রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ

প্রথম অধ্যায় – কাছাড়ের বিলুপ্ত রাজবংশ

প্রথম অধ্যায় – কাছাড়ের বিলুপ্ত রাজবংশ

ইহা বিশেষ রূপে প্রদর্শিত হইয়াছে যে, কাছাড়ের নির্বাণ প্রাপ্ত রাজবংশ ও ত্রিপুরার রাজবংশ এক মূল হইতে উদ্ভুত। রাজমালার মতে মহারাজ ত্রিলোচনের জ্যেষ্ঠপুত্র দৃকপতি উত্তরাধিকারিত্ব সূত্রে কাছাড়ের রাজদণ্ড ধারণ করেন। মতান্তরে— কামরূপের পূর্বাংশে ফা-বংশীয়গণ শাসনদণ্ড পরিচালনা করিতেছিলেন। পর্বতবাসী মানবগণ দ্বারা সেই রাজ্য বিনষ্ট হইয়াছিল। রাজ্যভ্রষ্ট নরপতির জ্যেষ্ঠপুত্র কাছাড় রাজ্যের স্থাপনকর্তা, সেই নরপতির কনিষ্ঠপুত্র ত্রিপুরা রাজবংশের আদি পিতা। সুতরাং ইহা সর্ববাদীসম্মত যে, কাছাড়ের নির্বাণ প্রাপ্ত রাজবংশ ও ত্রিপুররাজবংশ এক পিতার সন্তান। কিন্তু ঐতিহাসিত্ত্বানভিজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে যৎকালে কাছাড়রাজ।।২৫৩। বংশের এক সুদীর্ঘ বংশাবলী প্রস্তুত করেন; সেই সময়ে তাঁহারা তাঁহাদের কল্পনা অশ্বের বলগা উন্মোচন করিয়া পূর্ণচক্রের ঘোড়দৌড় করিয়াছেন। রাজমালা লেখক যযাতিপুত্র দ্রুহ্যু হইতে ত্রিপুরার বংশাবলী অঙ্কিত করিয়াছেন; আর কাছাড়ের ব্রাহ্মণগণ তৃতীয় পাণ্ডব ভীম ও হিড়িম্বা রাক্ষসীকে কাছাড় রাজবংশের আদি পিতা মাতা বলিয়া বৰ্ণনা করিয়াছেন। প্রাচীন ভৌগলিক তত্ত্বানভিজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ বারণাবতের নিকটবর্ত্তী[১] হিড়িম্বা রাক্ষসের বসতিস্থানকে বঙ্গদেশের পূর্বপ্রান্তে সংস্থাপন পূর্বক কাছাড়কে হিড়িম্ব রাজ্য অবধারণ করিয়াছেন। আমরা তাঁহাদের একপ্রকার বর্ণনা সমূহকে নিতান্তই কবিকল্পনা বলিয়া মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করিতে পারি।

আধুনিক নাগাপর্বত জেলার মধ্যে কাছাড় রাজবংশের দুইটি প্রাচীন রাজধানী প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, যথা— দিমাপুর ও মাইবাং। দিমাপুর নগরীর প্রাচীন অট্টালিকা সমূহের ভগ্নাবশেষ দর্শন করিলে নিতান্ত বিস্মিত হইতে হয়। পার্বত্য মানুষদিগের উৎপীড়নে ইঁহারা সেই সকল প্রাচীন রাজধানী ॥২৫৪॥ পরিত্যাগ পূর্বক দক্ষিণদিকে অগ্রসর হইতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

কাছাড়পতিগণের মাইবাং অবস্থানকালে একটি নিতান্ত ঘৃণাজনক কার্য্যদ্বারা কাছাড় ও জয়ন্তীয়া রাজবংশমধ্যে একটী লোমহর্ষণ কলহ উপস্থিত হইয়াছিল। জয়ন্তীয়াপতির ভ্রাতা স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্রীর কলুষিত প্রণয়ে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে লইয়া পলায়ন করেন। সেই পাপিষ্ঠ ও পাপীয়সীর আশ্রয়দাতা বলিয়া জয়ন্তীয়া রাজ কাছাড়পতির প্রতিকুলে অস্ত্রধারণ করেন। সংগ্রাম উপস্থিত হইলে জয়ন্তীয়াপতির ভ্রাতা স্বীয় প্রণয়িণী ও সহচরবর্গের সহিত দুরাক্রম্য পার্বত্য প্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। প্রবাদ অনুসারে জয়ন্তীয়াপতির ভ্রাতা ও তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রী অঙ্গমী নাগাসরদারগণের আদি পিতামাতা। তাঁহাদের অনুচরবর্গ ও অন্যান্য নাগাজাতির সংযোগে পরাক্রমশালী অঙ্গমী নাগাদিগের উৎপত্তি। প্রবল সংগ্রামে কাছাড়পতি পরাজিত হন। জয়ন্তীয়ারাজ দ্বারা মাইবাং নগরী বিনষ্ট হয়। কাছাড়পতি বর্তমান কাছাড় প্রদেশে উপনীত হইয়া কশপুরে রাজপাট স্থাপন করেন।

যদিচ আমরা কাছাড় রাজবংশের বংশাবলীর সত্যতা সম্পূর্ণভাবে এস্থানে স্বীকার করিতে পারি না, তথাপি এস্থানে সেই বংশাবলী প্রকাশ করিলাম। কারণ বংশাবলী প্রণেতাগণ কয়েকজন বিখ্যাত নরপতির নাম বংশাবলীমধ্যে সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন।২৫৫ প্রকৃতপক্ষে সেই সকল নাম বিশুদ্ধভাবে ধারাবাহিকরূপে লিখিত হয় নাই।

বংশাবলী

১ ভীম (পাণ্ডুপুত্র)

২ ঘটোৎকচ

৩ মেঘবর্ণ

৪ মেঘবল

৫ তাম্রধ্বজ

৬ কেতুধ্বজ

৭ বিশ্বকীর্তিধ্বজ

৮ বিশ্রবানধ্বজ

৯ তালধ্বজ

১০ বেতালধ্বজ

১১ বিশ্বাসনধ্বজ

১২ উন্মত্তধ্বজ

এই নরপতি ১৩৮৮ সংবতে জীবিত ছিলেন, এরূপ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। [২]

১৩ কুলিশধ্বজ

১৪ রুদ্রধ্বজ

১৫ কৌন্তিল্যধ্বজ

১৬ শত্রুজিতধ্বজ

১৭ বরিরুদ্রধ্বজ

১৮ ভাস্করধ্বজ

১৯ প্রভাকরধ্বজ

২০ বিষ্ণুধ্বজ

২১ হিরণ্যধ্বজ

২২ ভদ্রসেনধ্বজ

২৩ শুল্ক ধ্বজ

২৪ ঈশালধ্বজ

২৫ গুণকীৰ্ত্তিধ্বজ

২৬ পিঙ্গলধ্বজ

২৭ উপেন্দ্ৰধ্বজ

২৮ নলধ্বজত

২৯ পদ্মধ্বজ

৩০ পিকধ্বজ

৩১ বৃষধ্বজ

৩২ গুণধ্বজ

৩৩ শূরসেনধ্বজ

৩৪ রিপুদ্রবধ্বজ

৩৫ বলভদ্রধ্বজ

৩৬ চন্দ্রশেখর ধ্বজ

৩৭ মুকুটধ্বজ

৩৮ স্কন্দধ্বজ

৩৯দ্বিজেশধ্বজ

৪০ গণেন্দ্রধ্বজ (২৫৭)

৪১ মহেশ্বরধ্বজ

৪২ ভানুধ্বজ

৪৩ মহাকালধ্বজ

৪৪ কমলধ্বজ

৪৫ জ্ঞানধীরধ্বজ

৪৬ ভূপেন্দ্রধ্বজ

৪৭ ভানুধ্বজ

৪৮ ইন্দুধ্বজ

৪৯ অর্কধ্বজ

৫০ প্রতাপ নারায়ণ

৫১ রুদ্র নারায়ণ

৫২ বলবন্ত নারায়ণ

৫৩ নির্ভয় নারায়ণ

ইনি একজন বিখ্যাত নরপতি। প্রবাদ অনুসারে তিনি কুলদেবতা রণচণ্ডী হইতে এক তরবারি লাভ করিয়াছিলেন।[৪]

৫৪ উদয় নারায়ণ

৫৫ বীরনারায়ণ

৫৬ মদন নারায়ণ

৫৭ চিত্রধ্বজ

৫৮ বিন্দুধ্বজ

৫৯ কেতুধ্বজ

৬০ শঙ্খধ্বজ

৬১ ললিতধ্বজ

৬২ সিংহধ্বজ

৬৩ হেমধ্বজ

৬৪ শিকণ্ডীচন্দ্ৰ

৬৫ কুমুদচন্দ্ৰ

৬৬ প্রচুতরচন্দ্র

৬৭ উদিতচন্দ্ৰ

৬৮ প্রভাকরচন্দ্র

৬৯ কর্পূরচন্দ্র

৭০ গিরীচন্দ্র

৭১ ধীরচন্দ্র

৭২ শূরজীতচন্দ্র

৭৩ শত্রুজীতচন্দ্ৰ

৭৪ বালপ্রতাপ

৭৫ প্রকাশচন্দ্র

৭৬ বিক্ৰমচন্দ্ৰ

৭৭ আদীত্যচন্দ্ৰ ॥২৫৯॥

৭৮ বীরচন্দ্র

৭৯ পুণ্ডরীকাক্ষ

৮০ ভূপালধ্বজ

৮১ প্রবলচন্দ্র

৮২ পুরন্দরচন্দ্র

৮৩ ত্রিলোচন চন্দ্ৰ

৮৪ দীপ্তচন্দ্ৰ

৮৫ কাৰ্ত্তিকেয়চন্দ্ৰ

৮৬ নীলচন্দ্ৰ

৮৭ মকরধ্বজ

৮৮ নরকূলচন্দ্র

৮৯ নবচন্দ্র

৯০ কিশোরচন্দ্র

৯১ মনচন্দ্র

৯২ বীরদর্পচন্দ্র

৯৩ নিৰ্ভয়চন্দ্ৰ

৯৪ মেঘবলচন্দ্র

৯৫ বাহুবলচন্দ্র

৯৬ সুরেন্দ্রচন্দ্রধ্বজ

৯৭ শিখিধ্বজ

৯৮ উদয়াদিত্যচন্দ্র

৯৯ ময়ূরধ্বচন্দ্র

১০০ গরুড়ধ্বজ

১০১ মকরধ্বজ[৫]

১০২ তাম্রধ্বজচন্দ্ৰ॥[৬] ॥২৬০॥

১০৩ শূরদর্প নারায়ণ

ইনি আসাম পতির সাহায্যে জয়ন্তীয়া বিনষ্ঠ করিতে স্থির প্রতিজ্ঞ হইয়াছিলেন। কিন্তু অকাল মৃত্যু দ্বারা তাঁহার সমস্ত উদ্যোগ বিফল হইয়াছিল।

১০৪ ধর্মধ্বজচন্দ্র

১০৫ কীৰ্ত্তিচন্দ্ৰ

১০৬ রামচন্দ্র

ইহার শাসনকালে ত্রিপুরাপতি কাছাড় জয় করিয়াছিলেন।

১০৭ হরিচন্দ্র + ১০৮ লক্ষ্মীচন্দ্ৰ } ভ্রাতা!

১০৯ কৃষ্ণচন্দ্ৰ

১১০ গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণ॥২৬১॥

রাজা হরিশ্চন্দ্র নারায়ণের দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণচন্দ্র, কনিষ্ঠ গোবিন্দ্রচন্দ্র। পিতৃব্যের মৃত্যুর পর কৃষ্ণচন্দ্র ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরোহণ করেন। ইনি ৪০ বৎসর রাজ্যশাসন করিয়াছিলেন। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইরানবাসী জনৈক মোগল কতগুলি দুষ্ট লোক সংগ্রহ করত কাছাড় রাজ্য অধিকারের চেষ্টা করিয়াছিলেন। এ ব্যক্তি কশপুর নগর অধিকার করিলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোয়াবাড়ী নামক স্থানে পলায়ন করেন। বিজয়োন্মত্ত মোগল কাণ্ডজ্ঞানহীন হইয়া বদরপুরস্থিত কোম্পানির গারদ আক্রমণ করিলেন। শ্রীহট্টের ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ এই সংবাদ শ্রবণমাত্র কল্যাণ সিংহ সুবেদারকে একদল সৈন্যের সহিত সেই মোগলের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিলেন। সুবেদার কল্যাণ সিংহ তাঁহাক পরাজিত ও বন্দিকৃত করিয়াছিলেন।২৬২

কিছুকাল অন্তে সুবেদার কল্যাণ সিংহ কোম্পানির কার্য্য পরিত্যাগ পূর্বক কতগুলি পদচ্যুতি ও পেনসন প্রাপ্ত সিপাই সংগ্রহ করিয়া হাইলাকান্দী নামক স্থানে একটি নূতন রাজ্য স্থাপন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই সংবাদ শ্রীহট্টের মেজেস্ট্রেটকে জানাইলেন। মেজেস্ট্রেট সাহেব তাঁহার বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। কোম্পানির সৈন্যের আগমন বার্তা শ্রবণে সুবেদার কল্যাণ সিংহ পলায়ন করিলেন। কল্যাণ সিংহ জয়ন্তীয়া রাজ্যে উপনীত হইলে তথাকার অধিপতি তাহাকে আবদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু রজনীযোগে কারাগার হইতে পলায়ণ পূর্বক বিবিধ স্থান ভ্রমণ করত কল্যাণ সিংহ অবশেষে কুমিল্লা নগরে উপস্থিত হন, তথায় তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল।

১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে মণিপুরপতি মধুচন্দ্র স্বীয় অনুজ চৌরজিত ও মারজিত দ্বারা রাজ্যচ্যুত হইয়া কাছাড়পতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পঞ্চশত সৈন্য দ্বারা মধুচন্দ্রকে সাহায্য করিয়াছিলেন। কিন্তু সংগ্রামক্ষেত্রে মধুচন্দ্র হত হইলেন। কিয়ৎকালান্তে মারজিত কাছাড়পতির আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। তাঁহার একটি মনোহর অশ্ব ছিল। কাছাড়পতির ভ্রাতা গোবিন্দচন্দ্র তাহা বিক্রয় করিবার প্রস্তাব করিলেন। মারজিত অশ্ব বিক্রয় করিতে সম্মত হইলেন না, গোবিন্দচন্দ্র তাহা বলক্রমে গ্রহণ করিয়াছিলেন।২৬৩

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র পরলোকগমন করেন, তাঁহার কোনও পুত্রসন্তান ছিল না, এজন্য কনিষ্ঠ ভ্রাতা গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণ সিংহাসন আরোহণ করিয়াছিলেন।

রাজা গোবিন্দ্রচন্দ্র নারায়ণ মণিপুরের রাজকুমার গম্ভীর সিংহকে প্রধান সেনাপতির পদে নিযুক্ত করেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে মণিপুরপতি রাজা মারজিত কাছাড় আক্রমণ করেন। সেনাপতি গম্ভীর সিংহ বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক ভ্রাতৃপক্ষ অবলম্বন করেন। রাজা গোবিন্দচন্দ্র প্রাণভয়ে রাজ্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক শ্রীহট্টে পলায়ণ করিলেন। তিনি গবর্ণমেণ্ট সমীপে সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। তৎকালে গবর্ণমেন্ট তাঁহার বাক্যে কর্ণপাত করেন নাই কিন্তু ব্রহ্মযুদ্ধের সূচনা দর্শনে গবর্ণমেন্ট রাজা গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণকে কাছাড়ের সিংহাসনে সংস্থাপন করিতে মনস্থ করিলেন। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ৫ই মার্চ গবর্ণর জেনারেল বাহাদুর ব্রহ্মযুদ্ধ ঘোষণা করেন। উক্ত ঘোষণাপত্রে লিখিত আছে যে, “কাছাড় নামক ক্ষুদ্ৰ রাজ্যটি ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের আশ্রিত, ব্রহ্মসৈন্য এই রাজ্য মধ্যে প্রবেশ করিয়া, ব্রহ্মরাজের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিবার জন্য গবর্ণমেন্টকে বাধ্য করিয়াছিলেন।” কলিকাতার রাজপ্রাসাদে বসিয়া যে দিবস লর্ড আর্মহার্ষ্ট উল্লিখিত ঘোষণা পত্র প্রচার করেন, তৎপর দিবস অর্থাৎ ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ই মার্চ গবর্ণর জেনারেলের এজেন্ট স্কট সাহেব বদরপুরে।২৬৪॥ বসিয়া কাছাড়পতি গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণের সহিত সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করিয়াছিলেন। এই সন্ধি পত্রদ্বারা গোবিন্দচন্দ্র স্বয়ং ও স্বীয় উত্তরাধিকারিগণের জন্য কোম্পানির আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বহিঃশত্রু হইতে চিরকাল কাছাড় রাজ্য রক্ষা করিতে প্রতিশ্রুতি হন। উক্ত সন্ধিপত্রের চতুর্থ প্রকরণের মর্মানুসারে কাছাড়পতি কোম্পানিতে বার্ষিক দশ সহস্র টাকা কর প্রদানে সম্মত হইয়াছিলেন।

ব্রহ্মযুদ্ধের অবসানে রাজা গোবিন্দচন্দ্র নির্বিবাদে কাছাড় রাজ্য শাসন করিতেছিলেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কতকগুলি মণিপুরী (সম্ভবত মারজিতের অনুচর) একদা রজনীযোগে রাজপ্রাসাদে তস্করের ন্যায় প্রবেশ পূর্বক রাজা গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণের উপাংশুহত্যা সম্পাদন করে। তাঁহার পুত্রসন্তান ছিল না, এজন্য গবর্ণমেন্ট কাছাড় রাজ্য অধিকার করেন। কিন্তু তৎকালে বর্তমান কাছাড় জেলার তৃতীয়াংশ মাত্র গবর্ণমেন্ট প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। উত্তর কাছাড় সেই সময় তুলারাম সেনাপতির অধীন ছিল। তুলারামের পিতা কাঁচাদিন কাছাড়পতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নারায়ণের মৃত্যুর পর স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করেন। রাজা গোবিন্দ্রচন্দ্র নারায়ণ কৌশলক্রমে বিদ্রোহী শাসন কর্তাকে সমতল ক্ষেত্রে আনয়ন পূর্বক তাঁহার॥২৬৫॥ শিরচ্ছেদ করিলেন। তুলারাম স্বীয় পিতা হত্যাকাণ্ড দর্শনে গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণের দারুণ শত্রু হইয়া দাঁড়াইলেন এবং পর্বতবাসী নাগা কুকিদিগের সহিত দলবদ্ধ হইয়া তাঁহাকে জ্বালাতন করিতে লাগিলেন। পঞ্চদশ বৎসর ব্যাপী কলহের পর ১৭৫১ শকান্দে (১৮২৯ খ্রিঃ অঃ) রাজা গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণ তুলারামকে ২২২৪ বর্গ মাইল ভূমির জায়গীরদার বলিয়া স্বীকার করেন। তুলারামের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্রদ্বয় নকুলরাম ও ব্রজনাথ প্রায় দশ বৎসর পৈত্রিক রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন। ১৭৭৬ শকাব্দে (১৮৫৩ খ্রিঃ অঃ) নকুলরাম দিশোমানাগাদের প্রতিকূলে অস্ত্রধারণ করিয়া নিহত হন। এই সামান্য অপরাধে গবর্ণমেন্ট তুলারামের বংশধরদিগকে কিঞ্চিৎ বৃত্তি ও নিস্কর ভূমি প্রদান পূর্বক তুলারামের রাজ্যটী গ্রাস করিয়াছিলেন। অধুনা কাছাড় জেলার পরিমাণ ৪২০০ বর্গমাইল।

.

টীকা

১. বর্তমান বদাওনের পশ্চিমদিকে বারাণাবত নগরী অবস্থিত ছিল। হিড়িম্বার বন আধুনিক উত্তর পশ্চিম প্রদেশের অন্তর্গত।

২. Fisher’s History of the Chchar Raj – Family.

৩. নলধরজ নরপতি মণিপুর জয় করিয়াছিলেন। মণিপুরপতি ক্ষমা প্রার্থনা করিলে, তিনি তাহাকে নিম্নলিখিত শর্তে মণিপুরের রাজদণ্ড প্রদান করিয়াছিলেন। (ক) মহারাজ নলধ্বজ স্বীয় বিজয় বৃত্তান্ত চিরস্মরণীয় করিবার জন্য বংশ দ্বারা যে বিজয়স্তম্ভ মণিপুর নগরে স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা চিরকাল রক্ষা করিতে হইবে। (খ) মণিপুরী দিগকে ব্রহ্মাদিগের ন্যায় অৰ্দ্ধমস্ত কমুণ্ডন ও কেশবন্ধন করিতে হইবে। (গ) দ্বাদশ হস্তের উচ্চ কোনও গৃহ মণিপুরীগণ নির্মাণ করিতে পারিবে না।

৪. একদা স্বপ্নে নির্ভর নারায়ণ শুনিলেন, যেন জগজ্জননী বলিলেন, “বৎস! কল্যনদীতে যাইয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও।” পরদিন রাজা একাকী নদীতীরে উপস্থিত হইয়া দর্শন করিলেন; একটী বিষধর জলকেলী করিতেছে। নির্ভরনারায়ণ সর্পকে রণচণ্ডী জ্ঞানে তাঁহার লাঙ্গুলে হস্তার্পণ করিলেন; তৎক্ষণাৎ একখানি তরবারী রাজার হস্তে উঠিল। নরপতি সেই তরবারী লইয়া গৃহে গমন করিলেন। সেই দিবস রজনী যোগে দেবী পুনর্বার নির্ভর নারায়ণকে বলিলেন “বৎস! সর্পের লাঙ্গুলে ধরিয়া অন্যায় করিয়াছ, যাহা হউক এই তরবারী যত্নের সহিত রক্ষা করিও, ইহার কৃপায় তোমার বংশধরগণ নির্বিগ্নে কাছাড় রাজ্য উপভোগ করিবে।” কাছাড়পতিগণ ভক্তির সহিত সর্বদা এই তরবারীকে “রণচণ্ডী” জ্ঞানে পূজা করিতেন। প্রবাদ আছে, যে দিবস গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণের হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হয়, সেই দিবসেও ওই তরবারী রাজপ্রসাদ হইতে অপসৃত হইয়াছিল। বাঙ্গালায় “রণচণ্ডী” নামে ে ঐতিহাসিক উপন্যাস প্রকাশিত হইয়াছে তাহার সহিত কাছাড়ের ঐতিহাসিক তথ্যের কোনও সংশ্রব নাই। গ্রন্থকার অকৃতজ্ঞভাবে, স্কটের “আন অফ গার্টেন” (?) বাঙ্গালায় অনুবাদ করিয়াছেন।

৫. মণিপুপতি ব্রহ্মসৈন্য দ্বারা রাজ্যচ্যুত হইয়া কাছাড়পতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। মহারাজ মকরধ্বজ স্বীয় সৈন্য দ্বারা ব্রহ্মসৈন্য দূরীকৃত করিয়া মণিপুরপতিকে পুনর্বার সিংহাসনে স্থাপন করেন।

৬. মহারাজ তাম্রধ্বজ জয়ন্তীয়াপতির সহিত প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, জয়ন্তীয়া-রাজ একখানি উৎকৃষ্ট ও বৃহৎ নৌকা প্রস্তুত পূর্বক তদারোহণে কশপুরে গমন করেন। তিনি মহরাজ তাম্রধ্বজকে বলিলেন, বন্ধো! আমি এই নৌকা আপনার জন্য প্রস্তুত করাইয়াছি, আসুন আমরা উভয়ে একবার ইহাতে আরোহণ করি। সরলচিত্ত তাম্রধ্বজ সেই নৌকায় আরোহণ করিলে কপটমিত্র জয়ন্তীয়াপতি তাঁহাকে বন্ধন করিয়া বড় বক্রের প্রবল স্রোতে নৌকা ছাড়িয়া দিলেন। কাছাড়পতির সৈন্যগণ আশ্চর্য দর্শনে ধনুর্বাণ হস্তে দণ্ডায়মান হইল। তাম্রধ্বজ হস্তচালন দ্বারা তাহাদিগকে নিষেধ করিলেন। জয়ন্তীয়ারাজের বিশ্বাসঘাতকতা ও সমস্ত অবস্থা বর্ণনাপূর্বক আসামের অধিপতি স্বর্গ দেবের (আহুম বংশীয় আসাম পতিগণ ইন্দ্ৰ বংশজ বলিয়া সকলেই “স্বৰ্গদেব” উপাধি ধারণ করিতেন) নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। স্বর্গদেব দুইজন সেনাপতিকে দুইদল সৈন্যের সহিত জয়ন্তীয়ানগরে প্রেরণ করেন। তাঁহারা জয়ন্তীয়াপতিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও কাছাড়পতিকে মুক্ত করিয়া উভয়কে লইয়া প্রাগজ্যোতিষ্পুরে গমন করিলেন। স্বর্গদেব নানা প্রকার খেলাৎ প্ৰদান পূর্বক কাছাড়পতিকে স্বরাজ্যে প্রেরণ করেন এবং জয়ন্তীয়াপতির প্রাণদণ্ড করিয়াছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *