উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

প্রথম বাঙালি সম্রাট

প্রথম বাঙালি সম্রাট

তোমাদের অনেকেই হয়তো অবাক হবে। বাঙালি সম্রাট আবার কে? এমন বিস্ময় অহেতুক নয়। প্রাচীন আর্যাবর্ত বাঙালিদের আভিজাত্য স্বীকার করত না তো বটেই, উপরন্তু তাদের মনে করত অনেকটা হরিজনেরই সামিল। বলত, বাংলা হচ্ছে পাখির দেশ, ওখানে গেলে জাত যায়। ইংরেজরা শিখিয়েছে, বাঙালি হচ্ছে ভীরু, কাপুরুষ। ইস্কুলের ছেলেদের পড়িয়েছে, পুরোনো বাংলার বীরত্বের বড়াই করবার কিছুই নেই, প্রভৃতি।

একালে ভারতে অবাঙালিদের মুখেও শুনি ওই ধরনের বুলি। অল্পদিন আগেও ভারতের এক গুজরাটি মন্ত্রী মুখ ফুটে বলতে লজ্জা পাননি—বাঙালি খালি কাঁদতেই জানে! ভদ্রলোক বেবাক ভুলে গিয়েছিলেন যে, ভারতে মুসলমানদের দাসত্ব সর্বপ্রথমে স্বীকার করে সিন্ধুর সঙ্গে গুজরাটই এবং তাঁর জীবনকালেই বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছেন সুভাষ, বাঘা যতীন, কানাই, ক্ষুদিরাম প্রমুখ আগুনের দূতের দল।

এইসব হট্টগোলের মাঝে হঠাৎ বাঙালি সম্রাটের নাম করলে প্রথমটা চমকে যেতে হয় বইকি! কিন্তু কেবল একজন নন, বাঙালি সম্রাট ছিলেন একাধিক। তবে আজ আমি যাঁর কথা বলব, লিখিত ইতিহাসে তিনিই হচ্ছেন সর্বপ্রথম। তাঁর নাম শশাঙ্ক। বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁকে সম্রাট বলেই পরিচিত করেছেন।

কিন্তু জনসাধারণ তাঁর কথা ভালো করে জানে না কেন? এ-জিজ্ঞাসার জবাব হচ্ছে, কোনও কবি বা প্রাচীন লেখক তাঁর পক্ষ গ্রহণ করেননি বলে।

বিশাখ দত্ত লিখিত ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে ও গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় পাই ভারতবর্ষের প্রথম সম্রাট মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের কাহিনি। প্রথম চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন লিখে রেখে গেছেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের কাহিনি।

বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’-এ এবং চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙের ভ্রমণবৃত্তান্তে পাই সম্রাট হর্ষবর্ধনের কাহিনি। কল্হন প্রমুখ লেখকদের ‘রাজতরঙ্গিণী’ গ্রন্থে অমর হয়ে আছে কাশ্মীরের অনেক রাজার কাহিনি। কত বড় দিগবিজয়ী সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত! তাঁরও জীবনী সেদিন পর্যন্ত অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। অল্প যা কিছু জানা গিয়েছে, তাও তাঁর সভাকবি হরিষেণের লিপি আবিষ্কারের পর।

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সম্রাট শশাঙ্কদেব তেমন সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন। নইলে তিনিও আজ ইতিহাসে কোণঠাসা না হয়ে সম্রাট হর্ষবর্ধন ও ললিতাদিত্য প্রভৃতির মতোই প্রখ্যাত হতে পারতেন।

অবশ্য কেউ কেউ তাঁর উল্লেখ করে গিয়েছেন। কোথাও কোথাও তাঁর মুদ্রা বা শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এবং এদিকে-ওদিকে ছড়ানোভাবে পাওয়া গেছে আরও কিছু টুকরো টুকরো নজির।

বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিকরা ওই অপ্রচুর মালমশলার ভিতর থেকেই শশাঙ্কের যে অসম্পূর্ণ আখ্যান আবিষ্কার করেছেন, তার সাহায্যেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি তাঁর অপূর্ব মহাপুরুষত্ব। ওই আবিষ্কারকার্য এখনও চলছে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা প্রায়-পরিপূর্ণ শশাঙ্ককে দেখবার সুযোগ পাব।

আপাতত যেটুকু পেয়েছি তাই নিয়েই আমাদের তুষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু এর মধ্যে ও গণ্ডগোল ও তর্কাতর্কির অভাব নেই। ভিনসেন্ট স্মিথ, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোমোহন চক্রবর্তী, রাধাগোবিন্দ বসাক, রমেশচন্দ্র মজুমদার, কে. পি. জসওয়াল ও ডি. সি. গাঙ্গুলি প্রভৃতি বিশেষজ্ঞদের সৃষ্ট তর্কজালের মধ্যে পড়ুয়াদের জড়িয়ে ফেলবার ইচ্ছা আমাদের নেই। তাঁদের কাছ থেকে সহজ বুদ্ধিতে যেটুকু গ্রহণযোগ্য সেইটুকু নিয়েই এই প্রথম বাঙালি সম্রাটকে সকলের চোখের সামনে তুলে ধরতে চাই।

ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ পাদ।

অধঃপতিত গুপ্তসাম্রাজ্য। ধুলায় লুণ্ঠিত সম্রাটের শাসনদণ্ড! ভারতবর্ষ তখন অরাজক নয়, ‘সহস্ররাজক’! সাম্রাজ্যকে খান খান করে ফেলে পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করছেন ছোট ছোট রাজারা।

বাংলাদেশের যে অংশ আগে গৌড় (এখনকার উত্তরবঙ্গ) বলে বিখ্যাত ছিল, সেখানে রাজত্ব করতেন শশাঙ্ক নামে এক নরপতি। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণপুর। আধুনিক মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ছয় মাইল দূরে আছে রাঙামাটি নামে গ্রাম। সেইখানেই ছিল প্রাচীন কর্ণসুবর্ণপুরের অবস্থান।

একখানি সেকেলে শিলালিপি (অর্থাৎ পাথরের উপরে খোদা লিখন) পাওয়া গিয়াছে। তার উপরে লেখা ছিল—’শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্কদেবস্য’। সামন্ত বলে, অধীন রাজাকে। মহাসামন্ত অধিকতর বড় রাজা হলেও স্বাধীন নৃপতি নন।

অতএব বুঝতে পারি, প্রথম জীবনে শশাঙ্কদেব স্বাধীন ছিলেন না। তাঁরও চেয়ে একজন বড় বা মহা রাজার অধীনে রাজত্ব করতেন। কিন্তু তিনি কে?

ঐতিহাসিকদের অনুমান, তাঁর নাম মহাসেনগুপ্ত। বিক্রমাদিত্যের প্রথম পুত্র কুমারগুপ্ত, পিতার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের সিংহাসন পেয়েছিলেন এবং তাঁর দ্বিতীয় পুত্রের নাম গোবিন্দগুপ্ত। কালক্রমে গুপ্তসাম্রাজ্য লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এবং কুমারগুপ্তের বংশ লোপ পায়। সেই সময়ে ছোট তরফের অর্থাৎ গোবিন্দগুপ্তের বংশধররা মগধ ও গৌড় প্রভৃতি দেশের মহারাজা নামে আখ্যাত হন। মহাসেনগুপ্ত সেই বংশেরই সন্তান। এসব কথা এখনও যথাযথভাবে প্রমাণিত হয়নি, কেবল এইটুকু নিশ্চিতভাবে জানা গিয়েছে যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে মহাসেনগুপ্তই ছিলেন মগধের অধিপতি। সেইজন্যেই শশাঙ্ককে তাঁরই সামন্ত বলে আন্দাজ করা হয়েছে।

তারপর প্রশ্ন ওঠে, শশাঙ্কদেব কে? কেমন করে তিনি গৌড়ের সিংহাসন পেলেন? তাঁর পিতৃপরিচয় কী?

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে শশাঙ্কদেব ছিলেন ছোট তরফের গুপ্তবংশীয়দেরই একজন এবং মহাসেনগুপ্তের পুত্র। এটা মেনে নিলে, শশাঙ্কের মগধাধিকারের পক্ষে একটা সুযুক্তি পাওয়া যায় বটে, কিন্তু অন্যান্য ঐতিহাসিকরা ওই মত মানতে রাজি নন। আসল কথা, শশাঙ্কের পূর্বপুরুষদের কথা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে প্রবাদে বলে, পুরুষ ধন্য হয় স্বনামেই, অতএব তাঁর বংশপরিচয় না পেলেও আমাদের চলবে।

ঐতিহাসিক বলছেন : ‘শশাঙ্ক কামরূপ ব্যতীত সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের অধীশ্বর ছিলেন।’ উত্তর-পূর্ব ভারত বলতে সমগ্র বঙ্গ ও বিহার (বা মগধ) প্রদেশ বোঝায়। উড়িষ্যাতেও শশাঙ্কের সামন্তরাজা ছিলেন, তাঁর নাম মাধববর্মা।

সুতরাং শশাঙ্ককে হঠাৎ দেখি কেবল গৌড়ের সামন্তরাজার রূপে নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতব্যাপী বিশাল এক সাম্রাজ্যের স্বাধীন সম্রাট রূপে। কেমন করে এটা সম্ভবপর হল?

ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ পাদে উত্তর ভারতকে পড়তে হয়েছিল বিষম সব অশান্তির আবর্তে। তারই ফলে যে শশাঙ্কের ভাগ্যপরিবর্তন হয়েছিল, এ-বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। দেখা যাক, সেইসব অশান্তির কারণ কী?

প্রথমত, মধ্যপ্রদেশের কালাচুরি বংশীয় এক রাজার হস্তে মগধ-গৌড়ের অধিপতি মহাসেনগুপ্তের শোচনীয় পরাজয়। তারপর মহাসেনগুপ্তের আর কোনও কথা জানা যায় না, সম্ভবত তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, তিব্বতের শক্তিশালী রাজা স্রং সানের প্রবল আক্রমণে ছোট তরফের গুপ্তদের রাজ্য লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল।

তৃতীয়ত, দাক্ষিণাত্যের চালুক্যবংশীয় রাজা কীর্ত্তিবর্মন দাবি করেন, তিনি নাকি যুদ্ধে জয়ী হয়ে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ ও মগধের ওপর অধিকার বিস্তার করেছিলেন।

বেশ বোঝা যাচ্ছে, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে যোগ্য নায়কের অভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গিয়েছিল ভয়াবহ বিপ্লবের তরঙ্গের পর তরঙ্গ।

এমনি সব বিপ্লবের সময়েই উদ্যোগী পুরুষরা পান আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ। দৃষ্টান্ত দিতে গেলে ফরাসি বিপ্লবের কথা তুলতে হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পাদে ফরাসি দেশে তুমুল বিপ্লব না বাধলে পুরুষসিংহ হয়েও নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সম্রাট হওয়ার সুযোগ লাভ করতেন না।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, শশাঙ্কও ছিলেন পুরুষসিংহ। তিনি কেবল তেজি, সাহসী ও কর্মঠ নন, সেইসঙ্গে ছিলেন চতুর, সুকৌশলী ও সুবুদ্ধি এবং রাজনীতিতে পরম অভিজ্ঞ। উপরন্তু তরবারি ধারণ করতেন না দুর্বল অপটু হস্তে।

দৃপ্তকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘বিদেশি শত্রুদের হানায় সোনার বাংলা ছারখারে যেতে বসেছে—এ-দৃশ্য সহ্য করা অসম্ভব! ক্ষুদ্র গৌড়ের পঙ্গু সামন্ত রাজার তুচ্ছ মুকুট পরে আর আমি তুষ্ট ও নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকব না, আমি হব অদ্বিতীয়, আমি হব স্বাধীন—স্বদেশে স্থাপন করব স্বরাজ্য!’

শশাঙ্কের মুখে প্রেরণাবাণী শুনে জাগ্রত হল সমগ্র গৌড়-বঙ্গদেশ, উদ্বোধিত হল বাঙালিজাতির আত্মা, কোশমুক্ত হল হাজার হাজার শাণিত তরবাল!

তারপরেই দেখি অতীত ও বর্তমানের মাঝখানে নেমে এসেছে এক দুর্ভেদ্য, অন্ধ যবনিকা। সেই যবনিকা সরিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিকরাও এখনও পর্যন্ত বিশেষ কোনও দৃশ্য দেখতে পাননি—আমরা কিন্তু কান পেতে শুনতে পাই রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রের গগনভেদী রণকোলাহল, বঙ্গবীরদের সিংহগর্জন, পলাতক শত্রুদের আর্তনাদ!

তারপর যবনিকার ফাঁক দিয়ে কোনওক্রমে দৃষ্টি চালিয়ে ঐতিহাসিকরা সবিস্ময়ে দেখলেন কোনও কোনও উজ্জ্বল দৃশ্য!

উত্তর-পূর্ব ভারতের সিংহাসনে সগৌরবে অধিষ্ঠিত প্রবল পরাক্রান্ত স্বাধীন সম্রাট শশাঙ্কদেব। চারণকবিরা রচনা করছেন তাঁর নামে কুলকীর্তিগীতি এবং নিখিল বঙ্গের বাসিন্দারা দেশ ও জাতির মুক্তিদাতা বলে তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদন করছে সশ্রদ্ধ প্রণতি!

অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ ও মগধের ওপরে সগর্বে উড়ছে তখন প্রথম বাঙালি সম্রাট শশাঙ্কের বিজয়পতাকা।

‘এ নহে কাহিনি, এ নহে স্বপন’, এ-হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য।

কিন্তু শশাঙ্কের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এইখানেই হল না পরিতৃপ্ত। সমগ্র উত্তরাপথে তিনি চালনা করতে চাইলেন নিজের বিজয়ী বাহিনীকে।

কেবল যে নিজের সাম্রাজ্যের আয়তনবৃদ্ধির জন্যেই শশাঙ্কদেব এই নতুন অভিযানে নিযুক্ত হয়েছিলেন, এমন কথা মনে হয় না। তিনি কেবল যোদ্ধা নন, রাজনীতিবিদও ছিলেন। উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব দিক—তাঁর সাম্রাজ্যের দুই দিকেই ছিল পরম শত্রু—তাঁকে আক্রমণ করবার জন্যে তারা ছিল সর্বদাই প্রস্তুত।

নিষ্কণ্টক হওয়ার জন্যেই শশাঙ্কের এই নতুন যুদ্ধযাত্রা। আধুনিক যুদ্ধনীতি ও রাজনীতিতেও বলে, শত্রুর স্বরাজ্যে গিয়েই শত্রুকে আক্রমণ করা উচিত। শশাঙ্কদেবও সেই নীতি অবলম্বন করতে চাইলেন।

এইখানে আরও কোনও কোনও পাত্র-পাত্রীর একটু একটু পরিচয় দিলে পরের ঘটনাগুলো বোঝবার সুবিধা হবে।

উত্তর-পশ্চিম ভারতে (আধুনিক পাঞ্জাব প্রদেশে) ছিল শক্তিশালী স্থানেশ্বর রাজ্য—তার রাজা ছিলেন প্রভাকরবর্ধন, তাঁর বড় ছেলের নাম রাজ্যবর্ধন এবং তাঁর ছোট ছেলে ও ছোট মেয়ের নাম যথাক্রমে হর্ষবর্ধন ও রাজ্যশ্রী। কনৌজের রাজা গ্রহবর্মনের সঙ্গে রাজ্যশ্রীর বিবাহ হয়েছিল।

কনৌজের গ্রহবর্মন ছিলেন মৌখরী বংশের রাজা। ওই বংশের রাজারা বরাবর মগধ ও গৌড়ের সঙ্গে শত্রুতা করে এসেছেন। তাঁরা বারবার চেয়েছেন মগধ ও গৌড় অধিকার করতে। অতএব এই চিরশত্রুদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া, শশাঙ্কদেব একটি প্রধান কর্তব্য বলেই গণ্য করলেন। শত্রুকে আগে আক্রমণ করবার সুযোগ না দিয়ে তিনিই আগে আক্রমণ করতে চাইলেন শত্রুকে। এ হচ্ছে রণনীতি।

সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকে ছিল কামরূপ (আধুনিক আসাম প্রদেশ) রাজ্য। তার রাজার নাম ভাস্করবর্মন। ঐতিহাসিকরা বলেন, খুব সম্ভব শশাঙ্ক সম্মুখযুদ্ধে তাঁকে হারিয়ে দিয়েছিলেন বলে তিনিও মনে-মনে শত্রুতা পোষণ করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে সুযোগ খুঁজছিলেন।

এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে শশাঙ্কদেব সসৈন্য বেরিয়ে পড়লেন। তাঁকে যে যুদ্ধ করতে-করতে অগ্রসর হতে হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সে-সব যুদ্ধের কোনও বর্ণনা আর পাওয়া যায় না।

তাঁর বিজয়যাত্রা বিস্তৃত হয়ে পড়ল কাশীধাম পর্যন্ত। মুর্শিদাবাদ থেকে বারাণসী, দূরত্বও যথেষ্ট এবং এতখানি জায়গা দখল করাও যা-তা শক্তির পরিচায়ক নয়। তারপর এই পর্যন্ত এসে তিনি নিজের ভূয়োদর্শনের আর-একটা মস্ত প্রমাণ দিলেন।

তিনি বুঝলেন, মৌখরী রাজা গ্রহবর্মন হচ্ছেন স্থানেশ্বররাজ প্রভাকরবর্ধনের জামাই। সুতরাং তাঁকে আক্রমণ করলে তাঁর সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসবে স্থানেশ্বরের সৈন্যগণও। নিজের রাজ্য ছেড়ে অত দূরে গিয়ে একসঙ্গে দুই রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

মধ্যভারতে ছিল মালব প্রদেশ, সেখানকার রাজার নাম দেবগুপ্ত, তিনি গুপ্তবংশীয়। গুপ্তসাম্রাজ্যের অস্তিত্ব লোপ পাওয়ার পরেও ভারতের এখানে-ওখানে সেই বংশের কোনও-কোনও প্রাদেশিক নৃপতি রাজত্ব করতেন। দেবগুপ্তও সেইরকম একজন রাজা এবং মৌখরীরা ছিল গুপ্তদেরও চিরশত্রু।

দেবগুপ্তকে শশাঙ্ক মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্যে আহ্বান করলেন এবং দেবগুপ্তও সাগ্রহে দিলেন সেই আহ্বানে সাড়া।

তারপর খবর এল স্থানেশ্বররাজ প্রভাকরবর্ধন পরলোকে গমন করেছেন। এত বড় সুযোগ ছাড়া উচিত নয় বুঝে দেবগুপ্তের কাছে দূতমুখে শশাঙ্ক বলে পাঠালেন : ‘আপনি মৌখরীরাজ গ্রহবর্মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করুন। আপনাকে সাহায্য করবার জন্যে আমিও সদলবলে যাত্রা করছি।’

দেবগুপ্ত অবিলম্বে মৌখরীদের রাজ্য আক্রমণ করলেন।

তারপর উপরি-উপরি ঘটল ঘটনার-পর-ঘটনা।

মালবরাজের সঙ্গে যুদ্ধ হল মৌখরীরাজের এবং যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত হলেন গ্রহবর্মণ। দেবগুপ্ত মৌখরীরাজের সহধর্মিণী ও স্থানেশ্বরের রাজকন্যা রাজ্যশ্রীকে বন্দিনী করে শত্রুদের রাজধানী কনৌজ অধিকার করলেন।

যুবরাজ রাজ্যবর্ধন তখন রাজা হয়ে স্থানেশ্বরের সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। নিজের ভগ্নীপতির মৃত্যু ও সহোদরার বন্দিদশার কথা শুনে তিনি একটুও সময় নষ্ট করলেন না। দেবগুপ্তের সঙ্গে শশাঙ্ক যোগ দেওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য সংগ্রহ করে ঝড়ের মতো কনৌজের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সে প্রবল আক্রমণ সহ্য করতে পারলেন না দেবগুপ্ত।

স্থানেশ্বরের তরুণ রাজা যে এত শীঘ্র যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে পারবেন, শশাঙ্ক নিশ্চয়ই সেটা আন্দাজ করেননি। তিনি যখন সসৈন্যে ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হলেন, দেবগুপ্ত তখন পরাজিত ও নিহত।

সদ্য-সদ্য যুদ্ধজয়ী হয়ে তখন রাজ্যবর্ধনের সাহস গিয়েছে বেড়ে। প্রাজ্ঞতার পরিবর্তে তিনি দেখালেন অজ্ঞতা। আরও সৈন্যবলের জন্য অপেক্ষা না করেই তিনি শশাঙ্কের মতো অভিজ্ঞ যোদ্ধাকে আক্রমণ করতে ইতস্তত করলেন না, ফলে তিনিও যুদ্ধে হেরে বন্দি ও নিহত হলেন।

স্থানেশ্বরের রাজকন্যা ও কনৌজের রানি রাজ্যশ্রী এই গোলযোগের সময়ে কেমন করে কারামুক্ত হলেন তা জানা যায় না। তিনি পালিয়ে গেলেন বিন্ধ্যারণ্যের দিকে। শশাঙ্কের উদ্দেশ্য সিদ্ধ—চূর্ণ হল চিরশত্রু মৌখরীদের দর্প! সুদূর গৌড় থেকে বেরিয়ে তিনি আর্যাবর্তের প্রায় প্রান্তদেশে এসে রোপণ করেছেন নিজের গৌরবনিশান!

ওদিক থেকে সংবাদ এল, স্থানেশ্বরের রাজপুত্র বা নতুন রাজা হর্ষবর্ধন বিপুল এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে আসছেন।

এদিকে আবার কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণও শশাঙ্কদেবের অবর্তমানে সাহস পেয়ে হর্ষবর্ধনের পক্ষে যোগ দিয়ে সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে উপদ্রব আরম্ভ করেছেন।

দুই দিকে প্রবল শত্রু দেখে বিচক্ষণ নায়কের মতো শশাঙ্ক আবার স্বদেশের দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন। কিন্তু তার আগে নিহত ও পরাজিত মৌখরীরাজের ছোটভাই অবন্তীবর্মণকে কনৌজের সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে গেলেন—নিশ্চয়ই নিজের সামন্তরাজা রূপে।

হর্ষবর্ধন প্রথমে বিন্ধ্যারণ্যে যাত্রা করলেন। কারণ তিনি খবর পেয়েছিলেন, তাঁর সহোদরা রাজ্যশ্রী নাকি সেখানকার আদিবাসীদের আশ্রয়ে বাস করছেন। তিনি যথাস্থানে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, ভবিষ্যতের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে রাজ্যশ্রী জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করে জীবন দেওয়ার উদ্যোগ করছেন। ভগ্নীকে উদ্ধার করে তিনি ধাবিত হলেন শশাঙ্কের সন্ধানে। এসব হচ্ছে সপ্তম শতাব্দীর প্রথম পাদের ঘটনা।

তার পরের ঘটনা স্পষ্ট করে জানা যায় না। শশাঙ্কের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের কোথাও সম্মুখযুদ্ধ হয়ে থাকলেও তার কোনও সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে এটা ঠিক, শশাঙ্কের গতি কেউ রোধ করতে পারেনি, তিনি নিজের রাজ্যে ফিরে গিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, শশাঙ্কদেব পলায়ন করেননি, সুব্যবস্থিতভাবে সমগ্র ফৌজ নিয়ে পশ্চাদবর্তী হয়েছিলেন। এই বিংশ শতাব্দীতেও বৃহত্তর বাহিনীর সম্মুখীন হলে বড়-বড় সেনাপতিরা ঠিক ওই পদ্ধতিই অবলম্বন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে রুশিয়ানরা প্রথমে হটে গিয়েছিল বলেই পরে জার্মানদের একেবারে হারিয়ে দিতে পেরেছিল। শশাঙ্কদেবেরও এই চাতুর্যপূর্ণ যুদ্ধকৌশল ব্যর্থ হয়নি, কারণ পরে তাঁর রাজ্যে গিয়ে হর্ষবর্ধন হয়তো অল্পবিস্তর উৎপাত করেছিলেন, কিন্তু মগধ ও বঙ্গদেশ জয় বা শশাঙ্ককে বন্দি না করেই সে যাত্রা তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছিল স্বদেশে।

নিজের সাম্রাজ্যে স্বাধীন সম্রাট শশাঙ্কদেব স্বয়ংপ্রভু হয়েই সগৌরবে বিরাজ করতে লাগলেন।

হর্ষবর্ধন যখন ‘মহারাজাধিরাজ শ্রীহর্ষ’ বলে নিজের নামসই করতেন, তখনও শশাঙ্কদেব মাথা নত করে তাঁর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেননি। শ্রীহর্ষের সঙ্গে সংঘর্ষের পরে বহু বৎসর পর্যন্ত তিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপে নিজের রাজ্যচালনা করে গিয়েছেন। একদিকে হর্ষবর্ধন এবং আর-একদিকে কামরূপরাজ ভাস্করবর্মন, দুই দিকে দুই পরাক্রান্ত শত্রু, কিন্তু কেহই মগধ ও বাংলাদেশের সূচ্যগ্রপরিমিত ভূমি অধিকার বা শশাঙ্কের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করতে পারেননি। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, তাঁদের কারুরই শশাঙ্কদেবকে দমন করবার শক্তি ছিল না।

হর্ষবর্ধন কবি বাণভট্টের পালক ও অন্নদাতা ছিলেন। তাঁর প্রতিপালকের শত্রু বলে বাণভট্টও শশাঙ্কদেবকে বাছাবাছা গালাগালি দিয়েছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও করেছেন। একটি অভিযোগ এই : শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনের হত্যাকারী।

পৃথিবীর সব দেশেই সেকালকার রাজনীতিতে বিধি ছিল, পরাজিত শত্রুকে মৃত্যুমুখে নিক্ষেপ করা। অধিকাংশ স্থলেই সেই নীতি পালিত হত এবং আজও হয়। গত দ্বিতীয় মহাসমরে জয়ী হয়ে মিত্রপক্ষ বিচারের নামে জার্মানির বন্দি রণনায়কদের নিয়ে কী নরমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন, সেকথা সর্বজনবিদিত। শশাঙ্কদেব রাজনীতিই পালন করেছিলেন এবং রাজনীতি চিরদিনই নিষ্করুণ।

হর্ষবর্ধন হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেননি, কিন্তু তিনি ছিলেন বৌদ্ধদের পৃষ্ঠপোষক এবং এইজন্যে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী চৈনিক ভ্রমণকারী হিউয়েন সাং সর্বত্রই তাঁর গুণগান ও তাঁর শত্রুদের দোষকীর্তন করে গিয়েছেন। তিনি বলেন, শৈব শশাঙ্ক ছিলেন বৌদ্ধদের প্রতি অত্যাচারী ও বৌদ্ধ-কীর্তি ধ্বংসকারী। কিন্তু ঐতিহাসিকরা বলেন, এর কারণ শশাঙ্কের ধর্মদ্বেষিতা নয়, মগধে ও গৌড়ে যেসব বৌদ্ধ বাস করতেন, তাঁরা দেশের মহাশত্রু হর্ষবর্ধনের অনুগত ছিলেন বলেই শশাঙ্কের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

বাণভট্ট ও হিউয়েন সাং-এর অভিযোগ অমূলক বা অতিরঞ্জিত বলেই গ্রহণ করা হয়।

সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত যে সম্রাট শশাঙ্কের অপূর্ব প্রতিভায় ও প্রবল প্রতাপে গৌরবোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, এ-বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহের কারণ নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখনও তাঁর সম্বন্ধে আরও বেশি কিছু আবিষ্কৃত হয়নি।

তাঁর মৃত্যুর তারিখও সঠিকভাবে বলা চলে না। তবে তিনি যে ৬১৯ খ্রিস্টাব্দের পরেও জীবিত ছিলেন, একথা নিশ্চিতভাবে জানা গিয়েছে। খুব সম্ভব ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন।

শশাঙ্কের বলিষ্ঠ মুষ্টি থেকে রাজদণ্ড খসে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই সাম্রাজ্যের মধ্যে হল বহিঃশত্রুর আবির্ভাব। পূর্বদিক থেকে হানা দিলেন কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণ এবং উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হানা দিয়ে আর্যাবর্তের সম্রাট হর্ষবর্ধন সমগ্র মগধ ও বঙ্গদেশ দখল করে বসলেন। শশাঙ্কদেব বর্তমান থাকতে এমন সাহস বা ক্ষমতা তাঁদের কারুরই হয়নি। শশাঙ্কের শক্তি ও বীরত্বের এ-ও একটা শ্রেষ্ঠ প্রমাণ।

তখনকার মতো বাঙালির গৌরব বিলুপ্ত হল বটে, কিন্তু অষ্টম শতাব্দীতে পুনর্বার বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল নবজাগ্রত বাঙালির অমিত বাহুবল—তবে সে হচ্ছে ভিন্ন কাহিনি।

সম্রাট শশাঙ্কের এক পুত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁর নাম মানব। কিন্তু তিনি অযোগ্য পুত্র, পিতার মতো মহামানব হতে পারেননি, রাজ্যশাসন করতে পেরেছিলেন মাত্র আট মাস পাঁচ দিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *