প্রথম মানবী

প্রথম মানবী

ভোরবেলা সেই নারী প্রবেশ করল আদিম উদ্যানে। তখন পৃথিবীর সৃষ্টিরও ঊষাকাল।

কোথাও কোনো শব্দ নেই। যত দূর দৃষ্টি যায় মনুষ্য আকারের আর কোনো প্রাণী নেই। লতাগুল্মে, ক্ষুদ্র-বৃহৎ তরু-বৃক্ষে ফুটে আছে বিভিন্ন বর্ণের ফুল, সেগুলিরও নাম নেই। কোথাও ফুল থেকে ফল ফলেছে, কোনো কোনো গাছের শাখা ফলভারে নুয়ে পড়েছে, সেইসব ফলও নামহীন।

এখানে ফুলের সৌরভে আর কোনো কটু গন্ধ মেশেনি। বাতাস স্নিগ্ধ। মাঝে মাঝে বয়ে চলেছে তরঙ্গময় নির্ঝরিণী, তাদের জল স্ফটিক-স্বচ্ছ। একেবারে তলদেশের পাথরগুলি পর্যন্ত মালিন্যহীন।

বাতাস ও ঝরনা ছাড়া আর যা সঞ্চরণশীল, তা কুয়াশা। যেন আকাশের মেঘ নীচে নেমে এসে ভূমি স্পর্শ করতে চাইছে। তবে পূর্ব গগনের তরুণ সূর্য আস্তে আস্তে এদের ভক্ষণ করতে শুরু করেন। কুয়াশাই সূর্যের প্রাতরাশ।

আস্তে আস্তে পা ফেলে হাঁটছে সেই রমণী। তার শরীরে কোনো আবরণ নেই, আভরণ নেই। সুদীর্ঘ চুল পিঠ ছাড়িয়ে নেমেছে মসৃণ নিতম্বে। দুই বাহু ও ঊরুসন্ধিতেও নবীন তৃণের মতন রোম। নাসিকা তীক্ষ্ণ, ভ্রূদ্বয় গাঢ়, অক্ষিপল্লব সূক্ষ্ম। তার বক্ষের দুটি ঢেউ এবং কটিদেশের খাঁজ কোনো শিল্পীর নিপুণ হাতে গড়া। ঢেউ দুটিতে ভাসছে স্ফুটনোন্মুখ দুটি কুঁড়ি। চাঁদের অর্ধ কলার মতন নাবি।

রমণীটি যেন ঈষৎ উন্মনা, কোনোদিকেই স্থির দৃষ্টিপাত করছে না।

তার কোনো বয়স নেই। তার বাল্য, কিশোরীকাল নেই, ভবিষ্যৎ জরা সম্পর্কে কোনো উপলব্ধি নেই। সে যৌবনজাত। সে দেখেছে মাত্র কয়েকটি ঋতু, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীত। এবারেও সে টের পাচ্ছে আসন্ন শীতের মিহিন বাতাস।

এই আদিম উদ্যান সে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল এক বর্ষার রাতে। আশ্রয় নিয়েছিল দূরবর্তী এক পাহাড়ের গুহায়। এখানে তার ফেরা নিষেধ, তবু মাঝে মাঝে তার শরীর তোলপাড় করে দেয় এক ঘূর্ণি হাওয়া, তার সব কটি আঙুলের অগ্রভাগ, এমনকি কানের লতিতেও জ্বালা ধরায়। অনেক গণ্ডূষ জল পান করলেও তৃষ্ণা মেটে না। ঘুম আসে না রাত্রে। যেমন কাল সারা রাত সে চক্ষু মেলে শুধু অন্ধকার দেখেছে।

পর্বতগুহা ছেড়ে সে যে আজ প্রত্যুষে চলে এসেছে, তা সে নিজেই জানে না। এক জলপ্রপাতে স্নান সেরে সে হাঁটতে শুরু করেছিল বিপরীত দিকে। সচেতন সিদ্ধান্ত ছাড়াও মানুষ এমনভাবে কখনো-কখনো যায়। দিনের পর দিন একাকিত্ব তার অসহ্য বোধ হচ্ছিল, সে নেমে এসেছে সমতলে।

এ উদ্যানে কোনো নির্দিষ্ট পথ নেই। কখনো-কখনো বৃক্ষগুলির শাখা-প্রশাখা দুহাতে সরিয়ে যেতে হয়। পায়ে লাগে লতাজাল। কখনও পার হতে হয় অপ্রশস্ত সরণি।

হঠাৎ ঝুপ ঝুপ করে বর্ষণ শুরু হল। এখানকার বৃষ্টি শীত-গ্রীষ্ম মানে না।

রমণীটি একটি বৃহৎ বৃক্ষের তলায় এসে দাঁড়াল। সেখানে একটি দুগ্ধবতী গাভীও আশ্রয় নিয়েছে, তার গাত্রবর্ণ পিঙ্গল। এই প্রকার গাভীদের চক্ষু সব সময় সজল থাকে।

সে গাভীটির গলকম্বল স্পর্শ করে স্নেহ জানাতেই গাভীটি সন্তোষজনক শব্দ করল। অর্থাৎ, সে এই নারীকে চিনতে পেরেছে, কয়েক বিন্দু দুগ্ধক্ষরণ হল তার বাঁট থেকে।

সে এবার অনুভব করল, অনেক গাছপালাও যেন তার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন। নানারকম অদৃশ্য তরঙ্গ লাগছে তার শরীরে।

সে সহাস্যে বলল, কেমন আছ তোমরা সকলে? আমি এসেছি বলে খুশি হয়েছ তো?

হাসিটি সত্য, কথাগুলি অনুচ্চারিত। এখনও মনুষ্য ভাষার সৃষ্টি হয়নি। এই রমণী হাসতে পারে, সশব্দে কাঁদতে পারে, কণ্ঠ দিয়ে কখনও দু-একটি সুর ধবনিত হয়। কিন্তু অর্থবহ কোনো শব্দ সে জানে না।

ভাষা নেই, কিন্তু ভাব তো আছে। তাই অনেক কথা হয়, অনেকের সঙ্গে, নিঃশব্দে, মনে মনে।

তার নিঃশব্দ প্রশ্নের উত্তরে সে নানা দিক থেকে যেন তরঙ্গে তরঙ্গে ধবনিত হল। অনেকদিন পর এলে, তোমাকে দেখে খুশি হয়েছি অবশ্যই। তুমি আরও সুন্দর হয়েছ!

একটি গাছ থেকে একটি বর্তুল গড়নের পাকা ফল এই মুহূর্তে খসে পড়ল মাটিতে। এটাও যেন ভাষা। গাছটি স্বাগত জানাচ্ছে তাকে।

যুবতীটির মন ভার ছিল, গত রাতে তার বুক ভরা ছিল কান্নায়, এখন সে অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করল। বৃষ্টি থেমে গেছে, সে ফলটি তুলে নিয়ে গিয়ে বসল এক ঝরনার ধারে পাথরের পইঠায়।

সারা আকাশ জুড়ে রামধনু ফুটে উঠেছে।

সে এখন যে পাহাড়ের গুহায় থাকে, সেখান থেকে কোনোদিনই রামধনু দেখা যায় না। এখন পরিচিত রামধনুকে দেখেও সে প্রশ্ন করল, কেমন আছে?

রামধনু উত্তর দিল কি না, তা বোঝা গেল না।

আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে সে তাকাল জলের দিকে। দেখতে পেল নিজের মুখের প্রতিবিম্ব। এই জন্যই সে বার বার জলের ধারে বসে। দিনের পর দিন নিজের মুখচ্ছবি ছাড়া সে আর কোনো মানুষকে দেখে না। নিজের সঙ্গেই শুধু কথা হয়।

ঝরনার ওপাশ থেকে কী যেন একটি প্রাণী সাঁতার কেটে আসছে। এদিকে আসার পর বোঝা গেল, একটি সাপ। বেশ দিঘল চেহারা। চক্ষু দুটি কপালের ওপরে, জলেই অর্ধেক শরীর ডুবিয়ে সে চেয়ে রইল রমণীটির দিকে।

ভয় পাবার প্রশ্ন নেই। এই সাপটিকে সে এখানে আগেও কয়েকবার দেখেছে। কাছাকাছি এসে চেয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। কী যেন বলতে চায়। কিন্তু সাপের মনের তরঙ্গের সঙ্গে এই রমণীর মনের তরঙ্গ মেলে না, তাই সে কিছু বুঝতে পারে না।

রমণীটি তাকে বলল, তুমি যাও!

তবু সাপটি স্থির হয়ে রইল এক জায়গায়।

রমণী তখন হাঁটতে শুরু করল পুনরায়।

ঝরনাটি কিছুটা নীচের দিকে নেমে গিয়ে মিশে গেছে আর একটা স্রোতস্বিনীর সঙ্গে। দূর থেকে সেই সংগম স্থানটি দেখা যায়।

সেখানে জংঘা পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুরুষ।

এই রমণীরই মতন সেও নিপাট নগ্ন। তার শরীর অনেকটা রোমশ, দীর্ঘ কেশ, মুখমণ্ডল শ্মশ্রুতে প্রায় আবৃত। সুঠাম বক্ষ।

পুরুষটিকে দেখা মাত্র রমণীটির আশিরপদনখ শিহরিত হল। তারপর জ্বালা। তারপর উত্তাল বক্ষস্পন্দন। তার ইচ্ছে হল তৎক্ষণাৎ ঝড়ের মতন ছুটে যেতে। ওই কঠিন বক্ষে তার কোমল বক্ষ মেলাতে। তার শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু ওই মানুষটির সঙ্গে লীন হতে চায়।

তবু নিজেকে সংযত করল সে।

এ উদ্যান তার জন্য নিষিদ্ধ। এখানে সে বিধি ভেঙে এসেছে। যদি ওই পুরুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করে? যদি আরও কঠিন হয়ে উঠে তাকে দূরে ঠেলে দেয়? এখানে অলক্ষ্যে কোথাও আছে সৃষ্টিকর্তার তিন প্রহরী, যদি পুরুষটি তাদের ডাকে?

সে আপনমনে বলল, হে সখা, তুমি তো নিঃসঙ্গ। আমরা বিবাদ করেছি, তবু তো আমি দূরে সরে থাকতে পারি না। তোমারও কি মন উচাটন হয় না? তুমি তো কখনও এই উদ্যান থেকে বেরিয়ে পর্বতগুহায় আমার সন্ধানে যাওনি। তুমি কি এখনও ক্রোধ পুষে রেখেছ?

শরীর চাইছে ধেয়ে যেতে, মন টেনে ধরছে রাশ, রমণীটি এক স্থানে স্থির অথচ দোদুল্যমান।

আকাশে রামধনুটি এখনও মিলিয়ে যায়নি। প্রকৃতিতে চলেছে সুন্দরের কত রকম খেলা, বাতাসে মুগ্ধতার আবেশ, তবু ওই পুরুষটিকে দেখার পর রমণীটির আর কোনো দিকে মন গেল না, নিদারুণ তৃষ্ণার্তের মতন সে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল পুরুষটির দিকে।

একটু পরে পুরুষটি মিলিয়ে গেল জঙ্গলের আড়ালে।

কোথাও একটা পাখি খুব জোরে ডেকে উঠল।

তার ধবনিটি অনেকটা যেন টিট্রিভ, কিংবা লিললিথ! একবার মনে হয়, টিট্রিভ, আর একবার মনে হয়, লিললিথ।

রমণীটি ঘোর ভেঙে পাখিটাকে খুঁজতে লাগল। এই পাখিটির ডাক শুনেছে সে, কখনও দেখতে পায়নি। কিছু কিছু পাখি শুধু ঘন পাতার আড়ালে বসে ডাকে, কিন্তু যখন প্রকাশ্যে আসে কিংবা উড্ডীয়মান, তখন ডাকে না।

রমণীটি ব্যাকুলভাবে বলল, ওরে পাখি, আরও জোরে ডাক। নীচের দিকে নেমে যা আমার পুরুষ যেন এই ডাক শুনতে পায়। তাহলে হয়তো আমার কথা তার মনে পড়বে।

এই পাখির ডাক থেকেই রমণীটির নাম—লিলিথ।

সৃষ্টিকর্তা প্রথম যে মানব সৃষ্টি করেন, সে পুরুষ। জল, মৃত্তিকার মতন প্রকৃতির উপাদান দিয়েই সে গড়া। প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, তোমার নাম দিলাম আদম। পরে তুমি বহু নামে পরিচিত হবে। তুমি স্বচ্ছন্দে এই স্বর্গোদ্যানে বিচরণ করো।

কিছুদিন পরেই তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি একটা গভীর ভুল করেছেন। তিনি প্রথম মানুষটি গড়েছেন অনেকটা নিজের শরীরের আদলে, কিন্তু তিনি তো নারীও নন, তাঁর তো এক থেকে বহু হবার প্রয়োজন নেই, তিনি অদ্বিতীয়, তিনি এলোহিম। কিন্তু মানুষটিকে তিনি পুরুষলিঙ্গ দিয়েছেন, সে অবিরাম বিপরীত লিঙ্গের একজনকে চাইবে। তাঁর অন্যান্য সব সৃষ্টিই তো এক থেকে বহু হয়।

আদমের উপভোগের সব উপাদানই আছে এই কাননে, তবু প্রায়শই সে নিরানন্দ থাকে কারণটা সে নিজেই জানে না, কিন্তু দূর থেকে তাকে লক্ষ করে তার স্রষ্টা বোঝেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তির মনোবেদনা দেখে তিনি ব্যথিত হন নিজেও।

আবার একদিন সময় করে তিনি শিল্পকার্যে মন দিলেন। প্রকৃতির সব কিছুর সৌন্দর্য থেকে ছেনে ছেনে তিনি গড়ে তুললেন এক তিলোত্তমা মূর্তি। পুরুষের তুলনায় এর সব কিছুই কোমল, এমনকি হাতের আঙুলের লীলায়িত ভঙ্গি পর্যন্ত।

প্রাণসঞ্চার করা মাত্র শায়িত মূর্তিটি উঠে দাঁড়াল, একবারে পুরুষটির মুখোমুখি। দুজনে এমনভাবে চেয়ে রইল যেন সেই দৃষ্টিতে রয়েছে একটি সেতু।

আর তখনই শোনা গেল সেই পাখিটির ডাক, টিট্রিভ! লিললিথ?

তৃপ্তির হাসে ফুটে উঠল সৃষ্টিকর্তার মুখে। এতদিনে সম্পূর্ণ হল তাঁর সৃষ্টির কাজ।

তিনি এই মানব-মানবীকে বললেন, এবার তোমরা এই পৃথিবীকে চালনা করার ভার নাও। আদম, ওই পাখিটির ডাক অনুযায়ী তোমার এই সঙ্গিনীর নাম রাখা হল লিলিথ। তোমরা পরস্পরের পরিপূরক হও। কখনও কোনো সংকট হলে আমার শরণাপন্ন হোয়ো। আমি তোমাদের শব্দ দেব, ভাষা দেব। কিন্তু তা আয়ত্ত করতে তোমাদের সময় লাগবে। ততদিন তোমরা মুখোমুখি দাঁড়ালেই তোমাদের মনের তরঙ্গ বিনিময় হবে। মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারণ না করেও তোমরা পরস্পরের সব বাক্য হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে।

সৃষ্টিকর্তা অদৃশ্য হয়ে যেতেই আদম তার সঙ্গিনীকে বলল, এখন তোমার শরীরে ধূলি লেগে আছে। এসো, আমরা অবগাহন করি।

তারপর কাটতে লাগল দিনের পর দিন। দুজনের পরিচয় প্রগাঢ় হল। অবশ্য শরীর মিলনের চেতনা জাগল না। তারা দুই কুরঙ্গ-কুরঙ্গীর মতন পাশাপাশি বিচরণ করে স্নান করে একসঙ্গে, ফলমূল ভাগ করে খায়, শুয়ে থাকে কাছাকাছি। এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্ছেদ নেই। এমনকি ঘুমের মধ্যেও এক একবার জেগে উঠে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

একদিন একটা গাছ থেকে একটি সুপক্ব ফল পাড়তে গেল লিলিথ, আদম বলল ও ফলটি নিও না।

সরল কৌতূহলে লিলিথ জিজ্ঞেস করল, কেন?

আদম বলল, কোন ফলটি ভালো, আমি তোমায় চিনিয়ে দেব। আমি আহরণ করে দেব তোমার জন্য।

লিলিথ সহাস্যে বলল, হে সখা, তুমি দেবে, আমি অঞ্জলি পেতে গ্রহণ করব।

আর একদিন এক নতুন জলাশয়ে অবগাহন করতে চাইল লিলিথ, তার এক বাহু চেপে ধরে আদম বলল, ওখানে নেমো না।

লিলিথ বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল, কী কারণে?

আদম বলল, এই সরোবরে কয়েকটি ফুল ভাসছে! এই ফুলগুলি আমি আগে দেখিনি। জলে কেন ফুল ভাসবে? চল, তোমাকে আমি অন্য নির্মল সলিলে নিয়ে যাব।

নতুন সরোবরটিতে আর ওদের অবতরণ করা হল না।

এক অপরাহ্ণে আকাশ ধারণ করল রুদ্র রূপ।

সূর্য হারিয়ে গেলেন ঘন কালো মেঘের আড়ালে। সেই মেঘও যেন পাথরের মতন কঠিন। পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে শব্দ হতে লাগল প্রচণ্ড। যেন সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে স্পর্ধা করছে তাঁর কোনো প্রবল প্রতিপক্ষ, আজ সমস্ত সৃষ্টি ধবংস করে দেবে মাঝে মাঝে যেন সূর্যের চেয়েও তেজি বিদ্যুৎ চমক।

আগে একবার আকাশে এরকম রণ-হুঙ্কারের সময় সৃষ্টিকর্তা আদমকে দর্শন দিয়ে অভয় জানিয়েছিলেন। আদম তাই জানে, আকাশে যতই তর্জন-গর্জন হোক, এক সময়ে থেমে যাবে। লিলিথ দেখেনি আকাশের এই রূপ। কোনো অজানা আশঙ্কায় কম্পিত হচ্ছিল তার বুক।

তারপর শুরু হল ঝড়। তার এমনই শক্তি এবং তীব্র বেগ যে বহু বৃক্ষের শাখা ভেঙে পড়তে লাগল। কোনো কোনো বৃক্ষ সমূলে উৎপাটিত হয়ে চলে গেল সুদূরে। এরকম সময়ে পাহাড়ের গুহা তবু নিরাপদ।

ওরা দুজনে বসে রইল একটি প্রায় শুষ্ক নদীর খাতে। তার এক দিকটা প্রাচীরের মতন, ওপর দিয়ে অনেক কিছু উড়ে গেলেও ওদের গায়ে লাগে না।

ঝড়ের পর এল বর্ষণ। প্রস্তর মেঘ এখন দ্রব। আকাশ যেন এখন এক হ্রদ, একসঙ্গে নেমে আসছে মাটিতে।

নদীর খাতে ওরা দুজনে কিছুটা আশ্রয় পেয়েছে বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ ধারাপাতের পর ওদের শৈত্যবোধ হল। পাথরে হেলান দিয়ে বসেছিল পাশাপাশি, একসময় আদম বলল, লিলিথ, তুমি কাঁপছ? তুমি শুয়ে পড়, আমি তোমাকে আচ্ছাদিত করে থাকব।

পরম যত্নে সেই পুরুষ তার সঙ্গিনীকে শীতের বাতাস এবং বৃষ্টির ছাঁট থেকে রক্ষা করার জন্য সর্বাঙ্গ আবৃত করে রইল। বুকে বুক, মুখে মুখ, হাতে হাত, উরুতে উরু।

একটু পরেই মিলিয়ে গেল শীত বোধ। এককভাবে সমস্ত নারী ও পুরুষেরই শরীরে শীত আশ্রয় নিতে পারে, কিন্তু দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলে শীত পলায়ন করে। তখন সেই দুই শরীরের দখল নেয় উষ্ণতা।

ওদের এই অভিজ্ঞতাই ছিল না, দুজনেই বিস্মিত হয়ে পরস্পরের নাম ধরে ডেকে উঠল, আদম! লিলিথ!

উষ্ণতা ক্রমশ সঞ্চারিত হতে লাগল শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আগুনের মতন এতে দহন নেই, আছে পরস্পরের মধ্যে মিলিয়ে যাবার জন্য আশ্লেষ। একসময় আদম অনুপ্রবেশ করল লিলিথের গভীরে।

স্বয়ং প্রকৃতি তাদের নির্দেশ দিতে লাগলেন।

মনুষ্য জীবনে যে এত সুখ আছে তা জানত না দুজনের কেউ।

একসময়ে এই মিলনখেলা সাঙ্গ হবার পর শ্রান্তভাবে পাশাপাশি শুয়ে রইল এই নারী ও পুরুষ! অবিলম্বেই ঘুম এসে গেল।

এরপর কয়েকটি দিন, সকাল নেই, দুপুর নেই, সন্ধ্যা নেই, রাত্রি নেই, যে-কোনো সময়, যে-কোনো স্থানে ওরা মেতে উঠতে লাগল এই মিলনখেলায়। সমস্ত পশু-পাখি, বৃক্ষলতা, কীটপতঙ্গের মধ্যেও যে অনবরত এই মিলনখেলা চলছে, তা আগে ওরা লক্ষই করেনি। এবার সকৌতুকে ওদের লক্ষ করতে লাগল প্রাণীকুল।

দিন কেটে যাচ্ছে এক রোমাঞ্চকর উন্মাদনায়। এখন বৃষ্টি, রৌদ্র, ঝড়, বিদ্যুৎ সবই বেশি বেশি ভালো লাগে। সময় বড়ো মোহময়।

একদিন সেই নদীর খাতে, যেখানে নরম তৃণভূমিতে ওরা এখন একটি শয্যা নির্মাণ করেছে, আদম লিলিথের হাত ধরে মিলনের আহ্বান জানাল।

লিলিথ আদমের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, সখা, অনেকবার আমরা মিলনসুখ পেয়েছি, আমি নীচে, তুমি ওপরে। আজ আমরা বিপরীত বিহার করি না কেন? তুমি আগে শয়ন করো।

আদম বিস্মিতভাবে বলল, আমি নীচে থাকব? কেন?

লিলিথ বলল, দেখি না, কেমন লাগে?

আদম বলল, না, তা হয় না।

লিলিথ চপলভাবে বলল, কেন হবে না। এসো না পরীক্ষা করে দেখি।

আদম বলল, তা হয় না, লিলিথ! প্রথমবার আমরা যেমনভাবে শুরু করেছি, সেটাই প্রকৃতির নির্দেশ। পুরুষের ইচ্ছাটাই নারীর মান্য। নারীর ওপরে পুরুষ।

এবার লিলিথের বিস্ময়ের পালা। ভুরু উত্তোলন করে বলল, প্রকৃতি কে? তিনি আমায় কেন নির্দেশ দেননি?

আদম বলল, প্রকৃতি আমাদের সৃষ্টিকর্তার এক প্রতিনিধি।

লিলিথ বলল, কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যে আমাদের বলে গেলেন, আমরা পরস্পরের পরিপূরক!

আদম বলল, অবশ্যই। ক্ষুদ্র ও বৃহতেও তো পরিপূরক হয়। দুর্বল এবং সবলে। আমি তোমাকে সবসময় রক্ষা করব, তুমি আমায় মাধুর্য দেবে। এইভাবে আমরা পরিপূরক।

লিলিথ বলল, একেবারে সমানে সমানে পরিপূরক কি আমরা হতে পারি না?

আদম কিছু না বলে শুধু হাসল।

লিলিথ আবার বলল, এক একদিন আমি আগে অবগাহনে নেমে তোমাকে ডাকি। আবার কোনোদিন তুমি আগে ঝাঁপ দাও। এও তো সে রকম।

আদম বলল, অবুঝ হোয়ো না সখি। এও সেরকম নয়। পুরুষের ওপরে নারীকে যেতে নেই। এসো, আমি উত্তপ্ত হয়েছি।

কেন যেন লিলিথের মনটা বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে গেল, সে আদমের বক্ষে থেকেও তাপ বোধ করল না। সে উঠে গিয়ে নদীতে নামল। একা দাঁড়িয়ে রইল কটিতট নিমগ্ন জলে।

পরদিন আদম আবার তাকে আহ্বান জানাল, আজও লিলিথের সেই একই শর্ত। সে ওপরে থাকবে।

আদম তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করল। কিন্তু এই কোমলাঙ্গী তরুণীটি যে এমন কঠিন প্রতিজ্ঞ হতে পারে, তা কল্পনাই করা যায়নি।

লিলিথ বলল, আমরা সারা দিনক্ষণ সব কিছু একসঙ্গে করি, তবু কেন আমরা দুজনে সমান হতে পারব না, তা বুঝিয়ে দাও! আমি লক্ষ করছি, আমি কোন গাছের ফল খাব, কোন সরোবরে স্নান করব, সে ব্যাপারেও তুমি আমাকে নির্দেশ দিতে চাও। আমার বোধ-বুদ্ধি তোমার তুলনায় কীসে কম? সরোবরে ফুল ভাসলে সে সরোবর কেন অস্পৃশ্য হবে?

আদম বলল, আমার কথা অনুযায়ী চললে তোমার কদাচ বিপদ হবে না। আমি তোমার সব ভার নিয়েছি, তাই তুমি সবরকম চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পার।

লিলিথ বলল, তোমার শরীর যেসব উপাদান দিয়ে গড়া, আমার শরীরও সেরকম। আমাদের একই রকম প্রাণ, এক জীবন। তবু কেন অসমান হবে? আমি যে বুঝতে পারছি না সখা। আমাকে বুঝিয়ে দাও।

আদম বলল, তোমাকে এত কিছু চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার কেশে দুটি পুষ্প গুঁজে নেবে? তাহলে তোমাকে আরও সুন্দর দেখাবে!

লিলিথ করুণ কণ্ঠে বলল, আমি সুন্দর হতে চাই না, আদম। আমি তোমার সঙ্গে জীবনের প্রতিটি ব্যাপার সমানভাবে ভাগ করে নিতে চাই।

আদম এবার ঈষৎ বিরক্তভাবে বলল, পুরুষ আর নারী কখনো সমান হতে পারে না—এটাই সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ। তা কি অবহেলা করা যায়!

লিলিথ বলল, তুমি আগে একবার বলেছিলে, প্রকৃতির নির্দেশ। এখন বলছ সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ। তুমি কী করে এই নির্দেশ পাও, আমি কেন পাই না।?

আদম গম্ভীরভাবে বলল, চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করলে যে অভিজ্ঞতা হয়, তা থেকেই এই নির্দেশ বোঝা যায়। সিংহ থেকে শশক পর্যন্ত যে-কোনো প্রাণীদের নিরীক্ষণ করো, সব সৃষ্টির মধ্যে পুরুষ কি প্রধান নয়? পুরুষ উপরে, নারী নীচে।

লিলিথ বলল, পশুজগৎ… কী জানি… সৃষ্টিকর্তা বলেছিলেন, আমরা তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।

আদম বলল, যদি সব ব্যাপারে সমানই হতে হবে, তা হলে সৃষ্টিকর্তা পুরুষ আর নারীকে পৃথক রূপ দিয়ে সৃষ্টি করলেন কেন? আমাদের শরীরের গড়ন কি কিঞ্চিৎ পৃথক নয়? তুমি কি আমার তুলনায় কিঞ্চিৎ দুর্বল ও খর্ব নও?

লিলিথ বলল, তা ঠিক। হ্যাঁ, ঠিকই তো? আমি এতটা বুঝতে পারিনি। তবে, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব, রুষ্ট হোয়ো না, আমাদের হৃদয়, আমাদের মস্তিষ্ক, তাও কি ছোটো বড়ো? চিন্তাশক্তিতেও কি আমি তোমার চেয়ে ন্যূন?

আদম বলল, বলেছি তো, তোমাকে এসব চিন্তা করতে হবে না।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ।

তারপর লিলিথ আবার আদমের দেহ স্পর্শ করে কোমল কণ্ঠে বলল, থাক মিছে তর্ক। সখা একবার অন্তত আমরা বিপরীত বিহারের পরীক্ষা করে দেখিই না। যদি তাতে উপভোগ আরও বেশি হয়?

আদম বলল, এই কদিন আমরা যেভাবে মিলিত হয়েছি, তাতে কি আমাদের উপভোগের চরম হয়নি? তুমি তৃপ্তির পূর্ণতা লাভ করোনি? বলো, বলো, তবে কেন এবং কীসের জন্য অন্য পরীক্ষা?

আদম মুখ ফিরিয়ে রইল। লিলিথ চলে গেল অন্য দিকে। এইভাবে কাটল কয়েকটি দিন।

তারপর আবার এক মেঘাচ্ছন্ন দুপুরে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, পাখিরা ডাকছে পরস্পর মিলন কামনায়, ফুলেরা সৌরভ ছড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে তাদের দয়িতদের, আদমও কামমোহিত হয়ে আলিঙ্গন করতে গেল লিলিথকে।

সে আলিঙ্গনে ধরা দিয়ে লিলিথ অনুনয় করে বলল, একবার বিপরীত বিহার হোক, অন্তত একবার! তুমি আমার এই ইচ্ছেটুকুর মূল্য দেবে না?

এবারে ধৈর্যচ্যুতি হল আদমের। ক্রোধে জ্বলে উঠে সে বলল, বার বার শুধু ওই এক কথা? আমাকে অপদস্থ করতে চাস তুই নারী? তোর ইচ্ছে আবার কী? আমার সকল ইচ্ছে মেনে নেওয়াই তোর জীবনের সার্থকতা।

আদম সবলে লিলিথকে ভূপতিত করতে যেতেই লিলিথ কোনোক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় দিল।

পুরুষ ব্যাঘ্রের মতন তাকে তাড়া করে গেল আদম।

উত্তেজনায়, দুরন্ত বাসনায়, ক্রোধে চিৎকার করতে লাগল আদম। কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না লিলিথ। একটি সুবৃহৎ বৃক্ষের কাণ্ড প্রদক্ষিণ করে সে ঘুরছে, হাসছে সকৌতুকে।

আদমের মুখে হাসি নেই। তার চক্ষু দুটি জ্বলন্ত।

তার চিৎকারে সমস্ত কাননভূমি যখন কম্পিত, তখন অকস্মাৎ তিনটি প্রাণী সেখানে আবির্ভূত হল। এদের আকৃতি প্রায় মানুষেরই মতন, আবার পক্ষীর মতন ডানাযুক্ত। আকাশচারী এই তিন প্রাণী সৃষ্টিকর্তার দূত, এদের নাম সেনয়, সানসেনয় এবং সেমনগেলফ।

এই তিনজন লিলিথকে ঘিরে ফেলে প্রশ্ন করল, কী ব্যাপার, এই উদ্যানে এমন অশান্তি কেন?

লিলিথ কিছু বলার আগেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আদম বলল, এই নারী আমার অবাধ্য। আমি ওকে যেভাবে কামনা করি, ও তা মেনে নিতে চায় না। ও যদি আমার কথা না শোনে, তবে এমন সহচরীর প্রয়োজন নেই আমার।

লিলিথ এবার কিছু বলতে যেতেই তাকে থামিয়ে দিয়ে ওদের একজন বলল, এ কী মতিভ্রম তোমার, নারী? সবসময় পুরুষের প্রীতি অর্জন করতে পারলেই তো তুমি সুখী হবে। অবাধ্যপনাতে শুধু অশান্তি।

লিলিথ বলল, আমার একটি কথা শুনুন—

অন্য একজন বলল, শোনার তো কিছু নেই। তুমি এই পুরুষটির অনুগমন করো।

তৃতীয়জন কৌতুকহাস্যে বলল, নারী-পুরুষের এরকম ক্ষুদ্র কলহ তো মাঝে মধ্যে হতেই পারে। সৃষ্টিকর্তা অন্য পশু-প্রাণীদের এই বোধ দেননি, শুধু মানুষকেই দিয়েছেন, তার নাম মান-অভিমান। এই মান-অভিমানও মিলনখেলার অঙ্গ। যাও নারী, আমরা অন্তর্হিত হচ্ছি, তোমরা মান ভেঙে উপগত হও।

লিলিথ এবার অস্থিরভাবে বলল, আমার কথাটা শুনতেই হবে। পুরুষ যে বলল, ওর অবাধ্য হলে আমার মতন সহচরী ও চায় না, তাহলে আমিও কি বলতে পারি না, ও আমার অবাধ্য হলে আমিও ওর মতন সহচর চাই না?

তৃতীয়জন হাসতে হাসতেই বলল, ওসব তো কথার কথা।

প্রথমজন কিন্তু কঠোরভাবে বলল, সহচর নির্বাচনের অধিকার তোমার নেই, নারী! তুমি পূর্বনির্দিষ্ট। পুরুষের প্রয়োজনেই তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এটা সব সময় মনে রাখবে।

এইসব কথার মধ্যে আদম এসে লিলিথের এক বাহু ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। অন্য তিনজনও তাকে ঠেলে দিতে লাগল পুরুষটির দিকে।

পাশবদ্ধ হরিণীর মতন ছটফটিয়ে লিলিথ বলতে লাগল, না, না, আমাকে পাবে না, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শরীর পাবে না, কিছুতেই না, না, না।

এরপর যা কাণ্ড হতে লাগল, তাতে আর যাই হোক, মিলনখেলা কিছুতেই সম্ভব নয়। বলপ্রয়োগে নারীকে পরাস্ত করা যায়, কিন্তু তার কাছ থেকে মাধুর্য আদায় করা যায় না।

একসময় অন্য তিনজনও রুষ্ট হয়ে উঠল। একজন বলল, আদম, তুমি যদি একে না চাও, তবে একে এই পবিত্র উদ্যান থেকে দূর করে দেওয়া যাক!

আদম বলল, আমি আর ওর মুখদর্শন করতে চাই না। আমি নিঃসঙ্গ থাকব, সে-ও ভালো।

সকলে মিলে টানতে টানতে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে লিলিথকে কাননের বাইরে নিক্ষেপ করল। সে জায়গাটি ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে। সেখান থেকে গড়াতে গড়াতে সে গিয়ে পড়ল পাহাড়ের সানুদেশের এক নদীতে। ভাসতে লাগল, অচেতন হয়ে।

তবু তার প্রাণ গেল না। তারপর থেকে সে আশ্রয় নিয়েছে এক গিরিগুহায়। এ পাহাড়েও কিছু গাছপালা আছে। তেমন বৈচিত্র্য নেই বটে, তবে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য যথেষ্ট ফল পাওয়া যায়।

প্রথম কয়েকটা দিন কেটেছিল শুধু কান্নায়।

সে বুঝতেই পারে না, তার কী দোষ হয়েছিল? সে শুধু আদমের সঙ্গে সব ব্যাপারে সমান হতে চেয়েছিল, সে অধিকার তাকে কেন নেওয়া হবে না? সে তো অতিরিক্ত কিছু দাবি করেনি!

মানুষের এত কান্না কোথায় জমা থাকে? অবিরত ক্রন্দনেও অশ্রু ফুরোয় না।

কান্নাতে কোনো কিছুর উত্তরও পাওয়া যায় না।

সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন মান-অভিমান, অন্য কোনো প্রজাতি এই বোধ পায়নি। এই অভিমান কখনও এমন তীব্র হতে পারে যেন কোনো কোনো মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করতেও দ্বিধা করে না। লিলিথও কয়েকবার নদীর জলে আত্মবিসর্জন দেবার কথা চিন্তা করেছে, শেষ পর্যন্ত পারেনি।

কিছুদিন পর তার মন দুর্বল হয়ে গেল। দিনগুলি তবু কাটে কিন্তু রাত্রিগুলি যেন শেষই হতে চায় না। নিঃসঙ্গতা তাকে অসহ্য অস্থির করে দেয়। আদমের সঙ্গে তার কয়েকটি ঋতু একসঙ্গে সহবাস করার সুখস্মৃতি তার মনে পড়ে সর্বদা। সেই স্মৃতিতেই তার সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ হয়।

একদিন সে ঠিক করল, এভাবে জীবনযাপন করা অর্থহীন। বরং আদমের প্রভুত্ব মেনে নেওয়াই ভালো। আদমের সব ইচ্ছা সে মান্য করে চলবে। আদমের কাছে গিয়ে দয়া ভিক্ষা করলে কি আদম তাকে ফিরিয়ে নেবে না?

পুরুষের নীচে থাকাই যদি নারীর নিয়তি হয়, তবে তা অস্বীকার করে লাভ কী?

এইসব কথা সে ভাবে, মনস্থির করতে পারে না, ফিরে যাবার মতন মনোবলও আসে না। এরই মধ্যে এক প্রভাতে সৃষ্টিকর্তার সেই তিন দূত এসে উপস্থিত হল তার সামনে।

প্রথমজন, সেনয় বলল, তোমাকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়েছিল, সেই দণ্ড প্রত্যাহার করা যেতে পারে, যদি তুমি পূর্বশর্তগুলি মেনে নাও।

দ্বিতীয়জন, সানসেনয় বলল, তুমি আর চাপল্য দেখিয়ে পুরুষের সমান হতে চেয়ো না। তোমার আরও সুখের দিন আসন্ন। আদমের অনুগত হয়ে তুমি থাকবে সেই পবিত্র কাননে।

তৃতীয়জন, সেমনগেলফ কিছুটা কৌতুকের সুরে বলল, দেখো, কালে কালে পুরুষ নিজেই তোমার অনুগত হতে চাইবে, তুমি মুখে কিছু বলো না।

লিলিথ তো সব শর্ত মেনে নিতে রাজিই। এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে সে ফিরে যেতে চায় এই কন্দর ছেড়ে। শুধু তার একটিই আশঙ্কা আছে।

সে নতনেত্রে কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, আদম বলেছিল, সে আমার মতন সহচরী চায় না। এমনকি সে আর আমার মুখদর্শনও করতে চায় না। তার ক্রোধ কি প্রশমিত হয়েছে? সে কি আমাকে পুনঃগ্রহণ করতে রাজি আছে?

প্রথমজন বলল, আমরা বুঝিয়ে বললে সে অবশ্য রাজি হবে। কারণ, এখন তোমার গর্ভে তার সন্তান।

সন্তান? সে আবার কী বস্তু?

তবে কয়েকদিন ধরে লিলিথ অনুভব করছে বটে যে তার নিম্ল উদরটি কিছুটা স্ফীত হয়েছে, মাঝে মাঝে উদরের গভীরে কী যেন নড়াচড়া করে।

আহত অভিমানে লিলিথ বলল, আমার জন্য সে ব্যাকুল হয়নি। আমার গর্ভে কিছু একটা এসেছে বলেই সে আমাকে গ্রহণ করতে চায়?

দ্বিতীয় দূত বলল, শোনো নারী, তোমার মধ্য দিয়ে পুরুষ তার বংশবিস্তার করবে বলেই তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। নইলে আদমের সঙ্গী হিসেবে তো আর একটি পুরুষকেই নির্মাণ করা যেত! সৃষ্টিকর্তা তো নিজ হাতে বারবার মানব সৃষ্টি করতে পারেন না, সে ভার দেওয়া হয়েছে পুরুষকে। তুমি হবে ভবিষ্যৎ মানবদের গর্ভধারিণী।

লিলিথ বলল, আমি ধারণ করব? বেশ! কিন্তু কখন, কোন ঋতুতে আমার শরীর গ্রহণক্ষম হবে, তা আমি ঠিক করতে পারব না? আমারই তো শরীর?

প্রথম দূত বলল, শরীর তোমার। তুমি আধার মাত্র। তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।

আবার দপ করে জ্বলে উঠল লিলিথের তেজ।

সে বলল, আমার বাসনার কোনো মূল্য দেওয়া হবে না? আমি চাই না অমন মিলন। আদমকে গিয়ে বলুন, আদম নিজে এসে যদি আমাকে যাচ্ঞা করে, তবেই আমি ফিরে যাব। নইলে আমার গিরিকন্দরই ভালো।

এরপর কিছুক্ষণ ধরে তিনজন দূত নরম ও গরম ভাষায় লিলিথকে বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু অনড় হয়ে রইল লিলিথের জেদ। আদম নিজে এসে তার মিলন ভিক্ষা না করলে সে এখান থেকে এক পাও নড়বে না!

তখন প্রথম দূত আঙুল তুলে অভিশাপ দিল, তবে থাক তুই এখানে চিরনির্বাসিতা হয়ে। তোর গর্ভের সন্তানকে আমি ধবংস করে দিচ্ছি! পুরুষের বীর্যে আর তোর অধিকার রইল না। তুই আর কোনোদিন সন্তান পাবি না।

সেই অভিশাপে প্রায় দগ্ধ হয়ে ভূপতিত হয়ে রইল লিলিথ।

গর্ভ নষ্টে অসুস্থ হয়ে রইল দিনের পর দিন। তবু তার অদম্য প্রাণশক্তি। তার মৃত্যু হল না।

আবার শরীরের বল ও রূপ ফিরে পেয়ে সে সিদ্ধান্ত নিল, আর তার সঙ্গীর প্রয়োজন নেই। সে পশুপাখি, বৃক্ষ-লতাপাতার সঙ্গেই বন্ধুত্ব করে নেবে। যদি আকাশকে আপন করে নেওয়া যায় তাহলে আর কোথাও কোনো শূন্যতা থাকে না।

তবু মন যে মানতে চায় না। এক এক সময় বড়ো বেশি উতলা হয়ে ওঠে। জল যেমন জলের দিকে ধায়, তেমনই শরীর পেতে চায় আর একটি শরীর। রতি-অতৃপ্তির জন্য দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

এইভাবে আরও দুটি ঋতু পার করে দেবার পর আজ সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি। সারা রাত নিদ্রাহীনতার মধ্যে সে শুধু আদমের কথাই চিন্তা করেছে। সমস্ত শরীর-মন আকুল হয়ে আছে সেই পুরুষটির জন্য।

তাই ভোরের আলো ফোটার আগেই দীর্ঘপথ পার হয়ে সে গোপনে প্রবেশ করেছে আদিম কাননে। সে শুধু একবার মাত্র আদমকে প্রশ্ন করবে, সখা, তুমি সত্যিই আমাকে আর চাও না? তুমি আমাকে ঘৃণা করো? যদি তাই হয়, তাহলে আমি আর কখনও তোমার সম্মুখে আসব না। তোমাকে আর আমার মুখদর্শন করতে হবে না। আমি চিরবিদায় নেব! আমাদের সেই মধুর দিনগুলি তোমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে।

দূর থেকে একবার আদমকে দেখেও লিলিথ তার নিকটে যেতে সাহস পেল না। যদি আদম রূঢ় বাক্যে তাকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে তা সে সইতে পারবে তো? বরং দূর থেকে যতক্ষণ পারা যায়, আদমের জীবনযাত্রা লক্ষ করা ভালো, সে যদি আপনমনে কখনও লিলিথের নাম উচ্চারণ করে ফেলে, কিংবা যে-যে স্থানে তাদের রতিশয্যা পাতা হয়েছিল, সেইসব স্থানে যদি আদম একাকি গিয়ে শুয়ে থাকে, তবে হয়তো তার স্মৃতিকাতরতা বোঝা যাবে।

ছায়ার মতন আদমকে অনুসরণ করতে লাগল লিলিথ।

না, ঠিক ছায়া বলা যায় না, মাঝখানে দূরত্ব অনেকখানি। আর সে সবসময় নিজেকে আড়ালে রাখে। হাঁটে নিঃশব্দে। আদম কোথাও থেমে গেলে সেও কোনো বৃক্ষের নীচে অপেক্ষা করে।

একবার আদম সেই শুষ্ক নদীর খাতের ধার দিয়ে গেল, যেখানে এক বর্ষণমুখর দিনে তাদের প্রথম মিলন হয়েছিল। আদম সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করল না।

লিলিথ লক্ষ করল, আদমের যেন কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছে এর মধ্যে। মাঝে মাঝে সে কণ্ঠে একটা সুর তুলছে গুনগুন করে। আগে এমন শোনা যায়নি। বৃক্ষলতাদের মধ্যে শুধু ফলবান বৃক্ষদের প্রতিই ছিল তার আকর্ষণ, তার প্রিয়, নির্বাচিত ফল আহরণের জন্য। ফুলের প্রতি মনোযোগ দিত না। এখন সে স্নেহস্পর্শ ফুল্ল কুসুমকে। কোনো লতাকে জড়িয়ে দিচ্ছে বনস্পতির গায়ে।

এক স্থলে এক সঙ্গে অনেক ফুল ফুটে আছে, সেসব ছিঁড়ে নিয়ে আদম বসে পড়ল মাটিতে তারপর গাঁথতে লাগল মালা। লিলিথের বেশ কৌতুক বোধ হল। যখন দুজনে একসঙ্গে ছিল, তখন লিলিথ কখনো-কখনো মালা গেঁথেছে বটে, পরেছে নিজের গলায়। আদমকেও পরাতে গেছে, কিন্তু আদম স্বস্তি বোধ করেনি, ছিঁড়ে ফেলেছে একটুক্ষণ পরেই।

আজ আদম মালা গাঁথছে নিজের কণ্ঠে ধারণ করার জন্য? তবে কি লিলিথের কথা মনে পড়ছে তার? এবার সে আদমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে?

তার দ্বিধা কাটার আগেই আদম মালাটি গেঁথে উঠে দাঁড়াল। নিজের গলায় দিল না। মালাটি হাতে নিয়ে ছুটতে শুরু করল। উচ্চকণ্ঠে কী যেন একটা শব্দ বার করছে।

লিলিথও তাল রক্ষা করে ছুটতে লাগল, সেই দিকে।

একটুক্ষণ পরেই সে থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল তার। আর একটি নারী।

আদম ছাড়া এ উদ্যান জনশূন্য বলে ধরেই নিয়েছিল সে। তা তো নয়, এর মধ্যেই আদমের একটি সঙ্গিনী এসে গেছে। সৃষ্টিকর্তা গড়ে দিয়েছেন আর একটি নারী? সৃষ্টিকর্তাও লিলিথের সব অধিকার প্রত্যাহার করে নিয়েছেন?

অপর নারীটিও প্রায় লিলিথেরই আদলের। শুধু সে লিলিথের মতন তীক্ষ্ণনাসা নয়, চক্ষু দুটিতে ঘুম ঘুম ভাব। এ ছাড়া তার বক্ষের ডৌল, কোমরের খাঁজ ও নিতম্বের গড়ন একেবারে নিখুঁত।

সেই নারীটিও কয়েকটি বড়ো বড়ো গাছের পাতার ওপর কিছু ফলমূলের আবরণ-ত্বক ছাড়িয়ে রাখছে আদমকে দেখে সহাস্যে সম্ভাষণ জানাল।

আদম সেখানে বসে পড়ে মালাটি পরিয়ে দিল নারীটির কণ্ঠে। নারীটি পুলকিত হয়ে ফুলগুলি দেখল প্রথমে। তারপর একপাতা ফল তুলে একটি একটি করে খাওয়াতে লাগল তার পুরুষকে।

লিলিথ কখনও আদমের মুখে ফল তুলে দেয়নি, কখনও একই ফল খেয়েছে দুজনে দু-দিক থেকে। কিংবা যার যখন ক্ষুধা বোধ হয়েছে, বৃক্ষ থেকে ফল আহরণ করে ভক্ষণ করেছে।

ওদের আহার শেষ হবার পর নারীটি চলে এল আদমের পিঠের দিকে। সেই ঘর্মাক্ত প্রশস্ত পৃষ্ঠদেশে হস্ত সঞ্চালন করতে লাগল সে।

কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে অতি সন্তর্পণে লিলিথ আর একটু কাছে এল।

আদমের পৃষ্ঠদেশে ছোটো ছোটো সাদা সাদা কী যেন হয়েছে। ওগুলি ঘর্মচর্চিকা, অন্য নারীটি তার নখ দিয়ে চেপে ধরছে সেগুলিকে। বেশ আরাম বোধ হচ্ছে আদমের।

তারপর আদম লম্বা হয়ে শয়ন করল। আবার এদিকে চলে এসে নারীটি পদসেবা করতে লাগল তার। আদমের চক্ষু বুজে এল, তরুণীটি দু-হাতে মর্দন করতে লাগল তার পা।

এসব কিছু জানেই না লিলিথ।

সে আর অশ্রু সংবরণ করতে পারল না। পাছে তার কান্নার শব্দ হয়, তাই দ্রুত সরে গেল সেখানে থেকে।

একটি ঝরনার ধারে এসে ঝুঁকে পড়ে সে তার অশ্রুবিন্দু মেশাতে লাগল জলে।

দু-একবার আদমের ডাক শুনে সে বুঝতে পেরেছে, ওই দ্বিতীয় নারীটির নাম হবা। এখন এই পবিত্র উদ্যান শুধু ওদের দুজনের। লিলিথ আর এখানকার কেউ নয়। আদম আর কোনোদিন তাকে কামনা করবে না।

কতক্ষণ মনোবেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল লিলিথ তার ঠিক নেই। এক সময় নিদ্রিত হয়ে পড়ল সেখানেই। সর্বসন্তাপহারী নিদ্রা।

আবার যখন সে জাগরিত হল, তখন দিনমণি অস্তাচলে গেছেন। আকাশের অধিপতি এখন চন্দ্র। আজ আকাশ একেবারে নির্মেঘ। চন্দ্রকিরণে সমস্ত কানন অপরূপভাবে আলোকিত হয়ে আছে। সুপবন আমোদিত হয়ে আছে ফুলের সৌরভে।

ফিরে যেতে হবে, তবু পা উঠছে না লিলিথের। আজ থেকে সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেল। কোনো আশাও রইল না।

বঞ্চনার দুঃখ থেকে হঠাৎ হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠতে পারে রোষবহ্নি। লিলিথের রক্তপ্রবাহ দ্রুত হল, নাসারন্ধ্র দিয়ে বেরতে লাগল উষ্ণ নিশ্বাস। জ্বলন্ত হল দুই চক্ষু।

সে তার সব অধিকার ছেড়ে দেবে? কী অপরাধ করেছে সে! সে এখনও মনে করে, সৃষ্টিকর্তা তাকে আর আদমকে সমানভাবে গড়েছেন। তবু কেন আদমের প্রতি তাঁর এই পক্ষপাতিত্ব?

সৃষ্টিকর্তা কি জানেন, নারীর মান-অভিমান বোধের চেয়েও আর একটি বোধ কত প্রবল হতে পারে? তার নাম ঈর্ষা।

পূর্বাপর চিন্তা না করে সে ধেয়ে গেল আদম ও হবার সন্ধানে।

এক স্থানের ঘন লতাকুঞ্জের মধ্যস্থলে খানিকটা ভূমি পরিষ্কার করে লিলিথ রাত্রিযাপন করত আদমের সঙ্গে। স্থানটি প্রায় চারদিক ঘেরা। প্রথমেই লিলিথ গেল সেদিকে।

ঠিক সেখানেই শুয়ে আছে দুজনে। এ নীড় তো লিলিথেরই গড়া, এখানে অন্য নারীকে স্থান দিতে একটুও চক্ষুলজ্জা হল না আদমের?

দুজনেই নিদ্রায় বিভোর। আদম শুয়ে আছে আকাশমুখী হয়ে, হাত-পা ছড়িয়ে, এটাই তার শয়নের নিত্যদিনের ভঙ্গি। হবা একটু দূরে গুটিসুটি হয়ে ঘুমন্ত।

একটুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল লিলিথ। শুধু আকাশের চন্দ্র ছাড়া আর কেউ তাকে দেখছে না। ঈষৎ শীতের বাতাসের মধ্যেও তার শরীরে ফুটে উঠেছে বিন্দু বিন্দু স্বেদ।

হঠাৎ আর আত্মসংবরণ করতে পারল না লিলিথ। সে সোজা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আদমের উন্মুক্ত বক্ষে।

সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠল আদম। স্পর্শমাত্রই সে বুঝেছে, এ তার বর্তমান সঙ্গিনী নয়, পূর্বের নারী।

সে চিৎকার করে বলল, আবার তুই এসেছিস।

সে ঠেলে সরিয়ে দিতে গেল লিলিথকে। লিলিথও কিছুতেই নিজের দাবি ছাড়বে না।

ধস্তাধস্তির শব্দে জেগে উঠল হবা। সে বিস্ময়ে বিহ্বল। সে লিলিথের অস্তিত্বই জানে না। সে ভাবল, এ বুঝি কোনো অপ্রাকৃত উৎপাত।

সেও টেনে সরাতে গেল লিলিথকে। লিলিথের শরীরে যেন এখন দারুণ শক্তি, ওরা দুজনে মিলেও তাকে নিরস্ত করতে পারছে না।

অচিরে হাজির হল সৃষ্টিকর্তার সেই তিন দূত। এবারে লিলিথের চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করিয়ে দিল তারা। আর শুধু ভর্ৎসনা বা কটুবাক্য নয়, নির্মমভাবে প্রহার করতে করতে নিয়ে চলল এই নারীকে। রক্তাক্ত হয়ে গেল লিলিথের সর্বাঙ্গ।

এক ঘৃণ্য প্রাণীর মতন কাননপ্রান্তে তাকে ছুড়ে দিয়ে সেই দূতত্রয় বলল, এই শেষবার! আবার এখানে এলে তোর মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য।

অত প্রহার সত্ত্বেও লিলিথ ভয় পায়নি, তার ক্রোধও কমেনি। প্রতিশোধস্পৃহায় তার রক্ত এখন ফুটন্ত।

গুহার দিকে যেতে যেতে সে একটি বৃক্ষের নীচে একটি বিচিত্র প্রাণীকে দেখতে পেল। এ সেই স্থূলকায় সর্পটি, খোলস এখনও লেগে আছে, তার থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি প্রায় মনুষ্যাকৃতি মুখ, তার মস্তকে দুটি ছোটো শৃঙ্গ।

মনুষ্য ভাষায় সে বলল, দাঁড়াও, লিলিথ। তুমি আমাকে চিনতে পারনি। তোমার সৃষ্টিকর্তার চেয়ে আমি কিছু কম শক্তিশালী নই। আমার নাম ইবলিশ। তুমি আমার সঙ্গিনী হও। আমরা দুজনে মিলে তোমার সৃষ্টিকর্তার এই অবিচারের প্রতিশোধ নেব!

লিলিথ তার সৃষ্টিকর্তাকে দেখেছে। সে ছিল আদমের মতন সুপুরুষের মিলনসঙ্গিনী। সে এখন এই কদাকার প্রাণীটির সঙ্গিনী হবে? তার ঘৃণাবোধ হল। প্রতিশোধ নিতে হলে সে একাই নেবে। সে সদর্পে বলল, তুমি দূর হও।

লিলিথ ফিরে চলল তার গুহার দিকে। সে ঠিক করেছে, সে আর কখনও কাঁদবে না।

আহত বাঘিনীর মতো সে চাটতে লাগল নিজের শরীরের ক্ষতস্থানগুলি।

সে রাত্রে বিস্ময়ে ও ভয়ে বড়ো বেশি আপ্লুত হয়ে পড়েছিল হবা। আদম অনেকক্ষণ ধরে নানারকম সান্ত্বনা বাক্যে তাকে আশ্বস্ত করতে সমর্থ হল। প্রকৃতির উপাদান নয়, হবাকে গড়া হয়েছে আদমেরই একটি পঞ্জর দিয়ে। তাই সে আদমের সঙ্গে একাত্ম, সে সবসময় আদমের কথা মান্য করে। আদম বার বার বলল, ওই হিংস্র রমণীটি আর কখনও আসবে না। সৃষ্টিকর্তার দূতরা নজর রাখবেন, ওই রমণী আবার এই কাননে পদপাত করলেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে। তুমি আর চিন্তা কোরো না, হবা। সব চিন্তার ভার আমার।

কিন্তু কয়েকদিন পরেই ফিরে এল লিলিথ। দূতদের অগোচরে।

মধ্যরাত, আদম ও হবা দুজনেই নিদ্রাবিষ্ট। যথারীতি হবা একটু দূরে, কারণ আদম ঘুমের মধ্যেও হাত-পা সঞ্চালিত করে। চিৎপাত হয়ে শয়ন করতেই ভালোবাসে সে।

অকস্মাৎ আদম টের পেল তার বক্ষের ওপর কেউ এসে পড়েছে। চেনা স্পর্শ, অবশ্যই লিলিথ। আদম তাকে ঠেলে সরাতে গেল, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, তার হাত দুটি শক্তিহীন অবস্থায় পাশে পড়ে রইল, উঠল না! সে চিৎকার করতে গেল, ফুটল না কণ্ঠ। সে পাশ ফিরে হবাকে ডাকতে গেল। সক্ষম হল না। এমনকি সে মেলতেও পারল না চক্ষু। সে নীচে, ওপরে লিলিথ তার সর্বাঙ্গ জুড়ে আছে। তাকে নিজের গভীরে নিতে চাইছে। তার দুই রম্ভোরু দিয়ে দিচ্ছে প্রবল চাপ। বাধা দেবার সব শক্তিই চলে গেল আদমের। আবেশ ছড়িয়ে পড়ল দেহ জুড়ে। তার রেতঃপাত হয়ে গেল এক সময়।

তারপর ধড়মড় করে উঠে বসল আদম।

কোথায় লিলিথ? সে তো নেই। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ রাত, ভূমিতে খসে পড়া শুষ্ক পত্ররাজিতেও কোনো পদশব্দ শোনা যাচ্ছে না। হবাও জাগেনি, নিশ্চিন্তে নিদ্রিত। তবে কি লিলিথ হানা দিয়েছিল শুধু স্বপ্নে! কিন্তু সে বীর্য হরণ করেছে, তা স্বপ্ন নয়, সত্য।

হবাকে কিছুই বলল না আদম। বিমূঢ় হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ।

তারপর কেটে গেল বহু ঋতু ও যুগ। অনেক পুত্রকন্যার জন্ম দিল দুজনে। তাদেরও সন্তানসন্ততি হল। বৃদ্ধ হয়ে পিতামহ ও পিতামহী হিসেবে সুখ ভোগ করে এক সময় আদম ও হবা মৃত্যুবরণ করল।

লিলিথ কিন্তু রয়ে গেল।

অতৃপ্ত, বঞ্চিত, অপূর্ণ রতির ক্ষোভ নিয়ে সে বেঁচে রইল যুগের পর যুগ। তার নশ্বর শরীর? অদৃশ্য হয়ে গেল বটে, তবু সে দেখা দেয় যুবা পুরুষদের স্বপ্নে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *