প্রথম পরিচ্ছেদ – পূর্ব বাঙলায় দুর্ভিক্ষ

প্রথম পরিচ্ছেদ – পূর্ব বাঙলায় দুর্ভিক্ষ 

১. দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি 

১৯৪৭ সালের গোড়া থেকেই বাঙলাদেশে খাদ্যশস্যের, বিশেষতঃ চালের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। মার্চ মাসের প্রথম দিকে বাঙলা সরকারের খাদ্য বিভাগের কমিশনার এসএন রায় খাদ্য পরিস্থিতির ওপর একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন[১] যে, দুর্ভিক্ষের আশু সম্ভাবনা সম্পর্কে নানা মতলবপূর্ণ প্রচারণার ফলে গ্রামাঞ্চলে লোকে খাদ্যশস্য বিক্রী না করে নিজেদের ঘরে আটক রাখছে এবং তার ফলে বাজারে ধান চালের আমদানী অনেক কমে গেছে। আমদানী এইভাবে কমে যাওয়ার ফলে বাজারে শস্যের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও তিনি জানান। প্রতিবেশী প্রদেশ বিহারে এই সময় চালের মণ তিরিশ থেকে চল্লিশ টাকায় ওঠে এবং বাঙলাদেশ থেকে বিহারে চাল অনেকে চালান দিতে শুরু করে। এটাকেও খাদ্য কমিশনার বাঙলাদেশে চালের মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থের প্রচারণা এবং খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে সাপ্তাহিক মিল্লাত এই সময় ‘বাঙলার খাদ্য পরিস্থিতি’ নামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে: 

বাঙলায় কয়েকটি জেলায় চালের মূল্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখিলে চমকাইয়া উঠে। তাই পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহ বিভীষিকায় ভীত দেশবাসীর চিত্ত চাউলের মূল্য বৃদ্ধির সংবাদ পাইয়া শঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছে। 
রাজনৈতিক মতলববাজদের বৈঠকাদি ও তাঁহাদের সংবাদ পত্রাদিতে যেভাবে চাউলের মূল্যবৃদ্ধির কথা ফলাও করিয়া প্রচার করা হইতেছে এবং যেভাবে খাদ্য পরিস্থিতির নিদারুণ চিত্র দিনের পর দিন দেশবাসীর সম্মুখে তাঁহারা চিত্রিত করিয়া তুলিয়া ধরিতেছেন তাহাতে বাস্তবিকই শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কোন কোন জেলায় চাউলের মূল্য বৃদ্ধি পাইতেছে বটে। কেন যে বৃদ্ধি পাইতেছে এবং কীভাবে চেষ্টা করিলে ইহা রোধ করা যায় রাজনৈতিক মতলববাজরা তাহা জানেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মূল্যবৃদ্ধি হ্রাসের প্রচেষ্টায় অগ্রসর না হইয়া উল্টা পথে তাঁহারা পা বাড়াইয়াছেন। রাজনৈতিক ফায়দা উঠানোর প্রচারণা চলিতেছে, ‘এবার আর রক্ষা নাই, পঞ্চাশের মন্বন্তরের চাইতেও ভয়াবহ মন্বন্তর আসন’। তাঁহাদের এই প্রচারণা দেশের খাদ্য পরিস্থিতির উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া শুরু করিয়াছে। রাজনৈতিক ফায়দা ওঠানোর জন্যে মানুষ নানারূপ কৌশল অবলম্বন করিয়া থাকে বটে, কিন্তু এমন ঘৃণ্য ও সর্বনাশা কৌশল যে কোন মানুষ অবলম্বন করিতে পারে, ইহা ধারণা করাও কষ্টসাধ্য।[২] 

মিল্লাতের এই সম্পাদকীয়তে শুধু ‘রাজনৈতিক ফায়দার’ কথা উল্লেখ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিশেষতঃ কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভাকে এ ব্যাপারে দোষারোপ করার একটা প্রচ্ছন্ন চেষ্টা আছে। কিন্তু এই প্রচারণার জন্য দায়ী এবং তার থেকে মুনাফার ভাগীদার কেবলমাত্র ‘হিন্দু কংগ্রস’, ‘হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি রাজনৈতিক দলগুলিই ছিলো না। মুসলিম লীগ এবং তার ভেতরে বাইরে অবস্থিত জোতদার, আড়তদাররাও তার ভাগীদার ছিলো। শোষক শ্রেণীভুক্ত হিন্দু মুসলমান এ ক্ষেত্রে মিলিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছিলো। তাঁরা আর একবার প্রমাণ করেছিলো যে দুর্ভিক্ষ ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ নয়, শোষক শ্রেণীভুক্ত মানুষেরই অন্যতম অনাসৃষ্টি। 

১৯৪৭ এর গোড়া থেকে খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করার পর আগস্ট মাসে উত্তর এবং পূর্ব বাঙলায় তা রীতিমতো ভয়াবহ আকার ধারণ করে।[৩] এই ভয়াবহ খাদ্য পরিস্থিতির একটি চিত্র পাওয়া যায় ঢাকা জেলার বিক্রমপুর মহকুমার ওপর কমিউনিস্ট পার্টির বাংলা দৈনিক মুখপত্র স্বাধীনতায় প্রকাশিত ননী ভৌমিকের নিম্নোক্ত রিপোর্ট[৪] থেকে : 

খুট খুট খুট! নৌকোটি যখন খালের বাঁকে এসে পৌঁছালো তখন এই একঘেয়ে শব্দ আমার কানে বাজতে লাগলো। সকলে কথা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে হঠাৎ একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তাঁরা সকলেই স্থানীয় লোক। তাঁরা জানে এর অর্থ কি। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তাঁদের মধ্যে একজন ভাঙ্গা গলায় ফিস ফিস করে বললো : “তাঁরা ঘর ভেঙে ফেলছে। তাঁরাও চলে যাচ্ছে…।” ঢাকার বিক্রমপুরের মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ী পরিত্যাগ করছে। কাদাটে ধানীজমি ও ঘন সবুজ গাছ গাছড়ার মধ্যে এই সমস্ত ঘরবাড়ী একদিন হাস্য ও আনন্দ মুখরিত মানুষে ভর্তি থাকতো। কিন্তু এখন সেগুলি সব নিস্তব্ধ। গ্রামগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। 
আবার সেই দুর্ভিক্ষ। যারা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সাথে যুদ্ধ করে ভিটে আঁকড়ে পড়ে ছিলো, যারা গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়ে পরে আবার ফিরে এসেছিলো, তাঁরা নিজেদের ঘরবাড়ী আজ পরিত্যাগ করছে। চালের মূল্য মণপ্রতি ৩২ টাকা উঠেছে। মানুষ বাঁচার আশা করবে কীভাবে? 

বন্ধকী কারবারী ও মহাজনরা সেই দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজেদের উদরপূর্তি করছিলো সে সম্পর্কে রিপোর্টটিতে বলা হয়: 

কাজুর পাগলাইয়ে একজন বড়ো স্বর্ণকারের সাথে আমার দেখা হলো। প্রাচুর্যের আবেশে চোখ দুটি অর্ধমুদ্রিত রেখে সে বললো : “মধ্যশ্রেণীর মধ্যে দারিদ্র্য খুবই প্রকট। গত কয়েক বছরে আমি এত বেশী বন্ধক দিতে কখনো দেখি নি।” ৪৩ সালে তাঁরা অনেক কিছু বিক্রী করেছিলো। এবার সব কিছুই তাঁরা বন্ধক দিচ্ছে। মুসলমান কারিগরি ও মধ্যশ্রেণীর লোকেরা নিজেদের সব কিছু বন্ধকী দোকানে নিয়ে আসছে। সোনা খুব অল্পই। প্রধানতঃ রূপো এবং কাঁসার জিনিসপত্র। সোনা কারো কাছে নেই।” 

মধ্যশ্রেণীর অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়: 

লৌহজঙ্গে কনট্রোল দরে কিছু চাল পাওয়া যায়। প্রায় ৪০০ জনের মতো যথেষ্ট থাকলেও সেখানে প্রতিদিন জড়ো হয় ১৫০০ মানুষ। এদের অধিকাংশই স্ত্রীলোক। এমনকি মধ্যশ্রেণীর মেয়েরা পর্যন্ত সারি দিয়ে বসে থাকে। একজন হিন্দু প্রাথমিক শিক্ষক মুখে অদ্ভুত এক হাসি টেনে বললেন, “আমরা দুমাসে চার মণ আলু খেয়েছি। বাচ্চারা এটা আর সহ্য করতে পারছে না। মধ্যশ্রেণী এখন মিষ্টি আলু খেয়েই বেঁচে আছে।’ 

মধ্যশ্রেণীর থেকেও অবস্থা খারাপ দাঁড়ায় কারিগরদের। এ প্রসঙ্গে ননী ভৌমিক তাঁর রিপোর্টে লেখেন: 

কিন্তু শুধু মধ্যশ্রেণীরা একাই নয়। মধ্যশ্রেণীর প্রধান গ্রামগুলির চারিপাশে যে সমস্ত কারিগররা বসবাস করে তাঁদের পাড়াতে এই সংকট আরও অনেক গভীর। সেখানে মানুষ আরও সহায়হীন। বিগত দুর্ভিক্ষে তাঁদের জীবিকার উপায় নষ্ট হয়েছে, তাঁদের মৃতদেহই সে সময় দেখা গেছে চারিদিকে ছড়িয়ে থাকতে। তাঁদের কারও কোন জমি নেই, অনেকের নিজেদের বলতে কোন ঘরবাড়ীও নেই। 
কালাচাঁদ পোদ্দারের বাড়ী। সে তিন মাস পূর্বে বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে। এখানে তার বউ এবং তিন সন্তান থাকতো। সে কথা দিয়েছিলো তাঁদেরকে টাকা পাঠানোর। তিন মাসে এসেছে মাত্র দশ টাকা। একটা কাঁসার বাসন বিক্রী করা হয়েছে। তারপর একটা কানের দুল। কিন্তু এখন? আমার সঙ্গী জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের কি উপোস থাকতে হয়?” কালাচাঁদের বউ দরজার খুঁটি ধরে ঘোমটা দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে বললো, “তাছাড়া আর কি?” 
বীরভূম, বাঁকুড়ায় আমি চিরদুর্ভিক্ষাবস্থা দেখেছি। সেখানে নিম্নশ্রেণীর মানুষ বাঁচার চেষ্টা পর্যন্ত করে না। তাঁরা সোজা মরে যায়। এখানে কিন্তু অবস্থা অন্য রকম। এখানে মানুষ শেষ পর্যন্ত লড়াই করে। কিন্তু এবার তাঁদের লড়াই পর্যন্ত বৃথা হচ্ছে। 

বিভিন্ন শ্রেণীর কারিগরদের অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্টটিতে ননী ভৌমিক বলেন: 

“ঋষি” শ্রেণী গোয়াজিবন্দায় বাস করে। তারা চর্মকার। সেখানে ষাটটি পরিবারের বসবাস। গত দুর্ভিক্ষে সাতাত্তরজন সেখানে মারা গেছে। চামড়ার কাজের জন্য কোন চামড়া আজ নেই। জমির ওপর চাপ বেড়েছে। কেউ কেউ ঝুড়ি তৈরী করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক বেলার বেশী আহার তাদের জোটে না। অন্যদের ক্ষেত্রেও সেই এক কথা। জেলে, তাঁতী, কৃষক, হিন্দু ও মুসলমান সকলেরই এক ভাগ্য – মৃত্যু। 

বাণীগাঁও-এ তাঁতীদের পাড়া। এখানে তের হাজার মানুষ বাস করে। সাতষট্টিটি পরিবার অর্ধ উপবাসের মধ্যে আছে, দুটি পরিবার উপোস করছে। 

ইব্রাহিম এবং ওমর আলী দুই ভাই। একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ ছয়জন। পাঁচ গজ জায়গায় একটা টিনের ঘরের মধ্যে তাঁরা থাকে। তাঁত এখন নিস্তব্ধ এবং তাঁদের কোন খাদ্য নেই। তাঁরা বললো, “আমরা উপোস করছি। সুতো কোথায়? আমরা কনট্রোলের থেকে কিছু পাই – কিন্তু কার্ড মহাজনের কাছে জমা দেওয়া আছে।[৫] সে কখনো সখনো দুই এক টাকা দেয়।” শুধু কার্ড নয়, এই ছয়জনের জীবনই মহাজনের কাছে বন্ধক দেওয়া আছে। মেদনীমণ্ডা গ্রামে ১২০টি জেলে পরিবার ছিলো। দুর্ভিক্ষের (১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ – ব.উ.) পর সেখানে আছে ৭০টি পরিবার। এখন তাঁদের মধ্যে ৪০টি অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছে। বিক্রমপুরের কারিগররা ধ্বংসের মুখোমুখি। 

সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার এই যে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের কথা কেউ বলছে না। রিলিফ দাবী করার কথা কেউ চিন্তা করছে না। 

এই দুর্ভিক্ষাবস্থাতেও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়: 

হিন্দু ভদ্রলোকরা বলছে: সকলেই চলে যাচ্ছে। আমাদের মনে হয়, আমাদেরও চলে যাওয়া দরকার। তাঁরা কয়েকদিনের পুরানো খবরের কাগজে সিন্ধের ঘটনাবলীর কথা, অন্য কোন জায়গায় স্ত্রীলোক অপহরণের কথা পড়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। চালের মূল্য কমবে কিনা তারা সেটা জিজ্ঞেস করে না। তারা জানতে চায়, “আমাদের পক্ষে কি এখানে থাকা সম্ভব হবে?” শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। তাঁরা সর্বত্র জোর গুজব কান পেতে শোনে। মধ্যবিত্তরা চলে যাচ্ছে। তাঁরাও সস্তা খাদ্য পাবে কিনা জিজ্ঞেস করে না। হতাশায় তারা চীৎকার করে ওঠে : তারা সকলে চলে যাচ্ছে। আমরা কীভাবে থাকবো, কার কাছে আমরা কাজ করবো এসব কথা চিন্তার কোন পরোয়া তারা করে না”। পাকিস্তান অর্জিত হয়েছে। মুসলমানরা আশা করে যে দ্রব্যমূল্য এখন কমে আসবে। তারাও এখন বিশেষভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের কোন চিন্তা করে না। তারা পালিয়ে যাচ্ছে না; তারা আশার এই সামান্য আলোক ধরে থেকে যাচ্ছে। ভেতরে একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি এবং অসহায় প্রতীক্ষা। এই সব উপবাসী মুসলমানরা নিজেদের নেতাদের দিকে বিরাট আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। 

কুকুটিয়া ইউনিয়নের অবস্থা সম্পর্কে ননী ভৌমিক লেখেন: 

কুকুটিয়া ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে প্রায় ৫০ জন স্ত্রীলোক জড়ো হয়েছে। তারা শুনেছে যে, তাঁদেরকে বিনা পয়সায় চাল দেওয়া হবে। তারা নিজেদের রেশন কার্ড সাথে করে নিয়ে এসেছে। হিন্দু মুসলমান কারো কার্ডেই কোন জমা নেই। জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত একদানা চালও তারা পায়নি। 
প্রত্যেককে চার সের করে খুদ দেওয়ার কথা। তাও আবার সকলকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট নেই। কিন্তু তবু তারা এসেছে। ভাঙ্গাফুটো নৌকায় চড়ে মেয়েরা এসেছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সাঁতরে নদী পার হয়েছে। 
তাদের মধ্যে ছিলো রাজুবালা। সে বেশ কয়েকদিন ধরে উপোস করছিলো। কখনো তিন দিন বুক পর্যন্ত জল পার হয়ে, কখনো সাঁতরে এসে সে “কনট্রোলে” চাল পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিসারা বেওয়া নামে একটি অন্ধ বৃদ্ধা মেয়েও এসেছিলো। বাড়ীতে সে রেখে এসেছিলো তার বউ এবং তিনটি নাতিকে। নর্তন বিবি, সুরবালা, কাহিরণ এবং আরও অনেকে। তারা সকলেই এসেছে এবং তাদের সকলের চোখে মুখে সেই একই মর্মান্তিক কাহিনী লেখা আছে। দুর্ভিক্ষের কথা বলায় তারা সকলে এক সাথে বিড়বিড় করে বলে: “আকাল – হায় আল্লা! আমরা পাটশাক সিদ্ধ খেয়ে থেকেছি, ঢাকায় গেছি আর ফেনের জন্য চীৎকার করেছি। সেই আকাল আবার আসছে”। 

একটি কুজো মুসলমান বৃদ্ধা এক কোণে চুপচাপ বসেছিলো। সে ফিসফিস করে বললো: “গতবারে আমি বাড়ীতে ছিলাম, কিন্তু এবারে আমাকেও বাইরে আসতে হয়েছে।”

এই ভয়াবহ খাদ্য পরিস্থিতি এবং দুর্ভিক্ষাবস্থা সম্পর্কে সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যের উদাহরণ দিতে গিয়ে ননী ভৌমিক কুকুটিয়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের সাথে নিম্নলিখিত কথপোকথনের বর্ণনা দেন: 

ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টকে আমি জিজ্ঞেস করলাম “এখানকার দুস্থ লোকদের সংখ্যা কত তার কোন হিসেব কি আপনি তৈরী করেছেন?” 

“না! 

“আপনি কি জানেন কখন আপনি রিলিফের জন্যে আরও চাল পাবেন?” 

“না!” 

“কর্তৃপক্ষেরা কি আপনার প্রয়োজন সম্পর্কে আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি?” 

পূর্বের মতোই অবিচল থেকে তিনি বললেন, “না! আসুন আমরা যা পেয়েছি সেটাই বিলি করে শেষ করে দি। আমাদের কাজ এখানেই খতম। 

ননী ভৌমিকের এই রিপোর্ট ছাড়াও ত্রিপুরার ওপর আনন্দ পালের আর একটি পৃথক রিপোর্ট কমিউনিস্ট পার্টির ইংরেজী সাপ্তাহিক মুখপত্র পিপল্স্ এজ-এ ছাপা হয়।[৬] তাতে আনন্দ পাল বলেন: 

সমগ্র ত্রিপুরা জেলা নিদারুণ দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়েছে। আউশ ফসল হয়নি এবং জনসংখ্যার শতকরা নিরানব্বই জনকে তাদের চালের জন্য বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়। চালের দর প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ তা বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৩৫ টাকায়। এর ফলে অধিকাংশ লোক তিন চার দিনে একবার মাত্র ভাত খেতে পায়। অন্যান্য দিনে তাঁরা আলুসেদ্ধ বা ‘আরবী’ খেয়ে থাকে। দু মাস আগে যখন পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে শুরু করলো তখন স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষক সভা সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্ৰস্ত এলাকা সমূহে কতকগুলি অন্নছত্র খোলে। এখন প্রত্যেকদিন শত শত মানুষ – হিন্দু, মুসলমান, পুরুষ, নারী, শিশু সেই সমস্ত অন্নছত্রে এসে হাজির হচ্ছে। 

লাকসাম থানার বিজনিয়াবাজার এলাকায় এই ধরনের একটি অন্নছত্রে আমি প্রায় ৪০০ হিন্দু মুসলমান কৃষককে দেখলাম। পুরানো টোল খাওয়া মগ এবং মাটির বাসন নিয়ে খিচুড়ির আশায় তাদের বসে থাকা – সে এক করুণা উদ্রেককারী দৃশ্য। 

তাদের মধ্যে অধিকাংশই নয় থেকে আঠারো বিঘে জমির মালিক ছিলো। বকেয়া খাজনা এবং ক্রমাগত বাড়তি ঋণের দায়ে তাদের জমি চলে গেছে। কপর্দকহীন হয়ে তারা রাস্তায় দাঁড়িয়েছে এবং পরিণত হয়েছে ভিক্ষুকে। 

৫৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ আবদুর রহমানের ভাগ্যেও তাই ঘটেছে। সে নিজের দুটি নাতিকে সাথে করে পাশের গ্রাম থেকে এসেছে। দ্বারকানাথেরও সেই এক কাহিনী। পাঁচজন পোষ্যসহ গোপাল দাসও আজ ভিখারী। 

এক হাঁড়ি খিচুড়ী নিয়ে বসে থাকা অবস্থায় কাসেম আলীর কুঞ্চিত গাল বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো : “একদিন আমার আঠারো বিঘে জমি ছিলো। আমি অনেক গরীব মানুষকে নিজেই খাবার দিয়েছি। আর এখন, আমি নিজেই হলাম একজন ভিখারী।” 

এই এলাকায় ৩৭টি গ্রামের থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ জন খাদ্যের জন্যে এখানে আসে। প্রায় ৪০ জনকে বিনা পয়সায় চাল দেওয়া হয়। 

চান্দিনা থানার দেওরা ইউনিয়নে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং কৃষক সভা যৌথভাবে এই অন্নছত্র চালাচ্ছে। এখানে প্রতিদিন ৫০০ এর বেশী হিন্দু মুসলমান কৃষক খাদ্য পায়। 

ঐ একই এলাকায় ভাউকসার গ্রামে আর একটি অন্নছত্রও চালু আছে। এখানে ২২৫ জন হিন্দু-মুসলমান দুস্থকে খেতে দেওয়া হয় নতুবা তাঁদেরকে বিনামূল্যে চাল দেওয়া হয়। বর্তমান অন্নছত্রগুলিতে মানুষ যত দলে দলে এসে হাজির হচ্ছে ততই অবস্থার অবনতি ঘটছে এবং রিলিফের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনগণের রিলিফ কমিটি রিলিফের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে অর্থের আবেদন জানিয়েছে। 

২. পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার মন্ত্রীদের কাছে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার খোলা চিঠি

১৫ই অগাস্ট, ১৯৪৭ অর্থাৎ ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিকতার অবসান এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিষ্ঠা দিবসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার মন্ত্রীদের কাছে একটি খোলা চিঠিতে সমগ্র খাদ্য পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে তাঁদেরকে তৎক্ষণাৎ দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য আহ্বান জানান।[৭] 

পূর্ব বাঙলার খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রথমে তাঁরা বলেন: 

ঠিক এই মুহূর্তে যখন ক্ষমতা হস্তান্তরিত হতে যাচ্ছে তখন এক ভয়াবহ খাদ্য সংকট সমগ্র বাঙলাদেশকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। এই সংকটের চরিত্র অবশ্য দুই বাঙলাতে স্বতন্ত্র। পূর্ব বাঙলার খাদ্য পরিস্থিতি খুবই খারাপ। চালের মূল্য ৩০ টাকার উপরে উঠে গেছে। কেবলমাত্র ছয় লক্ষ লোকের জন্যে রেশনিং চালু হয়েছে এবং সেখানেও রেশন দোকানগুলিতে প্রায়ই সরবরাহ বন্ধ থাকে। গ্রামাঞ্চলে কোন কোন ঘাটতি এলাকায় যে আংশিক রেশনিং চালু করা হয়েছিলো তাও অনেক আগেই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। রিলিফ বিতরণ অথবা মূল্য কমিয়ে আনার জন্যেও খাদ্য সরবরাহ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। 

এর ফলে হিন্দু মুসলমান সকলকেই আজ পাইকারীহারে উপবাস থাকতে হচ্ছে। ত্রিপুরা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে যে বেসরকারী অন্নছত্রগুলি খোলা হয়েছে সেগুলি আমাদেরকে ১৯৪৩ সালের ভয়ানক দিনগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। অনাহারে মৃত্যুর খবর ক্রমাগতই আসছে। বিশালভাবে গ্রাম পরিত্যাগ করে মানুষ দলে দলে শহরের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে। পূর্ব বাঙলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখন সত্যিকার দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। 

পশ্চিম বাঙলার পরিস্থিতি সম্পর্কে কৃষক সভার এই দলিলটিতে নিম্নোক্ত বিবরণ দেওয়া হয়: 

পশ্চিম বাঙলায় কলকাতা এবং বিভিন্ন জেলায় ষাট লক্ষ, অর্থাৎ সমগ্র জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মানুষ রেশন প্রথার অধীনে আছে। এ জন্যেই এখানে চালের মূল্য পূর্ব বাঙলার মতো এতো উঁচুতে উঠতে পারেনি। গ্রামাঞ্চলে চাল ১৮ থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রী হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষক শ্রমিকদের পক্ষে এই দরেও কেনা সম্ভব হচ্ছে না এবং তাদের অধিকাংশই উপবাসী থাকছে। 

যে সমস্ত জায়গায় রেশন প্রথা আছে সেখানে দৈনিক রেশন হিসেবে মাত্র পাঁচ ছটাক দেওয়ার ফলে তাঁরা অন্ততঃ অর্ধ উপবাসী অবস্থায় থাকছে। গত ১৪ই জুলাই থেকে মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়া জেলাতে রেশন প্রথা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এমনকি কলকাতা শহরেও রেশন দোকানগুলিতে সরবরাহ খুব অনিয়মিত হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে যে সরকারী মজুদ সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে গেছে। মানুষ পরস্পরকে জিজ্ঞেস করছে :

মাদ্রাজের মতো এখানেও কি দৈনিক রেশন আরও কমিয়ে দেওয়া হবে? না রেশনিং ব্যবস্থা পুরোপুরিই ভেঙে পড়বে? প্রকৃত খাদ্য ঘাটতির কথা অস্বীকার করে কৃষক সভার এই চিঠিতে বলা হয় যে সেই ধরনের সংকটময় খাদ্য পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার কোন সঙ্গত কারণ ছিলো না। সরকারী হিসেব মতো বিচার করলেও এ কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। খাদ্য কমিশনার এস.কে. চ্যাটার্জীর ৬ই মার্চ, ১৯৪৭, তারিখের বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁরা বলেন যে পূর্ববর্তী শীতে ৮৫ লক্ষ টন আমন চাল উৎপন্ন হয়েছে এবং পরবর্তী শরতে ২৩ লক্ষ টন আউশ আশা করা যাচ্ছে। অর্থাৎ খাদ্য বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে ১০৫ লক্ষ টন প্রয়োজনের তুলনায় উৎপন্ন হচ্ছে ১০৮ লক্ষ টন। যাই হোক চিঠিতে তাঁরা বলেন যে এই সব হিসেবের মধ্যে কিছুটা অতিরঞ্জন থাকলেও জুলাই মাসে কোন খাদ্য ঘাটতির প্রশ্ন উঠতে পারে না। কাজেই বাঙলাদেশের ট্রাজেডী হলো – “খাদ্যের প্রাচুর্যের মধ্যে দুর্ভিক্ষ।” 

সরকার খাদ্য সংগ্রহ করতে কেন ব্যর্থ হয়েছেন সে সম্পর্কে কৃষক সভা এই চিঠিতে বিস্তারিতভাবে নিম্নলিখিত কারণগুলি উল্লেখ করেন: 

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পর থেকে বাঙলা সরকারের অনুসৃত খাদ্য নীতির সারাংশ হলো : ‘জনগণকে খাদ্য দানের জন্য জোতদার ও কালোবাজারীদের ওপর আস্থা রাখো’। 

প্রধান প্রধান এজেন্সীগুলি এ বছর তুলে দেওয়া হয়েছে এবং আমলাতন্ত্র দাবী করছে যে তারা এখন সরাসরি সরকারী সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করেছে। এখন আমাদের খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন প্রক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখা দরকার। 

১. খাদ্য সংগ্রহ 

সংগ্রহ বিভাগের নির্দেশসমূহ জনগণের জন্যে মহা গোপন ব্যাপার। আমরা কেবল তার প্রয়োগ সম্পর্কেই জানতে পারি। শুধু সরকারের জন্যে ধান চাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ধানকলগুলিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। ধান চালের ব্যবস্থার জন্যে ব্যক্তিগতভাবেও অনেককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে কিন্তু তাদের দ্বারা ক্রীত সমগ্র মজুদ সরকারের কাছে বিক্রীর কোন রকম বাধ্যবাধকতা নেই। 

বড়ো বড়ো খাস জমির মালিকদের জন্যেও লাইসেন্স নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তারাও তাদের উদ্বৃত্ত মজুদের সমগ্র অথবা কিছু অংশ সরকারের কাছে বিক্রী করতে বাধ্য নয়। কাজেই সরকারের কাছে বিক্রীর জন্যে ব্যবসায়ী অথবা জোতদার কারো কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

২. মূল্য নির্দিষ্ট নেই 

ধান কল থেকে সরকারের কাছে ধান চাল বিক্রীর দর খুব কম নির্ধারণ করা হয়েছে – ধান ৬ টাকা ৪ আনা মণ এবং চাল ১০ টাকা ১৪ আনা মণ। কিন্তু ব্যবসায়ী অথবা জোতদারদের দ্বারা অন্যত্র বিক্রীর ক্ষেত্রে কোন দর নির্ধারিত হয়নি। 

ধান চাল চলাচলের ব্যাপারে তাদেরকে কতকগুলো বিধিনিষেধ মেনে চলতে হলেও এর ফলে সরকারের খাদ্য নীতি অনুসারে সরকার ছাড়া অন্যদের কাছে যে কোন দরে বিক্রীর জন্যে আড়তদার ও জোতদাররা স্বাধীনতা পায়। 

৩. কর্ডন ও বিধিনিষেধ 

বিশেষ বিশেষ এলাকার চতুর্দিকে কর্ডন আছে এবং তার বাইরে চলাচল নিষিদ্ধ। কর্ডনের মধ্যে এক কালে ২০ মণ পর্যন্ত চলাচল করতে দেওয়া হয়। চলাচলের উপর এই সমস্ত নিষেধাজ্ঞা এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্টের অধীনস্থ পেট্রোল পার্টির দ্বারা বলবৎ রাখার কথা। 

৪. খাদ্য বিভাগে দুর্নীতি 

এখানেই আমরা দেখতে পাই বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের সংগ্রহ, এনফোর্সমেন্ট, মজুত ও বিতরণ ইত্যাদি সকল শাখায় প্রচলিত দারুণ দুর্নীতি। আইন তৈরী হয় আড়ৎদার অথবা জোতদারদের হাত বাঁধার জন্য নয়, ডিপার্টমেন্টের লোকদের ঘুষ খাওয়ার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য। 

৫. জনগণের সহযোগিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা 

সবশেষে, এই খাদ্যনীতির প্রয়োগ কিভাবে হচ্ছে জনগণের পক্ষ থেকে তা দেখাশোনার কোন ব্যবস্থা সেখানে নেই। সংগ্রহ এবং এনফোর্সমেন্ট বিভাগ জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিতরণ দেখাশোনার জন্য খাদ্য কমিটিসমূহ গঠিত হয়েছিলো কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এখন সেগুলির বিলোপ সাধন করা হয়েছে। এইভাবে খাদ্যনীতি জনগণের খাদ্যকে নিরাপদে জোতদার ও চোরাকারবারীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে সংগ্রহের কাজ বানচাল করে জনগণের জন্য দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করছে। 

এর থেকেই বোঝা যায় এ বৎসর জুন মাসের শেষ পর্যন্ত সরকার ৩.৫৮ লক্ষ টনের বেশী কেন সংগ্রহ করতে পারেননি। গত বৎসরের থেকে এই অঙ্ক মাত্র ২৫ হাজার টন বেশী। উৎপন্ন খাদ্যের একটা বিরাট অংশ জোতদারদের কাছে মজুত আছে এবং ইতিমধ্যেই তারা তার একটা অংশ চোরাকারবারী ব্যবসায়ীদের কাছে হস্তান্তর করেছে। একদিকে কৃষক জনতার ক্রমাগত দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে খাস জমির পরিমাণ বৃদ্ধি এই হলো যুদ্ধকালীন বৎসরগুলিতে গ্রাম্য অর্থনীতির পরিবর্তনের ধারা। খোদ কৃষকের শতকরা একচল্লিশ ভাগই আজ ভাগচাষী (অধ্যাপক এ ঘোষ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট)। হিসেব অনুসারে ১ কোটি ২০ লক্ষ একরের বেশী জমি বর্গাপ্রথায় চাষ আবাদ হয়। এই বর্গাপ্রথার মাধ্যমেই বিক্রয়যোগ্য অতিরিক্ত চাল মাত্র অল্পসংখ্যক জোতদারের হাতে একচেটিয়াভাবে চলে যায়। কাজেই প্রয়োজন ও সরবরাহের নিয়ম নয়, একচেটিয়া কর্তৃত্বের নিয়মই ধান চালের মূল্য নির্ধারণ করে। 

সরকারের খাদ্য সংগ্রহ ও বিতরণের ব্যর্থতার উপরোক্ত কারণগুলি উল্লেখের পর খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে কৃষক সভার পক্ষ থেকে এখানে বলা হয় যে প্রচলিত খাদ্য নীতির বিলোপই লক্ষ লক্ষ মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের দাবী। খাদ্য সংগ্রহ ও বিতরণের ক্ষেত্রে জনগণের ওপর আস্থাই নোতুন সরকারের খাদ্যনীতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিত বলেও তাঁরা উল্লেখ করেন। এ পর্যন্ত খাদ্যনীতির কাহিনী হচ্ছে জোতদার ও চোরাকারবারীদের সাথে আঁতাত এবং তাদের ওপর ক্রমবর্ধমান আস্থার কাহিনী। এর পরিবর্তে নোতুন খাদ্যনীতির যুগ হওয়া উচিত খাদ্য উৎপাদক কৃষক ও সাধারণ মানুষের সাথে মৈত্রী এবং তাদের ওপর আস্থার যুগ। এই নীতির ওপর ভিত্তি করে বঙ্গীয় কৃষক সভা দুই বাঙলার মন্ত্রীসভার কাছে নিম্নোক্ত খাদ্য পরিকল্পনার সুপারিশ করেন: 

ক. দুই বাঙলাতেই খাদ্য আছে 

এই বৎসরের কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য পশ্চিম বাঙলায় আরও তিন লক্ষ টন এবং পূর্ব বাঙলায় সাড়ে তিন লক্ষ টনের প্রয়োজন হবে। নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি জরুরী আইন প্রণয়ন করা দরকার: 

১. ২৫ বিঘা অথবা তার অধিক জমির মালিকদেরকে একটা নির্দিষ্ট উচিত মূল্য দিয়ে তাদের থেকে সমস্ত অতিরিক্ত মজুত বাধ্যতামূলকভাবে রিকুইজিশন। আউশ ধান সংগ্রহের কাজ শুরু করা। 

২. ধান কল ও কারবারীদেরকে প্রদত্ত সমস্ত লাইসেন্স বাতিল করে লাইসেন্সের মাধ্যমে তাদের সমস্ত মজুত শস্য নির্দিষ্ট উচিত মূল্যে সরকার কর্তৃক ক্রয়। 

৩. যে সমস্ত ধানকলগুলি সরকারের খাদ্য পরিকল্পনা বানচাল করার চেষ্টা করছে সেগুলি রিকুইজিশন করে সরকারী নিয়ন্ত্রণে চালু করা। 

৪. জনগণের সহযোগিতায় ২৫ বিঘা অথবা তদূর্ধ্ব খাস জমির মালিকদের অতিরিক্ত মজুদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করা। এই সংগ্রহ ও মজুদ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য আইন অনুযায়ী অথবা আইনের দ্বারা স্বীকৃত জনগণের যে কমিটিগুলি গঠিত হবে সেগুলির নির্বাচনে ২৫ বিঘা অথবা তদূর্ধ্ব জমির মালিকদের অংশ গ্রহণ করতে না দেওয়া অত্যাবশ্যক। 

৫. সারা বৎসরের জন্যে ধানের মূল্য ৮ টাকায় নির্দিষ্ট রাখা এবং উচ্চতর মূল্যে ক্রয় অথবা বিক্ৰী দণ্ডনীয় করা উচিত। 

৬. চাষীর দখলভুক্ত জমি থেকে তার উচ্ছেদ রহিত করা উচিত। 

৭. খাদ্য ও রিলিফ বিতরণ জনগণের কর্তৃত্বে রাখা উচিত। 

৮. উপরোক্ত জরুরী ব্যবস্থাসমূহ কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে এখনই কিছু সরবরাহের ব্যবস্থা করা উচিত। 

খ. সংগ্রহ ও বিতরণের সাধারণ নীতি 

সাধারণ সংগ্রহ নীতিকে নিম্নোক্ত নীতিগুলির ভিত্তিতে নির্ধারণ করা উচিত: 

১ . রেশনিং : কৃষি অর্থনীতি পুনর্গঠিত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমানে যে সমস্ত এলাকায় রেশনিং চালু আছে সেখানে তা চালু রাখা এবং সমস্ত শহর ও ঘাটতি এলাকায় তা সম্প্রসারণ করা। বর্তমান রেশনিং আইনের মেয়াদ ছয় মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং একটি নোতুন রেশনিং আইন পাস করা উচিত। নিম্নতম দৈনন্দিন রেশন হওয়া উচিত মাথাপিছু আধ সের। 

২. উৎপাদক-ক্রেতা সমবায় : উৎপাদক-ক্রেতা সমবায় গঠনের জন্য একটি নোতুন আইন পাস করা উচিত। এই সমবায়গুলিকে সমবায় বিভাগের অধীনে না রেখে উপরোক্ত আইনে বিশেষভাবে গঠিত জনগণের খাদ্য কমিটির নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বে (Supervision) রাখা উচিত। 

ক. এই সমবায়গুলির মাধ্যমেই সমস্ত খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিতরণ করা উচিত। 

খ. এই সমবায়গুলির মাধ্যমে সমস্ত অতিরিক্ত খাদ্য বাধ্যতামূলকভাবে সংগ্রহ করা উচিত। নিদারুণ খাদ্য সংকটের পুনরাবৃত্তি যাতে ঘটতে না পারে তার জন্য ধান চালের ব্যক্তিগত ব্যবসা বেআইনী করে সরকার কর্তৃক একচেটিয়াভাবে সমস্ত অতিরিক্ত মজুত সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করা উচিত। 

গ. এই সমবায়গুলির মাধ্যমে উৎপাদনকারীরা যাতে নিজেদের জিনিস বিক্রীর জন্যে উৎসাহ বোধ করেন সেই উদ্দেশ্যে কৃষকদের বস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির নিম্নতম চাহিদা মেটানোর জন্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তাদেরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া উচিত। 

৩. জনগণের খাদ্য কমিটি : ন্যায়সঙ্গত বিতরণের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত জনগণের খাদ্য কমিটিকে নোতুনভাবে গঠন করা উচিত। 

গ. খাদ্য উৎপাদন 

খাদ্য সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান প্রচুর খাদ্য উৎপাদনের মধ্যেই নিহিত এবং তা সম্ভব একমাত্র ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে। বাঙলাদেশের জমিদারী ব্যবস্থাই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ। জমিদারী ব্যবস্থার থেকে উদ্ভূত জোতদারী ও আধি কৃষিকার্যের সাথে সম্পর্কহীন মাত্র অল্প কয়েকজন মালিকের হাতে জমি এবং শস্য কেন্দ্রীভূত করেছে। সেজন্যেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার জন্য এখনই নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। 

১. নোতুন আইন প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত চাষীকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা স্থগিত রাখতে হবে। 

২. কয়েকজন বড়ো জোতদারের হাতে ক্রমবর্ধমান হারে খাদ্য মজুত বন্ধ করতে হবে। ভাগচাষীকে ফসলের এমন একটা নিম্নতম ভাগের (দুই তৃতীয়াংশ) নিশ্চয়তা দিতে হবে যা তার উৎপাদন ও জীবনধারণের খরচ মেটাতে পারে। দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তে-ভাগার দাবী খুবই ন্যায় সঙ্গত এবং তাকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে এখনই একটা জরুরী আইন পাস করা উচিত। 

৩. তোলায় খাজনা ( Rent in kind ) এখনই বিলোপ করতে হবে; 

৪. সমস্ত পতিত জমি এখনই চাষের জন্য গরীব কৃষক ও ভূমিহীন শ্রমিকদের হাতে তুলে দিতে হবে; 

৫. জমিদারী উচ্ছেদের জন্য এখনই একটি বিল পেশ করে এক বৎসরের মধ্যে তাকে আইনে পরিণত করতে হবে। এই আইনে খাস দখলে ৭৫ বিঘার উপর সমস্ত জমি কৃষক ও ভূমিহীন শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণের এবং কৃষিকার্যের সাথে সম্পর্কহীন যে সমস্ত দুস্থ পরিবারের জমি রাষ্ট্র নিয়ে নেবে তাঁদের জন্য রাষ্ট্রীয় সাহায্যের ব্যবস্থা থাকবে; 

৬. উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জনগণের সহযোগিতা ও রাষ্ট্রীয় সাহায্যের মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা কার্যকরী করা উচিত; শস্য ব্যাংকের মাধ্যমে চাষীদেরকে নগদ অর্থ এবং সস্তায় ধান কর্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার; 

৭. নিরপেক্ষ বিচারকমণ্ডলীর মাধ্যমে ভূস্বামী ও কৃষকদের মধ্যেকার বিবাদ মীমাংসার জন্য একটি আইন করা উচিত; 

৮. খাদ্য সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সাধারণ খাদ্যনীতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে উভয় রাষ্ট্রের জন্য একটি যুক্ত খাদ্য কাউন্সিল থাকা উচিত। 

কৃষক সভার এই খাদ্য সংগ্রহের সুপারিশ মালাবারে প্রচলিত ব্যবস্থার অনুরূপ বলে তাঁরা উল্লেখ করেন। এ ছাড়া যুক্ত প্রদেশ ও মাদ্রাজে আইনের দ্বারা কৃষক উচ্ছেদ বন্ধের এবং জমি সংক্রান্ত বিবাদ নিষ্পত্তির জন্যে মাদ্রাজে একটি পৃথক আইন প্রণয়নের কথাও তাঁরা উল্লেখ করেন। এর পর উভয় বাঙলার মন্ত্রীসভা জনপ্রিয় খাদ্যনীতির মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসবেন এই মর্মে আশা প্রকাশ করে এবং এ ক্ষেত্রে কৃষক সভার পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে তাঁরা বলেন: 

হিন্দু ও মুসলমান কৃষকদের মিলিত গণসংগঠন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই এবং বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য নিজেদের সমস্ত শক্তি ও সম্পদ নিয়োজিত করছে। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় স্বাধীন, 

সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য পূর্ণ সহযোগিতার জন্য তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছে। এর পর দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে নির্যাতন বন্ধের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করে কৃষক সভার পক্ষ থেকে সমস্ত নির্যাতনমূলক আদেশ প্রত্যাহার করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়: 

আজকের পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে সাফল্যের সাথে লড়াই করতে হলে নাগরিক অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সকল রাজনৈতিক বন্দীকে সাধারণভাবে মুক্তিদান অবশ্য প্রয়োজনীয়। খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন পরিচালনার জন্য নির্যাতন প্রত্যাহার করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতেই হবে। 

কৃষকরা বুঝুক যে তাদের নিজেদের নেতারাই ক্ষমতায় এসেছে : দেশকে তারা কখনো নিরাশ করবে না। 

বলাই বাহুল্য কৃষক সভার এই সমস্ত সুপারিশ অনুযায়ী দুই বাঙলার কোন অংশেই দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের কোন প্রচেষ্টা হয়নি। পশ্চিম বাঙলার কলকাতা এবং অন্যান্য অঞ্চলে রেশনিং ব্যবস্থা অনেকখানি বেশী এলাকা জুড়ে চালু থাকায় পূর্ব বাঙলার তুলনায় সেখানে খাদ্য সংকট এত তীব্র আকার ধারণ করেনি। তবে পূর্ব বাঙলার বিস্তৃত এলাকায়, বিশেষতঃ ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, সিলেট ইত্যাদি জেলায় ব্যাপক খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং সেই অবস্থাকে আয়ত্তে আনার জন্যে সরকারী উদ্যোগ খুব সীমিত থাকে। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে বোরো ফসল ওঠার পর বাজারে ধানচাল পূর্বাপেক্ষা বেশী আমদানীর ফলে এবং সরকারী গুদাম থেকে বিভিন্ন ঘাটতি এলাকায় কিছু পরিমাণ চাল পাঠানোর ফলে ১৯৪৭ এর শেষের দিকে খাদ্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু এই সাময়িক উন্নতির পর ১৯৪৮ এর প্রথম থেকেই খাদ্য সংকট আবার বৃদ্ধি পায় এবং পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। 

৩. কর্ডন প্রথা উদ্ভূত পরিস্থিতি 

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় থেকেই বাঙলাদেশের বিহার সীমান্তে কর্ডন প্রথা চালু হয়। কারণ বাঙলায় তখন দারুণ খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ায় বিহার থেকে খাদ্য শস্য বাঙলাদেশে চলে আসছিলো এবং তাতে বিহারেও খাদ্যাভাব ঘটার সম্ভাবনা ছিলো। এই সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্যে তৎকালীন বৃটিশ ভারত সরকার বাঙলা বিহার সীমান্তে কর্ডন প্রথা চালু করেন। 

১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসে দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাঙলায় যে কর্ডন প্রথা চালু করা হয় তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ। পূর্ব বাঙলা সরকার মনে করেছিলেন যে সতেরোটি জেলার মধ্যে আটটি উদ্বৃত্ত জেলার ধান চাল সংগ্রহ করে তারা ঘাটতি এলাকাগুলিতে নিয়ে যাবেন। এর ফলে ঘাটতি এলাকার ঘাটতি যেমন একদিকে পূরণ হবে, অন্যদিকে তেমনি সাধারণভাবে চালের মূল্যও হ্রাস পাবে। 

যে সমস্ত জেলাতে তখন কর্ডন ছিলো সেগুলির বাইরে কোন ধান চাল বেসরকারীভাবে জেলার বাইরে যাওয়া ছিলো নিষিদ্ধ। কেউ যাতে বেআইনীভাবে ধান চাল কর্ডন এলাকার বাইরে নিয়ে যেতে না পারে তার জন্যে জেলার চারিদিকে তখন সরকারী পাহারার ব্যবস্থা ছিলো। জেলা কর্ডনিং অফিসাররা এই পাহারার দায়িত্বে ছিলেন এবং স্থলপথ ও জলপথে চোরাচালান বন্ধের জন্যে তাদের অধীনে তখন যে সমস্ত পেট্রোল পার্টি থাকতো তারা নৌকা, স্পীড বোট, এবং অন্যান্য যানবাহনের সাহায্যে জেলাগুলির সীমান্ত পাহারা দিতো। বরিশাল ও খুলনা জেলা সমুদ্রের ধারে অবস্থিত থাকায় এই দুই জেলা থেকে সমুদ্রপথে চোরাচালানীরা ধান চাল পাচার করতো। এজন্যে এই দুই জেলায় সমুদ্রগামী লঞ্চও কর্ডনিং অফিসারদেরকে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এত সব ব্যবস্থা সত্ত্বেও সরকারের দ্বারা চোরাচালান বন্ধ করা ঠিকমতো সম্ভব হতো না। 

কোন চোরাচালানকারী মালসহ সরকারী পেট্রোল পার্টির হাতে ধরা পড়লে আইনতঃ তার সমস্ত মাল বাজেয়াপ্ত করার নিয়ম ছিলো। কিন্তু চোরাচালান ব্যতীত বেচাকেনার ব্যাপারে অন্য কোন বেআইনী কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লে নিয়ম ছিলো তাদের সমস্ত মাল শাস্তিমূলক দরে কিনে নেওয়া। এই ধরনের বেআইনী কাজ যে শুধু ব্যবসায়ীরাই করতো তাই নয়, সে সময়কার অনেক গণ্যমান্য এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিও অনেক সময় ধান চাল কেনাবেচার ব্যাপারে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকতেন। 

এই ধরনের একটি ঘটনার উল্লেখ এখানে করা যেতে পারে[৯]। খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুর জেলার সীমান্তে মাথিভাঙা নামে ফরিদপুরের মোহন মিঞাদের একটি চর এলাকা ছিলো। সেখানে তারা নিজেদের তত্ত্বাবধানে ধান চাল বেচাকেনার একটি কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সে সময়ে এ ধরনের কোন বিক্রয় কেন্দ্র আইনতঃ নিষিদ্ধ ছিলো এবং সেই হিসেবে সরকারের অনুমতি ব্যতীত কোনরকম বেচাকেনা আইনতঃ ছিলো দণ্ডনীয়। মাথিভাঙায় ধান চালের বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার সংবাদ পেয়ে বরিশাল জেলার কর্ডনিং অফিসার নিজেদের লোকজন এবং নৌকো লঞ্চ ইত্যাদি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। মাথিভাঙায় তখন মোহন মিঞা[১০] এবং তাঁর ভাই তারা মিঞার সরাসরি তত্ত্বাবধানে ধান চাল বিক্রির ব্যবস্থা চলছিলো। ধানচাল বোঝাই শত শত নৌকা সেখানে সারি সারি দাঁড়িয়েছিলো। 

জেলা কর্ডনিং অফিসার সেখানকার বিক্রয় কেন্দ্রকে বেআইনী ঘোষণা করে ধানচাল বোঝাই নৌকাগুলিকে বরিশাল সদরের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং তাদের নিজেদের তত্ত্বাবধানেই সেগুলিকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। নৌকোগুলিসহ মোহন মিঞা এবং তাঁরা মিঞাও কর্ডনিং অফিসারের সাথে বরিশাল গেলেন। তাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হলো যে সরকারী অনুমতি ব্যতীত মাথিভাঙায় ধানচালের বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা করে তাঁরা বেআইনী কাজ করেছেন এবং ঐ বিক্রয়কেন্দ্র আর বসতে দেওয়া হবে না। যে সমস্ত ধান চাল মাথিভাঙা থেকে বরিশাল নিয়ে আসা হয়েছিলো সেগুলো শাস্তিমূলক দরে সরকারের পক্ষ থেকে কিনে নেওয়া হবে বলেও তাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হলো। যে নৌকাগুলি ধরে আনা হয়েছিলো তাঁদের সংখ্যা ছিলো তিন চারশো এবং তাতে ধান চাল মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার মণ খাদ্য শস্য ছিলো। বরিশাল কর্ডনিং বিভাগের লোকেরা প্রত্যেক নৌকার মাল পৃথক পৃথকভাবে ওজন করিয়ে তাদের মালিকদেরকে রশিদ দিলেন এবং পরে এসে তাদেরকে টাকা নিয়ে যাওয়ার নির্দেশও দান করলেন। 

মাথিভাঙা বিক্রয় কেন্দ্রের মতো খোলা বাজার বসানোর প্রচেষ্টা কোন সাধারণ ব্যবসায়ী অথবা ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব ছিলো না। কিন্তু সেটা না হলেও এই ধরনের বেআইনী বেচাকেনা মোটামুটিভাবে কর্ডনভুক্ত উদ্বৃত্ত জেলাগুলি থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে লব্ধ ধানচালেরই বিক্রয় কেন্দ্র ছিলো এবং প্রত্যক্ষভাবেই তা চোরাচালানকে উৎসাহ প্রদান করতো। অবশ্য চোরাকারবারীরা চোরাই মাল শুধু যে এই ধরনের খোলা বিক্রয় কেন্দ্রগুলিতেই বিক্রি করতো তাই নয়। তাদের মূল বিক্রির বাজার থাকতো ঘাটতি জেলাগুলির অভ্যন্তরে। তারা সেই সময় উদ্বৃত্ত জেলাগুলি থেকে খাদ্য শস্য ভারতেও পাচার করতো। 

কর্ডন প্রথা চালু করা সত্ত্বেও বস্তুতঃপক্ষে দেখা গেল যে ধান চাল উদ্বৃত্ত এলাকায় সংগ্রহ করে ঘাটতি এলাকায় তাড়াতাড়ি চালান দেওয়ার কোন ব্যবস্থা সরকারের নেই। এর জন্যে প্রশাসনিক অব্যবস্থা এবং যানবাহন ও পথঘাটের দুরবস্থাই মূলতঃ দায়ী। সরকারী গুদাম ঘরে ধান চাল জমা হলেও এর ফলে ধান চাল ঘাটতি এলাকায় পৌঁছাতো খুব কম এবং গুদামগুলির অব্যবস্থার জন্যে সেগুলি পচে নষ্ট হয়ে যেতো অথবা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হতো। এই সমস্ত পচা চাল আবার বিতরণ করা হতো রেশনিং এলাকাগুলিতে। 

উদ্বৃত্ত এলাকাগুলি থেকে খাদ্যশস্য ঘাটতি এলাকায় সরবরাহ করার ক্ষেত্রে এই সরকারী ব্যর্থতা ব্যবসায়ীদের দ্বারা ধানচাল বেচাকেনা নিষিদ্ধ থাকার সাথে যুক্ত হয়ে খাদ্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল এবং ভয়াবহ করে তোলে। এর ফলে ঘাটতি এলাকায় সরবরাহ প্রায় অচলাবস্থায় পৌঁছে যায় এবং চোরাচালানীরা উদ্বৃত্ত এলাকা থেকে পাচারকৃত খাদ্যশস্য অত্যধিক মূল্যে সেখানে বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা সংগ্রহ করতে থাকে। বরিশাল, খুলনা, সিলেট ইত্যাদি জেলায় ফসলের মৌসুমে বাইরে থেকে, বিশেষতঃ ফরিদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালি থেকে দাওয়াল[১১] নামে এক শ্রেণীর ভূমিহীন ক্ষেতমজুরেরা ফসল বোনা থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত সমস্ত প্রকার কৃষিকাজ করে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা ধান কাটার কাজই করে এবং নিজেদের মজুরী টাকা পয়সায় না নিয়ে ফসলের একাংশ হিসেবে নেয়।[১২] কর্ডন প্রথা চালু হওয়ার পূর্বে তাঁরা নিজেদের প্রাপ্য ধান হিসেব করে বাড়ী আনতে পারতো এবং তার থেকেই তাঁদের বৎসরের পুরো অথবা আংশিক খোরাকী চলে যেতো। কিন্তু কর্ডন প্রথা চালু হওয়ার ফলে এই দাওয়ালেরা এক সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। 

এ সময় যারা বাইরে থেকে কর্ডনভুক্ত জেলাগুলিতে কাজ করতে যেতো তাদেরকে সেই কাজের জন্য এ্যাসিস্ট্যান্ট রিজিওন্যাল কনট্রোলার অব প্রকিওরমেন্ট (ARCP) এর থেকে পারমিট নিতে হতো। যাদের জমিতে এই কৃষি শ্রমিকরা কাজ করতো অনেক ক্ষেত্রে তারাই এদের পক্ষ থেকে এই সরকারী অনুমতি সংগ্রহ করতো। এই অনুমতির অবশ্য তেমন বেশী কিছু ফায়দা ছিলো না। কারণ উপার্জনকৃত পুরো ধান দাওয়ালেরা কোনমতেই নিজেদের এলাকায় নিয়ে যেতে পারতো না। কর্ডন এলাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তারা মাত্র বিশ মণের অনুমতি পেতো এবং এই ধানটুকু নেওয়ার জন্যেই তাদের পারমিটের প্রয়োজন হতো। পারিশ্রমিক বাবদ মোট যে পরিমাণ ধান তারা পেতো তার থেকে বিশ মণ বাদে বাকীটুকু তাদেরকে কর্ডন এলাকার মধ্যেই বিক্রি করতে হতো। এইভাবে নিজেদের সারা বৎসরের উপর্জিত ধান উদ্বৃত্ত এলাকায় অল্প মূল্যে বিক্রি করে যে টাকা তারা পেতো তা দিয়ে নিজেদের এলাকায় সমপরিমাণ ধান কেনা তাদের দ্বারা সম্ভব হতো না। এভাবে ঘাটতি এলাকা থেকে জীবিকার সন্ধানে উদ্বৃত্ত এলাকায় যাওয়া হাজার হাজার দাওয়াল কর্ডন প্রথার দ্বারা তাদের উপার্জিত ধান থেকে বঞ্চিত হয়ে অনাহার অর্ধাহার অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হতো। এই অবস্থার অবসানের জন্যে এ সময় পূর্ব বাঙলার কোন কোন অঞ্চলে ধান কাটা শ্রমিক ইউনিয়ন নামে কৃষি শ্রমিকদের ইউনিয়নও গঠিত হয়েছিলো।[১৩] এদের মূল দাবী ছিলো কর্ডন প্রথার বিলোপ। 

দাওয়ালেরা তাঁদের পরিশ্রমলব্ধ ধান নিজেদের এলাকায় নিয়ে যেতে না পারলেও চোরাচালানকারীরা শুধু যে পূর্ব বাঙলার ঘাটতি এলাকাগুলিতেই ধান চাল নিয়ে যেতো তাই নয় ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত কর্ডনভুক্ত উদ্বৃত্ত এলাকাগুলি থেকেও তাঁরা বিপুল পরিমাণ ধান চাল ভারতে পাচার করতো। এর কারণ উদ্বৃত্ত ধান সরকার মণ প্রতি ৮ টাকা দরে কেনার বন্দোবস্ত করেন কিন্তু ভারতে সেই ধানের দর তখন ছিলো তার থেকে অনেক বেশী। কাজেই জোতদার, মীরাসদার এবং অন্যান্য মজুতদাররা নিজেদের উদ্বৃত্ত অথবা মজুত ধান অধিক মূল্যের বিনিময়ে চোরাচালানকারীদের কাছে পাচারের জন্যে বিক্রি করতো। 

এই সমস্ত কারণ একত্রিত হয়ে পূর্ব বাঙলার ঘাটতি এলাকাগুলির খাদ্য পরিস্থিতি তখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছিলো যে, ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ থেকে পর্যন্ত লোক দলে দলে খাদ্যের সন্ধানে আসাম চলে যাচ্ছিলো। এই দেশত্যাগীরা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন না, তাঁদের মধ্যে অসংখ্য মুসলমানও ছিলেন।[১৪] 

খাদ্য ঘাটতি এ সময় দুর্ভিক্ষের অবস্থায় পৌঁছে যায় এবং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে এই সময় কর্ডনের বিরুদ্ধে সারা পূর্ব বাঙলায় একটি আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। 

এই আন্দোলনের কোন ব্যাপক সাংগঠনিক চরিত্র না থাকলেও ঢাকা এবং অন্যান্য কয়েকটি এলাকায় তা কিছুটা সংগঠিত হয়েছিলো ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে অবস্থিত ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীদের দ্বারা। এ ছাড়া তৎকালীন ব্যবস্থা পরিষদের বিরোধী দলীয় সদস্যেরাও এই আন্দোলনে কিছুটা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। এঁদের মধ্যে খয়রাত হোসেন, তফজ্জল আলী, মহম্মদ আলী, আবদুল মালেক, আনোয়ারা খাতুন প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য কোন অংশ গ্রহণ না করলেও কংগ্রেস দলভুক্ত বিরোধীদলীয় সদস্যেরা সকলেই এ সময়ে কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁদের কার্যকলাপ মোটামুটি ব্যবস্থা পরিষদে বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। 

কর্ডন বিরোধী এই আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান কিষাণ সভা অংশ গ্রহণ করেনি। উপরন্তু তাঁরা এই আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলো। কমিউনিস্ট পার্টি এ সময়ে ছিলো কর্ডন প্রথা চালু রাখার পক্ষে এ সম্পর্কে তাজউদ্দিন আহমদ তার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে উল্লেখ করেছেন যে – বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রণ রাখার সপক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে[১৫]। এ বিষয়ে পরদিন মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি অবশ্য আরও বলেছেন যে নিয়ন্ত্রণের সপক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির এই প্রস্তাব সরকারী প্রশাসন যন্ত্রকে ভেঙে ফেলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রচেষ্টা ছাড়া অন্য কিছু নয়[১৬]। তবে ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীরা যে কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে এ সময় দেশব্যাপী কোন বিরাট গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তা নয়। তবে যেটুকু সংগঠিত আন্দোলন সে সময় কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে হয়েছিলো সেটার নেতৃত্বে তাঁরাই ছিলেন। এই কর্মীদের মধ্যে কারও তখন দেশব্যাপী কোন পরিচয় ছিলো না। তবু শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ প্রভৃতি কর্মীরা নিজেদের এলাকায় গিয়ে খোঁজখবর নেন এবং ঢাকায় কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে সভাসমিতি সংগঠিত করেন।[১৭] 

রাজনৈতিক কর্মী এবং ব্যবস্থাপক সভার সদস্যদের এই ধরনের দুটি সভার উল্লেখ পাওয়া যায়।[১৮] ১৯৪৭ সালের ২০শে ডিসেম্বর বেলা ১২-৩০মিঃ এ কমরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিব, শওকত আলী, মহম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ প্রভৃতি কমরুদ্দীন আহমদের বাসায় মিলিত হয়ে নিয়ন্ত্রণ ও জেলা কর্ডন সম্পর্কে আলোচনা করেন। 

ঐ দিনই বলিয়াদি হাউসে ৩-৩০মিঃ এ বিরোধীপক্ষের কয়েকজন পরিষদ সদস্যের একটি সভা হয়। তাতে উপস্থিত থাকেন মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী, ডক্টর মালেক এবং অন্য ১৬ জন সদস্য। এ ছাড়া কমরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিব, শওকত আলী, শামসুজ্জোহা, আলমাস, আউয়াল, আজিজ আহমদ, মহিউদ্দীন, আতাউর রহমান, কফিলুদ্দীন চৌধুরী, কাদের সর্দার এবং মতি সর্দারও এই সভায় উপস্থিত থাকেন। সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই সভায় খাদ্য সমস্যা, পাট সমস্যা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা হয়। পরদিন সরকারী কর্তৃপক্ষের সাথে খাদ্য সমস্যা নিয়ে বৈঠকের বিষয়েও এই সভায় তাঁরা আলোচনা করেন। এই বৈঠক বসে ২১শে ডিসেম্বর বিকেল ৪টায়। এতে উপস্থিত থাকেন অন্যান্যদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, অলি আহাদ, শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আহমদ।[১৯] এঁরা প্রথমে খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ আফজলের সাথে কর্ডন তোলার ব্যাপারে আলাপ করেন। মন্ত্রী তাঁদেরকে জানান যে, কর্ডনিং এর সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের এবং সে ব্যাপারে তাঁদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। এর পর ১৯৪৭-এর শেষের দিকে কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী পীরজাদা আবদুস সাত্তার ঢাকায় আসেন।[২০] তাঁর সাথে ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীদের কোন বৈঠক হয়নি। তবে পীরজাদা এই সময় একটি সভায় যোগদানের জন্যে কার্জন হলে উপস্থিত হলে তাঁরা তাঁকে ঘেরাও করে কর্ডনের বিরুদ্ধে নানা প্রকার ধ্বনি তোলেন এবং তার সাথে বিক্ষোভকারীদের একটা ধাক্কাধাক্কিও বাধে। [২১] 

প্রাদেশিক খাদ্যমন্ত্রী আফজল এই সময় কর্ডন প্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন কর্ডনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মুখে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীরজাদা আবদুস সাত্তার পূর্ব বাঙলায় এই সফরে এসে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার সদস্য এবং আমলাদের সাথে খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। অবশেষে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির একটি কমিটির ওপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব অর্পিত হয়। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মন্ত্রী এবং অন্যান্যেরা কয়েকটি এলাকায় কর্ডন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন[২২]। এর ফলে বরিশাল, ময়মনসিংহ এবং সিলেট এই তিনটি জেলায় কর্ডন উঠিয়ে নেওয়া হয়। 

১৯৪৮ এর জানুয়ারী মাসের দিকে উপরোক্ত জেলাগুলি থেকে কর্ডন তুলে নিলেও সরকার স্থির করলেন যে, এক একটি উদ্বৃত্ত জেলা থেকে পার্শ্ববর্তী এক অথবা একাধিক ঘাটতি জেলাতে খাদ্য সরবরাহ করা হবে। এবং উদ্বৃত্ত এলাকাগুলো হতে শুধু সেই নির্দিষ্ট ঘাটতি এলাকাগুলিতেই ধানচাল যেতে পারবে, তার বাইরে নয়। অর্থাৎ এর পর জেলা কর্ডন উঠে গেলেও কর্ডন প্রথা অন্যভাবে চালু থাকলো। 

কর্ডনিং উঠে যাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা ব্যাপক আকারে ধানচাল কিনে গুদামজাত করতে ব্যস্ত হলো। এর ফলে বাজারে খাদ্যশস্যের আমদানী তেমন বৃদ্ধি পেলো না। এ ছাড়া আবার কর্ডনিং প্রথা চালু হওয়া এবং খাদ্য আমদানীর ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কায় মোটামুটি সম্পন্ন পরিবারের লোকেরাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধান চাল কেনা শুরু করলো। ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ক্রয়ের সাথে সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের অতিরিক্ত ক্রয়ের ফলে ঘাটতি এলাকায় বাজারে আমদানী বৃদ্ধি এবং মূল্য হ্রাস হলো না। কাজেই কর্ডন প্রথা রহিত করার ফলে ঘাটতি এলাকায় অল্প সময়ের জন্যে ধানচালের দাম কিছুটা কমলেও অতি শীঘ্র আবার তা ওপরের দিকে উঠে খাদ্য পরিস্থিতির অধিকতর অবনতি ঘটালো। 

এর ফলে যে শুধু ঘাটতি এলাকাগুলিতেই অবস্থার অবনতি ঘটলো তাই নয়, উদ্বৃত্ত এলাকাগুলিতেও খাদ্য শস্যের দর কর্ডন তুলে নেওয়ার পর মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি লাভ করে সেখানেও সংকটকে ছড়িয়ে দিলো। 

কাজেই কর্ডন তুলে দেওয়ার ফলে যে সুফল পাওয়া যাবে বলে ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীরা আশা করেছিলেন বস্তুতপক্ষে সে সুফল পাওয়া যায়নি। 

৪. ১৯৪৮ সালে একটি উদ্ধৃত্ত জেলার খাদ্য পরিস্থিতি 

পূর্ব বাঙলায় খাদ্য সংকট প্রকৃতপক্ষে একটা গুরুতর আকার ধারণ করতে থাকে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের দিকে।[২৩] এ সময়ে সিলেট জেলার ধর্মপাশা, বানিয়াচুঙ্গ ও সুনামগঞ্জ মহকুমার জগন্নাথপুর এলাকায় চালের দর চব্বিশ পঁচিশ টাকায় ওঠে এবং দরিদ্র কৃষক ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণের মধ্যে অন্নাভাব দেখা দেয়।[২৪] সিলেট জেলার রসুলগঞ্জে এই সময় আসন্ন দুর্ভিক্ষের প্রতিকার কল্পে আহুত এক জনসভায় সেখানকার ডিস্ট্রাক্ট কনট্রোলার সমবেত জনতার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তাঁদেরকে বলেন[২৫] যে, যাদের ঘরে মজুদ খাদ্য আছে তাঁরা যেন তিন মাসের উপযুক্ত খাদ্য রেখে বাকী খাদ্যশস্য জনগণের কাছে কনট্রোল দরে বিক্রি করে জনগণের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। 

জেলা কনট্রোলারের এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, সে সময় খাদ্য সংকটের মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে সরকারের কোন নির্দিষ্ট নীতি ছিলো না। কিন্তু তা না থাকলেও সেই সভার সভাপতি সুনামগঞ্জের মহকুমা হাকিম জনগণকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, রাস্তাঘাটের অসুবিধা সত্ত্বেও তাঁরা সুনামগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে নৌকাযোগে ধান এনে শিবগঞ্জ ও জগদীশপুরের দুটি গুদামে রাখবেন এবং সেখান থেকে বিতরণের ব্যবস্থা করবেন। ওপরে যে সমস্ত এলাকার উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে জগন্নাথপুর থানার সংকটই সব থেকে তীব্র আকার ধারণ করেছিলো। এজন্যে সিলেট জেলার যুব সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে “নিরন্ন ভাই-বোনদের সাহায্যে মুক্ত হস্তে দান করুন” এই মর্মে একটি আবেদন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।[২৬] তাতে বলা হয় যে, জগন্নাথপুর থানার খালীস গ্রামস্থ জনৈকা বিধবা নারী পুত্র কন্যার আহার যোগাতে অক্ষম হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। খাদ্যাভাবে সমগ্ৰ জগন্নাথপুর থানাব্যাপী এক ভীষণ হাহাকারের কথাও তাঁরা উল্লেখ করেন। 

১১ই মার্চ “আসন্ন দুর্ভিক্ষ” নামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে নওবেলাল জগন্নাথপুর থানার দুর্গত এলাকায় অতি সত্বর খাদ্য সরবরাহ ও বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। সরকারের থেকে আশানুরূপ কোন সাহায্য না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তাঁরা বলেন যে, দুর্ভিক্ষের আনুষঙ্গিক হিসেবে ইতিমাধ্যে সেখানে কলেরা দেখা দিয়েছে।

সিলেট জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একটি আবেদনপত্রেও কলেরার উল্লেখ দেখা যায়। “দুর্ভিক্ষের কবলে জগন্নাথপুর” নামে এই আবেদনপত্রটিতে তাঁরা বলেন: 

সম্প্রতি সমগ্র জগন্নাথপুর থানা এবং সুনামগঞ্জ ও ছাতক থানার কয়েকটি সার্কেলে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছে। এই বৎসর আমন ফসল সমূলে বিনষ্ট হওয়ায় এই ভয়াবহ অবস্থার উদ্ভব হইয়াছে। প্রায় এক লক্ষ লোক অন্নাভাবে করাল মৃত্যুর সম্মুখীন হইয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে কলেরা ও গো-মড়ক ব্যাপকভাবে দেখা দিয়াছে। লোকের দুরবস্থার কথা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। দুর্ভিক্ষ-পীড়িত লোকদের সাহায্যের জন্য মুসলিম লীগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হইতে রিলিফ বা সাহায্য দান আরম্ভ হইয়াছে। এই কার্য সুচারুভাবে সম্পন্ন করিতে বহু অর্থের প্রয়োজন। এখনই উপযুক্ত পরিমাণে সাহায্য না পাঠাইলে বহু লোকের প্রাণনাশের আশঙ্কা রহিয়াছে। দেশবাসী ভাই ভগিনীদের নিকট আমাদের বিনীত নিবেদন এই যে, আর্তের সাহায্যের জন্য আপনারা যথাসাধ্য দান করিয়া বিপন্ন নর-নারীকে মৃত্যুর কবল হতে রক্ষা করুন।[২৭] 

এটিতে স্বাক্ষর করেন মুনাওয়ার আলী, এমএলএ; আবদুল বারী চৌধুরী, সভাপতি জেলা মুসলিম লীগ, মোঃ মফিজ চৌধুরী এমএলএ, সম্পাদক জেলা মুসলিম লীগ; নগেন্দ্রনাথ দত্ত, সভাপতি কংগ্রেস কমিটি; এবং চন্দ্রবিনাদ দাস, সভাপতি কিষাণ সভা। 

এই আবেদনপত্রটির স্বাক্ষরকারীদের পরিচয় থেকে বোঝা যায় যে দুর্ভিক্ষের অবস্থা ১৯৪৮ এর মার্চ মাসের মধ্যেই সিলেট জেলার রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিলো। মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও কিষাণ সভার নেতাদের এই যৌথ আবেদন থেকে পরিস্থিতির গুরুত্বও ভালোভাবে বোঝা যায়। 

জগন্নাথপুর থানা রিলিফ কমিটির সম্পাদক শরিয়তউদ্দীন আহমদ এ সময় অভিযোগ করেন যে, প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী এবং সিলেটের ডেপুটি কমিশনারের কাছে সেই এলাকার অবস্থা বারবার জানানো সত্ত্বেও তাঁদের থেকে কোন সাড়া তাঁরা পাননি। দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বিবৃতিটিতে তিনি বলেন: 

বর্তমানে অবস্থা এতই ভয়াবহ হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে স্বচক্ষে না দেখিলে তার গুরুত্ব হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভবপর নহে। চতুর্দিকেই হাহাকারের রোল উঠিয়াছে। খাদ্য নাই, বস্ত্র নাই এবং এগুলি ক্রয় করিবার মতো সামর্থও নাই। জমি জমাও কেহ ক্রয় করে না। তাই গৃহস্থেরা হালের বলদসমূহ বিক্রী করিয়া নিঃস্ব হইয়া পড়িতেছে। বীজ ধান্য ও হালের গরুর অভাবে আগামী আমন ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনাও দেখা যাইতেছে না। তজ্জন্য ভয় হইতেছে আগামী বৎসর অবস্থা আরও ভয়াবহ হইতে পারে।[২৮]

প্রায় এক মাস পর শরিয়তউদ্দীনের অপর একটি বিবৃতিতে[২৯] বলা হয় রিলিফ কমিটির উদ্যোগে প্রাথমিক অবস্থায় সরকারী সাহায্য ব্যতিরেকেই খাদ্যশস্য বিতরণের যে ব্যবস্থা করা হয় তার ফলে অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটে। জগন্নাথপুরে দুর্ভিক্ষের অবসান হতে চলেছে বলেও উক্ত বিবৃতিটিতে আশা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তার পরই শিলাবৃষ্টির ফলে বোরো ফসলের বিস্তৃত ক্ষয়ক্ষতির ফলে অবস্থার আবার অবনতি ঘটে।[৩০] 

জুন মাসের দিকে অগ্রহায়ণী ফসল ভালো না হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় বিশেষতঃ সিলেটের বৃহত্তম গ্রাম বাণিয়াচুঙ্গে খাদ্য সংকট ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।[৩১] এ সময়ে সিলেটের ফুলবাড়ী নামক একটি গ্রামে পাঁচ ছয় দিন অনাহারের পর একটি ছেলের মৃত্যু ঘটে। এ অঞ্চলে তখন মীরাসদারদের[৩২] সপক্ষে সরকার ১৪৪ ধারা জারী করার ফলে একদিকে কিছু ফসল পানির নীচে পচে বিনষ্ট হয় এবং বাকী ফসল মীরাসদারদের ঘরে তোলা হয়। নানকার প্রজাদেরকে এইভাবে তাঁদের প্রাপ্য শস্য থেকে বঞ্চিত করায় এই এলাকায় খাদ্য সংকটকে তীব্রতর করে।[৩৩] 

ফুলবাড়ী অঞ্চলে অনাহারে মৃত্যু এবং সেখানকার সাধারণ খাদ্য সংকটের সংবাদ পেয়ে প্রকৃত অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্যে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ভূতপূর্ব সম্পাদক মাহমুদ আলী, উত্তর সিলেট জেলা লীগের সহকারী সভাপতি আবু জাফর আবদুল্লাহ, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য নুরুর রহমান, উত্তর সিলেট জেলা লীগের সম্পাদক আবদুর রহিম এবং উত্তর সিলেট জেলা লীগের কার্যকরী সমিতির সদস্য মতসির আলী ১১ই জুলাই সেখানে যান। এর পর সেই এলাকার অবস্থার ওপর তাঁরা সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন।[৩৪] বিবৃতিটির শেষে তাঁরা বলেন: 

অবস্থা দৃষ্টে আমরা এই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, এই অঞ্চলের অবস্থা শোচনীয় আকার ধারণ করিয়াছে। মৃত্যুর করাল ছায়া ধীরে ধীরে নামিয়া আসিতেছে এবং অবিলম্বে এই অবস্থার প্রতিকার না করিলে অদূর ভবিষ্যতে সমগ্র সমাজ ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িতে বাধ্য।

নিজেদের বিবৃতিতে তাঁরা উল্লেখ করেন যে ফুলবাড়ীতে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা সত্য হওয়া সত্ত্বেও জনৈক সরকারী কর্মচারী ঘটনাটি মিথ্যা বলে সরকারে কাছে রিপোর্ট পেশ করেছেন। ফুলবাড়ীর খাদ্য পরিস্থিতির সম্পর্কে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টটির কিছু অংশ নীচে উদ্ধৃত করা হলো: 

গোপালগঞ্জ থানায় এক মাইলের মধ্যে এই বিরাট গ্রামটি অবস্থিত। এখানে প্রায় ১২০০ ঘর লোকের বাস যাহার আনুমানিক লোক সংখ্যা ৬ হাজার হইবে। এই ১২০০ পরিবারের মধ্যে প্রায় ২২ ঘর মিরাসদার। বাকী দরিদ্র চাষী এবং দিন মজুর। ইহাদের মূল জীবিকা গৃহস্থি। মুখী এবং কচুর মূড়ার ক্ষেতই ইহাদের আয়ের উপায়। ইহাদের কেহ কেহ মাটির বাসন ইত্যাদি বিক্রয়ের ব্যবসা করে এবং কেহ টিকির ব্যবসাও করিয়া থাকে। হেমন্তকালে গ্রামের অনেক লোক মাটির কাজে বা ইট দেওয়া ইত্যাদিতে মজুর খাটিয়া কিছু কিছু উপার্জন করিয়া থাকে। 

আমরা সর্বমোট ৩৪টি পরিবারের অবস্থা দেখিয়া আসিয়াছি। মৃত ছেলের পিতা ইসইকে আমরা পাই নাই। কিন্তু তাহার মাতা এবং অন্যান্য ছেলেমেয়েকে দেখিয়াছি। ইসইর স্ত্রী এবং পাড়ার অন্যান্য লোককে জেরা করিয়া আমরা জানিতে পারিলাম যে, ঐদিন সে গরু রাখিতে গিয়াছিলো। মাঠ হইতে ফিরিয়া খাবার কিছু না পাইয়া জল খায় এবং সেই হইতে পেটের বেদনায় অস্থিরতা প্রকাশ করিতে থাকে। ৫/৬ ঘণ্টা অনবরত চীৎকারের পর তাহার মৃত্যু ঘটে। ঘটনার বহুদিন পূর্ব হইতেই এই পরিবার ৬-৭ বেলায় অর্থাৎ দুই দিন আড়াই দিনে এক এক বেলা কোনমতে আহার করিতে পাইতো। এখনও পরিবারের এই অবস্থাই রহিয়াছে। আমরা ইসইর তিন সন্তান সনু (৮), রখফুল (৪), মন্তকিল (২)কে দেখিয়া আসিয়াছি। অনাহারক্লিষ্ট এই পরিবারের উপর যে মৃত্যুর বিভীষিকা ধীরে ধীরে নামিয়া আসিতেছে সরকারের বেতনভোগী কর্মচারীদের চোখে তাহা না পড়িলেও আমাদের চক্ষুকে এড়াইয়া যায় নাই। 

আমরা ৩৪টি পরিবারের মধ্যে ৯টি পরিবারকেই পূর্বদিন খাইতে পায় নাই দেখিলাম। ইহাদের মধ্যে কোন কোন পরিবারের ২/৩ দিনের মধ্যে খাদ্য জোটে নাই। 

প্রায় প্রত্যেক পরিবারই এক বেলা খাইয়া রোজা রাখিয়াছে। ৩০টি পরিবারের ঐ দিনকার মতো খাওয়ার কোন সংস্থান নাই বলিয়া আমরা প্রমাণ পাইয়াছি। 

আমরা ঘরের ভিতর ঢুকিয়া তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের কোনও সন্ধান পাই নাই। আমাদের অতর্কিত আগমন পূর্বে প্ল্যানমতো ধান চাউল যে কেহ সরাইয়া রাখিবে, তাহারও কোন সুবিধা ছিলো না। অতএব আমাদিগকে বাধ্য হইয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইয়াছে যে সত্য সত্যই এই সকল পরিবার সংস্থানহীন অবস্থায় দিন গোজরান করিতেছে। 

আমরা রাকইর স্ত্রীর জবানবন্দী গ্রহণ করিলাম। মেয়েটি তাহার কাহিনী বলিতে গিয়া কাঁদিয়া ফেলিলো। তাহার স্বামী হাইলাকান্দিতে কাজে গিয়াছে, কিন্তু এ পর্যন্ত টাকা পয়সা পাঠায় নাই। ১০ জনের পরিবারকে স্ত্রীলোকটি দুঃখ মেহনত করিয়া খাওয়াইতেছে। মনাই, সোনাই দুই বিবস্ত্র শিশু সন্তানকে দেখিলেই বুঝা যায় অনাহার-মৃত্যুর করাল ছায়া ইহাদের চেহারায় ফুটিয়া উঠিয়াছে। 

আলিমের জবানবন্দীতে জানিলাম – তাহার ৭ জন খানেওয়ালা কিন্তু একা রোজগার করিয়া কিছুতেই কুলাইতে পারে না, ইহার উপর এখন সম্পূর্ণ বেকার। লোকটি বলিলো – তাহার ছেলে সলমানকে খাইতে দিতে পারে নাই। উপবাস এবং অর্ধ উপবাসে ৪/৫ বৎসরের শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। তাহার কন্যা সরাইকে আমরা দেখিয়াছি এবং ইহার যে দিন ঘনাইয়া আসিতেছে তাহা বিশ্বাস করিয়াছি। 

দক্ষিণ পাড়ার খোটাইর অবস্থা দেখিয়া আমাদের ধৈর্য ধারণ অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিলো। নিজের কুড়েখানি ভাঙ্গিয়া গিয়াছে কিন্তু ইহার মেরামত করিবার ক্ষমতা তাহার নাই: সে তইমের ঢেঁকিশালে আশ্রয় লইয়াছে। এই ঢেঁকিশাল ঘরের বারান্দার সহিত (অনুমান ২ হাত) তিন হাতি একচালি মাথার প্রান্তভাগ মাত্র ২ হাত উচ্চ। তাহার পরিবারে ৪ জন লোক রোজগারের কোন ব্যবস্থা নাই। কচুসিদ্ধই যে তাহাদের ঐ দিনকার খোরাক, তাহা আমরা দেখিয়া আসিয়াছি। 

মফিজ আলীর ৭ জন পোষ্য – রোজগারী সে একা। দৈনিক টাকার ঊর্ধ্বে রোজী করা তাহার পক্ষে সম্ভব নয়। সে বলিলো – গতকল্য শুধু চা খাইয়া রোজা রাখিয়াছি – আজ রোজী করিয়াছি মাত্র চার আনা; চাউল বিক্রয় হইতেছে নয় আনা সেরে আমার চলে কেমন করিয়া? ৬৪ বৎসর বয়স্ক বৃদ্ধ মজমিলকে দেখিলাম, তাহার বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পাইতে বসিয়াছে। ৭ জন পোষ্য লইয়া রোজার আগের দিন এক পোয়া খুদ খাইয়াছিলো। তাহার পর আর আহার জোটে নাই। ৬ বেলা উপবাস থাকার পর ১০/৭/৪৮ তারিখ রাত্রে ছোট ময়না নামীয় এক প্রতিবেশী এক সের চাউল দিয়াছিলো, তাহা খাইয়াছে; কিন্তু আমাদের উপস্থিতি পর্যন্ত তাহাদের ঐদিনকার কোন বন্দোবস্ত দেখি নাই। 

মজমিলের ১৫ বৎসর বয়স্কা কন্যা ছায়িরা ও অন্যান্য ছেলেমেয়েকে দেখিলাম। ইহারা আজরাইলের নোটিশ প্রাপ্ত অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে। বড়ো ছেলে মাখনকে (১২/১৩ বৎসর বয়সের) আমরা দেখিতে পাই। চেহারা দেখিয়াই ইহাকে ‘খানির-মরা’ বলিয়া ধারণা হয়। তাহাকে আমরা জিজ্ঞেস করি সে খাইয়াছে কিনা। উত্তরে ছেলেটি কাঁদিতে থাকে। 

৫. পূর্ব বাঙলা পরিষদে খাদ্য পরিস্থিতির ওপর আলোচনা 

বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী নূরুল আমীন ১১ই জুন, ১৯৪৮, পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে খাদ্য পরিস্থিতির ওপর একটি বিবৃতি দেন। 

জুন মাসের প্রথম দিকে চালের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন[৩৫] যে, বৎসরের সেই সময়ে দর বৃদ্ধি কোন নোতুন ব্যাপার নয়। প্রতি বৎসরই আমন ধান ওঠার সাথে সাথে চালের দর নীচের দিকে নামতে থাকে এবং এপ্রিলের শেষ থেকে তা ধীরে ধীরে আবার ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে। এই ঊর্ধ্বগতি সেপ্টেম্বরে আউশ ধান ওঠার আগে পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সেবার কিন্তু মে মাসেই চালের দর অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালের থেকে চড়া পর্যায়ে দাঁড়ায়। অবশ্য মার্চের প্রথম দিক পর্যন্ত এই দর ১৯৪৭ সালের ঐ সময়কার দরেরই সমপর্যায়ে ছিলো বলে তিনি উল্লেখ করেন। ১৯৪৮-এর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সমগ্র প্রদেশে চালের গড়পড়তা দর মণ প্রতি ২৬-২৯ টাকা এবং সর্বনিম্ন দর ২০-২৩ টাকা বলে নুরুল আমীন পরিষদকে জানান। 

চালের দর বৃদ্ধির মূল কারণগুলি সম্পর্কে তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেন: 

আমার মনে হয় সাধারণভাবে চালের দরবৃদ্ধির মূল কারণ হলো পাটের প্রচলিত চড়া দর; বরিশাল, ময়মনসিংহ ও সিলেট এই তিনটি উঁচু জেলার কর্ডন প্রথা তুলে নেওয়ার ফলে প্রদেশের বিস্তৃত এলাকায় কনট্রোল ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়া; মজুতদারী এবং বর্ষা ও কীট ইত্যাদি আরও কতকগুলি কারণ। আপনাদের হয়তো মনে থাকবে যে পরীক্ষামূলকভাবে পার্শ্ববর্তী ঘাটতি জেলাসমূহের স্বার্থে কর্ডন প্রথা তুলে নেওয়া হয়েছিলো। একথা সত্য যে পূর্বোল্লিখিত উদ্বৃত্ত জেলাসমূহের কর্ডন উঠিয়ে নেওয়ার ঠিক পর পরই পার্শ্ববর্তী ঘাটতি এলাকাসমূহের দর নীচে নেমে এসেছিলো কিন্তু শীঘ্রই উদ্বৃত্ত এবং ঘাটতি উভয় এলাকাতেই দর আবার চড়তে শুরু করে। আশা করা গিয়েছিলো যে ব্যবসায়ীরা ব্যবসার নিয়ম মেনে চলবে এবং যুক্তিসঙ্গত মুনাফা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ ব্যবসায়ীকে সর্বাধিক স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগের ফলে যে কোন লোক ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছে তাকেই আমরা মুক্ত হস্তে লাইসেন্স দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে যে বহু সংখ্যক লোক অযৌক্তিকভাবে উচ্চ মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে এই ব্যবসাতে ঢুকে পড়েছে।[৩৬] 

ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে এই বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে যে কথাটি নূরুল আমীন উহ্য রেখেছেন তা হলো এই যে, উল্লিখিত উচ্চ মুনাফা শিকারী ভূঁইফোড় ব্যবসায়ীরা আসলে মুসলিম লীগ এবং তৎকালীন সরকারের সাথে সম্পর্কিত পারমিটধারীর দল। 

পরিষদকে আশ্বাস দিতে গিয়ে নূরুল আমীন তাঁর বিবৃতিতে সরকারের হাতে তখন পর্যন্ত যথেষ্ট চাল থাকার কথা জানান এবং ইতিমধ্যেই তাঁরা কতকগুলি সংকটগ্রস্ত এলাকায় বিক্রীর জন্যে সরকারী গুদাম থেকে বিপুল পরিমাণ চাল হস্তান্তর করেছেন বলে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া যে সমস্ত জায়গায় দর খুব বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে রেশনিং চালু করা হবে এ কথাও তিনি জানান।[৩৭] 

নূরুল আমীন তাঁর বিবৃতি প্রসঙ্গে দাবী করেন যে, কতকগুলি জেলাতে মূল্যের ঊর্ধ্বগতি শুধু যে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে মূল্য ইতিমধ্যেই হ্রাস পেতে শুরু করেছে।[৩৮] কুষ্টিয়া সদর মহকুমায় ৫ই মে ১৯৪৮, চালের দর ছিলো মণ প্ৰতি ২৭ টাকা। ১২ই মে সেখানে দর বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৭ টাকা। কিন্তু ১৯শে মে সেই দর আবার নামিয়ে আনা হয় ৩২০ আনার। ২রা জুন, ১৯৪৮, দর আরও নেমে এসে দাঁড়ায় ৩১ টাকায়। পাবনা জেলাতেও তা-ই ঘটে। সেখানকার গড়পড়তা দর ১৯শে মে ছিলো ২৯॥০ ২৬শে মে তা চড়ে ৩০ টাকায়। ২রা জুন আবার তাকে নামিয়ে আনা হয় ২৭॥০। 

খুলনা সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত বিস্তৃতভাবে বলতে গিয়ে তিনি জানান যে, জেলা হিসেবে খুলনা উদ্বৃত্ত হলেও তার মধ্যেই কতকগুলি ঘাটতি এলাকা আছে। খুলনা শহর এই ধরনের একটি এলাকা। সেখানকার সরবরাহ আসে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে। উদ্বৃত্ত এলাকা থেকে খুলনা শহরে চাল না নিয়ে এলে ঘাটতি এলাকায় ঘাটতি এবং দর আরও বৃদ্ধি পায়। খুলনা জেলার সদর মহকুমায় ১৯শে মে, ১৯৪৮, চালের দর ছিলো মণ প্রতি ২৩ টাকা। ২৬শে মে সেই দর উঠে দাঁড়ায় ৩০ টাকায়। এই পর্যায়ে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন এবং তার ফলে ২রা জুন দর ২৩ টাকায় নেমে আসে। নূরুল আমীন নিজে ৩রা জুন খুলনা সদরে যান এবং সেইদিন দর দাঁড়ায় মণ প্রতি ২০ টাকায়। তিনি বলেন যে খুলনায় বেসরকারী ব্যক্তিরা তাকে জানান যে, সরকার যে প্রচেষ্টা শুরু করেছেন তার ফলে দর আরও কমতির দিকে যাবে। তিরিশ টাকা থেকে দর এত তাড়াতাড়ি ২০॥০ আনায় কমে আসার কথা উল্লেখ করে নূরুল আমীন দাবী করেন যে চালের দরবৃদ্ধি চাহিদা-সরবরাহের সাধারণ অর্থনৈতিক নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না, সেটা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা শিকারের প্রচেষ্টার দ্বারা। 

এই সময়ে পূর্ব বাঙলায় রেশন এলাকার মোট লোক সংখ্যা ছিলো ৮,০২,২৭০।[৩৯] এই রেশন এলাকাগুলিতে চাল সরবরাহ করাই সরকারের প্রথম দায়িত্ব হিসেবে নূরুল আমীন উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, সরকারের হাতে চালের হিসেবে ৫৭০০০ টন ধান ও চালের মধ্যে এই সমস্ত এলাকায় পাঠাতে হয় ৭,৫০০ টন। তাঁদের দ্বিতীয় দায়িত্ব পূর্ব বাঙলা রেলওয়ে, স্টিমার কোম্পানী, কাপড়ের কল এবং চিনিকল ইত্যাদি বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মেটানো। এদের মাসিক প্রয়োজন প্রায় ৪০০০ টন। গ্রামাঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ করাকে তিনি সরকারের পরবর্তী দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করেন। এর জন্যে মাসিক প্রায় ১০,০০০ টন চাল সরকারী গুদাম থেকে ছাড়া দরকার। কাজেই বিভিন্ন ঘাটতি এলাকায় জুন, জুলাই এবং অগাস্ট মাস পর্যন্ত সরবরাহের জন্যে তাঁদের হাতে যথেষ্ট চাল আছে বলে তিনি পরিষদকে জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, সেপ্টেম্বর মাসে আউশ ধান ওঠার পর স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।[৪০] 

এই বক্তৃতা প্রসঙ্গে নূরুল আমীন বলেন যে, খাদ্যশস্যের ব্যবসাকে পূর্ব বাঙলার মতো খাদ্য ঘাটতি এলাকায় কিছুতেই স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া যেতে পারে না। ব্যবসাদারদের ওপর খাদ্য বিতরণের দায়িত্ব অর্পণ করলে সেটা আত্মহত্যারই শামিল হবে। ব্যবসায়ীদের মূল উদ্দেশ্য মুনাফা এবং এর জন্যে তারা উদ্বৃত্ত এলাকাসমূহ থেকে ঘাটতি এলাকাসমূহে খাদ্য শস্য নিয়ে যাবে ঠিক, কিন্তু সেটা তারা বাজারে ছাড়বে নিজেদের নির্ধারিত দরে। অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন শ্রেণীর লোকেরা সেই দরে চাল কিনতে পারলেও গরীবদের পক্ষে তা সম্ভব হবে না, এবং গরীবরাই হলো সংখ্যায় গরিষ্ঠ। তাদেরকে এর ফলে উপোস থাকতে হবে।[৪১] 

.

এর পর কর্ডন প্রথা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নূরুল আমীন বলেন যে, ১৯৪৮ এর প্রথম দিকে জনগণের একাংশের পক্ষ থেকে বারবার খাদ্যশস্যের নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার দাবী উঠতে থাকে। তিনি বলেন যে, তাঁদের সেই দাবী না মেনে তাঁরা ভালোই করেছিলেন। যে তিনটি জেলায় কর্ডন তুলে নেওয়া হয়েছিলো সেখানে ব্যবসায়ীদেরকে ইচ্ছে মতো ব্যবসা করতে দেওয়াকে তিনি একটি দুঃখজনক ব্যাপার বলে উল্লেখ করেন। কয়েকটি উদ্বৃত্ত এলাকায় কর্ডন তুলে নেওয়ার ফলে অন্যান্য সংগ্রহ এলাকার ওপর একটা বিরূপ মানসিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলেও তিনি পরিষদকে জানান এবং বলেন যে, ঐ সমস্ত এলাকায় কর্ডন উঠিয়ে না নিলে সরকারের খাদ্য মজুত আরও সন্তোষজনক হতো।[৪২] 

খাদ্য ব্যবসায়ীরা এই সময় খাদ্য সংকটের সুযোগ নিয়ে যেভাবে অতিরিক্ত মুনাফা সংগ্রহের ব্যাপারে নিযুক্ত হয়েছিলো, সরকার যে সে বিষয়ে উপযুক্তভাবে অবহিত ছিলেন সেটা নূরুল আমীনের উপরোক্ত পরিষদ বক্তৃতা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও খাদ্য সরবরাহের জন্যে সরকারকে ব্যবসায়ীদের ওপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভরশীল না থেকে উপায় ছিলো না। এর প্রধান কারণ সরকারী প্রশাসনযন্ত্র, যানবাহন এবং পথ ঘাটের অবস্থা। সে সময় সরকারী প্রশাসনযন্ত্রের নানান অব্যবস্থা এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যানবাহন ও পথঘাটের শোচনীয় দুরবস্থার ফলে সরকারের পক্ষে সরবরাহ ব্যবস্থাকে পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণাধীনে চালানো অসম্ভব ছিলো। শুধু তা-ই নয়, যেটুকু সরবরাহের দায়িত্ব সরকারের হাতে তখন ছিলো সে দায়িত্বও সুষ্ঠুভাবে পালনের কোন ক্ষমতা সরকারের ছিলো না। এর ফলে উদ্বৃত্ত এলাকায় খাদ্য সংগ্রহ কিছুটা সম্ভব হলেও সেই খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকার বহুলাংশে ব্যর্থ হতো। আবার এই ব্যর্থতার ফলে একদিকে যেমন সরবরাহের অভাবে ঘাটতি এলাকায় ধান চালের দর বৃদ্ধি পেতো, তেমনি অন্যদিকে সরকারী গুদামে খাদ্যশস্য বিপুল পরিমাণে পচে গিয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়তো। 

খাদ্য সমস্যা সম্পর্কিত এই সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্যে ১৪ই জুন, ১৯৪৮, পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে একটি দীর্ঘ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ পরিষদ বিতর্ক শুরু হওয়ার সময় দেখা যায় সরকার পক্ষীয় সদস্যদের আসন বিপুল সংখ্যায় শূন্য।[৪৩] বিতর্কের প্রথমদিকে মনোরঞ্জন ধর সরকারকে বলেন যে, তাঁদের খাদ্যনীতি যা-ই হোক তাকে জনপ্রিয় হতে হবে। এজন্যে সরকার যদি নিয়ন্ত্রণ ও কর্ডন প্রথা রাখতে চান তাহলে জনগণকে তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে।[৪৪] 

কর্ডন প্রথা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শরফুদ্দীন আহমদ বলেন[৪৫] যে, সে বৎসরের প্রথম দিকে যখন তাঁরা কর্ডন তুলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন তখন ঘাটতি এলাকাগুলিতে চালের দর ছিলো ৪০-৫০ টাকা অথচ উদ্বৃত্ত এলাকায় তার দর ছিলো মাত্র ৫-৬ টাকা অথবা ৬।০ আনা। এদিক দিয়ে বিচার করলে অবস্থা নিতান্তই অসহ্য ছিলো এবং সেই হিসেবে কর্ডন তুলে দেওয়ার প্রস্তাব, বিশেষতঃ জেলার মধ্যে এবং আন্তঃজেলা কর্ডন তুলে দেওয়ার প্রস্তাব, খুবই যুক্তিসঙ্গত ছিলো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে সময় এইভাবে কর্ডন তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিলো তখন একথা কেউ ভাবেনি যে চালের দর এখন যতখানি উঠেছে ততখানি উঠবে। 

শরফুদ্দীন আহমদ চোরাচালানের উল্লেখ করে বলেন যে, সে সময়ে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে কর্ডন জোরদার করার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন যাতে করে খাদ্যশস্য ভারতে পাচার না হতে পারে। খাদ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন বলেছেন যে, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং তার ফলে কোন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যই ভারতে চালান হয়নি। তা যদি হয় তাহলে খাদ্যশস্যের এতখানি ঘাটতি হলো কেন? খোলা বাজারে ধান চাল যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে কিন্তু তার দর খুব বেশী। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, কোনো গুরুতর ঘাটতি এদেশে নেই। চোরাকারবারী এবং মজুতদাররা ইচ্ছেমতোভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণের দ্বারা কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা কামাতে ব্যস্ত হওয়ার ফলেই খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। শরফুদ্দীন আহমদ সরকারী গুদামে খাদ্যশস্য পচে বিনষ্ট হওয়ার উল্লেখ করে দেশের এই দুর্দিনে অপচয়ের জন্যে সরকারী প্রশাসনযন্ত্রকে দায়ী করেন। 

চিনি এবং আটার দুষ্প্রাপ্যতার উল্লেখও শরফুদ্দীন আহমদ তাঁর এই পরিষদ বক্তৃতায় করেন। তিনি বলেন যে, সংবাদপত্র এবং বেতারের মাধ্যমে সরকার জনগণকে বলেছেন যে বিভিন্ন জেলায় চিনি সরবরাহ করা হচ্ছে অথচ জনগণ কোন চিনির দেখা পাচ্ছেন না। পূর্বে লোকে গুড় ব্যবহার করতো কিন্তু এখন গুড়ও বাজার থেকে উধাও হয়েছে। 

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর[৪৬] বক্তৃতায় বলেন যে, দেশে দুর্ভিক্ষ এসে গেছে অথচ সরকার এই সংকটকে দুর্ভিক্ষ হিসেবে স্বীকার করতে চান না। সংগ্রহ ও বিতরণের ক্ষেত্রে তিনি সরকারী প্রশাসনব্যবস্থার দুর্নীতির উল্লেখ করেন। খুলনা জেলার সংগ্রহের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে প্রকিওরমেন্ট অফিসার গ্রামে গিয়ে গৃহস্থের বাড়ীতে উঠলে গৃহস্থ বলে তার ধান আছে ৫০ মণ, কিন্তু অফিসার বলে তার ধান আছে ১০০ মণ। এর পর ঘুষ না দিয়ে গৃহস্থের উপায় থাকে না। এ ধরনের সংগ্রহকে ধীরেন দত্ত ‘ডাকাতি বলে বর্ণনা করেন। রেশনিং প্রথা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, শহরের ৮ লক্ষ মানুষের জন্যে যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু আছে তার কোন মূল্য নেই। প্রকৃতপক্ষে দেশে যদি খাদ্য ঘাটতি থাকে তাহলে ৪ কোটি লোকের জন্যে রেশনিং চালু করা হোক। সরকার যদি তা না পারেন তাহলে শুধুমাত্র শহুরে লোকদের জন্যে রেশনিং চালু না রেখে তাকে সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া হোক। কর্ডন প্রথাও সম্পূর্ণভাবে রহিত করার জন্যে তিনি সুপারিশ করেন। 

চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের[৪৭] চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিবাত্যার উল্লেখ করে বলেন যে, তার ফলে সেখানকার অবস্থার দারুণ অবনতি ঘটেছে। কলকাতার ইংরেজী দৈনিক স্টেটসম্যানের বরাত দিয়ে তিনি জানান যে, কক্সবাজার থেকে দশ হাজার গরীব মানুষ আকিয়াব সীমান্তে খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ধানচাল কেনার মতো ক্ষমতা না থাকায় নিরুপায় হয়ে তাঁদেরকে এইভাবে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। সরকার প্রথমে সস্তা দরে খাদ্যশস্য বিক্রীর যে কেন্দ্রগুলো স্থাপন করেছিলেন সেগুলিও তুলে নেওয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন এবং ঘূর্ণিবাত্যা ও বন্যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্যে আবার সেগুলি চালু করতে সরকারকে অনুরোধ জানান। 

ফজলুল কাদের তাঁদের বক্তৃতায় জানান যে, তাঁর কাছে সংবাদ এসেছে যে প্রায় এক হাজার মাঝি চাল কেনার জন্যে আরাকান সীমান্তে গিয়েছিলো। তাঁদেরকে সেখানে গ্রেফতার করে তাঁদের নৌকাগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং তাঁদের টাকা কড়িও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে তদন্ত করার জন্যে তিনি দাবী জানান।

গণেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে গিয়ে বলেন: 

এই চালের দর বেশী বেড়েছে তার জন্য দায়ী সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টও। তাঁরা বলছেন পাটের দর বেড়েছে সেইজন্য সিম্‌প্যাথেটিক রাইজ হয়েছে। চালের দর বাড়বার কারণ গভর্নমেন্ট অন্যান্য সকল জিনিসের দর বৃদ্ধি বলেছেন। এই সামান্য কয়েকদিনের মধ্যে গভর্নমেন্ট কাপড়ের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। একসেস সেলস্ ট্যাক্স ২৫ পারসেন্ট হয়েছে। একে তো সিমপ্যাথেটিক রাইজ বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। সিমপ্যাথেটিক রাইজ কী করে হতে পারে? গভর্নমেন্ট সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের পিছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন, সেই টাকা চালের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। চালের দর বেড়ে যাচ্ছে। দোষ দেওয়া হচ্ছে হোর্ডারদের। আমি বলি Government is the worst hoarder. গভর্নমেন্ট লক্ষ মণ চাউল গোডাউনে নষ্ট করে দিচ্ছেন। হোর্ডাররা যা হোর্ড করে তার একটি দানা তাঁরা নষ্ট হতে দেয় না। আজাদ পত্রিকায় বের হয়েছে খুলনার সাতক্ষীরা মহকুমায় যথেষ্ট চাউল নষ্ট হয়েছে। আপনারা গেলে দেখতে পাবেন প্রত্যেক গভর্নমেন্ট গুদামে চাল নষ্ট হচ্ছে।[৪৮] 

এই চাল নষ্ট হওয়ার কথায় সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী নূরুল আমীন আপত্তি জানিয়ে বলেন যে, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। তার জবাবে গণেন্দ্র ভট্টাচার্য আবার বলেন যে প্রশ্ন তাঁর থাকতে পারে কিন্তু এই সমস্ত খাদ্যশস্য অসাধু কর্মচারীদের দোষেই নষ্ট হচ্ছে। ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে সিভিল সাপ্লাইয়ের পুলিশ ঘুষ নিচ্ছে এবং তার ফলেই দর বাড়ছে। 

পরিশেষে তিনি কর্ডনিং এবং সেই সাথে সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এছাড়া রেশনিং এলাকার বাইরে কোটি কোটি লোকের দুরবস্থার উল্লেখ করে তিনি রেশনিং তুলে দেওয়ার জন্যেও সরকারের কাছে দাবী জানান।[৪৯] 

নেলী সেনগুপ্তা[৫০] চট্টগ্রামের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, বৎসরের প্রথম দিকে সেখানে মাছ এবং তরিতরকারী সস্তায় পাওয়া যাচ্ছিলো। এমনকি অল্প কিছুদিন পর্যন্ত চালের দরও অযৌক্তিক রকম বেশী ছিলো না। কিন্তু কোন কারণ ছাড়াই চালের দর আবার সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। চিনি, আটা, কেরোসিন তেলের অভাবের কথা এবং সরষের তেলের দর সের প্রতি ৩ টাকা হওয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। 

নেলী সেনগুপ্তা রেশনের পচা চাল সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, তার বাড়ীতে রেশনের পচা চাল নিয়ে এলে সেটা দোকানে ফেরত পাঠান। দোকানদার তার পরিবর্তে ভালো চাল দেয় এবং তার কাছে সেই পচা চাল পাঠানোর জন্যে তার দোকানের যে কর্মচারী দায়ী ছিলো তাকে ধমক দেয়। পরে তিনি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেন, সে কর্মচারীটিকে ধমক দিয়েছে কেন। যে চাল রেশনে সকলের প্রাপ্য সেই চাল নির্বিচারে প্রত্যেককে দেওয়া উচিত। এর জবাবে দোকানদার জানায় যে, তার এ ব্যাপারে করার কিছু নেই। তার প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেই চাল রেশনের চাল হিসেবে বিক্রির জন্যে দেওয়া হয়েছে। তাকে বলে হয়েছে, যেমন করে হোক সেই চাল রেশনে বিক্রি করে দিতে । ফকির আবদুল মান্নান[৫১] খাদ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের বক্তৃতায় পাটের উচ্চমূল্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন যে, পাটের দর বৃদ্ধির ফলে অতিরিক্ত টাকা গৃহস্থেরা পায়নি, পেয়েছে পাটের দালালেরা। গৃহস্থেরা পাট বিক্রি করে যা পেয়েছে সেটা সঙ্গে সঙ্গে খরচা করে দিয়েছে। কাজেই পাটের দর বৃদ্ধির ফলে ধান চালের দর বৃদ্ধি হয়েছে এ যুক্তি তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন না। 

খুলনা জেলার খাদ্য সংগ্রহ সম্পর্কে গোবিন্দলাল ব্যানার্জী বলেন: 

গভর্ণমেন্ট ভালো করে প্রকিওরমেন্ট করবেন এই ভরসা করলেন। রিপার্সদের[৫২] টিকিট সিস্টেম করলেন। এই টিকিট এমনি দুর্বোধ্য যে ফলে খুলনা শহরে ৩ সপ্তাহ ধরে ১০ হাজার ১৫ হাজার লোক প্যারেড করে বেড়িয়েছে। রাত্রি ১২টায় ১টায় মিটিং হয়েছে। ১৪৪ ধারা থাকতেও তাঁরা মিটিং করবে আইন ভঙ্গ করবে। আমি নূরুল আমিন সাহেবের নিকট চিঠি লিখেছিলাম, উত্তর পাইনি। ৩/৪ হাজার ধানের নৌকা আটকানো হয়েছিলো-গুলিও চলেছিলো-কিছুই ফল হলো না। ১৫ হাজার চাষী যদি নাড়া দেয় সমস্ত জেলায় প্রকিওরমেন্টের অসুবিধা হবে- রিএকশন অন্য জেলায় যাবে। এনএম খান সাহেব ছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁকে আমি বলি আপনি আইসিএস মানুষ, পাবলিক মিটিং-এ বক্তৃতা করুন। এই যে হাজার হাজার লোক শহর কাঁপিয়ে চলেছে তাদের সামনে আপনার বক্তব্য পেশ করুন, তিনি বক্তৃতা করলেন না। তাঁর কাছ থেকে ২ লক্ষ মণ ধান নেওয়া হয়। মাত্র ৮০ হাজার মণ ধান নাকি গুদামে উঠেছে। আমার মনে হয় এর ফলে সমস্ত জেলায় প্রকিওরমেন্ট নষ্ট হয়েছে। গভর্ণমেন্ট সেই সময় ধান কিনবার যে রেট ধার্য্য করেছিলেন ৮।, সেই সময় আমরা বলেছিলাম এটা ফেয়ার প্রাইস। গভর্ণমেন্টকে প্রকিওরমেন্টে সাহায্য করবার জন্য আমি প্রকিওরমেন্ট সেন্টারে সেন্টারে গিয়েছি। অনেক জায়গায় চাল ছিলো কিন্তু টাকার অভাবে প্রকিওরমেন্ট হয়নি। মিষ্টার এনএম খানকে বলেছিলাম, টাকার ব্যবস্থা করুন। তারপর আর এক ডিফিকাল্টি টাকা ট্রেজারীতে উপস্থিত হলে। শুনলে অবাক হবেন যেখানে ৩০ হাজার মণ সহজে প্রকিওরমেন্ট হত – কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ লীডাররা এবং জনসাধারণ সর্বান্তকরণে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলো ডিপার্টমেন্টাল অফিসারদের bungling এর জন্য সেখানে ৭ হাজার মণ ধান প্রকিওরমেন্ট হয়েছে। আমার মনে হয় এজন্য whole department should be prosecuted।[৫৩]

বক্তৃতার শেষে গোবিন্দলাল ব্যানার্জী কনট্রোল এবং রেশনিং তুলে দেওয়ার দাবী জানান। সিলেটের চা বাগানের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্ত বলেন যে, পূর্ব বাঙলা সরকার সিলেটকে একটি উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে ধরে নিয়ে ভুল করেছেন। সিলেট কোনদিনও উদ্বৃত্ত এলাকা ছিলো না। প্রথমে বর্মা থেকে এবং আসাম থেকে সিলেটের চা বাগানগুলির জন্যে দেড় লক্ষ মণ চাল আসতো। দেশ ভাগের পর সেই চাল আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিন্তু এই ঘাটতি পূরণের কোন ব্যবস্থা হয়নি।[৫৪] 

তিনি বলেন যে, সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের মন্ত্রী নিজের বিবৃতিতে পূর্ব বাঙলা রেলওয়েকে চাল সরবরাহের কথা বলেছেন কিন্তু সিলেটের চা-বাগানগুলি সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। চা-বাগান শ্রমিকদের অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন: 

চা-বাগানের শ্রমিকদিগকে চাউল সরবরাহের সঙ্গে উহাদের মজুরীর একটা সম্পর্ক আছে। আগে বাগান কর্তৃপক্ষেরা যে দরেই চাল ক্রয় করুক না কেন শ্রমিকেরা ৫ টাকা মণ দরে চাল পেতো। চালের এই দরের উপর উহাদের মজুরী নির্ধারিত আছে। সরকার বাগানগুলিকে চাল না দেওয়াতে এবং বাগান কর্তৃপক্ষও চাল খরিদ করিতে না পারায়, শ্রমিকদিগকে বাজার হইতে চাউল খরিদ করিতে হয়। এখন বাজারে সে চালের দাম হচ্ছে ৩০ টাকা। ৫ টাকার স্থলে ৩০ টাকা দরে চাউল কিনিতে হওয়ায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মজুরী বৃদ্ধি না হওয়ায় শ্রমিকদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমাদের অনেক কষ্ট করে বাগানগুলিতে Strike বন্ধ করতে হয়। সরকার সে দিকে দৃষ্টি না দিলে আমাদের বিশেষ অসুবিধা হবে। [৫৫] 

বিরোধী দলের নেতা বসন্তকুমার দাস কংগ্রেস পার্লামেন্টারী পার্টির পক্ষ থেকে খাদ্য পরিস্থিতির ওপর বক্তৃতা দিতে গিয়ে “এই প্রদেশে দুর্ভিক্ষ আসতে দেবো না” এই মর্মে খাদ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের আশ্বাস এবং পূর্ববর্তী বৎসরের মতো এবারও “দৃঢ়ভাবে” দুর্ভিক্ষ দমনের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে বলেন: 

আমি জিজ্ঞাসা করি যে গত বৎসর যে অবস্থায় দুর্ভিক্ষের ছায়া দেখা দিয়েছিলো এবার কি ঠিক সেই অবস্থায় দুর্ভিক্ষের ছায়া এসেছে, না অবস্থার কোন বৈষম্য হয়েছে? গেল বৎসর যখন দুর্ভিক্ষের ছায়া পড়ে তখন দেখেছিলাম পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে যে বাণিজ্য সূত্র তা ছিন্ন হয়নি – আজ এই প্রদেশে যে অর্থনৈতিক সমস্যা এসেছে তা তখন ছিলো না – তখন দুর্নীতিপরায়ণ গভর্নমেন্ট কর্মচারী দেখিনি – তখন আমরা কালোবাজারী, মুনাফাখোর পাইনি। কিন্তু এই কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তা চিন্তা করে দেখুন। খাদ্য পরিস্থিতি বর্তমান আর্থিক অবস্থার একটা অংশ। এই যে ধান চালের দাম বেড়েছে এটা তার একটা দিক মাত্র! একটা দিক আমরা আলোচনা করছি – সমগ্র আর্থিক অবস্থা আলোচনা করছি না। আমরা কেবল খাদ্য পরিস্থিতি আলোচনা করছি এবং অন্যান্য যে সকল কারণে এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা আলোচনা করছি না।[৫৬] 

এরপর বসন্তকুমার দাস কনট্রোল, কর্ডনিং এবং রেশনিং সম্পর্কে বলেন: 

বর্তমান খাদ্য সংকটের জন্য সমস্ত দোষ চাপানো হয় চোরাকারবারী এবং মুনাফাখোরের উপর। আপনাদের আজ চিন্তা করতে হবে এই যে চোরকারবারী, মুনাফাখোর এদের সৃষ্টি করেছে কে। সৃষ্টি করেছে এই রেশনিং এবং কনট্রোল। যদি এই রেশনিং না থাকতো যদি এই কনট্রোল না থাকতো এই চোরকারবারী আমরা দেখতে পেতাম না। রেশন করা হয়েছে ৮ লক্ষ লোকের জন্য। একটা বরাদ্দ করা হয়েছে – সেটা প্রয়োজনের চাইতে কম – তাই নিয়ে প্রয়োজন মেটাতে হবে। লোক অন্যায়ভাবে খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহের চেষ্টা করে। যারা ব্যবসায়ী তাঁরা তার সুযোগ নেয় এবং বেশী মূল্যে জিনিস বিক্রী করে। ফলে চোরকারবারী, মুনাফাখোরের সৃষ্টি হয়। এই অসুরকে দমন করতে হবে। গভর্ণমেন্ট বলছেন তাঁরা চেষ্টা করছেন দমন হচ্ছে না। ২ শত কেস prosecution হচ্ছে। চোরাকারবারী ধ্বংস করতেই হবে – মুনাফাখোরদের ধ্বংস করতেই হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিপরায়ণ গভর্ণমেন্ট কর্মচারী যারা আছেন তাঁদেরও দমন করতে হবে। যদি রেশনিং কর্ডনিং এবং কনট্রোল রাখেন – তবে তার ভেতর দিয়ে  চোরাকারবারী ও মুনাফাখোরের সৃষ্টি হবে। একদিক দিয়ে দমন করছেন অন্য দিক দিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে। ভগবান লীলা করেন সৃষ্টির মধ্যে। গভর্ণমেন্টও একটা লীলা করছেন। তাঁরা কর্ডন কনট্রোল রেশনিং অসুরকে একদিকে মারছেন অন্যদিকে সৃষ্টি করছেন। আমরা গভর্ণমেন্টকে বলছি যে কর্ডনিং তুলে দিন। তাঁরা বলেন যে cordoning তুলে দিয়ে দেখা গেছে সেই সেই অঞ্চলে দাম হুহু করে বেড়ে গিয়েছে। কর্ডনিং করলেও বিপদ উঠিয়ে দিলেও বিপদ এই তো অবস্থা। প্রদেশের ভিতর প্রকিওরমেন্ট-এও একটা দাম বাড়বার কারণ। প্রদেশের ভিতর সংগ্রহের ব্যবস্থা রহিত করুন। এই ব্যবস্থা থাকলে দুর্নীতি চলবে। যদি প্রকিওরমেন্ট দরকার হয় বাহির থেকে আনুন। ডেপুটি লীডার বলেছেন পাকিস্তানে খাদ্যশস্যের অভাব নাই। করাচী থেকে ১২ লক্ষ মণ চাল আসবে, হুইট এবং হুইট প্রডাক্টস আসবে। কবে যে আসবে তা আমরা জানি না। চিনি নাই ৭ মাস হতে চলল তাঁদের কোন দৃষ্টি নাই। বাহির হইতে খাদ্য শস্য আমদানী করুন এবং ঘাটতি এলাকায় গভর্ণমেন্ট গুদামে তা রাখুন। লোকের মন থেকে ভীতি দূরীভূত হবে এবং যে সব ব্যবসায়ী বেশী দামে জিনিস বিক্রী করতে চায় তাঁরাও দমন হবে। আমরা বলতে চাই কন্ট্রোল, রেশনিং দ্বারা অনিষ্ট হচ্ছে। এ সমস্ত রহিত করে আমরা যে ব্যবস্থা বলছি তাই গ্রহণ করুন দেশে অচিরে সুখ শান্তি ফিরে আসবে।[৫৭] 

পূর্ব বাঙলা পরিষদে খাদ্য পরিস্থিতির ওপর উপরোক্ত বিতর্কের শেষে বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী নূরুল আমীন একটি দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। এই বক্তৃতায় তিনি সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচনাসমূহের একের পর এক জবাব দেন। এগুলির মধ্যে কতকগুলি এখানে উল্লেখযোগ্য। 

কেবলমাত্র শহরের লোকের জন্যেই রেশনিং প্রথা চালু রাখা হয়েছে এবং সেই হিসেবে রেশনিং পূর্ব বাঙলার সর্বত্র তুলে দেওয়া হোক এই বক্তব্য প্রসঙ্গে নূরুল আমীন বলেন যে, শুধু শহরের জন্যে রেশনিং প্রবর্তন করা এবং চালু রাখা হয়েছে একথা মোটেই ঠিক নয়। রেশনিং প্ৰথা শহর এবং গ্রামের সমগ্র জনগণের উপকারের জন্যেই প্রবর্তিত হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে গ্রামের সরবরাহের সাথে শহরের রেশনিং-এর প্রশ্ন খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কারণ, যে সমস্ত জায়গা ঘাটতি এলাকা এবং যেখানে বহু লোকের একত্র বসবাস একমাত্র সেই সমস্ত এলাকাতেই রেশনিং প্রবর্তন করা হয়েছে। তিনি বলেন যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি শহরে রেশনিং যদি তুলে নেওয়া হয় তাহলে বাইরে থেকে এইসব অঞ্চলে বিপুল পরিমাণে খাদ্যশস্য আমদানী হবে এবং তার ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ধান চালের দাম গ্রামাঞ্চলে ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ জন্যে যে সমস্ত ঘাটতি অঞ্চলে বহু লোকের বাস এবং যেখানে লোকেরা অপেক্ষাকৃত অধিক মূল্যেও খাদ্য কিনতে পারে সেই সব অঞ্চলে সরবরাহের ভার সরকার নিজের হাতে নিয়ে মূল্যকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছে। ঢাকায় যদি রেশনিং না থাকতো তাহলে মফস্বলে যে চাল এখন ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রী হচ্ছে সেই চালের দর বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াতো ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। নূরুল আমীন বলেন যে, রেশনিং প্রথার চিনা প্রাচীরের জন্যেই তা হচ্ছে না এবং রেশনিং তুলে নিলে গ্রামাঞ্চলের গরীবদের জীবনে ধান চালের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি আরও অনেক বেশী সর্বনাশ ডেকে আনবে।[৫৮] 

ভারতে ধান চাল পাচার এবং বর্ডার মিলিশিয়াদের দুর্নীতি সম্পর্কে কয়েকজন পরিষদ সদস্যের বক্তব্যকে খণ্ডন করতে গিয়ে নূরুল আমীন বলেন যে, যাঁরা ভারতে খাদ্যশস্য পাচারের কথা বলছেন তাঁরাই আবার বলছেন যে, পূর্ব বাঙলার থেকে পশ্চিম বাঙলায় ধান চালের দাম কম। পশ্চিম বাঙলায় ধান চালের অপেক্ষাকৃত অল্পমূল্যের কথা স্বীকার করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন যে, সেই অবস্থায় পূর্ব বাঙলা থেকে ধান চাল পাচার হওয়া কিভাবে সম্ভব? কাজেই তাঁর মতে চোরাচালানের প্রশ্নকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে হবে। দুই দেশের মধ্যে খাদ্যশস্যের আপেক্ষিক মূল্যই পূর্ব বাঙলা থেকে পশ্চিম বাঙলায় চোরাচালান না হওয়ার স্বাভাবিক কারণ। বর্ডার মিলিশিয়া চোরাচালানের কাজে লিপ্ত থেকে দুর্নীতি করছে এই অভিযোগকেও নূরুল আমীন ভিত্তিহীন ব্যাপার বলে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন।[৫৯] কনট্রোলপ্রথা সম্পর্কে নূরুল আমীন বলেন যে, তা বহাল রাখা অথবা রহিত করা সম্পর্কে পরিষদ সদস্যদের মধ্যে কোন মতৈক্য নেই। তিনি বলেন যে, তিনি নিজে একজন বিশেষজ্ঞ নন তবে যে ব্যবস্থা তাঁরা রেখেছেন সেটা অন্য দেশের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়েই রেখেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বিশেষভাবে পশ্চিম বাঙলা এবং ভারতের কথা উল্লেখ করেন। কলকাতায় তখনো খাদ্যশস্যের নিয়ন্ত্রণ ছিলো। সে দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন যে, কলকাতায় ঢাকার থেকে বেশী সংখ্যক বিশেষজ্ঞ আছেন এবং তাঁরা নিশ্চয় সেখানে অকারণে কন্ট্রোল প্রথা রাখছেন না। তাঁরা কাপড়ের কনট্রোল তুলে নিয়েছেন। তার পরিণতি কি হয়েছে তা সকলেরই জানা। কাজেই তাঁরা আবার কাপড়ের কনট্রোল প্রবর্তনের চিন্তা করছেন। সেখানে কনট্রোল তুলে নেওয়ার পরীক্ষা করতে গিয়ে এই অবস্থা হয়েছে। তাছাড়া ভারতের অন্যান্য বহু জায়গাতেও এখন খাদ্যশস্যের কনট্রোল চালু আছে। নূরুল আমীন বলেন যে, তাঁরাও পূর্ব বাঙলায় কনট্রোল তুলে দেওয়ার পরীক্ষা করেছেন এবং সে পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই কনট্রোল তুলে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। একথা সকলেই জানে যে, যেখানে যে জিনিসের ঘাটতি সেখানে সেই জিনিসের কনট্রোল দরকার। অন্যথায় যাদের বেশী দাম দিয়ে বেশী কেনার ক্ষমতা তাঁরা বেশী বেশী করে কিনে সেই জিনিসের দাম সাধারণ ভাবে অনেক বাড়িয়ে দেয় এবং তার ফলে গরীব এবং অল্পবিত্ত মানুষেরাই বিপদগ্রস্ত হন।[৬০] 

বিরোধী দলের ডেপুটি লীডার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্য – অকার্যকর নিয়ন্ত্রণ, সংগ্রহ ও বিতরণের থেকে একেবারে কোন সরকারী নিয়ন্ত্রণ, সংগ্রহ ও বিতরণের ব্যবস্থা না রাখা।[৬১] 

এই বিষয় উল্লেখ করে নূরুল আমীন বলেন, তার অর্থ হলো এই যে, হয় আমাদের একটা প্রথম শ্রেণীর প্রশাসন ব্যবস্থা থাকা দরকার, নয়তো কোন প্রশাসন ব্যবস্থা থাকারই দরকার নেই। কিন্তু কোন সরকারই এই উপদেশ মেনে নিতে পারেন না। কারণ প্রথম শ্রেণীর প্রশাসন ব্যবস্থার অভাবে তাঁরা যদি সমগ্র প্রশাসন ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে বসেন, তাহলে সারা দেশব্যাপী নৈরাজ্য দেখা দেবে। কাজেই সরকারকে সব সময় একটা আদর্শ সামনে রেখে মাঝামাঝি ধরনের প্রশাসন যন্ত্র দিয়েই কাজ চালাতে হবে।[৬২] 

সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বিভাগীয় মন্ত্রী নূরুল আমীন বলেন যে, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে তিনি চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেননি। ভালো অফিসারদের সম্পর্কে কেউ কথা না বলে ঢালাওভাবে শুধু দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারদের কথা বলেই সকলে ক্ষান্ত হচ্ছেন। এ কথা ঠিক যে, সকল অফিসারই সৎ নয়। কিন্তু তাই বলে সকল অফিসারকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে সাধারণভাবে অভিযোগ উত্থাপনেরও কোন ভিত্তি নেই। তিনি পরিষদ সদস্যদের কাছে অনুরোধ করেন তাঁরা যেন অফিসারদের বিরুদ্ধে বিশেষ বিশেষ অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারের সাথে সহযোগিতা করেন।[৬৩] 

অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহের প্রসঙ্গে নূরুল আমীন বলেন যে, সরকার যে সন্তোষজনকভাবে এই সংগ্রহ করতে পারেননি এ কথা সরকার নিজেই স্বীকার করেন। পূর্ববর্তী ডিসেম্বর – জানুয়ারী মাসের কনট্রোল বিরোধী আন্দোলনের উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সারা পূর্ব বাঙলাব্যাপী তখন কর্ডন তুলে নেওয়ার জন্যে জোর আওয়াজ তোলা হয়। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তখন হাজার হাজার লোকের সভায় কনট্রোলের বিপক্ষে এবং কনট্রোল প্রথা উঠিয়ে দেওয়ার আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ান। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাদেশিক সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা নিজেদের বিশেষজ্ঞদের সাথে একত্রে বসে সে সময় স্থির করেন যে তৎকালীন অবস্থায় কনট্রোল তুলে নিলে জনগণের পক্ষে তার পরিণতি মারাত্মক হবে। কাজেই কনট্রোল রাখারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে তিনটি জেলায় কর্ডন উঠিয়ে নিয়ে কতকগুলি বিশেষ বিশেষ এলাকায় সংগ্রহকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। কিন্তু এইভাবে কয়েকটি জেলায় কর্ডন তুলে নেওয়ার ফল অন্যান্য কর্ডনভুক্ত এলাকার পক্ষে খুব খারাপ দাঁড়ায়। সেখানকার লোকে নিজেদের এলাকাতেও কর্ডন উঠিয়ে নেওয়ার জোর দাবী তুলে সংগ্রহের ক্ষেত্রে নানারকম বাধা সৃষ্টি করে। সংগ্রহের পক্ষে সব থেকে উপযুক্ত মাস জানুয়ারী এইভাবে কনট্রোল রাখা না রাখার গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে নষ্ট হয়।[৬৪] 

কর্ডন থাকা অবস্থায় বলা হতো যে, কর্ডনিং অফিসাররা ঘুষ খেয়ে ধান চালের দর বৃদ্ধি করছে। নূরুল আমীন পরিষদকে জিজ্ঞাসা করেন বরিশাল ময়মনসিংহে কর্ডন তুলে নেওয়ার পর দর কমছে না কেন? এখন তো কর্ডনিং অফিসাররা নেই। তবে তাদের স্থানে এখন কারা এই দর বৃদ্ধি করছে? এর জবাবে তিনিই বলেন যে, তারা হচ্ছে ব্যবসায়ী এবং ব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউই নয়। এরাই উদ্বৃত্ত জেলাগুলি থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য খরিদ করে ধান চালের দর বাড়িয়ে দিচ্ছে। এদেরকে শায়েস্তা করার জন্যে নূরুল আমীন নিজের দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করেন।[৬৫] 

খাদ্য সমস্যার ওপর এই পরিষদ বিতর্কে খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান প্রভৃতি বিরোধী দলীয় সদস্যরা কোন অংশগ্রহণ করেননি। বিরোধীদলের মধ্যে শুধু কংগ্রেস সদস্যরাই ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সমালোচনাও কতকগুলি বিশেষ কারণে তেমন জোরালো অথবা সুফলপ্রসূ হয়নি। 

এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় পৃথকভাবে উল্লেখ করা দরকার। প্রথমটি হচ্ছে প্রকিওরমেন্ট বা সংগ্রহের প্রশ্নে কংগ্রেস সদস্যদের মতামত ও বক্তব্য। একথা খুবই সত্য যে, সরকারী নীতির মধ্যে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্নীতি ছিলো, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সংগ্রহ নীতি পূর্ব বাঙলার তৎকালীন সংকটাপন্ন অবস্থায় নীতি হিসেবে ভুল ছিলো। কিন্তু এই কথাটিই কংগ্রেস সদস্যরা বারবার করে তাঁদের বক্তৃতায় বলছিলেন। তাঁদের মুখ থেকে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ উঠিয়ে নেওয়ার কথাটা একটা দাবী হিসেবেই বারংবার উচ্চারিত হচ্ছিলো। 

তাঁদের এই দাবীর কারণ ছিলো এই যে, যাদের থেকে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ নীতির মাধ্যমে সরকার নির্দিষ্ট মূল্যে কিনে নিচ্ছিলো তাঁরা অনেকেই ছিলো জমিদার জোতদার ও মহাজন শ্রেণীর লোক। এবং তখনো পর্যন্ত এই শ্রেণীভুক্ত লোকদের মধ্যে ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্য। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ফলে মজুত খাদ্যশস্য এরা উচ্চহারে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রী করতে না পারার ফলে তাঁদের স্বার্থহানি হচ্ছিলো। পূর্ব বাঙলা পরিষদে কংগ্রেস সদস্যেরা নিজেরা ছিলেন এই জমিদার জোতদার শ্রেণীভুক্ত। তাছাড়া সাধারণভাবে এই শ্রেণীর স্বার্থেরও তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করতেন। এ জন্যেই ঢালাওভাবে সংগ্রহনীতি প্রত্যাহার করার স্বপক্ষে ছিলো তাঁদের ঐক্যবদ্ধ দাবী। 

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, রেশনিং সম্পর্কে কংগ্রেস সদস্যদের বক্তব্য এবং দাবী। এই দাবী একদিকে ছিলো যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, অন্যদিকে তেমনি বিস্ময়কর। তবে এই দাবীর তাৎপর্য উপলব্ধি করলে বিস্ময়ের অবসান ঘটতে দেরী হয় না। 

রেশনিং তুলে না দেওয়ার স্বপক্ষে নূরুল আমীন যে যুক্তি প্রদান করেছিলেন তা যথার্থ। কারণ জনবহুল এবং অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন লোকদের এলাকা বড়ো বড়ো শহরগুলিতে রেশনিং চালু না রাখলে ব্যবসায়ীরা সেই সব জায়গায় ইচ্ছেমতো সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে শুধু যে শহরেই খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে দিতো তাই নয়, গ্রামাঞ্চলেও তার দাম সব রকম নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতো। একথা এত সহজ এবং সাধারণভাবে সকলের জানা যে প্রথম দৃষ্টিতে কংগ্রেসের রেশনিং তুলে দেওয়ার দাবী সত্যিই বিস্ময়কর এক ধাঁধার মতো মনে হয়। 

কিন্তু একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, সংগ্রহনীতি বাতিল করার দাবীর মতো রেশনিং তুলে নেওয়ার দাবীও তাঁদের নিজেদের শ্রেণীচরিত্রের সাথে সম্পর্কিত। এই শ্রেণীচরিত্রের আবার একটা বিশেষ সাম্প্রদায়িক দিকও ছিলো। 

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ইত্যাদি বড়ো বড়ো রেশনিং এলাকাভুক্ত শহরগুলিতে খাদ্য সরবরাহ সাধারণতঃ হতো তাঁদের নিকটবর্তী কতকগুলি ধান চালের ব্যবসা কেন্দ্ৰ থেকে। এই ব্যবসাকে বলা হতো রাখীর ব্যবসা। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সরবরাহ রেশনিং প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত হতো মীরকাদিম, নরসিংদী, মদনগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা থেকে। রেশনিং প্রবর্তিত হওয়ার পর এই সব এলাকার রাখীর ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পূর্বে শহরাঞ্চলে খাদ্যশস্য সরবরাহ করে তাঁরা যে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতো সেটা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। 

এই রাখীর ব্যবসায়ীদের প্রায় সকলেই ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। এবং এদের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই পূর্ব বাঙলা পরিষদের কংগ্রেস দলীয় সদস্যেরা রেশনিং-এর সুবিধাবঞ্চিত পূর্ব বাঙলার চার কোটি দরিদ্র জনগণের দোহাই পেড়ে দেশ থেকে রেশনিং উঠিয়ে নেওয়ার দাবী জানাচ্ছিলেন। 

খাদ্য সমস্যার ক্ষেত্রে কংগ্রেস সদস্যদের এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যে কর্ডন বিরোধী আন্দোলন এবং সাধারণভাবে তৎকালীন খাদ্য আন্দোলন ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সদস্যরা তাঁদের সাথে একত্রে কাজ করতে অসমর্থ হন।[৬৬] রেশনিং-এর ক্ষেত্রে ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের লোকেদের দাবী ছিলো বরাদ্দ খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং পচা চাল আটা ইত্যাদি সরবরাহ বন্ধ করা। কাজেই কংগ্রেস সদস্যদের রেশনিং সম্পূর্ণভাবে উঠিয়ে নেওয়ার দাবীর সাথে তাঁদের একেবারেই কোন ঐকমত্য ছিলো না। 

প্রকিওরমেন্ট ও রেশনিং এর ক্ষেত্রে একদিকে প্রশাসনিক যন্ত্রের অব্যবস্থা এবং অন্যদিকে আমলাদের দুর্নীতিই খাদ্য পরিস্থিতিকে জটিল করেছিলো। মজুতদার ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সাথে জমিদার জোতদারদের আঁতাতও পরিস্থিতির অবনতি ঘটার অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো। পূর্ব বাঙলা পরিষদের সদস্যরা অধিকাংশই কোন না কোন সূত্রে এই সমস্ত সমাজবিরোধী স্বার্থের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। এজন্যে একদিকে যেমন তাঁদের সাথে খাদ্য আন্দোলনের কোন উল্লেখযোগ্য যোগ থাকেনি অন্যদিকে তেমনি তাঁরা সর্বদলীয় খাদ্য কমিটি গঠনের কোন প্রশ্নও তোলেননি। বিতর্ককালে নিজেদের সংকীর্ণ বক্তব্য পেশ করেই তাঁরা ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে খাদ্য সংকটের ক্ষেত্রে নিজেদের পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 

৬. ১৯৪৯ সালে বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্য পরিস্থিতি 

খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমা খাদ্যশস্যের দিক দিয়ে একটা উদ্বৃত্ত অঞ্চল। কিন্তু এই অঞ্চলেও খাদ্য সংকট ১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসে কি পর্যায়ে উপনীত হয় সেটা নিম্নলিখিত রিপোর্ট থেকে বোঝা যাবে: 

বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, কচুয়া, মোল্লাহাট প্রভৃতি অঞ্চলে এবার এক মণ ধান ৫০ টাকা দিয়েও কিনতে হচ্ছে। শত শত লোক এই বাগেরহাটে খাদ্যাভাবে অকাল মৃত্যুর কবলে চলে গেছে। মফস্বলের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ লেগে গেছে ৩/৪ মাস আগে থেকেই। যার ফলে মোড়েলগঞ্জ, মোল্লাহাট ফকিরহাট হতে সহস্র সহস্র লোক ঘরবাড়ী ছেড়ে শহরের দিকে দুমুঠো অন্নের সন্ধানে চলেছে ছেলেমেয়েদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে এই আশ্বাসে। এবং এই সকল অঞ্চলে ভিক্ষুকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে ও শহরে ভিড় করছে। বর্তমানেও ধান চালের দাম এত চড়া যা জনসাধারণের ক্রয় শক্তির বাইরে। এত গেল খাদ্য শস্যের অবস্থা – এদিকে সরিষার তেলের সের ৫ টাকা। তাও খাঁটি নয়। পেটের পীড়া সৃষ্টিকারী ভেজাল বাদাম তেল।… 

বর্তমানে বাগেরহাটে এত ভিক্ষুক বেড়েছে যে ৫০ সনের দুর্ভিক্ষের আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওদিকে শহরের চারিদিকে গায়ে খাটা মজুরদের অবস্থা ভয়ানক করুণ।… 

জনসাধারণ কনট্রোল ও চোরাবাজারের দৌরাত্ব্যে নাজেহাল হয়ে পড়েছে। জনসাধারণ যেখানেই এই সকল সমাজবিরোধী ও দুর্নীতিপরায়ণ কার্যের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হচ্ছে সেখানেই বাগেরহাটের সরকারী কর্তৃপক্ষ পুলিশ দিয়ে তাঁদের ছলে-কৌশলে লাঞ্ছনা দিচ্ছে। হাজতে আটকিয়ে জামিনের আশ্বাস দিয়ে আনসার বাহিনীর নাম নিয়ে জুলুম করে টাকা আদায় করছে।[৬৭] 

১৯৪৮ এর নভেম্বরের দিকে[৬৮] ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমায় চালের দর দাঁড়ায় ৪২ থেকে ৫৩ টাকা। সেই তুলনায় সেখানে পাটের দর থাকে মণ প্রতি ২৮-২৯ টাকা।[৬৯] রংপুরে নোতুন আমন চাল ২৯-৩০ টাকা এবং অন্যান্য চাল ৩৪-৩৫ টাকা মণ দরে বেচাকেনা হয়।[৭০] নোয়াখালীতে দুর্ভিক্ষের আভাস পাওয়া যাচ্ছে এই মর্মে রিপোর্টও এই সময় দেখা যায়। 

১৯৪৯ সালের জানুয়ারী মাসে খাদ্য পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। সংবাদপত্রে এ সময়ে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকার খাদ্যমূল্য সম্পর্কে যে রিপোর্টসমূহ প্রকাশিত হতে থাকে তার থেকে দেখা যায় যে, সর্বত্র চালের দর দ্রুতগতিতে অস্বাভাবিকরকম বৃদ্ধি পাচ্ছে। জানুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চালের দর দাঁড়ায় মণ প্রতি ৪০-৪২ টাকা, চাঁদপুরে ৩৬- ৩৭ টাকা, সিরাজগঞ্জে ৪০ টাকা।[৭১] প্রদেশের অন্যত্রও চালের মূল্য প্রায় ঐ রকমই থাকে।

এ সম্পর্ক দৈনিক আজাদে ২৫শে জানুয়ারী, ১৯৪৯ তারিখে “খাদ্য সমস্যার প্রতিকার” নামক একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এই সম্পাদকীয়টির নিম্নোদ্ধৃত অংশ থেকে তৎকালীন খাদ্য পরিস্থিতির একটা চিত্র পাওয়া যাবে: 

মাঘ মাস হইতে চাউলের মূল্য চল্লিশ টাকা এবং ধানের মূল্য ছাব্বিশ টাকায় উঠিবার যে কি কারণ থাকিতে পারে, তাহা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সরবরাহ বিভাগ এখনও খুলিয়া বলিতেছেন না কেন? গত বৎসর এ সময়ে চাউলের দাম পঁচিশ টাকা এবং ধানের দাম ষোলো-সতেরো টাকার মধ্যে ছিলো বলিয়াই আমাদের মনে পড়ে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে উহা বাড়িয়া চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ টাকায় উঠে। এবারকার আমন ফসল উঠিবার বহু পূর্বেই সরকার তাহাদের নূতন খাদ্য পরিকল্পনা রচনা করিয়াছিলেন বলিয়া আমরা জানি। বাড়তি এলাকায় যাহাদের তিরিশ বিঘার বেশী ধানের জমি আছে তাহাদের নিকট হইতে বাধ্যতামূলকভাবে ধান্য ক্রয় করিবার নীতি সরকার ধান উঠিবার বহু পূর্বেই প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং আমরা একথা শুনিয়াছিলাম যে, এজন্য আমলা ফায়লা নিযুক্তি করণের কার্যটা বহু পূর্বেই সরকার সারিয়া ফেলিয়াছিলেন। সব কাজেরই সাফল্য যাহারা কাজ করে তাহাদেরই উপরে নির্ভর করে বলিয়া এবং পদস্থ সরকারী আমলাদের অতীত কার্যকলাপ আমাদের জানা আছে গতিকে আমরা যদিও সরকারের উপরোক্ত ক্রয় নীতির সাফল্য সম্বন্ধে কোন দিনই খুব বেশী উচ্চাশা পোষণ করি নাই, তবু অন্ততঃ অবস্থাটাকে গতবারের চাইতে খারাপ করিয়া তুলিবেন না। আমরা এরূপ আশাও করিয়াছিলাম যে, বাড়তি এলাকা হইতে সরকার যে ধান-চাউল ক্রয় করিবেন, তাহা কালবিলম্ব না করিয়া ঘাটতি এলাকাতে প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং মফস্বলের প্রত্যেকটি অঞ্চলে নিয়ন্ত্রিত মূল্যে বিলি করিতে সমর্থ হইবেন। যদি সরকার তাহাতে সমর্থ হইতেন, তবে সে এলাকাতে বর্তমানে ধান চাউলের এরূপ অগ্নিমূল্য হইত না, তাহা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সরকারী যন্ত্র তাহা করিতে সম্পূর্ণ অসমর্থ হইয়াছেই, উপরন্তু আমরা দায়িত্বশীল মহল হইতে এরূপ সংবাদও পাইতেছি যে, অনেক বাড়তি এলাকায় সরকার এখন পর্যন্ত ক্রয়ও আরম্ভ করেন নাই; আর করিয়া থাকিলেও তাহা ঘাটতি এলাকায় প্রেরণ করিবার কোন ব্যবস্থাই অবলম্বন করিতে সমর্থ হন নাই। এদিকে সরকারী কড়াকড়ির ফলে ব্যবসায়ীগণও বাড়তি এলাকায় ধান চাউল ক্রয় করিয়া ঘাটতি এলাকায় প্রেরণ করিতে পারিতেছেন না। আর পারিলেও তজ্জন্য তাঁহাদিগকে নিশ্চয়ই যথেষ্ট সেলামি কোথাও দিতে হইতেছে। এই অবস্থায় পুরাপুরি সুযোগ লইতেছেন ঘাটতি এলাকার ব্যবসায়ীরা। করিৎকর্মা সরকারী আমলাদের “গুণাগুণ” সম্বন্ধে পূর্ব হইতেই ওয়াকিবহাল থাকাতে ঘাটতি এলাকার ব্যবসায়ীগণ একথা স্বতঃসিদ্ধ বলিয়াই ধরিয়া লইয়াছেন যে এবার তাঁহাদের এলাকায় খাদ্য সমস্যা গত বৎসর অপেক্ষাও সংকটজনক হইয়া উঠিবে। সুতরাং ভবিষ্যতে আশানুরূপ মুনাফা করিয়া লাল হইয়া উঠিবার আশায় ঘাটতি এলাকার এই সকল ব্যবসায়ীরা নিজেদের এলাকার ধান চাউল কৃষকদিগকে বেশী মূল্যের লোভ দেখাইয়া সমানে ক্রয় করিতেছেন। ইহারই ফলে ঘাটতি এলাকাগুলিতে ধান চাউলের দাম প্রতিদিনই এরূপভাবে বাড়িতেছে। 

উপরোক্ত আজাদ সম্পাদকীয় থেকে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় পূর্ব বাঙলার খাদ্য পরিস্থিতি ১৯৪৯ সালের জানুয়ারী মাসে কোন পর্যায়ে ছিলো। সরকারী প্রশাসনযন্ত্রের শৈথিল্য, অকর্মণ্যতা এবং কর্মচারীদের অসাধুতা এই সময় সাধারণভাবে বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের বিরুদ্ধে জনগণকে ভয়ানকভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এই বিক্ষোভের প্রমাণ সংবাদপত্রের পাতা থেকে শুরু করে সভা-সমিতি, বক্তৃতা-বিবৃতি এবং ব্যবস্থা পরিষদের বিতর্কের মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। 

ধানকাটা মজুর বা দাওয়ালদের অবস্থা এদিক থেকে উল্লেখযোগ্য। ঢাকা, ত্রিপুরা, ফরিদপুর, নোয়াখালী প্রভৃতি জেলা থেকে যে সমস্ত ধানকাটা মজুরেরা বরিশাল, খুলনা প্রভৃতি জেলায় ধান কাটার জন্যে ১৯৪৮-এর শেষের দিকে গিয়েছিলো তারা কর্ডন প্রথার জন্যে ধান কাটার পর নিজেদের প্রাপ্য ধান নৌকায় তুলতে পারে নাই। এই সময় সরবরাহ বিভাগ ব্যবস্থা করেছিলো যে দাওয়ালদের ধান সংগ্রহ করে তাঁরা সেই ধানের পরিবর্তে তাঁদেরকে টিকিট দেবে এবং সেই টিকিট দেখিয়ে নিজেদের এলাকায় স্থানীয় সরকারী গুদাম থেকে তারা সমপরিমাণ ধান পাবে। এর জন্যে দাওয়ালদেরকে বরিশাল ও খুলনা জেলাস্থ সরকারী গুদামে ধান জমা দিতে হতো। সেই ধান জমা দেওয়ার পর নিজেদের এলাকায় ধান ফেরত পেতে তাঁদের যে দীর্ঘ সময় লাগতো তার মধ্যে এই দাওয়ালদেরকে বাধ্য হয়ে ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত মণ দরে চাল কিনে খেতে হতো। তাছাড়া বরিশাল ও খুলনায় ভালো জাতের চাল সরকারী গুদামে তুলে দিয়ে তার পরিবর্তে তাদেরকে যে চাল ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিলো তা ছিলো নিতান্তই নিকৃষ্ট জাতের। এই সমস্ত দুর্ভোগের ওপর সরকারী ধান ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে সরকারী কর্মচারীদের হাতে তাদের লাঞ্ছনা তাদের দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে তুলতো।[৭২] 

এই কৃষিশ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে তখন অনেক রিপোর্ট আসতে শুরু করায় ১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৯ তারিখে দৈনিক আজাদ ‘ধানকাটা মজদুর’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে বলে: 

বরিশাল, শ্রীহট্ট, খুলনা এবং অন্যান্য বাড়তি জেলাগুলিতে ঢাকা, ত্রিপুরা, নোয়াখালী প্রভৃতি ঘাটতি জেলা হতে যে সকল ধানকাটা মজুর ধান কাটিতে এবার অঘ্রাণ মাসের প্রারম্ভে গিয়াছিলো, তাহারা সরল বিশ্বাসে উপরোক্ত সরকারী কুপন লইয়া প্রত্যাবর্তন করিয়াছে। এই সকল কুপন লইয়া তাহারা যখন তাহাদের এলাকার সরকারী গুদামে কর্তাদের কাছে ধান আনিতে গেল, তখন ধান আর তাহারা পাইলো না পাইলো প্রতিশ্রুতি, অর্থাৎ কথা। ঘাটতি জেলার সরকারী গুদামগুলিতে এখনও নাকি এক ছটাক ধানও আসিয়া পৌঁছে নাই, সরকারী সংগ্রহ বিভাগের এমনই মহিমা! কাজেই এই মজুরেরা আর ধান কোথায় পাইবে! তাহাদিগকে বলা হইয়াছে, যখন ধান গুদামে আসিবে, তখন কুপনে উল্লিখিত ধান শোধ দেওয়া হইবে। সরকার ও সরকারী কর্মচারীদের বুঝা দরকার যে ধানকাটা মজুরেরা জোতদার নহে যে তাহারা প্রতিশ্রুতির অপেক্ষা করিতে পারে, মাসে মাসে বেতন পায় না যে, তদ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিতে পারে। 

ধানকাটা মজুরদের অবস্থা এইভাবে বর্ণনা করার পর দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদকীয়টিতে সরকারকে যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তা খুবই উল্লেখযোগ্য। সরকারী কর্ডন নীতি এই দাওয়াল কৃষকদের মনে সরকার বিরোধী যে মনোভাব প্রচণ্ডভাবে জাগ্রত করেছিলো তারই পরিপ্রেক্ষিতে এতে বলা হয় : 

ঘাটতি এলাকায় এই মাঘ মাসেও চালের দর চল্লিশ টাকা। কাজেই এই দরিদ্র কৃষি মজুরেরা নিজেদের ন্যায্য পাওনা সময়মতো না পাইয়া সংঘবদ্ধ হইয়া কোনরূপ অবাঞ্ছিত কিছু করিবার পূর্বে সরকার ইহাদের প্রাপ্য ধান মিটাইয়া দিবার ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে করিবেন আমরা এই আশাই করি। 

কৃষকদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ সম্পর্কে মুসলিম লীগ সমর্থক এই পত্রিকাটির আতঙ্ক থেকে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনেকখানি অনুমান করা যায়। 

ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জে খাদ্য পরিস্থিতি জানুয়ারীর শেষ দিকে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। লৌহজঙ্গ থানার অবস্থাই দাঁড়ায় সব থেকে খারাপ। সেখানে খাদ্যাভাবে কয়েকজনের মৃত্যু ঘটার সংবাদও প্রকাশিত হয়।[৭৩] ত্রিপুরা জেলাতে এই সময় চালের মূল্য ৩০-৪০ টাকায় দাঁড়ায়। সেখানকার অবস্থার অবনতি ঘটার ফলে চাঁদপুরে শর্ষিণার পীর সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে চাঁদপুরের চারজন পরিষদ সদস্যকে এরূপ নির্দেশ দেওয়া হয় যাতে করে তাঁরা যেন তৎকালীন মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভাকে সমর্থন দান থেকে বিরত থাকেন। এই সংবাদ উদ্ধৃত করে ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ শীর্ষক একটি আধা সম্পাদকীয় কলামে দৈনিক আজাদ সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেন, “সময় থাকিতে মন্ত্রীসভা এখনো সতর্ক হোন”।[৭৪] 

ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে খাদ্যাভাবের নানান রিপোর্ট প্রকাশিত হতে থাকে। এই সময় নেত্রকোনার খাদ্যসংকট সম্পর্কে মহকুমা লীগ সম্পাদক একটি বিবৃতিও সংবাদপত্রে প্রদান করেন।[৭৫] 

১৯৪৯-এর মার্চ মাসে কিশোরগঞ্জে মধ্যবিত্ত ও নিম্নশ্রেণীর দুরবস্থা চরমে ওঠে। আগের বছর যেখানে ২০-২২ টাকায় চাল পাওয়া যেতো, সেখানে এই সময় চালের দর দাঁড়ায় ৪০-৪৫ টাকা। সরবরাহের অবস্থা এমন সংকটজনক হয়ে দাঁড়ায় যে তিন মাস আগে থেকে সেখানে রেশন দোকানগুলি থেকে চাল দেওয়া বন্ধ হয়।[৭৬]

মার্চ মাসের দিকে ফরিদপুর জেলার দুর্ভিক্ষের অবস্থা সম্পর্কে একটি রিপোর্ট থেকে কিছুটা বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়: 

ফরিদপুর জেলার দুঃখ-দুর্দশা আজ চরমে পৌঁছেছে। গোপালগঞ্জ মহকুমার প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ লোক ‘দাওয়াল’ ভূমিহীন কিষাণ। এরা বছরের ছমাসের খোরাক বরিশাল ও খুলনা থেকে জোগাড় করে থাকে। কিন্তু এই বছর তাদেরকে খুলনা ও বরিশাল থেকে তাদের এই মজুরীর ধান আনতে দেওয়া হয়নি। সীমান্তের সরকারী কর্মচারীরা চোরাকারবার ধরার অজুহাতে এদের কাছ থেকে জুলুম করে সেই ধান কেড়ে নিয়েছে। এর ফলে গোপালগঞ্জ মহকুমায় অবিলম্বে সরকারী সাহায্যের ব্যবস্থা না করলে এই এলাকায় দুর্ভিক্ষ অনিবার্য। মাদারীপুরের অবস্থা আরও শোচনীয়। গোপালগঞ্জের মতো এই মহকুমার প্রায় অর্ধেক লোক ‘দাওয়াল’। বরিশাল থেকে ধান আনতে না দেওয়ায় এখানকার এই দাওয়ালদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। বরিশাল ও খুলনা জেলার সীমানা পাড়ি দেওয়ার সময় সরকারী কর্মচারীরা ফরিদপুরের দাওয়ালীদের কাছ থেকে আনুমানিক তিন লাখ মণ ধান আটক করেছে। রাজবাড়ী সদরেও ব্যাপকভাবে খাদ্যাভাব দেখা দিয়াছে। ধান চাউলের দর গরীব জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। শোনা যাচ্ছে, সরকার নাকি ফরিদপুর জেলার এই খাদ্যাভাব দূর করার জন্য ছাব্বিশ হাজার মণ ধান বিতরণ করতে সিদ্ধান্ত করেছেন। ফরিদপুর জেলার পনেরো বিশ লাখ আকালগ্রস্ত জীবনের প্রতি এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কি হতে পারে! 

পাকিস্তান হওয়ার পর গরীব কিষাণ প্রজাদের দুর্দশা ষোলোকলায় পূর্ণ করার জন্য গোয়ালন্দ থেকে তারপাশা পর্যন্ত পদ্মায় যে নতুন চর উঠেছে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক জমিদার মোহন মিয়া (এমএলএ)-কে সরকার তার সবটুকুরই মালিক করে দিয়েছে। চরগুলো নদীগর্ভে যতদিন ছিলো ততদিন সরকারের খাজনা জুগিয়েছে – মোহন মিয়া নয় গরীব প্রজারা। তাদের আশা ছিলো চর উঠলে তারাই হবে জমির মালিক। তাছাড়া সরকারের জমিদারী উচ্ছেদ বিলের কথা তাদের এই আশাকে আরও দৃঢ় করেছিলো। জমিদারী উচ্ছেদের নামে একজন জমিদার এমএল-এর নতুন করে জমিদারী বৃদ্ধিতে জনসাধারণের সরকারের ন্যায় বিচারের প্রতি আস্থা নষ্ট হচ্ছে। পদ্মার এই চর মোহন মিয়ার হাতে যাওয়ায় আজ প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত।[৭৭] 

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যায় যে, চালের দর সে সময় অনেকখানি কমতির দিকে ছিলো।[৭৮] কিন্তু এর পর মে মাসের প্রথম সপ্তাহের দিক থেকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং চালের পুনরায় মূল্য বৃদ্ধির খবর গুণবতী, সৈয়দপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, নোয়াখালী, ঢাকা, ত্রিপুরা ইত্যাদি থেকে আসতে শুরু করে।[৭৯] 

এই অবস্থায় ৮ই মে, ১৯৪৯ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রদেশের খাদ্যাবস্থা নামক একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয়: 

বৈশাখ মাসের ১লা তারিখ হইতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সর্বত্র প্রবল বৃষ্টিপাত আরম্ভ হইয়াছে। আজ পঁচিশে বৈশাখ। এ পর্যন্ত দুই একদিন ছাড়া ইহার বিরাম নাই। এই বৃষ্টিপাতের ফলে মাঠ-ঘাট, খাল-বিল পানিতে ভরিয়া গিয়াছে। অন্ততঃ ছয় আনা বোরো ধান নষ্ট হইয়াছে। আসন্ন আউশ ফসল প্রায় সমূলে ধ্বংস হইয়াছে। নীচু ভূমির আগামী আমন ফসলেরও একই অবস্থা। এদিকে পাট ফসলের অবস্থাও অতি শোচনীয়। অনেক জায়গায় এখন পর্যন্ত বীজ বপন সম্ভব হয় নাই। যে সব জায়গায় বীজ বপন করা হইয়াছে সে সকল এলাকায় পাট ক্ষেতও অবিরাম বৃষ্টিপাতের দরুণ নিড়ানো সম্ভব হয় নাই; কাজেই চারা একরকম নষ্ট হইয়া গিয়াছে বলা চলে। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করিলে চলতি বাঙলা বৎসরের মধ্যভাগ হইতেই যে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ নানাদিক হইতে দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হইবে, তাহা একরকম অনিবার্য। বিশেষভাবে, খাদ্যশস্যের অভাব এবং পাট ফসল আংশিকভাবে ধ্বংস হওয়ায় দরুণ নগদ টাকার অপ্রাচুর্যের সম্মুখীন এই প্রদেশের জনসাধারণকে হইতে হইবে। 

অতিবৃষ্টির কারণে এই ক্ষয়ক্ষতির ফলে ত্রিপুরায় খাদ্যাবস্থার অবনতি সম্পর্কে এই সময় ত্রিপুরা জেলা মুসলিম লীগ সম্পাদক একটি দীর্ঘ বিবৃতি দান করেন।[৮০] ১৬ই মে তারিখে ঢাকাতে কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী পীরজাদা আবদুস সাত্তার খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রাদেশিক সরকারের সাথে আলোচনা করেন। এই আলোচনার শেষে যে সরকারী প্রেস নোটটি প্রকাশিত হয় তাতে বলা হয় যে, সম্প্রতি অতিবৃষ্টির ফলে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে শস্যের ক্ষতি হওয়ায় প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের কাছে অতিরিক্ত ১ লক্ষ ৪০ হাজার টন চাল দাবী করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই দাবী পূরণের যথাসাধ্য চেষ্টার এবং এই দাবীকৃত পরিমাণের মধ্যে ৭০ হাজার টন খাদ্যশস্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।[৮১] এর পর কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী পীরজাদা ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি সাংবাদিক সম্মেলনে খাদ্য সংগ্রহ নীতি সম্পর্কে বলেন: 

বাধ্যতামূলক খাদ্য সংগ্রহ নীতি সুষ্ঠুভাবে কার্যকরী করাই পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায়। কিন্তু উক্ত নীতি সুষ্ঠুভাবে কার্যকরী করিতে হইলে উদ্বৃত্ত শস্যের সঠিক পরিমাণ নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেবলমাত্র উদ্বৃত্ত শস্যের উপর লেভী নির্ধারণ করার উপরই উক্তনীতির সাফল্য নির্ভর করে।[৮২] 

এই দিনই একটি বেতার বক্তৃতায় পীরজাদা পূর্ব বাংলার জনগণকে আশ্বাস দেওয়ার উদ্দেশ্যে 

বলেন: 

আমি পূর্ববঙ্গবাসীকে আশ্বাস দিতেছি যে সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টির ফলে উদ্ভূত যে কোন জরুরী অবস্থার মোকাবেলা করিতে পাকিস্তান সরকার সর্বদাই প্রস্তুত রহিয়াছেন। সরকার খাদ্য বরাদ্দ করিতে কার্পণ্য করিবেন না।[৮৩] 

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পূর্ব বাঙলা সফর এবং খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে করাচীর ডন পত্রিকা একটি সম্পাদকীয়[৮৪] নিবন্ধে বলেন যে, খাদ্য সরবরাহের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাঙলাকে প্রভূত সাহায্য করা সত্ত্বেও সেখানে খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য এখনও গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। খাদ্যমন্ত্রীর পূর্ব বাঙলা সফরের ফলে অবস্থার কোন উন্নতি হবে বলে আশান্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই বলেও তাতে মন্তব্য করা হয়। এরপর পূর্ব বাঙলার খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে পত্রিকাটিতে আরও বলা হয়: 

বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে যেরূপ উচ্চমূল্যে চাউল বিক্রয় হইতেছে, তাহাতে মাঝামাঝি উপার্জনকারী সর্বশ্রেণীর লোকের মধ্যে পুষ্টির অভাব দেখা দিতে বাধ্য। পূর্ব পাকিস্তানে ঘি প্রায় পাওয়াই যায় না; ইহা এখন ধনী লোকদের অন্যতম মহার্ঘ বিলাসদ্রব্যে পরিণত হইয়াছে এবং খুব কম লোকেরই উহা কিনিবার সামর্থ্য আছে। সরিষার তৈল যাহা কিছু পাওয়া যায় তাহা সমস্তই ভেজাল মিশ্রিত। উহারও মূল্য সের প্রতি ২.৫০ টাকা হইতে ৩ টাকা পর্যন্ত। খাসীর গোস্তও অনুরূপ উচ্চমূল্যে বিক্রয় হয়। মাছ যদি ভারতে চালান দেওয়ার অনুমতি দেওয়া না হইতো, তবে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ আরও অনেক বেশী মাছ খাইতে পারিত। কিন্তু মাছ অবাধে ভারতে চালান দিতে দেওয়া হয়। ডিম ভারত ও বর্মায় রপ্তানী করা হয়।… 

পূর্ব পাকিস্তান সরকার নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, প্রদেশে কিরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতি আজ বিরাজ করিতেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই সংকটের অবসানের জন্য কোন ব্যাপক প্রচেষ্টার কথা শুনা যায় নাই। তবে পূর্ব পাকিস্তান সরকার সর্বপ্রকার খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করিতেছেন। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চাঁদপুর থেকে স্থানীয় লোকদের আসাম অঞ্চলে চলে যাওয়ার ওপর একটি রিপোর্ট[৮৫] প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টটিতে বলা হয় যে, প্রত্যহ চাঁদপুর এলাকার শত শত পাকিস্তানী মুসলমান ট্রেন ও স্টীমার যোগে কাজ ও খাবারের সন্ধানে ভারতের আসাম অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। এরা সকলেই কৃষক ও মজুর। অতিবৃষ্টির দরুণ এদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে এবং তারা কোন কাজ পাচ্ছে না। গত এক বৎসরের ওপর তিরিশ চল্লিশ টাকা মণ দরে চাল কিনে খাওয়ার ফলে এরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। আগামী এক বৎসরের মধ্যে ফসল লাভের কোন সম্ভাবনা নেই দেখে এই কৃষক মজুররা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। 

শুধু চাঁদপুরেই নয় পূর্ব বাঙলার অন্যান্য এলাকা থেকেও এই সময় দলে দলে কৃষকদের আসামের দিকে যাওয়ার খবর বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়। কি ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই বৎসরেরও কম সময়ে মধ্যে পূর্ব বাঙলার মুসলমান অধিবাসীরা ভারতের পথে খাদ্যের সন্ধানে দেশত্যাগ করতে পারেন সেটা সহজেই অনুমেয়। ১৯৪৯-এর জুন মাসের দিকে অনুষ্ঠিত ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে গৃহীত একটি প্রস্তাবে এ বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। বস্তুতঃপক্ষে এই সময় অনেক এলাকা থেকে দেশত্যাগের সংবাদ সরকারী মহল এবং তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট পত্রপত্রিকাতে পর্যন্ত যথেষ্ট উদ্বেগের সৃষ্টি করে। ‘আসামে হিজরত’ নামে দৈনিক আজাদের নিম্নোদ্ধৃত সম্পাদকীয়টিতে এই উদ্বেগের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়: 

ঢাকা জেলা মোছলেম লীগ কাউন্সিলের সাম্প্রতিক অধিবেশনে অন্যান্য বিষয়ের সহিত ঢাকা জেলার চরম খাদ্য সংকটের কথাও আলোচিত হইয়াছে। চরম আর্থিক দুরবস্থার সম্মুখীন হইয়া বহু মুসলমান আসামে চলিয়া যাইতেছে বলিয়া উপরোক্ত কাউন্সিলের এক প্রস্তাবে উল্লিখিত হইয়াছে। কাউন্সিল এরূপ হিজরত যাহাতে না হইতে পারে, তাহার কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করিবার জন্য পূর্ব পাক সরকারকে অনুরোধ করিয়াছেন। 

খাদ্যের ব্যাপারে ঢাকা জেলা বহুকালের ঘাটতি এলাকা, কারণ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এরূপ ঘনবসতিপূর্ণ জেলা আর নাই।… পূর্বে ব্রহ্মদেশ ও বরিশালের চাউল এই জেলার প্রয়োজন মিটাইতো। বর্তমানে ব্রহ্মদেশের সহিত অবাধ বাণিজ্য ব্যাহত এবং কর্ডনিং প্রথার জন্য বরিশাল হইতেও ধান-চাউল আসিতে পারে না। কাজেই জেলার কৃষি মজুর এবং অন্যান্য দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা যদি বাধ্য হইয়া আহারান্বেষণে প্রদেশ ছাড়িয়া অন্যত্র হিজরত করিতে আরম্ভ করিয়া থাকে তবে তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। 

অবশ্য খাদ্য সংকটের সম্মুখীন একমাত্র ঢাকা জেলার লোকেরাই হয় নাই। প্রত্যেকটি ঘাটতি জেলাই এই সমস্যার সম্মুখীন। কাজেই ঢাকা জেলার দরিদ্র শ্রেণীর লোকরা অনুরূপ অবস্থায় পতিত হইয়া থাকিলে সম্ভবতঃ অন্যান্য জেলার কিছু কিছু লোকও জন্মভূমি ছাড়িয়া অন্যত্র হিজরত করিতে আরম্ভ করিয়া থাকিবে। এমতাবস্থায় ঢাকা জেলা মোসলেম লীগ কাউন্সিল এই প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া সময়োচিত কাজই করিয়াছেন। বস্তুতঃ আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হইয়া পাকিস্তানীরা হিজরত করিয়া চলিয়া যাইবে, এই অবস্থা কোন আত্মসম্মানজ্ঞানী পাকিস্তানী বরদাশত করিতে পারে না। আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না, এ ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান সরকার এখন পর্যন্ত নীরব কেন? ঢাকা জেলা লীগ-কাউন্সিলের অধিবেশন হইয়া গিয়াছে আজ কয়েকদিন হইলো। জেলা লীগের তরফ হইতে যে অভিযোগ করা হইয়াছে, তাহা কতখানি সত্য এবং সত্য হইয়া থাকিলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের এরূপ দলে দলে হিন্দুস্থানে হিজরত বন্ধ করিবার কি ব্যবস্থা স্থানীয় সরকার অবলম্বন করিতেছেন বা করিয়াছেন, তাহা জানিবার ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রত্যেক পাকিস্তানবাসীরই আছে বলিয়া আমরা মনে করি।[৮৫] 

জেলা লীগ এরূপ অবাঞ্ছিত হিজরত বন্ধ করিবার উপায় হিসাবে সমগ্র জেলায় রেশনিং প্রথা প্রবর্তন করিবার ছোপারেশ করিয়াছেন।… আসামে হিজরতের প্রতিকারার্থে সরকার জেলা লীগ কাউন্সিলের উপরোক্ত প্রস্তাব বিবেচনা করিয়া দেখিতেছেন কিনা, আমরা জানি না। মোটের উপর বল প্রয়োগ ছাড়া অন্য সর্বপ্রকার কল্যাণকর উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানের দরিদ্র মুসলমানদের আসামে হিজরত বন্ধ করিবার ব্যবস্থা করা, আমরা স্থানীয় সরকারের আশু ও অপরিহার্য কর্তব্য বলিয়া মনে করি।[৮৬] 

পূর্ব বাঙলার খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার, পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন মহল ও পত্র-পত্রিকার বিশেষ কোন উদ্বেগ ছিলো না। এদিক দিয়ে করাচী থেকে প্রকাশিত ইংরেজী সাপ্তাহিক ফ্রিডমকে অন্যতম ব্যতিক্রম বলা চলে। এই পত্রিকাটিতে ১০ই জুলাই, ১৯৪৯ এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে[৮৭] পূর্ব বাঙলার খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে যা বলা হয় সেটা উল্লেখযোগ্য: 

জনসাধারণকে সাহায্য দান হিসাবে পূর্ব পাকিস্তান সরকার যাহা করিয়াছেন সেখানকার কোটি কোটি বুভুক্ষু বাসিন্দার কাছে তাহার মূল্যই নাই – ৪৩-এর সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পর অতি সামান্য পরিবর্তনই তাহাদের জীবনে দেখা দিয়াছে – ইহার সঙ্গে আসিয়া যোগ দিয়াছে রোগ, মহামারী আর বেকার সমস্যা। 

ইহা একটি দুর্বোধ্য রহস্য যে পাকিস্তানের এক অংশে যখন প্রচুর খাদ্য রহিয়াছে এবং শুধু তাই নয়, সেই খাদ্য হইতে কিছু পরিমাণে বিদেশে রপ্তানী করাও সম্ভব হইতেছে পাকিস্তানের অন্য অংশে তখন দারুণ খাদ্যাভাব দেখা দিয়া দুর্ভিক্ষ ঘনাইয়া আসিতেছে। বলা হইয়া থাকে যে, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে আমাদের যে ৭৫ কোটি টাকা লাভ হইয়াছে তার অধিকাংশই আসিয়াছে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে ভারতে প্রেরিত খাদ্য শস্য হইতে। আমরা কি আমাদের ভাই, বোন ও সন্তানদের মৃতদেহের উপর পাকিস্তানের সমৃদ্ধি গড়িয়া তুলিতে চলিয়াছি? আমাদের সব চাইতে মূল্যবান রপ্তানীদ্রব্য পাটের জন্য যারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনী খাটিয়া দেহপাত করে তারা কি পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা নয়? 

বস্তুতঃপক্ষে পূর্ব বাঙলার ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রশ্নটিকে খাদ্য সমস্যা প্রসঙ্গে এখানে যেভাবে উপস্থিত করা হয়েছে পূর্ব বাঙলার পত্র-পত্রিকাসমূহে, এমনকি বিরোধীদলীয় পত্রিকাসমূহেও সেইভাবে উপস্থিত করা হয় নাই। তাঁদের সমালোচনার কেন্দ্রস্থল সে সময় ছিলো প্রাদেশিক সরকার, তার বেসামরিক সরবরাহ বিভাগ এবং সাধারণভাবে প্রাদেশিক আমলাতন্ত্র। 

১৯৪৯-এর জুলাই মাসে যশোর ও খুলনায় চালের দর দাঁড়ায় ৪০-৪২ টাকায়। সেই তুলনায় বরিশাল, চাঁদপুর, নোয়াখালী ইত্যাদি জায়গাতে চালের দাম ছিলো অপেক্ষাকৃত কম মণ প্রতি ২৫ টাকা। কিন্তু এই অল্পমূল্য সত্ত্বেও ক্রয়ক্ষমতার নিদারুণ অভাবের জন্যে সেই সমস্ত এলাকাতেও খাদ্য সংকট এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে। চাঁদপুর সম্পর্কে নীচে উদ্ধৃত রিপোর্টটি উল্লেখযোগ্য: 

চাঁদপুর স্টেশনেই এক করুণ দৃশ্য দেখলাম শত শত গ্রাম্য লোক স্ত্রী পুরুষ ছেলে মেয়ে স্টেশনে গোডাউনের ছিদ্র দিয়ে ছিটকে পড়া ধান-চাউল কাকর পাথরের ভেতর থেকে বিরাট পাহাড় কেটে স্বর্ণ রেণু আহরণ করার মত খুঁটে নিচ্ছে। প্রতিটি দেহের চামড়া ফুঁড়ে উঠেছে – শক্ত, বিক্ষুব্ধ হাড়গুলি, প্রতিটি চেহারায় ভেসে উঠেছে – দুর্ভিক্ষ-মৃত্যুর চরম পরোয়ানা। ২৫ টাকায় তো দাম কমে এসেছে, কিন্তু কিনবার টাকা কোথায়? সামর্থ্য কোথায়?[৮৮] 

এর প্রায় দুই সপ্তাহ পর চাঁদপুর স্টেশনের কাছে স্থানীয় এক ব্যক্তি প্রাণ ত্যাগ করে। এই অনাহার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চাঁদপুর শহরে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।[৮৯] আগস্ট মাসের দিকে শত শত নরনারী ও শিশু গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের সংস্থান অভাবে দলে দলে চাঁদপুর শহরে এসে ভীড় করতে থাকে।[৯০] 

সেপ্টেম্বর মাসে নোয়াখালী জেলার রামগতি দ্বীপের অবস্থার ওপর একটি রিপোর্টে সেখানকার পরিস্থিতির কিছুটা বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। রিপোর্টটির কিছু অংশ নীচে উদ্ধৃত করা হলো: 

রামগতি দ্বীপ (উত্তর হাতিয়া) নোয়াখালী জেলার একটি শস্য-সমৃদ্ধ অঞ্চল। সম্ভবতঃ ইহাই এই জেলার প্রধান বাড়তি এলাকা। তাহা ছাড়া এই দ্বীপ প্রধানতঃ গৃহস্থ ও কৃষি বহুল। ধান, পাট, মরিচ, কুমড়া, তিল, মেটে আলু প্রভৃতি কৃষি শস্যের উপর এই দ্বীপের বাসিন্দাদের সম্পূর্ণভাবে জীবনধারণ করতে হয়। কিন্তু এই বৎসর বৈশাখ মাস হইতে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত অতিবৃষ্টির ফলে উপরোক্ত যাবতীয় শস্য বিনষ্ট হইয়া যায়। ধান ক্ষেতে কৃষকগণ আর কাঁচি বসাইতে পারে নাই। মরিচ পচিয়া ক্ষেতের পানি লাল হইয়া যায়। নিড়ানির অভাবে পাট বিনষ্ট হইয়া যায়। দিন মজুর ও কৃষকদিগকে গৃহস্থদের ক্ষেতের কাজের ওপর জীবিকা নির্বাহ করিতে হয়। কিন্তু এই বৎসর পানিতে ক্ষেত ডুবিয়া যাওয়ায় অজন্মা ও শস্যহানির দরুণ গৃহস্থদের নিকট হইতে তাহারা কোন কাজ পায় নাই। ফলে বর্তমানে তাহাদের জীবন ধারণের খড়কুটো অবলম্বন পর্যন্ত নাই। ওই দিকে খাদ্য শস্যের দাম উত্তরোত্তর হু হু করিয়া বাড়িয়া চলিয়াছে। ধানের দাম বর্তমানে ২৫ টাকা হইতে উপরের দিকে উঠিতেছে। প্রতি মণ চাউল ৪০ টাকায় বিক্রয় হইতেছে। এমতাবস্থায় জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা লোপ পাইয়াছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে দ্বীপের বিরাট এলাকা চর ফলকন ইউনিয়ন। এই অঞ্চলে পানি খুব বেশী জমিয়া যাওয়ায় শস্য রক্ষা করা মোটেই সম্ভব হয় নাই। চর জাংগালিয়ার পৌণে ষোল আনা লোকের আশু ধান্য ক্ষেতেই পচিয়া গিয়াছে। ফলে এই ইউনিয়নের ৫০ হাজার লোক বর্তমানে জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। চারিদিকে উপোসের পালা শুরু হইয়াছে। গরীব দিন মজুররা কচু সিদ্ধ, শাক সিদ্ধ খাইয়া কোন রকমে এখনও বাঁচিয়া আছে। গ্রামে গ্রামে গরু চুরি ও অন্যান্য চুরি ডাকাতির উপদ্রব বাড়িয়া গিয়াছে। ভিখারীর সংখ্যাও দিন দিন বিপুলভাবে বাড়িয়া চলিয়াছে। কিন্তু অবস্থা আজ এই রকম যে এক মুঠো ভিক্ষা দেওয়ার সংস্থানও জনসাধারণের নাই।

এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের একমাত্র কারণ এই এলাকায় জলনিকাশের কোন বন্দোবস্তু নাই। ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হইলেই জল দাঁড়াইয়া যায় এবং বিপুল শস্য হানি ঘটায়। মাত্র একটি খালের অভাবে বহু বৎসর ধরিয়া জনসাধারণ এইরূপে সর্বনাশা দুর্গতি ভোগ করিতেছে। এই বৃহৎ অঞ্চলের হাজার হাজার বাসিন্দাকে এই মৌসুমী দুর্গতির কবল হইতে রক্ষা করিতে হইলে চর জাংগালিয়ায় অবিলম্বে সরকারী সাহায্যে একটি খাল খনন করিয়া হাজিরহাট হইতে মেঘনায় পতিত সংকীর্ণ খালটির সংস্কার সাধন করতঃ উভয় খালের সংযোগ স্থাপন বিশেষ জরুরী প্রয়োজন। আর অবিলম্বে বিপর্যস্ত এলাকাকে দুর্ভিক্ষ এলাকা বলিয়া ঘোষণা করিয়া সর্বাত্মক রিলিফের বন্দোবস্ত করিবার জন্য আমরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। অন্যথায়, এই দ্বীপের বারো আনা লোককে আসন্ন মৃত্যুর কবল হইতে রক্ষা করা মোটেই সম্ভব হইবে না।৯১ 

উত্তর বাঙলায় চালের দর সম্পর্কে একটি রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯ চালের দর রংপুরে ৪০-৪২ টাকা, দিনাজপুরে ৩০-৩৫ টাকা, গাইবান্ধায় ৪৫-৫০ টাকা, এবং বগুড়ায় ৪০-৪২ টাকা। এ ছাড়া ময়মনসিংহের জামালপুর মহকুমায় চালের দর এই সময় দাঁড়ায় ৫৩-৫৪ টাকায়।[৯২] 

অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকে সিলেটের খাদ্য পরিস্থিতির নিদারুণ অবনতি ঘটে। সিলেট শহরের বস্তি অঞ্চলে, সদর ও সুনামগঞ্জের পাহাড়তলী এলাকায় গোলাপগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথ থানায় অন্নাভাব ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করে। কিন্তু অবস্থার সব থেকে বেশি অবনতি ঘটে গোয়াইনঘাট থানা এলাকায়। এই এলাকার অবস্থার ওপর উত্তর সিলেট জেলা মুসলিম লীগের দুইজন কর্মকর্তা সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন। সেই বিবৃতিতে তাঁরা বলেন: 

গৃহস্থেরা জমি ও হালের গরু বিক্রী করিয়া অর্ধাহারে কোনরূপ এতদিন চালাইয়াছিলেন, বর্তমানে তাহাও নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে। তদুপরি ক্রয় করিবার মত ধান্যও পাওয়া যাইতেছে না। গুয়াইনঘাটের গোদামে সরকারী ধান্য যাহা ছিলো তাহার পরিমাণ এতই অল্প ছিলো যে উহা বহু পূর্বেই নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে। বর্তমানে ধান্যের আশায় গোয়াইনঘাট গিয়া বহু ক্রেতাকেই একান্ত নিরাশ হইয়া ফিরিয়া যাইতে হইতেছে। ছেলেমেয়েদের ক্রন্দন দেখিয়া ক্ষুধার্ত পিতা-মাতা বর্তমানে নিজেদের মৃত্যু কামনা করিতেছেন। কয়েকটি ঘটনা আমরা স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করিয়াছি।… অর্ধাহার, অনাহার ও মৃত্যু এবং সঙ্গে সঙ্গে মহামারী যদি দুর্ভিক্ষের Definition হয় তবে ইহাকে দুর্ভিক্ষ ছাড়া আর কি বলা যাইতে পারে।[৯৩] 

এইসব অঞ্চলে তৎক্ষণাৎ রিলিফের ব্যবস্থা করার জন্যে তাঁরা তাঁদের এই বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের প্রতি আবেদন জানান। 

বরিশাল বরাবরকার একটি উদ্বৃত্ত এলাকা যে কয়টি উদ্বৃত্ত জেলায় সরকার কর্ডন প্রথা প্রবর্তন করেন তার মধ্যে বরিশালই ছিলো সর্বপ্রধান। কিন্তু অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকে সেই বরিশাল জেলাতেও খাদ্য পরিস্থিতি ভয়ানক আকার ধারণ করে। বরিশাল জেলা মুসলিম লীগের তৎকালীন সম্পাদক মহীউদ্দীন আহমদ এ সম্পর্কে বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একটি দীর্ঘ পত্র দেন। এই পত্রে তিনি বরিশালের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন: 

আমি সম্প্রতি রাজাপুর ও নলছটি থানার কিয়দঞ্চল সফর করিয়া সুপারীর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে কমিয়া যাওয়ায় সুপারী উৎপাদনকারী চটিওয়ালা ও ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের দুর্দশা দেখিয়া অত্যন্ত বিচলিত হইয়াছি। গ্রামে বর্তমানে অধিকাংশ কৃষকই অনাহার ও অর্ধাহারে কালাতিপাত করিতেছে। গত কিছুদিন পূর্বে বন্যায় জেলার কতিপয় স্থানের রবিশস্য নষ্ট হওয়াতে আমি মন্ত্রী সাহেবানদের নিকট রিলিফের আবেদন জানাইলে প্রকাশ আপনি এ জেলায় রিলিফের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করিয়াছেন। বহু কষ্টে যদিও অল্প কিছু টাকা এ জিলায় বরাদ্দ করা হইয়াছে এবং যদিও প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশে রিলিফ কমিটি গঠিত হইয়া আছে তথাপি জানিনা কেন আপনি উক্ত কমিটির সভাপতি হিসাবে রিলিফের কোন ব্যবস্থা করিতেছেন না বা কমিটির মিটিংয়ের সুযোগ দিতেছেন না। অথচ এই মুহূর্তেই রিলিফের ব্যবস্থা না করিলে গ্রাম্য জনসাধারণের সমূহ বিপদ। আশ্চর্য হই ঠিক সেই সময় আপনি – মহিলা কলেজ স্থাপনের জন্য প্রতি ইউনিয়ন হইতে চাঁদা তুলিবার নির্দেশ দিয়াছেন।[৯৪] 

অক্টোবরের শেষের দিকে ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার কয়েকটি গ্রাম এলাকা সফর করে সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার তাঁর বিবরণে বলেন: 

শতকরা প্রায় ৭৫ জন লোক এই অঞ্চলে অনাহারে অর্ধাহারে অখাদ্য-কুখাদ্য খাইয়া মরণের প্রতীক্ষা করিতেছে। অনেকে কচুপাতা খাইয়া কোনমতে এতদিন টিকিয়া ছিলো – এখন তাহা আর পাওয়া যাইতেছে না। কিছুদিন ধরিয়া গভর্নমেন্ট কন্ট্রোলে আটা সরবরাহ করিতেছেন তাহা প্রায় অবিক্রীত রহিয়া যাইতেছে। কারণ সস্তায়ও ক্রয় করার টাকা এদের কারো হাতে নাই।… ঢাকার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট বড়ো দুঃখের সহিত বলিলেন: এবারের আকাল ৪৩ সনের দুর্ভিক্ষের চাইতেও বহুগুণ মারাত্মক। গত বন্যায় অনেক ধান পাট নষ্ট হইয়া গিয়াছে এজন্য ভবিষ্যতের অবস্থা আরো খারাপ হইবে। পাট ১০/১২ টাকায় নামিয়াছে, তাহাও কেনার লোক নাই।… চারিদিকে তাই ঘরবাড়ী ও জমি বিক্রীর হিড়িক পড়িয়া গিয়াছে, অনেকে বাস্তুভিটা জলের দরে বিক্রী করিয়া ফরিদপুর চলিয়া যাইতেছে।[৯৫] 

৭. সরকারের নোতুন কর্ডন নীতি 

কর্ডন প্রথা সম্পর্কে সরকারী অথবা বেসরকারী মহল কোন ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ ঐকমত্য ছিলো না। বিভিন্ন জেলাতেও এই প্রথা সম্পর্কে মতামত ছিলো ভিন্ন ভিন্ন প্রকার। এদিক দিয়ে ঘাটতি অথবা উদ্বৃত্ত এলাকা বলে কোন কথা ছিলো না। এক উদ্বৃত্ত এলাকায় সাধারণভাবে লোকে কর্ডনের বিরোধী (বরিশাল) আবার অন্য উদ্বৃত্ত এলাকায় লোকে সাধারণভাবে তার সপক্ষে (সিলেট)। সরকার বিরোধী মহলের মধ্যে সাধারণভাবে কর্ডন উঠিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত খুব শক্তিশালী থাকলেও সেখানে পরিপূর্ণ ঐকমত্য ছিলো না। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি লেভীর অব্যবস্থা এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও তাঁরা ঢালাওভাবে কর্ডনপ্রথার বিরোধী ছিলো না। কিন্তু কংগ্রেস সংসদীয় দল পুরোপুরি কর্ডনের বিরুদ্ধে ছিলো। ঢাকার ১৫০নং মোগলটুলীর ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীরাও ছিলেন কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য কর্ডন প্রথা তিনটি উদ্বৃত্ত জেলা থেকে উঠিয়ে নেওয়ার পর অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কর্ডন প্রথার বিরোধিতা থেকে বিরত হন।

মুসলিম লীগ মহলে প্রথম দিকে কর্ডন প্রথার সপক্ষে সমর্থন থাকলেও ব্যাপকভাবে জনগণ তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ফলে তাঁরাও শেষে কর্ডন, বিশেষতঃ থানা ও মহকুমা কর্ডন, তুলে নেওয়ার পক্ষপাতী হন। ১৯-২০-২১শে জুন, ১৯৪৯ তারিখে ঢাকাতে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে থানা ও মহকুমা কর্ডনিং তুলে নিয়ে জেলা ও প্রাদেশিক কর্ডনিং দৃঢ়তর করার জন্যে প্রাদেশিক সরকারের কাছে সুপারিশ করেন। সরবরাহ বিভাগ উঠিয়ে নেওয়ার জন্যেও তাঁরা সরকারকে পরামর্শ দেন।[৯৬] 

কিন্তু প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের এই সুপারিশ প্রকৃতপক্ষে প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক অগ্রাহ্য হয়। খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ আফজল ৬ই জুলাই, ১৯৪৯ ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে[৯৭] জেলা কর্ডনিং রহিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণায় তিনি বলেন যে, উদ্বৃত্ত জেলাগুলির মধ্যে যে কর্ডন ব্যবস্থা চালু আছে তার স্থানে ঘাটতি জেলা ঢাকা, ফরিদপুর, ত্রিপুরা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম নিয়ে একটা ব্লক করে তার চারিদিকে কর্ডন ব্যবস্থা নোতুনভাবে প্রবর্তন করা হবে। এর ফলে সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা এবং বরিশাল জেলা নিয়ে গঠিত অপর ব্লকের মধ্যে অবাধে খাদ্য চলাচল করতে পারবে। এই নোতুন কর্ডন ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার পনেরো দিনের মধ্যে দেশের খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হবেন বলেও তিনি দাবী করেন। 

সরবরাহ বিভাগ তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গে মন্ত্রী আফজল বলেন যে, এই বিভাগের ব্যয়ভার দেশের বৃহত্তর জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। তা কেবলমাত্র দশ বারো লক্ষ রেশনিং এলাকাভুক্ত লোকের ব্যয় বৃদ্ধি করে। 

খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ আফজলের এই সাংবাদিক সম্মেলনের পর প্রাদেশিক লীগ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) একটি বিবৃতি দেন।[৯৮] তাতে তিনি বলেন যে, খাদ্যাবস্থার আশু সমাধান না হলে দেশে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। দুঃস্থ জনগণের সাহায্যের জন্যে তিনি সর্বত্র রিলিফ কমিটি গঠন করার জন্যে আবেদন জানান। 

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য মাহমুদ আলী খাদ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন যে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের প্রস্তাবের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সরকার মুসলিম লীগকে পরিহাস করেছেন। পনেরো দিনের মধ্যে খাদ্যাবস্থার উন্নতি ঘটবে মন্ত্রীর এই ভবিষ্যদ্বাণী প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, অবস্থার কোন উন্নতি তো ঘটবেই না উপরন্তু তা মুনাফাখোর ও মজুতদারদের কার্যকলাপ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। 

মুসলিম লীগ কাউন্সিলের প্রস্তাব মুসলিম লীগ সরকারের মন্ত্রীর দ্বারা – এইভাবে সরাসরি উপেক্ষিত হওয়ার ঘটনার প্রতিও তিনি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।[৯৯] 

কিন্তু প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সুপারিশ প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক অগ্রাহ্য হওয়ার ব্যাপারে কোন বক্তব্যই লীগ সম্পাদক মোহন মিয়া অথবা অন্য কোন উচ্চপদস্থ মুসলিম লীগ নেতার পক্ষ থেকে খোলাখুলিভাবে উপস্থিত করা হয়নি। 

৮. দুর্ভিক্ষ রিলিফ কমিটি 

১৯৪৮-৪৯ সালে পূর্ব বাঙলায় যে ব্যাপক খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা গেল সেই অবস্থাকে প্রতিরোধ করার কোন সুসংগঠিত ব্যবস্থা হয়নি। এদিক দিয়ে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের অবস্থার সাথে এই দুর্ভিক্ষের অবস্থার একটা মস্ত তফাত। একথা অবশ্য সত্য যে ১৯৪৮-৪৯-এর দুর্ভিক্ষ ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের মতো ব্যাপক ও ভয়াবহ ছিলো না। কিন্তু তা না হলেও এ দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্যসংকট জনগণের জীবনে ব্যাপকভাবে যে সংকট সৃষ্টি করেছিলো তাকেও ছোট করে দেখা চলে না। 

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়কার সর্বদলীয় রিলিফ কমিটির মতো কোন কমিটি এই সময় দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের কাজের জন্য প্রতিষ্ঠিত ও সক্রিয় হয়নি। প্রথম দিকে সিলেট জেলায় মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও কিষাণ সভার মিলিত উদ্যোগে একটি রিলিফ কমিটি অল্প কিছুদিন সক্রিয় থাকলেও পরে তা নানান কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং রিলিফের কাজ সেখানে আর অগ্রসর হয় না। এদিক থেকে সরকারী উদ্যোগেরও যথেষ্ট অভাব ছিলো। মুসলিম লীগ সরকার প্রাদেশিক লীগের সুপারিশক্রমে ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে একটা রিলিফ কমিটি গঠন করেছিলেন। এ সম্পর্কে সিলেটের নওবেলাল পত্রিকা স্থানীয় রিলিফ কমিটির অবস্থা সম্পর্কে ‘খাদ্যাভাব’ নামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে: 

প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুরোধক্রমে পূর্ব পাক সরকার প্রত্যেক জেলায় ও মহকুমায় মুসলিম লীগের সহযোগে রিলিফ কমিটি গঠন করিয়াছেন। আমরা যতদূর জানিতে পারিয়াছি উত্তর সিলেটেও অনুরূপ একটি রিলিফ কমিটি গঠিত হইয়াছিল। সিলেট জেলায় বিতরণের জন্য সরকার কিছু টাকা বরাদ্দ করিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে। কিন্তু এই রিলিফ কমিটির কোন সভা আহ্বান করা হইয়াছে বলিয়া আমরা অবগত হই নাই। এই কমিটিকে যদি অকেজো করিয়া রাখা হয় তাহা হইলে নাম-কা-ওয়াস্তে এক রিলিফ কমিটি রাখার যুক্তিযুক্ততা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। 

রিলিফ কমিটির এই নিষ্ক্রিয়তা শুধু সিলেট জেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। বরিশাল জেলা মুসলিম লীগ সম্পাদক মহীউদ্দীন আহমদের পূর্বোক্ত পত্র থেকেও রিলিফ কমিটির নিষ্ক্রিয়তার কথা জানা যায়। শুধু রিলিফের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তাই নয়, বস্তুতঃপক্ষে সরকারী আমলা কর্তৃক রিলিফের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার ব্যাপারটাই সেখানে বড়ো হয়ে দেখা দেয়। প্ৰত্যেক জেলাতেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সভাপতিত্বে এই সমস্ত রিলিফ কমিটি গঠিত হয়েছিলো এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এই সমস্ত আমলা সভাপতিদের ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তার ফলেই রিলিফ কমিটিগুলি পুরোপুরিভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। 

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে রিলিফের ক্ষেত্রে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক সভা ইত্যাদি মিলিতভাবে রিলিফ কমিটিতে কাজ করতো। পূর্ব বাঙলার ১৯৪৮-৪৯ সালের দুর্ভিক্ষে কংগ্রেস বহুলাংশে সাম্প্রদায়িক কারণে নিজেদের কাজ পূর্ব বাঙলা পরিষদের চৌহদ্দীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বাইরে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে। কমিউনিস্ট পার্টি এই সময় সশস্ত্র আন্দোলনে নামার ফলে তার এবং কৃষক সভার ওপর সরকারী নির্যাতন ও নানা প্রকার নিষেধাজ্ঞার জন্যে তারা খোলাখুলিভাবে রিলিফ কমিটিতে যোগদান করতে পারেনি। তাঁদের এই অনুপস্থিতিই এই কমিটিগুলির নিষ্ক্রিয়তার মুখ্য কারণ ছিলো। ১৯৪৩ সালের অভিজ্ঞতা থেকেই একথা প্রমাণিত হয়। কারণ সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষক সভাই ছিলো সারা বাঙলাব্যাপী রিলিফ সংক্রান্ত কাজের পুরোভাগে। এইভাবে কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষকসভা এবং কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে রিলিফ কমিটিগুলি মুসলিম লীগের সদস্যদের দ্বারাই মোটামুটিভাবে গঠিত ছিলো। এই সমস্ত মুসলিম লীগওয়ালারা রিলিফের কাজে নিজেরা তেমন উৎসাহী না থাকার ফলে আমলাদের নিজেদের উদ্যোগে সেই সমস্ত কমিটিকে সক্রিয় করার প্রশ্ন ওঠেনি। যে সমস্ত স্থানে স্থানীয়ভাবে মুসলিম লীগাররা রিলিফ কমিটিকে তৎপর করার চেষ্টা করেছিলেন সেখানেও প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রিলিফ কমিটিকে উৎসাহ দেওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট শৈথিল্য আমলাদেরকে সক্রিয় করে তোলার পথে হয়ে দাঁড়ায় মস্ত বাধা স্বরূপ। 

উপরোক্ত কারণগুলি মিলিত হয়ে এই পর্যায়ে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলনে জনগণকে সংগঠিত করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এবং জনগণকে সংগঠিত করতে না পারার ফলে রাজনীতিগতভাবে দুর্ভিক্ষ প্রশ্ন যতখানি খোলাখুলি সামনে আসা দরকার ছিলো ততখানি আসেনি। 

৯. সরকারী লেভী ব্যবস্থা 

অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পূর্ব বাঙলা সরকার উদ্বৃত্ত এলাকাগুলিতে জমির মালিকদের ওপর বাধ্যতামূলক বিক্রয় বা লেভী ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এই অবস্থা অনুযায়ী স্থির হয় যে, নির্দিষ্ট মূল্যে সরকার কৃষক এবং অন্যান্য ভূমি মালিকদের উদ্বৃত্ত ধান ক্রয় করবেন। সরকার নির্ধারিত এই নির্দিষ্ট মূল্য ছিলো প্রচলিত বাজার দরের থেকে অনেক কম। দ্বিতীয়তঃ, লেভী ধার্য করার সময় সরকারী কর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক প্রয়োজনের কথা বিবেচনা না করে অর্থাৎ প্রকৃত পারিবারিক উদ্বৃত্তের প্রতি কোন রূপ লক্ষ্য না রেখে বিক্রয়যোগ্য পরিমাণ নির্ধারণ করতো। ফলে কৃষকরা সারা বৎসরের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য উৎপাদন করলেও তার থেকে তারা বঞ্চিত হতো এবং অনাহার অর্ধাহারের সম্মুখীন হতো। এই কারণে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা ব্যাপকভাবে লেভী ব্যবস্থা, বিশেষতঃ সেই ব্যবস্থা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারী আমলাদের অবিবেচনার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। 

লেভী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জোতদার এবং বড়ো বড়ো ভূমি মালিকরাও এই সময় খুব সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের বিক্ষোভের মূল কারণ ছিলো এই যে, তাদের সমস্ত উদ্বৃত্ত সরকার অপেক্ষাকৃত অল্পমূল্যে কিনে নেওয়ার ফলে তারা একটা বিরাট আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলো। এই সময় অনেক জোতদার ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীদের সাথে যোগাযোগ রাখতো এবং তাঁদের কাছে উচ্চমূল্যে ধান বিক্রি করতো। সরকারী লেভী ব্যবস্থা সেদিক দিয়ে তাঁদের এই উচ্চ মুনাফা অর্জনের পথে একটা বিরাট অন্তরায় ছিলো। 

খাদ্য পরিস্থিতির ওপর পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে ১৪ই জুন, ১৯৪৮ যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় তাতে কংগ্রেস পার্লামেন্টারী পার্টি অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ উঠিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করে। পরিষদে কংগ্রেস দলের নেতা বসন্তকুমার দাস, ডেপুটি নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং অন্যান্য বক্তারা সকলেই লেভী ব্যবস্থার নানা ভুল ত্রুটির কথা উল্লেখ করে লেভীকেই খাদ্য সংকট বাড়িয়ে তোলার জন্যে অনেকাংশে দায়ী করেন এবং তা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার ওপর যথেষ্ট জোর দেন। বস্তুতঃপক্ষে তারা প্রত্যেকেই কর্ডন, রেশনিং এবং লেভী সব কিছুই উঠিয়ে দেওয়ার দাবী জানান। 

লেভীর বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ ১৯৪৯ সালে অনেক বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে বিভিন্ন স্থানে লেভী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সমস্ত সভা সমিতিতে সরকারের স্বেচ্ছাচারমূলক সংগ্রহ নীতির বিরুদ্ধে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী লেভীকৃত ধান কৃষকদেরকে নিজ খরচে সরকারী গুদামে পৌঁছে দিতে হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সমস্ত গুদামের দূরত্ব কৃষকদের বাড়ী থেকে অনেকখানি হতো। কাজেই কৃষকগণ তাদের উপর এই নির্দেশ জারীর ফলে স্বভাবতঃই বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তাছাড়া সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের প্রশ্নটিও ছিলো এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি উপযুক্ত মূল্য দিয়ে কৃষকদের ধান কিনতেন তাহলে তাঁদের বলার বিশেষ কিছু থাকতো না। কিন্তু সে দিক থেকেও কৃষকরা অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কারণ সরকার কৃষকদের ওপর লেভীকৃত ধানের দর বেঁধে দিয়েছিলেন। মণ প্ৰতি ৭০ আনা হিসেবে। এই দর ছিলো প্রচলিত বাজার দরের থেকে অনেক কম। যাদের কোন সত্যকার উদ্বৃত্ত ছিলো না তারা তো এর ফলে বিপদগ্রস্ত হচ্ছিলোই উপরন্তু যাদের ধান প্রকৃতপক্ষে উদ্বৃত্ত ছিলো তাদেরও বিপদের অবধি ছিলো না। কারণ উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি করেই তারা সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতো এবং সব রকম খরচ চালাতো। দেশব্যাপী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মুখে এত স্বল্প মূল্যে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করে তারা এদিক দিয়ে রীতিমতো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলো। 

এ সম্পর্কে দৈনিক আজাদ ২৮শে জানুয়ারী তারিখে ‘সংগ্রহ ও বিতরণ নীতি’ নামক একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়: 

সরকারী খাদ্য সংগ্রহ নীতি ও পূর্ব পাকিস্তানের ঘাটতি জেলাগুলির খাদ্য সমস্যা সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমরা একাধিকবার আলোচনা করিয়াছি। ইদানীং এ সম্বন্ধে আমরা জেলাগুলি হইতে যে সকল সাংবাদাদি পাইতেছি, তাহাতে একথা পরিষ্কার হইয়া যাইতেছে যে, সরকারের খাদ্য সংগ্রহ ও বিতরণ নীতিতে গুরুতর গলদ রহিয়াছে। প্রথমতঃ, বাড়তি জেলাগুলিতে যাহাদের মোট তিরিশ বিঘার বেশী ধান-জমি আছে, তাহাদের উপর নির্দেশ হইয়াছে : একর প্রতি সতেরো মণ ধান সরকারের নিকট বিক্রয় করিতে হইবে। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এই নির্দেশের বিরুদ্ধে বাড়তি জেলাগুলি হইতে প্রবল প্রতিবাদ উঠিয়াছে। কারণ পূর্ব বাঙলার মাটির উর্বরাশক্তি সম্বন্ধে যাঁহারা সম্যক অবগত আছেন, তাঁহারা সকলেই স্বীকার করিবেন যে, গড়ে একর প্রতি সতেরো মণ ধান এখানে উৎপন্ন হয় না। অবশ্য স্থানে স্থানে ইহার ব্যতিক্রম যে না হয়, তাহা নহে। কিন্তু ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কোন কোন অঞ্চলে একর প্রতি পঁচিশ মণ পর্যন্ত উৎপন্ন হইলেও উহার উপর নির্ভর করিয়া গড় করিলে মারাত্মক ভুল করা হইবে। তাহা ছাড়া এ সম্পর্কে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, সরকারের খাদ্য সংগ্রহ নীতির সাফল্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে ধান্য উৎপন্নকারী জনসাধারণের সহযোগিতার উপর। সাধারণের সহযোগিতা পাইয়া সরকার যদি বাড়তি এলাকার জোতদারদের নিকট হইতে একর প্রতি গড়ে তেরো চৌদ্দ মণও সংগ্রহ করিতে পারেন, তবু সরকারের সংগ্রহ অভিযান সাফল্য লাভ করিবে বলিয়াই আমাদের ধারণা।… ঘাটতি এলাকায় বাড়তি এলাকা হইতে বেসরকারীভাবে ধান চাল আনা বন্ধ করিবার পূর্বে সরকারের উচিত ছিলো ঘাটতি এলাকার সরকার নিযুক্ত এজেন্ট ছাড়া আর সকল ধান-চাউল ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল করিয়া দেওয়া এবং ঘাটতি এলাকার সকল মোকামে ধান-চাউলের পাইকারী ক্রয় বিক্রয় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করিয়া দেওয়া। তাহা হইলে ঘাটতি এলাকার মুনাফাভোগী ব্যবসায়ীরা ধান চাউল গোলাজাত করিবার সুযোগ পাইত না। এখনও সরকার ইচ্ছা করিলে ঘাটতি এলাকার মওজুতদারদের গোলা অধিকার করিয়া লইতে পারেন। 

ঐ একই দিনে অর্থাৎ ২৮শে জানুয়ারী আজাদে ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগ কর্তৃক সরকারী খাদ্য সংগ্রহ নীতির সমালোচনাও প্রকাশিত হয়। খুব সম্ভবতঃ আজাদের উপরোক্ত সম্পাদকীয়টি এই সমালোচনার দ্বারাই প্রভাবিত। ময়মনসিংহ জেলা লীগের ওয়ার্কিং কমিটি নিজেদের একটি সভায় লেভী সংক্রান্ত বিষয় আলোচনার পর একটি প্রস্তাবে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন যে, সরকার প্রতি একর জমিতে ১৭ মণ ধান উৎপাদন হয় বলে যে হিসেব নির্ধারণ করেছেন সেটা কমিয়ে এনে একর প্রতি ১৩ মণ হিসেবে নির্ধারণ করা উচিত। কৃষকদের থেকে ধান ও চাল যথাক্রমে ৭ টাকা এবং ১২ টাকায় ক্রয় করার যে সিদ্ধান্ত সরকার করেছেন সেটা পরিবর্তন করে ধান ও চাল মণ প্রতি যথাক্রমে ১০ টাকা এবং ১৮ টাকা নির্ধারণ করার জন্যেও সরকারের কাছে তাঁরা অনুরোধ জানান। ময়মনসিংহ জেলা লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভায় নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ভাটি এলাকায় অবিলম্বে প্রচুর খাদ্যশস্য পাঠানোর জন্যেও অনুরোধ জানানো হয়। অন্যথায় বহুলোক এই অঞ্চলে খাদ্যের অভাবে প্রাণত্যাগ করতে পারে বলেও তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। 

লেভী এবং সাধারণভাবে সরকারের খাদ্য সংগ্রহ নীতি সম্পর্কে সারা পূর্ব বাঙলাব্যাপী বিক্ষোভ, আলাপ-আলোচনা ইত্যাদি সম্পর্কে এ সময়ে সংবাদপত্রে নানা রকম রিপোর্ট প্রকাশিত হতে থাকে। এই অবস্থায় পূর্ব বাঙলা সরকার নিজেদের খাদ্যনীতিকে অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সংবাদপত্রে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়: 

সরকার সংবাদপত্রসমূহে প্রকাশিত এমন কতকগুলি বিবৃতি লক্ষ্য করিয়াছেন যাহাতে এই ধারণার সৃষ্টি হয় যে, চলতি বৎসরে সরকারের খাদ্য সংগ্রহ নীতির সম্বন্ধে কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে। 

যাহাতে জনসাধারণের মনে কোন রকম ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি না হইতে পারে সেইজন্য ইহা পুনরায় বিশেষভাবে ঘোষণা করা প্রয়োজনীয় হইয়া পড়িয়াছে যে, প্রথমতঃ, ধান এবং চাউল সংগ্রহ মূল্যের কোন পরিবর্তন হইবে না; দ্বিতীয়তঃ, কর্ডন আদেশ কোনরূপই শিথিল করা হইবে না এবং আইন অমান্যকারীদিগকে কোন দয়া প্রদর্শন না করিয়া এবং তাহাদের বয়স ও সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে গুরুতরভাবে শাস্তি দেওয়া হইবে। তৃতীয়তঃ, সর্বশেষ যে সংগ্রহ তালিকা প্রস্তুত হইয়াছে তাহার কোন পরিবর্তন হইবে না। 

স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন গুজব ছড়াইয়া কৃষকদিগকে বিপথে চালিত করিতে চেষ্টা করিতেছে। সরকার বর্তমান খাদ্য সংগ্রহ নীতি কার্যকরী করিবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ব্যক্তিগতভাবে ধান চাউল মওজুদ শুধু ক্ষতির কারণই হইবে না, ইহা একটি সমাজবিরোধী কাজ এবং এই অপরাধ কিছুতেই সহ্য করা হইবে না।[১০০] 

এই প্রেস নোটটি প্রকাশিত হওয়ার পর ১৩ই ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে[১০১] বেসামরিক সরবরাহ সচিব সৈয়দ মহম্মদ আফজল বলেন যে, জানুয়ারী মাসে নানা অসুবিধার জন্যে সরকার মাত্র ৮১ হাজার মণের বেশী ধান সংগ্রহ করতে পারেননি। কিন্তু ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দশ দিনের মধ্যেই মোট ১ লক্ষ ৩৫ হাজার মণ ধান ও চাল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, পূর্ব বাঙলা সরকারের পরিকল্পিত বাধ্যতামূলক খাদ্য সংগ্রহ নীতি কার্যকরী হলে পরবর্তী জুন মাসের মধ্যেই ৫৪ লক্ষ মণ ধান সংগৃহীত হবে। তিনি আরও বলেন যে, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ সুষ্ঠুভাবে চললে এবং বাইরে থেকে আশানুরূপ সরবরাহ পেলে এক মাসের মধ্যেই চালের গড়পড়তা দর মণ প্রতি ২০ টাকায় নেমে আসবে। সরবরাহ সচিবের এই ‘আশা’ যে বাস্তবের সাথে কতখানি সম্পর্কহীন ছিলো সেটা পরবর্তী কয়েক মাসে খাদ্য শস্যের উচ্চমূল্য থেকেই বোঝা যাবে। সমস্ত সরকারী ঘোষণা সত্ত্বেও সরকারী খাদ্য ও সংগ্রহ নীতি যে এই সময় খাদ্য পরিস্থিতির মোকাবেলা করার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত ছিলো ফেব্রুয়ারী পরবর্তী মাসগুলিতে খাদ্য পরিস্থিতির ভয়াবহতাই তার প্রমাণ। 

২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৯ ‘সংগ্রহ নীতি’ নামক একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে সরকারী খাদ্য নীতি সম্পর্কে সাপ্তাহিক নওবেলাল বলে: 

সরকারের বাধ্যতামূলক ধান্য সংগ্রহনীতির বিরুদ্ধে আজ দেশ জুড়িয়া প্রতিবাদ উঠিয়াছে। এই প্রতিবাদের অর্থ এই নয় যে, যেখানে বা যাহাদের কাছে উদ্বৃত্ত আছে তাহা গুদামজাত করিয়া ব্যক্তিগত মোনাফার জন্য রাখিয়া দেওয়া হইবে আর ঘাটতি এলাকার লোক অনাহারে অর্ধাহারে কালাতিপাত করিবে। যেসব মহল থেকে প্রতিবাদ উঠিতেছে তাহাদের এই প্রকার কোন অভিসন্ধি যে নাই তাহা নিশ্চিত করিয়াই বলা চলে। 

সংগ্রহনীতির ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিতে গিয়ে সম্পাদকীয়টিতে আরও বলা হয় যে, সরকার যদি দেশের খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতি কামনা করেন তাহলে তাঁদের উচিত বর্তমান সংগ্রহনীতি পরিত্যাগ করে অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধান চালের দর বেঁধে দেওয়া। তার ফলে প্রয়োজনবোধে সকলেই সরকারের কাছে তাঁদের উদ্বৃত্ত বিক্রি করে অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করবে এবং দেশব্যাপী যে অসন্তোষ জেগে উঠছে সেটাও কমে আসবে। 

১লা এপ্রিল ১৯৪৯, পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে প্রদেশের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।[১০২] এই বিতর্কের প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন তার বক্তৃতায় বলেন যে, খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতি সম্পূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ পরিকল্পনার সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল। বৎসরের গোড়ার দিকেই চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন পাটের অধিক মূল্য : ময়মনসিংহ, সিলেট ও বরিশাল থেকে ঘাটতি এলাকায় চাল সরবরাহে বাধা এবং ব্যবসায়ী ও গৃহস্থ কর্তৃক প্রয়োজনাতিরিক্ত মওজুদ। প্রদেশে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধিকেও নূরুল আমীন মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। 

লেভী সম্পর্কে নূরুল আমীন তার এই পরিষদ বক্তৃতায় বলেন যে, অনেক জেলাতেই দেয় ধানের পরিমাণ খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে নির্ধারণ করায় তার মধ্যে হয়তো কিছু কিছু ত্রুটি থেকে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে বড়ো চাষীদের অসাধুতার ফলে দেয় ধানের পরিমাণ সঠিকভাবে স্থির করা হয়নি, অল্প পরিমাণে স্থির করা হয়েছে। অপর পক্ষে অল্প কয়েক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে কোনরকম তদন্ত না করার বা কোন রকম আপীল না শোনার ফলে বড়ো চাষীদের দেয় ধানের পরিমাণ অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান যে, ধার্য ধানের পরিমাণের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার আপীল শোনার জন্যে বহু দরখাস্ত করা হয়েছে। তবে খাদ্য সংগ্রহের কাজ প্রায় আধাআধি হয়ে আসার ফলে সেই অবস্থায় দেয় ধানের পরিমাণ সম্পর্কে দ্বিতীয় দফা আপীল শোনার সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন। কারণ পুনরায় আপীল শোনার ব্যবস্থা করলে খাদ্য সংগ্রহ সংক্রান্ত সমস্ত পরিকল্পনা ও মূলনীতি ধসে পড়বে। এবং এর ফলে প্রয়োজনীয় ধান সংগ্রহ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। 

সরকারকে দেয় ধানের পরিমাণ সম্পর্কে তিনি বলেন যে, উৎপন্ন ফসলের মধ্যে খাওয়া খরচ মাথা পিছু ৫ মণ ও চাষের খরচ বাবদ একটা ন্যায্য পরিমাণ ধান বাদ দিয়ে যে ধান উদ্বৃত্ত থাকবে তারই তিন চতুর্থাংশ সরকারী গোলায় জমা দিতে হবে। চাষীরা এই ধানের মূল্য পাবে মণ প্রতি সাড়ে ৭ টাকা। 

পরিষদের ও বিরোধীদলের নেতাসহ এই খাদ্য বিতর্কে তেইশজন সদস্য অংশ গ্রহণ করেন। বিরোধী দলের নেতা বসন্তকুমার দাস বলেন যে, বিরোধী দলের সদস্যগণের মতে লেভী প্রথা দরিদ্র কৃষক শ্রেণীকে সমূলে ধ্বংস করবে। অতএব লেভী প্রথা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা বাঞ্ছনীয়। বর্তমান সরকারী ক্রয়মূল্য কৃষকদের পক্ষে সমূহ ক্ষতির কারণ বলে তিনি মনে করেন। কারণ কৃষির উৎপাদন-খরচ খুব বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই কৃষকদের স্বার্থে ক্রয়মূল্য বৃদ্ধি করা সরকারের কর্তব্য বলে তিনি পরামর্শ দেন। তাদের এই পরামর্শ সরকার গ্রহণ করলে তারা খাদ্য পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন বলে তিনি আশ্বাস দান করেন। 

খাদ্য-বিতর্কের জবাবে নূরুল আমীন ঐ দিনই পরিষদে আর এক দফা বক্তৃতা করেন। তাতে তিনি বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কর্ডন তুলে দেওয়া, বাধ্যতামূলক ধান সংগ্রহনীতি পরিত্যাগ করা এবং সরকারী ধান্য ক্রয়মূল্য বৃদ্ধি করার যে তিনটি প্রস্তাব দেওয়া হয় তার উল্লেখ করে বলেন যে, উক্ত তিনটি প্রস্তাবই জনস্বার্থের বিরোধী। কনট্রোল প্ৰথা তুলে দেওয়ার দাবী প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, যে অবস্থায় কর্ডন প্রথা চালু করতে হয়েছিলো সে অবস্থার অবসান হয়নি। তাছাড়া ১৯৪৮ সালে কয়েকটি জেলায় কর্ডন প্রত্যাহার করার ফল নিদারুণ ক্ষতিকর হয়েছিলো। কাজেই, দেশের বর্তমান অবস্থায় লেভী প্রথা প্রত্যাহারের ফল ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াবে। বিদেশের মুখাপেক্ষী না হয়ে অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহে অধিকতর মনোযোগ দিলে সমস্যা সমাধান সহজতর হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, সরকারী ক্রয়মূল্য বাড়ানো উচিত হবে না। কারণ ক্রয়মূল্য বাড়ালে বাধ্য হয়ে বিক্রয় মূল্যও সরকারকে বাড়াতে হবে। এর ফলে সেই বর্ধিত মূল্য জনসাধারণের এক বিরাট অংশের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। 

মে মাসে যুক্তরাজ্যের খাদ্য বিশেষজ্ঞ স্যার হ্যাচিসন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পূর্ব বাঙলার খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রদান করেন।[১০৩] এই রিপোর্টে তিনি বিনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। লেভী প্রথা সম্পর্কে তিনি বলেন যে শুধু উদ্বৃত্ত এলাকাতেই নয়, এমনকি ঘাটতি এলাকাতেও লেভী প্রবর্তন করা উচিত। সরকার কর্তৃক বিক্রীত খাদ্যশস্যে মুনাফা রাখা এবং বিপুল পরিমাণ শস্য গুদামজাত করে রাখাকেও তিনি মনে করেন অনুচিত। সরবরাহ বিভাগ উঠিয়ে না দিয়ে তাকে অন্ততঃ আরও কিছুদিন রাখার জন্যে তিনি সুপারিশ করেন। 

লেভী সম্পর্কে নানা প্রকার সমালোচনার পর সরকার এই ব্যবস্থাকে একটা নোতুন ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। পূর্বে ভূমি-মালিক পরিবারের সদস্যদের মাথা পিছু একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বাদ দিয়ে উদ্বৃত্ত ধান চাল সংগ্রহ করার যে ব্যবস্থা ছিলো তা পরিবর্তন করে সরকার জমির পরিমাণের ওপর লেভী ধার্য করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত ১৯৪৯-এর আগস্ট মাসে ঘোষণা করা হয়।[১০৪[ এই ঘোষণা অনুযায়ী স্থির হয় যে, ১০ একর হতে ২০ একর জমির মালিকের জন্যে একর প্রতি এক মণ হিসেবে, ২১ হতে ৫০ দুই মণ হিসেবে, ৪১ হতে ১০০ তিন মণ হিসেবে এবং ১০০ একরের বেশী জমির মালিকের জন্যে চার মণ হিসেবে লেভী ধার্য করা হবে। 

এই নোতুন সরকারী সিদ্ধান্ত লেভী ব্যবস্থাকে আরও সুষ্ঠুভিত্তির ওপর দাঁড় না করিয়ে প্রকৃতপক্ষে সমস্যাকে আরও অনেক বেশী জটিল করে তোলে। কারণ এতে একদিকে প্রত্যেক পরিবারের লোকসংখ্যাকে হিসেবের বাইরে রাখা হয় এবং অন্যদিকে জমির উৎপাদনের তারতম্যকে লেভীর ক্ষেত্রে বিবেচনার বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয় না। 

লেভী সংক্রান্ত এই নোতুন নীতি সম্পর্কে সাপ্তাহিক নওবেলাল ‘খাদ্য সমস্যা’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে বলে: 

আমরা পূর্বেও অনেকবার বলিয়াছি যে, জমির পরিমাণের ভিত্তিতে কোন লেভী নীতি ক্রটিশূন্য হইতে পারে না। আমাদের দেশের অবস্থা এইরূপ পর্যায়ে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যে, কেনা জমির মালিক হইলেই ফসল উপভোগ করা যায় না। অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই তদুপরি মহাজন মিরাসদারদের পাওনা মিটাইয়া কৃষকের যাহা বাকী থাকে তাহা দ্বারা জমির পরিমাণ অনুযায়ী লেভীকৃত ধান্য আদায় অসম্ভব বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। তাই আমাদের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ মওজুদ ফসলের উপর লেভী ধার্য করিলে ইহা কেবলমাত্র সার্থকই হইবে না। ন্যায়-নীতির দিক দিয়াও নিতান্ত সমীচীন হইবে।[১০৫] 

১৪ই ডিসেম্বর ১৯৪৯ তারিখের দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘লেভীর অনাচার’ নামে একটি সংবাদে ময়মনসিংহ জেলার দেওয়ানগঞ্জ থানার অন্তর্গত ৫নং সাধুরপাড়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের উক্তি উদ্ধৃত করে বলা হয়: 

গত ২২শে অক্টোবরে বকসীগঞ্জে লেভী এডভাইজারী কমিটির এক সভায় নিরপেক্ষভাবে দশজনের নামে লেভী ধার্য করা হয়; কিন্তু এস.এস.আর এর ছুটি গ্রহণ করার পর বিনা তদন্তেই আরো ১৬ জনের নামে “গ” ধারা মতে নোটিশ জারী হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে অনেকের ৫/৭ বিঘার বেশী আমন ফসলের জমি নাই, এমনকি কাহারও কাহারও লাঙ্গল পর্যন্ত নাই।[১০৬] 

‘ধান্য লেভী সমস্যা’ নামক একটি প্রবন্ধে[১০৭] জনৈক মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরী১০৮ লেভীর নির্যাতন সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করেন। তাতে তিনি বলেন যে, পূর্ববর্তী বৎসরে প্রকিওরমেন্ট বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মচারী ও মধ্যবর্তী দালালদের অনাচার ও অবিবেচনামূলক কার্যের ফলে কৃষক সমাজে এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন যে, এই লেভী ভীতির ফলে সরকারের অধিক খাদ্য ফলাও আন্দোলন একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেছে। এর আগের বৎসর প্রচলিত বাজারদরের থেকে অল্প দরে সরকার তাদের ধান কিনে নেওয়ায় কৃষকদের মন ভেঙে গিয়েছিলো। লেভী পদ্ধতির অবিবেচনামূলক প্রয়োগকেই তিনি চলতি বৎসরে ফসল হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। 

চলতি বৎসর ও পূর্ববর্তী বৎসরে ধান লেভীর মধ্যে পার্থক্য দেখাতে গিয়ে উপরোক্ত নিবন্ধে তিনি বলেন: 

গত বৎসরের ধান্য লেভী পদ্ধতি ও এ বৎসরের পদ্ধতির মধ্যে যথেষ্ট প্রভেদ দেখিতে পাওয়া যায়। গত বৎসর পরিবারের প্রত্যেক লোকের মাথা পিছু ৭॥০ সাড়ে সাত মণ বাৎসরিক হিসাব করিয়া ধান্য ধরা হইয়াছিলো। ইহার ফলে লেভী বিভাগ (Procurement Department) পূর্ব পদ্ধতি ত্যাগ করিয়া এক অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করিয়াছেন। এই বৎসর পূর্বের ন্যায় পরিবারের লোকসংখ্যা ও জমির পরিমাণ ইত্যাদি ত্যাগ করিয়া এই বৎসর কেবল জমির পরিমাণের উপর লেভী করিবার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। এবং এই সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রত্যেক চাষী – যাহার ১০ একর বা ৩২ কেদার বা ইহার অধিক জমি থাকিবে তাহারই উপর ধান্য লেভী করা ও সন্তানাদির জন্য বাৎসরিক খোরাক আছে কিনা তৎপ্রতি কোন বিবেচনা না করিয়া, তাহার ঘরে খোরাক থাক না থাক, কেবল জমির পরিমাণের উপর নির্ভর করিয়া ধান্য দিতে হইবে। এই লেভী পদ্ধতি পরিবর্তনের ফলে গত বৎসর যাহারা লেভীর দায় হইতে কোন প্রকারে বাঁচিয়া গিয়াছিলেন, এইরূপ বহু চাষীকে এই বৎসর ধান্য দিতে হইবে। এই লেভীর ধান্য তাহারা কোথা হইতে দিবেন এই চিন্তায় অনেক কৃষক মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িয়াছেন। 

ধান-চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাস্তবতঃ অনেক সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার ফলে ১৯৫০-এর ফেব্রুয়ারী মাসে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির[১০৯] মাধ্যমে সরকার জানান যে, ১৯৪৯ সালের ধান্যশস্য সংগ্রহবিধি অনুযায়ী সংগ্রহের যে পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে তাঁরা তা পুনর্বিবেচনা করছে। বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিভিন্ন স্থানে শস্যহানির ফলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়াই তাঁদের এই সিদ্ধান্তের কারণ বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। 

এই পুনর্বিবেচনার আবেদন যাতে যথার্থ ব্যক্তির থেকে আসে তার জন্যে ব্যবস্থা করা হয় যে, বড়ো বড়ো উৎপাদনকারীকে আবেদনপত্রের সাথে ৭০ টাকার ট্রেজারী চালান এবং পূর্ব নির্ধারিত পরিমাণের এক তৃতীয়াংশ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিতে হবে। এই সব দরখাস্তের শুনানী যাতে শীঘ্রই সমাপ্ত হয় তার জন্যে আঞ্চলিক প্রকিওরমেন্ট কনট্রোলার ও ডেপুটি কনট্রোলারকে তো ক্ষমতা দেওয়া হয়ই, তাছাড়া রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ (সদর, নেত্রকোণা ও জামালপুর মহকুমা), নোয়াখালী ও সিলেটের এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রকিওরমেন্ট কনট্রোলারকে এবং পাবনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, ঢাকা, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ (টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ) সিভিল সাপ্লাইয়ের ডিস্ট্রিক্ট কনট্রোলারকেও ক্ষমতা দেওয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষমতা দেওয়া হয় অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট কনট্রোলারকে। 

জমির পরিমাণের ওপর নির্ধারিত লেভী বজায় রেখে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু পরিমাণ আদায় মওকুফ করার জন্যে সরকার ওপরে যে ব্যবস্থার বিধান দিয়েছিলেন তাতে অপেক্ষাকৃত অল্প বিত্তের কৃষকদের তেমন কোন সুবিধা হওয়ার কথা নয়। যাদের জমি পরিমাণে বেশী তারাই সরকারী আমলাদের কাছে নিয়ম মাফিক আবেদন নিবেদন ও দরবার করে কিছু মওকুফ পেতে পারতো। এই ব্যবস্থার ফলে প্রকৃতপক্ষে এই শ্রেণীর ভূমি মালিকেরাই লাভবান হয়েছিলো। এর দ্বারা গরীব ও মধ্য কৃষকদের ওপর নির্বিচারে ধান লেভী করে যেতো। কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন নিবেদনের যে পদ্ধতি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছিলো সে পদ্ধতি অনুসরণ অশিক্ষিত এবং অল্প বিত্তের কৃষকদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাছাড়া শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত ভূমি মালিকরা সরকারী আমলাদের কাছে সুপারিশ করে যে সুফল পেতেন কৃষকদের পক্ষে সে ফল পাওয়া নানা কারণে সম্ভব ছিলো না। এই শ্রেণীভুক্ত কৃষকেরা লেভীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশেষ বিশেষ এলাকায় আন্দোলন করেছিলেন। এই আন্দোলন অনেক সময় সশস্ত্র সংগ্রামের রূপও পরিগ্রহ করেছিলো।[১১০] 

১০. অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি 

১৯৪৮-৪৯ সালে এবং তার পরবর্তী সময়েও মূল্যবৃদ্ধি যে কেবলমাত্র খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিলো তা নয়। অন্যান্য কতকগুলি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যও এই সময়ে ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই দ্রব্যগুলির মধ্যে কাপড়, কেরোসিন, চিনি, সরিষার তেল, নারকেল তেল, কয়লা ইত্যাদিই প্রধান। 

নওবেলাল পত্রিকায় এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ১৯৪৮-এর ১৩ই মে ‘বাঁচিবার পথ’ নামক একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয়: 

আন্তর্জাতিক অবস্থার চাপে এবং বিভাগের জন্য পাকিস্তানের আর্থিক কাঠামো ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সাধারণভাবে নীচে নামিয়া আসিতেছে, এবং দ্রব্যমূল্য দ্রুত বাড়িতে থাকিয়া দেশ জুড়িয়া এক অবিশ্বাস, ভয়, সন্দেহ এবং অসন্তোষের বিষ ছড়াইতেছে। এই অবস্থাকে অধিক দিন চলিতে দিলে দেশের অসন্তুষ্টি আত্মপ্রকাশ করিতে বাধ্য – হয়তোবা গণবিপ্লবের পর্যায়েও নামিয়া আসিতে পারে। 

এরপর এই পত্রিকার সম্পাদকীয়তে দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে আরও বলা হয়: 

যে অবস্থা স্বাভাবিকভাবে আমাদের উপর চাপিয়া আসিতেছে তাহার প্রতিরোধের জন্য সরকার কতখানি অগ্রসর হইয়াছেন তাহা অবশ্যই বিচার্য। আস্ত ডোমিনিয়ন সম্মেলনে মাছ, ডিম, তরকারী এবং অনুরূপ অন্যান্য কাঁচামাল পাকিস্তান হইতে অবাধে ভারতীয় ইউনিয়নে পাঠাইবার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। অথচ ভারত হইতে পাকিস্তানে ডাল, তৈল ইত্যাদি দ্রব্যের আমদানীকে সহজ করা হয় নাই। যাহার ফলে শিলং-এ মাছ ও ডিমের মূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়া আসিলেও সিলেটে তৈল বা ডালের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই বাড়িয়া উঠিতেছে। সিলেট হইতে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে ভারতীয় করিমগঞ্জে সরিষার তৈলের মূল্য মণকরা ৭০ টাকা এবং সিলেটে তাহার দাম[১১০] টাকা পর্যন্ত উঠিয়াছে। ইহা শত শত নজীরের একটি মাত্র। কিন্তু সরকারী ব্যবস্থায় এই অবস্থাকে কাটাইয়া উঠিবার কোন কার্যকরী পন্থা অবলম্বিত হইয়াছে কিনা তাহা এখনও অনুভব করা যাইতেছে না। 

এই সকল অব্যবস্থার প্রতিকারের জন্য প্রচার নীতি সাধারণভাবে দুইটা পথ অবলম্বন করিয়াছে। প্রথমতঃ শিশু রাষ্ট্রের দোহাই, দ্বিতীয়তঃ কমিউনিস্টভীতি প্রচার। 

ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ফরিয়াদ পত্রিকার ২৫শে জুন ১৯৪৯, সংখ্যায় ১৯৩৮ এবং ১৯৪৮ সালের একটি তুলনামূলক বাজার দর প্রকাশিত হয়।[১১১] বাজারদর সম্পর্কে তখনকার এই হিসেবটি নীচে উদ্ধৃত করা হলো: 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে দ্রব্যমূল্য যে পর্যায়ে ছিলো যুদ্ধকালীন অথবা তার পরবর্তী কোন সময়েই তা সে পর্যায়ে নেমে আসেনি। তবে এই তুলনামূলক হিসেব থেকে দশ বৎসরের ব্যবধানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটা সাধারণ চিত্র পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে ১৯৪৮ সালের এই বাজারদর খুব সম্ভবতঃ জিঞ্জিরা বাজার থেকে গৃহীত ঢাকার বাজারদর। 

জুলাই মাসের শেষের দিকে সিলেটের জগন্নাথপুর থানার অবস্থার ওপর একটি রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, সেখানে চালের দর মণপ্রতি বিশ বাইশ টাকা হলেও সেই দরে লোকের খাদ্যশস্য কেনার মতো কোন সামর্থ্য নেই।[১১২] আট দশ মাস ধরে সেই অঞ্চলে কোন কাপড় না আসায় সাধারণ লোকেরা খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হয়। লাইসেন্সদাররা তাদের কোটার কাপড় না আনার প্রধান কারণ পুরাতন লাইসেন্সদারদের বদল করে নোতুন লোকদেরকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে এবং তারা বেশীর ভাগ কাপড়ই চোরাকারবার করে। অন্যান্য বাজারদর সম্পর্কে রিপোর্টটিতে বলা হয়: 

কেরাসিন তৈল নাই বলিলেই চলে। সরিষার তৈলের সের ৩ – ৩০ টাকা, ডাইলের সের খাসারী দশআনা হইতে বারো আনা এবং মুসুরী ১।।০ ১।।০, কিছুদিন আগে একটা দিয়াশলাইর দাম ছিলো এক আনা বর্তমানে দুই আনা। এমন কি বর্তমানে এতদাঞ্চলে মাছের অভাব অত্যন্ত প্রকটভাবে দেখা দিয়াছে ও মাছের দাম আগুনের মত বাড়িয়া চলিয়াছে। ইহার উপর অসংখ্য ট্যাক্সের বোঝা জনসাধারণের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করিয়া তুলিয়াছে। এই উপর্যুপরি সংকটের চাপে সমস্ত সমাজজীবন ভাংগনের মুখে। গ্রামের স্কুলগুলি তৈলহীন মাটির প্রদীপের মত নিভিয়া যাইতেছে। বর্তমান সমাজে আর্থিক অবস্থা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপা ক্রোধ বারুদের ন্যায় ফাটিয়া পড়িতেছে। 

দ্রব্যমূল্যের এই অবস্থা যে উপরোক্ত এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো তা নয়। পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের বিভিন্ন বিতর্ক এবং উত্থাপিত প্রশ্নসমূহ থেকে পূর্ব বাঙলায় এই সময় ব্যাপকভাবে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। 

১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে পূর্ব বাঙলায় বস্ত্র সংকট দারুণ আকার ধারণ করে। এই সংকট সমাধানের উদ্দেশ্যে ২রা এপ্রিল ১৯৪৮ তারিখে পূর্ব বাঙলা পরিষদে মনোরঞ্জন ধর ব্যাপকভাবে চরখা প্রবর্তন ও প্রচলনের প্রস্তাব করেন।[১১৩] এই প্রস্তাব উত্থাপনকালে তিনি বলেন: 

বর্তমান বাজেট উপস্থিত হবার পর দিনের পর দিন অর্থসচিব ও অন্যান্য মন্ত্রী প্রবরদের বিভিন্ন বিবৃতি ও আলোচনা থেকে যে সব তথ্য পেয়েছি তাতে বিশেষভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে এক নিদারুণ বস্ত্র সংকটের কথা। অচিরে শিল্প প্রসারের যে তেমন সম্ভাবনা নাই তার উপর অর্থসচিব মহাশয় জোর দিয়ে উক্তি করেছেন একাধিকবার। এদিকে বস্ত্র সংকট যে কি নিদারুণ আকার ধরণ করেছে তার প্রমাণ আমরা নিত্য নিয়তই পাই। আজ আমাদের মা বোনদের লজ্জা নিবারণের কোন সংস্থান নাই, আমি জানি অনেক মেয়ে ঘরের বাইরে আসতে পারে না কাপড়ের অভাবে। অনেক মা, বোন আত্মহত্যা করে তাঁদের দুঃখের অবসান ঘটিয়েছে লজ্জা নিবারণ করতে না পেরে।[১১৪] 

৯ই এপ্রিল মনোরঞ্জন ধরের প্রস্তাবটি আলোচনার সময় পরিষদ সদস্যেরা বস্ত্র সমস্যার কিছুটা স্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্যে দলনিরপেক্ষভাবে চরখা প্রবর্তনের সপক্ষে নিজেদের মত প্রকাশ করেন। আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও তফজ্জল আলী এর বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত সামান্য পরিবর্তন সাপেক্ষে মনোরঞ্জন ধরের প্রস্তাবটিকে মন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ আফজল তাঁদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। কাজেই প্রস্তাবটি পরিষদে গৃহীত হয়। ১১৫ ১৯৪৮-এর ৮ই জুন পরিষদে বস্ত্র সম্পর্কিত আলোচনার সময় মনোরঞ্জন ধরের একটি প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন তাঁকে জানান যে, উপরোক্ত প্রস্তাবটি পরিষদে গৃহীত হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার এই বিশেষ উদ্দেশ্যে একটি সমিতি গঠন করেছেন। এ ছাড়া একটা প্রাদেশিক বোর্ডও তাঁরা গঠন করতে যাচ্ছেন। তিনি আশা করেন যে, বিভিন্ন জেলা ও মহকুমাগুলিতে এই বোর্ডের শাখাসমূহ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তাঁদের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে চরখা প্রবর্তিত হয়ে তার সরকার পূর্ব বাঙলায় আড়াই লক্ষ চরখা বিতরণ করার ব্যবস্থা করছে বলেও তিনি পরিষদকে জানান। [১১৬] 

যন্ত্র পরিস্থিতি সম্পর্কে এই বিতর্কের সময় অন্য একটি প্রশ্নের জবাবে নূরুল আমীন জানান যে, মাথাপিছু দশ গজ হিসেবে পূর্ব বাঙলায় বস্ত্রের মাসিক চাহিদা ২৩,০০০ বেল। কিন্তু কনট্রোল প্রথা চালু হওয়ার পরবর্তী হিসেব থেকে দেখা গেছে যে, পূর্ব বাঙলায় মাসে ১৩,০০০ বেল কাপড়ও বিক্রি হয় না।[১১৭] 

নিদারুণ বস্ত্র সংকট সত্ত্বেও কনট্রোলের মাধ্যমে কাপড় খরিদ করার সামর্থ্যও এই সময় মানুষের ছিলো না। এর থেকে বোঝা যায় সাধারণ লোকের ক্রয়ক্ষমতা তখন কোন পর্যায়ে ছিলো। 

কনট্রোলের মাধ্যমে যে কাপড় ডিলারদের কাছে পাঠানো হয় তার অধিকাংশই ভারত থেকে আমদানীকৃত। এই আমদানীকৃত কাপড়ের ওপর ভারত এবং পাকিস্তান দুই অংশেই রপ্তানী ও আমদানী কর ধার্যের ফলে তার মূল্য অনেক বেশী দাঁড়ায়।[১১৮] কনট্রোলের মাধ্যমে কাপড় দেওয়ার ব্যবস্থা সরকার করলেও এ জন্যেই সেই কাপড় সাধারণ লোকের পক্ষে কেনা অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে পরিষদে একটি প্রশ্নের জবাবে সরবরাহ মন্ত্রী সৈয়দ আফজল স্বীকার করেন যে, কোন কোন ক্ষেত্রে ডিলাররা তাদের মজুত কাপড় বিক্রি করতে অসুবিধা বোধ করছে। এবং অনেক আগেকার মজুত কাপড় সময়মতো বিক্রি করে উঠতে না পারার জন্যে সরকারী গুদাম থেকে পরবর্তী কোটার কাপড় তুলতে দেরী করছে।[১১৯] 

রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমায় কেরোসিন তেল এবং চিনির কোটা নষ্ট হওয়া সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের জবাবে সরবরাহ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রেল ও স্টীমার কোম্পানী সময়মতো পরিবহনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম না হওয়াতেই কেরোসিন তেলের কোটা নষ্ট হয়। চিনির ক্ষেত্রে অবশ্য অন্য ব্যাপার। চিনির পাইকারী ডিলাররা কল থেকে চিনি তোলার জন্যে যথেষ্ট সংখ্যায় এগিয়ে না আসার ফলেই প্রধানতঃ চিনির কোটা নষ্ট হয়ে যায়।[১২০] 

ঢাকায় কয়লার অভাব এবং কয়লার কোটা নষ্ট হওয়া সম্পর্কেও পূর্ব বাঙলা পরিষদে কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর জবাবে সরকার পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ঢাকার জন্যে ১৯৪৯-এর ফেব্রুয়ারী মাসে নির্দিষ্ট ২৬ ওয়াগন কয়লার মধ্যে মাত্র দুই ওয়াগন কয়লা ভারত থেকে ঢাকা এসেছে এবং বাকী কোটা নষ্ট হয়ে গেছে।[১২১] 

সরকার ঢাকাতে কয়লার রেশনিং চালু করার কোন ব্যবস্থা করেছেন কিনা তার জবাবে বলা হয় যে, কয়লার মাসিক কোটা নিয়মিত সরবরাহের কোন নিশ্চয়তা না থাকার ফলে ঢাকায় কয়লার রেশনিং চালু করা সম্ভব নয়।[১২২] 

সরবরাহের এই অনিশ্চিত অবস্থার জন্যে ঢাকায় এবং পূর্ব বাঙলার অন্যান্য শহরে এই সময় অন্যান্য দ্রব্যের সাথে কয়লারও দারুণ অভাব ঘটে এবং তার মূল্য বৃদ্ধি হয়। 

১৯৫০ সালে চাল এবং অন্যান্য দ্রব্যমূল্য অনেকখানি কমে এলেও ১৯৫১ সালে চালের মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে অন্যান্য জিনিসপত্রের মূল্যও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। এ সম্পর্কে ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত দৈনিক আজাদের একটি বিবরণে বলা হয়: 

সম্প্রতি কিছুদিন হইতে সাধারণভাবে সমগ্র প্রদেশে এবং বিশেষ করিয়া ঢাকা শহরে জীবন ধারণের অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য এত অধিক বৃদ্ধি পাইয়াছে যে, মধ্যবিত্ত ও দিনমজুরদের জীবন দুর্বিষহ হইয়া উঠিয়াছে।… 

গত বৎসরের তুলনায় চাউলের মূল্য হ্রাস পাওয়া তো দূরের কথা ঢাকার বাজারে বর্তমানে প্রতি মণ ২৫ টাকা হইতে ২৮ টাকা মূল্যে মাঝারি রকমের চাউল বিক্রয় হইতেছে। মাছ মাংসের মতো শাকসব্জী ও তরিতরকারীও সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। সের প্রতি বেগুন বারো আনা, আলু ১ টাকা, কাঁচা লঙ্কা ৩ টাকা, সরিষার তৈল (অবশ্য খাঁটি নয়) ৪ টাকা, নারিকেল তৈল ৭ টাকা আট আনা দরে বিক্রয় হইতেছে। আরও শোনা যাইতেছে, বাজারে সরিষার অভাব পরিলক্ষিত হইতেছে। এমনকি কয়েকটি সরিষার তৈলের কলও বন্ধ হইবার জোগাড় হইয়াছে। অচিরেই যদি সরিষার আমদানী না করা হয়, তাহা হইলে সরিষার তৈল্যের মূল্য ১০ টাকা সের দরে বিক্রয় হইতে পারে বলিয়া অনেকে এখন হইতেই আশঙ্কা করিতেছেন।[১২৩] 

১১. খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ 

১লা ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৯ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক বক্তৃতায় বলেন যে, সিন্ধু ও পশ্চিম পাঞ্জাবে শস্যহানি হওয়ায় তাঁরা আন্তর্জাতিক খাদ্য পরিষদের কাছে খাদ্যের জন্যে আবেদন জানিয়েছেন। ইতিমধ্যেই কিছু পরিমাণ খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে এসেছে এবং আরও আসছে। এছাড়া চলতি বৎসরে পশ্চিম পাকিস্তানে ফসল ভালো হয়েছে কাজেই সেখানকার গম বাজারে এলে খাদ্যসংকট দূর হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।[১২৪] 

এরপর ৯ই ফেব্রুয়ারী ময়মনসিংহে আর একটি বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, দেশের স্থানে স্থানে ধান-চালের মূল্য দরিদ্র জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এ সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতার ফলে সরকার উপলব্ধি করেছেন যে, ঘাটতি এলাকায় সরবরাহের ভার ব্যবসায়ীদের হাতে ন্যস্ত করা যায় না। জনসাধারণকে ন্যায্য দামে খাদ্যশস্য সরবরাহের জন্যে সরকার লেভী ও কর্ডনিং-এর ব্যবস্থা করেছেন। গত বৎসর কর্ডনিং-এর কড়াকড়ি হ্রাস করার ফল ভালো হয় নাই, কাজেই সরকারের দ্বারা অনুসৃত খাদ্য সংগ্রহ নীতিই শ্রেয়।[১২৫] ফেব্রুয়ারী মাসে খাজা নাজিমুদ্দীনের এই সব বক্তব্যের পরও অবস্থার কোন প্রকার উন্নতি না হয়ে বরং খাদ্য পরিস্থিতির অধিকতর অবনতি ঘটে। এর ফলে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় সরকারী দল মুসলিম লীগও সরকারী খাদ্য নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। 

১৪ই জুন, ১৯৪৯ গিয়াসউদ্দীন পাঠানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ময়মনসিংহ মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে প্রাদেশিক প্রধান মন্ত্রী এবং বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রীর কাছে এক প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুসলিম লীগের এই সভায় প্রচলিত লেভী প্রথার সমালোচনার প্রসঙ্গে বিভিন্ন জেলায়, বিশেষতঃ নেত্রকোণায় এ ব্যাপারে তাঁরা কৃষকদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করেন। এই সম্পর্কে সরকারী এবং বেসরকারী সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি দ্বারা তদন্তের দাবীও জানানো হয়। এই সংক্রান্ত প্রস্তাবে আরও দাবী করা হয় যে, প্রস্তাবিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেশ না করা পর্যন্ত যেন প্রচলিত লেভী কার্যকর করা না হয়। এইসভায় গৃহীত অপর একটি প্রস্তাবে সরকারী গুদামে প্রদত্ত ধানের ওজন, মূল্য বাকী ফেলা ইত্যাদি বিষয় অনাচারের তীব্র নিন্দা করা হয়। নানা স্থানে স্বল্প পরিমাণ ধান আটক করে গ্রাম্য চাষীদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে বলে সভায় অভিযোগ করে এই ব্যবস্থা রহিত করার দাবী জানানো হয়। সরকারী ক্রয় ও বিক্রয়ের মধ্যে তারতম্য অর্থাৎ সরকারের অতিরিক্ত মুনাফা সম্পর্কেও এই প্রস্তাবে তাঁরা উল্লেখ করেন।[১২৬] 

এই সময় ঢাকা জেলা মুসলিম লীগও খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে কতকগুলি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ১৭ই জুন তারিখে ঢাকা জেলা বোর্ডের মিলনায়তনে নওয়াব হাবিবুল্লাহর সভাপতিত্বে ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ কাউন্সিলের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। মোট[১১৪] জন কাউন্সিলের মধ্যে ৭৫ জন তাতে যোগদান করেন। এই সভায় খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁরা নিম্নলিখিত সুপারিশ করেন: 

ক. খাদ্যনীতি পুনর্বিবেচনা করা হোক, 

খ. প্রাদেশিক কর্ডন প্রথা দৃঢ়তর করা হোক, 

গ. জেলা কর্ডন প্রথা উঠিয়ে নেওয়া হোক, 

ঘ. লেভীপ্রথা সম্পর্কিত অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করা হোক, 

ঙ. বাড়তি এবং ঘাটতি এলাকার ধান ও চালের বর্তমান মূল্য সম্বন্ধে পুনর্বিবেচনা করা হোক, 

চ. খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও বণ্টনের মধ্যে সরকার আরও কম মুনাফা করুক, 

ছ. ঘাটতি এলাকায় তৎপরতার সাথে খাদ্যশস্য পাঠানো হোক, 

জ. ঘাটতি এলাকার গ্রামগুলিতে সম্পূর্ণ রেশনিং প্রবর্তন করা হোক এবং 

ঝ. খাদ্য সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে স্থানীয় মুসলিম লীগের সাহায্য গ্রহণ করা হোক।[১২৭]

ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ কাউন্সিলের এই শেষোক্ত সুপারিশটি থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, পূর্ব বাঙলা সরকার খাদ্য পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে এ সময়ে সরকারী কর্মচারীদের ওপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম লীগ সংগঠনের সাথে তাঁদের কোন সহযোগিতার সম্পর্ক ছিলো না। 

১৮, ১৯ ও ২০শে জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।[১২৮] সেই অধিবেশনে তাঁরা খাদ্য পরিস্থিতির উন্নয়ন; খাদ্য বিলিব্যবস্থা ও খাদ্য বিক্রয় সম্পর্কে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া সাধারণভাবে সরকারী আমলাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি প্রস্তাবে বলা হয় যে, স্বাধীনতা লাভ করার পর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব জনগণের ওপর ন্যস্ত হয়েছে, কারণ তাঁরাই রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক। কিন্তু এক শ্রেণীর সরকারী কর্মচারীরা তাঁদের পুরাতন নীতি অপরিবর্তিত রেখে জনগণের সাথে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। এই সমস্ত কর্মচারীরা যাতে জনগণের প্রতি ভদ্রোচিত ব্যবহার করে তার জন্যে মুসলিম লীগ কাউন্সিল মন্ত্রীসভাকে যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বনের নির্দেশ দান করেন। 

সামগ্রিকভাবে খাদ্য পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাঁরা বলেন, প্রদেশের খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় সর্বত্র দারুণ অসন্তোষের উদ্ভব হয়েছে। খাদ্য সমস্যা সম্পর্কিত সরকারী ঔদাসীন্যের ওপর কতকগুলি তথ্য পেশ করে কাউন্সিল অভিমত প্রকাশ করেন যে, বেসামরিক সরবরাহ দফতরের অক্ষমতা অথবতার অনেক প্রমাণ ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে এবং এই দফতর কর্তৃক জনগণের কোন উপকারই সাধিত হচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে শুধু মুসলিম লীগ সরকারই নয়, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানেরও দারুণ দুর্নাম হচ্ছে। 

তাঁরা এ প্রসঙ্গে আরও বলেন যে, সংগ্রহ (প্রকিওরমেন্ট), বিতরণ (ডিস্ট্রিবিউশন) ও চলাচল (মুভমেন্ট) সরবরাহ দফতরের এই তিনটি বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবে বিভিন্ন জেলার খাদ্য ব্যবস্থা পরিচালনা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। খাদ্য সংগ্রহনীতির বিধিব্যবস্থা সরকার যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে না পারায় সন্তোষজনকভাবে কাজে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছে না এবং তার ফলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। সরকারের মুনাফাখোরী সম্পর্কে তাঁদের অভিযোগে বলা হয় যে, সিন্ধু এবং অন্যান্য স্থান থেকে যথাক্রমে ১ ও ৫ টাকা মণ দরে ভাঙা চাল কিনে সরকারী সরবরাহ বিভাগ পূর্ব পাকিস্তানে তা ২২ টাকা দরে বিক্রি করছে। 

উপরোক্ত তথ্যসমূহের প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রদেশের খাদ্য সমস্যার উন্নতি বিধান কল্পে সরকারের নীতি পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে কাউন্সিল নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহ গ্রহণ করে : 

(ক) আন্তঃথানা ও আন্তঃমহকুমা কর্ডন প্রথা রহিত করিয়া জেলা ও প্রাদেশিক কর্ডন প্রথাকে অধিকতর কঠোরতার সহিত প্রয়োগ করিতে হইবে। (খ) ধান্য উৎপাদনকারীদের সুবিধা অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া সম্প্রতি প্রবর্তিত শস্য ক্রোক প্রথা রহিত করিয়া খাদ্য সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করা উচিত। (গ) সরকারকে লাভের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিয়া ধান চাউল ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের দাম অবিলম্বে কমাইয়া ফেলিতে হইবে। (ঘ) প্রকিওরমেন্ট, ডিস্ট্রিবিউশন ও মুভমেন্ট এই তিনটি বিভাগের কার্যপরিচালনার ভার তিনজন জেলা অফিসারের পরিবর্তে একজনের হাতে ন্যস্ত করিবার উদ্দেশ্যে সরকারকে ব্যবস্থা অবলম্বন করিবার জন্য কাউন্সিল নির্দেশ দিয়াছেন। তিনজন জেলা অফিসার নিজেদের জেদ ও রেষারেষি বজায় রাখিবার জন্য বহুক্ষেত্রে সরকারী কাজে গাফিলতি করিয়াছে বলিয়া প্ৰমাণ পাওয়া গিয়াছে। সরবরাহ দফতর উঠাইয়া দেবার মানসে এখন হইতেই ব্যাপক আকারে কর্মচারী ছাঁটাই করা শুরু করিবার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। (ঙ) খাদ্য সমস্যার প্রকৃত সমাধানের উদ্দেশ্যে সরকারকে মোছলেম লীগের সহিত সহযোগিতা করিতে বলা হইয়াছে। (চ) ঘাটতি এলাকায় খাদ্য সরবরাহ করিবার জন্য সরকারকে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে। (ছ) সরবরাহ দফতরকে আরও কার্যতৎপর ও নিপুণতার সহিত কার্য পরিচালনা করিতে হইবে। (জ) কাউন্সিল বন্যাবিধ্বস্ত ও ঘাটতি এলাকায় রেশনিং প্রথা প্রবর্তনের সুপারিশ করিয়াছে।[১২৯] 

ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলা লীগ এবং প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের উপরোল্লিখিত প্রস্তাবসমূহের মধ্যে কতকগুলি পার্থক্য উল্লেখযোগ্য। প্রথমতঃ, ময়মনসিংহ কাউন্সিলের প্রস্তাবে কর্ডন প্রথা সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই, ঢাকা কাউন্সিলের প্রস্তাবে জেলা কর্ডন তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং প্রাদেশিক কাউন্সিল জেলা কর্ডন জোরদার করার কথা বলেছেন। ময়মনসিংহ কাউন্সিলে লেভীর নির্যাতন সম্পর্কে বিশদভাবে উল্লেখ করে সেই নির্যাতন বন্ধ করা এবং সে বিষয়ে তদন্ত করার সুপারিশ জানানো হয়েছে। ঢাকা কাউন্সিলে নির্যাতন সম্পর্কে বিশদ উল্লেখ অথবা অভিযোগ না করে নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রাদেশিক কাউন্সিলে কিন্তু লেভীর নির্যাতন সম্পর্কে কোন কথাই বলা হয়নি। তাঁরা শুধু বলেছেন, ‘সম্প্রতি প্রবর্তিত শস্য ক্রোক প্রথা রহিত করিয়া খাদ্য সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করা উচিত’। উপরোক্ত তিনটি কাউন্সিলের প্রস্তাবেই অবশ্য সরবরাহ বিভাগের অতিরিক্ত মুনাফা আদায়ের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উল্লিখিত হয়েছে। ঢাকা জেলা এবং প্রাদেশিক কাউন্সিলের প্রস্তাবে খাদ্য সম্পর্কিত বিষয়ে মুসলিম লীগের সাথে সরকারের সহযোগিতার অভাব এবং প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে। প্রাদেশিক কাউন্সিলের সভায় ‘নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি এবং মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা হানি ও দুর্নাম সম্পর্কে সরাসরি উল্লেখ এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। 

৮ই জুলাই, ১৯৪৯ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিঞা) খাদ্য সংকট সম্পর্কে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দেন।[১৩০] তাতে তিনি বলেন: 

পূর্ব পাকিস্তান আজ গভীর খাদ্য সংকটের সম্মুখীন। এখানকার ইতিহাসে এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব আর কখনও হয় নাই। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে খাদ্যশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খাদ্য সংকটের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। প্রতিদিনই পরিস্থিতির অবনতি ঘটিতেছে।… জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে আমি বহু মর্মন্তুদ সংবাদ পাইয়াছি। যথাশীঘ্র উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন না করা হইলে ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইতে পারে বলিয়া আশঙ্কা করিতেছি। 

এরপর তিনি বলেন যে, সরকার সমস্ত জেলা, মহকুমা ও ইউনিয়নে রিলিফ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু সরকারের ঐ ব্যবস্থা সত্ত্বেও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ একটা নিজস্ব রিলিফ কমিটি গঠন করবে। এই কমিটির কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন: 

বিভিন্ন জেলা মহকুমা ও ইউনিয়নে আমাদের রিলিফ কমিটির শাখা থাকিবে। ইউনিটে রিলিফ কমিটিগুলি গ্রামে গ্রামে যাইয়া জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করিবেন এবং যাহাতে সঠিকভাবে দুর্গতির প্রতিকার হয় সেইদিকে লক্ষ্য রাখিবেন।… দেশে যে ভীতি ও অনিরাপত্তার আবহাওয়া সৃষ্টি হইয়াছে তাহা দূরীভূত করিয়া তাহাদিগকে জনসাধারণের মনে আশা ও সাহসের সঞ্চার করিতে হইবে। 

মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক রিলিফ কমিটি গঠনের ব্যবস্থা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিজস্ব উদ্যোগে একটি পৃথক রিলিফ কমিটি গঠন করার এই প্রস্তাব খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এর দ্বারা বস্তুতঃপক্ষে মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের অনাস্থা প্রকাশ পায়। 

কিন্তু প্রাদেশিক লীগ সম্পাদকের এই বিবৃতি সত্ত্বেও ১৮ জুলাই, ১৯৪৯ তারিখে বর্ধমান হাউসে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির একটি সভায় রিলিফ কমিটি সম্পর্কে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই প্রস্তাবে জেলা এবং মহকুমা রিলিফ কমিটিগুলিকে ৫ জন মুসলিম লীগ, ২ জন সংখ্যালঘু এবং ৩ জন সরকারী প্রতিনিধি সর্বমোট ১০ জন করে প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত করার অনুরোধ জানানো হয়। সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদলের নির্বাচনের দায়িত্ব তাঁরা ঐ একই প্রস্তাবে প্রাদেশিক গভর্নরের ওপর অর্পণ করেন। কাজেই এই প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকৃতপক্ষে ৫ জন মুসলিম লীগ এবং ৫জন সরকারী প্রতিনিধি নিয়ে প্রত্যেক জেলা ও মহকুমার রিলিফ কমিটি গঠনের যে কথা বলা হয় তাতে সরকারবিরোধী দলসমূহকে সম্পূর্ণভাবে রিলিফ কমিটির আওতার বাইরে রাখা হয়। রিলিফের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গী এবং রিলিফ কমিটিগুলির এই চরিত্রের জন্যেই সেগুলি নামমাত্র রিলিফ কমিটিতে পর্যবসিত হয়ে অচিরেই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। 

১২. ১৯৫১ সালের খাদ্যসংকট 

১৯৪৮-৪৯-এর নিদারুণ খাদ্যসংকট ১৯৪৯-এর শেষ ভাগে এবং ১৯৫০ সালে অনেকখানি হ্রাস হয়ে দুর্ভিক্ষ অবস্থার অবসান ঘটায়। কিন্তু ১৯৫১ সালের প্রথম দিক থেকেই আবার খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে এবং কয়েকটি জেলায়, বিশেষতঃ খুলনায়, বন্যার ফলে তা এক মারাত্মক দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করে। 

এপ্রিল মাসে খুলনার দক্ষিণ অঞ্চলে শ্যামনগর, কালীগঞ্জ, আশাসুনী, পাইকগাছা এবং অন্যান্য এলাকায় খাদ্যসংকটের তীব্রতা ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পায়। ভাতের অভাবে ঐ সমস্ত অঞ্চলের লোকেরা চালকুমড়া, সজনের ডাঁটা ইত্যাদি খাওয়াতে ব্যাপক হারে পেটের অসুখ দেখা দেয় এবং তার ফলে অনেকের মৃত্যু ঘটে। কোনোরকমে জীবন রক্ষার জন্যে গরীব কৃষকেরা নিজেদের জমি বিক্রি করতে শুরু করলেও জমির দাম তারা মোটেই পাচ্ছিলো না। কয়েক মাস পূর্বেও যে জমি ৪০০ টাকা বিঘা বিক্রি হতো তার দাম এই সময়ে দাঁড়ায় বিঘা প্রতি ৪০ টাকা। এইসব অঞ্চলে ধান-চাল বিক্রি সরকারীভাবে নিষিদ্ধ হওয়ায় অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।[১৩১] 

ঠিক এই সময়ে (৫ই এপ্রিল) বরিশালের সুতিয়াকাটিতে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বেসামরিক মন্ত্রী সৈয়দ আফজল হোসেন বলেন যে, পূর্ব বাঙলায় খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটার অথবা খাদ্য সম্পর্কে কোন সমস্যা দেখা দেওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সরকারী গুদামে ৫ লক্ষ মণ মজুদ চালের উল্লেখ করে বলেন যে, প্রয়োজনমতো যে কোন জায়গায় সে চাল পাঠানো হবে।[১৩২] 

এর এক মাস পর পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনও তাঁর মাসিক বেতার বক্তৃতায় খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন : 

আমাদের প্রদেশের খাদ্য পরিস্থিতি বর্তমানে সন্তোষজনক। সরকারের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য মওজুদ আছে। সুতরাং প্রদেশবাসীদের খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন সঙ্গত কারণ নাই।[১৩৩]

সরবরাহ মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর এই সব সরকারী বক্তব্য সত্ত্বেও খুলনা জেলা মুসলিম লীগের 

সম্পাদক আবদুল হামিদ এই সময় খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রচার করেন: 

গত কয়েক মাসে খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে যে খাদ্য পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, সরকার উহার প্রতি যথোচিত দৃষ্টি দেন নাই। ইহা অদৃষ্টের পরিণাম বই কি! খুলনা জেলা উদ্বৃত্ত খাদ্য এলাকা বলিয়া পরিচিত। কিন্তু গত বন্যার ফলে পাইকগাছা, শরণখোলা, মোল্লাহাট, তেরোখাদা, ডুমুরিয়া, শ্যামনগর, আশাসুনি, কালীগঞ্জ, দাকোপ, সাতক্ষীরা, তালা থানার যথেষ্ট শস্যহানি হইয়াছে। প্রাদেশিক মোছলেম লীগের অধিবেশনে এ সম্পর্কে প্রথম আলোচনা হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রে খুলনার খাদ্যসংকটের খবর প্রকাশিত হয় এবং প্রাদেশিক সরকারের নিকট সাহায্যের আবেদন করা হয়। কিন্তু সরকার পরিস্থিতি সম্পর্কে যথোচিতরূপে অবহিত হন নাই। অতীব দুঃখের বিষয় যে আজ পর্যন্ত কোনও মন্ত্রী খুলনায় যাইয়া পরিস্থিতির গুরুত্ব প্রত্যক্ষ করেন নাই। বর্তমানে খাদ্যসংকট চরম পর্যায়ে উপনীত হইয়াছে। যেসব লোক বৎসরের পর বৎসর অপরের মুখের গ্রাস যোগাইতো আজ তাহারা ঘাস ও গাছের পাতা খাইয়া দিনের পর দিন মৃত্যুমুখে অগ্রসর হইতেছে।[১৩৪] 

মুসলিম লীগ সরকারের মন্ত্রী এবং আমলাবর্গের সাথে মুসলিম লীগের প্রাদেশিক ও জেলা মহকুমা পর্যায়ের নেতাদের একটা অংশের যে বহুক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব, মতবিরোধ এবং সংঘাত ছিলো খুলনা জেলা লীগ সম্পাদকের এই বিবৃতিটি তারই অন্যতম উদাহরণ। ঠিক এই সময় আবার প্রাদেশিক সাহায্য মন্ত্রী মফিজউদ্দীন খুলনায় খাদ্য পরিস্থিতিকে শোচনীয় বলে বর্ণনা করেন। এর থেকে বোঝা যায় সরকারী মহলে, এমনকি মন্ত্রীদের নিজেদের মধ্যেও খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য এবং মতামত বিনিময়ের কতখানি অভাব ছিলো। 

১০ই মে, ১৯৫১ সাপ্তাহিক সৈনিক ‘খুলনায় দুর্ভিক্ষ’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে বলে যে, খুলনার একটি বড়ো অংশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। সরকার সাধারণতঃ কোন অবস্থাকেই সহজে গুরুতর বলে স্বীকার করেন না, কিন্তু খুলনার বর্তমান অবস্থা যে শোচনীয় সে কথা প্রাদেশিক সাহায্য মন্ত্রী মফিজউদ্দীন আহমদও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রপীড়িত অঞ্চলকে অবিলম্বে দুর্ভিক্ষ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়ে সম্পাদকীয়টিতে দুর্ভিক্ষ নিবারণে এগিয়ে আসার জন্যে সরকার ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। তাতে আরও বলা হয় যে, প্রাদেশিক মন্ত্রী প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন যে, একা প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে সেই দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত পাঞ্জাবের বন্যার সময় তাঁরা যেভাবে সেখানে বিপুলভাবে সাহায্য দিয়েছিলেন সেইভাবে পূর্ব বাঙলার এই বিপদের সময় এগিয়ে আসা। 

খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে ময়মনসিংহ এবং উত্তর বাংলা থেকে প্রাপ্ত সংবাদ খুব উদ্বেগজনক বলে সম্পাদকীয়টিতে উল্লেখ করা হয়। অনাবৃষ্টির ফলে ফসলের অবস্থা সেখানে ভয়ানক খারাপ হয়। অবস্থা যাতে আয়ত্তের বাইরে না যায় তার জন্যে সরকারকে তৎপর ও সচেষ্ট হওয়ার জন্যে এতে অনুরোধ জানানো হয়। 

২৭ ও ২৮শে মে তারিখে ঢাকা জেলার নরসিংদীতে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের সংগঠন কাউন্সিলের অধিবেশনে ফরিদপুর ও যশোরের বন্যাপীড়িত এবং খুলনায় বন্যা প্রপীড়িত অঞ্চলের জনগণের সেবার জন্যে নিয়োজিত সরকারী বা অন্য কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সর্বপ্রকার সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হয়।[১৩৫] 

১৭ই জুন ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক বেতার বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন বলেন যে, ঘূর্ণিবার্তা, ঝড়, শিলাবৃষ্টি ও বন্যায় গত কয়মাসে পূর্ব পাকিস্তানের ফরিদপুর, যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, দিনাজপুর, বরিশাল, ঢাকা ইত্যাদি জেলায় কতকগুলি এলাকা বিশেষভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। দুর্গত এলাকাসমূহের আয়তন প্রায় ৩ হাজার বর্গ মাইল এবং তার হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছয় লক্ষাধিক। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন যে, সরকার দুর্গতদের সাহায্যের জন্য ব্যাপক কর্মপন্থা অবলম্বন করছেন। এজন্য ‘প্রধানমন্ত্রীর জরুরী সাহায্য তহবিল’ নামে একটা তহবিল খোলার কথা উল্লেখ করে তাতে মুক্তহস্তে দান করার জন্যে তিনি সহৃদয় ব্যক্তিদের প্রতি আবেদন জানান।[১৩৬] 

যুবলীগ সমর্থক পত্রিকা নওবেলাল নূরুল আমীনের এই বক্তৃতার পর অভিযোগ করেন যে, নরসিংদীতে সেবাকার্যে সহযোগিতা প্রদানে আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও নূরুল আমীন সরকার যুব লীগের সহযোগিতা লাভের কোন প্রচেষ্টা করেননি।[১৩৭] 

বাগেরহাট তমদ্দুন মজলিশের পক্ষ থেকে মহম্মদ আশরফ কর্তৃক প্রেরিত একটি রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, ১৯৫১ সালের জুন মাসে খুলনা জেলার শুধু সাতক্ষীরা ও সদর মহকুমাই নয়, বাগেরহাট মহকুমার দক্ষিণ এবং পূর্ব অঞ্চলেও প্রায় দুমাস থেকে ব্যাপক দুর্ভিক্ষাবস্থা শুরু হয়েছে।[১৩৮] চৈত্র মাস থেকে এই সব অঞ্চলের লোকেরা খাদ্যাভাবে আলু কচু পোড়া ইত্যাদি খেয়ে জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, খাদ্য সংকটের সাথে কলেরা বসন্তের প্রকোপ তাদের জীবনকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। 

যাদের কিছু জমিজমা ছিলো তারাও প্রথম অবস্থায় তা বিক্রি করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। এক কচুয়া রেজিস্ট্রী অফিসে যেখানে পূর্বে দিনে আর্ট নয়টার বেশী দলিল রেজিস্ট্রী হতো না, সেখানে দিনে একশো থেকে দুশো পর্যন্ত দলিল এই সময়ে রেজিস্ট্রী হতে দেখা গেছে। এই সমস্ত জমিই মানুষ পানির দরে বিক্রি করেছে। কেউ কেউ সামান্য সরকারী ঋণও পেয়েছে। 

কিন্তু এই এলাকার অধিকাংশ লোকই ভূমিহীন। তাদের না আছে জমি, না আছে সরকারী ঋণ পাওয়ার সম্পত্তিগত যোগ্যতা। এর ফলে তাদের অবস্থা সহজেই অনুমান করা চলে। গ্রামে গ্রামে কঙ্কালসার মানুষের মিছিল বের হয়েছে। শরণখোলা থানার খালিয়া ইউনিয়নে দেখা যায় যে, কোন কোন বাড়ীতে আগে যেখানে ছয় সাতজন মানুষ ছিলো, সেখানে খাদ্যাভাব ও মহামারীতে চার পাঁচ জনই মারা গেছে। বাকী দুইজন একজন কোন রকমে টিকে আছে। মৃতদেহ সৎকার করার মতো লোকও এলাকায় তেমন নেই। এই সমস্ত অঞ্চলের ভূমিহীন কৃষকরা স্থানীয় মহাজন, তালুকদার, জোতদার প্রভৃতিদের জমিতে চাষ করে এক-চতুর্থাংশ মজুরী হিসেবে পেতো। তার দ্বারাই তাঁরা সারা বৎসরের ভরণ-পোষণ চালাতো। কিন্তু এ সময় মহাজনেরা আর কোন লোক খাটাতে পারে না। এই সবের ফলে বাগেরহাট শহর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অসংখ্য ভিক্ষুক ও বেকার মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে। 

কৃষিকার্যের অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্টটিতে বলা হয় যে, গো-মড়কে এইসব এলাকার অধিকাংশ কৃষকের গরু-বাছুর প্রায় শেষ হয়ে গেছে। গরু খরিদ করার জন্যে কোন কোন এলাকায় সরকার থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে কিন্তু এই ঋণ প্রয়োজনের তুলনায় এতো অল্প যে একজন গৃহস্থের পক্ষে সেই টাকা দিয়ে গরু তো দূরের কথা একটা ছাগল পর্যন্ত কেনা সম্ভব নয়। মোট কথা, নানা কারণে এই খাদ্য সংকটগ্রস্ত এলাকাগুলিতে এ বৎসর কৃষকদের পক্ষে সমস্ত জমি চাষ করা কোনমতেই সম্ভব নয়। 

সরকারী খাদ্যনীতি সম্পর্কে এতে বলা হয় যে, এই সমস্ত এলাকায় সরকার রীতিমতো ব্যবসা আরম্ভ করেছে। পৌষ মাসে ধান সংগ্রহের সময় সরকার ৫/৬ টাকা মণ দরে কৃষকদের থেকে ধান কিনে সেই ধান এই সংকটময় পরিস্থিতিতে কৃষকদের দুর্দিনে তাঁদের কাছে ১১/১২ টাকায় বিক্রির জন্যে পাঠাচ্ছে। কিন্তু এত উচ্চহারে ধান কেনার ক্ষমতা এই এলাকায় কৃষক অথবা নিম্নমধ্যবিত্তের নেই।[১৩৯] 

খুলনা, যশোর ও ফরিদপুরের বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় সাহায্যের জন্যে তমদ্দুন মজলিশ ২৯শে মে ‘দুর্গত এলাকা দিবস’ পালন করে। সেদিন মজলিশ কর্মীরা ঢাকার রাস্তায় গান গেয়ে দুর্গত এলাকার জন্যে সাহায্য সংগ্রহ করেছিলেন। সেইভাবে সংগৃহীত অর্থ এবং অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে তমদ্দুন মজলিশের কয়েকজন কর্মী দুর্গত এলাকায় সাহায্যের জন্যে যান এবং খুলনার অবস্থা সম্পর্কে একটা বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এ.আই. তাহা কর্তৃক লিখিত এই রিপোর্টের কিছু অংশ নীচে উদ্ধৃত করা গেলো : 

আমরা পাইকগাছা পৌঁছেই যে দৃশ্য প্রথমে দেখলাম সেটি হলো এই: একটি মেয়েছেলে, পরণে তার ছেঁড়া মশারীর এক টুকরো। বুকে ছোট শিশু, কম্পিত গলায় হাত বাড়িয়ে বলে, “বাবা একটু খেতে দেবে?” বিজলীর চমকের মতো শরীর শিহরে উঠলো; এই নগ্ন দৃশ্য যেন আর কোথায় দেখেছি? এই কম্পিত গলার আওয়াজ আরো যেন কোথায় শুনেছি? সমস্ত দেহ অবশ হয়ে এলো ‘৫০’ সালে[১৪০] মর্মান্তিক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলে – প্রশ্ন মনে জাগলো আবার সেই কলঙ্কিত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে কি? নদী পার হয়ে এগিয়ে চললাম – গ্রামের পর গ্রাম দেখে মনে হতে লাগলো যেন প্রাণশূন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে সব। একটি গ্রামের পাশে এসে দাঁড়ালাম – দেখে মনে হলো জনশূন্য। আমাদের সাথী স্থানীয় একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম এই গ্রামে কি লোকজন নেই? সে বল্লে, “এ গ্রামের পুরুষরা একমুঠো চালের আশায় সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ছেলেমেয়েরা কাপড়ের অভাবে বাইরে বেরোতে পাচ্ছে না।” হয়ত বা তারা কয়দিন ধরে উপবাসী, কথা বলবার শক্তিটুকু তাদের মাঝে আর বাকী নেই। লস্কর গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ একটি জীর্ণ দীর্ণ কুঁড়েঘর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম আজ ২ দিন ধরে তারা উপবাসী, ঘরে এক কণা চাল নাই – ছেলেদের পিতা কলেরায় আক্রান্ত। ওষুধ কেনা বা ডাক্তার দেখার মত একটি পয়সাও তাদের কাছে নেই। সেই বাড়ীর একটি ছেলে (দশ এগারো বছর বয়স হবে) জানালো তার বাবা দুদিন বিনামূল্যে চাল বিতরণ কেন্দ্র থেকে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছে। বান্দিকাটি গ্রামে গিয়ে খবর পেলাম গত মাসের তেইশ তারিখে সোনাগাজির মা ক্ষুধার তাড়নায় আত্মহত্যা করেছে। বিভিন্ন সূত্রে খবর পেলাম সারা দুর্ভিক্ষ অঞ্চলে এরূপ হৃদয় বিদারক কাণ্ড প্রায় ঘটছে… ক্ষুধার তাড়নায় প্রত্যহ কয়েকশত লোক তাদের জমি মহাজনের কাছে বন্ধক দিচ্ছে। যেখানে দলিল লেখা হচ্ছে ৫/৬ শ সেখানে তারা পাচ্ছে মাত্র পঁচিশ টাকা। চাষীদের শেষ সম্বল এক টুকরো জমিও আজ মহাজনের করতলগত হয়ে যাচ্ছে। সুতারখানি ইউনিয়নের ফকির সর্দারের একই অবস্থা। সাব রেজিস্ট্রারের অফিসের সামনে অসম্ভব ভিড়। আমরা সাব রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে অনেকগুলি দলিল নিজেরা পড়ে দেখলাম। তাতে জমি সরাসরি বিক্রির কথা লেখা রয়েছে – বন্ধক অথবা ফেরত দেবার কোন কথাই তাতে উল্লেখ নেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম দরিদ্র অসহায় কৃষকদের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে মহাজনেরা ফেরত দেবার প্রশ্নটা মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষান্ত হয়ে রয়েছে – দলিলে তার বিন্দুমাত্রও উল্লেখ নেই। আমরা রেজিস্ট্রারী অফিসের বাইরে এসে চাষীদের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম এবং বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে যখন এক একজন তাদের ওপর মহাজন, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, মাতব্বর প্রভৃতির অত্যাচার ও নিজেদের দুর্দশার কথা বর্ণনা করতে করতে আমাদের সাথে সাথে এগুচ্ছিলো, তখন এই অর্ধউলঙ্গ বুভুক্ষু গরীব চাষী মজুরদের দেখে মনে হচ্ছিলো এ যেন ভুখা জনগণের মিছিল…।

আমাদের সরকার জোর গলায় প্রচার করছেন অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করা হবে। সেই সাথে আমরা দেখছি প্রত্যহ খুলনার হাজার হাজার চাষী ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হচ্ছে। আর মহাজনেরা রাতারাতি নামমাত্র মূল্যে জমি কিনে বিরাট বিরাট জমিদার হয়ে যাচ্ছে। পাইকগাছা বাজারের উপর অবস্থিত কয়েকটি এলাকার মধ্যে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে এইরূপ দলিলের সংখ্যা হলো ১৯৫০ সালের জানুয়ারীতে ১০৫টি, ৫১ সালের জানুয়ারীতে ৫৪৭টি, দিন দিন এ সংখ্যা আরও বেড়ে যাচ্ছে। ‘৫০সালের জুন মাসে হয়েছে ৩৪৭টি আর ৫১ সালের মে মাসে হয় ১৩৪১টি। ৫০ সালের জুন মাসে হয়েছে ৬৪২টি আর ৫১ সালের ২৬ তাং বেলা চারটা পর্যন্ত হয় ১৬১৯টি। মহাজনরা বন্ধক দেওয়ার ভাঁওতা দিয়ে এই সব জমি সরাসরি কিনে নিচ্ছে। সেখানে মহাজনরা যাদের কাছে থেকে জমি কিনেছে তাদের আবার দিনমজুর হিসেবে নিয়োগ করছে অনেকে আবার তাও করছে না। 

কিন্তু শুধু খুলনা নয়। পূর্ব বাঙলার অন্যান্য জেলাতেও এই সময় খাদ্য সংকটের তীব্রতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের কার্যকরী সংসদের সদস্য মোহাম্মদ আবদুস সামাদ কর্তৃক নওবেলাল সম্পাদকের কাছে লেখা একটা চিঠিতে এই সময় সিলেট জেলার দিরাই ও জগন্নাথপুর থানার খাদ্যসংকট সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।[১৪১ প্রথম দিকে অনাবৃষ্টিতে এই অঞ্চলের উঁচু জমিগুলির ফসল নষ্ট হয়। তারপর বৈশাখের পূর্বে শিলাবৃষ্টিতে পাকা ধান অনেক পরিমাণে বিনষ্ট হয়। তারপরও যা কিছু অবশিষ্ট ছিলো বন্যার পানিতে তাও নষ্ট করে দেয়। এ সবের পর মহাজনের নির্যাতন। যারা কিছু ধান ঘরে তুলেছিলো 

তাদের ভাঁড়ার এই মহাজনেরা শূন্য করে দিলো। এই অঞ্চলের দুর্দশা সত্ত্বেও সরকারী সাহায্যের কোন চিহ্ন মাত্র সেখানে অনুপস্থিত। জগন্নাথপুর এবং সেই সাথে ছাতকের অবস্থা এরপর আরও অবনতি ঘটে। ১৪ই নভেম্বর ১৯৫১ তারিখে নওবেলালে জগন্নাথপুরের ৩৫ ব্যক্তি একটি চিঠিতে এই অঞ্চলের দুর্দশার একটা বর্ণনা দেন। ছাতক সম্পর্কেও একটি রিপোর্ট ঐ তারিখেই নওবেলালে প্রকাশিত হয়। 

সুনামগঞ্জের বোরো অঞ্চলেও শিলাবৃষ্টির ফলে ব্যাপকভাবে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সেখানে নিদারুণ খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এই অবস্থায় সরকার এই মহকুমার বর্ডার অঞ্চল ছাতক থেকে শুরু করে মহিষখোলা পর্যন্ত ভারতীয় বর্ডার থেকে পাঁচ মাইল ভিতরের এলাকাকে রেশনিং এলাকা বলে ঘোষণা করেন। এই এলাকার অধিবাসীদিগকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, তাঁরা এই পাঁচ মাইলের বাইরে ধান কিংবা চাল নিয়ে যেতে পারবে না। এই পাঁচ মাইল এলাকার ভেতরের বাজারেও ৫ সের চাল ও ১০ সের ধান এর বেশী নেওয়া চলবে না। এই এলাকার উদ্বৃত্ত ধান সরকার ৮ টাকা মণ দরে ক্রয় করবেন এবং যাদের খোরাকীর অভাব ঘটবে তাদেরকে সেই ধান ১০ টাকা মণ দরে বিক্রি করবেন। এই সরকারী খাদ্যনীতির ফলে কৃষকেরা নিজেদের ক্ষতির পরিমাণের দিকে তাকিয়ে সরকারের কাছে ধান বিক্রির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। এবং উচ্চতর মূল্যে সেই ধান বিক্রির ব্যবস্থা করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চোরাকারবারী, স্থানীয় মাতব্বর, আনসার এবং বর্ডার সিপাইদের খপ্পরে পড়ে।[১৪২] 

১৯৫১ সালের শেষ দিকে খুলনায় বিভিন্ন এলাকার অবস্থার কোন উন্নতি না ঘটে বরং আরও অবনতি ঘটে। এর ফলে সরকার তাঁদের পূর্ববর্তী ঔদাসীন্য কাটিয়ে খাদ্যসংকটকে স্বীকার করে সেই সংকট নিরসনের জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দান করে এবং উদ্যোগ নেয়। ৮ই নভেম্বর ফজলুল হক খুলনা ও বরিশালের দুর্ভিক্ষ ও বন্যা পীড়িত জনগণের সাহায্যের জন্যে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আবেদন জানান।[১৪৩] এর মাত্র কয়েক দিন পর ১৩ই নভেম্বর তিনি আবার বিশেষভাবে খুলনার দুস্থদের জন্যে একটা পৃথক আবেদন প্রচার করেন।[১৪৪] ১১ই নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় খুলনার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঁচ কোটি টাকার সাহায্য দাবী করা হয়[১৪৫]। এর পর ঢাকায় খুলনার জন্যে অর্থ ও বস্ত্র সংগ্রহ শুরু হয় এবং ঢাকার নাগরিকেরা অনেকেই তাতে সহযোগিতা করেন।[১৪৬] 

এই সময় সমগ্ৰ খাদ্য পরিস্থিতি, বিশেষতঃ খুলনার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদপত্রে নানা ধরনের ভয়াবহ রিপোর্ট প্রকাশিত হতে থাকলেও পূর্ব বাঙলার সাহায্য মন্ত্রী মফিজউদ্দীন ১৮ই নভেম্বর করাচীতে বলেন যে, খুলনা জেলায় অনাহারে কেউ মারা যায় নাই। যারা মারা গেছে তাঁদের মৃত্যুর কারণ পুষ্টির অভাব।[১৪৭] 

সাহায্য মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সাথে সঙ্গতি রেখে পূর্ব বাঙলা সরকার ২৭শে নভেম্বর ১৯৫১ তারিখে খুলনা ও বরিশাল সম্পর্কে নিম্নলিখিত প্রেস নোট জারী করে : 

সম্প্রতি কয়েকদিন সংবাদপত্রে এই রূপ প্রকাশিত হইয়াছে যে, খুলনা ও বরিশাল জেলায় অনশনে লোকের মৃত্যু হইতেছে। এই দুইটি জেলার বন্যাপীড়িত এলাকায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষগণ এই পর্যন্ত যতটুকু তদন্ত করিয়াছেন এবং সরকারের নিকট তাঁহারা এই সম্পর্কে যে সমস্ত রিপোর্ট দিয়াছেন, তাহা হইতে জানা যায়, এই সকল সংবাদের মধ্যে কোন সত্যতা নাই এবং অনশনে কাহারও মৃত্যু হয় নাই। খুলনা জেলায় কোন ক্ষেত্রে হয়ত অপুষ্টিই এই মৃত্যুর কারণ, অবশ্য অন্যান্য কারণও থাকিতে পারে, কিন্তু অনশনে মৃত্যুর সংবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রাদেশিক সাহায্য সচিব নিজে খুলনা জেলা সফর করিয়া আসিয়া এই সম্পর্কে এক বিবৃতি দিয়াছেন। 

১৩. লবণসংকট 

১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব বাঙলায় লবণসংকট একটা চরম আকার ধারণ করে। এই সংকটকালে লবণের দর ক্রমাগত ওপরের দিকে ওঠা শুরু করে শেষ পর্যন্ত তা দাঁড়ায় সের প্রতি ১৬ টাকায়। খাদ্যসংকট দেখা দিলে যেভাবে মানুষ বিপদগ্রস্ত হয় সেভাবে বিপদগ্রস্ত না হলেও এই সংকটের ফলে মানুষের, বিশেষতঃ গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের কষ্ট দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। 

কৃষকেরা সাধারণতঃ শহরবাসী মধ্যবিত্তদের থেকে লবণ বেশী ব্যবহার করেন। এর মূল কারণ তাঁদের দৈনন্দিন খাদ্যের মধ্যে বৈচিত্র্যের অভাব। তাঁরা প্রতিদিন পান্তাভাত খেতে অভ্যস্ত। পান্তা খাওয়ার সময় লবণ এবং লঙ্কা দুইই লাগে। বিশেষ করে লবণ এক্ষেত্রে অপরিহার্য। তাছাড়া ডাল, মাছ অথবা যে সামান্য তরিতরকারী রান্না হয় তার পরিমাণ অল্প হওয়ার ফলে অকুলান এড়ানোর জন্যে তাদেরকে বেশী করে ঝোল রাখতে হয়। এর ফলে লবণের খরচা বাড়ে। মোট কথা, গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র কৃষকদের সামান্য খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যে লবণের স্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এই গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যের মূল্য তিন চার আনা থেকে ১৬ টাকায় ওঠার পরিণাম তাদের জীবনে কি ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা চলে। 

৩রা অক্টোবর ‘বাজার দর’ নামক একটি সম্পাদকীয়তে দৈনিক আজাদ উল্লেখ করে যে, পূর্ব পাকিস্তানে লবণ বারো আনা থেকে দুই টাকা সের দরে বিক্রি হচ্ছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি ঢাকা শহরের অবস্থার ওপর অন্য একটি রিপোর্টে বলা হয় যে, শতকরা আশি জনের জীবনই সেখানে এক ভয়াবহ আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। নুনভাতের সংস্থান করাও তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ শহরে লবণের দর সের প্রতি এক টাকা আট আনা। মফস্বলে কোথাও কোথাও তিন টাকা সের দরে লবণ বিক্রি হচ্ছে বলেও রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়।[১৪৮] 

১২ই অক্টোবর করাচীর ইংরাজী দৈনিক ডন পূর্ব বাঙলায় লবণ সমস্যার ওপর একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে মন্তব্য করে যে সরকার তৎপর হলেই পূর্ব বাঙলার লবণ সমস্যা এড়ানো সম্ভব হতো।[১৪৯] 

অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লবণ সংকট সম্পর্কে ঢাকা বণিক সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন নিম্নলিখিত বিবৃতি দান করেন : 

পূর্ব পাকিস্তানে লবণের দুষ্প্রাপ্যতার জন্যে প্রদেশের সর্বত্র গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি হইয়াছে। লবণের অভাবের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন মত পোষণ করেন। কিন্তু সাধারণভাবে ইহার আসল কারণ কাহারও জানা নাই। তবে করাচী হইতে অপর্যাপ্ত সরবরাহই যে ইহার মূল কারণ তাহা নিঃসন্দেহে বলা চলে। সরকার নিযুক্ত লোভী আড়তদারদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভই সম্ভবতঃ বর্তমান পরিস্থিতির কারণ। সরকারী হিসাবমতে পূর্ব পাকিস্তানে বার্ষিক ৭৫ লক্ষ মণ লবণের প্রয়োজন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দাগণ সাধারণতঃ সামুদ্রিক লবণ ব্যবহার করে না। তথায় বৎসরে মাত্র ৬ লক্ষ মণ লবণ খরচ হয়। ইহাও সর্বজনবিদিত যে, সরকার দেশী শিল্পকে উৎসাহ দানের জন্যে বাহির হইতে লবণ আমদানী সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করিয়া দেওয়ার নীতি অবলম্বন করিয়াছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ৫টি লবণের কারখানা রহিয়াছে এবং তাহাতে বৎসরে ৫২ লক্ষ মণ লবণ উৎপন্ন হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও সেরূপ নামকরা কারখানা নাই। সুতরাং দেশে যে লবণ উৎপন্ন হয় তাহাতে শেষ পর্যন্ত প্রয়োজন অপেক্ষা বৎসরে ৩৯ লক্ষ মণ লবণ ঘাটতি পড়ে। অর্থাৎ দেশের প্রয়োজনের তুলনায় পাকিস্তানে লবণ উৎপাদনের পরিমাণ খুবই কম। সুতরাং উৎপাদন বৃদ্ধি বা বিদেশ হইতে লবণ আমদানী ব্যতিরেকে অন্য কোন উপায়ে দেশের প্রয়োজন মিটানো সম্ভবপর নয়। 

সরকার কর্তৃক লবণ আমদানী বন্ধ হওয়ার পর হইতেই আমি লবণের নিশ্চিত ঘাটতি অনুমান করিয়াছিলাম। আমি সরকারকে ভারত এবং অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্র হইতে লবণ আমদানীর অনুমতি দানের জন্য অনুরোধ করিয়াছিলাম। আমার প্রস্তাব অনুযায়ীই গত এপ্রিল মাসে বৈদেশিক বাণিজ্য উন্নয়ন পরিষদ বিদেশ হইতে লবণ আমদানীর অনুমতি দানের সোপারেশ জানাইয়াছিলেন। কিন্তু সরকার এ সম্পর্কে এখনও কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নাই। ঢাকা বণিক সমিতিতে প্রায় একই সময় খাদ্যমন্ত্রীর নিকট অনুরূপ সোপারে জানাইছিলো। কিন্তু এ সম্পর্কেও এখন পর্যন্ত কিছু করা হয় নাই। 

উৎপাদনের স্বল্পতা ছাড়া প্রদেশে লবণের বিলিব্যবস্থাও যথেষ্ট ভালোই রহিয়াছে। চট্টগ্রাম বন্দরে লবণ খালাস ও তাহা হইতে অন্যত্র চালান দেওয়ার ভার একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া। 

এ সম্পর্কে আমি আরও জানাইতে চাই যে, পশ্চিম পাকিস্তানে চা ও পানের অভাব থাকায় তথাকার বাসিন্দাগণকে বিদেশ হইতে এই উভয়বিধ দ্রব্য আমদানীর অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। 

স্বদেশী দ্রব্যের পৃষ্ঠপোষকতা করিতে যাইয়া পূর্ববঙ্গের অধিবাসীগণকে এক সের লবণের জন্য যখন ২.০০ টাকা হইতে ৩.০০ টাকা ব্যয় করিতে হইতেছে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীগণ কোন যুক্তিতে বিদেশ হইতে পান ও চা আমদানী করিয়া নিজেদের ঘাটতি পূরণের অনুমতি পাইতেছে? একই পরিস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন নীতি গৃহীত হইতে পারে কিরূপে? এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে করাচীতে বর্তমানে মাত্র দুই আনা সের দরে লবণ বিক্রয় হইতেছে।[১৫০] 

চট্টগ্রাম ব্যবসায়ী সংঘের অনারারী সেক্রেটারী এমএ ইদ্রিস ২৪শে নভেম্বর লবণ দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের খাদ্য ও কৃষি সচিবের নিকট প্রেরিত এক স্মারকলিপিতে বলেন যে, বিদেশী লবণ আমদানীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করার ফলেই পূর্ব পাকিস্তানে লবণের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।[১৫১] 

২৭শে অক্টোবর লবণ সমস্যা আলোচনার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবৃন্দ সলিমুল্লাহ মুসলিম হল প্রাঙ্গণে সমবেত হন। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন আখতারউদ্দীন আহমদ। পাকিস্তান সরকারের লবণ নীতির তীব্র সমালোচনা করে সেই সভায় বলা হয় যে, লবণ সমস্যাকে পৃথকভাবে না দেখে তাকে অন্যান্য সমস্যাসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। সভা শেষ হওয়ার পর পাঁচ শত ছাত্র পূর্ব বাঙলা সরকারের সরবরাহ মন্ত্রী সৈয়দ আফজালের বাসভবনে যান। বাসভবনে মন্ত্রী অনুপস্থিত থাকায় ছাত্রেরা সেক্রেটারীয়েটের দিকে অগ্রসর হন। সেক্রেটারীয়েটের সামনে শোভাযাত্রাটি আকস্মিকভাবে উপস্থিত হওয়ায় তাদেরকে প্রবেশ পথে বাধা দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা সম্ভব হয়নি। তার ফলে ছাত্রেরা সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে প্রবেশ করে ‘সরবরাহ মন্ত্রী গদী ছাড়’, ‘লবণ কেলেঙ্কারীর তদন্ত চাই’, ‘চোরাকারবারী কালোবাজারী বন্ধ কর’ ইত্যাদি ধ্বনি তোলেন। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন পুলিশ সার্জেন্ট সেক্রেটারীয়েট প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। এরপর বিভিন্ন ধ্বনি দিতে দিতে ছাত্র বিক্ষোভ মিছিলটি সেক্রেটারীয়েট এলাকা পরিত্যাগ করে। এ সময় ঢাকা শহরে লবণের এত বেশী অভাব দেখা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তম ছাত্রাবাস সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের খাদ্য তালিকা পরিবর্তন করে ছাত্রদেরকে দই সহযোগে ভাত খেতে দেওয়া হয়।[১৫২] 

এই সময় দ্রব্যমূল্য বিষয়ক একটি বিবরণে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় লবণসংকট সম্পর্কে বলা হয়: 

লবণ জিনিসটা ইদানীং মানুষের নিকট মণিমাণিক্যের ন্যায় দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ হইয়া উঠিয়াছে। ঢাকার বাজারে লবণের মূল্য সের প্রতি ৫ টাকা হইতে ৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হওয়ার সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। ত্রিপুরার ভাঁকশার হইতে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে যে, তথায় সের প্রতি ১৬.০০ টাকা দরে লবণ বিক্রয় হইতেছে।[১৫৩] 

১লা নভেম্বর ‘গদী ছাড়’ নামক একটি সম্পাদকীয়তে নওবেলাল পত্রিকায় লবণ সম্পর্কে বলা হয় : 

এইবার লবণের দুর্ভিক্ষ চরম আকার ধারণ করিয়াছে। সারা পূর্ববঙ্গ জুড়িয়াই লবণের দুষ্প্রাপ্যতা হেতু চড়া দর ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে। সের প্রতি দুই টাকা হইতে আরম্ভ করিয়া স্থান বিশেষে ষোলো টাকায় পর্যন্ত লবণ খরিদ করিতে লোকে বাধ্য হইতেছে। এই অত্যাবশ্যকীয় এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাবে জনসাধারণের দুর্দশার অবধি নাই। তাই চারদিক হইতে কিছু কিছু সোরগোল উঠিয়াছে। আমাদের আফজল মন্ত্রী আবার বিবৃতি ঝাড়িয়াছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের শৈথিল্য ও অব্যবস্থার জন্যই নাকি এই বিড়ম্বনা। ১৫৪ ২রা নভেম্বর তারিখে ঢাকার আর্মানীটোলা ময়দানে কফিলউদ্দীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে একটি জনসভা হয়।[১৫৫] তাতে প্রায় পনেরো হাজার লোক যোগদান করে। সভায় লবণ সমস্যা সম্পর্কে বক্তৃতা প্রসঙ্গে আতাউর রহমান খান বলেন যে, গড়ে দুটাকা করে হলেও পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর নয় কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের ওপর এবং প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর দোষ চাপাতে চেষ্টা করেছেন। বস্তুতঃপক্ষে উভয় সরকারই এই লবণ সমস্যার জন্যে দায়ী। 

পূর্ব বাঙলা পরিষদে উত্থাপিত জননিরাপত্তা বিলের উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, পাকিস্তান অর্জনের জন্যে যারা সংগ্রাম করেছিলো সরকার তাঁদেরকে কারাপ্রাচীরের অন্তরালে আশ্রয় দিয়েছেন। প্রদেশের বর্তমান শাসকগণ সমালোচনার ভয়ে এই সমস্ত কর্মীকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বিনা বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানকে জেলে আটক রাখার কথা উল্লেখ করেন। 

আতাউর রহমান সরকার কর্তৃক জননিরাপত্তা আইনের বলে রাজনৈতিক কর্মীদেরকে বিনা বিচারে আটক রাখার বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সুসংহত আন্দোলন চালানোর আহ্বান জানান। সভায় কমরুদ্দীন আহমদ এবং আবদুল জব্বার খদ্দরও বক্তৃতা করেন। খদ্দর তাঁর বক্তৃতায় লবণ দুর্ভিক্ষের জন্যে সরকারকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করে বলেন যে, চট্টগ্রামের কক্সবাজার এবং আরও কয়েকটি এলাকায় এবং নোয়াখালি জেলায় লবণ প্রস্তুতের যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রাদেশিক সরকার ইচ্ছে করে সে সম্পর্কে কোনও ব্যবস্থা অবলম্বন করেনি। 

এই সভায় একটি প্রস্তাবে সরিষার তৈল, নারিকেল তৈল, মশলা, জ্বালানী কাঠ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। অপর প্রস্তাবে প্রতিক্রিয়াশীল অর্ডিন্যান্সের সাহায্যে বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ করে স্বৈরাচারী শাসন প্রচলনের চেষ্টার তীব্র নিন্দা করা হয়। দাবী করা হয় নিরাপত্তা বন্দীদের মুক্তি অথবা বিচারের। 

সভা অন্য একটি প্রস্তাবে পূর্ব বাঙলা আইন পরিষদের সদস্যদের অনুরোধ জানায় যে, তারা যেন বর্তমান সরকারের নিরাপত্তা এবং আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্যে পরিষদে উত্থাপিত জননিরাপত্তা বিল গ্রহণ না করেন। 

২৪শে অক্টোবর পূর্ব বাঙলা পরিষদের স্পীকার সরবরাহ মন্ত্রী সৈয়দ আফজলকে লবণ পরিস্থিতির ওপর বিবৃতি দেওয়ার জন্যে আহ্বান করলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং মনোরঞ্জন ধর এ বিবৃতিটি পরিষদে আলোচনার প্রস্তাব করেন। তাঁরা বলেন যে, সমস্যাটি অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ সে জন্যে শুধু মন্ত্রীর বিবৃতি দ্বারা কোন ফায়দা হবে না। সমস্যাটির বিভিন্ন দিক নিয়ে পরিষদে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু তাঁদের এই অনুরোধের উত্তরে স্পীকার জানান যে সরবরাহ মন্ত্রীর বিবৃতিটি আলোচনার অনুমতি দিতে তিনি অনিচ্ছুক। এই অবস্থায় মনোরঞ্জন ধর বলেন যে, শুধু মন্ত্রীর বিবৃতি শোনার প্রয়োজন নেই, তাঁরা খবরের কাগজেই সে বিবৃতি পড়ে নিতে পারবেন। এর জবাবে স্পীকার বলেন যে, তাঁরা যদি মন্ত্রীর বিবৃতি শুনতে রাজী না থাকেন তাহলে তাঁর বিবৃতি দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।[১৫৬]

কিন্তু অক্টোবরের ২৪ তারিখে স্পীকারের এই মনোভাব এবং বক্তব্য সত্ত্বেও পরিষদে লবণ সমস্যার ওপর বিতর্ককে তাঁরা বেশী দিন ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেন না। এর কারণ একদিকে লবণ সমস্যার তীব্রতা বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে লবণসংকটের বিরুদ্ধে জনগণের উত্তরোত্তর সংগঠিত বিক্ষোভ। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২রা নভেম্বর পূর্ব বাঙলা পরিষদে সরবরাহ মন্ত্রী লবণ সমস্যার ওপর একটি বিবৃতি দেন এবং সেই বিবৃতিটির ওপর বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। 

সরবরাহ মন্ত্রী তাঁর পরিষদ বিবৃতিতে লবণসংকটের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: 

১৯৫০ সালের আগস্ট মাসে প্রাদেশিক সরকার লবণের দর বৃদ্ধির ব্যাপারটা লক্ষ্য করেন। করাচী থেকে যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা লবণ সরবরাহ করে তাঁদের একচেটিয়া মনোভাবের জন্যেই দরবৃদ্ধি হচ্ছিলো বলে মনে হয়েছিলো। তাঁদের কার্যকলাপে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই প্রাদেশিক সরকার লবণের দরকে যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে রাখার জন্যে একটি স্টাটুটারী আদেশ জারী করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুযায়ী ১৯৫০-এর ৩০শে আগস্ট পূর্ব বাঙলা লবণ নিয়ন্ত্রণ আদেশ জারী করা হয়। এই আদেশ অনুযায়ী পাইকারী দর নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হয় এবং স্থানীয় অফিসারদেরকে ক্ষমতা দেওয়া হয় প্রয়োজনমতো সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দরে লবণ বিতরণ করার। এই আদেশের আওতা থেকে খুচরো ব্যবসাকে বাদ রাখা হয়েছিলো এজন্যে যে, বহুসংখ্যক অল্পবিত্ত লোকে প্রদেশের সমস্ত বাজার এবং হাটে এ ধরনের ব্যবসা করছিলো এবং তাঁদের লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তার ফলে বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের ছোটখাটো কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি দেখা দিতে পারতো। ওপরের এই ব্যবস্থাকে মনে করা হয়েছিলো যথেষ্ট। সুতরাং প্রাদেশিক সরকার প্রস্তাব করেছিলেন যে, কেন্দ্রের উচিত প্রদেশের মধ্যে লবণ সরবরাহ বৃদ্ধি করা এবং সরকারী খাতে লবণ আমদানী করা। কেন্দ্রীয় সরকার নিজেরাই লবণের ব্যবস্থা করবেন স্থির করায় এই প্রস্তাব কার্যকর করা হয়নি। ১৩ই নভেম্বর ১৯৫০ তাঁরা আঞ্চলিক লবণ নিয়ন্ত্রণ আদেশ জারী করেন। সেই আদেশ অনুযায়ী লবণের বেচাকেনা এবং চালান কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে এসে পড়ে। 

বিদেশ থেকে আমদানীও লাইসেন্সভুক্ত করা হয়। ১৯৫০-এর ১৪ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার সামুদ্রিক লবণের একচেটিয়া সংগ্রহের এবং নিজেদের একাউন্টে তা পূর্ব বাঙলায় চালান দেওয়ার স্কীম চালু করেন। প্রাদেশিক সরকার পূর্ব বাঙলায় লবণ সরবরাহের ব্যাপারে কোন চিন্তা করে থাকলে সে বিষয়ে কোন কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্যেও তাঁরা তাঁদেরকে বলেন। ব্যাখ্যা হিসাবে বলা হয় যে, করাচী সল্ট ওয়ার্কার্স-এ সামুদ্রিক লবণের এমন বিরাট মজুদ আছে যা পূর্ব বাঙলার চাহিদা মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট। আমরা সেই একচেটিয়া স্কীমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি, কারণ বেসরকারী আমদানীকারকদেরকে একেবারে বাদ দিয়ে পুরো দায়িত্ব ঘাড়ে নেওয়াকে নীতি হিসেবে আমরা সমীচীন মনে করিনি। এসব কথায় কোন কান দেওয়া হয়নি। 

১৯৫০-এর ডিসেম্বর থেকে প্রাদেশিক সরকার যথেষ্ট উদ্বেগের সাথে লবণের চালান লক্ষ করছিলেন। ২৫ লক্ষ মণ হিসাবকৃত প্রয়োজন সত্ত্বেও ১৯৫১ সালের জানুয়ারী হতে মে পর্যন্ত করাচী থেকে লবণ পাওয়া গেলো ৯,৭০,৯৪২ মণ। এই ঘাটতি মে মাসের মাঝামাঝিই কেন্দ্রীয় সরকারের গোচরীভূত করা হলো এবং তাঁদেরকে এমনভাবে চালান নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হলো যাতে করে মাসে ৫ লক্ষ মণের বেশী সরবরাহ হয় এবং যার ফলে কিছু রিজার্ভ হিসেবে হাতে থাকতে পারে। যাই হোক, জাহাজে জায়গা পেতে অসুবিধা হওয়ার দরুণ কেন্দ্রীয় সরকার চালান আরও দ্রুতগতি করতে অক্ষম হলেন। জুলাই মাসে ৭,৩৭,৬০০ মণ পাওয়া গেল। মে মাসে পরিলক্ষিত ঘাটতি অবস্থার আরও অবনতি ঘটলো জুলাই মাসে এবং বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের মাননীয় মন্ত্রী ডিরেক্টর জেনারেলকে সাথে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করলেন এবং লবণকে O.G.L এর আওতাভুক্ত করার জন্যে চাপ দিলেন। করাচী থেকে চালান দ্রুতগতি করা এবং বিদেশ থেকে আমদানী করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জরুরী তাগাদা পাঠানো হলো। সেপ্টেম্বরেও চাপ অব্যাহত রাখা হলো এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে আবার বলা হলো লবণকে O.G.L এর আওতাভুক্ত করার জন্য। ডিরেক্টর জেনারেল সেপ্টেম্বরে আবার করাচী গেলেন অবস্থার ক্রমাবনতি কেন্দ্রীয় সরকারকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে। বিদেশ থেকে আমদানীর ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্রত্যাখ্যান করা হলো এই যুক্তিতে যে বিদেশী লবণ অধিকতর সস্তা না হতে পারে এবং মাল খালাস করার ব্যাপারে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরের ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ। তাঁরা আমাদেরকে আরও জানালেন যে, উচ্চতর ভাড়া দিয়ে হলেও করাচী পূর্ব বাঙলায় লবণ বহনের জন্যে তার বিদেশী জাহাজ ভাড়া করার ব্যবস্থা করছেন। ডিপার্টমেন্টগত প্রচেষ্টা ছাড়াও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর করাচী সফরকালে খুব জোর দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছেন। লবণের জাহাজ আসা শুরু হলো অক্টোবরের মাঝামাঝি যখন তার দর ইতিমধ্যেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে খুব তাড়াতাড়ি একের পর এক আমরা লবণের জাহাজ পাচ্ছি এবং মাস শেষ হওয়ার পূর্বেই আমরা চট্টগ্রামে ৫টি জাহাজ এবং চালনায় ১টি জাহাজের মাধ্যমে মোট ৭,৪৬,৪২১ মণ করাচী লবণ পেয়েছি। আমাদেরকে আরও জানানো হয়েছে যে, নভেম্বরের মাঝামাঝি আরও ৬টি জাহাজ ৮,৮৭,০০০ মণ নিয়ে রওয়ানা হচ্ছে। সুতরাং আমরা আশা করি ১৯৫১ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে আমাদের ৫ লক্ষ মণের একটা রিজার্ভ দাঁড়াবে।[১৫৭] 

লবণসংকটের কারণ এবং দায়িত্ব সম্পর্কে এই বক্তব্যের পর সরবরাহ মন্ত্রী তার বিবৃতিতে দাবী করেন যে, অক্টোবর মাস থেকে যে সরবরাহ তাঁরা পেয়েছেন তা দ্রুতগতিতে প্রদেশের সর্বত্র পাঠিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রিত দরে লবণ বিতরণের জন্যে স্থানীয় অফিসারদেরকে নির্দেশ দান করা হয়েছিলো। সমস্ত শহরে রেশন দোকানগুলির মাধ্যমে ৪ থেকে ৫ আনা সের দরে লবণ দেওয়া হয়েছিলো। গ্রামাঞ্চলে বাছাই করা খুচরো ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়েছিলো এবং দর নির্ধারিত হয়েছিলো সের প্রতি ৪ থেকে ৬ আনা। লবণ বেচাকেনার ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের কিছু কিছু দুর্নীতির কথা তিনি তার বক্তৃতায় স্বীকার করেন। এবং তাদের বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা আইন প্রয়োগের সিদ্ধান্তের কথা জানান। এর পর তিনি মহকুমা হাকিম এবং মহকুমা মুসলিম লীগের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় লবণের প্রচলিত দরের একটি তালিকা পাঠ করে শোনান। এ প্রসঙ্গে তিনি দাবী করেন যে পরিস্থিতি প্রায় তাঁদের আয়ত্তের মধ্যে এসে গেছে, কারণ লবণের দর পূর্ব বাঙলার কোন স্থানেই সের প্রতি ৬ টাকার বেশী নয়।[১৫৮] 

সরবরাহ সচিবের বক্তৃতার পর মীর আহমদ আলী লবণ সংকট প্রসঙ্গে গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বর্ণনা করে বলেন: 

পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে এ পর্যন্ত লবণের দাম এ রকম হয় নাই। গ্রামে গরীবদের দুর্দশার সীমা নাই। তাদের বুক ভেঙ্গে গেছে। তাদের কান্না যে কেউ শোনে না সে কথা বলাই বাহুল্য। আগুনে জ্বাল দিলে যে পরিমাণ না জ্বলে দুঃখীর আত্মনিনাদ তার চেয়ে বেশী জ্বলে। ১৬ টাকা সের লবণ বিক্রয় হল তাতে গরীবের কোটি কোটি টাকার সর্বনাশ হয়ে গেল।[১৫৯] 

সরবরাহ মন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে প্রাদেশিক সরকারকে বাঁচাবার যে চেষ্টা তাঁর বিবৃতিতে করেছেন সে সম্পর্কে বিনোদচন্দ্র চক্রবর্তী বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের: কাজেই প্রাদেশিক সরকারকেও এ সংকটের দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন যে, লবণ ঘাটতি সম্পর্কে সময়মতো সরকারকে তাঁরা সতর্ক করেছিলেন কিন্তু তারা তাদের কথা গ্রাহ্য করেননি।[১৬০] 

জনগণের দুর্দশার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনিও বলেন : 

আজ মাসাধিককাল যাবৎ লবণসংকটের দরুণ দেশের সকল শ্রেণীর লোককেই কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। আজ যদিও দেশের জনসাধারণ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছে তাহলেও এমন একদিন আসবে যখন তারাও চুপ করে থাকবে না। এখন হয়তো জনসাধারণের সংঘবদ্ধ হওয়ার শক্তি নাই, কথা বলবার শক্তি নাই কিন্তু এমন দিন চিরকাল থাকবে না। দেশের এই সংকটকালে বর্তমান সরকার কোন কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেন নাই, তারা যে যুক্তি দিয়েছেন তাতে জনসাধারণ তুষ্ট হতে পারেন নাই। গভর্নমেন্ট জনসাধারণকে এমনভাবেই চেপে রাখতে চান যাতে কোন প্রকার অসুবিধাতেও তাঁরা মাথা যেন না তুলতে পারে।[১৬১] 

মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টরা অনেক জায়গায় লবণের চোরাকারবার করছে এই মর্মেও তিনি অভিযোগ উত্থাপন করেন।[১৬২] ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকায় ৩১শে অক্টোবর, ১৯৫১ তারিখে নিম্নলিখিত সংবাদটি ছাপা হয়: 

পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী মিস্টার ফজলুর রহমান পাকিস্তান অবজার্ভারকে বলেন যে, পূর্ব বাঙলায় লবণের অভাব এবং তার মূল্য সম্পর্কে রিপোর্টসমূহ খুবই অতিরঞ্জিত। তিনি বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের হাতে বিপুল পরিমাণ লবণ বিতরণের জন্য ন্যস্ত করেন। তিনি আরও বলেন যে, প্রদেশে লবণের ন্যায়সঙ্গত এবং যথোপযুক্ত বিতরণের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের। 

উপরে উদ্ধৃত এই সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী বলেন যে, রাষ্ট্রের দুই প্রান্ত থেকে দুজন দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি দুরকম কথা বলছেন। প্রাদেশিক সরবরাহ সচিব বলছেন যে, আমাদের যে পরিমাণ লবণ প্রয়োজন কেন্দ্রীয় সরকার তা সরবরাহ করেনি। লবণ সরবরাহের পূর্ণ দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার নিজের হাতে নিয়ে সময়মতো সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্ৰীয় বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন তার ঠিক উল্টো। তিনি সংকটের পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করছেন প্রাদেশিক সরকারের কাঁধে। লবণের মূল্য অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে এই প্রসঙ্গে তিনি প্রাদেশিক সরবরাহ মন্ত্রীর বিবৃতির উল্লেখ করে বলেন যে, তাতেই সরকারীভাবে লবণের সের প্রতি দর ৬ টাকা স্বীকার করা হয়েছে, যে লবণ এক সের সাধারণতঃ দশ আনা থেকে চার আনায় পাওয়া যায়।[১৬৩] 

প্রভাস লাহিড়ী আরও বলেন যে, লবণের মধ্যে হাড়ের গুঁড়ো ভেজাল দেওয়া হচ্ছে এবং সেই ভেজাল খেয়ে নারায়ণগঞ্জের হাসপাতালে এক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। চট্টগ্রামেও ভেজাল লবণ খেয়ে লোকে পেটের অসুখে ভুগছে। শুধু হাড় গুঁড়ো নয়, লবণের সাথে চিনিও ভেজাল দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন।[১৬৪] 

সর্বশেষে সরকারকে সতর্ক করে তিনি বলেন: 

আজ লবণের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর পর সরিষার তেল, কোরাসিন তেল এবং নারিকেল তেলের সমস্যা এসে পড়লো বলে। সরিষার তেলের দাম দিন দিন বাড়ছে। পরিষদের অধিবেশন আর থাকবে না। তখন আপনারা একভাবে না একভাবে চালিয়ে যাবেন। প্রকাশ্যভাবে বাহিরে আমাদের কিছু বলবার উপায় নাই; Special Powers Ordinance ঘাড়ের ওপর ঝুলছে। আপনারা হয়তো নির্বিবাদে চালিয়ে যাবেন, কিন্তু তার বিষময় ফলের কথা চিন্তা করবেন।[১৬৫]

২রা নভেম্বর এই পর্যন্ত বিতর্ক চলার পর তা পরদিন পর্যন্ত মুলতুবী রাখা হয়। ৩রা তারিখে লবণ সমস্যার ওপর বিতর্ক আবার শুরু হলে আহমদ হোসেন[১৬৬] বলেন যে, কেন্দ্ৰীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের ওপর এবং প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর লজ্জাকর লবণ সংকটের দায়িত্ব চাপাতে চাইছেন। কিন্তু লবণের ক্ষেত্রে যখন সরকারের একচেটিয়া অধিকার রয়েছে তখন দায়িত্ব ষোলো আনা সরকারেরই, সে সরকার প্রাদেশিক হোক অথবা কেন্দ্রীয়। কেন্দ্রীয় সরকার যে পূর্ব বাংলায় প্রয়োজনীয় এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণ সময়মতো সরবরাহ করতে পারেননি, একথা সকলেই স্বীকার করেছেন। কাজেই সে পর্যন্ত দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। লবণের মূল্য অতিরঞ্জিত করে বলা হচ্ছে, এই মর্মে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী ফজলুর রহমানের বক্তব্যকে তিনি অসম্ভব রকম অযৌক্তিক বলে বর্ণনা করেন। প্রাদেশিক সরকারকেও গুরুতরভাবে দায়ী করে তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে, তাঁরা সরবরাহ ও বিতরণের জন্যে কি করেছেন? তাঁরা কি বিভিন্ন জেলায় নিয়মিত মাসিক সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন? তাঁরা কী মূল্য পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন? তারা কি যথেষ্ট সংখ্যায় এজেন্ট এবং পাইকারী বিক্রেতা নিয়োগ করেছেন? তারা কি তাদেরকে নিয়মিতভাবে লবণ সরবরাহ করেছেন। এর কোন কিছুই তাঁরা করেননি। 

আহমদ হোসেন বলেন যে, তিনি জানেন যে অনেক পাইকারী বিক্রেতা টাকা জমা দেওয়ার কয়েক মাস পরেও তাদেরকে সরবরাহ করা হয়নি। অনেকে পুঁজির অভাবে লবণ তুলতে পারেনি। পাইকারী বিক্রেতা যথেষ্ট সংখ্যায় নিযুক্ত না হওয়ার ফলে সমস্ত এলাকায় বিতরণ সম্ভব হয়নি। প্রাদেশিক সরকারের ৩১শে আগস্ট ১৯৫০-এর লবণ নিয়ন্ত্রণ আদেশ কেবলমাত্র আমদানীকারক ও পাইকারী বিক্রেতার দর নিয়ন্ত্রণ করে খুচরো ব্যবসায়ীদের খপ্পরে ক্রেতাদেরকে সমর্পণ করেছিলো। পাইকারী বিক্রেতাদের থেকে নিয়ন্ত্রিত দরে লবণ কেনার পর তা বহুবার করে হাত বদল হয়েছে, এবং সেগুলি সাধারণ ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর পূর্বেই প্রতি বস্তা ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে, তার জন্যে কারো কোন শাস্তি হয়নি। লবণ নিয়ন্ত্রণ আদেশের ৩ ও ৫ ধারা অনুযায়ী জেলা এবং মহকুমা কন্ট্রোলারদেরকে কোন ব্যক্তি প্রকৃত ডিলার কিনা তা না দেখে তাদেরকে মাল সরবরাহের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার ব্যাপক অপব্যবহারের অভিযোগও আহমদ হোসেন আনেন। এই অপব্যবহারের ফলে লবণের চোরাকারবার ব্যাপকভাবে সম্ভব হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি প্রস্তাব করেন যে, লবণ নিয়ন্ত্রণ আইন তৎক্ষণাৎ সংশোধন করে খুচরো দর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা হোক। সুরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত তাঁর বক্তৃতায় বরিশাল জেলার গৌরনদী থানা অঞ্চলে লবণের সাথে চিনি ভেজাল দেওয়া সম্পর্কিত সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবরের উল্লেখ করেন।[১৬৭] 

খয়রাত হোসেন[১৬৮] ভারত থেকে লবণ আনতে ব্যর্থ হওয়া এবং ভারতীয় সরকারের পারমিটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন যে, কাসিম ইসমাইল কোম্পানীকে ছয় টাকা দু আনা মণ দরে চার লক্ষ মণ লবণ ভারত থেকে আনার পারমিট দেওয়া হয়েছিলো। তাঁরা লবণ আনতে পারেনি। তাঁদের এই ব্যর্থতার জন্যে সরকার তাঁদেরকে কি শাস্তি প্রদান করেছেন, খয়রাত হোসেন তা জানতে চান। 

কিন্তু ওই একটি কোম্পানীই নয়। খয়রাত হোসেন বলেন যে, একের পর এক আরও কয়েকটি কোম্পানীকে উচ্চতর দরে লবণ আমদানীর পারমিট দেওয়া হয় কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছে। যারা কখনও লবণের ব্যবসা করেনি তাঁদের এই সব পারমিট দেওয়ার ফলে লবণ আমদানীর ক্ষেত্রে গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ ছাড়া তিনি আরও বলেন যে এ ব্যাপারে সরকারের এক পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী এবং মুসলিম লীগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জড়িত আছে। 

মনোরঞ্জন ধর[১৬৯] বলেন যে, লবণের দুষ্প্রাপ্যতার মূল কারণ চারটি। যথা : জাহাজে স্থানাভাব, লবণের উপর আবগারী কর, জাহাজের ভাড়ার উচ্চহার এবং অতিরিক্ত মূল্য। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক করাচী থেকে পূর্ব বাঙলায় লবণ সরবরাহের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি বলেন যে, মন্ত্রী মহোদয় আমাদের চাহিদা মাসে ৫ লক্ষ মণ অর্থাৎ বৎসরে ৬০ লক্ষ মণ বললেও আসলে চাহিদা হলো প্রায় ৭৫ লক্ষ মণ। করাচী এই সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছে কিন্তু তা পালন করার ক্ষমতা করাচীর নেই। কারণ নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে তিনি জানেন যে করাচীর যা উৎপাদন তার থেকে ৪০ লক্ষ মণের বেশী তাঁরা বৎসরে পূর্ব বাঙলায় সরবরাহ করতে পারে না। ৩০ লক্ষের এই ঘাটতি কিভাবে পূরণ করা সম্ভব একথা তিনি জিজ্ঞেস করেন। 

বক্তৃতার শেষে মনোরঞ্জন ধর হাতে কিছু পরিমাণ লবণ নিয়ে বলেন যে সেই লবণ তাঁকে দিয়েছেন ঢাকা শহরের আরামবাগ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সেক্রেটারী। আরামবাগের একটি রেশন দোকান কর্তৃক সেই লবণ কয়েকটি পরিবারকে দেওয়া হয়েছিলো। তিনি বলেন যে, তাঁর হাতে সেই লবণ পরীক্ষা করে দেখলে তাতে এমোনিয়াম সালফেট (গুঁড়ো হাড়) এবং চিনি পাওয়া যাবে। সেই লবণ খাওয়ার পর আজহার হোসেন নামক এক ব্যক্তির পরিবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে তখনো লবণের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ আছে। রেশন দোকান থেকে সরবরাহকৃত সেই লবণ পরীক্ষা করে দেখার জন্যে তিনি সরবরাহ মন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। 

বিতর্কের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন[১৭০] বলেন যে, প্রদেশে লবণের অভাব খুবই সাময়িক এবং শীঘ্রই সে অভাব দূর করা হবে। করাচী থেকে প্রয়োজনীয় সরবরাহের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার এবং অভ্যন্তরীণ বিতরণের জন্যে প্রাদেশিক সরকার এক্ষেত্রে দায়ী বলে তিনি স্বীকার করেন। কলকাতা থেকে পারমিটে লবণ আমদানী ক্ষেত্রে ব্যর্থতার উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সেই পারমিট সেপ্টেম্বর মাসে খুব স্বল্প মেয়াদের জন্যে দেওয়া হয়েছিলো এবং তার পরই পূজার ছুটি পড়ে যাওয়ায় সেই পারমিট ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। লবণের ওপর কর তুলে নেওয়ার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে ইতিমধ্যেই তাঁরা আলোচনা শুরু করেছেন বলে তিনি পরিষদকে জানান। 

পূর্ব বাঙলা পরিষদে যেদিন এই বিতর্ক শুরু হয়, অর্থাৎ ২রা নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের সহকারী অর্থসচিব গিয়াসুদ্দীন পাঠান ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে লবণ সমস্যার ওপর এক বক্তৃতা দেন। তাতে তিনি বলেন যে, জাহাজের অভাব এবং পাকিস্তানের দুই অংশের দূরত্বই পূর্ব বাঙলায় লবণ সরবরাহের পথে প্রধান অন্তরায়।[১৭১] 

এই সময় সরকার সংকটের গুরুত্ব অনুধাবন করে লবণের চোরাকারবারী ও মজুতদারী বন্ধের জন্যে একটি জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স জারী করেন।[১৭২] একটি সরকারী প্রেস নোটের মাধ্যমে সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়। চোরাচালানী ও মজুতদারদের গ্রেফতার করার উদ্দেশ্যে এই সরকারী অর্ডিন্যান্সের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ৪ঠা নভেম্বর দৈনিক আজাদে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। লবণ সমস্যার ওপর ঠিক এর পরদিনই আবার ‘স্থায়ী সমাধান চাই’ নামে আর একটি এবং ৭ই নভেম্বর ‘জাহাজের অব্যবস্থা’র ওপর আর একটি সম্পাদকীয় আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ সময়ে লবণসমস্যা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সরকার সমর্থক আজাদ পত্রিকার এই ঘন ঘন সম্পাদকীয় থেকে সেটা বেশ বোঝা যায়। 

৫ই নভেম্বর চট্টগ্রাম শহরে লবণ সমস্যা আলোচনার জন্যে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।[১৭৩] গণপরিষদের সদস্য এবং চট্টগ্রাম শহর মুসলিম লীগের সভাপতি নূর আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় স্থানীয় অঞ্চলে উৎপন্ন লবণের ওপর কর রহিত করণ, বিনা লাইসেন্সে লবণ আমদানীর অনুমতিদান, চোরাকারবারী ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন এবং পূর্ব বাঙলার লবণ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্যে পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়। 

অন্য কয়েকজন বক্তাও এই সভায় বক্তৃতা করেন। সরিষার তৈল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্যে এই সভায় প্রাদেশিক সরকারকে অনুরোধ করা হয়। এ ছাড়া লবণসমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্যে তাঁরা কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক উভয় সরকারকেই দায়ী করেন। 

১৪ই নভেম্বর পূর্ব বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন গণপরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্যে করাচী রওয়ানা হন। ঢাকা বিমানঘাঁটিতে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তিনি প্রদেশের বিভিন্ন সমস্যা আলোচনা করবেন এবং তার মধ্যে লবণ শুল্ক রহিতের প্রশ্নটি অন্যতম। ১৭৪ কেন্দ্রীয় ডেপুটি অর্থসচিব গিয়াসুদ্দীন পাঠানও একই সাথে করাচী যাত্রা করেন। তিনি একটি পৃথক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, পূর্ব বাঙলায় নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্যে তাঁরা কেন্দ্রীয় একটা তদন্ত কমিটি নিয়োগের অনুরোধ জানাবেন।[১৭৫]এই দুই মন্ত্রী ব্যতীত প্রাদেশিক লীগ কর্তৃক নিযুক্ত একটি প্রতিনিধিদলও ১৪ই তারিখে করাচী রওয়ানা হন। লবণের দুষ্প্রাপ্যতা এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির চড়া দামের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে সে সম্পর্কে তাঁরা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করবেন বলে সাংবাদিকদের জানান।[১৭৬]

২০শে নভেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে প্রশ্নোত্তরকালে খাদ্যসচিব পীরজাদা আবদুস সাত্তারকে সদস্যগণ পূর্ব পাকিস্তানে লবণ সংকটের ওপর বিশ মিনিট কাল ধরে নানান প্রশ্ন করেন।[১৭৭] এ সময় ঘাটতির কারণ অনুসন্ধানের জন্যে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ একটি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি নিয়োগের প্রস্তাব করেন। এক পর্যায়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে জাহাজযোগে লবণ প্রেরণ সম্পর্কে খাদ্যসচিবকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান যে, প্রশ্ন বাণিজ্যমন্ত্রী ফজলুর রহমানকে করা উচিত কারণ সেটা তাঁর দফতরের ব্যাপার। 

এই আলোচনাকালে ধীরেন দত্ত ভারত থেকে লবণ ক্রয় না করার জন্যে সরকারের ওপর দোষারোপ করেন। করাচীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আহমদ জাফরও লবণ ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে সরকারের নিন্দা করেন। 

এই সমস্ত পরিষদীয় বিতর্ক প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপাত্রদের বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী বক্তব্য, সংকটের দায়িত্ব একে অন্যের ঘাড়ে চড়ানোর প্রচেষ্টা ইত্যাদি থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় সরকারী দল এই সময় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বিরোধিতার ফলে কতখানি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিলো। প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেও যে নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতৈক্যের নিদারুণ অভাব ছিলো সেটাও খাদ্যসংকট, লবণসংকট ইত্যাদি পরিস্থিতিতে বেশ ভালো ভাবে বোঝা যায়। 

লবণসংকট সম্পর্কে যে তথ্যসমূহ পাওয়া যায় তার থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপন্ন লবণকে পূর্ব পাকিস্তানে চালান দেওয়ার প্রচেষ্টাই এই লবণ সংকটের মূল কারণ। পশ্চিম পাকিস্তানের লবণ ব্যবসায়ের স্বার্থেই পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলবর্তী এলাকায়, বিশেষতঃ চট্টগ্রামে লবণ তৈরী নিষিদ্ধ করা হয়, লবণের ওপর নিপীড়নমূলক শুল্ক নির্ধারণ করা হয়, বিদেশ থেকে লবণ আমদানী নিষিদ্ধ হয় এবং লবণ কার্যত একচেটিয়াভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্বে আনা হয়। সেদিক দিয়ে বিচার করলে জাহাজ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধা সংকটের কারণ হিসাবে নিতান্ত গৌণ। কেন্দ্ৰীয় সরকার যদি লবণ সরবরাহের অন্য সমস্ত পথ বন্ধ করে একচেটিয়াভাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লবণ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী না হতেন তাহলে জাহাজের অব্যবস্থা ইত্যাদির কোন গুরুত্বই সরবরাহের ক্ষেত্রে থাকতো না। যাই হোক, সংকট গুরুতর আকার ধারণ করার পর এবং পরিশেষে কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে বিভিন্ন কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বনের ফলে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে পূর্ব বাঙলায় লবণের দর দ্রুতগতিতে কমে আসতে থাকে। 

১৪. দুর্ভিক্ষের কারণ 

দুর্ভিক্ষ ১৯৪৮-৪৯ অথবা ১৯৫১ সালেই বাঙলাদেশে প্রথম দেখা দেয় নাই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং বৃটিশ সরকারের অধীনস্থ হওয়ার পর থেকে বাঙলাদেশে দুর্ভিক্ষ অবস্থা হয়েছিলো প্রায় চিরস্থায়ী। বাংলা ১১৭৬ (ইংরেজী ১৭৬৯) সালে কোম্পানীর আমলে বাংলাদেশে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো তার কোন তুলনা এ দেশের ইতিহাসে ছিলো না। সে দুর্ভিক্ষে তৎকালীন বাঙলাদেশের অন্ততঃ এক তৃতীয়াংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়েছিলো। উনিশ শতকের সত্তর, আশি এবং নব্বুই এর দশকে দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো এতোখানি ব্যাপক এবং ধ্বংসাত্মক না হলেও অনাহার অর্ধাহার এবং মহামারী কবলিত হয়ে সাধারণ কৃষকদের জীবনে সে সময় দুর্দশার অবধি ছিলো না। বিশ শতকেও বাঙলাদেশের দুর্ভিক্ষাবস্থার কোন অবসান হয়নি। শুধু তাই নয় বাংলা ১৩৫০ (১৯৪৩) সালে এখানে যে দুর্ভিক্ষ হয় তাতে সমগ্র বাঙলাদেশে প্রায় চল্লিশ লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটে। লক্ষ লক্ষ কৃষকের জমিজমা বাড়ী ঘর পানির দরে বিক্রি হয়ে তাঁরা পথের ভিখারীতে পরিণত হয়।[১৭৮] 

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে অর্থাৎ বৃটিশ সরকার কর্তৃক এদেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে খাদ্য পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে ছিলো তা এই পরিচ্ছেদের প্রথম দিকে আলোচিত হয়েছে। সেই খাদ্য পরিস্থিতি যে দুর্ভিক্ষে পরিণত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা সে বিষয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এবং পূর্ব বাঙলা সরকারকে বিভিন্ন মহল থেকে যথেষ্ট সতর্ক করা হয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই দুর্ভিক্ষ নিরোধের জন্যে সরকার যে উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করেনি সেটাও ইতিপূর্বে এই পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে। 

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের পর থেকে পূর্ব বাঙলায় কতকগুলি বিশেষ কারণে খাদ্যসংকট তীব্রতর আকার ধারণ করে এবং পরিশেষে সেই সংকটকে পরিণত করে দুর্ভিক্ষে। এই দুর্ভিক্ষের কারণসমূহকে মোটামুটি তিনভাগে বিভক্ত করা চলে। প্রথমতঃ বাঙলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী ভূমিব্যবস্থা।[১৭৯] দ্বিতীয়তঃ বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি পানি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত সমস্যা। তৃতীয়তঃ, সরকারী নীতি এবং শাসনতান্ত্রিক অব্যবস্থা ও দুর্নীতি। ১৯৪৮-৪৯ এবং ১৯৫১ সালে পূর্ব বাঙলার খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের কারণ আলোচনাকালে এই তৃতীয় কারণটির ওপরই এখানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, কারণ ভূমিব্যবস্থা ও পানিনিয়ন্ত্রণ ঘটিত কারণে যে অবস্থার সৃষ্টি সে সময় হয়েছিলো সে অবস্থাকে সরকারী নীতি এবং বিবিধ ব্যবস্থার মাধ্যমে মোটামুটিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। কিন্তু পাকিস্তান অথবা পূর্ব বাংলা, কোন সরকারই সে দিকে উপযুক্ত সতর্ক দৃষ্টি না দেওয়ার ফলেই সংকট আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। 

এ ক্ষেত্রে প্রথমেই সরকারী খাদ্য সংগ্রহ এবং আমদানী নীতির উল্লেখ করা চলে। বিভিন্ন মহল থেকে সরকারকে বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও তাঁরা পূর্ব বাংলার খাদ্য ঘাটতির সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ের কোন চেষ্টা করেননি। তাছাড়া জরুরী অবস্থার মুখোমুখি হয়েও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানীর গুরুত্বকে ভয়ানক লঘুভাবে দেখেন। এর মূল দায়িত্ব অবশ্য ছিলো কেন্দ্রীয় সরকারের, পূর্ব বাঙলা সরকারের নয়। পূর্ব বাঙলার প্রয়োজন কেন্দ্রের দ্বারা উপেক্ষিত হওয়ার ফলেই প্রয়োজনের তুলনায় বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানীর পরিমাণ দাঁড়ায় অনেক অল্প। 

অভ্যন্তরীণ সংগ্রহনীতি ও সরকারী বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের কর্মচারীদের দুর্নীতি, চোরাকারবারী ও ব্যবসায়ীদের সাথে তাঁদের যোগসাজশের ফলে তেমন কার্যকরী হয় নাই। উপরন্তু জোতদার শ্রেণীর লোকদের ধান চাল সংগ্রহের অপেক্ষা তাদের গরীব ও মধ্য কৃষকদের থেকে জোরপূর্বক ধান আদায়ের চেষ্টা সংগ্রহের কর্মসূচীকেই অজনপ্রিয় করে তোলে। এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষকরা কোন কোন এলাকায় সংঘবদ্ধভাবে সরকারী খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে।[১৮০] এবং তার সুযোগ নিয়ে জোতদার শ্রেণীর লোকেরা সরকারকে ফাঁকি দিয়ে চোরাকারবারীদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ধানচাল ভারতে চালান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। 

অন্যদিকে কর্ডন এলাকা বহির্ভূত এলাকায় ব্যবসাদারদের হাতে ধান-চাল ক্রয় বিক্রয়ের দায়িত্ব দেওয়ায় তারা খাদ্য মজুত করার অবাধ সুযোগ পায় এবং ঘাটতি এলাকাগুলিতে ধান-চালের দর ইচ্ছেমতো বৃদ্ধি করে। 

সরকারী সংগ্রহনীতির ব্যর্থতার আর একটি কারণ হলো লেভীকৃত ধানের নিম্নমূল্য নির্ধারণ। সাধারণভাবে ধানের এবং সামগ্রিকভাবে অন্যান্য দ্রব্যের ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধির মুখে সরকার যে দরে উদ্বৃত্ত ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা করেন, তার ফলে বিক্রেতারা নিদারুণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এদের অধিকাংশই ছিলো অল্প জমির মালিক। এটাই হলো সরকারী খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। তাছাড়া ক্রয়মূল্য কম হলেও সরকারী বিক্রয়মূল্য সেই তুলনায় অনেক বেশী হওয়ার ফলে এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। সরকার কর্তৃক ক্রয় এবং বিক্রয়মূল্যের মধ্যে এই তারতম্য রাখার কারণ তাঁরা বেসামরিক সরবরাহ বিভাগকে একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়ে তাকে আর্থিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার নীতি গ্রহণ করে। 

এইভাবে একদিকে আমদানীকৃত খাদ্যের অল্প পরিমাণ এবং অভ্যন্তরীণ সংগ্রহনীতির আংশিক ব্যর্থতার ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ সরকার কর্তৃক এ সময় সম্ভব হয় না। সরকারী প্রশাসনযন্ত্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে যথোপযুক্ত যোগাযোগ রক্ষিত না হওয়া এবং চলাচল ব্যবস্থার অসন্তোষজনক অবস্থার জন্যে মওজুদকৃত খাদ্যশস্যও সময়মতো বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা সরকারের পক্ষে হয়ে ওঠে না। 

দুর্ভিক্ষের মোকাবেলার ক্ষেত্রে আর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো সরকারী উদ্যোগের সাথে জনগণের সম্পর্কহীনতা। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সরকার জনগণের ব্যাপক সহযোগিতা লাভের কোন চেষ্টা তো করেইনি উপরন্তু সরকারী দল মুসলিম লীগ সংগঠনের সাথেও এক্ষেত্রে তাঁদের কোন উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক এবং যোগাযোগ ছিলো না। জনগণের সাথে এই বিচ্ছিন্নতা সামগ্রিকভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ। 

১৫. দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলন 

১৯৪৮-৪৯ এবং ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলায় যে ব্যাপক খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা গেল সেই অবস্থাকে প্রতিরোধ করার জন্যে কোন সুসংগঠিত আন্দোলন হয়নি। এদিক দিয়ে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের অবস্থার সাথে এই দুর্ভিক্ষের অবস্থার একটা মস্ত তফাত। একথা অবশ্য সত্য যে, ১৯৪৮-৪৯-এর দুর্ভিক্ষ ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের মতো ব্যাপক ও ভয়াবহ ছিলো না। কিন্তু তা না হলেও এ দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্যসংকট জনগণের জীবনে ব্যাপকভাবে যে সংকট সৃষ্টি করেছিলো তাকেও ছোট করে দেখা চলে না। 

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়কার সর্বদলীয় রিলিফ কমিটির মতো কোন কমিটি এই সময় দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের কাজের জন্য প্রতিষ্ঠিত ও সক্রিয় হয়নি। প্রথমদিকে সিলেট জেলায় মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও কিষাণ সভার মিলিত উদ্যোগে একটি রিলিফ কমিটি অল্প কিছুদিন সক্রিয় থাকলেও পরে তা নানান কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং রিলিফের কাজ সেখানে আর অগ্রসর হয় না। এদিক থেকে সরকারী উদ্যোগের যথেষ্ট অভাব ছিলো। মুসলিম লীগ সরকার প্রাদেশিক লীগের সুপারিশক্রমে ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে একটা রিলিফ কমিটি গঠন করেছিলেন। কিন্তু সেই কমিটির কোন তৎপরতা কোন স্থানেই ছিলো না। এ সম্পর্কে সিলেটের নওবেলাল পত্রিকা স্থানীয় রিলিফ কমিটির অবস্থা সম্পর্কে ‘খাদ্যাভাব’ নামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে : 

প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুরোধক্রমে পূর্ব পাক সরকার প্রত্যেক জেলায় ও মহকুমায় মুসলিম লীগের সহযোগে রিলিফ কমিটি গঠন করিয়াছেন। আমরা যতদূর জানিতে পারিয়াছি উত্তর সিলেটেও অনুরূপ একটি রিলিফ কমিটি গঠিত হইয়াছিলো। সিলেট জেলায় বিতরণের জন্য সরকার কিছু টাকাও বরাদ্দ করিয়াছিলেন বলিয়া জানা গিয়াছে। কিন্তু এই রিলিফ কমিটির কোন সভা আহ্বান করা হইয়াছে বলিয়া আমরা অবগত হই নাই। এই কমিটিকে যদি অকেজো করিয়া রাখা হয় তাহা হইলে নামকাওয়াস্তে এই রিলিফ কমিটি রাখার যুক্তিযুক্ততা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।[১৮১] 

রিলিফ কমিটির এই নিষ্ক্রিয়তা শুধু সিলেট জেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। বরিশাল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বরিশাল জেলা মুসলিম লীগ সম্পাদক মহীউদ্দীন আহমদের পূর্বোক্ত পত্র থেকেও রিলিফ কমিটির নিষ্ক্রিয়তার কথা জানা যায়। শুধু রিলিফের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয়তাই নয়, বস্তুতঃপক্ষে সরকারী আমলা কর্তৃক রিলিফের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার ব্যাপারটাই সেখানে বড়ো হয়ে দেখা দেয়। প্রত্যেক জেলাতেই ম্যাজিস্ট্রেটের সভাপতিত্বে এই সমস্ত রিলিফ কমিটি গঠিত হয়েছিলো এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এই সমস্ত আমলা সভাপতিদের ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তার ফলেই রিলিফ কমিটিগুলি পুরোপুরিভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। 

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে রিলিফের ক্ষেত্রে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক সভা ইত্যাদি মিলিতভাবে রিলিফ কমিটিতে কাজ করতো। পূর্ব বাঙলার ১৯৪৮-৪৯ সালের দুর্ভিক্ষে কংগ্রেস বহুলাংশে সাম্প্রদায়িক কারণে নিজেদের কাজ পূর্ব বাঙলা পরিষদের চৌহদ্দীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বাইরে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকে। কমিউনিস্ট পার্টি এই সময় সশস্ত্র আন্দোলনে নামার ফলে তার এবং কৃষক সভার ওপর সরকারী নির্যাতন ও নানা প্রকার নিষেধাজ্ঞার জন্যে তাঁরা খোলাখুলিভাবে রিলিফ কমিটিতে যোগদান করতে পারেনি। তাঁদের এই অনুপস্থিতিই এই কমিটিগুলির নিষ্ক্রিয়তার মুখ্য কারণ ছিলো। ১৯৪৩ সালের অভিজ্ঞতা থেকেই এ কথা প্রমাণিত হয়। কারণ সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষক সভাই ছিলো সারা বাঙলাব্যাপী রিলিফ সংক্রান্ত কাজের পুরোভাগে। এইভাবে কমিউনিস্ট পার্টি, কৃষক সভা এবং কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে রিলিফ কমিটিগুলি মুসলিম লীগের সদস্যদের দ্বারাই মোটামুটিভাবে গঠিত ছিলো। এই সমস্ত মুসলিম লীগওয়ালারা রিলিফের কাজে নিজেরা তেমন উৎসাহী না থাকার ফলে আমলাদের নিজেদের উদ্যোগে সেই সমস্ত কমিটিকে সক্রিয় করার প্রশ্ন ওঠেনি। যে সমস্ত স্থানে স্থানীয়ভাবে মুসলিম লীগাররা রিলিফ কমিটিকে তৎপর করার চেষ্টা করেছিলেন সেখানেও প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রিলিফ কমিটিকে উৎসাহ দেওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট শৈথিল্য আমলাদেরকে সক্রিয় করে তোলার পথে হয়ে দাঁড়ায় মস্ত বাধাস্বরূপ। 

উপরোক্ত কারণগুলি মিলিত হয়ে এই পর্যায়ে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলনে জনগণকে ব্যাপকভাবে ও দেশব্যাপী সংগঠিত করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এবং জনগণকে সংগঠিত করতে না পারার ফলে রাজনীতিগতভাবে দুর্ভিক্ষের প্রশ্ন যতখানি খোলাখুলি সামনে আসা দরকার ছিলো ততখানি আসেনি। কিন্তু এই অবস্থা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কোন আন্দোলন অথবা দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে কোন বিক্ষোভ সংগঠিত হয়নি এমন নয়। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে সে চেষ্টা হয়েছিলো। নীচে তারই কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করা গেলো। 

ক. 

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক যুব লীগের[১৮২] সাংগঠনিক কমিটি ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সভার পর নিজেদের কর্মীদের কাছে প্রেরিত একটি সার্কুলারে[১৮৩] খাদ্যসংকট সম্পর্কে একটি কর্মসূচীর বিবরণ দেন। তাতে বলা হয় যে, তৎকালীন খাদ্য সমস্যার সমাধানের ওপর লক্ষ লক্ষ লোকের জীবন নির্ভর করছে। কাজেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে হিন্দু মুসলমানকে মিলিতভাবে খাদ্য আন্দোলন গঠন করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে : 

যেসব জায়গায় আজ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে সেইসব এলাকায় জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত স্থানীয় খাদ্য কমিটির কর্তৃত্বাধীনে অবিলম্বে সরকারী লঙ্গরখানা খুলিতে হইবে। এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সম্প্রদায় যাহাতে স্বল্পমূল্যে তাহাদের আহার্য দ্রব্যাদি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্যাদি পাইতে পারে তাহার জন্য বিশেষ ধরনের দোকান খুলিতে হইবে এবং এইসব প্রত্যেক কাজ আমলাতান্ত্রিক কর্মচারীর উপর সম্পূর্ণ ছাড়িয়া না দিয়া, প্রত্যেক দেশপ্রেমিক কর্মীদের নিজ হাতে লইতে হইবে। 

এইসব কাজ সুষ্ঠুভাবে করিতে হইলে- অবিলম্বে সকল সম্প্রদায় ও সকল মতাবলম্বী ছাত্র ও যুবকদের বৈঠক আহ্বান করিতে হইবে। সেই সভায় ছাত্র ও যুবকদের যুক্ত রিলিফ ও খাদ্যকমিটি এবং খাদ্যকমিটির অধীনে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও গড়িয়া তুলিতে হইবে। মহিলা ও ছাত্রী কর্মীরা অনুরূপভাবে মহিলাদের মধ্যে কাজ করিবার জন্য এবং বিশেষতঃ হিন্দু মহিলাদের আতঙ্ক দূর করিবার জন্য নিজেদের সংগঠিত করিয়া তুলিতে পারেন।

এই স্বেচ্ছাসেবকদল চোরকারবারীদের উপর কড়া নজর রাখিবে, মজুতদার সম্পর্কে সকল সংবাদ সংগ্রহ করিবে, খাদ্যদ্রব্যের বেআইনী যাতায়াতের উপর লক্ষ্য রাখিবে; মজুতবিরোধী, চোরাকারবারবিরোধী আন্দোলন-এর মধ্য দিয়া জনসাধারণকে সচেতন করিয়া তুলিবে এবং চোরাকারবার ও মজুতদারদের দমনে জনসাধারণকে সক্রিয় করিবে; প্রত্যেক চোরাকারবারী ও মজুতদারদের সাথে সকল প্রকার সামাজিক সংস্রব বর্জন করিতে প্রত্যেককে উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিবে; লুক্কায়িত খাদ্যশস্যের সংবাদ সংগ্রহ করিয়া সরকারী কর্মচারীদিগকে খাদ্য সংগ্রহে সাহায্য করিবে। 

গণতান্ত্রিক যুব লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং এই সংগঠনের প্রতি সরকারের শত্রুতাপূর্ণ আচরণের জন্যে উপরোক্ত কর্মসূচী অনুযায়ী কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হয়নি। তবে এই সংগঠনের কর্মীরা সীমিতভাবে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গঠনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। 

খ. 

দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে সারা পূর্ব বাঙলাব্যাপী একটা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে না উঠলেও বিচ্ছিন্নভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করার জন্যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা অনেক এলাকাতেই এগিয়ে আসেন। স্থানীয়ভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি, রিলিফ কমিটি ইত্যাদি নামে বিভিন্ন কমিটি গঠিত হয়। অনেক জায়গায় খাদ্যের অভাব এবং উচ্চমূল্যের প্রতিবাদে মিছিল বের করা হয় এবং সেই সমস্ত মিছিলের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে, লাঠিচার্জ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ পর্যন্ত হয়। এই ধরনের ঘটনা শুধু যে ঘাটতি এলাকাগুলিতেই ঘটে তাই নয়। উদ্বৃত্ত এলাকাগুলিতেও এই ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা কিছু কিছু ঘটে। 

বরিশালে ছাত্রদের উদ্যোগে, বিশেষতঃ ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে একটি দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়।[১৮৪] একমাত্র সরকার সমর্থক মুসলিম ছাত্র লীগ ব্যতীত অন্যান্য সংগঠনও এই কমিটির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে। মহিলা সমিতির মধ্যে এই সময় নৌকার মাঝি, রিকশাচালকদের স্ত্রী প্রভৃতি গরীব মহিলারা ছিলেন। তাহারাও বেশ সক্রিয়ভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। গণতান্ত্রিক যুব লীগের একটা শাখাও এই সময় বরিশালে হয়েছিলো। আবদুর রহমান চৌধুরী, কাজী বাহাউদ্দীন প্রভৃতির নেতৃত্বে তাঁরা এবং মহীউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের একাংশ এই কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকেন। 

এই কমিটির কাজ শহর কেন্দ্রিক হলেও তারা বরিশাল শহর থেকে আট দশ মাইলের মধ্যে যে সব উদ্বৃত্ত ধান চাল জোতদার, চোরাকারবারী প্রভৃতিদের কাছে জমা ছিলো সেগুলির খবরাখবর সংগ্রহ করতো, সেখানে গিয়ে তাদেরকে ঘেরাও করে উদ্বৃত্ত ধান-চাল স্থানীয় গরীব কৃষকদের মধ্যে কিছুটা বিতরণ করতো। ট্রাকে করে কিছু অংশ শহরে এনে খাদ্য বিভাগের হাতে তুলে দিতো। ছাত্রেরা দুই একটা চোরাচালানের নৌকাও ধরেছিলো। এইসব কাজের প্রতি সাধারণভাবে জনগণের যথেষ্ট সমর্থন থাকতো। 

১৯৪৮-এর জুন মাসের দিকে খাদ্য পরিস্থিতির খুব অবনতি ঘটায় সে সময় বরিশাল শহরে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল বরিশালের কালেক্টরেট বিল্ডিং- এ গিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘেরাও করে। এই মিছিলে মনোরমা বসু, স্বদেশ বসু, গোলাম কিবরিয়া প্রভৃতি নেতৃস্থানে থাকেন। মিছিলকারীদের সাথে কালেক্টরেট বিল্ডিং-এর এলাকার মধ্যেই পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। মনোরমা বসু, স্বদেশ বসু, গোলাম কিবরিয়া প্রভৃতিকে এ সময় গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া স্বদেশ বসুকে ঐ সময় পুলিশ বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করে। শুধু এই কয়জন নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীই নয়, অন্যান্য অনেকেই এ সময় পুলিশের হাতে মারধোর খান এবং গ্রেফতার হন। 

এঁদেরকে East Pakistan Safety Ordinance এ গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু যে সময় গ্রেফতার করা হয় তার পূর্বেই অর্ডিন্যান্সটির মেয়াদ শেষ হয় এবং সরকার সেটিকে সময়মতো Revalidate না করায় সেই গ্রেফতার হয়ে পড়ে বেআইনী। প্রথমে এই রাজবন্দীদেরকে বেল দিয়ে ছেড়ে দিয়ে আবার বেল বাতিল করে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া অক্টোবর মাসে সরকার উপরোক্ত অর্ডিন্যান্সটিকে Retrospective effect দিয়ে আবার জারী করেন। এই সময় বন্দীরা তাঁদের গ্রেফতারের বৈধতা নিয়ে মামলা করলে কোর্ট তাঁদেরকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু এইভাবে ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরকে নিরোধমূলক আইনে আবার আটক করা হয়। 

গ. 

গণতান্ত্রিক যুবলীগের রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির একটি[১৮৫] সম্মেলন ১৯৪৮- এর সেপ্টেম্বরে ঈশ্বরদীতে অনুষ্ঠিত হয়। এই যুব সম্মেলনে গৃহীত ইস্তাহারে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের বিবরণ পাওয়া যায়। তাতে “খাদ্যসংকটের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াও। আমলাতান্ত্রিক গাফিলতির মুখোশ খুলিয়া দাও। জনগণের প্রতিরোধ গড়িয়া তোলো” এই শীর্ষক একটি অংশে দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে সাধারণভাবে বলা হয়: 

পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যসমস্যা প্রকট হইয়া উঠিয়া যশোর জেলায় ৪০ টাকা, খুলনায় ৩৮ টাকা, পাবনা নদীয়ায় ৩৫ টাকার উপরে চাউলের দর চলিতেছে। ২২/২৪ টাকার নীচে কোন জেলাতেই চাউল পাওয়া সম্ভব নয়। এক কথায় বলিতে গেলে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যের মূল্য জনসাধারণের নাগালের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইহা দ্বিতীয় খাদ্য সংকট। 

এই সংকট সমাধানে সরকারের তরফ হইতে এক বিবৃতি দেওয়া ছাড়া অন্য কোনই চেষ্টা হইতেছে না। খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ সম্পর্কে সরকারি নীতি খাদ্য সংকটকে আরও প্রকট করিয়া তুলিতেছে। এখন পর্যন্ত খাদ্য সংগ্রহের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা হয় নাই। বড়ো জোতদার ও মজুতদারদের স্পর্শ না করিয়া সাধারণ কৃষকের নিকট হইতে ধান চাউল সংগ্রহ করাই সরকারের নীতি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মজুতদার ও জোতদারকে তোষণ করিয়া কৃষকের ধান ‘সীজ’ করিবার নীতিতে খাদ্য সংগ্রহ হইতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানীরও কোন ব্যবস্থা হইতেছে না। 

যে খাদ্য বর্তমানে সরকার সংগ্রহ করিয়াছেন তাহাও সঠিকভাবে সরবরাহ হইতেছে না। খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ এইরূপে চলিতে থাকায় ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকের পূর্ব পাকিস্তান আজ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সামনে উপস্থিত হইয়াছে। 

এই বক্তব্যের পর খাদ্য সমস্যার আশু সমাধানের উদ্দেশ্যে এই যুব সম্মেলন অবিলম্বে নিম্নলিখিত কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করার জন্যে সরকারের নিকট দাবী জানায়: 

১. কৃষকের নিকট হইতে জবরদস্তিমূলকভাবে ধান কাড়িয়া লওয়া চলিবে না। অবিলম্বে সমস্ত জোতদার ও মজুতদারদের বাড়তি খাদ্য বাজেয়াপ্ত করিয়া লইতে হইবে। 

২. ভারত ও পাকিস্তানের বাহিরে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমঝোতা করিয়া খাদ্য আমদানীর ব্যবস্থা করিতে হইবে। 

৩. সরকার কর্তৃক সংগৃহীত খাদ্য কালবিলম্ব না করিয়া ঘাটতি এলাকায় সস্তা দরে সরবরাহ করিতে হইবে। 

৪. প্রত্যেক শহরে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করিতে হইবে এবং রেশনিং এলাকায় নিয়মিতভাবে সস্তা দরে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করিতে হইবে। 

৫. যে সমস্ত লোক দুস্থ হইয়া পড়িয়াছে এবং খাদ্য ক্রয়ে অক্ষম তাহাদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য বিলির ব্যবস্থা করিতে হইবে। বন্যা প্রপীড়িত অঞ্চলে দ্রুত সরবরাহ পাঠাইতে হইবে। 

৬. নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য কমাইতে হইবে। 

৭. কৃষকের ক্রয়শক্তি বৃদ্ধির জন্য অর্থকরী ফসল যেমন পাট ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধি করিয়া সর্বনিম্ন দর বাধিয়া দিতে হইবে। পাটের সর্বনিম্ন দর মণ প্রতি ৪০ টাকা বাঁধিয়া দিতে হইবে। 

৮. মজুর ও মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের মাহিনা বৃদ্ধি করিতে হইবে। 

৯. জিন্না তহবিল হইতে দুই তৃতীয়াংশ অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ ও বন্যা পীড়িতদের সাহায্যের জন্য বরাদ্দ করিতে হইবে। 

উপরোক্ত কর্মসূচী যাতে যথাশীঘ্রই কার্যকর করা সম্ভব হয় তার জন্য গণতান্ত্রিক যুবলীগের এই সম্মেলন পূর্ব বাঙলার যুব সমাজ ও জনগণের নিকট আহ্বান জানায়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে গৃহীত কর্মসূচীর মতো এই আহ্বানও পূর্বোল্লিখিত কারণে কোন ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। 

ঘ 

সিলেট জেলায় যে সর্বদলীয় রিলিফ কমিটি গঠিত হয়েছিলো সেটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু রিলিফ কমিটির নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও সিলেটে খাদ্য পরিস্থিতি ও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে অনেক সভা সমিতি হয়।[১৮৬] সিলেট শহরে ১লা মার্চ ১৯৪৯ তারিখে অনুষ্ঠিত এ ধরনের একটি জনসভার উল্লেখ এখানে করা যেতে পারে। 

সভাটি আহ্বান করে উত্তর সিলেট জেলা মুসলিম লীগ। তাতে সভাপতিত্ব করেন মওলানা সাখাওতুল আম্বিয়া। হিন্দু মুসলিম জনগণের এই বিরাট মিলিত জনসভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাব গৃহীত হয় : 

ফসল সংগ্রহের পর আজ ৪ মাস যাইতে না যাইতে দেশের প্রায় সর্বস্থান হইতেই খাদ্যাভাবের ভয়াবহ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। খাদ্যশস্যের মূল্য সর্বত্রই অতি উর্ধ্বে উঠিয়াছে এবং একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে, খাদ্যশস্যের মূল্য দেশবাসীর ক্রয়ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করিয়াছে। ইহাও সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হইয়াছে যে, সরকারের বর্তমান খাদ্যসংগ্রহ নীতি সম্পূর্ণরূপে বিফল হইয়াছে। 

বর্তমান অবস্থার উপর নিষ্ক্রিয়তা অবলম্বন করিয়া সরকার দেশবাসীকে প্রত্যক্ষভাবে মৃত্যুর পথে ঠেলিয়া দিতেছেন বলিয়া সন্দেহ করিবার কারণ উপস্থিত হইয়াছে। সিলেটের জনসাধারণের এই সভা যে সকল অঞ্চলে এই রূপ ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে সত্বর তাহাকে দুর্ভিক্ষাঞ্চল ঘোষণা করিয়া তদনুযায়ী অবস্থা আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যাইবার পূর্বে কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিকট দাবী জ্ঞাপন করিতেছে।[১৮৭] 

এই প্রস্তাব উত্থাপন করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য মাহমুদ আলী এবং প্রস্তাব সমর্থন করে সিলেট জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি রমেশচন্দ্র সোম বক্তৃতা করেন। এর পূর্বে খাদ্য পরিস্থিতির চরম অবনতির কথা বর্ণনা করে বক্তৃতা করেন আবদুস সামাদ, হরেন্দ্রকুমার মজুমদার, মোয়াজ্জম আহমদ চৌধুরী, মতসির আলী ও ওয়াহিদুর রেজা। 

ঙ. 

এই সময় পূর্ব বাঙলায় খাদ্য পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটে। লিয়াকত আলীর ঢাকায় উপস্থিতিকালে সারা দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থার এবং প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ ঐ দিনই আরমানীটোলা ময়দানে একটি জনসভা এবং তার পর একটি বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচী গ্রহণ করে।[১৮৮] 

এই বিক্ষোভ বন্ধ করার জন্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান ও আলী আহমদকে অনুরোধ জানান। তাঁরা এ ব্যাপারে মওলানা ভাসানীর সাথে আলাপ করেন কিন্তু ভাসানী তার কর্মসূচী বাতিল করতে রাজী হন না। কাজেই ১১ই অক্টোবর বিকেলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের সেই জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।[১৮৯] 

সভায় শামসুল হক এবং শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। শেখ মুজিবের বক্তৃতা ছিলো খুব উত্তেজনাপূর্ণ। দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, একজন অন্য একজনকে খুন করলে তার ফাঁসি হয়। যে নূরুল আমীন শত শত লোক খুন করছে তার কি হওয়া উচিত? তাকে এই মাঠের মধ্যে এনে গুলি করা উচিত।[১৯০] 

এই সভায় পূর্ব বাঙলার মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করে এবং মন্ত্রীসভার ব্যাপারাদি সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদ ভেঙে দিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নোতুন নির্বাচনের দাবী তাঁরা জানান। সভার পর বিভিন্ন ধ্বনি সহকারে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের এক মিছিল বের হয়।[১৯১] 

বাবুবাজার পুল ইত্যাদি পার হয়ে সেটি নবাবপুর দিয়ে যায়[১৯২]। নবাবপুরের রেলক্রসিং বন্ধ করে দেওয়ার ফলে মিছিল ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনের সামনে দিয়ে নাজিরাবাজার রেলক্রসিং-এর সামনে উপস্থিত হয়। সেখানেও গেট বন্ধ। SDO North সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার সাথে শামসুল হক ও শেখ মুজিবের তর্কাতর্কি শুরু হয়। মওলানা ভাসানী তখন রেলক্রসিং-এর পাশেই নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে যান। এই সময় একজন পুলিশ তাঁকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে যাচ্ছিলো কিন্তু শওকত আলী সে লাঠি ধরে ফেলেন। তাঁর সাথেও SDO North-এর তর্কাতর্কি শুরু হয়। অবস্থা যখন সেই পর্যায়ে পুলিশ তখন কাঁদুনে গ্যাস ছোঁড়া শুরু করে এবং গ্যাসের জ্বালায় অস্থির হয়ে সকলে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। শামসুল হকসহ ১১জন ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার হন। শেখ মুজিব, কাজী গোলাম মাহবুব, আবদুল ওদুদ, শওকত আলী প্রভৃতি নাজিরাবাজার রেলক্রসিং থেকে দৌড়ে ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে উপস্থিত হন।[১৯৩] 

শওকত আলী তখন ঐ বাড়ীতে থাকতেন। তিনি অন্যদেরকে বলেন যে, সেখানে থাকা তাঁদের পক্ষে নিরাপদ নয়। কিন্তু শেখ মুজিব সে সময় অন্যত্র যেতে রাজী না হওয়ায় শওকত আলী তাঁদেরকে তালা বন্ধ করে রেখে যান এবং বলে যান যেন তার আসার আগে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা না করেন। এরপর রাত তিনটের সময় পুলিশ তালা ভেঙ্গে মোগলটুলীর বাড়ীতে ঢোকে। ভেতরে যারা ছিলেন তাঁরা এর পূর্বেই ওপর থেকে অন্য বাড়ীর ছাদ বেয়ে পালিয়ে যান।[১৯৪] 

পরদিন শেখ মুজিবুর রহমান নূর জাহান বিল্ডিং-এ ক্যাপ্টেন শাহজাহানের বাড়ীতে আহত অবস্থায় আশ্রয় নেন। সেখানে দুতিন দিন থাকার পর একদিন পুলিশের দুজন অফিসার সে বাড়ীতে উপস্থিত হন। তাঁদের একজনের সাথে ক্যাপ্টেন শাহজাহানের সদ্ভাব ছিলো। তিনি কথা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানাটা পকেট থেকে একটু উঁচু করে তাকে দেখান। ক্যাপ্টেন শাহজাহান তখন সহজেই বুঝতে পারেন যে তার বাড়ীতে শেখ মুজিবের অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ সম্পূর্ণ ওয়াকেফহাল এবং তাঁর নিজের ওপর যাতে কোন বিপদ না আসে সেজন্যে অফিসারটি তাকে ইঙ্গিতে সাবধান করে দিলেন। এরপর ক্যাপ্টেন শাহজাহানের স্ত্রী শেখ মুজিবকে চাদর জড়িয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দেন।[১৯৫] শেখ মুজিব সেখান থেকে আনোয়ারা খাতুনের বাসায় গিয়ে ওঠেন এবং সেই বাসাতেই গ্রেফতার হন।[১৯৬]

১১ই অক্টোবরের ঘটনাবলী সম্পর্কে ঐ দিন রাত্রেই পূর্ব বাঙলা সরকার একটি প্রেস নোট জারী করে। তাতে বলা হয় : 

অদ্য বৈকাল ৪টায় আরমানিটোলা ময়দানে মুর্শিদাবাদের জনাব সাখাওয়াৎ হোসেনের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের এক সভা হয়। সভায় প্রায় ২ হাজার লোক যোগদান জনাব শামসুল হক-এমএলএ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং আরও কতিপয় বক্তা প্ররোচনামূলক উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা করেন। ফলে প্রায় ৫শত লোকের এক মিছিল রমনা অভিমুখে রওয়ানা হয়। মিছিলকারীদের অনেকের কাছে ইট পাটকেল ও লাঠি ছিলো। জিলা ম্যাজিস্ট্রেট এই মিছিল ছত্রভঙ্গ করার আদেশ দেয়। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ-সহ পুলিশ বাহিনী নাজিরাবাজার রেলওয়ে লেবেল ক্রসিংয়ের নিকট মিছিলকারীদের বাধা দেয়। তখন মিছিলকারীরা পুলিশের ওপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করিতে থাকিলে সাব ডিভিশনাল অফিসার এবং ৫ জন কনস্টেবল আহত হয়। তন্মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। অতঃপর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এই জনতাকে বেআইনী বলিয়া ঘোষণা করিলে পুলিশ সামান্য লাঠি চার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগ করিয়া জনতা ছত্রভঙ্গ করে। ঘটনাস্থলেই পুলিশ মিছিলকারীদের ১১ জনকে গ্রেফতার করে। পুলিশী তদন্ত চলিতেছে।[১৯৭] 

১১ই অক্টোবর আরমানীটোলায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভায় সভাপতি হিসেবে এই প্রেস নোটে ঢাকার সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটার সাখাওয়াৎ হোসেনের নাম উল্লেখ করায় সাখাওয়াৎ হোসেন একটি বিবৃতির মাধ্যমে বলেন যে, তিনি উক্ত সভায় শুধু যে সভাপতিত্ব করেননি তাই নয়, সেদিন তিনি ঐ সময়ে ঢাকা শহরেই উপস্থিত ছিলেন না।[১৯৮ ১২ই অক্টোবর তারিখে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ‘বিভেদ সৃষ্টিকারীদের’ বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী দিয়ে তাদেরকে শায়েস্তা করার সংকল্প ঘোষণা করেন।[১৯৯] ঐ দিন আওয়ামী লীগ পুলিশ নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকা শহরে হরতালের আহ্বান করে। এর ফলে নবাবপুর, জনসন রোড ইত্যাদি এলাকায় অধিকাংশ দোকান পাট বন্ধ থাকে। কাজেই পূর্ণ সাফল্য না হলেও হরতাল অনেকাংশে সাফল্যমণ্ডিত হয়।[২০০]

১৪ই অক্টোবর কারকুনবাড়ী লেনস্থ ইয়ার মহম্মদ খানের বাসা থেকে মওলানা ভাসানীকে বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স বলে গ্রেফতার করা হয়। মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান প্রভৃতিসহ যে কয়জন আওয়ামী লীগারকে ১১ই তারিখ থেকে গ্রেফতার করা হয় তাঁদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় উনিশ।[২০১] 

চ. 

১৯৫১ সালে খাদ্য পরিস্থিতি সরকারী দল মুসলিম লীগের মধ্যেও কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো তার একটি চিত্র বরিশালের একটি মুসলিম লীগ সভার নিম্নলিখিত বিবরণ থেকে পাওয়া যাবে।[২০২] 

বরিশাল জেলার গুরুতর খাদ্য পরিস্থিতি আলোচনার জন্যে জেলা মুসলিম লীগ কর্তৃক আহূত এই সভাটি অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় এ. কে. স্কুলের ময়দানে। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা মুসলিম লীগ সভাপতি সদর উদ্দীন আহমদ। সভা শুরু হওয়ার পূর্বে কতকগুলি পোস্টার প্রদর্শিত হয়। কঙ্কাল অঙ্কিত সেই পোস্টারগুলিতে লেখা থাকে “এটি একটি স্বাধীন দেশ কিন্তু জনগণ স্বাধীনতা ভোগ করছে না”, “আমরা চাই খাদ্য বস্ত্র এবং মানুষের মতো বাঁচতে”, “দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে” ইত্যাদি। 

পটুয়াখালি মহকুমার দুর্গত এলাকা সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জেলা মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এস. ডব্লিউ লকিতুল্লাহ বলেন যে, জনসাধারণ সেখানে ভুখা মিছিল করছে। জনগণের দুঃখজনক অবস্থাকে তুলে ধরতে অক্ষমতার জন্যে তিনি জেলার পরিষদ সদস্যদের, বিশেষতঃ খাদ্যমন্ত্রী মহম্মদ আফজলের দারুণ সমালোচনা করেন। 

শমশের আলী এডভোকেটও মহম্মদ আফজলসহ অন্যান্য পরিষদ সদস্যদের সমালোচনা করেন। এপিপি পরিবেশিত সংবাদকে খণ্ডন করার জন্যে, “জনগণ গাছের শিকড় ও পাতা খেয়ে আছে একথা অসত্য” – এই বলে যে সরকার প্রেস নোট প্রকাশিত হয়েছিলো তিনি তাকে চ্যালেঞ্জ করেন। শামশের আলী অনাহারে মৃত্যুর কতকগুলি উদাহরণ উল্লেখ করে মহম্মদ আফজলসহ অন্যান্য পরিষদ সদস্যদেরকে “প্রত্যাহার” করে নেওয়ার জন্যে জনগণের কাছে আহ্বান জানান। 

সরকারের সমালোচনা প্রসঙ্গে বি.ডি. হাবিবুল্লাহ বলেন যে, বর্তমান সরকার যদি জনগণকে খাদ্য দিতে না পারে এবং তারা যদি অনাহারে মারা যায় তাহলে তাঁদের গদীতে বসে থাকার কোন অধিকার নেই। তিনি আরও বলেন যে খোদাতালার রুদ্ররোষের জন্যে নয়, সরকারী নীতি নির্ধারকদের দুর্নীতির জন্যেই খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। 

মহম্মদ আলী আশরাফ দুর্গত এলাকায় নিজের সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, পটুয়াখালি মহকুমার আটটির মধ্যে ছয়টি থানায় ১৫০০ বর্গ মাইল এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং জনসাধারণ সেখানে সত্যি সত্যিই অনাহারে থাকছে। তিনি সেই দুরবস্থাকে আশঙ্কাজনক বলে বর্ণনা করেন। প্রতিটি ইউনিয়নে প্রায় ৩০০ জন মানুষ তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত অনাহারে থাকছে। আলী আশরাফ অনাহার মৃত্যু এবং আত্মহত্যার কতকগুলি উদাহরণ সভায় উল্লেখ করেন। 

তথ্যসূত্র 

১. মিল্লাত, ১৪.৩.১৯৪৭। 

২. পূর্বোক্ত। 

৩. Peoples Age 3.৪. 1947, Vol. Vi. No. 5. 

৪. Peoples Age. 3.৪.1947, Vol. Vi. No. 5. 

স্বাধীনতার এই রিপোর্টের ইংরেজী অনুবাদ পিপলস্ এজ-এর উপরোক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বর্তমান উদ্ধৃতিটি সেই ইংরেজী অনুবাদের বঙ্গানুবাদ। 

৫. মহাজন কনট্রোলের এই রেশন কার্ড নিজের কাছে রেখে সেটা দিয়ে সুতো কেনে এবং চড়া দরে অন্যের কাছে বিক্রী করে অতিরিক্ত মুনাফা কামায়- (ব.উ.)। 

৬. Peoples Age. 3.৪.1947, Vol. V. No. 5. 

৭. Peoples Age, (Fifteenth August Number). Vol. Vi. Nis. 6+7, Fridy, August 15, 1947 P 1৪. 

৮. ময়মনসিংহ জেলা উদ্বৃত্ত হিসেবে সেখানে কর্ডন থাকলেও সেই জেলার অন্তর্গত টাঙ্গাইল মহকুমা ঘাটতি এলাকা হওয়ায় সেখানে ঐ সময় কর্ডন ছিলো না। শুধু মহকুমাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ থানা এলাকার জন্যেও বিশেষ ব্যবস্থা চালু ছিলো। 

৯. ইমতিয়াজউদ্দীন খান (জেলা কর্ডনিং অফিসার, বরিশাল, অগাস্ট-ডিসেম্বর, ১৯৪৭)।

১০. মোহন মিঞা তখন হাবিবুল্লাহ বাহারের স্থানে সাময়িকভাবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাজ করছিলেন। এর পর ডিসি প্রাদেশিক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। 

১১. সিলেট জেলায় এদেরকে ভাগালু বলা হয়। 

১২. এই সব এলাকায় অনেক ক্ষেত্রে বাইরের গৃহ শিক্ষক ও মৌলভীরাও টাকার পরিবর্তে ধান নিতেন পারিশ্রমিক হিসেবে। 

১৩. কমরুদ্দীন আহমদ। 

১৪. কমরুদ্দীন আহমদ। 

১৫. তাজউদ্দীন আহমদ-এর ডায়েরী। 

১৬. পূর্বোক্ত, ১২.১.৪৮। 

১৭. কমরুদ্দীন আহমদ, তফজ্জল আলী। 

১৮. তাজউদ্দীন আহমদ ডায়েরী। 

১৯. পূর্বোক্ত। 

২০. কমরুদ্দীন আহমদ, তফজ্জল আলী। 

২১. কমরুদ্দীন আহমদ। 

২২. Assembly Proceedings 2nd Session, 194৪. Vol. II, P 123. 

২৩. ১৯৪৮ সালের ২৯শে জানুয়ারী সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় “ খাদ্য সমস্যা” শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে আসন্ন খাদ্য সংকটের উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু সংকট সেখানে তখনো পর্যন্ত তীব্র আকার ধারণ না করায় সে বিষয়ে কোন বিস্তৃত বিবরণ তাতে পাওয়া যায় না। 

২৪. নওবেলাল, ৪-৩-১৯৪৮। 

২৫. পূর্বোক্ত। 

২৬. পূর্বোক্ত। 

২৭. পূর্বোক্ত, ১১-৩-১৯৪৮। 

২৮. পূর্বোক্ত, ১৯-০৩-১৯৪৮। 

২৯. পূর্বোক্ত, ১৫-৪-১৯৪৮। 

৩০. পূর্বোক্ত, ২২-৪-১৯৪৮, ৬-৫-৪৮। 

৩১. পূর্বোক্ত, ১০-৬-১৯৪৮। 

৩২. সিলেটে স্থানীয় নানকার প্রজাদের ওপর বিবিধ রকম নির্যাতনকারী ভূমি মালিকদের মীরাসদার বলা হয়। 

৩৩. নওবেলাল, ২৪-০৬-৪৮ 

৩৪. পূর্বোক্ত, ১৫-৭-৪৮। 

৩৫. The East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Sceond Session, 194৪ (June), Vol. II, P 90. 

৩৬. পূর্বোক্ত, পৃ ৯০-৯১। 

৩৭. পূর্বোক্ত, পৃ ৯১। 

৩৮. পূর্বোক্ত, পৃ ৯১-৯২। 

৩৯. EB Legislative Assembly Proceedings, First Session, 194৪ (April), Vol. 1, No. 4, P 5. 

৪০. EB Assembly Proceedings, Sceond Session, 194৪. Vol. II, P 92. 

৪১. পূর্বোক্ত, পৃ ৯৩। 

৪২. পূর্বোক্ত, পৃ ৯৩-৯৪। 

৪৩. পূর্বোক্ত, পৃ ১২০, ১২২। 

৪৪. পূর্বোক্ত, পৃ ১২২। 

৪৫. পূর্বোক্ত, পৃ ১২২-২৫।

৪৬. পূর্বোক্ত, পৃ ১২৬-২৭।

৪৭. পূর্বোক্ত, পৃ ১২৭।

৪৮. পূর্বোক্ত, পৃ ১২৮-২৯।

৪৯. পূর্বোক্ত, পৃ ১২৯।

৫০. পূর্বোক্ত, পৃ ১৩০।

৫১. পূর্বোক্ত, পৃ ১৩০। 

৫২. ধাওয়ালদের। 

৫৩. পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৩।

৫৪. পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৪।

৫৫. পূর্বোক্ত। 

৫৬. পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৫-৩৬।

৫৭. পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৬।

৫৮. পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৮।

৫৯. পূর্বোক্ত, পৃ ১২৯-৩০।

৬০. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪০-৪২।

৬১. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪২।

৬২. পূর্বোক্ত। 

৬৩. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪২-৪৩। 

৬৪. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৫। 

৬৫. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৮। 

৬৬. কমরুদ্দীন আহমদ। 

৬৭. সাপ্তাহিক সৈনিক, ২৮-১১-১৯৪৮। 

৬৮. বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের একটি হিসেবমতে পূর্ব বাঙলার কতকগুলি ঘাটতি অঞ্চলে ডিসেম্বর, ১৯৪৮ এবং জানুয়ারী, ১৯৪৯ এ চালের দর ছিলো নিম্নরূপ : ঢাকা সদর ৪৫, নারায়ণগঞ্জ ৪৫, মানিকগঞ্জ ৪৫, মুন্সীগঞ্জ ৪৩, ফরিদপুর সদর ৩৩।০, গোয়ালন্দ ৩৭, মাদারীপুর ৪১, গোপালগঞ্জ (২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৯), চট্টগ্রাম সদর ২২।০, কক্সবাজার ২১, ত্রিপুরা (সদর উত্তর) ৩৬।০, ত্রিপুরা (সদর দক্ষিণ) ২৭০, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৪৪, চাঁদপুর ৩৪০, নোয়াখালী ৩০০, ফেণী ২২০। (East Bengla Legislative Assembly Procedings, Vol, IV-No. I. P 14-11). 

৬৯. পূর্বোক্ত। 

৭০. সৈনিক, ৫.১২.১৯৪৮। 

৭১. আজাদ, ২৪.১.১৯৪৯। 

৭২. ধানকাটা মজুরদের এই দুর্দশার উল্লেখ করে ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার কয়েকজন সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি প্রদান করেন (আজদ, ২০শে জানুয়ারী ১৯৪৯)। 

৭৩. আজাদ, ৩০-১-১৯৪৯। 

৭৪. আজাদ, ১২-২-১৯৪৯। 

৭৫. আজাদ, ২১-২-৪৯।

৭৬. সৈনিক, ১৮-৩-৪৯। 

৭৭. সৈনিক, ২৫-৩-৪৯। 

৭৮. আজাদ, ১৫-৪-৪৯, ১১-৪-৪৯। 

৭৯. আজাদ, ৩-৫-৪৯, ৭-৫-৪৯। 

৮০. আজাদ, ১৫-৫-৪৯। 

৮১. আজাদ, ১৮-৫-৪৯। 

৮২. আজাদ, ২১-৫-৪৯। ৮৩. পূর্বোক্ত। 

৮৪. আজাদ, ৮-৬-১৯৪৯। 

৮৫. আজাদ, ২১-৫-৪৯। 

৮৬. আজাদ ২৪-৬-৪৯। 

৮৭. উদ্ধৃত, সৈনিক, ২২-৭-৪৯। 

৮৮. সৈনিক, ২২-৭-৪৯। 

৮৯. সৈনিক, ৮-৮-৪৯। 

৯০. নওবেলাল, ১-৯-৪৯। 

৯১. সৈনিক, ৯-৯-৪৯। 

৯২. সৈনিক, ১৬-৯-৪৯। 

৯৩. নওবেলাল, ৩-১০-৪৯। 

৯৪. নওবেলাল, ১০-১০-৪৯। 

৯৫. সৈনিক, ২৮-১০-৪৯। 

৯৬. নওবেলাল, ১৭-৭-৪৯। 

৯৭. পূর্বোক্ত। 

৯৮. পূর্বোক্ত। 

৯৯. পূর্বোক্ত। 

১০০. আজাদ, ৫-২-৪৯। 

১০১. আজাদ ১৪-২-৪৯। 

১০২. আজাদ, ২-৪-৪৯। 

১০৩. আজাদ, ১৭-৫-৪৯। 

১০৪. নওবেলাল, ২৫-৮-৪৯। 

১০৫. পূর্বোক্ত। 

১০৬. উদ্ধৃত,নওবেলাল, ২৯-১২-৪৯। 

১০৭. নওবেলাল, ২৯-১২-৪৯। 

১০৮. ইনি নিজেকে একজন গ্রামবাসী এবং প্রকিওরমেন্ট বিভাগের তালিকাভুক্ত একজন বড়চাষী বলে অভিহিত করেন। 

১০৯. নওবেলাল, ৯-২-১৯৫০। 

১১০. লেভীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ এ বইয়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে (পূর্ব বাঙলায় কৃষক আন্দোলন) দ্রষ্টব্য। 

১১১. উদ্ধৃত নওবেলাল। 

১১২. নওবেলাল। 

১১৩. East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Vol. I, No. 4, P 29।

১১৪. পূর্বোক্ত। 

১১৫. পূর্বোক্ত, P 1৪4 

১১৬. EBLA. Proceedings, Vol. II. P 2৪। 

১১৭. পূর্বোক্ত, P 27. 

১১৮. E.B.L.A. Proceedings, Fourth Session 1949-50 Vol. IV. No. 1. P. 7.

১১৯. পূর্বোক্ত। P 6. 

১২০. EBLA. Proceedings, Fourth Session, 1949, Vol IV, No. 2, P. 144.

১২১. পূর্বোক্ত, P 16৪-69. 

১২২. পূর্বোক্ত, P 16৪-69. 

১২৩. উদ্ধৃত নওবেলাল, ১.১.১৯৫১, পৃ ২। 

১২৪. আজাদ, ২-২-৪৯। 

১২৫. আজাদ, ১০-২-৪৯। 

১২৬. আজাদ, ১৬-৬-৪৯। 

১২৭. আজাদ, ১৮-৬-৪৯। 

১২৮. আজাদ, ২৩-৬-৪৯। 

১২৯. আজাদ, ২৩-৬-৪৯। 

১৩০. আজাদ, ৮-৭-৪৯। 

১৩১. নওবেলাল, ১২-৪-১৯৫১ দৈনিক আজাদ থেকে উদ্ধৃত। 

১৩২. পূর্বোক্ত। 

১৩৩. নওবেলাল, ৩-৫-১৯৫১। 

১৩৪. পূর্বোক্ত। 

১৩৫. পূর্বোক্ত, ৭-৬-১৯৫১। 

১৩৬. পূর্বোক্ত, ২১-৬-১৯৫১। 

১৩৭. পূর্বোক্ত। 

১৩৮. সৈনিক, ২৪-৬-১৯৫১। 

১৩৯. সৈনিক, ১৫-৭-১৯৫১। 

১৪০. বাংলা ১৩৫০ অর্থাৎ ১৯৪৩ সাল। 

১৪১. নওবেলাল, ২-৮-১৯৫১।

১৪২. নওবেলাল, ২৫-১০-১৯৫১।

১৪৩. আজাদ, ৮-১১-১৯৫১।

১৪৪. আজাদ, ১৩-১১-১৯৫১।

১৪৫. আজাদ, ১২-১১-১৯৫১।

১৪৬. আজাদ, ১৪-১১-১৯৫১। 

১৪৭. আজাদ, ২০-১১-১৯৫১।

১৪৮. নওবেলাল, ১৮-১০-১৯৫১।

১৪৯. নওবেলাল, ১৮-১০-১৯৫১। 

১৫০. আজাদ, ১২-১০-১৯৫১। 

১৫১. আজাদ, ২৬-১০-৫১। 

১৫২. আজাদ, ২৮-১০-৫১ এবং নওবেলাল ১-১১-৫১। 

১৫৩. উদ্ধৃত, নওবেলাল, ১১-১১-১৯৫১। 

১৫৪. নওবেলাল, ১-১১-১৯৫১ পৃ ২। 

১৫৫. নওবেলাল, ১-১১-১৯৫১ পৃ ২। 

১৫৬. EBLA. Proceedings, Sixth Session, 1951, Vol. VI, No. 2, p 157-5৪.

১৫৭. EBLA. Proceedings, Sixth Session, 1951, Vol. VI, No. 2, P 135-36. 

১৫৮. পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৬-৩৮। 

১৫৯. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪০-৪১। 

১৬০. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪১-৪২। 

১৬১. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪২-৪৩। 

১৬২. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৩। 

১৬৩. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৩-৪৪। 

১৬৪. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৫। 

১৬৫. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৫। 

১৬৬. পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৭-৪৮। 

১৬৭. পূর্বোক্ত, পৃ ১৫১। 

১৬৮. পূর্বোক্ত, পৃ ১৫২। 

১৬৯. পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৪-৫৬।

১৭০. পূর্বোক্ত, পৃ ১৫-৬-৫৮।

১৭১. আজাদ, ৩-১১-৫১।

১৭২. পূর্বোক্ত। 

১৭৩. আজাদ, ৭-১১-১৯৫১। 

১৭৪. আজাদ, ১৫-১১-১৯৫১। 

১৭৫. পূর্বোক্ত। 

১৭৬. পূর্বোক্ত। 

১৭৭. আজাদ। 

১৭৮. দ্রষ্টব্য, বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক 

১৭৯. দ্রষ্টব্য, বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক। 

১৮০. তৃতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। 

১৮১. নওবেলাল, ৩.১১.৪৯। 

১৮২. দ্রষ্টব্য : বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড), পৃ : ৬-১৪। 

১৮৩. ২ নভেম্বর মুদ্রিত সার্কুলার। 

১৮৪. বরিশালের প্রতিরোধ সম্পর্কে এই তথ্য প্রধানতঃ স্বদেশ বসু ও আব্দুশ শহীদ থেকে প্রাপ্ত।

১৮৫. ‘পাকিস্তানের যুব সমাজের প্রতি’, ঈশ্বরদীতে অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিভাগীয় যুব সম্মেলনে গৃহীত ইস্তাহার, প্রকাশক : মোহাম্মদ একরামুল হক, সেক্রেটারী গণতান্ত্রিক যুব লীগ, রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক কমিটি, হোসেনগঞ্জ, রাজশাহী, সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ সাল, মূল্য তিন আনা। 

১৮৬. সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় এ সম্পর্কে অনেক রিপোর্ট আছে। 

১৮৭. নওবেলাল। 

১৮৮. সৈনিক, ২১-১০-৪৯, শওকত আলী, খোন্দকার মোস্তাক আহমদ। 

১৮৯. সৈনিক, ২১-১০-৪৯। 

১৯০. শওকত আলী। 

১৯১. সৈনিক, ২১-১০-৪৯। 

১৯২. পুরাতন ঢাকা রেলওয়ে-বউ. 

১৯৩. শওকত আলী। 

১৯৪. শওকত আলী। 

১৯৫. ক্যাপ্টেন শাহজাহান, মিসেস শাহজাহান। 

১৯৬. শেখ মুজিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন শাহজাহন। 

১৯৭. আজাদ, ১২-১০-১৯৫১। 

১৯৮. আজাদ, ১৩-১০-১৯৫১। 

১৯৯. আজাদ, ১৩-১০-১৯৫১। 

২০০. পূর্বোক্ত। 

২০১. আজাদ, ১৬-১০-১৯৪৯ এবং নওবেলাল ২০-১০.৪৯। 

২০২. Pakistan Observer – 20-6-1951. 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *