প্রথম অধ্যায় – কুরাইশদের প্ররোচনা ও হিজরত
১. হিজরতের পূর্বাবস্থা
৬২২ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর মদিনার মরুদ্যানের নিকট অবস্থিত কুবায় আগমনের সময় থেকে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মদিনা পর্বের সূচনা হয়। বিধর্মী কুরাইশদের অত্যাচারে মক্কায় তাঁর জীবন অতীষ্ঠ হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ পৌত্তলিকতা বিরোধী একেশ্বরবাদ (তৌহিদ) প্রচার এবং ইয়াসরিবাসীদের সাথে তাঁর যোগাযোগ বা চুক্তি (আকাবা)। আকাবার চুক্তি সম্বন্ধে পরে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। ধর্মীয় প্রভাবের দিক থেকে বিবেচনা করলে প্রতীয়মান হবে যে, হযরত মুহাম্মদ (স) নবী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে বলা যায় যে, বিবদমান গোষ্ঠীর (আউস ও খাযরাজ) মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনের জন্য তিনি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন। যারা ইসলাম কবুল করেছিল তাদের মধ্যে অধিকাংশ পরিষ্কার অন্তঃকরণে, নিষ্ঠা ও সততার সাথে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অনুসারী হয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকে রাজনৈতিক কারণে ইসলামে দীক্ষিত হয়। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর হিজরতের পূর্বে এ ধরনের সত্তর জন মুসলমান মদিনা বা ইয়াসরিবে গমন করে ইয়াসরিববাসীর আতিথ্য গ্রহণ করে। এ কারণে হযরত মুহাম্মদ (স) যখন ইয়াসরিবে পৌছলেন তখন সেখানে তার অনেক উম্মত ছিল। শুধু তাই নয় তিনি সেখানকার সামাজিক পরিবেশে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। অবশ্য হিজরীর পর পর তার কি ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল তা নির্ণয় করা যায় না। তাঁর মক্কা ও মদিনার অনুসারীরা যথাক্রমে মোহাজেরীন অর্থাৎ যারা হিজরত করেছেন এবং আনসার[১] অর্থাৎ সাহায্যকারী নামে পরিচিত হন।
[১. আনব শব্দটি কুরআনের সূরা সাফার ৬১, ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “হে বিশ্বাসীগণ, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী হও।”]
কুবায় কিছুদিন অবস্থানের পর হযরত মুহাম্মদ (স) কাফেলায় মদিনার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি একটি পরিষ্কার খেজুর বাগান পছন্দ করে[২] সেখানে বসতি স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন যা পরবর্তীকালে তাঁর মসজিদ (মসজিদ-আন- নাবাবী) এবং বাসস্থানে পরিণত হয়। মক্কা থেকে আগত মোহাজেরগণ মদিনা মসজিদের আশেপাশে বসতি স্থাপন করেন। একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে তখন এখানে ঘনবসিত ছিল না কারণ নবদীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা ছিল কম। ধারণা করা হয় যে যে স্থানে হযরত মুহাম্মদ (স) যে মসজিদ ও বাসস্থান স্থাপন করেন তা ছিল শহরের দক্ষিণে উঁচু ভূমিতে (আলিয়া) মদিনায় পৌছে প্রথম কয়েক মাস হযরত মুহাম্মদ (স) নবগঠিত মুসলিম উম্মার পরিচর্চা ও পরিচালনায় ব্যস্ত থাকেন। এ সমস্ত কর্মকাণ্ড ধর্মীয় ও জাগতিক ছিল। তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল বহুমুখী। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরিত অভিযানসমূহ। অভিযানসমূহের তারিখ সম্বন্ধে সঠিকভাবে জানা না গেলেও অন্যান্য কার্যাবলির সন-তারিখ বিশেষ জানা যায় না। এ কারণে হযরত মুহাম্মদ (স) কর্তৃক প্রেরিত পৌত্তলিক মক্কাবাসী এবং বিধর্মী যাযাবর গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত অভিযানসমূহ পর্যালোচনা করা যায়। এরপর মদিনার মুসলিম সম্প্রদায়ের নানা প্রকার কর্মকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে না হলেও সুষ্ঠুভাবে বিশ্লেষণ করা যায়।
[২. স্থানটি সহল ও সোহায়েল নামে দুই অনাথের ছিল এবং হযরত আবু বকর নবীর জন্য এই জায়গাটি ক্রয় করেন।]
২. প্রাথমিক অভিযানসমূহ
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনচরিত্র থেকে যে নির্ভরযোগ্য প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায় তা সাধারণত “আল-মাগাজী” বা “অভিযান” নামে পরিচিতি, যদিও মদিনা পর্বে অভিযানসমূহই সর্বাধিক প্রাধান্য বিস্তার করে নি তবুও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, নবপ্রতিষ্ঠিত মসজিদ রাষ্ট্রের স্থায়ীত্বে ও ধর্ম প্রচারের জন্য এ সমস্ত অভিযান বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এ সমস্ত অভিযানসমূহ পরিচালনার অন্তরালে যে ঘটনা রয়েছে এবং পরিচালনার তারিখ আরব ঐতিহাসিকগণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। আল-ওয়াকীদী যে চুয়াত্তরটি অভিযানের কথা বলেন তার মধ্যে সাতটি হিজরতের আঠারো মাসের মধ্যে পরিচালিত হয়। এ সমস্ত অভিযান তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু বিধর্মীদের বিরুদ্ধে প্রেরিত এ সমস্ত সামরিক অভিযান মক্কা ত্যাগের পর মক্কাবাসীদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বৈরী মনোভাব প্রকাশ করে।
অভিযানসমূহ প্রমাণ করে যে মক্কায় অবস্থানকালে হযরত মুহাম্মদ (স) আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মদিনায় হিজরত করার পর তিনি আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেন। একটি ব্যতীত এই অভিযানসমূহ সিরিয়া থেকে মক্কায় কাফেলায় বাণিজ্য বহরের ওপর আক্রমণ পরিচালিত হয়। বাণিজ্য পথ, যা মসলা পথ (Spice route) নামে পরিচিত, মদিনা এবং লোহিত সাগরের উপকূলের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে বিস্তৃত ছিল। যদিও উপকূল ঘেষে কাফেলা যাতায়াত করতো তবুও মদিনার আশি মাইলের মধ্যে দিয়ে তাদের যাতায়াত করতে হতো। মদিনা থেকে মসলা পথের যে দূরত্ব তার চেয়ে মক্কা নগরীর দূরত্ব ছিল দিগুণ। এ কারণে কাফেলার আক্রমণকারীদের কাফেলার যাত্রী ব্যবসায়ীদের সম্মুখীন হতে হোত এবং মক্কা থেকে তাদের সাহাযার্থে প্রেরিত আক্রমণকারী দল আসার আগেই মুসলিম অভিযানকারীরা মদিনায় নিরাপদে ফিরে আসতে পারতো। এ সমস্ত অভিযানসমূহের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম পূর্ব যুগের বেদুঈনদের অতর্কীত আক্রমণের মত কাফেলায় হামলা চালানো (ambush)। এ সমস্ত অভিযান সবসময় সফল হতো না। মুসলিম আক্রমণকারীগণ এ ধরনের সম্মুখ আক্রমণে অংশ গ্রহণের জন্য চিন্তাভাবনা করতো; কারণ কখনো কখনো তা তাদের জন্য বিপদজনক ছিল। সে সব ক্ষেত্রে তারা অভিযান প্রত্যাহার করতো!
প্রথম দুই কিংবা তিনটি অভিযান পরিচালনায় বিশ থেকে আশিজন অংশ গ্রহণ করে। তবে ৫২৩ খ্রিস্টাব্দে যে সমস্ত অভিযান হযরত মুহাম্মদ (স) নিজে পরিচালিত করেন তাতে দুইশত মুসলমান অংশ গ্রহণ করে। এমন একটি বিশাল কাফেলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে ২,৫০০ উঠ ছিল এবং এর পরিচালনায় নিয়োজিত ছিল ২০০ থেকে ৩০০ যাত্রী। এ ধরনের তথ্য কতটুকু সত্য তা সঠিকভাবে বলা যায় না। কারণ বদরের যুদ্ধের পূর্বে মক্কার যে কাফেলা মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হয় তাতে ৭০ জন যাত্রী ছিল। ক্রমাগত আক্রান্ত হলে মক্কার কাফেলায় অধিক লোক অংশগ্রহণ করে নিরাপত্তার জন্য।
যদি হযরত মুহাম্মদ (স) ২০০ কিংবা ১৫০ জন নিয়ে প্রাথমিক অভিযানসমূহে নেতৃত্ব দেন তা হলে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আনসারগণ তাতে সামিল হয়। এর কারণ হিজরতের সময় আনসারদের তুলনায় মোহাজেরদের সংখ্যা ছিল কম। ঐতিহাসিকগণ আনসারদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একমত নন; তাদের অনেকে বলেন যে, বদরের যুদ্ধে আনসারগণ প্রথম অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। যাহোক, বদরের যুদ্ধে ১০০ জন মোহাজের অংশগ্রহণ করেন (অনেকের মতে ৬০ জন) এবং আনসারদের মধ্যে ২৩৮ (অনেকের মতে ২৫৩) বিধর্মীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন।
মোহাজেরীনদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। হিজরতের পর কিছুসংখ্যক নব-দীক্ষিত মুসলিম মক্কা থেকে মদিনায় আসেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ আয়াশ বিন আবি রাবিয়া (কুরাইশ গোত্রের উপগোত্র মাখযুম) এবং হিশাম বিন আন আস (মাহম)। মাখযুম গোত্রের দলপতি আল-ওয়ালিদ বিন আল-মাখযুমের মৃত্যুর পর আয়াশ মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় চলে যান। বানু জুহরা গোত্রের মিকদাদ বিন আমর এবং বানু নাওফল গোত্রের উতবা বিন-গাষওয়ান উবায়দায় পরিচালিত অভিযানে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করেন। এছাড়াও যাযাবর বেদুঈনদের অনেকেই মাল-ই- গনিমতের লোভে ইসলাম কবুল করে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ সমস্ত অংশগ্রহণকারী মুসলিম সদস্যদের নিয়ে মুসলিম বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ২৫০ জনে দাঁড়ায়। এ ছাড়া মক্কায় বিধর্মীদের বিপক্ষে জুহায়না গোত্রের মাজদী বিন-আমর বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এভাবে নবী করীম (স) বিভিন্ন গোত্রে ও যাযাবর গোষ্ঠী থেকে নব-দীক্ষিত মুসলিমদের নিয়ে নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন।
উল্লিখিত সাতটি অভিযান রক্তপাতহীন হলেও এগুলোর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বিশেষভাবে মুসলমানদের নৈতিক শক্তি বৃদ্ধিতে হযরত মুহাম্মদ (স) যে একটি বড় দল নিয়ে মক্কায় তার চেয়ে বড় মক্কার সামরিক বাহিনীর মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তা পরিষ্কার হয়ে যায় এবং নবীর সামরিক কৌশল ও বীরত্বে যাযাবরগণ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অবশ্য যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী পাওয়ার আশায় তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। এর মধ্যে বনু জুহায়না ইসলামের ছায়াতলে আসে। উপরন্তু, হযরত মুহাম্মদ (স) বনু দামরা এবং বনু মুদলিজের মতো ছোট ছোট গোত্রের সাথে অনাগ্রাসান চুক্তি করেন। এই অনাগ্রাসন চুক্তির শর্তানুযায়ী এক পক্ষ অপর পক্ষকে আক্রমণ না করার অধিকার করে। অথবা অন্য কোন শত্রুপক্ষের সাথে যোগসাজসে আক্রমণ করবেনা অথবা শত্রুদের সাথে হাত মিলাবেনা।
মদিনায় আগমনের পর হযরত মুহাম্মদ (স) অভিযান পরিচালনায় প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মক্কার বিধর্মী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে সমর প্রস্তুতি। হযরত মুহাম্মদ (স)-কে মক্কা থেকে মদিনায় আসার আমন্ত্রণ জানাবার পূর্বে ইয়াসরীববাসী (আনসার) তাঁর সমরনীতির আভাস পান। এ মুহূর্ত্তে বলা মুশকিল ছিল হযরত মুহাম্মদ (স) সাতবার অভিযান পরিচালনা করে কোন উদ্দেশ্য সফল করতে চেয়েছিলেন। এ সমস্ত অভিযানের মূখ্য উদ্দেশ্য কি ছিল নেতিবাচক অর্থাৎ মক্কার কুরাইশদের কাফেলায় বাণিজ্য বন্ধ করে তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করা অথবা তিনি কি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে চেয়েছিলেন মক্কা বিজয়। এ সময় এমন কোন তথ্য প্রমাণ নেই যে, মক্কার কাফেলা আক্রমণ করে তিনি মদিনার বাণিজ্যের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যদিও শেষের দিকের একটি অভিযান (নাখলা) ছিল ব্যবসা-সংক্রান্ত। কিন্তু এ সময় তা (৬২৩ খ্রি.) তার সামরিক শক্তি, জনবল কিছুই ছিল না। এ কারণে তিনি কোন বৃহত্তর সামরিক অভিযান থেকে বিরত থাকেন। শুধুমাত্র মক্কার কাফেলায় আক্রমণ পরিচালিত হয় নি : তিনি দুষ্কৃতকারীদের সমুচিত শিক্ষা দানের জন্য অভিযান পরিচালনা করেন, যেমন মদিনার চারণ ক্ষেত্র থেকে উঠ চুরি করার অপরাধে কুরয-ই ফেহরী গোত্রের বিরুদ্ধে তিনি অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেন এবং মদিনার নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এই অভিযান করেন।
মক্কার কাফেলার ওপর আক্রমণে কুরাইশগণ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও তারা উপলব্ধি করেন যে, মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে মদিনার নিকটবর্তী বাণিজ্য পথ তাদের জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। কুরাইশগণ এ কথা ভেবে শঙ্কিত হলো যে, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও তাদের কাফেলা হামলার সম্মুখীন হচ্ছে এবং কোন একদিন মুসলিম অভিযানকারীরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে তারা হয়তো কোন দিন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আপাততঃ কুরাইশগণ কোন প্রকার সাবধানতা অবলম্বন করেনি; কিন্তু বদরের প্রান্তরে মুসলমানদের সাথে তাদের সংঘর্ষের জন্য তারা আশংকিত ছিল।
কুরআনে প্রাথমিক মুসলিম অভিযানের কোন উল্লেখ পাওয়া না গেলেও আত্মরক্ষামূলক অভিযানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, “মোহাজেরগণ সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চায় তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তাদের অনুমতি দান করেছেন।” সূরা হজ্জ (২২) ৩৯ এবং ৪০ আয়াতে উল্লেখ আছে :
“যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে (প্রতিরক্ষামূলক) কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সম্যক সক্ষম।”
“তাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ী থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে তারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ।”
পরবর্তীকালে মোহাজেরীন ও আনসারগণ যৌথভাবে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য কুরআনের ঐশীবাণী দ্বারা নির্দেশ লাভ করেন : সূরা বাকারার (২) ২৪৪ আয়াতে বলা হয়েছে।
“তোমরা আল্লাহর পথে (ফি সাবিল আল্লাহ) সংগ্রাম কর এবং জেনে রাখ যে আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”
কুরআনের এই আয়াতে নাজেল হবার পরও মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিশেষ সাড়া পাওয়া যায় নি, যার উল্লেখ পাওয়া যায় সূরা বাকারা (২) ২১৬, ২৪৬-২৪৭ আয়াতসমূহে।
“তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হলো, যদিও তোমাদের নিকট এটি অরুচিকর; কিন্তু তোমরা যা পছন্দ কর না, সম্ভবত তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং তোমরা যা পছন্দ কর সম্ভবত তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ যা জানেন তোমরা তা জান না।”
এরপর আল্লাহর পথে যুদ্ধে অংশকারীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ‘শহীদ’ ও বেহেস্তের কথা বলা হয়েছে : সূরা নিসাব (৪) ৯৫ আয়াতে উল্লেখ আছে :
“বিশ্বাসীদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়। যারা স্বীয় ধন-প্রাণ দিয়ে জিহাদ করে তাদের যারা ঘরে বসে থাকে (অলস) তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহর সকলকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর যারা জিহাদ করে তাদেরকে আল্লাহ মহা পুরষ্কারের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।”
৩. নাখলায় প্রথম সংঘর্ষ-যুদ্ধ
হিজরতকারী মুসলমানদের সাথে পৌত্তলিক কুরাইশদের প্রথম সাক্ষাৎ সংঘর্ষ-যুদ্ধ সংঘটিত হয় নাখলা নামক প্রান্তরে। এই সংঘর্ষের তথ্য সর্বপ্রথম উরওয়ার পত্রের ভিত্তিতে ইবন-ইসহাক দেন এবং পরবর্তীকালে, যা জুহরী এবং ইয়াজিদ বিন রুমান নামের প্রখ্যাত হাদিসকারের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এই তথ্যসূত্র অনুযায়ী বনু আব্দ শামসের আবদুল্লাহ বিন জাহাশের নেতৃত্বে আট অথবা বার জন মোহাজেরসহ একটি দল পাঠানো হয়। হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর একটি সীলমোহর করা চিঠি দিয়ে তাকে নির্দেশ দেন যে, তিনি তাইফ এবং মক্কার মধ্যবর্তী স্থান নাখলায় পৌঁছে দু’দিন পরে চিঠিটি খুলবেন। কুরাইশদের ক্রমবর্ধমান আক্রমণ ও লুটতরাজ বন্ধ করার জন্য এই অভিযান প্রেরিত হয়। সীলমোহরকৃত আদেশ পত্রটি খুলে আবদুল্লাহ বিন জাহাশ পড়লেন, “সঙ্গীদের নিয়ে নাখলার দিকে অগ্রসর হও এবং মক্কার কাফেলার জন্য অপেক্ষা কর।” এতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, মক্কার কাফেলাকে আক্রমণ করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) আবদুল্লাহকে নির্দেশ দেন নি। মুসলিম অভিযানকারীগণ মক্কা থেকে সিরিয়ায় গমনরত বার জন আরোহীর একটি কাফেলা দেখতে পান এবং তারা যে হজ্জ যাত্রী তা বুঝাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু আবদুল্লাহ এবং তার সঙ্গীগণ সুযোগমতো মক্কার কাফেলাকে আক্রমণ করে, এর ফলে আমর বিন আল-হাদরামী নিহত হয়, একজন পালিয়ে প্রাণ বাঁচায় এবং অপর দুজনকে বন্দী করা হয়। এ ধরনের নাখলার খণ্ড যুদ্ধ বিধর্মী কুরাইশদের জন্য ছিল একটি সাবধানবাণী। বন্দীসহ আবদুল্লাহ যখন মদিনায় মক্কার কাফেলা নিয়ে আসলেন তখন হযরত মুহাম্মদ (স) পবিত্র রজবের মাসে যখন রক্তপাত নিষিদ্ধ তখন মক্কাবাসীকে হত্যা করার জন্য আবদুল্লাহকে তিরস্কার করলেন। নবী করিম (স) এতই বিরক্ত হলেন যে, যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যাদির এক-পঞ্চমাংশ (মাল-ই- গণিমত) গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এই অনভিপ্রেত ঘটনার ফলে একটি ঐশীবাণী নাজেল হয়।[১] পরবর্তী পর্যায়ে পৌত্তলিক কুরাইশগণ এক প্রতিনিধিদল মদিনায় আসে এবং মুক্তিপণ প্রদান করে বন্দীদের নিয়ে যায়। যে দুজন মুসলমান দলচ্যুত হয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো তারা ফিরে আসার শর্তে বন্দী প্রতি ১৬০০ দিরহাম মুক্তিপণ ধার্য করা হয়।
[১. “আল্লাহর নিকট ততপেক্ষা অধিক অন্যায় : ফিতনা হত্যা অপেক্ষা ভীষণতর অন্যায়।”
“যারা বিশ্বাস বলে এবং যারা আল্লাহর পথে স্বদেশ ত্যাগ করে এবং জিহাদ করে তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে।”
সূরা বাকারার (২) ২১৭ ও ২১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করলে বল ‘এতে যুদ্ধ করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে বাধাদান করা আল্লাহকে অস্বীকার করা, মসজিদুল হারামে বাধা দেওয়া এবং তার বাসিন্দাকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা।”]
নাখলার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে, আবদুল্লাহ বিন-জাহাশের নেতৃত্বে যখন হযরত মুহাম্মদ (স) অভিযান পাঠান তখন সীলমোহরকৃত পত্র দেন; এর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে গোপনীয়তা বজায় রাখা। এই পত্রের বিষয়বস্তু কেবলমাত্র হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর পত্র লেখক এবং দু একজন সাহাবী জানতেন। তিনি আবদুল্লাহকে দক্ষিণ দিকে মক্কা থেকে চলাচলরত কাফেলার দিকে না পাঠিয়ে পূর্ব দিকে নজদের পথে যাত্রা করতে বলেন। এটি করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পৌত্তলিক মক্কীবাসীদের নিয়োজিত গুপ্তচরদের দৃষ্টি এড়ানো যাতে মুসলিম অভিযানের মূল উদ্দেশ্য তারা জানতে না পারে। পূর্ববর্তী যে সমস্ত অভিযান প্রেরিত হয় সেগুলোতে এ ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা হয় নি, উদ্দেশ্যমূলকভাবে যাতে শত্রুপক্ষ তাদের তৎপরতা সম্বন্ধে অবহিত হতে পারে। যাহোক, আবদুল্লাহ পরিচালিত এই অভিযান মদিনা অপেক্ষা মক্কার খুব সন্নিকটে ছিল বিধায় অভিযানকারীদের জন্য এর উদ্দেশ্য প্রকাশিত হলে বিপদজনক হতে পারতো- এ কারণেই গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।
আবদুল্লাহ যখন হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চিঠি খুলে পড়লেন তখন ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে উঠলেন এ কারণে যে যে ধরনের আক্রমণের কথা বলা হয়েছে তা তাদের নিরাপত্তার জন্য ছিল হুমকীস্বরূপ। তারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অবশ্য বিমুখ ছিল না।
রক্ত গরম হলে আরবগণ রক্তপাত ঘটাতে পারে কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় রক্তপাত ঘটানো দুরূহ ব্যাপার। হযরত মুহাম্মদ (স) নির্দেশ দেন যদি কেউ আক্রমণে অংশ নিতে না চায় তাহলে তাকে ফেরৎ পাঠাতে হবে। এ প্রসঙ্গে সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস এবং তার সঙ্গী উতবা বিন গাযওয়ানের কথা বলা যায়। আবদুল্লাহ বিন জাহাসের অভিযানে যোগদান করে ধীর গতিতে চলার ফলে তাদের উঠ মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কয়েক দিন পরে মূল দলটি মাল-ই-গণিমতসহ মদিনায় ফিরে আসলে সা’দ এবং উতবা তাদের পথ হারিয়ে যাবার কথা বলেন। কিন্তু তাদের কথা কতটা সত্য তা সঠিকভাবে বলা যায় না। সম্ভবত তারা নাখলায় সংঘটিত খণ্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন না। এতে পারস্যবিজেতা মুসলিম সেনাপতি সা’দের কাপুরুষকতা প্রকাশ পায়। সা’দ যখন পারস্যের সাসানীয় রাজ্যের বিরুদ্ধে ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে কাদেসীয়া প্রান্তরে যুদ্ধে লিপ্ত তখন তিনি অসুস্থতার জন্য পাল্কীতে শায়িত ছিলেন। ইবন হিশাম যদিও সা’দের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন যে সা’দই ইসলামের জন্য প্রথম রক্তপাত ঘটান তাবারী এর বিরোধিতা করে বলেন যে মরুভূমিতে পথ হারিয়ে যাওয়া একটি ঘটনা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিকর। মূলত ইসলামের জন্য প্রথম রক্তপাত ঘটান ওয়াকিদ বিন আবদুল্লাহ। তিনি নাখলায় মক্কার কাফেলার আরোহী আমর বিন আল-হাদরামীকে তরবারির আঘাতে হত্যা করেন। ইসলামের জন্য এটিই প্রথম শত্রুর প্রতি আঘাত। সা’দ এবং ওয়াকিদ সম্বন্ধে যে ভুল ধারণা জন্মায় তার মূল কারণ এই যে হযরত ওমরের খিলাফতে (খ্রি. ৬৩৪-88 ) ওয়াকিদ মৃত্যু বরণ করেন অন্যদিকে পারস্য বিজেতা ও গভর্ণর সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস পারস্য বিজয়ের পর চল্লিশ বছর জীবিত ছিলেন এবং তার পরিবারবর্গ থেকে তার সম্বন্ধে অনেক বীরত্বমূলক কাহিনী প্রচারিত হয়।
হযরত মুহাম্মদ (স) আবদুল্লাহ বিন জাহাসকে সীল মোহরকৃত যে পত্র দিয়েছিলেন তার বিষয়বস্তু কি ছিল তা তিনি এর লেখক এবং দু’একজন সাহাবী জানতেন, অন্য কেউ নয়। চিঠি খুলে নির্দিষ্ট স্থানে নাখলায় দু’দিন পরে পৌঁছবার পর আবদুল্লাহ একটি নির্দেশনামা পান। এই নির্দেশনামা ঐতিহাসিক সূত্রে দু’ভাবে বর্ণিত হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে নাখলায় গিয়ে মক্কা থেকে আগত মক্কার কাফেলাকে অতর্কিত আক্রমণ (ambush) করা। অপর একটি ভাষ্যে উল্লেখ আছে যে, নাখলায় গিয়ে অপেক্ষা করা ও লক্ষ্যরাখা। আরবিতে ‘তারাসাদু’ ওয়াট অবশ্য মনে করেন যে, আসল চিঠিতে আক্রমনের কথা বলা হয়েছে, যা পরে “অপেক্ষা করা ও লক্ষ্য রাখা” দ্বারা পরিবর্তিত হয়েছে। এটি করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রজব মাসে রক্তপাত নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও রক্তপাত হয়েছে এবং এটি যে অসম্মানজনক কাজ তা ঢাকার জন্য। কিন্তু আল্লাহ এক ঐশীবাণীতে এটি বৈধ করেন। একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে তিনি রক্তপাত চান নি : একটি স্কাউট দল গোপন সংবাদ আনার জন্য পাঠিয়েছিলেন তবে তিনি জানতেন এ ধরনের অভিযানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে, যার ফলে পৌত্তলিক ও মুসলমান উভয়য়ের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকবে। উপরন্তু, হযরত মুহাম্মদ (স) নিশ্চিতভাবে জানতেন না যে মক্কা থেকে চারজন আরোহীসহ এক কাফেলা নাখলা দিয়ে উত্তরে যাতায়াত করবে। এটি ছিল এক গোপন তথ্য সংগ্রহের অভিযান, যা সংঘর্ষে পরিণত হয়। তাছাড়া সিরিয়া থেকে মক্কা পর্যন্ত বিস্তৃত প্রচলিত মসলা পথে এই অভিযান না পাঠিয়ে অপ্রচলিত নজদেব পথে মহানবী পাঠান, যাতে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ এড়ানো যায়। সুতরাং হযরত মুহাম্মদ (স) সম্ভাব্যতা বিচার করেই অভিযান পাঠান। আবার এমনও হতে পারে যে, তিনি গুপ্তচরের মাধ্যমে নাখলায় মক্কাবাসীদের কাফেলার আগমনের তথ্য আগেই পেয়েছিলেন। নাখলার খণ্ড-যুদ্ধের সময়কাল নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ঐতিহাসিক ওয়াকীদীর মতে, নাখলার সংঘর্ষ রজব মাসের শেষে সংঘটিত হয়। তিনি বলেন, মুসলিম অভিযানকারীদের নিষিদ্ধ মাসে কাফেলা আক্রমণ করতে বাধ্য হন নতুবা তাদেরকে মক্কার পবিত্র ভূখণ্ডে প্রবেশের পথ আক্রমণ করতে হতো। যদি এই তথ্য সত্য হয় তাহলে বলা যায় যে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অভিযানের সময়কাল বিচার সঠিক হয় নি। অভিযানকারীদের পক্ষ থেকে সাফাই গাওয়া হয়েছে যে, তারা যখন আক্রমণ করে একজন বিধর্মীকে হত্যা করে তখন তারা জানতেন না যে রজব মাস শুরু হয়েছে না শেষ হয়েছে। কোন কোন আরব ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, নাখলার খণ্ড- যুদ্ধ রজব মাসের প্রথম দিকে সংঘটিত হয়। মোদ্দাকথা রক্তপাতের পর জানা যায় যে, রজব মাসে সংঘর্ষ হয়েছিলো। ওয়াট মনে করেন যে, রজব মাসের মাঝামাঝি এই ঘটনা ঘটেছিল এবং হযরত মুহাম্মদ (স) তথাকথিত পবিত্র রজব মাসেই অতর্কীত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।
এরপর পবিত্র রজব মাস প্রসঙ্গে আসা যাক। যদিও বলা হয়েছে যে হযরত মুহাম্মদ (স) পবিত্র রজব মাসে অতর্কীত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন তবুও সন্দেহ থেকে যায়। এর কারণ তিনি কোন প্রকার অসম্মানজনক কার্যকলাপে জড়াতে চান নি। এ ছাড়া রজব মাসের পবিত্রতা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। প্রাক-ইসলামী বা পৌত্তলিকতার (আয়ায়ামে জাহেলিয়া) যুগে রজব মাসকে পবিত্র মাস হিসেবে গণনা করা হতো এবং এই মাসে সকল প্রকার রক্তপাত নিষিদ্ধ ছিল। পৌত্তলিকরা মনে করতো যে, এই নিয়ম ভঙ্গ করা তাদের বিগ্রহ ধ্বংসের সামিল। অন্য যে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য তা হচ্ছে যুদ্ধ লব্ধ সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ গ্রহণের অনিচ্ছা। মাল-ই-গনিমা হিসেবে নবীর প্রাপ্য এক- পঞ্চমাংশ বাকি অংশ সৈন্যদের ভোগের জন্য প্রদান করার বিধি রয়েছে। সম্ভবত পবিত্রমাসে খণ্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় হযরত মুহাম্মদ (স) মাল-ই-গণিমতের অংশ গ্রহণে অসম্মতি জানান। এর ফলে বিধর্মীদের ধারণা হলো যে, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক প্রাক-ইসলামী যুগের রীতি লঙ্ঘন করেছেন বিধায় যুদ্ধলব্ধ সম্পদ গ্রহণ করেন নি। উপরন্তু, পৌত্তলিকগণ তাঁকে ব্যঙ্গ করে বলতে থাকে, একদিকে তিনি আল্লাহর একাত্ব ঘোষণা করছেন; আবার অন্যদিকে আল্লাহর বিধান যে রজব পবিত্র মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ তা লঙ্ঘন করছেন। এ পর্যায়ে বলা প্রয়োজন যে, কুরআনের ভিত্তিতে চার মাস খুবই পবিত্র বলে গন্য করা হয় এবং চারটি মাস হচ্ছে রজব, জুল কা’দা, জুল হিজ্জা এবং মুহাররম। সম্ভবত রজব মাসে নাখলায় সংঘর্ষ হলে স্বাভাবিকভাবে নবী করিম বিচলিত হন। এ কারণে সূরা বাকরার (২) ২১৭ আয়াতে যা পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে, স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে; প্রয়োজনে রজব মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ নয়। কুরআনের আলোকে বলা যায় যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে কুরাইশদের কুফরীর চেয়ে পবিত্র মাসে সংঘর্ষ অনেক শ্রেয়। শুধু তাই নয় বিধর্মীদের তাদের অবিশ্বাসের জন্য শাস্তি ভোগ করার আভাস দেওয়া হয়েছে। যাহোক, পরবর্তীকালে হযরত মুহাম্মদ (স) রজব মাসে কোন অভিযান পাঠান নি, যদিও ওয়াকীদী বলেন যে, হিজরীর ৬ ও ৮ সনে (খ্রি. ৬২৭, ৬২৯) তিনি দু’বার অভিযান প্রেরণ করেন। অবশ্য এগুলো ছিল রক্তপাতহীন অভিযান। শুধু রজব মাসই নয় ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে অন্যান্য পবিত্র মাসেও সমরাভিযান করতে হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে পবিত্র মাসে মুসলিম অভিযান নিষিদ্ধ নয়।
নাখলার ঘটনা প্রমাণ করে যে প্রয়োজনে ইসলামের স্বার্থে এবং পৌত্তলিকদের ধ্বংস সাধনে পবিত্র মাসে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ দুষণীয় বা অসম্মানজনক নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক প্রাক-ইসলামী দৃষ্টি ভঙ্গিতে রজব মাসে আবদুল্লাহ বিন জাহাশের অভিযানে আমর বিন আল-হাদরামীর হত্যা ছিল অপবিত্র (sacrilege) কাজ। যদিও কুরআনের আয়াতে এটি দুষণীয় হিসেবে বিবেচিত হয় নি তবুও পৌত্তলিকদের ইসলামে আকৃষ্ট করার জন্য নবী করীম রজব মাসে অভিযান প্রেরণ থেকে বিরত থাকেন। নবীর দিক থেকে নাখলার আক্রমন ও হত্যা অসম্মানজনক ছিল না কারণ তিনি মক্কার বাণিজ্য ও পৌত্তলিকতাকে একই সাথে আঘাত করেছেন। অপর দিকে মক্কার সন্নিকটে কুরাইশদের একজন ব্যবসায়ীর হত্যা এবং কাফেলার ধ্বংস তাদেরকে ভীষণভাবে বিচলিত করে এবং তাদের সামাজিক মার্যাদার হানী হয়। সেই সাথে তারা তাদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
৪. বদরের যুদ্ধ (মার্চ, ৬২৪)
নাখলা থেকে প্রাপ্ত যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী (মাল-ই-গণিমত) মক্কার কাফেলা আক্রমণে উৎসাহ জোগায় এবং এ কারণে হযরত মুহাম্মদ (স) পরবর্তী অভিযানে (বদর) ৩০০- ৩১৩ মুজাহিদ অংশ গ্রহণ করে। পূর্বে এই সংখ্যা ছিল ২০০, অর্থাৎ ১০০ মুজাহিদ বেশি। যেহেতু মোহাজেরদের সংখ্যা ছিল সীমিত, সেহেতু ধারণা করা যায় যে আনসারগণ দলে দলে বদরের যুদ্ধে যোগদান করে। ইবন সা’দের মতে, বদরের রণক্ষেত্র ২৩৮ জন আনসার এবং ৮৬ জন মোহাজের (অর্থাৎ ৩২৪) অংশগ্রহণ করে। হযরত মুহাম্মদ (স) সময়মত সংবাদ পেলেন যে, গাজা থেকে মক্কাগামী একটি কাফেলা শীঘ্র মদিনার সন্নিকট দিয়ে পার হবে। এই কাফেলায় ৭০ জন আরোহী থাকলেও এতে ৫০,০০০ দিনার মূল্যের ধনসম্পদ ছিল। মক্কার প্রায় প্রত্যেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের মাল- সামান এই কাফেলায় ছিল। এ কারণে মক্কাবাসীগণ এই কাফেলার নিরাপত্তার জন্য খুবই আশঙ্কিত ছিল। এমন হতে পারে যে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাফেলা নিরাপত্তার জন্য এই কাফেলায় যোগদান করে।
উল্লেখ্য, এই বিশাল কাফেলার নেতৃত্ব দেন মক্কার পৌত্তলিকদের প্রধান আবু সুফিয়ান বিন হারব। তিনি কাবা শরীফেরও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। মুসলমানদের মদিনা আগমনের পর ছোট ছোট অভিযানে অংশ নিয়ে কাফেলাগুলোকে ব্যতিব্যস্ত করা হতো। একথা জেনে আবু সুফিয়ান নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেন। তিনি মক্কায় সংবাদ পাঠিয়ে তাদের কাফেলার নিরাপত্তার জন্য জনবল চেয়ে পাঠান। এমতাবস্থায় আবু জেহেলের নেতত্বে ৯৫০ জন পৌত্তলিক মদিনার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পারতপক্ষে বিধর্মী মক্কাবাসীদের মধ্যে সকল সক্ষম ব্যক্তি এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে। এর কারণে এই যে পার্শ্ববর্তী কিনান গোত্র যাদের সাথে কুরাইশদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছিল, মক্কা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই বিশাল বাহিনীসহ মক্কা থেকে আবু জেহেল অগ্রসর হলেন হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সাহাবীদের অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক দলকে প্রচণ্ড হুমকি দিতে। বিধর্মী কুরাইশগণ আশা করে যে বিশাল বাহিনী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রগুলোকে মুসলিম বাহিনীতে যোগদানে নিরুৎসাহ করবে এবং ভবিষ্যতে মুসলমানগণ মক্কার কাফেলাকে আক্রমণ করবে না। আবু জেহেলের দল জানতে পারে যে, মক্কার কাফেলা নিরাপদে মদিনা পার হয়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অতর্কীত আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে। পৌত্তলিক মক্কাবাসী এবং মুসলিম উম্মার মধ্যে যে বিরোধ দেখা দিল তা বিধর্মী আমর বিন-হাদারামীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। আবদ শামস গোত্রের উতবা বিন রাবিয়া বন্দী দুজন কুরাইশের মুক্তিপণ দিতে চাইলে আবু জেহেল তাকে বিরত রাখেন। এর কারণ এই যে আবু জেহেল তার বাহিনী নিয়ে হযরত মুহাম্মদের বাহিনীকে সমূলে উৎপাঠিত করতে চান।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় যে মক্কার বাহিনী আগ্রাসন নীতি গ্রহণ করে। তবে মখজুম এবং আবদ সামসের মধ্যে যে সখ্যতা ছিল না তা এ অভিযানে প্রমাণিত হয়। কুরাইশ গোত্রের মধ্যে কোন ঐক্য ছিল না কারণ বদরের প্রান্তরে অভিযানের পূর্বে বনু জুহর এবং বনু আদি নামে দুটি ক্ষুদ্র উপ-গোত্র এই অভিযানে যোগদান করেনি। কারণ তাদের ধারণা হলো যে ইসলাম ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে বৃহত্তর আবদ শামস লাভবান হবে। বিশাল বহর নিয়ে আবু জেহেল অগ্রসর হলে তার ধারণা হলো যে মুসলিম বাহিনী তাদের আক্রমণ করতে সাহস করবে না।
মুসলমানগণ বদরের প্রান্তরের দিকে অগ্রসর হবার পূর্বে কুরাইশদের বিশাল বাহিনীর কথা জানতেন না। খলিফা আব্দুল মালিককে লিখিত উরওয়ার পত্রে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর রসূল অথবা তাঁর সাহাবীগণ বদরে উপস্থিত হবার পূর্বে কুরাইশদের অভিযানের কথা জানতে পারেন নি। তারা কাফেলার সন্ধানে বের হয়েছিলেন। ওয়াট বলেন, যদি মুসলমানগণ জানতো যে বদরের প্রান্তরে সংঘর্ষ-যুদ্ধ হবে তা হলে তারা হয়ত অভিযান থেকে বিরত থাকতেন (এই ভাষ্য সঠিক নয়)। তারা বদরে উপস্থিত এক ভেস্তিওয়ালার কাছে থেকে যখন জানতে পারেন যে আবু জেহেল এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কা থেকে মদিনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন তারা তা বিশ্বাস না করে মিথ্যা বলার জন্য ভেস্তিওয়ালাকে শাস্তি দেন। ভেস্তিওয়ালা যখন মিথ্যা করে আবু সুফিয়ান সম্বন্ধে বলল তখন মুসলমানগণ বিশ্বাস করলো। যাহোক, হযরত মুহাম্মদ (স) ভেস্তিওয়ালাকে ডেকে যখন জিজ্ঞাসা করলেন তখন প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ পেল। মক্কার পৌত্তলিকেরা ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য অগ্রাসন চালিয়েছে তা প্রমানিত হল। সূরা আনফালে (৮) ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে।
“স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে দু’দলের এক দল (কাফেলা অথবা আবু জেহেল বাহিনী) তোমাদের আয়াত্তাধীন হবে অথচ তোমরা চাচ্ছিলে যে নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়াত্তধীন হউক আর আল্লাহ চাচ্ছিলেন যে তিনি সত্যকে তার বাণী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সত্য প্রত্যাখানকারীদেরকে নির্মূল করেন।“
এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) আবু সুফিয়ান পরিচালিত কাফেলা এবং আবু জেহেলের নেতৃত্বে পরিচালিত মক্কার পৌত্তলিক নিরাপত্তা বাহিনীর আগমন সম্বন্ধে জানতেন। মুসলিম বাহিনী ও আনসারদের অংশগ্রহণেও শর্ত ছিল যে তারা মদিনা শহর আক্রান্ত হলে মুসলমানদের সাহায্য করবে, মদিনার বাইরে নয়। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাড়ায় যে মুসলিম বাহিনী মদিনার দক্ষিণে বদরের প্রান্তরে আবু জেহেলের বাহিনীর প্রায় মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আনসার ও মোহাজেরদের দ্বারা গঠিত মুসলিম বাহিনী যদি পিছু হটে যেত তা হলে তাদের জন্য তা হতো অপমানজনক ও কাপুরুষোচিত ব্যবহার। আবু জেহেলের বাহিনী অগ্রসর হলে হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর বাহিনীতে প্রভাব ফেলে মুজাহিদদের মধ্যে বিশ্বাস আনার চেষ্টা করেন এবং বলেন যে, কুরাইশদের ওপর অতর্কীত আক্রমণ দ্বারা তারা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন যদিও কুরাইশদের তুলনায় তাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক কম।
বদরের যুদ্ধ কোন তারিখে সংঘটিত হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না তবে ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, দ্বিতীয় হিজরীর ১৭, ১৯, ২১-এ রমজান অর্থাৎ ১৩, ১৫, ১৭ মার্চ, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে। আবু জেহেলের বদরে অভিযানের সংবাদ পাবার একদিন আগে রাত্রে হযরত মুহাম্মদ (স) বদরের আশেপাশে সমস্ত কূপগুলো দখল করে ফেলেন এবং মাত্র একটি ছাড়া অন্যান্য কুয়াগুলো বন্ধ করে দেন। যে কূপটি খোলা ছিল হযরত মুহাম্মদ (স) তার চারপাশে সৈন্য সমাবেশ করেন এবং এটি ছিল মক্কার নিকটবর্তী। এভাবে তিনি শত্রুপক্ষকে পানির সরবরাহ থেকে বঞ্চিত করে কৌশলগত অবস্থায় রইলেন। বিধর্মী কুরাইশদের ওপর অতর্কীত আক্রমণ পরিচালিত হয় নি। কিন্তু বদরের প্রান্তরে এসে আবু জেহেল পানি সঙ্কটে পড়েন এবং মুসলিম বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। যুদ্ধের বিশদ বিবরণ দিয়ে আরব ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, যুদ্ধের আগের রাতে কুরাইশদের ধারণা ছিল না হযরত মুহাম্মদ (স) কোথায় অবস্থান করছেন কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার দিন হঠাৎ তারা হযরত মুহাম্মদ (স) ও তাঁর বাহিনীকে তাদের কাছে একটি কূয়াকে ঘিরে থাকলে দেখলো। আরবদের যুদ্ধনীতি অনুযায়ী মূল যুদ্ধ শুরু হবার পূর্বে খণ্ড-যুদ্ধ, তীর ছোড়াছুড়ি এবং মল্ল যুদ্ধ হয়ে থাকে।[১] এর পর প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ কুরাইশদের বিপর্যয় ঘটে। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং তাদের পক্ষে প্রায় ৪৫ থেকে ৭০ জন যোদ্ধা নিহত হয়। নিহতদের তালিকায় ছিল আবু জেহেলসহ অনেক প্রবীন ও দক্ষ যোদ্ধা এবং বহুসংখ্যক বিধর্মী কুরাইশ বন্দী হয়। মুসলিম বিজয় নিশ্চিত হলে মুজাহিদগণ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (মাল-ই-গণিমত) সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (স) ঘোষণা করেন যে, যুদ্ধে নিহত কুরাইশদের রণক্ষেত্রে পরিত্যক্ত মাল-সামান এবং বন্দীদের মুক্তপনের অর্থ সকল যোদ্ধাদের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করা হবে। এর ফলে লুটতরাজ বন্ধ হয়।
[১. মহানবীর নির্দেশে আমীর হামজা আলী ও আবু উবাইদা কুরাইশদের পক্ষের নেতা উতবা শায়বা এবং ওয়ালিদ বিন উবার সাথে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।]
কুরাইশ যুদ্ধ বন্দীদের দুই-একজনকে দৃষ্টান্তমূলকভাবে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। বদরের যুদ্ধে বন্দী এবং পৌত্তলিককে হত্যা করা হয়, যা হযরত মুহাম্মদ (স) বন্ধ করেন। কারণ হত্যা করলে বন্দীর মুক্তিপণ হিসেবে অর্থ পাওয়া যাবে না। কিন্তু যে সমস্ত যুদ্ধ বন্দী নবীর স্বীয় গোত্রভুক্ত ছিল তাদের মুক্তিপণ ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ধরনের মহানুভবতা বিধর্মী কুরাইশদের মধ্যে মানসিক প্রভাব ফেলে এবং ধর্মান্তরীতে তাদের উদ্বুদ্ধকরে। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে বিধর্মী ওকবা বিন আবি মু’য়াতকে যে রসূলকে ব্যঙ্গ করে কবিতা রচনা করে, হত্যা করা হয়। অপর যে ব্যক্তিকে হত্যা করা হয় তার নাম আল নাদির বিন আল হারিস। সে দাবী করে যে পারস্য ভাষায় লিখিত তা গল্পগুচ্ছ পবিত্র কুরআনের সমতুল্য।
বিভিন্ন কারণে মুসলিম বিজয় সম্ভবপর হয়েছিল। এর একটি হচ্ছে যে কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে ঐক্য ছিল না। কুরাইশ যোদ্ধাদের সংখ্যা ৯৫০ বা ১০০০ হলেও যুদ্ধ শুরু হলে বহু যোদ্ধা রণক্ষেত্র ত্যাগ করে চলে যায়। যার ফলে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৬০০ অথবা ৭০০ তে। এদের মধ্যে অনেকেই আবু জেহেলের যুদ্ধ নীতি সমর্থন করেনি এবং রণক্ষেত্রে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেনি। উপরন্তু, সংখ্যায় অধিক থাকায় বিধর্মীদের মধ্যে আত্মগরিমা দেখা দেয়। অন্যদিকে স্বল্প সংখ্যক হলেও মুজাহিদদের মধ্যে ধর্মীয় প্রেরণার (জেহাদ) ফলে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ছিল। গাজী বা শহীদের যে প্রেরণা আল্লাহ ও রাসূল দিয়েছিলেন তাতেই মুসলিম বাহিনী উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। উপরন্তু, তাঁর সমরকৌশল যুদ্ধে জয়লাভের অন্যতম কারণ ছিল। কুরাইশদের তুলনায় আনসারগণ উত্তম যোদ্ধা ছিল একথা বলা যাবে না। তবে হযরতের নেতৃত্বে তারা যে একতাবদ্ধ ছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায়। ওয়ার্ট বলেন যে, মদিনার কৃষকগণ কোনক্রমেই মক্কার বণিক গোষ্ঠীর তুলনায় ভাল যোদ্ধা ছিল না। তবুও গায়েবী মদদে তাদের বিজয় হয়। কুরাইশদের মধ্যে যারা নিহত হন তারা ছিলেন বয়স্ক, ধনাঢ্য ও প্রতিভাবান ব্যক্তি।
৫. বদরের যুদ্ধের পর পরিস্থিতি
বদরের যুদ্ধে বীর সৈন্যদের মৃত্যু মক্কার জন্য ছিল এক মহাবিপর্যয়। আবু জেহেল (মাখজুম) ছাড়াও আবদ শামসের উকবা বিন আবি মুযাত, ওতবা বিন রা’বিয়া এবং শায়বান বিন রাবিয়া এবং নাওফল গোত্রের আল-হারিস বিন আমির এবং তুয়াইমা বিন আদি, আসাদ গোত্রের জা’মা বিন আল-আসওয়াদ, আবুল বাসতারী এবং নাওফেল বিন খোয়ায়লিদ; আবদ আদ-দার গোত্রের আন-নাদর বিন আল হারিস, সাহম গোত্রের মুনাববিহ বিন আল হাজ্জাজ এবং তার ভাই নুরাইয়, জুমা গোত্রের উমাইয়া বিন খালাফ। এ সমস্ত প্রবীন ও বয়স্ক যোদ্ধাদের মত অপর কেও পৌত্তলিক মক্কাবাসীদের মধ্যে রইল না। যেহেতু আবু সুফিয়ান কাফেলার নেতৃত্বে ছিলেন, সেহেতু তিনি রক্ষা পেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন। সুহাইল বিন আমর বন্দী হন কিন্তু মুক্তিপণ প্রদান করে ছাড়া পান। হাকিম বিন হিসাম এবং অপর কয়েকজন পৌত্তলিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। বিধর্মী কুরাইশদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুন যোদ্ধা ছিল কিন্তু রণক্ষেত্রে তাদের তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। যাহোক, কুরাইশদের পক্ষে বদরের যুদ্ধ ছিল মহাবিপর্যয়।
বদরের যুদ্ধে জয়লাভ করে মুসলিম উম্মা তাৎক্ষণিভাবে কোন সামরিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভ করেনি। হিজাজের আরবগণ উপলব্ধি করেন যে, এই যুদ্ধ মক্কার ওপর মদিনায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হযরত মুহাম্মদ (স) আরও কয়েকটি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হয় যার ফলে তার ধর্মীয় ও সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সুদৃঢ় হয় এবং আরব ভূখণ্ডের দূর-দূরাঞ্চল থেকে দলে দলে লোক ইসলামের ছায়াতলে আসতে থাকে। আবু জেহেল সহজেই উপলব্ধি করেন যে, নবগঠিত মুসলিম উম্মার কাছ থেকে পৌত্তলিক কুরাইশদের আরও প্রচণ্ড বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হবে। অবশ্য তিনি বুঝতে পারেন নি যে, স্বল্পসংখ্যক হয়েও মুসলিম বাহিনীর কাছে বিপুল সংখ্যক মক্কার পৌত্তলিক বাহিনী পয্যুদস্ত হবে। সামরিক সাফল্য ও রণনৈপুণ্য মুসলমানদের এমন এক অবস্থানে নিয়ে যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) শক্তিশালী মক্কার কনফেডারেসীকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হন।
মুসলিম বাহিনী ও পৌত্তলিক বাহিনী রণক্ষেত্র ত্যাগ করার সময় ভবিষ্যতে রণক্ষেত্রে মোকাবেলা করবে কিনা নিশ্চিত ছিল না। তবে বদরের যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। মক্কাবাসীদের পরাজয় নিছক দুর্ঘটনা ছিল না। মক্কাবাসী মনে করলো যে তাদের বিশাল সৈন্যবাহিনী দেখে হযরত মুহাম্মদ (স) ভবিষ্যতে সমরাভিযান করবেন না। মক্কাবাসীরা এর ফলে মাত্রাধিকভাবে আত্মবিশ্বাসী হলো। অর্থলিপ্সা ও কুরআনে বর্ণিত প্রাক-ইসলামী যুগের পাপাচার এমনভাবে তাদের গ্রাস করেছিল যে, তারা আত্মগরিমায় ভুগতে থাকে। অন্যদিকে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি না নিয়ে কুরাইশদের পরাজিত করে প্রমাণ করেন যে মুসলিম উম্মা সকলপ্রকার পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল। বদরের যুদ্ধে হযরত মুহাম্মদ (স) যখন দেখলেন যে, তিনি সংঘর্ষ এড়ানো যাবে না তখন তিনি আনসারদের ইসলামের রক্ষার জন্য সমরে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করেন। যদিও বদরের যুদ্ধ আকস্মিকভাবে হয়েছিল তবুও উভয় পক্ষের জন্য এর ফলাফল ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এতে প্রমাণিত হয় যে, সৈন্যসংখ্যার ওপর যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে না। অবশ্য ৯৫০ অথবা ১০০০ সৈন্য কুরাইশদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ৬০০ থেকে ৭০০ জন যুদ্ধ করে। তবুও সেক্ষেত্রে মুসলমানদের (৩১৩) তুলনায় বিধর্মীদের সৈন্য সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ। হযরত মুহাম্মদ (স) উপলব্ধি করেন যে, কুরাইশগণ পরাজিত হয়ে এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বিশাল বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে যে সৈন্য সংখ্যা বাড়াতে হবে তা নিশ্চিত।
মদিনায় যুদ্ধ জয়ের ফলে হযরত মুহাম্মদের (স) শক্তি সুসংহত হলো। পূর্বে যে সমস্ত অভিযান প্রেরিত হয় তা তেমন সাফল্য অর্জন করেনি। উল্লেখ্য যে, নবদীক্ষিত মুসলমানদের অনেকেই বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, যেমন প্রবীণ মুসলিম উসাইদ বিন হুদাইর। নবী যখন মদিনায় ফিরে আসলেন তখন তিনি তাঁর অজুহাত পেশ করেন। বস্তুত উসাইদ নবীর প্রতি আস্থাশীল ছিলেন না। বদরের যুদ্ধে নবী বুঝতে পারলেন যে, তাঁর উম্মতদের মধ্যে কারা নিষ্ঠাবান এবং তৌহিদে উদ্বুদ্ধ এবং কারা মৌখিকভাবে ইসলামকে সমর্থন দান করছে। বদরের যুদ্ধের পর যে দুজন পৌত্তলিক কবি রসুলের বিরুদ্ধে ব্যাঙ্গ করে কবিতা রচনা করে তাদের হত্যা করা হয়। তারা হচ্ছেন আসমা বিনতে মারওয়ান (উমাইয়া বিন যায়েদ) এবং আবু আফাক (বনু আমর বিন আউফ)। এ দুজন তাদের গোত্রের লোক দ্বারা নিহত হন এবং তাদের জন্য কোন রক্তপণ প্রদান করা হয় নি। একই সময়ে বনু কায়নুকা নামের এক ইহুদি গোত্রকে মুসলিম বাহিনী আক্রমণ করে। এই বিরোধের সূত্রপাত হয় একজন মুসলমানের হত্যাকে কেন্দ্র করে। এক পক্ষকাল অবরুদ্ধ থাকার পর বনু কায়নুকা আত্মসমর্পণ করলে তাদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়। এভাবে হযরত মুহাম্মদের (স) প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মোনাফেক আবদুল্লাহ বিন উবাই তার কনফেডারেটের ৭০০ জন সদস্যের সমর্থন হারান।
বদরের যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর নিকট সাহাবীদের প্রতি নব-দীক্ষিত মুসলমানদের আস্থা বৃদ্ধি ও বিশ্বাসের গভীরতা। মক্কায় বহু বছর নির্যাতন সহ্য করে এবং মদিনায় হিজরত করে অনিশ্চয়তার পর বদরের যুদ্ধের বিজয় ছিল মুসলমানদের জন্য এক অভাবনীয় সাফল্য। এর ফলে ধর্ম হিসেবে ইসলাম এক নবজীবন লাভ করে এবং পুনরুজ্জীবিত হয়। বিশাল সংখ্যক বিধর্মী কুরাইশদের সাথে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে নবীর বিজয়ের গায়েবী মদদ ছিল- এটি এক অলৌকিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। সূরা আনফালের (৮) ১৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে :
“তোমরা তাদেরকে বধ করনি, আল্লাহই তাদেরকে বধ করেছেন এবং তুমি যখন নিক্ষেপ করেছিলেন তখন তুমি নিক্ষেপ করনি, আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন এবং এটি বিশ্বাসীদের উত্তম পুরস্কার দান করবার জন্য, আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”
ওয়ার্ট বলেন যে, পৌত্তলিক মক্কাবাসীদের বিপর্যয়ের কথা মক্কায় অবতীর্ণ একটি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে : কিন্তু যে সূরা আনফালের (৮) উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে তা মদিনায় অবতীর্ণ হয়। এই সূরায় বিধর্মী কুরাইশদের ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। কুরআনের সূরা আন-আনবিয়া ( ) ৪১ ও ৪২ আয়াতে ফুরকান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। রিচার্ড বেল ‘ফুরকান’ শব্দটির ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, “ফুরকানে’র দিন তখন এসেছিল যখন দু’টি পরস্পরবিরোধী পার্টি বা দল পরস্পরের সংঘর্ষে অবতীর্ণ হল।” অন্য কথায় বদরের যুদ্ধ ‘ফুরকান’ শব্দটি সিরিয়াক শব্দ ‘পুরাকান’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে-এর অর্থ মহাপরীক্ষা থেকে মুক্তিলাভ-বিচারের থেকে পরিত্রাণ। হযরত মুসা যখন মিশরের ফেরাউন বাদশাহের অত্যাচার থেকে তার ইহুদী গোষ্ঠীকে মিশর থেকে প্যালেস্টাইনে নিয়ে আসেন তখন তাকেও ‘ফুরকান’ বা মুক্তি বলা হয়েছিল। বদরের যুদ্ধে আল্লাহর মদদে বিশাল পৌত্তলিক বাহিনী থেকে নবী করীমের জয়লাভও একটি মহাপরিত্রাণ। এই আলৌকিক ঘটনা হযরত মুহাম্মদের নবুয়তকে সুদৃঢ় করে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হযরত মুহাম্মদ (স) সূরা আল-আন আমর এ দু’টি আয়াত (৪১, ৪২) লাভ করেন।