প্রথম খণ্ডের শেষের দুটী কথা

প্রথম খণ্ডের শেষের দুটী কথা।

 এতদিনে আমার কর্ম্মতরু সম্পূর্ণরূপে ফলফুলে পূর্ণ হইয়া আমার অদৃষ্টাকাশে শাখা প্রশাখা বিস্তার করিয়া ছাইয়া উঠিল। এইবার সব ঠিক!

 কারণ কি তাহার কৈফিয়ৎ দিতেছি। অনেক দিবস হইল ৺গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের বিশেষ অনুরোধে আমার নাট্যজীবনী লিখিতে আরম্ভ করি; তিনি ইহার প্রতি ছত্র, প্রতি লাইন দেখিয়া শুনিয়া দেন; তিনি দেখিয়া ও বলিয়া দিতেন মাত্র, কিন্তু একছত্র কখন লিখিয়া দেন নাই। তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে আমি সরলভাবে সাদা ভাষায় যাহা লিখি তাঁহার নিকট সেই সকল বড় ভালই বলিয়া মনে হয়।

 এইরূপে আমার জীবনী লিখিয়া আমার কথা নাম দিয়া ছাপাইবার সঙ্কল্প করি। তিনিও এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগী হন। কিন্তু তিনি মধ্যে মধ্যে রোগ যাতনা ভোগ করিবার জন্য ও নানা ঝঞ্জাটে কতদিন চলিয়া যায়। পরে তাঁহার পরিচিত বাবু অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ছাপাইবার জন্য কল্পনা করেন। কিন্তু আমার কতক অসুবিধা বশতঃ হাঁ—না, এইরূপ নানা কারণে তখন হয় নাই। তাহার পর আমি মরণাপন্ন রোগগ্রস্ত হইয়া চারি মাস শয্যাগত হইয়া পড়িয়া থাকি; আমার জীবনের কোন আশাই ছিল না; শত শত সহস্র সহস্র অর্থ ব্যয় করিয়া, নানাবিধ চিকিৎসা শুশ্রূষা, দৈবকার্য্য করিয়া, প্রায় অনাহারে, অনিদ্রায় বহু অর্থ ব্যয়ে দেবতাস্বরূপ আমার আশ্রয়দাতা দয়াময় মহামহিমান্বিত মহাশয় আমায় মৃত্যুমুখ হইতে কাড়িয়া লইলেন। ডাক্তার, সন্ন্যাসী, ফকির, মোহন্ত, দৈবজ্ঞ, বন্ধু, বান্ধব সকলে একবাক্যে বলিয়াছিলেন, যে “মহাশয় সুধু আপনার ইচ্ছার জোরে (Will force) ইনি জীবন পাইলেন।” সেই দয়াময় তাঁহার ধন সম্পত্তি, তাঁহার মহজ্জীবন একদিকে; আর এই ক্ষুদ্র পাপিয়সীর কলঙ্কিত জীবন একদিকে করিয়া দারুণ ব্যাধির হস্ত হইতে আমায় রক্ষা করিলেন। আমি ব্যাধির যাতনায় বিগত নাড়ী হইয়া জ্ঞান হারাইলে, তিনি আমার মস্তকে হাত রাখিয়া স্নেহময় চক্ষুটী আমার চক্ষের উপর রাখিয়া, দৃঢ়ভাবে বলিতেন, “শুন, আমার দিকে চাহ; অমন করিতেছ কেন? তোমার কি বড় যাতনা হইতেছে? তুমি অবসন্ন হইও না! আমি জীবিত থাকিতে তোমায় কখন মরিতে দিব না। যদি তোমার আয়ু না থাকে তবে দেবতা সাক্ষী, ব্রাহ্মণ সাক্ষী, তোমার এই মৃত্যু তুল্য দেহ সাক্ষী, আমার অর্দ্ধেক পরমায়ু তোমায় দান করিতেছি, তুমি সুস্থ হও। আমি বাঁচিয়া থাকিতে তুমি কখনই মরিতে পাইবে না।

 সেই সময় তাঁহার চক্ষু হইতে যেন অমৃতময় স্নেহপূর্ণ জ্যোতিঃ বাহির হইয়া আমার রোগক্লিষ্ট যাতনাময় দেহ অমৃতধারায় স্নাত করাইয়া শীতল করিয়া দিত। সমস্ত রোগ-যাতনা দূরে চলিয়া যাইত। তাঁহার স্নেহময় হস্ত আমার মস্তকের উপর যতক্ষণ থাকিত আমার রোগের সকল যাতনা দূরে যাইত।

 এইরূপ প্রায় দুই তিনবার হইয়াছিল; দুই তিনবারই তাঁহারই হৃদয়ের দৃঢ়তায় মৃত্যু আমায় লইতে পারে নাই। এমন কি শুনিয়াছি অক‍্সিজেন গ্যাস দিয়া আমায় ১২৷১৩ দিন রাখিয়া ছিল। যাঁহারা সে সময় আমার ও তাঁহার বন্ধুবান্ধব ছিলেন, তাঁহারা এখনও সকলে বর্ত্তমান আছেন। সেই সময় মাননীয় বাবু অমৃতলাল বসু মহাশয়, উপেনবাবু, কাশীবাবু প্রভৃতি প্রতিদিন উপস্থিত থাকিয়া আমায় যত্ন করিতেন; সকলেই এ কথা জানিত।

 বুঝি এইরূপ সুস্থদেহে অসীম যাতনার বোঝা বহিতে হইবে বলিয়া, অতি হৃদয়শূন্য ভাবে লোকের নিকট উপেক্ষিত হইতে হইবে বলিয়া, অবস্থার বিপাকে এইরূপ দুশ্চিন্তায় পড়িতে হইবে বলিয়া; অসহায় অবস্থায় এইরূপ অসীম যাতনার বোঝা বুকে করিয়া সংসার সাগরে ভাসিতে হইবে বলিয়া, আমার দুরাদৃষ্ট তাঁহার বাসনার সহিত যোগ দিয়াছিল! বোধহয় তাহতেই সেই সময় আমার মৃত্যু হয় নাই। অথবা ঈশ্বর তাঁহার পরম ভক্তের বাক্যের ও কামনার সাফল্যের জন্যই আমায় মৃত্যুমুখ হইতে ফিরাইয়া দিলেন! কেননা আমার হৃদয়-দেবতা তিলেকে শতবার বলিতেন, যে “সংসারের কাজ করি সংসারের জন্য; শান্তি তো পাইনা; তাই বলিতেছি যে তুমি আমার আগে কখন মরিতে পাইবে না।” আমি যখন তাঁহার চরণে ধরিয়া কাতরে বলিতাম, এখন আর ও সকল কথা তুমি আমায় বলিও না। ত্রিসংসারে এ হতভাগিনীর তুমি বই আশ্রয় নাই। এ কলঙ্কিনীকে যখন সংসার হইতে তুলে আনিয়া চরণে আশ্রয় দিয়াছিলে তখন তাহার সকলই ছিল! মাতামহী, মাতা, জীবন জুড়ান কন্যা, রঙ্গভূমের সুখসৌভাগ্য, সুযশ, অশাতীত সম্পদ, বঙ্গ রঙ্গভূমের সমসাময়িক বন্ধুগণের অপরিসীম স্নেহ মমতা সকলই ছিল, তোমারই জন্য সকল ত্যাগ করিয়াছি; তুমি আমায় ত্যাগ করিয়া যাইও না। তুমি ফেলে গেলে আমি কোথায় দাঁড়াইব। তিনি হাসিয়া দৃঢ়তার সহিত বলিতেন, যে “সেজন্য ভেবনা, আমার অভাব ব্যতীত তোমার অন্য কোন অভাবই থাকিবে না। এমন বংশে জন্মগ্রহণ করি নাই যে এতদিন তোমায় এত আদরে, এত যত্নে আশ্রয় দিয়া, তোমার এই রুগ্ন, অসমর্থ অবস্থায় তোমার শেষ জীবনের দারুণ অভাবের মধ্যে ফেলিয়া চলিয়া যাইব। তাহার প্রমাণ দেখ যে আমার আত্মীয়দিগের সহিত একভাবে তোমায় আশ্রয় দিয়া আসিতেছি। এত জেনে শুনে সে তোমায় বঞ্চিত করিবে—আমার অভিশাপে যে উৎসন্ন যাইবে!

 তাঁহার মত সহৃদয় দয়াময় যাহা বলিবার তাহা বলিয়া সান্ত্বনা দিতেন, কিন্তু কার্য্যকালে আমার অদৃষ্ট, তীক্ষ অসি হস্তে আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, আমার জীবনভরা সমস্ত আশাকে ছেদন করিতেছে! আজ তিন মাস হইল এই অসহায়া অভাগিনী কাহারও নিকট হইতে তিন দিনের সহানুভূতি পাইল না; অভাগিনীর ভাগ্য! দোষ কাহারও নয়—কপাল! প্রাক্তনের ফল!! পাপিনীর পাপের শাস্তি!!!

 এই রোগ হইতে মুক্ত হইয়া আমি বৎসরাধিক উথানশক্তিহীন হইয়া জড়বৎ ছিলাম। পরে আমায় চিকিৎসকদিগের মতানুযায়ী বহুস্থানে, বহু জল-বায়ু পরিবর্ত্তন করাইয়া, হৃদয়দেবতা আমার সাস্থ্য সম্পূর্ণরূপে দান করিয়া গিয়াছেন।

 এইরূপ নানা অসুবিধায় এই পুস্তক তখন ছাপান হইল না। ৺গিরিশবাবুও দারুণ ব্যাধিতে স্বর্গে গমন করিলেন! তিনিও আমায় বলিয়াছিলেন, যে “বিনোদ! তুমি আমার নিজের হাতের প্রস্তুত, সজীব প্রতিমা! তোমার জীবন-চরিতের ভূমিকা আমি স্বহস্তে লিখিয়া তবে মরিব”; কিন্তু একটা কথা আছে, যে মানুষ গড়ে, আর বিধাতা ভাঙ্গে,” (“Man proposes but God disposes”) আমার ভাগ্যেই তাহা প্রত্যক্ষ, প্রমাণ।

 পরে ভাবিলাম যে যাহা হয় হইবে; বই হউক আর নাই হউক, আমার শেষ আকাঙ্ক্ষা বড়ই ছিল যে আমি আমার অমৃতময় আশ্রয়-তরুর সুশীতল সুধামাখা শান্তি ছাওয়াটুকু এই বেদনাময় ব্যথিত বুকের উপর প্রলেপ দিয়া চিরনিদ্রায় ঘুমাইয়া পড়িব; ঐ নিম্বার্থ স্নেহ ধারার আবরণে আমার কলঙ্কিত জীবনকে আবরিত রাখিয়া চলিয়া যাইব। ওমা! কথায় আছে কিনা? যে “আমি যাই বঙ্গে, আমার কপাল যায় সঙ্গে।” একটী লোক একবার তাহার অদৃষ্টের কথা গল্প করেছিল, এখন আমার তাহা মনে পড়িল। গল্পটী এই:—

 উপযুক্ত লেখাপড়া জানা একটি লোক স্বদেশে অনেক চেষ্টায় কোন চাকুরী না পাইয়া বড় কষ্ট পাইতেছিল। একদিন তাহার একটি বন্ধু বলিলেন, যে “বন্ধো। এখানে তো কোন সুবিধা করিতে পারিতেছ না, তবে ভাই একবার বিদেশে চেষ্টা দেখনা।” তিনি অনেক কষ্টে কিছু পাথেয় সংগ্রহ করিয়া রেঙ্গুন চলিয়া গেলেন। সেখানেও কয়েক দিন বিধিমতে চেষ্টা করিয়া কিছু উপায় করিতে না পারিয়া, একদিন দ্বিপ্রহর রৌদ্রে ঘুরিয়া এক মাঠের উপর বৃক্ষ তলায় ক্লান্ত হইয়া বসিয়া আছেন। এমন সময় তাঁহার মনে হইল যে রৌদ্রের উত্তপ্ত বাতাসের সহিত পশ্চাৎ দিকে কে যেন হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতেছে। সচকিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে গা?” উত্তর পাইলেন, “তোমার অদৃষ্ট”। তিনি বলিলেন, “বেশ বাপু! তুমিও জাহাজ ভাড়া করিয়া আমার সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছ? তবে চল, দেশে ফিরিতেছি, সেইখানেই আমায় লইয়া দড়িতে জড়াইয়া লাটু খেলিও।”

 আমিও একদিন চমকিত হইয়া দেখি যে আমার অদৃষ্টের তাড়নায়, আমার আশ্রয় স্বরূপ সুধামাখা শান্তি-তরু, মহাকালের প্রবল ঝড়ে কাল-সমুদ্রের অতল জল মধ্যে পড়িয়া ডুবিয়া যাইল! আমার সম্পূর্ণ ঘোর ছাড়িতে না ছাড়িতে দেখি যে আমি এক মহাশ্মশানের তপ্ত চিতাভস্মের উপর পড়িয়া আছি। আবাহকাল হইতে যে সকল হৃদয় অসীম যন্ত্রণার জ্বালায় জ্বলিয়া পুড়িয়া চিতার ছাইয়ে পরিণত হইয়াছে; তাহারাই আমার চারিধার ঘেরিয়া আমার বুকের বেদনাটাকে সহানুভূতি জানাইতেছে। তাহারা বলিতেছে, “দেখ, কি করিবে বল? উপায় নাই! বিধাতা দয়া করেনা, বা দয়া করিতে পারেনা। দেখ, আমরাও জ্বলিয়াছি, পুড়িয়াছি, তবুও যায় নাই গো! সে সব জ্বালা যায়। নাই! শ্মশানের চিতা ভস্মে পরিণত হয়েও সে স্মৃতির জ্বালা যায় নাই! কি করিবে? উপায় নাই!

 তবে যদি কোন দয়াময় দেবতা, মানুষ হইয়া বা বৃক্ষরূপ ধরিয়া সংসারে আসেন, তাঁহারা কখন কখন তোমার মত হতভাগিনীকে শান্তি-সুধা দানে সান্ত্বনা দিতে পারেন। তাঁরা দেবতা কি না? পৃথিবীর লোকের কথার ধার ধারেন না। আর কুটিল লোকের কথায় তাঁহাদের কিছু আসে যায় না! সূর্যের আলোক যেমন দেব-মন্দির ও আঁস্তাকুড় সমভাবেই আলোকিত করে—ফুলের সৌরভ যেমন পাত্রাপাত্র বিচার না করিয়া সমভাবে গন্ধ বিতরণ করে—ইঁহারাও তেমনই সংসারের হিংসুক, নিন্দাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর লোকদিগের নিন্দা বা সুখ্যাতির দিকে ফিরেও চাহেন না।

 তাঁহারা দেবলোক হইতে অপরিসীম স্নেহ সূর্ণ সুধামাখা আত্মানন্দময় হৃদয় লইয়া মর্ত্যভূমে দুঃখীর প্রতি দয়া করিবার জন্য, আত্মীয় স্বজনের প্রতি সহৃদয়তা দেখাইবার কারণ, বন্ধুর প্রতি সমভারে সহানুভূতি করিবার ইচ্ছায়, সন্তানের প্রতি পরিপূর্ণ বাৎসল্য স্নেহ প্রদানে লালন পালন করিতে, পত্নীর প্রতি সতত প্রিয়ভাষে প্রেমদানে তুষ্ট করিতে, আজ্ঞাকারীর ন্যায় সকল অভাবপূর্ণ করিবার জন্য সতত প্রস্তুত! প্রণয়িনীর নিকট অকাতরে প্রেমময় হৃদয়খানি বলি দিতে—ভালবাসার, আকাঙিক্ষতাকে আপনাকে ভুলিয়া ভালবাসিতে—আশ্রিতকে সন্তুষ্টচিত্তে প্রতিপালন করিতে—পাত্রাপাত্র অভেদজ্ঞানে আকাঙিক্ষতের অভাবপূর্ণ করিবার জন্য অযাচিতভাবে লুকাইয়া দান করিতে (কত সঙ্কুচিত হ’য়ে, যদি কেহ লজ্জা পায়)—ভগবানে অটল ভক্তি রাখিবার বাসনাকে হৃদয়ে স্থান দিতে— আত্মসুখ ভুলিয়া দেবসেবা ব্রতে সুখী হইতে— প্রাণ ভরিয়া অক্লান্ত হৃদয়ে পরোপকার করিতে আইসেন। ওগো তোমাকে আর কতই বা বলিব! তাঁহাদের তুলনা সুধু তাঁহারাই—যাহা লইয়া দেবলোকে দেবতা গঠিত হইয়া থাকে, তাঁহারা সেখানকার সেই সকলই লইয়া এই যন্ত্রণাময় মরজগতে অতি দুঃখীকে দয়া করিতে আইসেন। সংসারের গতিকে ক্রূর হৃদয়ের বিষদৃষ্টিতে যখন সেই মানবরূপ দেবতা বা তরুবর অবসন্ন হইয়া পড়েন, তখনই চলিয়া যান। যে অভাগা ও অভাগিনীরা সেই পবিত্র হাওয়ার কোলে আশ্রয় পাইয়া চিরদিনের মত ঘুমাইয়া পড়ে, সংসারের যাতনাময় কোলাহলে আর না জাগিয়া উঠে তাহারাই হয় তো সেই দেবহৃদয়ের পবিত্রতার স্পর্শে শান্তিধামে যাইতে পারে; আবার যাহারা অষ্টের দোষে সেই শান্তি-সুধাময় তরুচ্ছায়া হইতে বঞ্চিত হয়; তাহারা ই এই তোমার মত যাতনায় পোড়া শ্মশানের চিতাভস্মের উপর পড়িয়া গড়াগড়ি যায়। তোমার মত দুর্ভাগিনীদের আর উপায় নাই গো! যাহারা অমূল্য রত্ন পাইয়াও হারাইয়া ফেলে, তাদের উপায় নাই। আর তোমাদের মত পাপিনীদের হৃদয় বড় কঠিন হয় ও হৃদয় শীঘ্র পুড়েও না, ভাঙ্গেও না, অত জ্বালায় লোহাও গলিয়া যায়। তোমার মত হতভাগিনী বুঝি আমাদের মধ্যেও নাই, ও রকম কঠিন পাষাণ হৃদয়ের কোন উপায় নাই; তা কি করিবে বল? এই সকল কথা বলিয়া সেই জ্বালা যন্ত্রণায় পোড়া হৃদয়ের চিতাভস্মগুলি হায়! হায়! করিয়া উঠিল। তাহাদের সেই ভস্ম হইতে হায়! হায়! শব্দ শুনিয়া আমার তখন ক্ষাণিকটা চৈতন্য হইল। মনের মধ্যে একটা বৈদ্যুতিক আঘাতের মত আঘাত লাগিল, মনে পড়িল যে আমিও তো ঐরূপ একটি সুধাময় তরুর সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় পাইয়াছিলাম। তবে বুঝি সে তরুবরটী ঐ রকম দেবতাদের জীবনীশক্তি দ্বারা পরিচালিত “দেবতরু!” ঐ চিতাভস্মগুলি যে সকল গুণের কথা বলিলেন, তাহা অপেক্ষাও শত সহস্র গুণে সেই দেবতার হৃদয় পরিপূর্ণ ছিল। দয়ারসাগর, সরলতার আধার, আনন্দের উচ্ছাসিতপূর্ণ ছবি, আত্মপরে সমভাবে প্রিয়বাদিতা, সতত হাস্যময়, প্রেমের সাগর, আপনাতে আপনি বিভোর, কনকোজ্জ্বল বরণ সুন্দর, রূপে মনোহর, বিনয় নম্রতা বিভূষিত, সুধামাখা তরুবর! শুনিয়াছিলাম যে দেবতারাই অনাথ প্রাণীকে সময়ে সময়ে দয়া করিতে বৃক্ষ বা মানবরূপ ধরিয়া সংসারে আসেন। সেইজন্য শ্রীরামচন্দ্র, গুহক চণ্ডালকে মিতে ব’লে স্নেহ করিয়াছিলেন। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, দাসীপুত্র বিদুরের ঘরে ক্ষুদ খেয়েছিলেন। মহাপ্রভু চৈতন্য দেবও যবন হরিদাসকে দয়া করিয়াছিলেন। দুঃখী অনাথকে দয়া করিতে কি দোষ আছে গা? কাঙ্গালকে আশ্রয় দিলে কি পাপ হয় গা? লৌহের স্পর্শে কি পরেশ পাথর মলিন হয়? না কয়লার সংস্রবে হীরকের উজ্জ্বলতা নষ্ট করে?

 স্বর্গের চাঁদ যে পৃথিবীর কলঙ্কের বোঝা বুকে করিয়া সংসারকে সুশীতল আলোক বিতরণে সুখী করিতেছেন, থিবীর লোকেরা তাহারই আলোকে উৎফুল্ল হইয়া “ঐ কলঙ্কি চাঁদ ঐ কলঙ্কি চাঁদ” বলিয়া যতই উপহাস করিতেছে, তিনি ততই রজত ধারায় পৃথিবীতে কিরণ-সুধা ঢালিয়া দিতেছেন; আর স্বর্গের উপর বসিয়া হাসিয়া হাসিয়া, ভাসিয়া ভাসিয়া খেলা করিয়া বেড়াইতেছেন।

 আমিও তো তবে ঐ দেবতারূপ তরুবরের আশ্রয় পাইয়াছিলাম! কৈ সেই আমার আশ্রয়স্বরূপ দেবতা? কৈ—কোথায়? আমার হৃদয়-মরুভূমির শান্তি-প্রস্রবণ কোথায়? হু হু করিয়া শ্মশানের চিতাভস্ম মাখা বাতাস উত্তর করিল, “আঃ পোড়া কপালি, এখনও বুঝি চৈতন্য হয় নাই? ঐ শুন চৈত্র মাসের ৺বাসন্তি পূজার নবমীর দিনে, মহাপুণ্যময় শ্রীরাম নবমীর শুভ তিথির প্রভাত কালে ৭ টার সময় সূর্য্যদেব অরুণ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া, রক্তিম ছটায় কিরণ বহিয়া, পবিত্র জাহ্নবীকূল আলোকিত করিয়া, ধরায় নামিলেন কেন, তাহা বুঝি দেখিতেছ না? পবিত্র ভাগিরথী আনন্দে উথলিয়া, হাসিয়া হাসিয়া, সাগর উদ্দেশে কেন ছুটিতেছে, তাহাও বুঝি দেখিতেছ না? ৺জীউ; গোপাল-মন্দির হইতে ঐ যে পূজারি মহাশয় ৺জীউর মঙ্গল-আরতি সমাধা করিয়া প্রসাদি পঞ্চপ্রদীপ লইয়া ঐ কাহাকে মঙ্গল-আরতি করিয়া ফিরিয়া যাইতেছেন, চারিদিকে এত হরিসঙ্কীর্ত্তন, হরিনামধ্বনি, এত ব্রহ্মনামধ্বনি কেন গা? একি? সুরধুনির তীরে দেবতারা আসিয়াছেন নাকি? প্রভাতি-পুষ্পের সৌরভ বহিয়া বায়ু ঘুরিয়া বেড়াইতেছে? দেবমন্দিরে এত শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনি কেন? কিরণ ছটা অবলম্বন করিয়া সূর্য্যদেব কাহার জন্য স্বর্গ হইতে রথ লইয়া আসিয়াছেন? তাহাও কি বুঝিতেছ না?”

 চমকিত হইয়া চাহিয়া দেখি, ওমা! আমারই আজ ৩১ বৎসরের সুখ-স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া যাইল! এই দীনহীনা দুঃখী প্রাণী আজ ৩১ বৎসরের যে রাজ্যেশ্বরীর সুখ-স্বপ্নে বিভোর ছিল, মহাকালের ফুৎকারে ১২ ঘণ্টার মধ্যে তাহা কালসাগরের অতল জলে ডুবিয়া গেল! অচৈতন্য হইয়া পড়িয়া মস্তকে প্রস্তরের আঘাত পাইলাম, শত সহস্র জোনাকি-বৃক্ষ যেন চক্ষের উপর দিয়া ঝক্ মকিয়া চলিয়া গেল!

 আবার যখন চৈতন্য হইল, তখন মনে পড়িল যে আমি “আমার কথা” বলিয়া কতকগুলি মাথামুণ্ড কি লিখিয়াছিলাম। তাহার শেষেতে এই লিখিয়াছিলাম যে আমি “মৃত্যুমুখ চাহিয়া বসিয়া আছি। মৃত্যুর জন্য তত লোকে আশা করিয়া থাকে, সেও তো জুড়াবার শেষের আশা!

 ওগো! আমার আর শেষও নাই, আরম্ভও নাই গো! ১৩১৮ সালের চৈত্র মাসের ১৪ই বুধবারের প্রাতঃকালে সে আশাটুকু গেল!

 মরিবার সময় যে শাস্তিটুকু পাইবার আশা করিয়াছিলাম তাহাও গেল, আর তো একেবারে মৃত্যু হবে না গো, হবে না! এখন একটু একটু করিয়া মৃত্যুর যাতনাটি বুকে করিয়া চিতাভস্মের হায়—হায় ধ্বনি শুনিতেছি। আর দেবতারূপ তরুবরের আশ্রয় হইতে বঞ্চিত হইয়া এই মহাপাতকিনীর কর্ম্মফলরূপ সুবিশাল শাখা প্রশাখা ফুল ও ফলে পূর্ণতরুতলে বসিয়া আছি গো!

 পৃথিবীর ভাগ্যবান লোকেরা শুন, শুনিয়া ঘৃণায় মুখ ফিরাইও। আর ওগো অনাথিনীর আশ্রয়-তরু, স্বর্গের দেবতা, তুমিও শুন গো শুন! দেবতাই হোক, আর মানুষই হোক্; মুখে যাহা বলা যায় কার্য্যে করা বড়ই দুষ্কর! ভালবাসায় ভাগ্য ফেরেনা গো, ভাগ্য ফেরেনা!! ঐ দেখ আবার চিতাভস্মগুলি দূরে দূরে চলে যাচ্ছে, আর হায় হায় করিতেছে।

 এই আমার পরিচয়। এখন আমি আমার ভাগ্য লইয়া শ্মশানের যাতনাময় চিতাভস্মের উপর পড়িয়া আছি! এখন যেমন একটা অযাত্রার জিনিস দেখিলে কেহ রাম, রাম, কেহ কেহ শিব, শিব, কেহ বা দুর্গা, দুর্গা বলেন, আবার কেহ মুখ ঘুরাইয়া লইয়া হরি, হরি বলিয়া পবিত্র হয়েন। যাঁহার যে দেবতা আশ্রয়, তিনি তাঁহাকে স্মরণ করিয়া এই মহা পাতকীর পাপ কথাকে বিস্মৃত হউন। ভাগ্যহীনা, পতিতা কাঙ্গালিনীর এই নিবেদন। ইতি—১১ই বৈশাখ, ১৩১৯ সাল, বুধবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *