প্রথম সোপান
১
১৯৪৮ সালের অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে আমরা যখন পাবনা যাই তখন আমি ফোর-এ পড়ি। বছর শেষ হয়ে এসেছিল, তাই নতুন করে স্কুলে ভর্তি হয়ে পরীক্ষা দিয়ে ফাইভে ওঠার সময় ছিল না। কাজেই ওই পরীক্ষাটা আমার জীবন থেকে বাদ পড়ে যায়। ১৯৪৯ সালে স্কুল-কর্তৃপক্ষ রাজি হওয়ায় আমি সোজাসুজি রাধানগর মজুমদার একাডেমিতে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হই।
২
আমাদের স্কুলের কার্যক্রম আশ্চর্য শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলত। তার পেছনে ছিল আমাদের হেডমাস্টারের বিরল যোগ্যতা ও অসামান্য ব্যক্তিত্ব।
ফরসা, দীর্ঘ, ছিপছিপে গড়নের, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সেই অনন্য চেহারা ভুলে যাওয়া কঠিন। তাঁর নাক ছিল তীক্ষ্ণ, থুতনির বিভক্তি ছিল সুস্পষ্ট, দুই ভ্রূ দুদিকে কিছুটা বাড়ানো, ধবধবে শাদা ধুতি, শাদা পাঞ্জাবিতে তাঁকে প্রখর ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রোমান সেনেটারদের মতো লাগত। ক্বচিৎ তাঁকে আমরা স্কুলের বারান্দায় দেখতে পেতাম। নিজের ঘরে বসেই তিনি স্কুল চালাতেন। আমার ধারণা, সেখান থেকেই গোটা স্কুলটাকে ছবির মতো দেখতে পেতেন। দূর থেকে তাঁকে দেখলেও আমাদের বুক ঢিপঢিপ করত, তাঁকে দেখতে না হলে আমরা বেঁচে যেতাম।
যা কল্পনাও করিনি তাই ঘটল একদিন। সিক্সে পড়ার সময় একটা ব্যাপার নিয়ে আমাকে সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ হেডমাস্টারেরই মুখোমুখি হতে হল। ব্যাপারটা কিছুই নয়। আজকের হিশেবে ধরলে একেবারেই সাধারণ, কিন্তু সে-সময় এতটুকু ঘটনাকেও শৃঙ্খলার দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক বড় করে দেখা হত। ব্যাপারটা ধরেই আমাদের ক্লাসে হেডমাস্টারের প্রথম পদপাত। ঘটনাটা একেবারেই সামান্য। আমার সামনের বেঞ্চে বসা একজন ছাত্র অন্য এক ছাত্রের—যার সাথে তার ঝগড়া চলছিল—একটা কিম্ভূত ছবি এঁকেছে। পেছনের বেঞ্চ থেকে আমি তাকে ছবিটা আঁকতে দেখেছি। ছবিটা একেবারেই ভালো হয়নি, ব্যর্থতার পরিমাণ এতটাই যে, যার ছবি তাকে প্রায় চেনা অসম্ভব বলে ছবির নিচে তার নামটা বড় বড় অক্ষরে লিখে দিতে হয়েছে। ছবি আঁকার পর শিল্পী পা দিয়ে ঠেলে কীভাবে যেন সেটাকে যার ছবি তার পায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। ছবিটা পেয়ে সে তো রেগে কাঁই। সে সঠিকভাবেই সন্দেহ করছে ছবিটা কার আঁকা। কিন্তু তার হাতে এর কোনো প্রমাণ নেই। স্যারের কাছে সে এ নিয়ে নালিশ করল। স্যারও যথার্থভাবেই ধরে নিলেন অভিযুক্ত ছেলেটি ছবি এঁকেছে কি-না আমি তা জানি, যেহেতু আমি বসেছিলাম তার পেছনের বেঞ্চে, কিছুটা বাঁ দিকে সরে। আমাকে তিনি মোটামুটি সত্যবাদী বলে জানতেন বলে ভেবেছিলেন আমাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আসল খবরটা পাবেন। স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘ছবিটা কে এঁকেছে?
উত্তর দিতে গিয়ে আমি নৈতিক সমস্যায় পড়ে গেলাম। ছবিটা এঁকে ছেলেটা এমন কিছু দোষের কাজ করেছে বলে আমি মনে করি না। অথচ তার নাম ফাঁস হলে সে স্যারের হাতে বেধড়ক মার খাবে। মারের ব্যাপারে ঐ স্যার খুবই নামজাদা। এখন করা কী!
হঠাৎ একটা গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটা এক অধ্যাপককে নিয়ে (অধ্যাপক হেড়ম্ব মৈত্র কি?)। গল্পটা কিছুদিন আগেই রাধানগর লাইব্রেরিতে মহাদেবদার কাছে শুনেছিলাম। অধ্যাপক মহোদয় ছিলেন অসম্ভব নীতিবাদী। এতই নীতিবোধ তাঁর যে, সিনেমা দেখাকেও তিনি গর্হিত কাজ মনে করতেন। একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, এমন সময় এক যুবক হঠাৎ তাঁকে জিজ্ঞেস করল : ‘অমুক সিনেমাহলটা কোথায় বলতে পারেন?’ সিনেমাহলটা কোথায় তিনি জানতেন। কিন্তু প্রশ্ন শুনে তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। মুখ বিকৃত করে বললেন : ‘না, জানি না।’ ব্রিত হয়ে যুবক চলে গেল। যুবক পেরিয়ে যেতেই অধ্যাপকের মনে হল, তিনি তো মিথ্যাকথা বলে ফেলেছেন। সিনেমাহলটা কোথায় তা তো তিনি জানেন। না, না, মিথ্যা বলা তো চলতে পারে না। তিনি পেছন ফিরে তাড়াতাড়ি হেঁটে গিয়ে যুবককে ধরে ফেললেন। বললেন, ‘এই শোনো! সিনেমাহলটা কোথায় তা জানি না তা নয়। আসলে আমি জানি কিন্তু বলব না।
গল্পটা শুনে আমি খুবই উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। ভদ্রলোকের সত্যবাদিতা আমাকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল। আমার কেন যেন মনে হল, স্যারের প্রশ্নের উত্তরেও একই জবাব দেওয়া যায়। তাতে সত্যকথাও বলা হয় আবার ছেলেটাকে অযথা মার-খাওয়ানোর হাত থেকেও বাঁচানো যায়। আমি ঐ উত্তরই স্যারকে দিলাম।
আমার উত্তর শুনে প্রথমে স্যার কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন। হয়ত বুঝতে কিছুটা কষ্ট হল। কিন্তু বোঝার পর নানাভাবে আমার কাছ থেকে আসল কথা বের করতে চেষ্টা করলেন। ব্যর্থ হয়ে রেগে হেডমাস্টারের কানে কথাটা তুললেন।
যে হেডমাস্টারকে যমের মতো ভয় করি তাঁকে এত সামনে দেখে আমার হাত- পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কিন্তু মমতার শক্তি আমাকে অবিচল করে রাখল।
হেডমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন : ‘কে এঁকেছে ছবি?’ আমি আগের মতোই বললাম : ‘জানি, বলব না।’ হেডমাস্টার মশাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। ক্লাসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। কী হয় দেখার জন্যে সবাই উন্মুখ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্যার গম্ভীর গলায় বললেন : ‘সত্য বলার জন্যে তোমার প্রশংসা করছি, কিন্তু উত্তর না-বলার জন্যে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে
আমি আগের মতো একগুঁয়ে ভঙ্গিতেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কড়া শাস্তিই দিলেন হেডমাস্টার : আগামী সাত দিন ফার্স্ট পিরিয়ড থেকে লাস্ট পিরিয়ড পর্যন্ত আমাকে পেছনের বেঞ্চের উপর একঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আমি তাঁর শাস্তি মাথা পেতে নিলাম। আমি প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা ধরে তাঁর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। সাত দিন একটানা এভাবে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে আমি কিন্তু কষ্ট অনুভব করিনি। আমার মনে হত আমি সত্যকথা বলেছি। অযথা মার-খাওয়ানোর হাত থেকে একজনকে বাঁচাতে গিয়ে কষ্ট করছি। এ-কথা ভাবলেই আমার কষ্টের ভার কমে যেত। আমি দু-একবার ভেবেছি, যার জন্যে ঐ সাতটা দিন বেঞ্চের উপর ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সে আমার বন্ধু বা কাছের কেউ ছিল না। সে কি বুঝতে পেরেছিল যে কেবল একটা মানুষ অহেতুক শাস্তি পাবে এটা ভাবতে খারাপ লেগেছিল বলে, আমি তার শাস্তির চেয়ে অনেক বেশি শাস্তি নিজের ওপর নিয়েছিলাম?
৩
আমাদের বাসায় কলেজের একজন ছাত্রী প্রায়ই আসতেন। বড়আপার খুবই ঘনিষ্ঠ তিনি। ভারি ফুটফুটে চেহারার মেয়ে, চোখগুলো কথায় ভরা। হাসিতে গল্পে বাসাটাকে মাতিয়ে রাখতেন। তখন আমি বছর-দশেকের, সবে সিক্সে উঠেছি। একদিন হতবাক-করা একটা কথা বললেন তিনি। আমরা সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বড়আপাকে বললেন : আপনার ভাইটা দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দর। সত্যি সত্যি ‘সুন্দর’ শব্দটা তিনি ব্যবহার করলেন। তাঁর হাসিভরা চোখে সপ্রশংস দৃষ্টি। শুনে প্রায় বোকা হয়ে গেলাম। আমি সুন্দর। সুন্দর হওয়াটাও জীবনের একটা ব্যাপার তাহলে! (কত ব্যাপারই না আছে জীবনের ভেতর!) দু-তিন দিনও গেল না, আমার এক বন্ধুর বড়বোনের কাছ থেকে প্রায় একই কথা শুনলাম। নিজেকে বেশ দামি-দামি মনে হতে লাগল। এই অনুপ্রেরণার পথ ধরে পরদিন সকালেই আয়নার ওপর ভালো করে চোখ রাখতেই একটা মোটামুটি সুশ্রী চেহারার ছেলেকে আবিষ্কার করলাম তার ওপর। আমি একরকম যেন তার প্রেমেই পড়ে গেলাম। এতদিন আয়নাটা ছিল আমার চুল দেখার জিনিশ, এখন হল চেহারা দেখার। রবীন্দ্রনাথের ‘কঙ্কাল’ গল্পের রূপসী মেয়েটা যেভাবে নিজের অপরূপ সৌন্দর্যকে নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখত, নিজেই নিজের প্রেমিক হয়ে নিজের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখে নিজে সম্মোহিত হত, আমিও তেমনি আয়নায় নানান দিক থেকে নিজেকে দেখতে লাগলাম। না, ‘মহেন্দ্ৰনিন্দিতকান্তি, উন্নত দৰ্শন’ আমি ছিলাম না, তাই মেয়েটির মতো দুঃখজনক অবস্থায় আমাকে পড়তে হয়নি। তবু আমি ফাঁক পেলেই লুকিয়ে লুকিয়ে এদিক- ওদিক থেকে নিজেকে দেখতাম। আমার এই ঘোর বছর-কয়েক চলেছিল।
কে নিজের চেহারাটাকে অমন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানান ভঙ্গিতে দেখলে খুশি না হয়? সেলুনে চুল কাটতে যাওয়া বদখত চেহারার মানুষগুলো যেভাবে নিজেদের মুখগুলোকে নানান দিক থেকে নানান ভঙ্গিতে ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে দেখে, তা দেখেও তো ঐ একই কথা মনে হয়। যেন নিজের চেহারাটাকে আশ্বস্ত করে বলতে চায় : ওরে আবদুল কুদ্দুস, অনেকেই আছে এই পৃথিবীতে; কিন্তু তোর মতো কেউ নেই রে। কেউ নেই।
নিজের চেহারা নিয়ে আত্মপ্রেমে ভুগি আমরা সবাই। এখানে সুন্দর-অসুন্দরে কোনো পার্থক্য নেই।
ধরুন, আপনি কোনো ফটোগ্রাফির স্টুডিওতে ছবি তুলে পরের দিন গেছেন ছবি আনতে। ফটোগ্রাফার একগাল হেসে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে আপনাকে বললেন : “চমৎকার উঠেছে ছবি। এক্কেবারে আপনার মতো। আপনার চেহারার প্রতিটি বৈশিষ্ট্য কেমন জীবন্ত হয়ে ফুটেছে দেখুন!’ যে-ছবিকে ফটোগ্রাফার বলল, ‘একেবারে আপনার মতো’ তা দেখে আপনি কিন্তু চূড়ান্ত হতাশায় একেবারে ভেঙে পড়লেন। গলা চড়িয়ে রীতিমতো খেঁকিয়েই উঠলেন, ‘একে আপনি আমার মতো বলছেন? ভাঁওতা দেবার জায়গা পান না! আমার চেহারা এরকম নাকি! (মানে, এত খারাপ নাকি?) আস্ত একটা দোকান দিয়ে বসে আছেন, সামান্য একটা ছবি তুলতেও শেখেননি আজ পর্যন্ত।
সেই দোকানে ব্যর্থ হয়ে ধরুন আপনি আরেক দোকানে গেলেন ছবি তুলতে। পরের দিন যখন ছবি আনতে গেলেন তখন সেই ফটোগ্রাফার একটা উত্তম কুমারের বা দিলীপ কুমারের ছবি আপনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন : “খুব ভালো উঠেছে বলব না, তবে যতটা সম্ভব আপনার চেহারার কাছাকাছি করেই তুলতে চেষ্টা করেছি। আশা করি ছবিটা আপনার ভালোই লাগবে।’
যে-ছবির সঙ্গে আপনার চেহারার কোনো মিল নেই, সে-ছবি দেখে কিন্তু আপনি আনন্দে গদগদ হয়ে উঠবেন। খুশির আবেগে আপনার মনে হবে ছবিটা আসলে আপনারই। ফটোগ্রাফারকে মুহুর্মুহু ধন্যবাদ দিয়ে বলবেন : ‘অ্যাঁ, এ দেখছি হুবহু আমারই মতো। এত ভালো ছবি তুললেন কী করে ভাই আপনি? মানুষের এমন হুবহু ছবি তোলা যায়? সত্যি অসাধারণ ফটোগ্রাফার ভাই আপনি! ছবি নিয়ে কোথায় পড়াশোনা করেছেন? পুনায় না হলিউডে?’
৪
কথায় কথায় চেহারার কথাটা মনে এল এজন্যে যে, জীবনে আমার যে প্রথম ও সবচেয়ে সুন্দর বন্ধু হতে পারত তাকে আমি শুধু চেহারার কারণে বন্ধু বলে মেনে নিতে পারিনি। এই অপরাধবোধ আজও আমাকে কষ্ট দেয়।
স্কুলজীবনে আমার প্রথম বন্ধু অরুণ—অরুণকুমার ভট্টাচার্য। নেহাত ছেলেবেলার বন্ধুত্বেও যে-চেহারার কিছুটা ভূমিকা আছে, তা অনুভব করতাম আমার প্রতি অরুণের বিষণ্ণ আকুতি আর কাতরতা এবং ওর ব্যাপারে আমার অবহেলাপূর্ণ মনোভাব দেখে।
আমি তখন সদ্য রাধানগর স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছি। অরুণ ছিল আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। দেখতে ও ছিল ফরসা, মুখ গোল ধাঁচের, নাক কিছুটা বোঁচা—এমন কিছু নয় যাকে দশজনের মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়বে। ফার্স্ট বয় হিশেবে আমি ওকে সম্মানের চোখে দেখতাম। সামনের বেঞ্চে ওর পাশে বসতে পারলে গর্বিত হতাম।
হঠাৎ একদিন ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। আমাদের ক্লাস ফাইভের ইংরেজি বইটির প্রথম প্রবন্ধের নাম : মাই মাদার। প্রবন্ধটির প্রথম লাইন হল : ‘মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অন আর্থ ইজ মাই মাদার।’
একদিন ক্লাস চলছে এমন সময়ে ফস করে অরুণ আমাকে একটা ভাঁজ করা কাগজ দিল। বলল : ‘টিফিনের সময় দেখো।’ আমি অস্থিরভাবে টিফিনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। টিফিন হতেই কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরলাম, দেখি তাতে লেখা : ‘মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অন আর্থ ইজ সাঈদ।’ (তখন আমার নামের ঐ বানান আমি লিখতাম)। —অরুণ
.
বন্ধুত্ব নিবেদন করতে ক্লাস ফাইভ-পড়া ছাত্র তার জ্ঞানের আওতার সবচেয়ে সুন্দর বাক্যটাই ব্যবহার করেছে।
চিঠিটা পড়ার সময় অরুণ ছিল কিছুটা দূরে। দেখলাম, ও তাকিয়ে আমার চিঠিপড়া দেখছে। ওর বন্ধুত্বপ্রস্তাব আমি গ্রহণ করছি কি না আমার চেহারা দেখে হয়ত আঁচ করে নিচ্ছে।
বন্ধুত্ব কাকে বলে তখনও তা আমার অজানা ছিল। অনেক ছেলের সঙ্গেই এর আগে মিশেছি, খেলাধুলা করেছি; কিন্তু তার নাম যে ‘বন্ধুত্ব’ তা কে জানত। তাই ‘বন্ধু’ কথাটা পড়ে একেবারে লাল হয়ে উঠলাম! কী লজ্জার কথা। যেন কোনো মেয়েকে প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে কেউ!
তাছাড়া মুহূর্তের জন্যে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ কথাটাকে আমার কাছে কেন যেন ‘একমাত্র বন্ধু’ বলে মনে হল। ঐ অপরিণত বয়সে কোনোকিছুকেই ‘একমাত্র’ ছাড়া মানুষ ভাবতে পারে না। কিন্তু এ কী করে সম্ভব! ‘শ্রেষ্ঠ বা একমাত্র বন্ধু’ যে হবে তাকে কি সব দিক থেকে সেরা হতে হবে না!
হলই-বা ও ক্লাসের ফার্স্ট বয়, হলই-বা ওর গায়ের রঙ ফরসা বা ছেলে হিশেবে সহজ-সরল, কিন্তু তাতে কী? ওর নাক যে খাঁদা-মার্কা, চেহারাটাও যে বোকা- বোকা, সেসব কি দেখতে হবে না? শ্রেষ্ঠ বন্ধু হবার মতো সুন্দর কি ও? ওর জন্যে আমার স্বাভাবিক অনুভূতিটুকুও যেন শীতল হয়ে এল। ওর জন্যে আমার গৌরববোধ মিইয়ে এল। যাকে দেখলেই খুশি হতাম, তাকেই কেমন যেন বিস্বাদ আর অসহ্য লাগতে শুরু করল। ওকে আমি পছন্দ করি, ঠিক আছে; কিন্তু ওর সঙ্গে কোনো অঙ্গীকারে আটকা পড়তে আমি নারাজ। বেস্ট ফ্রেন্ড হিশেবে কবুল করে নিতে তো নয়ই। ওর প্রস্তাব আমাকে একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল। মুক্তির জন্যে আমি ওকে এড়িয়ে চলতে লাগলাম।
দামি জিনিশ মোফতে পেয়ে গেলে হয়ত এমনি শস্তা আর তুচ্ছ হয়ে পড়ে। জীবনের বোঝা হয়ে যায়। অরুণও আমার কাছে তেমনি অসহ্য আর অতিরিক্ত হয়ে উঠল। ওর গুণগুলো আরও শাদামাঠা, চেহারাটা আরও নির্লজ্জ বলে মনে হতে লাগল।
কিন্তু যতই বিরক্তকর লাগুক, জীবনের বাস্তবতার হাত থেকে রেহাই পাওয়া সোজা নয়। দিন-দুই যেতেই অরুণ বলল : ‘আমার চিঠির উত্তর দিলে না তো!’ কী উত্তর দিই চিঠির? কী লিখি? এ তো একটা ভারি দম-আটকানো অবস্থা। এ- কথা কি লেখা সম্ভব, আমি ওকে পছন্দ করি না? এতে তো ও মনে কষ্ট পাবে! একটা মানুষকে কি এভাবে কষ্ট দেওয়া উচিত? তাছাড়া ওর দোষই-বা কী? আমাকে ওর ভালো লাগে, এই তো! এর মধ্যে অন্যায়টাই-বা কি! ওকে কষ্ট দিতে পারলাম না। ওর মতোই একটা কাগজে একদিন লিখে দিলাম :
মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অন আর্থ ইজ অরুণ।
জানতাম এটা আমার মনের কথা নয়, নেহাতই অস্বস্তির সঙ্গে ওর মন-রাখার জন্যে একটা চালাকি, তবু যেভাবে ওর চিঠিটা ও ভাঁজ করে আমাকে দিয়েছিল আমিও আমার চিঠিটা সেভাবেই ভাঁজ করে ওকে দিলাম। চিঠিটা পড়ে ওর চোখদুটো খুশি হয়ে উঠল, লজ্জাও পেল।
অরুণ আমাকে খুবই ভালোবাসত। একেক সময় সবার সামনেই আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকত। ওর কাণ্ড দেখে সবাই হাসাহাসি করত। আমি অসম্ভব অস্বস্তিতে পড়তাম। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত।
অরুণকে আমি কিছুতেই বন্ধু বলে ভাবতে পারতাম না, তবু অঙ্গীকারে আটকা পড়ে ওর সঙ্গেই সারাক্ষণ গল্প করতে আর ঘুরে বেড়াতে হত। আমাদের স্কুলের পেছনেই ইছামতী নদী। শীতকালে নদীটা নিশ্চল আর স্রোতহীন হয়ে পড়ত। কোথাও কোথাও হয়ে পড়ত বদ্ধ ডোবার মতো, কোথাও কোথাও বেঁচে থাকত সামান্য স্রোতের এক চিলতে স্নিগ্ধ ধারা। কিন্তু প্রথম বর্ষায় যেদিন পদ্মার হিংস্র তীব্র ধারা এই ছোট নদীটার দুপাশ ভাসিয়ে আমাদের বাসার দোরগোড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত, সেদিন সেই নতুন অপ্রত্যাশিত পানির দুর্বার প্রবাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে কী উল্লাস আমাদের! খরস্রোতা নদীর সেই বন্য উচ্ছ্ৰিত হিংস্রতার সঙ্গে আমাদের দুরন্ত শৈশবের কী সহিংস কানাকানি। দেখতে দেখতে জীবনের কলরোল জেগে উঠত সেই ‘মাতিয়া ছুটিয়া’ চলা নদীর তীব্র ক্রূর বলীয়ান স্রোতোধারায়। নৌকার আনাগোনায়, মানুষের কলকণ্ঠে, কর্মপ্রবাহে, সংগীতে, পাল-তোলা নৌকার অপরূপ শোভাযাত্রায় নদী যেন প্রাণবন্ত আর সজীব হয়ে উঠত।
আমার কেবলই মনে হত, আহা এতদিন কোথায় ছিল এই প্রমত্ত বেগবতী নদী! কোন্ রূপকথার দৈত্য একে চুরি করে নিয়ে জাদু দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল!
শীতের কনকনে হাওয়ায় যখন গাছের পাতাগুলো ঝিরঝির করে কেঁপে চলত, আমি আর অরুণ তখন আমাদের বাসা পেরিয়ে বেশ কিছুদূর গিয়ে শাদা বালুর ওপর দিয়ে তিরতিরিয়ে বয়ে-চলা শীতকালের নদীর রুপোলি ধারায় পা ভিজিয়ে ওপারে চলে যেতাম। শালগাড়িয়ার গভীর জঙ্গলের দিকে এগোতে আমাদের সাহসে কুলোত না। নদীর ধারেই ছিল একটা বড়সড় দারুচিনি গাছ। তার নিচে বসে আমরা গল্প করতাম। চারপাশের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অরুণের ব্যাপারে আমার বিরক্তি কিছুটা কমিয়ে দিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতাম আমরা। এসব গল্প শৈশবের অকারণ-অবারণ প্রলাপ আর অর্থহীনতার খুশি আর আলোয় ভরা।
৫
কীভাবে ভারত ভাগ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ সংস্কৃতিমান, মূল্যবোধসম্পন্ন ও মানবিক অনুভূতিময় হিন্দুরা ধীরে ধীরে ও নিঃশব্দে, নতুন রাষ্ট্রের বিমাতাসুলভ নিরাপত্তাহীন ও অকর্ষিত আবহাওয়ায় এদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল তা আমি আমার ‘বিদায়, অবন্তী!’ স্মৃতিকাহিনীতে লিখেছি। কাউকে না-জানিয়ে প্রায় হঠাৎ করেই চলে যেত তারা। যাবতীয় সহায়-সম্পদ পানির দামে বেচে, বহুকালের বাস্তুভিটা ছেড়ে, অসহায় চোখের পানিতে দু’গণ্ড ভিজিয়ে, অগোচরে, প্রায়ই রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যেত। এই দেশত্যাগের পথ ধরে আমাদের সামনে দিয়ে একদিন এক-এক করে চলে গেল সবাই—যাদের মধ্যে জীবনের সৌন্দর্য, মর্যাদা আর প্রেমের পৃথিবীকে ছেলেবেলায় খুঁজে পেয়েছিলাম।
একদিন বিদায় নিল অরুণরাও। হঠাৎ একদিন ও আমাকে আলাদা করে ডেকে চুপিচুপি বলল, ওরা মাসখানেকের মধ্যে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। দেখলাম ওর চোখের কোণায় পানি চিকচিক করছে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এদেশে অনেক কিছু হতে পারে, এদেশের সব হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারে, আমি অরুণকে বেস্ট ফ্রেন্ড হিশেবে গ্রহণ না-করতেও পারি; কিন্তু তাই বলে ও চিরদিনের জন্যে এদেশ ছেড়ে যে চলে যেতে পারে, কোনোদিন ওকে আর কোথাও কোনোভাবেই দেখতে পাব না—এটা আমার কাছে সত্যিসত্যি অসহনীয় মনে হতে লাগল। হঠাৎ অনুভব করলাম তাচ্ছিল্য আর উপেক্ষার অসম্মান থেকে উঠে এসে অরুণ আমার সামনে পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষ হয়ে উঠেছে। অরুণের জন্যে আমার সত্যিকার যা অনুভূতি, সহজে পাওয়ায় যাকে আমি অনুভব করতে পারিনি, বরং অনেক সময়ই যাকে অসহ্য আর বিরক্তিকর বলে মনে হয়েছে; তাকে যেন সম্পূর্ণ আলাদা চেহারায় দেখতে পেলাম। বিচ্ছেদ এসে ওর জন্যে আমার আসল অনুভূতিকে স্পষ্ট করে তুলল। আমার হৃদয়ের গভীরতম জায়গায় অরুণের জন্যে যে কতখানি ভালোবাসা ছিল তা টের পেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। পৃথিবীর সব প্রিয় জিনিশই এভাবে আমাদের স্নায়ুতে প্রাণকোষে বাসা বেঁধে থাকে, না-হারানো পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারি না। কেবল মনে হতে লাগল, কোনোমতে যদি ওদের যাওয়া না হত তবে এতদিনের না-দেওয়া ভালোবাসা দিয়ে সেই ঋণ আজ আমি পরিশোধ করতাম। কিন্তু তখন ব্যাপারটা বেশিরকম দেরি হয়ে গেছে। অরুণকে এতদিন-যে কারণে-অকারণে তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর অপমান করেছি সেজন্যে নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী বলে মনে হতে লাগল।
বাস্তব পরিস্থিতিটায় অরুণ যেন একেবারেই হতবুদ্ধি হয়ে গেল। হঠাৎ এভাবে যে ওকে চলে যেতে হতে পারে তা ঐ ছোট, অবোধ শিশুটির হয়ত কল্পনারও বাইরে ছিল। ও ছিল এমনিতেই চুপচাপ, এই আঘাতে একেবারে ভাষাহীন হয়ে পড়ল। আমার দিকে একেক সময় অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকত, ওর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ত।
এদিকে ওদের যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। একদিন সত্যিসত্যি ওদের জিনিশপত্রের বাঁধাছাদার কাজ শুরু হল। আমিও এ-ব্যাপারে দিনকয়েক ওদের সঙ্গে নিঃশব্দে কাজ করে গেলাম।
একসময় সব দুরাশা মিথ্যা করে ওদের যাওয়ার দিন এসে দাঁড়াল। একদিন রাত দশটার দিকে পাবনা শহরের বাসস্ট্যান্ডে ওকে আমি বিদায় দিতে হাজির হলাম। যাত্রার সময় অরুণ একেবারেই ভেঙে পড়ল। হুহু করে কেঁদে উঠল। আমিও নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম। ওদের বাসার সবাই তখন কাঁদছিলেন। জন্মজন্মান্তরের দেশ ছেড়ে চলে যেতে সবার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল। ওদের বেশকিছু আত্মীয়স্বজন বাসস্ট্যান্ডে এসেছিলেন বাসস্ট্যান্ডে এসেছিলেন বিদায় দিতে। তাঁরাও কাঁদছিলেন। তাঁরাও ভেতরে ভেতরে দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পরিবারগুলো পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কে কোথায় ভেসে যাবে সেই উৎকণ্ঠায় সবাই তখন বিমূঢ়।
৬
অরুণ চলে যাবার পর আর-একজনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ছেলেটির নাম আবদুল্লাহ। ওদের বাড়ি ছিল পৈলানপুর থেকে সার্কিট হাউস-মুখো রাস্তার ডানদিকের কোনো-এক জায়গায়। আবদুল্লাহ প্রায়ই আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যেত। ওরা ছিল সম্পন্ন গৃহস্থ। ওদের বাড়ির লোকেরা ছিল খুবই শাদামাঠা, সরল স্বভাবের। আমার ভালো লাগত সবাইকে। আমাদের দুজনেরই নাম আবদুল্লাহ হওয়ায় ওর আব্বা একবার একটা খাসি জবাই করে লোক খাইয়ে আমাদের মিতা বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেকালের গ্রামীণ সংস্কৃতির এ ছিল একটা রেওয়াজ, হয়ত বন্ধুত্বের সম্পর্কের সূত্র ধরে দুই পরিবারকে আত্মীয়তার ভেতরে নিয়ে আসার এ ছিল উপলক্ষ। আবদুল্লাহর বাবা আমার আব্বাকেও নিমন্ত্রণ করেছিলেন অনুষ্ঠানের দিন। বাসার আরও কয়েকজন গিয়েছিল বলে মনে পড়ে।
আবদুল্লাহর চেহারা ছিল কিছুটা মেয়েলি ধাঁচের। মুখ ছিল বয়সের তুলনায় কচি। একহারা শরীরের জন্যে আরেকটু কমনীয় লাগত ওকে। অরুণের মতো ওর স্বভাবও ছিল নম্র এবং মৃদু, তাই ওর সঙ্গে কথা হত খুবই কম, তবু আমরা একসঙ্গে ঘুরে-বেড়ানো ছাড়াও অনেকরকম কাজেই জড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতাম।
একদিন হঠাৎ খবর পেলাম কয়েকদিনের মধ্যেই কলেজ মাঠে নেজামে ইসলামের তিনদিন স্থায়ী সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রধান অতিথি হয়ে আসছেন। নেজামে ইসলাম ব্যাপারটা কী, সম্মেলন কিসের, কিছুই জানতাম না। জানার আগ্রহও ছিল না। কিন্তু রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলাম শহীদুল্লাহ সাহেব আসছেন শুনে। উপমহাদেশের তখনকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ড. শহীদুল্লাহ, আঠারোটি ভাষা জানেন তিনি, এ-ছাড়াও বহু বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী। মনে হল ড. শহীদুল্লাহ নন, যেন স্বয়ং দেবদূত আসছেন সুদূর ঢাকা থেকে। তাঁকে কয়েকদিনের মধ্যে দেখার সৌভাগ্য পাব, ভাবতেও শরীরে রোমহর্ষ হতে লাগল।
কলেজের মাঠে সম্মেলনের বিশাল প্যান্ডেল তৈরির কাজ চলছিল। সাংগঠনিক কাজকর্মেরও বিরাম ছিল না। আমি আর আবদুল্লাহ প্যান্ডেল এলাকায় গিয়ে করুণ চেহারা নিয়ে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। যে-দেবদূতের আগমন উপলক্ষে এমন আয়োজন চলেছে আমরা এই দুটি অবোধ কিশোর কি সামান্যতমভাবে তাতে কোনো কাজে আসতে পারি? কী করেই-বা আমরা পারব? কীই-বা যোগ্যতা আমাদের। সামান্য একটু কাজ দিয়ে যদি কেউ এ-ব্যাপারে আমাদের করুণা করত তাহলেও আমরা যেন কৃতার্থ হয়ে যেতাম।
যিনি প্যান্ডেলের কাজ দেখাশোনা করছিলেন তাঁর কাছে গিয়ে আমাদের মনের কথা জানালাম। হয়ত তাঁরও লোকের ঘাটতি ছিল। তিনি আমাদের হাতে একটি শাবল ধরিয়ে দিয়ে প্যান্ডেলের খুঁটির গর্ত খোঁড়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন। যে প্যান্ডেলে ড. শহীদুল্লাহর মতো জ্ঞানতাপস ক’দিন পরেই বক্তৃতা করবেন সেই প্যান্ডেলের খুঁটির গর্ত খোঁড়ার মতো একটা অপরিমেয় গৌরবের কাজ-যে পাওয়া গেল তা ভেবেই নিজেদের ধন্য মনে হতে লাগল। আমরা একমনে গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে গর্ত খুঁড়ে চললাম। সাত-আটটা গর্ত খুঁড়তেই দুপুর হয়ে গেল। দুপুরে খাবারের ছুটি নিয়ে যে-যার বাসায় চলে গেলাম।
আমাদের কথা ছিল ঘণ্টা-দেড়েকের মধ্যে ফিরে এসে আবার কাজে হাত দেব। আমি সময়মতোই ফিরে এলাম; কিন্তু আবদুল্লাহ দেরি করতে লাগল। দেড় ঘণ্টা, দু-ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা যায়—আবদুল্লাহ আসে না। আমি একা একাই কাজ করে চলেছি। প্রায় চারটার দিকে আবদুল্লাহর ছোটভাই এসে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর চোখে পানি। জিজ্ঞেস করলাম : আবদুল্লাহ কোথায়?
ও কাঁদতে কাঁদতে বলল : ‘ঘণ্টাখানেক আগে মারা গেছে।’ ওর চোখের পানি টপটপ করে ঝরে পড়তে লাগল।
হঠাৎ যেন বাজ পড়ল মাথার ওপর। আবদুল্লাহ নেই! কয়েক ঘণ্টা আগের ওর কচি সজীব মুখ আমি তখনও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! সেই সপ্রাণ কণ্ঠস্বর, উষ্ণ নিশ্বাসের শব্দ আমার তখনও কানে আসছে। সেই আবদুল্লাহ নেই! অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করলাম : ‘কীভাবে মারা গেল!
ও বলল : ‘কলেরা হয়েছিল। একবার বাথরুমে গিয়েছিল। ফিরে এসে আর উঠতে পারেনি।’
ছুটলাম আবদুল্লাহদের বাড়িতে। গিয়ে দেখলাম, বিছানার ওপর লম্বা হয়ে আবদুল্লাহ শুয়ে আছে। সারা শরীর শক্ত, টানটান। ওর জিভ মুখ থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে ঝুলে আছে।
আবদুল্লাহর মৃত্যু আমার ঐ ছোট্ট জীবনটায় মৃত্যুর দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা। মৃত্যুর এই অভিজ্ঞতাগুলো জীবনের অর্থহীনতা সম্বন্ধে আমাকে সচেতন হতে সাহায্য করেছে। বিষয়-আশয়ের লোভ আর অকারণ আত্মপরতা থেকে আমাকে অনেকখানি মুক্তি দিয়েছে।
৭
রাধানগর স্কুলের সহপাঠীদের দুজনের গল্প বলেছি। আর দু-একজনের কথা বলে এই প্রসঙ্গের ইতি টানব। প্রথমে বলে নিই শ্রীপদর গল্প। ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্স পর্যন্ত আমি ছিলাম এ-সেকশনে। সেভেনে উঠে আমি বি-সেকশনে চলে যাই।
ফোর থেকে ফাইভে ওঠার মতো ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার সময়ও ফার্স্ট হয়েছিল অরুণ, সেকেন্ড হয়েছিল শ্রীপদ। বেতের মতো একহারা ঋজু চেহারার শ্রীপদ ছিল মুচির ছেলে। ওকে দেখলে আপোষহীন যোদ্ধার মতো লাগত। মনে হত নিজের নিয়তিকে জয় না-করে যেন ও ছাড়বেই না। স্কুলের কাছে মুচিপাড়ায় ছিল ওদের বাড়ি। পাড়াটা জঘন্যরকম নোংরা আর ঘিঞ্জি। বিশ-পঁচিশটা আলাদা আলাদা বেড়ার ঘর, প্রতি ঘরে একটা করে পরিবার—এই ছিল মুচিপাড়া। বেশকয়েকবার আমি ওদের ঘরে গিয়েছি। ঘরের ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে, শ্বাসরুদ্ধকর, আলো-বাতাস নেই বললেই চলে; তার এককোণে মাটির ওপর একটা টিমটিমে প্রদীপ জ্বালিয়ে অনমনীয় শ্রীপদ শরীর টান করে একমনে পড়াশোনা করত। এই সময় ওকে একটা নিদ্রাহীন জ্বলজ্বলে শিখার মতো লাগত। যেন কোনো অসাধারণত্বের পিপাসায় ও জ্বলছে। ওর তুলনায় নিজেকে অনেক ছোট মনে হত আমার। ঘরটাতে শ্রীপদর ভাইবোন বাপ মা সবাই থাকত একসঙ্গে। শ্রীপদদের অন্ধকার অস্বাস্থ্যকর ঘরটায় ঢুকলে কেমন যেন একটা নোংরা গন্ধ পেতাম। আমার নাড়ি উল্টে আসত। শ্রীপদর জন্য মন খারাপ হয়ে যেত। আমাদের বাসার বড় বড় ঘর, সচ্ছলতা আর সৌভাগ্যের জন্যে অপরাধবোধ জাগত।
শ্রীপদর এই তপস্যা ব্যর্থ হয়নি। অরুণ চলে গেলে বার্ষিক পরীক্ষায় শ্রীপদ আমাদের শাখায় ফার্স্ট হল। আমরা সিক্স ছেড়ে সেভেনে উঠলাম। ম্যাট্রিকসহ পরের পরীক্ষাগুলোতেও ভালো করেছিল শ্রীপদ। ভারতে গিয়ে চাকরি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কয়েক হাজার বছরের অস্পৃশ্য অস্তিত্বকে পায়ে মাড়িয়ে মাথা সোজা করে দাঁড়িয়েছিল ও।
ওর স্মৃতির সঙ্গে একটা দৃশ্য এখনও মনের সামনে জ্বলজ্বল করে ভাসে। শ্রীপদদের পাড়ায় শুয়োরের পাল ছিল। শুয়োরগুলো সারাদিন এদিকে-ওদিকে দলবেঁধে ঘোঁৎঘোঁৎ করত। এই শুয়োরগুলো একজাতের ভয়াবহ আর জঘন্য জন্তু। যখন যেখানে থাকত সে-জায়গাটাকে সঙ্গমে, শিৎকারে, অভব্য শব্দে, কাদায়, মাটিতে আবিল করে রাখত। শুয়োরগুলো কারো একার, না গোটা পাড়ার সম্পত্তি ছিল জানি না। তবে দেখতাম মাঝে মাঝে একেকদিন একেকটা শুয়োর মেরে ওদের সারা পাড়া মহোৎসবে মেতে উঠছে। শুয়োর-হত্যার ব্যাপারটা ছিল খুবই নৃশংস। যে-শুয়োরটাকে মারা হত সে কী করে যেন টের পেয়ে যেত যে আজ তাকে বলি দেওয়া হবে। জোরে ঝটকা মেরে ঘাতকের হাত থেকে সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। প্রাণের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত শুয়োরটা ঘরের পাশে, বেড়ার আড়ালে, মাচার পেছনে, ঘুপচিতে বা গর্তের ভেতর পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা শুরু করত। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারত না। সবাই মিলে হৈহৈ করে পেছন পেছন দৌড়ে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে ওটাকে শেষপর্যন্ত গেঁথে ফেলত। দৃশ্যটা দেখে আমি শিউরে উঠতাম 1
আজ মনে হয় মানুষের জীবনটাও হয়ত ঐ জন্তুগুলোর মতোই। মৃত্যুর হাত থেকে এভাবেই বাঁচার চেষ্টা করে। কিন্তু রক্তাক্ত বল্লম তাকে নানা জায়গা থেকে খুঁচিয়ে বের করে একসময় মৃত্যুর কাছে নিয়ে আসে। শুয়োরগুলোর জন্যে আমার খুব দুঃখ হত। একেবারেই মূঢ় জন্তু ওরা। রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের এই অবিশ্বাস্য জীবনটার কিছুই চেনে না। তবু জীবনের জন্যে কী মায়া! কালকালান্তরের কাছ থেকে পাওয়া এক দুজ্ঞেয় জীবনপিপাসা নিয়ে এই পৃথিবীর ওপর মানুষের মতোই ওরা বেঁচে থাকে।
৮
ক্লাস সেভেন ও এইটে আমার চোখে যে সবচেয়ে বেশি বিস্ময় জাগিয়েছিল সে মাহবুব আলম। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের দুই সেকশনে ভাগ করে দেওয়া হয়। হিন্দু ছাত্রদের দেওয়া হয় এ-সেকশনে, মুসলমান ছাত্রদের বি-সেকশনে। ফলে আমি বি-সেকশনে চলে যাই। সম্ভবত এই সময় মাহবুব আলম আমাদের সেকশনে এসে ভর্তি হয়। সেভেন থেকে টেন পর্যন্ত ও ছিল আমাদের সেকশনের ফার্স্ট বয়। মাহবুব আলমের হাতের লেখা ছিল মুক্তার মতো। ওর পরীক্ষার খাতাগুলোকে লাগত শিল্পীর আঁকা ছবির মতো, অবিশ্বাস্যরকম নির্ভুল আর পরিচ্ছন্ন, পরীক্ষকের পক্ষে সেখানে কলম ছোঁয়ানোর জায়গা থাকত না। পরীক্ষায় ও যা নম্বর পেত, তা বয়ে নিতে ওর আলাদা ঝুড়ির দরকার হত। স্যাররা সবাই ওকে আদর করতেন। ওর জন্যে গর্ববোধ করতেন। একবার উর্দুর হুজুর নাকি ওর খাতা পড়ে এমনই খুশি হয়েছিলেন যে, একশ’র মধ্যে একশ’ দশ দিয়ে ফেলেছিলেন (ভুলটা হয়েছিল মাহবুব আলমের একটা দুষ্টুমির কারণে। দুষ্টু মাহবুব উত্তর দেবার সময় যে ‘অথবা’সহ তিনটা বেশি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বসে আছে তা তিনি ধরতে পারেননি। খাতা দেখার পর নম্বর যোগ দিতে গিয়ে দেখেন মাহবুব একশ’র মধ্যে একশ’ দশ পেয়েছে)। মেধায়, দীপ্তিতে, প্রখরতায় ও ছিল ক্লাসের সবার থেকে জ্বলজ্বলে।
একদিন ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। আমরা সবাই ক্লাস করছি, হঠাৎ এক কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক, পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, মচমচ করে ক্লাসে ঢুকেই স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘মাহবুব আলমকে একটু পেতে পারি?’ চেয়ারে বসে ক্লাস নিচ্ছিলেন নিত্যানন্দ বাবু। মাহবুব আলমের নাম শুনতেই স্যার প্রায় লংজাম্পের ভঙ্গিতে চেয়ার থেকে মেঝেতে লাফিয়ে নেমে বিমূঢ় দৃষ্টিতে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন : ‘কে আপনি?’
যেন অন্য কোনো নক্ষত্র থেকে তিনি এসেছেন।
ভদ্রলোক নম্রভাবে বললেন : ‘আমি মাহবুব আলমের বাবা!’
উত্তর শুনে স্যার আনন্দে গর্বে পাগলের মতো হয়ে গেলেন। বারে-বারে বলতে লাগলেন : ‘আপনি মাহবুব আলমের বাবা! আমাদের মাহবুব আলমের বাবা আপনি? ও তো রত্ন। আমাদের গৌরব! ও-ই তো ইশকুলের মুখোজ্জ্বল করবে!’ বলে এমনভাবে মাহবুব আলমের বাবাকে সম্মানে সংবর্ধনায় আপ্লুত করতে লাগলেন যে আমরা আমাদের হতভাগ্য বাবাদের নিয়ে যে কোথায় লুকোব বুঝে উঠতে পারলাম না।
ভালো ছাত্রদের নিয়ে আমাদের শিক্ষকদের কী স্নেহ আর গৌরবই না দেখেছি সে-সময়ে! আজকের রজতসর্বস্ব যুগের শিক্ষকদের মধ্যে তার কোনো চিহ্ন বেঁচে আছে কি?
আমরা ভেবেছিলাম মাহবুব আলম বাস্তবজীবনে অসাধারণ সাফল্য দেখাবে। কিন্তু তা হয়নি। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় একটা মোটামুটি ফার্স্ট ডিভিশন পেলেও পরের পরীক্ষাগুলোতে ফলাফল হয়ে আসে আরও শাদামাঠা। যে ছিল স্কুলের ‘রত্ন’, ‘গৌরব’–সে একটা গড়পড়তা চাকরি করে সাধারণ চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে পৃথিবীতে বেঁচে থেকেছে। আমি একেক সময় ভেবেছি কেন হয় এমনটা! বয়সে যারা থাকে সেরা ছাত্র—’জ্যোতিষ্ক’ বা ‘বিস্ময়’–কেন তারা একসময় উল্কার মতো ঝরে মরে ছাই হয়ে যায়! কেবল মাহবুব আলমের ব্যাপারে নয়, আমার শিক্ষকজীবন জুড়েই আমি দেখেছি ব্যাপারটা।
৯
রাধানগর স্কুলের আরও যে-কজন বন্ধুর কথা মনে পড়ে ‘র’ তাদের একজন। তার সম্বন্ধে কিছু অপ্রিয় কথা বলতে হবে বলে তার আসল নামটা এখানে লিখলাম না। দুটো কারণে ওকে মনে আছে। প্রথমত বয়সে ও ছিল আমাদের চেয়ে অনেক বড়, লম্বা-চওড়াতেও। ওর তখন গোঁফ উঠে গেছে, গলার স্বর, আচার-আচরণ কিছুটা যুবকদের মতো। মাঝেমধ্যে ক্লাসের ছেলেদেরকে ও এমন সব গল্প শোনাত যা ঐ নিষ্পাপ ও কচি বয়সের উপযোগী নয়। আমার ধারণা, এতে মনের দিক থেকে ছেলেগুলোর ক্ষতি হত।
‘র’-কে মনে আছে আর একটা কারণে। ও ছিল মিচকে শয়তান। ক্ষিপ্র চতুর বেড়ালের মতো নিঃশব্দে ও এমন একেকটা প্রাণঘাতী কাণ্ড ঘটিয়ে বসত যে ওকে ধরা ছিল খুব কঠিন। তবু একদিন ও ধরা পড়ে গেল। ইচ্ছা করেই পড়ল; কারণ কাজটা কাঁচাভাবে না করে ওর উপায় ছিল না। তবু সবাই মজা পাবে বুঝে বিপদ জেনেও ও তা করল। সেদিন আমি বসেছি ক্লাসের পেছনদিকের কোনো একটা বেঞ্চে। স্যার ক্লাসে এসেছেন, সারা ক্লাস উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়েছে। তাকিয়ে দেখি প্রথম সারির বাঁ-দিকের বেঞ্চের ছেলেরা বসতে গিয়ে হঠাৎ অদৃশ্য। কী হল? উঁচু হয়ে দেখি, সবাই মাটিতে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। স্যার আসার সময় তারা দাঁড়াতেই পেছন বেঞ্চের ‘র’ আর আরেকজন চুপ করে কখন-যে তাদের বসার বেঞ্চিটাকে খানিকটা পেছনে নিয়ে গেছে তারা বুঝতে পারেনি।
এমনি ছিল ‘র’-র কাজ-কারবার।
আরেকদিনের একটা গল্প, সেটা বলেই ওর কথা শেষ করব। সেদিন আমি বসেছি সামনের দিকের বেঞ্চে, ও বসেছে একেবারে পেছনের বেঞ্চে। ক্লাসে অঙ্ক কষাচ্ছিলেন পি. সিং স্যার। এক-এক করে প্রত্যেক ছাত্রের সামনে গিয়ে তার অঙ্কের ভুল ঠিক করে দিচ্ছিলেন তিনি। স্যার ‘র’-র সামনে যেতেই ও উঠে দাঁড়াল। পি. সিং স্যার ছিলেন বেঁটেখাটো মানুষ, উচ্চতা খুবজোর পাঁচ ফুট তিন-চার ইঞ্চি, মাথা ভর্তি বিরাট টাক। ‘র’-র উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির ওপরে। কাজেই ‘র’-র মাথাটা পি. সিং স্যারের চেয়ে প্রায় একমাথা ওপরে। হঠাৎ দেখি এক আশ্চর্য দৃশ্য। পি. সিং স্যার নিচের দিকে তাকিয়ে ‘র’-র খাতার অঙ্ক একমনে ঠিক করে চলেছেন আর দুষ্টু ‘র’ চোখ দুটো বড় বড় করে পাকিয়ে স্যারের টাকটার চারধারে তা অনবরত ঘুরিয়ে চলেছে। ‘র’-র কাণ্ড দেখে সারা ক্লাস হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কেবল স্যারই নির্বিকার। একমনে ওর অঙ্কটা ঠিক করে চলেছেন তিনি।
আজকের শিক্ষকদের তুলনায় আমাদের শিক্ষকরা এমনই ছিলেন বোকা। ছাত্রের অঙ্ক ঠিক করতে দাঁড়ালে আর কোনোকিছুই টের পেতেন না।
১০
যা দিয়ে পাবনা আমার শৈশবকে সবচেয়ে ভয় দেখাত তা হল বিশাল কালো গাছপালায় ঢাকা শালগাড়িয়ার বিরাট জঙ্গল। ইছামতী পার হয়ে শালগাড়িয়ায় পা রাখলেই আমার গা ছমছমিয়ে উঠত। পাবনা শহর থেকে ইছামতীর ধার ঘেঁষে যে লাল ইটের রাস্তাটা পায়ে পায়ে এগিয়ে শালগাড়িয়ার শেষপ্রান্ততক চলে গেছে তারই শেষের দিকে নদীর ধারে শহরের শ্মশান। কিছুদিন পরপরই শব বহনকারীরা হল্লা করতে করতে ঐ পথ দিয়ে লাশ নিয়ে যেত। ঘন অন্ধকার বনজঙ্গলের ভেতর থেকে তাদের উঁচুগলার ঘন ঘন ‘বোলো হরি হরিবোল’ আওয়াজ আমার কাছে অশুভ ইঙ্গিতের মতো লাগত। আমাদের ছেলেবেলার বাংলাদেশের গোটাটাই ছিল এমনি জঙ্গলাকীর্ণ আর অন্ধকার। সে ছিল পুরোপুরি এক আলাদা বাংলাদেশ। আজকের ঝোপ-জঙ্গলহীন, ক্লিন-শেভ করা ছিমছাম বাংলাদেশের সঙ্গে তার কোনো মিলই নেই।
শালগাড়িয়ার জঙ্গল নিয়ে যা ছিল সবচেয়ে উদ্বেগজনক তা হল, শীতকালে ঐ জঙ্গলে প্রায়ই বাঘ আসত। বাঘ আসার ব্যাপারটা আমাদের জন্যে ছিল বিশেষভাবে আতঙ্কের। শালগাড়িয়ায় ভালো জলাশয় না-থাকায় প্রতি শীতে অন্তত দু-চারবার সে-বাঘ ইছামতী পেরিয়ে আমাদের বাসার সামনের পুকুরটায় পানি খেতে আসত। সবসময় আসত না, তবু শীতকালে রাত বেড়ে গেলে আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেপের নিচে ঢুকে যেতে পারলেই নিশ্চিন্ত হতাম। একেক দিন, পৌষ-মাঘের প্রচণ্ড শীতের রাতে আমাদের বাসার শ-দুয়েক গজ পেছনে ইছামতী বরাবর হঠাৎ করেই ফেউয়ের ডাক শোনা যেত। ভয়ে আমাদের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠত। আমরা বুঝতে পারতাম বাঘ ইছামতী পার হচ্ছে। কঠিন শীতে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে বাঘ দেখার জন্যে নিশ্বাস বন্ধ করে আমরা অপেক্ষা করতাম। একসময় দেখতাম আমাদের পুকুরের শান-বাঁধানো সিঁড়ি ধরে পায়ে পায়ে নেমে জলজ্যান্ত বাঘ পানি খেয়ে শালগাড়িয়ার দিকে ফিরে যাচ্ছে।
রাতে যে-বাঘকে দেখে এত ভয় হত দিন হলেই সে-ভয় আমার পুরোপুরি উবে যেত। এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। আব্বা এইসময় কলকাতা থেকে আমাদের তিনজনকে একটা করে খেলনা-বন্দুক এনে দিয়েছিলেন। আগের বারে আনা পিস্তলের গুলিতে বারুদ ছিল বলে সেগুলোর ট্রিগারে টান দিলে দ্রুম করে শব্দ হত। এগুলোতে তাও হত না। নিতান্তই শাদামাঠা খেলনা-বন্দুক। টান দিলে খট করে শব্দ করেই চুপ হয়ে যেত। তবু বারুদওয়ালা পিস্তল আমার ভেতর যে-আত্মবিশ্বাস জাগাতে পারেনি, এই পেল্লাই সাইজের বন্দুকটা তাই পেরেছিল। বন্দুকের মতো বড়সড় হওয়ায় ঐ জিনিশটা আমার মনে একটা সত্যিকারের বন্দুকের বিভ্রম জাগিয়েছিল। ওটা নিয়ে গাছপালার ভেতর দিয়ে হাঁটতে গেলেই আমাকে একধরনের দুঃসাহসের নেশায় পেয়ে বসত। মুহূর্তে ঐ খেলনা-বন্দুকটার অসারতা মন থেকে মুছে যেত। ওটাকে মনে হত সত্যিকার বন্দুক। মনে হত এ দিয়ে কেবল কানাকুয়া কেন, গণ্ডার বাঘ কোনোকিছু খতম করাই অসম্ভব নয় (এতবড় অস্ত্রটা কি এতটুকু করতে পারবে না?)। আত্মবিশ্বাসে আমি জ্বলতে থাকতাম। একটা আদিম বেপরোয়া বন্য দুঃসাহস আমাকে শক্তিশালী আর অন্ধ করে তুলত। এই খেলনা- বন্দুককে আমি এতটাই সত্যি বলে বিশ্বাস করতাম যে, হাতে ঐ বন্দুক আর কোমরে পিস্তল নিয়ে আমি একেকদিন একা একা শালগাড়িয়ার অনেক ভেতরে চলে যেতাম। মনে হত বাঘটা তো জানে না কী ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে আমি এগিয়ে আসছি। একবার দেখা হলে টের পাবে বাছাধন। আর এ দিয়ে না হলে কোমরে পিস্তল তো আছেই।
একটা খেলনা-বন্দুককে কী করে এতখানি বিশ্বাস করেছিলাম ভাবলে এখনও হাসি পায়। তবু মনে হয়, সেদিনের ঐ খেলনা-বন্দুকটার মতো আজও কি একইভাবে বহু হাস্যকর জিনিশকে অমনি সত্যি বলে বিশ্বাস করছি না? ভাবছি না কি একদিন বাংলাদেশ সুখের বাগান হবে, আলোকিত মানুষে ভরে যাবে এই দেশ!
১১
শালগাড়িয়ার মতো দুর্ভেদ্য না হলেও আমাদের বাসার পেছন থেকে শুরু হওয়া ইছামতীর ধার ঘেঁষে কয়েক মাইলের জনমানবহীন গাছপালার জগৎটাকে একরকম জঙ্গলই বলতে হবে। এ জঙ্গলটার একটা বড়সড় এলাকা, কপালকুণ্ডলার সমুদ্রতীরের মতো, ছিল আমার একক বিচরণক্ষেত্র। গুলতি হাতে ঘন গাছপালা আর জলাভূমির ভেতর দিয়ে ঘুঘু বুলবুলি বকদের পেছনে সতর্ক শিকারির মতো আমি হেঁটে বেড়াতাম। জলার ধারে ডালের ওপর একঠায় বসে- থাকা মাছরাঙাদের আশ্চর্য সৌন্দর্য আমাকে হতবুদ্ধি করে ফেলত। আমি সেই সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতে পারতাম না। ‘বউ কথা কও’ পাখির ধ্বনিপ্রতিধ্বনিময় কণ্ঠস্বর সারাটা বনভূমিকে সপ্রাণ করে রাখত। মিষ্টি গলার সপ্রতিভ বুলবুলি আর খুনসুটি-চটুল টুনটুনিরা যেন সেই গাছপালাওয়ালা জগতের সার্বক্ষণিক প্রাণধারা—সারাটা এলাকাকে তাদের মিষ্টি সংগীতের স্রোতধারায় মুখর করে রাখত। ঘুঘুর মাংসে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না, কিন্তু গুলতি দিয়ে ঘুঘু শিকার করতে পারলে বাসার লোকদের সামনে সম্মান আর প্রতিপত্তি লাভের সম্ভাবনা ছিল বলে ঘুঘুর ব্যাপারে আমার উৎসাহ ছিল। কিন্তু ঘুঘু শিকার করতে গিয়ে ঘুঘুদের নিরীহ, মুগ্ধ রূপ ভালোবেসে ফেলতাম আমি। শান্ত বাসার ভেতর তাদের ভীরু, অসহায় উৎকণ্ঠিত’ চাউনি আমাকে মমতায় ভরিয়ে তুলত। ঘুঘু শিকারে আমার হাত উঠত না। স্তব্ধ দুপুরে গ্রামের ফাঁকা ক্ষেতে ঘুঘুর ডাকে আমার বুকের ভেতরটা কেবলই একটা বিমর্ষ উদাস বেদনায় ডুকরে উঠত ।
জঙ্গলের মধ্যে যে-পাখিকে আমার সবচেয়ে নিঃসঙ্গ আর অবোধ মনে হত সে হল কানাকুয়া। এই বিরাট পাখিগুলোর জন্যে কেন যেন আমার মায়া লাগত। এত বড় পাখি তবু ঠিকমতো যেন দেখতে পায় না। উড়তেও পারে না ভালো করে। আচ্ছা, পাখিটার নাম কানাকুয়া হল কেন? সম্পূর্ণ মাথাটা কালো দেখে মানুষ কি এদের দৃষ্টিহীন ভেবে নিয়েছে? কেন যেন পাখিটাকে নিয়ে একটা বিমর্ষতার অনুভূতি রয়ে গেছে আমার মনে।
জঙ্গলের মধ্যে আমার সবচেয়ে রহস্যময় লাগত কাঠঠোকরাগুলোকে। গহন বনের ভেতর কোথায় কোনো গাছের আড়ালে বসে তার খাড়া মগডালটা ফুটো করে চলেছে তো চলেছেই। কালো রঙের এই ছোট নিরীহ পাখিটাকে হয়ত খুঁজে বের করতে সময় লাগবে। কিন্তু তার কাঠকাটার ত্রস্ত তীব্র সচকিত শব্দ বনের ছায়াঢাকা শান্ত হৃদয়টাকে ত্রাস জাগিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত যেন। সেই ভয়ার্ত শব্দ জেগে-ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গোটা বনভূমি যেন আরও স্তব্ধ হয়ে যেত। অমঙ্গল বা অশুভ কিছুর আশঙ্কায় যেন চুপ হয়ে যেত সব।
এখনকার শালিকগুলো আমাদের মাঠ বা নদীর ধারের শালিকগুলোর মতোই হয়ত, সেখান থেকেই উড়ে আসা, কিন্তু জঙ্গলের সাথে থেকে থেকে কোথায় যেন একটু আলাদা। এদের শরীরেও এখনকার সবকিছুর মতো যেন অরণ্যের বুনো গন্ধ।
এ-ছাড়াও আছে দোয়েল, চড়ুই, রাজঘুঘু, শঙ্খচিল, আরও অনেকে। ভালোবাসা আর বিস্ময় নিয়ে পথ হাঁটলে পাখিপ্রেমিকেরা হয়ত আরও অনেক বিচিত্র ধরনের পাখি দেখতে পেতেন ঐ গাছপালার গভীর জগতে। এত পাখি যারা আমাদের মতো অপ্রেমিকদের চোখের বাইরে থেকে যাবে চিরকাল।
১২
জঙ্গলের গাছগুলো দৈত্যের মতো বড় আর অন্ধকার। এর অধিকাংশই বহুকালের আদিম অরণ্য, মাঝে মাঝে আধা-যত্নে গড়ে-তোলা দুয়েকটা ফলের বাগান। চেনা গাছগুলোর মধ্যে বট, পলাশ, নিম, হরীতকী, নাগেশ্বর, গগন-শিরীষ, আম, জামরুল, লিচু, বেল, গোলাপজাম, গাব, বয়ড়া, কদবেল, সফেদা, শিশু—এমনি অনেক গাছ। হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকটা অর্জুনগাছের দেখা মিলত, তাদের কাণ্ডের বাকল ছেঁড়াখোঁড়া; ওষুধ হয় বলে মানুষ কেটে নিয়ে গেছে। এখানকার অচেনা পাখিদের মতো অনেক জংলি আর অচেনা গাছও আছে জঙ্গলটা জুড়ে, যাদের নাম জানার জন্যে মন আঁকুপাঁকু করেছে, কিন্তু ওয়াকিবহাল কাউকে না-পাওয়ায় জানা হয়নি। কত লতা, পাতা, গাছগাছালি অজানা রয়ে গেল। তাদের মধ্যে জংলি বিছুটি, ভাঙ বা বিশল্যকরণীর মতো দু-একটা উপকারী বা বিপত্তিকর কিছু গাছ ছাড়া কজনারই-বা নাম জানতে পেরেছি! এদের সঙ্গে এই অপরিচয়ের দুঃখ নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। চেনা গাছগুলোর মধ্যে কদবেল গাছের সরু-সরু ডালের গায়ে ছোট গোল গাঢ় সবুজ পাতারা চিরকাল আমার চোখে বিস্ময় জাগিয়েছে। কী অনিন্দ্য সৌন্দর্য দিয়েই না এই গাছগুলোর একহারা রূপসীরা তৈরি! রূপের কথাই যদি ধরা যায় তবে সফেদাও কম যাবে না। বিশাল এই গাছগুলোর রহস্যময় সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ধরে থাকা খয়েরি গোল ফলগুলো এখনও তো আমার কাছে রূপকথার ফল বলেই মনে হয়।
১৩
কদবেলকে কী ভালোই না বাসতাম ছোটবেলায়। মনে হত একটা পাকা কদবেলের জন্য, কবি হাফিজের মতো, সমরখন্দ বুখারা দিয়ে দিতে পারি। অথচ আজ হয়ত তা কেউ দিলেও নিতে চাইব না।
ফলের মধ্যে কামরাঙার বিস্ময়কর গড়ন দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। আসলে ফুলের মতোই পৃথিবীর প্রায় সব ফলের চেহারাও সুন্দর। আম, লিচু, পিচ, নাশপাতি, আনারস, আঙুর, আপেল, কমলা—কে দেখতে ভালো নয়? প্রকৃতির ভেতর দেখতে অসুন্দর কেউ নয়। কামরাঙা গাছের ঘন পাতাগুলোও যেন এর ফলেরই অজস্রায়িত বহুবিচিত্র রূপ। প্রতিটা পাতাই যেন একটা প্রতারক কামরাঙা। এত নকলের ভেতর থেকে যখন একেকটা আসল কামরাঙা আচমকা চোখে পড়ে যেত তখন তা নতুন দেশ আবিষ্কার করার মতোই অভাবিতের আনন্দ দিত।
বাদাম (জাম্বুরা), আমড়া, জাম, লটকন, জলপাই, পেয়ারা, জামরুল—এসব বড়সড় আর পরিচিত ফলের কথা বাদ দিলেও অনেক নাম-না-জানা ছোট ছোট ফল শৈশবের দিনগুলোতে আমার মন ভুলিয়েছিল। একটা ছোট্ট ফল ছিল কমলা রঙের, দেখতে ছোট্ট এত্তটুকুন একটা টমেটোর মতো, ভারি মিষ্টি আর সুস্বাদু। জংলি জাতের সেই ফলগুলোর নাম কারো জানা থাকে না, অনেক খোঁজখবর করেও নাম পাওয়া যায় না। তবু ফলটা মাঝে মাঝেই স্মৃতির ভেতর মুখ জাগায়। একধরনের সিঁদুরে রঙের ছোট্ট ফল ছিল, বড় আঁটির ওপরকার খোসাটুকুই শুধু মিষ্টি—তবু সারাজীবন সেগুলোকে মনে পড়েছে।
১৪
তবে সব ফলকে ভুললেও একটা ফলকে কোনোদিন ভুলতে পারব না— করমচা। খয়েরি রঙের পাকা করমচার ওপর দাঁত বসালে আলতার মতো যে রক্ত-লাল রসের ধারা মুখকে পুরো রঙিন করে দিত সেই অলীক সৌন্দর্যের বিস্ময়কে আজও আমি চোখের সামনে দেখতে পাই। কিন্তু এ ফল জঙ্গলে হত না। হত যার বাড়িতে সে এক কিপ্টে বুড়ি, থাকত রাধানগর গ্রামটিরই জঙ্গল- লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘরে। আমাদের করমচা গাছের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখলে বুড়ি লাঠি হাতে তেড়ে আসত : ‘কী চাই এখানে তোদের এ্যা? চাই কী? একটা করমচা ছিঁড়বি তো লাঠি দিয়ে হাত ভেঙে দেব।’ আমরা বলতাম : ‘অত বোকো না বুড়ি। বেশি লাফালাফি করলে তোমার করমচা গাছে হিং দেব।’ (গাছে গর্ত করে হিং দিলে নাকি সে গাছ মরে যায়)। হঠাৎ দেখতাম বুড়ির চোখ-দুটো সত্যিসত্যি তার কপালের ওপর। লোক জড়ো করে চেঁচিয়ে উঠত : “এ কী ‘অসাংঘাতিক’ কথা। আমার গাছ মেরে ফেলবি তোরা? দাঁড়া তবে, বলে লাঠি হাতে এগিয়ে আসত।
‘অসাংঘাতিক’ শব্দটা কোনো অভিধানে নেই। থাকলেও তার মানে হওয়া উচিত যা সাংঘাতিক নয় অর্থাৎ নিরীহ। তবু ঐ শব্দটা শুনে আমি ‘সাংঘাতিক’ কথাটার সর্বোচ্চ আতঙ্কের অনুভূতি পেতাম। আবেগের তোড়ে কবি হয়ে উঠত বুড়ি। তার ভাষা ব্যাকরণ ছাপিয়ে চলে যেত। ভুল হয়ে উঠত শুদ্ধ থেকেও শুদ্ধ। ‘অসাংঘাতিক’ অতি-সাংঘাতিকের দ্যোতনা দিতে থাকত। এমনি আবেগেজ্বলা সুতীব্র মুহূর্ত দিয়েই মানুষ রচনা করে নতুন শব্দ। গড়ে ওঠে মানুষের ভাষার দ্যুতিময় জগৎ। জন্ম নেয় নতুন ব্যাকরণ।
শেষ করার আগে আর-একটা ফলের কথা না-বললেই নয় : মাকাল। ভেতরে কদর্যকালো, কিন্তু বাইরে অপরূপ রঙিন। সবাই সুদর্শন অপদার্থদের মাকালের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু বাইরে যার অমন রঙের বৈভব, ভেতরে তার সুন্দর না হলেই-বা কি?
গাছপালা-ঢাকা ঐ জনহীন অরণ্যের একটা বিরাট এলাকাজুড়ে ছিল আমার একাকী বিচরণ। এখানে আমার কোনো সঙ্গী ছিল না। কেবল আমি আর ঐ প্রকৃতি। ঐ প্রকৃতি ছিল আমার বন্ধুর মতো। সমুদ্রের বিপুল ঢেউয়ের ওপরকার উত্তাল শাদা ফেনার মতো আমি তার শরীরজুড়ে কেবলি মাতামাতি করতাম।
১৫
এই জঙ্গলের ভেতর একটা ভয়ংকর মুহূর্তের কথা আজও মনে পড়ে। একদিন প্রায় সন্ধ্যা, আমি বাসায় ফিরে আসছি, হঠাৎ বিনা নোটিশে সারা বনজুড়ে কালবৈশাখীর ঝড় উঠল। বনের ডালপালা ভেঙে, সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে, কালো বিশাল দৈত্যের মতো এগিয়ে এল ঝড়টা। অরণ্যের স্নিগ্ধ গভীর পরিচিত রূপটা পলকে মুছে গেল। ঝড়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বনভূমিটাও যেন জেগে উঠল লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত অজগরের মতো।
অরণ্যটাকে এভাবে ঘাতক হয়ে উঠতে আমি আর কখনও দেখিনি। মৃত্যুভীতি আমাকে চেপে ধরল। তাড়াতাড়ি একটা মজবুত গাছের কাণ্ড আঁকড়ে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করলাম। মনে হল এই ঝড়, এই বন্য অন্ধ রক্তপিপাসু প্রকৃতি যেন আমার ছোট প্রাণটুকুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে দস্যুর দাঁতাল চেহারায় ছুটে আসছে। আকাশের উত্তাল কালো ছিন্নভিন্ন মেঘ, বাতাসের হুহুংকার, হিংস্র বিদ্যুৎ, তীব্র বৃষ্টি আর বজ্রগর্জনের সঙ্গে প্রতিটি গাছ যেন তাদের লম্বা কালো হাতগুলো দিয়ে আমার প্রাণটাকে পুরোপুরি সংহার করে ফেলবে।
জীবনে অনেকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু এই হিংস্র ভয়াল উন্মাদ প্রকৃতির সামনে নিজেকে যেমন অসহায় লেগেছিল, তেমন আর কখনও লাগেনি।
১৬
আর-একটা দিনের কথা বলে পাবনার প্রকৃতিবহুল গল্পের ইতি টানব। আব্বা না মা, কার ওপর যেন দারুণ অভিমান করেছি সেদিন। ঠিক করেছি বাড়ি ছেড়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব, জীবন গেলেও ফিরব না আর। কলেজের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ইটের রাস্তাটা কিছুদূর এগিয়ে মাটির রাস্তা হয়ে ডান-বাঁ ঘুরে রাধানগর গ্রামকে বাঁ-হাতে রেখে সোজা আবার সেই অরণ্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। পথটা ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। বেলা তখন সাড়ে দশটা-এগারোটা। বন ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীর, অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকার হয়ে একসময় হালকা হয়ে আসতে লাগল। এতদূর কোনোদিন আমি আসিনি। কিন্তু আমি কি জানতাম জঙ্গলের শেষে এমন একটা অপরূপ জলার জগৎ আমার জন্যে হাজার হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে? জায়গাটার নাম ঝপঝপের বিল। ঝপঝপে নামটাও রহস্যময়। নামটার মধ্যেও অদ্ভুত কোনো আদিম জীবের পানির ভেতর দিয়ে হেঁটে যাবার শব্দ কানে আসে।
বিস্তীর্ণ জলাটা নদী বালু আর চিকচিক করা পানির এক অন্তহীন অপরূপ দেশ। সেই দিগন্তহীন জগৎ আমাকে অবাক করে দিল। দেখলাম ছোট থাকতে বড়আপার কাছে শোনা রূপকথার সেই অবিকল রাজ্যটাই যেন দাঁড়িয়ে আছে সামনে, যেখানে রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্র কোটালপুত্র খোলা-তলোয়ার হাতে ঘোড়ার পায়ের ধুলো উড়িয়ে ছুটে যায়, দূর-গাছের মাথায় ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী বাসা বেঁধে থাকে। সেই রহস্যময় জগতের সুদূরতা কেবলই আমাকে দুহাতে ডাক দিতে লাগল, আর আমি ভেতরে ভেতরে অনেক দূরের জন্যে তাগিদ অনুভব করলাম।
এদিকে দেখতে দেখতে দুটোর মতো বেজে গেল। খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করতে শুরু করেছে। মনে হতে লাগল, খুব পছন্দসই না-হলেও পৃথিবীতে ‘বাসা’ জিনিশটা খুব খারাপ কোনো জায়গাও নয়। অন্তত সময়মতো খাবার পাওয়ার জন্যেও সেখানে ফিরে যাওয়া চলে। হেঁটে হেঁটে আবার রওনা হলাম বাসার দিকে। অনেকদূর হাঁটায় আমার চোখের কোণার অভিমানের পানি শুকিয়ে এবার আসল পানি বের হবার অবস্থা হয়েছে।
একসময় দূর থেকে আমাদের বাসাটা চোখে পড়ল। তখন প্রায় পাঁচটা বেজে গেছে। মনে মনে ভাবলাম এতক্ষণে না-জানি কী হুলস্থুল ঘটনাই ঘটে গেছে সারা বাসায়। হয়ত সবাই দুশ্চিন্তায় উৎকণ্ঠায় অস্থির হয়ে আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে গেছে। হয়ত পাগলই হয়ে গেছে সবাই।
কিন্তু বাসার কাছে যেতেই আমার ভুল ভাঙল। কোথায় বিষণ্ণতা আর নৈঃশব্দ্য! বাসার গোটাটাই উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কাছে পৌঁছোতেই টের পেলাম দেয়ালের ভেতরে অনেক শিশুর উচ্চকিত কলকণ্ঠ আর আনন্দধ্বনিতে সারাটা বাড়ি যেন উৎসবমুখর হয়ে রয়েছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাড়ির একটা জলজ্যান্ত ছেলে সাত-আট ঘণ্টা ধরে নিখোঁজ, অথচ ব্যাপারটা এতক্ষণ কারো খেয়ালেই আসেনি। সেকালের অনেক ছেলেমেয়ের বাড়িতে এই ছিল আমাদের নিয়তি।
১৭
আব্বা ছিলেন আমার কাছে বড় জীবনের আদর্শ। অধ্যাপক হিশেবে তিনি ছিলেন খ্যাতিমান। ছাত্রেরা তাঁর সম্বন্ধে এমন সশ্রদ্ধভাবে কথা বলত যেন কোনো দেবতা- টেবতা নিয়ে কথা বলছে। আব্বার এই মর্যাদা আর সম্ভ্রমের অবস্থান আমাকে শিক্ষক হতে উদ্বুদ্ধ করে। সারা অস্তিত্ব শিক্ষক হওয়ার নেশায় মরিয়া হয়ে ওঠে। মনে হয় পৃথিবীতে শিক্ষকের চেয়ে বড়কিছু কোথাও নেই।
১৮
বৈষয়িক লিপ্সা আব্বার মধ্যে একেবারেই ছিল না। তাঁর প্রধান আনন্দ ছিল ছাত্রদের জন্যে জীবন উৎসর্গ করায়, বিদ্যায়তনের পর বিদ্যায়তন গড়ে তোলায়। এ-ব্যাপারে একেবারে অন্ধ ছিলেন তিনি। একেকদিন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে আব্বা বাসায় ফিরতেন। মাকে ডেকে বলতেন : ‘জানো, আজ পঞ্চাশ হাজার টাকা পেলাম।’ পঞ্চাশ হাজার টাকা সেকালে অনেক টাকা। এ টাকা পেলে তো সংসারের কষ্টের পালে সুখের হাওয়া বয়ে যাবে। মা দুরাশা-ভরা উৎপূর্ণ-চোখে আব্বার দিকে তাকাতেন। এত টাকা কোথা থেকে পেলেন? বই লেখার রয়ালটি নাকি? অসম্ভবের স্বপ্নে মা যেন মেঘরাজ্যে ভাসছেন। আব্বা হেসে মাকে বাস্তবের জমিতে নামিয়ে আনতেন : ‘আরে ওসব না। গভর্নমেন্ট থেকে এবার আমাদের কলেজ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাচ্ছে। সারা দেশের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে বেশি পাচ্ছি বুঝলে? আমরাই! আমাদের রেজাল্ট সবচেয়ে ভালো যে! হাঃ হাঃ।’
ঘর-সংসারের কোনো অস্তিত্বই যেন আব্বার কাছে নেই। মার খুশিভরা মুখ চোখের পলকে মলিন হয়ে যেত। এমন নির্দয় স্বামীর ঘরও মানুষ করে!
আমাদের জীবনে আব্বা কোনো সরাসরি ভূমিকা নেননি। তবু আমাদের জীবনে আব্বার ভূমিকা বিরাট। সরাসরি ভূমিকা না নিলেও আব্বার ব্যক্তিগত নৈতিকতা, উঁচুমাপের আদর্শ, সামাজিক মর্যাদা আমাদের সামনে এমন এক উচ্চতর জীবনের আদর্শ দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, যে-আদর্শ থেকে নিচে নামা সম্ভব ছিল না। সেই অলিখিত বিধান ছিল আমাদের প্রায়-বিধিলিপি। আমাদের ভাইবোনদের অধিকাংশের মধ্যে এই আদর্শ আজও বেঁচে আছে।
১৯
নিজে আব্বা বৈষয়িক ছিলেন না, আমাদেরও কোনোদিন এ-ব্যাপারে উৎসাহও দেননি। আব্বা কতটা অবৈষয়িক ছিলেন একটা উদাহরণ দিলে তা বোঝা যাবে। মুন্সিগঞ্জ কলেজে আব্বা অধ্যক্ষ হয়ে যান ১৯৫৮ সালে। মুন্সিগঞ্জ কলেজের তখন খুব দুর্দিন। হন্যে হয়ে কলেজের গভর্নিং বডি একজন ভালো প্রিন্সিপাল খুঁজছেন। লোক পাঠিয়ে আব্বাকে ডেকেও এনেছিলেন তাঁরাই। সাক্ষাৎকারের দিন গভর্নিং বডির সভাপতি (এস.ডি.ও.) আব্বাকে জিজ্ঞেস করেন কত বেতন হলে তিনি আসতে পারেন। আব্বা তাঁদেরই এ-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ করলেন। এস.ডি.ও. বললেন : আমরা আগেই এ- ব্যাপারে চিন্তা করে রেখেছি। আপনাকে আমরা এক হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে পারব। এতে কি আপনার হবে?
আমাদের তখন মাসিক খরচ সাত-আটশো টাকার মতো। আব্বা তাঁর কথা শুনে বললেন : ‘অত দিতে হবে না। আটশো হলেই আমার মাস চলে যায়। ঐ দিলেই হবে।’
আব্বার প্রস্তাব শুনে গভর্নিং বডির মেম্বাররা বোকা হয়ে গেলেন। মুন্সিগঞ্জ থেকে ফিরে এসে আব্বা মাকে গল্পটা বলেছিলেন। মা জিজ্ঞেস করলেন : ‘আগবাড়িয়ে কেন মায়নাটা কমাতে গেলেন? দু-শো টাকা কি এক-দুই টাকা! হাতে একটা পয়সা নেই আমাদের ‘
আব্বা বললেন : ‘দেখলাম কলেজের অবস্থা খুব খারাপ। অত টাকা দিতে কষ্ট হবে।’
মা অসহিষ্ণু হয়ে বললেন : ‘তাই বলে এত টাকা ছেড়ে দেবেন?”
আব্বা গর্জন করে উঠলেন : ‘প্রিন্সিপালকে সব দিয়ে দিলে মাস্টাররা খাবে কী? একটা সমতা থাকতে হবে না?”
২০
আমাদের যুগে ‘খানেওয়ালা’ নামে একধরনের মানুষ ছিলেন। এঁরা ছিলেন ভোজনরসিক। সুস্বাদু অন্নব্যঞ্জনের ব্যাপারে এদের ছিল মহাবৈশ্বিক আগ্রহ। বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছেন : ভোজনরসিকতার সঙ্গে জীবনরসিকতার যোগ আছে। এই সৌভাগ্যবানদের অধিকাংশই ছিলেন তাই। ভোজনরসিকতার পাশাপাশি এঁদের জীবনরসিকতাও ছিল অমিত।
আমাদের যুগে খানেওয়ালা হিশেবে যাঁর সবচেয়ে বেশি নাম ছিল তিনি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। শুনতাম তিনি চৌষট্টি বছর বয়সে পঁয়ষট্টিটা ফজলি আম খেয়েছিলেন। আশুতোষ মুখার্জির খাওয়ার গল্পও ছিল প্রবাদের মতো। তিনি নাকি অফিস-শেষে ভীমনাগের দোকান থেকে সোয়া সের কাঁচাগোল্লা কিনে খেতে খেতে বাসায় যেতেন। ওটা ছিল তাঁর বিকেলের নাশতা। ড. শহীদুল্লাহ ছিলেন ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু অসম্ভব স্বাদ করে খেতেন। বাংলা একাডেমীতে তাঁর খাবারের পরিমাণ আর রকম দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রচুর খেতেন মওলানা ভাসানী। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁও ছিলেন অসম্ভব খাদ্যরসিক। তাঁর কথাবার্তার রসরসিকতার সঙ্গে খাদ্যরসিকতা ছিল এক-সুতোয় গাঁথা।
এই ভোজনরসিকতা আব্বার মধ্যেও ছিল। যারা ভালো খেতে পছন্দ করে তাদের অনেকেই নিজের হাতে বাজার করতেও ভালোবাসে। আব্বাও তাই করতেন। সুখাদ্যের জন্যে আব্বার উৎসাহকে মা-ও উসকে দিতেন। হয়ত পরিবারপ্রধানের সুস্বাস্থ্যের দরকারের কথা ভেবেই এটা করতেন। খাবার টেবিলে রুইমাছের বিরাট মাথা আমাদের করুণ-চোখের সামনে দিয়ে আব্বার পাতের দিকে নিয়মিতভাবেই পাচার হয়ে যেত। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এইসব ভোজনরসিক আর জীবনরসিকদের মধ্যে একটা গুণ প্রায় সব সময়েই দেখা যেত। এঁরা হতেন আমুদে আর রসিক।
২১
আব্বার মধ্যেও ছিল এমনি হাস্যরসের সাবলীল উৎসাহ। সারাক্ষণ হাসিতে কৌতুকে চারপাশের সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। কলেজে আব্বা কখন কোন্ ক্লাসে পড়াচ্ছেন তা অনেক দূরে দাঁড়িয়েও বলে দেওয়া যেত। যে-ক্লাসের ছাত্ররা উদ্দাম হাসিতে থেকে থেকে ফেটে পড়ছে, বুঝতে হত সেটা আব্বার ক্লাস। তাঁর অনেক হাসির কথাই এখনও মনে পড়ে। একবার আমার মেজোবোন আব্বাকে একটা প্রাণঘাতী চিঠি দিয়েছিলেন। খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন আব্বা সেটা পড়ে। চিঠিটা কতটা প্রাণঘাতী সে-সম্বন্ধে গল্প করতে গিয়ে আমাদের একদিন বললেন : চিঠি তো নারে, আস্ত যেন একটা শক্তিশেল (রাবণ যে-বাণ নিক্ষেপ করে লক্ষ্মণের প্রাণসংহার করেছিল)। ঢুকল বুকের সামনের দিক দিয়ে, পেছনদিকে তাকিয়ে দেখি পিঠ পেরিয়ে ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
মুন্সিগঞ্জে থাকতে একবার আব্বা কঠিন অসুখে পড়েছিলেন। একেবারে যমে মানুষে টানাটানি। কপালের জোরে শেষপর্যন্ত বেঁচে যান। সে-অসুখে আব্বার ওজন কমে গিয়েছিল ছাপ্পান্ন পাউন্ড। অসুখের পরে আব্বার এক পরিচিত ভদ্রলোক আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেন। আব্বার রুগ্ণ চেহারা দেখে বললেন : ‘আপনার ওজন তো খুবই কমে গেছে দেখছি!’ আব্বা বললেন : ‘খুবই।’ তাঁর সামনেই ছিল আমার এক ছোটবোন। তার ওজনও তখন ছাপ্পান্ন পাউন্ড। আব্বা তাড়াতাড়ি বোনটাকে কাছে এনে বললেন : ‘বুঝলেন, এরকম একটা আস্ত মেয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে।’
অসুখটার সবচেয়ে খারাপ সময়েও আব্বার রসবোধ ছিল একইরকম। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তখন তাঁর চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসক ড. ফজলে রাব্বি। ইনি সেই বিখ্যাত ফজলে রাব্বি যাঁকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার অপরাধে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করে। সেদিন আব্বার অবস্থা একেবারেই খারাপ। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। মুমূর্ষু অবস্থায় আব্বার শরীর বিছানার ওপর নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছে। চেতনা নেই বললেই চলে। ড. রাব্বি নিচু হয়ে আব্বার নাকের ঘ্রাণ নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছেন আব্বার বাঁচার সম্ভাবনা কতটুকু (খুব সম্ভব ঐ রোগের রোগীদের নিশ্বাসের ঘ্রাণ থেকে ডাক্তাররা এ ধরনের কোনো- একটা উপসর্গ আঁচ করতেন)। সবাই জানেন, কোনো মানুষ বেঁচে আছে না মারা গেছে এটা ভালুকেরা তার ঘ্রাণ নিয়ে বুঝতে পারে। কেউ একজন যে ভালুকের মতো ঘ্রাণ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে আব্বা বেঁচে আছেন কি না এটা তিনি কিন্তু ঐ মুমূর্ষু অবস্থাতেও টের পেয়ে ফেলেছেন। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই নিস্তেজ মানুষের মতো ক্ষীণ গলায় হেসে বললেন : ‘কে, ভালুক মশায় নাকি?’
ড. রাব্বি ছিলেন আব্বার ছাত্র। প্রাণপণে চেষ্টা করছিলেন আব্বাকে সারিয়ে তুলতে। আব্বার এই আজব কাণ্ড দেখে তিনি হেসে ফেললেন। মাকে ডেকে বললেন : ‘দুশ্চিন্তা করবেন না। উনি মরবেন না। মরার পরেও যার এমন রসবোধ থাকে সে মরতে পারে না।’
আব্বার মৃত্যু কিন্তু হয়েছিল সজ্ঞানেই। প্রায় পনেরো বছর পর। বিছানায় শুয়ে দু-হাতে খবরের কাগজ ধরে পড়ছিলেন তিনি। একসময় খুব আস্তে করে কাগজশুদ্ধ তাঁর হাতদুটো বিছানার উপর পড়ে গেল। সবাই গিয়ে দেখল তিনি মারা গেছেন।
আব্বার মতো আমারও আজ মৃত্যুর সময় এসে পড়েছে। শুধু জানি না, কোথায় কখন কীভাবে। তরুণবয়সে বিশাল জীবনটা ছিল সামনে। তখন প্রার্থনা করেছি জীবনটা যেন সুখের হয়। জীবনের সেই বিশাল জায়গাটা আজ দখল করে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু। আজকের প্রার্থনা : মৃত্যু যেন সুখের হয়। কষ্ট পেয়ে কষ্ট দিয়ে যেন মৃত্যু না হয়। হঠাৎ করেই যেন চলে যেতে পারি। ঠিক আব্বার মতো, নিঃশব্দে।
আমি জানি কারো হঠাৎ মৃত্যু হলে নিজে সে শান্তিতে বিদায় নেয় ঠিকই, কিন্তু কষ্ট হয় আশেপাশের মানুষদের। হঠাৎ আঘাতে তারা ভেঙে যায়, অনেক কথা অকথিত থাকে। মৃত্যুটা হয়ে ওঠে অসহ। কিন্তু একভাবে দেখলে পৃথিবীতে সব মৃত্যুই তো অকালমৃত্যু। তা সে পনেরো বছরে হোক আর একশ’ পনেরো বছরেই হোক। মৃত্যুতে সব সময়েই কিছু-না-কিছু অসমাপ্ত থেকে যায়। এই দুঃখ থেকে মুক্তি কোথায়? কাজেই যাকে মরে যেতে হচ্ছে, সে একটু শান্তিতে মরতে পারলেই তো সবদিক থেকে ভালো!
আব্বার এই হাসির দিকটা সবচেয়ে বেশি পেয়েছিল আমার ছোটভাই বেলাল (আল মনসুর)। ওর হাসি আব্বার চাইতেও স্বতঃস্ফূর্ত আর বুদ্ধিদীপ্ত ছিল। হাসি- তামাশায় চারপাশের সবাইকে ও মাতিয়ে রাখত। একদিনের ওর একটা রসিকতার কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। আমার এক চাচিশাশুড়ি ওকে জিজ্ঞেস করেছেন : ‘তোমার যে বয়স একেবারেই বাড়ছে না বেলাল, ব্যাপারটা কী বলো দেখি?’ মাথা চুলকিয়ে বেলাল বলল : ‘কী যে করি বলেন দেখি চাচি। কোনো কোনো বছর আমার বয়স মাস-দুই বাড়ে, কোনো কোনো বছর যে আবার বাড়েই না।’
আমি নিজেও আব্বার এই হাসির দিকটি কমবেশি পেয়েছি (যদিও তা লেখার ভেতর ঠিকমতো ফোটাতে পারি না)। আমার ছাত্রেরা এর সাক্ষী। আমার ক্লাসও আব্বার মতোই রস-রসিকতায় প্রাণবন্ত থেকেছে।
২২
মনে আছে, ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমার আর মামুনের খুব খারাপ ধরনের টাইফয়েড হয়েছিল। বাসার আরও কার কার যেন হয়েছিল, জ্বরে আচ্ছন্ন থাকায় ঠিকমতো মনে নেই। দুজনেই প্রায় মরতে বসেছিলাম সেবার। সেকালে টাইফয়েড ছিল ঘাতক-ব্যাধি। তখন এন্টিবায়োটিক সবে বের হলেও বাজারে নামেনি ঠিকমতো। তাই টাইফয়েড হলে রোগীরা সাধারণত মারা যেত। যারা বেঁচে যেত তাদের প্রায় সবারই কোনো-না-কোনো অঙ্গহানি হত। চোখ, কান, পা, হাত এমনি একটা প্রত্যঙ্গ গচ্চা দিয়ে তবে বাঁচতে হত। আমাদের অসুখ চলেছিল অনেকদিন। তিরিশ-বত্রিশ দিন চলার পর দিনকয়েকের জন্যে ভালো হয়ে আবার পড়েছিলাম একই অসুখে। জীবনের কোনো আশাই প্রায় ছিল না। দিনরাত প্রচণ্ড জ্বরে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করত। মাঝে মাঝেই প্রলাপ বকতাম। সকালে বিকেলে কিছুক্ষণের মতো ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ত। তারপর আবার আসত।
এই অসুখটা সারাজীবনের জন্যে আমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে রেখে গেছে। প্রতি বিকেলে আমাদের ঘর থেকে বাইরে এনে কিছুক্ষণের জন্যে বারান্দায় মাদুরের ওপর বসিয়ে দেওয়া হত। সন্ধ্যা পার হয়ে গেলে আবার ঘরের ভেতর নিয়ে বিছানার ওপর শুইয়ে দিত। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে বিকেলের ছায়ারা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে একসময় সন্ধ্যার আঁধারের ভেতর তলিয়ে যেত। সেইদিকে তাকিয়ে মনে হত আমার জীবনটাও হয়ত এমনিভাবে একটু একটু করে মৃত্যুর নিচে হারিয়ে যাবে। একটা অদ্ভুত ভয় আমাকে চেপে ধরত। খুবই নিঃসঙ্গ আর অসহায় লাগত। আমি কিছুতেই ওভাবে মরে যেতে চাইতাম না। সন্ধ্যা নিয়ে আমার এই ভীতি এখনও কাটেনি। সন্ধ্যায় সবসময় আমি অস্বস্তিবোধ করি। মৃত্যুর মতো একটা অনুভূতি এসে আমাকে চেপে ধরে, আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়; সেই অনুভূতি থেকে বাঁচার জন্যে প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই আমি ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে মানুষের সান্নিধ্যে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করি। আজও করি।
সেকালে ডাক্তারেরা জ্বর হলে স্বাভাবিক খাবার বন্ধ করে দিতেন। ভাত, ডাল, মাছ-মাংসের বদলে আমাদের কেবল বার্লি আর সাগু খেতে দেওয়া হত। এভাবে পুষ্টির অভাবে আমরা পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়তাম। আমাদেরও হয়েছিল তাই। এই অসুখের সময় বড়আপা কী মমতা নিয়ে-যে সারাক্ষণ আমাদের মাথায় পানি ঢালতেন, তাঁর সেই মাতৃমূর্তি আজও আমি ভুলিনি। ডাক্তার বলেছিলেন যতবেশি পারা যায় আমাদের মাথায় পানি ঢালতে, না হলে বিপদ হতে পারে। বড়আপা দিনরাত শুধু পানি ঢেলে ঢেলেই আমাদের যেন ভালো করে তুলেছিলেন। বাড়িতে ঘরভর্তি ভাইবোনের টাইফয়েড, তিনি সারাক্ষণ সবার সেবা-শুশ্রূষা করছেন, রাতেও আমাদের সঙ্গে থাকছেন। আমাদের ধারণা ছিল তাঁরও নির্ঘাত টাইফয়েড হবে। কিন্তু আশ্চর্য, তাঁর টাইফয়েড হল না। মহাকাব্যের যুদ্ধের মতো দুঃসহ ও দীর্ঘ যুদ্ধ শেষ করে তিনি জয়ী হলেন।
ভালো স্বাস্থ্যের জন্যে আমি টাইফয়েডের থাবা এড়িয়ে গেলেও মামুন ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে লাগল। সবাই ওর আশা ছেড়ে দিল। আমাদের দেখতেন ড. ইসহাক। সেকালের পাবনার সবচেয়ে বড় ডাক্তার ছিলেন তিনি (আজও তিনি সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছেন এবং সেদিনের মতো একইভাবে রোগী দেখছেন)। কোনো পথ বের করতে না-পেরে মামুনের জন্যে তিনি পেনিসিলিনের ব্যবস্থাপত্র দিলেন। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এর মাত্র কয়েক বছর আগে। ততদিনে পেনিসিলিন ইয়োরোপের বাজারে নেমে গেছে। কলকাতার বাজারেও দু-একটা চালান এসেছে। ড. ইসহাক নতুন বের হওয়া ক্লোরোমাইসিটিনের খবর রাখতেন। আব্বাকে বললেন, ওষুধটা কলকাতায় পেলেও পেতে পারেন। লোক পাঠিয়ে আনানোর চেষ্টা করেন। আর কিছুতে ধরবে বলে মনে হয় না।
সারা কলকাতা খুঁজে বহুকষ্টে ক্লোরোমাইসিটিনের মাত্র ছ’টি ট্যাবলেট জোগাড় করা গেল। প্রতিটি ক্যাপসুলের দাম পড়ল ষোলো টাকা। যে সময় চালের মণ ছিল দু-তিন টাকা, এক টাকায় আম পাওয়া যাচ্ছে দুশো, সে-সময় প্রতিটি ক্যাপসুলের এই দাম ছিল সোনার দামের চেয়ে বেশি। মামুন পানি দিয়ে প্রতিটা ক্যাপসুল খাবার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠত : ষোলো টাকা খেলাম। ঐ সময় পর্যন্ত মানবজাতির শরীর এন্টিবায়োটিকের সঙ্গে অপরিচিত ছিল; কাজেই ছটা ক্যাপসুলেই এমন কাজ হল যে, ও ভালো হয়ে উঠল।
২৩
এবার আব্বার একটা হাস্যকর দিক বলে তাঁর প্রসঙ্গ শেষ করি। আমার সেভেন-এইটে পড়ার সময় আব্বার ভুঁড়ি ছিল সুবিশাল। আমার শৈশবের ছিল এটি সবচেয়ে বড় মর্মবেদনার কারণ। সবাই আব্বার ভুঁড়ি নিয়ে হাসাহাসি করত। বন্ধুরা আমাদের অপমান করতে চাইলে মুখ ফুটে শুধু বলত ‘তোর বাপের ভুঁড়ি!’ ব্যস আমাদের খেল খতম। ভুঁড়ি তো আছেই, করাটা কী? বলব কি যে ভুঁড়ি নেই বা কোথায় ভুঁড়ি? অত চৌকশ আমরা ছিলাম না। চোরের মতো চুপ করে থাকতাম।
আব্বার ভুঁড়ির জন্যে অপমানিত হতে হতে আমাদের অবমাননা একসময় সহনীয়তার চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছল। তার ওপর ঘটল গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো একটা ব্যাপার। সে-সময় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্রহত্যার জন্যে সারাদেশব্যাপী ঘৃণিত পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন এসেছিলেন পাবনা কলেজে। আব্বার সঙ্গে তাঁর পাশাপাশি দাঁড়ানো একটা ছবি ছিল আমাদের বাসায়। ছবিটার দিকে তাকালেই আমার কেন যেন মনে হত আব্বার ভুঁড়িটা কিছুটা নূরুল আমীনের ভুঁড়ির মতো। ভুঁড়িটা তখন আরও দুঃসহ লাগত আমার কাছে। এসব কারণে কেবল আব্বার ভুঁড়ি নয়, ভুঁড়ি জিনিশটাকেই আমি ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম। আজও করি। মনে মনে ভাবতাম, এ-জীবনে আমার আর যা-ই হোক, ভুঁড়ি যেন কখনও না হয়।
আব্বার ভুঁড়ি নিয়ে বন্ধুদের অপমান-বিদ্রূপ অনেকদিন পর্যন্ত সহ্য করেছিলাম আমরা। কিন্তু একদিন সত্যিসত্যি সে দুর্দিন শেষ হয়েছিল; দুশ্চিন্তামুক্ত সুন্দর জীবন ফিরে পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু তা আমার কৃতিত্বে বা আব্বার ভুঁড়ি কমে যাওয়ার কারণে নয়, মামুনের বুদ্ধিমত্তায়। আগেই বলেছি মামুনের উপস্থিত-বুদ্ধি ছিল আমার চেয়ে অনেক ধারালো। একদিন আমরা সাত-আটজন বন্ধু দাঁড়িয়ে গল্প করছি, হঠাৎ এক বন্ধু যথারীতি বলে উঠল : ‘তোর বাপের ভুঁড়ি।’ অপমানে চুপসে আমি মিইয়ে মাটির সাথে মিশে গেলাম। কিন্তু দেখলাম মামুন হঠাৎ তেড়িয়া হয়ে উঠেছে। ও খেঁকিয়ে বলে উঠল : ‘আমার বাপের ভুঁড়ি আছে বুঝলাম। আর তোর বাপের?’ বলে ওর বাবা পা চাগিয়ে চাগিয়ে হাঁটার সময় কীভাবে পেছনের দিকটা দিয়ে একবার পশ্চিমদিককে একবার পুবদিককে সালাম করতে করতে এগিয়ে যান তা নিপুণ অভিনয়ের মাধ্যমে এমন হাস্যকর ভঙ্গিতে দেখিয়ে যেতে লাগল যে বন্ধুটি লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গেল।
সেই থেকে আব্বার ভুঁড়িঘটিত যন্ত্রণার হাত থেকে আমরা রেহাই পেলাম। নিজেদের বাবাদের সম্মানের স্বার্থেই আমাদের কোনো বন্ধুই আর কোনোদিন আব্বার ভুঁড়ি নিয়ে ঘাঁটাতে আসেনি।
সেদিন মামুনের সেই অসাধারণ উত্তর থেকে জীবনের একটা বড় শিক্ষা পেয়েছিলাম। শিক্ষাটা হল : আক্রমণের শ্রেষ্ঠ উত্তর আত্মরক্ষা নয়, প্রতি-আক্রমণ।
পৃথিবীর সব যোদ্ধাই নিজেদের বাঁচাতে এভাবে প্রতি-আক্রমণ করে। কীভাবে বুদ্ধিদীপ্ত প্রতি-আক্রমণ বিরুদ্ধপক্ষকে পুরো ঘায়েল করে দিতে পারে। একটা ছোট্ট গল্প বলে ব্যাপারটা বোঝাই। একবার এক জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বক্তৃতা করছিলেন। হঠাৎ এক শ্রোতা তাঁকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে উঠল : ফুল (নির্বোধ)।
তাঁর কথা শেষ হবার আগেই জিন্না ঝট করে বলে উঠলেন : “ইয়েস! জাস্ট এ্যাজ ইউ আর।’ (হ্যাঁ! ঠিক আপনারই মতো)।
২৪
একদিন বাসার ভেতরের বিরাট সিঁড়িটার ওপর বসে গালে হাত দিয়ে কিছু-একটা ভাবছিলাম। আব্বা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঠেস দিয়ে বললেন : ‘যেভাবে গালে হাত দিয়ে বসে আছে, ছেলে আমার আবার দার্শনিক হয়ে না যায়!’ হয়ত মন দিয়েই কিছু ভাবছিলাম, ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জা পেলাম। লজ্জা পেলাম, তবু একটা কথা কিছুতেই ভুলতে পারলাম না। হোক ব্যঙ্গ, তবু দার্শনিক, দার্শনিক শব্দটাই আব্বা বললেন তো! একদিন দার্শনিক হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে আমার! দার্শনিকের মতো লাগে আমাকে?
আমার ভেতরটা স্বপ্নে আশায় বলক দিয়ে উঠল। আমি কি সত্যিই কোনোদিন দার্শনিকদের মতো বড়টড় কিছু হব? পৃথিবীর বড় বা স্মরণীয় মানুষদের কেউ?
২৫
বড়আপা মাঝে মাঝেই আমাদের কবিতা পড়ে শোনাতেন। তাঁর কণ্ঠের সুরেলা আবৃত্তির ভেতর দিয়েই কবিতার অন্তর্নিহিত সংগীত-শক্তির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। কবিতার সেই সাংগীতিক ঢেউয়ের অনির্বচনীয় দোলায় দোল খেয়ে আমার জীবনের অনেকদিন কেটেছে। আমি-যে প্রায় চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত দিন নেই রাত নেই মাতালের মতো কবিতা পড়েছি, বিশ-বাইশ বছর পেরোবার আগেই বাংলা আর ইংরেজি কবিতার শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো পড়ে ফেলেছি, সেই মত্ততার সূচনা বড়আপার কবিতা পড়ার সুরময়তা থেকে।
মনে আছে একদিন সন্ধ্যাবেলা বড়আপা আমাদের রবীন্দ্রনাথের ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ কবিতাটি পড়ে শোনাচ্ছিলেন। পড়তে পড়তে একজায়গায় এসে যখন ‘মন্দিরেতে কাঁসর ঘণ্টা বাজল ঢঙ ঢঙ’ পঙ্ক্তিটির ‘ঢঙ ঢঙ’ কথাটা তাঁর সুরেলাকণ্ঠের আবৃত্তিতে অনুরণিত করে তুললেন তখন মনে হল আমি যেন তাঁর কণ্ঠস্বরের ভেতর সেই মন্দিরের সান্ধ্যকালীন ঘণ্টাধ্বনির মন্দ্রিত নিনাদিত সূক্ষ্ম মাধুর্যের পুরোটুকু শুনতে পাচ্ছি। সেই ঘণ্টাধ্বনির সংগীতে আমার অবোধ উৎকর্ণ হৃদয়ের ভেতরটা যেন এক অজানা বিস্ময়ে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে ইছামতীর ওপারেই ছিল একটা মন্দির। বাসা থেকে গাছপালার ভেতর দিয়ে তার উঁচু শাদা অস্পষ্ট চূড়াটা দেখা যেত। সন্ধ্যায় নিয়মিত সেই মন্দির থেকে সান্ধ্যকালীন ঘণ্টার শব্দ আমরা শুনতে পেতাম। বড়আপার আবৃত্তির ‘ঢঙ ঢঙ’ শব্দের সুরেলা বিষণ্ণ ধ্বনিটি শুনে মনে হল, বিমর্ষ সন্ধ্যায় সেই ঘণ্টার ধ্বনিটি যেন সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয় এক চেতনাপ্রবাহ হয়ে মন্দিরটার ঐ উঁচু চূড়াটার পাশ দিয়ে কোনো অস্পষ্ট অন্তহীনতার দিকে মিলিয়ে গেল। নিজের চোখে যেন দেখতে পেলাম দৃশ্যটা। কবিতার সাংগীতিকতাকে এমন পরিপূর্ণ ছবির মতন করে আমি খুব কমই দেখেছি। এইভাবে একবার দর্শন, একবার কবিতার জগৎ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল।
২৬
কয়েক বছর হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা নতুন সংগঠন গড়ে উঠেছে, নাম ‘বাঁধন’। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কলেজে এরই মধ্যে এর ছত্রিশটি শাখা হয়েছে। দ্রুত এদের সংখ্যা বাড়ছে। সংগঠনটির কাজ হল রোগীদের স্বেচ্ছায় রক্তদান করা। সংগঠনটি এর সভ্যদের রক্তের গ্রুপের একটা তালিকা কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরি করে রাখে। কেউ রক্ত চাওয়ামাত্র ঐ রক্ত-গ্রুপের এক বা একাধিক সদস্যকে রক্ত দেবার জন্যে তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
দেশের মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের ‘সন্ধানী’ নামে এমনি একটি দেশব্যাপী বিশাল প্রতিষ্ঠান আছে। দেশের মানুষদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করে এরা রোগীদের সরবরাহ করে।
আমার কাছে এ-ধরনের সংগঠনগুলোকে খুব ভালো লাগে। এতে অন্তত একটা কাজ হয়। তরুণ-তরুণীরা চারপাশের মানুষের জন্যে নিজেদের দিতে শেখে। একসময় পৃথিবীর জন্যে মানবতার জন্যে যাদের অনেক কিছু দিতে হবে, এই দিতে পারাটা তরুণবয়সে শুরু না হলে পরে তারা দেবে কী করে?
কিছুদিন আগে বাঁধনের একটা অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। বক্তৃতায় রক্ত দেবার ব্যাপারে তাদের উৎসাহকে এই বলে অভিনন্দিত করেছিলাম যে এর ভেতর দিয়ে তারা দিতে শিখছে। কিন্তু একই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে আমাদের রক্ত আমাদের শরীরের জিনিশ হলেও এ আমাদের নিজেদের জিনিশ নয়। এ প্রকৃতি থেকে পাওয়া জিনিশ। চেষ্টা করি না করি এ আমাদের শরীরে তৈরি হবেই। কিন্তু পৃথিবীকে আমাদের দিতে হবে আরও বড় জিনিশ, আমাদের নিজেদের জিনিশ। আমাদের শ্রম স্বেদ কষ্ট দিয়ে উপার্জন তৈরি করা জিনিশ।
কিন্তু সেই বড়কিছু দেবার প্রস্তুতি তো আজ থেকেই নিতে হবে। দরকারে সামান্য জিনিশ দিয়েই এ শুরু করতে হবে। প্রতিদানহীনভাবে কতরকম ত্যাগের ভেতর দিয়ে কতভাবে যে অন্যকে দেওয়া যায় তার সঙ্গে তাদের পরিচিত করে তুলতে হবে।
স্কুলে থাকতে আমি ছিলাম স্কাউট। কবে স্কাউটিংয়ে যোগ দিয়েছিলাম মনে নেই, কিন্তু স্কাউটিংয়ের অসাধারণ শপথবাক্যটা এখনও মাঝেমধ্যে মনে পড়ে।
স্কাউটিংয়ে যোগ দিয়ে কুচকাওয়াজ করেছি, সিগন্যালিং শিখেছি; তাঁবু বানাতে, দড়িতে গেরো দিতে, শৃঙ্খলাকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছি; এছাড়াও হরেকরকম দক্ষতা আয়ত্ত করেছি—তার কিছু মনে আছে, কিছু নেই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমার স্কাউট-জীবনের দুটো ঘটনা আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
মূল পাবনা শহরে ঢোকার মুখে ইছামতী ব্রিজের নিচে বিশাল আকারের কচুরিপানার এলাকা। একবার ঠিক হল আমরা স্কুলের স্কাউটরা সেই কচুরিপানা পরিষ্কার করব। সকাল ন’টা বাজতেই নর্দমার মতো নোংরা আর পূতিগন্ধময় সেই বিশাল জায়গায় কোমর পর্যন্ত কাদায় ডুবিয়ে আমরা কচুরি-উদ্ধারে নেমে পড়লাম। রোদের তাপে আমাদের শরীর তেতে উঠল, বিষ্ঠা-পরিপূর্ণ সেই জায়গাটার নাড়ি-ওগড়ানো দুর্গন্ধের ভেতর দাঁড়িয়ে দীর্ঘ পাঁচঘণ্টা ধরে ঘামে গরমে একসার হয়ে কচুরিগুলো পাড়ের ওপর টেনে তুলে বিরাট জায়গাটা পরিষ্কার করে তবে উঠলাম। ফাল্গুনের বদ্ধ নদীর ভেতর কাজটা করতে গিয়ে ক্লান্তিতে আমরা অবসন্ন হয়ে পড়েছিলাম। ক্ষুধায় শরীর এলিয়ে এসেছিল। কিন্তু নিজের জন্যে নয়, সবার ভালোর জন্যে এই যে কাজটা করতে পারলাম সেই অপার্থিব তৃপ্তিতে আমার মনটা ভরে উঠেছিল।
ব্যক্তিগত শ্রম দিয়ে অন্যকে কোনোকিছু দেবার আনন্দ জীবনে সেই আমার প্রথম। এই সুযোগ দেবার জন্যে স্কাউট-আন্দোলনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ব্যাপারটা উচ্চতর ও পবিত্রতর আনন্দ ও তৃপ্তির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ঘটনাটার ভেতর দিয়ে আমি জেনেছিলাম মানবজীবনের অধিকতর সুখ কোন্খানে। শৈশবে-কৈশোরে এই অনির্বচনীয় সুখের সঙ্গে পরিচয় না হলে বড় হয়ে অন্যকে দেওয়া বা অন্যের জন্যে করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আমার তরুণ ছাত্রদের মাঝেমধ্যে আমি একটা গল্প শোনাই। বলি : ধর, মাকে নানাভাবে জপিয়ে তাঁর কাছ থেকে তুমি একশ টাকা হাতিয়ে নিলে। এই পাওয়ায় নিশ্চয়ই একটা আনন্দ আছে। ধর, সেই টাকা নিয়ে তুমি রেস্টুরেন্টে যাচ্ছ; ইচ্ছা, বন্ধুদের সঙ্গে ফূর্তি করে খেয়েদেয়ে টাকাটা ওড়াবে। কিন্তু রাস্তায় পা বাড়াতেই তুমি দেখলে একটা না-খাওয়া মুমূর্ষু লোক তোমার সামনেই অচেতন হয়ে পড়ে গেল। ধর, তাকে দেখে তোমার ভেতর মমতা এসে গেল। একজন অনাহারী নির্জীব আর মৃত্যুপথযাত্রী লোককে সামনে ফেলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বন্ধুদের নিয়ে ফূর্তি করতে নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। তুমি পকেটের সেই টাকা খরচ করে তাকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে, সে ভালো হয়ে উঠলে তাকে খাবার কিনে দিয়ে ঘরে যাবার ব্যবস্থা করে বাড়ি ফিরলে। নিশ্চয়ই মানবে : মার কাছ থেকে টাকাগুলো হাতিয়ে নেবার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে তেমনি ঐ টাকাগুলো একজন দুঃখীর কষ্ট মোচনের জন্যে দিয়ে দিবার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। এখন প্রশ্ন : এই দুই আনন্দের মধ্যে বড় কোনটা? নিশ্চয়ই দ্বিতীয়টা। একটা ভোগের মত্ততায় স্থূল, অন্যটা দেবার তৃপ্তিতে পবিত্র। জীবনের সূচনার দিনগুলোয় এই পবিত্র আনন্দের সঙ্গে জানাজানি না হলে এ তো আমাদের কাছে অপরিচিত থেকে যাবে।
ছেলেবেলায় হিন্দিভাষার একটা ইসলামি গান শুনতাম :
মিলতা হ্যায় কেয়া নামাজ মে
সেজদা মে যা কে দেখ লে।
শৈশবের কচি, অনুভূতিময় ও নিষ্পাপ দিনগুলোয় যে-মানুষ এই সেজদাকে চিনল না, তার জীবনে তো ঐ উচ্চতর আনন্দের সূচনাই হল না। সে কী করে জীবন- নামাজের মর্মার্থ বুঝবে?
২৭
আর একটা ঘটনার জন্যে স্কাউটিঙের কাছে আমি ঋণী। আমাদের স্কাউট শিক্ষক ঠিক করে দিলেন টানা এক সপ্তাহ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে আমাদের রোজগার করতে হবে। আমাদের স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলার পাঠ হিশেবে ওপরের নির্দেশে নেওয়া হয়েছিল কর্মসূচিটা। আমাদের পাঁচ বন্ধুর ওপর দেওয়া হল জুতো পালিশ করে আয় করার দায়িত্ব। আমরা ব্রাশ, কালি, ন্যাকড়া, ক্রিম এসব নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে জুতো পালিশ করে বেড়াতে লাগলাম। সামনে জুতো-পরা কোনো ভদ্রলোক দেখলেই খপ করে তাঁর পা চেপে ধরে জুতো পালিশ শুরু করে দিতাম, অনুমতির ধারও ধারতাম না। জলজ্যান্ত ভদ্রলোকের ছেলে পা চেপে ধরেছে দেখে তাঁরা খানিকটা ওজর-আপত্তি করলেও শেষপর্যন্ত মজুরিটা দিয়ে দিতেন। জুতো পালিশ বাবদ আমরা জনপ্রতি এক আনা করে আদায় করতাম। সপ্তাহ-শেষে আমার নিট আয় হয়েছিল চার টাকা ছয় আনা। সেকালে একজন নিচের ক্লাসের স্কুলছাত্রের জন্যে এ অনেক টাকা। সিনেমা দেখে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে এ টাকা শেষ করতে অনেকদিন লেগেছিল।
মানুষের পায়ের নিচে বসে তাদের জুতো পালিশ করতে গিয়ে একটা বড় উপকার হয়েছিল আমার। অহং-এর দম্ভ থেকে এ আমাকে অনেকটাই মুক্তি দিয়েছিল। মানুষের সামনে ছোট বা নীচু হতে এরপর আমার খুব বেশি অসুবিধা হয়নি। এক সপ্তাহের রোজগারের টাকার চেয়ে এই আত্মিক রোজগার, আমার ধারণা, অনেক বড়।
স্কাউটিং করতে গিয়ে অনেক নতুন জিনিশ শিখেছিলাম। ব্যাজ পেয়েছিলাম অনেকগুলো। জাম্বুরিতে সারাদেশের স্কাউটদের বিপুল মিলনমেলায় সবার সঙ্গে একাত্ম হতে পারার অনুভূতিও ছোট কিছু ছিল না। কিন্তু ঐ দুটি ঘটনার ভেতর দিয়ে নিজেকে অন্যের জন্যে দিতে শেখার বা মানুষের সামনে বিনত হতে পারার যে অনুভূতি সারাজীবনের জন্যে নিজের ভেতর আহরণ করেছিলাম তার চেয়ে দামি আর কোনোকিছু নয়।
২৮
শিক্ষক, গুণ্ডা বা দার্শনিক হওয়ার পাশাপাশি জীবনের লক্ষ্য নিয়ে আর একটি ভাবনা আমার আসে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়। আমি আর আমার ছোটভাই মামুন গরমের ছুটিতে দিনাজপুরে মেজো খালুর বড়ভাইয়ের বাড়িতে যাচ্ছি আম খেতে। দিনাজপুরে যেতে হলে আমাদের প্রথমে ধরতে হবে নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস। ট্রেনটার কথা আগেই বলেছি। ইন্ডিয়ান রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ আর পরাক্রান্ত ট্রেন ছিল এটি। কলকাতা ছেড়ে একটানে চলে আসত ঈশ্বরদী, তারপর এক ধাক্কায় সান্তাহার। ট্রেনের বাঁশির জলদ গম্ভীর আওয়াজে বুকের ভেতরটা গমগম করত। সান্তাহারে গিয়ে ট্রেন বদলি করে আমাদের যেতে হবে দিনাজপুরে। কে আমাদের ঈশ্বরদীতে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল মনে নেই, কেবল মনে আছে স্টেশনের বাইরে ছোট্ট টিকিটঘর থেকে টিকিট নিয়ে বিরাট ওভারব্রিজটা পেরিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম প্ল্যাটফর্মে। জানি না কেন ওভারব্রিজটাকে আমার কাছে সেদিন অমন অন্তহীন মনে হয়েছিল–হয়ত যে- কারণে আমাদের পুকুরটার পাড় ধরে হাঁটতে গেলে সেটাকে অন্তহীন মনে হত, হয়ত সে-কারণেই—আমার পাগুলো বেশিরকম ছোট ছিল বলে।
নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই এর দানবীয় শক্তি এবং প্রচণ্ডতা আমাকে অভিভূত করে ফেলল। বিশেষ করে ফোঁসফোঁস করে এগিয়ে আসা এর দুর্ধর্ষ বিশাল ইঞ্জিনটা। ইঞ্জিনটার গায় পেশির দুর্জয় শক্তি যেন ফুলে ফুলে উঠছে আমার টিকিট ছিল ইন্টার ক্লাসের, কিন্তু ইঞ্জিনটার জান্তব শক্তিমত্তা রক্তের ভেতর শুষে নেবার জন্যে আমি ইঞ্জিনের পাশের থার্ডক্লাস কম্পার্টমেন্টটায় উঠে হ্যান্ডেল থেকে ঝুলে এর অবিশ্বাস্য কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম।
নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে মাঠঘাট প্রান্তরের ওপর দিয়ে। দূরত্বকে গোগ্রাসে গিলতে গিলতে, দৈত্যের মতো প্রচণ্ড শব্দে চারদিক ধ্বনিত মথিত করে ছুটে চলেছে যন্ত্রদানবটা। কী রাজকীয় বৈভব আর শক্তির ঐশ্বর্য তার সারা শরীরে! দিগ্বিজয়ীর মতো এগিয়ে যাচ্ছে সে। সবুজ নিশান উড়িয়ে স্টেশনের পর স্টেশন তাকে স্বাগত জানাচ্ছে, কিন্তু এদের কারো পাশেই সে থামবে না। স্টেশনগুলোর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো লোকগুলো বিরস করুণ মুখে ট্রেনটাকে দেখছে, এই ট্রেনে ওঠার সৌভাগ্য তাদের হবে না।
এমন রাজকীয় ট্রেনের যাত্রী হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হতে লাগল। ট্রেনটার সামনে ঝড়ের গতিতে বিশ্রামহীনভাবে ছুটে চলছে ইঞ্জিনটা। আমি অবাক বিস্ময়ে তার দুরন্ত শক্তিমত্তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার শিরাধমনীর রক্তপ্রবাহ চঞ্চল দুর্বার হয়ে উঠছে। আমার সবচেয়ে ঈর্ষা হচ্ছে ট্রেনের ড্রাইভারকে দেখে। ঝড়ের বেগে ছুটে যাওয়া গর্জমান বিশাল ট্রেনটার সে-ই তো অধীশ্বর। যেন সে মানুষ নয়, কোনো পরাক্রান্ত দেবতা বা রাজা। তার চেয়ে দুর্ধর্ষ আর গর্বিত মানুষ কে এই পৃথিবীতে? কে শ্রেষ্ঠ তার চেয়ে? মাঝে মাঝে ইচ্ছা হলেই মাথার ওপর আড়াআড়িভাবে টানানো দড়ির মতো কিছু-একটাতে সে টান দিচ্ছে আর হুইসিলের জলদগম্ভীর গর্জন দিগদিগন্তকে প্রকম্পিত করে তুলছে।
কেবল ড্রাইভার নয়, তার পাশে মাথায় লালকাপড় বাঁধা যে-লোকটা মাঝে মাঝে বয়লারে কয়লা ঠেলে দিচ্ছিল তাকে দেখেও আমার ঈর্ষা হতে লাগল। কত সুখী সে! এমন দানবীয় ট্রেনটাকে যারা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেও তাদেরই একজন। ট্রেনের ড্রাইভারকে আমার কাছে মানবজাতির শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ মনে হল। তার চেয়ে পৃথিবীতে বড় কে হতে পারে, ভেবে বের করতে পারলাম না। কেবল মনে হতে লাগল, শিক্ষক, দার্শনিক এমনকি গুণ্ডা হওয়ার চেয়েও এ যেন ওপরে। সেদিনই ঠিক করে ফেললাম পৃথিবীতে যদি কিছু হতে হয় তবে তা হবে ট্রেনের ড্রাইভার হওয়া। এই নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসের ড্রাইভার।
ট্রেনটার প্রচণ্ড শক্তি আমার চেতনাকে এভাবে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল যে শুনতে হাস্যকর শোনালেও কথাটা সত্যি) আমার অনার্স পরীক্ষা দেবার দিনগুলো পর্যন্ত, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে এতটা পড়াশোনার পরেও, আমার অবচেতন মনের স্বপ্ন ছিল ট্রেনের ড্রাইভার হওয়া। এ থেকেই বোঝা যায় কী অবাস্তব আর অপরিণত আমি ছিলাম আমার প্রথম যৌবনের দিনগুলোতেও।