প্রদীপের নীচে – বিধায়ক ভট্টাচার্য

প্রদীপের নীচে – বিধায়ক ভট্টাচার্য

প্রদীপের নীচে থাকে অন্ধকার, কিন্তু সে অন্ধকার আঁধি নয়—আলোর ছলনার পরিপ্রেক্ষিতে আলোহীনের ভূমিকা সেটা।

সমগ্র কাহিনীর প্রাণকেন্দ্র সেখানে।

প্রদীপের আলোর ঠিক নীচে, অন্ধকার যেখানে আলোর ওপিঠ হয়ে চোখ বুজে আছে, সেখানকার নিরাপদ নির্ভরতায় বাস করে আমাদের ক্রিমিন্যাল। সেখানে পৌঁছোতে হলে যাত্রা করতে হবে আলোর মধ্য দিয়ে—সন্দেহের চোরাবালি সে পথে, চেনা মুখের অচিন—লোক সেটা।

তাই—

প্রদীপের নীচের অন্ধকারে অপরাধী নেই, আছে আলোর কালোতে। সেইখানেই খুঁজতে হবে তাকে।

রাত্রি একটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ।

নিঝুম নিশুতি রাত। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের লম্বা রাস্তা দিয়ে একখানি মোটর সাইকেল ভট ভট করে আওয়াজ করে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে। পথের আলোগুলো একচোখো দানবের মতো একদৃষ্টে চেয়ে আছে। গাড়িখানি চলেছে কলকাতা থেকে ব্যারাকপুরের দিকে। কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে এসেছে কিছুক্ষণ। পোশাক দেখে মনে হয় মোটর সাইকেল—এর আরোহী একজন পুলিশ অফিসার।

হঠাৎ পাশের একখানা অন্ধকার বাড়ির তিনতলায় আলো জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে নারীকণ্ঠের একটি আর্তনাদ শোনা গেল। গাড়ি থামিয়ে অফিসার একবার চাইলেন বাড়ির দিকে। তারপর গাড়িটাকে ফুটপাথে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে গিয়ে বাড়ির দরজায় ঘা দিলেন। স্তব্ধ রাতে কড়া নাড়ার আওয়াজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠল।

খুট করে একটু আওয়াজ হল। দরজাটা একটু ফাঁক হল। একটা গোঁফওলা কুৎসিত মুখ দেখা গেল সেই ফাঁকে। ফিসফিস আওয়াজ : কি চাই?

তার মুখের ওপর তীব্র টর্চের আলো ফেলে অফিসার বললেন, আমি একবার ভেতরে যাব।

—কিছু নেই ভেতরে। কালো মুখ বলল।

—তবু যাব—দরজা খোল। বললেন অফিসার।

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজাটা আর একটু খুলে গেল। অফিসার সেই পথেই জোর করে ঢুকে পড়লেন। একটু চুপচাপ…দরজা বন্ধের শব্দ…একটু ধস্তাধস্তি…দুটি—তিনটি অস্ফুট আর্তনাদ…নির্জন বি—টি রোড আরও নির্জনতর হল।…

লাউডন স্ট্রিটের প্রখ্যাত শিল্প—ব্যবসায়ী মনোতোষ মান্নার একমাত্র কন্যা ও উত্তরাধিকারিণী রুমা বেরিয়ে এল তার শোবার ঘর থেকে, সেইদিনকার ইংরিজি কাগজখানা হাতে করে। ড্রয়িংরুমে প্রাতরাশ আহাররত পিতাকে বলল, দেখেছ, বাপী আজকের কাগজ? পুলিশ অফিসার মিস্টার মণ্ডল খুন হয়েছেন। আর আমার সেই বান্ধবীকে তোমার মনে আছে? সেই যে রত্না মজুমদার? এই দেখ তার ছবি বেরিয়েছে—সে নাকি মৃত মণ্ডলের পাশে বসে বিড় বিড় করে কি বকছিল!

—সেকি! কবেকার ঘটনা? মিঃ মান্না সবিস্ময়ে বললেন।

—পরশু রাত্রে। এই দেখ কাগজে বেরিয়েছে।

মনোতোষবাবু কিছুক্ষণ কাগজে চোখ রেখে আস্তে আস্তে বললেন, সত্যি, এ ভারি চিন্তার কথা হয়ে পড়ল তো! প্রকাশ্যে কলকাতা এবং তার আশপাশ থেকে যেভাবে মেয়ে চুরি শুরু হয়েছে, তাতে তো আর—অথচ আমি জানি, পুলিশ এই কেস নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে।

—চুরিও করছে এরা মেয়ে বুঝে বাপী! কই আমায় করুক তো চুরি!

—ডোন্ট সে দ্যাট, —ডার্লিং!

‘চা—কোণ’ রেস্তোঁরা।

শহরের আধা—অভিজাত জায়গা। ফরাসি পদ্ধতিতে সাজানো না হলেও উক্ত প্রণালীতে বসবার ও পরিবেশন ব্যবস্থা। এইখানে চারটি যুবক নিয়মিত যাতায়াত করে। একজন ডাক্তার, একজন কবি, একজন গাইয়ে, একজন ফুটবল খেলোয়াড়। আশ্চর্যের ব্যাপার—চারজনেই বাংলাদেশের নামকরা ছেলে। প্রথমে পরিচয় ছিল না, পরে একে একে চারজনই অন্তরঙ্গ হয়ে দাঁড়াল।

এই চারটি ছেলেই রুমার বাড়িতে যাতায়াত করে এবং সকলেই তার পাণিপ্রার্থী। অবশ্য উদ্দেশ্য প্রত্যেকেরই একটা আছে। ডাক্তার ভাবে—বিয়ে হলে বর—পণের টাকা দিয়ে একটা বিরাট ডিসপেনসারি করবে। চিকিৎসার আধুনিকতম যন্ত্রপাতি আনাবে। কবি ভাবে—একটা নিজস্ব প্রকাশনী খুলে, অপূর্ব বাঁধাই দিয়ে নিজের কাব্য ছাপাবে। গাইয়ে ভাবে—সে একটা গানের ইস্কুল খুলবে। এর মধ্যে ফুটবল খেলোয়াড়ই কিছু ভেবে স্থির করতে পারেনি, সে কেবল রুমার কথাই ভাবে। মনে হয় রুমাও একথা জানে—তাই তার গভীর পক্ষপাতিত্ব এই ফুটবলারের ওপর। ফুটবল খেলোয়াড়ের নাম— সোনা সরকার, কবির নাম—স্বপন সেন, গাইয়ের নাম—নীলেশ দাস, আর ডাক্তারের নাম বিধু ব্যানার্জি, অর্থাৎ ডক্টর ব্যানার্জি।

এই সঙ্গে প্রত্যেকের স্বভাবটা বলা দরকার, নইলে পরে অসুবিধে হবে। ফুটবলার সোনা সরকার হচ্ছে ‘হ্যাপি গো লাকি’ মানুষ অর্থাৎ ‘ভালোমন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে’ গোছের। তার এই বেপোরোয়া ভাবটি অত্যন্ত ভালো লাগে বলেই রুমা তার প্রতি আসক্ত। স্বপন সেন কবি। তার বুকের মধ্যে সর্বদাই ছলছল করে। চাঁদ উঠলে, হাওয়া বইলে অর্থাৎ একটু নতুন রকম কিছু দেখলেই তার কাব্যের তরঙ্গ আসে। পাশে থাকে নীলেশ সুর লাগিয়ে গায়। নীলেশ ক্লাসিকাল গাইয়ে। সে অথরিটি কোট না করে কোনো কথা বলে না। আর সবশেষে হল ডাক্তার ব্যানার্জি—কম কথা বলে, অত্যন্ত হিসেবি, প্রাপ্তি না থাকলে কোনো কাজ করে না। এমন কি যেখানে তার ভিজিট পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখান থেকে আসবার সময় কিছু একটা হাতে নিয়ে চলে আসে। সে বস্তু লাউ, কুমড়ো, ফাউন্টেন পেন—যাই হোক না কেন!

এই হল চার বন্ধুর ইতিবৃত্ত। এবার রুমা সম্বন্ধে একটু কথা বলে আমরা মূল গল্পে ফিরে যাব।

মনোতোষ মান্নার প্রচুর অর্থ। ব্যবসা করে এই টাকা তিনি অর্জন করেছেন। পৃথিবীর বহু দেশে তাঁর ব্যবসার শাখা অফিস আছে। এমন কি চিন, জাপান, মালয়, জাভা, সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা সর্বত্র তাঁর প্রতিনিধি আছে। বিরাট বাড়ি; বিপত্নীক হয়েছেন প্রথম যৌবনে। একমাত্র কন্যা রুমাকে তাঁর অদেয় কিছু নেই। এমনি চলাফেরার অবাধ অধিকার তো তাকে দিয়েছেনই, এ ছাড়াও দিয়েছেন স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্ষমতা! ফলে বাপের কাছে মেয়ের কিছুই গোপন নেই। শুধু একটি বিষয় সে পিতাকে বলতে পারেনি যে, সে ফুটবলার সোনা সরকারের প্রণয়াসক্ত। আজ নয়, অনেক দিন আগে থেকে। সে আর এক ইতিহাস।

বাপের কাছে বসে প্রাতরাশ খেতে খেতে বলল রুমা : আচ্ছা বাবা! এই যে মেয়ে চুরি হচ্ছে—? কী করে এরা এসব মেয়েদের নিয়ে গিয়ে?

—পুলিশের রিপোর্টে যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে এরা মেয়েদের বিক্রি করে। এটা একটা ব্যবসা। আমার তো মনে হয় মা, এদের ব্যবসা পৃথিবী জুড়ে চলেছে। এবং এদের পেছনে হয়তো এমন লোক আছে, যার নাম শুনলে সভ্য জগৎ হাঁ করে থাকবে।

দুজনেই নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ মনোতোষ বললেন, আমি কালকে একবার গোসাবা যাচ্ছি মা। দিন সাতেক দেরি হবে আমার।

—কেন? গোসাবা হঠাৎ?

—না। ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপার এটা। মানে রেগুলার একটা প্যাসেঞ্জার লঞ্চ চলাচল করবার প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছি—কুমার বাহাদুরের কাছে। দেখি কী হয়!

—কুমার?

—কুমার অরিজিৎ বর্মণ। এখন তিনি গোসাবায় আছেন। এই যুবক যেমন উচ্চশিক্ষিত, তেমনি সুদর্শন। পিতৃ—পিতামহের বিরাট জমিদারি পেয়েছেন। কাজেই ভাবনা—চিন্তার কিছু নেই। বছরের বেশির ভাগ সময় অবশ্য কলকাতাতেই থাকেন—এখন আছেন গোসাবায়।

—কোথায় জমিদারি?

—সুন্দরবনে। গোসাবা থেকে আরও একদিনের পথ। আরও নিবিড় বনের মধ্যে। কমলাঘাট হচ্ছে জায়গাটার নাম। লঞ্চ সেই অবধি যাবে।

—বাঘ আছে বাবা ওখানে?

—তা সুন্দরবনের অরণ্য—বিশেষ করে কমলাঘাটের কাছে—ওখানে বাঘ কেন, আরও অনেক কিছু আছে মা। সন্ধ্যার পর কেউ বেরোয় না বলে শুনেছি। যাই হোক, ক’টা দিন একটু সাবধানে থেকো মা। বিশেষ করে একলা কোথাও বেরিও না।

—আমায় চুরি! ইস!

