প্রথম অধ্যায় – সূচনা

প্রথম অধ্যায় – সূচনা

কামরূপ ও রাক্ষিয়াং[১] দেশের মধ্যবর্তী স্থানকে প্রাচীন আর্য্যগণ সুহ্ম আখ্যা দান করেন। ইহার অন্য নাম কিরাত দেশ। বিষ্ণুপুরাণে লিখিত আছে, ভারতের “পূর্বদিকে কিরাতের বাস।” সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, লৌহিত্যবংশীয় মানবদিগকে আর্য্য ঋষিগণ কিরাত আখ্যায় অভিহিত করিয়াছেন। তদনন্তর কিরাত ভূমি “তৃপুরা” আখ্যা প্রাপ্ত হয়। এই “তৃপুরা” শব্দ হইতে ক্রমে ত্রীপুরা এবং “ত্রীপুরা” হইতে ত্রিপুরা শব্দের উৎপত্তি।

তৃপুরা শব্দের মূল নির্ণয় করা সুকঠিন। তন্ত্র ও পুরাণ (১) আলোচনা দ্বারা বিবিধ প্রকার সিদ্ধান্ত অনুমান করা যাইতে পারে, “ত্রিপুরাসুর হইতে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি কিম্বা ত্রিপুরাসুর নির্মিত তিনটি পুরী হইতে ত্রিপুরা নামের উদ্ভব; অথবা ভগবতী ত্রিপুরাসুন্দরী হইতে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি কিম্বা রাজবংশের স্থাপন কর্তার নামানুসারে এই দেশ ত্রিপুরা আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে।”[২] এই সকল সিদ্ধান্ত আমাদের বিবেচনায় নিতান্ত অযৌক্তিক। যে অনার্য্য কিরাতদিগকে আমরা “তিপ্রা” (ত্রিপুরা) আখ্যায় পরিচিত করিয়া থাকি, তাহাদের জাতীয় ভাষায় জলকে “তুই” বলে।[৩] এই তুই শব্দের সহিত “প্রা” সংযুক্ত করিয়া “তুইপ্রা” শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে। (২) সেই তুইপ্রা হইতে তিপ্রা, এবং তিপ্রা হইতে ক্রমে তৃপুরা, ত্রীপুরা ও ত্রিপুরা শব্দের উৎপত্তি।

কবিচুড়ামণি কালিদাস রঘুবংশে সুহ্মদেশকে মহাসাগরের “তালিবন শ্যাম উপকণ্ঠ” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। চীন পরিব্রাজক হিয়োনসাঙের ভ্রমণ বৃত্তান্ত “সি-উ-কি” গ্রন্থে কমলাঙ্ক (কুমিল্লা) সাগর তীবরর্ত্তী দেশ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে।[৪] আমাদের বিবেচনায় অনার্য্য কিরাতগণ এই জল অর্থাৎ সমুদ্রের তীরবর্ত্তী দেশকে “তুইপ্রা” আখ্যা প্রদান করিয়াছিল। সেই তুইপ্রা কিরূপে তিপ্রা (ত্রিপুরা) শব্দে পরিণত হইয়াছে তাহা পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে।

অধুনা ২৪৯১ বর্গ মাইল বিস্তৃত একটি জেলা এবং ৪০৮৬ বর্গ মাইল বিস্তৃত একটি পার্বত্য রাজ্য ত্রিপুরা নামে পরিচিত; কিন্তু প্রাচীন সুহ্ম বা ত্রিপুরার পরিমাণ ৭৫০০০ বর্গ মাইল (৩) অপেক্ষা ন্যুন ছিল বলিয়া বোধ হয় না। তৎকালে সমগ্র কুকি প্রদেশ, মিতাই (মণিপুর) রাজ্য, কাছাড়, শিলহট্ট (শ্রীহট্ট), চট্টগ্রাম ও নওয়াখালী এই সুহ্ম বা ত্রিপুরার অন্তর্নির্বিষ্ট ছিল।

কিঞ্চিদূন পঞ্চশতাব্দী পূর্বে, যৎকালে মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্যের সভাপণ্ডিত ব্ৰাহ্মণ কুলজাত শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর “রাজমালা” রচনা করেন তৎকালে তাঁহারা ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা এইরূপ নির্দ্দেশ করিয়াছেন :

কিরাত নগরে রাজা বিধির গঠন।
রাজ্যের সীমানা কহি শুনহ বচন।।
উত্তরে তৈরঙ্গ নদী দক্ষিণে রসাঙ্গ।
পূর্বেতে মেখলি সীমা পশ্চিমে কাচবঙ্গ।
ত্রিবেগ স্থানেতে রাজা করিল এক পুরী।
নানামত নির্ম্মাইল পুরীর চত্তারি।।

-প্রাচীন রাজমালা।

উত্তরে তৈরঙ্গ নদী, দক্ষিণে রসাঙ্গ (আরাকান), পূর্ব সীমা মেখলী (মনিপুরী দিগেরনিবাস দুন[৫] পশ্চিমে এই রাজ্যের সীমা বঙ্গের সহিত সংলগ্ন।

রাজমালার উল্লেখিত বর্ণনা দ্বারা সমগ্র কুকি (লুছাই) প্রদেশ, মনিপুরের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকস্থ পার্বত্য প্রদেশ, মধ্য ও দক্ষিণ কাছাড়, শ্রীহট্টের দক্ষিণাংশ, ময়মনসিংহের দক্ষিণ (৪) পূর্বাংশ, ঢাকার পূর্বাংশ, সমগ্র নওয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা ত্রিপুরার অন্তর্গত হইতেছে। আধুনিক ত্রিপুরা রাজ্য ও ত্রিপুরা জেলার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা গ্রন্থকারের অভিপ্রায় হইলেও প্রাচীন ত্রিপুরার সীমান্তর্গত স্থান সমূহ উপেক্ষিত হইবে না।

ব্রহ্মার প্রাচীন ইতিহাস মহারাজোয়াং গ্রন্থে ত্রিপুরা রাজ্য পাটিকাড়া আখ্যা দ্বারা পরিচিত হইয়াছে; কিন্তু বর্ত্তমান শতাব্দীর প্রারম্ভে ব্রহ্মরাজ তরফুমা ত্রিপুরাপতিকে অমরপুরের[৬] অধিপতি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস “রাজোয়া” গ্রন্থে ত্রিপুরাকে “থুরতন” লেখা হইয়াছে। মিতাই (মণিপুরী) গণ ইহাকে “তলেঙ” রাজ্য বলিত। মিনহাজ, জইয়েবারণি প্রভৃতি প্রাচীন মুসলমান ইতিহাস লেখকগণ ত্রিপুরাকে “জাজনগর” বা “জাজিনগর” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। এইরূপে ভিন্ন ভিন্ন দেশীয় ইতিহাসে ত্রিপুরা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত হইয়াছে। (৫)

.

টীকা

১. রাক্ষিয়াং অর্থ রাক্ষসের নিবাসভূমি। প্রাচীন বঙ্গবাসিগণ ইহাকে রসাঙ্গ বলিতেন। পাশ্চাত্য বণিকগণ ইহাকে আরাকান করিয়াছেন।

২. ত্রিপুরার ভূতপূর্ব কালেক্টর সাউদারলেন্ড সাহেব ত্রিপুরা নামোৎপত্তির এক আশ্চর্য্য ও কল্পিত ইতিহাস প্রকাশ করিয়াছেন। (Calcutta Review Vol. XXXV. p 325) তদনন্তর স্মার্ট সাহেব স্বীয় রিপোর্টে তাহাই ঘোষণা করিয়াছেন। (Smart’s Report on the District of Tipperah. p. 1 ) কাপ্তান লেউইন তাহাই উদ্ধৃত করিয়াছেন। (Lewin’s Hill Tracts of Chittagong. p 79) তৎপর খ্যাতনামা হন্টার সাহেব সেই অমূলক বর্ণনা স্বীয় গ্ৰন্থ মধ্যে সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন। (Statastical Account of Bengal Vol. VI. p. 357 )

৩. এই তুই শব্দ সংস্কৃত “তোয়” শব্দের অপভ্রংশ কিনা তাহা বিশেষ বিবেচ্য, কারণ ত্রিপুরা জাতির পূর্ব ও দক্ষিণদিগবাসী কুকি, কুইমি, মুরু, খেয়াং, বঞ্জুগী ও পংখু জাতি জলকে তুই বা তোই বলে। কেবল সিন্ধুগণ ‘তি’ বলিয়া থাকে। সিন্ধুগণ দ্বারা ‘তিপ্রা’ নামকরণও নিতান্ত বিচিত্র নহে।

৪. Cunningham’s Ancient Geography of India. Page 503. প্রফেসার বিল, সি-উ-কির অনুবাদ (Buddhist Records of the Western World) গ্রন্থে বাঙ্গালার অন্তর্গত স্থান সমূহের স্থিতি নির্ণয় করিতে যাইয়া সর্বত্রই ভ্রমমার্গে পাদবিক্ষেপ করিয়াছেন। বোধহয় তিনি ডাক্তার ফারগুসনের প্রদর্শিত ভ্রমাত্মক বর্থে বিচরণ করিয়াছেন। (J. R. A. S (N. S) Vol. VI p 213 ff)

৫. দুন- Valley.

৬. অমরপুর অমরমাণিক্যের রাজধানী, নিবিড় অরণ্য মধ্যে গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত। ত্রিপুরার অন্যান্য রাজধানী অপেক্ষা অমরপুর ব্রহ্মার নিকটবর্তী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *