প্রথম অধ্যায় – পুঁজিবাদ সীমাবদ্ধতা
এক দিকে প্রাণহীন বিশাল প্রাচুর্য, অন্যদিকে দারিদ্র্য
প্রকৃতপক্ষে গভীর বিশৃঙ্খলারই প্রকাশ ও চিহ্ন।
-টিবর সিটোকভস্কি
ক্লাসিক্যাল ‘লেইজে- ফেয়ার’ ধারণা সম্বলিত পুঁজিবাদের অস্তিত্ব বর্তমান পৃথিবীর কোথাও নেই। শতাব্দীকাল ধরে এর পরিমার্জন ও পরিবর্তন ঘটেছে। পুঁজিবাদের ত্রুটিগুলো, বিশেষত অর্থনীতির উপর এর বিরূপ প্রভাব দূর করার জন্য বিভিন্ন সরকার সংশোধনমূলক বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফলে অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে পুঁজিবাদ তার আকর্ষণীয় আবেদন অব্যাহত রেখেছে। সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা, অর্থনীতিতে সরকারের বিশাল ভূমিকার নেতিবাচক ফলাফল এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রভৃতির কারণে পুঁজিবাদের আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। উদারনীতিবাদ বা স্বল্পতম সরকারি হস্তক্ষেপ সম্বলিত ক্লসিক্যাল মডেলে প্রত্যাবর্তনের প্রতি সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের আহবান বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু পাশ্চাত্যের শিল্পোন্নত জগতেই নয়, বরং তৃতীয় বিশ্বের বৃহদাংশে ও প্রাক্তন কমিউনিস্ট দেশসমূহে এ ধরনের চিন্তাধারা অর্থনৈতিক নীতিকে প্রভাবান্বিত করেছে। এমতাবস্থায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যৌক্তিকতা কতটুকু, কোন উপাদানগুলো এর বিকাশে সহায়তা করেছে, এ ব্যবস্থা দ্বারা এর সাফল্য হিসেবে দাবিদার ও বহুল প্রচারিত উৎপাদন দক্ষতা এবং একই সাথে সম্পত্তি অর্জন করা সম্ভব কিনা তা খতিয়ে দেখা বাঞ্ছনীয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংশোধনমূলক পদক্ষেপের কতিপয় অংশ বর্তমান অধ্যায়ে এবং ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ শীর্ষক তৃতীয় অধ্যায়ে বাকি অংশ আলোচিত হয়েছে।
পুঁজিবাদের পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছেঃ
(ক) পুঁজিবাদ ব্যক্তিগত মানুষের পছন্দের ভিত্তিতে সম্পদ বৃদ্ধি ও পণ্য উৎপাদন এবং চাহিদা পূরণকে মানব কল্যাণের জন্য সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে,
(খ) পুঁজিবাদ ব্যক্তিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য ব্যক্তিমালিকানা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণে অবারিত স্বাধিনতাকে পুঁজিবাদ অপরিহার্য মনে করে,
(গ) পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক সম্পদ বণ্টনে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজারে উৎপাদক শ্রেণী কর্তৃক বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অত্যাবশ্যক মনে করে,
(ঘ) উৎপাদন দক্ষতা বা ন্যায়সঙ্গত বণ্টন কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের বৃহৎ ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে বলে পুঁজিবাদ মনে করে না, এবং
(ঙ) পুঁজিবাদ দাবি করে, মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক স্বার্থও পূরণ হবে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যুক্তি: সামঞ্জস্যতার দাবি
বাজারব্যবস্থার সামগ্রিক যুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা একই সাথে ব্যক্তিস্বার্থ ও সমাজস্বার্থকে সুষমভাবে সমন্বিত করে। মনে করা হয়, সার্বভৌম ভোক্তা হিসেবে মানুষ যৌক্তিকভাবে আচরণ করে এবং তাদের পছন্দ মোতাবেক সর্বনিম্ন মূল্যে পণ্যদ্রব্য ও সেবা ক্রয় করতে চেষ্টা করে। মানুষের এ পছন্দ এবং পছন্দনীয় সামগ্রীর জন্য বাজার মূল্য প্রদানে আগ্রহ বাজার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। উৎপাদক শ্রেণী আবার ভোক্তা শ্রেণীর এ চাহিদা মোতাবেক সম্ভাব্য সর্বনিম্ন মূল্যে উৎপাদন এবং সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে। ভোক্তা শ্রেণীর উপযোগিতামূলক বাজারে পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারিত হয়। উৎপাদন উপকরণ, পণ্যসামগ্রী ও সেবার মূল্য নির্ধারণের এই পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থনীতিতে ভোক্তা শ্রেণীর পছন্দের সাথে সর্বোচ্চভাবে সামঞ্জস্যশীল পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন নিশ্চিত হয়।
বাজার অর্থনীতিতে এভাবে নির্ধারিত দ্রব্যমূল্য কারো সচেতন প্রচেষ্টা বা সরকারি হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই উৎপাদনের এক খাত হতে অন্য খাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পদ সঞ্চালন করে থাকে।
বাজার অর্থনীতিতে যে পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয় তা ভোক্তা সমাজের পছন্দের ফল, তাই একে সবচেয়ে দ্ক্ষ ব্যবস্থা বলা যায়। যেহেতু এ ব্যবস্থা পণ্যসামগ্রীর ইনসাফতিত্তিক উৎপাদনে বিভিন্ন উৎপাদন উপকরণের (শ্রম, ভূমি, পুঁজি ও উদ্যোক্তা শ্রেণী) অবদানের ভিত্তিতে তাদের আয় নির্ধারন করে দেয়, তাই এ আয় বণ্টন ব্যবস্থাকেও বলা যায়। ফলে ভোক্তা শ্রেণীর সর্বাধিক সন্তুষ্টি, উৎপাদক শ্রেণীর সর্বনিম্ন উৎপাদন খরচ, মজুরি ও লভ্যাংশসহ সকল উৎপাদন উপকরণের সর্বোচ্চ উপার্জন নিশ্চিত হয়। উপসংহারে তাই বলা যায়, বাজার অর্থনীতি শুধুমাত্র সম্পদ ব্যবহারে দক্ষতাই নিশ্চিত করে না, বরং আয় বণ্টনের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ ন্যায়পরতা নিশ্চিত করে। ব্যক্তি ও সামাজিক স্বার্থের মাঝেও বাজার ব্যবস্থা অর্থনৈতিক সুসামঞ্জস্যতা বিধান করে। এ ব্যবস্থা মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করে কিনা অথবা এর বন্টন ব্যবস্থা সুষম কিনা- এ প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত নয়। কেননা বাজার অর্থনীতির মূল্যব্যবস্থা পূর্ব নির্ধারিত, সামষ্টিক মূল্যবোধ নির্দেশিকা ছাড়া এ প্রসঙ্গের নিরপেক্ষ সমাধান সম্ভব নয়। সম্পদের বৈষম্য প্রশ্নটিও তাই যথাযথ নয়, কেননা ব্যক্তির সম্পদ পণ্য উৎপাদনে তার অবদানের উপর নির্ভরশীল। তাই সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ততটুকুই, যতটুকু সামগ্রীর প্রতিযোগিতা, সুস্থ বাজার, দ্রব্য সামগ্রীর সরবরাহের ত্রুটি দূরীকরেণের জন্য প্রয়োজন।
প্রত্যেক প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্যকে একটি ‘প্যারেটো অপটিমাম’ (Pareto Optimum)বলে ধরা হয়। কারো অবস্থার কিছু অবনতি না ঘটিয়ে অন্য একজনের অবস্থার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয় এবং এ অবস্থাকে ‘দক্ষ’ ও ‘সুষম’ বলে মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ‘দক্ষতা’ ও ‘ন্যায়পরতা’র এ সংজ্ঞার কাঠামোর সাথে তাই দারিদ্র্য দূরীকরণ, অভাবমোচন ও প্রয়োজন পূরণ, আয় ও সম্পদের বৈষম্য দূরীকরণের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ধরে নেয়া হয় যে, প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থা দ্বারা যে ‘দক্ষতা’ ও ‘ন্যায়পরতা’ অর্জিত হবে, তার পরোক্ষ ফল হিসেবে এসব উদ্দেশ্যগুলো সাধিত হবে। প্যারেটো অপটিমালিটির কাঠামোর মধ্যে থেকে স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য পন্থা হচ্ছে, কারোর অবস্থার অবনতি না ঘটিয়ে অন্যের অবস্থার উন্নতি ঘটানো। কিন্তু ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায় যে, ব্যক্তিস্বার্থ ও সমাজস্বার্থের মাঝে সমন্বয়ের এ দাবিটিতে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। এ ব্যবস্থা ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। মূলত ‘ব্যক্তিস্বার্থের’ দ্বারা পরিচালিত বাজারব্যবস্থার ‘অদৃশ্য হাত’ ডালটনের ভাষায় জন্ম দিয়েছে, “ভোগবাদের ফসল অমানবিক, অবহেলিত ও অন্যান্য এক সমাজ; সামাজিক বৈষম্য মালিক, শ্রমিক, ভূস্বামি ও প্রজা এবং শাসক ও শাসিতের মধ্যকার দ্বন্দ”। কারণ হচ্ছে তা পুঁজিবাদের যৌক্তিকতাভিত্তিক এমন কতগুলো পূর্বশর্তের ধারণা, উপর নির্ভরশীল যা বাস্তবসম্মত নয় এবং সাধারণ অবস্থার মাধ্যমে যা কার্যকর হয়নি বা কার্যকর করা যায় না। ব্রিটটান তাই যথার্থ বলেছেন, “বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে সামাজিক সুফল পাওয়ার জন্য যেসব পূর্ব ধারণা, শর্ত ও সীমারেখা প্রয়োজন তা কখনো পূর্ব থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি; বরং পুঁজিবাদের অধিকাংশ রীতিনীতি বিশেষ সমস্যা উদ্ভব হবার পূর্বে রচিত হয় না। যেহেতু ব্যক্তি ও সমাজস্বার্থের মধ্যে সমন্বয়ে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের সেকুলার ধারণাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে, তাই এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও উপাদানগুলো অবলোকন করা দরকার।
সেকুলার মতবাদের উপর গুরুত্বারোপ
জ্ঞানালোকের বিশ্বদুষ্টি (The Enlightenment Worldview)
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্যন্ত প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী রেঁনেসা আন্দোলন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধারণাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। ‘রেঁনেসা’ যা প্রায়শ ‘যুক্তির যুগ’ এর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তার চূড়ান্তরূপে দেখা যায় যে, তারা খৃস্টিয় বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছে। এ ধর্মবিরোধী ভূমিকার কারণসমূহ অনুসন্ধান করার অবকাশ এ পুস্তকে নেই। তবে অবশ্যই অন্যতম কারণ হিসেবে চার্চের দুর্নীতি ও কুপমণ্ডুকতাকে চিহ্নিত করা যায়। ‘যাজকশ্রেণীর মাঝে ধর্মীয় অবস্থার অবনতি এত বিশাল যে, তা প্রমাণের জন্য হাজারো উদাহরণ উপস্থাপন করf যেতে পারে’। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ যাজক- বিরোধী মনোভাব প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের প্রতিও আস্থার ভিত নাড়িয়ে দেয়। ফলে চার্চের সাথে সম্পৃক্ত সকল প্রকার বিশ্বাসকেই “অগ্রহণযোগ্য” বলে ধরে নেয়া হয়। রেঁনেসার সামগ্রিক সময়ে ভলতেয়ারের “কুখ্যাত জিনিসটি ধ্বংস কর” এ বাণী প্রতিধ্বনি করে বেরিয়েছে। ডুরান্ট যথার্থই মন্তব্য করেছেন, যদি যাজক শ্রেণী সুরুচিশীল ও ভক্তিবাদী জীবনযাপন করত, তবে হয়ত খৃস্টিয় প্রত্যাদিষ্ট কিতাব ও ঐতিহ্যের মর্যাদাকে চার্চ রক্ষা করতে পারতো’।
রেঁনেসা আন্দোলনের অগ্রগামী চিন্তানায়কগণ ধর্মীয় বিশ্বাসের বদলে মানব জীবনের ক্ষেত্রে যুক্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাদের মতে, কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা হতে জ্ঞান অর্জন সম্ভব। আধ্যাত্মিক সত্যকে অনুভব বা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও কেবলমাত্র যুক্তিকেই সর্বাধিক প্রাধান্য প্রদান করা হয়। একের পর এক ক্ল্যাসিক চিন্তাবিদ লক, বার্কলি, হিউম, কান্ট বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সম্মানজনক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন এবং তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব, আত্মার অমরত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ, পারলৌকিক জীবন এবং অন্যান্য ধর্মীয় মতাদর্শের প্রতি সংশয় সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হিউম ধর্মীয় বিশ্বাসকে আধিভৌতিক ও কল্পনাপ্রবণ বিভ্রম বলে অভিহিত করেন। এ ধরনের মন্তব্য নিউটনের জগত সম্পর্কে ধারণাকে গ্রহণযোগ্য করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করল। নিউটনের মতে, ঈশ্বর একজন ঘড়ি নির্মাতার মতো, যিনি এ জগৎ সৃষ্টি করে একে স্বয়ংক্রিয় ঘড়ির মতো চালিত করে দিয়েছেন, কিন্তু এরপর আর এর কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করেননি। ভলতেয়ার এ কথাটাই তার বহুল প্রচলিত প্রবচনে এভাবে ব্যক্ত করেছেন, “যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাও থাকত, তবে তাকে আবিষ্কার করে নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ত”।
বিশ্বের এ যান্ত্রিক ব্যাখ্যার ফলে মানব আত্মারও যান্ত্রিক ব্যাখ্যা করা শুরু হলো। মানুষকে অন্ধ, উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির স্বয়ংক্রিয় বিবর্তন প্রক্রিয়ার এক দুর্ঘটনাজাত উপজাত হিসেবে দেখা হলো। মানুষ এক অন্ধ নিষ্ঠুর শক্তির করুণার শিকার, যাকে ঐ শক্তি অজ্ঞাতসারে জন্ম দিয়েছে। যেসব প্রতিপাদ্যের উপর ধারণা অবয়ব লাভ করল তা কতটুকু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত তা বিবেচ্য বলে গণ্য হলো না। বরং বিজ্ঞানের নামে এসব ধারণা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে পরিগণিত হলো।
ধর্মের বাধন, যা নৈতিকতা ও মানব ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে জীবনের ভিত গঠন করে, তা এভাবে ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ল। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হয় অথবা মানব জীবনের জন্য কোনো তাৎপর্য বহন না করে, তবে মৃত্যুর পর পারলৌকিক জীবনে স্রষ্টার সামনে জবাবদিহিতার কোনো প্রশ্ন আসে না। যদি জীবনের কোনো চরম ও গূঢ় উদ্দেশ্য থাকেও, তবে দেকার্তের ভাষায় তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। মানব জীবনের উদ্দেশ্য এমন একটি ধারণা যা ‘বৈজ্ঞানিকভাবে অর্থহীন’ এবং ক্রমান্বয়ে সামাজিক চিন্তাধারা থেকে তা অপসৃত হচ্ছে। তদানুসারে বার্ট্রান্ড রাসেল মন্তব্য করেছেন, ‘সকল যুগের সকল পরিশ্রম, সকল অনুপ্রেরণা, মানব প্রতিভার সকল ঔজ্জল্য এ সৌরজগতের মৃত্যুর সাথে অমোঘ নিয়তির মতো নিভে যাবে। মানবকীর্তির সকল সৌধ এ বিশ্বজগতের ধ্বংস্তূপের নিচে কবরস্থ হয়ে যাবে’। ‘জীবনের যদি কোনো চূড়ান্ত উদ্দেশ্য না থাকে, তবে কোনো প্রকার উচ্চতর অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস ও আদর্শকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকারও কোনো অর্থ হয় না’। তাই জাঁপল সাত্রের ভাষায় ‘মূল্যবোধের একমাত্র ভিত্তি হতে পারে মানবীয় স্বাধীনতা। কোন মূল্যবোধের ভিত্তিতে জীবন পরিচালিত হবে তার জন্য বাহ্যিক বা অতিলৌকিক কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন নেই’। সামাজিক ডারউইনবাদ এ ধারণাকে আরো জোরদার করল। ‘অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম’ এবং ‘যোগ্যতমের বেঁচে থাকার অধিকার’ এ ধারণাদ্বয় শেকড় গেড়ে বসল।
বস্তুবাদ ও নির্ণয়বাদ (Materialism & Determinism)
রেঁনেসা কর্তৃক ধর্মীয় ধারণা ও বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যানের ফলে সমাজ বিজ্ঞানে ব্যক্তি ও সামাজিক আচরণকে নিউটনের পদার্থ বিজ্ঞানের যান্ত্রিকগুণে ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা শুরু হলো। লা মেটরি বললেন, মানুষের আচরণ পদার্থ বা রাসায়নিক কার্যকারণ ও প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। ‘পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা বস্তুর বুদ্ধিমত্তা আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না’- এ ধারণা ‘পজিটিভিজম (Positivism) আন্দোলন নামে দানা বেঁধে উঠল। এর ফলে যুক্তি ও বিজ্ঞান প্রাধান্য লাভ করল। মানুষের কর্মকান্ডকে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যার এ প্রচেষ্টার ফলে সমাজ বিজ্ঞান বস্তুবাদী ও নির্ণয়বাদী রূপ পরিগ্রহ করল।
স্রষ্টায় অবিশ্বাসের পরিণতিতে সৃষ্টি হয়েছে বস্তুবাদ। বস্তুবাদী দর্শন অনুযায়ী বস্তুই হচ্ছে এ মহাবিশ্বের প্রথম বা মৌলিক সৃষ্টির ভিত্তি। কোনো উচ্চতর উদ্দেশ্য, চরম লক্ষ্য বা বুদ্ধিমত্তা দ্বারা এ মহাবিশ্ব পরিচালিত নয়। সব কিছুকে বস্তুর ভিত্তিতে ও প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করতে হবে। মানুষের আবেগ এবং মূল্যবোধ হচ্ছে এক ধরনের মানসিক প্রক্রিয়া বা বিভ্রম যার প্রকৃত কোনো ভিত্তি নেই। এর ফল দাঁড়ায় সম্পদ, দৈহিক সুখ ও ইন্দ্রিয় সম্ভোগ হচ্ছে সর্বোচ্চ বিষয় যা মানুষ অর্জন করতে পারে। বস্তুবাদ এভাবে বাণিজ্যিক সংস্কৃতির জন্ম দিল। বছরের পর বছর এরূপ ভোগ সংস্কৃতির লিপ্সা এত বৃদ্ধি পেলো যে, তার চাহিদা সীমিত সম্পদের সীমাকে ছাড়িয়ে গেল।
নির্ণয়বাদকে মানবাত্মার সচেতন রূপকে অস্বীকার করার ফল বলা যায়। নির্ণয়বাদের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য দাঁড়ায়, এ মহাজাগতিক বিশ্বের সকল কিছু, ইতিহাসের সকল ঘটনাবলী তাদের ভৌতিক, সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারণের উপর নির্ভরশীল এবং নিয়ন্ত্রিত। লক মানব মনকে ‘টেবুলা রাসা’ (tabula rasa) নামে অভিহিত করেছেন, যার কোনো নিজস্ব চরিত্র নেই। তার মতে, মানব মন হচ্ছে কাঁচামালের মতো যা বাহ্যিক আর্থ-সামাজিক শক্তিসমূহ দ্বারা রূপ ও আকৃতি লাভ করে। মার্কস ফ্রয়েড, ওয়াটসন এবং স্ক্রিনারের মতে ‘মানুষের মন পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এ পরিবেশ মানুষের মনের নিয়ন্ত্রনের বাইরের শক্তি। মানুষের আচরণকে তাই অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় বাহ্যিক ক্রিয়ার প্রভাবে সৃষ্ট স্বয়ংক্রিয় ও যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া বলা যায়’ (ওয়াটসন ও স্ক্রিনার)। ফ্রয়েডের মতে, ‘এ আচরণ হচ্ছে অবচেতন মনের প্রতিক্রিয়া’। আর মার্কসের মতে ‘মানুষের আচরণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিক্রিয়ার প্রতিফলন’। মানবসত্তার জটিলতা ও স্বাতন্ত্র্যকে অগ্রাহ্য করা ছাড়াও নির্ণয়বাদ ব্যক্তিমানুষের কার্যকলাপের জন্য স্বীয় নৈতিক দায়দায়িত্বকেও অস্বীকার করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নির্ণয়বাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মীয় চিন্তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ধর্মীয় মতে ‘সকল কাজের জন্য স্রষ্টার নিকট জবাবদিহিতা রয়েছে’।
অসফল প্রতিবাদ
মানুষ ও বিশ্ব সম্পর্কে এই যে যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ হয়নি এমন নয়। রুশো, কান্ট ও বার্গসনের মতো রোমান্টিক ও আদর্শবাদী দার্শনিক এবং অসংখ্য ধর্মবেত্তাগণ তীক্ষ্ম প্রতিবাদ উচ্চারণ করেন। তারা জ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তির সীমাবদ্ধতাসমূহের উপর আলোকপাত এবং অনুভূতি ও সংজ্ঞার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এভাবে তারা মহাজাগতিক বিশ্ব পরিকল্পনায় মানুষের অনন্য অবস্থানকে চিহ্নিতও করতে চান। তারা রেঁনেসা চিন্তাধারার অন্তঃসারশূন্যতাকে তুলে ধরেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ভলতেয়ারের ‘কেনডাইড’-কে (Candide) “ভাঁড়ের কলম হতে বেরিয়ে আসা অখাদ্য” হিসেবে বর্ণনা করেন। রোমান্টিক দার্শনিকদের দৃষ্টিতে রেঁনেসাবাদী দার্শনিকগণের দর্শন অনুভূতিহীনতা, নিরেট যান্ত্রিকতা, অবাস্তবতা ও অমানবিকতার দোষে দুষ্ট।
কিন্তু পাশ্চাত্যে সেকুলারতার যে জোয়ার উত্তাল হয়ে উঠেছিল, রোমান্টিক দার্শনিকগণের প্রচেষ্টা তা রোধ করতে ব্যর্থ হয়। দেকার্তে, স্পিনোজা লিবনিজ এবং লকের মতো রেঁনেসার প্রাথমিক চিন্তাবিদগণ তাদের যুক্তিবাদ বা প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের প্রতি বিরোধিতাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাননি। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভলতেয়ার, হিউম এবং হলব্যাচের মতো চিন্তাবিদগণ ছিলেন ভিন্নতর। তারা শুধু অধিকতর বস্তুবাদীই ছিলেন না, বরং তারা ছিলেন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন।
ফলে রেঁনেসা আন্দোলন যা কতিপয় বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল, তা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রভাবিত করে একসময় বুদ্ধিজীবী সমাজের বৃহদাংশসহ জনসাধারণের উল্লেখযোগ্য অংশকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আকৃষ্ট করে ফেলে। ই. এফ. শুমেকারের ভাষায়, ‘উনবিংশ শতাব্দীর এই মতাদর্শ শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আজকের পশ্চিমারা বিশেষত আমেরিকানরা এখনো রেঁনেসা যুগের আত্মিক সন্তান’।
রেঁনেসা চিন্তাধারার জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও স্রষ্টায় বিশ্বাস, আস্থা ও আশা মানব হৃদয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহে দৃঢ়মূল ছিল এবং তারা যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। সার্বিক নিরশ্বরবাদের অস্তিত্ব যেমন আজকে নেই তেমনি রেঁনেসা যুগেও ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তখন যা ঘটেছিল তা হলো, রেঁনেসা চিন্তাধারার মোকাবিলায় সমাজে সম্মিলিত শক্তি হিসেবে ধর্মের ভূমিকা হ্রাসপায় এবং সেকুলারমতবাদ ধর্মের স্থান দখল করে নেয়। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। নৈতিক মূল্যবোধ তার সামাজিক আইনগত ক্ষমতা হারায় এবং সামাজিক নৈতিক মূল্যবোধ অপরিচিত বিষয়ে পরিণত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষাসূচি কদাচিৎ বাধ্যতামূলক করা হয়, ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে তা আর ছাত্রদের আকর্ষণ করল না। কেননা শিক্ষার্থীরা বাস্তব জগতে যা তাদের জন্য লাভজনক হবে, সেসব বিষয়ের প্রতিই মনোযোগী হলো।
নৈতিক ছাঁকনির অভাব
ধর্মের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব তার মূল্যবোধের সামাজিক প্রয়োগশক্তির উপর নির্ভরশীল। তাহলেই কেবল আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের উপর ধর্মের প্রভাব অক্ষুণ্ণ থাকে। এমতাবস্থায় ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি অনাস্থার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে দুঃখজনক বিপর্যয় বলা হয়। কেননা এর ফলে সমাজ জীবনকে মন্দ হতে পরিশুদ্ধ রাখার আর কোনো ব্যবস্থা থাকে না। স্বার্থপরতা, জিনিসপত্রের মূল্য ও মুনাফা ধর্মীয় মূল্যবোধের স্থান দখল করে নেয় এবং তা সম্পদের বণ্টন, চাহিদা ও সরবরাহের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তি মানুষের অভ্যন্তরীণ চেতনার মধ্যে কার্যকর বিবেকবোধ তখনো কিছুটা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করলেও ব্যক্তিস্বার্থ ও সমাজস্বার্থের মধ্যে সমন্বয় বিধানের জন্য যে সামগ্রিক নিয়ামক ব্যবস্থ থাকা দরকার তা আর কার্যকর থাকে না।
ধর্মীয় মূল্যবোধের নিয়ামক ব্যবস্থাকে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় অনুশাসন দুর্বল হয়ে পড়ায় একই স্রষ্টার সৃষ্টি সকল মানুষের ন্যায়পরতা ধারণাটি ধূলিস্যাৎ হয়ে পড়ে। উক্ত অনুশাসনের উদ্দেশ্য ছিল সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সকল মানুষের অভাব পূরণ এবং সম্পদ ও আয়ের সুষম বণ্টন। ইতিহাসের ব্যাপক অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে টয়েনবি ও ডুরান্ট এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধ ব্যতিরেকে নৈতিক উচ্চমান ও সামাজিক সংহতি অর্জন সম্ভব নয়। টয়েনবি’র ভাষায়, ‘ধর্ম মানুষের মাঝে সামাজিক দায়িত্বানুভূতিকে ধ্বংসের পরিবর্তে বৃদ্ধি করে। মানুষে মানুষ ভ্রাতৃত্ববোধের পূর্বশর্ত হচ্ছে সব মানুষের পিতা তথা স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বরের ধারনা। যদি মানব পরিবারের পিতা হিসেবে স্রষ্টাকে স্বীকার করে নেয়া না হয়, তবে মানব সমাজকে এক সূত্রে বন্ধনের আর কোনো বিকল্প থাকে না’। উইল এবং এরিয়েল ডুরান্টও জোরালোভাবে মন্তব্য করেছেন যে, ‘ ধর্মের সাহায্য ব্যতিরেকে কোনো সমাজ উচ্চ নৈতিক মান বজায় রেখেছে ইতিহাসে এর কোনো উদাহরণ নেই।
উপযোগবাদ (Utilitarianism)
ধর্মীয় অনুশাসন হতে যে সামাজিক শুভবুদ্ধি ও চেতনা জাগ্রত হয় তার অনুপস্থিতিতে কিভাবে ভালোমন্দ, কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত অথবা ন্যায়-অন্যায় নির্ণয় করা যাবে? জেরেমি বেস্থাম, যিনি নিজে ছিলেন একজন নাস্তিক, এই প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়াস পান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সদুত্তর তিনি খুঁজে পাননি। নৈতিক মূল্যবোধের স্থান অধিকারী উপযোগবাদের ভোগবাদী মতবাদ হচ্ছে, যা কিছু কষ্টদায়ক তাই মন্দ। এভাবে আনন্দ ও কষ্টের ভিত্তিতে নির্ণীত হবে ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি। উপযোগবাদের এই নীতিকে অনেকটা গাণিতিক অংক শাস্ত্রের মতো মনে করা হলো। ১৭৭৯ সালে রেভারেন্ড জন ফরস্টারকে লিখিত এক পত্রে বেস্থাম বলেন, ‘উপযোগবাদ এমন এক দৈব শক্তির ন্যায় যা ভালোমন্দ সম্পর্কিত সকল প্রশ্নের সমাধান দিতে পারে’। তাই যে ব্যক্তি তার উপযোগ বৃদ্ধির চেষ্টা করেন তিনি একজন ভালো লোক এবং একটি ভালো সমাজ হচ্ছে তাই, যা তার সামগ্রিক উপযোগ বৃদ্ধির চেষ্টায় নিয়োজিত। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির চেষ্টায় যদি প্রত্যেক ব্যক্তি নিয়োজিত হয়, তাহলে সর্বাধিক মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত হবে। ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মাঝেও সমন্বয় সাধিত হবে। বেস্থামের মতে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্বীয় স্বার্থ অনুযায়ী পরিচালিত হবার অধিকার রাখে। সুতরাং বেস্থামের যুক্তি অনুযায়ী মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হবার ধারণা একটি ‘সারহীন বাহুল্য কথা মাত্র’।
যেহেতু সুখ হচ্ছে একটি মানসিক অবস্থা, সেহেতু কী কী উপাদান ব্যক্তি ও সমাজের সুখ বৃদ্ধি করে তার বিস্তৃত বিবরণ ও ব্যাখ্যা নেই বলে উপযোগিতাবাদ নীতিকে অস্পষ্ট ও অকার্যকর বলা যেতে পারে। লক্ষ কোটি মানুষের সুখকে পরিমাপ ও যোগ করা সম্ভব নয় বিধায় বিকল্প উপযোগবাদ নীতির মাধ্যমে কতটুকু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন সম্ভব তাও নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে কোনো প্রকার সর্বসম্মত ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। কেননা সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্বীয় স্বার্থের অনুসরণ করে; স্বীয় স্বার্থান্বেষণ অন্যের কল্যাণ-অকল্যাণের উপর কি প্রভাব ফেলবে সে বিষয়ে কোনো ব্যক্তি সচেতন নয়। তাছাড়া ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ নিজেদের অনুকূলে শক্তি ও ক্ষমতা খাটিয়ে অনেক কিছু করতে পারে। এখানে রাউলস এর ‘অজ্ঞতার পর্দা’ (veil of ignorance) নামক নীতির উল্লেখ করা যেতে পারে। সমাজের প্রত্যেকটি লোক তার নিজের স্বার্থ, সামাজিক অবস্থান, তার শ্রম ও প্রতিভা সম্পর্কে বাজার মূল্যের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান সম্পর্কে না জেনেই যদি নিজ নিজ পছন্দ বা অগ্রাধিকার ব্যক্ত করতে থাকে, তবে তা হবে একটি কল্পনাবিলাসী ব্যাপার। একটি সামাজিক সংগঠনের ন্যায়ভিত্তিক নীতিমালা হিসেবে এটি কার্যকরভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই এই উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় যে, উপযোগবাদ সাধারণ স্বাচ্ছন্দ্য বা ন্যায়নীতির কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারে না। বরং কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব দিতে অক্ষম এমন হাজার প্রশ্নের জন্ম দেয়। অধিকন্তু, ধর্ম যেভাবে মানুষকে সামাজিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে, উপযোগবাদ তা করতে পারে না। তাই পশ্চিমা বিশ্বেও উপযোগবাদের বিরোধিতা দেখা যায়। এ সবের ফলশ্রুতিতে নৈতিক নীতিমালার বিষয়ে উপযোগবাদের দৃষ্টিভংগির প্রতি সামগ্রিক বিকর্ষণ পরিলক্ষিত হয়।
এতদসত্ত্বেও গত দু’শতাব্দী ধরে পশ্চিমা দর্শনের উপর উপযোগবাদ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। পশ্চিমা জীবনাচরণ ও চিন্তাধারা বাকি বিশ্বকেও উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে। উপযোগবাদ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত প্রয়োগবাদ উভয়ই নৈতিক মূল্যবোধের ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। প্রয়োগবাদ ধর্মীয় আবরণ হতে মুক্ত করে সেকুলার ব্যক্তি মানুষের কোনো কিছুর ‘প্রয়োজনীয়তা’ এবং ‘আর্থিক মূল্যে’র ভিত্তিতে নৈতিক মূল্যবোধের নতুন সংজ্ঞা নির্মাণ করেছে। ফলে বিশেষ কোনো নীতিমালার প্রতি আস্থা এবং সামাজিক ঐকমত্যের জন্য মানুষের সর্বসম্মত কোনো নৈতিক আচরণের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। কেননা কোনো বিশেষ নৈতিক নীতিমালা দ্বারা আর্থিকভাবে কে কতটুকু লাভবান হবে, সে সম্পর্কে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে। বার্ট্রান্ড রাসেলের ভাষায়, “সমাজের অধিকাংশ মানুষ অন্য মানুষের কল্যাণের চেয়ে নিজের সুখ সুবিধার প্রতি অধিক আগ্রহশীল”।
উপযোগবাদ মানুষের সম্পদ ও দৈহিক ভোগলালসাকে যৌক্তিক ভিত্তি প্রদান করে। এই মতবাদ ভোগকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা মানুষের সকল শ্রম-সাধনার চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে নির্ধারণ করে। উপযোগবাদের মতে, উপার্জন বৃদ্ধি ও ভোগ চরিতার্থকরণ একটি উৎকর্ষ মূল্যবোধ। এ লক্ষ্যে যা কিছু করা হবে তা হবে ন্যায়সংগত। এভাবে ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের মাধ্যমে সামাজিক স্বার্থও পূরণ হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে এই দর্শন নৈতিক মুল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের সৃষ্টি করে। ১৯৭৮ সালে আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসীন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘দু’শত বছর এমনকি পঞ্চাশ বছর পূর্বেও আমেরিকায় একথা কল্পনা করা যেত না যে, একজন মানুষকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি চরিতার্থ করার জন্য অসীম স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। পরবর্তীতে পশ্চিমা জগতের সর্বত্র সবধরনের বাধা নিষেধ উঠে গেল। শতাব্দীব্যাপী যে খৃস্টিয় মূল্যবোধের ঐতিহ্য বজায় ছিল তার বন্ধন হতে সমগ্র পাশ্চাত্য জগত মুক্ত হয়ে গেল’।
কৌশলসমূহের ব্যর্থতা
কতিপয় অসমর্থনযোগ্য ধারনা
অর্থনীতিতে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কতিপয় ধারণার প্রবর্তন পুঁজিবাদের ভিত্তি ও কৌশল নির্মাণে সহায়তা করেছিল।
অর্থনীতির সূত্র
এই সব বিশ্বাসের অন্যতম হচ্ছে, বিশ্বজগত সম্পর্কে যান্ত্রিকতার ধারণাকে সমাজ বিজ্ঞানের উপর অর্পণ করে বলা দেয়া হয়েছে যে, পদার্থ জগত যেভাবে আচরণ করে বা যেভাবে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, অনুরূপভাবে মানুষের আচরণকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ নিউটনের পদার্থবিদ্যার অনুসরণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, জড় জগতের সামঞ্জস্যতা ও ছন্দময়তার মতোই আর্থ-সামাজিক জীবনেও যান্ত্রিক নিপুণতায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে। এভাবে স্মিথ থেকে অর্থনৈতিক সূত্রাবলীকে নিউটনের সূত্রসমূহের মতো গাণিতিক বলে গণ্য করা হতে লাগল।
মানুষের যৌক্তিক অর্থনৈতিক আচরণ
দ্বিতীয় ধারণা হলো, “মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ সব সময় যুক্তিবুদ্ধির ভিত্তিতে হবে”- এই ধারণাটি আধুনিক অর্থনীতির মূল কথা। মানুষ কেবলমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। জেভনস এর ভাষায় ‘মানুষের সমগ্র আচরণ স্বীয় স্বার্থ ও উপযোগিতা দ্বারা সুনিপুণভাবে তথা যান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়’। ফ্রিডম্যান বলেন,’মানুষের একমাত্র সামাজিক দায়িত্ব হচ্ছে মুনাফা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা’। অর্থনীতির এই সব সূত্র ব্যক্তিস্বার্থকে যুক্তিশীলতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখে। এজওয়ার্থ তাই সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, অর্থনীতির প্রথম সূত্র হচ্ছে, ‘প্রত্যেকটি অর্থনৈতিক এজেন্ট তার স্বীয় স্বার্থবোধ দ্বারা উজ্জীবিত’। প্রায় সকল আধুনিক অর্থনৈতিক মডেলই এই নীতিমালার ভিত্তিতে রচিত।
কিন্তু বাধাবন্ধনহীনভাবে এভাবে ব্যক্তিস্বার্থকে অনুসরণের মনোভাব ও মতবাদকে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে কলুষমুক্ত মনে করতে পশ্চিমের খৃষ্টিয় সমাজে সামাজিক আশীর্বাদ বা গ্রহণযোগ্যতা লাভের জন্য নতুন ধারণা প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সে ধারণাটি হচ্ছে, প্রকৃতির মধ্যে মধ্যাকর্ষণ শক্তি যেভাবে সামঞ্জস্যতা বিধানের কাজ করে, তদ্রুপ ব্যক্তি মানুষের স্ব-স্ব স্বার্থের অনুসরণও সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যতা বিধানের কাজ করে। এডাম স্মিথ যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, যদি প্রত্যেকে স্ব-স্ব স্বার্থ অনুযায়ী চলে তবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার অর্থনীতির ‘অদৃশ্য হাত’ সমগ্র সমাজের সামগ্রিক স্বার্থকে রক্ষা ও নিশ্চিত করবে এবং এভাবে ব্যক্তি ও সমাজে স্বার্থের মাঝে সমন্বয় সাধিত হবে। তাই দেখা যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তিস্বার্থ প্রকৃতপক্ষে সামাজিক স্বার্থকেই সংরক্ষণ করছে। ব্যক্তিস্বার্থকে এভাবে এক ধরনের পবিত্রতা দানই অর্থনীতিতে এডাম স্মিথের অন্যতম প্রধান অবদান।
অর্থনীতির অধিকাংশ পণ্ডিতই একমত যে, মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ যুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত। তবে এই যৌক্তিতার স্বরূপ কি তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। কেবলমাত্র আর্থিক স্বার্থ ও পারস্পারিক সমাঞ্জস্যতাকে অর্থনৈতিক যুক্তির উপাদান হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এই আর্থিক স্বার্থের আওতায় পড়ে সীমাহীন সম্পদ আহরণের প্রয়াস ও যথেচ্ছ ভোগবিলাস। যৌক্তিক আচরণের বিষয়ে মানুষের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, জীবনের উদ্দেশ্য, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং অন্যান্য মানবিক দিককে বিবেচনার মধ্যে ধরা হয়নি। যেহেতু উল্লিখিত এই সব উপাদান ও বিষয়কে পরিমাপ করা যায় না, তাই ক্লাসিক্যাল অর্থনীতি ও পুঁজিবাদের সূত্রের মাঝে এসব উপাদানগুলো কোনো তাত্ত্বিক দখল করে নিতে পারেনি।
নেয়ায়িক প্রত্যক্ষবাদ (Positivism)
তৃতীয় ধারণাটি হচ্ছে ‘পজিটিভ’ অর্থনীতির ধারণা। এর সংজ্ঞা অনুযায়ী কোনো রকম নৈতিক রূপরেখা বা মূল্যবোধের সাথে অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থনীতিতে মূল্যবোধের বিশ্লেষণ অপ্রাসঙ্গিক । অর্থনীতির এভাবে সম্পূর্ণভাবে মূল্যবোধের সাথে সম্পর্ক রহিত হয়ে যায়। প্রায় সব অর্থনীতিবিদই ক্রমান্বয়ে এ ধরনের মতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। ‘প্যারেটো অপটিমাম’ কে ‘অর্থনৈতিক দক্ষতা’র সাথে সমার্থক ধরা হয় এবং এ তত্ত্বটি কল্যাণ অর্থনীতির প্রিয়পুত্র হিসেবে পরিচিত লাভ করে। প্রস্তাবিত ব্যবস্থার ফলশ্রুতিতে যদি লক্ষ লক্ষ লোক মনে করে যে তারা ভালো অবস্থায় আছে, কিন্তু এক ব্যক্তি যদি মনে করে যে সে ভালো অবস্থায় নেই, তাহলে অর্থনীতিবিদ তার প্রস্তাবিত নীতির প্রত্যাশা সম্পর্কে মূল্যায়ন করা স্থগিত রাখতে বাধ্য হন। হার্ভে লিভেনস্টেইন বলেন, ‘যেখানে সার্বজনীন সম্মতি নেই, এবং যেখানে কিছু লোক বলে ভালো আছি, অন্যান্যরা মনে করে খারাপ আছি, সেখানে কল্যাণ অর্থনীতিবিদরা ঘোষণা করতে পারেন না যে কল্যাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় যে, যারা পরিবর্তন চায় ‘প্যারেটো অপটিমাম’ তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রদান করে। এর ফলে নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়া হয়ে পড়েছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, নিস্ক্রিয়, বৈচিত্র্যহীন, লাগামহীন, বিশেষ করে বস্তুবাদী সমাজে, যেখানে সকল গোষ্ঠী প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থ আদায়ে সচেষ্ট থাকে।
অর্থনীতিবিদ ‘সে’ (Say) এর সূত্র
চতুর্থ ধারণাটি হচ্ছে অর্থনীতিবিদ ‘সে’ এর সূত্র। ‘সে’ নিউটনের পদার্থবিদ্যার সূত্রকে অর্থনীতিতে প্রয়োগ করেছেন। এই মহাবিশ্ব যেভাবে স্বয়ংক্রিয় ও সূচারুরূপে চলেছে, সেভাবে অর্থনীতিকে হস্তক্ষেপহীন অবস্থায় ছেড়ে দিলে তা সেরকম সুচারুরূপে চালিত হবে। উৎপাদন তার নিজস্ব চাহিদার জন্ম দেবে। অতিরিক্তি উৎপাদন বা বেকারত্ব সৃষ্টি হবে না। অতি উৎপাদন বা বেকারত্বের কোনো প্রবণতা দেখা দিলে তা আপনাআপনি সংশোধিত হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক নিয়মকানুন ও সূত্রাবলী সার্বিকভাবে শক্তিশালী এবং এর জন্য বাইরের কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। সূচারু অর্থনীতি পরিচালনায় সরকারের কোনো ভূমিকাই যেহেতু নেই, তাই অনর্থক হস্তক্ষেপ থেকে সরকারের দূরে থাকাই শ্রেয়। বাজার শক্তিসমূহ ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে শৃঙ্খলা, সামঞ্জস্যতা, দক্ষতা ও ন্যায়পরতা নিশ্চিত করবে। যে বাজারব্যবস্থা আপনাআপনি ভিতর থেকে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে, সেখানে সরকারের অনাহুত হস্তক্ষেপ বরং বিকৃতি ও অদক্ষতারই জন্ম দেবে। মানুষ ও বিশ্ব সম্পর্কে যান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হবার এই মতবাদ তাই বাজার শক্তির কার্যকারিতার বিষয়ে এক অন্ধ বিশ্বাসের জন্ম দেয়।
সামাজিক ডারউইনবাদ
ব্যক্তিস্বার্থের অন্ধ অনুসরণ ও পজিটিভ অর্থনীতিকে দুষণমুক্ত বলে যে পবিত্রতার আচ্ছাদন প্রদান করা হলো, তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী বলে দেখা দিলো। যুগ যুগ লালিত আর্থ-সামাজিক ন্যায়নীতি এসং সম্পদ ও আয়ের সুষম বণ্টনের ধারণা ও বিশ্বাস বিরাট ধাক্কার সম্মুখীন হলো। নতুন ধারণা অর্থনীতিবিদের সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দান করল। তাদের প্রচারিত আর্থিক মতবাদ অপর্যাপ্ত ও অন্যায়- এই মন্তব্য হতেও পজিটিভ অর্থনীতির মূল্যবোধ- নিরপেক্ষ ধারণা তাদের অব্যাহতি প্রদান করল। ফলে অর্থনীতিবিদের কাজ দাঁড়ালো উপাত্ত-তথ্যের বিবরণ বিশ্লেষণ করা, নৈতিক মূল্যমান বিচার করা নয়। উপর্যুক্ত মতবাদের নিরিখে একজন দরিদ্র ব্যক্তি এক ডলার খরচ করে যে উপযোগ সন্তুষ্টি লাভ করবে, তা একজন লাখপতির এক ডলার খরচের সন্তুষ্টির চেয়ে অনেক বেশি- এ ধরনের তুলনামূলক বিশ্লেষণের কোনো অবকাশ নেই এবং তা করা হলে তাকে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা বলে আখ্যায়িত করা হবে। আর্থ-সামাজিক ন্যায়নীতির প্রতি প্রদর্শিত এই উপেক্ষার প্রেক্ষাপটে ইংরেজ অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাস (১৭৬৬-১৮৩৪) খৃস্টিয় সমাজে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট এ পৃথিবীতে কোনো নতুন শিশু যদি জন্মগ্রহণ করে, যাকে তার পিতামাতা ভাণপোষণ করতে পারে না, প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর বাজারে যার শ্রমের কোনো চাহিদা নেই, তার খাদ্য দাবি করার প্রকৃতপক্ষে কোনো অধিকার নেই; বস্তুত এ পৃথিবীতে জন্মলাভ করারই তার অধিকার ছিল না। প্রকৃতির হিংস্র মুষ্টির নিচে তার কোনো আশ্রয় নেই। প্রকৃতি তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে না এবং তার ধ্বংসের আদেশকে প্রকৃতি ত্বরিৎ গতিতে কার্যকর করে’।
সামাজিক ডারউইনবাদ অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করে নৈতিকতা ও ন্যায়নীতির সংজ্ঞা পাল্টে দিলো। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন অনুভব করলো না। অর্থনীতির এই নবতত্ত্বের ছত্রছায়ায় ধনীরা বিবেকের দংশনবোধকে ঢেকে রাখল। দরিদ্র ও বেকারদের অলস, অস্থিরমতি, অসৎ বা উদ্যমহীন বলে মনে করা হলো। তাদের ভর্তুকি প্রদানের যে কোনো উদ্যোগ বাজার অর্থনীতিকে ভণ্ডুল করে যোগ্যতা অনুসারে পুরস্কার দেবার সুন্দর ব্যবস্থাকে সাবোটাজ করার অপচেষ্টা বলে অভিহিত করা হলো। সমাজের এই সব দরিদ্র বেকারদের ভাতা প্রদানের উদ্যোগ হবে উদ্যমী, পরিশ্রমী, উৎপাদনশীল ব্যক্তিবর্গকে দণ্ডদান করা, যার ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়ে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন প্রচেষ্টাও নেয়া হলো যে, অর্থনীতির উপযুক্ত বিবৃতিতে যদি কাজ না হয় তবে পাদ্রীদের মুখ থেকে উচ্চারণ করা হবে যে, দারিদ্র্য পাপের শাস্তি এবং ধন সম্পদ হচ্ছে পূণ্যের পুরস্কার। এভাবে সমাজের প্রভাবশালী মতটি দাঁড়াল, ধনিক বণিক উৎপাদক শ্রেণীর বিপক্ষে দরিদ্র শ্রেণীকে যদি বেঁচে থাকতে হয়, তবে সামাজিক ভর্তুকির সাহায্যে নয়, বরং ব্যক্তিমানুষের দান দাক্ষিণ্যের উপর তাদের টিকে থাকতে হবে। এসব মতামত বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন ভাষায় প্রখ্যাত লেখকবৃন্দ যথা ডেনিয়েল ডেফো (১৭০৪), বার্নার্ড মেনডিভিলি (১৭১৪), আর্থার ইয়ং (১৭৭১) থেকে শুরু করে হার্বার্ট স্পেন্সার (১৮৫০), ডইসি (১৯০৫) এবং কেলভন কুলিজ এর লেখায় প্রকাশ পেয়েছে।
পুঁজিবাদ নামক পদ্ধতি এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সম্পদ উপার্জনে অপরিসীম ও বাধাহীন স্বাধীনতা প্রদান করে। বাজার অর্থনীতির নিয়মকানুন ও সূত্র যেহেতু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের মতো নিখুঁত ও প্রয়োগসিদ্ধ, তাই জীবন যুদ্ধে পরাজিত পেছনের সারির মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে পুঁজিবাদের ফল বলে অভিহিত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সামাজিক ডারউইনবাদ এই শিক্ষা দেয় যে, মুক্তবাজারের খোলা প্রতিযোগিতা প্রকৃতপক্ষে সাধারণ কল্যাণের ঢাল স্বরূপ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তি প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে উৎপাদন খরচ সর্বনিম্ন হবে, দক্ষতা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাবে। তাই নৈতিকভাবে উচিত বা অনুচিত এরূপ বিচার-বিশ্লেষণ বা সরকারি হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্র কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করলে, ব্যক্তিমালিকানায় উদ্যোগ অপ্রতিহত গতিতে চলতে থাকলে সর্বোচ্চ কল্যাণ লাভের মধ্য দিয়ে জাতীয়স্বার্থ সর্বাধিকভাবে রক্ষিত হবে। প্রত্যেক মানুষ তার স্বীয় স্বার্থের শ্রেষ্ঠ বিচারক। তাতে বাঁধাহীনভাবে স্ব-স্ব স্বার্থের অনুসরণের দ্বারা শুধু নিজের কল্যাণ হবে না, শেষ পর্যন্ত তা অন্যের কল্যাণও ডেকে আনবে।
তিক্ত ফলাফল
বাজারব্যবস্থা পশ্চিমা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দীর্ঘকালীন সমৃদ্ধি বয়ে এনেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সম্পদের বিপুল সম্প্রসারণ ঘটেছে। বাজারব্যবস্থার বিজয় দেখিয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হতে বিরত থাকে। পোলেনি’র ভাষায় সমাজই যেন বাজারের সম্প্রসারিত এক রূপ পরিগ্রহ করলো না। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বেকারত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলল। এতে দেখা যায় দ্রুত উন্নয়ন ও বিপুল সমৃদ্ধি সত্ত্বেও দ্ক্ষতা ও ন্যায়পরতা স্বপ্ন সোনার হরিণই হয়ে রইল।
পুঁজিবাদের ত্ক্তি বাস্তব পরিণতি মানুষের বিবেকের ন্যয়নীতিবোধকে নাড়া না দিয়ে পারেনি। তাই দেখা যায়, অতীত বা বর্তমানে পুঁজিবাদের মৌলিক নীতিমালাসমূহ বিরোধিতা ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। ইংল্যান্ডের টমাস কার্লাইল (Pastand Present, 1843), রাস্কিন (Unto this Last, 1862) ও চার্লস ডিকেন্স (Hard Times, 1854-55) এবং আমেরিকার হেনরী জর্জ (Progress and Poverty, 1870) এর ন্যায় বিখ্যাত মনীষীবৃন্দ ‘লেইজে ফেয়ার’ নীতির স্বার্থপরতাকেন্দ্রিক মতবাদকে আক্রমণ করে লেখনী চালনা করেন। থমাস কার্লাইল এই প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিকে ‘ডিসমাল সাইন্স’ (Dismal Science) বলে অভিহত করেন। তিনি নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তিস্বার্থ সমাজস্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়ে অনুকূল হতে তরান্বিত করবে- এ চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান করেন। হেনরী জর্জ বিত্ত ও দারিদ্র্যের বৈপরীত্যকে তীব্রভাবে নিন্দা করেন এব মন্তব্য করেন, ‘যতদিন পর্যন্ত স্ফীত সম্পদরাজি শুধু ধনিক শ্রেণীর বিত্ত বেসাতি বিলাসের ঘরে জমা হবে, যতদিন ধনিক শ্রেণী ও দরিদ্র শ্রেণীর দূরত্ব তীব্রতর হবে, ততদিন সত্যিকার ও স্থায়ী সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে বলা যাবে না’।
যাই হোক, এসব খ্যাতিমান লেখকদের সকল সমালোচনা সত্ত্বেও পুঁজিবাদী অর্থনীতির চিন্তাধারার জোয়ার তীব্রভাবে প্রবাহিত হতে লাগল। খ্যাতিমান সমালোচক ও মনীষীদের সকল বিরূপ মন্তব্য শুধু ইতিহাসের প্রভাবহীন মন্তব্য রূপেই বিরাজ করল। আধুনিক যুগের কিছু কৃতি লেখকও পুঁজিবাদের তিক্ত ফলাফলে উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন। হীমেন মিনিস্কি’র মতে, ‘পুঁজিবাদী সমাজ বৈষম্যপূর্ণ ও অদক্ষ’।
সমাজের চাহিদা পূরণে পুঁজিবাদের ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে, পুঁজিবাদের উদ্দেশ্য ও কৌশলের সাথে সমাজের লক্ষ্য ও চাহিদার সংঘাত। ব্যক্তিস্বার্থ ও সমাজস্বার্থের মাঝে বিরোধিতার বদলে সেতুবন্ধন রচিত হবে বলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দাবি করেছে। কিন্তু যেসব ধারণা, পূর্বশর্ত ও প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে এই দাবি করা হয়েছে, তা অবাস্তব ও অসত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। সমাজের চাহিদা ও লক্ষ্যপূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। অথচ পুঁজিবাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তা সামাজিক ডারউইনবাদ বাস্তবায়নেরই এক প্রকার অমানবিক প্রচেষ্টার নামান্তর। পুঁজিবাদের ভিত্তিভূমি হিসেবে যেসব শর্ত ও ধারণার কথা বলা হয়েছে তার সুস্পষ্ট ভাসা ভাসা ধারণার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক ‘দক্ষতা’ ও ‘ন্যায়পরতা’ অর্জিত হবে তা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
সম্পদের অদক্ষ বণ্টন ব্যবস্থা
কী উৎপাদন করতে হবে
বাজারব্যবস্থা দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রে সীমিত সম্পদের সুদক্ষ বণ্টন নিশ্চিত করে বলে যে দাবি করা হয় তাকে কেবলমাত্র সামাজিক ডারউইনবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সত্য হিসেবে অভিহিত করা যায়। আসলে দেখা যায়, এই ধরনের মূল্যবোধ ও নৈতিকতাহীন পুঁজিবাদী সমাজে অর্থবিত্তের মালিক ভোক্তাশ্রেণীর পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন হয়ে থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পক্ষপাতহীনভাবে পরিপূর্ণ প্রতিযোগিতা, দক্ষতা, ন্যায়পরতা প্রভৃতি পূর্বশর্তের কথা বলে এবং তার ভিত্তিতে উৎপাদন ব্যবস্থা দ্বারা সমাজের চাহিদা পূরণ হবার দাবি করে। কিন্তু বাস্তবে এই পূর্বশর্তসূহের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
অবাস্তব অনুমান
প্রথম অনুমান করে নেয়া হয়েছে যে, প্রাথমিক শর্ত হিসেবে সামাজিক ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রয়োজন নেই। বরং বিভিন্ন শ্রেণীর ভোক্তাগণ স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই তাদের চাহিদার ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের মধ্যে সীমিত রাখবে। ফলে ভোক্তার কোনো স্বেচ্ছাচারী চাহিদার সংঘাত দেখা দেবে না।
কিন্তু এই ধারণা তিনটি কারণে ভুল প্রমাণিত হয়েছে:
(১) যখন কোনো নৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই, তখন বিত্তশালীরা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ভোগ্য ও বিলাস সামগ্রী ক্রয় ও ভোগে কেন বিরত থাকবে? এটাই স্বাভাবিক যে সীমিত সম্পদের অপচয় দরিদ্র শ্রেণীর ভোগান্তি হবে- এ ধরনের বিবেক দংশনে ভোগার কারণ নেই। ধনিক শ্রেণী দরিদ্র শ্রেণীর দুঃখ-দুর্দশার জন্য নিজেদের বিলাস ও অপচয়কে দায়ী না করে বরং গরীব মানুষের অদক্ষতা ও তথাকথিত অকর্মণ্যতাকে দায়ী করে।
(২) ভোগলিপ্সা ও প্রয়োজন পূরণ অথবা অত্যাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয়- এভাবে চাহিদাকে আলাদা করে দেখার কোনো উপায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নেই। বরং এ ধরনের বিভাজন প্রক্রিয়ার কোনো অবকাশ পুঁজিবাদী দর্শনে নেই। যেহেতু এ ধরনের সামাজিক কোনো মূল্যবোধের তাড়না পুঁজিবাদী সমাজে নেই অথবা সমাজের সার্বিক চাহিদার বিচারে কোন দ্রব্যসামগ্রী প্রয়োজনীয় আর কোনগুলো তুলনামূলকভাবে কম প্রয়োজনীয়, তা নির্ধারণ করে দেবার বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো ভূমিকা নেই। তাই ধনিক শ্রেণী জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে নিজেদের যথেচ্ছা ভোগলালসা ও চাহিদা দ্বারা দরিদ্র মানুষকে তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন থেকেও বঞ্চিত করে থাকে।
(৩) বণিক শ্রেণী তাদের মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলার জন্য পত্রপত্রিকা, রেডিও টেলিভিশন ও অন্যান্য মাধ্যমে বিজ্ঞাপনী চমক চাঙ্গা করে তোলে। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী বিজ্ঞাপনী প্রচারণা ভোক্তশ্রেণীর মাঝে এমন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সক্ষম যে, তার সামাজিক মর্যাদা তার কেনাকাটার ধার ও ভারের দ্বারা বাড়বে বা কমবে। ফলে সে তার মানসিক বিচারবুদ্ধি হরিয়ে ফেলে, চটকদার বিজ্ঞাপনী আকর্ষণের জোয়ারে ভেসে যায়। ‘স্টাটাস সিম্বল’ (Status Symbols)বা সামাজিক মর্যাদা লাভের অন্তহীন প্রতিযোগিতায় সমাজে সৃষ্টি হয় অফুরন্ত চাহিদার নানা প্রকরণ। গলব্রেথের ভাষায়, “ভোক্তাশ্রেণীর সকল প্রকার বিজ্ঞাপনী ভাষার মর্মবাণী দ্রব্যসামগ্রী ভোগের মাঝেই রয়েছে আনন্দের সর্বোচ্চ উৎস এবং এটাই হচ্ছে মানুষের অর্জনের সর্বোচ্চ শিখর”। ফলে অপ্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যক নয় এমন সব সামগ্রীর উৎপাদনে বাজার ভরে যায়। বিজ্ঞাপনের প্রভাবমুক্তভাবে ভোক্তাশ্রেণীর যখন দ্রব্য সামগ্রী নির্বাচন ও কেনার স্বাধীনতা থাকে না, তখন ভোক্তাশ্রেণীর সার্বভৌমত্ব ও চূড়ান্ত স্বাধীনতার পুঁজিবাদ হাস্যকর বিষয় মাত্র।
এ ধরনের পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া মুনাফার স্তূপকে স্ফীত করে তোলে ঠিকই, তবে তা দরিদ্র শ্রেণীকে তাদের প্রয়োজন পূরণের হক থেকে বঞ্চিত করার বিনিময়ে। ধনীক শ্রেণীর লোক দেখানো এই ভোগবিলাসপূর্ণ কেনাকাটায় ইন্ধন যোগায় বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক এ খাতে ঋণ প্রদান। এ বিষয়ে ড্যানিয়েল বেল এর মন্তব্য ‘আগে ক্রয়ের পূর্বে মানুষকে সঞ্চয় করতে হতো, আর এখন ক্রেডিট কার্ডের বদৌলতে মানুষের সঞ্চয় না থাকলেও তারা কেনার হিড়িকে নেমে যেতে পারে। ফলে আগে যা কল্পনা করেনি তেমন চাহিদা ও ক্রয়ের নতুন সড়ক খুলে যাচ্ছে’। ফলে একদিকে সকল কেনার ইচ্ছা হয়ত মিটছে না, কিন্তু অপরদিকে অবাঞ্ছিতভাবে বেড়ে চলেছে ঘাটতি, মুদ্রা সরবরাহের বৃদ্ধি, মুদ্রানীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি এবং দুঃসহ বৈদেশিক ঋণ। এ ব্যবস্থা সমাজে অহংকার, হিংসা ও পরশ্রীকাতরতার জন্ম দিচ্ছে বলে অনেক পণ্ডিত ও গুণিজন সমালোচনা মুখর হয়েছেন। এ ধরনের তীক্ষ্ণ সমাজ সচেতন সমালোচনা যতই প্রশংসার দাবিদার হোক না কেন এতে কোনো কাজ হচ্ছে না। যতক্ষণ না সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের স্ফূরণ ঘটছে, অন্য মানুষের হকের প্রতি দায়িত্ববোধ ও সহমর্মিতা সৃষ্টি না হচ্ছে, মূল্যবোধ ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টির আদর্শবাদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে এবং সার্বিকভাবে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা সে আলোকে পুনর্গঠিত না হচ্ছে, ততদিন এ ক্ষয়ি অবস্থার পরিবর্তন আশা করা যায় না।
ন্যায়ভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা
দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদগণ প্রথমেই এমন এক আদর্শবাদী সমাজ কল্পনা করে নিয়েছেন, যেখানে সম্পদ ও আয়ের ইনসাফপূর্ণ বণ্টনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত আছে। যদি আয় ও সম্পদের এমন ইনসাফপূর্ণ ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন সমাজে বজায় থাকত, তবেই বাজারে কী ধরনের পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হবে তার উপর প্রত্যেক মানুষের পছন্দ অপছন্দের প্রভাব কাজ করত। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো কোনো শ্রেণীর বিশাল বিত্ত-বৈভব প্রাপ্তি; ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তিতে বিশেষ শ্রেণীর বিশেষ সুবিধা; বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার সুযোগ; পারিবারিক ঐতিহ্য, শারীরিক শক্তির বিভিন্নতা ও উচ্চাশা সব মিলে সমাজে মানুষের আয়ের বণ্টন শুধু যে বৈষম্যমূলক তা নয়, প্রকৃতপক্ষে সেখানে আয়ের ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের কোনো অবকাশই নেই। ফলে বিত্তবেসাতিদর মালিক সমাজে উপর শ্রেণী, যারা জাতীয় আয় ও ব্যাংক ঋণের সিংহভাগ দখল করে আছে, তারাই তাদের পছন্দ মাফিক ভোগ্য সামগ্রীর উৎপাদনকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রন করে। ঐ সব দ্রব্যসামগ্রী সমাজের জন্য কতটুকু প্রয়োজনীয় তা বিবেচ্য বিষয় থাকে না। যেহেতু এসব মানুষের অর্থকড়ি ও সম্পদের কোনো সীমা পরিসীমা নেই, তাই মর্যাদাপূর্ণ বিলাস সমাগ্রীর দাত যতই উচ্চ হোক না কেন অর্থাৎ পুঁজিবাদী চাহিদা তত্ত্বের ভিত্তিতে দাম যতই বেড়ে যাক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। এসব অনুৎপাদনশীল বিলাস দ্রব্য ক্রয়ের ঘোড়দৌড়ে এ শ্রেণীর কোনো বিষয় নেই। এভাবে দেখা যায়, বাজার অর্থনীতি চাহিদা পূরণের যে সুন্দর স্বপ্ন উপস্থাপন করে, তা অর্থবিত্তহীন বিশাল দরিদ্রশ্রেণীর ক্রয় ক্ষমতার অভাবে বিত্তশালী শ্রেণীর ইচ্ছেমতো অর্থব্যয়ের ক্ষমতার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে সঠিক দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের তত্ত্বটির প্রসাদের ভিত কত যে নড়বড় তার বাস্তব অবস্থা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফলাফল সম্পর্কে তাই অর্থনীতিবিদ টাওনি Towney সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন, ‘প্রতি বছর বাজারে যেসব পণ্য সামগ্রীর উৎপাদন দেখা যায় তার বৃহদাংশকে সঠিক অর্থে নিছক অপচয় বলা যায়, কেননা এসব সামগ্রী উৎপাদনের কোনো প্রয়োজনই ছিল না অথবা অন্য সব অত্যাবশ্যক সামগ্রী যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদনের পরই এসব উৎপাদনের অবকাশ দেখা দিত’। এ ধরনের অপচয়ধর্মী উৎপাদনের ফলে উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রীর টাকার হিসেবে সামগ্রিক মূল্যমান যাকে জাতীয় আয় (Gross National Product) নামে অভিহিত করা হয় তা আপাতঃদৃষ্টিতে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রকৃত অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। তাই জাতীয় আয়ের (জিএনপি) হ্রাস বৃদ্ধি দ্বারা মানুষের কল্যাণ বা অবস্থার উন্নতি অবনতি বোঝা যায় না ।
দ্রব্যমূল্য চাহিদার প্রতিফলন
তৃতীয়ত, এটা ধরে নেয়া হয় যে, কোনো জিনিসের জন্য যত বেশি টাকা খরচের জন্য মানুষ আগ্রহ প্রদর্শন করে, সে জিনিস তত বেশি প্রয়োজনীয়। কিন্তু এ তত্ত্বটি তর্কসাপেক্ষ। একজন দরিদ্র বা ধনী পিতার সন্তানের জন্যে দুগ্ধ সমানভাবে আবশ্যক হলেও দরিদ্র পিতা দুগ্ধের জন্য যত টাকা দিতে প্রস্তুত বা সক্ষম, তার চেয়ে ঠুনকো বিলাসী খেয়ালি জিনিসের জন্য ধনী পিতাকে অনেক বেশি মূল্য দিতে প্রস্তুত দেখা যায়। তাই দেখা যায় দ্রব্যের উচ্চমূল্য তার প্রয়োজনীয়তাকে প্রতিফলিত করে না। তাই সমাজের দুগ্ধের প্রয়োজন অনেক বেশি হলেও দরিদ্র শিশুদের সে চাহিদা পূরণ না হয়ে দেখা যায় ধনিক শ্রেণীর বিলাস সামগ্রী অনেক বেশি উৎপাদন হচ্ছে। এর দ্বারা কিন্তু অনুৎপাদনশীল ও বিলাস সামগ্রীর প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত হয় না। আর্থার ওকুন (Arthur Okun) তাই পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন, ‘পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দরিদ্র ঘরের সন্তানের মুখে এক মুঠো ভাতের সংস্থানের বদলে ধনী ঘরের পোষা কুকুরের মাংসের ব্যবস্থা করাকেই অগ্রাধিকার প্রদান করে’। শেষতক যে দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়-তা হলো বিলাস সামগ্রীর প্রতি বিত্তশালীদের আগ্রহের কারণে এসব জিনিস প্রচুর উৎপাদিত হয় এবং সরবরাহ বৃদ্ধির সাধারণ নিয়মে ক্রমান্বয়ে এসবের দাম পড়ে আসে। অন্য দিকে অগনিত দরিদ্র শিশু থাকলেও তাদের দরিদ্র পিতার ত্রয় ক্ষমতা না থাকায় দুগ্ধ প্রয়োজন মোতাবেক উৎপাদিত হয় না বরং ফলে এক সময়ে দুগ্ধের দাম বৃদ্ধি পায়।
পূর্ণ প্রতিযোগিতা
চতুর্থত, এটাও স্বাভাবিক হিসেবে ধরে করে নেয়া হয়েছে যে, পূর্ণ প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বাজার অর্থনীতি চালিত হবে। পূর্ণ প্রতিযোগিতা বলতে বোঝায় অসংখ্য ক্রেতার সাথে অসংখ্য বিক্রেতাও থাকবে, উৎপাদন করার জন্য কোনো আগ্রহী উৎপাদকের বাজারে প্রবেশে কোনো প্রকার বাধা থাকবে না। বর্তমানে ও ভবিষ্যতের বাজার তথ্যের উপর পরিপূর্ণ ধারণাও সবার জানা থাকবে। কিন্তু এসব শর্তের উপস্থিতি কোথাও দেখা যায় না। পরিপূর্ণভাবে প্রতিযোগিতামূলক বাজার একটি অবাস্তব স্বপ্ন। বড় বড় ব্যবসা ও উৎপাদক প্রতষ্ঠান এবং সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণকে যেখানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে, সে অবস্থায় পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থা ভবিষ্যতে প্রবর্তনের আশা করাও দুরাশা মাত্র। অসংখ্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ও বাধাবিঘ্ন বাজার শক্তিসমূহের সুচারুরূপে পরিচালনার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদনে সামাজিক সম্পদসমূহ ব্যবহারের মাধ্যমে যে প্রকৃত খরচ পড়ে তা দ্রব্য সামগ্রীর বাজার দরের মধ্যে প্রতিফলিত হয় না। কোথাও দেখা যায় দ্রব্যমূল্য উক্ত দ্রব্য তেরির সামাজিক ব্যয়ের চেয়ে বেশি, আবার কোথাও দেখা যায় দ্রব্যমূল্য উক্ত দ্রব্য তৈরির সামাজিক ব্যয়ের চেয়ে কম। এরকম অবস্থায় সমাজের সীমিত সম্পদের যে সুদক্ষ ও সুচারুরূপে ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদনে চারটি উপকরণ ভূমি, পুঁজি, শ্রম ও সংগঠনের যে আনুপাতিক অবদান রয়েছে তার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। উৎপাদন উপকরণগুলো উৎপাদনে তাদের অবদানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিনিময় মূল্য পায় না অর্থাৎ কেউ পায় বেশি আর কেউ পায় কম। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা ও অনুপ্রেরণার একমাত্র উৎস যেখানে ব্যক্তিগত আর্থিক স্বার্থ এবং যতবেশি তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই মুনাফা অর্জনে যখন সবাই ব্যস্ত, তখন তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সামাজিক লাভ-ক্ষতি কী দাঁড়াবে তা কেউ হিসেবের মধ্যেই আনে না। অথচ সমাজকল্যাণ ও সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে উৎপাদন প্রচেষ্টা থেকে উদ্ভূত এই সামাজিক লাভ-ক্ষতির বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাজার অর্থনীতিতে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যনির্ধারণী ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দীর্ঘ সময়ের কোনো সীমারেখা এসে ব্যক্তিস্বার্থ ও সমাজস্বার্থের ফারাক ঘুচিয়ে উভয়ের সমন্বয় ঘটাবে- এই আশাবাদ এতই সুদূর পরাহত যে, একে এক প্রকার অর্থহীন আশাবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই।
বিকৃত অগ্রাধিকার
যখন প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণের অভাবে বাজার অর্থনীতিতে সন্তোষজনক অবস্থা বিরাজ করতে দেখা যায় না, তখন বাজারে উৎপাদনের বেলায় অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিকৃতি ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। আয় ও সম্পদের বিশাল বৈষম্য ও সামাজিক ঐকমত্যহীনতার কারণে যখন সামাজিক অগ্রাধিকার বাজার অর্থনীতিতে কোনো স্থান পায় না, তখন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পদের যে অদক্ষ ও অন্যায্য ব্যবহার ঘটবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ধনিক শ্রেণীর বিশাল ক্রয় ক্ষমতার বদৌলতে তাদের খামখেয়ালিপূর্ণ বিলাসিতা পূরণের জন্য সীমিত সম্পদের অপচয়ের কারণে গরীব মানুষ অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণ হতে বঞ্চিত থাকে। প্রফেসর স্যামুয়েলসন তাই উল্লেখ করেছেন, ‘লেইজে ফেয়ারের তথাকথিত প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতি ক্ষুধার্ত, বিকলাঙ্গ ও অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেয়, যারা বড় হয়ে তাদের মতো পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত শিশুর জন্ম দেবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই’। তাঁর ভাষায়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এমনকি সমগ্রভবিষ্যৎ জুড়ে এই লেইজে ফেয়ার পুঁজিবাদ আয় ও সম্পদ বৈষম্যের নিদর্শক জ্যামিতিক রেখাকে (Lorenz curves) অপ্রতিহতভাবে চালিয়ে নেবে’। তিনি আরো বলেন, “অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথের কোনো অধিকার নেই একথা বলার যে, মুক্তবাজার অর্থনীতির ‘অদৃশ্য হাত’ অন্ধ ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা চালিত মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে শেষ পর্যন্ত সামাজিক স্বার্থ বিকাশ সাধনের দিকে নিয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ এ ধরনের প্রতিপাদ্যের অনুকূলে কোনো প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি। শুধু তাই নয় ১৭৭৬ সাল হতে এ পর্যন্ত এ ধরনের ধারণার সপক্ষে কেউ কোনো প্রমাণ্য দলিল পেশ করতে পারেনি”। The Affluent Society নামক গ্রন্থে গলব্রেথ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে অর্থনৈতিক সম্পদের বিভিন্ন উৎপাদন খাতে বণ্টন ব্যবস্থা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট; সেখানে ধনিক শ্রেণীর মাঝে বিভিন্নভাবে সৃষ্ট কৃত্রিম প্রয়োজন ও চাকচিক্যময় অপ্রয়োজনীয় ভোগবিলাসের খাতে বিপুল সম্পদের অপচয় এমনভাবে ঘটছে যাতে সম্পদভান্ডারে টান পড়ে গেছে। ফলে মৌলিক ও অত্যাবশ্যক প্রয়োজনসমূহ পূরণের জন্য সম্পদের সংকুলান করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা, গৃহায়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সেবাখাতসমূহ যার সাথে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের বর্তমান ও ভবিষ্যতের কল্যাণ ও অগ্রগতি জড়িত তা চরমভাবে অবহেলিত হচ্ছে।
সামাজিক অগ্রাধিকারসমূহকে বাজার অর্থনীতিতে প্রতিফলিত করার উপায় উদ্ভাবনের কোনো পন্থা রয়েছে কি? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, উপযোগবাদী দর্শনভিত্তিক প্রচলিত অর্থনৈতিক মতবাদ যার ভিত্তি সামাজিক ডারউইনবাদ বা কল্যাণ অর্থনীতি- যেটাই হোক না কেন, উপর্যুক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। এ মতবাদে মানুষের জন্য কোনো নির্দেশনা নেই এবং বিশ্বব্যবস্থার সেকুলার ব্যাখ্যার প্রেক্ষাপটে বাজার শক্তিসমূহই অর্থনৈতিক সম্পদের বিলিবণ্টনে একমাত্র নিয়ামক শক্তি হবে, যৌক্তিকভাবে একথা মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কেননা ধর্মীয় নির্দেশনার অনুপস্থিতিতে যদি কোনো কিছুর উপর নির্ভর করতে হয়, তবে একমাত্র বিকল্প হিসেবে মেনে নিতে হয় বাজার শক্তিসমূহের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার উপর নির্ভরতা। কারণ যদি কোনো ব্যক্তি, দল বা শ্রেণীকে সামাজিক অগ্রাধিকার নির্ণয়ের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, তবে তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ তারা সমগ্র সমাজের উপর চাপিয়ে দেবে। এমতাবস্থায় বাজার শক্তিসমূহের উপর নির্ভরতাই তুলনামূলকভাবে শ্রেয়তর বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক। সামাজিক অগ্রাধিকার নির্ণয়ের ঐকমত্য সৃষ্টির কোনো পন্থা উদ্ভাবনের নীতিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বাজারব্যবস্থা স্বীকার করে না। যেহেতু উচিত বা অনুচিত সম্পর্কে বাজার অর্থনীতিতে কোনো নির্দেশনা নেই, তাই স্বাভাবিকভাবে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বীয় স্বার্থকে সর্বতোভাবে পরিপূরণের দিকে ধাবিত করে। সমাজের সকল মানুষের কল্যাণ ও স্বার্থ নিশ্চিত হচ্ছে কিনা-এ ধরনের মূল্যবোধভিত্তিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক দর্শনে স্বীকৃত নয় বিধায় সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সমাজের বিভিন্ন মানুষের স্ব-স্ব অর্থনৈতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে। অর্থনীতিবিদ শুমেকার (Schumacher) এর ভাষায়, বাজার অর্থনীতি প্রকৃত প্রস্তাবে সামাজিক অঙ্গীকারমুক্তভাবেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করে। ক্রেতা বা বিক্রেতা কেউই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নিজেদের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর প্রতি দায়বদ্ধ নয়। অধিকন্তু পুঁজিবাদ ব্যক্তিগত অগ্রাধিকারকে সামাজিক রূপ দান করে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সম্পদের সামাজিক পুনবণ্টনের বিরোধী। ফলে দেখা যায়, বাজার অর্থনীতির চাহিদা ও সরবরাহভিত্তিক ত্রুটিপূর্ণ দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা সরকারের কিঞ্চিত হস্তেক্ষেপের সাথে যুক্ত হয়ে মানুষের আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকারের খাতে প্রবাহিত করার ফল হিসেবে সমাজের সকলের জন্য অভাব পূরণ ভিত্তিক কাঠামোগত পরিবর্তন অর্থনীতিতে আনা সম্ভব হয় না।
উৎপাদন ব্যবস্থা
উৎপাদনের মানদন্ড
কোনো দ্রব্য বা সেবা উৎপাদনের জন্য শ্রম, পুঁজি, প্রযুক্তি ও সংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। মানুষের শ্রম ও সীমিত সম্পদের সমন্বয়ে মানব সমাজে উৎপাদন সংঘটিত হয়। তাই উৎপাদন ব্যবস্থাকে দক্ষ ও সুষম করার জন্য উৎপাদন প্রক্রিয়া কতিপয় সুনির্দিষ্ট বৈশেষ্ট্যের দাবি রাখে। তাই শ্রমিক ও মালিক উভয়পক্ষকেই সর্বতোভাবে তাদের সার্বিক দৈহিক ও মানসিক শক্তি এবং ক্ষমতা প্রয়োগে উদ্বুদ্ধকরণের উপযোগী উৎপাদন ব্যবস্থাপনা চালু করা অত্যাবশ্যক। ন্যূনতম খরচ বলতে শুধু ব্যক্তিগত ব্যয় বোঝায় না। কোন প্রকার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কতটুকু সামাজিক ব্যয় সংশ্লিষ্ট সে প্রশ্নও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন খরচের অন্য একটি দিক হচ্ছে বর্তমান সীমিত সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, না কী নতুন সম্পদ সৃষ্টির ভিত্তি তৈরি হচ্ছে, সে দিকটির বিচার বিশ্লেষণ করা। তাছাড়া বিবেচনায় আনতে হবে কোনো উৎপাদন প্রক্রিয়ার পার্শ্ব–প্রতিক্রিয়া হিসেবে সৃষ্ট নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অভাব অপূরণজনিত অসন্তোষ ইত্যাদি উপাদানসমূহকে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন ব্যবস্থা এমন হবে যা মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করে তোলে এবং সংঘবদ্ধ মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে। এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব যদি নিম্নবর্ণিত শর্তসমূহ পূরণ করা সম্ভব হয়:
ক. মালিক ও শ্রমিকপক্ষ উভয়ই যদি উৎপাদনে তাদের অবদানের বিনিময়ে আনুপাতিক হারে পারিশ্রমিক লাভ করে;
খ. উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘাতের পরিবর্তে যদি সমন্বয় গড়ে তোলা হয়;
গ. কাজের একঘেঁয়েমী এ অনাবশ্যক বিরক্তি যদি হ্রাস করা হয়;
ঘ. কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারিত করা হয়; এবং
ঙ. ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ প্রবণতা রোধ করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে, সকল বাস্তব পরিস্থিতি হতে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যে উৎপাদন ব্যবস্থায় মালিক ও শ্রমিক পক্ষ উভয়কে তাদের কর্মক্ষমতা ও দক্ষতার সবটুকু উজাড় করে দিতে উদ্ধুদ্ধকরণে ব্যর্থ হয়েছে অথবা বেকারত্ব, প্রকৃত পারিশ্রমিকের বদলে কম মজুরি প্রদান এবং সম্পদ এ আয়ের কেন্দ্রীভূতকরণ ঘটিয়েছে সে উৎপাদন ব্যবস্থা শুধু অবাঞ্ছনীয় নয়; বরং অকার্যকরও বটে।
পুর্বশর্তসমূহ
উৎপাদন দক্ষতার দিক থেকে পুঁজিবাদ সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা বলে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এ ব্যবস্থাধীনে উদ্যোগ গ্রহনকারী পুঁজিপতি শ্রেণী হচ্ছে সমাজের প্রতিনিধি যারা কী ধরনের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা উৎপাদিত হবে তা নির্ধারণ করে। ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি ও মুনাফার আকর্ষণ পুঁজিপতি শ্রেণীকে কার্যকর ভূমিকা পালনে উদ্ধুদ্ধ করে। বাজার দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য পুঁজিপতি শ্রেণীর জন্য সংকেত হিসেবে কাজ করে। একদিকে মুনাফার আর্কষণ তাকে সর্বোচ্চ শ্রম ও মেধা নিয়োগে উদ্ধুদ্ধ করে, অন্যদিকে অন্যান্য পুঁজিপতিদের সাথে প্রতিযোগিতা মূল্য বাড়িয়ে সমাজকে শোষণ করার প্রবণতা হতে প্রতিহত করে। প্রতিযোগিতা তাকে ব্যয় সংকোচন, অপব্যয় হ্রাস, উৎপাদন উপকরণের খরচ কমাতে বাধ্য করে। ফলে পণ্য উৎপাদনের সর্বনিম্ন খরচই পণ্যের বাজার দামে পরিণত হয়। উপর্যুক্ত বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে এ যুক্তি উপস্থাপন করা যায় যে, উৎপাদক শ্রেণী মুনাফা দ্বারা তাড়িত হলেও প্রতিযোগিতা তাদের অতিরিক্ত দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ থেকে নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং এভাবে ভোক্তা তথা সমাজের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা হচ্ছে এক ধরনের বাইরের হস্তক্ষেপবিহীন একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যাতে অপচয়, শোষণ বা অতিরিক্ত মুনাফার কোনো অবকাশ নেই। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মুনাফার আর্কষণ উদ্যোক্তা শ্রেণীকে অধিকতর দক্ষতা ও দ্রব্যসামগ্রীর মান উন্নয়নে উজ্জীবিত করে। রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ এবং চীনের ন্যায় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এ উপলদ্ধি অধিকতর স্বীকৃতি লাভ করছে। সরকারি খাতের শিল্পসমূহের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও বিশৃঙ্খলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহও অধিকতর দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পবিকাশের দিকে বেশ ঝুঁকে পড়েছে।
ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প ও মুনাফার ভিত্তিতে দেশের শিল্পকারখানার বিকাশ সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে- এ প্রতিপাদ্যটির সফলতার জন্য কতকগুলো পূর্বশর্ত রয়েছে। তা হচ্ছে, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ, সামাজিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্ণীত মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সরকারের কার্যকর তত্ত্বাবধায়ক ভূমিকা।
সুস্থ প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র অধিকতর কর্মপ্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতা, জন্য অত্যাবশ্যক নয়, বরং মুনাফা অর্জনের আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও অতীব প্রয়োজনীয়। প্রতিযোগিতা তখনই সুস্থ বলে বিবেচিত হবে, যখন তা অন্য উদ্যোক্তাকে বাজার থেকে উৎখাতের সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি হতে উদ্ভূত না হয়ে পণ্যের মান, সেবা বা দক্ষতার ক্ষেত্রে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবার মানসিকতা দ্বারা উজ্জীবিত হবে। সুস্থ প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র অধিকতর কর্মপ্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতার জন্য আবশ্যক। যদি অসাধু ও দুর্নীতিপরায়ণ বুদ্ধি ও পদ্ধতি দ্বারা প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন এবং তাদের মনমানসিকতা এ ধরনের নেতিবাচক হীনবুদ্ধি দ্বারা চালিত হয়, তবে সে প্রতিযোগিতাকে সুস্থ প্রতিযোগিতা বলা যায় না। এ ধরনের প্রতিযোগিতা প্রতিযোগী উৎপাদকের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাবের বদলে জিঘাংসার সৃষ্টি করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সামাজিক ডারউইনবাদের সর্বগ্রাসী প্রতিক্রিয়ায় প্রত্যেক উদ্যোক্তা প্রতিযোগী অন্য প্রতিযোগীকে বাজার হতে উৎখাতের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। তা সম্ভব না হলে সকল উদ্যোক্তা-উৎপাদকশ্রেণী ভোক্তাশ্রেণীকে শোষণের উদ্দেশ্যে অসাধু গাঁটছড়ায় মিলিত হয়। উদ্যোক্তাশ্রেণীর মাঝে অসুস্থ প্রতিযোগিতা প্রকৃতপক্ষে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং সব মানুষের বিশেষ করে ভোক্তাশ্রেণীর জন্য অকল্যাণ ডেকে আনে। অসাধু প্রতিযোগীদের মধ্যে স্বার্থের কারণে ঐক্যবদ্ধতা একচেটিয়া বাজারের জন্ম দেয় যা শোষণের দুয়ারকে উন্মোচিত করে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বাজার হতে উৎখাতের মাধ্যমে বড় বড় উৎপাদক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে যোগসাজস করে ক্রমশ বাজার অর্থনীতিতে শোষণের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
উল্লেখ্য, প্রতিযোগিতা কার্যকর হতে পারে যদি একই পণ্যের বিপুল পরিমাণ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থাকে এবং কারো পক্ষে এককভাবে দ্রব্যমূল্যের উপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব না হয়। তাছাড়া উৎপাদক শ্রেণীকে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রত শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। যদি সমাজে কোনো প্রকার নৈতিক মুল্যবোধ ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত ও কার্যকর না থাকে, যদি স্রষ্টার সামনে জবাবদিহিতার ভয় না থাকে, তবে অধিক মুনাফা অর্জনের লোভ বাজারে নানাবিধ কার্যকলাপের জন্ম দেবে। অসুস্থ প্রতিযোগিতার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে বাজার দখলের জন্য নানারকম চটকদার বিজ্ঞাপনী প্রচারণা। তাছাড়া রয়েছে একই পণ্যের ক্ষেত্রে সম্মিলিত গবেষণার পরিবর্তে প্রত্যেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আলাদা গবেষণা কার্যক্রমের ফলে খরচ বৃদ্ধির দিক। প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার এই সব নেতিবাচক দিকের ফলে যে কোনো পণ্যের সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধিই স্বাভাবিক ঘটনা।
সরকারি আইনকানুন ও বিধিনিষেধ নৈতিক অনুভূতি ও দায়িত্ববোধের স্থান দখল করতে পারে না। নৈতিক দায়িত্বানুভূতির বিকল্প না হলেও সরকারি বিধিনিষেধের অবশ্যই কিছু কার্যকারিতা রয়েছে যা উৎপাদকশ্রেণীর যথেচ্ছ আচরণকে লাগাম টেনে ধরে-একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য সমাজে যদি সর্বোচ্চ স্তরে বিরাজ না করে, তবে নানারূপ অসাধুর ব্যবসায়িক কলাকৌশল প্রতিরোধের জন্য আইনের পর আইন রচনা করতে হবে, এমনকি আইনের ফাঁকফোর রোধের জন্য আবার নতুন করে আইন রচনা করতে হবে, যার জন্য সমাজের খরচের দিকটি কোনভাবে কম হবার কথা নয়। এতদসত্ত্বেও আইন ফাঁকি দেবার প্রবণতা ও উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে আইনের বাধা ডিঙিয়ে যাবার প্রচেষ্টা কম হবে মনে করারও কারণ নেই। অর্থাৎ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সুচারু ও ন্যায়ভিত্তিক পরিচালিত হবার জন্য সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিক আচরণের কোনো বিকল্প নেই।
অপূর্ণ পূর্বশর্তসমূহ
পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যক্তি মালিকানাধীন ও মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমুখী করার জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোতে যে কতগুলো পূর্বশর্তের আবশ্যকীয় প্রয়োজন তা পূরণ হয়নি। উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ক্রমাগতই হ্রাস পেয়েছে। সাধারণভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত কোনো মূল্যবোধ সমাজে ঠাঁই করে নিতে পারেনি। নৈতিক মূল্যবোধের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য এক সময়ে সরকারি নিয়মনীতির উপর খুব জোর দেয়া হত। কিন্তু সরকারি নিয়মনীতির কড়াকড়িও বর্তমানে ক্রমাগতভাবে শিথিল হবার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ‘ঊনিশ শতকের বৃটেনে বাজার সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ছিল প্রধানতম বিষয়। বর্তমানে বৃটেনে নয়, বরং সারা পৃথিবীতে প্রতিযোগিতা ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়ে চলেছে’।
গত এক শতাব্দী যাবৎ পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রধান বেশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে কতিপয় বৃহৎ উৎপাদন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্রমাগত প্রাধান্য। বর্তমানে পুঁজিবাদী বিশ্বে এডাম স্মিথ কল্পিত একটি দ্রব্যের উৎপাদনকারী অসংখ্য ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। কোনো দ্রব্যের উৎপাদনে এরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে কতিপয় বিশাল আকৃতির শিল্প প্রতিষ্ঠান এই মুষ্টিমেয় শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদিত পণ্যটির দাম, উৎপাদনের পরিমাণ এবং ভবিষ্যতে কী পরিমাণে বিনিয়োগ করা হবে- এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান ও পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহের কতিপয় বিশালাকৃতির শিল্প প্রতিষ্ঠান বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সব প্রভূত ক্ষমতাশালী কোম্পানীগুলো শিল্প উৎপাদন, খনিজ সম্পদ উত্তোলন, পরিবহন ও যোগাযোগ, ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স ব্যবস্থাসহ বাজার অর্থনীতির বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। কৃষি ক্ষেত্রেও কৃষি খামারগুলো একত্রীকরণের মাধ্যমে বিশাল বিশাল কৃষি ফার্ম গড়ে উঠেছে। এ সম্পর্কে নর্ম হোয়াইট বলেন, ”বৃহৎ কৃষি খামারের প্রতি সরকারি নীতির পক্ষপাতিত্বের ফলে বিশালাকৃতির করপোরেশনসমূহ জন্ম লাভ করেছে। এরা খাদ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। অবশ্যম্ভাবীভাবে কৃষিখাতের এ ধরনের বিশাল ফার্মের উত্থানে সুদূরপ্রসারী ফলাফল রয়েছে।
প্রথমত, অপরিমেয় অর্থ ও ধন-সম্পদের বদৌলতে এসব বিশাল বিশাল কর্পোরেশনসমূহ এসব দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভূত ক্ষমতা ও প্রভাব বলয়ের সৃষ্টি করে। সরকার ও জনগণ উভয়ের উপরই এসব কর্পোরেশনের কার্যকলাপের প্রভাব রয়েছে। ব্যবসায়ী ফার্মগুলোর মাত্র ১০% হওয়া সত্ত্বেও বৃহদাকৃতির এই মুষ্টিমেয় কর্পোরেশনসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের সমগ্র অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ৮০% নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি বাকি ৯০% ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপও বিভিন্নভাবে বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়। পুঁজি, উৎপাদন, বিনিয়োগ, নতুন পণ্য, ভোক্তার প্রতিক্রিয়া অথবা কর্মসংস্থান সর্বক্ষেত্রেই এ সকল বৃহৎ কর্পোরেশন মার্কিন অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ করে। অনধিক ২০০ টি এ ধরনের কর্পোরেশন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে। কর্পোরেশনগুলো তাদের নজিরবিহীন ও সীমাহীন অর্থনৈতিক শক্তির সাহয্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ জীবনের প্রায় প্রতিটি অঙ্গনে অপ্রতিহত প্রভাবের ছাপ রেখে চলছে। অনেক সময় নিজেদের স্বার্থের তাগিদে জনসাধারণের স্বার্থবিরোধী নীতি গ্রহণে কর্পোরেশনসমূহ সরকারকে বাধ্য করে।
অধিকন্তু দানব আকৃতির এইসব কর্পোরেশনগুলো কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নয়। মুষ্টিমেয় পরিবার এইসব কর্পোরেশনের সিংহভাগ স্টকের মালিক এবং ঐ কতিপয় পরিবারের হাতেই কর্পোরেশনগুলোর নীতি নির্ধারনের চূড়ান্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে আছে। ১৯৬০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করদাতাদের মধ্যে মাত্র ১% লোক শেয়ার স্টকের ৪৮% দখল করে আছে। তাই ‘শেয়ার হোল্ডারদের গনতন্ত্র’ নামক শব্দটি একটি ফাঁকা বুলি মাত্র, বিশেষত যখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডাররা বোর্ড মিটিংয়েই অংশ গ্রহণ করে না। ‘ফরচুন’ পত্রিকার তালিকাভুক্ত ৫০০ টি শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ১৫০টির প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতা এক ব্যক্তি বা একটি পরিবারের সদস্যদের হাতে কেন্দ্রীভূত। তাই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, অর্থনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খাতসমূহ কতিপয় ধনাঢ্য অভিজাত শ্রেনীর হাতে সার্বিকভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। বিশাল ক্ষমতা তাদের পণ্য সামগ্রী, মূল্য, বিনিয়োগ প্রভৃতি মৌলিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার একচেটিয়া আনুকূল্য প্রদান করেছে যা শুধু সমগ্র জাতিকে নয় বরং সারা বিশ্বকেই প্রভাবিত করছে।
দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণী, কৃষক, ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক শিল্পজীবীরা ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের স্বাধীনতা ও দরকষাকষির ক্ষমতা হারিয়ে বসেছে। গত দুই শতাব্দীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মজুরি ও বেতনভোগী শ্রেণীর সংখ্যা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৭৮০ সালে এর সংখ্যা ছিল ২০%, যা ১৯৭০ সালে ৮৪% এ এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী অথবা ম্যানেজার বা অফিসার শ্রেণীর লোকের সংখ্যা এই দুই শতাব্দীকালে ৮০% হতে ২০% এ নেমে এসেছে। স্বল্পমেয়াদী তারতম্য বাদ দিলে দেখা যায় দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা হচ্ছে বৃহৎ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে। দানবাকৃতির কর্পোরেশনসমূহের প্রদান কার্যনির্বাহী এবং পরিচালকগণ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করছে। এর ফলে সমাজে সম্পদ ও ক্ষমতা আরো বেশি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। কার্ল মার্কসের ভাষায় বলা যায়,’মজুরি-দাসত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে’।
তৃতীয়ত, বাজার অর্থনীতিতে যে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার কথা বলা হয় বৃহৎ কর্পোরেশনগুলো তা সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে সক্ষম। তারা একসাথে গাঁটছড়া বেঁধে প্রতিযোগিতামূলক পণ্য মূল্যের পরিবর্তে যোগসাজসে একই ধরনের পণ্য মূল্য বাজারে বেঁধে দেয়।
চতুর্থত, বৃহৎ শিল্প বা ব্যবসা প্রতিয়ানগুলোর বিশাল আকৃতির মুখে নতুন কোনো ফার্ম বাজারে প্রবেশের উৎসাহ পায় না। বাজারে প্রবেশের জন্য প্রচুর সম্পদের প্রয়োজন এবং নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ঝুঁকি নিতে সাহস পায় না। কেবলমাত্র প্রচুর বিত্তশালী কোনো ব্যক্তি যার জন্য ব্যাংক ঋণও খোলা রয়েছে, এ ধরনের বাজারে নতুনভাবে প্রবেশের জন্য উদ্যোগী হতে পারে।
পঞ্চমত, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ভাগাভাগি হয়ে গেছে। অধিকাংশ বৃহৎ কর্পোরেশনে স্টকহোল্ডারদের পরিবর্তে পেশাজীবী ব্যবস্থাপকগণ সার্বিক দেখাশোনার কাজটি করেন। যদিও তাত্ত্বিকভাবে এসব পেশাজীবী ব্যবস্থাপকগণ শেয়ারহোল্ডারদের বেতনভুক্ত কর্মচারী মাত্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরাই প্রকৃত ক্ষমতা বিস্তার করে। শেয়ারহোল্ডারদের শুধু বছর শেষে বার্ষিক সভায় রিপোর্ট শোনার মধ্যে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এসব পেশাজীবী ম্যানেজারদের অধিকাংশই উঠে এসেছেন সমাজের উঁচু স্তর হতে। এন্ড্র হেকার এ বিষয়ে মন্তব্য করেন যে, ‘ইউরোপের বৃহৎ কর্পোরেশনসমূহে গণতান্ত্রিক সামাজিক পরিবেশ বিরাজ করে না। বরং এটাই লক্ষণীয় যে, সমাজের অভিজাত উঁচু শ্রেণী হতে কর্পোরেশনের ব্যব্স্থাপক শ্রেণীকে বাছাই করে নেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্পদ ও সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পর্কিত বৃহৎ কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপকের পদ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এসব হচ্ছে ক্ষমতার করিডোরে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রবেশপত্র স্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রে একই অবস্থার উল্লেখ করে ‘মিল’ বলেন, কর্পোরেশনগুলো হচ্ছে সম্পদের উৎস এবং ক্ষমতা ও সম্পদ অব্যাহত রাখার জন্য একই সাথে ভিত্তি। যেসব ব্যক্তি ও পরিবারবর্গের প্রভূত সম্পদ রয়েছে, দেখা যায় তারাই এসব কর্পোরেশনের হর্তাকর্তা বিধাতা।
কর্পোরেশনসমূহের আয়তন বৃদ্ধি বিশাল কনগ্লোমারেটে পরিণত হবার পশ্চাতে দৃশ্যত দ্ক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্য কাজ করেছে। কিন্তু অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের মতে দ্ক্ষ প্রতিষ্ঠান হবার জন্য এর আয়তন আরো সীমিত হওয়া প্রয়োজন। অধিকাংশ বৃহৎ কর্পোরেশনের কাঠামো হচ্ছে এরূপ, যেন কতগুলো আধা-স্বায়ত্বশাসিত কোম্পানীগুলোর যদি আলাদা স্বাধীন অস্তিত্ব থাকত তবে তারা অধিকতর দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারত। বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ বা বন্ধন পদ্ধতি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যাংকসমূহের ট্রাস্ট কার্যক্রম ট্রেড এসোসিয়েশন, প্রাইস-লিডারশিপের পদ্ধতি এবং সর্বোপরি উৎপাদক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অশুভ যোগসাজশ অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনকে আরো প্রসারিত করেছে। মুনাফা যদি দ্ক্ষতার পরিমাপক হয় তবে গবেষণা হতে দেখা গেছে যে, অনেক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের লাভের হার যে শিল্পে মুষ্ঠিমেয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান কর্তৃত্ব করছে তাদের চেয়ে কম নয়। সুতরাং, দেখা যায় শিল্প প্রতিষ্ঠানের বৃহদায়তনই দক্ষতা নিশ্চিত করে না।
কর্পোরেশন ও কোম্পানীসমূহের বৃহদাকৃহতি লাভের পশ্চাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। প্রতিযোগী ফার্মসমূহ ক্রয় এবং ফার্মসমূহের উল্লম্ব ও আনুভুমিক একত্রীকরণে বৃহৎ কর্পোরেশনের উৎসাহকে উদ্দীপিত করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সস্তা দরে ঋণ দান করে। ব্যাংক হতে এ অর্থের যোগান না হলে এ ধরনের একচেটিয়া অবস্থা সৃষ্টি করা দুঃসাধ্য ছিল। বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের বদলে কতিপয় বৃহৎ কোম্পানীকে ঋণদান করাকে পছন্দ করে। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে কৃষিখাতেও বৃহৎ খামারগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক পরিসংখ্যান হতে দেখা যায় যে, কৃষিখামারের সংখ্যা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। এ অবস্থার জন্য পক্ষপাতমূলক ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থাই দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১৯% বৃহৎ কৃষিখামার কৃষিখাতে প্রদত্ত ঋণের ৬০% দখল করে আছে, যার পরিমাণ ব্রাজিল ও মেক্সিকোর যৌথ বৈদেশিক ঋণের সমান। কর্পোরেশনসমূহের সম্প্রসারণের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে কর্পোরেশনগুলো তাদের লভ্যাংশের মাত্র অর্ধেক স্টকহোল্ডারদের প্রদান করে, বাকি অংশ নতুন যন্ত্রপাতি ক্রয় ও সম্প্রসারণে ব্যয় করে। লভ্যাংশকে নতুন সম্প্রসারণে বিনিয়োগ স্বীকৃত পন্থা বলা হলেও এটা যেভাবে করা হয় তা যথাযথ নয়। শেয়ারহোল্ডারগণ কীভাবে এবং কোন খাতে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ চায় সে বিষয়ে কোনো মতামত গ্রহণ না করেই বিনিয়োগ খাতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদি বোর্ড মিটিং এর বাইরে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের মতামত নেয়া হতো, তবে এ ব্যবস্থাকে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক বলা হতো এবং এতে মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত হতো।
কর্পোরেশনের সম্প্রসারণ বেকারত্ব সমস্যাকেও তীব্রতর করেছে। এর কারণ হচ্ছে কর্পোরেশনসমূহ শ্রমনিবিড় উৎপাদন প্রক্রিয়ার বদলে পুঁজিনিবিড় ব্যবস্থঅর প্রতি অধিক পক্ষপাতী। ব্যাংক ঋণের অবারিত ছাড় সে উৎসাহে আরো ইন্ধন যোগায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাংকের সুদের হার কম রাখার প্রয়োজনীয়তা, পরবর্তী দুই বছর পাবলিক সেক্টরে ঋণের সুদ পরিশোধের ভার লাঘব করা এবং যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন ও প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করা প্রভৃতি প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র কর্পোরেট সম্প্রসারণকেই উৎসাহিত করা হয়নি, বরং পুঁজি নির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়াকেও অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়। প্রাথমিকভাবে এসব পদক্ষেপের ফলে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেলেও বেকারত্ব সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে।
উৎপাদন উপকরণসমূহের ব্যক্তি মালিকানা ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদ ব্যবহারে দক্ষতা নিশ্চিত করে- এ বিষয়টি তাত্ত্বিকভাবে সঠিক বলে মনে হয়। কিস্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থা শুধুমাত্র জন্ম দিয়েছে অপ্রয়োজনীয় দানবাকৃতির কনগ্লোমারেট কোম্পানীসমূহ, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও অপরিসীম বেকারত্ব। এর ফলাফল সম্পর্কে বার্লি চমৎকারভাবে বলেন, ‘পুঁজি রয়েছে, তাই রয়েছে পুঁজিবাদ। মধ্যখানে মার খাচ্ছে ঝুঁকি গ্রহণকারী উদ্যোক্ত শ্রেণী’। তাই দেখা যায়, পুঁজিবাদের দু’টি শক্তিশালী স্তম্ভ তথা ভোক্তাশ্রেণীর সার্বভৌম চূড়ান্ত ক্ষমতা ও উদ্যোক্তা শ্রেণীর সৃজনশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতা উভয়ের ভিত নড়ে গেছে। ব্যক্তি ভোক্তা ও ব্যক্তি উদ্যোক্তা উভয়ই উৎপাদন সংগঠনের বিশাল শক্তিশালী চাকার কাছে হার মেনে আনুগত্য করছে।
কিন্তু এ ধরনের অবস্থার উদ্ভব বাহির থেকে হয়নি, বরং পুঁজিবাদী কাঠামোর ভিতর থেকে জন্ম নিয়েছে। নৈতিক মূল্যবোধহীন পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি, সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থাও এ অপব্যবস্থা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থাসমূহের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাসমূহও তেমন কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি। বরং শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ন্ত্রণের বদলে এসব সংস্থা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিধিবদ্ধ আইনকানুনসমূহ প্রণীত হয় কর্পোরেশনসমূহের স্বার্থরক্ষার জন্য। প্রকৃতপক্ষে, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মহল কর্তৃকই এসব আইনকানুনের খসড়া প্রণীত হয়। গলব্রেথ তাই বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘আধুনিক অর্থনীতিতে বড় বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের হাতে ক্ষমতা জিম্মি হয়ে আছে। তথাকথিত সার্বভৌম ভোক্তাশ্রেণী ও সাধারণ জনগণের অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে। কর্পোরেশনসমূহের অর্থনীতির উপর সুদৃঢ় কায়েমী-স্বার্থ হ্রাস করার অন্যতম উপায় হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রায়ন। কর্পোরেশন গণতন্ত্রায়নের উপায়সমূহ হতে পারে-এদের আকৃতি কমিয়ে ‘অপটিমাম’ পর্যায়ে নিয়ে আসা, একই পণ্যের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো, কর্পোরেশনের পুঁজির পরিমাণের মধ্যে ইকুইটির অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়া এবং জনগণের মাঝে শেয়ারের মালিকানা ছড়িয়ে দেয়া। কিন্তু অর্থব্যবস্থার আমূল সংস্কার ব্যতীত এ ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আশা করা যায় না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাতারাতি প্রতিযোগী ফার্ম কিনে ফেলা, বাজারে প্রচুর বন্ড ইস্যু করা, সর্বোপরি বিশাল উৎপাদন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ব্যাংকসমূহের পক্ষপাত ইতিবাচক পরিবর্তনের বদলে বিপরীতমুখী স্রোতকেই জোরদার করে তুলেছে।
অন্যায্য বণ্টনব্যবস্থা
সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শেষ কথা হচ্ছে আর্থিক লভ্যাংশের বণ্টন। উৎপাদনের উপকরণসমূহ তথা শ্রমিক, পুঁজি সরবরাহকারী, ভূমি মালিক ও উদ্যোক্তা শ্রেণী উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে স্ব-স্ব ন্যায়সংগত লভ্যাংশ প্রাপ্তির জন্য কৃষক যেমন তার শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করে একটি ভালো ফসল লাভের আশায়- এটি তারই অনুরূপ। তাই একটি সমাজ কাঠামো কতটুকু ভালো তা নির্ভর করেছে শুধুমাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার দ্ক্ষতার উপর নয়, বরং একই সাথে বণ্টন প্রক্রিয়া সুষম ও ন্যায়সংগত কিনা তারও উপর। ইতোমধ্যেই সুস্পষ্টভাবে দেখা গেছে, সমাজের জন্য কী কী পণ্য সামগ্রী উৎপাদন করা প্রয়োজন এবং কীভাবে তা উৎপাদন করতে হবে- এ প্রশ্নের জবাবে পুঁজিবাদ সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদের বিভিন্ন খাতে বণ্টনের ক্ষেত্রে দ্ক্ষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। এখন দেখা যায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রেও পুঁজিবাদ কোনো প্রকার ন্যায়নীতি প্রদর্শন করতে পারেনি।
স্থিতাবস্থার পক্ষে চুক্তি
প্রচলিত পশ্চিমা অর্থনীতিতে লভ্যাংশ বণ্টনের বিষয়টি বিভিন্ন উৎপাদন খাতে বিভিন্ন উৎপাদন উপকরণের বণ্টনের ন্যায় গুরুত্ব লাভ করেনি। কারণ এটা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে যে, উৎপাদন উপকরণসমূহের যদি বিভিন্ন উৎপাদন খাতে দক্ষতার সাথে বিলিবণ্টন নিশ্চিত করা যায়, তবে বিভিন্ন উৎপাদন উপকরণসমূহ মোট উৎপাদনে প্রত্যেকে নিজস্ব অবদান অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের প্রাপ্য আয় পেয়ে যাবে। যদি কোনো উৎপাদন উপকরণের আয় উপযুক্ত নীতি অনুযায়ী প্রাপ্ততার চেয়ে কম দেখা যায়, তবে দীর্ঘমেয়াদে ঠিক মাত্রায় পৌঁছে যাবে। যেহেতু সম্পদ হচ্ছে মানুষের দীর্ঘকালীন সঞ্চয়ের ফসল, তাই অর্থনৈতিক যুক্তি অনুযায়ী সমাজে বিরাজিত বর্তমান সম্পদ বণ্টনের অবস্থানকে ন্যায়সংগত বলা ছাড়া উপায় নেই। অধিকাংশ পশ্চিমা অর্থনীতিবিদ সমাজে সম্পদ বণ্টনের বর্তমান স্থিতাবস্থার পক্ষে অর্থনীতির শাণিত যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। স্যামুয়েলসন স্বীকার করেছেন, “সম্পদ ও আয় বণ্টনের নীতি ও তত্ত্ব এখনো স্থিতিশীলতা লাভ করেনি”। অর্থনীতির এরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এ ধরনের অবস্থা কেন বিরাজ করছে সে বিষয়ে সংগতভাবেই প্রশ্ন তোলা যায়। উৎপাদনশীল অবস্থার প্রান্তিক তত্ত্ব মোট উৎপাদনে প্রত্যেক উৎপাদন উপকরণের অবদান বা হিস্যা কতটুকু তা প্রদর্শনের চেষ্ট করেছে। অপরদিকে ‘প্যারিটো অপটিমালিটি’ তত্ত্ব আয় বণ্টনের বর্তমান স্থিতাবস্থার কোনোরূপ পরিবর্তনের চেষ্টাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে বর্ণনা করেছে। এ তত্ত্ব অনুযায়ী আয় ও সম্পদের পুনর্বণ্টন ‘প্যারিটো অপটিমালিটি’ অনুযায়ী সমাজের সব মানুষের সর্বমোট যে সুখবোধ থাকে তা বিনষ্ট হবে। বিভিন্ন মানুষের মাঝে উপযোগ-উপভোগের পারস্পরিক তুলনা সম্ভব নয়- এ ধারণায় বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদগণ বলেন যে, আয়ের অধিকতর সুষম বণ্টন আয়ের বৈষম্যমূলক বণ্টনের চেয়ে শ্রেয়তর বা অধিকতর কল্যাণকর হতে পারে মর্মে কোনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত উপসংহার টানা যায় না। পুঁজিবাদী সমাজে বলবৎ বর্তমান আয় বণ্টনব্যবস্থা প্রকৃতির কঠিন নিয়মের ফল এবং সংগত বলে তারা রায় প্রদান করেন।
তাই সামাজিক ন্যায়পরতা কোনো অলীক আদর্শের ভিত্তিতে আয়ের পুনর্বণ্টনের যে কোনো উদ্যোগ শুধু যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে তা নয়, এ প্রচেষ্টা অনাকাঙ্ক্ষিতও বটে। বর্তমান অর্থনৈতিক মতবাদসমূহ সমাজে বলবৎ আয়বণ্টন ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে। আয়ের বিশাল বৈষম্যকে এসব অর্থনীতিবিদগণ প্রকৃতির নিয়ম ও অনিবার্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাদের মতে, অর্থনৈতিক বা সামাজিক ন্যায়পরতা একটি অবাস্তব স্বপ্নমাত্র। এ ধরনর ন্যায়পরতা প্রচেষ্টা বরং সামাজিক দুঃখ-কষ্টকে বৃদ্ধি করবে। এ ধরনের চিন্তাধারার ফলে প্রতীয়মান হয় যে, পুঁজিবাদী হচ্ছে সম্পূর্ণ নৈতিকতাহীনভাবে অন্যায় ও অসংগত। অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, ব্যক্তি মানুষের অন্ধস্বার্থপরতা যা বৈষম্যমূলক আয়বণ্টন ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, তা একটি প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর সামাজিক শক্তি। প্রখ্যাত মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম সামনার বলেন, “কোটিপতি ব্যক্তিগণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফল, সমাজের বিশেষ বিশেষ কর্মসম্পাদনের জন্য প্রকৃতি তাদের নির্বাচন করেছে। তারা উচ্চ মুনাফা অর্জন করে এবং বিলাস ব্যসনে জীবনযাপন করে। কিন্তু সমাজের কল্যাণের জন্যই সমাজকে এ মূল্য দিতে হবে”। তাদের উচ্চ আয় সঞ্চয় সৃষ্টি করে, উদ্যোগ গ্রহণকে উৎসাহিত করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। রবার্ট ওয়েন বলেছেন, ‘দরিদ্র ও বেকারগণ তাদের দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী নন, বরং তারা যান্ত্রিক বাজারব্যবস্থার শিকার’। কিন্তু পুঁজিবাদের প্রবক্তা অর্থনীতিবিদদের ভাষ্যে রবার্ট ওয়েনের এই বক্তব্যের কোনো প্রতিধ্বনি মেলে না।
প্রবৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ
দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য সম্পদ ও আয়ের পুনর্বণ্টনের ধারণাকে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদগণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিকল্প হিসেবে তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ প্যারিটো বলেন, ‘যদি জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের চেয়ে মোট আয়ের বৃদ্ধির হার বেশি না হয় তবে আয়ের বৈষম্য কমানো সম্ভব নয়’। পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল উভয় শিবিরের অর্থনীতিবিদগণ আয়ের সুষম বণ্টনের পরিবর্তে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর জোর দিয়েছেন। থুরো এই ধরনের চিন্তাধারাকে সংক্ষেপে এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘যদি কোনো দেশের অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় তবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং সবার জন্য অধিকতর আয়ের পথ সুগম হবে। জনগণ তাদের অধিকতর আয় অর্জনের কারণে বিত্তশালী অবস্থার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেই সুখি থাকবে। সমাজ তখন আর ধন বৈষম্য নিয়ে মাথা ঘামাবে না। শেষ পর্যন্ত অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে আয় বৈষম্যের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসবে’।
এভাবে দেখা যায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশ্নটি মাত্রাহীন গুরুত্ব লাভ করেছে এবং একে আয় বৈষম্য হ্রাসের অস্ত্র হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। লক্ষণীয় যে, প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি দরিদ্র জনগণের ভোগের মাত্রা বাড়াতে সক্ষম হলেও তাদের সব অভাব পূরণ করতে পারেনি। অধিক প্রবৃদ্ধি ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তদানুযায়ী বেড়েছে তাদের ভোগের মাত্রার ব্যবধানও। কোলকো এর মতে, ‘যত দিন আয় বৈষম্য বিরাজ করবে ততদিন ধনী ও দরিদ্র শ্রেনীর মাঝে ভোগের বিরাট ব্যবধানও থেকে যাবে’। অধিক প্রবৃদ্ধি প্রকৃতপক্ষে ধনিক শ্রেণীর বিত্ত ও আয়কে আরো ফাঁপিয়ে তোলে, কেননা বৈষম্য সৃষ্টিকারী সকল প্রকার পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এ অবস্থায় অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। অধিকন্তু প্রবৃদ্ধি কখনো একটানা চলতে থাকে না। প্রবৃদ্ধিতে মাঝে মাঝে দেখা দেয় মন্দা ও বেকারত্ব। এই অর্থনৈতিক মন্দা সবার জন্য ক্ষতিকর হলেও দরিদ্র শ্রেণীর উপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক।
প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা যদিও অনস্বীকার্য, তবুও এর উপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ অনেক সমস্যার জন্ম দিয়েছে। বাজেট ও বাণিজ্য ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি ও স্টাগফ্লেশন (Stagflatioh) [যে বিশেষ সময়সীমার মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়, কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি পায় না], বৈদেশিক সুদ পরিশোধের দায়ভার প্রভৃতি এ সমস্যাসমূহের অন্যতম। প্রবৃদ্ধির জন্য সতর্ক বিবেচনাহীন দৌড় প্রতিযোগিতা সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদকে নিঃশেষ করে তুলেছে, প্রকৃতির দুষণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা মানুষ, পশুপাখি ও উদ্ভিদ জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে।
আয় বৈষম্য নিরসনের জন্য প্রবৃদ্ধি অর্জন ছাড়াও আরো কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে একথা অস্বীকার করার জো নেই। এ পদক্ষেপগুলো প্রগতিশীল করব্যবস্থা, ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি। কিন্তু একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, প্রগতিশীল করব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। যেহেতু জনগণের সিংহভাগ মজুরও বেতনভোগী, তাই তাদের আয় পরোক্ষ করের আওতায় পড়ে যায়। অপর দিকে ধনাঢ্য শ্রেণী তাদের আয় ও মুনাফার উপর ধার্যযোগ্য আয়কর নানা পন্থায় ফাঁকি দেবার ফাঁকফোকর ও সুযোগ খুঁজে নেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভর্তূকিব্যবস্থা এমনভাবে বিন্যস্ত থাকে যা দরিদ্র শ্রেণী থেকে ধনিক শ্রেনীকেই বেশি সহায়তা করে।
সন্দেহবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত কার্যকারিতা ও সক্ষমতার বিষয়ে পুঁজিবাদী দেশসমূহও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছে। নির্দিষ্ট ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতির অবমতা, বাজার অর্থনীতির তাত্ত্বিকরূপ বাস্তবে খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি বিষয় ক্রমাগত স্বীকৃতি লাভ করছে। সমকালীন অনেক পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ স্বীকার করে নিয়েছেন যে, অর্থনীতির কোনো খাতেই পূর্ণাঙ্গ প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা বিরাজ করে না। বরং একচেটিয়া মালিকানা, বৈষম্যমূলক সুযোগ-সুবিধা, বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর জন্য ব্যাংক ঋণের অবাধ সুযোগ, কোনো বিশেষ খাত বা অঞ্চলে নতুনদের বিনিয়োগের জন্য প্রবেশের ক্ষেত্রে নানা কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি হচ্ছে বাজার অর্থনীতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এ অবস্থাই বিদ্যমান সম্পদ ও আয় বৈষম্যের জন্য প্রধানত দায়ী। এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতাহীন পুঁজিবাদী সমাজ ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে আয়-বৈষম্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ কথাও প্রতিভাত হয়েছে যে, মানুষের কেবলমাত্র কার্যক্ষমতার পার্থক্যের জন্যই আয়- বৈষম্যের সৃষ্টি হয়নি। আয়-বৈষম্যের জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী মানবসৃষ্ট পক্ষপাতমূলক নানা অবস্থা।
আয়-বৈষম্যের অন্যতম প্রধান বাস্তব কারণ হচ্ছে উৎপাদন উপকরণ ও ব্যবসা- বাণিজ্যের মালিকানা সমাজের মানুষের মাঝে সুষমভাবে বিস্তৃত ও বণ্টিত নয়। ব্যাংকব্যবস্থাও এ অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা সৃষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যই ব্যাংক ঋণের দুয়ার খোলা থাকে। গেলব্রেথের (Galbraigth) ভাষায়, ‘পরিকল্পিত অর্থনীতিতে বৃহৎ কর্পোরেশনসমূহ বাণিজ্যিক ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানী ও বিনিয়োগ ব্যাংসমূহের নিকট আকর্ষণীয় খদ্দের’। তিনি আরো মন্তব্য করেন, ‘পরিকল্পিত অর্থনীতিতে দেখা যায় যাদের ঋণ নেবার প্রয়োজন নেই, এসব বৃহৎ সংস্থাসমূহই ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহভাজন। বিপরীত চিত্র দেখা যায় তারা ব্যাংকের নিকট আকর্ষণীয় খরিদ্দআর নয়’। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিকট ব্যাংক ঋণের সহজলভ্যতার ফলে সমাজে ন্যায়পরতার সৃষ্টির পরিবর্তে ঐ সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সমাজে কাঙ্ক্ষিত ন্যায়পরতার দুয়ার ক্রমাগত অবরুদ্ধ হয়ে কতিপয় ধনিক-বণিক শ্রেণীর স্বার্থই ক্রমাগতভাবে চরিতার্থ হয়েছে। অপর দিকে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যারা সীমাবদ্ধ বেতন ও মজুরি পাচ্ছে, তাদের দুর্গতি বেড়ে চলেছে। কার্ল মার্কস এ সমস্যা এবং এ অবাঞ্ছিত অবস্থা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তি মালিকানা অবসানের যে অবাস্তব সমাধান বাতলে দিয়েছিলেন তা সমাধানের বদলে অধিকতর সমস্যার জন্ম দিয়েছে।
বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও তাদের অভিভাবক ব্যাংকসমূহের ক্ষমতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, পুঁজিবাদ মুখরক্ষাকারী যেসব প্রসাধনীমূলক পরিবর্তন আনয়ন করে, তা দ্বারা সমাজের ইনসাফ বৃদ্ধি করবে এ আশা দুরাশা মাত্র। বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানসমূহের কায়েমী স্বার্থ ফ্রাংকেনস্টাইনের রুপ ধারণ করেছে। ফলে তাদের অপসারণ করে সমাজে শুভ ফলাফল আনয়নের প্রচেষ্টায় সফল হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেভিড রকফেলার একবার সবাইকে স্তম্ভিত করে জানিয়েছিলেন যে, এক ভোটের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন ছাত্রের মধ্যে তিনজন ছাত্রই মনে করে যে, বৃহৎ পুঁজিপতি পরিবারগুলো সরাকারের লাগাম প্রশাসন ও কংগ্রেসের হাত হতে ছিনিয়ে নিয়েছে। উক্ত ভোটের ফলাফল মিশিগান ইউনিভার্সিটি কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণা জরিপ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ৫৯% আমেরিকান নাগরিকই মনে করেন যে, কায়েমী স্বার্থবাদী কতিপয় পুঁজিবাদী পরিবারই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এমতাব্স্থায় আয় ও সম্পদের বৈষম্য নিরসনে অর্থনীতির কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানসমূহের আমূল পরিবর্তন অত্যাবশ্যক বলে তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। বৈষম্য হ্রাস করতে পারে এমন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আদর্শিক দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যতীত এ ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রত্যাশা করা যায় না। একই সাথে প্রয়োজন সামাজিকভাবে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রতি রাষ্ট্রের শক্তিশালী ইতিবাচক ভূমিকা পালনের সদিচ্ছা। কিন্তু লেইজে ফেয়ার অর্থনীতির স্থলে যে কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রব্যবস্থা পাশ্চাত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা বাঞ্ছিত ফলাফল আনয়নে ব্যর্থ হয়েছে।
‘লেইজে ফেয়ার’ ব্যবস্থার অবসান
দু’টি ঘটনা ‘লেইজে ফেয়ার’ পুঁজিবাদের ভিত বিশেষ করে রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ না করার নীতিকে ধ্বসিয়ে দিয়েছিল। ঘটনা দু’টি হচ্ছে, ১৯৩০ এর দিকে মহামন্দা এবং সমাজবাদের উত্থান। ঘটনাদ্বয় কিনেসিয়ান বিপ্লব ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ‘লেইজে ফেয়ার’ পুঁজিবাদের কফিনে ঘটনা দু’টি শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। স্যুমপিটার ও টয়েনবির মতো মার্কসবাদী নয় এমন অনেক অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজার কথা ভবিষ্যতদ্বাণী করেছিলেন। অবশ্য মিল্টন ফ্রিডম্যান ও ফ্রেডরিথ হায়েক এর মতো কতিপয় অর্থনীতিবিদ ‘লেইজে ফেয়ার’ অর্থনীতিকে সমর্থন করে যেতে লাগলেন, যদিও তা অনেকটা পরিবর্তিত কাঠামোয়। আশির দশকে এ ধরনের অর্থনীতিবিদের বলয় বৃদ্ধি পেতে লাগলো। মহামন্দার পর অর্থনীতিতে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রবণতা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল সে উৎসাহ ক্রমান্বয়ে সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের অদক্ষতা, বাজেট ঘাটতি পূরণের অসমর্থতা ও এসব কারণে কল্যাণ রাষ্ট্রের উপর সৃষ্ট বিরূর ধারণা ইত্যাদি কারণে হ্রাস পেতে লাগল।
ত্রিশ দশকের দীর্ঘস্থায়ী মহামন্দা অর্থনীতিবিদ ‘সে’ এর অর্থনীতির সূত্রের উপর দীর্ঘকালীন আস্থা বিনষ্ট করে দেয়। এত প্রতীয়মান হয় যে, অর্থনীতির নিজে নিজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধিত হবার বা বিচ্যুতি ঠিক করে আদর্শ স্থানে ফিরে আসার ক্ষমতা নেই। অর্থনৈতিক সংকটকালীন সময়ে বৃটিশ ও অন্যান্য সরকারের লেইজে ফেয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রফেসর কিনস বিস্মিত হয়ে পড়েন। কিনসের ক্লাসিক্যাল পূর্বসূরিরা উনবিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদী অর্থনীতির কাঠামোকে যেখানে স্বাভাবিক, প্রকৃতিসম্মত, যুক্তিসংগত, চিরকালীন ও সরল অভিধায় অভিষিক্ত করেছিলেন সেখানে কীনস তার Economic Consequence of the Peace গ্রন্থে পক্ষান্তরে লেইজে ফেয়ার পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে ‘অস্বাভাবিক, অস্থিতিশীল, জটিল, অনির্ভরযোগ্য ও ভঙ্গুর’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
সংস্কারের কণ্টকাকীর্ণ পথঃ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সুচনা
কিনস এর জেনারেল থিওরির মূল প্রতিপাদ্য তারল্যের অগ্রাধিকার (liquidity prefernece) বা ভোগ বা সঞ্চয় বিনিয়োগ রেখা নয়; বরং এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে এডাম স্মিথ হতে শুরু করে সব ক্লাসিক্যাল ধারণায় ‘ আপনাআপনি সব সময় পূর্ণ কর্মসংস্থান বিরাজ করবে’ মর্মে যে তত্ত্ব ও ধারণা দেয়া হয়েছে তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। কিনস যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, মুক্তবাজার অর্থনীতি সব সময় পূর্ণ কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে না। এ ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দীর্ঘ সময়ের জন্য অর্থনৈতিক মন্দার খানাখন্দে পড়ে থাকতে পারে। মন্দার কবলে পতিত অর্থনীতি একসময়ে আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমৃদ্ধির যুগে ফিরে আসবে- এ ধরনের বিশ্বাস একটি চরম ভ্রান্তিবিলাস বলে কিনস যৌক্তিক পন্থায় দেখিয়ে দিয়েছেন। কিনস বলেন, কেউ ধৈর্যের সাথে দীর্ঘকাল সমৃদ্ধির আশায় বসে থাকবে না, কারণ দীর্ঘকালীন সময় আমরা সবাই লাশে পরিণত হব। এ প্রেক্ষাপটেই মন্দা থেকে উত্তরণের জন্য ঘাটতি ব্যয়ের মাধ্যমে সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার জন্য কিনসীয় প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে আমরা দেখতে পাই ১৯৩০ দশকের প্রলয়ংকরী মহামন্দা বাস্তবে লেইজে ফেয়ার পুঁজিবাদকে সমূলে উৎপাটিত করেছে, আর তাত্ত্বিকভাবে কিনসের অর্থনৈতিক দর্শনকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে। এর সাথে সমাজতন্ত্রের উত্থান যুক্ত হয়ে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র যুগের সূচনা হয়েছে।
অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ব্যর্থতা
একথা বলা প্রয়োজন যে, কিনস কল্যাণ রাষ্ট্রের শুধুমাত্র একটি বিষয়ের উপরই আলোচনা করেছেন- তা হচ্ছে পূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার বিষয়টি। এ উদ্দেশ্যে রাজনীতির মাধ্যমে কার্যকর চাহিদা বৃদ্ধিকে তিনি জোর দিয়েছেন। কিনসের এই ব্যবস্থাপত্র যেহেতু যুগপৎ মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দার তীব্রতাকে হ্রাস করে ব্যবসায়িক চক্রের উর্ধ্বগামীতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, সেহেতু তার দেয়া ব্যবস্থাপত্র সঠিকভাবেই হোক বা ভুলক্রমেই হোক এ আস্থার জন্ম দিয়েছে যে, ১৯৩০ দশকের গভীর ও প্রলম্বিত মন্দা অতীতের বিষয় এবং এর আর পুনরায় আবির্ভাব হবে না।
কিনস কিন্তু সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোন খাতে কত বরাদ্দ করতে হবে তথা তুলনামূলক অগ্রাধিকারের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাপত্র রেখে যাননি। তার ব্যবস্থাপত্রে মূল প্রতিষেধক হিসেবে পূর্ণ কর্মসংস্থান অবস্থায় মোট চাহিদার পরিমাণকে একই পরিমাণে অক্ষুন্ন রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রতিরক্ষা, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা কল্যাণ ভাতা যে কোনো খাতে খরচ বৃদ্ধি বা হ্রাস করে মোট চাহিদার পরিমাণকে অব্যাহত রাখা যেতে পারে। কিনস অগ্রাধিকারের বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টিতে পূর্ণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ ব্যর্থ বলে প্রতিভাত হয়েছিল। তবে তাঁর মতে পুঁজিবাদ বিভিন্ন উৎপাদন খাতে উৎপাদন উপকরণের বণ্টন ও মানুষের সাথে আয়ের বণ্টন সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিল। তাই দেখা যায়, কিনস পুঁজিবাদের কাঠামোয় সামান্য পরিবর্তনেই সন্তুষ্ট ছিলেন ততটুকু মাত্র যা পূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারে। পূর্ণ কর্মসংস্থানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না এমন সব পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোয় কোনো প্রকার পরিবর্তন আনয়নে কিনস বিশ্বাসী ছিলেন না।
অর্থনৈতিক সমস্যা
অর্থনৈতিক মন্দাকে মোকাবিলা করার জন্য কিনস প্রস্তাবিত ঘাটতি ব্যয়ের অস্ত্র অধিকাংশ সরকার সমাজকল্যাণ বা প্রতিরক্ষা খাতে অর্থায়নে অথবা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছে। অধিকাংশ দেশে সরকারি খাতে এই ব্যয় বৃদ্ধি বেসরকারি ভোগখাতে ব্যয় হ্রাস না করেই সংঘটিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্তি লাভকারী ভোগবাদ, আর্কষণীয় বিজ্ঞাপন, ব্যাংকের ভোগখাতে ঋণের প্রসার বেসরকারি ভোগখাতকে বরং চাঙ্গা করে তুলেছে। এ ভোগব্যয় বৃদ্ধিটি এমন যে, একে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কেননা বিরাজমান ভোগবাদী পরিবেশে জীবনের পরম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যত বেশি ভোগ করা যায় তা এবং দেখা গেছে সমাজের কেউই অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত নয়। সমাজে যদি সবাই মান্য করে এমন ত্যাগ স্বীকারকারী মূল্যবোধের অস্তিত্ব ও তার প্রতি আনুগত্য না থাকে তবে এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়াই খুব স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। সরকারি ও বেসরকারি খাতে এরূপ ব্যয় বৃদ্ধি পঞ্চাশ ও ষাট এই দুই দশকে পাশ্চাত্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বজায় রেখেছিল। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদের পরিসীমায় অর্থনীতির উপর যে প্রচণ্ড চাপ ও ভার সৃষ্টি করেছে তাতে নব নব গুরুতর সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। উদ্ভূত সমস্যাসমূহের অন্যতম হচ্ছে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতির হার। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত প্রায় দু’শতাব্দী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৩%। কিন্তু ১৯৪০ এর দশকে গড় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ছয় গুণ। কোনো ব্যাখ্যা দ্বারা একে মেনে নেয়া যায় না। কেননা এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে, এ ধরনের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি দক্ষতা ও ন্যায়পরতা উভয়ের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুদ্রাস্ফীতির ফলে প্রাথমিকভাবে দেখা যায় যে, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় উচ্চ অর্থনীতি স্টাগফ্লেশন (Stagflation) দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ দেখা যায় উচ্চ দ্রব্যমূল্য ও উচ্চ মজুরি হারের সাথে হাতে হাত রেখে পড়তি চাহিদা, নিম্ন উৎপাদন, অধিক বেকারত্ব ও উৎপাদন ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের অসমর্থতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। অধিকাংশ শিল্পোন্নত দেশে প্রবৃদ্ধির হার কমে আসে এবং বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় কিনসীয় পদ্ধতিতে মোট চাহিদার পরিমাণ অক্ষুন্ন রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এটা আবার একদিকে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিকে আরো অবনতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। এখন একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি ও বেকারত্ব হ্রাস করার জন্য দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত।
১৯৮০ এর দশকে মূল্যস্ফীতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও অর্থনীতিবিদগণ একে একটি সাময়িক স্থিতিশীলতা বলে মনে করেন এবং ধারণা পোষণ করেন যে, মূল্যস্ফীতি আবারও একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাজেট ঘাটতি যদি অব্যাহত থাকে। এ অবস্থার আরো অবনতি হবে যদি রাশিয়া ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে অর্থবাজার হতে ব্যাপকভাবে ঋণ গ্রহণ করে থাকে এবং অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলোও অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও বেকারত্বের হার হ্রাসের জন্য উচ্চমাত্রার সরকারি ব্যয় অব্যাহত রাখে। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, অর্থবাজারে অত্যধিক লেনদেনের তারল্য সৃষ্টির ফলে বৈদেশিক মুদ্রা স্টক ও পণ্য বাজারে সৃষ্ট উচ্চমাত্রার অস্থিতিশীলতা। ব্রাডি কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী পুঁজিবাজার ক্রমশই ঝুঁকপূর্ণ ও বিপজ্জনকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে এবং এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক কিছু করারও অবকাশ দেখা যাচ্ছে না। যখন বিশাল বাজেট ঘাটতি, নাটকীয়ভাবে স্থিতিহীন সুদের ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হার বিরাজ করে এবং স্বল্পমেয়াদের পণ্য আন্তঃদেশে দমকা বাতাসের মতো অর্থের আগমন ও নির্গমন হয়, তখন অর্থবাজার বিপজ্জনকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে দাঁড়ায়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার অন্যান্য কারণগুলো হচ্ছে, সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণদানের অত্যধিক প্রসারণ বা সংকোচন, সম্পদ ও আয়ের বিরাট বৈষম্য, যাকে হেইলব্রোনার ‘পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার পরিকল্পনাহীন ও নৈরাজ্যবাদী চরিত্র’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সুষম অর্থ ও রাজস্বনীতি প্রবর্তন এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন ব্যতিরেকে অস্থিতিশীলতার এইসব উৎসের মূল্যেৎপাটন করা সম্ভব নয়।
তৃতীয় সমস্যা হচ্ছে, ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ফলে ঋণের ক্রমবর্ধমান সুদের বোঝা। তুলনামূলকভাবে অধিক ঋণের হার ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা অর্থনীতিতে আবার নতুন নেতিবাচক মাত্রা যোগ করে। ঘাটতি বাজেটের জন্য অর্থ সংগ্রহ সকল দেশের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ালেও উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ প্রক্রিয়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব উন্নয়নশীল দেশের জন্য বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের বিষয়টি সমগ্র আন্তর্জাতিক অর্থবাজারের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে দিয়েছে। চরমভাবে ঋণগ্রস্ত দেশসমূহের দুঃসহ অভাব লাঘবের জন্য বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রস্তাব রাখা হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত পরিমাণ অর্থের সংকুলান করা যায়নি বলে এসব কর্মসূচি গতিশীলতা লাভ করতে পারেনি। ইতোমধ্যে কতিপয় দেশ তাদের রপ্তানি আয়ের সুনির্দিষ্ট অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। বৃহৎ ঋণগ্রস্ত দেশসমূহ যদি একই পরিকল্পনা ঘোষণা করে তাহলে ব্যাংকসমূহের জন্য সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিবে।
চতুর্থ সমস্যা হচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারি খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধির ফলে সঞ্চয়ের হার হ্রাস পাওয়া। যেহেতু সঞ্চয় ও বিনিয়োগ সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত, তাই বিনিয়োগ স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পেয়েছে। ১৩টি মুখ্য ওইসিডি দেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হার ১৯৬০-৭১ দশকের ১৭.৫% ও ১৭.৬% হতে হ্রাস পেয়ে ১৯৮০-৮৭ সালে ১০.৭% ও ১০.৮% এ এসে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও একত্রীভূত জার্মানী কর্তৃক বিনিয়োগের জন্য সংকুচিত বিশ্ব-সঞ্চয়ের ভাণ্ডারের উপর যেহেতু অধিকতর চাহিদা ও চাপ সৃষ্টি হবে, তাই বিশ্ব অর্থনীতির দিগন্তে সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব-সঞ্চয় ভাণ্ডার বিশেষত উচ্চ সঞ্চয়কারী দেশ জাপানেও সঞ্চয়ের ফলে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং স্টক, দ্রব্য সামগ্রী ও বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
পঞ্চম সমস্যা হচ্ছে, ভোগের ইচ্ছা চরিতার্থকরণ ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির উপর অত্যধিক ও অপ্রয়োজনীয় গুরুত্ব আরোপের ফলে অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদের ক্রমবর্ধমান হ্রাস এবং প্রাণী ও পরিবেশের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার এই গ্রহে জীবনের উপর হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। এখন এটা সর্বমহলে উপলদ্ধি হচ্ছে যে, ‘বিশ্বের পরিবেশগত সংকট মোকাবিলার জন্য বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের মৌলিক নীতিমালার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ব্যতিরেকে গত্যন্তর নেই’। বিশ্বের বিভিন্ন মহল থেকে এ বিষয়ে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও এক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় একটি বিশেষ দিকের প্রতি স্বল্পই সচেতনতা ও উপলদ্ধি সৃষ্টি হয়েছে। তা হচ্ছে ‘সম্ভোগের জড়তা’ থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে নৈতিক মূল্যবোধ ও সহজ সরল জীবনযাত্রার দিকে প্রত্যাবর্তনের অনুরাগ ও অনুভূতি।
উভয় সংকট
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার দুটি পন্থা রয়েছে- হয় উৎপাদন ব্যয় না হয় মোট চাহিদা কমাতে হবে। প্রথম ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী কোনো না কোনোভাবে দ্রব্যমূল্য হ্রাস করতে হবে। দ্বিতীয় ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সুষম বাজেটের দিকে ফিরে যেতে হবে। অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা দ্বারা প্রথমটি অর্জন করা যেতে পারে। অবশ্য এর দীর্ঘকালীন ব্যবহার সম্ভব নয়, বিশেষত মুদ্রাস্ফীতিজনক পরিস্থিতিতে। কারণ প্রকৃত মজুরি হ্রাসের এই ব্যবস্থা শ্রমজীবী মানুষের জন্য কষ্টদায়ক ও অন্যায্য। তাছাড়া এতে কালোবাজারী, দীর্ঘকালীন সরবরাহ স্বল্পতা এবং উৎপাদন উপাদানের বিভিন্ন খাতে বণ্টনে বিকৃতি দেখা হয়। দেখা যায়, নিয়ন্ত্রণের ঢাকনা যখন তুলে ফেলা হয়, তখন দ্রব্যমূল্য ও মজুরি বৃদ্ধি পাগলা ঘোড়ার বেগে ছুটে আসে। সুষম বাজেটের ব্যবস্থাপত্র মূল্যস্ফীতির দিগন্তে স্বস্তির বাতাস এনে দিলেও অন্য সীমান্তে বৃদ্ধি হ্রাস, অধিকতর বেকারত্ব, কল্যাণ খাতে ব্যাপক কাটছাঁটের দুর্যোগ ডেকে আনে, বিশেষত যখন সরকার তার জন্য সকল খাতে বিশেষ করে প্রতিরক্ষা খাতে, ব্যয় কমাতে রাজী না থাকে এবং সেকুলার ভোগবাদী সমাজ যখন তাদের অনাবশ্যক ও অপচয়মূলক খরচ কমাতে অসম্মত থাকে। এ অবস্থা পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে একটি সংকটে নিপতিত করেছে। সৃষ্টি হয়েছে সমাধানহীন এক সংঘাতের। এ সংঘাত হচ্ছে পুঁজিবাদের কথিত সফল ও বাঞ্ছিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং মুদ্রাস্ফীতিমুক্ত স্বাস্থ্যকর অর্থনীতির সংঘাত।
তাই দেখা যাচ্ছে, কিনসীয় কৌশল উভয় সংকটের সৃষ্টি করেছে। একদিকে এ অর্থনৈতিক কৌশল দারিদ্র্য দূরীকরণ, ন্যূনতম প্রয়োজনের চাহিদা পূরণ, মূদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করত পারেনি। অন্যদিকে সম্পদ ও আয়ের বিশাল বৈষম্য হ্রাসেরও কোনো পন্থা এই কৌশল উদ্ভাবন করতে পারেনি। অবশ্য সমাজতন্ত্রের অপ্রতিরোধ্য অগ্রাধিকারের মুখে এ লক্ষ্যসমূহ কালক্রমে বুদ্ধিবৃত্তিক গ্রহনযোগ্যতা লাভ করেছে, যা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার জন্ম দিয়েছে এবং পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে কল্যাণ রাষ্ট্রের এ ধারণা সজীব শিকড়ের আকার ধারণ করেছে।
কল্যাণ রাষ্ট্র কেবলমাত্র অর্থনীতিতে সরকারের ভারসাম্য সৃষ্টিকারী ভূমিকা পালনের কিনসীয় প্রস্তাবকেই গ্রহণ করেনি, অধিকন্তু কল্যাণ খাতে অধিকতর ব্যয় এবং যথাযথ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সরকারের কল্যাণমুখী ভূমিকাকেও আত্মস্থ করেছে। সরকারি ও বেসরকারি কোনো খাতে ভারসাম্য সৃষ্টিকারী ব্যয় হ্রাস না করেই কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তির উপর প্রত্যাঘাতের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক ডারউইনবাদীদের দৃষ্টিতে এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে কল্যাণ খাতে ব্যয় হ্রাস। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সমাজ, মনুষ্যত্বের উদ্বোধন যার লক্ষ্য হিসেবে এখানে সজীব, সেখানে কল্যাণ খাতে ব্যয় হ্রাস বা পূর্ণ কর্মসংস্থান ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্য কি বিসর্জন দেয়া সম্ভব? যেহেতু এটা সম্ভব নয়, তাই প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে কোথায় ভুল আর কোথায় বিভ্রান্তি? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও পদ্ধতিতেই মৌলিক গলদ রয়েছে।
সামাজিক অনিষ্টকারিতা
পুঁজিবাদের সেকুলার দর্শনের ট্রাজেডি হচ্ছে কতিপয় পুঁজিপতিদের লাগামহীন স্বার্থসিদ্ধির সুযোগ দানের বিনিময়ে সমাজে সিংহভাগ মানুষ অধিকার ও কল্যাণ হতে বঞ্চিত হয়েছে; শুধু তাই নয় বরং পুঁজিবাদ আরে অনেক সামাজিক অনিষ্টকারিতার জন্ম দিয়েছে। ঐশি নির্দেশনা এবং তা হতে উদ্ভুত সামাজিক মূল্যবোধগুলোকে অবহেলা ও অস্বীকৃতির মাধ্যমে পুঁজিবাদ এমন একটি বাঁধনহীন, লাগামহীন সমাজের জন্ম দিয়েছে যার পরতে পরতে দুর্নীতি ও দুষ্কৃতি বিস্তার লাভ করেছে। অধিক হতে অধিকতর ভোগবিলাসের লালসা, ছলেবলে কৌশলে যেভাবেই হোক অধিকতর সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার মানসিকতার ইন্ধন জুগিয়েছে।
পুঁজিবাদী দর্শনের ফসল নেতিবাচক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ ও আত্মস্বার্থপরতার অবাধ প্রচার ও প্রসার হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি দুর্বল করে তোলে। অথচ একথা অনস্বীকার্য যে, সুস্থ ও সবল সামাজিক অগ্রগতিতে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। পারিবারিক আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা ব্যতিরেকে স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরকে ভালোবাসার বন্ধনের মাঝে জড়িয়ে রাখতে পারে না। ঐ সমাজে এটা সম্ভব নয় যেখানে অবাধ যৌন স্বাধীনতা বিরাজ করে, স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই প্রতারণামূলক যৌন অনাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এমন সমাজে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ভেঙে পড়াই স্বাভাবিক। ‘ঈশ্বর এখন মৃত’- এ দাম্ভিক ঘোষণার পরপরই এলো ‘পরিবার কাঠামোকে ভেঙে ফেল’- এই বাণিজ্যিক কৃষ্টির শ্লোগান। ‘শাসন-শোষণের নীড় ও শৃঙ্খল’ অভিধায় পরিবারকে চিহ্নিত করে এর নিন্দাবাদ উচ্চারিত হলো। ‘ঐতিহ্যের শিকল’ এবং ‘সমষ্টিগত সকল বন্ধন’ হতে মানুষের মুক্তি দেবার জন্য পশ্চিমা রেনেসাঁ আন্দোলনের স্বাভাবিক ফলাফল ছিল এগুলো।
বিবাহ বন্ধনের বাইরে যৌন সম্পর্কের অনুমোদন এবং অর্থ উপার্জনের অবাধ লিন্সার সাথে সন্তান লালনপালনের জন্য ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উপযুক্ত যত্ন ও স্নেহমমতার মাধ্যমে সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য মাতাপিতার পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার প্রয়োজন, এর মাধ্যমে পরিপূর্ণ নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার কথা, তা এখন আর লভ্য নয়। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যে সময়টা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে সময়টি মাতৃক্রোড়ের বদলে ডে-কেয়ার সেন্টারে হতে পারে না। তাই কিশোর অপরাধ বেড়ে চলছে এবং এমন এক প্রজন্ম বেড়ে উঠছে যাদের মাতাপিতা, ভাইবোন, মানুষ এবং সামাজিক মূল্যবোধ কোনো কিছুর প্রতিই কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। মানুষের মানবিক মূল্যবোধের এরূপ অবনতিশীল পরিস্থিতিতে কি মানব সভ্যতা টিকে থাকতে পারে?
মুষ্টিমেয় বৃহৎ কতিপয় পুঁজিবাদী পরিবার কর্তৃক সমগ্র অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ এবং নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্ষেত-খামার আছে এমন ধরনের জনসংখ্যার ক্রমহ্রাসমান হার গ্রামাঞ্চল ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শহর হতে বিরাট জনগোষ্ঠীকে কাজের খোঁজে বৃহৎ নগরীর দিকে ধাবমান করে তুলেছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নগরমুখী এই বৃহৎ অভিবাসন একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনের সাথে যুক্ত হয়ে পরমাণু আকৃতির ক্ষদ্র পরিবারের সমকালীন ধরণাকে বাস্তব রূপ দিচ্ছে। ফলে পরিবারের সদস্য হিসেবে পূর্বে একে অন্যের আপদে-বিপদে, সুখ-দুঃখে যে পারস্পরিক নির্ভরতা ও সহায়তা পেত, তা হতে বর্তমান একক পরমাণু পরিবারগুলো বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে দরিদ্র, আর্ত, রোগগ্রস্ত, বৃদ্ধ, বিকলাঙ্গ জনগণের দেখাশোনা করার সমগ্র বোঝা ও দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর বর্তায়, যেটা আনজাম দেবার শক্তি, সম্পদ ও সরঞ্জাম কোনোটাই রাষ্ট্রের নেই।
পরিবার নামক তৃণমূল প্রতিষ্ঠান ও যুথবদ্ধ সামাজিক জীবনের ভাঙন সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি অতীব কার্যকর পথ ও পন্থার ভিত্তিভূমিকে প্রবলভাবে ক্ষয় ও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধিতে ইন্ধন যুগিয়েছে। দারিদ্র্য দ্বারা সৃষ্ট দস্যুতা, চুরি, ধর্ষণ ও অর্থের বিনিময়ে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ এবং ধনিক শ্রেণী কর্তৃক ঘুষ, ভোক্তাকে প্রতারণা, বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন, নিম্নমানের দ্রব্য সামগ্রীর বাজারজাতকরণ, অন্যায্য শ্রমনীতি এবং কর ফাঁকি দেবার প্রচেষ্টা প্রভৃতি হোয়াইট কালার অপরাধ ও দুর্নীতিকে একত্রীভূত করলে যে অপরাধ ইনডেক্স বেরিয়ে আসবে তা ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী। সরকারিভাবে অপরাধের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা ডুবন্ত বিশাল হিমবাহের পানির উপরকার শীর্ষ দেশের মতো। সমাজদেহে অস্বাভাবিকতার সকল লক্ষণের বৃদ্ধি সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এটি ব্যক্তি-মানুষের জীবনে অসুখি হবার অভিব্যক্তিরই প্রকাশ। দেহ এবং যৌন সম্ভোগ ও সম্পদ বৃদ্ধির বল্গাহীন প্রচষ্টার মাঝে যদি মানুষের সুখ ও প্রশান্তি নিহিত থাকত তবে সমাজদেহে যে অস্বাভাবিকতার লক্ষণ জাজ্বল্যমান হয়ে ফুটে উঠেছে তা এত তীব্র হয়ে দৃশ্যমান হতো না, যা বস্তুত সভ্য সমাজের অস্তিত্বকেই হুমকির সম্মুখীন করেছে।
অধিকাংশ সরকারই একথা উপলদ্ধি করতে পারছে না যে, কেবলমাত্র পুলিশী শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে অপরাধ হ্রাস ও দমন করা সম্ভব নয়। অপরাধ হ্রাসের জন্য প্রয়োজন আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা এবং একই সাথে মৌলিক চেতনা ও মূল্যবোধের মাধ্যমে সমাজ দেহের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস। অপরিহার্য বিষয়ের বাস্তবায়ন ব্যতীত অপরাধ হ্রাসের কথা উচ্চারণ ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার যুক্তির মতো অন্তঃসারশূণ্য। ফলে ব্যর্থতা অবধারিত। আর্থ-সামাজিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য অনিবার্যভাবে প্রয়োজন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার আমূল সংস্কার, যা শুধু ঐশীবাণী প্রদর্শিত নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণের মাধ্যমেই সম্ভব। কিন্তু দেখা যায়, পুঁজিবাদের বিশ্বদৃষ্টি ও কৌশল মানুষের নফসানিয়াতের তাড়না থেকে সৃষ্ট যা ঐশীবাণী নির্দেশিত মূল্যবোধকে অস্বীকার করে জৈবিক তাড়নার দিকে ধাবিত হয়েছে।
ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে, বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদরাজির মালিকও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সত্ত্বেও অধিক অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশসমূহ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিরসন, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চাহিদাপূরণ এবং আয় ও সমাজের বিশাল বৈষম্য হ্রাসে সমর্থ্য হয়নি। শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ৩৩.৬% তথা ৩ কোটি ২৪ লাখ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে। এদের এক চতুর্থাংশ আবার ‘দারিদ্র্য ও হতাশার দুষ্টচক্রে’ আবর্তিত। এরা হচ্ছে ‘বস্তি সংস্কৃতির বন্দী আদম সন্তান’। কিশোরী গর্ভবতী, পিতৃহীন পরিবার, অমোচনীয় বেকারত্ব, অপরাধ ও মাদকাসক্তির অবক্ষয়িত সমাজ ও সংস্কৃতির অন্ধগলিতে এদের জীবন তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ষাট ও সত্তর দশকে যখন লেইজে ফেয়ার দর্শন প্রত্যাখ্যাত হয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণ রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং যার ফলে উন্নত কল্যাণ রাষ্ট্রসমূহের আবির্ভাব ঘটে, উপযুক্ত হতাশাব্যঞ্জক চিত্রসমূহ তখনকার ছবি। এমতাস্থায় দুর্দশা আরো কত গভীরতর হবে তা কল্পনাও করা যায় না, যখন রিগান ও থ্যাচার প্রশাসন পুনরায় লেইজে ফেয়ারের পথে ওকালতি করছেন এবং তারা দারিদ্র্যের জন্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এবং তাদের ভর্তুকি দেবার সরকারি নীতিকেই দায়ী করছেন? এসবের সাথে যদি শ্লথ প্রবৃদ্ধির সমষ্টি অর্থনৈতিক বৈসাদৃশ্যকে যুক্ত করা হয় তবে নিশ্চিতভাবে এটা সবার দৃষ্টিগোচর ও হৃগয়ঙ্গম হবে যে, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অর্থনৈতিক মডেল ব্যতিরেকে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।