠের এক কোণে ইট পেতে বসেছিল৷ আর সেদিনই আমি প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম জগদীশ বড় হয়ে একদিন প্রফেট হবে৷
স্কুলে আমি আর অরূপ বরাবর হয় ফার্স্ট নইলে সেকেন্ড হতাম৷ বছর বছর একটা চাপা রেষারেষি চলত আমাদের মধ্যে৷ দু-জনেই দু-জনকে ভেতরে ভেতরে সহ্য করতে পারতাম না৷
যেদিনের কথা হচ্ছে তার দিনকয়েক আগেই রেজাল্ট বেরিয়েছে৷ আমি হয়েছি ফার্স্ট আর অরূপ সেকেন্ডের বদলে বেশ খানিকটা নিচে নেমে গেছে৷ ফলে সেদিন রাগটা একটু বেশি চাগাড় দিয়েছিল তার৷ আমার দম কাটেনি, তা সত্ত্বেও দু-হাতে আমায় চেপে ধরে একরকম ঠেলেই মাটির উপর ফেলে দিল অরূপ৷ মাথাটা ঢুকে গেল মাটিতে পড়ে থাকা একটা পাথরে৷ আমার সারা শরীর গুলিয়ে উঠল৷ মাথাটা ঝনঝন করল৷ চোখে অন্ধকার দেখলাম৷ মুহূর্তে পৃথিবীটা নিভে এল চোখের সামনে৷
চোখ যখন খুললাম তখন আশপাশটা ফাঁকা হয়ে গেছে৷ বোধহয় আমি মরে-টরে গেছি ভেবেই ভয়ে বন্ধুবান্ধবরা সব ছুটে পালিয়ে গেছে৷
মাথায় অসহ্য ব্যথা, তা সত্ত্বেও কোমরে ভর দিয়ে উঠে বসতে বসতে দেখলাম একমাত্র জগদীশ আমার ঠিক পাশটায় চুপ করে বসে আছে৷ টিফিনবেলা, দুপুরের রোদ নামছে ধুলো মেখে৷ মাঠের শেষ প্রান্তে উঁচু গাছপালা দুপুরের হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে৷ সেদিকে তাকিয়ে মন দিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে সে৷
আমি একবার মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে দেখলাম রক্ত বেরোচ্ছে কি না৷ নাঃ বেরোচ্ছে না৷ কিন্তু এত অসহ্য যন্ত্রণা যে মনে হচ্ছে পরমুহূর্তে মাথা ছিঁড়ে যাবে৷ উঠে বসতে গিয়েও যন্ত্রণায় কঁকিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম মাঠের উপরে৷
আমার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে জগু বলল, ‘টিফিনবেলা শেষ হয়ে আসছে রে সোমু, চ, স্কুলে ফিরতে হবে…’
আমি ধুঁকতে ধুঁকতেই ঘাড় নাড়লাম, ‘আমি মনে হয় আর উঠতে পারব না রে জগু৷ আমার মাথাটা…’
‘ব্যথা করছে?’
‘ভীষণ! মনে হয় ভেতরে ভেতরে রক্ত বেরিয়ে…’
জগদীশকে একটু বিরক্ত দেখায়৷ আমাকে এই আহত অবস্থায় ফেলে সে পালাতে পারেনি, আবার এতক্ষণ বসে থাকার পরেও যে আমি উঠে আবার স্কুলে যেতে পারব না সেটাও হিসেবের মধ্যে রাখেনি৷
‘তাহলে কী করব? স্কুলে গিয়ে বলি?’
‘না না৷ গার্জেন কল হবে…’ আমি দু-হাতে মাথা চেপে ধরেই বলি, ‘বাড়িতে গেলে ব্যথার উপরেই আবার পিটিয়ে সোজা করে দেবে…’
‘তাহলে উপায় কী?’
আমি হাত নাড়াই, ‘তুই চলে যা, আমি এখানে একটু শুয়ে থাকি…’
খানিকটা বিরক্ত হয়েই জগদীশ চলে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে যায়, তারপর হুট করে আমার হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘তুই আমায় কথা দে সোমু৷ আজকের ঘটনাটা তুই কাউকে বলবি না…’
‘আমি না বললেই বা কী? ওরা চারজন তো জানে৷ ওরা বলে বেড়াবে৷’
দু-দিকে মাথা নাড়ায় জগু, ‘ওটার কথা বলছি না, এখন যেটা করব সেটা…’
কথাটা বলে হঠাৎই জগদীশের হাতটা উঠে আসে আমার মাথায়৷ খুব আলতো করে আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে সে৷ জ্বর হলে যেমন মা হাত বুলিয়ে দেয়, কিংবা ভালো রেজাল্ট করে বাড়ি ফিরলে যেভাবে পিঠে হাত রাখে বাবা৷ ঠিক তেমন করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে জগদীশ৷
প্রথম প্রথম ভারি অস্বস্তি লাগে আমার৷ বয়েজ স্কুলের মাঠে শুয়ে থাকা একটা ছেলের কপালে আর একটা ছেলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে—এ জিনিস অন্য কেউ দেখতে পেলে অপদস্থ হওয়ার আর সীমা থাকবে না৷ হাত দিয়ে ঠেলে জগুর হাতটা সরিয়ে দিতে যাব, ঠিক সেই সময়ে, থেমে গেলাম৷
সেই অস্বস্তির মধ্যেই খেয়াল হল—আমার মাথার ব্যথাটা কমে আসছে ধীরে ধীরে৷ সঙ্গে গা বমিবমি ভাবটাও৷ ব্যথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই৷ কিন্তু হলফ করে বলতে পারি মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগেও যন্ত্রণায় আমার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল৷ মনে হচ্ছিল এক্ষুনি বমি হয়ে যাবে৷ জগদীশ হাতের স্পর্শে সেই যন্ত্রণা যেন কপালে লেগে থাকা ছাইয়ের টিপের মতো মুছে ফেলছে৷
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে৷ মায়ের কথা মনে পড়ে গেছিল সেদিন৷ স্কুলে ক্লাস থ্রির পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে একটা বই পেয়েছিলাম—প্রভু যিশুর জীবন৷ গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাকে কোলের কাছে শুইয়ে সেই বইটা পড়ে শোনাত মা৷ তাতে লেখা ছিল প্রভু যিশুরও নাকি এমন একটা ক্ষমতা ছিল, কেবলমাত্র মাথায় হাতের স্পর্শ করে মানুষের রোগ-জরা-যন্ত্রণা সারিয়ে দিতে পারতেন তিনি৷ তবে কি আমার ক্লাসের বন্ধু রোগাপটকা বিহারী জগদীশের সেই একই ক্ষমতা আছে? সেও কি তবে…
কয়েকে সেকেন্ড পরেই মাঠের উপর উঠে বসলাম৷ ততক্ষণে যন্ত্রণার বদলে আমার শরীরে জেগে উঠেছে অপার বিস্ময়ের অনুভূতি৷ জগদীশের মাথার পেছনে যেন রোদ পড়ছে না৷ একটা বলয় ঢেকে রয়েছে ওকে৷ ওর কপালে জমা হয়েছে বিন্দুবিন্দু ঘাম, ঠিক যিশু খ্রিস্টের মুকুটের মতো৷ গায়ের থেকে এক সাইজ বড় ঢিলে পোশাক, মাথার উসকোখুসখো চুল, লম্বাটে দড়ির মতো রোগা চেহারা…
সেদিন এতটাই হকচকিয়ে গেছিলাম যে তাকে আর আলাদা করে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি৷ ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করব৷ কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখলাম পাড়ার লোক জড়ো হয়েছে আমাদের দরজায়৷ অনেকদিন থেকেই বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না৷ রাত হলেই ধুম জ্বর৷ সেই জ্বর সেদিন দুপুরেই চিরকালের মতো সেরে গেছে৷
মাকে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি জগদীশ সত্যি যিশু খ্রিস্টের মতো প্রফেট কি না৷ আমি নিজে আরও প্রমাণ পেয়েছিলাম বেশ কিছুদিন পরে৷ হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলে আরও অনেকের কাছে প্রমাণও করতে পারতাম৷ কিন্তু তার আগেই পালিয়ে গেল জগদীশ…
(৩)
‘লোকটা কে গো বাবা?’ অনিন্দিতার মনের ভেতর যে প্রশ্নটা গত দিন দুয়েক ধরে দলা পাকাচ্ছে তা আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম৷ ছোট থেকেই দেখেছি জগদীশের ভিতরে এমন কিছু আছে যাতে বাচ্চারা সহজেই ওর বন্ধু হয়ে যায়৷ বিশেষ করে অনিন্দিতার মতো মিশুকে বাচ্চার তো ওকে পেলে কথাই নেই৷
‘আমার ছোটবেলার বন্ধু৷ তোর সঙ্গেও তো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে…’ আমি ওর কপালে হাত রেখে বলেছি৷ ও নতুন খেলনাগুলো বিছানার উপরে সাজাতে সাজাতে উপরে নিচে মাথা নেড়েছে, ‘কাকুটা খুব ভালো বাবা৷ আমাকে কত গল্প শুনিয়েছে…’
‘তাই নাকি? কীসের গল্প বলেছে তোকে?’
প্রশ্ন শুনে অনিন্দিতার চোখ গোলগোল হয়ে যায়, ‘জানো বাবা, কাকু অনেক ভূতের গল্প জানে!’
‘সে কী! কীরকম ভূত?’
অনিন্দিতা মনে মনে হিসেব করে গুছিয়ে নিয়ে আঙুলের কড় গুনে বলে, ‘বেম্মদত্যি, মেছো, বাঁশভূত, কানাভুলো… আর…’ একটানা কথাগুলো বলতে গিয়ে কাশির দমক উঠে আসে অনিন্দিতার গলা বেয়ে৷ কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে আসে মুখ দিয়ে৷
কাবেরি ছুটে এসে ওর মাথাটা বুকে টেনে নেয়, ‘তোমাকে বারণ করেছি না একসঙ্গে অতগুলো কথা বলতে?’
রক্তের ছোপ লাগে আমার বছর এগারোর বাচ্চা মেয়েটার গালে৷ রুমালটা লাল হয়ে যায়৷ নিজের বুকে হাত রেখে কোনওরকমে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে সে৷ আমি ওকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিই৷
‘কোথায় ব্যথা হচ্ছে মা?’ ওর প্রায় বন্ধ হয়ে আসা চোখের দিকে চেয়ে আমি প্রশ্ন করি৷
‘আমার বুকে খুব ব্যথা করে বাবা৷’ ওর গলা থেকে ক্ষীণ শব্দ বেরোয়৷
কাবেরি ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকে, শাড়ির খুঁটে চোখের জল মোছে৷ আমি বিছানায় ওর পাশে বসতে বসতে বলি, ‘তোকে বলেছিলাম না, বড় কিছু করতে গেলে কষ্ট সহ্য করতে হয়?’
‘স্নো হোয়াইটের মতো?’ যন্ত্রণাক্লিষ্ট গলাতেই প্রশ্ন করে অনিন্দিতা৷
‘একদম, স্নো হোয়াইটের মতো…’
‘কিন্তু আমি স্নো হোয়াইট হব না বাবা…’
‘সেকি! কেন হবি না?’
‘ও ওর বাবাকে মাকে ভালোবাসত না৷ আমি তো তোমাদেরকে খুব ভালোবাসি বাবা…’
কাবেরি চোখ থেকে জল মোছে৷ ছোট থেকেই মেয়েটা আমার ন্যাওটা৷ বাবা ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছুই চেনে না সে৷ কাজের সূত্রে দূরে কোথাও গেলে খানিকটা ওর জন্যেই বেশিদিন থাকতে পারি না আমি৷ আমাকে বেশিক্ষণ না দেখলেই কান্নাকাটি শুরু করে৷ কান্নাকাটি থেকে শুরু হয় কাশি, সেখান থেকে রক্তবমি৷
‘তুমি এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো তো, সেই কখন উঠেছ ঘুম থেকে…’ ওর মা কপালে হাত বুলাতে বুলাতেই বলে৷ অনিন্দিতার চোখে ধীরে ধীরে বুজে আসে৷
আমাদের একতলার ঘরটা ফাঁকাই থাকে৷ গেস্টরুম হিসেবে ব্যবহার করি আমরা৷ আপাতত দিনতিনেক সেখানেই রয়েছে জগদীশ৷ অনিন্দিতা রাতে একরকম জেদ করেই আমাদের কাছে শোয় না৷ তিনতলায় ওর সাজানো গোছানো একটা ঘর রয়েছে৷ সেখানেই থাকে সারাদিন৷ আমরা রাতটুকুনি দোতলায় থাকি৷ বাকি দিনটা ওর সঙ্গেই কাটাই৷
যে তিনদিন জগদীশ এখানে এসে রয়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগ সময়টাই ও কাটিয়েছে অনিন্দিতার ঘরে৷ অনিও সুস্থ থাকলে ওকে ছাড়তে চায়নি৷
‘তুমি সত্যি কষ্ট সারিয়ে দিতে পারো?’ জগদীশের দিকে তাকিয়ে অবুঝ গলায় প্রশ্ন করেছে অনিন্দিতা৷
বিমর্ষ মাথা নেড়েছে জগদীশ, ‘আমি পারি না রে খুকি, আগে পারতাম…’
‘কেন পারো না?’
জগদীশ হেসে উত্তর দিয়েছে, ‘তুমি ছোটবেলায় যা পারতে এখনও কি আর তাই পারো খুকি? আগে তো স্কুলে যেতে, এখন আর যাও?’
মুহূর্তে পুতুলের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে উত্তর দিয়েছে অনিন্দিতা, ‘বাবা বলেছে আমার শরীর ঠিক হয়ে গেলেই আমি স্কুলে যাব৷ তার মানে তুমিও আবার পারবে আমাকে সারিয়ে দিতে?’
জগদীশ উত্তর দেয়নি৷ কথা ঘুরিয়ে দিয়েছে৷ কখনও ওর আঁকার খাতায় ছবি এঁকে দিয়েছে, সেই ছবির নিচে নম্বর দিয়েছে অনি, কখনও আবার রসিয়ে রসিয়ে বলেছে ওর বাবার ছেলেবেলার গল্প৷ কবে ওর বাপ কান ধরে স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়েছিল, কবে বাড়িতে মার খাবার ভয়ে পুকুরপাড়ে কচুবনের ভিতর লুকিয়েছিল, সব গল্প৷ শুনতে শুনতে অনিন্দিতা কখনও খিলখিল করে হেসেছে৷ কখনও শরীরের সব জোর একত্র করে জগদীশের ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়েছে৷ আবার কখনও ক্লান্ত হয়ে ওর হাতের উপরে মাথা দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে৷
বাড়ি ফিরে ওর বন্ধ চোখের পাতার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হয়েছে অনিন্দিতার শরীর থেকে যাবতীয় যন্ত্রণা যেন ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে জগদীশ৷ সত্যি কি ক্ষমতাটা হারিয়ে গেছে ওর? চেষ্টা করলে কি পারবে না আর একবারও?
নাকি ও নিজের জন্য ভয় পাচ্ছে? প্রফেটরা কি নিজেদের কথা ভাবে?
(৪)
গানু যাদবের ছেলে জগদীশের যে একটা কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে সে ব্যাপারটা কাউকে জানাতে আমাকে মানা করেছিল জগদীশ৷ কিন্তু খানিকটা আমারই কল্যাণে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের লোকমুখে৷ কেন জানবে না? এমন একটা বিরল ক্ষমতা কি ঘরে ঘরে হয়? প্রথমে স্কুলের ছেলেদের মুখে, তারপর বাড়ি বাড়ি গুজব ছড়িয়ে পড়ে৷ প্রথমে অবশ্য কেউ বিশ্বাস করতে চায়নি৷
স্কুলেই একদিন তাকে পাকড়াও করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে, তুই সেদিন যেটা করলি সেটা শিখলি কোথা থেকে?’
দু-দিকে মাথা নাড়ে জগু, ‘শিখিনি, আমি জানি না কী করে হয়…’
‘ছোট থেকেই পারিস?’
‘উঁহু, এই মাসখানেক হল… একটা স্বপ্ন দেখি বারবার…’
‘কী স্বপ্ন?’
ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভেবে জগু বলে, ‘মনে হয় আকাশ থেকে কে যেন নেমে এসে আমায় কী একটা দিয়ে আবার আকাশের দিকে উড়ে চলে যাচ্ছে৷ কী দিয়েছে সেটা দেখার আগেই ঘুম ভেঙে যায়…’
আমার সেই মায়ের বলা যিশুর গল্পটার কথা মনে পড়ে যায়৷ যিশুকেও তো এমন করে নির্দেশ পাঠাতেন ভগবান৷ কে বলতে পারে সেটা স্বপ্ন ছিল না?
জগদীশকে নিয়ে গ্রামে সত্যিকারের হইচই যখন পড়ল তখন আমরা স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠেছি৷ পাশের গ্রাম থেকে ঝেঁটিয়ে লোকজন দেখতে এল তাকে৷ তারা সবাই লোকমুখে শুনেছে বকুলপুরের একটা বাচ্চা সদ্য ইস্কুল পাশ করা ছেলে, নাকি মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে রোগ সারিয়ে দিচ্ছে৷ সে গুজবের ফয়সালা হতেই সভা বসল৷
জগদীশের বাবা গানু যাদব থেকেও নেই৷ ঘর থেকেই বেরোয় না সে৷ এদিকে সে নিজে মুখচোরা গোছের৷ ততদিনে আমি গ্রামের একটা হোমরাচোমরা গোছের হয়ে উঠেছি৷
আমারই তত্ত্বাবধানে সভায় জোগাড় করে আনা রোগে ভোগা গ্রামবাসীদের মাথায় হাত বোলাল জগদীশ৷ কিন্তু লাভ হল না তাতে কিছু৷ সুস্থ হওয়া কিংবা যন্ত্রণা লাঘবের সাম্যন্য চিহ্নও দেখা গেল না তাদের শরীরে৷ গুজব ছড়ানোর জন্য গ্রামের মাতব্বরদের দু-কথা শুনিয়ে রোগীর বাড়ির লোক ফিরে গেল৷
সেদিন রাতে জগুদের বাড়ির ছাদে বসেছিলাম আমরা৷ আমরা দু-জন৷ আমার কাঁধ ঝুঁকে পড়েছিল৷ ঘন ঘন সিগারেট ধরাচ্ছিলাম৷ আকাশে ঝুলে থাকা চাঁদের দিকে উড়ে যাচ্ছিল সেই ধোঁয়া৷ মায়ের কোলে শুয়ে শোনা সেই গল্পটার কথা, বইতে আঁকা যিশু খ্রিস্টের ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার৷ তবে কি সত্যি জগদীশের ক্ষমতাটা কাকতালীয়? সিগারেটের ধোঁয়াটা আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে? ছড়িয়ে পড়ছে? নাকি বিশেষ কোনও গন্তব্য আছে তাদের?
‘তোর জন্য এতগুলো লোকের কাছে নাককাটা গেল আমার৷’ জগদীশ ছাদের মেঝেতে পা ঘষতে ঘষতে বলল৷ মুখে স্পষ্টতই বিরক্তির ছাপ ওর৷
‘ওরা আজ বিশ্বাস করেনি, কাল করবে৷’
‘তুই কী করে জানলি?’
‘সব প্রফেটদের সঙ্গে এইটাই হয়৷ প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না৷ অপমান অপদস্থ করে৷ তারপর ধীরে ধীরে একটা মিরাকেল চোখের সামনে দেখে…’
আমার কথা শুনে এবার কিছুটা রেগেই যায় জগদীশ, ‘তুই এই এক ধানাইপানাই এবার বন্ধ কর তো৷ আমি ওসব কিছু নই…’
‘নোস? সিদ্ধেশ্বরীর মাঠের কথা ভুলে গেলি? আমাকে, বিতনুকে, ঘেঁটুদের আধমরা কুকুরটাকে, স্কুলের দারোয়ানের বউটাকে তুই শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে সারিয়েছিস এটা অস্বীকার করতে পারবি?’
কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা আটকে যায় আমার৷ একটা সরু বিদ্যুতের রেখা মাথার ভিতর খেলে যায়৷ একটু আগে যে নামগুলো আমি বলেছি তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে৷ চেয়ার থেকে উঠতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় নীচ থেকে একটা চাপা চিৎকার ভেসে এল৷
এই ক-দিনে জগুর বাপের শরীরটা আরও খারাপ হয়েছে৷ মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচার সম্ভবনা নেই ভদ্রলোকের৷ ভেসে আসা আওয়াজটা শুনে মনে হল আজ রাতটুকু কোনওরকমে চলে গেলেই রক্ষে৷
দু-জনে মিলে নিচে নেমে দেখলাম অবস্থাও সঙিন৷ শরীরের মাঝের অংশ থেকে বিছানার বাইরে ঝুলছে৷ কোমর থেকে উঠে আসা যন্ত্রণায় থেকে থেকে থরথর করে কেঁপে উঠছে শরীরটা৷ মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরিয়ে এসে মাটিতে পড়ছে টপটপিয়ে৷ বুঝলাম বুকের ভিতর আটকা পড়া প্রাণটা শরীর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে৷
জগু এগিয়ে যায় বাপের দিকে৷ দু-জনে মিলে ধরাধরি করে শরীরটা খাটের উপরে তুলে দিই৷ জগু বাপের পাশে বসে পড়ে আসতে আসতে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে তার মাথায়৷ বুড়োর গোঙানি একটু একটু করে কমে আসতে থাকে তাতে৷ বেশ বোঝা যায় ম্যাজিকের মতো শরীরের ভিতর থেকে রোগ সরে যাচ্ছে তার৷ আমি আর অবাক হই না৷ এই ক-দিনে এ জিনিস দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি৷
‘তুই এখন আয় বরং…’ আমার দিকে চেয়ে বলে জগু, ‘বাবা আজ রাতটা চলে যাবে…’
‘বাপের উপর কাজ করে, কিন্তু অচেনা লোকের উপর কাজ করে না…’ আমি মাটির দিকে চেয়ে বিড়বিড় করি, ‘তুই মানেটা বুঝতে পারছিস?’
‘পারছি না, তুই এখন আয় সোমু৷ এইসব নিয়ে আমি আর…’ বিরক্ত হয়ে আমার হাত ঠেলে সরিয়ে দেয় জগু৷
‘শুধু একটা মিরাকেল ঘটাতে হবে…’ আমার চোখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, ‘তুই যাদের ভালো করে চিনিস, যাদের ভালোবাসিস শুধু তাদের উপর কাজ করে তোর ম্যাজিক… একটা মিরাকেল ঘটাতে পারলেই…’
এতক্ষণে ছেলেটার রাগ আর বিরক্তি সপ্তমে উঠেছে মনে হয়৷ কপালের শিরা দপদপিয়ে ওঠে৷ হঠাৎই আমার দিকে আক্রমণাত্মকভাবে এগিয়ে আসে জগু, আমার জামার কলার খামচে ধরে সে, ‘অনেকদিন থেকে এইসব নউটাংকি সহ্য করছি৷ লোকে ঠিকই বলে, মা মরে যাওয়ার পর থেকেই মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে তোর৷ একদিন স্কুলের মাঠে কী বাঁচিয়েছিলাম বলে পেয়ে বসেছিস, না? তুই যা বলবি তাই করতে হবে আমাকে?’
‘হ্যাঁ করতে হবে…’ আমি ধাক্কা মারি ওকে, ‘দুনিয়ায় আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে, তারা কেউ এই ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না৷ তুই জন্মেছিস, তার একটা কারণ থাকবে না?’
‘থাকলে থাকবে, আমার কারও বাঁচা-মরায় কিছু যায়-আসে না৷’
‘তোর মুখে এই কথা মানায় না…’ আমি ভর্ৎসনা করি তাকে৷
আমার কাঁধে এবার সজোরে ধাক্কা মারে সে, ‘বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা তুই এখানে থেকে… তোর কোনও কথা আমি শুনব না…’
‘শালা স্বার্থপর কোথাকার… দুনিয়ায় এত মানুষের এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা, এত রোগ৷ তোর হাতে সবাইকে ভালো করে দেওয়ার ক্ষমতা আর তোর কিছু যায়-আসে না, না?’ কথাগুলো একদলা থুতুর মতো ধেয়ে যায় ওর দিকে৷
‘আর আমার? আমার কষ্টটার কী হবে?’ কথাটা যেন বলতে চায়নি জগদীশ৷ ঝগড়ার মুখে একরকম জেদের বশেই বলে ফেলেছে সে৷
‘তোর কষ্ট বলতে? তোর আবার কীসের…’
‘প্রফেট না? খুব প্রফেট সাজানোর শখ হয়েছিল আমাকে? দেখ এবার…’
কথাটা শেষ না করেই ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দেয় জগদীশ৷ তারপর গায়ের জামাটা খুলে ফেলে একটানে৷ জামাটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঘরের এককোণে৷ তারপর বন্য পশুর মতো ডুকরে ওঠে৷
আমার চোখ ততক্ষণে স্থির হয়ে গেছে ওর বুকের উপরে৷ জগদীশের সমস্ত শরীর জুড়ে অসংখ্য কাটাকুটি দাগ৷ যেন ধারালো ছুরি কিংবা কাঁটা লাগানো মুগুর দিয়ে কেউ বারবার ওর বুক ক্ষতবিক্ষত করেছে৷ দাগগুলোর কয়েকটা পুরনো, কয়েকটা অপেক্ষাকৃত নতুন৷ একটা থেকে এখনও রক্তও গড়িয়ে পড়ছে৷ যেন এইমাত্র কেউ ব্লেড চালিয়েছে তার বুকের মাঝবরাবর৷
‘কী… এগুলো কী করে…’
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সে গর্জন করে ওঠে, ‘কারও যন্ত্রণা মুছে দিতে পারি না আমি সোমু৷ কেবল নিজের শরীরে নিয়ে নিতে পারি… যতবার কারও রোগ সারিয়েছি, ততবার সেই যন্ত্রণা আমাকে শেষ করে দিয়ে গেছে… বাড়ি ফিরে… বাড়ি ফিরে আমি…’
বাকি কথাগুলো বেরয় না ওর গলা দিয়ে৷ যন্ত্রণা মেশানো কান্নায় ওর গলা বুজে আসে৷ শরীরের শক্তি যেন কমে আসছে ওর৷ ধীরে ধীরে মাটির উপরে বসে পড়ে ও৷
ওর বাপের বিছানার পাশে পড়ে থাকা তুলো আর ওষুধ দিয়েই বুকের ক্ষত থেকে রক্ত পড়া বন্ধ করি আমি৷ ছুঁয়ে দেখি ওর বাকি কালচে হয়ে যাওয়া দাগগুলো৷ কোনওটা গভীর, আবার কোনওটা কেবল চামড়ার উপর বারবার আঁচড়ের দাগ৷ সেগুলো স্পর্শ করতেই আমার শরীর কেঁপে ওঠে৷ ঈশ্বরের হাতের স্পর্শ! স্যালভেশন!
বিড়বিড় করি আমি, ‘মার্ক ১০:৪৫, For even the Son of Man did not come to be served–but to serve–and to give his life as a ransom for many.’ কে বলেছে তুই প্রফেট নোস জগু? নিজেকে এতটা কষ্ট দিয়ে তুই এতগুলো মানুষের যন্ত্রণা…’
‘আমি পারব না, আমি পারব না আর…’ একটা লাথি মেরে আমাকে ঘরের উল্টো দিকে ছিটকে ফেলে দেয় দুবলা ছেলেটা৷ কোমরে চোট লাগে আমার৷ তাও সরীসৃপের মতো হাতে ভর দিয়ে তার কাছে এগিয়ে যাই আমি৷ আবার একটা লাথি ছিটকে আসে আমার দিকে, ‘আমি পারব না আমি পারব না, তুই একটা পাগল সোমু, তোর মা মরে যাওয়ার পর থেকে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে…’
আমি বিকারগ্রস্তের মতো ওর পা জড়িয়ে ধরি, ‘মানুষের খুব কষ্ট রে জগু৷ তুই বাঁচা ওদের, নিজের বুকে টেনে নে সবটা… তোকে সবাই মনে রাখবে, তুই এই ঘরে এই বুড়োটার সঙ্গে ধুঁকতে ধুঁকতে…’
আমার মুখে আরও কয়েকটা লাথি কশায় জগু৷ আমার রক্তাক্ত ঠোঁট তখনও বলে চলেছে, ‘শুধু একটা মিরাকেল… সবার সামনে একবার একটা মিরাকেল…’
আমার ধারণা ভুল ছিল৷ সেদিন রাত কাবার হবার আগেই জগুর বাপ মারা যায়৷ ঠান্ডা দেহ পরদিন সকালে আমরা গ্রামের কয়েকটা ছেলে মিলে দাহ করি৷ জগু ওর বাপের মুখে আগুন দিতে পারেনি৷ কারণ সে রাতের পর ওকে আর বকুলপুরে দেখা যায়নি৷
প্রফেট হবার আগেই জগু কোথায় যেন পালিয়ে গেছিল৷
(৫)
রাত দশটা বেজেছে৷ মোটামুটি এর মধ্যেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ি আমরা৷ একটু আগে তিনতলার ঘরে অনিন্দিতাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি আমি৷ নিচে চলে আসার আগে আমার হাত জড়িয়ে ধরেছে ও, নরম গলায় বলেছে, ‘আমাকে একবার তোমাদের গ্রাম দেখাতে নিয়ে যাবে বাপি?’
আমি হেসে উত্তর দিয়েছি, ‘কেন নিয়ে যাব না? কিন্তু গ্রাম দেখার এত আগ্রহ কেন? জগদীশকাকুর গল্প শুনে?’
হেসে ঘাড় নাড়ায় ফুলের মতো মেয়েটা, ‘জগদীশকাকু তোমার সব সিক্রেট বলে দিয়েছে আমাকে, সব…’
আমার মুখে অজান্তেই হাসি খেলে যায়, ‘তাই নাকি? কীরকম সিক্রেট?’
‘এই যে তুমি ছেলেবেলায় মায়ের জন্য মন কেমন করলে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে৷’
‘ধুর, মিথ্যে বলছে, আমি কখনও কাঁদি?’
‘কে বলেছে কাঁদ না? আমি নিজে দেখেছি৷ কাল রাতে ছাদের কোণে বসে কাঁদছিলে যে, ভেবেছিলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, তাই না?’
আমি মুখ সরিয়ে নিই৷ অনিন্দিতা আমার কবজির কাছটা চেপে ধরে, ‘তোমার কষ্ট হয় কেন বাপি? আমার জন্য?’
‘তোর জন্য কষ্ট হবে কেন?’
‘এই যে আমি আর বেশিদিন বাঁচব না, আমাকে তখন মিস করবে ভেবে…’
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি আমি৷ ধমকের গলায় বলেছি, ‘তোকে এসব কথা কে বলেছে? খুব পেকেছিস না?’
অনিন্দিতা আর কিছু বলেনি৷ ও তেমন করে কিছু বলেই না কোনওদিন৷ শুধু চুপ করে যায়৷ তখন ওর চোখ কথা বলে৷ ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা আলগা হাসিটা কথা বলে৷ সেদিকে আজ আমি তাকাতে পারিনি৷ নেমে এসেছি নিচে৷
‘চেনা নেই, জানা নেই, খামোখা লোকটাকে বাড়িতে এনে রেখেছ…’ বালিশে ওয়ার গলাতে গলাতে বলল কাবেরি৷ ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বলি, ‘চিনি না কে বলেছে? জগু আর যাই হোক, ক্ষতিকর নয়৷ তাছাড়া…’
‘তাছাড়া কী?’
‘আমাদের মেয়েকে বাঁচাতে হলে একমাত্র ওই পারবে কাবেরি… আর সব কিছু তো চেষ্টা করে দেখলাম…’
কয়েক সেকেন্ড কোনও উত্তর আসে না৷ কাবেরি পাশ ফিরে শুতে শুতে বলে, ‘বিয়ের আগেই শুনেছিলাম আমার শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর থেকেই তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছিল৷ আজ এত বছর পরে বুঝতে পারছি…’
ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিই আমি, ‘পাগলামো মনে হচ্ছে তোমার? আমি নিজের চোখে ওকে ওইসব করতে দেখেছি৷ শুধু আমি কেন, গ্রামের আরও অনেকে দেখেছে৷ ও নিজের উপর একটু বিশ্বাস রাখতে পারলে, আর একটু যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেই এতদিনে…’
‘বেশ, সব মেনে নিলাম৷ কিন্তু আজ এত বছর পরেও সে ক্ষমতা ওর আছে তাই বা তুমি জানলে কেমন করে?’
‘আছে, আছে, আমি জানি৷ নইলে ও কেন সংসার করল না বলতে পারো? সামান্য একটা কুলিগিরি করে জীবন কাটাচ্ছে কেন বলতে পারো?’
‘কেন?’
‘কারণ ও আর যন্ত্রণা পেতে চায় না৷ ওর ভিতরে একটা নরম মন আছে৷ ও ভালোবাসে, এমন কেউ কষ্ট পেলে ও সহ্য করতে পারে না৷ তাই সংসার ধর্ম করতে চায়নি…’
‘সেইজন্য তুমি ভেবেছ তোমার মেয়েকে ভালোবেসে ফেলে ওর রোগটা সারিয়ে দেবে আর নিজে মরবে?’
‘প্রফেটরা মরে না কাবেরি৷ রোগ ওদের শেষ করতে পারে না৷ তুমি দেখো ও ঠিক আমাদের মেয়েকে…’
আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার পাশ ফিরে শোয় কাবেরি, ‘ডাক্তার বলেছে আর কয়েকটা মাস৷ মনের জোর দরকার আমাদের অনেকটা৷ তুমি আমাকে আর একবার যন্ত্রণা দিও না গো…’
ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ ভেসে আসে৷ বাইরের আকাশে চাঁদ জেগে আছে আজ৷ অনির খেলনা রাতবাতিটার মতো দেখাচ্ছে আজ চাঁদটাকে৷ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হয় দূর থেকে একটা পরিচিত সুর ভেসে আসছে৷ গ্রামে থাকতে শুনেছিলাম কি? আমার মা গুনগুন করত বোধহয় এই সুরটা… কতদিন হল মাকে মনে পড়ে না আমার৷ এখন মায়ের কথা ভাবলে বরঞ্চ অনির মুখটা মনে পড়ে৷ মায়ের কোলের গন্ধটা ওর শরীরে কী করে এল কে জানে৷ হঠাৎ ইচ্ছা হল অনির কোল ঘেঁষে শুতে৷ আমি কি আবার বাচ্চা হয়ে যাচ্ছি?
আমার ফেলে আসা বন্ধু, স্কুলের মাঠ, গাছে বাঁধা টায়ারের দোলনা, ঘেঁটুদের পুকুরপাড়টা কি ডাকছে আমাকে?
আমি জানি জগু সারিয়ে তুলবে আমার মেয়েকে৷ ও এই তিনদিনে খুব ভালোবেসে ফেলেছে অনিকে৷ ওকে এভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দিয়ে ও কিছুতেই পালিয়ে যেতে পারে না৷
উঁহু, প্রফেটরা, পালিয়ে যায় না৷ ফিরে আসতেই হয় ওদের৷ আমার মা বলেছিল…
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না৷ মাঝরাতে একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল৷ ভালো করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম৷ হ্যাঁ৷ আওয়াজ আসছে একটা৷ সিঁড়ির উপর মৃদু পায়ের আওয়াজ তুলে তিনতলায় উঠছে কেউ৷ কে হতে পারে?
আমি দ্রুত খাট থেকে নেমে চটিটা পায়ে গলিয়ে নিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালাম৷ বাইরের আলোটা জ্বলছে না৷ কেবল একটা অবয়ব অন্ধকারের বুক চিরে ফুটে রয়েছে৷ একটা মানুষ সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে তিনতলার দিকে৷
টেবিল থেকে টর্চটা তুলে নিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ চেয়ে দেখলাম কাবেরি এখনও পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে৷ ওর ঘুম গভীর৷
ছায়ামূর্তিটার পেছন পেছনে তিনতলার ঘরে উঠে এলাম আমি৷ অনির ঘরের দরজা ভেজানো ছিল৷ সেটা আলতো হাতের ঠেলায় খুলে ফেলল লোকটা৷ তারপর ঘরের ভেতরে ঢুকে অন্ধকারে হারিয়ে গেল৷
মনে হয় কিছু একটা ভাবছে আগন্তুক৷ আমি যে ওকে ফলো করে এসেছি তা লোকটা এখনও বুঝতে পারেনি৷
পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে এলাম৷ অনির ঘরের জানলাটা বেশ বড়৷ সেটা দিয়ে ভরাট চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের ভিতর৷ আমার এগারো বছরের অসুস্থ মেয়েটার ঘুমন্ত মুখ সেই জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে৷ অনিন্দিতার খাটের পাশে বসে পড়েছে লোকটা৷ একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর মুখের দিকে৷ অঘোরে ঘুমোচ্ছে আমার মেয়ে৷ ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা নীল যে বেবি ল্যাম্পের আলোয় ভারী মায়াবী দেখাচ্ছে ওর মুখটা৷ বুকটা ওঠানামা করছে ধীরে ধীরে৷
হঠাৎ একটা চাপা কান্নার শব্দ ভেসে এল৷ বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসা মানুষটা কাঁদছে৷ ঠিক এমন করে বাইশ বছর আগে তাকে কাঁদতে দেখেছিলাম৷ আজ মানুষটা বদলে গেছে, কিন্তু কান্নার শব্দটা…
চাপা যন্ত্রণার নিঃশ্বাস যেন ঘরের বাতাসটাকে ভারী করে তুলেছে৷ সেই বাতাসের ভেতর আমার গলাটা নিজের কানেই অলৌকিক শোনাল, ‘আর কষ্ট পেতে দিস না ওকে জগু, সুস্থ করে দে ওকে…’
এতক্ষণে ঠিক পেছনেই আমার অস্তিত্ব টের পায় লোকটা৷ চকিতে ফিরে তাকায় আমার দিকে৷ ঘরে এখনও আলো জ্বলছে না৷ তাও দু-জনেই দু-জনকে চিনতে পারি৷
জগুর গলায় শুকনো কান্নার ছাপ, ‘আমি জানি তুই কেন আমাকে নিয়ে এসেছিস এখানে…’
আমি উপরে নিচে মাথা নাড়াই, ‘একদিন না একদিন তোকে জানাতেই হত৷ কিন্তু এও জানতাম আমার মেয়েকে ভালোবেসে ফেলতে বেশিদিন লাগবে না তোর… ওকে সুস্থ করে দে জগু, ও খুব কষ্ট পাচ্ছে…’
জগুর গলাটা এবার বদলে যায়, ‘আমি কাউকে সুস্থ করতে আসিনি আজ৷ আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি৷ ওকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছিলাম…’ আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত দরজার দিকে পা বাড়ায় জগু৷
আমার দুটো হাতের সজোরে ধাক্কা ওকে দেওয়ালের উপর ছিটকে ফেলে দেয়৷ মুখ দিয়ে যন্ত্রণামাখা শব্দ বেরিয়ে আসে৷ আমি আড়চোখে একবার অনিন্দিতার দিকে তাকাই৷ এখনও ঘুমিয়ে আছে সে৷
শ্বাপদের মতো হিংস্র গলায় বলি, ‘ঈশ্বর নিজে যাদের মসিহা করে পাঠায় তাদের পালিয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না জগদীশ, আমার মেয়েকে না সারিয়ে তুই আজ কোথাও যেতে পারবি না…’
‘আমি কোন মসিহা নই…’ কাঁদো কাঁদো গলায় আর্ত চিৎকার করে ওঠে জগদীশ, ‘কষ্ট হয় আমার, খুব কষ্ট হয়… আমার শরীরে কী যন্ত্রণা…’
দু-হাতে আমার জামা খিমচে ধরে সে৷ ওর আঙুলের চাপে আমার চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসতে চায়৷ তাও আমি চেপে ধরে থাকি ওকে, ‘যন্ত্রণা পেতে হয় বন্ধু, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে যারা প্রফেট হয়েছে তাদের সবাইকে যন্ত্রণা পেতে হয়েছে৷ হয়নি? বল? তোদের ছাদে বসে রাতের পর পর তাদের গল্প পড়ে শোনাইনি আমি তোকে?’
দু-হাতের চাপে আমাকে সরানোর চেষ্টা করে জগু, ‘তুই একটা মাথাখারাপ পাগল সোমু, আর এসব ছেঁদো কথা, আমি প্রফেট কি না তাতে তোর কিচ্ছু যায়-আসে না, তুই শুধু তোর মেয়েকে বাঁচাতে চাস… আর কার কী ক্ষতি হল তাতে তোর কিছু যায় আসে না…’
‘না, যায়-আসে না…’
‘কিন্তু আমার যায়-আসে, শিয়ালদা স্টেশনের কুলি হই আর যাই হই৷ আমি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে থাকতে চাই…’
‘কী আছে তোর জীবনে বেঁচে থাকার মতো? কে আছে?’
অদ্ভুত হাসি খেলে যায় জগদীশের মুখে৷ একটা হাত বুকপকেটে ঢুকিয়ে একটা পুরনো ছবি বের করে আনে সে৷ তারপর সেটা তুলে ধরে আমার মুখের সামনে৷ চাঁদের আলো যেন নিজে থেকেই বেড়ে ওঠে৷ সেই আলোয় দেখতে পাই একটা তেলচিটে ফটোগ্রাফ৷ তিনটে মানুষের ছবি৷ বাবা-মা আর মেয়ে৷ এর মধ্যে একজনকে আমি চিনি৷ বাকি দু-জনকে চিনতে অবশ্য অসুবিধা হল না৷
‘তুই বিয়ে করেছিস জগু?’
‘আমি পালাতে পারিনি রে… পালাতে পালাতে ক্লান্ত হয়ে… এরা কেউ আমার সঙ্গে থাকে না৷ মাসে একবার টাকা পাঠিয়ে দিই৷ একবার করে দেশে ফিরে মেয়েকে দেখে আসি৷ কিন্তু ওদের জন্য বাঁচতে ইচ্ছা করে সোমু৷ ওদের জন্য কষ্ট পেতে ইচ্ছা করে না…’
ছবিটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিই আমি, বিকারগ্রস্তের মতো বলি, ‘হোক সংসার৷ প্রফেটরা সংসার করলেও সংসারের কথা ভাবে না৷ তুই হয় আজ আমার মেয়েকে সারিয়ে তুলবি নাহলে… একটা মিরাকেল জগু, আজ থেকে বাইশ বছর আগে পারিসনি, কিন্তু আজ পারবি… ওইটুকু মেয়েটা মরে যাবে ধুঁকতে ধুঁকতে? একটা মিরাকেল জগদীশ…’ অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে কথাগুলো৷
‘আমি…’ এতক্ষণে জগদীশের চিৎকার আকাশ ছুঁয়ে ফেলে, মনে হয় গোটা বাড়িটাই কেঁপে ওঠে সে চিৎকারে, ‘প্রফেট নই!’
অনিন্দিতার পুরনো কাঠের ব্যাটটা কখন ওর হাতে উঠে এসেছে খেয়াল করিনি৷ মাথায় তীব্র যন্ত্রণার স্রোত আছড়ে পড়তে পড়তে অনুভব করি আমাকে সেইভাবেই মাটির উপরে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে জগদীশ…
(৬)
কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম জানি না৷ চোখ যখন খুললাম তখন ঘণ্টাখানেক সময় পেরিয়ে গেছে৷ জানলা দিয়ে সাদা আলো আসছে না, মানে ভোর হয়নি এখনও৷
মাথার পেছনটা চেপে ধরে কোমরে ভর দিয়ে উঠে বসতে বসতে বিছানার দিকে একবার তাকালাম৷ অনি আগের মতোই ঘুমাচ্ছে৷ এত চিৎকারে একবারও চোখ মেলে চায়নি৷ ওর মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে নাকের কাছে হাত রাখলাম৷ বেঁচে আছে মেয়েটা৷
ঘরের ভেতরটা বড্ড দমবন্ধ লাগছে৷ ওষুধ আর অস্থির নিঃশ্বাসের শব্দ ঘিরে রেখেছে ভিতরের বাতাসটাকে৷ ছাদের খোলা হাওয়ায় একবার দাঁড়াতে পারলে বেশ হত৷
মাথার পেছনে হাত বোলাতে বোলাতেই দরজা পেরিয়ে ছাদে এসে দাঁড়ালাম৷ সত্যিই একটা ঝিমঝিমে নরম খাওয়া খেলা করছে ছাদময়৷ মাথাটা একটু পরিষ্কার হল আমার৷
পরিচিত চাঁদটা আমার দিকে চেয়ে হাসছে৷ একটু আগে মায়ের গলায় শোনা যে সুরটা কানে আসছিল সেটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে৷ সবকিছু বড্ড নিস্পন্দ, নির্বাক!
একটা যন্ত্রণা দলা পাকাচ্ছে আমার মনের ভেতর৷ অনিন্দিতা আর ভালো হবে না কোনওদিন৷ প্রত্যেকটা রাতে ওইটুকু ফুটফুটে মেয়েটাকে রক্তবমি করতে, যন্ত্রণা পেতে দেখতে হবে আমাকে, একদিন হয়তো সেই কাশির আওয়াজও থেমে যাবে৷ ওর বাবা ওর জন্য কোনও দেবদূত এনে দিতে পারেনি৷ কিংবা সবটাই হয়তো ওর বাবার পাগলামো৷
ছাদের কিনারে শরীর এলিয়ে দিলাম৷ আর একবার পাশ ফিরলেই গিয়ে পড়ব নিচে৷ নিচের মাটিটা ডাকছে আমাকে৷ গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে মাথায় ব্যাটের বাড়ি মেরেছে জগু৷ মাথার ভেতরটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে৷ যন্ত্রণাটা ছড়িয়ে যাচ্ছে মনের ভিতর৷
বাইশ বছর পর এই প্রথম মনে হল আমার—মা ভুল বলেছিল৷ মা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমার মাথার ভিতরে…
‘বাপি…’ পাশ থেকে ভেসে এসেছে গলার আওয়াজটা৷ দীর্ঘ যন্ত্রণাময় শ্বাসমাখা একটা ডাক৷ আমি ফিরে তাকালাম না৷ আকাশে চাঁদের আলো, তাতে চোখের জল ঝিকমিক করে উঠবে৷ মেয়েটা কবে যেন বড় হয়ে বাপের চোখের জল চিনে নিতে শিখেছে৷
‘তুমি এখানে এসে শুয়েছ কেন? কী হয়েছে বাপি?’ কথাটা বলতে বলতেই সে এসে বসল আমার পাশে৷
‘কিছু না, এমনি শুয়ে আছি একটু৷ তুই ভিতরে যা…’
কয়েকটা সেকেন্ড চুপ করে থাকলাম দু-জনে৷ আবার টেনেটেনে নিঃশ্বাসের শব্দ৷ কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে ওর৷
একটা নরম স্পর্শে বুঝলাম আমার মাথাটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে ও৷ তারপর হাত থেকে নামিয়ে রেখেছে নিজের কোলে৷ ওর কোল জুড়ে রক্তের গন্ধ৷ শুকনো রক্তের খসখসে স্পর্শ পেলাম স্কার্টে৷
আমার শরীর মনের যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে উত্তরোত্তর৷ মাটিটা আরও বেশি করে ডাকছে৷ আর মাত্র একবার পাশ ফিরলেই…
‘তোমার কী কষ্ট হচ্ছে বাপি? শরীর খারাপ লাগছে?’
রাতের হাওয়ায় বাচ্চা মেয়েটার গলার আওয়াজ আমার শরীরটাকে কাঁপিয়ে দিল৷ আবার জিজ্ঞেস করে সে, ‘কী কষ্ট হচ্ছে বলো না বাপি, কোথায় ব্যথা হচ্ছে তোমার?’
আমি উত্তর দিতে পারলাম না৷ শরীরটা কেঁপে উঠেছিল একবার৷ আবার স্থির হয়ে গেলাম৷
ঠিক এইসময়ে একটা অদ্ভুত কাজ করল অনিন্দিতা৷ প্রকৃতির কোন খেয়ালে জানি না, ওর হাতটা উঠে এল আমার মাথায়৷ কোমল স্পর্শে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল সে৷ আর আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমার শরীর মনের ব্যথা কমে যাচ্ছে একটু একটু করে!
হ্যাঁ, ওর হাতের স্পর্শে, ওর গলার ‘বাপি’ ডাকে সত্যি সত্যি ম্যাজিকের মতো কমছে আমার ব্যথাটা৷ বাইশ বছর আগে যেমন করে কমিয়েছিল আমার বন্ধু৷
অবাক বিস্ময়ে এই প্রথম আমি ওর মুখের দিকে চাইলাম৷ বিস্তীর্ণ কালো আকাশের প্রায় সবটা ঢেকে দিয়েছে আমার ছোট্ট অসুস্থ মেয়েটা৷
আমার চোখের জলটা খেয়াল করে আর একটা হাত বাড়িয়ে জলটা মুছে দিল সে৷ নরম হাসি হেসে ফিসফিস করে বলল, ‘কষ্ট পেও না বাপি, দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে…’
শরীর মনের সমস্ত যন্ত্রণা মুহূর্তে মুছে গেল আমার৷ মাতৃহারা শিশুর মতো অনিন্দিতার কোমর আঁকড়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললাম আমি৷
জগদীশ পারেনি৷ সে পালিয়ে গেছিল৷ কিন্তু সেদিন রাতে আমার এগারো বছরের অসুস্থ মেয়ে অনিন্দিতা, প্রফেট হতে পেরেছিল…