প্রথম পরিচ্ছেদ : ‘গহরায় আগুন’

প্রথম পরিচ্ছেদ – ‘গহরার আগুন’

‘ওই যে দেখছ ঘাসে ঢাকা ময়দান, ওতে যদি আগুন লাগাও তবে কিছুতে তা আটকাবে না। তবে যে আগুন গহরায় শুরু হয়েছে তা ডাঙায় উঠে এলে আটকায় এমন বাহাদুর কে আছে?’—আলিবর্দি খান।

১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে ওড়িশার উপকূল দিয়ে বর্ষাকালের শেষে পাঁচটি রণতরী মাদ্রাজ থেকে কলকাতার দিকে প্রতিকূল হাওয়ায় কোনোমতে জল ঠেলে মন্থর গতিতে এগোচ্ছিল। পিছনে পাঁচখানা সৈন্যবাহী জাহাজ, তাতে নয়শ গোরা সৈন্য আর পনেরশ তেলেঙ্গা সিপাহী। প্রবল জলস্রোত পার হয়ে কলকাতা পৌঁছাতে বছর পেরিয়ে গেল। দীর্ঘ জলপথে কিছু করার নেই। নওয়ারার অধ্যক্ষ দিলীর জঙ্গ, গোরা সৈন্য ও পনেরশ তেলেঙ্গা সিপাহীর নায়ক সাবিৎ জঙ্গ। বিস্ততবাসনায় উত্তেজিত মস্তিষ্কে তাঁরা যুদ্ধ জয়ের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে নানা তর্কাতর্কিতে কালক্ষেপ করতে লাগলেন। তদানীন্তন হায়দরাবাদ ও মুর্শিদাবাদের অভিজাত মোগল সমাজে দিলীর জঙ্গ ও সাবিৎ জঙ্গ নামে চিহ্নিত এই দুই সন্দিহান ভাগীদারের প্রকৃত পরিচয় অ্যাডমিরাল ওয়াটসন ও কর্ণেল ক্লাইভ।

মাদ্রাজের কাউনসিল থেকে নবাব কর্তৃক বিতাড়িত কলকাতার বিধ্বস্ত সিলেক্ট কমিটির কাছে এঁরা একখানা চিঠি নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাতে মাদ্রাজ কাউনসিল মন্তব্য করেছেন, বাংলার নবাবের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনো দরকার নেই। বরং যুদ্ধের পিছনে ‘কোম্পানির তহবিল থেকে অর্থশ্রাদ্ধ’ না করে নবাবের সঙ্গে সন্ধির চুক্তি করাই যুক্তিযুক্ত। চুক্তিতে ইংরেজ কোম্পানির কোনো নতুন সুযোগ সুবিধে থাকবে না, কেবল নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ কলকাতা প্রত্যর্পণ করবেন, নবাবী ফৌজের হাতে লুন্ঠিত শহরের অধিবাসীদের ক্ষতিপূরণ দেবেন এবং মোগল বাদশাহ ফাররুক্‌শিয়রের ফারমান (১৭১৭) মোতাবেক ইংরেজদের করমুক্ত বাণিজ্যে কোনো বিঘ্ন উৎপাদন করবেন না। কিন্তু চিঠির একটি ইঙ্গিত প্রথম থেকেই দুই সেনাপতির মনে ধরেছিল, তা হল এই যে শর্ত আদায়ের জন্য অল্পস্বল্প লুঠতরাজ বা যুদ্ধবিগ্রহের প্রয়োজন হতে পারে, বা, নবাবের শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলানোর সুযোগ মিলতে পারে। আঙ্গরিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিম উপকূলের সুবর্ণদুর্গ অভিযানের সময় লুঠতরাজ করে ক্লাইভ ও ওয়াটসন এর আগে অনেক ধনোপার্জন করেছিলেন। তবে সেবার ক্লাইভের ভাগে কিছু কম পড়েছিল, তাই আশু ধনসমাগমের আশায় বালেশ্বরের উপকূল দিয়ে যেতে যেতে দুই ভাগীদার স্থির করে রাখলেন এবার বখরা হবে সমান সমান, কারো কম কারো বেশি নয়। বছর পেরিয়ে যেতে দেখা গেল ক্লাইভ ওয়াটসনের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার পালন করেন নি।

মাদ্রাজ কাউনসিলের পত্রনির্দেশ এবং ক্লাইভ-ওয়াটসনের জল্পনা কল্পনা বিচার করলে বোঝা যায়, রাজ্য বিস্তারের চিন্তায় কোনো ইংরেজের মস্তিষ্ক তখনো উত্তেজিত হয়ে ওঠেনি। ছলে বলে কৌশলে নিজ নিজ উপার্জিত সম্পত্তি বৃদ্ধির উপরেই কোম্পানির উর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মচারীদের নজর সীমাবদ্ধ ছিল। ইংল্যাণ্ডের রাজা কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত সামরিক অফিসার কর্ণেল ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াট্‌সনও নিজ নিজ বখরার কথা ছাড়া কিছু ভাবতে পারেন নি। যেহেতু গোটা অভিযানের ব্যয় নির্বাহ করছিলেন মাদ্রাজ কাউনসিল, তাই কাউনসিলের নির্দেশই তাঁদের শিরোধার্য ছিল। মাদ্রাজ কাউনসিলের নির্দেশ ছিল খুব সুস্পষ্ট। তাতে সুবাহ্‌ বাংলা বিহার ওড়িশায় ইংরাজ রাজশক্তি প্রতিষ্ঠার কোনো ইঙ্গিত ছিল না। কেবল ফার্‌রুকশিয়রের ফারমানের সুযোগ নিয়ে কোম্পানি যে বৈষম্যমূলক বাণিজ্য বিস্তার করেছিল, জোর করে সেই একতরফা নিষ্কর ব্যবসা আবার চালু করাই মাদ্রাজ ও কলকাতার কর্মকর্তাদের প্রধান এবং আপাতত একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এঁদের সবার উপরে বিলেত থেকে কোম্পানির ডিরেক্টরদের কড়া নির্দেশ ছিল, আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর মসনদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কোনো বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তাঁরা যেন কোম্পানিকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করেন। এই নির্দেশ স্থানীয় কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত পালন করেন নি। এর কারণ কিন্তু রাজ্য বিস্তারের আগ্রহ নয়, বরঞ্চ মুর্শিদাবাদ রাজনীতির আবর্তে উথ্থিত অর্ধরাশির প্রতি প্রচণ্ড লোভ। সুবাহ্ বাংলা বিহারে ইংরাজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সংঙ্কল্প নিয়ে তাঁরা বিলাতের আদেশ লঙ্ঘন করতে অগ্রসর হন নি।

বর্ষার শেষে কলকাতা পুনরুদ্ধার হল। লড়াইয়ে ইংরাজদের বিক্রম দেখে বিস্মিত হয়ে নবাব সন্ধি করে ফেললেন। ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি থাকায় আলিনগরের সন্ধি বিষয়সচেতন ইংরাজদের পক্ষে বেশ মনোগ্রাহী হল। তাদের তরফ থেকে অনিবার্য গতিতে নবাব সরকারের সঙ্গে চরম সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাবার কোনো আপাতগ্রাহ্য কারণ রইল না। কিন্তু মুর্শিদাবাদের মোগল শাসক মহলের মধ্যে হঠকারী দুর্দাম অসংযতচিত্ত নবাবের বিরুদ্ধে মুহুর্মূহঃ চক্রান্ত শুরু হবার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেল। ষড়যন্ত্র তাঁদের কাছে নতুন ব্যাপার নয়, এবং নিজেদের ক্ষমতাচ্যুত করে কোম্পানিকে সর্বেসর্বা বানানোর অভিসন্ধিও তাঁদের ছিল না। সতের বছর আগে মুর্শিদাবাদের তিন প্রধান রাজপুরুষ ইংরেজদের অপেক্ষা না রেখেই তখনকার নবাবের বিরুদ্ধে চক্রান্ত পাকান। সেবার উচ্ছৃঙ্খল তরুণ নবাব সরফরাজ খান যুদ্ধে নিহত হন এবং পাটনার শাসক আলিবর্দি খান মুর্শিদাবাদের মসনদে অবৈধভাবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ওই তিন রাজপুরুষ ছিলেন হাজি আহ্‌মদ, দেওয়ান আলমচন্দ ও জগৎশেঠ ফতেহ্‌চন্দ। এবার কিন্তু সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী খামখেয়ালী মাসতুত ভাই শওকৎ জঙ্গকে পূর্ণিয়ার আসন থেকে ধনে প্রাণে উৎপাটন করে নবাব মনসুর-উল-মুল্‌ক্‌ মির্জা মহম্মদ শাহ কুলী খান সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ বাহাদুর হায়বৎ জব্দ তাঁর প্রতিপক্ষদের সাজানো খুঁটি তছনছ করে দিয়েছিলেন। তাই রাজনীতির দাবাখেলায় ইংরেজ গোলন্দাজ ও তেলেঙ্গা পদাতিক আমদানীর প্রয়োজন হয়ে পড়ল। এর শেষ পরিণতি কি হবে জগৎ শেঠ ও মোগল রাজপুরুষরা গণনা করতে পারেন নি, ইংরেজ কোম্পানির ছোট বড়ো কতারাও পারে নি। যাঁরা নিজ নিজ স্বার্থ সিদ্ধির খেলায় মগ্ন ছিলেন, তাঁরা ভারতবর্ষের নিয়তি নিয়ে যে খেলা শুরু হল সে সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না, আর সত্যি বলতে কি সে চৈতন্য হবার কোনো স্পষ্ট কারণ তখন ছিল না।

ব্যাপারটা আর একটু তলিয়ে দেখা দরকার। ভারতচন্দ্র বর্ণিত সরফরাজ হত্যা ও অখ্যাত গ্রাম্যকবি বর্ণিত পলাশীর যড়যন্ত্রের মধ্যে কোনো গুরুতর উদ্দেশ্যগত পার্থক্য ছিল না।১০ সমগ্র ভারতবর্ষের কথা দূরে থাক, সুবাহ্‌ বাংলা বিহারের রাজনীতির জগতেও পলাশীর চক্রান্ত কোনো আগাগোড়া পরিবর্তন ঘটানোর সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল না। মোগল রাজপুরুষ বা ইংরেজ কোম্পানি কর্মচারী, কোনো পক্ষ থেকে নয়। নিজামতের সামরিক নেতৃপদে অধিষ্ঠিত মনসবদারান্‌, দেওয়ানী বিভাগের প্রভাবশালী হিন্দু মুৎসুদ্দিয়ান্‌, এবং মুর্শিদাবাদ খাজাঞ্চীখানার অধিপতি জগৎশেঠ পরিবার, আদপেই কোম্পানির ধামাধরা ছিলেন না। সরফরাজ খানকে মসনদ থেকে সরিয়ে যে খেলায় এঁদের হাত পেকেছিল, সেই অভ্যস্ত খেলা খেলতে গিয়ে মুর্শিদাবাদের প্রধান প্রধান রাজপুরুষরা সাবিং জঙ্গ, দিলীর জঙ্গ ও কাশিমবাজার কুঠীর ওয়াট্‌স্‌ সাহেবকে দলে টেনেছিলেন। পলাশীর বিপ্লবের পর সাবিৎ জঙ্গ ও তাঁর প্রধান টুপীওয়ালা সহকর্মীদের এরা মোগল মনসবদার শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত করে নেবার প্রয়াস পান।১১ ইংরেজরা না থাকলেও অন্য কোনো উপায়ে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌কে মসনদ থেকে হটাবার পুনঃ পুনঃ চেষ্টা থেকে এই অধ্যবসায়ী রাজপুরুষেরা নিশ্চয় বিরত হতেন না। কি দিল্লীতে কি বা অন্যান্য সুবায় রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষমতার লড়াই করা মোগল মনসবদার শ্রেণীর বংশানুক্রমিক অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছিল। আলিবর্দি খান চক্রান্ত করে সুবাহ্ বাংলা বিহার ওড়িশার নাজিম হবার পর যদিও এই অন্তর্দ্বন্দ্ব নিজের চরিত্রবলে আয়ত্তের মধ্যে রেখেছিলেন, তবুও পুনঃ পুনঃ বর্গি হাঙ্গামায় তাঁর শক্ত মুঠি কতক পরিমাণে শিথিল হয়ে গেছিল, এবং ১৭৫১ খ্রীস্টাব্দে মারাঠা অশ্বারোহীদের উড়িষ্যা এবং বাৎসরিক ১২ লক্ষ টাকার চৌথ প্রণামী দিয়ে মানে মানে বিদায় করা সত্ত্বেও তাঁর মৃত্যুর শেষ তিন চার বছর আগে থেকে (১৭৫৩-৪) মুর্শিদাবাদের মোগল মনসবদার শ্রেণীর অন্তর্ঘাতী হানাহানি আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।১২ সে কথায় পরে আসছি। সাধারণ ভাবে এ কথা মনে রাখা দরকার যে সরফরাজ খান, আলিবর্দি খান, সিরাজউদ্দৌলাহ্‌, শওকৎ জঙ্গ, মীরজাফর, রায় দুর্লভ, হোসেন কুলী খান, খাদিম হোসেন খান, ইয়ার লতিফ খান, রাজা মোহনলাল এবং অন্যান্য প্রধান প্রধান মোগল রাজপুরুষদের সকলের মনসবদার শ্রেণীভুক্ত নিজ নিজ মনসব বা পদানুক্রম নির্দিষ্ট ছিল। মুর্শিদাবাদের মসনদে ঘন ঘন নবাব পরিবর্তনের খেলায় যাঁরা মগ্ন ছিলেন, তাঁরা স্বাভাবিক কারণেই এটা চান নি যে মসনদ মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরের ফলে খেলাটাই বন্ধ হয়ে যাক।

কোম্পানি বাহাদুর কি কোনো বিপরীত পরিকল্পনার বশবর্তী হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন? তাও নয়। প্রথমে বলে রাখা দরকার যে প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্যক্তিগত ভাবে কোম্পানির কর্মচারীরা সর্বক্ষেত্রে এক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কাজ করতেন না। কোম্পানির সঙ্গে কোম্পানির স্থানীয় কর্মকর্তাদের পার্থক্য মোগল রাজপুরুষেরা স্পষ্ট ভাবে বুঝতেন না। কোম্পানি একটি বণিক সমষ্টি, একটি নৈর্ব্যক্তিক কর্পোরেশন, এবং আইনের চোখে একজন ব্যক্তিবিশেষ, এ সব তত্ত্বের সঙ্গে তাঁরা তখনো পরিচিত হন নি। মসনদে আরোহণের বহুদিন পরেও ক্লাইভের আশ্রিত মীরজাফর ক্লাইভের কতাঁকে একজন মহামহিম রাজপুরুষ বলে কল্পনা করতেন, তার আঁচ পাওয়া যায় সাবিৎ জঙ্গকে সুপারিশ করে বিলেতে কোম্পানি বাহাদুরের কাছে তিনি যে বার্তা প্রেরণ করেন তাই থেকে।১৩ কিন্তু বস্তুতপক্ষে কোম্পানির সঙ্গে কোম্পানির স্থানীয় কর্মকতাদের মধ্যে স্বার্থসংঘাত পলাশীর যুদ্ধের বহু আগে থেকে প্রকট হয়ে উঠেছিল। অধীনস্থ দেশীয় দালাল ও গোমস্তাদের ছদ্মনামে কোম্পানির কাছে নিজেদের পণ্য চড়াদামে বিক্রী করে মুনাফা করা, কোম্পানির জন্য পণ্যক্রয়ের সময় দেশীয় বণিকদের কাছ থেকে ‘দস্তুর’ আদায় করা, কোম্পানির টাকায় নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য চালানো, সময় সময় কোম্পানির তহবিল তছরূপ করে গা-ঢাকা দেওয়া, নিজেদের কাণ্ডকারখানা গুপ্ত রাখার অভিসন্ধিতে বিলাতে কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে আগাগোড়া মিথ্যা কথা লিখে পাঠানো, এই সব কীর্তিকলাপ কোম্পানির নিম্নতম কুঠিয়াল সাহেব থেকে শুরু করে কলকাতার গভর্ণর পর্যন্ত সর্বস্তরের লোভী ও অসৎ সিবিলিয়ানদের শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।১৪ মনিবের উপর দিবারাত্রি প্রবঞ্চনা করে কোম্পানির কুঠীর যে সব বড়ো সাহেব ও ছোট সাহেব নিজেদের থলি ভর্তি করে দেশে ফেরবার জন্য পা বাড়িয়ে থাকতেন, নবাবী রাজশক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমগ্র সুবাহ্‌র রাজস্ব ভাণ্ডার লুঠতরাজ করবার অবসর পেলে সেই লোকেরা যে পশ্চাৎপদ হবে না তা বিশদ করে বলবার অপেক্ষা রাখে না। ফরাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধার পর ইংরাজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি দেশীয় রাজশক্তিকে স্বপক্ষে টানার প্রয়োজন অনুভব করতে শুরু করলেও বাণিজ্যহানির আশঙ্কায় তাঁরা যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজ্যবিস্তারের ব্যাপারে মোটই উৎসুক ছিলেন না। নিজেদের গূঢ় স্বার্থের তাড়নায় এবং স্থানীয় ঘটনাচক্রের টানে কোম্পানির কর্মচারীরা ঘন ঘন কোম্পানির নির্দেশের সীমা অতিক্রম করতে শুরু করলেন। পলাশীর আগের বা পরের কোনো সন্ধিবিগ্রহ বিলেতের নির্দেশক্রমে ঘটে নি। এক জাহাজ পাঠিয়ে আর এক জাহাজে বিলেত থেকে নির্দেশ আনতে বেশ কয়েক মাস কেটে যেত। এ অবস্থায় স্থানীয় সাহেবদের উপর নির্ভর করা ছাড়া কোম্পানির গত্যন্তর ছিল না।

তবে কোম্পানীর সঙ্গে নবাবের বিরোধ বাধল কেন? এ বিরোধ এক দিনের নয়। ১৭১৭ খ্রীস্টাব্দে দিল্লী থেকে মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে কোনো নবাবী চৌকীতে নৌকা না থামিয়ে মাল না দিয়ে সওদা চালাবার অবাধ অধিকার সম্বলিত মোগল ফারমান নিয়ে আসা থেকে শুরু করে ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে কোম্পানীর কলকাতা দুর্গে নবাবী ফৌজ প্রতিরোধের দুঃসাহসিক চেষ্টা পর্যন্ত ইংরাজদের উদ্ধত কার্য কলাপের ধারা নবাব সরকারকে উত্তরোত্তর সচকিত করে তুলেছিল। দিল্লী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বাদশাহী ফারমান তুচ্ছ করার মতো মনোবৃত্তি মুর্শিদাবাদের মোগল মনসবদার মহলের ছিল না। কিন্তু ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া কাঁহাতক বরদাস্ত হয়? ইংরেজরা মুর্শিদাবাদের মাথার উপর দিয়ে দিল্লী থেকে ফারমান হস্তগত করার পর থেকে খুঁটিনাটি কারণে প্রায় প্রত্যেক বছরই কোম্পানীর নৌকাগুলির সঙ্গে নবাবী চৌকীগুলির বিরোধ বাধতে লাগল। কলকাতা কাশিমবাজারের সুরক্ষিত আবাস থেকে পাটনা পর্যন্ত গঙ্গা বক্ষে বরকন্দাজ বোঝাই নৌকায় বিপুল বিক্রমে সশস্ত্র সওদা চালানো, কোম্পানীর দস্তক লটকে কোম্পানীর দেশী বিলাতী কর্মচারীদের নিজস্ব পণ্যদ্রব্য বিনাশুল্কে পাচার করা, নবাব সরকারে উচিত মতো খাজনা ও নজরানা দিতে একদল বেয়াদব ফিরিঙ্গি সওদাগরের গররাজি বা নিমরাজি হওয়া, পরিশেষে নবাবী হুকুমতের মধ্যেই নবাবী হুকুম অগ্রাহ্য করে ফরাসডাঙ্গার ফিরিঙ্গিদের উপর কলকাতার ফিরিঙ্গিদের মারমুখীভাব দেখানো, এই সব লক্ষ্য করতে করতে সুজাউদ্দিন খান থেকে শুরু করে আলিবর্দি খান পর্যন্ত সব নবাব বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে উঠলেন।

‘এই ফিরিঙ্গি গুলার অপকর্মের কি বয়ান দেবো আপনাকে,’ এই কথা দিল্লীর সেনাপতি খান দৌরানকে লিখলেন মুর্শিদাবাদের নবাব সুজাউদ্দিন খান।১৫ ‘প্রথমে এগুলা যখন এদেশে এল তখন নিতান্ত দীন বিনীত ভাবে তখনকার সুবাহ্‌র কাছে কুঠী তুলবার জন্য একখণ্ড জমি কিনবার পরওয়ানা চেয়ে আর্জি করল। যেই না পরওয়ানা পাওয়া অমনি সেখানে রাতারাতি একটা মস্ত কেল্লা বানিয়ে বুরুজগুলির উপরে সব বড়ো বড়ো কামান বসাল, আর চারদিকে গড়খাই কেটে দরিয়ার সঙ্গে একেবারে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে ফেলল। যত সব ফেরারী সওদাগর আর অন্যান্য প্রজাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে ওরা ঐখানে নিজেদের হেফাজতে রেখেছে আর মালগুজারী যা আদায় করছে তার পরিমাণ লাখ টাকা।’

১৭৩০ থেকে ১৭৫০ এর মধ্যে বছর বছর মোগল ফৌজদারের আওতায় হুগলী বন্দরে যত জাহাজ আসত তার তুলনায় ইংরেজ কোম্পানীর আওতায় কলকাতা বন্দরে জাহাজ আসত কমপক্ষে দুইগুণ বেশী।১৬ এই ভাবে কলকাতা অনেক দিক থেকে বাংলাদেশের একটি বিকল্প বৈষয়িক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফরাসীদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ বাঁধার পর কলকাতা আবার বিকল্প রাষ্ট্রীয় কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে কি না, আলিবর্দি খান তাই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। সিরাজ যখন শিশু তখনি নিজের দুই জামাতাকে নিভৃতে ডেকে তিনি বলেছিলেন ‘ঐ যে দেখছ ঘাসে ঢাকা ময়দান, ওতে যদি আগুন লাগাও কিছুতে তা আটকাবে না। তবে যে আগুন গহরায় শুরু হয়েছে তা ডাঙায় উঠে এলে আটকায় এমন বাহাদুর কে আছে?’ প্রকাশ্য দরবারে আমীর ওমরাওদের কাছে তিনি বলতেন তাঁর মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলাহ্ মসনদে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে টুপীওয়ালারা হিন্দের সব সমুদ্র তীরগুলি দখল করে বসবে।১৭ বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে ইংরাজদের সঙ্গে ছোট ছোট নানা কারণে বারবার মনোমালিন্য ঘটায় সিরাজ অন্য সুরে কথা কইতে শুরু করলেন। এরা একদল সওদাগর অথচ এদের ব্যবহারটা মোটেই সওদাগরের মতো নয়। এদের শায়েস্তা করবার জন্য যে জিনিসটার প্রয়োজন তিনি সব চেয়ে বেশি অনুভব করতেন তা হল ‘এক পাটি চটিজুতা।’১৮ মোগল আমীর ওমরাওরাও অনেকে সেটাই যথেষ্ট বলে ভাবতেন, আর না ভাবার কোনো কারণ তখনো ঘটেনি। অথচ মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময়ে নবাবী ফৌজ যে কি-রকম অপারগ, এবং ফৌজের নেতৃস্থানীয় মোগল মনসবদাররা যে কত বড় অপদার্থ, তা আলিবর্দির চেয়ে বেশি কেউ জানতেন না। সুদূর বড়ার ও নাগপুর থেকে ঝাড়খণ্ডের অরণ্যপথে রসদবিহীন অবস্থায় বর্গিরা বছর বছর আসত। খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ আর লুঠতরাজ করা ছাড়া নবাবী ফৌজের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হবার যোগাড়যন্ত্র তাদের ছিল না। তাই কোনো সত্যিকারের শক্তি পরীক্ষা মোগল মনসবদারদের দিতে হয় নি। একটু ছোটাছুটি করে গলদঘর্ম হয়ে গিয়ে রায় দুর্ল্লভ ও মীর জাফর’এর মতো বড়ো বড়ো মনসবদারেরা স্থাণু হয়ে যেতেন। অথচ পালাবার সময় এঁদের গতির আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা দেখে বিস্মিত হয়ে আলিবর্দি এঁদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদগুলি থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন। গোলাম হোসেন খানের ইতিহাসে আবার ফকরউদ্দীন হোসেন খান নামে এক মনসবদারের বিবরণ পাওয়া যায় যিনি পূর্ণিয়ার ফৌজদারী থেকে বরখাস্ত হয়ে অনবধানতা প্রযুক্ত ক্ষোভের বশে মারাঠাদের শিবিরে যোগদান করে তাদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে দুদিনে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছিলেন।১৯ জন্মাবধি আরামে মানুষ হয়ে তিনি শারীরিক কষ্ট কাকে বলে জানতেন না। নতুন সঙ্গীসাথীদের দলে ভিড়ে তিনি যখন দেখলেন এদের চড়বার মধ্যে আছে খালি ঘোড়া, আর খাবার মধ্যে শুধু বাজরার রুটি তখন দুদিনে তাঁর প্রাণ হাঁপিয়ে উঠল, সারা দিন ঘোড়ায় চড়ে চড়ে দম বন্ধ হয়ে গেল, বীতশ্রদ্ধ হয়ে মারাঠাদের ছেড়ে তিনি দিল্লী চলে গেলেন। তাঁর বাবা ছিলেন সাত হাজারী মনসবদার, ঠাকুরদাদা কাবুল সুবাহ্‌র নাজিম। দিল্লীতে ধনদৌলত আর মণিমুক্তার ছড়াছড়ির মধ্যে গা এলিয়ে দিয়ে ভগ্নহৃদয়ে তিনি কয়েক দিন যেতে না যেতেই মরে গেলেন।

এই সব রণবীর মনসবদারদের কথা পড়লে মনে হয় আলিবর্দি খানের মতো প্রতিভাবান পুরুষ মসনদে না থাকলে দিল্লীর মতো মুর্শিদাবাদের মোগল শাসক গোষ্ঠীও অচিরেই মারাঠাদের বশবর্তী হয়ে যেত। স্বয়ং আলিবর্দি খান গোটা কয়েক বড়ারের বর্গিদলের হাতে ওড়িশা ছেড়ে না দিয়ে পার পান নি, তাদের জন্য বারো লক্ষ টাকার চৌথ সংগ্রহ করতে গিয়ে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং নাটোর দিনাজপুর ইত্যাদি জমিদারদের উপর নিজের স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে নানা নিগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।২০ ১৭৫১ খ্রীস্টাব্দে মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি হয়ে যাবার পর চৌথ মেটাবার জন্য এক কালে বহু টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। আর কোনো বহিরাক্রমণের আশঙ্কা না দেখে আলিবর্দি খরচ বাঁচাবার জন্য সৈন্য সংখ্যা হঠাৎ অনেক কমিয়ে দিলেন। নবাবী রাজশক্তির তলোয়ারের ধার এইভাবে ভোঁতা হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা সম্বন্ধে জনাকয়েক তীক্ষ্ণ বুদ্ধি বিদেশী বণিক রাজপুরুষের মাথায় বিদ্যুতের মতো দু একটা চিন্তা খেলে গেল। কিন্তু সেই এক ঝলক ইঙ্গিতের সত্যিকার গুরুত্ব তখনো কারো হৃদয়ঙ্গম হয়নি।

১৭৫১ খ্রীস্টাব্দে ১৫ জুন পণ্ডিচেরীর ফরাসী গভর্নর দুপ্লে হায়দরাবাদে তাঁর সহকারী বুসীর কাছে লিখলেন—‘এই মাত্র বাংলা থেকে খবর পেলাম নবাব আবার কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছেন। সলাৰৎ জঙ্গের (হায়দরাবাদের নিজাম) সাহায্যে এমন এক বাদশাহী পরওয়ানা কি আনানো যায় না যাতে নবাব আমাদের গায়ে আর হাত না তোলেন? এ না হলে নবাবকে তাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।’ পরের দিন আর একটু খোলসা করে লিখলেন—‘এই লোকটির [অর্থাৎ নবাব আলিবর্দি খানের] গর্ব খর্ব করা কিছুই না। যে সব সেপাইদের আপনি চেনেন তাদের মতোই এঁর সেপাইগুলিও অপদার্থ। বাংলা, বালাশোর, মসুলিপটনে চার পাঁচ হাজার সেপাই… আর কিছু হালকা কামন… ব্যস, বাংলাদেশে আর কিছুর দরকার হবে না, কারণ ও দেশটা একেবারে পুরো খোলা, একটা দুর্গও সেখানে নেই। একটু সাবধানে এগোলেই আমরা বাংলার মালিক বনে যেতে পারি।’২০(ক) ইংরেজ কোম্পানীর কর্মকর্তাদের মাথায় এ সব চিন্তা ছিল না, তবে ইংরেজ সেনাপতিরা মাঝে মাঝে স্বভাবসিদ্ধ ভাবে বুক ফোলাতেন। একবার অ্যাডমিরাল ওয়াটসন তাঁর সঙ্গী কর্ণেল ক্লাইভের কাছে এই রকম বড়াই করেছিলেন। তখন ১৭৫২ খ্রীস্টাব্দ, মারাঠাদের বিস্তর টাকা দিয়ে বিদায় করে নবাব সবার উপর টাকার জন্য চাপাচাপি করছেন। তাঁর পীড়াপীড়িতে রাগ করে ওয়াটসন ক্লাইভকে লিখলেন: ‘Clive ’twould be a good deed to swing the old dog. I don’t speak at random when I sav, the Company must think seriously of it or it will not be-worth their while to trade in Bengal.’২১ সে সময় এ কথা কেবল মুখেন মারিতং জগৎ। কর্ণেল মিল নামে আলিমান (অস্ট্রিয়ান) সম্রাটের অধীনস্থ এক ইংরাজ সৈনিকও প্রভুর কাছে লিখেছিলেন, ‘আলিবর্দি খান নামে এক বিদ্রোহী নায়ক মোগল সাম্রাজ্য থেকে সুবাহ্‌ বাংলা, বিহার, ওড়িষা আলাদা করে নিয়েছেন। তাঁর ধনরত্নের পরিমাণ তিরিশ কোটি টাকা। বাৎসরিক খাজনা নিশ্চয় দুই কোটি টাকা। তিনখানা জাহাজ পনেরশ থেকে দু হাজার সৈন্য নিয়ে যেতে পারলেই তাঁর রাজ্য দখল করা সম্ভব।’২২ এই সব কথা যার তার বিরুদ্ধে নয়, স্বয়ং নবাব আলিবর্দি খান সম্বন্ধে, যাঁর মতো প্রতিভাবান মোগল রাজপুরুষ সে যুগে আর কেউ ছিলেন না। উড়ো চিন্তাগুলি তাই তখন প্রশ্রয় পায়নি। ভিতর থেকে না ভাঙলে নবাবী রাজশক্তিকে শুধু বাইরের আঘাতে ভাঙা যেত না।

বৃদ্ধ নবাবের রাজত্বকালের শেষ তিন চার বছরে ভাঙনের চিহ্ন দেখা দিল। বর্গিযুদ্ধ শেষ হবার পর একটু আমোদ আহ্লাদ করতে তিনি তিন হাজার নৌকা নিয়ে মৃগয়ায় বেরিয়েছেন, এমন সময় (১৭৫৩ খৃঃ) কালান্তর ঝিলে তাঁর নৌকার উপর এক পশলা গুলী বৃষ্টি হয়ে গেল। লোকে বুঝল এর পিছনে তাঁর আদরের নাতির হাত আছে, কিন্তু নবাব শুধু বললেন—‘সে যদি আমার দাম না বোঝে—আমার জিন্দগিতে যদি তার কিম্মৎ না মানে—তবে জলদি তার খোয়াব পুরা হলেই তো আমি সব ভাবনা থেকে রেহাই পাই।’২৩ এ ব্যাপারে আলিবর্দির সঙ্কল্প অটল থাকলেও দরবারের প্রধান প্রধান আমীর ওমরাওদের মধ্যে কেউ চাইছিলেন না নবাবের নাতি মসনদে চড়ে বসুক। তাঁদের ইচ্ছা নবাবের প্রধান জামাই গহসেটি বেগমের স্বামী ধীরচিত্ত বিগত যৌবন নওয়াজিশ মুহম্মদ খান নবাব হন। সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র প্রতি প্রধান প্রধান মোগল রাজপুরুষদের মনোগত বিতৃষ্ণার কারণ অভিজাত মোগল মনসবদার গোলাম হোসেন খান চোখা চোখা বাক্যে স্পষ্টভাবে বিবৃত করে গেছেন। ‘নবাব আলিবর্দি খানের বিবিজানরা, এবং তাঁর পেয়ারের সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ এমন সব কদর্য কুকর্ম এবং বেহায়া বেলেল্লাপনায় লিপ্ত থাকতেন যা খানদানী লোকের কথা দূরে থাক আম জনতাকে পর্যন্ত বেইজ্জত করবে। তাঁর এই স্নেহের পুত্তলি সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ রাজপথে ছুটাছুটি করতে করতে যে সব ঘৃণিত ও অকথ্য আচরণ করতেন তাতে লোকে তাজ্জব বনে যেত। নবাবের নাতিপুতিদের নিয়ে তিনি এক দল গড়ে রাস্তায় রাস্তায় অলিতে গলিতে যা আরম্ভ করলেন তাতে পদ, বয়স, স্ত্রীপুরুষভেদ কোনো কিছুর মর্যাদা রইল না। …জেনানা বা মর্দানা যাকে দেখে পছন্দ হত সেই তাঁর রিরংসার শিকার হত। …তাঁর এই লাগামছাড়া উত্তেজনার খোরাক না জুটলেই দেখা যেত তিনি নিতান্ত ক্ষুণ্ণ আর বিমর্ষ হয়ে পড়ে আছেন। …পাপ পুণ্যের তফাৎ না করে, খুব নিকট রক্তের রিশতা না মেনে তিনি যেখানে যেতেন সে জায়গা অপবিত্র করে আসতেন, পাগলের মতো সম্রান্ত নরনারীর ঘরে ঘরে ব্যাভিচার ঘটাতেন, পদমর্যাদা বা বংশমর্যাদা মানতেন না।’২৪ হিন্দু সমাজে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ কর্তৃক সধবা বিধবা হরণ নিয়ে বহুদিন ধরে নানা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, কিন্তু গোলাম হোসেন খানের বিবৃতিতে বোঝা যায় যে মুসলমান রাজপুরুষরাও এই উদ্ধত উচ্ছৃঙ্খল যুবক সম্বন্ধে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিলেন। নবাবের নাতির ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজিত এবং বিমর্ষ ভাবের যে বর্ণনা গোলাম হোসেন খান দিয়েছেন তাতে আধুনিক মনস্তত্ত্বে নির্দিষ্ট maniac-depressive অবস্থার কথা মনে পড়ে যায়। সঙ্গত কারণেই সিরাজের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে লোকে বলত ‘খোদা হাফিজ এর হাত থেকে আমাদের নিরাপদ রাখুন।’২৫

স্নেহান্ধ আলিবর্দি খানের শেষ তিন চার বছরের কার্যকলাপ কিঞ্চিৎ বিস্ময়কর। ধীর স্থির প্রিয়পাত্র জামাই নওয়াজিশ মুহম্মদ খানের দাবী অগ্রাহ্য করে বিদ্রোহী নাতি সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র২৬ উত্তরাধিকার পাকা করবার জন্য তিনি মনসবদারদের মধ্যে বিবাদ সংঘটনে প্রবৃত্ত হলেন। নওয়াজিশ মুহম্মদ খান বেঁচে থাকলে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ মসনদ দখল করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। সিরাজের সৌভাগ্যক্রমে আলিবর্দির জীবদ্দশায় তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। বিধবা অবস্থাতেই তাঁর পত্নী গহসেটি বেগম পরে যা পরাক্রম প্রকাশ করেছিলেন সধবা থাকলে তিনি নিশ্চয়ই সিরাজের সর্বনাশ সংঘটন করে ছাড়তেন। ইংরেজ গোলন্দাজের দরকার হত না, স্বামীকে দিয়ে এবং স্বামীর অনুগৃহীত সংখ্যাগরিষ্ঠ মনসবদারদের দিয়ে কার্যসিদ্ধি করে নিতেন। নওয়াজিশ ও গহসেটির দাম্পত্য সম্পর্ক সুখের ছিল না—তাঁদের কোনো সন্তান হয় নি। কঠিন রোগে মৃত্যুর আগে নওয়াজিশ মুহম্মদ খান ঢাকার নায়েব নাজিম পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন—এ কার্য নির্বাহ করতেন তাঁর অধীনস্থ দুই সুযোগ্য রাজপুরুষ, হোসেন কুলী খান এবং রাজবল্লভ সেন। হোসেন কুলী খানকে সিরাজের পথের কাঁটা হিসাবে কল্পনা করে আলিবর্দি ক্রমশঃ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছিলেন। এদিকে বর্গিযুদ্ধের সময় আতাউল্লাহ্‌ খানের রাজদ্রোহী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার জন্য মীরজাফরের উপরেও তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবার মতলব করে আলিবর্দি খান এবার হোসেন কুলী খানকে দিয়ে মীরজাফরের ঘোড়সওয়ারী হিসাবপত্র পরীক্ষা করাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। বর্গিযুদ্ধের সময়ই ধরা পড়েছিল যে মীরজাফর তাঁর মাইনেতে যত সওয়ার রাখার কথা তার অর্দ্ধেকও রাখেন না। হোসেন কুলী খান ফাঁদে পা দিলেন না। তখন আলিবর্দি খান মীরজাফরকে এক জন নিকট আত্মীয় হত্যার অপরাধে হোসেন কুলী খানের উপর প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করতে লাগলেন। কিন্তু বীরপুরুষ মীর মুহম্মদ জাফর খানের সাহসে কুলেল না। ১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র প্রাসাদের উপর এক অতর্কিত আক্রমণ ঘটল। তার পেছনে হোসেন কুলী খানের হাত আছে সন্দেহ করে আলিবর্দি স্থির করে ফেললেন এই লোকটিকে সরিয়ে ফেলতে হবে।২৮

ঐ বছরই সুযোগ মিলে গেল। পারিবারিক সম্মানহানির জন্য নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে আলিবর্দির বেগম হোসেন কুলী খানের গর্দান চাইলেন। নওয়াজিশের সম্মতি ছাড়া তা হতে পারে না জানিয়ে আলিবর্দি মুর্শিদাবাদ থেকে রাজমহলে সরে পড়লেন। নওয়াজিশের সম্মতি আদায় করতে বেগ পেতে হল না, কারণ গহসেটি বেগম তাঁর প্রণয়ের পাত্র হোসেন কুলী খানের উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। হোসেন কুলী খানের অপরাধ তিনি গহসেটি বেগমকে ত্যাগ করে তাঁর ছোট বোন আমিনা বেগমের কাছে যাতায়াত শুরু করেছেন। আমিনা বেগম সিরাজের মা। নওয়াজিশ মুহম্মদ খানের সম্মতিক্রমে তাঁরই প্রাসাদ থেকে স্বস্থানে ফিরবার পথে হোসেন কুলী খানের ভবনের সামনে থেমে সিরাজউদ্দৌলাহ্ হোসেন কুলী খান ও তাঁর অন্ধ ভাই হায়দার আলী খানকে রাজপথে টেনে বার করে আনিয়ে খণ্ড খণ্ড করে হত্যা করে সমগ্র মনসবদার মহলের হৃৎকম্প ধরিয়ে দিলেন।২৯ রাজমহল থেকে ফিরে এসে আলিবর্দি এই হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। কিন্তু মীরজাফরের রিসালা থেকে অনেক সওয়ার বরখাস্ত করে দিলেন, যাতে ঐ দিক থেকেও সিরাজের কোনো বিপদ না থাকে।৩০

নওয়াজিশ গত হলেন। আলিবর্দি শেষ শয্যায়। নওয়াজিশের বিধবা বেগম গহসেটি হোসেন কুলী খানের অবর্তমানে তাঁর অপর প্রিয়পাত্র রাজবল্লভ সেনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। সিরাজের নজর পড়ল রাজবল্লভের উপর। হোসেন কুলীর প্রেতলোক যাত্রার পর রাজবল্লভ একাই ঢাকার নিয়াবতের শাসন কার্য চালাচ্ছিলেন। গহসেটি বেগমকে নিঃসহায় করতে হলে রাজবল্লভকে সরাতে হয়। সিরাজ ঢাকার নিয়াবতের হিসাবপত্রের নিকাশ এবং বকেয়া খাজনা তলব করলেন। রাজনগরের সামান্য বৈদ্য পরিবারে জাত মহারাজ রাজবল্লভের সৌভাগ্যের রবি তখন শীর্ষে, এমন সময় এই বিপদ উপস্থিত হল।

কৃষ্ণজীবন মজুমদার নামে ঢাকার সরকারের এক অখ্যাত রাজকর্মচারীর পঞ্চম পুত্র ছিলেন এই রাজবল্লভ সেন। ফারসী ভাষা আয়ত্ত করে ইনি ঢাকার নওয়ারা মহলের পেশকার পদ প্রাপ্ত হন এবং ক্রমে ক্রমে পদোন্নতি করে ১৭৪১ খ্রীস্টাব্দ থেকে হোসেন কুলী খানের অধীনে ঢাকার নিয়াৰতের কার্যনিবাহ করতে শুরু করেন। এহেন পদন্নোতি করে রাজবল্লভ পৌরাণিক রীতি অনুসারে অগ্নিষ্টোম এবং বাজপেয় যজ্ঞ অনুষ্ঠান করলেন৩১ এবং বৈদ্যজাতির সমাজের সমাজপতি হয়ে নবদ্বীপ কাশী কাঞ্চী ত্রিবেণী ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে প্রধান প্রধান পণ্ডিতদের ডেকে এনে বঙ্গীয় বৈদ্য সমাজের পৈতা সংস্কারের ব্যবস্থাপত্র লিখিয়ে নিলেন। নানাবিধ শাস্ত্রীয় যুক্তিপ্রয়োগে বৈদ্যজাতির উপবীত বিধায়ক এই সংস্কৃত ব্যবস্থাপত্র থেকে আর কিছু না হোক ইংরেজ আমলের অব্যবহিত আগেকার প্রধান প্রধান পণ্ডিতদের নাম ও নিবাসের একটা মূল্যবান তালিকা পাওয়া যায়।৩২ রাজবল্লভের সমাজ সংস্কার প্রচেষ্টা কেবল বৈদ্যজাতির উপবীত বিধানে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নিজের আট বছরের বিধবা কন্যার বিয়ের চেষ্টায় নদীয়ার পণ্ডিতদের কাছ থেকে অক্ষত যোনি হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহের ব্যবস্থাপত্র আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন। শোনা যায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কৌশলে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে এই নিয়ে যে গল্প প্রচলিত হয় তাতে রাজবল্লভের প্রতিনিধিরা নদীয়ায় উপস্থিত হলে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁদের খাবার সময় একটি বাছর উপহার দেন এবং কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলেন, বহুদিন অপ্রচলিত বিধবা বিবাহ শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী পুনঃপ্রচলিত হলে শাস্ত্রমতে গোমাংস খেতেও তাঁদের আপত্তি হওয়া উচিত নয়। লজ্জিত হয়ে রাজনগরের দূত নবদ্বীপ ত্যাগ করেন। এ নেহাত গল্প কারণ ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী’ অনুসারে বুদ্ধিমান জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র প্রবল প্রতাপান্বিত রাজপুরুষ রাজবল্লভের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করে গোপনে বাধা দিয়েছিলেন।

রাজবল্লভের এই দোর্দণ্ড প্রতাপের দিনে তাঁর ইচ্ছা লঙ্ঘন করার ফল কি হতে পারে তা ঢাকা কুঠীর ইংরেজ সাহেবরাও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে আরমানী বণিকদের জাহাজ লুণ্ঠনের অপরাধে ইংরেজদের সাজা দেবার জন্য নবাব আলিবর্দির পরওয়ানা আসা মাত্র রাজবল্লভ ঢাকায় ইংরেজদের কারবার বন্ধ করে দেন। সে যাত্রা জগৎশেঠকে ধরে নবাব দরবারে অনেক নজরানা দিয়ে ইংরেজরা পার পায়। নওয়াজিশ মুহম্মদ খানের শিশু উত্তরাধিকারী মুরাদউদ্দৌলাহ্‌ ১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দে ঢাকার নায়েব নাজিম হওয়া মাত্র নিয়াবতের দেওয়ান রাজবল্লভ ইংরেজ কুঠিয়ালদের কাছে দশ হাজার টাকা নজরানা চেয়ে পাঠান। তাঁরা অনিচ্ছাভরে তিন হাজার টাকা দেবার প্রস্তাব করায় কুঠীর গোমস্তারা হাজত বাসে গেলেন, বাখরগঞ্জে কোম্পানীর চালের নৌকা আটক হল, এবং কেউ যেন ঢাকার কুঠীর চাকরী না করে এই পরোয়ানা জারি হয়ে গেল।৩৩ এহেন পরাক্রান্ত রাজবল্লভ যখন নবাবের নাতি কর্তৃক নিয়াবতের নিকাশ এবং বাকির তলবে সঙ্কটাপন্ন হয়ে ধনসম্পত্তি সহ নিজের পরিবারের জন্য কলকাতায় আশ্রয় ভিক্ষা করলেন, তখন আলিবর্দির মৃত্যুর পর রাজবল্লভ গহসেটি বেগমের দল ক্ষমতা দখল করবে আন্দাজ করে ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তৃপক্ষ রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস এবং অন্যান্য পরিবারবর্গকে কলকাতায় আশ্রয় দিতে দ্বিধা করলেন না। ইংরেজ বণিকদের হিসাবে ভুল হল। আলিবর্দির মৃত্যুর পর মোতিঝিলের সৈন্যদল অপর পক্ষে চলে যাওয়ায় দশ দিনের মধ্যে গহসেটি বেগম বন্দী হলেন। মসনদের লড়াইয়ে হস্তক্ষেপ করার চিন্তা ইংরেজদের মাথায় ছিল না, কিন্তু নতুন নবাবের বদ্ধমূল ধারণা হল যে তাদের সঙ্গে গহসেটি বেগম, রাজবল্লভ এবং পূর্ণিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী শওকৎ জঙ্গের তলে তলে যোগ আছে। গুপ্তচর পাঠিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ কৃষ্ণদাসকে ধরে আনবার পরওয়ানা পাঠালেন। কলকাতার নির্বোধ গভর্নর ড্রেক গুপ্তচরকে তাড়িয়ে দিলেন। এর ফলে সিরাজের ব্যক্তিগত সন্দেহ, ক্রোধ এবং বিতৃষ্ণা ভিতর থেকে মথিত হয়ে উঠল। তখন নবাব সরকার ও ইংরেজ কোম্পানীর ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের ব্যক্তিনিরপেক্ষ কারণগুলিও প্রকট হয়ে উঠল।

এই ভাবে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র সঙ্গে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সংঘর্ষের সূত্রপাত করে রাজবল্লভ আপাতত মঞ্চ থেকে অপসৃত হলেন। ঢাকার নিয়াবতের দেওয়ানী থেকে বরখাস্ত হয়ে তিনি মুর্শিদাবাদে নজরবন্দী হয়ে রইলেন। পলাশীর ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকা খুব প্রত্যক্ষ না হলেও তিনি চক্রান্তকারীদের যতটা পারেন সাহায্য করেছিলেন। তাঁর নির্মিত প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য কীর্তিগুলি যখন ১২৭৫ সনের প্লাবনে কীর্তিনাশার গর্ভস্থ হয় তখন রাজনগরের রাজকবি জয়চন্দ্র ভট্ট রাজনগরের শোকগাথা রচনা করে গেয়েছিলেন৩৪(ক)

জানি কোনো শাপে জরাসন্ধ ভূপে
জন্মিল রাজনগর মাঝ।
যাঁহার কৃপাতে বাঙ্গালা মুল্লুকেতে
প্রকাশ পাইল ইংরাজ॥
নবাবী আমল করি বে-দখল
ইংরাজকে রাজত্ব দিল।
ধন্য মহারাজ ডঙ্কা ভবমাঝ
রেখে পরলোকগত হল॥৩৪(খ)

এর বেশির ভাগই কবির কল্পনা। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে কৃষ্ণদাসের কলকাতা আশ্রয় পাওয়ার ঘটনা অবলম্বন করে নবাব সরকার ও ইংরেজ কোম্পানীর স্বার্থসংঘাতের যে কারণগুলি অনেকদিন ধরে অন্তর্নিহিত ছিল, সেগুলি প্রকট হয়ে উঠল। পূর্ণিয়ার ফৌজদার পদে অধিষ্ঠিত আলিবর্দির অপর দৌহিত্র শওকৎ জঙ্গ সামান্য ইংরাজ কোম্পানীর চেয়ে অনেক বড়ো শক্ত, তাই গহসেটি বেগমকে বন্দী করে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ প্রথমে পূর্ণিয়ার দিকে পা বাড়ালেন। ইংরেজদের বাণিজ্যসূত্রে দেশে অনেক সোনা রূপা টাকাকড়ি আমদানী হচ্ছিল অতএব তাদের আশ্চর্য আস্পর্ধা সত্ত্বেও দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার সঙ্কল্প তাঁর ছিল না। কিন্তু পথে ইংরেজ গভর্নর ড্রেকের কাছ থেকে একখানা দুর্বিনীত চিঠি পেয়ে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ ক্ষিপ্ত হয়ে রাজমহল থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে৩৫ মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে রায় দুর্লভকে কাশিমবাজার অবরোধ করতে পাঠিয়ে দিলেন। ড্রেক সাহেবের চিঠিখানা পাওয়া যায় নি, যতদূর জানা যায় তিনি ফরাসীদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা উল্লেখ করে লিখেছিলেন যে আত্মরক্ষার জন্যে ইংরেজরা গঙ্গাতীরস্থ পুরোন দেওয়ালগুলি সংস্কার করে নিচ্ছেন। চিঠি পড়ে রুষ্ট নবাব আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন ‘কার এত হিম্মৎ যে আমার মুল্লুকে লড়াই শুরু করে? কে ভেবেছে যে সবাই কে সেলামৎ রাখার জোর নেই আমার?’৩৬ অতএব পলাতক কৃষ্ণদাসের করতলস্থ ৫৩ লক্ষ টাকার ধনরত্ন নিয়ে নয়,৩৭ নবাবের হুকুমতের মধ্যে বাস করে নবাবের হুকুমের অপেক্ষা না করে ফরাসীদের সঙ্গে লড়াইয়ের আস্পর্ধা করার জন্যেই ইংরেজদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত নবাবের সঙ্ঘর্ষ বাধল। সুবাহ্‌ বাংলার মোগল সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতা যাতে কোনো ভাবে খর্ব না হয় সেই জন্য এই লড়াই। কাশিমবাজারের বড়ো কর্তা ওয়াটস্‌কে বন্দী করে তাঁকে দিয়ে নবাব যে মুচলেকা লিখিয়ে নেন তাই থেকে বোঝা যায় কোন্ কোন্ ব্যাপারে ইংরেজরা নবাবী হুকুম লঙ্ঘন করে নবাবের রোষানলে পড়েছিলেন। মুচলেকার মর্ম: (১) কলকাতায় নবাবের কোনো পলাতক প্রজাকে আর আশ্রয় দেওয়া হবে না (২) কলকাতার কেল্লার নতুন নির্মিত অংশগুলি ভেঙে ফেলা হবে (৩) আর কখনো দস্তকের অপব্যবহার হবে না। শোনা যায়, বড়ো কর্তা ওয়াট্‌স্ যখন মুর্শিদাবাদে ধৃত হয়ে একজন মনসবদারের নির্দেশে কাঁদতে কাঁদতে ‘তোমার গোলাম, তোমার গোলাম’ বলে দুই হাত জোড়া করে নবাবের পা ধরেছিলেন (‘হাত বন্দকি সাহেবকা৩৮ কদম পকড়না৩৯), তখন কাশিমবাজার কুঠীর আর এক অখ্যাত কুঠিয়াল ওয়ারেন হেস্টিংস প্রাণ ভয়ে পালিয়ে ভবিষ্যতের কাশিমবাজার রাজের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণকান্ত নন্দীর আশ্রয় পান এবং সেই সূত্রে পরে হেস্টিংসের দেওয়ান রূপে কান্তবাবুর কপাল খুলে যায়:

হেস্টিংস সিরাজ ভয়ে হয়ে মহাভীত।
কাশিমবাজারে গিয়া হন উপনীত॥
কোন্‌ স্থানে গিয়া আজ লইব আশ্রয়।
হেস্টিংসের মনে এই নিদারুণ ভয়॥
কান্তমুদী৪০ ছিল তার পূর্বে পরিচিত।
তাহারি দোকানে গিয়া হন উপনীত॥
নবাবের ভয়ে কান্ত নিজের ভবনে।
সাহেবকে রেখে দেয় পরম গোপনে॥
সিরাজের লোক তার করিল সন্ধান।
দেখিতে না পেয়ে শেষে করিল প্রস্থান॥
মুস্কিলে পড়িয়া কান্ত করে হায় হায়।
হেস্টিংসে কি খেতে দিয়া প্রাণ রাখা যায়?
ঘরে ছিল পান্তা ভাত আর চিংড়ি মাছ।
কাঁচা লঙ্কা, বড়ি পোড়া, কাছে কলাগাছ॥

* * *

সূর্যোদয় হল আজি পশ্চিম গগনে।
হেস্টিংস ডিনার খান কান্তের ভবনে॥৪১

কাশিমবাজার অবরোধের অতিরঞ্জিত ঘটনাবলী এই রকম কৌতুকবহ ভাবে দেশবাসী মনে রেখেছিল। আসলে হেস্টিংসও কোম্পানীর আড়ঙে ধরা পড়েছিলেন, কৃষ্ণকান্ত ওলন্দাজ কুঠী থেকে তিন হাজার টাকা সংগ্রহ করে তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন। কাশিমবাজার কুঠী ফতেহ্‌ করে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ ক্ষিপ্রগতিতে সসৈন্যে কলকাতার কেল্লার দিকে অগ্রসর হলেন। নবাবের মা বললেন, একদল সওদাগরের সঙ্গে লড়াই করা তাঁর শোভা পায় না। কিন্তু নবাব আমিনা বেগমের কথা গ্রাহ্য করলেন না,৪২ কারণ নবাবের মা রাজনীতির কিছু বুঝতেন না। সিরাজের নিজের কাগজপত্র থেকে তাঁর জীবনী রচনা করার মতো কোনো উপাদান আজ আর নেই, কিন্তু রাজমহল থেকে কলকাতা অভিমুখে অগ্রসর হবার সময় হুগলীর আরমানি বণিক খোজা ওয়াজিদকে তিনি গুটি দু-তিন চিঠি লিখেছিলেন যার ইংরাজি অনুবাদ অর্ম সাহেবের কাগজপত্রে রয়ে গেছে। তাতে যুদ্ধের কারণগুলি নবাবের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। বেশ বোঝা যায় ফিরিঙ্গি বণিক দল বণিকোচিত ব্যবহার না করে নবাবী হুকুমৎ অগ্রাহ্য করেছিল বলেই যুদ্ধ বেধেছিল। প্রথম চিঠি রাজমহল থেকে ফিরে আসার সময় লেখা।

রাজমহল।

২৮ মে ১৭৫৬

আমার হুকুমতের মধ্যে আঙ্গরেজদের মজবুৎ কেল্লা ভূমিসাৎ করে দেওয়া আমার স্থির সঙ্কল্প। বর্তমানে৪৩ তাতে কোনো বাধা নেই দেখে রাজমহল থেকে আমি জোর কদমে কলকাতা রওনা দিচ্ছি। আমার মুল্লুকে তারা যদি থাকতে চায় তবে তাদের কেল্লা জমিনে ফেলে দিতে হবে, গড়খাই ভরাট করে ফেলতে হবে, আর নবাব জাফর খানের৪৪ আমলে যে যে শর্ত ছিল সেই সেই শর্ত মোতাবেক কারবার করতে হবে। নাহলে আমার রিয়াসত থেকে আমি তাদের বের করে দেবো, আল্লাহ্ এবং নবীদের নামে হলপ করে বললাম। তাদের হয়ে যে যতই ওকালতি করুক তাতে কোনো ফল হবে না এবং আপনিও তাদের হয়ে কোনো কথা বলবেন না, কারণ এই জাতটাকে ওই হালে রাখতে আমি বদ্ধপরিকর। এর সঙ্গে ফরাসিস, ওলন্দাজ ও দিনেমারদের প্রতি আমার নেক নজরের পরওয়ানা পাঠালাম, আপনি তাদের হাতে পরওয়ানা দিয়ে দেখবেন তারা যেন তাদের কারবারে বা কোনো কিছুতেই বাধা না পায় এবং অঙ্গরেজরা বিতাড়িত হবার পর তাদের ফিরে আসতে যেন মদদ না করে।

(নীচে নবাবের স্বহস্তে লিখিত)

আল্লাহ্‌ ও নবীদের নামে কসম রইল, আঙ্গরেজরা যদি গড়খাই ভরাট করে কেল্লা মাটিতে ফেলে না দেয় আর নবাব জাফর আলি খানের আমলের আইন মোতাবেক৪৫ কারবার করতে রাজি না থাকে, তাহলে আমি তাদের হয়ে কোনো ওকালতি শুনবো না, এবং আমার মুল্‌ক থেকে তাদের সরাসর্‌ বার করে দেবো।

খোজা ওয়াজিদের মাধ্যমে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ ইংরেজ ওলন্দাজ দিনেমার ও ফরাসী কোম্পানীর সঙ্গে কেনাবেচা করতেন ও যোগাযোগ রাখতেন। রাজমহল থেকে মুর্শিদাবাদ পৌঁছে কলকাতা রওনা হবার আগে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ খোজা ওয়াজিদকে আর একখানা চিঠি দিলেন।

মুক্সাদাবাদ

১ জুন ১৭৫৫

আপনার চিঠিতে জ্ঞাত হলাম মিহি কাপড় এবং ঘোড়ার জন্য আমি যে বরাত দিয়েছিলাম আপনি সে সন্দেশ পেয়েছেন এবং আমার চাবুক সওয়ার এক জোড়া অম্প্‌ দেখে পছন্দ করায় আঙ্গরেজরা তার মধ্যে একটি ঘোড়া চাবুক সওয়ারের হাতে আমার কাছে নজরানা পাঠিয়েছে। মিহি কাপড়ের জন্য আমার রাত বহাল রইল। আঙ্গরেজরা চাবুক সওয়ারের হাতে যে ঘোড়া দিয়েছে তা আপনি ফেরত পাঠাবেন কারণ তাদের হাত থেকে আমি কোনো নজর নেবো না। আমার হুকুম তারা অগ্রাহ্য করেছে, আমার মর্জি তারা অমান্য করেছে, তাই তাদের ঘোড়া ফেরত পাঠানো সাব্যস্ত হল। তিন দফায় আমার হুকুমৎ থেকে তাদের সরাসর খৎম্‌ করে দেওয়াই আমার রায়। প্রথমতঃ তারা বে-আইনী ভাবে বাদশাহী মুল্‌কে৪৬ গড়খাই কেটে জোরদার কেল্লা বানিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ দস্তকের ছাড় যাদের কোনো আইন মোতাবেক পাবার কথা নয় তাদের বেআইনী ভাবে দস্তক দিয়ে ইংরেজরা মাশুলের খাতে বাদশাহী খাজনার অনেক ঘাটতি করেছে। তৃতীয়তঃ গাফিলতির শিকায়তে বাদশাহের অধীনস্থ যে সব মুতাসেদ্দীর নিকাশ দেবার কথা তাদের ধরিয়ে না দিয়ে আঙ্গরেজরা আইনের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিজেদের হেফাজতে রেখেছে। উপরোক্ত অপরাধে তাদের দেশ হতে বহিষ্কার করে দেওয়াই মুনাসিব। তারা যদি এই কয় দফা শিকায়ৎ রফা করে নবাব জাফর খানের আমলের অন্যান্য সওদাগরদের শর্তে কারবার করতে রাজি থাকে তবে আমি তাদের গোস্তাকি মাফ করে এদেশে বসবাস করতে দেবো, আর নইলে অতি শীঘ্র ঐ জাতটাকে বের করে দেবো। এদেশে ফিরিঙ্গিরা আসার পর থেকে একবারও ফরাসিসরা আঙ্গরেজদের আক্রমণ করেনি, কি অজুহাতে ফরাসিসরা দরিয়ায় আঙ্গুরেজদের উপর চড়াও হবে? আমি যখন ডাঙায় আঙ্গুরেজদের আক্রমণ করবে তখন কিসের বিনিময়ে ফরাসিসরা দরিয়ায় আঙ্গুরেজদের আক্রমণ করতে পারে আপনি সন্ধান করে তৎপর হবেন। তাদের রাজি করার জন্য আমার তরফ থেকে আপনি প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন যে কলকাতা দখল করার পরেই আমি তাদের হাতে শহর ছেড়ে দেবো।’

(নীচে নবাবের স্বহস্তে লিখিত)

আঙ্গরেজদের এ সব কথা জানাবেন। এ সব নির্দেশ পালন করলে তারা বসবাস করতে পারবে, নচেৎ অচিরে দেশ থেকে বের করে দেবো।৪৭

নবাবের চিঠিতে যা লক্ষণীয় জিনিস তা হল ফাররুকশিয়রের অন্যায় অবিবেচনা প্রসূত ফরমান বরবাদ করে মোগল ও আরমানী সওদাগরদের সঙ্গে এক হারে মাশুল দিয়ে ইংরাজদের ব্যবসা করতে বাধ্য করানোর দৃঢ় সঙ্কল্প। সওদাগরদের মতো ব্যবহার না করে ইংরাজরা রাজদ্রোহে নেমেছিল, সেই অপরাধে দেশ থেকে বের করে দেবার পরও উচিত মতো শর্তে তাদের ফিরে আসার পথ নবাব খোলা রেখেছিলেন। সম্ভবতঃ দেশে সোনারূপার আমদানী কমে যাক তা চাননি বলেই সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ কলকাতা দখল করার পর ‘মাদ্রাজ কুঠির ইংরেজদের গোমস্তা’ পিগট সাহেবকে লিখে পাঠিয়েছিলেন—‘সুবাহ্‌ বাংলা থেকে আপনার কোম্পানীর সওদাগরী কারবার তুলে দেবার ইরাদা আমার ছিল না, কিন্তু দেখলাম আপনার গোমস্তা রজার ড্রেক মহাপাজি এবং বেয়াদব। বাদশাহের কুঠীতে যে সব লোকের হিসাব নিকাশ বাকী ছিল৪৮ সে তাদের নিজের হেফাজতে নিয়ে রাখত। বারবার মানা করা সত্বেও সে তার বেহায়াপনা থামাল না। কোম্পানীর সওদাগরী কারবার করতে এসে এরা এরকম বেয়াদবি করে কেন? যাই হোক, সেই বেহায়াটার উচিত সাজা হয়েছে—সুবাহ্‌ থেকে তাকে তাড়ানো হয়েছে।’৪৯

‘হাতবন্দ’ করে নবাব সাহেবের ‘কদম পাকড়ানো’ অবস্থায় ওয়াট্‌স্‌কে যে মুচলেকা দিতে হয়েছিল তাতে সিরাজউদৌলাহ্‌ স্পষ্ট করে লিখিয়ে নিয়েছিলেন যে, জুয়াচুরী করে যাকে তাকে দস্তক দেওয়ার জন্য নবাব সরকারের সব ক্ষতিপূরণ কোম্পানীকেই দিতে হবে।৫০ চল্লিশ বছর আগে ইংরাজ কোম্পানীর দূতেরা বিনা মাশুলে কোম্পানীর কারবার করবার আবদার নিয়ে মোগল দরবারে গেছিলেন, এবং এক লক্ষ পাউন্ডেরও বেশী খরচ করে ফার্‌রুকশিয়ারের কাছে কাজ হাসিল করেছিলেন।৫১ এতে নবাব সরকার এবং নবাব সরকারের অধীন বণিক প্রজাদের কত ক্ষতি হবে তা বিবেচনা না করেই বাদশাহী ফারমান জারী করা হয়েছিল। অসন্তুষ্ট নবাবেরা এর পর থেকে যখন যেমন পারেন নজরানা আদায় করেই ক্ষান্ত ছিলেন। নজরানা কত কম দেওয়া যায় ইংরাজরা সেই তালে থাকত। শুধু তাই নয়, অন্যায় এর উপর অন্যায় চাপিয়ে তারা কোম্পানীর কারবার ছাড়া সাহেবদের ব্যক্তিগত কারবারের জন্যেও দস্তক জাল করতে শুরু করেছিল।৫২ এ সব অন্যায় সুবিধে সত্ত্বেও অষ্টাদশ শতকের মাঝখানে ইংরাজদের কারবারে মন্দা দেখা দিল।

এ সময়ে বাইরে থেকে সোনা রূপা আমদানী করে, দেশীয় মহাজনদের কাছ থেকে ধার করে, যে ভাবে হোক টাকা যোগাড় করে প্রত্যেক বছর ইংরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অনেক পরিমাণ কাপড়, রেশম, সোরা, ইত্যাদি জিনিস ইওরোপে রপ্তানীর জন্য কিনতেন। একে তাঁরা বলতেন ‘ইনভেস্টমেন্ট’। ১৭৫৩ পর্যন্ত ইনভেস্টমেন্টের জিনিসগুলি যোগান দিতেন এক দল স্বাধীন দেশীয় বণিক। কোম্পানীর কাছ থেকে দাদন নিয়ে জিনিস কিনতেন বলে তাঁদের ইংরাজরা নাম দিয়েছেন ‘দাদনী বণিক’। কলকাতায় গোপীনাথ শেঠ, রামকৃষ্ণ শেঠ, শোভারাম বসাক ইত্যাদি প্রধান প্রধান শেঠ ও বসাক জাতীয় বণিক এবং আমির চন্দ (ইতিহাসের ওমিচাঁদ) নামক উত্তর ভারতীয় নানকপন্থী বণিক ইংরাজদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে জিনিসের যোগান দিতেন। এঁদের স্বাধীন ব্যবসা ছিল তাই ইংরাজদের যে সব শর্তে এরা জিনিসের যোগান দিতেন তা কোম্পানীর কর্মচারীদের মনঃপূত ছিল না। এই নিয়ে আমির চন্দ এবং অন্যান্য ‘দাদনী বণিক’দের সঙ্গে ঝগড়া করে ১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দে তাঁরা মফস্বলের আড়ংগুলিতে নিজেদের দেশীয় গোমস্তা লাগিয়ে কোম্পানীর ইনভেস্টমেন্টের জিনিস কিনতে শুরু করলেন।৫৩ এতে হঠাৎ কোম্পানীর ইনভেস্টমেন্ট অনেকখানি পড়ে গেল, কারণ নতুন ব্যবস্থা কার্যকরী হতে সময় লাগে। ১৭৫১ খ্রীস্টাব্দে কোম্পানীর ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণ ছিল তেত্রিশ লক্ষ ছেষট্টি হাজার টাকা। ১৭৫৫য় তা গিয়ে দাঁড়াল বারো লক্ষ একাশি হাজার টাকা।৫৪ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মফস্বলের আড়ং এ দস্তকের আড়ালে সাহেব ও গোমস্তাদের নিজেদের ব্যবসা বেড়ে গেল। এতে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ ক্ষিপ্ত হলেন।৫৫ নবাবের দপ্তরে যত রসিদ ছিল তাই দেখে তাঁর ধারণা হল যে বাদশাহী ফারমান পাবার পর দস্তকের জালিয়াতি করে ইংরেজরা নবাব সরকারকে অন্তত দেড় কোটি টাকা ঠকিয়েছে।৫৬ পায়ে ধরিয়ে ওয়াট্‌সের কাছ থেকে মুচলেকা নিলেন, যত পরিমাণ মাশুলের টাকা ঠকানো হয়েছে বলে প্রমাণ হবে, তার সবটাই কোম্পানী পুরিয়ে দেবে। কাশিমবাজারের ইংরাজ কুঠী দখল করে নবাব যখন কুঠীর দ্বিতীয় সাহেব কলেটের বাড়িতে আড্ডা গেড়েছেন, তখন জগৎ শেঠ মহতাব রায় ইংরাজদের হয়ে বলতে এলেন, এরা একদল নিরীহ বণিক, আর্থিক ভাবে নবাবের রাজস্বের পক্ষে খুবই হিতকারী, নবাব এদের বিরুদ্ধে ক্রোধ সম্বরণ করুন। ক্রুদ্ধ নবাব সেই মুহূর্তে জগৎ শেঠকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন, ইংরাজদের হয়ে তিনি আর কোনো কথা বলবেন না। ওয়াট্‌সের মুচলেকা যদি ইংরেজরা পালন করত, তাহলে জগৎ শেঠের মাধ্যমে সহজেই ঝগড়া মিটে যেত। ড্রেকের নির্বুদ্ধিতায় কলকাতা অধিকৃত ও লুন্ঠিত হল্‌। নবাবী ফৌজের হাতে অনেক ইংরাজের প্রাণ গেল। ইংরেজরা ঘটনার নাম দিল ব্ল্যাক হোল ট্র্যাজিডি।

জগৎ শেঠ ইংরাজের ধামাধরা বলে একটা ভুল ধারণা বাঙালী সমাজে বহুদিন ধরে চালু আছে। পলাশীর যুদ্ধের আগেকার বঙ্গীয় সমাজের বৈষয়িক কাঠামো এবং পলাশীর রাষ্ট্র বিপ্লবের আভ্যন্তরীণ চেহারা বুঝতে গেলে এই অমূলক ধারণা আগে সরিয়ে ফেলা দরকার। ১৭৫৭র অনেক আগে থেকে কলকাতা বন্দরে সুবাহ্ বাংলার বৈষয়িক আদান-প্রদানের কেন্দ্র গড়ে ওঠার সুস্পষ্ট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তা আগে বলা হয়েছে। গাঙ্গেয় উপত্যকার সমস্ত টাকা পয়সার লেনদেন ও বেচাকেনা (অর্থাৎ money market বা টাকার বাজার) জগৎ শেঠ পরিবারের হাতের মুঠোয় ছিল বলে তা হতে পারে নি। অনেক চেষ্টা করেও ইংরেজরা সেই মুঠি শিথিল করতে পারে নি। ‘ইনভেস্টমেন্ট’ আশানুরূপ না বাড়ার পেছনে টাকার বাজারের৫৭ উপর দখলের অভাব কোম্পানীর কর্মকর্তারা খুবই অনুভব করছিলেন। মাদ্রাজে কোম্পানীর যেমন মিন্‌ট্‌ ছিল কলকাতায় নবাবরা সে রকম হতে দেন নি। সুবাহ্‌ বাংলার টাঁকশাল ছিল মুর্শিদাবাদে, তা ছাড়া রাজমহলেও। মুর্শিদাবাদ এর টাঁকশালই বড়ো। নবাবরা বছর বছর তা ইজারা দিতেন। ইজারাদারের পিছনে ছিলেন জগৎ শেঠ পরিবার, টাঁকশালের আসল কর্তা এবং ঢাকা হুগলী থেকে মুর্শিদাবাদ পাটনা পর্যন্ত গঙ্গার দুই পারের টাকা পয়সার প্রবাহের সর্বময় নিয়ন্তা। ইংরাজ কোম্পানী মাদ্রাজ থেকে আর্কট রূপাইয়া এনে ‘ইনভেস্টমেন্টের’ জিনিস খরিদ করতেন। কিন্তু আর্কট রূপাইয়ার দাম খাজনা খানায় গ্রাহ্য সিক্কা রূপাইয়ার চেয়ে কম ছিল, এই জন্যে অনেক বাটা বা ‘ডিসকাউন্ট’ দিতে হত। সিক্‌কার তুলনায় আর্কট বা অন্যান্য নানা প্রকার প্রচলিত মুদ্রার হার কি হবে তা শেষ পর্যন্ত জগৎশেঠের কুঠী থেকে নিয়ন্ত্রিত হত।৫৮ এতে কোম্পানীর স্বার্থে ঘা পড়ত। এ সব সমস্যা ছাড়াও, জলপথে বাইরে থেকে কোম্পানী যে রূপা বা টাকা আনতেন তা কলকাতার ইনভেস্টমেন্টেই ফুরিয়ে যেত। কাশিমবাজার, ঢাকা বা পাটনার আড়ং-এর ক্রয়কার্য চালাতে ইংরাজরা জগৎ শেঠের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করত।৫৯ ওলন্দাজ এবং ফরাসীরাও জগৎ শেঠের কাছে ধারে ব্যবসা চালাত।৬০ এদেশে বাইরে থেকে রূপা এনে ইওরোপীয় কোম্পানীগুলি তাঁর কাছে বিক্রী না করে আর কারো কাছে বিক্রী করুক জগৎশেঠ তা চাইতেন না।৬১ তা করতে গিয়ে বার কয়েক ইংরাজরা তাঁর কোপে পড়েছিল তাও পলাশীর যুদ্ধের আগেকার কোম্পানীর কাগজপত্র থেকে জানা যায়।৬২ দেশে যা রূপা আসে সব কেনা জগৎ শেঠের স্থির লক্ষ্য ছিল। তাই দিয়ে টাঁকশালে টাকা বানিয়ে বাজারে সুবিধে মতে ছেড়ে তাঁরা বিভিন্ন মুদ্রার পারস্পরিক হার নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং বাটা নিতেন। জগৎ শেঠের একচেটিয়া টাকার ব্যবসা ভাঙতে আলিবর্দির নবাবীর শেষ দিকে ইংরাজ কোম্পানী উঠে পড়ে লাগলেন। বিলেত থেকে নির্দেশ এল, নবাবকে বুঝিয়ে কলকাতায় টাঁকশাল তৈরীর অনুমতি আদায় করা হোক। জগৎ শেঠকে না জানিয়ে খুব গোপনে ইংরাজরা একাজে প্রবৃত্ত হয়েছিল তা কামিশবাজার থেকে কলকাতায় রজার ড্রেককে লেখা ওয়াট্‌সের চিঠি থেকে জানা যায় :

8 February 1753

Hon’ble Sir,

As the directions to the Hon’ble the President and Council from the Hon’ble the Court of Directors for the establishment of a mint in Calcutta require the utmost secrecy, I have been obliged to use the greatest caution in the affair, but by all discreet enquiries I could make it would be impracticable to effect it with the Nabob, as an attempt of that kind would be immediately overset by Juggut Set even at the expense of a much larger sum than what our Hon’ble Masters allow us to pay, he being the sole purchaser of all the bullion that is imported in this province by which he is annually a very considerable gainer.

However that no means might be left unessayed to get so beneficial a privilege for our Hon’ble master, I have at last ventured to entrust and consult our vaqueel, who is of the same opinion that it is impossible to effect it here, but said his Master Hackim Beg had a son in great power in Delhi, who might be able to get us a Phirmaund from the King;৬৩ but that this would be attended at least with the expenses of one hundred thousand Rupees, and that on the arrival of the Phirmaund here it would cost another hundred thousand Rupees to the Mutsuddys and Dewans of the Nabob to put that Phirmaund in force, and that this affair must be carried on with the greatest secrecy, that Juggut Set’s house might not have the least intimation of it, but I much question whether we could get the mint for any sum with so extensive a privilege as our Hon’ble Masters want.

I am, etc.,

William Walle

ওয়াট্‌সের চিঠি থেকে বেশ বোঝা যায় জগৎ শেঠের সঙ্গে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ সমরে অবতীর্ণ হয়ে কোম্পানীর কোনো লাভ হবে বলে তিনি মনে করতেন না। টাঁকশালের ব্যাপারে ইংরাজরা তখন আর অগ্রসর হল না। কলকাতা আবার ক্লাইভ ও ওয়াটসনের দখলে যাবার পর হঠাৎ ভয় পেয়ে নবাব সন্ধি করে ফেললেন। সেই আলিনগরের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইংরাজরা কলকাতায় টাঁকশাল বসাল। কিন্তু জগৎ শেঠের প্রবল প্রতিবন্ধকতায় সেই টাঁকশালের টাকা চালাতে ইংরাজরা অনেকদিন ধরে বেগ পেয়েছিল। ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দে কোম্পানী সুবাহর আসল কত, তা সত্ত্বেও কলকাতার কাউনসিল বিলেতের ডিরেক্টরদের জানাতে বাধ্য হলেন:৬৪

‘Our Mint is at present of very little use lo us, as there has been no bullion sent out of Europe this season or two past, and we are apprchensive that it will never be attended with all the advantages that we might have expected from it, as the coining of Siccas in Calculla interferes so much with the interest of the Scths that they will not fail of throwing every obstacle in our way to depreciate the value of our money in the country, notwithstanding its weight and standard is in every respect as good as the Siccas of Moorshedabad; so that a loss of balla will always arise on our moncy, let our influence at the Durbar be ever so great.

দরবারে রেসিডেন্ট বসিয়েও জগৎ শেঠের টাকার জোর ইংরাজরা একদিনে ভাঙতে পারেনি। মীরকাশিমকে মসনদে তুলে ইংরাজরা প্রথমেই যে নবাবী পরোয়ানা আদায় করে নেয় তাতে হুকুম ছিল কেউ যেন কলকাতার সিক্‌কার উপরে বাটা না চায়।

যে কালেতে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ ইংরাজ উচ্ছেদে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন সেই কাল তাঁর কপালে সুসময় ছিল না। ‘গোমস্তা রজার ড্রেক’ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের সহজেই কলকাতা থেকে উৎখাত করে তাঁর ধারণা হয়েছিল সারা বিলেতে ইংরাজ মর্দানের সংখ্যা দশ বারো হাজারের বেশী হবে না। তারা যে জোর করে আবার কলকাতা দখল করতে আসবে এ কথা তিনি ভাবতেই পারেন নি। দরবারে ইংরাজদের নিয়ে রোজ হাসি মস্করা হত, নবাব বলতেন ‘এদের শায়েস্তা করতে হলে একজোড়া পয়জার চাই, আর কিছু না।’ অন্য সময় হলে এ কথা সত্য হতে পারত। যুদ্ধবিগ্রহ অনেক খরচের ব্যাপার, তাতে সৈন্যসামন্ত লাগে, টাকা লাগে, এমনিতে একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তাতে ক্ষতি বই লাভ নেই। ইংরেজরাও নবাব যেমন আশা করেছিলেন তেমনি ব্যাপারটা মিটিয়ে নিত। কিন্তু ঐ সময় ফরাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘনিয়ে আসবার ফলে মাদ্রাজে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের অধীনে ইংল্যান্ডের রাজার নৌবহর এসেছিল। নবাবের অদৃষ্টে—এবং অদূর ভবিষ্যতে সমগ্ৰ মোগল মনসবদার সমাজের রহস্য যবনিকাবৃত ললাট লিখনে—বিপদের সূত্রপাত হল এইখানে। হাতে লোক লস্কর থাকতে নবাবী শর্তে বাণিজ্য করতে হবে কেন? বাদশাহী ফারমান অনুযায়ী আগেকার মত পক্ষপাত পুষ্ট নিষ্কর বাণিজ্যের পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে মাদ্রাজ কাউনসিল ফৌজ ও নওয়ারা পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা নন, খালি কলকাতা প্রত্যর্পণ এবং ক্ষতিপূরণের কথাটাই সন্ধির শর্ত বলে লিখে দিলেন।৬৫ তাছাড়া আরো একটা কথা লিখলেন যা ক্লাইভ ওয়াটসন মানিকজোড়ের বিশেষ মনঃপূত হল। কথাটা উদ্ধৃত করে দেওয়া দরকার:

‘Should it be judged proper by the Company’s representatives after the taking of Calcutta to request the assistance of the squadron to attack Hughly or any other Moor’s town, or to make reprisals in the river upon Moor’s vessells, it is hoped it will not be thought unreasonable that commissaries be appointed on both sides to dispose of the prizes that may be so taken, their produce to be deposited untill it shall be determined by His Majesty in what manner it should be distributed.’৬৬

অর্থাৎ রাজার নৌবহর এবং কোম্পানীর কর্মচারী এই দুই তরফ থেকে লুন্ঠিত ধনরত্নের বাটোয়ারার তোড়জোড় চলছিল প্রথম থেকেই। কলকাতা দখল হওয়া মাত্র৬৭ তার অধিকার নিয়ে ক্লাইভ ও ওয়াটসনের মধ্যে হাতাহাতি লেগে গেল। কিন্তু তাতে ইংরেজ ফৌজ ও নওয়ারার হাতে হুগলীর মোগল বন্দর লুণ্ঠন ও গৃহে গৃহে অগ্নিসংযোগের ব্যাঘাত হল না। শহরের পথে নরহত্যা করে গঙ্গার দুই ধারের নিরীহ লোকজনের ঘরদোর গোলাবাড়ি জ্বালিয়ে বীরদর্পে ইংরাজ নাবিকরা কলকাতা ফিরে এল।

শওকৎ জঙ্গকে উৎখাত করে নবাব তখন সবে নিষ্কণ্টক হয়ে মসনদে জাঁকিয়ে বসেছেন, তাঁর সৌভাগ্য রবি তখন শীর্ষে। হুগলী লুণ্ঠনকারী নবাগত ইংরাজ দলের বড়ো বড়ো জাহাজের বহর এবং ভারি ভারি কামানের পাল্লার কথা শুনে ত্রস্ত হয়ে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ দমদম পর্যন্ত নেমে এসে তাঁবু ফেললেন। এইখানে তাঁর প্রথম ভুল হল। তাঁর পক্ষাবলম্বী কাশিমবাজারের ফরাসীদের প্রধান মঁসিয় ল’ (Law) পরবর্তীকালে নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, কলকাতায় নেমে না এসে নবাব যদি মুর্শিদাবাদ থেকে ইংরাজদের বাণিজ্যের উপর অবরোধ বজায় রেখে কুঠীতে কুঠীতে রসদ যাওয়া বন্ধ রাখতেন, তাহলে ইংরাজরা বেশীদিন যুদ্ধ চালাতে পারত না।৬৮ শীতকালের ভোরবেলা কুয়াশার মধ্যে অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে আতঙ্কিত নবাব বুঝতে পারলেন না যে ইরানি ঘোড়সওয়ারের পাল্টা আক্রমণে হানাদার ক্লাইভের দফা রফা হতে বসেছে। নবাবের শিবির থেকে পরের দিন জগৎ শেঠের দালাল রণজিৎ রায় সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। ক্লাইভ এক মুহূর্তের জন্যেও ইতস্তত করলেন না। তাঁর জানা ছিল যে নবাব গঙ্গার পার ধরে ওপর উঠে গেলে তাঁকে বশে আনার লোকবল বা অর্থবল ইংরাজদের নেই। নবাবের বিশেষ ইচ্ছা না থাকলেও রণজিৎ রায়ের তৎপরতায় আলিনগরের সুলেনামা সম্পাদিত হল। বাদশাহী ফারমান মোতাবেক বেমাশুল কারবারের অধিকার, মর্জিমত কেল্লা মজবুত করবার অধিকার এবং শহরে টাঁকশাল বসাবার অধিকার তাতে প্রতিষ্ঠিত হল।

যে জন্য মাদ্রাজ কাউনসিল নওয়ারা পাঠিয়েছিলেন আপাতদৃষ্টিতে তা সিদ্ধ হল। ওয়াটসনের নওয়ারা ও ক্লাইভের ফৌজ এবার মাদ্রাজে ফিরে যেতে পারত। বর্ষার আগেই ফিরে আসার জন্য ক্লাইভ আর ওয়াটসনের কাছে মাদ্রাজ কাউনসিল থেকে তাগাদা আসতে লাগল।৬৯ না হক ফৌজ আর নওয়ারা বসিয়ে রেখে খাওয়ানো কোনো বুদ্ধিমান ব্যবসায়ীর কার্যপ্রণালী হতে পারে না। অথচ নবাবের সঙ্গে কোম্পানীর সত্যিকারের কোনো শক্তি পরীক্ষা তখনো হয় নি। আলিনগরের সন্ধি টিকবে কি না তাতে সকলের সন্দেহ, এবং উভয় পক্ষই কুয়াশার মধ্যে লড়াই করে হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে সন্ধি করে ফেলে কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ। ক্লাইভ আর ওয়াটসনের কারোরই শেষ পর্যন্ত একটা কিছু না দেখে মাদ্রাজে ফিরে যাবার ইচ্ছে নেই। ঘটনাচক্রে ফৌজ ও নওয়ারার খরচ যুগিয়ে কলকাতায় বসিয়ে রাখার যথেষ্ট জোরদার যুক্তি মিলে গেল। আলিনগরের সন্ধির আগেই ফরাসীদের সঙ্গে ইংরাজদের যুদ্ধ বেধে গেছে। মাদ্রাজ থেকে ওয়াটসনের কাছে নির্দেশ এল, ফরাসডাঙ্গা (চন্দননগর) অধিকার করা এখন থেকে ইংরেজ অভিযানের অন্যতম লক্ষ বলে গণ্য করতে হবে। আলিনগরের সন্ধি হয়ে যাওয়া মাত্র ক্লাইভ এ ব্যাপারে জগৎ শেঠের দালাল রণজিৎ রায়কে বাজিয়ে দেখলেন। কারণ নবাব ফরাসীদের সহায়তা করলে চন্দননগর জয় করতে যাওয়া নিতান্ত নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। ইংরাজদের হুগলী প্রজ্জ্বলন কাণ্ডে জগৎ শেঠ স্বভাবতই উৎসাহিত হন নি। চন্দননগর ধর্ষণের প্রস্তাবেও তাঁর উৎসাহ দেখা গেল না। তাঁর কুঠীতে ফরাসীদের ধার তের লক্ষের উপর, তারা বিতাড়িত হলে সে দেনা শোধ হবে কি করে? ক্লাইভ চার দিক না দেখে শুনে চন্দননগরের দিকে অগ্রসর হতে চাইছিলেন না। কিন্তু ওয়াটসন নবাবের সামনে সিংহনাদ করতে শুরু করলেন।

নবাবকে তিনি বুঝিয়ে রেখেছিলেন—দিলীর জঙ্গ যে সে লোক নন, কোম্পানীর গোমস্তা নন। তিনি ইংল্যান্ডের রাজার অ্যাডমিরাল, এবং ইংল্যান্ডের রাজা মোগল বাদশাহ থেকে কোনো অংশে কম নন। সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ ফরাসীদের রক্ষা করার ব্যাপারে ইতস্তত করতে লাগলেন। এইখানে তাঁর দ্বিতীয় ভুল হল। হুগলীর ফৌজদার তখন নন্দকুমার। তাঁর প্রতি নবাবের নির্দেশ ছিল ফরাসডাঙ্গার ফরাসীদের যেন ঠিকমত দেখাশুনা করা হয়। নন্দকুমারকে ইংরাজরা উৎকোচে বশীভূত করল। বিপুল বিক্রমে লড়াই করে ফরাসীরা চন্দননগর থেকে উৎখাত হল। তারপর দোনামনা করতে করতে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ মঁসিয় ল’কেও সদলবলে কাশিমবাজার থেকে পাটনা পাঠিয়ে দিলেন। আহমদ শাহ আবদালী তখন দিল্লী ও হিন্দুস্তান লুঠপাট করছেন, তিনি যদি বাংলায় নেমে আসেন তাহলে ইংরাজদের সাহায্য দরকার। তাই নবাব ইতস্তত করছিলেন।৭০ এমন সময় খবর এল আহমদ শাহ আবদালী কাবুল ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু ততদিনে ফরাসীরাও বাংলা থেকে বিদায় হয়েছে। এবার সিরাজ ও ইংরাজ মুখোমুখি। মধ্যে অসন্তুষ্ট জগৎ শেঠ ও মুর্শিদাবাদের মোগল মনসবদার মহল।

চন্দননগর আক্রমণের ঠিক আগে যেন নবাব আলিবর্দি খানের ভবিষ্যৎ বাণীর সফল প্রতিধ্বনির সুরে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন সিরাজউদ্দৌলাহ্‌কে লিখলেন—‘But it is time now to speak plain, if you are really desirous of preserving your country in peace and your subjects from misery and ruin, in ten days froin the date of this, fulfil your part of the treaty in every Article, that I may not have the least cause of complaint; otherwise, remember, you must answer for the consequences… I will kindle such a flame in your country, as all the water in the Ganges will not be able to extinguish.’

জল থেকে ডাঙায় উঠে আসা আগুন নেবানোর বৃথা চেষ্টায় নবাব দিলীর জঙ্গের কথা মতো ফরাসীদের তাড়িয়ে দিলেন, তবু আগুন নিবল না।

কিন্তু এ কথা মনে রাখা দরকার যে ইংরাজদের মাথায় তখনো মুর্শিদাবাদের তখৎ মোবারক উলটানোর পরিকল্পনা আসেনি। শুধু নবাবকে দিয়ে দেশ থেকে ফরাসীদের তাড়াতে বাধ্য করানোর জন্য ওয়াটসন অগ্নিমূর্তি ধরেছিলেন। চন্দননগর পতনের এক সপ্তাহ বাদেই তিনি বিলেতে লিখেছিলেন যে এবার নৌবহর সুদ্ধ বোম্বাই রওনা হবেন, শুধু বর্ষা শেষের অপেক্ষায় আছেন।৭২ আর ক্লাইভ তো নবাবের আপত্তি দেখে তটস্থ হয়ে চন্দননগর আক্রমণ না করেই মাদ্রাজ ফিরে যেতে তৈরী হয়েছিলেন, পরে নবাবের আফগান ভীতির সুযোগে তিনি ফরাসীদের আক্রমণ করতে সাহস পান। ওই সময় ক্লাইভ বিলেতে সিক্রেট কমিটর কাছে লিখেছিলেন—‘All operations therefore are now over, and I may hope in [a] few days to make my passage for the coast with the satisfaction of having left your affairs well re-established and a general tranquility in the province’৭৩

অতঃপর চন্দননগর জয়ের পরে ক্লাইভ মাদ্রাজে জানিয়েছিলেন, বর্ষা শেষ হওয়া মাত্র তিনি ফৌজ সমেত ফিরে আসছেন, কারণ চুক্তির সব শর্ত নবাব পালন করায় এখন এই সুবাহ্‌তে কোম্পানীর বৃহস্পতির দশা চলছে এবং তিন লক্ষ টাকা হাতে এসে গেছে।৭৪

তবে নবাবের মতো ‘দুর্বলচিত্ত এবং কেবলমাত্র ভয়ভাব চালিত’ নরপতিকে ভয় দেখানো ছাড়া হাতে রাখা যাবে না বুঝে তিনি পিছনে কোম্পানীর ফৌজের একটা বড়োসড়ো অংশ মোতায়েন রেখে যাবার পক্ষপাতী ছিলেন।৭৫ আর এ সব ব্যাপারে ক্লাইভের সঙ্গে সর্বদাই লাঠালাঠি লেগে থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে ওয়াটসন একমত হলেন। তাঁরও ধারণা হয়েছিল যে শক্ত কেল্লায় মস্ত ফৌজ না রেখে গেলে নবাব আবার খেদিয়ে দেওয়া ফরাসীদের নিজের দলে ভেড়াবার চেষ্টা করবেন। নবাবকে হাতে রাখা দরকার এই চিন্তা নবাবের নতুন বন্ধু দিলীর জঙ্গ ও সাবিৎ জঙ্গের মাথায় ঘুরঘুর করছিল। দুজনের মনের ভাবখানা তখন এই—নবাবের সঙ্গে পাকা দোস্তী পাতাতে না পারলে নবলব্ধ সুযোগ সুবিধেগুলি বজায় রাখা যাবে না, এবং দোস্তী পাকা করতে হলে কেল্লা মজবুত করে ফৌজ মোতায়েন রেখে যাওয়া চাই।৭৬

মুর্শিদাবাদের উঁচু মহলে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়ার পর এ ব্যাপারে ক্লাইভের চিন্তা পাল্টে গেল। এর আগে হুগলী লুঠতরাজের সময় ইংরাজৱা ঢাকা শহর আক্রমনের কথা চিন্তা করেছিল। ৭৭ তখন নিহত নবাব সরফরাজ খানের ছেলে আগা বাবা ও তাঁর চার ছোট ভাই ঢাকায়। মসনদে ওঠার পরেই সিরাজ ইংরাজদের সঙ্গে আগা বাবার যোগসাজস সন্দেহ করে পাঁচ ভাইকে গহসেটি বেগমের আশ্রয়,চত করে মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।৭৮ শোনা যায় ঢাকা আক্রমণের মতলব আঁটবার সময় ইংরাজরা আগা বাবাকে হস্তগত করার তালে ছিল! কথা সত্যি হোক বা না হোক নবাব ভয় পেয়েছিলেন। ইংরাজরা চন্দননগর জয় করার পরেই তিনি দু হাজার বরকন্দাজের পাহারায় সরফরাজ খানের পাঁচ ছেলেকে আবার ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ আনানোর হুকুম দেন।৭৯ একচক্ষু হরিণের মতো বিপদ কোন দিক থেকে আসবে নবাব দেখতে পান নি। মুর্শিদাবাদের রাজপুরুষদের বাদ দিয়ে ইংরাজদের কেবল নিজেদের চেষ্টায় একজন নবাবকে ঠেলে আর একজন নবাবকে মসনদে বসানোর কোনো ক্ষমতা ছিল না। আগা বাবার কথা ইংরাজরা ভাবুক বা না ভাবুক,৮০ এ কাজে ক্লাইভ যে হাত দেন নি তা সুনিশ্চিত। কারণ আগা বাবার হয়ে মুর্শিদাবাদের রাজশক্তির অন্দর মহল থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ায় নি। ক্ষমতার অন্দর মহলে গুপ্ত সহায়ক না পেলে বাইরে থেকে রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটানো সম্ভব ছিল না। অপ্রত্যাশিত ভাবে সাবিৎ জঙ্গ ওরফে ক্লাইভ সেই সহায়তা পেলেন।

সুবাহ্ বাংলায় মানুষ ও জমির ওপরে প্রভুত্ব তখন দুই স্তরে ন্যস্ত। ওপরের স্তরে মালজমির রাজস্বভোগী মোগল শাসক শ্রেণী, এবং নীচের স্তরে বড়ো বড়ো পরগনার রাজস্ব আদায়কারী ব্রাহ্মণ কায়স্থ পাঠান রাজপুত ও ক্ষেত্রী জমিদার বর্গ। শোনা যায় নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে দেশীয় হিন্দু জমিদার ও রাজাদের অংশ ছিল, কিন্তু মূল ভূমিকাগুলিতে যাদের স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাওয়া যায় তাঁরা হলেন মোগল মনসবদার শ্রেণীভুক্ত প্রধান প্রধান মুসলমান ও হিন্দু রাজপুরুষ ও জগৎ শেঠ। এঁদের ষড়যন্ত্রে ইতিহাসের রথচক্রে প্রচণ্ড টান পড়ল। এই ষড়যন্ত্রের প্রকৃতি বুঝতে হলে এর সামাজিক পটভূমিকা সম্বন্ধে দু একটা কথা জানা দরকার।

.

টীকা

৫। Abdul Majed Khan, The Transition in Bengal 1756-1775. A Study of Sayyid Muhammad Reza Kaan (Cambridge.1956), p xii

৬। Kalikinkar Datta, Siraj-ud-Daulah (Calcutta 1971), p. 37.

৭। বখরার হিসাবে নাম রইল নওয়ারা ও ফৌজের—দুই দল সমান বখরার অধিকারী এবং সেই হারে এ্যাডমিরাল ওয়াট্‌সন ও কর্ণেল ক্লাইভ সমান ভাগীদার। ওয়াট্‌সন সুবর্ণদুর্গের দৃষ্টান্ত দিলেন, কিন্তু ক্লাইভ তা মানলেন না। Clive’s Evidence before the Committee of the House of Commons 1772, in S.C. Hill (ed.), Bengal in 1756-57: A Selection of Public and Private Papers Dealing with the Affairs of the British in Bengal during the Reign of Siraj Uddaula, vol III (London 1905), p. 308.

৮। পরে এই নিয়ে ওয়াট্‌সনের উত্তরাধিকারীরা ক্লাইভের বিরুদ্ধে মামলা আনেন। ঐ, ৩১২-৩ পৃঃ।

৯। Court of Directors to Fort Willam, 25 August 1752: ‘Standing upon defensive to observe to the utmust of your power to the strictest neutrality between the competitors.’ Brijen K. Gupta, Sirajuddaulah and the East India Company 1756-57. Background to the Foundation of British Power in India (Leiden 1962), p. 37.

১০। সূচনার শিরোভাগে উদ্ধৃত কবিতাংশ দুটি তৎকালীন দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারে পাশাপাশি রাখা চলে। সমকালীন লোকেদের চোখে কোনো পার্থক্য ছিল না।

১১। এই ব্যর্থ চেষ্টার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন আবদুল মাজেদ খান। Transition in Bengal, প্রথম অধ্যায়।

১২। গোলাম হোসেন খান সিয়র-উল-মুতাক্ষরিন্‌ গ্রন্থে ও করম আলি মুজাফ্‌র নামা গ্রন্থে এই শেষ তিন চার বছরের যে সব ঘটনা বিবৃত করেছেন তা থেকে পলাশীর পটভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১৩। মীরজাফরের চিঠি ওয়ারেন হেস্টিংস কৃত অনুবাদ। হেস্টিংসের কাগজপত্র থেকে উদ্ধৃত করেছেন আবদুল মাজেদ খান। The Transition in Bengal, p. 11.

১৪। P.J. Marshall, East Indian Fortunes. The British in Bengal in the Eighteenth Century (Oxford 1976), pp 159-162.

১৫। ১৮ জুন ১৭৩৩ এ-লেখা চিঠি। Brijen Gupta, Sirajuddaulah and the East India Company বইয়ের ৩৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।

১৬। P.J. Marshall, East Indian Fortunes, p. 57.

১৭। Seid Gholam Hossein Khan, The Seir Mutagharin (English trans, reprint, Calcutta, n.d), Vol II, pp. 162.163.

১৮। দরবারে কলকাতা বিজয়ী সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ এ কথা প্রকাশ করেছিলেন। J.H. Little, The House of Jagatseth (Calcutta 1967), p. 166.

১৯। Seir Mulagharin, vol II, 73-74,90

২০। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গলার ইতিহাস। অষ্টাদশ শতাব্দী-নবাবী আমল (কলকাতা ১৩০৮) ১৮৯-১৯১ পৃঃ। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কবিতার গ্রন্থসূচনায় জানা যায় নবাব আলিবর্দি খান মহাবৎ জঙ্গ কৃষ্ণচন্দ্রকে মুর্শিদাবাদে আটকে রেখে নদীয়ার রাজস্ব আদায়ের জন্য একজন সাজোয়াল (sezawal)—জমিদারী অধিগ্রহণকারী রাজস্ব আদায়ক নিয়োগ করেছিলেন।

মহাবদজঙ্গ তারে ধরে লয়ে যায়।
নজরানা বলে বারো লক্ষ টাকা চায়॥
লিখি দিলা সেই রাজা দিব বারোনক্ষ।
সাজোয়াল হইল সুজন সর্বভক্ষ॥
বর্গিতে লুঠিলা কত কত বা সুজন।
নানা মতে রাজা প্রজার গেল ধন॥
বদ্ধ করি রাখিলেন মুরসিদাবাদে।
কত শত্ৰু কত মতে লাগিল বিবাদে॥

এই সুজন নামক সাজোয়াল সম্ভবত মীরজাফরের দেওয়ান সুজন সিংহ। মহারাষ্ট্র যুদ্ধের সময় কাপুরুষতা ও রাজদ্রোহের অপরাধে মীরজাফরকে মীর বকশী পদ এবং হিজলীর ফৌজদার পদ থেকে থেকে বরখাস্ত করা হয়, তখন কিছুদিনের জন্য মীর বকশী পদ নসরুল্লাহ বেগ খানকে এবং হিজলীর ফৌজদারের পদ সুজন সিংহকে দেওয়া হয়। পাটনার আফগান বিদ্রোহের সময় আলিবর্দি খান আবার মীরজাফরকে বকশী অর্থাৎ সামরিক বিভাগের কর্তা (pay master) নিযুক্ত করেন। Seir Mutaqherin, vol II, p. 27.

২০(ক)। Brijen Gupta, Sirajuddaulah and the East India Company, p 56.

২১। Sushil Chaudhuri, ‘Sirajuddaulah, the English Company and the Plassey conspiracy’. Indian Historical Review, vol XIII nos 1-2.

২২। Brijen Gupta, Sirajuddaulah and the East India Company, p 56.

২৩। করম আলি, মুজাফ্‌ফর নামা। যদুনাথ সরকার কৃত অনুবাদ। Jadunath Sarkar (tr.), The Bengal Nawabs, pp. 50-51.

২৪। Seir Mulaqherin, vol. II. pp. 121-22.

২৫। তদেব।

২৬। সিরাজ অল্প বয়সে পাটনায় পালিয়ে গিয়ে নিজের প্রভুত্ব কায়েম বার চেষ্টা করেছিলেন।

২৭। Seir Mutaqherin, vol. II. p.89.

২৮। করম আলী, মুজাফ্‌ফর নামা। Jadunath Sarkar (tr.), The Bengal Nawabs, p. 56

২৯। Seir Musqhsrin, vol. II. pp.122-126.

৩০। The Bengal Nawabs, p. 56.

৩১। ১৭৫৫ খ্রীস্টাব্দের আগে ঐ দুই যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা প্রমাণ হয় ঐ বৎসর নির্মিত বর্ধমান জেলার শ্রীখণ্ড, গ্রামের ভূতনাথ দেবের মন্দিরের প্রস্তরলিপি থেকে।

প্রাসাদং সমকারয়ৎ পরমমুং শ্রীভূতনাথস্য বৈ।
যোহ গ্লিষ্টোমমহাধবদরাদিমযজদ্যো বাজপেয়ী ক্ষিতৌ॥
দাতা শ্রীযুক্ত রাজবল্লভ নৃপোম্বষ্ঠারবিন্দার্যামা।
শাকে তর্কহীরাধ্ররজনীনাথে চ মাঘেহ, সিতে॥

অর্থাৎ যিনি অগ্নিষ্টোম প্রভৃতি মহাযজ্ঞ সম্পাদন করেছেন, যিনি পৃথিবীতে বাজপেয়ী নামে খ্যাত, অম্বষ্টকুলের পর সেই নৃপদাতা শ্রীরাজবল্লভ ১৬৭৬ শকের মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে ভূতনাথ দেবের এই রমণীয় প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন। রসিকলাল গুপ্ত, মহারাজ রাজবল্লভ সেন ও তৎসমকালবর্তী বাঙ্গলার ইতিহাসের স্কুল স্কুল বিবরণ। (কলকাতা, তারিখ নেই), ১১৯ পৃঃ।

৩২। সংস্কৃত ‘রাজবিজয়নাটকে’ রাজবল্লভ প্রবর্তিত উপনয়নের সময় বলা হয়েছে ‘শাকে সিন্ধুমুনির সৈকসংখ্য মাঘে’ অর্থাৎ ১৬৭৪ শকের মাঘ মাস (=১৭৫৩ খ্রীস্টাব্দ)। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বাঙ্গালীর সারস্বত অবদান: বঙ্গে নব্যন্যায় চর্চা (কলকাতা চৈত্র ১৩৫৮) ২০১ পৃঃ। বৈদ্য কুলজিতে ঐ ঘটনার এই বিবরণ পাওয়া যায়:

যে কালে মহম্মদ সাহ্‌ দিল্লীর পালক। স্বজাতিরে ছিন্ন ভিন্ন দেখিয়া রাজন।

নবাব মহবৎ জঙ্গ বঙ্গাদি শাসক॥ পণ্ডিত নিকট করে পত্রিকা প্রেরণ॥

দেখে বৈদ্য বহুতর যজ্ঞসূত্রহীন। অগিষ্টোম অত্যগিষ্টোম যজ্ঞকারী।

কোন কোন বৈদ্য সদাচারেতে প্রবীন॥ মহারাজ রাজবল্লভ দাতা শুদ্ধচারী॥

বৈদ্য কুলজি লেখক গোপালকৃষ্ণ কবীন্দ্র রচিত ‘কুলপঞ্জিকা’ হতে রসিকলাল গুপ্ত কর্তৃক মহারাজ রাজবল্লভ গ্ৰন্থে উদ্ধৃত, পৃঃ ১০৬-৭।

৩৩। এই বিবরণ অনুসারে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আগে থেকে পণ্ডিতদের উপর নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যেন তাঁরা সভাস্থলে মহারাজের পুনঃ পুনঃ অনুরোধেও কিছুতেই বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা না দেন। পরামর্শ অনুযায়ী রাজবল্লভের দূতের সামনে কৃষ্ণচন্দ্র পণ্ডিতদের অনেক পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কিন্তু নদীয়ার ‘স্বাধীন’ পণ্ডিত বর্গ এই অন্যায় উপরোধ মর্যাদাপূর্ণ ভাবে উপেক্ষা করেন। গল্পটি পণ্ডিতদের পক্ষে সম্মানজনক নয়, কিন্তু এতে কিছু সত্য লুকিয়ে থাকা সম্ভব। ঐ, ১১৩-১১৭ পৃঃ।

৩৪। Henry Beveridge, The District of Bakurganj (London 1876). p. 438; কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙ্গলার ইতিহাস: নবাবী আমল ১৮২-১৮৭ পৃঃ।

৩৪(ক) রসিকলাল গুপ্ত, মহারাজ রাজবল্লভ, ১৪-১৫ পৃঃ।

৩৪(খ) রাজনগরে রাজবল্লভ জরাসন্ধ অবতার রূপে খ্যাত ছিলেন।

৩৫। বিপদ দেখে শওকৎ জঙ্গ সিরাজের সঙ্গে একটা সাময়িক বোঝাপড়া করে নেন। ফলে সিরাজের তখন অন্য দায় নেই।

৩৬। S.C Hill (ed.), Indian Records Series. Bengal in 1756-1757. A Selection of Public and Private Papers Dealing with the affairs of the British in Bengal during the reign of Siraj Uddaula, vol 1 (London 1905). pl. (introduction)

৩৭। Ibid, p. 249.

৩৮। অর্থাৎ নবাবের।

৩৯। Bengal in 1756-57, vol.I pp 222, 252.

৪০। কৃষ্ণকান্ত নন্দী সে সময়ে কাশিমবাজারের একজন দাদনী বণিক ও ভূস্বামী ছিলেন, মোটেই ‘মুদী’ নন। Somendra Chandra Nandy, Life and Times of Canto Baboo, vol. I (Calcutta 1978). pp. 10-14.

৪১। সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইতিহাসমিশ্রিত বাংলা কবিতা (১৭৫১-১৮৫৫ খ্রী:) (কলকাতা ১৩৬১), ৮৮ পৃঃ

৪২। Bengal in 1756-57, vol. 1, p. 20

৪৩। অর্থাৎ শওকৎ জঙ্গের সঙ্গে সাময়িক বোলপড়া হয়ে যাওয়ায়।

৪৪। মুর্শিদকুলী খান।

৪৫। অর্থাৎ বিনাশুল্কে নয়, মুসলমান ও আরমানীদের হারে শুল্ক দিয়ে। ফাররুকশিয়রের ফারমান পাওয়ার আগে মুর্শিদকুলী খানের আমলে সেই হারে খাজনা দিয়ে ইংরাজরা বাণিজ্য করত।

৪৬। আইন মতে বাংলা বিহার ওড়িষা সুবাহ্‌র নাজিমের ‘হুকুমত’ তখনো দিল্লীর মোগল বাদশাহ্‌র ‘মুল্‌কের’ অন্তর্গত ছিল। মুর্শিদকুলী খানের সময় থেকে নবাবরা কার্যত স্বাধীন হলেও আইনতঃ তাঁরা বাদশাহর ‘নাজিম’।

৪৭। S.C. Hill, Bengal in 156-57, vol. I, pp. 35.

৪৮। বণিক পিগট সাহেবকে সহজে বোঝানোর জন্য নবাব এইভাবে কৃষ্ণদারে উল্লেখ করেছিলেন।

৪৯। Hill, Bengal in 1756-57, vol.I, p.106

৫০। Ibid, p. 46.

৫১। Ibid, p. 199.

৫২। If I am not mistaken the Company also indulged their covenanted servants with dusticks for their private goods too…at least it was what was practised here…which was certainly no small benifit to us as it gave us a considerable advantage over all other merchants, for it is to be observed every servant acted for himself, the same as the counal acted for the Company…so that what with the Company and the servants dusticks together, the merchants did contrive to get their goods to and from Calcutia without ever paying the Governments’ dutys. The gentleman in Europe cannot pretend to accuse us in that article, because one of their Council was always appointed Register of the dusticks which were always given in the Company’s name and passed for their property, let the goods belong to whom they would…Their granting dusticks also brought them in a small revenue, as they were rated at three rupecs cach. ‘Narrative of the Capture of Calcutta by William Tooke’ Ibid. p. 282.

৫৩। Narendra Krishna Sinha, The Economic History of Bengal from Plassey to the Permanent Satament, vol. I (Calcutta 1956), pp. 5-9.

৫8। Brijen Gupia, Sirajuddaulah and the East India Company. p. 34.

৫৫। Abdul Majed Khan, The Transition in Bengal, pp. 43-44.

৫৬। N.K. Sinha, op. cit. p.9. নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ এই তথ্যের উৎস উল্লেখ করেননি। এ হয়ত জনশ্রুতি।

৫৭। অন্যান্য পণ্যের মতো সোনারূপা, টাকা কড়ি, এগুলিও পণ্য। এ সব নিয়ে যে বেচাকেনা হয় এবং সুদে টাকা দিয়ে ও হুন্ডীর মাধ্যমে যে টাকা সরবরাহ করা হয়, তাকে অষ্টাদশ শতকের টাকার বাজার বলা চলে।

৫৮। পলাশী যুদ্ধের পরেও বেশ কয়েক বছর বিভিন্ন মুদ্রার পারস্পরিক হার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা জগৎ শেঠের কাছ থেকে ইংরাজ কোম্পানী কেড়ে নিতে পারেননি। এখন কলকাতায় মিন্‌ট্‌ হয়েছে, তবুও না। ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দে একজন ইওরোপীয় বণিক কলকাতার মিন্‌টের টাকায় এগার লক্ষ টাকা নিতে অস্বীকার করে কারণ দর্শালেন যে ঐ টাকায় তাঁর সম্পওি রোজই জগৎ শেঠের খুশীমত শতকরা পাঁচ দশ টাকা কমে যাবে। জগৎ শেঠ তাঁর ভাষায় ‘has the sole management and direction of the current money of the country, and can always make it fluctuate in such a manner, as he sees fitting and convenient for his purpose.’ এ কথা শুনে কোম্পানীর ডিরেক্টররা এত ক্রুদ্ধ হলেন যে ঐ বিদেশী বণিক-কে দেশ থেকে বের হয়ে যেতে বললেন। Litttle, House of Jagat Seth, pp. 153 154.

৫৯। ১৭৪৯ খ্রীস্টাব্দে জগৎ শেঠের কাছে ঢাকা আড়ঙের দেনা ৫ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা, ১৭৫১ য় কাশিমবাজার আড়ঙের দেনা ৫ লক্ষ ১২ হাতার টাকা। ঐ, ১৪৭ পৃঃ।

৬০। পলাশীর যুদ্ধের আগের বছর ওলন্দাজ কুঠী জগৎ শেঠের কাছে চার লক্ষ টাকা ধার করেছিল। সুদ শতকরা নয় টাকা। Hall, Bengal in 1756-57, p.32 পলাশীর যুদ্ধের বছ ফরাসীদের ধার পনের লক্ষ। Little, House of Jagat Seth, p. 154.

৬১। রূপা থেকে টাঁকশালে টাকা তৈরী হত তাই রূপার উপর এত ঝোঁক। এই রুপার টাকা সর্‌রাফ সাহুকরদের তহবিলে আছে জেনেই লোকে তাঁদের কাছ থেকে হুন্ডী নিত। জগৎ শেঠের বৃহৎ হুন্ডীর কারবার ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ পাটনা হয়ে দিল্লী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। হুন্ডীর পিছনে রূপাইয়া, রূপাইয়ার পিছনে রূপা, তাই রুপার আমদানী নিয়ন্ত্রণ করে টাকা পয়সার বাজার বা money market নিয়ন্ত্রন করা যেত।

৬২। ঐ, ১৫২-৩ পৃঃ।

৬৩। মোগল বাদশাহ্‌।

৬৪। চিঠির তারিখ ২৯ ডিসেম্বর ১৭৫৯। Little, House of Jagat Seth, p. 154.

৬৫। Select Committee, Fort St. George, to Select Committee, Fort William, 13 October 1756: ‘Should the Nabob on the arrival of these forces, make offers tending to the acquiring to the Company the before mentioned advantages, rather than risque the success of a war, we think that sentiments of revenging injuries, although they were never more just, should give place to the necessity of sparing as far as possible the many bad consequences of war, besides the expance of the company’s treasures…’ Hill, Bengal in 1756-57, p. 239. এ থেকে বোঝা যায় খরচ বাঁচাবার দিকে কোম্পানির কর্মকর্তাদের দৃষ্টি কত সতর্ক ছিল। রাজ্য জয়ের উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল না। ওয়াট্‌সনকে তাঁরা লিখেছিলেন ‘We submit to you, sir, to determine whether exemplary reparation is not necessary… The taking satisfaction in the most exemplary manner will in our opinion be the quickest means of re-establishing the English in the province of Bengal and even on better terms than have hithto obtained’ Ibid, p. 200. এই কথার সুরে সুর মিলিয়ে ক্লাইভ ১৩ অক্টোবর ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে লণ্ডনের সিলেক্ট কমিটিকে লেখেন ‘I flatter myself that this expedition will not end with the taking of Calcutta only, and that the Company’s estate in these parts will be settled in a better and more lasting condition than ever.’ Ibid, pp. 232-3. ক্লাইভের এই কথা ভবিষ্যৎ বাণীর মতো শোনালেও তাঁর দৃষ্টি তখনো বেশী দূর অগ্রসর হয়নি। এর ছয় দিন আগে রজার ড্রেকের পিতৃব্যকে লেখা ক্লাইভের চিঠিতে তা বোঝা যায়: ‘A general calamity such as this must affect every well wisher to his country and I am srue it must you in particular. I cannot help felling for your nephew’s misfortunes… I hope to have the pleasure of re-establishing him at Calcutta in a condition of recovering all the Company’s and his own losses also.’ Ibid, p. 229.

৬৬। ঐ, ২২২ পৃঃ।

৬৭। এতে ক্লাইভের কোনো লাভ হল না, বরং পকেট থেকে আড়াই হাজার পাউন্ড খরচ হয়ে গেল। Hill, Bengal in 1756-57, vol. II p. 210.

৬৮। Ibid, vol. III, P. 181.

৬৯। S.C. Hill, Bengal in 1756-57,vol II, p.256.

৭০। আলিনগরের সন্ধির পর ইংরাজরা যাতে আর বাড়তে না পারে সেই জন্য নবাব ফরাসীদেরও চন্দননগরে টাঁকশাল বসানোর ও নিন্ম বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছিলেন। স্থির ভাবে এই নীতি অনুসরণ কলে ইবরাজদের শক্তি এত বাড়তে পারত না। Ibid, p. 30.

৭১। Ibid, p. 273. আলিনগরের চুক্তিতে কোথাও লেখা ছিল না ফরাসীদের তাড়াতে হবে। নবাব মুখে বলেছিলেন ইংরাজের শত্রু এখন থেকে তাঁরও শক্ত হবে। চুক্তি অনুযায়ী নবাব ফরাসীদের তাড়াতে বাধ্য—ওয়াটসনের এই ব্যাখ্যা কোনো মতেই টেকে না।

৭২। Ibid, p. 312.

৭৩। Colond Clive to Secret Committee, London, 22 February 1757. Ibid, p. 241. এই চিঠির তিন সপ্তাহ পরে ক্লাইভ নবাবের কাছ থেকে বাধা না পাওয়া সম্বন্ধে, নিশ্চিত হয়ে ১৪ মার্চ চন্দননগর আক্রমণ করবার সাহস পান। নবাব বাধা দিলে কখনোই তাঁর এ সাহস হত না তা ওপরের চিঠি পড়লেই বোঝা যায়।

৭৪। ‘He has fulfilled most of the Articles of the treaty made with us. The three lack of rupees is already paid… and I make little doubt but that all his engagements will be duly executed. On the whole I may affirm to you that the Company’s affairs in this province wear a very prosperous face.’ Ibid, p. 308

৭৫। Clive to William Mabbot, 16 April 1757, Ibid, p. 337,

৭৬। Watson to John Cleveland, 14 April 1757, Ibid, p. 332. ‘…unless we can establish a lasting friendship and alliance with him, notwithstanding our late sucess, it will be impossible for the Company to preserve their rights and privileges granted them in this country, and nothing but a well-built citadas with a proper number of land forces, always quartered here, can put them on a respectable footing with the Nobob.’

৭৭। Ibid, p. 195.

৭৮। Ibid, p. 66.

৭৯। Ibid, p. 331.

৮০। ঐতিহাসিক হিল সাহেব ঢাকায় রণতরী পাঠিয়ে আগা বাবাকে নবাব খাড়া করার জল্পনা কল্পনা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তাঁর দলিল সংগ্রহে এর কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। Ibid, vol. I, introduction, pp. exxxvii-exxxviii, বরং ঐ দলিল সংগ্রহে দেখা যায় যে ঢাকায় রণতরী পাঠানোর জল্পনা কল্পনার সময় ক্লাইভ মাদ্রাজে আশ্বাস পাঠিয়েছিলেন যে সত্ত্বর সন্ধি স্থাপনের চেষ্টায় তাঁর কোনো ত্রুটি হবে না। Ibid, vol. II, PP. 174-5.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *