প্রথম অধ্যায়—মধুকৈটভ বধ

প্রথম অধ্যায়—মধুকৈটভ বধ

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, যে সূর্য্যতনয় সাবর্ণি অষ্টম মনু বলিয়া কথিত হন, তাঁহার উৎপত্তি বৃত্তান্ত এবং সে‌ই মহাভাগ রবিতনয় সাবর্ণি যেরূপে মহামায়াপ্রভাবে মন্বন্তরাধিপতি হ‌ইয়াছিলেন, তৎসমূদয় আমি সবিস্তারে বলিতেছি, শ্রবণ কর। পূর্ব্বে স্বারোচিষ মন্বন্তরে, চৈত্রবংশ-সমুদ্ভূত সুরথ নামক রাজা, সমুদয় ক্ষিতিমন্ডলের অধিপতি হন। তিনি প্রজাগণকে ঔরসপুত্র সদৃশ পালন করিতেন। তৎকালে কোলাবিধ্বংসকারী (শূকরভোজী ম্লেচ্ছ জাতিবিশেষকে ধ্বংসকারী) ভূপালবর্গ তাঁহার শত্রু হ‌ইয়াছিল। তৎপরে সে‌ই ভূপালবর্গের সহিত উদ্ধতগণের দমনকারী সুরথ ভূপতির যুদ্ধ ঘটে। কোলাবিধ্বংসকারী ভূপতিগণ অনেকাংশে হীন হ‌ইয়াও তাঁহাকে যুদ্ধে পরাজিত করে। অনন্তর পরাজিত সুরথ রাজা স্বপুরে আগমন করিয়া নিজ দেশের‌ই অধিপতি হ‌ইয়া রহিলেন; কিন্তু তৎকালেও সে‌ই প্রবল শত্রুগণ তাঁহাকে আক্রমণ করিল। নিজ পুরেও দুষ্ট জঘন্য-স্বভাব বলবান অমাত্যবর্গ, তখন দুর্ব্বল সুরথ রাজার ধনাগার ও সৈন্য হস্তগত করিল। তদনন্তর হৃতাধিকার সে‌ই সুরথ রাজা, অশ্বারোহণ করিয়া একাকী গহন বনে গমন করিলেন। রাজা সে‌ই গহন বনমধ্যে দ্বিজশ্রেষ্ঠ মেধা মুনির আশ্রম দেখিলেন। সে‌ই আশ্রম হিংসাহীন শ্বাপদগণে বেষ্টিত ও মুনিশিষ্যবর্গে উপশোভিত ছিল। ১-৯

সে‌ই মুনিশ্রেষ্ঠের আশ্রমে মুনি কর্ত্তৃক সৎকৃত (আপ্যায়িত) হ‌ইয়া রাজা সুরথ ইতস্ততঃ বিচরণ করত কিছুকাল অবস্থিতি করিলেন। তিনি সে‌ই সময় সেখানে মায়ামূঢ়চিত্ত হ‌ইয়া এ‌ই প্রকার চিন্তা করিতে লাগিলেন,— “আমার অসচ্চরিত্র সে‌ই ভৃত্যবর্গ আমার পূর্ব্বপুরুষগণের পালিত, এক্ষণে মৎপরিত্যক্ত সে‌ই পুরীকে ধর্ম্মের সহিত কি পালন করিতেছে? জানি না, সদা-মদযুক্ত, আমার সে‌ই প্রধান শূরহস্তী শত্রুগণের বশ্য হ‌ইয়া এক্ষণে কি প্রকার ভোগ প্রাপ্ত হ‌ইতেছে? প্রতিদিবস মৎপ্রদত্ত প্রসাদ, ধন ও অন্নাদি দ্বারা আমার অনুগত ভৃত্যবর্গ অদ্য নিশ্চয়‌ই অন্য রাজগণের উপাসনা করিতেছে। অনিয়মিতরূপে সর্ব্বদা ব্যয়কারী সে‌ই দুষ্ট অমাত্যগণ, অতি দুঃখে সঞ্চিত আমার সে‌ই ধনরাশি নিশ্চয়‌ই ক্ষয় করিতেছে।” সুরথ রাজা এ‌ই প্রকার ও অন্যান্য নানা প্রকার চিন্তা করিতে লাগিলেন। অনন্তর রাজা সে‌ই মুনির আশ্রমনিকটে এক বৈশ্যকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “অহে! তুমি কে? এবং তোমার এখানে আসিবার কারণ‌ই বা কি? শোকযুক্তের ন্যায় তোমাকে দুর্ম্মনা (চিন্তিত) দেখিতেছি কেন?” ১০-১৬

রাজার এ‌ই প্রকার প্রণয়যুক্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া, বৈশ্য বিনয়াবনত হ‌ইয়া রাজাকে প্রত্যুত্তর করিল, আমি ধনীদিগের কুলে উৎপন্ন, সমাধিনামা বৈশ্য। অসাধু পুত্র, দারা ও স্বজনবর্গ, ধনলোভে আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছে। তাহারা আমার ধন সকল গ্রহণ করিয়া আমাকে পরিত্যাগ করিলে, আমি পুত্র, দারা, বিশ্বস্ত বন্ধু ও ধনবিহীন হ‌ইয়া দুঃখে বনে আগমন করিয়াছি। এস্থলে থাকিয়া আমি পুত্র, দারা ও বন্ধুবর্গের কোন মঙ্গলামঙ্গল বার্ত্তা জানিতে পারিতেছি না; এক্ষণে তাহাদের গৃহে মঙ্গল ঘটিয়াছে, কি ঘটিয়াছে, আমার পুত্রগণ এক্ষণে সদাচারী কিংবা দুরাচার-পরায়ণ হ‌ইয়াছে, এ সকল কিছুই জানিতে পারিতেছি না। ১৭-২১

রাজা কহিলেন, যে পুত্রদারাদিগণ লোভপরবশ হ‌ইয়া তোমার ধনাদি হরণ করিয়াছে, তাহাদিগের উপর‌ই তোমার মন কি প্রকারে স্নেহযুক্ত হ‌ইতেছে? বৈশ্য কহিল, আপনি আমার সম্বন্ধে যাহা বলিলেন, তাহা সত্য বটে, কিন্তু আমি কি করিব! আমার মন কোন প্রকারে‌ই নিষ্ঠুর হ‌ইতেছে না! যে পুত্রগণ ধনলোভে, পিতৃস্নেহ বিসর্জ্জন করিয়া আমাকে দূর করিল, যে পত্নীগণ পতিপ্রেম ও বন্ধুগণ বন্ধু-সৌহার্দ্দ পরিত্যাগ করিয়া আমাকে গৃহ হ‌ইতে নিরাকৃত (নিষ্কাশিত) করিল, সে‌ই দুর্ব্বৃত্ত পুত্র দারা ও বন্ধুবর্গের প্রতি‌ই আমার মন অনুরক্ত। মহামতে! প্রতিকূল বন্ধুবর্গের উপর আমার চিত্ত কেন যে প্রেমপ্রবণ হয়, আমি তাহা বুঝিয়াও বুঝিতে পারিতেছি না। তাহাদের জন্য এ‌ই দীর্ঘনিশ্বাস ও এ‌ই দুর্ম্মনস্কতার (উদ্বেগের) উৎপত্তি। আমার মন যে সে‌ই প্রীতিশূন্য পুত্রাদির উপর নিষ্ঠুর হ‌ইতেছে না, আমি ইহার কি প্রতিবিধান করিব? ২২-২৬

মার্কণ্ডেয় বলিলেন, তৎপরে রাজা সুরথ ও সমাধি নামক বৈশ্য, উভয়ে একত্রে সে‌ই মেধা মুনির নিকটে উপস্থিত হ‌ইলেন। অনন্তর রাজা ও বৈশ্য মুনির যথোচিত সম্মানপূর্ব্বক পূজ্যানুক্রমে উপবেশন করিয়া তাঁহার সহিত নানাপ্রকার কথা কহিতে লাগিলেন। রাজা বলিলেন, ভগবন্‌! যে বিষয়টী আমি বুঝিতে পারিতেছি না বলিয়া, আমার মন দুঃখিত রহিয়াছে, সে‌ই বিষয় আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করিতেছি; আপনি আমাকে তাহা বুঝাইয়া বলুন। আমি বুঝিতেছি যে, ইহা ভ্রম; তথাপি অজ্ঞের ন্যায় আমার রাজ্য ও অখিলরাজ্যাঙ্গের উপর এতাদৃশ মমতা। হে মুনিশ্রেষ্ঠ! ইহা কিরূপ? আর এ‌ই বৈশ্যকে ইহার পুত্রগণ অবমানিত (অপমানিত) করিয়াছে; দারা, ভৃত্য ও বন্ধুবর্গ পরিত্যাগ করিয়াছে; তথাপি এ‌ই ব্যক্তি সে‌ই সকল দুষ্ট পুত্রাদির উপর অনুরক্ত; এ‌ই প্রকার আমি ও এ‌ই বৈশ্য, উভয়ে‌ই এ‌ইরূপ পরিদৃশ্যমান দোষপূর্ণ বিষয়ে মমতাযুক্তমানস হ‌ইয়া সাতিশয় দুঃখ পাইতেছি। হে মহাভাগ! আমরা উভয়ে জ্ঞানী হ‌ইয়াও যে এ প্রকার বিবেকান্ধের ন্যায় মোহ প্রাপ্ত হ‌ইতেছি, ইহার কারণ কি? ২৭-৩৩

ঋষি কহিলেন, সমস্ত জন্তুর‌ই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান আছে। হে মহাভাগ! বিষয় সমুদয় এবং বিষয়জ্ঞানসম্পাদক ইন্দ্রিয়গণও পরস্পর বিভিন্নস্বভাব। দেখুন, কোন কোন প্রাণী দিবসে দেখিতে পায় না, কেহ কেহ বা রাত্রিতে দেখিতে পায় না, আবার কেহ কেহ বা দিবারাত্রে তুল্যদৃষ্টি। আপনি যে প্রকার জ্ঞানের কথা কহিতেছেন, মনুষ্যগণের এরূপ জ্ঞান আছে বটে, কিন্তু কেবল মনুষ্যমাত্র‌ই যে এ প্রকার জ্ঞানের অধিকারী, তাহা নহে; যেহেতু পশুপক্ষী ও মৃগাদিও এরূপ জ্ঞানবান হয়। বিষয়গোচর জ্ঞান যে প্রকার পশু পক্ষী প্রভৃতির আছে, মনুষ্যেরও সে‌ই প্রকার আছে এবং মনুষ্যগণেরও বিষয়গোচর যে জ্ঞান আছে, পশুপক্ষীদিগেরও তাহা‌ই আছে; সুতরাং এ প্রকার জ্ঞান মনুষ্য ও ইতর প্রাণীদিগের সমান। এ প্রকার জ্ঞান থাকিলেও পরস্পরে বিষয়ের কত বিভিন্নতা দেখুন। এ‌ই পক্ষিগণ ক্ষুধাতে পীড়িত, তথাপি স্বকীয় শাবক সকলের চঞ্চুতে ধান্যকণাদি প্রদান করিতে কত‌ই যত্নবান! আর হে মনুজশ্রেষ্ঠ! মনুষ্যগণ নিজ সুতগণের (পুত্রদের) প্রতি অভিলাষী হ‌ইয়া তাহাদিগের ভরণপোষণ করিতেছে। মনুষ্যগণ কেবল প্রত্যুপকার জন্য লোভে এ প্রকার করিতেছে, ইহা কি দেখিতেছেন না? ৩৪-৩৯

এ‌ইরূপ উপকারাদির প্রত্যাশা না থাকিলেও মহামায়ার সংসার-স্থিতিকারী প্রভাবে সর্ব্বপ্রাণী বাসনারূপ আবর্ত্তময় মোহগর্ত্তে নিপতিত হ‌ইতেছে। সে‌ইজন্য এ বিষয়ে বিস্ময় করা উচিত নহে। মহামায়া, জগৎপতি হরির যোগ-নিদ্রাস্বরূপা; তিনি এ‌ই জগৎকে মোহিত করিতেছেন। সে‌ই ভগবতী মহামায়া‌ই জ্ঞানীদিগের চিত্ত সকল বলপূর্ব্বক আকর্ষণ করিয়া মোহে নিক্ষেপ করিতেছেন। সে‌ই দেবী এ‌ই সচরাচর জগৎ (স্থাবর জঙ্গমাত্মক বা স্থির এবং গতিশীল অর্থাৎ জড় ও জীব, চেতন ও অচেতন মিলিয়ে এ‌ই সমগ্র জগৎ) সৃজন করিয়াছেন। তিনি‌ই প্রসন্না হ‌ইয়া মনুষ্যদিগের মুক্তিপ্রদ বর দান করেন। তিনি‌ই মুক্তির উৎকৃষ্ট হেতুস্বরূপা সনাতনী ব্রহ্মজ্ঞানস্বরূপা বিদ্যা। তিনি সংসারবন্ধন, জন্ম ও মৃত্যু প্রভৃতির হেতু; তিনি ঈশ্বরগণেরও ঈশ্বরী। রাজা বলিলেন, — হে ভগবন্‌! আপনি যাঁহাকে মহামায়া বলিতেছেন, সে‌ই দেবী কে? হে দ্বিজ! তাঁহার উৎপত্তিবৃত্তান্ত কি প্রকার এবং তাঁহার কর্ম্ম‌ই বা কি? সে‌ই দেবীর স্বভাব ও স্বরূপ এবং তিনি যাহা হ‌ইতে উৎপন্না, হে ব্রহ্মজ্ঞশ্রেষ্ঠ! তৎসমুদয় আমি আপনার নিকট শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি। ৪০-৪৬

ঋষি কহিলেন, — সে‌ই জগন্মূর্ত্তি মহামায়া নিত্যা — উৎপত্তি-বিনাশ-রহিতা। তিনি সমুদয় বিশ্ব‌‌ই ব্যাপিয়া রহিয়াছেন। তথাপি তাঁহার বহুপ্রকার উৎপত্তিকথা আমি বলিতেছি, শ্রবণ করুন। দেবতাদিগের কার্য্যসিদ্ধির জন্য তিনি যখন আবির্ভূতা হন, নিত্যা হ‌ইলেও তখন‌ই তিনি লোকমধ্যে উৎপন্না বলিয়া অভিহিতা হন। কল্পান্তে জগৎ একসমূদ্রীকৃত হ‌ইলে ভগবান্‌ বিষ্ণু যখন অনন্তশয্যা আশ্রয় করত যোগনিদ্রা অবলম্বন করেন, তখন বিষ্ণু-কর্ণমল-সম্ভূত, মধু ও কৈটভ নামে বিখ্যাত ভয়ঙ্কর অসুরদ্বয় ব্রহ্মাকে হনন করিতে উদ্যত হ‌ইয়াছিল। বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত অতি দীপ্তিমান্‌ প্রজাপতি ব্রহ্মা সে‌ই ভয়ঙ্কর অসুরদ্বয়কে দেখিয়া এবং বিষ্ণুকে নিদ্রিত দর্শন করিয়া, বিষ্ণুর জাগরণের নিমিত্ত একাগ্রহৃদয়ে হরির নেত্রস্থিতা, বিষ্ণুর নিদ্রাস্বরূপা, বিশ্বেশ্বরী, জগদ্ধাত্রী, স্থিতি-সংহার-কারিণী সে‌ই যোগনিদ্রার স্তব করিতে লাগিলেন। ব্রহ্মা বলিলেন, ৪৭-৫৩

হে ব্রহ্মস্বরূপে! হে নিত্যে! তুমি দেবগণের হবির্দান-মন্ত্র (যজ্ঞে ঘৃত আহুতি দেওয়ার সময় যে মন্ত্র বলা হয়) স্বাহা স্বরূপা; তুমি পিতৃগণের উদ্দেশে প্রদানমন্ত্র (পিণ্ডদানের মন্ত্র) স্বধা-স্বরূপা; তুমিই বষট্‌কার (যজ্ঞে দেবতাদের আহ্বানমন্ত্র) ও অকারাদি স্বরবর্ণ; হে দেবি তুমি সুধা স্বরূপা; তুমি‌ই বর্ণসমূহে হ্রস্ব-দীর্ঘ-প্লুতরূপ মাত্রাত্রয়-রূপা। ৫৪

যে অর্দ্ধমাত্রার উচ্চারণ বিশেষরূপ হয় না, তুমি‌ই সে‌ই অর্দ্ধমাত্রারূপে স্থিতা। হে দেবি! তুমি‌ই সে‌ই প্রসিদ্ধ গায়ত্রী-স্বরূপা। হে দেবি! তুমি‌ই সে‌ই সর্ব্বোৎকৃষ্টা জগজ্জননী প্রকৃতিস্বরূপা। ৫৫

হে দেবি! তুমি‌ই এ‌ই জগতের সৃষ্টি করিতেছ, তুমি‌ই ইহাকে ধারণ করিতেছ, তুমি‌ই ইহাকে পালন করিতেছ এবং প্রলয়কালে তুমি‌ই এ‌ই জগৎকে গ্রাস করিয়া থাক। ৫৬

তুমি সর্গকালে (উৎপত্তির সময়) সৃষ্টিরূপা, তুমি পালনে স্থিতিরূপা, এবং হে জগন্ময়ি! এ‌ই জগতের বিনাশকালে তুমি‌ই সংহাররূপা। ৫৭

হে দেবি! তুমি মহাবিদ্যা, তুমি মহামেধা, তুমি মহামায়া, তুমি মহাস্মৃতি; হে দেবি! তুমি মহামোহ-জনিকা মহাদেবী এবং মহাসুরী। ৫৮

হে দেবি! তুমি সত্ত্ব-রজস্তমোগুণ স্বরূপে সকল চরাচরের‌ই প্রকৃতি। তুমি কালরাত্রি অর্থাৎ ভয়ঙ্কর যমস্বরূপা। তুমি মহারাত্রি, অর্থাৎ বস্তু মাত্রের আবরক তমোময় প্রলয়-স্বরূপা। তুমি ভয়ঙ্কর মোহরাত্রি অর্থাৎ জগতের মোহ-জনক সংসার-স্বরূপা। ৫৯

হে দেবি! তুমি শ্রী, তুমি ঈশ্বরী, তুমি লজ্জা, তুমি বুদ্ধি এবং তুমি দিব্যজ্ঞানের একমাত্র লক্ষ্য। তুমি লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, শান্তি ও ক্ষান্তিস্বরূপা (ক্ষমাস্বরূপা)। ৬০

তুমি খড়্গিনী (যার হাতে খড়্গ), শূলিনী (যার হাতে শূল), গদিনী (যার হাতে গদা), চক্রিণী (যার হাতে চক্র), শঙ্খিনী (যার হাতে শঙ্খ) এবং চাপিনী (যার হাতে ধনুক)। হে দেবি! বাণ, ভূষুণ্ডী (লাঠি) এবং পরিঘও (মুগুরও) তোমার অস্ত্র। ৬১

হে দেবি! তুমি সৌম্যা, সৌম্যতরা, অধিক কি, জগতে যত প্রকার সুন্দর পদার্থ আছে, তুমি তাহাদের সকলের অপেক্ষা সুন্দরী। হে দেবি! তুমি শ্রেষ্ঠা, শ্রেষ্ঠ হ‌ইতে শ্রেষ্ঠতরা এবং তুমি‌ই শ্রেষ্ঠতরদিগেরও ঈশ্বরী। ৬২

হে অখিলাত্মিকে! যাহা কিছু ভাব ও অভাবরূপ পদার্থ আছে, তাহাদের যে শক্তি, তুমি‌ই সে‌ই শক্তিস্বরূপা, অতএব তোমাকে কি প্রকারে স্তব করিব? ৬৩

হে দেবি! জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কর্ত্তা সে‌ই ভগবান বিষ্ণুকে‌ই যখন তুমি নিদ্রাভিভূত করিয়া রাখিয়াছ, তখন আর কে তোমার স্তব করিতে সমর্থ হ‌ইবে? ৬৪

হে দেবি! বিষ্ণু, ঈশান (শিব) ও আমাকে যখন তুমি‌ই শরীর গ্রহণ করাইয়াছ, তখন অপর কোন্‌ ব্যক্তি তোমার স্তব করিতে সমর্থ হ‌ইবে? ৬৫

হে দেবি! সে‌ই তুমি এ‌ই প্রকার স্বকীয় উদার প্রভাব-বর্ণন দ্বারা পরিতুষ্ট হ‌ইয়া এ‌ই দুরাধর্ষ মধু ও কৈটভ নামক অসুরদ্বয়কে মোহিত কর। ৬৬

এবং জগৎস্বামী অচ্যূতকে প্রবোধিত কর। হে দেবি! এ‌ই মহাসুরদ্বয়কে বিনাশের জন্য শীঘ্র এ‌ই ভগবান্‌ বিষ্ণুর সংজ্ঞা দান কর। ৬৭

ঋষি বলিলেন, সে‌ই অসুরদ্বয়ের নিধনার্থে বিষ্ণুর প্রবোধ-প্রার্থী ব্রহ্মা এ‌ই প্রকারে সে‌ই তমোগুণময়ী নিদ্রারূপা দেবীর স্তব করিলে পর, অব্যক্তজন্মা ব্রহ্মার সম্মুখে ভগবান্‌ বিষ্ণুর নেত্র, মুখ, নাসিকা, বাহু, হৃদয় ও বক্ষঃস্থল হ‌ইতে নিষ্ক্রান্ত হ‌ইয়া দেবী অবস্থিতি করিলেন। তখন নিদ্রারূপা দেবী তাঁহাকে পরিত্যাগ করিলে পর, ভগবান বিষ্ণু একার্ণবস্থিত অনন্তশয্যা হ‌ইতে উত্থান করিয়া দেখিলেন, সে‌ই দুরাত্মা অতি বীর্য্য-পরাক্রমশালী, ক্রোধরক্তনেত্র মধু ও কৈটভ নামক অসুরদ্বয়, ব্রহ্মার বিনাশে কৃতোদ্যম হ‌ইয়াছে। উত্থানান্তর ভগবান্‌ বিভু হরি, সে‌ই অসুরদ্বয়ের সহিত পঞ্চসহস্র বৎসর বাহুযুদ্ধ করিলেন। সে‌ই অতি বলোন্মত্ত অসুরদ্বয় মহামায়াবিমোহিত হ‌ইয়া কেশবকে বলিল, “তুমি আমাদিগের নিকট হ‌ইতে বর গ্রহণ কর।” ভগবান্‌ বলিলেন, তোমরা যদি আমার উপর তুষ্ট হ‌ইয়া থাক, তবে উভয়ে‌ই আমার বধ্য হও, আমার এ‌ই বর, অন্য বরে কোন প্রয়োজন না‌ই। ঋষি কহিলেন, ভগবান্‌ এ‌ই প্রকারে উভয়কে বঞ্চনা করিলে পর, সে‌ই অসুরদ্বয় সমুদয় জগৎ জলপ্লাবিত দেখিয়া ভগবান্‌ পুণ্ডরীকাক্ষকে (যার চোখ শ্বেতপদ্মের মত সুন্দর অর্থাৎ বিষ্ণুকে) বলিল, হে কেশব! তোমার সহিত যুদ্ধে আমরা প্রীত হ‌ইয়াছি, অতএব তোমা দ্বারা আমাদের মৃত্যু শ্লাঘনীয়; কিন্তু যে স্থান জলপ্লাবিত হয় না‌ই, আমাদিগের সে‌ই স্থানে বধ কর। ঋষি কহিলেন, “তাহাই হ‌উক” এ‌ই কথা বলিয়া ভগবান্‌ শঙ্খ-চক্র-গদা ধারণপূর্ব্বক স্বকীয় জঘন (উদরের নিম্নভাগ) দেশে রাখিয়া চক্রদ্বারা সে‌ই অসুরদ্বয়ের মস্তক ছেদন করিলেন। স্বয়ং ব্রহ্মা স্তব করিলে, এ‌ই মহামায়া দেবী এ‌ই প্রকারে উৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। তোমাকে পুনর্ব্বার এ‌ই দেবীর প্রভাব বলিতেছি, শ্রবণ কর। ৬৮-৭৮

প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত॥১॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *