প্রথম নায়িকা
কে স্বপ্ন দেখে না?
সবাই স্বপ্ন দেখে। শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে। সব শিশুই স্বপ্ন দেখে, পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে মেঘের রাজ্য জয় করার দুদিন পর স্বপ্ন দেখে, রেলগাড়ির ইঞ্জিন চালাবার। বা উড়োজাহাজ নিয়ে উড়ে বেড়াবার।
স্বপ্ন বদলে যায় কৈশোরে, বদলে যায় যৌবনে। যৌবনে স্বপ্নের মিছিল আসে। তখন চোখে কত রকমের কত স্বপ্ন। মনে কত আশা।
স্বপ্ন দেখার শেষ নেই প্রৌঢ়ত্বে, বার্ধক্যেও। তখন নাতিনাতনীকে নিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে; স্বপ্ন দেখে সুখের সংসার রেখে বিদায় নেবার। হয়তো আরো কত কি।
মনীশও স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্কুলে একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার পর থেকেই ওর চোখে এক স্বপ্ন। সাহিত্যিক হবে। সেই এক স্বপ্ন বুকে নিয়েই কলেজের দিনগুলো কাটিয়ে এম. এ. পড়তে শুরু করল।
কী মনীশ, কী নিয়ে পড়ছো?
ডাক্তারবাবুর প্রশ্ন শুনে মনীশ একটু হেসে বলে, বাংলা নিয়ে পড়ছি।
বাংলা নিয়ে? ডাক্তারবাবু যেন ইলেকট্রিক শক্ পান। ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেন, একি বিদ্যাসাগরবঙ্কিমের যুগ যে বাংলা নিয়ে এম এ. পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই…
মনীশ আর শুনতে চায় না। বলে, আমি বরাবরই ঠিক করেছিলাম, বাংলা নিয়ে পড়ব।
তারপর কী করবে?
মনীশ জবাব দেবার আগেই ডাক্তারবাবু বলেন, বাংলায় এম. এ. পাশ করে হয় স্কুলে মাস্টামি, নন হয় কলেজে…। উনি পুরো কথাটা শেষ না করেই একটু থেমে বলেন, তুমি এত ভালো ছেলে হয়েও কেন যে সায়েন্স নিয়ে পড়লে না, তা ভেবে পাই না।
শুভাকাঙ্ক্ষী হলেও ডাক্তারবাবুর কথায় মনীশ দুঃখ পায়। স্বপ্নরাজ্যের রাজপ্রাসাদের একটা পাথর খসে পড়ে। তবে মনে মনেই ডাক্তারবাবুকে জবাব দেয়, সবাই কী ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার হতে পারে? না কি হওয়া উচিত? সবাই যদি ডাক্তারএঞ্জিনিয়ার হয়, তাহলে সমাজ চলবে কী করে? কারা স্কুলকলেজে পড়াবে? অফিসের কর্মী আসবে কোথা থেকে? কোর্টকাছারিতে মামলামোকদ্দমা সামলাবে কারা?
ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ হবার পর মনীশ কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। বইয়ের দোকানগুলো দেখে আর মনে মনে ভাবে, একদিন নিশ্চয়ই ওর বই দিয়ে এই দোকানগুলো সাজানো হবে। ওর বই পড়ে মুগ্ধ হবে হাজার হাজার পাঠকপাঠিকা। প্রতিদিন কত চিঠি আসবে ওদের কাছ থেকে।
তারপর?
আমন্ত্রণ আসবে সভাসমিতি থেকে। ওকে দেখার জন্য উপচে পড়বে ভীড়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওরা ওর কথা শুনবে।
তারপর?
হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ঘিরে ধরবে ওর অটোগ্রাফের জন্য, ছবি তোলার লোভে।
স্বপ্ন দেখতে দেখতে মনীশ একটু হাসে। হাসবে না। সুন্দরী শিক্ষিতা ধনীর দুলালী মনপ্রাণদেহ সমর্পণ করতে চাইলে হাসি পাবে না?
তারপর হঠাৎ ঝড় ওঠে। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সব স্বপ্ন। এমন কি পায়ের তলার মাটিও যেন সরে যায়। লেখাপড়া শেষ না করেই মনীশ চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এখন ওর চোখে নতুন স্বপ্ন–চাকরি চাই! বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে সদ্য বিধবা মাকে, ভাইবোনকে।
.
হেমন্তবসন্তের মতো গ্রীষ্মবর্ষাও তো চিরস্থায়ী নয়। দুপুরের ডাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েই মনীশ আনন্দে খুশিতে চিৎকার করে ওঠে, মা, চাকরি পেয়েছি।
মা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি জানতাম, চাকরি তুই পাবিই। দুদিন আগে বা দুদিন পরে কিন্তু….
আঁচলের কোণা দিয়ে মুখ চেপে ধরে চাপা কান্না কাঁদতে কাঁদতে উনি বলেন, তোর বাবা তো নিজে মরলেন না, তোর ভবিষ্যৎটাও মেরে গেলেন।
মনীশ ওর মাকে জড়িয়ে একটু হাসতে হাসতে বলে, কে বলল, আমার ভবিষ্যৎ নেই? যারা দুঃখেকষ্টে অতি সাধারণভাবে জীবন কাটায়, তারাই তো সত্যিকার সাহিত্যিক হয়।
সারাদিন কেরানিগিরির পর তুই আবার লেখালেখি করবি, তাহলেই হয়েছে।
হ্যা মা, সারাদিন কেরানিগিরি করার পরই আমি লিখব।
আমাকে ভোলাবার চেষ্টা করিস না।
না মা, আমি তোমাকে ভোলাচ্ছি না; সত্যি কথাই বলছি।
না, মনীশ মাকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়নি। ডালহৌসী পাড়ার স্টিফেন হাউসের এই অফিসে বসে সারাদিন কলম পিষতে পিষতেও ও স্বপ্ন দেখে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ডালহৌসী পাড়ার জনারণ্যে হারিয়ে যাবে না কিন্তু তবু ভেসে যায় দায়িত্বকর্তব্য আর পরিবেশের চাপে। জোয়ারে।
ওকে বাজারহাট করতে না হলেও দুই ভাইবোনের পড়াশুনা দেখতে হয়, দেখাতে হয়। তাছাড়া টুকটাক এখানেওখানে যেতেই হয়। বাবা মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তে সামাজিক দায়দায়িত্ব শেষ হয়নি! আজ বুড়ি মাসীর মেয়ের বিয়ে, কাল রাঙা পিসীর ফুলের বিয়ে বা বড় মাসীর নাতির অন্নপ্রাশন তো লেগেই আছে। যেমন সময় নষ্ট তেমনি টাকার শ্রাদ্ধ। তবু মুখে হাসি নিয়ে মনীশকে এইসব দায়িত্ব পালন করতে হয়।
অফিসেও একটা না একটা কিছু লেগেই আছে। সামনের মাসে ত্রিদিববাবুর রিটায়ারমেন্ট। তাই শনিবার তার বিদায় সংবর্ধনা। ও মাসের প্রথম শনিবার ফুলেশ্বরে পিকনিক। পিকনিক থেকে ফিরে আসতে না আসতেই জয়ন্ত মুচকি হেসে একটা কার্ড এগিয়ে দিল।
খামের উপর প্রজাপতির ছবি দেখেই মনীশ জিজ্ঞেস করে, কার বিয়ে? তোমার?
না, আমার ছোট বোনের।
ও! তাই নাকি? এক মুহূর্তের মধ্যে মনীশ ভেবে নেয়, তাহলে এ বিয়েতে না গেলেও চলবে।
জয়ন্ত একটু থেমে বলে, ভাই, আমার বাবা নেই। আমিও সব চাইতে বড়। সব দায়িত্বই আমার। তাই তোমরা সবাই না হলে হয়তো বিপদে পড়ে যাব।
মনীশ সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বলে, কিছু চিন্তা করো না। তোমার বোনের বিয়ে মানে তো আমাদেরও বোনের বিয়ে।
আরো কত কি! আজ এক অসুস্থ সহকর্মীকে হাসপাতালে দেখতে যাবো তো গামীকাল পাশের টেবিলের বিকাশবাবুর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি।
প্রচণ্ড কাজের চাপের উপর এসব উপরি পাওনা। সরকারি অফিস না যে এগারটায় এসে চারটেয় চলে যাও। মাঝে ঘণ্টাখানেক টিফিনের ছুটি। ঠিক সাড়ে নটায় অফিস ঢুকতে হয়। সাড়ে পাঁচটায় ছুটির কথা কিন্তু অধিকাংশ দিনই সাড়ে ছটার আগে বেরুতে পারে না মনীশ।
তবে অফিস থেকে বেরিয়েই মনীশ বাড়ি ফেবে না। আপনমনে ঘুরে বেড়ায় ডালহৌসী-এসপ্লানেড বা ইডেন গার্ডেনের পাশে, গঙ্গার ধারে। রোমন্থন করে সারাদিনের স্মৃতি।
এইভাবেই দিনগুলো কেটে যায়। শেষ হয় মাসের পর মাস। ঘুরে যায় একটি বছর।
টুকটাক পড়াশুনা করলেও মনীশ কিছু লেখার অবকাশ পায়নি গত তিন বছরে। হঠাৎ সেদিন রাত্রে খেয়াল হতেই ও চমকে ওঠে।
দিন সাতেক পরে মনীশ অফিস থেকে বেরিয়েই নিজে হাতে জিপিওতে লেখাটা পোস্ট করে দিল। মনে মনে ঠিক করল, যদি ছাপা হয়, তাহলে লিখবে; হয়তো এই শেষ। মনে মনে আশা করেছিল, মাসখানেকের মধ্যেই লেখাই ফেরত আসবে। অথবা… …অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাইতেছি, আপনার গল্পটি আগামী কানো এক সংখ্যায় প্রকাশিত হইবে এবং…
ভাবতে গিয়েও মনীশের হাসি পায়। ওর মতো লোকের প্রথম লেখাই যদি ছাপা হয়, তাহলে আর কথা ছিল না। তাও আবার সর্বজনপ্রিয় স্বদেশ পত্রিকায়।
লেখাটি অমনোনীত হবার চিঠি যদি কোনো কারণে মার হাতে পড়ে, সেই ভয়ে মনীশ ছদ্মনামে লিখেছে। অমনোনীত হলে মা দুঃখ পাবেন। তাছাড়া অমনোনীত হবার ঠিটি যদি পিওন ভুল করে পাশের বাড়ি বা সামনের বাড়িতে বিলি করে, তাহলে কে না ওকে উপহাস করবে? খারাপ খবর তো হাওয়ায় উড়ে যায়!
কিন্তু তিন মাস পরও মনোনীত বা অমনোনীত হবার কোনো চিঠি না পেয়ে মনীশ ভাবল, বোধহয় লেখাটি হারিয়ে গেছে। অথবা শতসহস্র লেখার ভীড়ে লেখাটি চাপা পড়ে আছে। একবার ভেবেছিল, স্বদেশ অফিসে গিয়ে খবর নেয় কিন্তু সাহসে কুলোয়নি।
প্রতিদিনের কাজকর্ম দায়দায়িত্বের চাপে মনীশ যখন লেখাটির কথা প্রায় ভুল বসেছিল, তখন একটা অঘটন ঘটে বসল।
.
ছুটির পর নীচে নামার জন্য লিফটএ চড়তেই পেছন দিক থেকে দুটি মেয়ের কথাবার্তা শুনে মনীশ চমকে ওঠে–আমি বলছি, এই স্টিফেন হাউসেরই কেউ এই লেখা লিখেছে।
তার কোনো মানে নেই। এই বিল্ডিংএ কী কম বাইরের লোক আসে?
তা ঠিক কিন্তু এত নিখুঁত ছবি কি বাইরের কেউ লিখতে পারবে?
যাই হোক লেখাটা চমৎকার। ভদ্রলোকের হাতটি ভারি মিষ্টি।
আমারও দারুণ লেগেছে কিন্তু এই লেখকের লেখা আর কোথাও পড়েছি বনে মনে হয় না।
না রে, আমিও কোনদিন এর লেখা পড়িনি।
মনীশ ওদের কথাবার্তা শুনে উত্তেজনায় ছট ফট করে কিন্তু চঞ্চলতায় পেছন ফি তাকাতে পারে না।
কিন্তু কোন মেয়েটিকে নিয়ে লিখেছে বলতো?
এই বাড়িতে এত মেয়ে কাজ করে যে ঠিক ধরতে পারা মুশকিল।
থার্ড ফ্লোর থেকে একটি মেয়ে লিফটএ ওঠানামা করে, তারা চেহারা হাব-ভাবের সঙ্গে
অন্য মেয়েটি উত্তর দেবার আগেই লিফট নীচে পৌঁছে যায়।
মনীশ প্রায় পাগলের মতো ছুটে গিয়ে এক কপি স্বদেশ হাতে নিয়ে সূচিপত্র দেখে আনন্দে খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। এক কপি, দু কপি না, চার কপি কাগজ কিনল। মাসের প্রায় শেষ। তবু মোড়ের মাথার নরেন্দ্র মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে কুড়ি টাকার মিষ্টি কিনে বাড়ি ঢুকল।
নাও মা, মিষ্টি খাও। মনীশ হাসতে হাসতে বলে, বুলা আর কচিকেও দাও
তা তো দেব কিন্তু হঠাৎ এত মিষ্টি আনলি কেন?
ইচ্ছে হল, তাই আনলাম।
তাই বলে এত মিষ্টি?
মনীশ হাসতে হাসতে বলে, বেশি তর্ক করলে তোমাকে একলা এইসব মিষ্টি খাইয়ে ছাড়ব
পাঁচসাতদিন পর ও অফিস থেকে ফিরতেই মা বললেন, হ্যাঁরে, দুপুরের ডাকে তোর একটা প্যাকেট এসেছে। টেবিলের উপর রেখে দিয়েছি।
ও! তাই নাকি?
মনীশ দৌড়ে ঘরে যায়। দেখে, দুকপি পত্রিকা ছাড়াও সম্পাদক ছোট্ট একটা চিঠি লিখেছেন–আপনার লেখাটি ছেপে সত্যি আনন্দ পেয়েছি। পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে লেখাটির প্রশংসা করে কয়েকজন টেলিফোনও করেছেন। যাই হোক দুএকদিনের মধ্যে একবার দেখা করলে ভালো হয়।
মনীশ আনন্দে খুশিতে বার বার চিঠিটা পড়ে। ইচ্ছে করে তখনই ছুটে যায় স্বদেশ ফিসে কিন্তু না, যায় না। নিজেকে সংযত করে। পাঁচসাতদিন পরে যায়।
প্রবীণ সম্পাদক ওকে দেখেই অবাক–তোমার এত অল্প বয়স? আমি তো ভেবেছিলাম, অন্তত পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ হবেই।
মনীশ হেসে বলে, আমি গত মাসেই পঁচিশে পড়েছি।
হ্যাঁ। তাই তো দেখছি। সম্পাদক একটু হেসে বলে, কিন্তু এই বয়সেই তোমার লেখার বেশ মুন্সীয়ানা আছে। তাছাড়া তোমার হাতটি খুব মিষ্টি।
মনীশ শুনে খুশি হয় কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
তা তুমি কতদিন ধরে গল্প লিখছো?
প্রথম গল্পই আপনাকে পাঠিয়েছি।
তাই নাকি?
সম্পাদক বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য! তোমার প্রথম লেখাই এত ভালো। একটু থেমে উনি বললেন, বিয়াল্লিশ বছর এই কাগজ চালাচ্ছি! অনেক লেখক-লেখিকা দেখলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তোমাকে বলতে পারি, যদি তুমি ফাঁকি না দাও, তাহলে তুমি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক হবেই।
ফাঁকি দিলে আপনি আমাকে শাসন করবেন।
উনি হো হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, লেখকের খ্যাতিযশ হলে কি তিনি সম্পাদকদের পরোয়া করেন?
ওর কথা শুনে মনীশ অবাক হয়। বলে, আশা করি আমি কোনোদিনই আপনার মতামতকে উপেক্ষা করব না।
আচ্ছা ওসব বাদ দাও। এবার কাজের কথায় আসি।
মনীশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়।
সম্পাদক প্রশ্ন করেন, তোমার কী উপন্যাস লেখার কোনো পরিকল্পনা আছে?
মনীশ একটু হেসে বলে, আমার দুটো উপন্যাস লেখা আছে কিন্তু ভয়ে কাউকে দেখাইনি।
কীসের ভয়?
যদি কেউ না পড়েই ফেলে দেন।
সম্পাদক একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, আমি যে সব লেখাই পড়ি, তার প্রমাণ তা পেয়েছ।
মনীশ একটু হেসে বলে, সে তো একশ বার।
কালই দুটো উপন্যাস আমাকে দিয়ে যাও। আমি পড়ে দেখি।
ঠিক আছে; আমি কালই নিয়ে আসব।
হ্যা আর একটা কথা।
বলুন।
তুমি কি বিশেষ কোনো কারণে ছদ্মনামে লিখেছ?
মনীশ আবার একটু হেসে বলে, ভয়ে ভয়েই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছি।
তুমি নিজের নামেই লেখো। ছদ্মনাম কী দরকার?
তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
সম্পাদক বলেন, হ্যাঁ, সেই ভালো, ছদ্মনাম ব্যবহার করে অযথা লেখক আর পাঠকের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে লাভ কী?
মনীশ স্বপ্নেও ভাবেনি, স্টিফেন হাউসের এক অখ্যাত অফিসের কেরানিগিরি করা জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক পাঠিকামহলে এক আলোড়ন সৃষ্টি করবে। চারদিকে খুশির বন্যা। মনীশ খুশি; মনীশের মা খুশি; খুশি ওর দুই ভাইবোন। খুশি ওর প্রত্যেকেটি সহকর্মী। গর্বিতও।
জয়ন্ত ওর ছোটবোনের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বলে, ঐ যে বিয়ের দিন যে পরিবেশন করেছিল, সেই তো মনীশ ব্যানার্জী।
ঘরের সবাই বলেন, তাই নাকি?
জয়ন্ত গর্বের হাসি হেসে বলে, হ্যাঁ। ও তো আমার ভেরি ক্লোজ ফ্রেন্ড।
হেড ক্লার্ক গিরীশবাবু সবার সামনেই বলেন, সারাজীবন এই স্টিফেন হাউসের কেরানিগিরি করছি বলে দুনিয়ার সবাই ঘেন্না করতো কিন্তু মনীশের দয়ায় এখন বাজারে আমাদের প্রেস্টিজ বেড়ে গেছে।
মনীশ বলে, গিরীশদা, প্লীজ ঐ দয়াটয়া বলবেন না।
সে না হয় নাই বললাম কিন্তু তুমি যে আমাদের প্রেস্টিজ বাড়িয়ে দিয়েছ, সে বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই।
পিছন দিক থেকে শ্যামল আর অজিত প্রায় এক সঙ্গেই বলে, ঠিক বলেছেন গিরীশদা
কোম্পানির মালিক মিঃ চৌধুরী শুধু এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট শিপিংফ্রেট এলসি লাভ লোকসান ছাড়া কোনোদিন কোনো কথা বলেননি। তাছাড়া গিরীশদার মতো প্রবীণ কর্মীও ওর মুখে কোনোদিন হাসি দেখেননি। সেই মিঃ চৌধুরী নিজের চেম্বারে ঢোকার আগে এক গাল হাসি হেসে মনীশদাকে বলেন, আমার স্ত্রী আর দুই মেয়ে তো তোমার রীতিমত ভক্ত হয়ে উঠেছে। একদিন তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাবো।
মনীশ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, হ্যাঁ সার, নিশ্চয়ই যাবো।
চৌধুরী সাহেব নিজের চেম্বারে ঢুকে যেতেই গিরীশদা মুচকি হেসে বলেন, দেখলে তো মনীশ, তোমার জন্য বড় সাহেবের মনোভাবও কেমন বদলে গেছে। আগে উনি এ ঘর দিয়ে যাবার সময় আমাদের কারুর মুখের দিকেও চেয়ে দেখতেন না।
জয়ন্ত হাসতে হাসতে বলে, এ আর কী দেখছেন গিরীশদা। এর পর দেখবেন বড়সাহেব মনীশের পাশের চেয়ারে বসে আপনাদের সবার সঙ্গে চা খাচ্ছেন।
তা হতেই পারে। গিরীশদা কাজ করতে করতেই বলেন।
স্টিফেন হাউসের অন্যান্য অনেক অফিসের লোকজন মাঝে মাঝেই এ ঘরে ঢুকে বসে যান, মনীশবাবু, লেখাটা দারুণ হচ্ছে। মনীশ একটু হেসে বলে, ধন্যবাদ। লিফটএ ওঠা নামার সময় অনেক মেয়েপুরুষই ওকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ভালো আছেন তো? দুচারজন মহিলা তো নিজেদের খুশি চেপে রাখতে পারেন না। ওকে দেখলেই বলেন, আমরা কিন্তু আপনার দারুণ ভক্ত হয়ে উঠেছি। মনীশ শুধু একটু হাসে কিন্তু এত মানুষের এত অভিনন্দন সত্ত্বেও যেন ওর মন ভরে না। এই স্টিফেন হাউসের যে মেয়েটিকে নিয়ে ও গল্প লিখে সাহিত্য জগতে প্রবেশাধিকার পেল, সে তো কোনোদিন কিছু বলল না; এখনও মাঝে মাঝে লিফটএ ওঠানামার সময় দেখা হয় কিন্তু একবার দুচোখ তুলে তাকায় না। মনীশ মনে মনে ভাবে, ও কী জানে না আমি ওকে নিয়েই লিখেছি? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? ঐ মেয়েটি ছাড়া আর কারুর সঙ্গেই সার্কুলার রেলের কামরায় দেখা হয়নি। নাকি ঐ মেয়েটি গল্প উপন্যাস পড়ে না? না, না, তা কখনই নয়। যদি সাহিত্যটাহিত্য বিষয়ে কোনো আগ্রহই না থাকতো, তাহলে কী ওকে বইমেলায় দুতিনদিন দেখি?
যাই হোক যত দিন যায়, তত ওর খ্যাতি ছড়ায়। বুলা বলে, জানো দাদা, আমাদের স্কুলের চারপাঁচজন মিসরা তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য পাগল। কচি বলে, আমাদের লাইব্রেরিয়ান স্যার বলছিলেন, কী একটা ফাংশানে তোমাকে নিয়ে যাবেন।
মনীশ কিছু বলে না কিন্তু শুনে খুশি হয়।
ওর মা হাসতে হাসতে বলেন, তুই লিখছিস বলে কিছু কিছু মেয়ে তো আমার সঙ্গেই গল্প করতে আসে।
মনীশ হাসে।
আজকাল আমি পথঘাটে বেরুলেই কিছু কিছু লোককে বলতে শুনি, ঐ যে মনীশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা যাচ্ছেন। উনি এক গাল হাসি হেসে বলেন, শুনে যে কি ভালো লাগে, তা বলতে পারব না।
স্টিফেন হাউস উপন্যাসটি শেষ হবার আগে থেকেই নানা পত্রপত্রিকা থেকে লেখার অনুরোধ আসে। মনীশ সবাইকে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানিয়ে লেখে, চাকরিবাকরি করে লেখার খুব বেশি সময় পাই না। সেইজন্য এখনই লেখা দিতে পারছি না কিন্তু ভবিষ্যতে সুযোগ মতো নিশ্চয়ই লেখা পাঠাবো। ঐ চিঠি পাবার পরও দুচারটি পত্রিকার লোকজন বাড়িতে এসে হাজির হয়। অনুরোধ উপরোধ করে। ফিস ফিস করে বলে, দরকার হলে টাকাটা অ্যাডভান্সও দিতে পারি।
মনীশ বলে, না, না, তার দরকার হবে না। লেখা ছাপা হলেই টাকা দেবেন।
স্বদেশ সম্পাদকও মহা খুশি। উনি সবার সামনেই বলেন, মনীশের উপন্যাসের জন্য কাগজের ডিমান্ড এত বাড়বে, তা আমি ভাবতে পারিনি।
মনীশ জিজ্ঞেস করে, অন্য উপন্যাসটি কবে ছাপরেন?
পূজা সংখ্যায়। উনি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি অন্য কোনো পূজা সংখ্যায় লিখবে?
কয়েকটা কাগজের থেকে বার বার বলছে কিন্তু আমি এখনই আর লিখতে চাই না।
ভেরি গুড! সম্পাদক টেবিলের উপর জোরে একটা ঘুষি মেরেই বলেন, তাহলে দেখো আমি কী করি।
সত্যি, একজন নতুন লেখককে নিয়ে যে কোন পত্রিকা এত হৈ চৈ করতে পাবে, তা মনীশ কল্পনাও করতে পারেনি। মনীশের ছবি দিয়ে পোস্টার, মনীশের ছবি দিয়ে কলকাতার সব দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন। এর উপর সিনেমার স্নাইড আর রেডিওতে বিজ্ঞাপন। পূজা সংখ্যা বেরুবার আগেই এমন অবস্থা দাঁড়ালো যেন মনীশ প্রায় ফিল্মের হিরো! পথেঘাটে ট্রামেবাসে সবাই অবাক হয়ে ওকে দেখে। বাসের নিত্য সহযাত্রী বৃদ্ধরা বলেন, আরে, তুমি যে এত বড় লেখক, তা তো আমরা জানতামই না। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা ওকে কাছাকাছি পেলেই অটোগ্রাফ চায়। বুলা আর কচি বলে, দাদা, তোমার জন্য স্কুলে আমাদের কী খাতির, তা ভাবতে পারবে না।
সব চাইতে মজা হয় স্টিফেন হাউসে। লিফটএ ওঠার জন্য মনীশ লাইনে দাঁড়ালেই সবাই হৈ হৈ করে ওঠেন, আরে, আপনি আবার লাইনে দাঁড়াচ্ছেন কেন? যান উঠে যান।
দু পাঁচ মিনিট লাইনে দাঁড়াতে কী আর এমন কষ্ট! আপনারা উঠুন।
কে কার কথা শোনে? সবাই প্রায় জোর করে ওকে লিফটএ ঢুকিয়ে দেয়।
আর চৌধুরী সাহেব?
উনি এখন রোজই মনীশের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব না করে নিজের চেম্বারে ঢোকেন না। তাছাড়া পুজোর ছুটির পর প্রথম অফিসে এসেই চৌধুরী সাহেব সবার সঙ্গে কোলাকুলির পর্ব শেষ করেই বললেন, গিরীশবাবু, আমি আপনাদের সবাইকে জানিয়ে একটা কথা বলতে চাই।
হা স্যার বলুন।
মনীশ ব্যানার্জীর জন্য আমরা সবাই গর্বিত, সে বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই।
গিরীশবাবু বললেন, সে তো একশ বার।
তাই বলছিলাম, আপনারা যদি আপত্তি না করেন, তাহলে আমি মনীশকে দুশ টাকা স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট দিতে চাই।
ঘর ভর্তি সবাই হাততালি দিয়ে ওকে সমর্থন জানালেন।
এবার মনীশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, এই আমার প্রথম চাকরি। আপনি তাড়িয়ে দিলে না বোধহয় আমি কোনোদিনই এ চাকরি ছাড়ব না।
চৌধুরী সাহেব দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে বলেন, আরে, ছি, ছি! আপনাকে তাড়াব? আপনাকে তাড়ালে আমাকে আর এই স্টিফেন হাউসে ঢুকতে হচ্ছে না।
ওর কথায় সবাই হাসেন।
মনীশ বলে, স্যার, আমি এখন লিখেও কিছু আয় করতে শুরু করেছি। আপনি কাইন্ডলি শুধু আমাকে ইনক্রিমেন্ট দেবেন না।
কিন্তু এ তো স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট! বছরের শেষে তো সবারই নর্মাল ইনক্রিমেন্ট হবে।
স্যার, আপনি সবাইকে দশ টাকা করে দিলেও…।
চৌধুরী সাহেব ওর কাঁধে একটা হাত রেখে বলেন, ঠিক আছে, আমি সবাইকে পঞ্চাশ টাকা করে স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট দিচ্ছি কিন্তু আপনাকে ঐ দুশ টাকা।
কিন্তু স্যার…
সবাই হাততালি দিয়ে চৌধুরী সাহেবের ঘোষণাকে অভিনন্দন জানালেন।
.
মনীশের চোখে হঠাৎ পৃথিবীর রঙ বদলে গেল। চারদিকে শুধু আলো আর আলো। ডালহৌসীর জনারণ্যে এমন যে আশাহীন অন্ধকারময় কেরানিগিরির জগৎ, সেখানেও আলো ছড়িয়ে পড়ল। হাটেবাজারে, পথেঘাটে কর্মক্ষেত্রের ভেতরে ও বাইরে, অপরিচিতের অজানা মহলেও স্বীকৃতি আর ভালোবাসা। বাবার মৃত্যুর পর যারা একবারও এদিকে পা বাড়াননি, তারাও হঠাৎ এক বাক্স মিষ্টি হাতে নিয়ে আসতে শুরু করলেনবিশ্বাস করুন বৌদি, আমি ভাবতেও পারিনি, আমাদের মনীশদাই এত পপুলার লেখক। খবরের কাগজ দেখে দীপা বলল, এ তো আমাদেরই মনীশদা।
মনীশের মা একটু শুকনো হাসি হেসে বলেন, সত্যই তো আপনারা জানবেন কী করে? দীপা কলেজে পড়ে বলেই এসব খবর ওরাই রাখে।
প্রলয়বাবু এক গাল হাসি হেসে বলেন, এক রবিবার দীপাকে নিয়ে আসব। ও মনীশের সঙ্গে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই নিয়ে আসবেন।
সন্ধের পর বাড়ি ফিরতেই ওর মা হাসতে হাসতে বলেন, হারে, তুই এবার থেকে আমাকে মাইনে দিবি।
কী ব্যাপার? তোমাকে হঠাৎ মাইনে দেব কেন। মনীশও হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে।
সারাদিন তোর সেক্রেটারিগিরি করছি আর মাইনে দিবি না? উনি একটু থেমে বলেন, তোর জন্য রোজ আমাকে কত লোকের সঙ্গে বক বক করতে হয় জানিস?
মনীশ ওর মার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, আজ আবার কে এসেছিল?
তোর বাবার এক পুরনো সহকর্মী প্রলয় চ্যাটার্জী এসে তার প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মেয়ের গুণকীর্তন করলেন ঘন্টাখানেক ধরে।
হঠাৎ এত বছর পর!
ঠিক জানি না; হয়তো ওর মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবার মতলব।
বাঃ। চমৎকার।
মনীশের মা বলে যান, উনি থাকতে থাকতেই বুলার স্কুলের দুই দিদিমণি এসে হাজির।
কেন?
ওদের স্কুলের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তোকে প্রধান বিচারক হতে হবে।
আমি কি শম্ভু মিত্তির যে আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বিচারক হব?
সে আমি জানি না কিন্তু আমি কথা দিয়েছি, তুই যাবি।
কথা দিয়ে দিয়েছ?
হ্যারে; না দিয়ে পারলাম না। উনি একটু থেমে বলেন, এ ছাড়া ইন্দ্রানী তার দুই বন্ধুকে নিয়ে এসেছিল।
ইন্দ্রানী আবার কে?
ওর মা একটু হেসে বলেন, ও তোর ভক্ত হিসেবেই প্রথম আসে কিন্তু এখন তো আমারই ভক্ত হয়ে উঠেছে। উনি একটু থেমে বলেন, আজকাল তো অনেক ছেলেমেয়ে আসাযাওয়া করে কিন্তু ইন্দ্রানীর মতো কেউ না।
বুলা দৌড়ে এসে বলে, আমাদের স্কুলের ক্লাস টেন এর একটা মেয়ে তোমার দারুণ ভক্ত। সে তোমার একটা ছবি চেয়েছে।
আমি কোথায় ছবি পাবো?
না, না, দাদা, প্লীজ।
এইভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে বছর ঘুরে যায়।
মনীশের খ্যাতি যশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থও আসে পত্রপত্রিকা প্রকাশকদের কাছ থেকে দুঃশ্চিন্তা অভাবঅনটন এখন অতীত স্মৃতি মাত্র। তবে এখন মনীশের ব্যস্ততার শেষ নেই সকালবেলায় উঠেই লিখতে বসে। এরই মধ্যে পত্রপত্রিকা ও প্রকাশকদের লোকজন একে কথাবার্তা বলে। তারপর খেয়েদেয়েই অফিস দৌড়য়! অফিসেও নানাজন আসে দেখাসাক্ষা করতে। অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফেরে না কোনোদিনই। ন্যাশনাল লাইব্রেরি বা পত্র পত্রিকার অফিসে যেতে হয় মাঝে মাঝেই। অথবা আপনমনে ঘুরে বেড়ায় এখানে ওখানে কখনও কখনও পুরনো বন্ধুবান্ধব বা অফিসের সহকর্মীদের পাল্লায় পড়ে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরে।একটু কিছু খেতে খেতেই ভাইবোনের সঙ্গে গল্পগুজব হাসিঠাট্টা করে আবা লিখতে বসে। কত রাত পর্যন্ত লেখে, তার ঠিকঠিকানা নেই।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙলেই মা ওকে বকুনি দেন, হারে, দেড়টা বেজে গেল। শিগগির শুয়ে পড়। একটা অসুখবিসুখ না হলে বুঝি..
হ্যা মা, এখুনি উঠছি
এইভাবেই আরো প্রায় বছরখানেক কাটার পর ওর মা একদিন বললেন, তুই এ বড় বড় ডাক্তার দেখালি কিন্তু তবু তো আমার প্রেসারটা কিছুতেই কমছে না। অর্ধেক সময়েই মাথা তুলতে পারি না। তাই তোকে একটা কথা বলতাম।
মনীশ বলে, হ্যাঁ, মা, বলল।
কিন্তু কথাটা তোকে মনে রাখতে হবে।
তোমার কোন কথাটা আমি রাখি না?
না, তা বলছি না, তবে…
তবে আবার কী?
এবার ওর মা বলেন, তুই যে নিজে দেখেশুনে কোনো মেয়েকে ঘরে আনবি, এমন সম্ভাবনা তো দেখছি না
মনীশ একটু হেসে বলে, তুমি কি বিয়ের কথা বলবে?
বিয়ের কথা মানে? ওর মা একবার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমি একটি মেয়েকে পছন্দ করেছি। ওর মা আর বড় ভাইকে কথাও দিয়েছি।
মনীশ মার কথা শুনে যেন গাছ থেকে পড়ে। বলে, একেবারে কথা দিয়ে দিয়েছ!
হ্যাঁ। উনি একটু থেমে বলেন, মেয়েটি সাক্ষাৎ লক্ষ্মীপ্রতিমা। অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করে একটা প্রাইভেট ফার্মে এগারশ টাকা মাইনের চাকরি করছে! সুতরাং অপছন্দ হবার কোনো কারণ নেই।
উনি একটু থেমে বলেন, তাছাড়া তোর বয়স তো দিন দিন কমছে না। বিয়ে করার বয়স বহু দিন হয়ে গেছে।
হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে মনীশ সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারে না।
মনীশ কিছু বলবার আগেই উনি আবার বলেন, মেয়েটিকে বুলা কচিরও ভালো লেগেছে। সামনের রবিবার তোকে মেয়ে দেখাতে নিয়ে যাব।
তার আর দরকার নেই। শুধু এইটুকুই বলেই মনীশ নিজের ঘরে চলে যায়। আর মনে মনে ঠিক করে, স্টিফেন হাউসের যে মেয়েটিকে নিয়ে ও প্রথম গল্প লিখে সাহিত্য জগতের স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে প্রবেশাধিকার পেয়েছে, তার সঙ্গে একটু কথা বলবে।
কিন্তু হা ভগবান! দিনের পর দিন স্টিফেন হাউসের ঘরে ঘরে উঁকি দিয়েও মনীশ সেই প্রথমা নায়িকার দেখা পায় না। ওদিকে ওর মা যথারীতি এগিয়ে যান।
মনীশ মনের মধ্যে একটা অসহ্য জ্বালা বোধ করে কিন্তু কাউকে কিছু প্রকাশ করে না কিন্তু সময় তো দাঁড়িয়ে থাকে না। সে তার আপন গতিতে এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে ওর মা ছেলেকে বার বার অনুরোধ করেন, চল না বাবা, একবার মেয়েটাকে দেখতে।
বলছি তো তার দরকার নেই।
আমার মন বলছে, আমি ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিন্তু তবু নেমন্তন্নর কার্ডগুলো ছাড়ার আগে তুই মেয়েটাকে না দেখালে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।
না, না, আমি কোথাও যাব না।
দিন তিনেক পর মনীশ অফিস বেরুবার সময় ওর মা বললেন, হ্যাঁরে, আজ তিনটের সময় ডাঃ ঘোষ আসবেন। তোকে থাকতে বলেছেন। তুই কি তখন আসতে পারবি?
উনি ঠিক আসবেন?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে এসে যাবো।
মনীশ ট্যাক্সি নিয়ে ঠিক আড়াইটের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ির দরজায় পা দিয়েই মাকে জিজ্ঞেস করে ডাঃ ঘোষ আসেননি তো?
না না। উনি একটু থেমে বলেন, তুই তোর ঘরে যা; আমি চা নিয়ে আসছি।
ঠিক আছে।
মনীশ তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে পা দিয়েই সেই স্টিফেন হাউসের প্রথমা নায়িকাকে দেখে চমকে ওঠে। আমতা আমতা করে বলে, আপনি?
মা আসতে বলেছিলেন।
মা আসতে বলেছিলেন?
ও শুধু মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ
পেছন দিক থেকে মনীশের মা ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁরে আমি কি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি?
আনন্দে খুশিতে মনীশ দুহাত দিয়ে মাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলল, তুমি কী করে আমার মনের কথা জানতে পারলে?
…ওরে, আমি যে তোর মা!