প্রপাত
সময় সেই সন্ধ্যা ছটায়, তবু ল কলেজের ক্লাসে দেড়টার পরে আর থাকতে পারল না চিন্ময়। মনে হচ্ছিল দপ দপ করছে রগের দু-পাশে, হাতের নাড়িতে মৃদু জ্বরের দ্রুতলয় উত্তেজনা। বসে ছিল ঠিক একটা পাখার নীচেই, তা সত্ত্বেও পাঞ্জাবির কাঁধটা ভিজে উঠেছিল ঘামে। শেষপর্যন্ত একেবারে প্রফেসারের চোখের সামনে দিয়েই বেরিয়ে এল সে।
উতরোল হাওয়া বইছে বাইরে ইউনিভার্সিটির লনে। মাথার একগুচ্ছ চুল হঠাৎ হঠাৎ উড়ে পড়ল চশমার উপর, কতগুলো বিসর্পিল কালো কালো রেখায় এক বারের জন্যে অস্বচ্ছ হয়ে গেল দৃষ্টি। কোনো দূর অরণ্যের ধ্বনির মতো মাথার উপরে শোনা গেল পত্ৰমর্মর। আশুতোষ মিউজিয়মের গায়ে দাঁড়-করানো বাসুদেবমূর্তিটা এক বার নড়ে উঠল যেন।
চোখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল চিন্ময়। মাথার উপরে পাতার শব্দে বুকপকেট থেকে খামখানাও যেন সাড়া দিয়ে উঠেছে। অথবা ভীরু একটা চাপা কণ্ঠস্বরের মতো শোনা যাচ্ছে তিনটে লাইন, যা বার বার পড়ে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে চিন্ময়ের।
আজ সন্ধে ছটায় চাঁদপাল ঘাটের ট্রাম-স্টপটার সামনে দয়া করে একটু দাঁড়াবেন। আমি আসব। দরকারি কথা আছে। ছায়া।
মনে মনে লাইন ক-টা গুঞ্জন করতে করতে চিন্ময় হাঁটতে লাগল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এক বার। একটা পঁয়ত্রিশ। আরও প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা। কী করে কাটবে এতক্ষণ, কী করে এতখানি অসহ্য সময় পার হওয়া যাবে।
আপাতত মেস। অনেকক্ষণ চোখ বুজে বিছানায় পড়ে থাকা আর চুপ করে ভাবা, হঠাৎ ছায়া এ-চিঠি তাকে লিখতে গেল কেন?
সত্যি, কেন ছায়া এই চিঠি লিখল তাকে?
দুপুরের নির্জন নিঃশব্দ মেসে তিন তলার সিঙ্গল সিটেড ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চিন্ময় সেই কথাটাই ভাবতে চেষ্টা করল। এমন কী তার বলবার আছে যার জন্য চিন্ময়কে সে ডেকে পাঠিয়েছে সন্ধ্যা ছ-টার সময় চাঁদপাল ঘাটের ট্রাম-স্টপের সামনে?
সকালে চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই একটা তীক্ষ্ণ অস্বস্তিতে জর্জরিত হচ্ছে চিন্ময়। কী চায় ছায়া? মুক্তি? বলতে চায় আমার জীবনে আর একজন মানুষ অনেক দিন থেকে অপেক্ষা করে আছে, তাকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারব না। বলবে বাংলাদেশে অনেক সুপাত্রী জুটবে আপনার জন্যে, শুধু আমায় দয়া করুন?
অথবা–
অথবা আর কী হতে পারে? চার দিন আগে মাত্র পনেরো মিনিটের জন্যে যার সঙ্গে পরিচয়, যার ছায়া-ছড়ানো করুণ মুখের আবছা আভাস মাত্র মনে করতে পারে চিন্ময়, যার হাতের আংটির পোখরাজ পাথরটা মাত্র বার কয়েকের জন্যে জ্বলজ্বল করে উঠেছিল আসন্ন সন্ধ্যার শান্ত আলোতে, সেই ছায়াসঙ্গিনীর মতো মেয়েটি কেন হঠাৎ এই প্রগলভ চিঠির আশ্রয় নিয়েছে?
চার দিন আগে রবিবারে ছুটি ছিল। সকাল বেলা নিশ্চিন্ত মনে খবরের কাগজটা পড়বার
সময়ে এক বার এসে হানা দিয়েছিল বলাইদা।
এই, ভালো চা আর গরম জিলিপি আনা এক ঠোঙা।
তা আনাচ্ছি। কিন্তু হঠাৎ পাড়ার রোয়াকের মায়া ছেড়ে এখানে এসে জুটলে যে?
কী করব? চিন্ময়ের সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে বলাইদা বললে, কাল রাত্রেও রমাপ্রসাদবাবু এসেছিলেন। বললেন, তুমি আর এক বার ওকে মনে করিয়ে দিয়ে বলাই। একালের ছেলে, কখন আবার ভুলে যায়…
চিন্ময় হাসল, একালের ছেলেদের স্মৃতিশক্তির বালাই নেই এ ধারণা কী করে জন্মাল রমাপ্রসাদবাবুর? কিন্তু সত্যি বলাইদা, আমার কেমন উৎসাহ হচ্ছে না।
বলাইদা ভুরু কোঁচকাল, পাকামো হচ্ছে নাকি? আজ তিন মাস ধরে সারা কলকাতায় তোমার জন্যে মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছি, আর এখন বলা হচ্ছে উৎসাহ পাচ্ছি না?
বিয়ে করতে আপত্তি নেই, কিন্তু মেয়ে দেখাটাই…
একটানে সিগারেটের আধখানা শেষ করলে বলাইদা, বুঝেছি, আর বলতে হবে না! অর্থাৎ এ-যুগে এরকম বর্বরতা আর সহ্য হয় না, একটি মেয়েকে গোরু-ছাগলের মতো ইত্যাদি, ইত্যাদি। ওসব লেকচার ছেড়ে দে। না দেখে একটা কালোকোলো হাবাগোবা মেয়ে বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে সেটা আগে বললেই হত। পাঁচ মিনিটে কনে জুটিয়ে দিতুম, এসব ঝকমারি আমাকে পোয়াতে হত না।
চিন্ময় বললে, না না, জীবে দয়া করবার ঔদার্য আমার নেই। শিক্ষিতা সুন্দরী স্ত্রী সবাই চায়—আমিও চাই। শুধু বলছিলুম, এভাবে মেয়ে দেখতে যাওয়াটা…
বলাইদা বললে, তুই একটা ছাগল। টুইশন করলি, ডজন খানেক স্কুল-কলেজের মেয়ে পড়ালি, তার মধ্যে একটা প্রেমট্রেমের ব্যবস্থা করে নিতে পারলিনে? তাহলে তো এসব ঝামেলা করতে হত না। নে, এখন চটপট চা আর জিলিপি আনতে দে। আর মনে রাখিস, ঠিক চারটের সময় আমি আসব, তুই জামাকাপড় পরে রেডি হয়ে থাকবি।
অতএব যেতেই হল চক্ৰবেড়েতে। ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সাড়ে চারটেয়।
হলদে রঙের পুরোনো দোতলা বাড়ি। সামনে হাত পাঁচ-ছয় খানিকটা চতুষ্কোণ জমি, একটা জীর্ণ চেহারার ইউক্যালিপ্টাস একগুচ্ছ শীর্ণ পাতার অঞ্জলি তুলে বেমানানভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। বাড়িটাকে আচমকা কেমন শ্রান্ত, কেমন অবসন্ন মনে হয়।
রমাপ্রসাদবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। অভ্যর্থনা করে নিয়ে বসালেন বাইরের ঘরে। পুরোনো ফার্নিচার, পুরোনো ফোটো, বিলিতি তেল কোম্পানির রংচঙে ক্যালেণ্ডার, তক্তপোশের উপরে পাতা সুজনিটায় ইস্ত্রির মরচে-ধরা দাগ একটা। শুধু কোণভাঙা দুটো কাচের ফুলদানি থাকলেই যেন সম্পূর্ণ হত সবটা।
তারপর সেইরকম। সেই দরজার পর্দার ওপার থেকে কয়েকটি পা আর শাড়ির প্রান্ত, চুড়ির আওয়াজ আর চাপা ফিসফিসানি, একটি আট-ন বছরের মেয়ের পর্দা সরিয়ে এক বারের জন্যে মুখটি বাড়িয়ে দেওয়া, আর রমাপ্রসাদবাবুর একটানা বলে যাওয়া মেয়েটি আমার দেখতে-শুনতে ভালোই, রান্না-সেলাই সবই জানে, তবে লেখাপড়া বেশিদূর করেনি। ম্যাট্রিকের আগে টাইফয়েড হয়েছিল।
সব সেইরকম। সেই শিঙাড়া-লেডিকেনি-সন্দেশের খাবারের প্লেট। মেয়ে দেখতে এলে কী কী খাবার সাজিয়ে দিতে হয়, মিঠাইওয়ালাদের পর্যন্ত মুখস্থ আছে সেটা। সেইসঙ্গে সবিনয় অনুরোধ–না না, ও আর ফেলে রাখবে না, দুটি তো মিষ্টি, সামান্য ব্যবস্থা।
পুরোনো ফোটো, পুরোনো ফার্নিচার, পুরোনো ঘড়ির শব্দ আর পুরোনো সামাজিকতার ভিতরে চিন্ময় যখন ক্রমশই স্তিমিত হয়ে উঠছিল, তখন দু-হাতে দু-পেয়ালা চা নিয়ে ছায়া ঘরে ঢুকল। এ-পর্যন্ত সব জ্যামিতির নিয়মে চলছিল, কিন্তু ইউক্লিডের থিয়োরেম এইবার হোঁচট খেল একটা। এই ঘরে এমনি পুরোনো নীতিনিয়মের ভিতরে মেয়েটি এমন আকস্মিকভাবে দেখা দিল যে, চমকে উঠল চিন্ময়। যেন বটতলার রামায়ণের ভিতর থেকে হঠাৎ আবিষ্কার করা গেল অবনীন্দ্রনাথের একখানা ছবি।
কী ছিল মেয়েটির চেহারায়? চিন্ময় আজও সেকথা জানে না। ভোরের তারার মতো আলো-অন্ধকার জড়ানো চোখ, হালকা মেঘে-ছাওয়া জ্যোৎস্নার মতো শরীর, ঠোঁটের কোণে নিঃশব্দ কান্নার মতো কী-একটা মাখানো।
এক বার রমাপ্রসাদবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখল চিন্ময়। বাহুল্যহীন বেঁটেখাটো চেহারা, মোটা মোটা হাতের আঙুল, পলা-বসানো রুপোর আংটি একটা, মোটা নাকের তলায় সযত্নে কাঁচিছাঁটা গোঁফ। এঁরই মেয়ে! ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।
বলাইদা কী দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করল, ভালো করে শুনতেও পেল না চিন্ময়। মাত্র কয়েক পলক দেখার রঙে মনকে রাঙিয়ে নিয়ে বসে রইল স্বপ্নবিহ্বলের মতো।
দশ-পনেরো-বিশ মিনিট। বলাইদার বেসুরো গলায় ঘোর কেটে গেল। আজ আমরা তবে
আচ্ছন্নের মতো বেরিয়ে এল চিন্ময়। শুধু এক বারের জন্যে মাথা তুলে দেখল ইউক্যালিপ্টাস গাছটাকে। পড়ন্ত দিনের ছাইরং লালচে আকাশের দিকে একগুচ্ছ শীর্ণ পাতার অঞ্জলি। খেয়ালের মতো তার মনে হল, ওই গাছটার কী-যেন একটা মানে আছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে, কিছুটা বোঝা যাচ্ছে না।
ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে বলাইদা বললে, কেমন দেখলি?
ভালো লাগল। আমি রাজি আছি।
হুঁ! বলাইদা এক বার তাকাল চিন্ময়ের চোখের দিকে, সেই পুরোনো নিয়মেই হয়তো কোনো একটা রসিকতা করতে চাইল, কিন্তু তারপরেই আর কথা খুঁজে পেল না। বলাইদাও কি ওই ইউক্যালিপ্টাস গাছটাকে দেখতে পেয়েছে? সেও কি একটা মানে বুঝতে চাইছে মনে মনে?
সেই ছায়া তাকে চিঠি লিখেছে। সেই মেয়েটি।
সেদিন ছায়ার মতোই পা জড়িয়ে জড়িয়ে ঢুকেছিল ঘরে। থেমে-যাওয়া সেতারের ঝংকারের মতো কী-একটা বয়ে এনেছিল নিজের সঙ্গে। সেই ছায়া কী কথা তাকে বলতে চায়। ফিকে নীল এক টুকরো কাগজে মাত্র তিনটি সংক্ষিপ্ত লাইনে কোনো আশ্চর্য সংবাদের সংকেত লুকিয়ে রয়েছে।
চিন্ময় উঠে বসল। সাড়ে তিনটে। বাইরে ক্ষুরের ফলা রোদ এখনও। রাস্তায় হাঁপিয়ে চলা ট্রাম-বাসের ম্যারাথন রেস। ফুটপাথ ঘেঁষে পড়ে থাকা পিচ-জ্বালানো কদাকার গাড়িটা থেকে উগ্র বিস্বাদ গন্ধ। ওপাশের বাড়িটার তেতলার কার্নিশে একটা দুঃসাহসী সাদা-কালো বেড়ালের থাবা চেটে চেটে প্রসাধনের চেষ্টা।
চিন্ময় থাকতে পারল না। জামা চড়িয়ে, চটিটা পায়ে টেনে আবার নেমে এল রাস্তায়। উঠে পড়ল চৌরঙ্গির ট্রামে। আর এক বার ইচ্ছে হল পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে পড়ে নেয়; কিন্তু দরকার ছিল না, নির্ভুলভাবে লেখাটা মুখস্থ হয়ে গেছে।
চৌরঙ্গির একটা চায়ের দোকানে খানিকটা সময় কাটল। আরও খানিক সময় কাটল বইয়ের স্টলে এলোমেলো পাতা উলটে। তারপর ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে পায়ে হেঁটে চাঁদপাল ঘাটের কাছে যখন পৌঁছুল, তখন সাড়ে পাঁচটার কাছাকাছি।
আরও–আরও আধ ঘণ্টা।
রেললাইনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দেখল নোঙর-ফেলা নিথর জাহাজগুলোকে। দেখল গঙ্গার স্রোতে ভেসে গাংশালিকের খেলা আর ফেরি-লঞ্চের আনাগোনা। তারপর হাতের ঘড়িতে যখন ছ-টা বাজতে দশ মিনিট, তখন এসে দাঁড়াল ট্রামস্টপের সামনে। এতক্ষণে মাথার দু ধারে রগ দুটো আবার দপ দপ করতে শুরু হয়েছে, হাতের নাড়িতে আবার উত্তেজিত জ্বরের স্পন্দন।
ছায়া এল ছ-টার তিন মিনিট আগেই।
চিন্ময় ভেবেছিল, হয়তো চিনতে পারবে না। হয়তো আভাসের মতো যাকে দেখেছে, এই মুহূর্তে তাকে সম্পূর্ণ অপরিচিত বলে মনে হবে। আর ছায়াই কি দেখেছে তাকে? তার দিকে চোখ তুলেই কি তাকিয়েছে একটি বারের জন্যেও?
তবু দুজনেই দুজনকে চিনতে পারল সঙ্গে সঙ্গেই। সংকোচ নেই, দ্বিধা নেই, জড়তা নেই। আশ্চর্য স্বাভাবিক গলায় ছায়া বললে, অনেকক্ষণ এসেছেন?
হার স্বীকার করল না চিন্ময়। মিথ্যে কথাই বললে।
মিনিট পাঁচেক।
কোনো কাজের ক্ষতি হয়নি আপনার?
না, কিছু না।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ছায়া। সেই পুরোনো ঘরটার মতোই আলো-অন্ধকার এখানে। আরও নিবিড়, আরও সংকেতিত। খানিকটা চেনা যায়, অনেকটা চেনা যায় না। উত্তেজনায় টানটান স্নায়ু। প্রত্যেকটা মুহূর্ত খরমুখ। চিন্ময় সইতে পারল না।
কেন ডেকেছিলেন আমাকে? ছায়া মুখ তুলল। আধবোজা চোখ মেলে ভালো করে তাকাল কি না বোঝা গেল না।
চলুন, বসি কোথাও।
ইডেন গার্ডেনে?
ঘাটের জেটিতেই চলুন। চিন্ময় বুঝল। একেবারে একান্ত হতে চায় না। ইডেন গার্ডেনের ঘন ঘাসের নির্জনতায় নয়, এক-আধজন কাছাকাছি থাকুক, নিভৃতির ভিতরেও থাকুক লৌকিক সৌজন্য।
তাই চলুন তবে।
বেঞ্চিগুলোতে জায়গা ছিল না। জেটির বাঁ-দিকে নীচু পন্টুনের উপর যেখানে জোড়া অজগরের মতো দুটো জলের পাইপ এসে নেমেছে, পায়ে পায়ে দুজনে এগিয়ে গেল সেখানেই।
এখানে কোথায় বসবেন? চিন্ময় প্রশ্ন করল।
কাঠের উপরেই বসা যাক। খানিক দূরে নোঙর ফেলা দুটো জাহাজের ভূতুড়ে গম্ভীর মূর্তির দিকে তাকিয়ে ছায়া বললে, আপনার অসুবিধে হবে না?
না।
দুজনে বসল। এপারে আলো, ওপারে আলো, মাঝখানে কালো গঙ্গা। ডান দিকে অনেক দূরে হাওড়া ব্রিজের বৈদ্যুতিক সরলরেখা। যেন একটা তারার বল্লম দিয়ে এপার-ওপার গেঁথে রেখেছে কেউ।
ছায়াই শুরু করল, এবং বিনা ভূমিকাতেই।
ক্ষমা করবেন। আমার নাম ছায়া নয়।
চিন্ময় চমকে উঠল। যেন কথাটা শুনতেই পায়নি, কী বলছেন?
আমার নাম ছায়া নয়, বন্দনা।
নির্বোধের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে রইল চিন্ময়। বললে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
বন্দনা আস্তে আস্তে বললে, বোঝাটা কিছু শক্ত নয়। আপনি ছায়াকে দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছায়া কালো, ছায়া কুৎসিত। তার কপালে একটা ধবলের দাগ। তাই ছায়ার ভূমিকায় আমাকেই অভিনয় করতে হয়েছে।
গঙ্গার কালো জলে একটা স্টিমারের কর্কশ বাঁশি বাজল, কয়েকটা লাল-নীল আলো ভেসে চলল কাঁপতে কাঁপতে। চিন্ময়ের মনে হল পন্টুনটাও কাঁপছে তার সঙ্গে সঙ্গে, দুলছে। ওপারের আলোগুলো, হাওড়া ব্রিজের তারার বল্লমটা থেকে থেকে বেঁকে যাচ্ছে ধনুকের মতো।
একটা অস্ফুট শব্দ করল চিন্ময়।
গল্পের মতো মনে হচ্ছে, তাই না? বন্দনার গলাটা যেন গঙ্গার ওপার থেকে শুনতে পেলচিন্ময়। আমাকে দেখিয়ে ওঁরা ছায়ার সঙ্গে আপনার বিয়ের ব্যবস্থা করছিলেন।
চিন্ময় নড়ে উঠল।
আপনি ঠাট্টা করছেন তো?
ঠাট্টা করবার মতো পরিচয় কি আপনার সঙ্গে আছে আমার? শীতল নিষ্প্রাণ স্বরে বন্দনা জবাব দিলে।
সত্যিই, সে-পরিচয় নয় বন্দনার সঙ্গে। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্যে দেখেছিল। তাও কয়েক বার চোরের মতো তাকিয়েছিল সভয়ে। না, বন্দনা ঠাট্টা করছে না।
গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়াতেও চিন্ময় ঘামতে লাগল।
কিন্তু বিয়ের সময়ই তো ধরা পড়বে সব। তখন যদি…
উঠে আসেন বাসর থেকে? চিন্ময়ের কথাটা বন্দনাই কুড়িয়ে নিলে, পাড়ার ছেলেদের আপনি চেনেননি চিন্ময়বাবু। আপনি কি আশা করেন যে, কন্যাদায়গ্রস্ত ভদ্রলোককে বিপদে ফেলে আপনি পালিয়ে আসবেন আর তারা আদর করে একখানা ট্যাক্সি ডেকে দেবে আপনাকে?
দাঁতে দাঁত চেপে খানিক নিথর হয়ে রইল চিন্ময়। হঠাৎ নিজের ডান হাতে একটা বন্য বর্বর শক্তি যেন অনুভব করল সে। ম্লান আলোয় এক ফোঁটা শিশিরের মতো পোখরাজের আংটিটা জ্বলছে বন্দনার আঙুলে, ইচ্ছে করলে ওই আঙুলটাসুদ্ধ বন্দনার ছোটো মুঠোটাকে এক্ষুনি সে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলতে পারে।
হিংস্র কিছু না করে কেবল কপালের ঘামই মুছে ফেলল চিন্ময়। শুকনোভাবে জিজ্ঞাসা করলে, কিন্তু আপনি কেন একাজ করতে গেলেন? আপনি কি ওঁদের আত্মীয়া?
প্রশ্নটার জন্যে বন্দনা অপেক্ষা করছিল। আবার ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল। চোখ দুটো
দেখা গেল না, তারা অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
সেকথা থাক। নাই-বা শুনলেন।
অভিনয় করেছিলেন, ভালোই করেছিলেন। চিন্ময় বিষাদহাসি হাসল, কিন্তু একথাগুলো কেন বলতে এলেন আমাকে? এটুকু অনুগ্রহ করার কী দরকার ছিল?
আকস্মিকভাবে উঠে দাঁড়াল বন্দনা।
আজ আমি যাই চিন্ময়বাবু। আবার সর্বাঙ্গে সেই ক্রুদ্ধ হিংস্রতার বিদ্যুৎ বয়ে গেল চিন্ময়ের। দাঁড়িয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গেই।
জবাব দিলেন না?
কী হবে জবাব দিয়ে? আপনি বুঝবেন না। যাবার জন্যে পা বাড়াল বন্দনা। চিন্ময়ের অবাধ্য হাতটা এবারে আর শাসন মানল না। নগ্ন নির্লজ্জ ক্রোধে বন্দনার মুঠোটা চেপে ধরল মুহূর্তের মধ্যে। থরথর করে বন্দনা কেঁপে উঠল এক বার, তারপরেই পাথর হয়ে গেল।
কী করছেন আপনি? পাগল হয়ে গেলেন? হাত ছেড়ে দিল চিন্ময়, কিন্তু তার চোখ দুটো বুনো জন্তুর মতো জ্বলছে তখন।
চুলোয় যাক ছায়া, অধঃপাতে যাক। আপনি আমায় বিয়ে করতে পারেন?
এর জন্যেও কি প্রতীক্ষা করেছিল বন্দনা? সে-ই জানে। অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক স্বরে বললে, আমি কে, আমার কী পরিচয়, আপনি জানেন?
জানবার দরকার নেই। বিয়ে করবেন আমাকে?
কোথা থেকে চলন্ত স্টিমারের একটা দীর্ঘ রশ্মি এসে ছড়িয়ে পড়ল বন্দনার মুখে। সেই ভোরের তারার মতো ম্লান আচ্ছন্ন তার চোখ, ঠোঁটের কোণে সেই বিষণ্ণতার মায়া-মাখানো। বন্দনা আস্তে আস্তে বললে, না।
হাওড়ার ব্রিজ একটা তারার বল্লমের মতো গঙ্গার এপার-ওপারকে গেঁথে রেখেছে। জাহাজ দুটো দাঁড়িয়ে আছে অবাস্তব ফ্যান্টাসির মতো। দু-দিকের এত আলোর ভিতরে গঙ্গার জলটা কী অবিশ্বাস্য রকমের কালো!
চিন্ময় বললে, আচ্ছা আপনি যান। যে-উপকারটুকু করলেন, অনেক ধন্যবাদ সেজন্যে।
তবু যাওয়ার আগে বন্দনা আরও কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে রইল। কী-একটা বলতে গিয়ে বার কয়েক কাঁপতে লাগল তার ঠোঁট।
আশা করি, রমাপ্রসাদবাবুকে…
আমি জানি, বন্দনার উপস্থিতি এবার অসহ্য মনে হতে লাগল চিন্ময়ের, আপনাকে বলতে হবে না। আপনি যান।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বন্দনা। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চিন্ময় এবার ধপ করে হিমশীতল একটা পাইপের উপরেই বসে পড়ল। সারাদিনের উত্তেজনার টানটা ছিঁড়ে গেছে, শরীরে একটা গুরুভার অবসাদ নেমে এসেছে। ভূতুড়ে জাহাজ দুটোর দিকে বিমর্ষ দৃষ্টি ফেলে বসে রইল সে, পাইপের মুখ থেকে ঝিরঝির করে জল নেমে এসে তার জুতোর তলাটা একটু একটু করে ভিজিয়ে দিতে লাগল।
দু-বছর পরে আবার মেয়ে দেখতে যেতে হল চিন্ময়কে, মুনসেফির নমিনেশন পাওয়ার পরে। এবার রাঁচিতে। কিন্তু জাল-জুয়াচুরির কোনো ভয় ছিল না। মেয়ের বাপ বড়োদরের সরকারি চাকুরে। হাজারিবাগ রোডে প্রকান্ড বাংলো। হাল আমলের ড্রয়িং রুমে অত্যন্ত নিঃসংকোচভাবেই মুখোমুখি এসে দাঁড়াল সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়েটি। টি-পট থেকে চা ঢেলে দিলে চিন্ময়ের পেয়ালায়, রাঁচির আবহাওয়া নিয়ে গল্প করল, গান শোনাল অর্গান বাজিয়ে।
এবার বলাইদা নয়, অন্য দুটি বন্ধু ছিল সঙ্গে।
বাইরে বেরিয়ে লঘু ঈর্ষাভরা গলায় ব্যোমকেশ বলল, তুই ভাগ্যবান রে!
চিন্ময় মৃদু হাসল, তাই মনে হচ্ছে আপাতত। তবে শেষপর্যন্ত জাল না হলেই বাঁচা যায়।
বন্ধুরা ভেঙে পড়ল অট্টহাসিতে, সেই বন্দনা? না না, এবার আর সে-ভাবনা নেই।
চাঁদপাল ঘাটের সেই সন্ধ্যাটা সহজে ভুলতে পারা যায়নি। একটি সূক্ষ্ম বেদনা থেকে থেকে মনের মধ্যে বেজে উঠত, তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে গল্পটা বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলে চিন্ময়। ক্রমেই ব্যাপারটা কৌতুকের রূপ নিলে।
চেনা-জানা কেউ কনে দেখতে গেলেই একজন আরেকজনকে সাবধান করে দেয়, জাল কি না ভালো করে যাচাই করে নিয়ে হে। সব মেয়েই তো বন্দনা নয় যে আগ বাড়িয়ে এসে উপকার করে যাবে।
খুশিতে চঞ্চল হয়ে এগিয়ে চলল তিন জন। ফাল্গুন মাসের চমৎকার সকাল। মিষ্টি ঠাণ্ডা, মিষ্টি রোদ। ঝিলমিল পাতা আর পাখির ডাক।
অমল বললে, কথা তো একরকম দিয়েই এলি দেখছি।
একটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্ময় বললে, কী আর করা যায়? মা আলটিমেটাম দিয়েছেন। আসছে বৈশাখ মাসের মধ্যে বিয়ে না করলে তীর্থযাত্রায় বেরুবেন। সে যাক, আজই ফিরবি নাকি কলকাতায়?
ব্যোমকেশ গালের পাশ থেকে পাইপটা বের করে আনল, এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? থেকে যাই আর একটা দিন। চল, আজ বেরিয়ে আসি হুড্র থেকে।
হুড্র? বার দশেক দেখেছি, পুরোনো হয়ে গেছে।
ব্যোমকেশ বললে, ইডিয়ট! হুড্র কখনো পুরোনো হয় না। ওর যে কী-একটা আশ্চর্য সৌন্দর্য আছে, যখনই দেখি, তখনি মনে হয় এভারনিউ! চল, গাড়ির জোগাড় করি।
খাওয়া-দাওয়ার পর তিন জনে বেরুল ট্যাক্সি নিয়ে।
হুড্রতে যখন গাড়ি পৌঁছুল তখন মনটা যেন দশ বছর পেছিয়ে গেছে ওদের।
ব্যোমকেশ বললে, হাউ লাভলি!
অমল বললে, দূর, একা একা এ ভালো লাগে না এখানে। সঙ্গে ফিয়াঁসি না থাকলে কেমন ফিকে ফিকে লাগে যেন।
ব্যোমকেশ পাইপটা গালের একপাশে ঠেলে দিলে। তারপর চোখের একটা ভঙ্গি করে বলল, দেয়ার ইজ এ চান্স ফর ইউ। পারো তো পিক-আপ করে নাও-না।
চিন্ময় আর অমল তাকিয়ে দেখল। ছোটো-বড়ো পাথরের মধ্যে দিয়ে টাল খেতে খেতে সুবর্ণরেখার রুপালি জল যেখানে এসে নীচের শূন্যতায় ঝাঁপ দিয়েছে, ঠিক প্রায় তারই কাছাকাছি নিথর হয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। মগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে ওধারের কালো পাহাড় আর কালো জঙ্গলের দিকে।
চিন্ময়ের পা দুটো যেন পাথরের মতো আটকে গেল। তৎক্ষণাৎ আবছা স্বরে চিন্ময় বললে, বন্দনা! বন্দনা!
ব্যোমকেশের মুখ থেকে টপ করে পাইপটা নীচে পড়ে গেল, যেন সামনে সাপে ফণা তুলেছে এমনিভাবে লাফিয়ে উঠল অমল।
পাইপটা কুড়িয়ে নিয়ে ব্যোমকেশ বললে, চল, আলাপ করি।
এতক্ষণের খুশিটা দপ করে নিবে গেছে একটা দমকা হাওয়ায়। আবার দপ দপ করছে। কপালের রগগুলো। দু-বছর আগেকার চাঁদপাল ঘাটের সন্ধ্যাটা ফিরে এসেছে, ডান হাতে ছটফট করছে সেই বন্য হিংস্র শক্তিটা।
ভুল হয়ে গিয়েছিল, সেদিন অত সহজেই ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল না বন্দনাকে। অনেক নিদ্রাহীন রাত্রে দুঃসহ অন্তজ্বালায় সেকথা ভেবেছে চিন্ময়, মনে হয়েছে একটা নিষ্ঠুর কঠিন কিছু তার করা উচিত ছিল সেদিন। শক্ত মুখে চিন্ময় বললে, না।
পুরোনো আলাপটা ঝালিয়ে নিবি না? অমল হাসল, আবার পাত্রী দেখতে এসেছিস, সে-খবরটা দিবিনে ওকে?
দরকার নেই। চল নীচে নামি।
বন্ধুরা কিছু-একটা বুঝল, রসিকতা করতে গিয়ে সেদিনের বলাইদার মতোই থমকে গেল ব্যোমকেশ। নামতে শুরু করল তিন জন।
কিন্তু হাত কয়েক নেমেই থমকে দাঁড়াল চিন্ময়।
তোরা ঘুরে আয়। আমি উপরেই রইলাম।
ব্যোমকেশ আর অমল মুখ চাওয়াচাওয়ি করল এক বার। নেমে গেল নিঃশব্দে।
চিন্ময় যখন ফিরে এল, তখনও সেইভাবেই মগ্ন হয়ে বসে আছে বন্দনা যেন স্বপ্ন দেখছে। পায়ে পায়ে চিন্ময় এগিয়ে গেল।
শুনুন?
হুড্রুর তীব্র গর্জনের মধ্যেও ডাকটা শুনতে পেল বন্দনা। ফিরে তাকাল চিন্ময়ের দিকে।
চিনতে পারেন? কঠিন মুখে আবার প্রশ্ন করল চিন্ময়।
পারি বই কী। বন্দনা শ্রান্ত হাসি হাসল, আপনি ভোলবার নন। কিন্তু এখানে আপনাকে আশা করতে পারিনি।
বিনা নিমন্ত্রণেই পাশের পাথরটার উপর বসে পড়ল চিন্ময়। বললে, রাঁচিতে মেয়ে দেখতে এসেছিলাম। চমৎকার পাত্রী। তা ছাড়া এবার আর ডুপলিকেটের ভয় নেই।
নেই নাকি? বন্দনা তেমনি ক্লান্তভাবে হাসল, যাক, খুশি হলাম। চিন্ময় আশ্চর্য হল। কথাটার একটা প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল, ভেবেছিল অন্তত এক বারের জন্যেও চকিত হয়ে উঠবে বন্দনা, অন্তত অপমানের এক ঝলক রক্তের উচ্ছাস ফুটে উঠবে গালে। কিন্তু কিছুই ঘটল না। একখন্ড পাথরের মতোই নিরুত্তাপ বন্দনা।
কেমন যেন কুঁকড়ে গেল চিন্ময়, হঠাৎ অত্যন্ত ইতর মনে হল নিজেকে। একটা ঢোঁক গিলে বললে, আপনি এখানে যে?
বন্দনা বললে, দুটি পাতালের সঙ্গী জুটিয়েছি, পালিয়েছি তাদের সঙ্গে। বলছে বম্বেতে নিয়ে গিয়ে ফিলমে নামাবে। আপাতত দেখছি রাঁচিতে এনে হাজির করেছে, তারপরে কোথায় নিয়ে যাবে জানি না।
মাথার উপর একটা শক্ত পাথর দিয়ে যেন ঘা মারল কেউ। আকস্মিক যন্ত্রণায় বিবর্ণ হয়ে গেলচিন্ময়, পাগল হয়ে গেছেন আপনি? সেদিন যেকথা বন্দনা জিজ্ঞাসা করেছিল, আজ ঠিক সেই প্রশ্নই বেরিয়ে এল চিন্ময়ের মুখ দিয়ে।
একটা ছোটো নুড়ি তুলে নিয়ে একরাশ ফেনিল জলের মধ্যে ছুড়ে দিলে বন্দনা।
কী করব বলুন? বাবা কালো, মা কুৎসিত, হঠাৎ কোত্থেকে জন্ম হল আমার!
বন্দনার মুখটা বিকৃত হয়ে গেল, বাবা কদর্য সন্দেহ করলেন মাকে। সে-সন্দেহ আরও বীভৎস হয়ে উঠল যখন পর পর ছায়া আর কমলা জন্মাল বাবার ঠিকে মিল দিয়ে। শেষপর্যন্ত মাকে আত্মহত্যাই করতে হল, আর বাবা তাঁর সমস্ত প্রতিশোধ নিলেন আমার উপর। লেখাপড়া শেখালেন না, যারা দু-একজন আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, জঘন্য অশ্লীল চিঠি লিখে ভাংচি দিলেন তাদের। তারপর থেকে বাবার দুটি খাঁটি কন্যার জন্যে আমাকে সিটিং দিতে হয়েছে। ছায়া, কমলা দুজনকেই পার করেছেন বাবা। যদিও ছায়ার স্বামী দু-দিন পরেই ছায়াকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, তবু তো কন্যাদায় উদ্ধার হয়েচে ওঁর!
চিন্ময় স্থবিরের মতো বসে রইল। রক্তে যে-উত্তাপ জেগেছিল, তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই আর, এখন মেরুদন্ড দিয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বইছে, একটা তীব্র আকস্মিক শীতে জমে যেতে চাইছে আঙুলগুলো।
লেখাপড়া শিখিনি, তবু একটা প্রাইমারি স্কুলে অ আ ক খ-র চাকরি জুটিয়েছিলাম। বাবার একখানা বেনামি চিঠিতেই সে-চাকরি গেল। ফিলমে নামতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কনে দেখার আড়ষ্ট ভূমিকাটাই অভ্যেস আছে—চলল না। নার্স হতে গেলাম, সেখানেও বাবা কী মন্ত্র পড়লেন তাড়িয়ে দিলে আমাকে। শুধু অধঃপাতের দরজাই দরাজ ছিল সবসময়ে, কিন্তু মা-র যন্ত্রণাভরা মুখ ভুলতে পারিনি তখনও। কিন্তু আর থাকা গেল না। মা বেঁচে থাকতেই বাবা নতুন সংসার করেছিলেন, দ্বিতীয় পক্ষের ট্যারা মেয়ে কেয়া পনেরোয় পা দিয়েছে, আবার আমায় কেয়ার পার্ট শুরু করতে হবে। তাই পাড়ার দুটো নামকরা ছেলের সঙ্গেই পালাতে হল শেষপর্যন্ত।
মেরুদন্ডের মধ্যে ঠাণ্ডা স্রোতটা বরফ হয়ে গেছে চিন্ময়ের। কনকনে শীতে দাঁতগুলো ঝনঝন করে উঠছে। চিন্ময় অস্পষ্ট গলায় বললে, তারা কোথায়?
নীচে নেমেছে প্রায় তিন ঘণ্টা আগে। সঙ্গে ফ্লাস্ক ছিল। এখন মনে হচ্ছে মদ ছিল তাতে। পায়ে একটা ব্যথার জন্যে আমি নামতে পারিনি, আপাতত বেঁচে গেছি ওদের হাত থেকে। কিন্তু আজ না হোক কাল আছে, কালের পর পরশু আছে, ওরা তা জানে।
বন্দনা উঠে দাঁড়াল। চিন্ময় বন্দনার দিকে তাকাল কিন্তু মুখটা দেখতে পেল না। হঠাৎ যেন ওর মাথাটা মুছে গেছে। সামনে দাঁড়িয়ে একটা মুন্ডহীন শরীর, একটা বীভৎস কবন্ধ।
আকস্মিক অর্থহীন ভয়ে তীব্র চিৎকার করলে চিন্ময়। সেই চিৎকারে বন্দনা চমকে পিছিয়ে গেল, সেখান থেকে পিছলে পড়ল দু-হাত দূরে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আবার টলে পড়তে গেল সেখানে যেখানে একরাশ ফেনিল জল সোজা নীচের বিপুল শূন্যতায় ঝাঁপ দিয়েছে।
চকিতে দৃষ্টিটা স্বচ্ছ হয়ে গেছে চিন্ময়ের, রক্তের মধ্যে হঠাৎ বরফ-গলানো সূর্য জ্বলে উঠেছে।
মুহূর্তের জন্যে শুনল প্রপাতের রাক্ষসগর্জন, দেখতে পেল বন্দনার চোখে-মুখে মৃত্যুর আসন্নতা।
প্রাণপণ শক্তিতে দু-হাত বাড়িয়ে অনিবার্য রসাতল থেতে বন্দনাকে টেনে আনল চিন্ময়। প্রায় মূৰ্ছিত বন্দনাকে বুকের মধ্যে আশ্রয় দিয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললে, আপনি আমার সঙ্গেই কলকাতায় ফিরে যাবেন। আজকেই।