2 of 3

প্রথম নারী

প্রথম নারী

বেশি দূরে নয়, হয়তো গড়িয়া বা টালিগঞ্জ বা দমদমে কারুর বাড়িতে গেছি। সেখানে এখনও কিছু ফাঁকা জায়গা আছে, গাছপালা আছে, একটা দুটো পুকুর আছে। সেরকম জায়গায় যদি হঠাৎ খুব জোর বৃষ্টি নামে, আমি জানলার কাছে কিংবা ঢাকা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, চোখ ভরে। দেখি হাওয়ার ধাক্কায় গাছগুলোর এলোমেলো নাচ, আর ঘাসভরা মাঠের ওপর অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ শুনতে-শুনতে আমার মন খারাপ হয়ে যায়।

আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ে, মনে পড়ে যায় অনেক দিন আগেকার এইরকম একটা বর্ষার দিনের কথা।

প্রকৃতির নিয়মে প্রত্যেক বছরই তো বর্ষা আসে। জীবনের যতগুলি বছর আমরা কাটিয়ে যাচ্ছি, ততগুলি বর্ষা ঋতু দেখে যাচ্ছি। বৃষ্টির মধ্যে কতরকম মনে রাখবার মতন ঘটনাই তো ঘটে, কিন্তু আমার শুধু বিশেষ একটা বর্ষার কথাই মনে গেঁথে আছে।

কত বয়েস হবে তখন আমার, আঠেরো কিংবা উনিশ। ভানুকাকাদের একটা বাড়ি ছিল গালুডিতে। প্রত্যেক বছরই পুজোর সময় ভানুকাকা আমাদের নিয়ে যেতে চাইতেন সেখানে। কী কারণে যেন আমাদের যাওয়া হত না। ভানুকাকার সঙ্গে আমরা কোনওদিনই গালুডি যাইনি। একবারই মাত্র গেছি গালুডিতে, তাও পুজোর সময় নয়। কেন যে গ্রীষ্মকালে ওই গরমের জায়গায় যাওয়া ঠিক হয়েছিল তা এখন মনে নেই।

ভানুকাকা আমাদের চাবি দিয়েছিলেন আর মালির নামে একটা চিঠি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাবা যেতে পারলেন না। বাবার অফিসের গোডাউনে আগুন লেগে গিয়েছিল হঠাৎ, তখন তাঁর। কলকাতা ছেড়ে যাওয়া চলে না। আমাদের টিকিট কাটা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই ঠিক হল, মাকে নিয়ে আমরা ভাইবোনেরা চলে যাব, বাবা কয়েকদিন পরে আসবেন।

ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে থেকেই আমি হয়ে গিয়েছিলাম হেড অফ দা ফ্যামিলি। মা ও ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব আমার ওপর।

গালুডিতে ভানুকাকাদের বাড়িটা ছিল বেশ ফাঁকা জায়গায়, স্টেশন থেকে অনেকটা দূরে। ছোট দোতলা বাড়ি, সামনে-পেছনে বাগান, পাঁচিলের ওপাশে ঢেউখেলানো প্রান্তর। ওইসব জায়গায় গ্রীষ্মকালে কেউ বেড়াতে যায় না। অনেক বাড়িই তালাবন্ধ ছিল।

সারাদিন কাজ তো কিছু নেই, বাগানে খানিকটা খেলাধুলো আর নানারকম খাওয়ার চিন্তা। দুপুরে অসহ্য গরম বাতাস, বাইরে বেরুবার উপায় নেই। শত গরমে ঘুমও আসে না। রাস্তায় পোস্টম্যানের সাইকেলের ক্রিং-ক্রিং শুনলেই মনে হত, আজ কি চিঠি আসবে? কিন্তু প্রত্যেকদিন কে চিঠি লিখবে আমাদের? বাবার কাছ থেকে একখানা চিঠি এসেছিল, তাঁর আসতে আরও কয়েকদিন দেরি হবে।

বালক থেকে সাবালক পদে উত্তীর্ণ হয়েছিলুম বলে আমার সবসময় নতুন কিছু একটা করতে ইচ্ছে করত। কিন্তু গালুডির মতন নির্জন জায়গায় কী-ই বা করার থাকতে পারে। মাঝে-মাঝে ট্রেনে চেপে চলে যেতুম ঝাড়গ্রাম কিংবা ঘাটশিলা, কিছু কেনাকাটি করবার জন্য। কেনাকাটি আসল উদ্দেশ্য নয়, গালুডিতেও মোটামুটি সব জিনিস পাওয়া যায়, কিন্তু এই যে আমি যখন ইচ্ছে একা-একা ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারি সেটাই ছিল একটা উত্তেজনা ব্যাপার।

ওইরকম বয়সে বেশির ভাগ ছেলেই লাজুক হয়। আমি অচেনা লোকজনের সঙ্গে ভাব জমাতে পারতুম না কিছুতেই। গালুডির তুলনায় ঝাড়গ্রামে লোকজন অনেক বেশি, সেখানে গিয়ে ঘুরে বেড়াতাম রাস্তায়-রাস্তায়, কিন্তু কারুর সঙ্গে আলাপ হয়নি। ঘাটশিলাতেও একদিন গিয়ে দেখি সুবর্ণরেখার ধারে এক দল ছেলেমেয়ে পিকনিক করতে এসেছে ওই গরমের মধ্যে। তারা। অনেকেই আমার বয়েসি। একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি অনেকক্ষণ দেখছিলুম ওদের। ওরা খেলছে, হাসাহাসি করছে, নিজেরাই রান্না করছে উনুন ধরিয়ে। বারবার ইচ্ছে করছিল, ওদের দলে মিশে যাই। কিন্তু ওরা আমায় ডাকেনি, ডাকলেও বোধহয় আমি লজ্জায় ওদের সঙ্গে যোগ দিতে পারতুম না। নিজেকে দারুণ একা মনে হত।

গালুডিতে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি দু-তিনখানা বাড়িই একেবারে ফাঁকা। সেইজন্য আমাদের খুব ডাকাতের ভয় ছিল। সন্ধ্যের পর দরজা জানলা বন্ধ করে বসে থাকতুম ভেতরে। সেইজন্যই সন্ধেগুলো আরও অসহ্য বোধ হত। আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকারটি যেমন বুড়ো তেমন রোগা, আমরা ওর নাম দিয়েছিলুম লটপট সিং। ডাকাত কেন, সামান্য একটা চোর এলেও বোধহয় ওর কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাওয়া যেত না।

একদিন বিকেলবেলা আমরা বাইরের বাগানে বসে চা খাচ্ছি, এমনসময় দেখলুম আমাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দুজন মহিলা আর একটি বাচ্চা ছেলে।

মা জিগ্যেস করলেন, ওরা কারা?

আমি ওদের চিনি না, আগে কখনও দেখিনি। ওরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে লাগল কিছুক্ষণ। তারপর গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

আমরা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে তাকিয়ে রইলুম। এ পর্যন্ত গালুডিতে আর কেউ আমাদের বাড়ির গেট দিয়ে ঢোকেনি।

আজও আমি সেই দৃশ্যটি স্পষ্ট দেখতে পাই। একেবারে সামনে রয়েছে রত্নাদি, নীল শাড়ি পরা, বেশ লম্বা চেহারা, পিঠের ওপর চুল খোলা, তাঁর পাশে লাফাতে-লাফাতে আসছে পিকলু, তার বয়েস সাত বছর, কালো হাফ প্যান্ট আর হলদে গেঞ্জি পরেছে সে। তাদের পেছনে, একটু ব্যবধান রেখে আস্তে-আস্তে হেঁটে আসছে এলা, যেন তার ভেতরে আসবার ইচ্ছে ছিল না। এলা পরে আছে একটা হরিণ-রঙা শাড়ি। সমস্ত দৃশ্যটা আমার স্মৃতিতে যেন একটা বাঁধানো ছবি, যদিও তখন আমি তাদের নাম জানতুম না।

প্রথম মহিলাটি একেবারে কাছে এসে হাসিমুখে মাকে বললেন, মাসিমা, আমায় চিনতে পারছেন? আমি রত্না।

মা তখনও চিনতে পারেননি, কৌতূহলের সঙ্গে একটু-একটু হাসি মিশিয়ে চেয়ে রইলেন।

মহিলাটি মাকে প্রণাম করে বললেন, সেই যে গড়পারে আমরা—

মা সঙ্গে-সঙ্গে বললেন ও, তুমি রত্না! সত্যি চিনতে পারিনি প্রথমটায়, এসো, এসো!

একটুক্ষণ কথাবার্তাতেই সব বোঝা গেল।

আমরা একসময় গড়পারে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতুম। সে প্রায় দশ-বারো বছর আগেকার কথা। আমারই সে-বাড়িটার কথা ভালো করে মনে নেই, আমার ছোট বোন তখন জন্মায়নি। রত্নাদিরা থাকতেন পাশের ফ্ল্যাটে। আমাদের থাকার সময়েই রত্নাদিনতুন বউ হয়ে এসেছিলেন সেখানে। সেইটুকুই আমার মনে আছে যে, বিয়ের কোনও উৎসব হয়নি, খাওয়া-দাওয়াও হয়নি, তবু সে-বাড়িতে একজন নতুন বউ এসেছিল। বাড়িতে এবং পাড়াতে সেটা ছিল একটা আলোচ্য বিষয়। আমারও শিশুমনে একটা খটকা লেগেছিল।

শৈলেনদা আর রত্নাদি এক অফিসে চাকরি করতেন। একদিন সন্ধেবেলা রেজিস্ট্রি বিয়ে সেরে ওঁরা একসঙ্গে গড়পারের বাড়িতে চলে আসেন।

আমার মায়ের সঙ্গে রত্নাদির বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। রত্নাদিদের নতুন সংসার সাজিয়ে দিতে মা সাহায্য করেছিলেন কিছু-কিছু। রত্নাদি সেইসব কথাই বলতে লাগলে উচ্ছ্বসিতভাবে।

রত্নাদির বিয়ের পর আমরা ওই গড়পারের বাড়িতে ছিলুম মাত্র একবছর। তারপর উঠে যাই ভবানীপুরে। রত্নাদিরাও এখন ওই বাড়িতে থাকেন না।

রত্নাদি এলার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, মাসিমা, এ আমার ছোট বোন, আপনি দু একবার দেখেছেন ওকে, অবশ্য ও তখন খুবই ছোট ছিল…

মা বললেন, হ্যাঁ, একটু-একটু মনে পড়ছে, খুব দুরন্ত ছিল তখন, এখন দেখছি খুব শান্ত!

এলা শুধু শান্ত নয়, প্রায় নির্বাক বলা যায়। একবার শুধু সে মায়ের কোনও একটা প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলেছিল, সেটা না শুনলে ওকে বোবা মনে হতেও পারত।

একটু লম্বাটে মতন মুখ এলার, শ্যামলা রং, চোখ দুটি খুব টানা-টানা। কালো আর গভীর। চোখ তুলে সে মাঝে-মাঝে মুখের দিকে তাকায়, চেয়েই থাকে, কোনও কথা বলে না।

মা রত্নাদিকে জিগ্যেস করলেন, তোমরাও এই গরমে এখানে বেড়াতে এসেছ? আমাদের তো পুজোর সময় আসার কথা ছিল, তখন হয়ে উঠল না, সেইজন্যই তো…তাও তো উনি আসতে পারলেন না…

রত্নাদি একটুক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর মুখ তুলে বললেন, মাসিমা, শৈলেন খুব অসুস্থ। আর কতদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারব তা জানি না।

আমি বিষম চমকে উঠেছিলুম। কী শান্তভাবে কথাটা বলেছিলেন রত্নাদি। গলার আওয়াজে কোনওরকম দুঃখ বা উচ্ছাস নেই, যেন জীবনের অনেক ঘটনার মতন এটাও একটা সাধারণ ঘটনা। এটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করার কোনও মানে নেই।

আমরা যে পরিবেশে মানুষ, সেখানে কোনও স্ত্রীকে প্রকাশ্যে তার স্বামীর নাম উচ্চারণ করতে শুনতুম না সেই সময়ে। কিন্তু রত্নাদি এমনভাবে শৈলেন কথাটা উচ্চারণ করলেন, যেন সেটা তাঁর কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম।

রত্নাদির ওই কথা শুনে এলা এক দৃষ্টিতে তার দিদির দিকে তাকিয়েছিল, কোনও কথা বলেনি।

পিকলু তখন একটু দূরে আমার ছোট বোনের সঙ্গে খেলা শুরু করেছে।

শৈলেনদার যে ঠিক কী অসুখ তা বুঝলুম না। তবে শুনলুম যে উনি শুকনো জায়গায় এলে ভালো থাকেন। রত্নাদি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এখানে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছেন। পুরো গ্রীষ্মের তিন মাস এখানে কাটিয়ে যাবেন। ওঁরা এসেছেন দেড়মাস আগে।

মা রত্নাদিদের চা খাওয়ালেন। তারপর ওঁরা যখন বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, তখন মা। আমাকে বললেন, ওদের একটু এগিয়ে দিয়ে আয় তো, নীলু!

রত্নাদি হেসে বললেন, আমাদের এগিয়ে দিতে হবে না, এতদিনে আমাদের সব চেনা হয়ে গেছে।

তার পরই মন বদলে আবার বললেন, আচ্ছা এসো নীলু, আমাদের বাড়িটা চিনে যাবে। মাসিমাকে নিয়ে আসবে একদিন

বিকেল শেষ হয়ে এসেছে, পশ্চিম দিগন্তে যেখানে আকাশমিশেছে সেদিকটা লালে লাল। আমরা সেইদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। সারা পথ রত্নাদি আমার সম্পর্কে অনেক কথা জিগ্যেস করলেন। এলা তখনও কোনও কথা বলল না, মনে হয় যেন আমাদের কথা শুনছেও না। মেয়েটা লাজুক না অহংকারী?

রত্নাদিদের বাড়িটা বেশ দূরে। একটা বড় মাঠ পেরিয়ে খুব ফাঁকা জায়গায়। স্টেশন থেকে যতদূরে হয়, ততই বাড়িভাড়া কমে যায়।

সেদিন আর রত্নাদিদের বাড়ির মধ্যে যাইনি, রত্নাদিও ডাকেননি ভেতরে। হঠাৎ আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। রত্নাদি বলেছিলেন, মাঝে-মাঝে চলে এসো, নীলু! আমরা প্রায় সব সময়েই বাড়িতে থাকি। আর হ্যাঁ, শোনো, ভালো কথা মনে পড়েছে। তুমি কি ট্রেনে চেপে ঝাড়গ্রাম যেতে পারবে?

আমি বললুম, আমি তো প্রায়ই যাই।

—একটা ওষুধ আনতে হবে, এখানে পাওয়া যাচ্ছে না, তুমি এনে দিতে পারবে?

আমি তৎক্ষণাৎ বানিয়ে বললুম, আমি তো কালকেই ঝাড়গ্রামে যাব বাজার করে আনতে।

—তাহলে তো ভালোই হল।

সেদিন ওখান থেকে ফেরার পথে আমি বেশ ভয় পেয়েছিলুম মনে আছে। অথচ ভয় পাওয়ার কোনও কারণ ছিল না, আমি তেমন একটা ভীতুও নই। এবড়ো-খেবড়ো পাথর ছড়ানো বড় মাঠটা পেরিয়ে আসবার সময় হঠাৎ সাংঘাতিক ঝড় উঠেছিল। চতুর্দিক শোঁ-শোঁ শব্দে কেঁপে উঠল। ঘূর্ণিপাক খেয়ে উড়তে লাগল ধুলো, কোনও দিকে কিছুই দেখা যায় না। আমার মনে হল, এখন ছুটতে গেলেই আমি দিক ভুল করব।

মাঠের মধ্যে ঝড় দেখে ভয় পাওয়ার ছেলে আমি নই। কিন্তু তার একটু আগেই, রত্নাদিদের বাড়ির গেট পেরুবার একটু পরেই আমার মনে হয়েছিল, আমার জীবনে এবারে একটা পরিবর্তন আসছে। আমি সাবালকদের জগতে প্রবেশ করেছি, এবার শিগগিরই এমন কিছু ঘটবে যার ফলে বদলে যাবে আমার বাকি জীবনের গতি।

এই কথা ভাবতে-ভাবতে খানিক দূর আসার পরই অকস্মাৎ ওরকম ঝড় ওঠায় আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলুম। এই যে অন্ধ ঝড়, যার মধ্যে কোনও দিক বোঝা যায় না, এই কি তাহলে আমার ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতীক?

যাই হোক, সেই সন্ধেবেলা ঠিকঠাকই বাড়ি পৌঁছেছিলুম।

রত্নাদি যদি ঝাড়গ্রাম থেকে আমাকে ওষুধ আনবার কথা না বলতেন, তাহলে হয়তো পরের দিনই আমার ও-বাড়িতে যাওয়া হত না। যদিও আমার তৃষিত মন চাইছিল মানুষের সঙ্গ, কিন্তু রত্নাদিদের বাড়িতে যাব কি যাব না তা ভেবে ভেবে মন ঠিক করতে আমার দু-তিনদিন লেগে যেত।

ওষুধ নিয়ে পৌঁছবার পর সেদিন দেখলুম শৈলেনদাকে। শৈশবের অস্পষ্ট স্মৃতিতে শৈলেনদাকে মনে ছিল একজন শক্ত-সমর্থ পুরুষ হিসেবে। এখন দেখলুম বিছানার সঙ্গে একেবারে লেগে যাওয়া একজন কঙ্কালসার মানুষ। একটানা দু-তিনমিনিট কথা বলতে পারেন না, তার পরই দারুণ হাঁপানি ওঠে।

তবু আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি অন্য কারণে। শৈলেনদা একবারও তাঁর অসুখের কথা বলেন না। মুখে ব্যথা-বেদনার কোনও চিহ্ন নেই। অত হাঁপানির মধ্যেও একটু সুযোগ পেলেই ঠাট্টা-ইয়ার্কি করেন, নিজেও হেসে ওঠেন। এরা অন্য ধরনের মানুষ।

রত্নাদি আমার পরিচয় দেওয়ার পর শৈলেনদা বললেন, ও হ্যাঁ, মনে আছে…তোমার বাবা তো ভীষণ ব্যস্ত মানুষ, সেই সকালে বেরুতেন আর ফিরতেন অনেক রাতে। আমি একদিন জিগ্যেস করেছিলুম, দাদা, আপনি আপনার ছেলেদের কারুকে রাস্তায় দেখলে চিনতে পারবেন? হা-হা-হা!

সেদিন রত্নাদি আমায় বলেছিলেন, নীলু, তুমি কি রোজ বাজার যাও? তাহলে আমাদের কিছু আলু আর পেঁয়াজ এনে দেবে? অনেকটা দূর তো, তাই আমরা রোজ বাজারে যাই না। অবশ্য তোমার। যদি অসুবিধে না হয়…

কয়েকদিন পরে বোঝা গেল, আমি যে শুধু আমাদের বাড়িরই হেড অফ দা ফ্যামিলি তাই-ই নয়, রত্নাদিরাও অনেক ব্যাপারে আমার ওপরে নির্ভর করেন। উনিশ বছর বয়েসে দুটি সংসারের দায়িত্ব আমার ওপর। সকাল-বিকেল দু-বেলাই আমাকে রত্নাদিদের বাড়িতে যেতে হয়। আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকারের একটি সাইকেল ছিল, আমি ব্যবহার করতে লাগলুম সেটা, ফলে অনেক সুবিধে হয়ে গেল।

অনেক গল্প-উপন্যাসে দেখা যায়, মধুপুর বা শিমুলতলার মতন জায়গায় বেড়াতে গেলে উঠতি বয়েসের ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা প্রেমের ব্যাপার হয়ে যায়, সেটা খানিকটা মধুর বিরহে শেষ হয়। কিন্তু এলার সঙ্গে আমার প্রেম হয়নি। এলা প্রায় আমারই বয়েসি, কলেজে সে আমার চেয়ে এক ইয়ার নীচে পড়ে, আমাদের মধ্যে প্রেম না হোক বেশ একটা বন্ধুত্ব হওয়া তো স্বাভাবিকই। ছিল। আমার দিক থেকে ইচ্ছেও ছিল যথেষ্ট। তবু সেরকম কিছু হয়ে উঠল না।

এলা সত্যিই বড় কম কথা বলে। ওদের বাড়িতে যখনই যেতুম, দেখতুম সে কোনও বই নিয়ে বসে আছে। রান্নাঘরে তাকে রান্না করতে, কুয়ো থেকে জল তুলতেও তাকে দেখেছি। কিন্তু তার বই হাতে নিয়ে বসে থাকা ছবিটিই বেশি মনে পড়ে।

এলা যে আমার সঙ্গে একেবারে কথা বলত না তা নয়। চা খাবেন? বা, আপনাদের বাড়িতে খবরের কাগজ আসে? এই ধরনের মামুলি কথা সে বলত ঠিকই, কিন্তু তার মনটাকে সে যেন। রেখেছিল একটা খড়ির গণ্ডি দিয়ে ঘিরে, যার মধ্যে সে কারুকে প্রবেশ করতে দেবে না। অনেক সময় কোনও কথা না বলে সে শুধু আমার চোখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকত, সেটাই আমার অদ্ভুত লাগত। মেয়েরা সাধারণত পুরুষদের চোখের দিকে স্পষ্টভাবে তাকায় না।

পরের শনিবার কলকাতা থেকে এসে উপস্থিত হল অজিতদা আর সুকোমলদা। এদের মধ্যে। অজিতদা হল রত্নাদির ছোটভাই আর সুকোমলদা তার বন্ধু। শৈলেনদার আত্মীয়-স্বজন বিশেষ কেউ নেই, রত্নাদির বাড়ির লোকেরাই মাঝে-মাঝে ওদের দেখাশুনো করতে আসে। পনেরো দিন অন্তর একবার। শনিবার বিকেলে এসে সোমবার চলে যায়।

যদিও ওরা আসে অসুস্থ শৈলেনদার খোঁজ-খবর নিতে, কিন্তু ওদের ব্যবহারের মধ্যে একটা বাইরে বেড়াতে আসার মেজাজ থাকে। বাড়িটা হইহুল্লায় সরগরম হয়ে ওঠে। বাগানে মুরগি কাটা হয়। সন্ধের পর সুকোমলদার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পড়ে রামের বোতল। এমনকী শৈলেনদাকেও সেই রাম খাওয়ানোর চেষ্টা হয়েছিল, দু-চুমুক দিয়েই শৈলেনদা দারুণ কাশতে শুরু করেছিলেন।

সুকোমলদা সদ্য ডাক্তারি পাস করে হাউস সার্জেন হয়েছে তখন, এই ধাবধাড়া গোবিন্দপুরে এসে তার চালচলন বিধান রায়ের মতন। শৈলেনদার বুক পিঠ পরীক্ষা করে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, শুনুন, জামাইবাবু, আমি যা বলছি, তা যদি ঠিকঠাক মেনে চলেন, তাহলে দু-সপ্তাহের। মধ্যে আপনাকে খাড়া করে দেব!

শৈলেনদা হেসে বলেছিলেন, ওরে, অনেক টাকা খরচ করে অনেক বড় ডাক্তার দেখিয়েছি। আমি কি ছেলেমানুষ যে আমাকে মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে ভোলাবি? এখানে এসেছিস, একটু আনন্দ ফুর্তি কর। কাল তোরা সবাই মিলে চিকিগড় ঘুরে আয় না!

প্রথম দিন গালুডিতে পৌঁছোবার এক ঘণ্টা বাদেই আমি দেখেছিলুম, সুকোমলদা এলাকে বিরক্ত করতে শুরু করে দিয়েছে। আমি না হয় খুব লাজুক, কিন্তু সুকোমলদা তো গল্পের বাইরের চরিত্রের মতন, স্বাস্থ্য ভালো, ডাক্তারি পাস করেছে, পরিপূর্ণ সার্থক একজন যুবক। সে এলার মতন একজন যুবতী মেয়েকে দেখলে প্রেম না হোক একটু ফষ্টিনষ্টি তো করতে চাইবেই। আমার সামনেই সুকোমলদা এলার পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, এই মেয়েটা এত লাজুক কেন? কথাই বলে না!

সেদিন আমি ও-বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকিনি।

পরের দিনও সকালে ও-বাড়িতে যাইনি অন্যদিনের মতন। বাজার-টাজার করবার জন্য আর তো আমার প্রয়োজন হবে না, দুজন শক্ত-সমর্থ পুরুষ মানুষই তো এসে গেছে।

বিকেলবেলা অজিতদা আর সুকোমলদা পিকলু আর এলাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। মা-র সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করল। তারপর সুকোমলদা আমাকে বলল, নীলু, তুমি আমাদের সঙ্গে চলো, আমরা একটু বেড়াব।

একথা ঠিক, সুকোমলদা কক্ষনো আমার সঙ্গে একটুও খারাপ ব্যবহার করেনি। আমাকে সে প্রতিযোগী হিসেবে ভাবেনি মোটেই। সেকথা সে ভাববেই বা কেন, আমি তো এলার প্রেমিক ছিলাম না, এমনকী বন্ধুও হতে পারিনি। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বেড়াবার সময় সুকোমলদা এলার কাঁধ জড়িয়ে ধরত, আমাকে ধর্তব্যের মধ্যেই গণ্য করত না। বোধহয় আমাকে মনে করত। ছেলেমানুষ।

এলা কিন্তু সুকোমলদাকে দেখে গদগদ হয়ে যায়নি। স্বভাব পালটায়নি সে। সুকোমলদার মতন একজন আকর্ষণীয় ও উৎসাহী যুবককে দেখেও প্রগলভা হয়ে ওঠেনি সে। সুকোমলদা তার কাঁধ জড়িয়ে ধরলে সে আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। রেগে চ্যাঁচামেচিও করেনি, আবার প্রশ্রয়ও দেয়নি।

গালুডিতে আমাদের থাকার কথা ছিল কুড়ি-একুশ দিন। আমার ছোট-ভাইবোনরা দশ বারোদিনের মধ্যেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ওই বয়সে প্রকৃতি বেশি ভালো লাগে না। বন্ধু-টন্ধুর অভাবেই ওরা চঞ্চল হয়ে পড়েছিল। রোজই বায়না ধরত, মা, আর ভালো লাগছে না। এবার। ফিরে চলো!

মা বলতেন, এত খরচ-পত্তর করে আসা, এর মধ্যেই ফিরে যাবি কী রে! দাঁড়া, আগে তোদের বাবা আসুক। এখানকার জল খুব ভালো–।

বাবা আসবেন-আসবেন করেও আসতে পারছিলেন না। চিঠিতে জানিয়েছিলেন, থাকো, আরও কয়েকটা দিন থেকে যাও!

এক পক্ষ কাল ঘুরে যাওয়ার পর অজিতদা আর সুকোমলদা আবার এল কলকাতা থেকে। এবারে সঙ্গে আর-একজন বন্ধু, তার নাম সৌমিত্র। সে খুব ভালো গান করে। শনিবার সন্ধেবেলা বসল গানের আসর। পরের রবিবার পূর্ণিমা, ঠিক হল, সেদিন বাগানে চাঁদের আলোয় পিকনিক হবে! সুকোমলদা আমাকে বলল, নীলু, তুমি বাড়িতে বলে আসবে, কাল রাতে তোমার ফেরা হবে। বেশি রাত হয়ে যাবে, তুমি এখানেই শুয়ে থাকবে। কিংবা আমরা সারারাতই জাগতে পারি।

মা অবশ্য আমার বাইরে রাত কাটানোর প্রস্তাবে রাজি হননি। অন্যান্য কারণ ছাড়াও, ডাকাতির ভয় আছে, আমাদের বাড়িতে আর কোনও পুরুষ মানুষ তো নেই। মা বলেছিলেন, এগারোটার মধ্যে ফিরে আসিস।

রত্নাদিও রাত্তিরবেলা বাগানে পিকনিক করার ব্যাপারটা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। সন্ধের দিকে তিনি বলছিলেন, অজিত, তোরা বরং সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যা না! জানিস তো, তোর জামাইবাবু এইসব হইচই কত ভালোবাসত! এখন নিজে জয়েন করতে পারে না। ঘরে শুয়ে-শুয়ে সব আওয়াজ শুনবে, ওর খারাপ লাগবে!

একথা শুনে সুকোমলদা সহাস্যে বলেছিল, তুমি বলছ কী, মেজদি! এই ব্যাপারটা আমরা ভাবিনি? জামাইবাবুর অসুখটা তো বেশির ভাগই সাইকোলজিক্যাল। আজ ওকেও আমরা পিকনিকে নিয়ে আসব। বাগানে খাটে শুয়ে থাকবে।

শৈলেনদা সব শুনে খুব উৎসাহ দেখিয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আজ আমি বেশ ভালো আছি। কতদিন খোলা আকাশের নীচে শুয়ে চাঁদের আলো দেখিনি। আমি যাব—

কেন যেন সেই পিকনিকে আমি খুব আনন্দ পাইনি। শৈলেনদা বারবার কাশছিলেন। সুকোমলদা আর সৌমিত্রদা রামের বোতল আর গান নিয়ে নিজেদের মধ্যে মশগুল হয়ে রইল। একবার তারা এলাকে খুব পীড়াপিড়ি করতে লাগল গান গাইবার জন্য। এলা কিছুতেই গান গাইবে না। ওরা এলার হাত ধরে জোর করে টেনে এনে বসিয়ে দিল ঘাসের ওপর। এলা মুখ গোঁজ করে রইল। তবু। আমার মনে হল, কয়েকজন অত্যাচারী পুরুষ এলাকে বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু আমি কী করব। আমি তো এলার প্রেমিকও নই, বন্ধুও নই।

রাত সাড়ে দশটার সময় আমি উঠে পড়লুম। অন্য কারুর কাছে বিদায় নেওয়ার কোনও দরকার নেই, আমি শুধু রত্নাদিকে বললুম, আমি যাচ্ছি রত্নাদি, মা চিন্তা করবেন। রত্নাদি একটুও আপত্তি। করলেন না। মাথা নেড়ে বললেন, যাও। তোমার কাছে টর্চ আছে তো, নীলু?

গেটের কাছে এসে দেখি সেখানে এলাদাঁড়িয়ে আছে। কাঁদছিল কি? কি জানি, আমি তার চোখ দেখিনি। জায়গাটা বেশ অন্ধকার, কোনও মেয়ের মুখের ওপর টর্চও ফেলা যায় না!

আমাকে দারুণ চমকে দিয়ে এলা বলল, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।

আমি শুকনো গলায় বললুম, আমার…আমার সঙ্গে?

—হ্যাঁ।

-বলো!

আমার মুখের দিকে বড়-বড় চোখ দুটি মেলে এলা চুপ করে রইল। অন্ধকারের মধ্যেও যেন আমি দেখতে পেলুম তার কালো চোখের গভীরতা। এইরকম ভাবে পল, অনুপল খরচ হতে-হতে কত সময় কেটে গেল কে জানে!

একসময়ে অজিতদা এল, এলা, তোমাকে সুকোমল ডাকছে, এই বলে এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে। আমরা দুজনেই মুখ ঘোরালুম সেদিকে। অজিতদা নিরীহ, ভালোমানুষ ধরনের, তার বন্ধুরা কীসে খুশি হয় তাই দেখার জন্যই সবসময় সন্ত্রস্ত।

এলা আমাকে বলল, আজ থাক। তুমি কাল আসবে? কাল সকালে ওরা চলে গেলে, তারপর বলব। ঠিক এসো–।

সে রাতে কি আমি ঘুমোতে পেরেছিলুম, একটুও? শুধু বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছি। চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠেছে গেটের কাছের সেই দৃশ্যটা। এলাকি ওখানে আমারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল? এতদিন বাদে সে একসঙ্গে অতগুলো কথা বলেছিল, যেন সেই মুহূর্তে সে খড়ির গণ্ডিটা মুছে দিয়ে কাছে ডেকেছিল আমাকে।

আসলে রাত্তিরে বিছানায় শুলে সকলেই কোনও এক সময় ঠিক ঘুমিয়ে পড়ে। আমার যখন ঘুম ভাঙল, তখন সকাল আটটা বেজে গেছে। মা আমায় ডেকে তুলে বললেন, চা খাবি না? আজ আর বাজারে যেতে হবে না।

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।

বছরের প্রথম বৃষ্টি, বাইরের দিকে তাকালে আরামের আমেজ লাগে। অন্যান্য দিন সকাল নটার মধ্যেই চচ্চড়ে রোদে একেবারে ঝলসে যেত চারদিক। আজ সজল স্নিগ্ধ রঙে ছেয়ে আছে। পৃথিবী। গাছপালাগুলো আর রুক্ষ মাটি হ্যাংলার মতন চোঁ-চোঁ করে টেনে নিচ্ছে বৃষ্টির পানীয়।

আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছি বটে কিন্তু আমার বুকের মধ্যে সবসময় বেজে চলেছে একটা দামামা। এলা আমাকে কিছু বলবে! এলা আমাকে কিছু বলবে!

কী বলবে এলা? এমন কোনও কথা, যা অজিতদার সামনে বলা যায় না! অন্ধকারে গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল আমারই অপেক্ষায়? আমি কি এতখানি যোগ্য! এর আগে তো সে একবারও অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলেনি আমার সঙ্গে। মাঝে-মাঝে শুধু স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকেছে, আমি কি ওর। চোখের ভাষা বুঝতে পারিনি?

বৃষ্টি থামল সাড়ে নটার পর। এখন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায়। মনটা যদিও ছুটে যেতে চাইছে, কিন্তু আরও একটুক্ষণ অপেক্ষা করাই ঠিক করলুম। দশটার পর অজিতদারা বেরিয়ে ট্রেন ধরতে যাবে। এখন গোছগাছ চলছে, এই সময় গিয়ে পড়লে কোনও কথাই হবে না। তা ছাড়া সুকোমলদা হয়তো আমাকে স্টেশন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চাইবে। আগেরবার তাই করেছিল। থাক আর-একটু দেরি করে যাওয়াই ভালো, অজিতদারা বেরিয়ে পড়ুক বাড়ি থেকে। এলাও সেই কথাই বলেছিল, ওরা চলে গেলে

আমাদের বাড়ির কাছ দিয়েই ট্রেন লাইন গেছে, কখন কোন ট্রেন যায় আসে আমরা আওয়াজ শুনতে পাই। কলকাতার ট্রেনের জন্য কান খাড়া করে রইলুম।

তার মধ্যে আবার বৃষ্টি এল কেঁপে। এবারে আর বড়-বড় ফোঁটা নয়, এখন বেশ জোরে বাতাস বইছে, তার সঙ্গে ঢেউ-এর মতন আসছে বৃষ্টি। এরই মধ্যে ঝমঝমিয়ে চলে এল কলকাতার ট্রেন। বাড়িতে ছাতা বা রেইনকোট নেই, কিন্তু একদিন বৃষ্টিতে ভিজলে কিছু আসে যায় না।

জামাটা গায়ে চড়িয়ে বললুম, মা, আমি একটু বেরুচ্ছি!

মা বললেন, এই বৃষ্টির মধ্যে? কোথায় যাবি? বললুম যে আজ বাজারে যাওয়ার দরকার নেই। ডিমের ঝোল করে দেব।

—একটু রত্নাদিদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসব!

—এই বৃষ্টি মাথায় করে? কালই তো মাঝরাত্তির পর্যন্ত সেখানে ছিলি! আজ সকালেই আবার যেতে হবে কেন?

আমি চুপ করে রইলুম। কাল অত রাত করে ফেরার পর আজ সকালেই আবার ছুটে যাওয়ার কী যুক্তি আমি দেখাব?

আমি এখন হেড অফ দা ফ্যামিলি। যখন যেখানে খুশি যেতে পারি। এর আগে মায়ের কাছে কোনও যুক্তি দেখাবার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু এখন রত্নাদিদের বাড়ির কথা একবার বলে ফেলে একটা দারুণ লজ্জা আমায় ছেয়ে ফেলল। কেন সেখানে যেতে চাই তা মাকে বলা যাবে না।

চুপ করে বসে রইলুম বারান্দায়। কিন্তু বৃষ্টির রূপ দেখার মন আমার নেই। এই বৃষ্টি আমার অসহ্য লাগছে। আগে কোনওদিন আমার বৃষ্টির ওপর এত রাগ হয়নি।

অজিতদাদের ট্রেন ধরতে হবে, তারা নিশ্চয়ই বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেনি। এতক্ষণে বাড়ি ফাঁকা। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, রত্নাদি রয়েছেন রান্নাঘরে, পিকলু বারান্দায় খেলছে, আর এলা। একটা বই সামনে নিয়ে বসে আছে। নিশ্চয়ই সে বারবার চোখ তুলে দেখছে গেটের দিকে। সামান্য বৃষ্টির জন্য আমি তার কাছে যাইনি। নিশ্চয়ই সে আমাকে কাপুরুষ ভাবছে।

এক-একবার ইচ্ছে হচ্ছিল মাকে কিছু না বলে ছুটে চলে যাই। কিন্তু বৃষ্টি আর হাওয়ার বেগ দুটোই বেড়েছে। এর মধ্যে বিনা কাজে বেরুনো খুবই অস্বাভাবিক। আমি তো সেরকম গোঁয়ার বা অবাধ্য ধরনের ছেলে ছিলাম না।

সেই বৃষ্টি থামল প্রায় পৌনে একটায়। মা তখনই আমাকে খেতে ডাকলেন। এই সময় কারুর বাড়িতে যাওয়াও ঠিক নয়। বারোটা থেকে তিনটে, এই সময় অযাচিতভাবে কেউ কারুর বাড়ি যায় না, এরকম একটা অলিখিত নিয়ম আছে। ও-বাড়িতে গেলে রত্নাদিই হয়তো আমাকে প্রথম দেখবেন, একটু অবাক হয়ে তাকাবেন। কিংবা দুপুরবেলা ও-বাড়ির দরজা বন্ধ থাকবে, আমি দরজা ধাক্কা দিলে ঘুম থেকে উঠে এসে রত্নাদি জিগ্যেস করবেন, কী ব্যাপার?

আড়াইটের সময় আবার বৃষ্টি ফিরে এল। এবারে বেশ হালকা, ঝিরঝিরে। কে বলবে গতকাল দুপুরেই এ-অঞ্চলে কী প্রচণ্ড গরম ছিল, এখন বেশঠান্ডা শিরশিরে ভাব।

জানলার পাশে এসে আমাদের কেয়ারটেকার লটপট সিং জানাল, এরকম সারাদিন ধরে বৃষ্টি এ অঞ্চলে সাধারণত হয় না। এ যেন বঙ্গাল বারিষ-এর মতন।

আমি তখন প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি, বৃষ্টি থামুক বা না থামুক, ঝড়-বজ্রপাত যা কিছু শুরু হোক, তিনটে বাজলেই আমি বেরিয়ে পড়ব।

মা, আমি যাচ্ছি! বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই আমি চলে এলুম গেটের বাইরে। বৃষ্টি থামেনি। জোরও হয়নি। সাইকেলটা নেওয়ার কথা মনে পড়েনি। আমাদের বাড়ির রাস্তাটুকু ছাড়াবার। পরেই আমি দৌড় শুরু করে দিলুম। অন্ধকারে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এলা আমাকে বলেছিল, তোমার সঙ্গে কথা আছে। এখনও নিশ্চয়ই সে আমার অপেক্ষায় গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে।

রত্নাদিদের বাড়ির কাছে এসে দেখলুম গেটটা হাট করে খোলা। ভেতরের দরজাটাও খোলা। আমার বুকটা ধক করে উঠল। কী যেন একটা কিছু ঘটেছে। তারপর লক্ষ্য করলুম বাগানের মধ্যে একটা ট্রাক দাঁড় করানো।

আমি গেটের কাছে এসে পৌঁছতেই বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল অজিতদা। এ কি, অজিতদারা যায়নি সকালের ট্রেনে! কেন?

অজিতদা আমাকে দেখে বলল, তুমি এসে পড়েছ? তোমাদের বাড়িতে লোক পাঠাতে যাচ্ছিলুম। একটু থেমে, মাটির দিকে চোখ করে, নীচু গলায় বললে, সাড়ে দশটার সময় শৈলেনদা মারা গেছেন!

আমার উনিশ বছরের জীবনের সবচেয়ে বড় শোক অনুভব করছিলুম সেই মুহূর্তে। শৈলেনদার জন্য নয়। এটা মৃত্যুর বাড়ি, এখানে অন্য কোনও কথা হবে না। এলা আমাকে তার সেই কথাটা বলতে পারবে না।

সাড়ে দশটার পর অনেকটা সময় কেটে গেছে, কান্নাকাটির পালাও চুকে গেছে। এখন সবাই নানা রকম ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। রত্নাদিকে অন্যদিনের মতনই শক্ত দেখলুম। তিনি জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করছেন। সন্ধের আগেই ওঁরা ট্রাকে করে সবাই মিলে রওনা হবেন কলকাতার দিকে। কী একটা ইনসিওরেন্সের ব্যাপারে শৈলেনদার দেহ কলকাতায় নিয়ে গিয়ে পোড়ালেই সুবিধে হবে।

আমি এক ফাঁকে বেরিয়ে গিয়ে মাকে নিয়ে এলুম এ-বাড়িতে। তারপর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম বাগানে। আমার আর কিছুই করার নেই। এলার সঙ্গে কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে। তার দৃষ্টির ভাষা আমি বুঝতে পারিনি। তাতে কি ভৎসনা ছিল? কিংবা, এলা কাল রাতের কথা ভুলে গেছে? আমাকে সে আর কিছু বলতে চায় না?

ওদের ট্রাক গালুডি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর প্রথম জল এল আমার চোখে। জামার হাতায় যতবার চোখ মুছি তবুও কান্না থামে না।

তারপর আর কোনওদিন এলাকে দেখিনি। রত্নাদি কোথায় থাকেন জানি না। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনও প্রয়োজনীয়তা ওঁরা বোধ করেননি। সেইটাই তো স্বাভাবিক।

আমার জীবনে সেই প্রথম একটি নারী আমাকে বলেছিল, আমাকে সে নিরালায় কিছু জানাতে চায়। কী বলতে চেয়েছিল এলা? আমি কিছুতেই তা অনুমান করতে পারি না আজও। হয়তো খুবই সাধারণ কোনও কথা। বোধহয় কোনও বই চাইত। কিন্তু অজিতদাকে দেখে থেমে গিয়েছিল কেন?

সেই কথাটা শোনা হয়নি, এলাকে আর কখনও দেখিনি, তাই আজও আমার জীবনে একটা শূন্যতা বোধ রয়ে গেছে। বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে, শূন্যতাবোধটা আরও বেড়ে যায়, জানা হয়নি। একজন নারীকে, সে কিছু বলতে চেয়েছিল, আমার শোনা হয়নি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *