রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ
রাজমালা চতুৰ্থ ভাগ

প্রথম অধ্যায় – প্রাচীন ভুলুয়া রাজ্য বা জেলা নওয়াখালী

প্রথম অধ্যায় – প্রাচীন ভুলুয়া রাজ্য বা জেলা নওয়াখালী

আমরা পূর্বে বলিয়াছি যে, সূক্ষ্মদেশ বা প্রাচীন ত্রিপুরা অনেকগুলি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ভুলুয়া তাহার অন্যতম। প্রবাদ অনুসারে গৌড়ের প্রাতঃস্মরণীয় নরপতি আদিশূরের বংশধর বিশ্বস্তর শূর এই রাজ্যের স্থাপনকর্তা। মতান্তরে ‘আদিশূরের বংশধর বিশ্বম্ভর শূর মিথিলা প্রদেশ শাসন করিতেছিলেন। ৬১০ বঙ্গাব্দে রাজা বিশ্বম্ভর চন্দ্রনাথ দর্শন মানসে পোতারোহণে গমন করিতেছিলেন। ঘটনাক্রমে রাস্তারোহিগণের দিগ্‌ভ্রমে জন্মে, ক্ৰমে অষ্টাহ ইতস্তত নৌসঞ্চালনের পর তাঁহারা একটী ক্ষুদ্র দ্বীপ দর্শন করেন। ॥৩৯১ নৃপতি বারাহী মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন, দেবী তৎকালে আবির্ভূতা হইয়া তাহাকে বলিলেন— বৎস! এই দ্বীপে তুমি আমাকে স্থাপন কর। এই ক্ষুদ্র দ্বীপ একটি বৃহৎ রাজ্যে পরিণত হইবে এবং তুমি এই রাজ্যের অধিপতি হইবে। এই রাজ্য ভুলুয়া নামে খ্যাত হইবে। তোমা হইতে অধস্তন সাত পুরুষ ক্রমান্বয়ে এই রাজ্যে একাধিপত্য করিবেন। অষ্টম পুরুষে তোমার এই বিস্তৃতরাজ্যের সীমারেখা সঙ্কুচিত হইবে। পঞ্চদশ পুরুষে তোমার বংশধরগণ হৃত রাজ্য হইবেন।”

দেবীর আদেশ অনুসারে বিশ্বম্ভর সেই স্থানে বারাহী দেবীর প্রস্তর মূর্ত্তি সংস্থাপন পূর্বক ৬১০ বঙ্গাবদের ১০ মাস ভুলুয়া রাজ্যের রাজদণ্ড ধারণ করেন[১]। প্রচলিত ও লিখিত প্রবাদ বাক্য হইতে যে সময় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে ॥৩৯২॥ তাহা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ কি না তৎপক্ষে আমাদের সন্দেহ আছে, কিন্তু বখতিয়ার খিলজী কিম্বা তাঁহার অনুচরগণ দ্বারা তাড়িত হইয়া যে শূর বংশীয় বিশ্বম্ভর ভুলুয়ার উপনীত হইয়াছিলেন এরূপ অনুমান অসঙ্গত নহে।

প্রবাদ অনুসারে কল্যাণপুর তাঁহাদের আদি রাজধানী। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় আমিসা পাড়া গ্রামে রাজা বিশ্বম্ভর প্রথমত বাসস্থান নির্মাণ করেন, কারণ এই স্থানেই বারাহী দেবীর মন্দির ও প্রস্তরময়ী মূর্ত্তি অদ্যাপি দৃষ্ট হইয়া থাকে।

ভুলুয়াপতি শূরবংশীয়গণ ক্ষত্রিয় কুল হইতে উদ্ভুত[২]; কিন্তু বিবাহ সম্বন্ধ দ্বারা তাঁহারা-বঙ্গজ কায়স্থ সমাজে অনুপ্রবিষ্ট হইয়াছেন। কোন কুলক্রিয়া উপলক্ষে বঙ্গজ কায়স্থ কুলীনগণ সকলেই ভুলুয়া রাজধানীতে উপস্থিত হইয়াছিলেন, ভোজনকালে চতুর্মণ্ডলের মিত্র, বসু বংশীয় শহরের কৃষ্ণ জীবন মজুমদার এবং হংস বসু ও কীৰ্ত্তি বসু পলায়ন করেন। এই অপরাধে পলায়িত ব্যক্তিগণের কুল নষ্ট হয়। বঙ্গজ কায়স্থ মিত্রগণ মধ্যে তৎকালে কেবল চতুমণ্ডলের মিত্রগণেরই কুল ছিল। সুতরাং তাহাদের কুল নষ্ট হওয়ায় ॥৩৯৩। বঙ্গজ মিত্রগণ সকলেই অকুলীন। এই প্রবাদ অনুসারে রাজা কবিচন্দ্রের সময় এই ঘটনা হইয়াছিল।[৩]

বিশ্বম্ভরের উত্তর পুরুষগণ ত্রিপুর রাজদণ্ডের অধীনতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিল। ত্রিপুরার সামন্ত শ্রেণীতে ভুলুয়ারাজ সর্ব প্রধান বলিয়া আখ্যাত হইয়াছিলেন। প্রাচীন ত্রৈপুর নৃপতিগণের অভিষেক কালে ইহারাই তাঁহাদের ললাটে রাজটীকা প্রদান করিতেন। ত্রিপুরেশ্বর সিংহাসনে উপবেশন করিলে ভুলুয়াপতি সর্ব প্রথম “নজর” প্রদান করিতেন, তদনন্তর অন্যান্য সামন্ত ও অমাত্যবর্গ নজর দান করিতে সক্ষম হইতেন। রাজা বিশ্বম্ভর হইতে অধস্তন ৭ পুরুষের বংশাবলী এইরূপ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।

রাজা বিশ্বম্ভর হইতে অধস্তন ৭ পুরুষের বংশাবলী

রাজা লক্ষণ মাণিক্য একজন অসাধারণ বীর ও পণ্ডিত ছিলেন। লক্ষণ মাণিক্যের অভিষেকের পূর্বেই জুগীদিয়া ও দাঁদড়া নামক পরগণা দুইটি ভুলুয়া রাজ্য হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল। রাজা তুডরমল্লের ওয়াশীলতোমর জমায় সরকার সুবর্ণগ্রামের অন্তর্গত প্রাচীন ভুলুয়ার অধীন মহাল সমূহের এইরূপ তালিকা প্রদত্ত হইয়াছে।

ভুলুয়া জোয়ার রাজস্ব : ১৩৩১৪৮০ দাম

জুগীদিয়া রাজস্ব : ৫১২০৮০ দাম

দাঁদড়া রাজস্ব : ৪২১৩৮০ দাম

আমরা পূর্বেই বলিয়াছি আকবর সাহেব রাজস্ব মন্ত্রী সের সাহের রাজস্বের হিসাব নকল করিয়া অপূর্ব বাহাদুরী প্রাপ্ত হইয়াছেন। প্রকৃত পক্ষে সম্রাট আকবর এই সকল স্থানের করগ্রাহী ছিলেন না। যাহা হউক এস্থলে ভুলুয়ার রাজস্ব ৩৩২৮৭ টাকা লিখিত হইয়াছে। ॥৩৯৫॥

বিখ্যাত পাঠান সম্রাট সের সাহ কিম্বা তৎপূর্ববর্তী অন্য কোন নরপতি ভুলুয়া ও অন্য দুইটি পরগণা হইতে যদিও কোন সময় এইরূপ কর গ্রহণ করিয়া থাকেন, কিন্তু আকবর তাহা করিতে পারেন নাই। ইংরেজ ভ্রমণকারী রলফ ফিছ বলিয়াছেন যে, “এই সকল সামন্ত নরপতিগণ প্রবল নদীস্রোতে আপনাদের বিজয়ী পতাকা উড্ডীন করিয়া আকবরের অশ্বারোহিগণকে উপহাস করিতেছিলেন।” প্রাচীন বঙ্গবাসীদিগের চির অভ্যস্ত জল-রণ- নৈপুণ্য বিনষ্ট করিবার শক্তি তখনও মোগলদিগের করায়ত্ত হয় নাই।

লক্ষণমাণিক্য সংস্কৃত শাস্ত্রে অসাধারণ পণ্ডিত ও কবি ছিলেন। তিনি অৰ্জ্জুন কর্তৃক কর্ণ বধ অবলম্বন করিয়া “বিখ্যাত বিজয়” নামক একখানি সংস্কৃত নাটক রচনা করেন। যদিচ তাঁহার গ্রন্থ “রত্নাবলী”; কিম্বা “নাগর বন্দের” ন্যায় উৎকৃষ্ট নহে, তথাপি ইহা জনৈক রাজকবির লেখনী-প্রসূত বলিয়া আমরা গৌরবের সহিত উল্লেখ করিতে পারি। নান্দীতে গ্রন্থকার তাঁহাদের প্রাচীন কুলদেবতা বারাহীদেবীর বন্দনা করিয়াছেন। তদনন্তর সূত্রধর প্রস্তাব ও গ্রন্থের যেরূপ পরিচয় করিয়াছেন তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ। বীররসই এই নাটকের জীবন। ইহা ॥৩৯৬॥ দের দ্বারা গ্রন্থকারের প্রকৃত পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।

প্রবাদ অনুসারে রাজা লক্ষণ একজন অসাধারণ বীরপুরুষ ছিলেন। সংগ্রামকালে তিনি যে কবচ পরিধান করিতেন, তাহার কিয়দংশ অদ্যাপি দৃষ্ট হইয়া থাকে। এই কবচটি সম্পূর্ণ অবস্থায় দর্শন করিয়াছেন, এরূপ লোক অদ্যাপি নিতান্ত বিরল নহে। এরূপ শ্রুত হওয়া গিয়াছে যে, ইহা ওজন প্রায় ১ মণ ছিল, অৰ্দ্ধ মণ ওজনের একটি কবচ পরিধান পূর্বক সংগ্রাম করা একজন সাধারণ বীরের কার্য্য। আধুনিক জগতের বীর জাতি সমূহের মধ্যে বোধ হয় এরূপ বীর নিতান্ত বিরল।

চন্দ্রদ্বীপপতি রাজা কন্দর্পনারায়ণ রায় লক্ষণমাণিক্যের সমসাময়িক, তাঁহাদের মধ্যে সদ্ভাব ছিল বলিয়া বোধ হয় না। ভুলুয়াপতিগণ বারংবার চন্দ্রদ্বীপে বিজয়ী পতাকা উড্ডীন করিয়াছেন। কন্দর্পনারায়ণের মৃত্যুর পর তৎপুত্র রাজা রামচন্দ্র নিতান্ত বিড়াল তপস্বীর ন্যায় ভুলুয়ায় আগমন করেন। উদার হৃদয় লক্ষণমাণিক্য স্বজাতীয় বালক নরপতির বিনীত ব্যবহারে নিতান্ত প্রীতিলাভ করিয়াছিলেন। তিনি একদা ॥৩৯৭॥ সরল ভাবে রাজা রামচন্দ্রের সহিত তাঁহার কোষ নৌকায় গমন করত আমোদ প্রমোদ করিতেছিলেন। বিশ্বাসঘাতক পামর রামচন্দ্র সেই সময় স্বীয় প্রধান সেনাপতি রামমোহন সিংহ (প্রকাশ্য রামাই মাল)[৫] ও অন্যান্য বীর পুরুষ দ্বারা নিরস্ত্র বীর লক্ষণমাণিক্যকে বন্ধন করিয়া চন্দ্রদ্বীপে লইয়া গেলেন। তথায় নিতান্ত নিষ্ঠুরতার সহিত তাঁহাকে বধ করা হইয়াছিল।”

চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস লেখক বাবু ব্রজসুন্দর মিত্র বলেন, শৃঙ্খলাবদ্ধ লক্ষণমাণিক্য পৃষ্ঠের আঘাতে একটি প্রকাণ্ড তালবৃক্ষ ধরাশায়ী করিয়াছিলেন। ॥৩৯৮॥

লক্ষণমাণিক্যের মৃত্যুর পর বলরাম রায় ভুলুয়ার রাজদণ্ড ধারণ করেন। ত্রিপুরেশ্বরের মহারাজ অমরমাণিক্য ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরোহন করেন। রাজা বলরাম তৎকালে চিরপ্রচলিত প্রথা অনুসারে তাঁহকে রাজটীকা প্রদান করত নজর ও করদান করিতে অসম্মত হইয়াছিলেন। এজন্য অমরমাণিক্য ভুলুয়া আক্রমণ ও জয় করিয়া বলরাম হইতে কর গ্রহণ করেন।

১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে “টেরছেলিং” নামক ওলান্দাজদিগের একখানি অর্ণবপোত ভুলুয়ার নিকটবর্ত্তী সমুদ্রতটে ঝড়ের দ্বারা বারংবার আঘাত প্রাপ্ত হইয়া বিনষ্ট হইয়াছিল। চার্লস ডোবেল প্রভৃতি আট জন নাবিক তৎকালে বহুকষ্টে প্রাণ রক্ষা করিয়াছিল। তাহারা ভুলুয়াপতির নিকট উপনীত হইলে, তিনি উৎকৃষ্ট আহাৰ্য্য প্রদান পূর্বক একখানি নৌকা দ্বারা তাহাদিগকে ঢাকায় প্রেরণ করেন[৬]। ইহা নিতান্ত ॥৩৯৯॥ দুঃখের বিষয় যে নাবিকগণ ভুলুয়াপতির নাম উল্লেখ করেন নাই। কেবল মাত্র “বোলোয়ার প্রিন্‌স” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।

বংশ বিস্তৃতির সহিত ভুলুয়ারাজ্য খণ্ড খণ্ড হওয়ার সূত্রপাত হইয়াছিল। আকবরের পূর্বেই এই রাজ্য তিন অংশে বিভক্ত হয়; তাহা পূর্বে প্রদর্শিত হইয়াছে। ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে (১১৩৫ বঙ্গাব্দে) ভুলুয়া রাজ্য ১টী জমিদারীতে বিভক্ত হইয়াছিল, তাহার তালিকা যথাস্থানে প্রদত্ত হইবে। এরূপ বিভক্ত হইবার কারণ আমরা এবংম্প্রকার স্থির করিতে সক্ষম হইয়াছি।

১। মগ ও মুসলমানদিগের সহিত কলহ করিয়া ত্রিপুরেশ্বর দুর্বল হইয়া পড়িলেন, সুতরাং ভুলুয়াপতি হইতে কর গ্রহণ করিতে অপারগ হইলেন। তৎপরিবর্তে ভুলুয়াপতিগণ সম্পূর্ণরূপে মোগলদিগের অধীনস্থ জমিদার হইলেন।

২। মগ ও পর্তুগিজ বোম্বাটীয়াদিগের হস্ত হইতে সীমান্ত প্রদেশ রক্ষা করিবার জন্য মোগলগণ ভুলুয়ায় কয়েকজন মুসলমান জমিদার নিযুক্ত করিলেন। তদরিক্তি ভুলুয়ায় একটি সেনানিবাস (বা ‘থানা’) স্থাপিত হইল। তাহার ব্যয় নির্বাহ জন্য রাজস্ব ও ভূমি দ্বারা জায়গীর নির্দ্ধারিত হইয়াছিল। ॥৪০০।।

রাজা রুদ্ররায়ের পত্নী রাণী শশীমুখীর শাসনকালে নিজ ভুলুয়া রাজ্য তিনভাগে বিভক্ত হইয়াছিল। সুর বংশের দুইটি কনিষ্ঠ শাখা দুই অংশ ও রাজ বংশের কর্মচারী খিলপাড়া নিবাসী সিংহ বংশীয় নারায়ণ চৌধুরীগণ একাংশ গ্রহণ করেন। সুর বংশের সেই দুইটি শাখা দত্তপাড়া ও মাইজদীর চৌধুরী বলিয়া অদ্যাপি পরিচিত হইয়া থাকেন। দত্ত পাড়ার চৌধুরীগণ অধুনা সামান্য তালুকদার মাত্র। কিন্তু তাহাদের গুহ বংশীয় দেওয়ানের বংশধরগণ অতুল সম্পত্তির অধিকারী হইয়াছেন। ইহা নিতান্ত সুখের বিষয় যে চন্দ্রদ্বীপের রাজলক্ষ্মীর ন্যায় ভুলুয়া রাজলক্ষ্মী মুদি বংশের আশ্রয় গ্রহণ না করিয়া আংশিকভাবে দেওয়ান বংশের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। গুহবংশীয়গণ অধুনা দত্তপাড়ার দেওয়ানজী বলিয়া আখ্যাত হইয়া থাকেন। আমরা শুনিয়া সুখী হইলাম যে, দেওয়ান মহাশয়গণ দরিদ্র প্রভু বংশের প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করিয়া থাকেন; ইহা আধুনিক বাঙ্গালি চরিত্রের বিপরীত এবং তাঁহাদের মহত্বের পরিচায়ক। মাইজদীর চৌধুরী ও খিলপাড়ার সিংহ নারায়ণ চৌধুরীগণের উত্তর পুরুষগণও হৃতসর্বস্ব হইয়াছেন। বিক্রমপুর তারপাসা নিবাসী ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয়গণের পূর্ব পুরুষ রাণী শশীমুখীর অধীনে কার্য্য করিয়া প্রচুর সম্পত্তি অর্জ্জন করিয়াছিলেন।

ভুলুয়ার নিকট সমুদ্রগর্ভে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ অনেকগুলি “চর” দ্বীপ দৃষ্ট হইয়া থাকে। বলা বাহুল্য যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনাদের স্রোত প্রবাহিত কদমরাশি দ্বারা এই সকল দ্বীপ গঠিত হইয়াছে। ব্লেব ও বানডিন ব্রোকের মানচিত্রের সহিত মেজন রেনল কৃত এবং আধুনিক মানচিত্র যুগপৎ দৃষ্টি করিলে প্রতীত হইবে যে, এই সকল দ্বীপ অতি আশ্চর্যভাবে আয়তন বৃদ্ধি করিতেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলি দ্বীপ স্রোত প্রবাহিত কদমরাশি দ্বারা সংযুক্ত হইয়া এক একটি প্রকাণ্ড দ্বীপ গঠিত হইয়াছে। প্রবল স্রোতবেগে কোন দ্বীপের একদিক ভাঙ্গিয়া গেলেও অন্যদিকেও তাহার আয়তন আশ্চর্য্য রূপে বৰ্দ্ধিত হইতে থাকে। বৰ্ত্তমান হাতীয়া দ্বীপ তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ইহার একদিক ভাঙ্গিয়া গিয়া বিপরীত দিকে নলতিয়ার সহিত সংযুক্ত হইয়া সমুদ্রের দিকে আয়তন বৃদ্ধি করিতেছে। জেলা নওয়াখালীর অন্তর্গত দ্বীপ সমূহের মধ্যে বনদ্বীপ, সিদ্ধি এবং হাতীয়াই প্রধান। তদ্ব্যতীত আরও ১৮টি দ্বীপ আছে। তন্মধ্যে কতকগুলি ভুলুয়ার সমতল ক্ষেত্রের সহিত সংযুক্ত হইয়া গিয়াছে।

১১৩০ সালের তহশীল তোমর জমা হইতে ভুলুয়ার নিম্নলিখিত তালিকা উদ্ধৃত হইল :

১১৩০ সালের তহশীল তোমর জমা

তুডরমল্লের ওয়াশীল তোমার জমাতে কেবলমাত্র সনদ্বীপের নাম দৃষ্ট হইতেছে। কিন্তু ভুলুয়া ও তদন্তর্গত অন্যান্য মহালের ন্যায় ইহা সরকার সুবর্ণ গ্রামের অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। তাহাতে উক্ত দ্বীপ সরকার ফতেয়াবাদের অধীন ॥৪০৩। বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। এবং তাহার রাজস্ব ২৯৫৬১।০ আনা লিখিত আছে। আধুনিক দুর্দান্ত জমিদারগণের দুশ্চরিত্র নায়েবগণের ন্যায় রাজা তুড়ড়মল্ল কাগজপত্রে আকবরের রাজস্ব বৃদ্ধি করিতে যথাসাধ্য প্রয়াস পাইয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে আঔরংজেবের অভ্যুদয়ের পূর্বে মোগর সম্রাটগণ সনদ্বীপের রাজস্ব এক কপদকও ভোগ করিতে পারেন নাই। এই দ্বীপের আধিপত্য লইয়া হিন্দু, মগ, পর্তুগিজ ও মুসলমানগণ নররুধিরে বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি অবিশ্রান্ত রঞ্জিত করিয়াছেন। আমরা এস্থলে তাহার বিস্তৃত ইতিহাস লিখিতে ইচ্ছা করি না। বাঙ্গালি জাতির জল রণ— নৈপুন্য খ্যাতি প্ৰাচীন জগতে সবর্বত্র বিঘোষিত হইয়াছিল। ১৫২৪ শকাব্দে শ্রীপুরপতি কায়স্থ কুলতিলক বীরচূড়ামণি কেদর রায় দ্বারা নির্বাণোনুখদীপশিখার ন্যায় সেই প্রাচীন গৌরবজ্যোতি শেষবার বিকীর্ণ হইয়াছিল। মগদিগের ভুজ গর্ব খর্ব করিয়া— বঙ্গোপসাগরে বিজয়ীপতাকা উড্ডীন করিয়া সেই প্রাতঃস্মরণীয় বঙ্গকুলচূড় কেদার রায় ১৫২৪ শকাব্দে সন্দ্বীপ অধিকার করেন। জগতের ইতিহাসে আমরা জীবনস্মৃত, এজন্যই আমরা আমাদের শের নেলসনের নামটিও বিস্মৃতি সাগরে ডুবাইতে প্রস্তুত হইয়াছি ১৫৮৮ শকাব্দে (১১ জুমদা ১০৭৬ হিঃ সালে) সনদ্বীপ স্থায়ীরূপে মোগল সম্রাটদিগের করতলস্থ হইয়াছিল। ১১৩৫ সালের ॥৪০৪॥ রাজস্বের হিসাবে সনদ্বীপের রাজস্ব ৫৪৬৯৬ টাকা লিখিত।

১১৭০ সালের জমাবন্দিতে ভুলুয়া ও তদন্তর্গত মহাল সমূহের রাজস্ব নিম্নলিখিতরূপে লিখিত আছে :-

ভুলুয়া – ১৩৫৯৮২

জগীদিয়া – ১৭৭৩৭

দাঁদরা ও এলাহাবাদ বাবুপুর – ১২৯৮৪

গোপালপুর – ১৫৮৮৯

সন্দ্বীপ – ১০৮৪৭০

অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহালগুলির রাজস্ব একপ্রকার অতিরিক্ত রূপে বৰ্দ্ধিত হইয়াছিল। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিগণ দেশীয় বস্ত্রের বাণিজ্য জন্য জুগীদিয়া কল্যানদী এবং লক্ষ্মীপুরে তিনটি কুঠি নির্মাণ করেন। কোম্পানির দেওয়ানী প্রাপ্তির পর ভুলুয়া, ঢাকা- জেলালপুরের অধীন ছিল। তদনন্তর ত্রিপুরা জেলা সৃষ্টি হইলে সমগ্র ভুলুয়া তাহার অধীন হইয়াছিল, কেবলমাত্র সনদ্বীপ প্রভৃতি চরগুলি চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে লবণ প্রস্তুত জন্য ভুলুয়ার একজন এজেন্ট নিযুক্ত হন। ভুলুয়ার প্রস্তুত লবণ চট্টগ্রামে প্রেরিত হইত।। ৪০৫

এই সময় ভুলুয়া বাসীগণ ডাকাইত দিগের অত্যাচারে হৃত সর্বস্ব হইতেছিল। সেই উপদ্রব নিবারণের জন্য ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের অন্তর্গত সনদ্বীপ, হাতীয়া প্ৰভৃতি দ্বীপ এবং ত্রিপুরা জেলার অধীন থানে সুধারাম ও বেগমগঞ্জ, বামনী ফাঁড়ি দ্বারা নওয়াখালী নামক একটি ক্ষুদ্র জেলা সৃষ্টি হয়। এই জেলায় ফৌজদারী সংক্রান্ত শাসন কাৰ্য্য নির্বাহ জন্য জনৈক ইংরেজ জয়েন্ট ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হইয়া ছিলেন। অল্পকাল অন্তে জেলা ত্রিপুরার অন্তর্গত রামগঞ্জ ও আমিরগাঁও এবং বাখরগঞ্জের অধীন (থানা চানদীয়া ও ধনিয়ামনিয়া ফাঁড়ি) দক্ষিণ সাবাজপুর দ্বারা এই ক্ষুদ্র জেলার অঙ্গ পুষ্টি করা হইয়াছিল। কিন্তু দ্বীপ সমূহ ব্যতীত সমগ্র নওয়াখালীর রাজস্ব ও দেওয়ানী বিভাগ তখনও ত্রিপুরা জেলার অধীনে ছিল। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে লবণের এজেন্টকে কালেক্টরের ক্ষমতা প্রদত্ত হয়। সম্ভবত ১৮৩০ সালে নওয়াখালীর জন্য একজন স্বতন্ত্র কালেক্টর নিযুক্ত হন। তদনন্তর যৎকালে মাজেষ্ট্রেট ও কালেক্টরের ক্ষমতা একজন রাজপুরুষের হস্তে সমর্পিত হয়, তৎকালে নওয়াখালী জেলা অপেক্ষাকৃত উন্নতি প্রাপ্ত হয়, কিন্তু দেওয়ানী ও ছেসন সম্বন্ধে সেই সময়েও ইহা ত্রিপুরার অধীন ছিল। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে নওয়াখালীতে স্বতন্ত্র সিবিল ও ছেসন জজ নিযুক্ত হয়। তৎকালে ত্রিপুরার অন্তর্গত ছাগলনাইয়া ॥৪০৬॥ ও চট্টগ্রামের অন্তর্গত নীরেশ্বরী থানা এই জেলার সহিত সংযুক্ত হয়। কিন্তু ইহার পূর্বে (১৮৭৫) খ্রিস্টাব্দে চালদীয় ও ধনিয়া মনিয়া পুনর্বার বাখরগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। কিছুকাল অন্তে মীরেশ্বরী থানা চট্টগ্রাম জেলাভুক্ত হইল। সুতরাং এক্ষণ আমরা দেখিতেছি যে, একটি জেলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া দুইটি জেলা সৃষ্টি করা হইয়াছে। একটী ত্রিপুরা অন্যটি নওয়াখালী। কারণ নওয়াখালীর অঙ্গপুষ্টির জন্য বাখরগঞ্জ ও চট্টগ্রাম হইতে যে সকল স্থান গৃহীত হইয়াছিল, তৎসমস্তই পুনর্বার সেই সেই জেলার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। কেবল মাত্র রাজ কর্মচারিগণের বিষম যন্ত্রণাদায়ক উপসর্গ স্বরূপ কয়টী দ্বীপ জেলা নওয়াখালীর অঙ্গে গ্রথিত রহিয়াছে।

অধুনা নওয়াখালী জেলার পরিমাণ ১৬৪৪ বর্গমাইল। এই জেলায় ১০০৯৬৯৩ জন লোকের বাস। এই জেলা দুইটি মহকুমায় বিভক্ত যথা সদর ও ফেণী। বলা বাহুল্য যে ফেণী নামক নদীর তীরে অবস্থিত বলিয়া শেষোক্ত মহকুমাটি ফেণী আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। জেলা নওয়াখালীর অন্তর্গত ভূমি, গবর্ণমেন্টের খাস মহাল ব্যতীত, নিম্নলিখিত শ্রেষ্ঠ, মধ্য ও অধীন স্বত্বে বিভক্ত।

(ক) শ্রেষ্ঠ স্বত্বঃ- (খেরাজ বা সকর ভূমি)

১। জমিদারী। ১০ সালা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বের জমিদারগণ দ্বিবিধ উপায়ে এই সকল তালুকের সূত্রপাত করেন।

১) সেলামী কিম্বা অন্যরূপ উপকার প্রত্যাশায় জমিদারগণ পাট্টাদ্বারা যে সকল তালুক সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাহাদের পাট্টাই তালুক বলিত।

২) রাজস্বের জন্য একটি নির্দ্ধারিত জমা অবধারণ পূর্বক জমিদারগণ তাঁহাদের বৃহৎ জমিদারির ক্ষুদ্র অংশ বিক্রয় করিয়া প্রকৃত খারিজা তালুকে মূল ভিত্তি সংস্থাপন করেন। যদিচ রাজকর পরিশোধ জন্য জমিদারগণ তালুকদারবর্গের মারফতদার মাত্র ছিলেন। তত্রাচ তাঁহাদের প্রতি জমিদারগণ নানা প্রকার অত্যাচার করিতে বিরত ছিলেন না। পরম কারুনিক লর্ড কর্ণওয়ালিসের মন্তব্য লিপি[৭] প্রচারিত হইলে ইহারা সকলেই জমিদারের অধীনতা শৃঙ্খল ছেদন করিবার সুযোগ প্রাপ্ত হইলেন। তাঁহাদর আবেদন অনুসারে এই শ্রেণীর তালুক সমস্তই খারিজ হইয়া গেল। তালুকদারগণ জমিদারদিগের ন্যায় তাঁহাদের তালুকের রাজস্ব রাজকীয় ধনাগারে অর্পণ করিতে অধিকার প্রাপ্ত হইলেন। তদবধি এই সকল তালুক খারিজ বা স্বাধীন তালুক আখ্যা দ্বারা আখ্যাত হইতেছে। নওয়াখালী জেলার মধ্যে এইরূপ অবিভক্ত তালুকের সংখ্যা ৭৪০ এবং বিভক্ত তালুকের সংখ্যা ৭১৪ হইবে।

খ) শ্রেষ্ঠস্বত্ব :- লাখেরাজ বা নিষ্কর।

এই সকল নিষ্কর চারি শ্রেণীতে বিভক্ত।

১। গবর্ণমেন্টের প্রদত্ত লাখেরাজ। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী প্রাপ্তির পর এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে এই লাখেরাজ প্রদত্ত হইয়াছিল। ইহার সংখ্যা ১টী মাত্র।

২। বাদসাহি লাখেরাজ। ১। আয়মা, ২) মদদমাস। ইহার বিবরণ পশ্চাৎ প্রদত্ত হইবে।

৩। সিদ্ধনিষ্কর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে জমিদারগণের প্রদত্ত নানা প্রকার নিষ্কর।

৪। খোসবাস। মগদিগের অত্যাচার নিবারণ জন্য ১৪০০ মোগল সৈন্য ভুলুয়াতে স্থাপিত হয়। ইহারা প্রথমত ভুলুয়ার ওয়াদাদার হইতে বেতন প্রাপ্ত হইত। পশ্চাৎ বাঙ্গালার নবাব তাহাদিগকে বেতনের পরিবর্তে ৪০ দ্রোণ ভূমি জায়গীর স্বরূপ দান করেন। সৈন্যগণ খরিদ করিয়া ভূমির খোসবাস ভুক্ত হইয়াছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় এই সকল ভূমির কোনরূপ কর ধার্য্য হয় নাই। বোর্ডের অনুমতিতে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কালেক্টর এই ভূমি বাজেয়াপ্ত করিতে প্রবৃত্ত হন। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে তাহার জরিপ জমানবন্দী হইয়াছিল। তন্মধ্যে ৩৬টি খোসবাস মহালের মালিক দশ বৎসরের রাজস্ব গবর্ণমেন্টকে ॥৪০৯॥ সেলামী পূর্বক লাখেরাজ স্বত্ত্ব স্থির রাখিয়াছিলেন। মধ্যস্বত্ব :-

(ক) খেরাজ বা সকর।

১: অধীন তালুক— যাহার খাজনা জমিদারকে প্রদান করিতে হয়। এই তালুক দুই শ্রেণীতে বিভক্ত যথা— (ক) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্ববর্ত্তী। লিখিত চুক্তি পত্রদ্বারা এই সকল তালুকের মালিকগণ খারিজের অধিকার প্রাপ্ত হয় নাই। অথচ জমিদারগণও এই সকল তালুকদার হইতে নির্দ্ধারিত কর ব্যতীত অতিরিক্ত গ্রহণ করিতে পারেন না।

(খ) পত্তনি তালুক ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ আইনের মর্মানুসারে নির্দ্ধারিত করে এই সকল তালুক সৃষ্টি হইয়াছে।

২: পরিবর্তনশীল জমার তালুক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে কিম্বা পরে প্রধানত পতিত ভূমি আবাদ দ্বারা এই সকল তালুক সৃষ্টি হইয়াছিল। জমিদারগণ এক পাট্টা প্রদান পূর্বক আপন গৃহে সুখে নিদ্রা গিয়াছেন, আর তালুকদারগণ আপন আপন শরীরের রক্ত জল ও বহু অর্থ ব্যয় করিয়া এই সকল তালুকের আবাদ ও উন্নতি করিয়াছেন। প্ৰথম অবস্থায় তালুকদারগণের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শিত হইয়াছিল। “যে নল দ্বারা অধীন স্বত্ত্বাধিকারীদিগের ভূমির পরিমাপ করা হয়, এই সকল তালুকের ভূমি তদপেক্ষা বৃহৎ নলে পরিমাপ হইত এবং আবাদি ভূমির পঞ্চমাংশ তালুক দারগণ “জীবিকা” বা ॥৪১০॥ “মথন” বলিয়া বাদ পাইতেন”।[৮] কিন্তু আধুনিক জমিদারগণ তাঁহাদের হৃদয়ের মহত্ত্ব ও কর্তব্য ব পরায়ণতা কর্মনাশার জলে বিসর্জ্জন পূর্বক এই সকল তালুকদারের প্রতি নানা প্রকার অত্যাচার করিতে বিরত হইতেছেন না। এই শ্রেণীর তালুকের বিবরণ পশ্চাৎ‍ বিস্তৃত ভাবে লিখিত হইবে।

৩: তপা। ইহা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্ববর্ত্তী অধীন তালুকের ন্যায়। নওয়াখালী জেলার মধ্যে ৩০টির অধিক তপা হইবে না।

৪: নম্বরীয়ান। গবর্ণমেন্টের খাস মহালের অন্তর্গত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পূর্বে নির্দ্ধারিত জমায় তালুকের সৃষ্টি হইয়াছিল। সেই সকল জমিদারী গবর্ণমেন্টের খাস হইলে নম্বর অর্থাৎ সংখ্যা দ্বারা এই সকল মহালের তালিকা প্রস্তুত হয়, এজন্য ইহা নম্বরীয়ান আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। নওয়াখালী জেলার মধ্যে এই রূপ নম্বরী মহালের সংখ্যা ২৫টির অধিক হইবে না।

৫: দর-পত্তনি। পত্তনি তালুকের মালিকগণ নির্দ্ধারিত জমায় অন্যকে বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছেন।

৬: ওসত তালুক। খারিজা বা স্বাধীন তালুকদর ॥৪১১॥ এবং অধীন তালুকদারগণ দরপত্তনির ন্যায় বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছেন। পত্তনি তালুকের বিধি অনুসারে এই সকল তালুক রাজস্বের জন্য সরাসরিতে নিলাম হইতে পারে। এই তালুকের সংখ্যা ১০০ সহস্র হইবে।

৭: সিকিম-তালুক। এইগুলি প্রায় ওসত তালুকের ন্যায় ইহার সংখ্যা প্রায় ৩০০০ সহস্র হইবে।

৮: দরসিকিমি। সিকিমি তালুকদার তাঁহাদের অধীনে এই সকল তালুক সৃষ্টি করিয়াছেন।

৯: জঙ্গলবুরি— তালুক। চর ভূমিতে আবাদের জন্য এই সকল তালুক সৃষ্টি হইয়াছে।

১০: হাওলা। পতিত ভূমি আবাদ করিবার জন্য ভূম্যধিকারিগণ দ্বারা ব্যক্তি বিশেষকে যে অধিকার প্রদত্ত হইত তাহাকে হাওলা বলিত। হাওলাদার স্বয়ং এবং প্রজার সাহায্যে ভূমি আবাদ করিয়া কমিসন স্বরুপ লভ্যের অধিকারী হইতেন। প্রথম অবস্থায় হাওলা রায়তী, স্বত্বের ন্যায় সৃষ্টি হইয়াছিল। কিন্তু ক্রমে ইহা তালুকের শ্রেণীতে পরিগণিত হইতেছে। হাওলার অধীনে ক্রমে নিমহাওলা, ওসতহাওলা প্রভৃতি সৃষ্টি হইয়া ইহাকে মধ্য স্বত্বে সংস্থাপন করিয়াছে। হন্টার সাহেব চট্টগ্রামের নওয়াবাদ তালুকের সহিত নওয়াখালীর হাওলা মহালের তুলনায় সমালোচনা করিয়াছেন। ॥৪১২

১১: জিম্বা। ইহার সাধারণ অর্থ এইরূপ যে, নিব্যুঢ় স্বত্ব বিহীন ভূমি। কোন জমিদারী কিম্বা তালুক বাকী রাজস্বের জন্য নিলাম হইলে নূতন ক্রেতা তাঁহার অধীন ভূম্যধিকারীকে কোনরূপ তালুকদার বর্ণনা না করিয়া তাহা হইতে কর গ্রহণ পূর্বক ভবিষ্যতে বিরোধের পন্থা পরিষ্কার রাখিবার জন্য “জিম্বা” উল্লেখ দাখিলা প্রদান করেন। ইহা একটি আশ্চর্য্য কৌশল বটে। এইরূপে নওয়াখালীতে জিম্বা ও জিম্বাদার শব্দের উৎপত্তি হইয়াছে।

(খ) মধ্যস্বত্ব : -লাখেরাজ বা নিস্কর।

১। দেবোত্তর। ২। ব্রহ্মোত্তর। ৩। মহত্বরান। ৪। খয়রাতী। ৫। চাকবান। – এই সকল ভূমির বিবরণ পশ্চাৎ বিশেষভাবে লিখিত হইবে।

অধীস্বত্ত্ব : –

১। মসক্কসী রায়তী। ইহাতে কায়েমী রায়তী বলা যাইতে পারে। যথেচ্ছ ভোগ ও বিনিয়োগের অধিকার রায়তগণ মধ্যবর্ত্তী- স্বত্বাধিকারী হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে।

২। রায়তী খোদকান্ত, –এই সকল রায়তী ভূমির খাজনা বৃদ্ধির অধিকার ভূম্যধিকারী আছে। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের আট আইন প্রচারের পূর্ব হইতেই খোদকান্ত রায়তগণ স্বত্বের ভূমি খরিদ বিক্রি করিয়া আসিতেছে। ॥৪১৩॥

৩। ওসত রায়তী- রায়ত্বের অধীন খোদকান্ত রায়তী।

৪। নিম ওসত- রায়তী- ওসত রায়তের অধীন তদ্রুপ স্বত্ত্ব বিশিষ্ট রায়তী ভূমি।

৫। চান্দীয়ারায়তী- হাট বাজারের ভিটী ভূমি।

৬। ওসত চান্দীয়া- রায়তী-চান্দীয়া- রায়তীর অধীন তদ্রুপ স্বত্ব বিশিষ্ট রায়তী ভূমি।

৭। জোত- প্রকৃত কৃষক সম্প্রদায়ের কৃষির ভূমিকেই জোত বলে।

বাস্তভূমি ব্যতীত কর নির্ণয় জন্য নওয়াখালী জেলার ভূমিকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে।

১- ধানী। ২-বাগান। ধানী জমির নিরেখ কাণী প্রতি ৫/৬ টাকার ন্যূন নহে। বাগান কাণী প্রতি ৮/১০ টাকা জমা।

নওয়াখালী জেলার প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য ধান্য সুপারী নারকেল৯। ॥৪১৪

১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ছাগলনাইয়া থানার অন্তর্গত চাকলে রোসনাবাদের কিয়দংশ জেলা নওয়াখালীর অধীন হইয়াছে।

এই জেলা নিম্নলিখিত পরগণা ও মহালে বিভক্ত।

পরগণা ও মহাল
পরগণা ও মহাল

.

টীকা

১. রাজ্যের মুদ্রণ প্রমাদ।

২. সময় সম্বন্ধে হন্টার সাহেব ভ্রমাত্মক মত প্রচার করিয়াছেন। (Statistical Account of Bengal Vol, VI p 24 ) ডাক্তার ওয়াইজ লিখিয়াছেন:- The exact date of the fiction is given as the 10th If Magh, 610 Bengal year of A.D. 1203, the same year in which the first Muhammakan invasion of Bengal under Bakhtyar Khilji took place. (J.A.S.B. Vol XLIII. Part 1 P. 205 )

৩. ইহার একটি বিশেষ প্রমাণ এই যে, রঘুনন্দন এই রাজবংশের উপর আধিপত্য স্থাপন করিতে পারে নাই। বাচস্পতি মিশ্রের ব্যবস্থা অনুসারে তাহাদের দশক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া থাকে।

৪. এজন্য মিত্রবংশীয়গণ ভুলুয়া রাজবংশের প্রতি জাতক্রোধ হইয়াছিলেন। ডাক্তার ওয়াইজ সেই মিত্রবংশীয় বারু ব্রজসুন্দর মিত্রের সাহায্যে “দ্বাদশ ভৌমিকের ইতিহাস” রচনা করিয়াছিলেন। এজন্য তিনি ভুলুয়া রাজ্যের স্থাপন কর্তার এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেনঃ- “Raja Bishandhar Raj of the low class of Kayastha Called Sur”, (J.A.S.B. Vol XLIII. Part 1 P. 203 )

৫. মন্তব্যটি সংশয়াতীত নয়। মোহম্মদ তুগলকের রাজত্বের প্রথম তিন বছরের মধ্যেই চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত ভুলুয়া দিল্লীর সম্রাজ্যভুক্ত হয়। ফকরুদ্দিন (পরে ফকরুদ্দিন মুবারকশাহ) ভুলুয়াতে আপন অধিকারে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া মেঘনা অতিক্রম করিয়া সোনারগাঁ আক্রমণ করিয়াছিলেন সম্ভবত ১৩৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে The history of Bengal, Vol II, পৃঃ ৮৮

৬. প্রেক্ষাবৎ পরিতোষ নিস্তল মহামাণিক্য রত্নাকর। প্রাক্ সৎপুরুষ পৌরুষোৎকর কথা স্রোতস্বতী ভুধর :। মূল্যচ্চারণ চাতুরী মধুকরী প্রাগভ্য পুষ্পাকর; শ্রমল্লহ্মণ ভুপতে রভিনবস্তাছক্ প্রবন্ধোত্তরঃ। আশ্রয়ো যস্য রাস্ত নিস্তস্য, বীররসস্য চেৎ। প্রবন্ধো ভূভুজা বদ্ধস্তস্মিল্লোকপরিক শ্রমঃ॥

৭. সেনাপতি রামমোহন সিংহ (রামাইমালী) কায়স্থ বংশজ। উজীরপুরার সিংহ (রায়) মহাশয়গণ তাহার সন্তান সন্তুতি।

৮. চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাসে লেখকগণ এই ঘটনাটি কিঞ্চিৎ বিকৃত আকারে চিত্রিত করিয়াছেন, কিন্তু তাহারাও রামচন্দ্রের বিশ্বাসঘাতকতা ও কাপুরুষোচিত ব্যবহার গোপন করিতে পারেন নাই। ডাক্তার ওয়াইজ ইহা এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন :-
 “He (Ramchandra) immediately ordered his war-boats to be got ready and his followers to be armed. The fleet crossed Megna and anchored of Bhaluah, Lakhan Manik, not suspecting any treachery, went on board to welcome his neighbours without any guard. He was at once siezed and carried off to chandradip. (J.A.S.B. Vol. XLIII, Part 1 P. 204 )

৯. They were at length to their lodging, and by the princes’ order, served with an excellent kind of meat called brensie, which is only seen here at great men’s tables. This was such a nourishing food, that in three, or four days they recovered their full strength. In a day or two after, the prince sent them word that they might go where they pleased, the barques being ready. This being their desire they parted an hour after, and happily arrived at Decka. (Tales of Shipwrecks and Adventures at Sea. P. 705)

১০. এই মন্তব্য লিপির বিবরণ পশ্চাৎ প্রদত্ত হইবে।

১১. Hunter’s statistical Account of Bengal, Vol. VI, Page 308.

১২. সম্প্রতি সুপারি বৃক্ষের যে রূপ মড়ক উপস্থিত হইয়াছে, ইহার কোনরূপ প্রতিকার না হইলে নওয়াখালীবাসীগণ নিতান্ত কষ্টে পতিত হইবে। নিতান্ত দরিদ্র ব্যক্তিরা বৎসর অন্যূন শতাবধি টাকার সুপারি বিক্রয় করিয়া থাকে। বার্ষিক ৪/৫ হাজার টাকার সুপারি বিক্রয় করিয়া থাকেন, এরূপ লোক নিতান্ত বিরল নহে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *