প্রথম পর্ব : শরৎকাল
অধ্যায় এক
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯০, রাত ১০ : ৪৯, ইয়োকোহামা
লাইন ধরে কন্ডোমিনিয়াম বিল্ডিংয়ের সারি। প্রত্যেকটা বিল্ডিং চৌদ্দ তলা উঁচু। স্যানকিন গার্ডেনের পাশে, হাউজিং ডেভেলপমেন্টের পুরো পূর্ব দিক জুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিল্ডিংগুলো। ওগুলো নির্মাণ করা হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু ভাড়া বা বিক্রি হয়ে গেছে প্রত্যেকটা ইউনিট-ই। একেকটা বিল্ডিংয়ে প্রায় একশো জন মানুষের বাস। কিন্তু এদের বেশিরভাগ-ই নিজেদের প্রতিবেশীদের চেহারা পর্যন্ত দেখার সুযোগ পায় না। এখানে মানুষের বসবাসের প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায় শুধুমাত্র রাতে। জানালার দিকে তাকালে ভেতরে আলো জ্বলতে দেখা যায় তখন।
দক্ষিণ দিকে সাগরের পানিতে প্রতিফলিত হয় ফ্যাক্টরির জ্বলজ্বলে আলো। ফ্যাক্টরির দেয়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাইপ আর কন্ডুইট। যেমনটা রক্তের মধ্যে শিরা উপশিরা ছড়িয়ে থাকে, ঠিক সেভাবেই। ফ্যাক্টরির সামনের দিককার দেয়ালে জ্বলে অসংখ্য লাইট। দেখে মনে হয় অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে জোনাকি। এমনকি এই অদ্ভুত দৃশ্যেরও মধ্যে ও রয়েছে একপ্রকার সৌন্দর্য্য। সাগরে বর্ণনাতীত এক ছায়ার সৃষ্টি করে এই ফ্যাক্টরি।
কয়েকশো মিটার দূরত্বে, হাউজিং ডেভেলমেন্টের ওখানে, ফাঁকা অংশ বরাবর রয়েছে একটি সিঙ্গেল দ্বিতল ভবন। ভবনের মূল দরজা দিয়ে সরাসরি রাস্তায় চলে আসা যায়। রাস্তাটা উত্তর-দক্ষিণ মুখী। রাস্তার পাশেই একটি গ্যারেজ। বাড়িটা খুবই সাধারণ। হাউজিং এলাকায় নতুন নির্মিত বাড়িগুলোর মতোই। কিন্তু এই বাড়ির আশপাশে আর কোনো বাড়ি নেই। যদিও যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা থাকার জন্য বিক্রি হয়েছে আশেপাশের কিছু অংশ। তবে রাস্তার পাশের বেশিরভাগ জায়গাতেই ঝোলানো ‘বিক্রয় হবে’ সাইনবোর্ড। কন্ডোগুলোও একই সময়েই নির্মিত। ক্রেতারা দ্রুতই কিনে ফেলেছে এগুলো। সেসবের তুলনায় হাউজিং ডেভেলমেন্টকে বড়ই নিঃসঙ্গ মনে হয়।
অন্ধকার রাস্তা থেকে বাড়িটার দ্বিতীয় তলার জানালার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে ফ্লুরাসেন্ট বাল্বের আলো। বাড়িটার ভেতরের এই একমাত্র আলো জ্বলছে তোমাকো ওশির ঘরে। তার পরনে শর্টস ও সাদা একটা টি শার্ট। চেয়ারে বসে স্কুলের পড়া করছে সে। তার দেহ রয়েছে অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে। ডান পা মেঝেতে স্ট্যান্ডফ্যানের দিকে ছড়িয়ে রাখা। টি শার্টের মধ্যে দিয়ে নিজের দেহে ফ্যানের বাতাস লাগাচ্ছে সে। তপ্ত গরমকে বিড়বিড় করে গালি দিল ওশি। প্রাইভেট গার্লস হাইস্কুলের সিনিয়র ক্লাসের শিক্ষার্থী সে। সামার ভ্যাকেশনের মধ্যে অলসতার কারণে একগাদা হোমওয়ার্ক জমে গিয়েছে তার। ছুটিটা ঘুরেফিরেই কাটিয়ে এখন গালি দিচ্ছে গরম আবহাওয়াকে। যদিও এবারের গ্রীষ্মে অতটা গরমও পড়েনি। বেশিরভাগ দিনেই আকাশ ছিল পরিষ্কার। কিন্তু প্রত্যেকবারের মতো এবারের ভ্যাকেশনে বিচে বসে কাটাতে পারেনি সে। আর ভ্যাকেশন শেষ হওয়ার পরেও মোটামোটি পরবর্তী পাঁচদিন গ্রীষ্মের আকাশ পরিষ্কার থাকার কথা। ব্যাপারটা ভেবে মেজাজ খারাপ হলো তোমাকোর। গালি দিল পরিষ্কার আকাশকেও।
এই অসহ্যকর গরমে কীভাবে পড়াশোনা করা যায়?
নিজের চুলের মধ্যে হাত চালাল তোমাকো। উঠে দাঁড়িয়েছে সে, রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে। একটি মথ দেখতে পেল জানালার কাঁচে। এক মুহূর্তের মধ্যেই ফ্যানের বাতাসের তোড়ে উড়ে গেল সেটা। মনে হলো পোকাটা উড়ে যাওয়ার পর জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল কিছুটা।
আগামীকাল একটা ক্লাসটেস্ট আছে তোমাকো ওশির। কিন্তু পড়াশোনার অবস্থা যাচ্ছেতাই। সারারাত পড়লেও ক্লাসটেস্টের জন্য ভালো প্রিপারেশন নেয়া সম্ভব না।
ঘড়ির দিকে তাকাল সে। প্রায় রাত এগারোটা বাজে। টিভিতে আজকের বেসবল ম্যাচের শেষাংশ দেখার কথা ভাবল ওশি। হয়তো দর্শক সারিতে একঝলক তার বাবা মাকেও দেখা যেতে পারে। কিন্তু কলেজে ভর্তির জন্য মরিয়া তোমাকো আগামীকলের ক্লাসটেস্ট নিয়ে চিন্তিত। যেভাবেই হোক তাকে কলেজে ভর্তি হতে হবে। কোন কলেজ সেটা কোনো ব্যাপার নয়। যেকোনো একটা হলেই হলো। তারপরও, সামার ভ্যাকেশন খুব একটা ভালো কাটল না এবার। ফালতু আবহাওয়ার কারণে খুব একটা উপভোগ করা হয়ে ওঠেনি সময়টা। বিশ্রী গরমের কারণে কোনো কাজ-ই করা হয়নি ঠিকমতো।
হাইস্কুলে এটাই আমার শেষ সামার। বেশ ভালোমতোই কাটাতে চাচ্ছিলাম এবার, কিন্তু হলো না। ছুটি শেষ। দ্য এন্ড। ভাবলো সে।
গরমের চেয়ে এখন এই চিন্তাটায় মনযোগ বিচ্যুত করে দিল তার।
আর বাবা মাকে নিয়ে কি-ই বা বলব? এভাবে মেয়েকে পড়ার জন্য ফেলে রেখে গেছে। এদিকে আমি ঘেমে একাকার আর গ্যালারিতে বসে বেসবল খেলা উপভোগ করছে ওরা। আমার মনের অবস্থাটা একদমই বোঝে না।
অপ্রত্যাশিতভাবেই অফিসের এক সহকর্মী হাইভোল্টেজ এই বেসবল ম্যাচের টিকেট দিয়েছিলেন ওশির বাবাকে। ফলে খেলা দেখতে আজকে টোকিও ডোমে গিয়েছে তার বাবা-মা। এতক্ষণে অবশ্য হয়ে গিয়েছে ফিরে আসার সময়। যদি তারা খেলা শেষে অন্য কোথাও না গিয়ে থাকে তবে। আজকে নিজেদের নতুন বাড়িটাতে একাই আছে তোমাকো।
আজকের আবহাওয়া অদ্ভুত রকমের আর্দ্র। সেইসাথে বেশ কয়েকদিন বৃষ্টির দেখা নেই। অনবরত ঘাম ঝরছে তার শরীর থেকে। বদ্ধ বাতাসেই স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। অবচেতন মনেই নিজের উরুতে থাবা দিল তোমাকো। হাত সরিয়ে নেয়ার পর সেখানে কোনো মশার দেখা পেল না সে। হাঁটুর ওপরের অংশে চুলকানির অনুভূতি হলো তার। হতেও পারে সেটা কল্পনা। একধরনের ভনভন শব্দ শুনলো সে। হাত চালালো নিজের মাথার ওপর। মাছি। ফ্যানের বাতাসের তোড় থেকে বাঁচতে উঁচুতে উড়তে আরম্ভ করেছে সেটা। মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেল মাছিটা। ঘরের মধ্যে মাছি ঢুকলো কীভাবে? দরজা তো বন্ধ। তোমাকো উঠে গিয়ে ভালোভাবে খতিয়ে দেখল জানালার কাঁচটা। সেখান দিয়ে মাছি ঢোকার কোনো সুযোগ-ই নেই। হঠাৎ করেই তৃষ্ণা পেল তার। বুঝতে পারল প্রস্রাব করতে টয়লেটেও যাওয়া প্রয়োজন।
অদ্ভুত একটা অস্বস্তি হচ্ছে তোমাকো ওশির। ঠিক দমবন্ধ নয়, তবে মনে হচ্ছে বুকের ওপর চাপা দেয়া হয়েছে বিরাট বড় পাথর। নিজের জীবন কতটা অসঙ্গত এই নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ করত তোমাকো। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ। একেবারে নীরব হয়ে গিয়েছে সে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অকারণেই ঢিপঢিপ করতে থাকল তার বুক। সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়ল সিঁড়ির ওপর। রাস্তা পেরিয়ে যাওয়ার কারণে ম্লান হয়ে গেল গাড়ির শব্দ। মনে হলো অদ্ভুত এক আঁধারে ছেয়ে গেছে বাড়িটা। ইচ্ছাকৃত ভাবেই আওয়াজ করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল তোমাকো। নিচতলার হলের আলো জ্বালিয়ে দিল সে।
টয়লেটে বসে চিন্তায় ডুবে গেছে তোমাকো। বাথরুম শেষ করার পরেও দীর্ঘসময় ধরে বাথরুমে বসে রয়েছে সে। এখনও থামেনি তার বুকের কাঁপন। আগে কখনো এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি তোমাকো। কি হচ্ছে এসব? ঘন একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করল সে। এরপর দাঁড়িয়ে একসাথে উঠিয়ে নিল শর্টস ও প্যান্টি।
বাবা-মা প্লিজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, মনে মনে বলল তোমাকো। পরমুহূর্তেই নিজের কাছেই শিশুতোষ মনে হলো তার আচরণ। কার সাথে কথা বলছি আমি?
সে তার বাবা-মাকে দ্রুত বাড়িতে ফেরার জন্য অনুনয় জানিয়েছে, এমনটা মনে হলো না। মনে হচ্ছে সে আহবান জানিয়েছে অন্য কাউকে…
আমাকে দয়া করে ভয় দেখানো বন্ধ কর…
কি ঘটছে সেটা বোঝার আগেই, নিরীহ ভঙ্গিতে অনুরোধ জানাল সে।
হাত ধুয়ে নিল কিচেন সিঙ্কে। হাত না শুঁকিয়েই ফ্রিজ থেকে আইস কিউব বের করল তোমাকো। একটি গ্লাসে আইসকিউব রেখে ঢেলে নিল কোক। একবারেই সবটুকু কোক গিলে কাউন্টারে রেখে দিল গ্লাসটা। কিছুক্ষণ গ্লাসের মধ্যে থাকার পর গলে গেল আইসকিউব। কাঁপছে তোমাকো। হঠাৎ করেই শীত করছে তার। এখনও শুঁকিয়ে আছে গলা। ফ্রিজ থেকে কোকের বড় বোতলটা বের করে গ্লাসটা ভরে নিল সে। থরথর করে কাঁপছে তোমাকোর হাত। তার মনে হচ্ছে পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেউ। এমন কিছু, যেটাকে মানুষ বলা যায় না। তার চারপাশের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে মাংসের পচা গলা গন্ধ। গন্ধটা গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। এটা জাগতিক কিছু হওয়া সম্ভব নয়।
“থামো! দয়া করে, বন্ধ কর!” চিৎকার করে অনুনয় করল তোমাকো।
নিশ্বাস ফেলার মতো একটু পরপর জ্বলছে নিভছে সিঙ্কের ওপরের পনেরো ওয়াট ফ্লুরাসেন্ট বাল্ব। লাইটটা নতুন। কিন্তু এখন যা ঘটেছে সেটা বাস্তব ধারণার বাইরে। হঠাৎ করেই তোমাকোর ইচ্ছা হলো, কিচেনের সব লাইটের সুইচ অন করে দিতে। কিন্তু সুইচের কাছাকাছি যেতে পারল না সে। সামান্য ঘুরেও দাঁড়াতে পারল না পর্যন্ত। পিছনে কি কি আছে সেটা ভালোমতোই জানা আছে তার। পিছনে রয়েছে একটি জাপানি ঘরনার তাতামি ম্যাট, এক কোণায় তার দাদীমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে রাখা ছোট্ট বুদ্ধমূর্তি। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের ফাঁকা অংশের ঘাস দেখতে পেল সে। বাড়ির লাইটের সামান্য আলো পড়েছে ঘাসের ওপর। সেখানে অন্য কিছু থাকার কথা নয়।
এরইমধ্যে দ্বিতীয় গ্লাসের অর্ধেক কোক গিলে ফেলেছে তোমাকো। এক বিন্দুও নড়তে পারল না সে। একধরনের তীব্র অনুভূতি হলো তার। কোনোভাবেই কোনো উপস্থিতির কথা কল্পনাতেও আনতে পারছে না সে। কিন্তু সে নিশ্চিত, পেছনে রয়েছে কিছু একটা। এমনকি জিনিসটা এই মুহূর্তে স্পর্শ করছে তার কাঁধ।
“এমন যদি হয় এটা…” বাকিটা কল্পনাতেও আনতে চাইলো না তোমাকো। সে যদি এমনটা ভাবে তাহলে সেটাই সবসময় ধরে বসে থাকবে হয়তো। আর যদি এই ব্যাপারে না ভাবে, তবে হয়তো ভয়টা আর প্রশ্রয় পাবে না। কয়েক সপ্তাহ পর এমনিতেই ভুলে যাবে সে। সব সুইশির দোষ। ওর এটা বলা উচিত হয়নি… পরবর্তীতে নিজেদের বিরত রাখতে পারেনি ওরা। অবশ্য এরপর শহরে ফিরে এসে জীবন্ত, প্রাণবন্ত দৃশ্যগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি ওদের। মনে হয়েছিল পুরো ব্যাপারটাই একধরনের মজা। কেউ মজা করেছে ওদের সাথে। এইমুহূর্তে আনন্দের কোনো কিছু ভাবার চেষ্টা করল তোমাকো। এসবের বাইরে যেকোনো কিছু। কিন্তু এটা, এটা যদি সত্যি হয়…কেননা ফোন কিন্তু বেজেছিল, তাই না?
বাবা-মা কি করছ তোমরা বাইরে এতক্ষণ?
“বাসায় আসো জলদি!” চিৎকার করে উঠল তোমাকো।
চিৎকার করার পরেও ভয়ঙ্কর ছায়াটা সরে যাওয়ার কোনো লক্ষণ-ই দেখাল না। এখনও ছায়াটা রয়েছে তোমাকোর পিছনে। স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে করছে সঠিক সময়ের অপেক্ষা। অপেক্ষা সঠিক সুযোগের।
সতেরো বছর বয়সেও তোমাকোর জানা নেই প্রকৃত আতঙ্ক কি জিনিস। কিন্তু তার জানা আছে কল্পনায় ভয়ের অস্তিত্বের সৃষ্টি হয় নিজ তাগিদেই।
এটা সেই জিনিস-ই। হ্যাঁ, সেটাই হবে। একবার ঘুরে তাকালেই দেখব কিছু নেই। কিচ্ছু না।
পিছে ঘুরে তাকানোর অদম্য ইচ্ছা গ্রাস করেছে তোমাকোকে। নিশ্চিত হতে চাচ্ছে পিছনে কিচ্ছু নেই। এই চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বের হতে চাচ্ছে সে। কিন্তু বাস্তবেই কি এরকম কিছু ঘটবে? ভয়ের শীতল এক স্রোত বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড দিয়ে। মেরুদণ্ড দিয়ে কাঁধ হয়ে পুরো শরীরেই ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ের এই শীতল অনুভূতি। ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে তার টিশার্ট। তার শারীরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ও অনুভূতি হয়ে গিয়েছে দৃঢ়। যা একেবারে কল্পনার বাইরে।
…কেউ কি বলেছিল, তোমার দেহ, মনের চেয়ে বেশি সততা ধারণ করে?
তার মনের মধ্যে আবারও বলে উঠল : ঘুরে তাকাও। কিচ্ছু নেই সেখানে। গ্লাসের কোক শেষ করে গিয়ে পড়তে না বসলে কালকের পরীক্ষায় কি হবে সেটা বলাই বাহুল্য। গ্লাসের মধ্যে ভেঙে গেল একটা আইস কিউব। আইস কিউব ভাঙার শব্দেই অনুপ্রাণিত হয়েই যেন পিছে ঘুরে তাকালো তোমাকো।
.
৫ সেপ্টেম্বর, রাত ১০ : ৫৪ মিনিট
টোকিওর শিনগাওয়া স্টেশনের সামনের রাস্তার ইন্টারসেকশনের জ্বলে উঠেছে হলুদ লাইট। চাইলেই বেরিয়ে যেতে পারত সে। কিন্তু সেটা না করে ক্যাবটা থামাল কিমুরা। রোপভি ক্রসিংয়ের কাছাকাছি থেকে ভাড়া তোলার ব্যাপারে আশাবাদী সে। এখানে থেকে আকাসাকা বা রোপঙির উদ্দেশ্যে অনেক কাস্টমার-ই ক্যাবে ওঠে। কিন্তু এভাবে সিগন্যালে আটকা পড়লে ক্যাব থেকে তাদের নেমে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
রাস্তার প্রতিবন্ধক ও কিমুরার ট্যাক্সির মাঝামাঝি জায়গায় এসে থেমেছে একটি মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল আরোহী বয়সে তরুণ। পরনে জিন্স। মোটরসাইকেল জিনিসটা কিমুরাকে আতঙ্কিত করে তোলে। কারণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে মোটরসাইকেল এরকম ট্রাফিকের মধ্যেও পাশ কেটে বেরিয়ে যায়। যখন রাস্তার সিগন্যালে আটকা পড়তে হয় আর মোটরসাইকেল ক্যাবের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ক্যাবের দরজা ব্লক করে দেয়, সেসময় খুবই বিরক্ত লাগে কিমুরার। আর আজকে প্রায় সারাদিন-ই কাস্টমারদের নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তাকে। এমনিতেই মন মেজাজ খারাপ কিমুরার। বাইকারের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল কিমুরা। হেলমেটের কাঁচের আড়ালে ঢাকা পড়েছে বাইকারের চেহারা। হাঁটু সোজা করে সাইডওয়াকে এক পা ছড়িয়ে রেখেছে বাইকার। আর বেশ এলোমেলো ভঙ্গিতে নিজের শরীর নাচাচ্ছে সে।
সাইডওয়াক দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা গেল একজন আকর্ষণীয় পা- ওয়ালা যুবতীকে। যুবতীকে দেখার উদ্দেশ্য মাথা ঘোরাল বাইকার। কিন্তু তার দৃষ্টি যুবতীকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারল না। যুবতীর পেছন দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করতে গিয়ে প্রায় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বেঁকে গেল তার মাথা। যুবতী চলে গেছে বাইকারের দৃষ্টিসীমার বাইরে। বাইকারকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে যুবতী। কোনোকিছুর দিকে তাকিয়ে আছে বাইকার। জ্বলে উঠেছে ‘ওয়াক’ লাইট। তাড়াহুড়ো করে চলতে আরম্ভ করেছে এতক্ষণ ধরে রাস্তায় আটকে থাকা পথচারীরা। ছাড়িয়ে যাচ্ছে ট্যাক্সিকে। কেউই হাত তুলে ভাড়া করল না কিমুরার ক্যাব। ইঞ্জিন চালু করে সবুজ বাতি জ্বলার অপেক্ষায় থাকল কিমুরা। ঠিক তখনই বাইকারটা খিঁচুনি দিয়ে হাত উঁচু করে হেলে পড়ল কিমুরার ট্যাক্সির সাথে। আওয়াজ সৃষ্টি করে ক্যাবের দরজার কাছে পড়ে গেল সে। ট্যাক্সির ভেতর থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে না আর।
বালের দল যত্তসব।
নিশ্চিত ব্যালান্স হারিয়ে উল্টে পড়েছে ছেলেটা। ব্লিঙ্কার লাইট অন করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো কিমুরা। গাড়ির দরজার কোনো ক্ষতি হলে ছোড়াটার কাছে থেকে ক্ষতিপূরণ না নিয়ে ছাড়বে না, ভাবল সে। জ্বলে উঠেছে সবুজ বাতি। চলতে আরম্ভ করেছে কিমুরার আশেপাশের গাড়িগুলো। রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে বাইকার। রাস্তার ওপর কাঁপছে তার পা। প্রাণপণ চেষ্টা করছে মাথা থেকে হেলমেট সরানোর। ছেলেটার দিকে দেখার আগে নিজের রুটি রুজির উৎসের দিকে খেয়াল করল কিমুরা। ধারণা মতোই গাড়ির ডোর প্যানেলে পড়েছে বেশ বড়সড় স্ক্র্যাচ।
“শিট!” নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে রাস্তায় পড়ে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল কিমুরা।
তখনও হেলমেটের স্ট্র্যাপ টাইট করেই বাঁধা ছেলেটার চোয়ালে। হেলমেট খোলার জন্য সংগ্রাম চলছেই। দেখে মনে হলো পারলে নিজের মাথা ছিঁড়ে ফেলবে সে এতই কি কষ্ট হচ্ছে তার?
বড়সড় কোনো সমস্যা রয়েছে বাইক আরোহীর, এখন বুঝতে পারছে কিমুরা। অবশেষে ছেলেটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করল সে, “ঠিক আছো তুমি?”
হেলমেটের কাঁচের কারণে ছেলেটার মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পেল না সে। বাইকার চেপে ধরেছে কিমুরার হাত। মনে হলো কিছু একটা চাচ্ছে সে। বেশ জোরেসোরেই কিমুরার হাত চেপে ধরেছে সে। কিন্তু বলছে না কিছুই। হেলমেটের কাঁচ ওঠানোর লক্ষণও নেই। লাফিয়ে উঠল কিমুরা।
“একটু অপেক্ষা করো। আমি ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি।”
পাবলিক টেলিফোনের দিকে দৌড়ে গেল কিমুরা। কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না, সামান্য পড়ে যাওয়ার পর কীভাবে কারও অবস্থা এরকম হতে পারে। নিশ্চয়ই পড়ে গিয়ে কোনোভাবে মাথায় আঘাত লেগেছে তার।
নির্বোধের মতো চিন্তা করা যাবে না। হেলমেট ছিল ছেলেটার মাথায়, তাই না? দেখে তো মনে হয় না হাত-পা ভেঙেছে। আশা করছি কোনো ঝামেলায় পড়বো না…আমার গাড়িতে ছেলেটা কোনোভাবে আঘাত পেলে সেটা আমার জন্য ভালো কিছু নয়।
বিশ্রী একটা অনুভূতি হলো কিমুরার।
যদি সত্যি ছেলেটা গুরুতর আঘাত পায়, তবে আমার ইন্স্যুরেন্সের কোনো ঝামেলা হবে? মানে এক্সিডেন্ট রিপোর্ট, পুলিশি ঝামেলা…
ফোন রেখে ফিরে এসে দেখল ছেলেটার নড়াচড়া বন্ধ। নিজের গলা আঁকড়ে ধরেছে তার হাত। থেমে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছে বেশ কয়েকজন পথচারী। ভিড় ঠেলে ছেলেটার কাছে গেল কিমুরা। সবাইকে নিশ্চিত করতে চাইল, অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দিয়েছে সে।
“দাঁড়ান! দাঁড়ান! অ্যাম্বুলেন্স রাস্তায় আছে। এক্ষুণি চলে আসবে।” চোয়াল থেকে হেলমেটের স্ট্র্যাপ খুলে দিল কিমুরা। মাথা থেকে বেরিয়ে এলো হেলমেটটা। ছেলেটার হেলমেট খুলতে এত সংগ্রাম করতে হচ্ছিল কেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারল না কিমুরা। মুখ কুঁচকে গেছে ছেলেটার। একটা শব্দ দ্বারাই ছেলেটার চেহারার অভিব্যক্তি বর্ণনা করা যায়: আশ্চর্য্য। খোলা অবস্থায় রয়েছে ছেলেটার চোখ। বড় বড় হয়ে গেছে ছেলেটার চোখ দুটো। বের হয়ে আছে লাল জিহ্ববা। লালা ঝড়ে পড়ছে মুখের কোনা দিয়ে। সম্ভবত দেরি করে ফেলেছে অ্যাম্বুলেন্স। হেলমেট সরিয়ে গলায় হাত দিয়ে পালস বোঝার চেষ্টা করল কিমুরা। কিছুই অনুভব করল না সে। জমে গেল কিমুরা। পুরো দৃশ্যটা যেন বাস্তবতা বিবর্জিত।
এখনও ধীরগতিতে ঘুরছে মোটরসাইকেলের একটা চাকা। ইঞ্জিন লিক হয়ে গড়িয়ে পড়ছে তেল। রাস্তা বেয়ে নর্দমায় গিয়ে মিশছে সেগুলো। একটুও বাতাস বইছে না। রাতের আকাশ একেবারে পরিষ্কার। আবারও লাল বর্ণ ধারণ করেছে মাথার ওপরে স্পটলাইট। উঠে দাঁড়িয়ে, ধীরপায়ে সাইডওয়াকের কাছে হেঁটে গেল কিমুরা। সেখানে দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপর পড়ে থাকা ছেলেটার দিকে একবার তাকাল সে। হেলমেটের সাথে ঠেকে রয়েছে মাথাটা। বেঁকে আছে একেবারে ঠিকঠাক অ্যাঙ্গেলে। দেখতে অস্বাভাবিক লাগছে, যেভাবেই তাকানো হোক না কেন।
মাথাটা কি আমি-ই ওভাবে রাখলাম? আমি-ই কি মাথাটা হেলমেটের সাথে ঠেকিয়ে রেখেছি? বালিশের মতো? নাকি অন্যকিছু?
গত কয়েক সেকেন্ডে কি ঘটেছে মনে করতে পারল না কিমুরা। ছেলেটার খোলা অবস্থায় থাকা বড় বড় চোখ দুটো যেন চেয়ে আছে তার দিকেই। অজানা আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেল তার শরীর দিয়ে। হালকা উষ্ণ বাতাস অনুভব করল সে। গ্রীষ্মের সন্ধ্যা এখন, কিন্তু কাঁপতে থাকল কিমুরা।
অধ্যায় দুই
শরতের সকালের উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হচ্ছে ইম্পেরিয়াল প্যালেসের বাইরের অংশে। অবশেষে শেষ হয়েছে সেপ্টেম্বরের শ্বাসরুদ্ধকর গরম। সাবওয়ে প্লাটফর্মের অর্ধেক পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে কাজুইয়ুকি আসাকাওয়া। হঠাৎ করেই মত পরিবর্তন করল ও। নয় তলার ওপর থেকে দেখতে পাওয়া পানি কাছ থেকে দেখতে চাচ্ছে আসকাওয়া। ওর মনে হয়, এডিটোরিয়াল অফিসের দূষিত বাতাস ফিল্টার হয়ে বেজমেন্টে আসে। ঠিক বোতলের তলানীতে যেমনটা জমা হয় ওরকম। বাইরের মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চাচ্ছে ও। রাস্তায় নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। প্যালেসের সবুজ চত্ত্বর ওর সামনে। রিং রোডের ৫ নম্বর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নির্গত ধোঁয়া এসে জমা হয়েছে এখানে। অবশ্য দেখে খুব একটা বিষাক্ত মনে হচ্ছে না ওগুলো। উজ্জ্বল হয়ে আছে আকাশ। আবহাওয়া কিছুটা শীতল।
সারারাত কাজ করে শারীরিকভাবে ক্লান্ত আসাকাওয়া। কিন্তু খুব বেশি একটা ঘুম পায়নি ওর। প্রতিবেদন লেখা শেষ করে বেশ ঝরঝরে লাগছে আসাকাওয়ার। সচল হয়ে আছে মস্তিষ্কের কোষগুলোও। গত দুই সপ্তাহে একদিনের জন্যেও ছুটি নেয়নি আসাকাওয়া। আজ ও আগামীকাল বাড়িতে থেকে বিশ্রাম নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ওর। খুব সহজেই এডিটর ইন চিফের কাছে ছুটির অনুমতি নেয়া যাবে।
কুদানশিতার দিক থেকে একটি ফাঁকা ট্যাক্সি আসতে দেখল আসাকাওয়া। প্রবৃত্তির বশেই হাত উঁচিয়ে থামাল ট্যাক্সিটা। দুই দিন আগে মেয়াদ ফুরিয়েছে ওর তাকেবাশি থেকে শিনবাবা যাওয়ার কমিউটার পাসের। এখানে থেকে সাবওয়েতে করে কিতা শিনাগাওয়ায় ওর কন্ডোমিনিয়ামে ফিরতে চারশো ইয়েনের মতো খরচ হয়। কিন্তু এখন ক্যাবে করে যাওয়ার জন্য খরচ হবে প্রায় দুই হাজার ইয়েন। বাড়তি পনেরোশ ইয়েন খরচ করতে খুব একটা পছন্দ করে না আসাকাওয়া। কিন্তু সাবওয়েতে গেলে তিনবার ট্রান্সফারের ঝক্কি ও এইমাত্র পাওয়া পারিশ্রমিকের কথা ভেবে এবারের মতো ট্যাক্সিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।
আজকের দিনে, এই স্পট থেকে ট্যাক্সিতে চড়ার সিদ্ধান্ত খেয়ালের বশেই নিয়েছে আসাকাওয়া। বলা চলে কোনোপ্রকার চিন্তাভাবনা ছাড়াই নেয়া সিদ্ধান্ত এটা। সাবওয়ে থেকে ট্যাক্সিতে চড়ার মানসিকতা নিয়ে বের হয়নি ও। বাইরের মুক্ত বাতাসে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল ওর। ঠিক তখনই একটা ট্যাক্সি আসে, লালবাতি জ্বলছিল ট্যাক্সির ওপরে। এর মানে ট্যাক্সিটা ফাঁকা। তখনই টিকেট কিনে তিনটা আলাদা স্টেশন ধরে বাড়ি ফেরাটা বড় ঝক্কির কাজ মনে হয়েছে আসাকাওয়ার। যদি আসাকাওয়া আজকে কষ্ট করে সাবওয়ে দিয়েই বাড়ি ফিরত, তবে নিশ্চিতভাবেই কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা জীবনেও জোড়া লাগত না। গল্পের শুরু এরকম কাকতালীয় ঘটনার মধ্যে দিয়েই হয়।
প্যালেসসাইড বিল্ডিংয়ের সামনে থামল ট্যাক্সিটা। ড্রাইভার ছোটখাটো গড়নের। বয়স চল্লিশের মতো। দেখে মনে হলো সারারাত জেগে ছিল সেও। চোখ লাল হয়ে আছে ড্রাইভারের। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে ড্রাইভারের রঙিন ছবি রাখা। ছবির নিচে লেখা ড্রাইভারের নাম : মিকিয়ো কিমুরা।
“কিতা শিনাগাওয়া যাব।”
গন্তব্যের নাম শুনে মনে মনে নেচে উঠল কিমুরা।
কিতা শিনগাওয়া তার ক্যাব কোম্পানি গ্যারেজের ঠিক পাশেই। আর যেহেতু শিফট শেষ, ওদিকে এমনিতেও যেতে হতো তাকে। এসব মুহূর্ত, মানে যখন সব তার মনমত চলে, সেসময় তার মনে হয় ক্যাব চালানো তার জন্য কতটা উপভোগ্য। হঠাৎ তার মনে হলো কথা বলা দরকার।
“কোনো প্রতিবেদন লিখছেন নাকি?”
গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে আসাকাওয়া। ক্লান্তির কারণে চোখ লাল। নিজের মন শান্ত করার চেষ্টায় প্রশ্নটা করল ড্রাইভার।
“উহ?” সতর্ক হয়ে উত্তর দিল ও। ভাবছে ড্রাইভার কীভাবে ওর
পেশার ব্যাপারে জানতে পারল।
“আপনি পত্রিকার রিপোর্টার, তাই না?”
“হ্যাঁ, একটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের। আপনি জানলেন কীভাবে?” দীর্ঘ বিশ বছর ধরে ট্যাক্সি চালাচ্ছে কিমুরা। যাত্রী ওঠানোর স্পটের ওপর নির্ভর করে যাত্রীর পেশার ব্যাপারে ধারণা করতে পারে সে। সেইসাথে যাত্রীর কথা বলার ধরন, পোশাক দেখেও ধারণা করা সম্ভব। কোনো ব্যক্তি যদি উঁচু মানের কোনো পদে কর্মরত থাকে, আর এটা নিয়ে যদি সে গর্বিত হয়, তবে সবসময়ই সেই ব্যক্তি নিজের কাজ নিয়ে কথা বলতে প্রস্তুত।
“এত সকালেও কাজে ব্যস্ত থাকা নিশ্চয়ই খুব কঠিন।“
“না, ঠিক উল্টোটা। আমি বাড়ি ফিরছি। বাড়ি ফিরে ঘুমানো যাবে।”
“তাহলে আপনি আমার মতোই।”
নিজের কাজ নিয়ে খুব একটা গর্ববোধ করে না আসাকাওয়া। কিন্তু জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখে যে পরিমাণ সন্তুষ্ট হয়েছিল, আজও ঠিক একই রকম সন্তুষ্ট ও। অবশেষে শেষ হয়েছে ওর লেখা সিরিজ প্রতিবেদন। জনসাধারণের ভালো প্রতিক্রিয়াও আশা করা যায় এটা থেকে।
“আপনার কাজ কি মজাদার?”
“হ্যাঁ, আমার তো ওরকম-ই ধারণা,” অবিচ্ছিন্ন ভাবে বলল আসাকাওয়া। মাঝেমধ্যে ওর কাজ বেশ আনন্দের, মাঝেমধ্যে বিরক্তিকর। কিন্তু এখন ওসব বিস্তারিত প্যাঁচালে যেতে চাইল না ও। দুই বছর আগের নিজের মুখ থুবড়ে পড়া ব্যর্থতার কথা এখনও ভুলতে পারে না আসাকাওয়া। নিজের লেখা সেই প্রতিবেদনটির শিরোনাম এখনও স্পষ্ট মনে আছে ওর।
‘আধুনিককালের নতুন ঈশ্বর।”
এখনও মনের আয়নায় ভেসে ওঠে ওর তখনকার হতভাগ্য অবস্থা। এডিটর ইন চিফের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় ভাবে বলেছিল এই প্রতিবেদনে
আর কাজ চালাতে না পারার কথা।
কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা বিরাজ করল ট্যাক্সিতে। স্বাভাবিক গতিতেই টোকিও টাওয়ার ছাড়িয়ে মোড় নিল ট্যাক্সি ক্যাব।
“এক্সকিউজ মি,” বলল কিমুরা। “ক্যানাল রোড ধরে আগাবো নাকি ১নং কেইনি?” কিতা শিনগাওয়ার ঠিক কোন জায়গায় যাওয়া হবে সেটার ওপর নির্ভর করে রুট ধরে এগোতে হয়।
“এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে এগোন। শিনবাবার আগে নামিয়ে দিলেই হবে।” যাত্রীকে ঠিক কোথায় নামাতে হবে এটা জানা থাকলে একটু রিল্যাক্স থাকতে পারে ট্যাক্সি ড্রাইভার। ডানে ফুদা- নো- সুজির দিকে মোড় নিল কিমুরা। ঠিক ঐ জায়গাটার কাছাকাছি চলে এসেছে ট্যাক্সি। গত একমাসে এই জায়গাটার কথা মাথা থেকে বের করতে পারেনি কিমুরা। আসাকাওয়াকে তাড়া করে ফিরছে নিজের কর্মজীবনের ব্যর্থতা। এদিকে কিমুরা কারণবশত-ই ঐ অদ্ভুত এক্সিডেন্টটা চাইলেই স্পষ্ট মনে করতে পারে। কেননা এই এক্সিডেন্টের পিছে কোনো দায় ছিল না কিমুরার। সেজন্য নিজের বিবেকের কাছেও প্রশ্নবিদ্ধ নয় সে। দায় ছিল পুরোপুরি অপর পক্ষের। কিমুরার নেয়া কোনো পদক্ষেপও এক্ষেত্রে কাজে লাগত না। যে আতঙ্ক কিমুরার মাঝে ভর করেছিল সেটা পেছনে ফেলে আসতে পেরেছে সে। একমাস…খুব কি দীর্ঘ সময়? তবে দুইবছর আগের ব্যর্থতার আতঙ্ক এখনও তাড়া করে আসাকাওয়াকে।
এই জায়গা যতবারই ক্রস করে, প্রত্যেকবারই যাত্রীদের ঘটনাটা বলতে ইচ্ছে করে কিমুরার। কেন এই বীভৎস কাহিনি বলার এত স্পৃহা, সেটা জানা নেই তার। রিয়ারভিউ মিররে তাকিয়ে যদি দেখতে পায়, যাত্রী ঘুমাচ্ছে তবে আর কথা বাড়ায় না সে। আর যদি যাত্রী না ঘুমিয়ে থাকে তবে, ঐ অদ্ভুত ঘটনার খুঁটিনাটিসহ যাত্রীকে শোনায় কিমুরা। নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা। প্রত্যেকবার এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় ঐ ঘটনাটা বলা যেন একপ্রকার বাধ্যবাধকতা।
“মাসখানেক আগে আজব একটা ঘটনা ঘটেছিল এখানে…”
কাহিনি শুরু করার অপেক্ষায় থাকার সময়ই হলুদ থেকে লাল হয়ে গেল ট্রাফিক লাইট।
“বুঝতেই পারছেন, দুনিয়াতে কত অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।”
এভাবে বলা শুরু করে তার যাত্রীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করল কিমুরা। প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল আসাকাওয়া। কথাটা শুনে বিরক্তি নিয়ে মাথা তুলে তাকাল ও। কিমুরার কণ্ঠ শুনে চমকে উঠেছে আসাকাওয়া। বোঝার চেষ্টা করছে এই মুহূর্তে কোথায় ওরা।
“হঠাৎ মৃত্যু কি আজকাল বেড়ে গেছে নাকি? বিশেষ করে তরুণদের মধ্য।”
“উহ?” শব্দটা ধাক্কা দিলে আসাকাওয়ার কানে। হঠাৎ মৃত্য…বলতেই থাকল কিমুরা।
“যাইহোক, ব্যাপারটা এরকমই, প্রায় মাসখানেক আগের ঘটনা। ঠিক এই জায়গাতেই, ক্যাবের মধ্যে বসে ছিলাম আমি। ট্রাফিক লাইট বদলের অপেক্ষায়। ঠিক তখনই একটা মোটরবাইক আমার গাড়িতে এসে ধাক্কা খায়। এমন না বাইকটা চালাচ্ছিল বা নড়াচড়া করছিল সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করেই, ধপাস! এরপর কি হয়েছিল বলে মনে হয় আপনার? ওহ আর মোটরবাইক চালক? উনিশ বছর বয়সী, প্রিপেইটারি স্কুলের ছাত্র। জায়গাতেই মারা যায় সে, বেচারা। একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। এরপর অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ আসে। এরপর আমার ক্যাবটা দেখে, কারণ ক্যাবের সাথেই ধাক্কা খেয়েছিল সে। ভয়াবহ অবস্থা।”
চুপচাপ ঘটনাটা শুনছিল আসাকাওয়া। কিন্তু দশ বছরের অভিজ্ঞ একজন রিপোর্টার হিসেবে একধরনের প্রবৃত্তি কাজ করছে তার ভেতরে। সেই প্রবৃত্তির বশেই ড্রাইভার ও ক্যাব কোম্পানির নাম ও ঠিকানা নোট করে নিল ও।
“তার মরার ধরনও ছিল উদ্ভট। পাগলের মতো মাথা থেকে হেলমেট খোলার চেষ্টা করছিল সে। পিঠের ওপর ভর করে ছটফট করছিল। আমি অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দিতে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি মারা গেছে।”
“ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে বললেন?” পুরোপুরি সজাক হয়ে উঠেছে আসাকাওয়া।
“ঐ যে ওখানে। দেখতেন পাচ্ছেন?” ক্রসিংয়ের সামনের জায়গাটা নির্দেশ করল কিমুরা। শিনাগাওয়া স্টেশন তাকানাওয়া অঞ্চলের মিনাতো ওয়ার্ডে অবস্থিত। ব্যাপারটা মাথায় ভালোভাবে গেঁথে নিল আসাকাওয়া। ওখানকার কোনো এক্সিডেন্ট তাকানাওয়ার এখতিয়ারের মধ্যেই পড়ে। মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় চলছে আসাকাওয়ার। ভাবছে কে তাকে তাকানাওয়া পুলিশ স্টেশনে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবে। বড় ধরনের পত্রিকায় কাজ করার এই এক সুবিধা। এদের বড় বড় জায়গায় যোগাযোগ থাকে। মাঝেমধ্যে এদের তথ্য সংগ্রহের দক্ষতা পুলিশকেও হার মানায়।
“তাহলে ওরা এটাকে আকস্মিক মৃত্যু বলেছে?” ও নিশ্চিত নয় এটা কোনো মেডিকেল টার্ম কিনা। তাড়াহুড়োর সাথে জিজ্ঞেস করল আসাকাওয়া। ওর জানা নেই এই এক্সিডেন্ট কেন ওকে খোঁচাচ্ছে…
“হাস্যকর, তাইনা? আমার ক্যাব একদম দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটা এমনিতেই হুমড়ি খেয়ে ক্যাবের ওপর পড়ে। শুধু সে একাই। কিন্তু তবুও আমাকে এক্সিডেন্ট রিপোর্ট করতে হয়েছে। আমার ইন্স্যুরেন্স রেকর্ড পর্যন্ত চেক করেছে ওরা। ওদের জানিয়েছি, পুরো ব্যাপারটাই আকস্মিক। হুট করেই ঘটেছে।”
“ঘটনার দিন ও তারিখ কি আপনার স্পষ্টভাবে মনে আছে?”
“হা হা, প্রতিবেদনের গন্ধ পাচ্ছেন নাকি স্যার? সেপ্টেম্বর মাস ছিল। দাঁড়ান দেখি, চার কি পাঁচ তারিখ। সময় রাত এগারোটার কাছাকাছি, মনে হয়।”
কথাগুলো বলার পর ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেল কিমুরা। গুমোট আবহাওয়া, বাইকের ইঞ্জিন থেকে তেল গড়িয়ে পড়া। গড়িয়ে ড্রেনে পড়ার সময় ইঞ্জিনের তেলগুলো মনে হচ্ছিল একেবারে জীবন্ত কিছু। মোটরবাইকের জ্বলন্ত হেডলাইট পড়ে ছিল রাস্তার ওপর। শব্দহীন ভাবে বয়ে চলছিল ড্রেনের নোংরা পানি। নিজের দেহের সকল অনুভূতি বিকল হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল কিমুরার। সাথে সাথেই চোখের সামনে ভেসে উঠল মৃত ছেলেটার অজানা যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে যাওয়া চেহারা। হেলমেটের ওপর রাখা ছিল তার মাথা, ঠিক বালিশের মতো। কি এমন ঘটেছিল তার সাথে?
জ্বলে উঠেছে সবুজ ট্রাফিক লাইট। গ্যাস স্টেশনের দিকে এগোলো কিমুরা। ব্যাকসিট থেকে আসছে কাগজ কলমের শব্দ। নোট নিচ্ছে আসাকাওয়া। কেমন যেন বমি বমি ভাব হতে লাগল কিমুরার। সেদিনের প্রত্যেকটা ঘটনা তার এত স্পষ্টভাবে মনে থাকার কারণ কি? ঢোক গিলল সে। তিক্ত একটা স্বাদ অনুভূত হচ্ছে মুখের ভেতরে। ঢোক গেলার পর কমে গেল বমি বমি ভাব।
“মৃত্যুর কারণ কি যেন বললেন আপনি?” জিজ্ঞেস করল আসাকাওয়া।
“হার্ট অ্যাটাক।”
হার্ট অ্যাটাক। ময়নাতদন্তের পর মেডিক্যাল এক্সামিনার কি এটাই বের করেছিল? আসাকাওয়ার মনে হয় না এই টার্মটা ব্যবহার করেছে ওরা।
“আমাকে ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে হবে। দিন আর সময়টাও।” নোট নেয়ার সময় বিড়বিড় করে বলল আসাকাওয়া। “অন্যভাবে বলতে গেলে আর অন্য কোনোরকমের আঘাতের চিহ্ন-ই ছিল না?”
“হ্যাঁ, ঠিক। আঘাতের বিন্দুমাত্র চিহ্ন ছিল না। শুধু শক। মানে… ঘটনা দেখে আমারও শকে চলে যাওয়ার কথা, তাই না?”
“উহ?”
“মানে মৃতদেহের চেহারায় আকস্মিকতার ছাপ স্পষ্ট ছিল।”
কিছু একটা খেলে গেল আসাকাওয়ার মনে। একইসাথে ওর ভেতর থেকেই কোনো কণ্ঠ নাকচ করে দিল দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনার সম্পৃক্ত থাকার সম্ভাবনা। শুধুই একটা কাকাতলীয় ঘটনা, আর কিছুই না, ভাবলো ও।
কেইহিন কিউকোর শিনবাবা স্টেশনের লাইট দেখা যাচ্ছে সামনে। “লাইটের ওখানে গিয়ে বামে মোড় নিয়ে থামবেন।”
থেমে গেল ট্যাক্সি। খুলে গেছে ট্যাক্সির দরজা। ড্রাইভারের হাতে দুই হাজার ইয়েনের নোট ধরিয়ে দিল আসাকাওয়া। সেইসাথে একটা বিজনেস কার্ড।
“আমার নাম আসাকাওয়া। ডেইলি নিউজের রিপোর্টার। কোনো সমস্যা না থাকলে, পরে এই ব্যাপারে আরও ডিটেইলস জানতে চাই আপনার কাছে।”
“কোনো সমস্যা নেই,” বলল কিমুরা। সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাকে। মনে হচ্ছে মিশন সম্পন্ন হয়েছে তার।
“আমি কাল বা পরশু আপনাকে কল করব।”
“আমার নম্বর লাগবে?”
“কিছু মনে করবেন না, আপনার কোম্পানির নম্বর ও ঠিকানা লিখে নিয়েছি। বেশি দূরে নয় সেটা।”
ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে গেল আসাকাওয়া। দরজা বন্ধের সময় ইতস্ততবোধ করল ও। এতক্ষণ যা শুনলো সেসব থেকে অজানা এক ভয়ের অনুভূতি হচ্ছে ওর ভেতরে। এসব ফালতু ব্যাপারে হয়তো আমার নাক না গলানোই ভালো হবে, ভাবলো আসাকাওয়া। হতেই পারে এটা শুধুই সময়ের খেল। কিন্তু এতক্ষণে ভালোমত কৌতূহল জেগে উঠেছে ওর মধ্যে। চাইলেই বের হতে পারবে না এই ব্যাপারটা থেকে। সেটা খুব ভালোমতোই জানে আসাকাওয়া। কিমুরাকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করল ও :
“ব্যথায় কাতরাতে থাকা ছেলেটা মাথা থেকে হেলমেট খোলার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল, তাই না?”
অধ্যায় তিন
আসাকাওয়ার রিপোর্ট শুনে মুখ বিকৃত করল ওর এডিটর ওগুরি। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ল দুই বছর আগে কি হয়েছিল আসাকাওয়ার সাথে। রাত দিন নিজের ওয়ার্ড প্রসেসরের সামনে পড়ে থেকে গুরু শোকো কাগোয়ামার জীবনীর জন্য খাটাখাটনী করেছিল ও। একসূত্রে গাঁথার চেষ্টা করছিল ওর সব রিসার্চগুলো। সেসময় কিছু একটা ঠিক ছিল না ওর মধ্যে। এতই বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল, ওকে মনোবিদের কাছে পাঠানোর চেষ্টাও করেছে ওগুরি।
কিন্তু সমস্যাটা হলো ঐসময় খুব স্বাভাবিক-ই ছিল এরকম কিছু। কেননা বছর দুয়েক আগে, পুরো পাবলিশিং ইন্ডাস্ট্রিতে অদ্ভুতভাবে মাতামাতি শুরু হয়েছিল অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে। এডিটোরিয়াল অফিস ছেয়ে গিয়েছিল ‘ভূতের’ ছবিতে। দেশের প্রত্যেকটা পত্রিকা প্রকাশক মাঠে নেমেছিল বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত ব্যাপার স্যাপারের ছবি ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির খোঁজে। বলাই বাহুল্য সেসবের বেশিরভাগ-ই ছিল ভুয়া। কি হচ্ছে এসব, সেসময় ভেবেছিল ওগুরি। পত্রিকার এই জগৎটা সামলানোর ব্যাপারে ভালো রকমের অভিজ্ঞ ওগুরি, কিন্তু সেসময় এসব কার্যকলাপের কোনো ব্যাখ্যা ছিল না তার কাছেও। ব্যাপারটা প্রথমে উস্কে দিয়েছিল একেবারেই ভ্রান্ত কয়েকজন কন্ট্রিবিউটর। এরপর থেকে আক্ষরিক অর্থেই অফিস ডুবে যাচ্ছিল অকাল্ট ভিত্তিক মেইল আর প্যাকেজের সাগরে। শুধু ডেইলি নিউজ কোম্পানি এই বাড়াবাড়ির টার্গেট ছিল না। জাপানের অন্যান্য ছোটবড় পত্রিকাকেও সামলাতে হচ্ছিল এই আচমকা পরিস্থিতি। সময় নষ্ট করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সার্ভে চালানো হয়েছিল দাবিগুলোর সত্যতা যাচাইয়ে। ধারণা অনুযায়ী, বেশিরভাগ জমা পড়া অতিপ্রাকৃত কাহিনি-ই ছিল বেনামী, এটাও বলতে হয়, সেসবের মধ্যে ছিল না একই নামে পাঠানো একাধিক লেখা। হিসেব অনুযায়ী, এর অর্থ বিভিন্ন পত্রিকার প্রকাশকদের চিঠি পাঠিয়েছিল প্রায় দশ মিলিয়ন মানুষ। দশ মিলিয়ন মানুষ! সংখ্যাটা চোখ কপালে ওঠানোর মতো। কিন্তু অতটা ভয়ঙ্কর ছিল না পাঠানো কাহিনিগুলো। ফলাফল দাঁড়িয়েছিল, জাপানের প্রত্যেক দশজনের মধ্যে একজন অতিপ্রাকৃত ধরনের কিছু না কিছু লিখে পাঠাচ্ছিল পত্রিকা অফিসগুলোতে। যদিও পত্রিকা ইন্ডাস্ট্রির কেউ অথবা তাদের পরিবার বা বন্ধুরা কেউই ছিল না প্রেরকদের মধ্যে। কি হচ্ছিল এসব? কোথায় থেকে আসছিল এত মেইল? সবজায়গায় খোঁজ চালিয়েছিল সম্পাদকরা। কিন্তু কেউ কিছু খুঁজে পাওয়ার আগেই কমে যেতে লাগল এই উন্মাদনা। এই অদ্ভুত উন্মাদনা চলেছিল প্রায় ছয়মাস নাগাদ। এরপর হুট করেই স্বাভাবিক হতে লাগল এডটরিয়াল রুম। যেন জেগে উঠেছে কোনো দুঃস্বপ্ন থেকে। পরবর্তীতে এই ধরনের কিছু আর পায়নি কেউ
দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রগুলো কীভাবে ব্যাপারটায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেটা জানা ছিল ওগুরির কর্তব্য। ঘটনার উপসংহার হলো, তাদের উচিত ছিল পুরো ব্যাপারটা সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলা। কয়েকটা সস্তা ম্যাগাজিনের উস্কানিতেই এই উন্মাদনা শুরু হয়েছে, এমনটাই সন্দেহ ওগুরির। পাঠকদের পাঠানো ছবি ও কাহিনি ছাপিয়ে তারা এসব ব্যাপারে পাবলিকের সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছিল বিশালাকারের একটা অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি। যদিও ওগুরির জানা আছে, এভাবে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাকে যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করে কোনো ব্যবস্থা নিতেই হতো।
অবশেষে এডিটোরিয়াল অফিস থেকে সব মেইলগুলো না খুলেই ফেলা হয়েছিল চুল্লিতে। এভাবেই পুরো ব্যাপারটা সামলেছিল ওরা। এমনভাবে আচরণ করেছিল, যেন কিছুই ঘটেনি। কঠোর পলিসি মেনে চলছিল ওরা, অকাল্ট বা অতিপ্রাকৃত ব্যাপারে একটা শব্দও ছাপানো যাবে না। এমনকি কানে তোলেনি নামবিহীন কোনো সোর্সের পাঠানো তথ্যও। এসব ব্যবস্থা নেয়ার কারণেই কিনা ঠিক নিশ্চিত নয়, ভাটা পড়েছিল এই উন্মাদনার জোয়ারে। আর উন্মাদনার পুরো সময়টা নির্বোধের মতো ছোটাছুটি করেছিল আসাকাওয়া। জ্বালানি ঢালতে চেয়েছিল নিভে যাওয়া অগ্নিশিখায়।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আসাকাওয়ার দিকে তাকাল ওগুরি। আবারও কি একই ভুল করতে চলেছে ও?
“শোনো এখন তাহলে,” যখন কিছু বলার থাকে না সেসময় এভাবেই কথা বলা শুরু করে ওগুরি। শোনো এখন তাহলে।
“আমি জানি আপনি কি ভাবছেন স্যার।“
“আমি বলছি না, ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না। আমরা জানিনা কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কিন্তু দেখো, যেটা আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে, সেটা আগেরবারের মতো যদি কিছু হয়, তবে ব্যাপারটা আমার খুব বেশি ভালো লাগবে না।”
আগেরবার। বছর দুয়েক আগে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার স্যাপারে যে পাগলামি শুরু হয়েছিল সেটা ঠিক করা গেছে বলেই ধারণা ওগুরির। যেসব অনাকাঙ্খিত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে, এরপর থেকে অতিপ্রাকৃত জিনিসটাকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করেছে সে। দুই বছর পরেও একই আছে তার মনোভাব।
“আমি বলছি না এখানে রহস্যময় কিছু ঘটেছে। আমি শুধু বলছি, ঘটনাটা কাকতালীয় হতে পারে।”
“কাকতালীয় ঘটনা। হুমম…” কানে হাত দিয়ে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করল ওগুরি।
আসাকাওয়ার স্ত্রীর ভাগ্নি, তোমাকো ওশি। গত পাঁচ সেপ্টেম্বর, রাত এগারোটা নাগাদ হনমোকুতে নিজের বাড়িতে মারা গিয়েছে। মৃত্যুর কারণ হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। হাইস্কুলের সিনিয়র ক্লাসের শিক্ষার্থী ছিল সে। বয়স মাত্র সতেরো। একই দিনে, একই সময়ে মোটরসাইকেলে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে প্রিপেটারি স্কুলের একজন ছাত্র। তার বয়স উনিশ। মৃত্যুর কারণ, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ। শিনগাওয়া স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে, ট্রাফিক সিগন্যালের অপেক্ষায়।
“ব্যাপারটা কাকতলীয় ঘটনা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। ক্যাব ড্রাইভারের কাছে এক্সিডেন্টের ঘটনা শোনার পর, স্ত্রীর ভাগ্নির কথা মনে পড়েছে তোমার। এর বেশি নয়, তাই কি?”
“অপরদিকে,” বলতে শুরু করেছে আসাকাওয়া। প্রতিক্রিয়া দেখায় কিনা সেটা দেখার জন্য একটু থামল ও। এরপর আবার বলতে আরম্ভ করল, “মোটরসাইকেলের ছেলেটা মৃত্যুর আগে মাথা থেকে হেলমেট খোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল।”
“…তো?”
“তোমাকোর মৃতদেহ দেখার পরেও মনে হয়েছিল সে যন্ত্রণায় নিজের মাথা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেছে। চুলের সাথে বিঁধে ছিল তার আঙুলগুলো।”
বেশ কয়েকবার তোমাকোর সাথে দেখা হয়েছে আসাকাওয়ার। অন্যান্য স্কুল বালিকাদের মতো সেও বেশ যত্নশীল ছিল চুলের ক্ষেত্রে। প্রতিদিন শ্যাম্পু করত, বিভিন্নভাবে যত্ন নিত। চুলের ব্যাপারে যত্নশীল একজন কেন এভাবে চুল ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করবে? তার এরকম আচরণের প্রকৃত কারণ জানা নেই আসাকাওয়ার। কিন্তু যতবারই ও মৃত্যুর আগে তোমাকো পাগলের মতো চুল ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টার কথা ভেবেছে ততবারই ওর মনে হয়েছে, কোনো অজানা, ভয়ানক কোনো আতঙ্কের মুখোমুখি হয়েছিল তোমাকো।
“আমি জানি না আসলে। শোনো তাহলে এখন। তুমি কোনো কুসংস্কারের পেছনে ধাওয়া করছ না, এই ব্যাপারে নিশ্চিত তো? যদি দুটো ঘটনার ওপর আটঘাট বেঁধে দৃষ্টিপাত করো তবে স্বাভাবিকভাবেই কিন্তু অনেক মিল পাওয়া যায়। তুমি বলছ, দুজনেই হার্ট এটাকে মারা গিয়েছে। সুতরাং দুজনকেই প্রচুর কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। ফলে মেয়েটা ব্যথায় চুল ছেড়ার চেষ্টা করেছে, আর ছেলেটা প্রাণপণ হেলমেট খোলার… আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হচ্ছে।”
এটা শুধুই একটা সম্ভাবনা, সেটা বুঝতে পারার পর মাথা ঝাঁকাল আসাকাওয়া। এত তাড়াতাড়ি হার মানবে না ও।
“কিন্তু স্যার, সেক্ষেত্রে ব্যথাটা তো বুকে হওয়ার কথা। মাথাটা কেন টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করবে?”
“আচ্ছা শোনো তাহলে। তোমার কি কখনো হার্ট এট্যাক হয়েছে?”
“জ্বি না।”
“কোনো ডাক্তারকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছ?”
“কোন ব্যাপারে?”
“হার্ট এট্যাক হলে কেউ মাথা টেনে ফেলার চেষ্টা করে কিনা?”
নীরব হয়ে গেল আসাকাওয়া। সত্যি বলতে জিজ্ঞেস করেছিল সে। ডাক্তারের জবাব ছিল : সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়া যায় না। উত্তরটা ধোঁয়াশা যুক্ত। মোটের ওপর মাঝেমধ্যে বিপরীতও ঘটতে পারে। মানে কোনো ব্যক্তি সেরিব্রাল হেমোরেজ অথবা সেরিব্রাল মেমব্রেন রক্তক্ষরণের শিকার হলে মাথায় প্রচুর যন্ত্রণার সাথে পাকস্থলীতেও অস্বস্তিবোধ করে।
“তাহলে এটা নির্ভর করছে আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর। কঠিন অঙ্কের সমস্যা সমাধানে কেউ মাথা চাপড়ায় কেউ আবার সিগারেট ধরায়। কেউ কেউ আবার হাত দিয়ে পেটও ঘষে।” নিজের সুইভেল চেয়ারে ঘুরিয়ে বলল ওগুরি। “মূল কথা হলো, এই অবস্থায় আমরা কিছুই বলতে পারছি না, তাই না? এধরনের ব্যাপারে আমাদের আর কোনো স্কোপ নেই। কারণ দুই বছর আগে কি ঘটেছিল সেটা ভালোমতোই জানো তুমি। আমরা এসব ব্যাপারে হাত-ই লাগাব না, এমনকি হালকা ভাবেও না। তবে যদি ছাপানোর যোগ্য কোনো যুক্তিযুক্ত কিছু হয়, তাহলে অবশ্যই ভেবে দেখা যায়।”
হয়তো সত্যি রয়েছে কোনো রহস্য। অথবা হয়তো ওর এডিটর যেমনটা বলল ঠিক তেমনই, শুধুই একটা কাকতলীয় ঘটনা এটা। কিন্তু তারপরও শেষে গিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানিয়েছিল ডাক্তার। সত্যি কি হার্ট এট্যাকের শিকার হওয়া কেউ মাথার চুল টেনে ছেড়ার চেষ্টা করে, বেশ জোরালো ভাবেই প্রশ্নটা করেছিল ও। হুমম, ভ্রুকুচকে জবাব দিয়েছিল ডাক্তার। তবে তার চেহারা বলছিল, সে কোনো রোগীকে এমনটা করতে দেখেনি।
“জ্বি স্যার, আমি বুঝতে পেরেছি।”
এই মুহূর্তে আপাতত চুপচাপ থাকা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই ওর। দুটো ঘটনার মধ্যে জোরালো কোনো সম্পৃক্ততা বের করতে না পারলে ওর এডিটরের মন গলানো মুশকিল হবে। কিছু না খুঁজে পেলে এই ব্যাপারে আর মাথা ঘামাবে না, নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করল আসাকাওয়া।
অধ্যায় চার
ফোন রেখে দিল আসাকাওয়া। অনুভূতিহীনভাবে রিসিভারে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকল ও। নিজের অহেতুক উত্তেজনা মিশ্রিত কণ্ঠস্বরের ফলে ফোনের অপর প্রান্তের মানুষের প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন এখনও কানে লেগে আছে ওর। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে কাজটা করতে সক্ষম হবে না ও। সেক্রেটারির কাছে থেকে ফোনটা ধরার পর বরাবরের মতোই আত্মম্ভরি ভঙ্গিতে কথা বলছিল ফোনের অপর প্রান্তের লোকটা। কিন্তু আসাকাওয়ার প্রস্তাব শুনে কথার সুর একটু নরম হয়েছিল তার। আসাকাওয়া সম্ভবত বিজ্ঞাপনের জন্য ফোন করেছে, প্রথমে ভেবেছিল সে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে মনে হিসেব করে দেখেছে তাকে নিয়ে লেখা আর্টিকেলের লাভের মাত্রা। সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে এখনও চলছে ‘টপ ইন্টারভিউ’ নামক সিরিজটা। আইডিয়াটা ছিল সিইওদের স্পটলাইটে নিয়ে আসা। যারা নিজ চেষ্টায় গড়ে তুলেছে নিজেদের কোম্পানি। মূলত সফলতার পথে তাদের বাঁধা-বিপত্তি ও সেগুলো পেরোনোর ইতিহাসের ওপরেই ফোকাস করার কথা। বড় মাপের এক কর্তাব্যক্তির ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য অ্যাপয়নমেন্ট যেভাবে জোগাড় করল সেটা বিবেচনা করে হলেও আরেকটু সন্তুষ্টির সাথে ফোনটা রাখতে পারত আসাকাওয়া। কিন্তু কোনো কিছু চেপে রয়েছে ওর বুকে। আসাকাওয়ার ভয় এসব একঘেয়ে সংকীর্ণমনা ব্যক্তি, তাদের বলা বস্তাপচা কর্পোরেট গল্প, বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সুযোগ সৃষ্টি করার গর্ব… আসাকাওয়া যদি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন না কেটে দিত তবে চলতেই থাকত লোকটার প্যাঁচাল। এসব নিয়ে চরম মাত্রায় বিরক্ত আসাকাওয়া। এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত সবাইকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে ও। ভালোমতোই জানা আছে ওর, ম্যাগাজিনকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিজ্ঞাপন দরকার। আর এই ধরনের ইন্টারভিউ আর আর্টিকেল বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য রাস্তা বাতলে দেয়। কিন্তু কোম্পানি লাভ নাকি ক্ষতি করল সেটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না আসাকাওয়া। কাজটা উপভোগ্য কিনা, সেটাই ওর কাছে মুখ্য। কোনো কাজ যতই সহজ হোক না কেন, কাজে যদি যথেষ্ট সৃজনশীলতা ও চিন্তাভাবনার জায়গা না থাকে তবে নিঃসন্দেহে কাজটা আপনার কাছে বিষিয়ে উঠবে।
চতুর্থ তলার আর্কাইভের দিকে এগোলো আসাকাওয়া। আগামীকালের ইন্টারভিউয়ের জন্য কিছু কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে ওকে। কিন্তু অন্য কিছু একটা খোঁচাচ্ছে আসাকাওয়াকে। উত্তেজিত হচ্ছে দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনার মোটিভ ও সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনার কথা ভেবে। ঠিক তখনই মনে পড়ল। কোথায় থেকে কীভাবে কাজটা শুরু করবে, সেটা জানা নেই ওর। ঠিক সেই মুহূর্তে খেয়াল করল ঐ অদ্ভুত ঘটনাটা ভাবার সাথে সাথেই মানসিকভাবে বেশ হালকা বোধ করছে ও।
পাঁচ সেপ্টেম্বর রাত এগারোটায় দুটো হঠাৎ করে ঘটা ব্যাখ্যাবিহীন মৃত্যু কি একইসূত্রে গাঁথা?
যদি তাই-ই হয়, আর যদি এরকম আরও কিছু একই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে ব্যাপারটা কাকতালীয় হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিককার সময়ের পত্রিকাগুলো একটু ঘেঁটে দেখার সিদ্ধান্ত নিল আসাকাওয়া। বিন্দুবিসর্গ সহ খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়া ওর চাকরীর-ই অংশ। কিন্তু স্থানীয় পত্রিকাগুলোর শুধুমাত্র হেডলাইন পড়ে আসাকাওয়া। ফলে ভালো রকমের সম্ভাবনা রয়েছে কোনো কিছু চোখ এড়িয়ে যাওয়ার। এমনটাই ঘটেছে, মনে হলো ওর। মনে হচ্ছে মাসখানেক আগে স্থানীয় পত্রিকার পাতার একেবারে কোণায় একটা অদ্ভুত শিরোনাম দেখেছিল ও। ছোট্ট একটা প্রতিবেদন ছিল সেটা, পত্রিকার পাতার একেবারে নিচে বাম দিকে। ওর মনে আছে, পত্রিকার কোন অংশে এসেছিল খবরটা। আসাকাওয়ার মনে পড়ল, শিরোনামটা পড়ে কিছু একটা ভাবছিল ও, ঠিক তখনই পেছন ডেস্ক থেকে কেউ একজন ডেকে উঠেছিল ওকে। পরবর্তীতে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে আর পড়া হয়ে ওঠেনি ঐ প্রতিবেদন।
কিশোর বয়সের গুপ্তধন সন্ধানের রোমাঞ্চ নিয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর সকালের পত্রিকা খোঁজ করতে আরম্ভ করল আসাকাওয়া। ও নিশ্চিত, পাওয়া যাবে কোনো ক্লু। আর্কাইভ থেকে মাসখানেক পুরোনো পত্রিকা পড়া ওকে মানসিকভাবে স্বস্তি দেয়, যেটা একঘেয়ে ইন্টারভিউ কখনোই দিতে পারে না। দৌড়াদৌড়ি করে মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়ার চাইতে এই ধরনের কাজে বেশি উপযুক্ত আসাকাওয়া।
অবশেষে ৭ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যার সংস্করণে খুঁজে পাওয়া গেল প্রতিবেদনটি। পত্রিকার যে অংশে ভেবেছিল ঠিক সেখানেই। জাহাজডুবির কারণে ৩৪ জনের মৃত্যুর খবরের পাশে পত্রিকার পাতায় খুব কমই অংশ পেয়েছে এই প্রতিবেদনটি। সন্দেহাতীতভাবেই চোখ এড়িয়ে গেছে সেটা। সিলভার রিমের চশমাটা পড়ে পত্রিকায় মুখ ডুবিয়ে দিল আসাকাওয়া। পড়তে শুরু করেছে প্রতিবেদন।
.
রেন্টাল কারের মধ্যে তরুণ যুগলের অস্বাভাবিক মৃত্যু
৭ তারিখ ভোর ছয়টা পনেরো নাগাদ আশিনার ইয়াকুশায় একটি ফাঁকা লটে, রেন্টাল কারের মধ্যে দুজন তরুণ তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ঐ রাস্তা পার হওয়ার সময় লাশ দুটো দেখতে পায় একজন ট্রাক ড্রাইভার। এরপর ইয়াকুশা থানায় ব্যাপারটা জানায় সে। কারের রেজিস্ট্রেশন থেকে জানা যায়, ঐ দুজন স্কুল শিক্ষার্থী। ছেলেটা টোকিওর শিবুওয়া অঞ্চলের প্রিপেটারি স্কুলের ছাত্র (বয়স ১৯) আর মেয়েটা ইয়োকাহামার ইসোগো অঞ্চলের প্রাইভেট গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী (বয়স ১৭)। শিবুওয়ার এক এজেন্সি থেকে দুদিন আগে সন্ধ্যায় ভাড়া নেয়া হয়েছিল কারটা। ভাড়া করেছিল প্রিপেটারি স্কুলের শিক্ষার্থী দুজন-ই খুঁজে পাওয়ার পর গাড়িটি ছিল লকড় অবস্থায়। তখনও ইগনিশনে চাবি লাগানো। মৃত্যুর সম্ভাব্য সময়কাল পাঁচ তারিখ মাঝরাত থেকে ছয় তারিখ ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত যেকোনো সময়। যেহেতু গাড়ির কাঁচ ওঠানো ছিল, সেকারণে হয়তো যুগল শ্বাসরোধের ফলে মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না প্রেমে পাগল হয়ে ওভারডোজ ড্রাগ সেবনের ফলে সুইসাইডের সম্ভাবনাও। মৃত্যুর আসল কারণ সনাক্ত সম্ভব হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত খুনের আলামত নেই।
.
এটুকুই ছিল প্রতিবেদনটি। কিন্তু আসাকাওয়ার মনে হলো কিছু একটা পেয়ে গেছে ও।
প্রথমত যে মেয়েটা মারা গেছে তার বয়স সতেরো। ইয়োকাহামার গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল মেয়েটা। ঠিক ওর ভাগ্নী তোমাকোর মতো। আর গাড়ি ভাড়া করা ছেলেটা প্রিপেটারি স্কুলের শিক্ষার্থী, ঠিক শিনগাওয়া স্টেশনের সামনে মৃত্যবরণ করা ছেলেটার মতো। মৃত্যুর সম্ভাব্য সময়কাল ও আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে একই। এই ক্ষেত্রেও মৃত্যুর কারণ অজানা।
এই চারটি মৃত্যুর মধ্যে থাকতে পারে কোনো সম্পর্ক। চারটি মৃত্যুর মধ্যেকার মিলগুলো খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগবে না। মোটের ওপর বড়সড় একটা পত্রিকায় চাকরি করে আসাকাওয়া। তথ্য ও তথ্যের উৎসের অভাবে অন্তত ভুগতে হবে না ওকে। প্রতিবেদনটি কপি করে এডিটোরিয়াল অফিসের দিকে এগিয়ে গেল ও। সোনার টুকরো হাতে পেয়েছে বলে মনে হলো ওর। নিজে থেকেই শান্তি ফিরে এসেছে ওর মনে। এলিভেটরে ওঠার জন্য অপেক্ষা করল না আসাকাওয়া।
ইয়াকুশা সিটি হলো প্রেসক্লাব। নিজের ডেস্কে বসে আছে ইয়োশিনো। খসড়ার ওপর কলম চালাচ্ছে সে। এক্সপ্রেসওয়েতে ভীড় না থাকলে টোকিও থেকে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে এখানে পৌঁছাতে। ইয়োশিনোর পিছে এসে দাঁড়িয়ে তার নাম ধরে ডাকল আসাকাওয়া।
“হাই, ইয়োশিনো।”
গত দেড় বছর ইয়োশিনোর সাথে দেখা হয়নি আসাকাওয়ার।
“হুহ? হাই আসাকাওয়া। হঠাৎ ইয়াকুশায় কি মনে করে? এখানে এসে বসো।”
ডেস্ক থেকে একটা চেয়ার টেনে বের করে আসাকাওয়াকে বসতে বলল ইয়াশিনো। দাঁড়ি কামানো নেই ইয়াশিনোর। অদ্ভুত রকমের নিরীহ দেখাচ্ছে তাকে। কিন্তু মানুষকে বুঝতে পারার ভালো গুণ রয়েছে তার মধ্যে।
“ব্যস্ত নাকি তুমি?”
“বলতে পারো।”
আসাকাওয়া যখন স্থানীয় সংবাদ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতো সেসময় থেকে ইয়াশিনোর সাথে ওর পরিচয়। যদিও ইয়াশিনো চাকরিতে প্রবেশ করেছে ওর তিন বছর আগে। তার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ।
“ইয়াকুশা অফিসে ফোন দিয়েছিলাম। ওখানে থেকেই জানলাম তুমি এখন এখানে।”
“কেন? কোনো দরকার আছে নাকি?”
ইয়াশিনোর বানানো প্রতিবেদনের কপি তার হাতে ধরিয়ে দিল আসাকাওয়া। দীর্ঘ মুহূর্ত ধরে সেটার দিকে চেয়ে থাকল ইয়াশিনো। যেহেতু প্রতিবেদনটি তার লেখা সেহেতু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই কি লেখা রয়েছে ওতে সেটা বুঝতে পারার কথা। এতই মনোযোগ দিয়ে আর্টিকেলটি দেখছে, হাতে থাকা বাদামও মুখে তুলতে ভুলে গেছে ইয়াশিনো। মনে হচ্ছে, প্রতিবেদনে আসলে কি লিখেছিল সেটা নজর বুলিয়েই স্মৃতি থেকে বের করার চেষ্টা করছে সে।
“কি হয়েছে এটার?” গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বলল ইয়াশিনো।
“তেমন কিছু না। আমি আরেকটু বিস্তারিত জানতে চাচ্ছিলাম শুধু।”
উঠে দাঁড়িয়েছে ইয়াশিনো, “পাশের রুমে চলো। কফি বা অন্য কিছু খেতে খেতে আলাপ করা যাবে।
“তোমার হাতে সময় আছে তো? বিরক্ত করছি না তো আবার?”
“কোনো সমস্যা নেই। যা করছিলাম তার থেকে এটা বেশি ইন্টারেস্টিং।”
সিটি হলের পাশে রয়েছে ছোট্ট একটা ক্যাফে। দুশো ইয়েনে এক কাপ কফি পাওয়া যায় সেখানে। ইয়াশিনো বসে কাউন্টারের দিকে ঘুরল : “দুইটা কফি।” এরপর আসাকাওয়ার দিকে ফিরে আরেকটু এগিয়ে বসল সে। “আচ্ছা, জানো তো, বারো বছর ধরে আঞ্চলিক খবরগুলো নিয়ে কাজ করছি আমি। বহু জিনিস দেখেছি নিজের চোখে। কিন্তু এই ব্যাপারটার মতো উদ্ভট কিছু আগে কখনোই দেখিনি।”
এক চুমুক পানি খাওয়ার জন্য থামল ইয়াশিনো। আবার শুরু করল সে, “আসাকাওয়া, দেখো এক্ষেত্রে আমাদের মাঝে তথ্যের বিনিময়টা যেন ফেয়ার হয়। মেইন অফিসের কেউ কেন এটার ব্যাপারে আগ্রহী হবে?”
তাকে কিছু জানানোর জন্য প্রস্তুত নয় আসাকাওয়া। নিজেই পুরো কাজটা করতে চাচ্ছে ও। ইয়াশিনোর মতো অভিজ্ঞ কেউ এই ব্যাপারে যদি সামান্য আঁচও পায়, তবে নিঃসন্দেহে পুরো কেসটা বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। বাধ্য হয়েই মিথ্যের আশ্রয় নিল আসাকাওয়া।
“না, তেমন কোনো বিশেষ কারণ নেই। মৃত মেয়েটা আমার ভাগ্নীর বান্ধবী ছিল। তার মৃত্যুর ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য মাথা খারাপ করে দিচ্ছে সে। ফলে আমাকে এখানেই….
মিথ্যেটা খুবই দুর্বল। ইয়াশিনোর চোখে সন্দেহের আভাস দেখতে পেল বলে মনে হলো আসাকাওয়ার। কিছুটা বিচলিত বোধ করল ও।
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। সে হাইস্কুলের শিক্ষার্থী। বন্ধুর মৃত্যু তার জন্য খুবই খারাপ কিছু। তার ওপর পরিস্থিতি আবার এরকম। আমাকে এই ব্যাপারে খুঁচিয়েই চলেছিল সে। আমিও তোমার কাছে সাহায্য চাইছি। একটু বিস্তারিত জানাও।”
“তো কি জানতে চাচ্ছ তুমি?”
“ওদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা গিয়েছিল?”
মাথা নাড়ল ইয়াশিনো। “ওরা শুধু জানিয়েছে মৃত্যুর কারণ হঠাৎ করে হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। তবে এর কারণ কি সেই ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই ওদের।”
“মার্ডার কিনা খতিয়ে দেখেছে? ধরো, শ্বাসরোধে হত্যা ধরনের কিছু।“
“অসম্ভব। কাঁধে সামান্য একটা দাগও ছিল না।”
“মাদক?”
“অটোপসিতে সেটারও কোনো হদিস মেলেনি।”
“মানে স্পষ্টভাবে বললে কেসটা সমাধান হয়নি।”
“নাহ, বাল। কোনো সমাধান-ই হয়নি। এটা খুন নয়, এমনকি সত্যি বলতে এটা কোনোধরনের ঘটনায় না। হয় ওরা অসুস্থতার কারণে মরেছে অথবা কোন ধরনের দুর্ঘটনার শিকার, এটুকুই। এরকম কিছুই হবে। এমনকি কোনো তদন্তও করা হয়নি।”
পুরোই নিরেট একটা বিষয়। নিজের চেয়ারে হেলান দিল ইয়াশিনো ১ “তাহলে ওরা কেন মৃতের নাম প্রকাশ করেনি?”
“মৃতদের বয়স কম। সেইসাথে সন্দেহ ছিল এটা প্রেমঘটিত আত্মহত্যা।”
এই পর্যায়ে হঠাৎ করেই হাসল ইয়াশিনো। মনে হলো কিছু একটা মনে পড়েছে তার। আবার সামনের দিকে হেলে আসল সে।
“জানো, ছোড়াটার প্যান্ট আর জাঙ্গিয়া হাঁটুর নিচ পর্যন্ত নামানো ছিল। আর মেয়েটার প্যান্টিও।”
“তো, তোমার মতে ওরা যৌনকর্মে লিপ্ত ছিল।”
আমি সেটা বলিনি। ওরা কেবল সেটার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
“নাহ, আর মজা লুটার প্রস্তুতি নেয়ার সময়ই, ব্যাস! তখনই ঘটনাটা ঘটে, “ দুই হাতে তালি দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাল ইয়াশিনো।
“তখনই কি ঘটে?”
ঘটনার যতটুকু জানা গেছে সেটার পুরোটাই জানাল ইয়াশিনো।
“ঠিক আছে আসাকাওয়া। অনেক কিছুই জানলে। মানে এমন কিছু যা কেসগুলোর সাথে সম্পৃক্ততা তৈরি করে। তাই না?”
জবাব দিল না আসাকাওয়া।
“আমি গোপন রাখব। এমনকি তোমার কাছে থেকে কেস ছিনিয়েও নিব না। আমি এই ব্যাপারটাতে শুধুই আগ্রহী।”
এখনও নীরব-ই রয়েছে আসাকাওয়া।
“এভাবেই আমাকে সাসপেন্সের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখবে নাকি?”
আমার কি বলা উচিত…আমি পারব না। এখন কিছুই বলব না। কিন্তু মিথ্যে কখনো টিকে থাকে না, ভাবল আসাকাওয়া।
“দুঃখিত ইয়াশিনো। তুমি আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারবে? এখনই কিছু বলতে পারছি না। তবে দুই তিনদিনের মধ্যে কিছু একটা জানাতে পারব। কথা দিচ্ছি।”
হতাশা ছেয়ে গেল ইয়াশিনোর চেহারায়।
“তুমি বললে সেটাই হবে…”
অনুনয়ের ভঙ্গিতে তার দিকে তাকাল আসাকাওয়া। ঘটনাটা বলে যেতে বলছে তাকে।
“যাইহোক, আমাদের ধরে নিতে হবে কিছু একটা ঘটেছে। একটা ছেলে ও মেয়ে ঠিক সেক্স করার আগমুহূর্তে শ্বাসরোধে মারা গেছে? এটা মজার কিছু নয়। হতে পারে আগে থেকেই কোনো বিষ সেবন করেছিল ওরা, যার প্রতিক্রিয়া সেই সময় ঘটেছে। কিন্তু বিষের কোনো আলামত নেই। অবশ্যই কিছু ধরনের বিষ গ্রহণের পর কোনো আলামত পাওয়া যায় না। তবে সামান্য দুজন স্টুডেন্টের পক্ষে ওরকম বিষ ম্যানেজ করা সম্ভব নয়।”
যে জায়গায় গাড়িটা পাওয়া গিয়েছে সেখানকার কথা ভাবল ইয়াশিনো। নিজেও ঐ জায়গায় গিয়েছিল সে। ফলে স্পষ্ট ধারণা আছে তার। এক খণ্ড ফাঁকা জমির ওপর পার্ক করা ছিল গাড়িটা। জায়গাটা আশিনা থেকে মাউন্ট ওকুণ্ড যাওয়ার পথে একটা কাঁচা রাস্তার পাশে। ফাঁকা জমিটার পাশে ছিল একটা গিরিখাতও। মেইন রোড দিয়ে কোনো গাড়ি যাওয়ার সময় শুধুই মাঠের মধ্যে থাকা গাড়িটার পেছনের লাইটের প্রতিফলন দেখতে পাবে। কেন এমন জায়গায় দুজন স্কুল শিক্ষার্থী গাড়ি পার্ক করেছিল সেটা ধারণা করতে আইনস্টাইন হওয়া লাগে না। রাত নামার সাথে সাথে ঐ রাস্তা দিয়ে খুবই কম গাড়ি যাতায়াত করে। আর গাছগাছালিও রয়েছে চারপাশে। দুজন স্কুল পড়ুয়ার নিজেদের আড়াল করার জন্য একেবারে নিখুঁত জায়গা সেটা।
“এরপর, ছেলেটাকে স্টিয়ারিং হুইলে মাথা ঠেকিয়ে রাখা অবস্থায় সাইড উইন্ডো দিয়ে দেখা গেল। আর মেয়েটার মাথা প্যাসেঞ্জার সিট ও দরজার মাঝামাঝি ঠেকিয়ে রাখা ছিল। এই অবস্থাতেই মৃত্যু হয় ওদের। গাড়ি থেকে ওদের লাশ বের করা আমি নিজ চোখে দেখেছি। গাড়ির দরজা খোলার সাথে সাথেই দুটো বডি গড়িয়ে বাইরে পড়ে। দেখে মনে হয়েছিল মৃত্যুর সময় কোনো অজানা শক্তি চেপে ধরেছিল ওদেরকে। মৃত্যুর পরেও প্রায় ত্রিশ ঘণ্টা চেপেই ধরে রেখেছিল ওদের দেহ। যতক্ষণ না ইনভেস্টিগেটররা গাড়ির দরজা খুলে ওদের উদ্ধার করে। যা বলছি বুঝতে পারছ?
দুই দরজাওয়ালা গাড়ি এইটা। ঐ ধরনের গাড়ি এইটা যেখানে চাবি ভেতরে থাকলে দরজা লক করা সম্ভব না। আর চাবি ছিল ইগনিশনে। কিন্তু গাড়ির দরজা…বুঝতেই পারছ। গাড়িটা পুরোটাই লক করা অবস্থায় ছিল। কোনো অজানা শক্তি ওদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে এমনটা কল্পনা করাও কঠিন। আর কি মনে হয় তোমার, মৃতদেহ দুটোর মুখভঙ্গি কেমন ছিল? দুজনের চেহারায় ছিল অসীম আতঙ্কের ছাপ। ভয়ে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল মুখ।”
নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য থামল ইয়াশিনো। শব্দ করে কয়েকবার ঢোক গিলল সে। ঢোক গিলে শুকিয়ে যাওয়া গলা ভেজানো গেল কিনা সেটা বলা কঠিন।
“গভীরভাবে চিন্তা করো ব্যাপারটা নিয়ে। ধরেই নাও কোনো ভয়ানক দানব বেরিয়ে এসেছিল পাশের বন থেকে। ভয় পেয়ে গিয়েছিল ওরা। ভয় পাওয়ার ফলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরার কথা ওদের। ছেলেটা না ধরলেও, অন্তত মেয়েটা ভয়ে জড়িয়ে ধরত ছেলেটিকে। যতই হোক প্রেমিক প্রেমিকা ওরা। কিন্তু সেটা না করে দুজন দুদিকের দরজার সাথে হেলান দিয়ে থাকল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন একে অপরের থেকে যতটা পারে দূরে সরে যেতে চাচ্ছিল।”
আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত উঁচু করল ইয়াশিনো।
“আমার স্বাভাবিক ধারণার বাইরে এসব কিছু।”
ইয়োকুশার জাহাজডুবির ঘটনা না ঘটলে পত্রিকায় এই প্রতিবেদন হয়তো আরও বেশি স্পেস পেত। সেক্ষেত্রে অনেক পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত ব্যাপারটা। হয়তো অনেকে শখের বশে সমাধানও করতে চাইতো এই রহস্যজনক ঘটনা। কিন্তু…কিন্তু ঐ জায়গার পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে একধরনের সম্মতিতে পৌঁছেছে সবাই। ইনভেস্টিগেটররা সহ যারা সিনে উপস্থিত ছিল, এদের সবার-ই ঘটনাটা নিয়ে চিন্তাধারা কমবেশি একই। আর এদের মধ্যে প্রায় সবাই-ই নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছে সেটা। কিন্তু সবার ভেতরেই সামান্য হলেও থেকে গিয়েছে সন্দেহ ও সংশয়। এই ঐক্যমত্যের ধরনটাই এমন।
একই মুহূর্তে দুজন তরুণ তরুণীর হার্ট এট্যাকে মৃত্যু পুরোপুরি অসম্ভব। যদিও কেউই ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি, কিন্তু মেডিকেলের দোহায় দিয়ে নিজেদের মনকেই বুঝ দিয়েছে সবাই। বিজ্ঞানসম্মত কথাবার্তা না হওয়ার কারণে মানুষজন হাসাহাসি করবে ঠিক এই ভয়েই মুখে কুলুপ এটে রয়েছে ওরা। আর যদি এই ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেই থাকে তবে সেটার মানে দাঁড়ায় ব্যাখ্যাতিত ভয়ঙ্কর কোনো সত্ত্বার অস্তিত্ব মেনে নেয়া। ফলে লোকজন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা মেনে নেয়ায় শ্রেয় মনে করেছে। সেটা যতই অসঙ্গত হোক না কেন।
অদ্ভুত এক ভয়ের স্রোত বয়ে গেল আসাকাওয়া ও ইয়াশিনোর মেরুদণ্ড বেয়ে। স্বাভাবিকভাবেই একই জিনিস ভাবছে ওরা দুজনেই। দুজনের নীরবতায় সাক্ষ্য দিচ্ছে ওদের বুকের ভেতরে চলা পূর্বশঙ্কার।
কিছুই শেষ হয়নি, খেলা কেবল শুরু। মানুষ যতই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পন্ন হোক না কেন, কারও মৌলিক পর্যায়েও যদি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকে তবুও সে এমন কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে যেগুলোর ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না।
“লাশ পাওয়ার পর ওদের হাত কোথায় ছিল?” হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল আসাকাওয়া।
“মাথার ওপর। মনে হচ্ছিল হাত দিয়ে নিজেদের মুখ ঢাকার চেষ্টা করেছে ওরা।”
“এমন না তো, ওরা হাত দিয়ে নিজেদের মাথা টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করছিল?” নিজের চুলের ওপর হাত দিয়ে দেখাল আসাকাওয়া।
“এহ?”
“অন্যভাবে বলতে গেলে, নিজেদের মাথা বা চুল টেনে ছেড়ার চেষ্টা করছিল, এমন কিছু নয় তো?”
“নাহ। আমার ওরকম মনে হয় না।”
“আচ্ছা। আমি কি ঐ দুজনের নাম ঠিকানা পেতে পারি, ইয়াশিনো?”
“নিশ্চয়ই। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলবে না।”
হেসে মাথা নেড়ে সায় জানাল আসাকাওয়া। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিলে ধাক্কা লেগে কফি ছলকে পড়ল পিরিচের ওপর। ইয়াশিনো ছুঁয়েও দেখেনি নিজের কফিটা
অধ্যায় পাঁচ
সামান্য সময় পেলেই চারজন ভিক্টিমের ব্যাকগ্রাউন্ড খতিয়ে দেখতে লাগল আসাকাওয়া। কিন্তু কাজের এতই চাপ, ব্যাপারটা নিয়ে আশানুরূপ কাজ করতে পারছে না ও। চোখের পলকেই কেটে গেছে একটা সপ্তাহ। শুরু হয়েছে নতুন মাস। আগস্টের বৃষ্টি আর সেপ্টেম্বরের আর্দ্রতা উভয়েই নিকট অতীত। প্রকৃতিতে এখন শরতের আগমনী বার্তা। উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি এর মধ্যে। লোকাল পত্রিকাগুলোর প্রত্যেকটা ইঞ্চি খুঁটিয়ে পড়েছে আসাকাওয়া। কিন্তু পূর্বের ঘটনার মতো কিছু নজরে পড়েনি ওর। নাকি ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা ঠিকই নিজের মতো পদক্ষেপ ফেলছে ধীরগতিতে কিন্তু ভয়ানকভাবে? হয়তো ধরা পড়ছে না আসাকাওয়ার নজরে। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে আসাকাওয়ার মনে হচ্ছে চারটি ঘটনা নিছকই কাকতালীয় ও সম্পর্কবিহীন। এরমধ্যে ইয়াশিনোর সাথেও যোগাযোগ হয়নি ওর। হয়তো সেও ভুলে গেছে পুরো ব্যাপারটাই। না ভুললে এতদিনে আসাকাওয়ার সাথে যোগাযোগ করত সে।
এই কেসের ব্যাপারে আসাকাওয়ার আগ্রহ যখনই একটু কমতে আরম্ভ করে, সেসময় পকেট থেকে চারটা কার্ড বের করে দেখতে থাকে ও। নিজেকেই বলে, কোনোভাবেই ঘটনাগুলো কাকতালীয় হতে পারে না। কার্ডগুলোতে মৃত চারজনের নাম, ঠিকানা ও প্রাসঙ্গিক তথ্য লেখা। কার্ডের বাকি অংশের মৃতদের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের উল্লেখযোগ্য রেকর্ড, আর ওর রিসার্চ থেকে কিছু বের হলে সেসব লেখার কথা ভেবেছে আসাকাওয়া।
কার্ড ১ :
তোমাকো ওশি
জন্ম তারিখ : ১০/২১/১২
কেইসেই স্কুল ফর গার্লস, সিনিয়র, বয়স ১৭
ঠিকানা : ১-৭ মোতোমাচি, হনমকু, নাকা ওয়ার্ড
ইয়োকাহামা, আনুমানিক রাত এগারোটায়, পাঁচ সেপ্টেম্বর, বাড়ির নিচতলার কিচেনে মৃত্যুবরণ করে। বাবা-মা সেসময় বাড়ির বাইরে ছিল।
মৃত্যুর কারণ : হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ।
কার্ড ২ : সুইশি আইওয়াতা
জন্ম তারিখ : ৫/২৬/৭১
ইশিন প্রিপেটারি একাডেমি, ফার্স্ট ইয়ার, বয়স ১৯
ঠিকানা : ১/৫/২৩ নিশি নাকানাবু, শিনাগাওয়া ওয়ার্ড, টোকিও।
৫ সেপ্টেম্বর, রাত ১০ : ৫৪, শিনাগাওয়া স্টেশনের কাছাকাছি হঠাৎ রাস্তার ইন্টারসেকশনে পড়ে গিয়ে মৃত্যু।
মৃত্যুর কারণ : কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট
কার্ড ৩ :
হারুকো সুজি
জন্ম তারিখ : ১/১২/৭৩
কেইসেই স্কুল ফর গার্লস, সিনিয়র, বয়স ১৭
ঠিকানা : ৫-১৯, মোরি, ইসোগো ওয়ার্ড, ইয়োকাহামা
৫ সেপ্টেম্বর, মাঝরাতে (অথবা পরেরদিন ভোরে), মাউন্ট ওকুশুর কাছাকাছি রাস্তার ধারে গাড়ির মধ্যে মৃত্যুবরণ করে।
মৃত্যুর কারণ : হঠাৎ হার্ট ফেইল।
কার্ড ৪ : তাকেহিমো নোমি
জন্ম তারিখ : ১২/8/7০
ইশিন প্রিপেটারি একাডেমি, সেকেন্ড ইয়ার, বয়স উনিশ।
ঠিকানা : ১-১০-৪ উয়েহারা, শিবুয়া ওয়ার্ড, টোকিও।
৫ সেপ্টেম্বর, মাঝরাতে (অথবা পরেরদিন ভোরে), হারুকো সুজির সাথে, মাউন্ট ওকুশুর কাছাকাছি রাস্তার ধারে গাড়ির মধ্যে মৃত্যুবরণ করে।
মৃত্যুর কারণ : হঠাৎ হার্ট ফেইল।
একই হাইস্কুলে পড়ত তোমাকো ওশি আর হারুকো সুজি। বন্ধু ছিল ওরা। সুইশি আইওয়াতা ও তাকেহিও নোমিও পড়ত একই প্রিপেটারি স্কুলে। বন্ধু ছিল ঐ দুজনও। কাজ শুরুর আগে অন্তত এই ব্যাপারটা পরিষ্কার। এককথায় নিশ্চিত। আর আরেকটা সাধারণ ব্যাপার হলো একত্রে ড্রাইভিংয়ে গিয়েছিল সুজি আর নোমি। মাউন্ট ওশুকু, ইয়োেকাহামার ওদিকে। পাঁচ সেপ্টেম্বর রাতেই। এটুকু নিশ্চিত, এই দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা না হলেও, একসাথে মজা লুটে বেড়াচ্ছিল ঠিকই। মেয়েটার বন্ধুদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেছে, গুজব ছিল টোকিওর প্রিপেটারি স্কুলের কারও সাথে চক্কর চলছে সুজির। যদিও আসাকাওয়া জানে না, কীভাবে অথবা কোথায় পরিচয় হয়েছিল দুজনের। স্বাভাবিকভাবেই ওর সন্দেহ, সম্পর্ক ছিল ওশি আর আইওয়াতার মধ্যেও। কিন্তু এই ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পায়নি ও। একইভাবে এমনও হতে পারে ওশি আর আইওয়াতার মধ্যে কখনো দেখাও হয়নি। কিন্তু কোনসূত্রে এই চারজনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা যায়? এই অজানা আতঙ্ক যদি এলোমেলোভাবেও এই চারজনকে বেছে নিয়ে থাকে, তবুও এই চারজনের অবস্থান খুবই কাছাকাছি। হয়তো কোনো গোপন রহস্য জেনে গিয়েছিল এই চারজন। এই কারণেই হয়তো মরতে হয়েছে ওদেরকে…আরও বৈজ্ঞানিকভাবে ভাবার চেষ্টা করল আসাকাওয়া। সম্ভবত চারজন কখনো একই স্থানে, একই সময়ে মিলিত হয়েছিল। আর চারজন আক্রান্ত হয় অজানা কোনো ভাইরাস দ্বারা। যা হার্ট ফেইলর ঘটিয়েছে ওদের।
ধুর, হাঁটার সময় মাথা নাড়ল আসাকাওয়া। ভাইরাস হার্ট ফেইলর ঘটাবে? নাহ।
সিঁড়িতে উঠল ও। ভাইরাস, ভাইরাস, বিড়বিড় করছে আসাকাওয়া। অবশ্যই ব্যাপারটা শুরু করা উচিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েই। আচ্ছা, ধরা যাক, হার্ট এট্যাক ঘটিয়েছে কোনো ভাইরাস-ই। সুপারন্যাচারাল কিছুর কারণে মৃত্যুগুলো ঘটেছে এটা বিশ্বাস করার থেকে, অজানা কোনো ভাইরাসের কারণে মৃত্যু ঘটেছে এটা বিশ্বাস করা সহজ। এটা শুনলে লোকজন কম হাসবে। এমনকি এই ধরনের ভাইরাস এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে আবিষ্কৃত না হলেও, ধরে নেয়া যায় পৃথিবীতে এর প্রবেশ ঘটেছে কোনোভাবে। অথবা হতে পারে এটা কোনো বায়োলজিক্যাল মারণাস্ত্র। নিশ্চিতভাবেই উড়িয়ে দেয়া যায় না কোনো সম্ভাবনা। কিছুক্ষণের জন্য এটাকে ভাইরাস হিসেবেই কল্পনা করার চেষ্টা করল আসাকাওয়া। কিন্তু মনকে সন্তুষ্ট করতে পারল না ও। কেন মৃত্যুর সময় সবার চেহারায় অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট ছিল? কেন গাড়ির দুইপ্রান্তে হেলান দিয়ে মৃত্যুবরণ করল সুজি ও নোমি? মনে হচ্ছিল যেন একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে চায় ওরা। কিছু পাওয়া গেল না কেন অটোপসিতে? কোনো সূক্ষ্ম বায়োলজিক্যাল উইপন শেষ প্রশ্নটার সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে। কোনোভাবে হয়তো ট্রেস ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে এর।
যদি এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছায় ও, তাহলে আরেকটা ব্যাপারকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সেটা হলো, আর কোনো ভিক্টিম নেই এই চারজন বাদে। হতে পারে বাতাসে ছড়ায় না এই ভাইরাস। হয় এইডসের মতে রক্তে ছড়ায় নয়তো অসংক্রমক। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, কিসের ভিত্তিতে বাছাই করা হয়েছে এই চারজনকে? পিছে ফিরে এই চারজনের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের সকল কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে হবে আসাকাওয়াকে। বের করতে হবে সেই স্থান ও কাল, যে বিন্দুতে মিলিত হয়েছে এই চারজন। যেহেতু চারজনের মুখ চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, ফলে সহজ হবে না কাজটা। যদি এদের মিলিত হওয়া গোপন কিছু হয়ে থাকে, তবে স্বাভাবিকভাবেই এদের বন্ধু ও বাবা-মার জানার কোনো সম্ভাবনা নেই। কীভাবে বের করবে ও? কিন্তু ও নিশ্চিত, এই চারজন একই জায়গা, সময় আর রহস্যের সাথে সম্পৃক্ত।
ওয়ার্ড প্রসেসরের সামনে বসে রয়েছে আসাকাওয়া। মস্তিষ্কে ঝড় চলছে অজানা ভাইরাসকে নিয়ে। ওর নেয়া নোট ও ক্যাসেটের কন্টেন্টের সাহায্যে আজকের মধ্যে একটা আর্টিকেল লিখে শেষ করতে হবে ওকে। আগামীকাল, রবিবার, আসাকাওয়া আর ওর স্ত্রী শিজু বেড়াতে যাবে স্ত্রীর বোন ইয়োসিমি ওশির বাড়িতে। তোমাকো ওশির ঠিক যে জায়গায় মৃত্যু হয়েছে সে জায়গাটা নিজ চোখে দেখতে চাচ্ছে আসাকাওয়া। বুঝতে চাচ্ছে ঐ জায়গার বাতাসে এখনো অশুভ কিছু রয়েছে কিনা। আসাকাওয়ার স্ত্রীও বড়বোনকে সন্তান হারানোর জন্য সান্তনা দিতে চায়। এই কারণে সেখানে যেতে রাজি হয়েছে সেও। স্বামীর সত্যিকার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে অবগত নয় সে।
কোনো আউটলাইন মাথাতে আসার আগেই ওয়ার্ড প্রসেসরের কি বোর্ডে হাত নাচাতে লাগল আসাকাওয়া।
অধ্যায় ছয়
এই মাসে প্রথমবারের মতো বাবা-মার সাথে দেখা হলো শিজুর। নাতনির মৃত্যুর পর সময় পেলেই আশিকাগা থেকে টোকিওতে আসে তার বাবা মা। শুধুই নিজের মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে নয় বরং নিজেদের সান্ত্বনার জন্যেও আসে তারা। আজকে সেটা বুঝতে পারল শিজু। নিজের বাবা-মার শুকনো, দুখী মুখখানা দেখে হৃদয়ে ব্যথা অনুভূত হয় শিজুর। তিনজন নাতি-নাতনি ছিল ওদের। ওদের বড়মেয়ের মেয়ে তোমাকো, আরেকটা মেয়ে কাজুকোর ছেলে কেইচি আর শিজুর মেয়ে ইয়োকো। প্রত্যেকটা নাতি নাতনি একজন অপরজনের থেকে আলাদা। তোমাকো, ওদের প্রথম নাতনি। যতবারই তার সাথে দেখা হতো ততবারই আনন্দের ঝিলিক দেখা যেত ওদের চেহারায়। তোমাকোর সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করত ওরা। বর্তমানে একেবারে হতাশায় ডুবে গেছে শিজুর বাবা-মা। বলা কঠিন, কার মধ্যে মৃত্যু শোক বেশি, বাবা-মা নাকি দাদা-দাদীর।
মনে হয়, নাতি-নাতনি মানে বিশেষ কিছু।
এই বছরে ত্রিশে পা দিয়েছে শিজু। তার বোনের কষ্ট কল্পনাও করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। বোনের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে, নিজের বাচ্চাকে হারানোর কষ্টের ব্যাপারে ধারণাও করতে পারল না সে। কিন্তু নিজের দেড় বছর বয়সী সন্তানের সাথে সদ্য মৃত তোমাকোর কোনো ধরনের তুলনায় চলে না। সতেরো বছর বয়সে মারা গিয়েছে তোমাকো। ধারণাও করতে পারল না আগত বছরগুলোতে মেয়ের প্রতি তার ভালোবাসা কতটা বৃদ্ধি পাবে।
দুপুর তিনটা বাজার পরপর আশিকাগায় নিজেদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল শিজুর বাবা মা।
একটা ব্যাপারে অবাক না হয়ে পারেনি শিজু। তার স্বামী আসাকাওয়া, সবসময় নিজে কাজে ব্যস্ত থাকা একজন মানুষ, কেন উঠে পড়ে লাগল শিজুর বোনের বাড়িতে আসার জন্য? এই লোক-ই কাজের অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছিল তোমাকোর শেষকৃত্য। আর এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে। তোমাকোর সাথে মাত্ৰ কয়েকবার দেখা হয়েছে আসাকাওয়ার। খুব বেশি কথাও হয়নি ওদের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবেই তোমাকোর মৃত্যু খুব বেশি আলোড়িত করেনি আসাকাওয়াকে।
আসাকাওয়ার কাঁধে আলতো টোকা দিয়ে শিজু বলল, “শোনো, আমাদের ফেরার সময় হয়েছে সম্ভবত…”
“ইয়োকোর দিকে দেখো। ঘুম পেয়েছে ওর। এখানেই একটু ঘুমিয়ে নিক নাহলে ও।”
মেয়েকে সাথে এনেছে ওরা। স্বাভাবিকভাবে, এখন ঘুমের সময় তার। বরাবরের মতোই ঘুমের চোটে চোখ পিটপিট করছে সে। কিন্তু তাকে যদি এখানে ঘুম পাড়ানো হয়, তবে আরও দুই ঘণ্টার মতো থাকতে হবে ওদেরকে। দুই ঘণ্টা ধরে শোকাহত বোন আর তার স্বামীর সাথে কি কথা বলবে ওরা?
“ট্রেনেও ঘুমাতে পারবে ও, কি বলো?” নিচুস্বরে বলল শিজু।
“শেষবার এমনটা চেষ্টা করতে গিয়ে খুব খারাপ হয়েছিল। ভয়ানক অভিজ্ঞতা ছিল সেটা। দরকার নেই।”
ভিড়ের মধ্যে ঘুম পেলে খুবই অস্থির হয়ে যায় ইয়োকো। হাত, পা ছড়িয়ে, চিৎকার চেঁচামেচি করে জীবন অতিষ্ট করে তোলে বাপ-মার। বকাবকি করলে আরও খারাপ হয়ে যায় পরিস্থিতি। ঘুম পাড়ানো ছাড়া এর থেকে বাঁচার কোনো উপায়-ই নেই। এসব পরিস্থিতিতে আশেপাশের মানুষের কথা ভেবে বিব্রতবোধ করে আসাকাওয়া। মেয়ের অত্যাচারের শিকার হয়ে মাঝেমধ্যে বিরক্তও হয় ও। অন্য প্যাসেঞ্জারদের বিরক্ত ভরা চাহনীতে দমবন্ধ লাগে ওর।
স্বামীকে এরকম অবস্থায় দেখতে ভালো লাগে না শিজুরও। নার্ভাস স্বরে বলল শিজু, “আচ্ছা, তুমি যা ভালো বোঝো।”
“আচ্ছা, চলো ওপর তলায় ওকে ঘুম পাড়ানো যায় নাকি দেখি।”
মায়ের কোলে শুয়ে আছে ইয়োকো। ঘুমে চোখ অর্ধবোজা তার।
“আমি ওকে শুইয়ে দিয়ে আসি,” মেয়ের গাল হাত দিয়ে আদর করে বলল আসাকাওয়া। আসাকাওয়ার মুখ থেকে এরকম কিছু শুনতে পাওয়া একটু অদ্ভুত-ই বটে। খুব কম সময়েই বাচ্চার দেখাশোনা করে ও। হয়তো এখন মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে ওর। সম্ভবত সন্তান হারানো বাবা মাকে দেখার পর।
“আজ কি হয়েছে তোমার? ভূতুড়ে ব্যাপার স্যাপার দেখছি।”
“চিন্তা কোরো না। দেখে মনে হচ্ছে ও ঘুমে এখনই ঢলে পড়বে। আমার হাতে ছেড়ে দাও ব্যাপারটা।”
বাচ্চাটকে আসাকাওয়ার হাতে দিল শিজু, “সবসময় তুমি এরকম আচরণ করলে খুবই ভালো হতো।”
মায়ের থেকে বাবার কোলে গিয়ে মুখ বিকৃত করল বাচ্চাটা। কিন্তু আর কিছু করে ওঠার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল আসাকাওয়া। দুই তলায় রয়েছে দুটো জাপানি স্টাইলের ঘর ও একটি ওয়েস্টার্ন। যেটাতে থাকত তোমাকো। বাচ্চাটকে জাপানি স্টাইলের রুমে শুইয়ে দিল ও। রুমটা দক্ষিণমুখী।
যেহেতু বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে, তার সাথে আর থাকার দরকার নেই ওর। ঘুমের ঘরে নিয়মিত নিঃশ্বাস ফেলছে সে। এরইমধ্যে বিভোর ঘুমে তলিয়ে গেছে বাচ্চাটা।
রুম থেকে বেরিয়ে নিচে হচ্ছেটা কি সেটা কান পেতে শুনল আসাকাওয়া। এরপর প্রবেশ করল তোমাকোর বেডরুমে। মৃত মেয়ের ব্যক্তিগত জায়গায় ঢোকার জন্য অনুশোচনা বোধ হলো তার। কাজটা কি ঘৃণিত? কিন্তু ওর তো উদ্দেশ্য সৎ। অশুভ সত্ত্বাকে পরাজিত করায় লক্ষ্য। কিছুই হবে না। যদিও ও এসব ভাবছে, তবুও কোনো কাজে, কাজটা যেমনই হোক না কেন, এই ধরনের চিন্তাভাবনা কোনো না কোনো ভাবে যুক্তি দিয়ে পরাস্ত করে ও। এই ব্যাপারে তো আর আর্টিকেল লিখছে না, শুধুই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে চারজন কোন বিন্দুতে মিলিত হয়েছে, নিজেকে প্রবোধ দিল আসাকাওয়া।
ডেস্ক ড্রয়ার খুলল আসাকাওয়া। সেখানে শুধুই সাধারণ স্টেশনারি জিনিসপত্র। একজন স্কুল পড়ুয়ার যেমনটা থাকে। বরং ওগুলো রয়েছে বেশ গোছানো অবস্থায়। তিনটা স্ন্যাপশট, জাঙ্ক বক্স, চিঠি, সেলাইয়ের ব্যাগ, নোটপ্যাড।
মেয়েটার মৃত্যুর পর তার বাবা-মা কি দেখেছিল জায়গাটা? দেখে তো সেরকম মনে হচ্ছে না। সম্ভবত গোছানো ছিল মেয়েটা। কোনো ধরনের ডায়েরী খুঁজে পাওয়ার আশা করল আসাকাওয়া। এরকম কিছু খুঁজে পেল সময় বাঁচবে অনেক।
আজকে আমি সুজি, হারুকো, তাকেহিওর সাথে ছিলাম। আমরাথ… ইশ যদি এরকম লেখা কিছু পাওয়া যেত। বুকসেলফ থেকে একটা নোটবুক নামিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল ও। খুবই মেয়েলী ধরনের ডায়েরি এটা। তবে এতে রয়েছে কিছু এন্ট্রি। কিন্তু সেটাও দীর্ঘদিন আগের।
ডেস্কের পাশের শেলফে কোনো বই নেই। শুধু রয়েছে লাল রঙয়ের মেকআপ স্ট্যান্ড। সেখানকার ড্রয়ার খুলল আসাকাওয়া। সস্তা জিনিসপত্র দিয়ে ভর্তি। অনেকগুলো মিসম্যাচ ইয়ার রিং চোখে পড়ল ওর। বুঝায় যাচ্ছে মেয়েটার কানের দুল হারানোর অভ্যাস ছিল। দেখা যাচ্ছে একটি ছোট চিরুণী। চুল গেঁথে রয়েছে সেটাতে। ওয়ার্ডরোব খোলার পর স্কুল পড়ুয়া কোনো মেয়ের, মেয়েলী গন্ধ নাকে এলো আসাকাওয়ার। হ্যাঙ্গারে রঙিন জামা ও স্কার্ট ঝোলানো। মেয়েটার বাবা-মা নিশ্চিতভাবেই এখনো ভাবেনি, কি করবে এসব পোশাক দিয়ে। এখনও সেগুলোতে রয়েছে ওদের মেয়ের দেহের ঘ্রাণ। নিচতলায় কি হচ্ছে, কানপেতে আবারও শোনার চেষ্টা করল আসাকাওয়া। কেউ ওকে এখানে দেখতে পেলে কি ভাববে, এই ব্যাপারে নিশ্চিত নয় ও। কোনো শব্দ শোনা গেল না। নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছে ওর স্ত্রী আর তার বোন। ওয়ার্ডরোবের প্রত্যেকটা পোশাকের পকেট সার্চ করল আসাকাওয়া। রুমাল, মুভি টিকেট, চুইংগাম, ন্যাপকিন, কমিউটার পাস কেস, এসবই রয়েছে সেখানে। কেইসের ভেতরকার কমিউটার পাসটা ইয়ামাতে থেকে সুরুমী পর্যন্ত, চেক করে দেখল ও। এছাড়াও পাস কেইসে রয়েছে একটি স্টুডেন্ট আইডি কার্ড ও মেম্বারশিপ কার্ড। মেম্বারশিপ কার্ডে একটি নাম লেখা : শুরুতে কিছু একটা এরপর নোনো-ইয়ামা। বুঝতে পারছে না শুরুর শব্দটা কীভাবে উচ্চারিত হবে, ইউকি সম্ভবত। শুধু শব্দটা দেখে বোঝা গেল না, নামটা ছেলের নাকি মেয়ের। অন্য মানুষের কার্ড তার কাছে কেন থাকবে?
সিঁড়িতে পদধ্বনি শুনল ও। কার্ডটা পুড়ে নিল পকেটে। জায়গামত রেখে দিল পাস কেইস। লাগিয়ে দিল ওয়ার্ডরোবের পাল্লা। আসাকাওয়া হলে যাওয়ার সাথে সাথেই দেখতে পেল ওর স্ত্রীর বোনকে।
“আশেপাশে কোনো বাথরুম আছে?” যতটা পারা যায় অভিনয় করে বলল আসাকাওয়া।
“হলের একদম শেষপ্রান্তে রয়েছে,” মনে হলো না কোনোকিছু সন্দেহ করেছে সে। “ইয়োকো ভালো মেয়ের মতো ঘুমাচ্ছে তো?”
“হ্যাঁ, ধন্যবাদ। আপনাদের খামোখা ঝামেলায় ফেললাম আমরা।”
“আরেহ, এগুলো কোনো ঝামেলায় না,” সামান্য মাথা নিচু করে বলল সে। এরপর অপর জাপানি স্টাইলের ঘরে প্রবেশ করল ওর স্ত্রীর বোন। তার হাত কিমনোর স্যাশ-এ।
বাথরুমে প্রবেশ করেই কার্ডটা বের করল আসাকাওয়া। “প্যাসিফিক রিসোর্ট ক্লাব মেম্বার্স কার্ড।” ওখানে লেখা আছে এটা। কার্ডটা নোনোইয়ামার নামে ইস্যুকৃত, মেম্বারশিপ নম্বর ও এক্সপায়ার ডেটও লেখা সেখানে। উল্টেপাল্টে দেখল আসাকাওয়া। রয়েছে পাঁচজনের মেম্বারশিপের ব্যবস্থা। কোম্পানির নাম ও ঠিকানাও লেখা আছে কার্ডে। প্যাসিফিক রিসোর্ট ক্লাব, ইনকর্পোরেটেড। ৩-৫ কোজিমাচি, চিয়েদা ওয়ার্ড। ফোন নম্বর : (০৩) ২৬১-৪৯২২। কোথাও থেকে কুড়িয়ে না পেলে, তোমাকে কার্ডটা নিয়েছিল নোনোইয়ামার কাছে থেকে। কেন? অবশ্যই প্যাসিফিক রিসোর্টের সুযোগ সুবিধা ভোগ করার জন্য। কোন শাখায় আর কবে?
বাড়ির ভেতরে থেকে ফোন করতে পারবে না আসাকাওয়া। সিগারেট কেনার নাম করে বাইরে একটা পে ফোনের কাছে এলো ও। ডায়াল করল নম্বরটা।
“হ্যালো, প্যাসিফিক রিসোর্ট, কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?” বলল একজন তরুণীর কণ্ঠ।
“মেম্বারশিপ কার্ডের মাধ্যমে কি কি সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়, জানতে চাচ্ছিলাম।”
ওপাশ থেকে পাওয়া গেল না কোনো প্রতিক্রিয়া। সম্ভবত কার্ডের রয়েছে প্রচুর সুযোগসুবিধা। যার সবগুলো হয়তো একজায়গায় লিস্টও করা নেই।
“আচ্ছা…যেমন ধরুন টোকিও থেকে একরাতের জন্য কেউ আসলে, ‘ যোগ করল আসাকাওয়া। হতে পারে ঐ চারজন দুই অথবা তিন রাতের জন্য ছিল ওখানে। কিন্তু যেহেতু কোনো আলামত পায়নি ও, সেহেতু হয়তো এক রাতের বেশি ওখানে ছিল না ওরা। বাবা-মাকে বন্ধুর বাড়িতে থাকার নাম করে একরাতের জন্য সহজেই বাইরে কাটাতে পারত মেয়েটা।
“সাউথ হ্যাকনির প্যাসিফিক ল্যান্ডে সবধরনের সুযোগসুবিধা-ই আছে স্যার,” পেশাদারিত্বের সাথে বলল মেয়েটা।
“নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, কি ধরনের অবসর যাপনের ব্যবস্থা আছে আপনাদের?”
“অবশ্যই আছে স্যার। গলফ, টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল, খেলার মাঠ।”
“লজিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে?”
“জ্বি স্যার। প্যাসিফিক ল্যান্ডে আবাসিক হোটেলের মতো সুযোগসুবিধা রয়েছে আমাদের। ভিলা লগ কেবিন রেন্টাল কটেজ। আমাদের ব্রোশিউর পাঠাবো আপনাকে?”
“জ্বি, নিশ্চয়ই।” আগ্রহী গ্রাহকের মতো ভাব ধরে বলল আসাকাওয়া। এভাবেই সহজে তথ্য আদায় করা যাবে, ভাবল ও। “হোটেল আর কেবিন কি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত?”
“অবশ্যই, তবে নন মেম্বার রেটে।”
“ও আচ্ছা। দয়া করে ফোন নম্বরটি দিবেন? হয়তো যেতে পারি সেখানে।”
“আপনি চাইলে এখুনি রিজার্ভেশনের ব্যবস্থা করতে পারি।”
“নাহ, কোনো একসময় হয়তো ড্রাইভ করে সেখানে গিয়ে দেখে আসবো জায়গাটা। শুধু ওখানকার ফোন নম্বরটা পাওয়া যাবে…”
“এক মিনিট প্লিজ।”
মেমো আর পেন বের করল আসাকাওয়া।
“হয়েছে?” জিজ্ঞেস করার পর দুটি এগারো ডিজিটের ফোন নম্বর বলল মেয়েটা। বেশ দূরের এরিয়া কোড। নম্বর লিখে নিল আসাকাওয়া।
“আপনাদের অন্য ফ্যাসিলিটিজগুলো আর কোথায় কোথায় আছে? ভবিষ্যতের সুবিধার জন্য জানতে চাচ্ছি আরকি।”
“একইধরনের সুযোগসুবিধা সম্পন্ন রিসোর্ট আছে লেক হামানা আর হামাজিমাতে।”
দুটোই বহুদূরে। কোনো ছাত্রছাত্রীর অত দূরে যাওয়ার মতো বুকের পাটা নেই।
“আচ্ছা, নামের মতোই দেখছি সবগুলোই প্যাসিফিকের আশেপাশে।”
প্যাসিফিক রিসোর্টের মেম্বারশিপ কার্ডের সুযোগ সুবিধা বিস্তারিত বর্ণনা করতে লাগল মহিলাটি। ফোন রাখার আগে নীরবভাবে সবকিছু কিছুক্ষণ শুনল আসাকাওয়া।
“দারুণ। বাকিটুকু আশা করছি আপনাদের লিফলেট থেকে জেনে নিতে পারব। আমার ঠিকানা দিচ্ছি আপনাকে। দয়া করে পাঠিয়ে দেবেন।” ঠিকানা দিয়ে ফোন রেখে দিল ও। মহিলার ভাষণ শোনার পর মনে হচ্ছে না ওখানে যাওয়া খুব একটা খারাপ হবে। যদি সামর্থ্যের মধ্যে থাকে তবে।
ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গিয়েছে ইয়োকোর ঘুমানোর। বাড়ি ফিরে গেছে শিজুর বাবা-মা। কিচেনে শিজু সাহায্য করছে তার বোনকে। এখনও অল্পতেই ভেঙে পড়ার দশা রয়ে গেছে তার বোনের।
“কি হয়েছে আজকে তোমার? কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছ।” থালাবাসন ধোঁয়া অবস্থাতেই বলল শিজু। “ইয়োকোকে দেখাশোনা করছ, রান্নাঘরে সাহায্য করতে চাইছ। বদলে গেলে নাকি একেবারে? আশা করি এরকমই থাকবে।
ভাবনায় ডুবে আছে আসাকাওয়া। চাচ্ছে না চিন্তা বাধাপ্রাপ্ত হোক। আশা করল ওর স্ত্রী তার নামের অর্থের মতোই আচরণ করবে। শিজু যার অর্থ ‘নীরব’। নারীদের মুখ বন্ধ রাখার সর্বোত্তম উপায় হলো জবাব না দেয়া।
“ওহ, যাইহোক, বাবুকে বিছানায় শোয়ানোর আগে আলাদা ডিসপোজেবল দিয়েছিলে তো? অন্যের বিছানা নষ্ট করুক এমনটা চাই না আমি।”
কোনো আগ্রহ দেখাল না আসাকাওয়া। দেয়ালের দিকে চেয়ে দেখল শুধু। এখানেই মারা গিয়েছে তোমাকো। গ্লাসের টুকরো ও কোক ছড়িয়ে ছিল তার মৃতদেহের পাশে। ফ্রিজ থেকে কোক বের করে খাওয়ার সময়েই সম্ভবত তাকে আক্রমণ করেছিল ভাইরাস। রেফ্রিজারেটর খুলল আসাকাওয়া, তোমাকো যা করেছিল সেটা অনুসরণ করার চেষ্টা করছে আসাকাওয়া। কল্পনায় হাতে গ্লাস নিয়ে ড্রিঙ্কস খাওয়ার ভঙ্গি করল ও।
“কি করছ তুমি এসব বলো তো?” মুখ হা করে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে শিজু। নিজের কাজ চালিয়ে গেল আসাকাওয়া। ড্রিঙ্কস খাওয়ার ভঙ্গি করছে এখনও। নিজের পিছনে তাকাল ও। পিছে তাকিয়ে দেখল ঠিক ওর দিক বরাবর গ্লাসডোর। কিচেনকে লিভিংরুম থেকে আলাদা করেছে এই গ্লাস ডোর-ই। সিঙ্কের ওপর ফ্লুরাসেন্ট লাইট প্রতিফলিত হচ্ছে সেখানে। হয়তো এখনো আলো আছে বাইরে আর ঘরের ভেতরেও জ্বলছে লাইট, ফলে ঐ ফ্লুরাসেন্ট বাল্বের প্রতিফলন পড়েছে শুধু গ্লাসডোরেই। ফলে কিচেনের এপারে সৃষ্টি হয়েছে প্রতিবিম্বের। যদি গ্লাস ডোরের অপর প্রান্ত কালো হয় আর এদিকে উজ্জ্বল, তবে সেই রাতে তোমাকো যা দেখেছে.. সেটা হয়তো আয়নার মতো প্রতিবিম্বের সৃষ্টি করেছিল কিচেনের গ্লাসডোরে। তোমাকোর আতঙ্কে বিকৃত চেহারাও হয়তো ভেসে উঠেছিল সেখানে। এই গ্লাসডোর-ই হলো সব ঘটনার সাক্ষী, ভাবতে শুরু করেছে আসাকাওয়া। কাঁচ প্রতিফলিত বা ট্রান্সপারেন্ট হতে পারে আলো আধারীর অবস্থার ওপর নির্ভর করে। কাঁচের সাথে নিজের মুখ ঠেকিয়ে দিয়েছিল আসাকাওয়া, সেইসময় কাঁধে আলতো টোকা দিল ওর স্ত্রী। ঠিক সেইমুহূর্তে ওপর তলায় কেঁদে উঠল ইয়োকো। উঠে পড়েছে বাচ্চাটা।
“ইয়োকো জেগে গেছে,” তোয়ালায় হাত মুছল ইয়োকো। ঘুম থেকে উঠে ওদের মেয়ে কখনোই এভাবে কাঁদে না। দৌড়ে দ্বিতীয় তলায় গেল শিজু।
শিজু বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রবেশ করল ইয়োশিমি। খুঁজে পাওয়া কার্ডটা তার হাতে ধরিয়ে দিল কার্ডটা।
“পিয়ানোর নিচে পড়ে ছিল এইটা।” স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বলে প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় থাকল ও।
কার্ডটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল ইয়োশিমি।
“অদ্ভুত ব্যাপার। ওখানে কি করছিল এটা?” সংশয়ের সাথে মাথা নাড়ল সে।
“তোমাকো কি কোনো বন্ধুর কাছে থেকে আনতে পারে এটা বলে মনে হয়?”
“কিন্তু এই নাম আগে কখনো শুনিনি আমি। এই নামে ওর কোনো বন্ধু ছিল বলেও জানা নেই আমার।” অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার সাথে আসাকাওয়ার দিকে তাকাল ইয়োশিমি।
“ধুর! বাদ দাও। দেখে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলেই মনে হচ্ছিল। মেয়েটা যে…” আটকে গেল তার কণ্ঠস্বর। এমনকি সামান্য কিছুও দুঃখী করে তুলছে তাকে। কিছু জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত বোধ করল আসাকাওয়া। তবুও জিজ্ঞেস করল ও।
“তোমাকো আর ওর কোনো বন্ধুর গ্রীষ্মের ছুটির ভেতর ঐ রিসোর্টে গেছিল, এমন কোনো সম্ভাবনা রয়েছে?”
মাথা নাড়ল ইয়োশিমি। নিজের মেয়ের ওপর ভরসা আছে তার। মিথ্যে বলে বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর মতো মেয়ে ছিল না তোমাকো। আর পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিচ্ছিল সে। ইয়োশিমির এই মুহূর্তের অনুভূতি ধরতে পারল আসাকাওয়া। তোমাকোর বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস না করার সিদ্ধান্ত নিল ও। কোনো হাইস্কুল শিক্ষার্থী, যার আবার সামনে পরীক্ষা, সে কোনোদিনও বয়ফ্রেণ্ডের সাথে কটেজ ভাড়া নেয়ার কাহিনি বাবা মাকে জানাবে না। সম্ভবত মিথ্যে বলেছিল সে। হয়তো বলেছিল একসাথে পড়াশোনা করার জন্য রাতটা বন্ধুর বাড়ি কাটাবে।
“এটার মালিককে খুঁজে ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করব।”
ইয়োশিমি নীরবে মাথা নিচু করে সায় জানাল। লিভিংরুম থেকে শোনা গেল তার স্বামীর ডাক। দ্রুত বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। মেয়েটার শোকাহত পিতা বসে রয়েছে নতুন স্থাপন করা বুদ্ধমূর্তির সামনে। মূর্তির পাশে তার মৃত মেয়ের ছবি রাখা। কথা বলছে মেয়ের ছবির সাথেই। অস্বাভাবিক রকমের উৎফুল্ল শোনাল লোকটার কণ্ঠস্বর। হতাশ বোধ করল আসাকাওয়া। নিশ্চিত শোকে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে তার। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া কোনো কিছুই করার নেই আসাকাওয়ার।
একটা জিনিস ধরতে পেরেছে আসাকাওয়া। যদি এই নোনোইয়ামা তোমাকোকে মেম্বারশিপ কার্ড ধার দিয়েই থাকে তবে নিশ্চয়ই নোনোইয়ামা কার্ডটা ফেরত নেয়ার জন্য তোমাকোর বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করার কথা তার। কিন্তু তোমাকোর মা কিছুই জানে না এই ব্যাপারে। নোনোইয়ামার কার্ডের ব্যাপারে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। যদি কার্ডটা কোনো ফ্যামিলি মেম্বারশিপ ডিলও হয়ে থাকে, তারপরও এটার মূল্য এতই বেশি যে সহজে কার্ডটা হারাতে দেয়ার কথা নয় তার। তাহলে মানে টা কি দাঁড়াল? এতক্ষণ এসব কিছু ভেবেই ব্যাপারটা বের করতে পারল আসাকাওয়া। বাকি তিনজনের মধ্যে একজনকে কার্ডটা ধার দিয়েছিল নোনোইয়ামা। সেটা হয়তো আইওয়াতা, সুজি অথবা নোমিকে। এদের মধ্যে কেউই কার্ডটা ধার দিয়েছে তোমাকোকে। আর এভাবেই মিলেছে পুরো জিনিসটা। যাকে ধার দিয়েছিল তার বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করার কথা নোনোইয়ামার। সেই বাবা-মাও হয়তো খোঁজ চালিয়েছে তাদের সন্তানের জিনিসপত্রের মধ্যে। নিশ্চয়ই তারা খুঁজে পায়নি কার্ডটা। কারণ কার্ডটা এখন এখানে। বাকি তিন ভিক্টিমের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলে হয়তোবা নোনোইয়ামার ঠিকানা পাওয়া যেতে পারে। আজকে রাতের মধ্যেই কল করা উচিত। যদি এখান থেকে কোনো ক্লু না বের করতে পারে, তবে মনে হয় না শুধু কার্ড দেখে বোঝা যাবে কোন রহস্যময় বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল এই চারজন। যেকোনো মূল্যে নোনোইয়ামার সাথে দেখা করতে চায় আসাকাওয়া। তার কি বলার আছে সেটা শুনতে চায় ও। দরকার হলে মেম্বারশিপ কার্ডের নম্বর দেখে নোনোইয়ামার ঠিকানা খুঁজে বের করতে হবে। সরাসরি প্যাসিফিক রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো কিছু পাওয়া যাবে না তবে এক্ষেত্রে ওর পত্রিকার কানেকশন কাজে লাগিয়ে তথ্য বের করা যেতে পারে।
কেউ একজন ডাকছে ওকে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কণ্ঠস্বর। ‘ওগো… শুনছো… শুনছো…” বাচ্চার কান্নার সাথে মিশে গেছে ওর স্ত্রীর কণ্ঠস্বর।
“একটু আসতে পারবে এখানে?”
বাস্তবে ফিরে এলো আসাকাওয়া। হঠাৎ করে ও বুঝতে পারল না কি ভাবছিল এতক্ষণ। ওর মেয়ের কান্নার মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত একটা ভাব। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অনুভুতিটা আরও গাঢ় হলো ওর।
“কি হয়েছে?” জেরা করার মতো জিজ্ঞেস করল স্ত্রীকে।
“কোনো একটা সমস্যা হয়েছে ইয়োকোর। মনে হয় কিছু একটা ঘটেছে ওর সাথে। ওর কান্নার আওয়াজ স্বাভাবিকের থেকে ভিন্ন। অসুস্থ হলো নাকি?”
ইয়োকোর কপালে হাত রাখল আসাকাওয়া। জ্বর আসেনি তার। কিন্তু কাঁপছে তার ছোট্ট হাতদুটো। কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল পুরো দেহে। মাঝেমধ্যে নড়ে উঠছে পিঠ। চোখ চেপে রেখেছে সে। চোখদুটো লাল।
“কতক্ষণ ধরে এরকম করছে ও?”
“মনে হয় ঘুম থেকে উঠে আশেপাশে কাউকে না দেখতে পেয়ে এই হাল।”
ঘুম থেকে উঠে মাকে না দেখতে পেলে প্রায়ই কাঁদে বাচ্চাটা। কিন্তু মা ছুটে এসে কোলে নিলেই থেমে যায় সে। কোনো বাচ্চা যখন কাঁদে তখন কিছু একটা চায় সে…কিন্তু কি সেটা? কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে বাচ্চাটা। এমনি এমনি তো এরকম করবে না। ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রয়েছে সে। জড়োসড়ো হয়ে গেছে আতঙ্কে। ভয়ে মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা বাচ্চাটার। মুখ থেকে হাত সরিয়ে, হাতের মুঠি সামান্য খুলল ইয়োকো। সামনের দিকে কিছু একটা নির্দেশ করছে সে। সেদিকে তাকাল আসাকাওয়া। একটা পিলার রয়েছে ওখানে। চোখ তুলে তাকাল ও। প্রায় ত্রিশ সেন্টিমিটার ওপরে, সিলিংয়ের ওখানে হাতের মুঠির সমান একটা মুখোশ ঝুলানো। হ্যানায়া নামক নারী দৈত্যের মুখোশ। মুখোশ দেখেই ভয় পেয়েছে সে?
“দেখ,” মাথা দিয়ে মুখোশের দিকে ইশারা করে বলল আসাকাওয়া। দুজনই একসাথে তাকাল মুখোশের দিকে। এরপর ঘুরল বাচ্চাটার দিক বরাবর।
“নাহ…দৈত্যের মুখোশ দেখে ভয় পেয়েছে ও?”
পা উঁচু করে ওখান থেকে মুখোশটা নামাল আসাকাওয়া। সেটা উল্টে ড্রেসারের ওপর রাখল ও। মুখোশটা আর দেখতে পাচ্ছে না ইয়োকো। হঠাৎ-ই কান্না থামিয়ে দিয়েছে সে।
“কি হয়েছে ইয়োকো? ঐ ফালতু দৈত্য দেখে ভয় পেয়েছ সোনা?” শিজুকে দেখে মনে হলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সে। হাসিমুখে বাচ্চাটার গালে আদর করতে লাগল সে। কিন্তু কিছু কারণে ঠিক স্বস্তি পেল না আসাকাওয়া। এই ঘরে থাকতে চাচ্ছে না ও।
“চলো, বাসায় চলো,” স্ত্রীকে তাড়া দিল ও। ওশিদের বাড়ি থেকে ফিরেই সেই সন্ধ্যায় সুজি, নোমি আর আইওয়াতার বাড়িতে কল করল আসাকাওয়া। প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করল, তাদেরকে কোনো অভিভাবক কল করে কোনো রিসোর্টের মেম্বারশিপ কার্ডের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে কিনা। সর্বশেষ ব্যক্তি, আইওয়াতার মা দীর্ঘ উত্তর দিল ওকে। “একজন কল করেছিল। তার দাবি সে নাকি আমার ছেলের সাথে একই স্কুলে পড়ত। বয়সে একটু বড় ছেলেটা। বলেছিল, সে নাকি আমার ছেলেকে কোন রিসোর্টের মেম্বারশিপ কার্ড ধার দিয়েছিল। সেটা ফেরত চায়…কিন্তু আমার ছেলের ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজেই এরকম কিছু পাইনি।”
মহিলার কাছ থেকে নোনোইয়ামার ফোন নম্বর নিয়ে দ্রুত কল করল আসাকাওয়া। নোনোইয়ামা আগস্টের শেষ রবিবারে শিবুয়ায় এসেছিল, আইওয়াতার কাছে। তখনই কার্ডটা ধার দিয়েছে সে। যেমনটা আসাকাওয়া ধারণা করেছিল আরকি। আইওয়াতা নাকি তাকে বলেছিল, হাইস্কুলের মেয়েটার সাথে এটা ব্যবহার করে রিসোর্টে যাবে। সামার ভ্যাকেশন শেষ হয়ে যাচ্ছে, একবারের জন্য হলেও সামার ভ্যাকেশনটা উপভোগ করতে চাই। এছাড়া পড়াশোনায় মন বসানোই অসম্ভব, বলেছিল আইওয়াতা।
এই কথাটা শুনে হেসেছিল নোনোইয়ামা। নির্বোধ কোথাকার, প্রি স্কুলের পোলাপাইনদের আবার সামার ভ্যাকেশন কিসের, ভেবেছিল সে।
আগস্টের শেষ রবিবার ছিল ২৬ তারিখ। যদি ওরা এরপরে গিয়েই থাকে তবে সেটা ২৭, ২৮, ২৯ তারিখের মধ্যে যেকোনো দিন। প্রি স্কুলের ব্যাপারে জানা নেই আসাকাওয়ার। কিন্তু ও জানে গার্লস হাইস্কুলের ফল সেমিস্টার শুরু হয় পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে
অপরিচিত পরিবেশ ও ক্লান্তি থেকে মায়ের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছে ইয়োকো। বেডরুমের দরজায় কান রেখে আসাকাওয়া শুনল দুজনেই তলিয়ে গেছে গভীর ঘুমে। রাত নটা বাজে… এখন বিশ্রামের সময় আসাকাওয়ার। বাচ্চা ও স্ত্রী না ঘুমানো পর্যন্ত এই ছোট্ট কন্ডোতে ওর কাজ করার জায়গা হয়ে ওঠে না।
ফ্রিজ থেকে বিয়ার বের করে গ্লাসে ঢালল আসাকাওয়া। একটু স্পেশাল লাগছে স্বাদটা। মেম্বারশিপ কার্ডের হদিশ বের করে কেসে ভালো রকমের উন্নতি হয়েছে আজ। ২৭ থেকে ৩০ এ আগস্টের মধ্যে সুইশি, আইওয়াতা ও বাকিদের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে প্যাসিফিক রিসোর্ট ফ্যাসিলিটিজে রাত কাটানোর। সম্ভবত সাউথ হ্যাকনে প্যাসিফিক ল্যান্ডের ভিলা লগ কেবিনে। কেননা পরিস্থিতি অনুযায়ী সাউথ হ্যাকনে প্যাসিফিক রিসোর্ট-ই হচ্ছে সব থেকে নিকটবর্তী। কয়েকজন স্কুল শিক্ষার্থীর পক্ষে দূরে কোথাও হোটেল ভাড়া করে থাকার কথা কল্পনাতেও আনতে পারল না আসাকাওয়া। মেম্বারশিপ কার্ডের মাধ্যমে হয়তো সস্তায় কটেজ ভাড়া করেছিল ওরা। এক্ষেত্রে দরকার পড়েছে মাত্র পাঁচ হাজার ইয়েন। মানে জনপ্রতি খরচ পড়েছে এক হাজার ইয়েনের একটু বেশি। ভিলা লগ কেবিনের ফোন নম্বর রয়েছে ওর কাছে। নেয়া নোটগুলো রেখেছে টেবিলের ওপর। সহজ ও দ্রুত উপায় হলো ফ্রন্ট ডেস্কে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়া। নোনোইয়ামা কার্ডের নামে চারজনের কোনো গ্রুপ ছিল কিনা। কিন্তু ওরা ফোনে জানাতে চাইবে না আসাকাওয়াকে। যারা রিসোর্ট বা কটেজে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে তাদেরকে আগে থেকেই ট্রেনিং দেয়া হয়। বোঝানো হয় কাস্টমারদের তথ্যের নিরাপত্তা তাদের দায়িত্ব। এমনকি আসাকাওয়া নিজেকে প্রভাবশালী পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তদন্তের খাতিরেও যদি তথ্যগুলো জানতে চায়, তবুও ফোনে ওকে কিছুই জানাবে না ম্যানেজার। লোকাল ব্যুরোতে যোগাযোগ করে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে গেস্ট রেজিস্টারের তথ্য জানার সিদ্ধান্ত নিল আসাকাওয়া।
শুধুমাত্র পুলিশ ও অ্যাটর্নির কাছেই ম্যানেজার রেজিস্টারের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য। আসাকাওয়া নিজেকে পুলিশ কিংবা অ্যাটর্নি পরিচয় দিয়ে তথ্য বের করতে পারবে, তবে খুব শিগ্রহী ধরা পড়ে যাবে ও। আর সেটা ওর সংবাদপত্রের জন্যেও ভালো কিছু হবে না। চ্যানেল ধরে এগোনো সব থেকে নিরাপদ। কিন্তু এক্ষেত্রে তিন চারদিন লেগে যাবে। আর কোনো কাজে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করা পছন্দ নয় আসাকাওয়ার। এখনই জানা প্রয়োজন ওর। এই কেসের প্রতি ওর আগ্রহ এখন তুমুল পর্যায়ের। তিনদিন অপেক্ষা করা সম্ভব নয় ওর পক্ষে। কি বের হয়ে আসবে এই তদন্ত থেকে? যদি ঐ চারজন আগস্টের শেষে ভিলা লগ কেবিনে রাত্রিযাপন করেই থাকে তবে সেখান থেকে কি এমন কোনো ক্লু মিলবে, যা এই চারজনের মৃত্যু রহস্য সমাধানে সহায়ক? কি হতে পারে সেটা? ভাইরাস, ভাইরাস। সচেতনভাবে আসাকাওয়া এটাকে ভাইরাস নামে আখ্যায়িত করছে যেন অজানা রহস্যময় এই জিনিসটা ওকে ভীতসন্ত্রস্ত করে ফেলতে না পারে। সামান্য হলেও মনে হচ্ছে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মুখোমুখি হতে চলেছে কোনো অতিলৌকিক জ্ঞান। যে অজানা জিনিসটার সাথে লড়াই করতে হবে ওকে, সে জিনিসের কোনো অদ্ভুত নাম দিতে চায় না ও। সে কারণে নিজের ভাষাতেই পরিচিত নাম দিয়েছে ও জিনিসটার।
ইয়োকোর আচমকা কান্নার কথা মনে পড়ল আসাকাওয়ার। বিকালে দৈত্যের মুখোশটা দেখে এত কাঁদল কেন সে? বাড়িতে ফেরার পথে ট্রেনে স্ত্রীকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে ও।
“আচ্ছা, তুমি কি ইয়োকোকে দৈত্যের কোনো গল্প শুনিয়েছ?”
“কি?”
“মানে ছবি বা বইয়ে দৈত্যের ছবি দেখিয়ে আরকি। দৈত্য ভয় পাওয়ার জিনিস, এটা তুমি ওকে শিখিয়েছ?”
“নাহ। কেন এমনটা শেখাবো আমি?”
প্রসঙ্গ শেষ হয়ে গিয়েছিল ওখানেই। এই ব্যাপারে সচেতন নয় শিজু। তবে দুশ্চিন্তা ভর করেছে আসাকাওয়ার মনে। এই ধরনের ভয়ের অবস্থান অনেক গভীরে, আধ্যাত্মিক পর্যায়ে। জানাশোনা কোনো ভয়ের থেকে আলাদা এই ভয়। আদিমকাল থেকেই মানুষ কিছু না কিছুকে ভয় পেয়ে এসেছে। টাইফুন, সাইক্লোন, বুনো জন্তু, অন্ধকার। কোনো বাচ্চা জীবনে প্রথমবারের মতো বজ্রপাত দেখে প্রবৃত্তিগতভাবেই ভয় পাবে। এমনটাই স্বাভাবিক। কেননা বজ্রপাত বাস্তব, অস্তিত্ব রয়েছে এটার। কিন্তু দৈত্যকে কেন? অভিধান অনুযায়ী দৈত্য হলো কাল্পনিক দানব, অথবা মৃতের অতৃপ্ত আত্মা। দৈত্য দেখতে ভয়ানক বলে যদি ইয়োকো ভয় পেয়ে থাকে, তবে গডজিলা দেখেও ভয় পাওয়ার কথা তার। গডজিলাও দেখতে ভয়ঙ্কর। ডিপার্টমেন্ট স্টোরে একবার সাজানো গডজিলা দেখেছিল সে। ভয়াবহ একটা গডজিলার রেপ্লিকা। ভয় পাওয়ার বদলে আগ্রহ নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে ছিল ইয়োকো। এই পুরো ব্যাপারটার কি ব্যাখ্যা হতে পারে? একটা ব্যাপার-ই হলো, গডজিলা দেখতে যতই ভয়ংকর হোক না কেন, এটা অবাস্তব।
কিন্তু দৈত্যের ব্যাপারটা কি? দৈত্য তো জাপানের বিশেষ সংস্কৃতির অংশ। আর অন্য কোথাও দৈত্য এরকম সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠেনি। দানব…ভাবল আসাকাওয়া। দ্বিতীয় গ্লাস বিয়ারের স্বাদ প্রথমটির মতো লাগছে না।
ইয়োকো কি তবে অন্যকিছু দেখে ভয় পেয়েছিল? এটাই হবে, অন্ধকার ছিল জায়গাটা। অন্ধকারকে খুব বেশি ভয় পায় ইয়োকো। কখনো একটা ঘরে একা থাকেনি সে। ইয়ো-কো, এর অর্থ সূর্য সন্তান। কিন্তু অন্ধকার, ঠিক বিপরীত মেরুতেই এর অবস্থান। এমনকি এখনো মায়ের কোলে অন্ধকার ঘরে ঘুমোচ্ছে ইয়োকো।