প্রথম পাপ
শনিবারের বিকেল। সমরেশ একটা লম্বা দিবানিদ্রা দিয়ে উঠে মিটমিট করে তাকাচ্ছিল এবং আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকা যায় কিনা চিন্তা করছিল। দময়ন্তীকে ঘরের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে দেখে জড়িত কণ্ঠে বলল—’চা-টা কিছু লাগাও!’
দময়ন্তী বলল, ‘লাগাচ্ছি। আগে উঠে হাত-মুখ ধোও তো! তারপর বারান্দায় এসো। দিব্যি ফুরফুর করে হা—ওয়া দিচ্ছে।’
হাত-মুখ ধুয়ে সমরেশ অর্ধনিমিলিত চোখে বারান্দায় এসে ধপ করে একটা মোড়ার ওপর বসে পড়ল। আগের মতোই জড়িত গলায় বলল, ‘ইঃ! কী ঘুমেই ধরেছে! বলি, চা-টা বেশ কড়া করে করেছ তো? নইলে এ শালার ঘুম ছুটতে দেরি হবে।’
এমন সময় ওদের বারান্দার ঠিক নীচেই একটা বিশাল গাড়ি এসে ফুটপাথের পাশে দাঁড়াল। নিঃশব্দে, মরালগতিতে যেন হাওয়ায় ভেসে এল গাড়িটা।
দুজনে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল গাড়িটাকে। কিন্তু তারপরে গাড়ির ভেতর থেকে যিনি নামলেন, তাঁকে দেখে তো দুজনেরই চক্ষুস্থির— সমরেশের বিশেষ করে। অনবদ্যকান্তি, অপূর্বসুন্দরী এক মহিলা এমন লীলায়িত অথচ ঈষৎ গর্বিত ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন যে মনে হল যেন, একটি গীতি-কবিতা চোখের ওপর দিয়ে ভেসে চলে গেল। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সমরেশ। বলল, ‘বোধ হয় একতলায় বাড়িওলার কাছে এল, তাই না?’
দময়ন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘তাই হবে বোধ হয়। কিন্তু তোমার কী হল? শালার ঘুম ছুটে গেল মনে হচ্ছে যেন?’
‘আরে, না, না’, সমরেশ লজ্জিত গলায় বলল, ‘কী যে বলো, তার ঠিক নেই। আমি কি আর ওই ভদ্রমহিলাকে দেখছিলুম নাকি? আমি তো গাড়িটা দেখছিলুম। আচ্ছা, কনভার্টিবল ক্রাইসলার— দেখলেই মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়।’
চায়ের কাপের ওপর দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে সমরেশের দিকে তাকিয়ে দময়ন্তী বলল, ‘তোমরা, পুরুষেরা ভয়ানক মিথ্যেবাদী!’
‘দ্যাখো, জাত তুলে কথা কইবে না বলে দিচ্ছি!’ সমরেশ কটমট করে তাকাল, ‘মনে রেখো, জগতে যে দুজন সত্যবাদী বলে বিখ্যাত, তাঁরা দুজনেই পুরুষজাতীয়।’
‘কে সেই দুজন শুনি?’
‘একজন ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির আর অন্যজন শ্রীসমরেশ দত্তগুপ্ত। সন অব…’
ভয়ানক চ্যাঁচামেচি করে দময়ন্তী প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ক্রিং ক্রিং করে দরজার ঘণ্টি বেজে উঠল।
দুজনেই চোখ কপালে তুলে তাকাল দুজনের দিকে।
‘হাঁ করে দেখছ কী? যাও, দরজাটা খোলো গিয়ে!’ চাপা গলায় দময়ন্তী ধমকে উঠল। তারপর চায়ের কাপ-টাপগুলো ট্রের ওপর সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
‘আপনিই বোধ হয় মিস্টার সমরেশ দত্তগুপ্ত?’ দরজা খুলে দিতে প্রশ্ন এল।
সমরেশের মনে হল যেন পাঁচটা কোকিল একসঙ্গে ডেকে উঠল।
ঢোক গিলে বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিই সমরেশ দত্তগুপ্ত।’
‘ভেতরে আসতে পারি কি? বড়ো বিপদে পড়ে আপনাদের কাছে এসেছি।’
ব্যস্ত হয়ে সমরেশ দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। বলল, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, ভেতরে আসুন, বসুন ওই সোফাটায়।’
অপাঙ্গে ভদ্রমহিলাকে দেখল সমরেশ। বয়স খুব কমিয়ে-সমিয়ে ধরলেও তিরিশ। তবে প্রগাঢ় যৌবনা, ‘যুবতীবিষয়ে সৃষ্টিরাদ্যেব ধাতু’ বলা চলে। লম্বা প্রায় পাঁচ ফুট পৌনে চার ইঞ্চি। পরনে গাঢ় নীল রঙের একটা সিল্কের শাড়ি এবং সেই কাপড়েরই একটা স্লিভলেস ব্লাউজ। মাঝখানে যে প্রায় সাড়ে আট ইঞ্চির মতন শরীরের অংশটুকু দৃশ্যমান তার মিনিমাম পরিধি বাইশ ইঞ্চির বেশি হতেই পারে না। আর তার ওপরে-নীচে অদৃশ্য অংশদ্বয়ের পরিধি চৌত্রিশের কম হলে যেন সমরেশের নাম পালটে রাখা হয়।
কিন্তু এই পর্যবেক্ষণ সমরেশকে অর্ধপথেই বন্ধ করতে হল। কারণ পাঁচটা কোকিল আবার একসঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘আপনার স্ত্রী কি বাড়িতে আছেন?’
চমকে উঠে সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছেন বই কী! উনি আসছেন এক্ষুনি।’
‘দেখুন, আপনার বন্ধু ডিটেকটিভ ইনস্পেকটর শিবেন সেন আমাদেরও পারিবারিক বন্ধু। উনিই আমাকে পরামর্শ দিলেন, আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে। এর আগে আপনার স্ত্রী নাকি দু-তিনটি কেসে রহস্যোৎঘাটনে ওঁকে সাহায্য করেছিলেন? এখন তো তাঁর ওপরে শিবেনের অগাধ বিশ্বাস। তাঁর মগজে নাকি একটি চমৎকার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী শক্তি আছে!’
সমরেশ একটা খুব বিনীত হাসি হাসল বটে, কিন্তু মনে মনে শিবেনের মুণ্ডপাত করল। আগে থেকে একটু বলে রাখতে হয়। কথা নেই, বার্তা নেই, দুম করে একজনকে পাঠিয়ে দিয়েই খালাস। তাও আবার এরকম সাংঘাতিক একজনকে।
ভদ্রমহিলা তখনও কথা বলেই চলেছেন, ‘আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারবেন। আমার নাম শুনে থাকতে পারেন। আমার নাম মালবিকা হালদার।’
মালবিকা হালদার! হাঁ করে তাকিয়ে রইল সমরেশ। কস্মিনকালেও এ হেন একটা নাম শুনেছে বলে মনে করতে পারল না। ঠিক তক্ষুনি দময়ন্তী ঘরে ঢুকে ওকে উদ্ধার করল। নমস্কার করে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘ওমা! আপনিই মিসেস মালবিকা হালদার? কী আশ্চর্য, আপনার নাম শুনেছি বই কী! কত ছবি দেখেছি আপনার ‘ফেমিনিকা’ পত্রিকায়। আপনিই তো গত বছর কলকাতার ‘সামার কুইন’ হয়েছিলেন, তাই না?’
লজ্জিতভাবে একটু ঘাড় কাত করলেন মহিলা। বললেন, ‘শিবেনের কাছে আপনাদের নাম শুনে ছুটে চলে এলুম। ভয়ানক বিপদ আমার মিসেস দত্তগুপ্ত, আমায় আপনি বাঁচান। আমার সম্মান, আমার সংসার, আমার ভবিষ্যৎ… এভরিথিং ইজ অ্যাট স্টেক। একজন মেয়ে হিসেবে আপনার কাছে মিনতি করছি, আমায় উদ্ধার করুন। কোনো পুরুষের কাছে সংকোচে যেতে পারিনি, কিন্তু আপনি তো আমার দুঃখটা সঠিক বুঝতে পারবেন, অন্তরে অনুভব করতে পারবেন।’ বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে এল মিসেস হালদারের। কোলের ওপর রাখা ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগটি খুলে তার ভেতর রুমালটা খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু রুমাল বেরোনোর আগেই তাঁর দু-চোখ ছাপিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল।
সমরেশ অত্যন্ত অপ্রস্তুত আর দময়ন্তী করুণ মুখ করে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে রইল। দময়ন্তীর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সমরেশ ফিসফিস করে বলল, ‘এসব কান্নাকাটির মধ্যে আমি আবার কেন? তুমি রহস্যের সমাধান করো, আমি ঝপ করে মেজদার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।’
সমরেশের হাত চেপে ধরে দময়ন্তী চাপা গলায় বলল, ‘না, কোথাও যাবে না তুমি। তুমি সঙ্গে না থাকলে আমি কনফিডেন্স পাই না যে! চুপ করে বসে থাকো তো!’
মিসেস হালদার বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর কান্নার বেগ একটু কমে এলে দময়ন্তী মৃদুকণ্ঠে বলল, ‘কী বিপদ আপনার বলুন। যদি আমার সাধ্যের মধ্যে হয়, নিশ্চয়ই সাহায্য করব আমি।’
রুমালে চোখ মুছে সেটিকে যথাস্থানে রেখে কম্পিত কণ্ঠে মালবিকা বললেন, ‘আমাকে কেউ ব্ল্যাকমেল করছে, মিসেস দত্তগুপ্ত। মাসে মাসে দশ হাজার টাকা করে দিয়ে যাচ্ছি আমি। অবশ্য টাকাটা বড়ো প্রশ্ন নয়, টাকা আমার অনেক আছে। কিন্তু এই লুকোচুরি যে-কোনো দিন ধরা পড়ে যেতে পারে। আর সেদিন আমার সর্বনাশ! এই মুখ আর কোথাও দেখাতে পারব না। সেদিন সেই লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে আমাকে হয়তো আত্মহত্যাই করতে হবে। ভেবে দেখেছি, এ ছাড়া আর অন্যপথ আমার থাকবে না।’
দময়ন্তী বলল, ‘আপনি এখনই এ নিয়ে এত ভাবছেন কেন? তেমন সময় তো আসেনি। তবে কে আপনাকে ব্ল্যাকমেল করছে বলুন, দেখি, তাকে আটকানোর কোনো পথ বের করতে পারি কিনা?’
মাথা নীচু করে মালবিকা বললেন, ‘সেইটেই তো এখনও পর্যন্ত বের করতে পারলুম না। টাইপ করা চিঠিতে টাকার ডিমান্ড আসে। কে পাঠায়, কোথা থেকে পাঠায়, কিছুই জানি না।’
দময়ন্তী আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সে কী? লোকটার নামধাম জানেন না, অথচ মাসে মাসে টাকা গুনছেন? টাকাটা দেন কী করে?’
‘কলকাতায় একটা কফির দোকান আছে, সেখানে খাবার দাবারও বিক্রি হয়। একটা টিফিন ক্যারিয়ারে টাকাটা রেখে, আমি সেটা সেখানে কাউন্টারের ওপর রেখে আসি। তারপর কে কীভাবে নিয়ে যায়, আমি বলতে পারব না। কারণ আরও অনেকগুলো টিফিন ক্যারিয়ার থাকে সেখানে। আমারটা মিশে যায় সেগুলোর সঙ্গে।’
‘কী নাম সেই কফির দোকানটার?’
‘আমায় মাফ করবেন, আমি বলতে পারব না। শিবেনও পীড়াপীড়ি করেছিল। আমি বলিনি। কারণ, চিঠিতে লেখা থাকে যে, যদি কখনো কোনোভাবে কারোর কাছে রেস্টুরেন্টটার নাম করি, তাহলে…’
‘বুঝেছি।’ দময়ন্তী বলল, ‘থাক, তাহলে। কিন্তু যে ব্যাপারে আপনাকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে, সেটা জেনুইন তো?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালবিকা বললেন, ‘হ্যাঁ, জেনুইন।’ ওঁর মাথাটা ঝুঁকে পড়ল বুকের ওপর।
‘সেটা কী, তা জানতে পারি কি?’
‘ক্ষমা করুন আমায়। সেটাও আমি বলতে পারব না। আমায় সে অনুরোধ করবেন না।’ ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর আবার বুজে আসবার উপক্রম হল।
‘কী আশ্চর্য!’ দময়ন্তী হতাশ গলায় বলল, ‘আপনি চান, আমি আপনাকে এই বিপদে সাহায্য করি, অথচ খোলসা করে কিছুই বলছেন না। এ অবস্থায় আমি কী করতে পারি, বলুন তো দেখি?’
কোনো জবাব না দিয়ে অপরাধীর মতো মুখ করে বসে রইলেন মালবিকা। দময়ন্তী কিছুক্ষণ বিরাগপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে ওর মুখের রেখাগুলো ক্রমশ কোমল হয়ে এল। শান্ত গলায় বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি বরং আপনার জীবনের গল্প আমাদের শোনান। কী করেন আপনার স্বামী? ছেলেপুলে ক-টি?’
কৃতজ্ঞ চোখ তুলে দময়ন্তীর দিকে তাকালেন মালবিকা। বললেন, ‘আমার স্বামী ডক্টর বি.কে. হালদার, কতগুলো বড়ো বড়ো কোম্পানির ডিরেক্টর। তাঁর নাম হয়তো শুনেছেন। সাধারণভাবে তিনি কেমিক্যাল আর রঙের ব্যবসা করেন।’
সমরেশ বলল, ‘আরে! স্পেকট্রাম পেন্টস-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডক্টর বি.কে. হালদার আপনার স্বামী? ওঁকে তো খুব ভালো করে চিনি। ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি তখন ছিলুম ইলেকট্রিকাল সেকশনের সেক্রেটারি।’
মালবিকা বললেন, ‘হ্যাঁ, নানারকম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উনি জড়িত। সবগুলোর নামও আমি জানি না ছাই। যাক, আপনি যখন ওঁকে চেনেন, তখন তো ভালোই হল। আমাদের পরিচয়টা ভবিষ্যতে আরও ঘনিষ্ঠ করে নেওয়া যাবে।’
সমরেশ হেঁ হেঁ করে বিনীত হাসি হাসল।
দময়ন্তী বলল, ‘নিশ্চয়ই নেওয়া যাবে। কিন্তু আপাতত আপনার গল্পটা চলুক।’
‘হ্যাঁ, ওই যে বলি’, মালবিকা বললেন, ‘কিন্তু কোত্থেকে যে শুরু করব, জানি না। আচ্ছা, বরং ছেলেবেলা থেকেই শুরু করি, কি বলেন?’
.
‘আমার বাবা ছিলেন তালতলার বিখ্যাত মিত্র বংশের সন্তান। তালতলাতেই আমাদের সাবেক বাড়িতে আমার জন্ম হয়। আমরা দুই বোন। আমিই ছোটো। আমার দিদির নাম ছিল শ্রীলেখা, ও আমার চেয়ে চার বছরের বড়ো ছিল।
‘শুনেছি, আগে নাকি আমাদের অনেক টাকা-পয়সা ছিল। কিন্তু বাবা যখন সংসারের ভার নিলেন, তখন একমাত্র ওই প্রকাণ্ড বাড়িটা ছাড়া তাঁর বোধ হয় অন্য কোনো সম্বল ছিল না। কাজেই তাঁকে চাকরি নিতে হল। একদিন আমাদের হাত ধরে কলকাতা ত্যাগ করলেন বাবা। পুনার কাছে পুরন্দরপুর বলে একটা ছোটো শহরের মিউনিসিপ্যাল কলেজে ইংরেজির অধ্যাপনার চাকরি পেয়েছিলেন। সেখানেই নতুন করে সংসার পাতলেন।
‘কী আশ্চর্য সুখে আর অপূর্ব আনন্দেই না আমাদের ছেলেবেলা কেটে ছিল সেখানে! আমি যখন যাই তখন প্রায় ছ-বছরের শিশু ছিলুম, আর যখন ফিরি তখন আমার বয়স ষোলো। এই দশটা বছর যেন একটা দীর্ঘ স্বপ্নের মতো মনে পড়ে।
‘একটা ছোটো বাংলো ধরনের বাড়িতে থাকতুম, তার মাথায় টালির ছাদ আর চারদিকে বড়ো বড়ো গাছ। আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন বাবার হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট মিঃ প্যাট্রিক অ্যাডামস। বুড়ো ইংরেজ, ছেলেপুলে ছিল না, স্ত্রীও মারা গিয়েছিলেন। আমরা ওঁকে ডাকতুম ওল্ড প্যাট বলে, আর কী অত্যাচারই না করতুম! দিদিটা অবশ্য শান্ত, নরম মতন ছিল। আমি ছিলাম দুর্দান্ত। বুড়ো কিন্তু আমাদের সব দুষ্টুমি হাসি মুখে সহ্য করতেন, বোধ হয় কিছুটা প্রশ্রয়ও দিতেন। যখন মারা যান, তখন এমন প্রচণ্ড দুঃখ হয়েছিল যে, আমরা দু-বোন প্রায় দু-দিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে খালি কেঁদেছিলুম।
‘বাবা অবশ্য কাঁদেননি, কিন্তু অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছিলেন। বুড়ো মারা যাওয়ার মাস ছয়েক পরে কলকাতায় একটা প্রাইভেট কলেজে চাকরি পেলে বাবা আবার আমাদের নিয়ে ফিরে আসেন তালতলায়।
খুব খারাপ লেগেছিল কলকাতায় ফিরে এসে। অবাধ মুক্তির থেকে একেবারে জেলখানায়। বিশ্রী লাগত আমাদের বাড়িটা— একটা প্রকাণ্ড প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মনে হত। বিশাল বিশাল একগাদা ঘর, তাদের বেশিরভাগই তালাবন্ধ। বারান্দার একপ্রান্ত থেকে চিৎকার করলে, অন্য প্রান্ত থেকে শোনা যায় না। বাড়িটা কেমন যেন সবসময় নির্জন।
‘দিদির অবশ্য আরও খারাপ লেগেছিল। কারণ আমি তখন প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেব বলে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতুম, ও বেচারি একা একা ঘুরে বেড়াত। ওর তো পড়াশোনা ছিল না। পুরন্দরপুর কলেজ থেকেই বিএ পাশ করে নিয়েছিল।
‘যাই হোক, কলকাতায় ফেরার বছর খানেকের মধ্যেই দিদির বিয়ে হয়ে গেল। দিদির শ্বশুরবাড়িও খুব বিখ্যাত পরিবার। শ্যামবাজারের শ্রীকণ্ঠ ঘোষেদের প্রায় দু-শো বছর কলকাতায় বসবাস। কুলীন এবং পয়সাওলা লোক ওঁরা। সেই শ্রীকণ্ঠ ঘোষের নাতি ছিলেন আমার ভগ্নীপতি।
‘দিদির বিয়েতে ভয়ানক কান্নাকাটি করেছিলুম আমি। ভয় হয়েছিল, দিদি আমায় একটা প্রকাণ্ড নির্জনতার মধ্যে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। নির্জনতা সহ্য করতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বেশিদিন নয়। কারণ, কিছুদিন পরেই বাবার সনির্বন্ধ অনুরোধে আমার ভগ্নীপতি দিদিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেই এসে বসবাস করতে লাগলেন এবং সেখান থেকেই তাঁর পগেয়াপটির ব্যবসা চালাতে লাগলেন।
‘এই সময় আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলুম এবং ভয়ানকভাবে ফেল করলুম। তখনই আবার দিদির ছেলেপুলে হবার সম্ভাবনা দেখা দিল। তখন বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে বোম্বে রওনা হলেন। আমার ভগ্নীপতি অবশ্য তালতলাতেই থেকে গেলেন।’
সমরেশ এখানে বাধা না দিয়ে আর পারল না। বলল, ‘আবার বোম্বে? কেন, বোম্বে কেন?’
‘কারণ বাবার মনে তখনও বম্বে-পুনা অঞ্চলের স্মৃতিই অনেক বেশি উজ্জ্বল। কলকাতায় যা আমরা পাই না, ওখানে তাই পেয়েছিলুম— মানুষের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা। বম্বের ডা: ই.কে. ভারুচা ছিলেন মস্ত বড়ো ডাক্তার, আর বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু। বাবা কলকাতায় প্রায় কাউকেই চিনতেন না, তাই ডাঃ ভারুচার কাছে যাওয়াই তাঁর বিবেচনায় উপযুক্ত বলে মনে হয়েছিল। ডাঃ ভারুচার নার্সিংহোমেই বাবার নাতির জন্ম হয়। ওর জন্মের পরেই দিদি ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন সেই ডাক্তারই যে কী অমানুষিক পরিশ্রম করে দিবারাত্রি দিদির পাশে বসে থেকে দিদিকে ভালো করে তোলেন, তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। কলকাতার কোনো ডাক্তারের কাছ থেকে সেরকম সেবা আশা করাই অন্যায়।
‘যাই হোক, প্রায় আট কী ন-মাস বাদে দিদিকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে আমরা আবার কলকাতায় ফিরে এলুম। বাবা চাকরি, টিউশানি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আমি বসলুম পরীক্ষার পড়া নিয়ে।
‘তারও প্রায় তিন-চার মাস পরে একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটল আমাদের বাড়িতে। হঠাৎ আমার ভগ্নীপতি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন। আর তার পরদিন থেকে শোকে উন্মাদ হয়ে গেল আমার দিদি। আমার মা যে কী অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন সেসময়, সেকথা আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না। তিনি একহাতে পাগল মেয়ের সেবা করেছেন, অন্যহাতে সদ্যোজাত নাতিকে মানুষ করেছেন। একদিনও এক মুহূর্তের জন্য ভেঙে পড়েননি। পড়লে যে কী হত আমাদের সংসারের, আমি জানি না। তবে বাবা শোকে কেমন যেন জুবুথুবু হয়ে গিয়ছিলেন। তাঁর দরাজ প্রাণখোলা হাসি চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
‘এরপর আমার আর লেখাপড়া হল না। মনই বসাতে পারলুম না, কাজেই পড়াশোনা ত্যাগ করলুম। কী হবে খামোখা সময় আর টাকা-পয়সার বাজে খরচা করে?
‘কী অদ্ভুত জীবনটা কেটেছে তখন! দুঃখের বলবো না, যন্ত্রণারও বলবো না, কেমন একটা অসাড়… বোবা… অনুভূতিহীন জীবন। সেই বিশাল প্রাসাদের অন্ধকারে আমি, মা, আমার উন্মাদ দিদি আর তার ছেলেটা একটানা একঘেয়ে দিন কাটিয়ে গেছি। বাবার সব চুল অকালে পেকে গেল। সমস্ত আত্মীয় স্বজনকে ত্যাগ করলেন তিনি, তারাও তাঁকে ত্যাগ করল। ফলে কেউ আসত না আমাদের বাড়ি, আমরাও কারোর বাড়ি যেতুম না। আনন্দহীন, স্ফূর্তিহীন একটা দিনগত পাপক্ষয় করে যেতুম। সারাদিন সংসারের কাজ করতুম, আর ভগবানকে ডেকে জিজ্ঞেস করতুম, কার অপরাধে আমাদের এই অবস্থা? কোনোদিন উত্তর পাইনি।
‘বাবা সারাদিন ছাত্র পড়াতেন। আমাদের মূল বাড়ি থেকে কিছু দূরে আউটহাউসে তাঁর কোচিং ক্লাস ছিল। আমি মাঝে মাঝে জানলায় দাঁড়িয়ে সেই বাড়িতে লোকজনের আসা-যাওয়া দেখতুম। সেখানে যাওয়া অবশ্য আমার বারণ ছিল।
‘প্রায় সাত বছর আমাদের এইভাবেই কেটেছিল। ভেবেছিলুম, কোনোদিন পরিবর্তন আসবে না, আসা সম্ভবও নয়। কিন্তু একদিন সেই পরিবর্তন এল!
‘বাবার কাছে একটি মেয়ে পড়তে আসত, তার নাম তন্দ্রা হালদার। তার দাদা বিভাসকুমার তাকে রোজ গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে যেত এবং নিয়ে যেতে আসত। আমি অবশ্য তাকে কোনোদিন লক্ষই করিনি, তার সঙ্গে পরিচয় হওয়া তো দূরস্থান। কিন্তু ও আমাকে কে জানে কখন কীভাবে দেখেছিল। বাবার কাছে তারপর ও বিয়ের প্রস্তাব করে।
‘বাবা প্রথমে সোজা না বলে দিয়েছিলেন। এবং লুকিয়ে প্রেম করছি সন্দেহ করে আমাকে খুব বকেছিলেন। কিন্তু মা বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করান। ওরা বংশমর্যাদায় যদিও আমাদের সমান ছিল না, কিন্তু লেখাপড়ায় ওদের বংশের নাম আছে, টাকা পয়সাও আছে, তা ছাড়া আদর করে নিতে চাইছে যখন, তখন মেয়েকে সুখেই রাখবে— এইসব বলে মা বাবার মন ভেজালেন।
‘তারপর আমাদের বিয়ে হয়ে যায়— সে আজ প্রায় বছর আষ্টেক আগেকার ঘটনা।’
সমরেশ এতক্ষণ দমবন্ধ করে শুনছিল। এখন দম ফেলে বলে ফেলল, ‘যাক বাঁচা গেল!’
খুব আস্তে করে বললেও, কথাটা কানে গেল মালবিকা হালদারের। বললেন, ‘না, এইখানেই শেষ নয়। বরং এবার শুরু বলতে পারেন।
‘বিয়ের পর আমার স্বামীর ব্যবসায় প্রচণ্ড উন্নতি হয়। এত টাকা রোজগার করেন যে, তা তাঁর পূর্বপুরুষের সঞ্চিত সম্পত্তির চেয়েও বেশি। আমাকে তো দেখেই বিয়ে করেছিলেন, তার ওপর এই উন্নতির জন্যও তাঁর মনে হল, আমিই এর কারণ। একরকম কুসংস্কার আর কী! কিন্তু তার ফলে উনি আমার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আমি যখন যা করতে চেয়েছি, বাধা দেননি। বরং উৎসাহ আর প্রশ্রয় দিয়েছেন।
‘কিন্তু আমার বাবা-মা আর সুখের মুখ দেখে যেতে পারেন নি। আমার বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যেই দিদি মারা যায়। বুড়ো বুড়ি নাতিকে নিয়ে ছিলেন বেশ, কিন্তু একদিন প্রবীর, মানে আমার দিদির ছেলেকে স্কুলে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ট্রাম থেকে পড়ে মা মারা যান। প্রবীরের বয়স তখন আট কী নয়। এত শোক বাবা আর সহ্য করতে পারলেন না। একদিন সন্ধ্যেবেলা প্রবীরকে তাঁর জামাই-এর হাতে দিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। যাবার আগে শুধু বলেছিলেন, আমি পুরন্দরপুর চললুম। প্রবীর রইল, তুমি বাবা ওকে একটু দেখো। আমরা খবর নিয়ে দেখেছি, পুরন্দরপুরে উনি যাননি।’
‘বলেন কী?’ সমরেশ আবার বলে উঠল, ‘তার মানে তিনি আজ কোথায়?’
‘জানি না। বেঁচে আছেন কিনা, তাই বা কে জানে। যাই হোক, তারপর থেকে প্রবীর আমাদের কাছেই মানুষ হতে থাকে। এদিকে, অনেক বছর হয়ে গেল, আমাদের কোনো ছেলেপুলে হল না। ডাক্তার বললেন, আমার কোনোদিন হবেও না। তখন আমার স্বামী একদিন প্রস্তাব করলেন যে, আমরা যদি প্রবীরকে দত্তক নিই, তাহলে বেশ ভালো হয়। আমিও অবশ্য এই প্রস্তাবে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলুম।’
সমরেশ এখানে আবার হাঁ করেও মুখটা চট করে বন্ধ করে ফেলল। মালবিকা বলে চললেন, ‘তখনই প্রথম সেই বিশ্রী চিঠিটা আসে। আজ থেকে প্রায় বছর খানেক আগে।’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘প্রবীরকে যে আপনারা দত্তক নিতে চান, একথা কি আপনার স্বামী কাউকে বলেছিলেন?’
মালবিকা বললেন, ‘বহু লোককেই বলেছিলেন। উকিল ডেকে পরামর্শ হয়েছিল। যাগযজ্ঞ যা হবার তার জোগাড়যন্ত্র করবার জন্য ভাইপোকে বলেছিলেন। সকলেই জানত। আমরা লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করিনি।’
দময়ন্তী বলল, ‘তা তো বটেই। কিন্তু তারপর আপনারা দত্তক নিলেন?’
‘না, আমিই কায়দা করে বাধা দিলুম। ওই চিঠি! ওই চিঠিই আমার ইচ্ছেটাকে নষ্ট করে দিয়ে গেল। আজ প্রায় এক বছর হয়ে গেল। আমি টাকা গুনে যাচ্ছি। যতক্ষণ না এই যন্ত্রণার হাত থেকে উদ্ধার পাচ্ছি, ততক্ষণ কী করে বেচারা প্রবীরকে এর মধ্যে টেনে আনি, বলুন? দত্তক নেওয়া পিছিয়ে দেওয়ায় উনি অবাক হয়েছেন, বিরক্তও হয়েছেন, কিন্তু পীড়াপীড়ি করেননি। বলেইছি তো, আমার কোনো কাজেই উনি বাধা দেন না। আমরা অপেক্ষা করে আছি— উনি আমার মত পালটানোর আর আমি এই চিঠির অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচবার কোনো উপায়ের।’
মালবিকার চোখ দুটি আবার জলে ভরে এল। সিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আর আমার বলবার কিছু নেই, মিসেস দত্তগুপ্ত, আমার জীবনের প্রায় সব কথাই আপনাকে বললুম। কী দুঃখকে একসময় আমাকে সহ্য করতে হয়েছে, আপনি হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না। আজ আবার সর্বনাশের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি। কী জানি, এর হাত থেকে আমার মুক্তি আছে কি না। যত টাকা লাগে আমি খরচ করতে রাজি আছি। কিন্তু আমি মুক্তি চাই, উদ্ধার পেতে চাই এই যন্ত্রণা থেকে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দময়ন্তী বলল, ‘উতলা হবেন না, মিসেস হালদার। টাকা-পয়সার কথাটা বড় নয়। কিন্তু সবকথা আপনি আমাকে বলেননি। বললে ভালো করতেন। তা ছাড়া বুঝতেই পারছি, বলতে পারবেনও না। যাই হোক, ক-টা প্রশ্ন করব আপনাকে। যদি সম্ভব হয়, উত্তর দেবেন কি?’
একটু সামলে নিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে মালবিকা বললেন, ‘হ্যাঁ দেব। কী প্রশ্ন, বলুন?’
‘প্রথমত’, দময়ন্তী একটু ভেবে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি কি জীবিত?’
‘শাশুড়ি নেই। শ্বশুর কাশীবাসী, আমার বিয়ের আগে থেকেই।’
‘আপনার স্বামীর ভাই-বোন কজন? তাদের ছেলেপুলে ক-টি?’
‘ওঁরা দু-ভাই, এক বোন। বিভাসের বড়ো এক দাদা ছিলেন, প্রভাস হালদার। মারা গেছেন। তাঁর একটিই ছেলে, নাম প্রকাশ। যাদবপুরে থার্ড ইয়ারে পড়ে। লেখাপড়ায় ভালো ছেলে। ওর কাকার মতো মস্ত বড়ো ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। আর বোন, মানে তন্দ্রা। বিয়ে থা করেনি, লেখাপড়া নিয়েই আছে। ও এখন ভুবনমোহিনী কলেজের লেকচারার।’
‘আপনার সঙ্গে এই ভাসুরপোর সম্পর্ক কেমন?’
একটু চুপ করে থেকে মালবিকা বললেন, ‘ভালো নয়। আমাকে সহ্য করতে পারে না। আড়ালে নাকি আমাকে ডাইনি বলে।’
‘আপনার প্রতি ওর রাগের কোনো কারণ কি আপনি অনুমান করতে পারেন? কাকার সম্পত্তির আপনি একজন ভাগীদার, তাই কি?’
‘তা হতে পারে। অসম্ভব নয়।’
‘আপনার বাবার বয়স এখন কত, যদি বেঁচে থাকেন?’
‘পঁয়ষট্টির কাছাকাছি হবে। সঠিক বলতে পারব না।’
‘আপনার ছেলেপুলে হবে না যে বললেন, সেটা জানতে পারলেন কী করে? কোনো ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?’
‘নিশ্চয়ই! আমরা দুজনেই দেখিয়েছিলুম।’
‘দুজনেই? বাঃ, আপনার স্বামী তো খুব বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন লোক। সাধারণত এরকম হয় না। কাকে দেখিয়েছিলেন?’
‘একজনকে দেখাইনি। আমি দেখিয়েছিলুম ডাঃ মৃণালিনী করের কাছে আর উনি ডাঃ কেশবনের কাছে।’
‘ডাঃ মৃণালিনী কর, মানে সুভাষচন্দ্র সেবাসদনের ভিজিটিং ডাক্তার? কী বললেন তিনি? বললেন যে আপনিই…’
‘হ্যাঁ’, মিসেস হালদারের গলাটা অত্যন্ত করুণ শোনাল, ‘আমি বন্ধ্যা।’
লজ্জিত ও দুঃখিত মুখে দময়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর আবার প্রশ্ন করল, ‘একজনকেই দেখাননি কেন?’
‘কোনো পুরুষ ডাক্তারের কাছে এ ব্যাপারে নিজেকে পরীক্ষা করাতে ভয়ানক লজ্জা করেছিল।’ বলতে বলতে কান দুটো লাল হল মালবিকার।
‘ডাক্তার কর তো হাজরায় বসেন জানি। ডাক্তার কেশবন কোথায় বসেন? উনি কি গাইনোকোলজিস্ট?’
‘নিশ্চয়ই। এম.বি.ডি.জি.ও। মাদ্রাজের লোক কিন্তু তিনপুরুষই কলকাতায়। প্রায় বাঙালিই হয়ে গেছেন। বসেন আমাদের পাড়াতেই, নিউ আমেদপুর, বি ব্লকে। আমার যখন ইউটেরাসের একটা গণ্ডগোল হয়, তখন উনিই চিকিৎসা করেছিলেন। আমার স্বামী ওঁকে নিয়ে আসেন। ভারি ভালো লোক। আমাকে খুব পছন্দ করেন।’
‘আপনার এই অসুখটা কতদিন আগে হয়েছিল?’
‘তা, বছর খানেকের ওপর হবে।’
‘ডাক্তার মৃণালিনী কর কি আগে আপনার কোনোদিন চিকিৎসা করেছেন?’
‘হ্যাঁ, করেছেন। আমরা তালতলায় থাকতে উনি আমাদের পারিবারিক ডাক্তার ছিলেন। তখন সদ্য পাশ করে বেরিয়েছেন। পরে বিলেতে গিয়ে এম.আর.সি.ও.জি হয়ে আসেন। তখন আমার বিয়ে টিয়ে হয়ে গেছে।’
‘আচ্ছা, আপনারা কি একই দিনে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন পরীক্ষা করাতে?’
‘না। একদিন হঠাৎ উনি এসে বললেন যে, তার দিন সাতেক বাদে আমাকে উনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন, এবং নিজেকেও দেখাবেন। আমি তো ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলুম। তার পরদিনই গেলুম মৃণালিনীদির কাছে। উনি আমাকে পরীক্ষা করে যে রিপোর্ট দিলেন, সেটা এনে ওঁকে দেখালুম। উনি প্রথমে আমাকে খুব সান্ত্বনা দিলেন। তারপর বললেন, ডাঃ কেশবনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট যখন করেই ফেলেছি, তখন যাই, আমিই একবার ঘুরে আসি। তোমার আর যাবার দরকার নেই। অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে উনি একাই গিয়েছিলেন, আমি সেদিন যাই-ই নি।’
‘ডাক্তার কেশবন কী বললেন?’
মাথা নীচু করে লজ্জিত কণ্ঠে মালবিকা বললেন, ‘কী আবার বলবেন? আমি জানি না।’
‘এবার শেষ প্রশ্ন। আপনার জামাইবাবু আত্মহত্যা করেছিলেন কেন? তার কারণ কি কিছু জানা গেছিল?’
‘হ্যাঁ। উনি কী-একটা কলিকের রুগি ছিলেন। যখন ব্যথা উঠত, দু-হাতে পেট চেপে ধরে সারা ঘরের মেঝেয় ছটফট করে গড়াতেন আর চিৎকার করতেন। ব্যথা চলে যাওয়ার দিন সাতেক পরেও অসম্ভব মনমরা আর খিটখিটে হয়ে থাকতেন, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিতেন, কেউ কাছে গেলে তাড়া করে যেতেন। আত্মহত্যা করার মাস পাঁচ-ছয় আগে থেকেই ওঁর অসুখটা ভয়ানক বেড়ে যায়। প্রায়ই বলতেন, আমি না মরলে এই যন্ত্রণার হাত থেকে উদ্ধার পাব না।’
‘তখন ওঁর চিকিৎসা করতেন কে?’
‘মৃণালিনীদি।’
হঠাৎ খুব ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন মিসেস হালদার। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই রে! ভয়ানক দেরি হয়ে গেল আমার। এখন আবার আকবর হোটেলে একটা পার্টি আছে। আমি এবার যাব, কেমন? কিছু মনে করবেন না যেন। কিন্তু আপনার সাহায্য আমি পাব তো, মিসেস দত্তগুপ্ত?’
দময়ন্তী শান্ত গলায় বলল, ‘দু-দিন পরে আসবেন মিসেস হালদার। আমি একটু ভেবে দেখি। কিন্তু এক্ষুনি উঠবেন কি? একটু বসুন। আমি চট করে কফিটা করে নিয়ে আসি। জল বোধ হয় অনেকক্ষণ ফুটে গেছে।’
.
দরজাটা বন্ধ করে দময়ন্তীর পাশে এসে বসল সমরেশ। দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘কী বুঝলে?’
হাত নেড়ে সুর করে সমরেশ বলল,
‘পাটনী কহিল আমি বুঝিনু সকল।
যেখান কুলীন জাতি সেখানে কোন্দল।।’
দময়ন্তী হেসে বলল, ‘যা বলেছ। দুনিয়ার সকলের পেডিগ্রি নিয়ে ভয়ানক চিন্তিত ভদ্রমহিলা। কে কুলীন, কার কত টাকা, কার কী ডিগ্রি, সব নখাগ্রে। কলকাতার আদি বাসিন্দাদের এটা বোধ হয় একটা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এসব বাদ দাও। আর কী বুঝলে?’
সমরেশ বলল, ‘আর বুঝলুম, এটা একটা অতি যাচ্ছেতাই কেস। ভদ্রমহিলা তাঁর জীবনকাহিনী যা শোনালেন, তার সবটাই অর্থহীন। আরে, আসল ব্যাপার হল, তিনি ব্ল্যাকমেলড হচ্ছেন। কে ব্ল্যাকমেল করছে? জানি না। কেন করছে? জানি, কিন্তু বলব না। কোথায় করছে? পুনরায় জানি, কিন্তু বলব না। কিন্তু আমায় বাঁচান! দূর, দূর! এখানে কেন বাপু? কোনো গনৎকারের কাছে যা-না, উপকার পাবি!’
দময়ন্তী বলল, ‘তোমার রাগ করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এমন কতগুলো কথা থাকে, যা কোনো মেয়ে অন্য কোনো মেয়েকেও বলতে পারে না লজ্জায়। আর যতই সাজগোজ করুন আর পার্টি এবং ফ্যাশন প্যারেডে যান না কেন, ভেতরে ভেতরে ইনি তো দেখলুম একটি একেবারে খাঁটি বাঙালি মেয়ে। একদিকে যেমন স্নেহে, সংশয়ে, ভালোবাসায় কোমল, অন্যদিকে প্রিয়জনকে অমঙ্গল থেকে বাঁচানোর জন্য সবরকম নীতিজ্ঞান বিসর্জনেও প্রস্তুত। তবে যে কথাটা চট করে ধরা যায় না, তা হচ্ছে, উনি যে গল্পটা বললেন তার মধ্যে অন্তত চারটে অসম্পূর্ণ সত্য বা পূর্ণ মিথ্যে কথা আছে। প্রায় বিশ্বাসযোগ্য করেই বলেছেন, কিন্তু ফাঁকাগুলো যে ধরা যায় না তা নয়। যদি এই ক-টা ফাঁক পূর্ণ করতে পারি, তবে হয়তো পুরো ব্যাপারটাই সমাধান করা যাবে।’
সমরেশ হতাশভাবে বলল, ‘কী জানি, এতগুলো ফাঁকফোকর যে তুমি কোত্থেকে দেখছ, তুমিই জানো। আমার সামনে তো বিরাট নিরেট অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। আর সেই অন্ধকার ভেদ করবার জন্য তুমি যে চিন্তা করবে, সেটা নেহাত সময় নষ্ট হবে। কারণ, ভদ্রমহিলা যদি তোমায় সব ইনফরমেশন না দিয়ে উলটে আবার কতগুলো মিথ্যে কথা বলে থাকেন, তাহলে লেট হার গো টু হেল। আমরা বরং চলো একটা নাইট শোতে সিনেমা দেখে আসি। চিত্তটা প্রফুল্ল হবে।’
দময়ন্তী হেসে ফেলল। বলল, ‘শান্ত হও। ভদ্রমহিলার সত্যিই ভয়ানক বিপদ। আমি যদি সম্ভব হলেও সাহায্য না করে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকি, তবে যে সেটা আমার অত্যন্ত অপরাধ হবে গো। কী জানো? ভদ্রমহিলার গল্পটা শুনে আমার আদ্যিকালের আদম আর ঈভের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ঈশ্বরের কথা না শুনে সর্পরূপী শয়তানের প্রলোভনে পড়ে যে পাপ ঈভ করেছিল, তার জন্য তারা দুজনে যে শুধু ইভেনের বাগান থেকে বিতাড়িত হয়েছিল তাই নয়, যুগযুগান্তর ধরে সেই পাপ আজও আমাদের কলুষিত করে রেখেছে। সেই পাপ আজও আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রলোভনের বিষ অন্তরে লুকিয়ে।’
দময়ন্তীর কথা মাঝপথে বন্ধ করে দিয়ে আবার দরজার বেল বেজে উঠল। সমরেশ দরজা খুলেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই যে সর্পপ্রবর! আয় আয়।’
শিবেন সেন ঘরে ঢুকে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘সর্পপ্রবর! তার মানে?’
সমরেশ বলল, ‘মানে কিছুই নেই। কিন্তু বলি বাপু হে! আমাদের স্বামী-স্ত্রীর এই ইডেন গার্ডেনে তুমি যে সব ডেঞ্জারাস টিম পাঠাচ্ছ, সেটা কি ঠিক হচ্ছে? আমি অবশ্য প্রলুব্ধ হব না বলেই প্রতিজ্ঞা করে বসে আছি।’
শিবেন আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ডেঞ্জারাস টিম? কী বলছিস কী তুই?’
দময়ন্তী বলল, ‘বুঝলেন না? ও মিসেস মালবিকা হালদারের কথা বলছে। বিকেলবেলা এসেছিলেন, একটু আগে গেলেন।’
জিভ কেটে চোখ কপালে তুলে শিবেন বলল, ‘কী সর্বনাশ! এসে গেছেন এর মধ্যেই? আমি তো তাঁর কথাই বলতে আসছিলুম।’
সমরেশ আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘যথারীতি পুলিশ! অপদার্থ, অকর্মণ্য, লেট লতিফ পুলিশ!’
শিবেন বলল, ‘তুই থামবি? বউদি আপনি বলুন তো, কিছু বললেন ভদ্রমহিলা? তাঁর তো ভয়ানক বিপদ।’
সমরেশ থামল না, বলল, ‘বললেন মানে? একঘণ্টা ধরে বললেন। তাঁর জীবনকাহিনি শোনালেন আমাদের। তার মধ্যে আবার একগাদা মিথ্যে কথা। আর এই ভদ্রমহিলাকে দেখ। আমি যখন একটা আধসিকি মিথ্যে কথা বলি, তক্ষুনি খুব মোটা গলায় অভিযোগ হয়, তোমরা পুরুষরা ভয়ানক মিথ্যেবাদী। আর একজন ভদ্রমহিলা একঘণ্টা ধরে এক ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে গেলেন, তার বেলায়, নাঃ, ওঁর যে ভীষণ বিপদ, আমাকে সাহায্য করতেই হবে। কেন রে বাপু? মেয়েছেলেদের এই স্বজাতিপ্রীতি খুব খারাপ লাগে আমার।’
দময়ন্তী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে উঠল। ছদ্মগাম্ভীর্যের সঙ্গে মাথা নেড়ে শিবেন বলল, ‘ঠিক, ঠিক, এ ব্যাপারে আমি তোর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আর বুঝলেন বউদি, আপনাদের উনি কী বলেছেন জানি না, আমাকে খালি বলেন, আমায় একজন ব্ল্যাকমেল করছে, আমাকে বাঁচাও। ব্যস, আর কিছু না। তা দেখলুম, একজন সুন্দরী মহিলা, বিপদে পড়েছেন, অথচ আমাকে সবকথা খুলে বলতে সংকোচও অনুভব করছেন। তখন দিলুম আপনার নাম করে। তা ডিটেল কিছু বলেছেন নাকি?’
দময়ন্তী বলল, ‘বলেছেন বটে, তবে সবটা নয়। আমার কাছেও লজ্জা পেয়েছেন। যা বলেছেন, আপনাকে বলি, শুনুন।’
সমস্ত গল্পটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনল শিবেন। শেষ হলে বলল, ‘এর মধ্যে ভয়ানক লজ্জাকর কী ব্যাপার লুকিয়ে থাকতে পারে, আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না। তবে হ্যাঁ, থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। বলুন এবার, আপনি কদ্দূর কী বুঝলেন?’
দময়ন্তী বলল, ‘দাঁড়ান। আগে একটু ভাবি। গল্পটার মধ্যে কতগুলো ফাঁক আছে। সেগুলো ঠিকমতো ভরাট না করলে, আসল সত্যটা ধরা যাবে না।’
সমরেশ বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো। তুমি ততক্ষণ চিন্তা করো, আমরা বরং দাবা নিয়ে বসি।’
দময়ন্তী বলল, ‘তা বসো। কিন্তু তার আগে শিবেনবাবুকে চা খাওয়ানো দরকার। আমি এক্ষুনি করে নিয়ে আসছি।’
.
প্রায় একঘণ্টা পরে শোবার ঘর থকে বেরোল দময়ন্তী। চোখ দুটো উত্তেজনায় উজ্জ্বল।
শিবেন আর সমরেশ বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে দাবা খেলছিল। দময়ন্তী পাশে এসে দাঁড়াতে দুজনে এমনভাবে চোখ তুলে তাকাল, যেন এর আগে আর কোনোদিন ওকে দেখেনি। সমরেশ অবশ্য স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে চট করে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করে ফেলল। বলল, ‘সমাধান হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে?’
শিবেন তাড়াতাড়ি দাবার বোর্ড গুটিয়ে ফেলল। দময়ন্তী বলল, ‘মনে হচ্ছে তো। কিন্তু তার আগে, ব্ল্যাকমেলের একটা চিঠি পেলে হত।’
শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার কাছে একটা চিঠি আছে। ভীষণভাবে সেন্সর করে মিসেস হালদার দিয়েছেন আমাকে যদি ফিঙ্গারপ্রিন্ট-ট্রিন্ট কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু ওই সেন্সর করতে গিয়ে সে সব ফিঙ্গারপ্রিন্টের চোদ্দোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন, সে কথা আর বলিনি মহিলাকে।’ বলে পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ বের করে দময়ন্তীর হাতে দিল।
চিঠিটা খুলে দময়ন্তী বলল, ‘একী? এটা তো প্রিন্ট করা চিঠি দেখছি, টাইপ করা তো নয়!’
সমরেশ দময়ন্তীর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে দেখে বলল, ‘না, এটা টাইপ করাই। ইলেকট্রিক টাইপরাইটারে লেখা হয়েছে। টাইপরাইটারের মেক বোধ হয় স্ট্যান্ডার্ড প্রিন্সটন— আমেরিকায় তৈরি। মোটামুটি পুরোনো। যে টাইপ করেছে সে প্রফেশনাল টাইপিস্ট নয়, তবে শিক্ষিত লোক।’
শিবেন আর দময়ন্তী দুজনেই হাঁ করে সমরেশের দিকে তাকিয়ে ছিল। সমরেশ থামতেই শিবেন বলে উঠল, ‘সাবাস! এবার লোকটার নাকের বাঁ-পাশে একটা আঁচিল আছে কিনা বলে ফেল, তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়। ব্যপারটা কী? তোর মগজেও কি আজকাল ডিডাকটিভ লজিক উঁকিঝুকি মারতে শুরু করেছে নাকি?’
দময়ন্তী বলল, ‘সত্যি! ভারি আশ্চর্য! তোমার জীবনে আনন্দ তো দুটি। এক খেলা দেখা, আর অন্যটা হল বিকট বিকট অঙ্ক কষা। বলি, সেসব ছেড়ে টাইপরাইটারের ব্যবসা ধরলে নাকি?’
লজ্জিতভাবে ঘাড় চুলকে সমরেশ বলল, ‘ইয়ে, মানে, আসলে ব্যাপারটা খুব সোজা। ইলেকট্রিক টাইপরাইটারের লেখা এরকম প্রিন্ট বলেই মনে হয়। আমাদের অফিসে এরকম টাইপরাইটার আছে কিনা গোটা ছয়েক। আর আমার সেক্রেটারি যে মেশিনটা ব্যবহার করে তার টাইপ আর এর টাইপ একদম এক ছাঁদের। তাতেই মেকটা আন্দাজ করলুম। পুরোনো বললুম, কারণ দেখ পি লেটারটা ভাঙা, সহজেই চোখে পড়ে। তবে যে টাইপ করেছে, সে যে প্রফেসনাল টাইপিস্ট নয়, তার কারণ চিঠিটা লেখা হয়েছে কাগজটার একদম ওপরে, নীচে একগাদা সাদা জায়গা পড়ে রয়েছে। প্রফেশনাল টাইপিস্ট কক্ষণও এরকম করে না। একটা ছোটো চিঠিও একটা বড়ো কাগজে এমনভাবে ধরাবে যে লেখাটা আর কাগজের সেন্টার অব গ্র্যাভিটি এক হয়ে যাবে। আমি অফিসে চাকরি করি, তাই এটা আমার পক্ষে ধরা সহজ। ও কলেজে পড়ায়— ও ধরবে কোত্থেকে?’
দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘আর লোকটি যে শিক্ষিত, সেটা বুঝলে কী করে? কোনো বানান ভুল, কাটাকুটি নেই, তাই?’
‘ঠিক তাই। দিব্যি পরিষ্কার টাইপ করা।’
দময়ন্তী বলল, ‘যাক, তুমি আমার যে কী উপকার করলে, কী বলব! চিঠিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেলুম না বটে, কিন্তু তার বদলে যা পেলুম, তাতে করে ব্ল্যাকমেলারটিকে পাকড়াও করা বোধ হয় সহজ হবে।’
‘বলো কী? ব্ল্যাকমেলারটি কে ধরে ফেলেছ? ওই হতচ্ছাড়া ভাসুরপোটি নিশ্চয়ই? ব্যাটার খুড়োর সম্পত্তির ওপর খুব লোভ। আমি গোড়াতেই বুঝেছি।’
‘না, ভাসুরপোটি হতেই পারে না। সে বেচারি নির্দোষ।’
শিবেন বলল, ‘না, না, অমন মাঝখান থেকে বলবেন না। গোড়া থেকে বলুন।’
দময়ন্তী বলল, ‘দেখুন, আমাদের সামনে প্রশ্ন চারটে। প্রথমত, কেন ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কোন লুকোনো অপরাধের জন্য ব্ল্যাকমেল হতে হচ্ছে ভদ্রমহিলাকে। তৃতীয়ত, কে ব্ল্যাকমেল করছে এবং চতুর্থত, সে অপরাধটির সংবাদ পেল কী করে।
‘প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, ব্ল্যাকমেলের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, টাকা শোষণ করা। যদি দত্তক নেওয়া বন্ধ করাই উদ্দেশ্য হত, তাহলে সে উদ্দেশ্য সফল হলেও মাসে মাসে টাকা চেয়ে পাঠানো হত না। ভদ্রমহিলার যে ধারণা, দত্তক নেওয়া বন্ধ করবার জন্যই চিঠি লেখা হচ্ছে, তার কারণ, দত্তক নেওয়ার কথা তাঁরা ঘোষণা করবার ঠিক পরে পরেই প্রথম চিঠিটা আসে, তাই। সেটা কিন্তু সমাপতন। গল্পটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, যদিও চিঠিটার ওই সময়ে আসাটা স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে, তাহলেও দত্তক নেওয়ার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ভদ্রমহিলা যে তাঁর ভাসুরপোটিকে প্রচ্ছন্ন সন্দেহ করেন, সেটা নিতান্তই অমূলক।
‘এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন। আচ্ছা, কী কী কারণে একজন বিবাহিতা ভদ্রমহিলা ব্ল্যাকমেলড হতে পারে? বিয়ের আগে লেখা প্রেমপত্র, প্রতিহিংসাপরায়ণ কোনো পূর্বপ্রেমিক স্বয়ং, অত্যন্ত গুরুতর কোন প্রাকবিবাহ অপরাধ, যেমন খুন টুন অথবা অন্য কিছু, এই তো?
‘প্রাকবিবাহ প্রেম, প্রেমপত্র বা প্রেমিক স্বয়ং এই ব্ল্যাকমেলিংয়ের কারণ হতে পারে বলে আমার কিছুতেই মনে হয় না। তার কারণ, ভদ্রমহিলা যে সমাজে ঘোরাঘুরি করেন, সেখানে বিয়ের আগে প্রেম অতি তুচ্ছ ব্যাপার এবং পূর্বপ্রেমিকের অস্তিত্ব কোনো একটা সমস্যাই নয়। তাও হয়তো এ ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেওয়া যেত, যদি জানতুম যে ভদ্রমহিলার স্বামী খুব রক্ষণশীল, নেহাত চাকরির খাতিরে বা হঠাৎ পয়সার গরমে এ হেন সমাজে মিশতে বাধ্য হচ্ছেন। এ দুটোর কোনোটাই ঘটনা নয়। ভদ্রলোক বনেদি বড়োলোক, এবং যাঁর স্ত্রী এমন মারাত্মক রূপ আর পোশাক আশাক নিয়ে একা একা রাত্রিবেলা পার্টিতে যান, তাঁকে আর যাই বলুন না কেন, রক্ষণশীল কিছুতেই বলতে পারেন না। আচ্ছা, সমরেশ! তুমি তো ডাক্তার হালদারকে খুব কাছ থেকে দেখেছ। কীরকম লোক উনি?’
সমরেশ বলল, ‘অতিশয় ডেঞ্জারাস! অর্থপিশাচ, পাঁড় মাতাল, প্রচণ্ড স্বার্থপর আর যাকে বলে ভয়ানক নারীলোলুপ। কিন্তু দুর্দান্ত কাজের লোক, চেহারাটি কন্দর্পের মতো আর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ একজন দিকপাল। লোকটা অদ্ভুত। ভূতের মতো খাটতে পারে, কোনো মেয়েকে পগাবার জন্য বছরের পর বছর পেছনে লেগে থাকতে পারে, বেস্পতিবার মাল ফুরিয়ে গেলে পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে এক পেগ হুইস্কির আশায়। আর লোকে বলে, গত বছর ওঁর কারখানায় যে গণ্ডগোল হয়েছিল, তার দুজন লেবার লিডার নাকি এখন ওঁর একতলার বসবার ঘরের বড়ো বড়ো দুটো সোফার নীচে মাটির তলায় পোঁতা অবস্থায় আছেন। তবে এ ব্যাপারে, বিশেষ কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ আমি পাইনি। শিবেন হয়তো কিছু বলতে পারে।’
শিবেন বলল, ‘অসম্ভব কিছু নয়। লোকটা সত্যি অতি সাংঘাতিক ক্যারেক্টার। যাই হোক, একটা কথা বোঝা যাচ্ছে যে, ওসব পূর্বপ্রেমিক ফ্রেমিক কিছু নয়। অপরাধটা তাহলে কী?’
দময়ন্তী বলল, ‘সেটা বোঝা যেতে পারে, যদি ভদ্রমহিলা তাঁর গল্পের মধ্যে যে গোটাচারেক অসত্য বা অর্ধসত্য কথা বলেছেন, সেগুলো আলোচনা করা যায়।
‘প্রথম অর্ধসত্য হচ্ছে, ভদ্রমহিলার বাবার সন্তানসম্ভবা বড়োমেয়েকে নিয়ে সপরিবারে বম্বে যাওয়ার কারণ হিসেবে যা বলা হয়েছে। মানুষের বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ওই অবস্থায় মেয়েকে নিয়ে ট্রেনে চড়ে, কেউ বারো-শো মাইল পাড়ি দেয় না। তার ওপর ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা তখন খুব স্বচ্ছল ছিল বলা চলে না, কারণ একটা ডিস্ট্রিক্ট টাউনের কলেজে লেকচারারের চাকরি করে উনি যে বিরাট টাকা পয়সা জমিয়েছিলেন, তা কোনোমতেই মনে হয় না। অতএব বম্বে যেতে ওঁকে নিশ্চয়ই ধার দেনা করতে হয়েছিল। আর ভারুচার সঙ্গে ওঁর গভীর প্রণয় ছিল সেটাও খুব বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। ডাঃ ভারুচা পার্শি, খাস বম্বের লোক, খ্যাতনামা ডাক্তার, ব্যস্ত মানুষ। তাঁর সঙ্গে পুণা থেকেও কয়েক মাইল দূরের একটা ছোট্ট কলেজের ইংরেজি ভাষার বিদেশি এক অধ্যাপকের সঙ্গে পরিচয় হওয়াই তো কষ্টকর, ঘনিষ্ঠতা তো দূরের কথা। অতএব এটা ধরেই নেওয়া যেতে পারে, ভদ্রলোকের বম্বে যাওয়ার অন্য কারণ ছিল। আসল উদ্দেশ্য ছিল প্রকাণ্ড একটা শহরে হারিয়ে যাওয়া, যেখানে তাঁকে কেউ চেনে না, অথচ সে অঞ্চলের আদবকায়দা, ভাষাটাষা তাঁর অজানা নয়।’
শিবেন বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে সন্তান সম্ভাবনাটা তাঁর বড়োমেয়ের নয়— ছোটো মেয়েরই? কী সর্বনাশ!’
দময়ন্তী বলল, ‘ঠিক তাই। আট-ন-মাস বাদে ভদ্রলোক যখন নাতি কোলে ফিরে এলেন, তখন কেউ জিজ্ঞাসাই করল না ছেলেটি কার। তখন সে প্রশ্ন ওঠেই না।’
সমরেশ বলল, ‘হুঁ, মালবিকার এত আতঙ্কের কারণ এইবার বোঝা যাচ্ছে। বিভাসকুমার যদি জানতে পারেন যে বিবাহের সময় তাঁর ধর্মপত্নী যাকে বলে ভার্গো ইনট্যাক্টা ছিলো না, তাঁকে মোটামুটি ঠকানো হয়েছে, তাহলে তাঁর বসবার ঘরের জন্য আরেকটা বড়ো সোফার অর্ডার দেওয়ার হাত থেকে কেউ তাঁকে ঠেকাতে পারবে না।’
দময়ন্তী বলল, ‘তা ছাড়া আমার সন্দেহটা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ ভদ্রমহিলার আর একটা মিথ্যে কথা। সেটা হচ্ছে, মিস্টার হালদারের প্রবীরকে দত্তক গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ।
‘কত বয়েস হবে মিস্টার হালদারের? চল্লিশ বা আরও কম? মাত্র ছ-সাত বছর হল বিয়ে হয়েছে। জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার জন্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন— তা সে টাকা রোজগারের জন্যই হোক আর মেয়েদের পেছনেই হোক। ছেলেপুলে হয়নি তো কী হয়েছে? সময় তো চলে যায়নি। অনেকের তো বিয়ের দশ-বারো বছর পরেও ছেলেপুলে হয়। ঠিক এই সময় মিস্টার হালদারের মতো লোক দত্তক নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠবেন— সেটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক। আসলে মালবিকার মাতৃস্নেহ এখানে একটা খুব শক্তিশালী ফ্যাক্টর। প্রথমত তিনি চান প্রবীরকে ওয়ান্স অ্যান্ড ফর অল নিজের ছেলে হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং দ্বিতীয়ত সেটা চান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যে সুযোগ কোনোদিন আসবে বলে তিনি কল্পনাও করেননি, সেই সুযোগই আজ উপস্থিত। এই দিনটির জন্যই বোধ হয় বিয়ের বছর খানেক পর থেকেই তিনি সমানে স্বামীর কানে মন্ত্রণা দিয়ে গেছেন আস্তে আস্তে। কী মন্ত্রণা তিনি দিয়েছেন আমি জানি না, কিন্তু তাঁর চেষ্টা যে সার্থক হয়েছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
‘কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দত্তক নেওয়ার জন্য অত সাততাড়াতাড়ি চেষ্টা কেন করছিলেন ভদ্রমহিলা? তার উত্তর হল, তাঁর ভয় ছিল যদি ওঁর আবার কোনো ছেলেপুলে হয়, তাহলে প্রবীরকে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠা তিনি দিতে চাইছেন, সেটা আর সম্ভব হবে না। কিন্তু আজ উনি বুঝতে পেরেছেন যে সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই। কারণ তাঁর স্বামীটি একজন ক্যাসানোভা।’
সমরেশ বলল, ‘অর্থাৎ তিনি একজন দুর্ধর্ষ প্রেমিক, কিন্তু সন্তানের জন্মদানে অক্ষম?’
দময়ন্তী লজ্জিতভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, মানে ব্যাপারটা অনেকটাই সেই রকমই। কিন্তু ভদ্রমহিলার এই আবিষ্কারই তাঁকে ব্ল্যাকমেলারের হাতে ঠেলে দিয়েছিল।’
শিবেন বলল, ‘তাহলে আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন ”কোন অপরাধের ফল এই ব্ল্যাকমেলিং” তার সমাধান হয়ে গেল। এবার তৃতীয় প্রশ্ন, এই ব্ল্যাকমেলারটি কে?’
‘সেটা বোঝা যাবে ভদ্রমহিলার তৃতীয় মিথ্যেটা নিয়ে আলোচনা করলে। উনি বলেছেন, দত্তক নেওয়ার চূড়ান্ত ডিসিশন নেওয়ার আগে ওঁরা যে একসঙ্গে একই ডাক্তারের কাছে যাননি, তার কারণ এ বিষয়ে কোনো পুরুষ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার লজ্জা তাঁকে বাধা দিয়েছিল। এটা ডাহা মিথ্যে কথা। কারণ, এর আগে তার যে রোগের জন্য পুরুষ ডাক্তার চিকিৎসা করেছিলেন, তার বেলায় যদি লজ্জা না করে থাকে, তবে এর বেলায়ও লজ্জা হবার কোনো কারণ নেই। লজ্জাটা এ ব্যাপারেই নয়। আসলে ওই পরীক্ষার ফল কী হবে, তা তাঁর থেকে ভালো আর কেউ জানে না। কাজেই তাঁকে যেতে হল তাঁর বিশ্বাসভাজন একজন ডাক্তারের কাছে, যিনি তাঁর মনোমতো একটা সার্টিফিকেট দিতে আপত্তি করবেন না। তিনি আশা করেছিলেন, এই সার্টিফিকেট দেখালে আর কোনো পরীক্ষা টরীক্ষার ঝামেলা থাকবে না।’
সমরেশ বলল, ‘ঠিক ক্লিয়ার হল না। যদি দুজনে একসঙ্গে যেতেনও তাহলেই বা কী হত? প্রমাণ হত যে ভদ্রলোকের বাবা হবার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু ভদ্রমহিলার মা হবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু একহাতে যখন তালি বাজে না, তখন দুজনকে নিঃসন্তানই থাকতে হবে এবং দত্তক নিতে কোনো বাধা হবে না। এতে অসুবিধেটা হচ্ছে কোথায়?’
‘অসুবিধে আছে নিশ্চয়ই। দেখ, মালবিকার মানসিকতাটা বোঝার চেষ্টা করো। তিনি তাঁর স্বামীকে যেমন ভয় করেন, তেমনি হাজার দোষ থাকলেও বোধহয় ভালোও বাসেন। ভালোবাসেন কারণ খানিকটা কৃতজ্ঞতাবোধ, খানিকটা অন্য কিছু। ভয় করেন কারণ জানেন উনি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং হিংস্র প্রকৃতির লোক, ক্ষেপে গেলে যে পাঁক থেকে পদ্ম তুলে এনেছেন, আবার সেই পাঁকেই ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করবেন না। কাজেই উনি এমন কিছু কিছুতেই করতে চান না, যা তাঁদের বর্তমান স্ট্যাটাস ক্যুয়ো নষ্ট করে দিতে পারে।
‘এখন আমরা জানি, ভদ্রলোক একজন উঁচুদরের খেলোয়াড়— যাকে ইংরেজিতে বলে ”প্লে বয়”। কাজেই স্বভাবতই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে তাঁর পৌরুষের প্রচণ্ড একটা অভিমান আছে। সেক্ষেত্রে তিনি যদি তাঁর অক্ষমতার কথা জানতে পারেন, তাহলে তিনি যে কী মূর্তি ধরবেন, মালবিকার তা জানা ছিল না। কাজেই তিনি চেষ্টা করলেন ডাক্তার মৃণালিনী করের কাছ থেকে তাঁর বন্ধ্যাত্বের সার্টিফিকেট দাখিল করে বিভাসকুমারকে ডাক্তারের কাছে যাওয়া বন্ধ করতে। অবশ্য তাঁর আশঙ্কাটা ছিল অমূলক। খেলোয়াড় বিভাসকুমার খেলোয়াড়ি মনোভাবেই ডাক্তার কেশবনের রিপোর্টটা নিয়েছিলেন।’
শিবেন বলল, ‘ব্যাপারটা তাহলে এইবার একটু পরিষ্কার হচ্ছে। মালবিকার অতীত কলঙ্কের কাহিনি জানা থাকবার কথা দুজনের। একজন ওঁর বাবা, অন্যজন তাঁদের সে সময়কার পারিবারিক ডাক্তার মৃণালিনী করের। ওঁর বাবাকে স্বচ্ছন্দে বাদ দেওয়া যেতে পারে। বাকি থাকেন ডাক্তার কর। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই তাঁর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়েছিলেন, এবং ডাক্তার করও এই সুযোগ হেলায় হারাতে রাজি হননি। কি বলেন?’
সমরেশ বলল, ‘এখন কর্তব্য হচ্ছে, একবার ওঁর চেম্বারে গিয়ে কায়দা করে টাইপরাইটারটা দেখে আসা।’
দময়ন্তী হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, দেখে আসা কর্তব্য বই কী। তবে আরও একজন সন্দেহভাজন চরিত্র আছেন। তাঁকে বাদ দিলে তো চলবে না।’
সমরেশ বলল, ‘এই মরেছে! তিনি আবার কিনি?’
‘ডাক্তার কেশবন।’ দময়ন্তী বলল।
‘ডাক্তার কেশবন!’ শিবেন আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কিন্তু তিনি তো… যাই হোক, তাঁকে আপনার সন্দেহের কারণটা কী? তার পক্ষে কি মালবিকার অতীত কলঙ্কের কথা জানা সম্ভব? তিনি তো ভদ্রমহিলাকে বোধ হয় দু-তিন বারের বেশি দেখেনই-নি। অবশ্য যদি তাঁর সঙ্গে ডাক্তার করের পূর্বপরিচয় থেকে থাকে সে আলাদা কথা।’
দময়ন্তী বলল, ‘জানা সম্ভব। ডাক্তার করের সঙ্গে পূর্বপরিচয় থাকারও দরকার থাকে না। প্রকৃতপক্ষে, ডাক্তার কেশবন যখন প্রথম মালবিকাকে পরীক্ষা করেন, তখনই তিনি জানতে পারেন যে অতীতে কখনও কোথাও তিনি একটি শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি পরিবারটিকে ভালো করে জানতেন না, কাজেই বোধ হয় ভেবেছিলেন যে সে শিশুটি হয়তো জন্মে মারা গিয়েছিল বা বর্তমানে বড়ো হয়ে হোস্টেলে টোস্টেলে বা বাইরে কোথাও আছে। কাজেই তিনি ও বিষয়ে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেননি বা করবার কথাও বোধ হয় চিন্তা করেননি। কিন্তু যখন তিনি বিভাসকুমারকে পরীক্ষা করলেন, তখন কৌতূহলটা ফণা তুলে উঠে দাঁড়াল। খোঁজ খবর নিয়ে জানলেন যে বিভাসকুমার নিঃসন্তান বলেই সবাই জানে এবং তাঁর শালির ছেলেকে তিনি দত্তক নিতে যাচ্ছেন। চট করে দুই দুই-এ চার করলেন ডাক্তার। একটা চিঠি দিলেন— যদি লেগে যায়। লেগে গেল। লোভের কাছে তাঁর সামাজিক কর্তব্যবোধকে জলাঞ্জলি দিলেন।’
সমরেশ বলল, ‘ডাক্তার কেশবন বুঝলেন কী করে? বাচ্চা হলেই তার চিহ্ন কিছু থেকে যায় নাকি?’
দময়ন্তী লজ্জিতভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, পেটের চামড়ায় দাগ থাকতে পারে আর যে স্টিচ পড়ে তার দাগ সারা জীবনই থাকে। একটু অভিজ্ঞ চোখ অনায়াসে ধরতে পারে।’
সমরেশ বলল, ‘সিজারিয়ান না কী যেন বলে, তাই না?’
‘না, সিজারিয়ান ডেলিভারি ছাড়াও নর্ম্যাল ডেলিভারিতেও স্টিচ পড়ে। তার দাগ থেকে যায়।’
শিবেন বলল, ‘মালবিকা কেন ডাক্তার কেশবনকে সন্দেহ করেননি? তিনি কি জানেন না এই সব চিহ্নের কথা?’
‘না, জানেন না। না বলে দিলে কোনো অনভিজ্ঞ মেয়ের পক্ষে জানা সম্ভবও নয়। বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে যে বয়সে মেয়েরা প্রাণের কথা, মনের কথা বলে, অন্যের অভিজ্ঞতার ভাগ নেয়, সেই বয়সটা তো ওঁর কেটেছে নিঃসঙ্গ বন্দি জীবনে— বৃদ্ধা মা আর পাগল দিদিকে নিয়ে। জানবার কোনো সুযোগই হয়নি।’
সমরেশ বলল, ‘বুঝলুম। কিন্তু হে নারী, তুমিই-বা এত ডিটেল জানলে কোত্থেকে? হিস্ট্রির সিলেবাসে তো বাপু এসব জিনিস থাকে বলে শুনিনি।’
‘আহা, হিস্ট্রির সিলেবাসের বাইরে যেন কিছুই জানি না আমি। আমাদের পরিবারটিকে তো তুমি জানোই। তুমিই তো বলো, রাবণের গুষ্টি— ভাই-বোন মিলে একগাড়ি লোক। আমরা বোনেরা যখন একত্র হই, তখন নাকি পাড়ায় কাক চিল বসতে পায় না। আমার দিদিদের আর বউদিদের তো তুমি দেখেছ। মুখের কোনো আগল নেই। আড্ডা মারতে বসে যা-খুশি তাই নির্বিকার চিত্তে বলে যাবে। ভেবেছোটা কি, বিয়ের আগেই আমার সবকিছু জানা হয়ে গিয়েছিল।’
সমরেশ তাচ্ছিল্যভরে বলল, ‘সবকিছু! থাক, থাক, ওসব বিষয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালো।’
দময়ন্তী লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, ‘অসভ্য বাঁদর! বলি, শুধু অসভ্যতা করবে, না শুনবে কথাগুলো।’
শিবেন তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ইন্টারেস্টিং কথা হচ্ছিল, তার মধ্যে তুই যত ভ্যাজ ভ্যাজ আরম্ভ করলি। আপনি বলুন বউদি। ডাক্তার মৃণালিনী করকে আপনি তাহলে সন্দেহ থেকে একেবারেই বাদ দিতে চান?’
সমরেশ আবার যোগ দিল :’টাইপরাইটারটা চেক করাতেও তোমার আপত্তি?’
দময়ন্তী বলল, ‘একেবারেই বাদ দিতে চাই, এমন কথা বলব না। তবে আমার ধারণা, তালতলার এই হতভাগ্য পরিবারটির সত্যিকারের শুভানুধ্যায়ী যদি কেউ থাকেন, তবে তিনি এই ভদ্রমহিলা। তা ছাড়া আরেকটা কথা ভেবে দেখুন, মিসেস হালদার যে রেস্টুরেন্টে টাকা দিতে যান, এটা একটা বিশুদ্ধ দক্ষিণ ভারতীয় রেস্টুরেন্ট— যা আজকাল কলকাতায় অজস্র গজিয়ে উঠেছে। কফির দোকান আর তার কাউন্টারের ওপর টিফিন ক্যারিয়ার— এটা অন্য কিছু হতে পারে না।
‘তবে দক্ষিণ ভারতীয় রেস্টুরেন্ট বলে ডাক্তার কেশবনের ওপর মালবিকার সন্দেহ হতে পারত। কিন্তু তিনি যে সমাজে মেশেন, সেটা নিতান্তই কসমোপলিটন। কাজেই বিশেষ কাউকে নির্দেশ করা তাঁর পক্ষে ঠিক সম্ভব হয়নি। ডাক্তার কেশবনই বরং এত কম পরিচিত যে তাঁর নাম বোধ হয় মালবিকার মনেই পড়েনি।’
শিবেন বলল, ‘যাক, তাহলে আপনার তৃতীয় আর শেষ প্রশ্নের জবাব হল এই। আমি কিন্তু ডাক্তার করকেও একটু বাজিয়ে দেখতে চাই। তাঁকে একেবারে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। তাহলে সমরেশ, আমি কাল বিকেলে আসব। তোরা রেডি থাকিস। আমরা একসঙ্গে ডাক্তার কেশবনের চেম্বারে হানা দেব।’
দময়ন্তী দু-হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘ওরে বাবা! না, না, আমি যাব না। সমরেশকে নিয়ে যান, ওর খুব সাহস। আমার ভীষণ ভয় করে।’
.
দময়ন্তী একটা ম্যাগাজিন খুলে বসেছিল বটে, কিন্তু মোটেই পড়ছিল না। ভেতরে ভেতরে খুবই অস্থির হয়ে উঠেছিল সে। দরজার ঘণ্টি বাজতেই একলাফে গিয়ে দরজা খুলল।
সমরেশ আর শিবেন ঘরে ঢুকল। শিবেন মৃদু মৃদু হাসছিল আর সমরেশ প্রায় লাফাচ্ছিল উত্তেজনায়।
‘উঃ! পুলিশি হেক্কার কাকে বলে, আজ বুঝলুম।’ বলল, সমরেশ। ‘বাপরে বাপ! সে কী ধমক ধামক, আমারই পিলে চমকে চমকে উঠছিল। কেশবনের তো কথাই নেই— একেবারে স্পিকটি নট।’
দময়ন্তী বলল, ‘আঃ বাজে কথা ছাড়ো। কী হল বলো দেখি?’
‘হল যা, একেবারে গুরুচরণ। আমরা তো প্রথমে রুগি সেজে ঢুকলুম। আমি রুগি, শিবেন গার্জিয়ান। রোববার, চেম্বার ফাঁকা। প্রথমে তো ভাগিয়েই দিচ্ছিল। পরে অনেক অনুনয়, বিনয় করবার পর, দেখতে রাজি হল। ঘরে ঢুকে দেখি, ব্যাটা বসে বসে টাইপ করছে। টাইপরাইটারটা প্রথমেই দেখে নিলুম। আমার কথাই ঠিক— স্ট্যান্ডার্ড প্রিন্সটন। তারপর, দু-একটা কথার পরেই শিবেন নিজের পরিচয়টি দিল।
‘শিবেন প্রথমটা আন্দাজে ছেড়েছিল। বলল, আমরা জানি, আপনি আপনার রুগিনীদের ব্ল্যাকমেল করছেন, তার অকাট্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। যেখানে সমাজকে রোগমুক্ত করবার দায়িত্ব আপনার, সেখানে আপনি নিজেই একটা কুৎসিত ব্যাধিবিশেষ। আমরা দেখব, যাতে এই ব্যাধিটি সমূলে উৎপাটিত করা যায়।
লোকটা প্রথমে তেড়ে এসেছিল। তারপর আমতা আমতা করতে লাগল। ইতিমধ্যে আমি উঠে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি যে টেবিলের ওপর টাইপরাইটারটা রাখা, তার আধখোলা ড্রয়ারের ভেতর একটা লাল টুকটুকে নোটবই দেখা যাচ্ছে। ঠিক যে সন্দেহ হয়েছিল তা নয়, কৌতূহলের বশেই বইটা তুলে নিয়েছিলুম। লোকটা তখন শিবেনের ধাতানি শুনছে, লক্ষ্য করেনি, বইটি খুলে আমার তো চক্ষুস্থির! ভেতরের পাতায় প্রায় জনা পনেরো মহিলার নাম। প্রত্যেকের নামের পাশে একটা করে তারিখ আর একটা করে টাকার অঙ্ক। সবচেয়ে বেশি আমাদের মিসেস হালদারের নামে, দশ হাজার টাকা। আর সবচেয়ে কম কে এক মিসেস কমলা সরকারের নামে— পাঁচশো টাকা।’
‘শিবেনকে সেটা দেখাতেই ও তো একেবারে ফেটে পড়ল। তারপর যা মুখ ছোটাল না, তা ভাষায় বর্ণনা করা আমার অসাধ্য। লোকটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। শিবেন শেষ অস্ত্র ছাড়ল। বলল, আমরা মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনকে জানাব আপনার কথা। আপনি একজন জঘন্য অপরাধী। আমরা দেখব, যেন আপনার সমস্ত ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হয় এবং পুলিশের তরফ থেকে যা করণীয় তাও আমরা করব।
‘লোকটা হাতজোড় করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ধপ করে বসে পড়ল। শিবেন বলল, কোনোরকম ক্ষমা আপনি পাবেন না, আপনি ক্ষমার অযোগ্য। আমি যা বললুম, তা আমরা করবই। এই বলে বইটি পকেটে পুরে আমরা গটগট করে বেরিয়ে এলুম। আসার আগে দেখলুম, লোকটা তার চেয়ারে কেমন ধারা নেতিয়ে পড়ে আছে।’
শিবেন বলল, ‘হ্যাঁ, ডোজ একখানা যা দিয়ে এসেছি, ব্যাটা তার ধাক্কা সামলে উঠতে সময় নেবে। আসলে আমরা করতে তো পারতুম না কিছুই। এখন ওর অপরাধবোধটা ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিয়ে আসা হল। এতেই কাজ হবে।’
দময়ন্তী বলল, ‘নিশ্চয়ই হবে। আশা করি, মিসেস হালদার এবারে নিজের ছেলেকে ছেলে হিসেবে পেতে আর কোনো অসুবিধে বোধ করবেন না। এবং আরও অনেকেই মুক্তি পাবেন।’
শিবেন চলে গেলে সমরেশ বলল, ‘কেসটা তাহলে এইখানেই শেষ? যাকে বলে, দ্য এন্ড?’
দময়ন্তী বলল, ‘ঠিক দ্য এন্ড নয়। মোটামুটি শেষ বলতে পারো। মনে আছে, আমি বলেছিলুম ভদ্রমহিলা চারটে প্রধান মিথ্যে কথা বলেছিলেন? লক্ষ্য করোনি, আমরা তিনটে মিথ্যে নিয়ে আলোচনা করেছিলুম। চতুর্থটার সঙ্গে অবশ্য এ ব্যাপারটার কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু কাল যখন ভদ্রমহিলা আসবেন, তখন সেটাও একবার যাচাই করে নেওয়া যাবে। কোনো দরকার নেই যদিও। নেহাত মেয়েলি কৌতূহল বলতে পারো।’
সমরেশ বলল, ‘হুঁ, কৌতূহলটা আমার মধ্যেও বেশ জোরালোভাবে সংক্রামিত হয়েছে।’
.
সমরেশ অফিস থেকে ফিরতেই দময়ন্তী বলল, ‘চট করে চানটান করে নাও। মিসেস হালদার ফোন করেছিলেন, আসবেন এখনই।’
কাতর মুখে সমরেশ বলল, ‘চান আবার কেন! নিউমোনিয়া ধরাতে চাও নাকি? শুধু হাত-মুখটা ধুয়ে নিলে চলবে না?’
দময়ন্তী বলল, ‘এই গরমে কী করে যে বিকেলে চান না করে থাকো, জানি না।’ বোধ হয় আরও কিছু গঞ্জনা সে দিত, কিন্তু তার আগেই টেলিফোন বেজে উঠল।
সমরেশ দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরল। হাসিমুখে বলল, ‘কে, শিবেন? বল, কী বলছিস।’ হঠাৎ তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আর্তগলায় বলল, ‘কী বললি?… কী সর্বনাশ! … আমরা বেরিয়ে আসার পরেই?… নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে? কী সাংঘাতিক!… উঃ, এখনও চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি যে রে, লোকটাকে জলজ্যান্ত দেখে এলুম!… বড়ো বাড়াবাড়ি হয়ে গেল ব্যাপারটা। ভেবে দেখ, লোকটার অপরাধবোধ কী তীব্র ছিল! ছেলেপুলে আছে নাকি রে? নেই? বিয়ে থা করেনি? … আচ্ছা, ঠিক আছে। তুই আর কী করবি? চলে আয় রাত্রিবেলা। ছাড়ছি।’
দময়ন্তী উদবিগ্ন মুখে সমরেশের পিছনে দাঁড়িয়েছিল। টেলিফোন রাখতেই বলল, ‘ভদ্রলোক বিয়ে-থা করেছিলেন নাকি গো?’
সমরেশ কী যেন জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। কখন যেন নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন মালবিকা। কিছু একটা ঘটেছে অনুমান করে নিজের উপস্থিতিটা জানান দিতে ইতস্তত করছেন। সমরেশ তাঁর দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ গলায় বলল, ‘আর আপনার কোনো ভয় নেই, মিসেস হালদার। আর কোনোদিন আপনার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি আসবে না। আপনি মুক্তি পেয়েছেন।’
মালবিকা সমরেশের গলার নিরানন্দটুকু লক্ষই করলেন না। আনন্দে, উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে সোফার ওপর বসে পড়লেন। স্খলিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি মুক্তি পেয়ে গেছি! আর আসবে না চিঠি— আর কোনোদিনও আসবে না? আমি কী করে আপনাদের ধন্যবাদ জানাব? কেমন করে আমার কৃতজ্ঞতা জানাব?’
দময়ন্তী তাঁর পাশে বসে বলল, ‘আপনি শান্ত হোন, মিসেস হালদার। কৃতজ্ঞতা জানাবার সময় অনেক পাবেন। আপাতত অতীতকে পুরোপুরি ভুলে গিয়ে, স্বামী সন্তান নিয়ে নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করুন। ভগবান নিশ্চয়ই আপনাদের মঙ্গল করবেন।’
অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলেন মালবিকা। ভেতরের প্রচণ্ড আবেগগুলোকে আয়ত্তে আনবার প্রচেষ্টায় সমস্ত মুখ লাল হয়ে উঠল। তারপর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে দময়ন্তীর মুঠির মধ্যে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এটা আপনাকে নিতেই হবে, মিসেস দত্তগুপ্ত। আমার কৃতজ্ঞতা জানাবার এটা একটা সামান্য উপকরণ বলে মনে করবেন।’
দময়ন্তী আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কী এটা?’
মালবিকা বললেন, ‘কাল এটাই দিতে যেতুম টিফিন ক্যারিয়ারে করে।’
সমরেশ হাঁসফাঁস করে উঠল, ‘দশ— হাজার টাকার চেক!’
দময়ন্তী ভয়ানক লজ্জিত হয়ে বলল, ‘না, না সেকী! আপনি আমায় টাকা দিচ্ছেন কেন? আমি তো প্রফেশনাল নই। আমি পরিচিতদের বিপদে একটু সাহায্য করে থাকি মাত্র।’
মালবিকা বললেন, ‘কোনো কথাই আমি শুনব না, মিসেস দত্তগুপ্ত। এটা তো যেতই, আরও কত যে যেত সেই শয়তানটার পেটে কে জানে! আমি যদি তার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে এটা একটা সৎকাজে ব্যয় করতে চাই, আপনি বাধা দেবেন কেন?’
সমরেশ মনে মনে বলল, ‘বটেই তো, বটেই তো!’
মালবিকা এবার সমরেশের দিকে ফিরলেন। বললেন, ‘আপনি এইমাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন। চানটান এখনও করেননি দেখছি। যান, আপনি বিশ্রাম করুন। আমিও এবার উঠি।’
বললেন বটে, কিন্তু উঠলেন না। নিজের মনের সঙ্গে খানিকক্ষণ লড়াই করলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর কৌতূহলেরই জয় হল। লজ্জিতভাবে দময়ন্তীর দিকে চেয়ে বললেন, ‘ব্ল্যাকমেলারটিকে তো ধরতে পেরেছেন— কী করে পেরেছেন জানি না। কেন সে ব্ল্যাকমেল করছিল, তাও কি ধরতে পেরেছেন?’
নিরুত্তাপ গলায় দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, বোধ হয় পেরেছি।’
‘তার মানে আমার জীবনের সব কথাই আপনার জানা! আপনি কি ম্যাজিক জানেন?’
‘না, সব কথাই যে জানা তা বলব না। কয়েকটা কথা সঠিক জানি না, অনুমান করতে পারি। যদি কিছু মনে না করেন, দু-একটা প্রশ্ন করব?’
ক্ষীণ কণ্ঠে মালবিকা বললেন, ‘করুন।’
‘আপনার ভগ্নীপতি যে মারা যান, সেটা বিষ খেয়ে কি? কী বিষ?’
‘কোনো একটা ফুলের বীজের এক্সট্র্যাক্ট। বেদেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। খুব সামান্য পরিমাণে খেলে লোকে পাগল হয়ে যায়, আর একটু বেশি পরিমাণে খেলে মৃত্যু অনিবার্য।’
মালবিকার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে দময়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার ভগ্নীপতিকে কে সেই বিষ মেশানো খাবার দিয়েছিল? আপনার দিদি?’
আতঙ্ক বিস্ফারিত চোখে চিৎকার করে উঠলেন মালবিকা, ‘না, না, দিদি নয়— দিদি নয়! ও দেয়নি— দিতে পারে না! ও যে ভীষণ ভালো ছিল, ফুলের মতো সুন্দর আর কোমল! জানেন, কী ভয় পেত আরশোলাকে, তবু একটা প্রাণে ধরে মারতে পারত না। যখন পাগল হয়ে গেল, তখন খালি কাঁদত আর বলত, তুমি আমায় বিষ দিলে! আমি তোমায় অত ভালোবাসতুম, তবু আমায় বিষ খাওয়ালে? ও জানত ওর স্বামীর সুন্দর মুখের পিছনে একটা কী ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ লুকিয়ে আছে, তবু স্বামীকে আগলে রাখতে চাইত আর ভালোবাসত।’
বহুদিন আগেকার ভয়াবহ স্মৃতি চোখের জল হয়ে মালবিকার দু-চোখ ছাপিয়ে টপটপ করে পড়তে লাগল। দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন ভদ্রমহিলা।
দময়ন্তী প্রায় নিজের মনেই বলল, ‘তাহলে স্বামী মারা যাওয়ার আগেই উনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন! আমি এই রকমই সন্দেহ করেছিলাম।’
বেশ কিছুক্ষণ বাদে মুখ তুললেন মালবিকা। সমরেশ আশ্চর্য হয়ে দেখল, তাঁর চোখ দুটো শুকনো— যেন কী এক জ্বালায় সব জল শুকিয়ে গেছে। শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে মালবিকা বললেন, ‘একটা ছোট্ট সুন্দর সংসার ছিল আমাদের। জ্বলে গেল, সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। মাত্র একজনের বিষে। দিদিটা পাগল হয়ে মরল, বাবা প্রায় উন্মাদ আর আমার সর্বনাশ!
‘অথচ দিদি চেষ্টা করেছিল সুন্দর একটা সংসার গড়ে তুলতে। আমরা বম্বে থেকে ফেরার পর ও বাবা আর মাকে কত বুঝিয়েছিল। বলেছিল, ঘি আর আগুন কাছাকাছি থাকলে কী আর করা যাবে! তোমরা শান্ত হও, ক্ষমা করো। আমাকে দেখ তো, আমি তো ভুল বুঝিনি। দিদি কী বোকাই ছিল! ভেবেছিল ওর স্বামী ক্ষণিকের জন্যে আত্মসংযম হারিয়ে ফেলেই বিপত্তি ঘটিয়েছিল। আসলে ও ছিল সাপের মতো ক্রুর, শয়তানের মতো নিষ্ঠুর। দিদিকে ও কোনোদিনই ভালোবাসেনি, ওর দৃষ্টি ছিল আমার দিকে। প্রথম থেকেই।
‘আমি তখন প্রায় বালিকাই বলা চলে। ওর ভালোবাসার কথাগুলো বিশ্বাস করেছিলুম, দিদিকে ভুল বুঝেছিলুম। দিদি যখন পাগল হয়ে দিন-রাত খালি কেঁদে কেঁদে বলত, ‘তুমি আমায় বিষ দিলে!’ আমি তখন সেটা প্রলাপ বলেই ভাবতুম। কিন্তু বাবা-মার মুখের দিকে চেয়ে কী একটা সন্দেহ আমার মনে ঢুকেছিল, বম্বে থেকে ফেরার পর ওর কাছে আর একদম যেতুম না।
‘ও তখন বাধা পেয়ে উন্মাদ হয়ে উঠল। ওই বিশাল বাড়ির নির্জনতায় ওর বিষাক্ত নিশ্বাস আমাকে খুঁজে বেড়াত! তারপর একদিন উত্তেজনার মুহূর্তে ও আমায় বিষের কৌটো দেখিয়ে আমার জন্য কি না করেছে সেটা প্রমাণ করবার চেষ্টা করল। সঙ্গেসঙ্গে যেন একটা প্রচণ্ড বজ্রাঘাতে আমার চোখের সামনে যে অন্ধকার পর্দাটা ছিল, সেটা ছিঁড়ে খুঁড়ে আসল সত্যের বীভৎস রূপটা দেখতে পেলুম। সেই বিকৃত রূপ দেখে তখন উন্মাদ হবার পালা আমার। আমার অত ভালোবাসার— অত আদরের দিদিটার দিকে চেয়ে, বাবা-মার দিকে চেয়ে আমার বুকটা ফেটে যেত।’
দময়ন্তীর দিকে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে মালবিকা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি জানতে চান, কে বিষ দিয়েছিল? নিতান্ত অল্প বয়সেও প্রতিহিংসা নিতে, নিজের সম্মান বাঁচাতে, যে ফণা একবার ছোবল মেরে ক্ষান্ত না হয়ে আবার মারতে উদ্যত হয়েছিল, তাকে চিরকালের মতো শেষ করে দিতে কে বিষ দিতে বাধ্য হয়েছিল, শুনবেন?’
সমরেশ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না, মিসেস হালদার, আমরা জানতেও চাই না, আর শুনতেও চাই না। যা হয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে। তাকে আর টেনে এনে লাভ কী? অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন আপনি। এখন বাড়ি যান। আজ আপনার আনন্দের দিন। অতীতকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে, নতুন করে শুরু করুন পথচলা। এই তো সবে শুরু। আপনার সব শুভ হোক।’