—ইস নয় মা। এরা সত্যিই শক্তিশালী দল।

ফুটপাথের দিকে চেয়ে ‘চা—কোণ’ থেকে নীলেশ ডাকল, ডাক্তার! ও ডাক্তার!

বিধু ডাক্তার যাচ্ছিল ফুটপাথ দিয়ে ব্যাগ হাতে করে আর গলায় স্টেথেসকোপ ঝুলিয়ে। উঠে এল ‘চা—কোণে’। বলল, চায়ের দোকান থেকে ডাক্তার ডাক্তার বলে কেউ ডাকে নাকি? কবে যে তোর জ্ঞান হবে নীলেশ! ওতে প্রেস্টিজ ঢিলে হয় না?

—আরে লাও! বলল নীলেশ। তুমি যে সাধের ডাক্তার, তাতে চায়ের দোকান তো ভালো, এরপর জুতোর দোকান থেকে ডেকে ফেলবে কেউ!

—হ্যাঁ, ডাকলেই হল! চটে গিয়ে জবাব দিল বিধু। বসল এক বেঞ্চিতে। বলল, সনাতন! এক কাপ চা দেবে—

‘চা—কোণের’ খোঁড়া চাকর সনাতন হেসে বলল, দিচ্ছি বাবু। কাল আসেননি কেন?

—কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি তোর কাছে? আসিনি, বেশ করেছি! দাসখত লিখে দিয়েছি তোদের, যে রোজ আসতে হবে? বল, বল নীলেশ, ডাকলি কেন?

—শুধু কাল কেন—মাঝে মাঝেই তো আজকাল দু—চারদিন করে ডুব মারছো চাঁদু!

—না, মারবে না! তোমরা আমায় খেতে দেবে? বাজে কথা থাক! ডাকলি কেন?

—ভাবলাম…আজকের কাগজটা পড়েছ?

—না, কী আছে তাতে?

—ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে পুলিশ অফিসার মণ্ডল খুন হয়েছেন। আধ—পাগল অবস্থায় একটি সুন্দরী মেয়েকে পথে পাওয়া গেছে। সে মণ্ডলের বডির সামনে বসে বিড় বিড় করে কি সব বকছিল।

—মরেছে! পুলিশের ডেডবডির কাছে সুন্দরী মেয়ে বসে? এ যে বেশ রসাল হত্যাকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে স্বপন!

—হুঁ! স্বপন বলল অন্যমনস্ক ভাবে। বোধ হয় কবিতা ভাবছিল সে।

চা দিয়ে গেল সনাতন। চায়ে চুমুক দিতে লাগল বিধু।

—কোথায় চলেছিস এত ভোরে?

—আরে, একটা রুগি কাল সন্ধে থেকে ধুঁকছে। সকালে যাচ্ছিলাম, সে যাত্রা করেছে কিনা তাই দেখতে। যাই হোক, আমি তাহলে উঠি।

—আর একটু বসবি নে? সোনা হয়তো এসে পড়বে এক্ষুনি। বলল নীলেশ।

ঠিক এই সময় স্বপন কাগজটা পড়ছিল, সে বলে উঠল, নীলেশ! সেই যে দিন দশ—পনেরো আগে একটি মেয়ে চুরি গিয়েছিল—

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো রুমার বান্ধবী—

—হ্যাঁ। পুলিশ কিন্তু অনুমান করছে যে এই মেয়েটিই সেই হারানো রত্না মজুমদার। ও তো হস্টেলে থাকত। ওর বাপ—মাকে নাকি দিল্লিতে খবর দেওয়া হয়েছে।

—পাগল অবস্থাতেই চুরি যায়, না চুরি হবার পর পাগল হয়? কী লিখছে?

—সেসব কিছু লেখেনি। কিন্তু এও সেই মেয়ে—চুরির গ্যাং।

—হ্যাঁ, তাদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, যে বেছে বেছে মেয়ে—চুরি করতে যাবে? বলল বিধু।

—করবে বৈকি!

—করবে বৈকি! বিধু খিঁচিয়ে উঠল : কি করবে তারা মেয়ে চুরি করে?

—বিক্রি করবে! নীলেশ বলল।

—বিশ্বাস করি না। সুটকেস নিয়ে উঠে দাঁড়াল বিধু। হিরে—জহরত নয়, সোনা—রুপো নয়, নিদেন সুটকেস—ফাউন্টেন পেন নয় যে, মেয়ে পেলেই বিক্রি করবে। অতই সহজ কিনা!

—আরে ভাই, যারা এসব করে তাদের কাছে এসব ডাল—ভাত। বলল স্বপন।

ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকল সোনা। তাকে একটু চিন্তান্বিত দেখাচ্ছিল। সে এদের কোনো দিকে না চেয়ে চুপ করে একটা চেয়ারে বসে বলল, সনাতন! একটা চা দে তো!

নীলেশ আর স্বপন সোনার কাছে এসে বসল। নীলেশ বলল, হল কী?

—আজকের কাগজ পড়েছিস?

—হ্যাঁ। সাংঘাতিক খবর।

—এই রত্না মেয়েটিকে আমি চিনি। লাভলি গার্ল! হঠাৎ দিন কয়েক আগে নিখোঁজ হয়ে যায়। হস্টেলের লেডি সুপারের কাছ থেকে শুনে আমিও অবিশ্যি খোঁজাখুঁজি করেছিলাম, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। হঠাৎ এই বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ‘কী জানি’ বলে সোনা চায়ের কাপ টেনে নেয়।

ব্যাগ নিয়ে বিধুকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সোনা বলল, কোথায় চললি?

—একটা রোগী—

—তোর জন্যেও ভাবনা হয়েছে আমার বিধু। রাস্তা দিয়ে যেরকম টঙাস টঙাস করে হেঁটে হেঁটে এখানে—ওখানে যাস—কোনদিন না খোয়া যাস তুই।

—আমায় চুরি করবে কেন?

—আরে বাবা বিলেতফেরত ডাক্তার তো! ভালোমন্দ কত কাজেই লাগতে পারতো!

—ওকে দেখে কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ ফেরতও মনে হয় না। না সুট, না স্টাইল, না বা গাড়ি—

—সেটা হল—বিধু সাহেব হওয়া পছন্দ করে না বলে। খাঁটি বাঙালির চিকিৎসক খাঁটি বাঙালি। না রে বিধু?

—এখন অবধি তো আছি। জানি না পরে কী আছে কপালে। এই বলে বিধু বেরিয়ে গেল।

সেইদিন বিকেলে সোনা আর রুমা গেল একসঙ্গে, উদ্ধারাশ্রমে রত্নার সঙ্গে দেখা করতে। পুলিশ কমিশনারের নামে মনোতোষের চিঠি থাকাতে কোনো অসুবিধেই হল না। একটু পরেই একেবারে রত্নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারা।

ছোট্ট ঘরখানিতে রত্না বসে আছে। চুপ করে এমন ভাবে, যাতে মনে হয় জগৎ—সংসার পরিত্যাগ করে এসেছে সে। সোনা আর রুমা গিয়ে কাছে দাঁড়াতেই সে চোখ তুলে একবার তাদের দিকে চেয়ে আবার হাত দিয়ে মাটিতে ছবি আঁকতে লাগল। একটু পরে নিজের মনেই বলল, কী আশ্চর্য! আমার ড্রেসটা এখন পর্যন্ত দিয়ে গেল না। হাজার বার বলছি যে বাঙালির পোশাক আমার সুট করছে না, তবু এইগুলো দিয়ে গেল!

রুমা এগিয়ে গিয়ে ডাকল, রত্না!

রত্না আবার মুখ তুলে চাইল। হাসল একটু। বলল, আমি কিন্তু বাঙালি নই—পাঞ্জাবি। বাংলাতে ডোমিসাইলড বলে বাংলাটা ভালোই বলতে পারি। আপনারা?

বৃথা চেষ্টা। চোখে জল এল রুমার। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে সোনাকে নিয়ে গাড়িতে এসে বসে বলল, একটা মজা দেখেছ?

—কী?

—ওর চোখদুটো কেমন ঘোর—ঘোর লাল। মনে হয় যেন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। তাই না?

—হবে। লক্ষ করিনি রুমা। আমি একেবারে অন্য জগতে ছিলাম।

সেদিন রাত্রেই মনোতোষ গোসাবা চলে গেলেন। যাবার সময় বারংবার মেয়েকে বলে গেলেন সাবধানে থাকতে। দিন পাঁচ—ছয় দেরি হবে তাঁর ফিরতে।

সন্ধ্যার সময় চার বন্ধু গিয়ে জড়ো হল রুমার বাড়িতে। অনেক রাত অবধি গল্পগুজব করে বাড়ি ফিরল সবাই। আলোচনার মধ্যে সেই মেয়ে—চুরির কথা। সমগ্র শহরে আর কোনো কথা নেই।

আজ দিন ছয়েক মনোতোষ গোসাবা গেছেন। এর মধ্যে রুমার সঙ্গে সোনার মেলামেশা বেড়েছে। গানে গানে মুখর হয়ে উঠেছে অভিভাবকহীন প্রহরগুলি। আজ ভিকটোরিয়া, কাল বোটানিকাল, পরশু ডায়মন্ডহারবার—এইভাবে কাটছে তাদের আনন্দের দিন আর রাত্রি।

সেদিন ডায়মন্ড হারবারের প্রত্যন্ত দেশে, অর্থাৎ দুর্গ ছাড়িয়ে আরও দূরে গঙ্গার ধারে বসে দুজনে গান গাইছে। আকাশে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। এমন সময় নারীকণ্ঠের আর্তনাদ চারদিক মুখরিত হয়ে উঠল।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সোনা। বলল, সর্বনাশ হয়েছে রুমা! এ নিশ্চয় সেই মেয়ে—চুরির ব্যাপার!

—দূর! তোমার মাথায় পোকা ঢুকেছে!

আর্তনাদটা বার দুই শোনা গিয়েছিল। তারপর আবার সব নিস্তব্ধ। দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছিল ভাবী জীবনের স্বপ্ন নিয়ে। সন্তানের কথায় ভারি আপত্তি করেছিল রুমা। বলেছিল, না ভাই। সে আমার ভারি লজ্জা করবে। তা ছাড়া কোথাও কিছু নেই, বাচ্চা এসে মা বলে ডাকতে শুরু করলেই তো বুড়ি হয়ে গেলুম!…ঠিক এমনি সময় উঠল আর্তনাদ। থেমে যাবার পর দুজনের কথা ফুরিয়ে গেল। সোনা বলল, তুমি যা ভাবছ রুমা, তা নয়। এরা অত্যন্ত পাওয়ারফুল দল। যে কোনো মেয়েকে যে কোনো জায়গা থেকে এরা চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। জান, রত্নাকে আবার নিয়ে গেছে তারা?

—সেকি!

—হ্যাঁ।

ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রিভলবারটা বার করে পাশে রেখে রুমা বলল, তাহলে তো এটাকে সব সময় কাছে রাখতে হয়!

—তা হয় বৈকি! হঠাৎ সোনা বলল, তুমি একটু একলা থাকো রুমা। আমি দেখে আসি ব্যাপারটা কি হল। ওই দেখ গোলমাল এখনও শোনা যাচ্ছে! রিভলবার তো রয়েছে কাছে—ভয় কী?

—না, ভয় আবার কি! যাও, ঘুরে এস। কিন্তু দেরি করো না।

—সে আর বলতে! বলে চলে গেল সোনা।

পূর্ণ চাঁদের জ্যোৎস্না অপরূপ। একা একা কেমন সত্যিই ভয়—ভয় করতে লাগল রুমার। সে উঠে দাঁড়িয়ে গান গাইবার চেষ্টা করল। দূর থেকে ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে। দেখা গেল একখানি নৌকা দ্রুতবেগে (ছিপের মতো, তবে ছই আছে) চলে গেল সমুদ্রের দিকে। উত্তর থেকে দক্ষিণে। আর্তনাদও শোনা গেছে উত্তরে। কাজেই যথেষ্ট সন্দেহের কারণ আছে। নৌকায় ছই—এর মাথায় বসে আছে দুজন লোক, দাঁড় টানছে দুজন। ছই—এর মধ্যে আরও দু—তিনজন লোক যে আছে—এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ।

তীর থেকে বেশি দূরে ছিল না নৌকা। রুমা উঠে দাঁড়িয়ে রিভলবারটা তুলে নিল। তার মনে হল যে, এই নৌকাটা করেই মেয়েটিকে নিয়ে পালাচ্ছে। গুলি করে ওদের পথরোধ করলে হয়তো একটা কিনারা হবে। এই ভেবে, রিভলবারটা নিয়ে গুলি করতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে আওয়াজ এল : ও কী করছেন রুমা দেবী! গুলিগোলা কিসের জন্যে?

বিদ্যুদ্বেগে পেছন ফিরে চাইল রুমা। দেখল ডাক্তার বিধু এগিয়ে আসছে।

—আরে, আপনি এখানে!

—নিয়তি! নইলে রোগী দেখতেই বা এখানে আসব কেন? কিন্তু রোগী দেখা মাথায় উঠে গেছে।

—কেন?

—আর কেন! সবে স্টেথেসকোপটা মশায় বুকে বসিয়েছি—এমন সময় বাঁচাও—বাঁচাও! কোথায় বিপদ, কার বিপদ, কেন বিপদ—এসব দেখবার আগেই, কোনোরকমে প্রেসক্রিপশনটা লিখে দিয়েই গাড়িতে উঠে দে ছুট! পথ দিয়ে যেতে যেতে ওই গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখলাম, একটি মহিলা বসে একলা। সাবধান করতে এসে দেখি, আপনি!

—ও! আমাকে বুঝি সাবধান করবার দরকার নেই?

—না, না, তা কেন? আপনার কথা আলাদা। আপনার সঙ্গে রিভলবার থাকে, সোনা থাকে—

—এরা থাকলেই বুঝি আমার চুরি যাবার ভয় নেই?

—কী যে বলেন!

—এক্ষুনি কিন্তু এখান দিয়ে একটা নৌকা চলে গেল, আমার মনে হয় বিধুবাবু—ওইটে করেই মেয়েটিকে নিয়ে ওরা চলে গেল।

—মেয়েটিকে মানে?

—চিৎকার শোনেননি? এ ঠিক সেই মেয়ে—চোরের দল।

উসখুস করতে লাগল বিধু। ভয় ফুটে উঠল তার মুখে—চোখে। রুমা হেসে বলল, বসুন। ভয় পেলেন নাকি?

—না, ভয় ঠিক নয়। তবে কি জানেন, স্টেথেসকোপটা দিয়ে তো এদের ঠেকানো যাবে না, তাই…সোনা আসেনি?

—এসেছে। দেখতে গেছে ব্যাপারটা কী!

একটু থেমে বলল বিধু : সোনাকেই তাহলে গ্রহণ করবেন, ঠিক করলেন?

—না তো! এখনও কিছু ঠিক করিনি। তবে এটা ঠিক, মালা দিলে আপনাদের চার বন্ধুর একজনের গলাতেই দেব।

—তাহলে আশা ছাড়ব না?

—মোটেই না!

একটু পরেই বিধু উঠল। সোনার সঙ্গে দেখা করবার কথাতেও সে বসল না। বলল, পথে আরও দুটো রোগী আছে—দেখে কলকাতায় ফিরব। চলে গেল সে।

সোনা ফিরে এল। বিধু এসেছিল শুনে বলল, আস্তে আস্তে বেশ পসার হচ্ছে তো ওর! আমার কথাই ঠিক। এখানকার স্কুল—টিচারের মানসী নামে একটি খুব সুন্দরী মেয়েকে মুখ বেঁধে নিয়ে চলে গেছে।

—মুখ বেঁধে!

—হ্যাঁ। পুকুর থেকে জল নিয়ে বাড়ি ফিরবার মুখে কয়েকজন লোক এসে চেপে ধরে গঙ্গার দিকে নিয়ে যায়।

—ঠিক। তাহলে ওই নৌকাতেই নিয়ে গেছে। নইলে এই ভাটার টানে ফিরে যাবার জন্যে চার—দাঁড় চালাবে কেন?

—চার—দাঁড়?

—হ্যাঁ। আর যাবার সে কি তাড়া!

এরপর কোনো কথাই জমল না। দুজনে টিফিন—কেরিয়ার থেকে খাবার বার করে খেলো। সোনা বলল, রুমা! একলা কোথাও বেরিও না! প্লিজ!

সোনার মুখের দিকে চেয়ে কী ভাবল রুমা। তারপর নিজের পেলব বাহু দুটি দিয়ে সোনার গলাটি জড়িয়ে ধরে বলল, ভয় নেই গো ভয় নেই, তোমার ওসব মানসী, প্রেয়সী, রত্নার চাইতে আমি মনের বলে অনেক দড়।

সোনা দু—হাত দিয়ে হঠাৎ রুমার মাথার দু—পাশ ধরে নিজের মুখের দিকে টেনে আনতেই—

—এই—এই—অ্যা—ই! চিৎকার উঠল পেছনে থেকে। দেখা গেল গাছের পাশ দিয়ে নীলেশ আর স্বপন বেরিয়ে আসছে।

—তোরাও এসেছিস দেখছি! সোনা বলল।

—তবে? নীলেশ বলল : এর নাম হল স্টান্ট। তোমরা দুটিতে কী করছ না করছ ওয়াচ করব না আমরা?

সবাই হেসে উঠল। সবাই মিলে গাড়িতে উঠে বসল।

কাগজে কাগজে পুনরায় রত্না হরণ নিয়ে পুলিশের প্রতি ধিক্কার জেগে উঠল। অফিসার মণ্ডলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। শুধু বললেন—কালো মতো একটা লোক, গোঁফ আছে, আর কপালটা কাটা—! মনে রাখতে পারছেন না কিছুই!

গোসাবা থেকে প্রিন্স অরিজিৎকে সঙ্গে নিয়ে মনোতোষ ফিরে এলেন। প্রিন্স অরিজিতের দেখবার মতো চেহারা। লম্বা দেহ, অতি আধুনিক সজ্জা তাঁর। কলকাতায় তাঁর নিজের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও তিনি মনোতোষ ও রুমার অনুরোধে লাউডন স্ট্রিটের বাড়িতেই রইলেন। দিন সাতেক রুমার সঙ্গে মেশবার পর তিনি মনোতোষকে প্রস্তাব করলেন—রুমার পাণিপ্রার্থী হয়ে। মনোতোষ মনে মনে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, এর চাইতে ভালো প্রস্তাব আর হতে পারে না। আমি আগামী রবিবার রাত্রে একটা পার্টি ডাকি। সেই পার্টিতে ঘোষণা করব এই আনন্দ সংবাদ। কিন্তু মনোতোষ ভুল করলেন, তিনি অত্যাধুনিক হয়েও রুমার মত নিলেন না। রুমার ভদ্রতাবোধকে প্রেম বলে ধরে নিলেন তিনি।

অরিজিতের আসার পর থেকে সোনা পড়েছে বিপদে। প্রতিদিনের অভ্যাস—মাঠ থেকে সে সোজা চলে আসে রুমার কাছে। এখানে চান—টান করে জল খেয়ে বেরিয়ে যায় দুজনে বেড়াতে। ফেরে রাত্রি ন’টার পর। প্রথম যেদিন এসে শুনল রুমা বাগানে আছে, গানের শব্দও ভেসে আসছে—এগিয়ে গেল সোনা। গিয়ে দেখল, কৃত্রিম ঝরনার ধারে একটা পাথরের বেদিতে বসে আছে দুজনে। রুমা গান গাইছে—প্রিন্স শুনছে। গান শেষ হবার পূর্বেই সোনাও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ভেতরে একটা কান্না পাক খাচ্ছে। ধনী মনোতোষ হৃদয়ের খবর না রাখতে পারেন, কিন্তু রুমা!

দ্বিতীয় দিনও তাই। তৃতীয় দিন গিয়ে শুনল—ওরা বেড়াতে বেরিয়ে গেছে। একী অসহ্য যন্ত্রণা! রুমার সঙ্গে দেখা করা দরকার। বিদায় যদি নিতে হয় তবে সামনাসামনি নেবে সোনা।

সেদিন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রিন্স আর রুমা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অরিজিৎ বললেন : রুমা দেবী, আপনার বাবা আপনাকে কোনো কথা বলেছেন কি?

—না তো! রুমা বলল, তিনি দয়া করে আমাকে আপনার কাছে উৎসর্গ করবেন বলে কথা দিয়েছেন।

রুমার কাছে এ খবর নতুন। তবু সে দম নিয়ে বলল, আপনার—আমার পরিচয় পনেরো দিনও হয়নি প্রিন্স। এরই মধ্যে এ কথা উঠছে কেন?

হয়তো আপনার ফাদার দেরি করতে চান না। চারপাশে যে রকম মেয়ে চুরির হ্যাঙ্গামা চলেছে—তাতে হয়ত কুমারী মেয়েকে ঘরে রাখতে তিনি ভয় পাচ্ছেন।

—বিবাহিতা বুঝি চুরি যাচ্ছে না! কিন্তু ডায়মণ্ডহারবারে মানসী বলে যে মেয়েটি চুরি গেছে সেও তো বিবাহিতা ছিল!

—মানসীর খবর আপনি জানলেন কী করে? প্রিন্স যেন চমকে উঠলেন।

এটা লক্ষ করল রুমা। আরও পরীক্ষা করবার জন্য বলল, এই গ্যাংয়ে রাজার ছেলেও আছে প্রিন্স, আমি সে খবর পেয়েছি!

—অ্যাবসার্ড মিস মান্না। খবর আপনি কেমন করে পেতে পারেন? সিক্রেট অরগানিজেশন এত কাঁচা কাজ করে না। চলুন, রাত হয়ে গেল—

রুমার ধারণা বদ্ধমূল হল। সে বাড়ি ফিরে নিজের ডায়েরিতে লিখল, মেয়ে চুরির গ্যাংয়ের উল্লেখে প্রিন্সের মুখের ভাব—পরিবর্তন লক্ষণীয়। এ ছাড়াও তিনি যেন একটু অস্থির হলেন, দেখলাম। কিন্তু কেন?

‘চা—কোণে’ দেখা করল চার বন্ধু। সোনা সব কথা বলল বন্ধুদের। স্বপন, বলল, সখিলো! বলিতে বিদরে হিয়া, আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়, আমারি আঙিনা দিয়া। সঙ্গে সঙ্গে সুরে গেয়ে উঠল নীলেশ। শুধু বিধু বলল, তুই বলিস তো আমরা সদলবলে গিয়ে মিঃ মান্নার কাছে প্রটেস্ট করতে পারি।

—লাভ কী তাতে?

—লাভ হচ্ছে এই—যে উনি সচেতন হবেন। প্রিন্সের মোহ থাকা ভালো, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি সোনা—লোকটাকে আমি দুদিন দেখেছি—আমার ভালো লাগেনি ভাই। কী একটা রহস্য যেন লোকটার সর্বাঙ্গে। ওকে নিয়ে এসে বাড়িতে জায়গা দিলেন মনোতোষবাবু, কাজটা ভালো করলেন না!

—কেন বলছিস, এ কথা—বল তো?

—মন বলছে বলে—বলছি।

কি একটা ভাবল সোনা, তারপর বলল, রিয়্যালি—আমারও ভালো লাগেনি। অথচ—পরশু দিনের পার্টিতে শুনলাম, মনোতোষ ওদের এনগেজমেন্ট ডিক্লেআর করবেন।

—হতে পারে না। চল আমরা এখুনি যাই। ডাক্তার চেঁচিয়ে উঠল। পার্টির আগে আমরা রুমার সঙ্গে দেখা করি অন্তত! স্পষ্ট ভাষায় জানতে চাই কী তার ইচ্ছা। আমাদের কপালে তো ও কোহিনুর লাগবে না, তাই বলে তোর বরাতেও না? কোথাকার কে এক ব্যাটা অরিজিৎ—

—চুপ! বলল সোনা। আগে দেখা না করে কোনো কথা বলা চলবে না।

দুর্যোগ ঘনতর হচ্ছে।

সেদিন রাত্রে খাওয়া—দাওয়ার পর মনোতোষের সঙ্গে দেখা করল রুমা। পিতাকে সব কথা খুলে বলল। সোনার সম্বন্ধে কোনো কথাই গোপন করল না। এমন কি কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে তাদের মধ্যে যে প্রেম—সব বলল। মনোযোগ দিয়ে শুনলেন মনোতোষ। বললেন, Calf Love—এ সব। প্রশয় দিও না। যে ব্যবস্থা করছি—জেনো, তাতে তোমার মঙ্গল হবে।

—বাবা!

—না রুমা। তোমার সব কথা আমি রেখেছি। একথা রাখব না। বিশেষ করে আমি যখন কথা দিয়ে ফেলেছি—তখন এ বিয়ে হবে। পৃথিবী ধ্বংস হলেও হবে। মনটাকে ঠিক করে নাও। ও সব ফুটবলার—টুটবলার মাঠেই ভালো—মাঠেই ওরা গোল করতে পারে, কিন্তু জীবনে গোলমাল করে। No, I won’t support it.

দাঁতে দাঁত চেপে রুমা বেরিয়ে এল বাপের ঘর থেকে। সারারাত্রি জেগে কত কী ভাবল…কাঁদল…তারপর গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।

আগে থেকে টেলিফোন করা ছিল—ইডেন গার্ডেনের নির্দিষ্ট জায়গায় এসে চার বন্ধু ও রুমা দেখা করল। গভীর পরামর্শের পর স্থির হল, রবিবার পার্টির শেষে—(পার্টি শেষ হবে রাত্র ৮ টায়) ওরা ৯—৪৫ মিনিটের বম্বে মেলে দুজনে নিরুদ্দেশ যাত্রা করবে। কয়েক হাজার টাকা ব্যাংক থেকে চুপিচুপি কালকেই তুলে নেবে রুমা। বম্বেতে ওদের বিয়ে হবে। তারপর মধু যামিনী যাপনের জন্য জাহজে চেপে যে কোনো জায়গাতে গেলেই হবে। ব্যাংকের সঙ্গে সে ব্যবস্থা করে নেবে সে।

—বাবা যদি আপত্তি করেন?

—পারেন না। কারণ এ টাকা তো বাবার দেওয়া নয়। আমার মায়ের আর দিদিমার।

—তাহলে আমরা কোথায় অপেক্ষা করব? স্বপন বলল।

—কেন, স্টেশনে! নীলেশ বলল।

—সেই ভালো। হাওড়া এনকয়ারির কাছে দাঁড়াব আমরা। বলল বিধু।

—আমি কি একটু তফাতে একটা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করব রুমা?

রুমা একটু ভেবে নিল। তারপর বলল, গাড়িটা ওই রাস্তার মোড়ে রেখে তুমি আমাদের বাড়ির গেটের পাশে থেকো। একটা চামড়ার সুটকেস নেব তো?

—হ্যাঁ।

—সো লং! বলে রুমা নিজের গাড়িতে চাপল। চার বন্ধু হাঁটতে লাগল।

স্বপন সর্বদা—হাতে—রাখা খাতাখানি খুলল, পকেট থেকে কলমটা বার করল। লিখল :

 কিন্তু কোকিল ‘কা’ বলে না—

 কাকের মায়ের বুকের তাপে—

 তবু কুহুর প্রাণ গলে না—

 কিন্তু কোকিল ‘কা’ বলে না।

—নীলেশ!

—দে!

নীলেশ খাতা হাতে নিয়েই বলল,—বিষ্ণু দিগম্বরের সাধনার মতো,—ইষ্ট নামের মতো—’কা’ দিয়ে শুরু করলাম। বলেই সুর করল, কা—কা—কা! স্বপন, এইখানে একটা লাইন চাই যে! কা—কা—কা!

স্বপন বলল, ওরে কুহু ফিরে চা! কিন্তু কোকিল—! আহা! নীলেশ, কেউ চিনলে না রে!

—পরে চিনবে ভাই, এখন পা চালিয়ে চল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এইভাবে গান বাঁধা আর সুর করা,—বুঝবি সেদিন, যেদিন দুটোতে গাড়ি চাপা পড়বি! বলল বিধু!

বিরাট পার্টি। বাড়ি সংলগ্ন বাগানে আয়োজন হয়েছে উৎসবের। কলকাতার শ্রেষ্ঠ নাগরিকবৃন্দের সমাবেশ। প্রিন্স অরিজিৎকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল—রুমা এসে দাঁড়াল। বাকদান ঘোষণা করা হল। মনোতোষ বললেন, পৃথিবীর সর্বত্র ঘুরেও প্রিন্স অরিজিৎ ভারতবাসীই আছেন। এবার গোসাবা গিয়ে তাঁকে দেখবামাত্র আমার মন বলল—এই তো আমার রুমা মায়ের পতি। আমার ভাগ্য ভালো— যে প্রিন্সও কিছুদিন থেকে জীবন—সঙ্গিনীর কথা ভাবছিলেন। প্রস্তাব শুনে বললেন—রুমাকে না দেখে বলতে পারব না। তিনি এলেন, রুমাকে দেখলেন—সম্মতি দিলেন! আগামী মাসের সতেরোই হবে এই বিয়ে। সেদিন রুমা মায়ের জন্মদিন।

বিরাট খাওয়া—দাওয়া আনন্দ—কোলাহলের মাঝখানে—দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে, কখন যে রুমা নিঃশব্দে সরে পড়েছে কেউ জানে না।

বম্বে মেল ছেড়ে গেল।

বন্ধুরা মুখ চাওয়া—চাওয়ি করছে। কী ব্যাপার? সবই ভেস্তে গেল নাকি? ওরা তো এলো না স্টেশনে। না রুমা, না সোনা! নীলেশ বলল, আমার মন কু গাইছে। কিন্তু!

বিধু বলল, হুট করেই কু গাওয়াসনে ভাই। আগে দ্যাখ! চল সেখানে যাই।

লাউডন স্ট্রিটে আসামাত্র এখানকার নিঃশব্দ—ব্যস্ততা সকলের চোখে পড়ল। এখানে—ওখানে গ্রুপ বেঁধে লোকজন দাঁড়িয়ে কী যেন আলোচনা করছে। মনোতোষের বাড়ির কাছে দেখা গেল, দরোয়ানরা টর্চ ফেলে বাগানে কী যেন খুঁজছে। গেটের কাছে যেতেই পেছন থেকে কে যেন ডাকল, ডাক্তারবাবু!

বিধু, নীলেশ ও স্বপন একত্রে এগোল। গিয়ে দেখল, যে গাড়িটা আজ ওরা সবাই মিলে ঠিক করেছিল সোনার জন্য, তারই ড্রাইভার ডাকছে বিধুকে। সে বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। সোনাদা এইখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন, আমি গেটের কাছে দাঁড়াব। রুমা সুটকেস নিয়ে আসবে, সেইটে নিয়ে আসব। আমি বললাম, আমি যাই? সোনাদা বললেন, তোকে তো চেনে না, তাতে কাজ হবে না। এই বলে সেই যে সোনাদা গেলেন, কই আর তো এলেন না!

—সেকি!

—হ্যাঁ নীলেশদা, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। অথচ সোনাদার নিজের সুটকেস আমার গাড়িতে রইল!

—বাড়ির মধ্যে নেই তো! মানে, রুমা যদি অন্য কোনো পথ দিয়ে…বিধু বলবার চেষ্টা করল।

—কিন্তু ওরা বাগানে আলো ফেলে কাকে খুঁজছে?

—তাই তো! তবু দরোয়ানকে একবার ডেকে,—বিধু বলল।

—নট ব্যাড, বলে নীলেশ সবাইকে নিয়ে এগোল। বাগানে ঢুকেই বৃদ্ধ বুদ্ধু সিং—এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার কাছে খবর পাওয়া গেল, পার্টির মাঝখানে সেই যে রুমা বাগান থেকে বাড়ির দিকে চলে এসেছিল, তারপর থেকেই তার খোঁজ নেই। অথচ ঘরে তার বড় সুটকেসটাও নেই।

চিন্তান্বিত মুখে বেরিয়ে এল বন্ধুর দল। কারও মুখে কোনো কথা নেই। ফিরে এল গাড়ির কাছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।

—তাহলে? বলল বিধু।

—কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না। নীলেশ বলল, একটা কথা ঠিক যে, বাড়ি থেকে সুটকেস নিয়ে রুমা বেরিয়েছিল, গেটের কাছেও সে এসেছিল আর দেখাও হয়েছিল তার সোনার সঙ্গে। তারপরই কেউ কিছু বলতে পারছে না। নয় কী?

—তাইতো মনে হচ্ছে। বলল স্বপন।

তিনজনে গাড়িতে চেপে বসল। একবার থানাতে একটা খবর দিলে হয় না? বলল বিধু।

—না, এখন থাক। নীলেশ বলে—যদি মনে কর রাত্রে এসে হাজির হয়ে যায়! যদি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে থাকে দুজনে?

—একটা ব্যাপারে বাইশটা ‘যদি’। বিধু বলল।

—যদি ছাড়া এখানে আর কোনো উপায় নেই ডাক্তার।

—বেশ তো, আগে সবটা দেখে তবে বল! আগে থেকেই ‘যদি’ বলছিস কেন?

পরদিন ভোরে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ আর একবার চমকাল। শোনা গেল—অরিজিতের পীড়াপীড়িতে বেশি রাত্রে পুলিশ আসে, এবং ঘটনা কাগজে প্রকাশ হয়ে যায়। পুলিশের টনক নড়ল। দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গের উপর চাপ এল। চারদিকে একটা হৈ হৈ পড়ে গেল। পুলিশ পরদিন তিন বন্ধুকে জেরা করল—অরিজিৎকেও জেরা করল পুলিশ। কিন্তু কিছুই প্রকাশ হল না। শুধু ভারত জুড়ে পুলিশের জাল পড়ে গেল। বহু নিরপরাধ ধরা পড়ে মার খেতে লাগল। কাগজ লিখল, পুলিশ যদি এ ব্যাপারের কিনারা করতে না পারেন—তবে পদত্যাগ করুন।

অরিজিৎ পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখলেন। মনোতোষকে বললেন, ওসব কিচ্ছু না। মনে হয় সোনার সঙ্গে পালিয়েছে সে।

মনোতোষ কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। ‘ক্ষমা করেছি, ফিরে আয়’ বলে। কিন্তু আটচল্লিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল—কোনো কাজ হল না।

আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে চোখ খুলল সোনা। এ কোথায় সে? নিবিড় অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। এ কোথায় সে? সমস্ত শরীরে ব্যথা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। একটা ভাঙা জানলা মনে হচ্ছে…অনেকক্ষণের চেষ্টায় সেটা ডিঙিয়ে উঠানে পড়ল সে। চাঁদের আলো উঠানে। এটা একটা পোড়ো বাড়ি। একটা লোক ঘুমিয়ে আছে। মাথার কাছে বিড়ি আর দেশালাই। একটা কাঠি জ্বেলে লোকটাকে দেখবার ইচ্ছা হল। যদি জেগে ওঠে! ধীরে ধীরে পাঁচিল ডিঙিয়ে বেরিয়ে গেল সোনা। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড। বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ করল যাতে পরে বাড়িটা ভুল না হয়।

সেই রাত্রেই ডাকাডাকি করে তিন বন্ধুকে জড়ো করে সোনা বলল, নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই। শিগগির চল।

চারজনে যাত্রা করল ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের বাড়িতে।

ভোর হতে তখন কিছু দেরি।

কপালকাটা গোঁফওয়ালা লোকটিকে পেতে দেরি হল না। সে সদর দরজায় তালা দিচ্ছিল। বোধহয় বিপদের গন্ধ পেয়ে।

সোনা বলল, ঘুম ভেঙে দেখেছে পাখি পালিয়েছে, তাই নিজেও কাটবার তাল করছে। ধর!

আকস্মিক আক্রমণে সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু কোনো জবাব দিল না।

বিধু বলল, এমনি হবে না। ব্যাটাকে শুইয়ে ফেলে থার্ড ডিগ্রি দাও।

তাই হল। হাত পা—বেঁধে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে তার বুকের ওপরে একটা বরফের চাঁই চাপিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। একটু পরে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগল কালু মিঞা।

বিধু বলল, বল! কোথায় রাখা হয় এই মেয়েগুলোকে? বল!

কালু অবশেষে মরিয়া হয়ে বলে ফেলল, কমলাঘাট।

—কমলাঘাটের কোথায়? সোনার প্রশ্ন।

—মায়া—মঞ্জিলে।

কালু আরও বলল, কর্তাদের কাউকে সে চেনে না। সে চাকর মাত্র। তবে সে শুনেছে, মেয়েগুলোকে কমলাঘাটের মায়া—মঞ্জিলে রাখা হয়। সেখানে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে চালান দেওয়া হয়।

—আগে এনে কোথায় রাখা হয়?

—এই বাড়িতে।

সোনা বলল, ঠিক আছে, এ ব্যাটাকে নিয়ে চল সঙ্গে।

বিধু বলল, মায়া—মঞ্জিলে? পাগল নাকি? সেখানে যাওয়া একটা সাংঘাতিক কাজ। শেষকালে এ ব্যাটার ওপর চোখ রাখতে রাখতেই টায়ার্ড হতে হবে। তার চাইতে একে পুলিশে দেওয়া ভালো। মারের চোটে হয়তো আরও কিছু বেরোবে।

তাই হল। কালুকে থানায় জমা দেওয়া হল। পুলিশ সুপারের সঙ্গে সোনা দেখা করে কমলাঘাট যাবার কথা বলল।

—সে তো সুন্দরবনে।

—তাই যাব স্যার!

মনোতোষ যদি বা রাজি হলেন, অরিজিৎ বাধা দিলেন। নানাভাবে এদের বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলেন যে, সে পথ দুর্গম। বাঘ, সাপ ও হিংস্র মানুষে ভর্তি। বিপদ প্রতি পদে। তা ছাড়া মেয়ে—চোরেরা কি এত বোকা যে তারা মায়া—মঞ্জিলে রাখবে মেয়েদের!

—কালু বলেছে।

—মিথ্যে কথা বলেছে। মায়া—মঞ্জিলে আমার বাড়ি। আমার চাইতে সে বাড়ির খবর অন্য কেউ বেশি জানে না।

—আপনি বাস করেন সেখানে?

—না। বাসের অযোগ্য সে জায়গা। আগে যখন আমার প্রজারা ছিল আশেপাশে, তখন আমার পূর্বপুরুষেরা থাকতেন সেখানে। বাবাও কিছুদিন বাস করেছেন। এখন কয়েক ঘর সাঁওতাল ছাড়া আর কিছু নেই।

মনোতোষ যখন বললেন, ঘুরেই আসুক না প্রিন্স। কিছু ক্লু যদি পাওয়া যায়, তবে—!

রেগে উঠলেন প্রিন্স। বললেন, যেতে পারেন তবে জীবনহানি হলে আমাকে দায়ী করবেন না। আমার কিন্তু কোনো ঝক্কি নেই।

সোনা অরিজিতের এই প্রতিবাদে অবাক হল।

ঠিক হল, চার বন্ধুই যাবে কমলাঘাটে।

পুলিশ আর্মস দিতে রাজি হল না। সোনার বাবা ছিলেন শিকারি। অতএব বন্দুক—রিভলবার সে সঙ্গে নিল। বিধু বিলেতফেরত ডাক্তার। তার নিজেরও একটা রিভলবার ছিল, নিয়ে নিল। এ—ছাড়া বল্লম—টল্লম ইত্যাদি—

কমিশনার সাহেব সঙ্গে পুলিশ দিতে চাইলেন। সোনা রাজি হল না। বলল, লোক জানা—জানি হলে ওরা সাবধান হয়ে যাবে স্যার। অরিজিতের তীব্র আপত্তির কথা বলাতে কমিশনার চঞ্চল হলেন এবং দুজন অফিসারকে ডেকে অরিজিতের ওপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখতে বলে দিলেন।

জলযাত্রা…

মনোতোষের সুন্দর লঞ্চ। তাতে করে চার বন্ধু রওনা হল। পথের সে এক বিচিত্র ইতিহাস। ক্রমে গোসাবা ছেড়ে যখন তারা কমলাঘাটের দিকে এগোতে লাগল, তখন মনে হল আসাই উচিত হয়নি তাদের। তীরে কুমিরের পাল রোদ পোয়াচ্ছে। বড় বড় সাপ জলে সাঁতার কাটছে। কমলাঘাটে যখন তারা নামল, তখন সন্ধ্যা হব—হব। একটা লোক নেই, গভীর জঙ্গল। বাঘের ডাক ও নানা রকমের শব্দ শোনা যাচ্ছে। স্বপন অজ্ঞান হয়ে গেল। এতক্ষণে এরা বুঝল যে স্বপনকে আনা ভুল হয়েছে তাদের।

একটা জিনিস তারা লক্ষ করেছিল যে তাদের ঠিক আগে আগে একখানা ছোট লঞ্চ যাচ্ছিল। এরা স্পিড দিয়ে দেখেছে—তাদের সঙ্গে পারেনি। অনেকগুলি খাঁড়ি নদী এসে পড়েছে এই নদীতে। হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে এসে তারা আর ছোট লঞ্চকে দেখতে পায় না। যেন উবে গেল কর্পূরের মতো। অনেক চেষ্টা করেও আর তার পাত্তা পেল না তারা।

প্রকাণ্ড বাড়ি। ঢোকবার মুখেই গেটে অজগরের অভ্যর্থনা। অজ্ঞান স্বপনের দেহ বহন করে ওরা ওপরে উঠে দোতলার একটি ঘরে বিশ্রামের ব্যবস্থা করল। সঙ্গে খাবার ছিল— খেয়ে নিল।

সোনা বলল, ভোর হবার আগে আর কিছু করা যাবে না।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে তারা অনেক রকম আওয়াজ শুনেছে। কোথায় যেন কে গান গাইছে। মেয়েলি গলা। পুরুষের কর্কশ হাসি। একটু পরে সেতারের আওয়াজ। বন্ধুরা ঘুমোচ্ছে। সোনা টর্চ নিয়ে উঠে এগোল। শব্দ শুনে মনে হয় নীচে থেকে আসছে। প্রতিধ্বনি হতে পারে।

দু—তিনবার সোনার মনে হল, কে যেন অতি সন্তর্পণে তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। এমন কি একটু দাঁড়ালে হয়তো তাকে নাগালের মধ্যে পাওয়া যাবে। রিভলবার নিয়ে দাঁড়াল সোনা। কিন্তু না, কেউ নয়। জোরে বাতাস বইছে। হয়তো তারই শব্দ। সোনা ভাবল, কাল সকালে দেখা যাবে। এই রাত্রে জীবন বিপন্ন করে লাভ নেই।

পরদিন তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করল তারা। বিধু খুব কাজে লাগছে এ সময়। নীলেশ আর স্বপন একেবারে যাচ্ছেতাই। ক্ষণে ক্ষণে স্বপনের ভাব আসে, দু—লাইন গান রচনা হয়—নীলেশ সুর দেয়। সারাটা পথ ওরা দুজনে এই করল।

—এভাবে একই সঙ্গে চারজন একদিক দিয়ে খুঁজলে লাভ হবে কী? বরং আমি উল্টো দিক থেকে সার্চ করতে করতে তোমাদের সঙ্গে মিট করি। বিধু বলল।

—খুব ভালো আইডিয়া। বলল সোনা।

বিধু চলে গেল, টর্চ আর রিভলবার নিয়ে।

এরা তিনজন এগোচ্ছে। হঠাৎ সিঁড়ির নীচে একটা পাপোশের ওপর পা পড়তেই সামনের জমিটা ক্যাঁ—চ শব্দ করে ফাঁক হয়ে যেতে লাগল। বাপরে বলে স্বপন পা সরিয়ে নিতেই সেটা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ওরই মধ্যে দেখা গেল একটা সিঁড়ি নীচে নেমেছে।

সোনা বলল, এক কাজ কর তোরা। ওটা চেপে রাখ! আমি নীচে নামি। কিন্তু খবরদার, আমার জান তোদের হাতে রইল। এ সময় বিধুটা কাছে থাকলে কাজ হত। তোদের বিশ্বেস করে না মরি!

—কুছ পরোয়া নেই, নেমে যা। কবি বলল।

—স্বপন না পারে, আমি আছি। গাইয়ে জবাব দিল।

আবার শব্দ। পথ হল। সোনা নেমে গেল। পা দিয়ে চেপে ধরে আছে স্বপন। গুপ্তদ্বারের পাল্লা দুটি পুরো উন্মুক্ত। হঠাৎ দূরে শোনা গেল বাঘের ডাকের সঙ্গে কী একটা পাখি মধুর শিস দিচ্ছে। স্বপন বিহ্বল হয়ে গেল। তার ভাব এল। নিজের অজান্তে সে সরে গিয়ে গান রচনা করতে লাগল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। খেয়াল নেই কারও। গান লেখা হচ্ছে—সুর দেওয়া হচ্ছে। হঠাৎ নীলেশের মনে পড়ল। সে চিৎকার করে উঠল। আবার গিয়ে পা দিয়ে দাঁড়াতেই দরজা ফাঁক হয়ে গেল। উষ্কখুস্ক, আলুথালু বেশ সোনা উঠে এসে ‘দড়াম’ করে এক ঘুসি স্বপনকে, আর একটা নীলেশকে বসিয়ে দিয়ে শুধু বলল, রাস্কেল! আর একটু হলে আমি মরে যেতাম। শিগগির আয় ওপরে। অনেক কথা আছে।

বিধুও এল একটু পরে। সে কিছু দেখতে পায়নি। তবে একটা রুমাল কুড়িয়ে পেয়েছে। কোণে একটা ‘অ’ লেখা।

সোনা বলল, এইটেই ওদের আড্ডা। কিন্তু এখানে একটা মেয়েও নেই। দু’দিন আগে, কি একটু আগেও হয়তো ছিল। মোট কথা, আমি কিছু জিনিস পেয়েছি। আমরা আজই কলকাতা যাব। এখানে কোনো কাজ নেই।

—কী জিনিস পেলি, দেখাবিনে ভাই? বিধু বলল।

কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে সোনা বলল, না, পরে।

দুপুরে খাওয়া—দাওয়ার পর ব্যাগপত্র নিয়ে আবার নদীর ধার। এইখানে সর্বনাশ অপেক্ষা করছিল তাদের জন্যে। গিয়ে দেখল, লঞ্চ যেখানে ছিল—সেখানে নেই। সর্বত্র খুঁজে দেখল, কোথাও নেই।

হঠাৎ তারা লক্ষ করল যে সঙ্গে স্বপন নেই। অর্থাৎ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় থেকেই নেই। একে লঞ্চ না থাকায় মাথার গোলমাল, তার ওপর কবি মিসিং।

আবার সবাই ফিরে গেল। কাছাকাছি একটা সাঁওতাল পল্লিতে মহুয়ার নেশায় মাতাল হয়ে পড়ে বিড় বিড় করে কবিতা আওড়াচ্ছে স্বপন। বহু কষ্টে তার মাথায় জল—টল দিয়ে ঠান্ডা করা হল।

ঠিক হল, শত্রু যখন তাদের পেছনে পেছনেই আছে, তখন এখান থেকে হেঁটে গোসাবা গিয়ে, তারপর কলকাতা যাওয়া যাক। পুরো তিনদিন লাগল যেতে। কখনও গাছের ওপর, কখনও মাচায় রাত্রি কাটিয়ে দুর্গম পথ অতিক্রম করে আধমরা অবস্থায় তারা পৌঁছল গোসাবায়। সেখান থেকে লঞ্চ ব্যবস্থা করে কলকাতা।

কলকাতা এসেই অপূর্ব খবর। আজ ভোরে রুমাকে বাড়ির কাছে পাওয়া গেছে। কিন্তু সে কাউকে চিনতে পারছে না। গেল চার বন্ধু মিলে তার কাছে। এরাও তখন ক্লান্ত বিপর্যস্ত।

রুমা রোগা হয়ে গেছে। সে ক্রমাগত বলছে—আমি ইরানি মেয়ে, তোমরা আমাকে এ পোশাক পরিয়ো না। আমাকে আমার পোশাক পরিয়ে দাও।

চুপ করে লক্ষ করল সোনা। চোখে জল এল তার। মনোতোষকে বলে সবচাইতে বড় ডাক্তার আনিয়ে সোনা বলল, ওর ব্লাডটা একটু কালচার করে দেখুন তো স্যার!

ডাক্তার রক্ত নিয়ে গেলেন। সেইদিন রাত্রে মনোতোষ ও সোনা বসে কথা বলছে, টেলিফোন করে ডাক্তার জানালেন, এ রক্ত জর্মানিতে পাঠাতে হবে। কারণ যে বস্তু রক্তে পাওয়া যাচ্ছে, তার ক্রিয়া আজও জানা নেই।

মনোতোষ বলল, তাই পাঠান ডাক্তার তালুকদার। রিপোর্ট আমাদের চাই।

অনেক—অনেক চেষ্টা করল সোনা রুমার চৈতন্য ফেরাতে। কিন্তু সে এক বিচিত্র অবস্থা। হাসছে, কাঁদছে, গান গাইছে—আবার বলছে, আমার জাতভাইয়েরা কোথায় গেল? আমার বন্ধুরা?

কুমার অরিজিৎ এই সময় আর এক বিচিত্র ব্যবহার শুরু করলেন। তিনি মনোতোষকে ফোন করতে লাগলেন—এই অবস্থাতেই রুমার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিতে হবে। মনোতোষ যত বোঝাবার চেষ্টা করেন, তত বেঁকে বসেন কুমার। শেষে একদিন রাগ করে ব্যাগ—ট্যাগ নিয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, গেটে দণ্ডায়মান দরোয়ান বাধা দিল। বলল, আপনি এখন কলকাতার বাইরে যেতে পারবেন না।

—কেন জানতে পারি কি? গর্জন করলেন কুমার।

—না।

—কী অধিকারে আমাকে আটকানো হচ্ছে?

—জানি না। আমি হুকুমের চাকর।

ফিরে গেলেন অরিজিৎ। কিন্তু তিনি অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠলেন। মুখ—চোখ শুকিয়ে গেল তাঁর। তিনি যেন সর্বদাই কী ভাবেন। অবশেষে এক চালাকি করলেন তিনি। সবাইকে লুকিয়ে তিনি বিলেতের পাসপোর্ট করালেন অন্য নামে। ছদ্মবেশে বেরিয়ে গেলেন গভীর রাত্রে!

ভোরে মনোতোষ তাঁকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশকে জানালেন। পুলিশ গিয়ে জাহাজ থেকে ছদ্মবেশধারী অরিজিৎকে অ্যারেস্ট করে নিজেদের কাস্টডিতে রেখে দিল।

টেলিফোনে পুলিশ কমিশনার মনোতোষকে বললেন, এই কুমার অরিজিৎকে অ্যারেস্ট করে মনে হচ্ছে মেয়ে—চুরি রহস্যের দরজার ওপর এসে দাঁড়িয়েছি। এই ভদ্রলোকই নাটের গুরু।

—আমারও তাই মনে হয়েছিল। কেননা রুমালখানার ‘অ’টা—

রাইট। সেটা একটা বড় প্রমাণ। বললেন পুলিশ কমিশনার।

সোনা কিন্তু অদূরে বসে ক্রমাগতই নিজের মনে মৃদু মৃদু মাথা নাড়ছে। মনোতোষ দেখতে পেয়ে বললেন, কী হল হে?

—না, কিছু না। অরিজিৎ কনফেস করেছেন?

—না। পুলিশ সন্দেহ করছে।

—ও। সোনা উঠে রুমার ঘরে গেল।

রুমা তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অপূর্ব ইরানি সাজ সাজছে। সোনাকে দেখে ফিক করে হেসে বলল, ভালো লাগছে না আমাকে?

—অপূর্ব লাগছে!

—নিজের দেশের পোশাক অনেক কষ্ট করে পেয়েছি!

—কী বলছ রুমা?

রুমা চুপ।

—তুমি ইরানি—একথা তোমাকে কে বোঝালে? তুমি বাঙালি। আমি কে বল তো?

—তুমি? উপেন? না।…তবে তুমি… হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি, বুঝেছি—তুমি হচ্ছো সেই লোকটি— যে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। সেই যে অ—না—ব—না প দিয়ে নাম।

—হ্যাঁ, এই তো সুন্দর মনে পড়ছে। তারপর? তারপর?

—কেন মনে পড়বে না? ওদের সঙ্গে তোমার ঝগড়া হল, আমি তো সব বসে বসে দেখছিলাম। তুমি যেন কী করছিলে? কী যেন করছিলে? ও, হ্যাঁ! আমার একটা ছবি তোমার হাতে ছিল।

এই অবধি বলে রুমা আবার চোখে সুর্মা লাগাতে লাগল। পরে নিজের মনে হেসে বলল, তোমাদের সঙ্গে বাপু আমি একমত নই। সব মেয়েগুলোকেই তো তোমরা বিক্রি করেছ, আমার বেলায় না হয় নাই করলে! আমায় যদি তোমার পছন্দ হয়ে থাকে, তবে হোক না বিয়ে। আমি তো এখন আর ইরানে যাব না। কিন্তু দেখো, ওরা তোমার এই মত নেবে না। এই অবধি বলে হঠাৎ রুমা, ‘মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে—বড্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে,—উঃ!’ বলে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

নিষ্ক্রিয় হয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু যেমন করে হোক—এর সমাধান না করে শান্তি পাবে না সোনা। আজ ক’দিন এসেছে রুমা। পাঁচদিন, তার মানে ছ’দিন, অর্থাৎ আরও আটদিন সময় হাতে আছে। এই আটদিনের মধ্যে এই রহস্যের সমাধান করতে হবেই। নইলে সব গোলমাল হয়ে যাবে, সব চলে যাবে আয়ত্বের বাইরে।

বাইরে বেরিয়ে এল সোনা। মনোতোষের সঙ্গে দেখা হল। বলল, মাঝে একদিন আমার আপনার গাড়িটা দরকার হবে—

—বেশ তো বাবা। আমি ড্রাইভারকে বলে রাখব—তুমি যখন ইচ্ছে নিয়ে যেও।

—যে আজ্ঞে।

বড় রাস্তায় পড়ে ট্রাম ধরল সোনা। রাত্রি ন’টা বেজে গেছে। ট্রামের ভিড় ক্রমশ কমে আসছে। একটি আসনে বসে আবার সে চিন্তায় ডুবে গেল। সেই মায়া—মঞ্জিলের পাতালপুরী।

ছবি ফুটে উঠল—

সিঁড়ি ধরে ধরে অন্ধকার পথ দিয়ে নামছে সোনা। মনে চিন্তা চলছে—যদি কাছাকাছি কেউ থাকে, তার টর্চ জ্বাললেই দেখতে পাবে। তার চাইতে অন্ধকারে এগোনো ভালো। ধীরে ধীরে এক পা এক পা করতে করতে সোনা এগোচ্ছে। হাতে রিভলবার। সামনে ধাক্কা খেলো। দেখল দেয়াল। পাশে রাস্তা। সরু পথ। ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে বিদ্যুৎদ্বেগে পকেট থেকে টর্চ বার করে আলো জ্বালল। সামনে একটি গোখরো সাপ মাথা তুলে কী যেন দেখছে, বিভ্রান্ত হয়েছে তীব্র আলোতে। টর্চ অন্যত্র ফেরাল—সাপটা চলে যাচ্ছে, আলো ফেলে তাকে ফলো করল সোনা। প্রশস্ত অঙ্গন। হঠাৎ দিনের আলো এল কোত্থেকে? ওপরে ভেন্টিলেটার দিয়ে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত হচ্ছে।

প্রাঙ্গণের চারপাশে ঘর। একটি ঘরের দরজা খোলা। আর সব বন্ধ। সেই ঘরে ঢুকল সোনা। লোক বাস করে ডেফিনিটলি এ—ঘরে। সারি সারি চারটে বিছানা গুটোনো। একটি পাতা। অবাক হল সোনা। বিছানায় হাত দিয়ে দেখল, এখনও গরম। তার মানে কেউ ছিল একটু আগে। বালিশ তুলল। না, কিছু নেই। পাতলা তোশকের ওয়াড়ের তলায় কী একটা খড়মড় করে উঠল। হাত ভরে বার করে আনল সোনা। কাগজ। কোনো খবরের কাগজের স্পেশাল এডিশন—এর পেছনের সাদা দিকে লেখা। মেয়েলি হাতের লেখা। খুব তাড়াতাড়ি লিখেছে পেনসিল দিয়ে। শেষ হয়নি চিঠিখানা।

চিঠি না পড়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে ঘরটা আরও ভালো করে দেখল। কোণে একখানা ডুরে শাড়ি পড়ে আছে জড়ো করা। আরও খুঁজতে খুঁজতে ঘরের কোণে ছোট্ট এক কুচি উড পেনসিল পাওয়া গেল। বোঝা গেল মেয়েটি চিঠি লিখছিল, হঠাৎ কোনো বিপদের গন্ধ পেয়ে কাগজখানা তোশকের ওয়াড়ে লুকিয়ে ফেলে আর পেনসিলটাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে সোনা চারপাশ খুঁজল—কিন্তু কাউকে দেখেনি। অথচ সে আসবার আগে কেউ যে এই মেয়েটিকে ত্বরিত গতিতে সরিয়ে নিয়ে গেছে—তার প্রমাণ প্রত্যক্ষ না থাকলেও, মনের ভেতরে যে দেবতা প্রচ্ছন্ন থেকে মানুষকে বিপদ সম্বন্ধে সতর্ক করেন, তিনিই বলে দিলেন সোনাকে।

ফিরে এসে দেখল, যে দরজা দিয়ে সে নেমেছিল সে দরজা বন্ধ। হতাশ হয়ে বসে পড়ে যখন ভগবানকে ডাকছে, তখন দরজা খুলল। অবশ্য ঘুসি মারাটা তার উচিত হয়নি বন্ধুদের।

জন—বিরল কলকাতার পথ।…লোকজন কমে এসেছে। চিঠিখানিও বড় মজার। এদিক—ওদিক চেয়ে সোনা পকেট থেকে চিঠিখানা বার করে পড়তে লাগল :

আমার নাম প্রতিমা। চন্দননগরে আমার বাবা কালেকটরিতে কাজ করেন। আমার বয়স এই উনিশ। সুন্দরী বলে সবাই জানত, কিন্তু সেই রূপই আমার কাল হল। সিনেমা দেখতে এসে এদের হাতে পড়ে এখানে চলে এসেছি। দু’দিন পরে আমাকে ইনজেকশন দেওয়া হয়। কাল থেকে জ্ঞান হয়েছে আমার। হয়তো আজ কি কাল আবার আমাকে ইনজেকশন দেবে। দিলেই আবার সব ভুলে যাব পনেরো দিনের জন্য। আমাকে ধরে না আনলে, আমি এবার ম্যাট্রিক দিতাম। কী জানি, কোথায় বিক্রি করে দেবে আমাকে—জীবনে আর কোনোদিন বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারব কিনা। কাল জ্ঞান হওয়া অবধি শুধু মনে হচ্ছে এদের কাণ্ড— কারখানা লিখে রেখে যাই। এই পাতালপুরীতে এই চিঠি কেউ পাবে কি না জানিনে, যদি পায়! কত অঘটন তো ঘটে ভগবানের রাজত্বে, যদি কেউ পায়, তা হলে হয়তো এরা ধরা পড়বে। বহু মেয়ের প্রাণ বাঁচবে তা হলে।

এটা একটা বিরাট দল। সব জাতির লোক এর মধ্যে আছে। বি.টি রোডে একটা আড্ডা আছে লোক দেখানো, সেখানে একটা চাকর থাকে, কখনও সখনও মেয়েদের এক—আধঘণ্টার জন্য সেখানে রাখা হয়। মেয়েদের এরা চোখ বেঁধে একরকম ইনজেকশন দেয়। দিলে পনেরো দিনের জন্য সে সব ভুলে যায়। অসম্ভব সাহস এদের। বড়লোকের মেয়েদের এরা ইনজেকশন দিয়ে দ্বিতীয় দিন বাড়িতে রেখে আসে। ওই সময় একজন লোক—’অ’ দিয়ে তার নাম, সে তাকে বুঝিয়ে দেয়—ঘরে যা টাকা—কড়ি আছে, তাই নিয়ে তুমি আমাদের কাছে চলে আসবে। যে দেশে তাকে বিক্রি করা হবে, তাকে বার বার সেই দেশের মেয়ে বলা হয়— সেও সম্মোহিত হয়ে সেই কথা বলে। ছেড়ে দিয়ে তার ওপর তীক্ষ্ন নজর রাখে এরা। প্রায়ই চৌদ্দ দিনের দিন—সে মেয়ে দিনে হোক, রাত্রে হোক, বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসবেই, একটা নাম তাকে বলা থাকে,—তার কাছে গিয়ে সেই নাম বললেই সে তার সঙ্গে আবার চলে আসবে। আমাকে দিয়ে এরা কী করবে, করিয়েছে, মনে নেই। তবে চোখের সামনে দেখলাম রেবা, ঊষসী, মানসী, অসীমা, সবাই বিক্রি হয়ে গেছে। এখানে ওরা মেয়েগুলোকে তালিম দিতে একবার আনে, আর সমুদ্রপথে চালান দেবার সময় একবার আনে। রুমা বলে একটি মেয়েকে পরশু নিয়ে গেছে বাড়িতে, এখান থেকে ইনজেকশন দিয়ে নিয়ে গেছে। আমি—

আর নেই। চিঠিটার সবটা থাকলে ভালো হত। তবে রুমার ফিরে আসার সঙ্গে অদ্ভুত তারিখ অবধি মিলে গেছে। কিন্তু ইনজেকশনটা কী? ব্লাডে হয়তো তাই পাওয়া গেছে, ঠিক সেই জন্যই এখানকার ডাক্তাররা ধরতে পারছেন না। একবার জিজ্ঞেস করলে হয়।

এসপ্ল্যানেডে নেমে সার্কুলার রোডের ট্রামে উঠল সোনা। বিধুর বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছল, তখন বিধু আর দুটি ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে।

—তুই হঠাৎ? বিধু বলল।

—এমনি। দরকার আছে।

তারা চলে গেল, বিধু ফিরে এল।

—কে ওরা?

—আমার পুরনো বন্ধু। একটি বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বিলেতে।

—এত রাত্তিরে? খাবার নেমন্তন্ন ছিল বুঝি?

—হ্যাঁ। না, এমনি কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।

—ও! চল!

ধীরে ধীরে সেই ইনজেকশনের কথা জিজ্ঞেস করল সোনা। চুপ করে রইল বিধু। পরে বলল—আমি আমার গুরুর কাছে যা শিখেছি, তাতে ভাই এমন ইনজেকশনের কথা বাপের জন্মে শুনিনি। এ তো সেই তান্ত্রিক সন্ন্যাসী—ফন্ন্যাসীরা করে। হিপনোটিজম যাকে বলে আর কি!

—ব্লাড—এর মধ্যে দিয়ে হিপনোটিজম ইনজেকট করা কি জার্মানিতে ইনভেনট হয়েছে, জানিস?

খানিকক্ষণ যেন সোনাকে দেখে নিল বিধু। তারপর বলল, না। কেন এ কথা বলছিস বলতো?

—তুই একদিন রুমাকে দেখে এলেই বুঝতে পারবি!

—রুমাকে? আমি তো রোজই যাই দেখতে।

—সে কি!

—হ্যাঁরে! তোর লেডি—লাভ সে। ভেবেছিলাম, আমার ক্ষমতার মধ্যে থাকলে—

—So kind of you.

—না—না, এটা আমার কর্তব্য।

দুজনে বাইরের ঘরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বেরোতেই দেখল, সেই লোক দুটি ফিরে এসে একেবারে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একজনের চোখ দেখে চমকে উঠল সোনা। কী পাওয়ারফুল চোখ!

—কি গো তোমরা ফিরে এলে? বলল বিধু।

—তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। শোন! একটু তফাতে নিয়ে গিয়ে কী যেন বলল সে।

বিধু হেসে বলল, কী আশ্চর্য! অ্যাবসার্ড! ও! তোদের পরিচয় নেই! আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু সোনা সরকার। বাংলাদেশের অন্যতম বেস্ট ফুটবলার। আর এঁরা হচ্ছেন, জনাব আমিনুদ্দিন জাহির, মিঃ চন্দ্রশেগরান এবং সেই আশ্চর্য চোখের লোক মিঃ অপূর্ব সোম।

ট্রামে বসে আসতে আসতে হঠাৎ কী একটা স্ট্রাইক করল সোনার মনে। সে পকেট থেকে ছোট ডায়েরি বার করে কী যেন টুকে রাখল।

পুলিশ এ অবধি যা সংগ্রহ করেছে, তাতে অরিজিৎ যে দোষী এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যতক্ষণ না আরও কিছু খবর পাওয়া যায়, ততক্ষণ চার্জ ফ্রেম করা মুশকিল। জেলে অফিসার দেখা করলেন এবং অরিজিতের সত্য গোপন করবার চেষ্টা দেখে আরও নিঃসংশয় হলেন তাঁরা।

পরদিন মায়ের কী একটা কাজে বসিরহাট মোটর সাইকেলে যাচ্ছে সোনা। তার মাসিমা থাকেন সেখানে, খবরটা জরুরি, কিন্তু সোনা ছাড়া যাবার লোক নেই। অতএব সোনা ঠিক করল, বেলা তিনটে নাগাদ বেরোলে বসিরহাটে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আসতে রাত্রি সাতটা—আটটা বাজবে। তারপর রুমার কাছে গেলেই হবে।

দু’ধারে জঙ্গল। দূরে একটা পোড়োবাড়ি। এককালে কোনো বড়লোকের বাড়ি ছিল। বাড়ির বাইরে মাঠের মাঝখানে একখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে। সোনা দেখল, গতকালের সেই তিনটে লোক দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল। সোনা চমকে উঠল। দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই গাড়িটা কলকাতার দিকে গেল।

সোনা দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর মাসির বাড়ি কাজ সেরে, ফিরবার পথে সেই বাড়িটার কাছে মাঠে গাড়িটা রাখল। মেন গেট বন্ধ। ঘুরতে ঘুরতে একটা ভাঙা পাঁচিল দিয়ে ভেতরে ঢুকল। মূল বাড়িতে ঢোকবার একটি ছোট খিড়কির দরজা।

কড়া নাড়তেই তালা খোলবার শব্দ হল। কালো মতো একটি মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে তাকে দেখে তাড়াতাড়ি বন্ধ করবার উপক্রম করল। সোজা ঠেলে দাঁড়াল সোনা। পকেট থেকে রিভলবার বের করে বলল, একটা আওয়াজ করেছ কি গুলি করব।

—তুমি কি পুলিশ?

—হ্যাঁ।

—দরজা ছেড়ে দাও। আমি পালাই।

—চুপ। ভেতরে ঢুকে সোনা বলল, তালা লাগাও। চাবি দাও আমাকে। যদি বাঁচতে চাও, এইখানে দাঁড়িয়ে থাক। বাবুরা কি আছেন?

—না।

—যে বাবু এখানে পাহারা দেন, তিনি আছেন?

—না। তিনি কলকাতা গেছেন সাধুবাবার সঙ্গে। সকালে ফিরবেন।

একেই বলে সুবুদ্ধি। সোনার আজকাল কী মনে হয়েছে রিভলবারটা সব সময় নিজের কাছে রাখে। রাত্রি দশটা বাজে। সোনা দোতলায় উঠল। প্রত্যেক ঘরে ঘরে একটি করে মেয়ে শুয়ে আছে। একটি মেয়ে নাচ প্র্যাকটিস করছে। দরজার ওপর দাঁড়িয়েছিল একটি তরুণী। তাকে সোনা বলল, প্রতিমা কোথায়?

—প্রতিমা?

—হ্যাঁ।

—কী প্রতিমা? দুগগা প্রতিমা?

সোনা কোনো কথা না বলে এগিয়ে গেল। সবসুদ্ধ প্রায় পনেরোটি মেয়ে। কারও সঙ্গে কথা বলতে না পেরে সোনা বেরিয়ে এল।

এ মেয়েটি বোধ হয় ঝি। হঠাৎ সেই মেয়েটি সোনার পায়ে আছাড় খেয়ে বলল, বাবু আমায় বাঁচান! আমার কোনো দোষ নেই।

কী ভাবল সোনা। বলল, যদি বাঁচতে চাও, তবে এখানে আমার কথা কাউকে বলো না। বললে তোমাকে আর বাঁচাতে পারব না।

—বলব না বাবু! বাড়িতে আমার চারটে কাচ্চাবাচ্চা। আমি চাকরি করতে এসে ফেঁসে গেছি।

—ঠিক আছে। তুমি বেঁচে যাবে।

এই বলে সোনা এগিয়ে গিয়ে কী ভেবে ফিরে এসে বলল, এতগুলো মেয়েকে নিয়ে এই মাঠে থাকো, কুকুর নেই তোমাদের?

—আছে। বাঘের মতো চারটে কুকুর আছে। রাত বারোটা থেকে তাদের খুলে দেওয়া হয়। বাবুদের শুতে—শুতে বারোটাই হয় তো! আমি বেঁচে যাব তো বাবু?

—হ্যাঁ—হ্যাঁ। বাকি সবাইকার ফাঁসি হবে জেনো।

পথে যেতে যেতে সেই গাড়িটা ক্রস করল। সোনা ভাবল কালকেই পুলিশ নিয়ে হানা দেবে নাকি? পরে ভাবল, তাহলে আসল ক্রিমিন্যাল ধরা নাও পড়তে পারে। তারা ওখানে থাকে না। কিন্তু ঝিটা যদি বলে দেয় তাহলে এরা পালাবে। কিন্তু ব্রেনটা যদি ধরা না পড়ে তাহলেই গণ্ডগোল।

হিসেব করে দেখল সোনা, আগামী পরশু হচ্ছে মেয়েটির হিসেব মতো চৌদ্দো দিন রুমার বাড়ি আসার। চিঠি যদি সত্যি হয়, তবে পরশুই ওরা রুমাকে নিয়ে যাবে।

পরদিন ভোরে মনোতোষের বাড়ি আসতেই তিনি বললেন, একটা ব্যাপার হয়েছে। কাল রাত্রিতে দেখলাম, একটা অ্যাটাচিতে আমার আয়রন সেফ খুলে রুমা টাকা ভরছে। ধরতে কোনো জবাব দিতে পারল না। শুধু বলল, যতটা পারি নিয়ে যাব। কী ব্যাপার বলতে পার?

পকেট থেকে চিঠিখানা বার করে মনোতোষকে দিল সোনা। গত দিনের অভিজ্ঞতাও বলল, সমস্ত ব্যবস্থা কমপ্লিট হয়ে গেল। পুলিশ কমিশনার সোনার কাজ সম্বন্ধে খুশি হয়ে তার ইচ্ছে মতো পুলিশের ও অফিসারের ব্যবস্থা করে দিলেন।

আগের রাত্রে বিধুর বাড়ি কথাটা বলতে গিয়ে তাকে পেল না সোনা! ফলে নীলেশকে তার কাছে থাকতে বলল। স্বপনকে বলা না বলা সমান। দুখানি গাড়ি প্রস্তুত রইল। অন্যান্য পুলিশ ও অফিসার ইচ্ছে মতো পোসটিং করল।

সমস্ত দিন ছটফট করছে রুমা। সোনার ইচ্ছে মতো পাঁচ হাজার টাকা অ্যাটাচি কেসে রেখে দিয়েছেন মনোতোষ। সেটা রুমা সব সময় কাছে রেখেছে। সোনা অনেক চেষ্টা করল তার সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু বৃথা চেষ্টা।

সন্ধের আগেই রুমা আবার সেই ইরানি পোশাকে সাজল। তারপর অন্ধকার হতে অ্যাটাচি কেসটা হাতে করে বাগানে বেরিয়ে এল। সোনা একটা ঝোপের পাশে লুকিয়ে, তাকে ওয়াচ করতে লাগল। রুমা পায়চারী করে। এদিক—ওদিক চায়।

দূরে একটা মালিকে দেখা গেল। সে এদিক—ওদিক দেখে রুমার কাছে এসে বলল, আমি অপূর্ব—

হঠাৎ যেন স্টিফ হয়ে গেল রুমা। বলল ফিসফিস করে—আদেশ করুন।

—টাকা নিয়েছ?

—হ্যাঁ।

—এস আমার সঙ্গে। এই বলে দুজনে মেন গেটের দিকে না এগিয়ে উত্তর—পূর্ব দিকের পাঁচিলের দিকে এগোল। সোনার মনে পড়ল—ওদিকে একটা ছোট্ট দরজা আছে। সোনা বোঁ বোঁ শব্দে তাদের দুখানা গাড়ির দিকে ছুটে গেল। বলল, আস্তে আস্তে ফলো কর। ওরা ওদিক দিয়ে বেরিয়েছে। গাড়ি চলতে শুরু করল, পেছনের গাড়িতে রইলো পুলিশ ছদ্মবেশে। প্রথমে গাড়িটাকে তারা দেখতে পেল না। দূরে একটা মোড়। ঘুরতেই দেখা গেল গাড়িখানা যাচ্ছে। সোনা বলল, কোনোরকম বুঝতে দিও না যে আমরা ফলো করছি। বেলগাছিয়ার ব্রিজের কাছে আর একখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল পথের পাশে চুপ করে আলো নিভিয়ে। রুমার গাড়িটা কাছে আসতেই ওদের ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে কী বলল। চোখের পলকে দুখানা গাড়ি ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করল। সোনা বলল, সর্বনাশ হয়েছে—ওরা আমাদের দেখতে পেয়েছে। চালাও গাড়ি। সে কি রেস! সামনে দুখানা গাড়ি ছুটছে, পিছনে দুখানা গাড়ি ছুটছে।

হঠাৎ সোনার মনে পড়ল—সামনের মধ্যমগ্রামের রাস্তায় গাড়ি সোজা দিকে বেরিয়ে গেলে পুলিশের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।

সোনা রাইফেল তুলে নিয়ে পেছনের ধাবমান গাড়িটার চাকা তাক করে গুলি করল। মিস করাতে ও গাড়ির বেগ ডবল হল।

হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা গেল। ড্রাইভার বলল, সোনাবাবু, মাথা নামান, ওরাও গুলি করছে। সোনা আবার লক্ষ স্থির করে গুলি করল। প্রচণ্ড একটা শব্দ। গাড়িখানা ঘুরতে ঘুরতে রাস্তা থেকে কুড়ি—পঁচিশ ফিট নীচে মাঠের মধ্যে গিয়ে পড়লো। চাকা উপরে, গাড়ি নীচে। বিরাট অ্যাকসিডেন্ট।

হঠাৎ সোনা চিৎকার করে উঠল—এ গাড়িতে রুমা ছিল না তো।

—না। সেটা আগের গাড়ি। বেরিয়ে গেছে।

—যাক। কিছু ভয় নেই। গাড়ি থামাও। সোনা পেছনের পুলিশের গাড়ির অফিসারকে ডেকে বলল—

—এ গাড়িটায় যিনি ছিলেন, নিঃসন্দেহে তিনিই ব্রেন। রুমাকে নতুন করে হিপনোটাইজ করার জন্য এঁর গাড়ি অপেক্ষা করছিল। কাম অন।

বিরাট অ্যাকসিডেন্ট! ড্রাইভারটার বুকে স্টিয়ারিং গেঁথে গেছে। সবাই মিলে প্রবল বলে গাড়ির বডি সরাতে দেখা গেল, চাকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আর একটা বডি।

টর্চের আলো ফেলল তার মুখে। সবিস্ময়ে সবাই চিৎকার করে উঠল, একি! এ যে আমাদের বিধু ডাক্তার! চোটটা খুব সাংঘাতিক হওয়াতে তারা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল বিধুকে।

যে গাড়িটা বেরিয়ে গিয়েছিল, তাকে অ্যারেস্ট করে পুলিশ এল। তারা পথ আটকে ছিল। সেই রাত্রেই ভাঙা বাড়ির সব মেয়ে পুলিশের জিম্মায় চলে গেল।

পরের দিন থেকে রুমা সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। আনন্দ কলরোল জেগে উঠল।

তিন মাস পরে বিচারালয়ে বিধু তার অপরাধ স্বীকার করল। তবে সে বলল, সে বেতনভোগী চাকর। আসলে অপূর্ব প্রভৃতি পঁচিশজন লোক এই সংস্থার মালিক। প্রত্যেক ইনজেকশনের জন্য বিধু দু’হাজার টাকা পায়। সোনা বিধুর প্রত্যেকটি কাজ বিশ্লেষণ করে দেখালে যে সব কাজেই অপরাধের গন্ধ ছিল। শুধু বন্ধুদলের মাঝখানে ছিল বলে সন্দেহ তার ওপর পড়েনি।

জার্মানি থেকে রক্তের রিপোর্ট এল। ডকটর স্নিকবার্গ এই ইনজেকশনের আবিষ্কর্তা। এখনও পরীক্ষার ক্ষেত্রে আছে বলে পৃথিবীতে এর ব্যাপক প্রচলন হয়নি। হলে রোগীর ক্ষেত্রে তো বটেই, অপরাধ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও যুগান্তর আনবে। পনেরো দিন থাকে এর ক্রিয়া।

অরিজিৎ—এর গুপ্তধন সোনা রাজি হল বার করে দেবে। তবে তাকে শেয়ার দিতে হবে। ভিরু ভালো মানুষ অরিজিৎ মায়া—মঞ্জিল নবদম্পতিকে দান করলেন। কলকাতার পুলিশ এই ব্যাপারে পুরস্কৃত হল। কারণ সোনা বলল, ওঁদের সাহায্য না পেলে কিছুই হত না।

দলের প্রায় সবাই ধরা পড়েছিল। শুধু দু’একজন বিদেশে পালিয়েছিল। যাই হোক এই ঘটনার পর কলকাতায় মেয়ে চুরির খবর আর শোনা যায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *