রাতের কলকাতা কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের জন্য লিখিত হল।
সেকেলে কলকাতার দৃশ্য আছে হুতোম প্যাঁচার নক্সা১-য়। আমার এ বইখানিও নকশা২ এবং এতে আছে একেলে কলকাতার সময় বিশেষের ছবি। আমার তুলিতে হুতোমের তেমন পাকা রং নেই, লোকের ভালো না লাগাই সম্ভব! ভরসা খালি এইটুকু যে, দুধ না পেলে অনেকে ঘোল খেতেও রাজি আছেন।
আর কিছু না হোক এই নকশা অনেকেরই ছানি-পড়া চোখে অব্যর্থ ঔষধের কাজ করবে। কলকাতার রাত্রি রহস্য সম্বন্ধে আমাদের অধিকাংশেরই দৃষ্টি যারপরনাই ঝাপসা। রাতের কলকাতা তাঁদের চোখ সাফ করে দেবে। ছেলে-মেয়ের বাপরা বুঝবেন, আসল বিপদ কী এবং কোনখানে। তাঁদেরই অসাবধানতায় কুসংসর্গে পড়ে অপ্রাপ্তবয়স্করা নরকে আসা-যাওয়া করবার সুযোগ পায়।
তবু আমি সম্পূর্ণ ছবি দিইনি। ছবির সবটা আঁকতেও পারতুম, কিন্তু সে সম্পূর্ণতা এমন কল্পনাতীতরূপে ভয়ানক, যে আঁকতে প্রবৃত্তি হল না। অল্প যেটুকু দেখিয়েছি, তাই-ই হয়তো নীতিবাগীশের ধাতে সহ্য হবে না। কী করব, উপায় নেই, আরও রেখে-ঢেকে বলা অসম্ভব। এ শ্রেণির নকশা এর চেয়ে শিষ্ট ভাবে ও শ্লীল ভাষায় লেখা চলে না। তবু আমি হুতোমের চেয়ে সবদিকেই— কী ভাষায় আর কী বিষয়ে— ঢের বেশি সাবধান হয়েছি। আমাকে স্থানীয় আবহাওয়া ফোটাবার জন্য মাঝে মাঝে গ্রাম্য কথাও ব্যবহার করতে ও নরকের পর্দা তুলতে হয়েছে এবং স্থানে স্থানে অল্পস্বল্প আদিরসকেও৩ একেবারে পরিহার করতে পারিনি। কিন্তু এরকম গ্রাম্য কথা, নরকের দৃশ্য ও আদিরস একালকার উচ্চশ্রেণির কথা-সাহিত্যের মধ্যেও যথেষ্ট আছে— অধিকন্তু আধুনিক ঔপন্যাসিকরা আমার চেয়েও ঢের বেশি অগ্রসর হয়েছেন। আজকালকার উপন্যাস ও থিয়েটারি নাটকগুলির তুলনায় রাতের কলকাতা যে বাইবেলের মতো পবিত্র, এইটুকুই আমার সান্ত্বনা। পাঠক লক্ষ করলে আরও দেখবেন যে, পাপকে আমি পাপ বলেই বরাবর চিনিয়ে দিয়েছি, তার প্রতি সকলের ঘৃণা ও বিরক্তি আকর্ষণেরই চেষ্টা করেছি, আধুনিক অনেক উপন্যাসের মতো পাপের প্রতি পাঠকের সহানুভূতি উৎপাদনের প্রয়াস এ পুস্তকের কোথাও নেই। কাজেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রাতের কলকাতা-কে একজন পাঠকও অশ্লীল বলে ভাবতে পারবেন না। এ পুস্তকের কোথাও অন্যায়রূপে অশ্লীলতার সমাবেশে পাঠকের মনকে উত্তেজিত করবার চেষ্টামাত্র নেই।
যেসব ব্যাপার এতে আছে, তার অধিকাংশই স্বচক্ষে দেখেই লেখা হয়েছে। শোনা কথায় নির্ভর করলে আরও অনেক ব্যাপার লেখা যেত, আমি তা করিনি। আমি গোয়েন্দার মতো পথে পথে ঘুরে এইসব বিবরণ সংগ্রহ করেছি এবং গণিকা পল্লির উপাদান সংগ্রহে অনেক প্রথম শ্রেণির ‘বিশেষজ্ঞ’-রও সাহায্য পেয়েছি। পাঠকদের মধ্যেও যদি কোনো বিশেষজ্ঞ থাকেন, আশা করি তিনি বিচার করে দেখবেন যে, আমার পরিচিত ‘বিশেষজ্ঞ’-দের দেওয়া উপাদানগুলি নির্ভরযোগ্য কিনা! এখনও অগুনতি উপাদান আমার হাতে রইল— যার মধ্যে কলকাতার আরও ঢের বিশেষত্ব আছে। পাঠক সমাজে আগ্রহের সাড়া পেলে সেগুলি নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আবার দেখা দেব।৪ নইলে এইখানেই ইতি।
মেঘনাদ গুপ্ত৫
প্রথম দৃশ্য – শহরের সাধারণ ছবি
কলকাতা!
—ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর১.১, ভারতের সর্বপ্রধান নগর, প্রাচ্যের প্যারি, সর্বজাতির মিলনক্ষেত্র, বাঙালি গর্বের নিধি, নব-সভ্যতার জন্ম-পীঠ, প্রাসাদকীর্ণ কলকাতা!
দিবারাত্র তার পথে পথে জনতার স্রোত বইছে; মান্ধাতার পালকি১.২, গোরুর গাড়ি১.৩ আর মানুষ-গাড়ির১.৪ পাশে পাশে পরম আধুনিক বৈদ্যুতিক ট্রাম, বাস ও মোটরগাড়ি ছুটছে এবং তার দেহে ছায়া ফেলে আকাশে উড়ছে উড়োজাহাজ; চশমা-নাকে, লপেটা-পায়ে, টেরি-মাথায়, ছড়ি-হাতে কাপুড়ে-বাবু১.৫; কালো অঙ্গে ফিটফাট বিলাতি পোশাক ‘ইঙ্গ-বঙ্গ’ পুঙ্গব; নানান অদ্ভুত আকারের টুপি আর হরেক রকমের জামাকাপড় পরে পারসি, গুজরাটি, মারাঠি, শিখ, পাঠান, কাবুলি, নেপালি, ভুটানি, পাঞ্জাবি, মগ১.৬, জাপানি, চীনে ও মাড়োয়ারি প্রভৃতি নিখিল প্রাচ্যের মনুষ্য-নমুনা; ইংরেজ, স্কচ, আইরিশ, ফরাসি ও আমেরিকান প্রভৃতি পাশ্চাত্য জাতির উগ্র মূর্তি আবার সেই সঙ্গে অর্ধনগ্ন উড়িয়া আর পূর্ণনগ্ন নাগা সন্ন্যাসীর দল১.৭— মানবতার এমন অপূর্ব জগাখিচুড়ি পৃথিবীর আর কোথাও গেলে চক্ষে পড়বে না! একদিকে বড়ো বড়ো রং-বেরঙের আকাশছোঁয়া অট্টালিকাশ্রেণি, তারই ছায়ায় ছায়ায় হেলে-পড়া, ঘুঁটে দেওয়া মেটে দেয়াল১.৮ অগণ্য কুঁড়েঘর এ দৃশ্যও অন্যত্র দুর্লভ! রাজপথের একদিকে মূর্তিমান ঐশ্বর্যের মতো শকটারোহী, নির্বিকার, সুসজ্জিত, জগতের দুঃখ-দারিদ্র্যে অচৈতন্য লক্ষ্মীর বরপুত্ররা এবং অন্যদিকে প্রকাশ্য রাস্তার ধুলায় ছেঁড়া কাঁথা পেতে চিরদারিদ্র্যের উপাসক, কোটরগত-চক্ষু, অস্থিচর্মমাত্রসার দীন ভিখারির দল নাভিশ্বাস টানতে টানতে মৃত্যুর অপেক্ষায় পড়ে আছে— আবার তাদের স্তিমিত নেত্রের সামনে দিয়ে চলেছে সারে সারে ঢাক-ঢোল-ভোঁপু বাজিয়ে, ফুলের গন্ধ বিলিয়ে, কোঁচানো চাদর উড়িয়ে নিশ্চিন্তপ্রাণ বরযাত্রীর দল— নিয়তির এ হেন নির্দয় পরিহাসলীলা আর কোথায় গেলে দেখা যায়? জীবন ও মৃত্যু এখানে একত্রে বাস করে, এক ডালের মধু ও কাঁটার মতো!
কবিবর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তও কলকাতার সম্বন্ধেই বলেছেন—
এই কলিকাতা— কালিকা ক্ষেত্র, কাহিনী ইহার সবার শ্রুত,
বিষ্ণুচক্র ঘুরছে হেথায়, মহেশের পদধূলে এ পূত।
হিন্দুর কালী আছেন হেথায়, মুসলমানের মৌলা আলি,
চারি কোণে সাধু পীর চারিজন মুস্কিলাসান চেরাগ জ্বালি।
সকল ধর্ম মিলেছে হেথায় সমন্বয়ের মন্ত্র-সুরে,
স্বাগত সাধক-ভক্ত-বৃন্দ মরতের বৈকুণ্ঠপুরে।১.৯
বাস্তবিক, কলকাতাকে প্রথম দৃষ্টিতে দেখলেই মনে হয়, এ নগর সাধুর তীর্থক্ষেত্র, ধার্মিকের সাধন-নিকেতন, পবিত্রতার পুণ্য আশ্রম! হিন্দুর কালী, তারা, মহাদেব, শনি, জগদ্ধাত্রী, জগন্নাথ, শীতলার মন্দির১.১০, বৌদ্ধের বিহার, জৈনের পরেশনাথ দেবালয়১.১১, ক্রিশ্চানের গির্জা, মুসলমানের মসজিদ— এর চারিদিকে ধোঁয়ামাখানো আকাশের গায়ে নানা আদর্শের শিল্প বিচিত্র মাথার পর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি পদেই একটি-না-একটি মন্দির ও তার সামনে দলে দলে ভক্তের ভিড় পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সকালে-সন্ধ্যায় পূজার্চনা, শঙ্খঘণ্টার রোল, ঝমাঝম দর্শনীর ধ্বনি! অধিকাংশ হিন্দু দেব-দেবীরই অবস্থা যে বেশ উন্নত, সেটা মন্দিরের মর্মরমণ্ডিত সুচিকন গৃহতল, দেব-দেবীর সমুজ্জ্বল স্বর্ণালংকার ও সেবাইতদের ভোগপুষ্ট নধর দেহগুলি দেখলেই বুঝতে বিলম্ব হয় না।
কিন্তু বাইরেকার এই ধর্মের বর্মের তলায় কত যে অন্যায়, কত যে জঘন্যতা ও যে পাশবিকতা আত্মগোপন করে আছে, তীক্ষ্নদৃষ্টি না থাকলে কেউ তা দেখতে পাবে না! একদিকে চিৎপুরের চিত্রেশ্বরী১.১২ ও আর একদিকে কালীঘাটের কালিকাদেবী১.১৩ কলকাতার ঘাঁটি আগলে থাকলে কী হবে তাঁদের দিব্যদৃষ্টিতে ধূলি নিক্ষেপ করে শয়তান তার শত পাপসঙ্গীকে নিয়ে, নিত্যই তো শহরের মধ্যে এসে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ বলেছেন—
এই কলিকাতা ব্যাঘ্র-বাহিনী ছিল এ একদা বাঘের বাসা,
বাঘের মতন মানুষ যাহারা তাহাদেরি ছিল যাওয়া ও আসা!
সেকালে এখানে যেমন বাঘের মতন মানুষ ছিল, একালেও তেমনি মানুষরূপী বাঘের অভাব কলকাতায় নেই। এই সব মানুষ-বাঘের দল এখন বরং বেশি ভারী হয়েছে। তবে এরা বীরত্বে বা তেজে নয়— হিংসায় এবং পশুত্বেই বাঘের মতন। এই বাঘ-বাঘিনির দল সারা কলকাতায় ছড়িয়ে আছে, দিনেদুপুরে দলে দলে তারা আমাদের মধ্যে বিচরণ করছে। শিকারের খোঁজে সর্বদাই ওত পেতে প্রস্তুত হয়ে আছে অদৃশ্য মড়কের মতো! আমরা তাদের চিনি না, তারা কিন্তু আমাদের নাড়ি-নক্ষত্রের সব খবর রাখে নখদর্পণে! রাত্রে যখন কলকাতার বুকের উপরে প্রগাঢ় তিমিরের পর্দা নেমে আসে, এই বাঘ-বাঘিনিরা তখন অতর্কিতে, নানা কৌশলে আমাদের আক্রমণ করে। বনের বাঘ চায় মানুষের রক্ত-মাংস, কিন্তু এরা চায় আমাদের আত্মার সারাংশ! আর, একবার যার আত্মা তাদের খপ্পরে গিয়ে পড়ে, আর তার বাঁচোয়া নেই। পল্লিগ্রামের নিশ্চিন্ত-প্রাণ পিতামাতারা আপনাদের সুকুমার মতি সন্তানদের কলকাতায় পাঠিয়ে দেন— মানুষ হবার জন্যে। কিন্তু বাঘ-বাঘিনির পাল্লায় পড়ে প্রায়ই তাদের মনুষ্যত্ব নিঃশেষে নিহত হয় এবং দেশে ফিরে যায় তারা এক একটি আস্ত জানোয়ার বা ভূত হয়ে।
কলকাতার বাইরের চাকচিক্য, শোভা-সৌন্দর্য, আলোক-হাস্য, ধর্মের ভাণ, গির্জা-মন্দির-মসজিদের জটলা দেখে কেউ যেন না ভোলেন। চেরাগের তলাতেই কত জমাট অন্ধকার আছে, আজ আমরা সেই গোপন দৃশ্যেরই কতক কতক খুলে দেখাব। আমরা সকলে সারাজীবন এই কলকাতার কোলে বসে কাটিয়ে দিই, এই কলকাতার অঙ্কেই আমাদের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের লীলা, কলকাতার বাসিন্দা বলে আমাদের মন গর্বে ও গৌরবে স্ফীত, কিন্তু কলকাতার যথার্থ স্বরূপ আমাদের মধ্যে কয়জনে দেখেছে? কলকাতার এই দুর্গম ও ভয়াবহ প্রাসাদ-অরণ্যে, নিস্তব্ধ গভীর রজনীতে কয়জন ভ্রমণ করবার সাহস রাখে? আমাদের আশেপাশে নিত্য কত ‘রোম্যান্স’, কত চিত্তোত্তেজক ঘটনা, কত বিয়োগান্ত নাটকের অভিনয় হচ্ছে, তা দেখবার আগ্রহ কয়জনের আছে? সকালে খবরের কাগজের রিপোর্ট— তার মূল্য কতটুকু? মারাত্মক বিপদ মাথায় নিয়ে, বারংবার গুন্ডার ছুরি এড়িয়ে, ‘অ্যাডভেঞ্চার’-এর ‘স্পিরিট’ সার্থক করবার জন্যে একাকী আমি, একগাছা ছোটো কিন্তু শক্ত লাঠিমাত্র সম্বল করে, সন্ধ্যা থেকে শেষরাত পর্যন্ত কলকাতার পথে পথে নিশাচরের মতো নিয়মিতরূপে ভ্রমণ করেছি—দুর্নীতির ছোঁয়াচ লাগবার ভয় না রেখে অনেক অস্থানে-কুস্থানে ঢুকতেও ইতস্তত করিনি। আমার এই দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার সমস্ত এই ছোটো পুস্তকে ধরবে না। তবে কতক কতক আভাস ও ইঙ্গিত দিয়ে যাব, পাঠকদের ভালো লাগলে, ভবিষ্যতে কলকাতার আরও নানা রূপ সবিস্তারে বর্ণনা করবার চেষ্টা করব।
***
প্রস্তাবনা
১. হুতুম প্যাঁচার নকশায়— হুতুম প্যাঁচার নকশা নামটি ভুল। সঠিক নাম হুতোম প্যাঁচার নকশা। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৮৩ শকে (আনু. ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে)। নাম ছিল ‘হুতোম প্যাঁচার কলিকাতার নকশা’। ষোলো পৃষ্ঠার এই বইতে একটিই নকশা ছিল। নাম ‘চড়ক’। দাম ‘পয়শায় দুখানা’। তারপর আরও নকশা যোগ করে ১৮৬২ সালে প্রকাশ পায় ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা/ প্রথম ভাগ’, ১৮৬৩-তে দ্বিতীয় ভাগ এবং ১৮৬৪-তে দুই ভাগ একত্রে। ১৮৬৮-তে যে সংস্করণটি প্রকাশিত হয়, সেটিই ছিল লেখক কালীপ্রসন্ন সিংহের জীবিতকালে প্রকাশিত শেষ সংস্করণ। পরে ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে সজনীকান্ত- ব্রজেন্দ্রনাথ এই বইটির পুনঃপ্রকাশ করেন। তাঁদের সম্পাদনাতেই ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে এটি পুনরায় প্রকাশিত হয়। আশ্বিন, ১৩৯৮ সনে অরুণ নাগের টীকা ও সম্পাদনায় সুবর্ণরেখা থেকে ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’ প্রকাশ পায়।
২. নকশা— ‘নকশা’ শব্দটি গ্রন্থনামে কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রথম ব্যবহার করলেও এটি তাঁর মৌলিক অবদান নয়। যতীন্দ্রমোহন ঘোষ বঙ্গসাহিত্যে নকশা (পঞ্চপুষ্প, আশ্বিন, ১৩৩৭ সন) প্রবন্ধে নকশার চরিত্রের একটি সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেন। যথেষ্ট হাস্যরস, সামাজিক অনাচার বা ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বিদ্রুপ, সামাজিক দোষ দূর করতে শিক্ষাদান, ব্যঙ্গ জোরদার করতে অতিরঞ্জন, লঘু ভাষা, ইঙ্গিতপূর্ণ বর্ণনা আর নাতিদীর্ঘ আকৃতি- এই হল নকশার বৈশিষ্ট্য। তবে গবেষক নির্মলেন্দু ভৌমিকের মতে এর সঙ্গে যুগলক্ষণকেও যোগ করা উচিত ( উনিশ শতকের বাংলা নকশা, কলিকাতা, ১৯৮৪)। এখনও যা জানা গেছে, তাতে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে সমাচার দর্পণে (২৪.২ ও ৯.৬) প্রকাশিত ‘বাবুর উপাখ্যান’ বাংলা নকশার আদি উদাহরণ। হুতোমের আগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতা কমলালয় (১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ) ও নববাবু বিলাস (১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ) নামে দুটি নকশা লেখেন, যদিও হুতোমের ভাব বা ভাষার সঙ্গে এদের খুব বেশি মিল নেই। বরং ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত টেকচাঁদ ঠাকুর ওরফে প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালের প্রভাব হুতোমে বেশ কিছুটা দেখা যায়। ১৮৬২ সালে হুতোমের পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশের পর বাংলায় নকশা লেখার জোয়ার আসে। বর্তমান লেখাটিও ওই ঘরানার।
৩. আদিরসকেও— কোনও কাব্যপাঠ শ্রবণ বা পাঠ করে অথবা নাটক অভিনয় দেখে মনে যে স্থিরতর অপূর্ব ভাবের উদয় হয়, সেই স্থায়ী ভাবকে রস বলে। এই রসের প্রবক্তা ভরত। আদিরস বলে কিছু নেই প্রকৃতপক্ষে। নাম শৃঙ্গার রস। কিন্তু ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে নবরসের মধ্যে শৃঙ্গার রসকে সর্বপ্রথমে স্থান দিয়েছিলেন, তাই এটি আদিরস বলেও অভিহিত হয়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, শাস্ত্রমতে কাব্যরস হল অমৃত। কাব্যরস নয় প্রকার। যথা: (১) আদি, (২) বীর, (৩) করুণ, (৪) অদ্ভুত, (৫) হাস্য, (৬) ভয়ানক, (৭) বীভৎস, (৮) রৌদ্র এবং (৯) শান্ত। নায়ক-নায়িকার অনুরাগবিষয়ক রসকে আদিরস বলে।
৪. অদূর ভবিষ্যতে আবার দেখা দেব— লেখক যদিও একটি সিক্যুয়েলের আভাস দিয়েছেন, কিন্তু সেটি কখনোই প্রকাশ পায়নি।
৫. মেঘনাদ গুপ্ত— এই মেঘনাদ গুপ্ত কে, এই নিয়ে একসময় সামান্য বিতর্ক তৈরি হলেও এখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে বলা যায় এটি স্বয়ং হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ছদ্মনাম।
হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জন্ম: ১৮৮৮ সালে। ছোটোদের জন্য রহস্য রোমাঞ্চ ও গোয়েন্দা গল্প লেখার জন্য বিখ্যাত। তাঁর কয়েকটি গল্প ও উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জন্মস্থান কলকাতা। পিতার নাম রাধিকাপ্রসাদ রায়। তিনি মাত্র চোদ্দো বছর বয়েসে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বসুধা পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘আমার কাহিনী’ প্রকাশিত হয়। ১৩২২ বঙ্গাব্দে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এবং মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ভারতী পত্রিকা নতুনরূপে প্রকাশিত হলে হেমেন্দ্রকুমার এর লেখকগোষ্ঠীতে যোগদান করেন। সাপ্তাহিক নাচঘর (১৩৩১ বঙ্গাব্দ) পত্রিকাটি তিনি সম্পাদনা করেছিলেন। এ ছাড়া রংমশাল পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। ছোটোদের জন্য তিনি আশিটিরও বেশি বই লিখেছিলেন। এর মধ্যে কবিতা, নাটক, হাসি ও ভূতের গল্প, অ্যাডভেঞ্চার ও গোয়েন্দা কাহিনি, ঐতিহাসিক উপন্যাস, সব কিছুই ছিল। তাঁর সৃষ্ট দুঃসাহসী জুটি বিমল-কুমার, জয়ন্ত (গোয়েন্দা) ও সহকারী মানিক, পুলিশ ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু, ডিটেকটিভ হেমন্ত, বাংলা কিশোর সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য চরিত্র। হেমেন্দ্রকুমার রায় বড়োদের জন্যও বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: জলের আলপনা, বেনোজল, পদ্মকাঁটা, ঝড়ের যাত্রী, যাঁদের দেখেছি, বাংলা রঙ্গালয় ও শিশিরকুমার, ওমর খৈয়ামের রুবায়ত প্রভৃতি। তাঁর ‘সিঁদুর চুপড়ি’ গল্পটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়ে একটি সংকলন গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল। বিমল ও কুমারের অভিযানকাহিনি অবলম্বনে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘যকের ধন’ দুইবার চলচ্চিত্রায়িত হয়। তিনি সফল গীতিকারও ছিলেন। সেই সময়ের বাংলা থিয়েটার এবং গ্রামাফোনে গাওয়া গানের প্রচলিত রীতি এবং রুচির মোড় ফিরিয়েছিলেন তিনি। তাঁর রচিত অনেক গান সেই সময়ে জনপ্রিয় ছিল। ‘অন্ধকারের অন্তরেতে’ গানটি এর মধ্যে অন্যতম। তিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ির ‘সীতা’ নাটকের নৃত্য পরিচালক ছিলেন। তিনি ভালো ছবিও আঁকতে পারতেন। বাংলায় শিল্প সমালোচনার তিনি অন্যতম পথিকৃৎ।
এই বইটি হেমেন্দ্রকুমার নিজের নামে লেখেননি। বইটির ২০১৫ সালের উর্বী সংস্করণে গবেষক পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “স্বর্গত লেখক শ্রী প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বিশু মুখোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন যে হেমেন্দ্রকুমার রায় মেঘনাদ গুপ্ত ছদ্মনামে রাতের কলকাতা রচনা করেন। হেমেন্দ্রকুমারের কনিষ্ঠ পুত্র স্বর্গত শ্রী প্রদ্যোৎকুমার রায় আমাকে বলেছিলেন তিনি তাঁর পিতার বন্ধুদের কাছে শুনেছিলেন যে হেমেন্দ্রকুমার লেখার খাতিরে Firsthand Information-এর খোঁজে বিশ শতকের প্রথমে একটি যষ্টি হাতে বিপদের ঝুঁকি নিয়েও রাতের কলকাতার বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করতেন।” এর আগেও ১৯৮৮ সালের ১৫ অক্টোবর ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে শতদল গোস্বামী লেখেন, “হেমেন্দ্রকুমার রায় মেঘনাদ গুপ্ত ছদ্মনামে রাতের কলকাতা নামে একটি বই লিখেছিলেন। কলকাতা শহরের নৈশ জীবনের বাস্তবচিত্র আঁকা হয়েছে। ছদ্মনাম নিয়েছিলেন কারণ অভিভাবকরা যাতে না জানতে পারেন বইটি তাঁরই লেখা। মেঘনাদ গুপ্ত অবশ্য ছদ্মনামের ছদ্মনাম, তাঁর আসল নাম হয়তো অনেকেই জানেন না, প্রসাদ রায়।”
এখানে বইটির প্রথম সংস্করণে চোখ বোলালে আরও একটি অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ে। ১৯২৩ সালে বইটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন হেমেন্দ্রকুমারের বয়স পঁয়ত্রিশ। তরুণ বয়সের হেমেন্দ্রকুমারের পক্ষে অভিভাবকের ভয় স্বাভাবিক। বইটির আখ্যাপত্রে লেখা, “হেমন্তকুমার রায় কর্ত্তৃক ৭৫ হ্যারিসন রোড, কলিকাতা হইতে প্রকাশিত।” এই হেমন্তকুমারের খোঁজ অনেক করেও আমি পাইনি। ফলে এটা একটা অনুসিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে, বইটি নিজের খরচেই ছাপিয়েছিলেন হেমেন্দ্র। হেমন্ত তাঁর আরও একটি ছদ্মনাম মাত্র।
বইটির ভাষাশৈলী আর ধরনের সঙ্গে হেমেন্দ্রকুমারের ভাষার বিস্তর মিলের কথা গবেষক পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়, দেবাশীষ গুপ্ত, বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায়রা জানিয়েছেন। সে মিল বর্তমান সম্পাদকের চোখেও এসেছে। তাই ‘with a pinch of salt’ এটা মেনে নেওয়াই যায় যে, হেমেন্দ্রকুমার রায়ই আদতে মেঘনাদ গুপ্ত।
.
প্রথম দৃশ্য: শহরের সাধারণ ছবি
১.১ দ্বিতীয় শহর— প্রথম শহর অবশ্যই লন্ডন। মাত্র ১৩০০ টাকার বিনিময়ে সাবর্ণ চৌধুরীর বাড়ির বিদ্যাধর রায়ের কাছ থেকে তিনটি গ্রাম- সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা ইজারা নেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সাহেবরা এই শহরে আসার পর থেকে ধীরে ধীরে একে লন্ডনের আদলে গড়ে তোলেন। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কলকাতা কতগুলো বিচ্ছিন্ন গ্রাম থেকে শহরের রূপ নেওয়া শুরু করে। সাহেবরা নিজেদের বসবাসের জন্য হোয়াইট টাউন তৈরি করেন গঙ্গার ধার বরাবর। নেটিভরা থাকতেন সাবেক ব্ল্যাক টাউনে।
১.২ পালকি— একধরনের বিলাসবহুল যান, যাতে আরোহণ করে ধনিক গোষ্ঠী কিংবা সম্ভ্রান্তবংশীয় ব্যক্তিগণ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন। চাকাবিহীন হওয়ায় মনুষ্যশক্তি প্রয়োগে চালিত, অর্থাৎ কয়েকজন ব্যক্তি পালকিকে ঝুলন্ত অবস্থায় ঘাড়ে বহন করে স্থানান্তরে অগ্রসর হয়। তাদের পালকি বেহারা নামে অভিহিত করা হয়। প্রথমদিকে দেব-দেবীর আরোহণ কিংবা দেবমূর্তি বহনের উদ্দেশ্যে এরূপ যানবাহন তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অনেক মন্দিরেই পালকি সহযোগে দেবতাদের বহনের দৃশ্যমালা ভাস্কর্য বা চিত্র আকারে তুলে ধরা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে পরবর্তীকালে মুখ্যত সম্ভ্রান্ত এবং ইউরোপীয় ব্যক্তি ও ভদ্রমহিলারা রেলগাড়ি প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত পালকিতে চলাফেরা করতেন।
কলকাতায় পালকি বেহারারা ছিল উড়িয়া এবং কাহার। “ধাক্কুড়াকুড় হেঁইয়া নাবড়” ছন্দের বুলি তুলে চারজন বাহক পালকি কাঁধে নিয়ে চলত। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “কলিকাতার চলাফেরা” গ্রন্থে লিখছেন, “উড়িয়াদের মধ্যেও গৌড় বাউড়ি প্রভৃতি দুই-চার জাতি আছে, যাহারা একমাত্র পাল্কি বহনের অধিকারী।” এই পালকিবাহকরা যেখানে বাসা করে থাকত, তার কাছেই কর্পোরেশান ‘Palanquin Stand’ বলে একটা খোঁটা মেরে দিত। সাধারণ মানুষ এদের পাল্কির আড্ডা বা আড়া বলতেন। পালকির দরকার হলে সেই আড়াতে গিয়ে “বেহারা” বা “দাসপো” বললেই তাঁরা চোখ রগড়াতে রগড়াতে সাড়া দিত। ভাড়া অধিকাংশ সময় বেহারাদের মর্জিমাফিক হত। ১৮২৭ সালে সরকার পালকি বেহারাদের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করেন এবং ভাড়া বেঁধে দেন ‘সমস্ত দিন ফি চারি আনা। ইঙ্গরাজি ১৪ ঘড়িতে একদিন গণা যাইবেক।” বেহারারা এর বিরুদ্ধে সদলবলে ধর্মঘট করে। কলকাতার বুকে সেটাই প্রথম ধর্মঘট। বিংশ শতকের চারের দশক থেকে পালকির সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। বালথ্যাজার সলভিন্স-এর আঁকা ছবিতে সেকালের কলকাতায় বেশ কয়েক ধরনের পালকি চোখে পড়ে- Long Palanquin, Chaise Palanquin, Boutcha, Mejanaab, D’ Bouly, Mohhafa, D’ Jehalledar আর Chanpal Palanquin। ঠিকা পালকি ছাড়াও বড়োলোক বা সাহেবদের নিজস্ব পালকি ও বেহারা ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছেলেবেলা’-য় লিখছেন, “পালকিখানা ঠাকুরমাদের আমলের। খুব দরাজ বহর তার, নবাবি ছাঁদের। ডাণ্ডা দুটো আট আট জন বেহারার কাঁধের মাপের। হাতে সোনার কাঁকন, কানে মোটা মাকড়ি, গায়ে লালরঙের হাতকাটা মেরজাই-পরা বেহারার দল সূর্য-ডোবার রঙিন মেঘের মতো সাবেক ধনদৌলতের সঙ্গে সঙ্গে গেছে মিলিয়ে। এই পালকির গায়ে ছিল রঙিন লাইনে আঁকজোক কাটা, কতক তার গেছে ক্ষয়ে, দাগ ধরেছে যেখানে সেখানে, নারকোলের ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে ভিতরের গদি থেকে। এ যেন একালের নামকাটা আসবাব, পড়ে আছে খাতাঞ্চিখানার বারান্দায় এক কোণে।” সঙ্গে বালথ্যাজার সলভিন্সের আঁকা পালকির ছবি।
১.৩ গোরুর গাড়ি— শুধু গোরু নয়, কলকাতায় সেকালে মহিষ-জোতা গাড়িও প্রচুর দেখা যেত। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, “বলদ গাড়িই আবহমান কাল ধরিয়া চলিয়া আসিতেছিল। প্রথম প্রথম মহিষ জোতা গাড়ি দেখিয়া এতই ভয় হইত যে, আমরা তাহার পার্শ্ব দিয়া যাইতে সাহস করিতাম না।” গোরুর গাড়ি মূলত মাল বইবার কাজে ব্যবহার করা হত। যেখানে গোরুর গাড়িতে ২০ মন বোঝা নেওয়া যেত, সেখানে মহিষের গাড়োয়ানরা “৪০ মণের কাছাকাছি মাল চাপাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না।” পরে সাহেব-মেমসাহেবরা কলকাতা থেকে গোরুর গাড়ি তুলে দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, “ইহাদের বড় কষ্ট হয়।” তবে ততদিনে কলকাতায় মোটরগাড়ি এসে গেছে। তাই ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, এই দয়া-দেখানো “ইংরাজদিগের অনেকে কোন না কোন প্রকারে মোটর গাড়ির কারখানার সহিত সংলিপ্ত আছেন।”
১.৪ মানুষ গাড়ির— এই কাহিনি লেখার সময় অপেক্ষাকৃত নবীন যান ছিল এই মানুষ গাড়ি বা রিকশা। বাংলা রিকশা শব্দটি এসেছে জাপানি জিনরিকশা থেকে। চিনা ভাষায় জিন শব্দের অর্থ মানুষ, রিকি শব্দটির অর্থ শক্তি আর শা শব্দটির অর্থ বাহন। অর্থাৎ রিকশার বলতে মানুষের শক্তি দ্বারা চালিত বাহনকে বোঝায়। জোনাথন স্কোবি নামে একজন মার্কিন মিশনারি ১৮৬৯ সালে রিকশা উদ্ভাবন করেন। স্কোবি থাকতেন জাপানের ইয়াকোহামায়। নিজের অথর্ব স্ত্রীকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে নিতে তিনি এই যান তৈরি করেন। ১৮৮০ সালে ভারতে প্রথম রিকশা চালু হয় হিমাচল প্রদেশের সিমলায়৷ রেফ জে ফোর্ডিস নামের এক ব্রিটিশ নাগরিক, তিনি একে নিয়ে আসেন এ দেশে। কিন্তু সেই সময় যে হাতে টানা রিকশা দেখা যেত, তার আর আজকের হাতে টানা রিকশার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তখন একটা রিকশা চালাতে পাঁচজন মানুষ লাগত, এতটাই বড়ো ছিল সেই রিকশা। এর পুরোটাই তৈরি ছিল লোহা দিয়ে। ১৯০০ সালে কলকাতায় হাতে টানা রিকশা চালু হয়, তবে মালপত্র বহনের জন্য। ১৯১৪ সালে কলকাতা পৌরসভা রিকশায় যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়। ভারতে প্রথম রিকশা বানায় হার্টস রয়াল হর্স রিপোজিটরি। কলকাতার স্টেটসম্যান- এ মানুষে টানা রিকশার প্রথম বিজ্ঞাপন পাই ১৯০২ সালে অক্টোবর মাসে ডব্লিউ লেসলি অ্যান্ড কোম্পানির (সঙ্গের ছবি)। দাম ১৬০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা। এর পরে ১৯০৩ সালের ৫ এপ্রিল ব্রেকওয়েল অ্যান্ড কোম্পানি মাত্র ১৮০ টাকায় সেকেন্ডহ্যান্ড “almost new” রিকশার বিজ্ঞাপন দেন।
১.৫ লপেটা পায়ে, টেরি মাথায়, ছড়ি হাতে— লপেটা হল নাগরা ও পাম্প শু এই দুই-এর মধ্যবর্তী আকারবিশিষ্ট পাদুকা। টেরি মানে বাঁকা বা তেরছা সিঁথি। ১৯১৬ সালে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস রচিত, ইণ্ডিয়ান প্রেস প্রকাশিত ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ প্রথম সংস্করণে লেখা আছে- টেরি কাটা, টেড়ি কাটা- মাথার চুলে টেড়া বা বাঁকা সিঁথি রচনা করা; বাঁকাইয়া চুল।
সুকুমার রায় আশ্বিন, ১৩২৯-এর সন্দেশ পত্রিকায় তাঁর ‘বাবু’ কবিতায় এই তিনটিকেই মিলিয়ে লিখেছেন-
অতি খাসা মিহি সূতি
ফিনফিনে জামা ধুতি,
চরণে লপেটা জুতি জরিদার।
এ হাতে সোনার ঘড়ি,
ও হাতে বাঁকান ছড়ি,
আতরের ছড়াছড়ি চারিধার।
চক্চকে চুল ছাঁটা
তায় তোফা টেরিকাটা-
সোনার চশমা আঁটা নাসিকায়।
১.৬ মগ— মগ আরাকান নিবাসী জাতি বিশেষ। জাতিতত্ত্ববিদেরা এদের ইন্দো-চিন নিবাসী বলে মনে করেন। এদের মধ্যে মারমগরি, ভুঁইয়া মগ, বড়ুয়া মগ, রাজবংশী মগ, মারমা মগ, রোয়াং মগ, ভ্যুমিয়া মগ ইত্যাদি নামে জাতবিভাগ আছে। বাংলায় অতীতে বিভিন্ন দেশের জলদস্যুরা আসত চুরি ডাকাতি বা সম্পদ লুট করতে। তাদের নিয়ে অনেক গল্প কবিতা ছড়া লেখা হয়েছে। একদল ভয়ানক দস্যু আসত মগ রাজার দেশ থেকে। এরা ছিল মূলত পর্তুগিজ নৌ-দস্যুদের রাজাকার বাহিনী। মগরা আমাদের অঞ্চলে এসে যে অরাজকতার সৃষ্টি করত, তার মাত্রা বোঝানোর জন্য বলা হত মগের মুল্লুক অর্থাৎ যা খুশি তাই করার দেশ। অনেকের মতে মগ মানেই আরাকানি আর মগের মুল্লুক মানে আরাকান রাজ্য। আরাকানরাজের সৈন্যদলের মধ্যে অনেক মগ ও অবৈতনিক পর্তুগিজ সৈন্য ছিল। এরা বছরে বারোমাস লুণ্ঠন, অপহরণ ও অত্যাচার চালাত। শায়েস্তা খাঁর এই দুর্ধর্ষ অভিযানে পর্তুগিজ ও মগেরা চট্টগ্রাম থেকে অতি ক্ষিপ্রতায় পালানোর (স্থানীয়ভাবে এই ঘটনা ‘মগ-ধাওনি’ নামে খ্যাত ছিল) সময় ১,২২৩টি কামান ফেলে যায়, কিন্তু অধিকাংশ ধনসম্পদ ঘড়ায় করে মাটিতে পুঁতে রেখে যায় (পরবর্তীকালে, মগ-পুরোহিতরা সাংকেতিক মানচিত্রের সাহায্যে গোপনে এইসব স্থানে এসে ঘড়াগুলি উঠিয়ে নিয়ে যেতেন)। এইভাবে গোটা বাংলায় ‘মগের মুল্লুক’-এর অবসান ঘটে। ইংরেজ শাসনেও পর্তুগিজ হার্মাদদের দস্যুতার কথা শোনা যেত; ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দেও কলকাতায় মগ দস্যুর ভয় ছিল জনসমাজে। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার হাওড়ার শিবপুরে (এখনকার বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে) গঙ্গার একটা বাঁধ তৈরি করে মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদের আগমনপথ বন্ধ করে দেন।
১.৭ নাগা সন্ন্যাসীর দল— ভারতে যখন বকধার্মিকদের দৌরাত্ম্য প্রচণ্ড রূপ নেয়, তখন তাকে রুখতে গুরু শংকরাচার্য একটি খারু গঠন করেন। ওই সংঘের মাধ্যমেই নাগাদের পত্তন হয়। শাস্ত্রজ্ঞান ও অস্ত্রজ্ঞান- উভয় বিষয়েই এই নাগারা বিজ্ঞ ছিল। এই দুইয়ের প্রয়োগে তারা তখন সনাতন ধর্মের ওপরে যে বিপত্তি নেমে এসেছিল তার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। পরবর্তী মুসলিম শাসন আমলেও এই সাধুরা স্বধর্ম রক্ষায় তৎপর ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নাগা সন্ন্যাসীদের একটি গোষ্ঠী ইংরেজ আমলে লোকজনকে টাকা ধার দিত, নির্দিষ্ট সময় পর তা তুলে নিয়ে যেত ফায়দা সহ। এ নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে তাদের বিবাদ-লড়াই হত প্রায়ই। নাগা সন্ন্যাসীরা কেউ কেউ রাজা-জমিদারদের পক্ষে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে লড়াইও করত। ব্রিটিশ আমলে মুসলিম ফকিরদের সঙ্গে সন্ন্যাসীদের কোনও কোনও পক্ষ ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে বলেও জানা যায়। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, এই সন্ন্যাসীরা ছিলেন বৈদান্তিক হিন্দু যোগী এবং একদণ্ডী সন্ন্যাসবাদের গিরি ও পুরী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
প্রসঙ্গত, বাংলায় কোম্পানি শাসনের তিন বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৭৬০ সালের জুনে বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চল থেকে শুরু হয়েছিল ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। ফকির মজনু শাহ্ এই বিদ্রোহের প্রাণপুরুষ ছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে নাটোরের জমিদার দেবী চৌধুরাণীর সেনাপতি সন্ন্যাসব্রতধারী ভবানী পাঠক এই বিদ্রোহে যুক্ত হয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন, অনুপ্রাণিত করেন। ভোজপুরী ব্রাহ্মণ ভবানী পাঠক তখন মজনু শাহর সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ইতিহাসবিদ ড. সিরাজুল ইসলামের লেখায় জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ‘নাগা’ ও ‘গিরি’ সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। অযোধ্যার নবাবের সৈন্যবাহিনীতে ‘গোঁসাই’ বাহিনী গঠিত হয় মূলত ওই সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে। ইংরেজ কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নবাব মিরকাশিম ফকির-সন্ন্যাসীদের সাহায্য নিয়েছিলেন।
১.৮ হেলে পড়া, ঘুঁটে দেওয়া মেটে দেয়াল— মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, কলকাতায় তখন পাকা বাড়ি আর মাঠকোঠা কম ছিল। সব জায়গায় এঁদোপুকুর আর বাঁশঝাড়। চারিদিকে বড়ো বড়ো তেঁতুল, নারকেল গাছ আর পুকুরে ভর্তি। ধানখেত আর পুকুরও ছিল। রাস্তার ধারে বড়ো বড়ো পগার। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকেও কলকাতায় মাটির বাড়ির অভাব ছিল না। বাড়িতে ছিল খড়ের ছাউনি, তাতে আগুন লেগে বিপদ ঘটত প্রায়ই। বিনয় ঘোষের ‘সংবাদপত্রে সেকালের কলকাতা’-তে বাড়ির মাটির দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যু বা খড়ের চালে আগুন লাগার কাহিনি পাওয়া যায়।
সাধারণত নরম থাকতে থাকতে গোবরকে ঘেঁটে সমসত্ত্ব করে গোল তাল পাকিয়ে সেগুলি হাতের সাহায্যে দেওয়াল বা তেমন কোনও শক্ত তলের উপর থপ থপ করে থেবড়ে দিয়ে চ্যাপটা করা হয়। একে বলে ঘুঁটে দেওয়া।
রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠে আছে:
“বড় বউ মেজ বউ মিলে।
ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে।।”
গোবর হাওয়ার সংস্পর্শে শুকিয়ে শক্ত হয়ে ঘুঁটে হয়ে যায়। জলীয় অংশ কমে যাবার ফলে এর আয়তন সংকোচন হয়। হাতে করে থেবড়ানোর জন্য ঘুঁটের বাইরের তলে হাতের তিন-চার আঙুলের ছাপ থাকে। পিছনের তলটি সাধারণত দেওয়ালের ন্যায় সমতল হয়। দেওয়ালগুলি এমনভাবে বাছা হয় যাতে রোদ পড়ে ও ঘুঁটে তাড়াতাড়ি শুকোয়। শুকিয়ে গেলে ঘুঁটে দেওয়াল থেকে সহজেই খসিয়ে নেওয়া যায়। কাচা ঘুঁটে দেওয়াল থেকে খোলার চেষ্টা করলে ভেঙে যায়। প্রায় শুকোনো ঘুঁটে দেওয়াল থেকে ছাড়িয়ে নেবার পর গোছা গোছা করে রোদে রেখে আরও ভালো করে শুকোনো হয়। তখন ঘুঁটে সমতল না থেকে একটু বেঁকেচুরে যেতে পারে। যে ঘুঁটে যত ভালো শুকোনো হয় তা তত সহজে জ্বালানো যায়। তাই ভালো করে শুকোনো ঘুঁটের কদর বেশি। এক-একটি ঘুঁটে দেখতে বড়োসড়ো মনে হলেও সমান আয়তনের কয়লা, এমনকি কাঠের থেকেও ঘুঁটে অনেক হালকা।
১.৯ কবিবর সত্যেন্দ্র দত্তও কলকাতার সম্বন্ধেই বলেছেন— মূল কবিতার নাম ‘স্বাগত’। কলকাতার সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষ্যে এটি রচিত হয়। কবিতার প্রথম দুটি লাইন ছিল—
“স্বাগত বঙ্গ মনীষী সংঘ ভূষিত অশেষ মানের হারে
এ মহানগরে এসো- আজি এসো ভাবের জ্ঞানের সন্তাগারে।”
অধ্যায়ের পরের উদ্ধৃতিও একই কবিতা থেকে নেওয়া।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নবকুমার, কবিরত্ন, অশীতিপর শর্মা, ত্রিবিক্রম বর্মণ, কলমগীর প্রভৃতি ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। দেশাত্মবোধ, মানবপ্রীতি, ঐতিহ্যচেতনা, শক্তিসাধনা প্রভৃতি তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। ১৯১৮ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় ছন্দ সম্পর্কিত তাঁর প্রসিদ্ধ রচনা ‘ছন্দ-সরস্বতী’ প্রকাশিত হয়। তাঁর অপর কৃতিত্ব বিদেশি কবিতার সফল অনুবাদ। আরবি, ফার্সি, চিনা, জাপানি, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষার বহু কবিতা অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি সাধন করেন। মেথরদের মতো অস্পৃশ্য ও অবহেলিত সাধারণ মানুষ নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন। তিনি একাধিক ছদ্মনামে কাব্যচর্চা করতেন। কবিতায় ছন্দের সমৃদ্ধির জন্য তিনি ছন্দের রাজা ও ছন্দের জাদুকর বলে খ্যাত।
১.১০ শীতলার মন্দির— হিন্দু ধর্মের একজন লৌকিক দেবীবিশেষ। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে এই দেবীর প্রভাবেই মানুষ বসন্ত প্রভৃতি রোগাক্রান্ত হয়। এই কারণেই গ্রামবাংলায় বসন্ত রোগ মায়ের দয়া নামে অভিহিত হয়ে থাকে। তাই কেউ বসন্তে আক্রান্ত হলে দেবী শীতলাকে পূজা নিবেদন করে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির আরোগ্য কামনা করা গ্রামীণ হিন্দু সমাজের প্রধান রীতি। যেমন: বসন্তবুড়ি ব্রত। গ্রামীণ বাংলার বাঙালি হিন্দুঘরের মহিলারা বসন্ত রোগের নিরাময় কামনায় শীতলার এই ব্রত পালন করেন। এটি চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে করা হয়। ব্রতটি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় বিশেষভাবে প্রচলিত। বসন্তবুড়ি ব্রত পালনের প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ অর্থাৎ মঙ্গলঘট ও ডাব সংগ্রহ করতে হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্রতের দিন সারাদিন উপবাস করে বাড়ির উঠোনে উন্মুক্ত স্থানে একটি ঘটের উপর ডাবটি রাখা হয়। এরপর ওই ডাবের জল দিয়ে ঘটটিকে স্নান করিয়ে পূজা করতে হয়।
মাঘ মাসের ষষ্ঠ দিনে দেবী শীতলার পূজা করা হয়। শীতলা দেবীর বাহন গর্দভ। প্রচলিত মূর্তিতে শীতলা দেবীর এক হাতে জলের কলস ও অন্য হাতে ঝাড়ু দেখতে পাওয়া যায়। ভক্তদের বিশ্বাস কলস থেকে তিনি আরোগ্যসুধা দান করেন এবং ঝাড়ু দ্বারা রোগাক্রান্তদের কষ্ট লাঘব করেন
১.১১ জৈনের পরেশনাথ দেবালয়— কলকাতার উত্তর-পুবে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ লাগোয়া বদ্রীদাস টেম্পল স্ট্রিটে (গৌরীবাড়ি) জৈনতীর্থ শ্রী পার্শ্বনাথ জৈন উপবন মন্দির। নামে পরেশনাথ মন্দির হলেও আসলে ১৮৬৭ সালে রায় বদ্রীদাস মুকিম বাহাদুরের হাতে তৈরি ২৪ জৈন তীর্থঙ্করের অন্যতম শীতলানাথজির (১০ম) মন্দির এটি। আর পরের বছর সুখলাল জহুরী গড়ান জৈন শ্বেতাম্বর মন্দির। মন্দিরে রয়েছে আরও অনেক কিছু। শ্বেতমর্মরের বিগ্রহ, ক্রিস্টাল, ডায়মন্ড, রুবি, মুক্তা, কোরাল ছাড়াও মূল্যবান সব রত্ন, রঙিন কাচ আর মন্দির স্থাপত্যের সূক্ষ্ম কারুকার্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। শিল্পী গণেশ মুসকরের আঁকা ছবিগুলিও সুন্দর। সারা মন্দির জুড়ে রয়েছে বাগিচা। ভক্তদের বিমোহিত করে ফোয়ারা, জলাশয়, রঙিন মাছ, মর্মরমূর্তি। সরোবরের পাড়ে রয়েছে শান্তি ও অহিংসার প্রতীকী মূর্তি, বাঘে-গোরুতে জল খাচ্ছে। বাঁদিকে পবিত্র প্রান্তিক শিলা। মন্দিরের মূল মূর্তি শীতলানাথজির কপালের ডায়মন্ডটি দর্শকদের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটায়। রাসপূর্ণিমায় জাঁকালো উৎসব হয়। ঝলমলে মিছিল বেরোয়। প্রতি দিন সকাল ৬টা থেকে ১২টা এবং বিকেল ৩টে থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মন্দির খোলা।
১.১২ চিৎপুরের চিত্তেশ্বরী— আকবরের অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমলের গোমস্তা মনোহর ঘোষ ১৬১০ সালে কলকাতার গঙ্গাতীরবর্তী এই অঞ্চলে চিত্তেশ্বরী দুর্গার মন্দির স্থাপন করেন। তাঁর আদি নিবাস ছিল হুগলির (অধুনা হাওড়ার) বালি। এই ‘চিত্তেশ্বরী’ নামটি থেকেই অপভ্রংশের ফলে ‘চিৎপুর’ নামটির সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস। কেউ কেউ আবার ‘চিৎপুর’ নামটির পিছনে জনৈক ‘চিতে’ ডাকাতের হুংকার আছে বলে মনে করেন। চিৎপুর রোড (বর্তমান রবীন্দ্র সরণি) কলকাতার অতি প্রাচীন একটি রাস্তা। পরবর্তীকালে চিতু ডাকাত ও চিত্তেশ্বরীর নাম অনুসারে এই জায়গার নাম হয় চিৎপুর। কলকাতার প্রাচীন নথিপত্র থেকে দেখা যায়, একেবারে শুরুর সময়েই উত্তরের চিৎপুর থেকে দক্ষিণে গোবিন্দপুরের কালীঘাট অবধি একটি রাস্তা বিস্তৃত ছিল। ইংরেজরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘রোড টু কালীঘাট’ বা ‘পিলগ্রিম পাথ’ (Pilgrim Path)। চিৎপুর থেকে দক্ষিণমুখে সুতানুটি ছাড়িয়ে একটা কাঁচা রাস্তা সোজা কালীঘাটের দিকে চলে গেছিল। এই রাস্তাই চিৎপুর রোড। মূলত এই রাস্তা ধরেই পুণ্যার্থী তথা ভক্তরা চৌরঙ্গীর গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কালীঘাটে তীর্থ করতে যেত। অনেকের ধারণা রবীন্দ্র সরণি বা পূর্বতন চিৎপুর রোডের আশপাশের অঞ্চলটিই শুধু চিৎপুর। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, চিৎপুরের ব্যাপ্তি অনেকটা এলাকা জুড়ে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী-র ‘চণ্ডীমঙ্গল’ ও ‘মনসার ভাসান’-খ্যাত বিপ্রদাস পিপলাই-এর ‘মনসাবিজয়’-এ চিৎপুরের উল্লেখ আছে। যদিও তা প্রক্ষিপ্ত বা পরবর্তীকালের সংযোজন বলেই মনে হয়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ ‘চিত’ শব্দের প্রধান অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘চন্দনাদিরচিত চিত্র বা লেখা’। যে-কোনো শাক্ত বা বৈষ্ণব মন্দিরে তীর্থ করতে যাওয়ার পথে পুণ্যার্থীরা কপালে ও হাতে চন্দনের ছাপ নিতেন। তিলক কাটা তো একটি স্বাভাবিক প্রথা। শ্বেতচন্দনের জায়গায় শাক্তরা আবার রক্ততিলক কাটতেন। অর্থাৎ চিৎপুর ছিল কালীঘাটমুখী ভক্তস্রোতের গায়ে-হাতে-কপালে শ্বেতচন্দন ও রক্ততিলক নেওয়ার এক প্রধান হল্ট। ‘চিত্রপুর’ নামেও পরিচিত ছিল ‘চিতপুর’। চক্রপাণি নামে বাংলার নবাবের এক চিত্ররসিক সেনাপতি নাকি এখানে বাস করতেন। এটি ছিল শিল্পীদের এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। চিত্রপুর হোক, চিতপুর হোক, বা চিৎপুরই হোক– চিৎপুরের যাত্রাশিল্প কিন্তু এখনও পুরোনো ‘মেকআপ ম্যান’-দের স্মৃতি উসকে দেয়। গায়ে, হাতে ও কপালে চন্দন ছাপ নেওয়া ও তিলক কাটার প্রাচীন অভ্যাস সহজে যাওয়ার নয়।
চিৎপুর রোড ছিল কলকাতার প্রাচীনতম রাস্তা। ধনী মানুষের পাশাপাশি এই অঞ্চলে অনেক সাধারণ মানুষের বসবাস ছিল। বাংলা প্রাচীন পঞ্জিকা এখান থেকে ছাপা হত। চিৎপুর রোডই ছিল বটতলা বইবাজারের কেন্দ্র। চিৎপুর রোডের পান, আড্ডা, যাত্রা ও অনুষ্ঠান কলকাতার বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। বিবাহের অনুষ্ঠানে ‘হি ইজ আ জলি গুড ফেলো’ গাওয়া ব্রাস ব্যান্ডের কেন্দ্র ছিল এই রাস্তা। চিৎপুর রোডের একটি অংশ লোয়ার চিৎপুর রোড দিল্লির চাঁদনি চকের সমতুল্য ছিল। সঙ্গে ১৮৫৭ সালে অঙ্কিত চিৎপুর রোড (উডকাট)।
১.১৩ কালীঘাটের কালিকা দেবী— কালীঘাট একটি বহু প্রাচীন কালীক্ষেত্র। কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, “কালীক্ষেত্র” বা “কালীঘাট” কথাটি থেকে “কলকাতা” নামটির উদ্ভব। জনশ্রুতি, ব্রহ্মানন্দ গিরি ও আত্মারাম ব্রহ্মচারী নামে দুই সন্ন্যাসী কষ্টিপাথরের একটি শিলাখণ্ডে দেবীর রূপদান করেন। ১৮০৯ সালে বড়িশার সাবর্ণ জমিদার শিবদাস চৌধুরী, তাঁর পুত্র রামলাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তের উদ্যোগে আদিগঙ্গার তীরে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। কালীঘাটের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা দিয়ে চারশো বছর আগে ছোটো ছোটো জাহাজ চলত। ভক্তেরা পুণ্যস্নান করে মা কালীর থানে পুজো দিতেন। মন্দিরের সামনেই ছিল স্নানের ঘাট।
লোকমুখে অন্য একটি গল্প প্রচলিত আছে যে, সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের সন্তোষ রায়চৌধুরী একদিন হুগলি নদীতে ভ্রমণকালে অলৌকিক আলো দেখে আকৃষ্ট হন এবং সেখানে গিয়ে তিনি একইরকম ভাবে আঙুলের আকারের পাথর খুঁজে পান। সেটিকে তুলে নিয়ে তিনি একটি ছোটো মন্দির স্থাপন করেন। বর্তমানে এই মন্দির কালীঘাট মন্দির নাম পরিচিত। প্রথমে মন্দিরটি একটি কুঁড়েঘরের মতো ছিল। পরে সেটিকে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়। মন্দিরটি সন্তোষ রায়চৌধরী বানানো শুরু করেছিলেন ১৭৯৯ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নাতি রাজীবলোচন রায়চৌধুরী ১৮০৯ সালে মন্দিরের কাজ সম্পন্ন করেন। বর্তমান এই মন্দিরটি নব্বই ফুট উঁচু। এটি নির্মাণ করতে আট বছর সময় লেগেছিল এবং খরচ হয়েছিল ৩০,০০০ টাকা। মন্দির সংলগ্ন জমিটির মোট আয়তন ১ বিঘে ১১ কাঠা ৩ ছটাক; বঙ্গীয় আটচালা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মূল মন্দিরটির আয়তন অবশ্য মাত্র ৮ কাঠা। মূল মন্দির সংলগ্ন অনেকগুলি ছোটো ছোটো মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ, শিব প্রভৃতি দেবতা পূজিত হন। কালীঘাট মন্দিরের নিকটেই পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর শিবের মন্দির। ১৮৫৪ সালে তারা সিং নামে জনৈক পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী বর্তমান নকুলেশ্বর মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। শিবরাত্রি ও নীলষষ্ঠী উপলক্ষ্যে এই মন্দিরে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। কালীমন্দিরের পশ্চিম দিকে রয়েছে শ্যামরায়ের মন্দির। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাওয়ালির জমিদার উদয়নারায়ণ মণ্ডল এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। এখানে রামনবমী ও দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৬২ সালে শবদাহের জন্য মন্দিরের অদূরে নির্মিত হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশান। বাংলার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে এই শ্মশানে। এখানকার শ্মশানকালী পূজা বিখ্যাত। সঙ্গের ছবিতে ১৮৮৭ সালের আদিগঙ্গা ও ঘাটের মন্দিরসমূহ।