প্রথম অধ্যায় – আবুল আব্বাস [৭৫০-৭৫৪ খ্রি.] ও আল-মনসুর [৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.]
আবুল আব্বাস [৭৫০-৭৫৪ খ্রি.]
সিংহাসনারোহণ : জাবের যুদ্ধে উমাইয়াদের পতন ইসলামের ইতিহাসে আব্বাসীয় খিলাফতের উত্থান সূচনা করে এবং এর নায়ক ছিলেন আবুল আব্বাস আস্- সাফ্ফা (রক্তপিপাসু)। আবুল আব্বাস আল-হাশেমিয়ায় রাজধানী স্থানান্তরিত করে উমাইয়াদের সুপরিকল্পিতভাবে নিধনযজ্ঞের আয়োজন করেন। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি আবু ফুট্রস নামক স্থানে ৮০ জন উমাইয়া বংশের লোককে নির্মমভাবে হত্যা করেন। মুয়াবিয়া এবং দ্বিতীয় ওমর ব্যতীত প্রায় সকল উমাইয়া খলিফার সমাধিগুলো বধ্বিস্ত করা হয় এবং শবদেহ অগ্নিদগ্ধ অথবা বিনষ্ট করা হয়।
বিদ্রোহ দমন : খলিফা আবুল আব্বাসের সিংহাসনে আরোহণের পর সিরিয়া এবং মেসোপটেমিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দিলে খলিফার চাচা আবদুল্লাহ্ একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহীদের নির্মূল করেন। খলিফার ভ্রাতা আবু জাফরও এই বিদ্রোহ দমনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ওয়াসিতের উমাইয়া শানসকর্তা ইয়াজিদ-ইবন-হোবায়রা হযরত আলী (রা)-এর জনৈক বংশধর আবদুল্লাহ ইবন-হাসানকে খলিফা ঘোষণা করে বিদ্রোহী হলে আবু জাফর এবং হাসান-বিন-কাহতাবকে প্রেরণ করা হয়। যুদ্ধে ইয়াজিদ ও তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রসহ অসংখ্য অনুচর নিহত হন।
প্রশাসন : প্রশাসনিক কাঠামো দৃঢ়তর করবার জন্য আবুল আব্বাস স্বীয় ভ্রাতা এবং ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আবু জাফরকে ইরাক, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ায়, পিতৃব্য দাউদ-ইবন-আলীকে সিরিয়ায়, সুলায়মান-ইবন-আলীকে বসরায়, আবু মুসলিমকে খোরাসানে এবং আবু আয়ুনকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এছাড়া খালিদ-বিন- বার্মাকদের অর্থসচিব এবং আবু সালমাকে উজীরের পদে নিযুক্ত করা হয়।
চরিত্র : প্রায় সাড়ে চার বছর রাজত্ব করে আবুল আব্বাস আল-সাফা ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবার পূর্বে তাঁর ভ্রাতা আবু জাফরকে উত্তরাধিকারী এবং তাঁর ভ্রাতৃষ্পুত্র ঈশাকে পরবর্তী ভাবী উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। রক্তলোলুপতা এবং নৃশংসাতার জন্য আবুল আব্বাসকে আস-সাফ্ফা (রক্তপিপাসু) উপাধি প্রদান করা হয়। লেইনপুল বলেন, “তিনি শুধু পাষণ্ডই ছিলেন না, বরং মিথ্যা শাপথকারী এবং কৃতঘ্ন ও বিশ্বাসঘাতকও ছিলেন।” রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং আব্বাসীয় খিলাফতের স্থায়ীত্বের জন্য তিনি কঠোর নীতি অবলম্বন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সংযমী, দূরদর্শী, বিচক্ষণ এবং কর্তব্যনিষ্ঠ। উম্মে সালমা নামে তাঁর একমাত্র পত্নী ছিলেন। জনহিতকর কার্যের জন্য তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। হিট্টি যথার্থই বলেন, “আস-সাফা ইসলামের সর্বাপেক্ষা গৌরবোজ্জ্বল এবং দীর্ঘতম রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন।”
আবু জাফর আল-মনসুর [৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.]
সিংহাসনারোহণ : আবু আব্বাস আস-সাফ্ফার মৃত্যুর সময় তাঁর ভ্রাতা আবু জাফর হজ্ব উপলক্ষে মক্কায় ছিলেন। আবুল আব্বাসের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ঈশা আবু জাফরকে কুফার পরবর্তী খলিফা বলে ঘোষণা করলেন। ভ্রাতার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আবু জাফর দ্রুত কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং ‘আল-মনসুর’ অর্থাৎ ‘বিজয়ী’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর খিলাফতের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল : (ক) বিদ্রোহ দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং রাজ্যকে সুসংহত করা, (খ) রাজ্য বিস্তার দ্বারা আব্বাসীয় প্রভৃত্ব সুদূরপ্রসারী করা এবং (গ) প্রশাসনিক সংগঠন দ্বারা রাজ্যের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা।
বিদ্রোহ দমন : আব্বাসীয় খিলাফতে আল-মনসুরের শাসনকাল নিঃসন্দেহে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি, সাংগঠনিক কার্যকলাপ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তাঁকে আব্বাসীয় বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। বিদ্রোহ দমন করে নব-প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খিলাফতকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব।
আবদুল্লাহ-ইবন-আলীর বিদ্রোহ : আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবদুল্লাহ-ইবন- আলীর যথেষ্ট অবদান ছিল। আবুল-আব্বাস প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন যে, জাবের যুদ্ধে আবদুল্লাহ উমাইয়া বংশের ধ্বংস সাধন করতে পারলে তিনি তাঁকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করবেন। আবুল আব্বাস অঙ্গীকার ভঙ্গ করে তাঁর ভ্রাতা আবু জাফর ও ভ্রাতুষ্পুত্র ঈশাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করলে এবং আবু জাফর ক্ষমতালাভ করলে আবদুল্লাহ সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আল-মনসুর পিতৃব্যের বিদ্রোহ দমনের জন্য আবু মুসলিমকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। আবদুল্লাহ ১৭,০০০ সুশিক্ষিত সৈন্য নিয়ে নাসিরিন নামক প্রান্তরে আবু মুসলিমের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে সংঘটিত এই যুদ্ধে আবদুল্লাহ পরাজিত হয়ে ভ্রাতা সুলায়মানের নিকট বসরায় আত্মগোপন করেন। সুলায়মানের পদচ্যুতির পর আল-মনসুর আবদুল্লাহকে এবং তাঁর দুই জ্যেষ্ঠ পুত্রকে হাশেমীয়ার অদূরে একটি দুর্গে বন্দী করে রাখেন। সাত বছর কারারুদ্ধ থাকার পর চতুর্দিকে পানি বেষ্টিত লবণের উপর ভিত্তি করে নির্মিত প্রাসাদটি প্রবল বারিপাতে ধসে পড়লে হতভাগ্য আবদুল্লাহ নিহত হন। শঠতা এবং কৌশল অবলম্বন করে এভাবে আল- মনসুর তাঁর পিতৃব্যকে হত্যা করে সিংহাসন কণ্টকমুক্ত করেন।
আবু মুসলিমের পতন ও হত্যা : আব্বাসীয় প্রচারণার উদ্যোক্তা এবং রাজবংশ স্থাপনের অন্যতম কর্ণধার আবু মুসলিমের পতন এবং হত্যা একটি বিষাদপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে। নাসিবিনের যুদ্ধে আবদুল্লাহকে পরাজিত করে তিনি স্বীয় প্রদেশ খোরাসানে শাসনকার্য পরিচালনা করতে চাইলে আল-মনসুর আপত্তি জানান। তাঁকে সিরিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হলে আবু মুসলিম তা প্রত্যাখ্যান করে অবাধ্যতা এবং ঔদ্ধত্যের পরিচয় দেন। উপরন্তু, নাসিবিন যুদ্ধের লুণ্ঠিত দ্রব্যের তালিকা প্রস্তুতের ব্যাপারে তিনি খলিফার প্রতি যে উক্তি করেন তা অশোভন এবং দাম্ভিকতাপূর্ণ ছিল। আবু মুসলিম আব্বাসীয় বংশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তিতে বিচলিত হয়ে খলিফা তাঁকে অপসারণের পরিকল্পনা করতে থাকেন। খলিফার অভিসন্ধি বুঝতে পেরে আবু মুসলিম খোরাসানে চলে যান এবং প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে তাঁর সাথে সুবিধা করতে পারবেন না বুঝতে পেরে খলিফা বহু প্রলোভন এবং প্রতারণাপূর্ণ মধুর বাক্যে তাঁকে রাজদরবারে আহ্বান জানান। অতঃপর আবু মুসলিম দরবারে আগমন করলে কিছুদিন পরে তাকে গুপ্তঘাতকের দ্বারা হত্যা করা হয় (৭৫৫ খ্রি.)।
এটি খুবই পরিতাপের বিষয় যে, যার অসাধারণ প্রচারণা, দক্ষতা, রণনৈপুণ্য এবং সাংগঠনিক ক্ষমতায় আব্বাসীয় বংশের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত, তাঁকেই নিমর্মভাবে হত্যা করা হয়। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে আবু মুসলিম বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং বিচক্ষণতার দ্বারা ইসলামের ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করেন। কথিত আছে যে, তিনি আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় ছয় লক্ষ উমাইয়ার প্রাণনাশ করেন। খলিফার পিতৃব্য আবদুল্লাহ অসাধারণ রণনৈপুণ্য ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দ্বারা আব্বাসীয় খিলাফতের ভিত্তি স্থাপন করেন; কিন্তু তাঁকেও আল-মনসুরের ঈর্ষাপরায়ণতা এবং বিশ্বাসঘাকততার বলী হতে হয়েছিল। মূইর বলেন, “তিনি (আবু মুসলিম) মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা এবং রণনৈপুন্য দ্বারা ইসলামের ধ্যান-ধারণার অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধন করেন এবং উমাইয়া বংশের ধ্বংসস্তূপের উপর আব্বাসীয় বংশ প্রতিষ্ঠিত করেন।” আল- মনসুরের শঠতাপূর্ণ কার্যকলাপের একমাত্র যুক্তি ছিল আব্বাসীয় বংশকে কণ্টকহীন করা।
সানবাদের বিদ্রোহ দমন : আবু মুসলিমের অপ্রত্যাশিত ও বর্বরোচিত হত্যার প্রতিবাদে খোরাসান এবং পারস্যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বিক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত পারসিকগণ হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে জনৈক সানবাদের নেতৃত্বে একটি বিরাট বাহিনী গঠন করেন। মাজুসী (Magian) সম্প্রদায়ের নেতা সানবাদ রায় (Ray) হতে নিশাপুর পর্যন্ত সমগ্র ভূভাগে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। রাজকীয় বাহিনীর ক্ষিপ্রতা এবং যুদ্ধ-কৌশলে খলিফা বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন এবং রণক্ষেত্রে সানবাদ নিহত হন। আবু মুসলিম বিদ্রোহ ঘোষণা করে খোরাসান ত্যাগের পূর্বে শাসনভার আবু নাসের নামে একজন বিশ্বস্ত অনুচরের উপর ন্যস্ত করেন। কিন্তু প্রভুর মৃত্যুর পর আবু নাসের খলিফা আল-মানসুরের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এভাবে সুদূর খোরাসানে আব্বাসীয় প্রভুত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়কে দমন : ৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মনসুর হজ্ব সম্পন্ন করে জেরুজালেম আগমন করেন। সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার মধ্য দিয়া রাওয়ান্দিয়ায় প্রত্যাবর্তনকালে তাঁকে একটি বিপজ্জনক পরস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। রাওয়ান্দিয়া নামে এক পারসিক সম্প্রদায় আল-মনসুরকে আল্লাহর অবতার (Incarnation of Allah) বলে ঘোষণা করে। রাজপ্রাসাদের চতুর্দিকে সমবেত হয়ে তারা উচ্চস্বরে বলতে থাকে, “এটিই আমদের প্রভুর ঘর-যিনি আমাদিগকে উপজীবিকা প্রদান করে প্রতিপালন করেন।” তারা খাদ্য ও পানীয় প্রদানকারী স্রষ্টা বলে আল-মনসুরকে অভিহিত করে এবং তাঁর দেহরক্ষীদের নায়ককে জিব্রাইল ফেরেশতার অবতার বলে মনে করে। ইসলাম বিরোধী প্রচালনায় বিচলিত হয়ে খলিফা আল-মনসুর ২০০ জন রাওয়ান্দিয়াকে কারারুদ্ধ করেন। এর কিছুদিন পর ৬০০ রাওয়ান্দিয়ার একটি দল খলিফার দর্শনপ্রার্থী হয়ে তাঁকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে। সৌভাগ্যবশত মারওয়ানের বংশধর মায়ান-বিন-যায়দার হস্তক্ষেপের ফলে খলিফা আক্রমণকারীদের হাত হতে রক্ষা পান। যে মায়ানকে হত্যার জন্য খলিফা পুরস্কার গোষণা করেছিলেন সেই মায়ানের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত হতে তিনি অব্যাহতি পান। কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ খলিফা মায়ানকে ‘সিংহপুরুষ’ উপাধি প্রদান করেন এবং প্রথমে ইয়ামামার ও পরে সিজিস্তানের শাসনকর্তার দায়িত্ব অর্পণ করেন। অনৈসলামিক কার্যকলাপ বন্ধ করবার জন্য আল-মনসুর কুসংস্কারাচ্ছন্ন রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়কে রাজধানী হতে বহিষ্কৃত করেন।
তাবারিস্তান ও খোরাসানে শান্তিপ্রতিষ্ঠা
রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্রোহের মূলোপাটন করে আল-মনসুর খোরাসানে অশান্তি ও গোলযোগ নির্মূল করবার প্রচেষ্টা চালান। ৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের শাসনকর্তা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে খলিফা তাঁর পুত্র আল-মাহদী এবং সেনাপতি খোজাইমাকে বিদ্রোহ দমনে প্রেরণ করেন। বিদ্রোহিগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করলে খোরাসানে পুনরায় শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্রোহীদের নেতা আবদুল জব্বার রাজদরবারে প্রেরিত হলে তার হাত-পা ছিন্ন-ভিন্ন করবার পর তাকে হত্যা করা হয় এবং তার এক পুত্রকে লোহিত সাগরের একটি দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়।
খোরাসানের বিদ্রোহ দমনের পর আল-মনসুর তাবারিস্তানের বিদ্রোহী শাসনকর্তা ইস্পাহান্দের বিরুদ্ধে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। পরাজিত হয়ে ইস্পাহান্দ বশ্যতা স্বীকার করলেও কিছুদিন পরে তিনি পুনরায় রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়েন। খলিফার বাহিনী ইরাক ও মসুল হতে সৈন্য সংগৃহ করে দাইলামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আল-মাহদী এই সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দান করেন। এক বৎসরকাল এই বিদ্রোহ চলতে থাকে। আবু মুসলিম ও কাহতাবের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে খালিদ-বিন-বাৰ্মাক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে ৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে আল-মনসুর তাঁকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। দেমাবন্দ পর্বতের পাদদেশে ক্ষুদ্র অঞ্চলটি দখল করে তিনি আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের সাথে উহাকে সংযোজিত করেন।
আলী সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ : খলিফা আল-মনসুরের শাসনকালে সর্বপ্রথম আলী এবং আব্বাসীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। একথা অনস্বীকার্য যে, হযরত আলী ও ফাতিমার বংশদরগণ আব্বাসীয়দের সহায়তা না করলে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। পরিতাপের বিষয় আব্বাসীয়গণ ক্ষমতালাভ করবার পরেই তাদের ধ্বংসের জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। আব্বাসীয়গণ সিংহাসন লাভ করবার পর ইমাম হাসানের বংশধরগণ রাজনীতি অপেক্ষা ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা ও চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ইসলামের মৌলিক স্পৃহা ও আদর্শের পুরোধা হিসেবে আলীর বংশধরদের সমাজে যথেষ্ট সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। আলী সম্প্রদায়ের প্রতি জনসাধারণের অসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধা সন্ধিগ্ধচিত্ত খলিফা আল-মনসুরকে বিচলিত করে তোলে। খলিফা গুপ্তচর নিযুক্ত করে আলী সম্প্রদায় কোন প্রকার আব্বাসীয় বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত আছে কি- না এইরূপ গোপনীয় সংবাদ সংগ্রহে ব্যগ্র হয়ে উঠেন।
আব্বাসীয় প্রচালনা এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকালে আলী সম্প্রদায় সমর্থন জ্ঞাপন করে কিন্তু বানু আব্বাসীয়দের নৃশংসতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও কাপটতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে তারা ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। উল্লেখযোগ্য যে, উমাইয়াদের পতনকে ত্বরান্বিত করবার জন্য মদিনায় চারিটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় মনসুরসহ বানু হাশিমের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, উমাইয়াদের পতনের পর ইমাম হাসানের প্রপৌত্র মুহাম্মদকে খলিফা নিযুক্ত করা হবে। মনসুরও মুহাম্মদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মহান ও পবিত্র চরিত্র, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং কর্মদক্ষতার জন্য তিনি ‘পবিত্র আত্মা’ অর্থাৎ আন-নাফস-উজ-জ্যাকিয়া (An-Nafs-Us- Zakiya) উপাধি লাভ করেন। উমাইয়াদের পতনের পর আবুল আব্বাস আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করলে মুহাম্মদ কোন প্রকার প্রতিবাদ করেন নি। কিন্তু আল-মনসুর সিংহাসনারোহণ করে মদিনায় অনুষ্ঠিত সভায় আলী সম্প্রদায়ের প্রতিপত্তি এবং জনপ্রিয়তার কথা স্মরণ করে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করতে প্রয়াসী হন। আল-মনসুর পরিচালিত হজ্বের কাফেলায় মুহাম্মদ এবং তদীয় ভ্রাতা ইব্রাহিম যোগদান না করায় খলিফার সন্দেহ ও ঈর্ষা ঘনীভূত হয়।
আব্বাসীয় বংশকে নিষ্কণ্টক করবার জন্য খলিফা আল-মনসুর আলী সম্প্রদায়কে ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন। তিনি মুহাম্মদ এবং ইব্রাহিমকে বন্দী করতে না পারায় ইমাম হাসানের পরিবারবর্গকে কারারুদ্ধ করেন। তাঁদের অনেককেই নির্যাতিত এবং হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় মুহাম্মদ এবং বসরায় ইব্রাহিম প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মুহাম্মদ আব্বাসীয় শাসনকর্তাকে বন্দী করে মদিনা দখল করলে হেজাজ এবং ইয়েমেনবাসিগণ তাঁকে খলিফা বলে আনুগত্য প্রকাশ করে। এমনকি ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মালিক মুহাম্মদকে ন্যায়সঙ্গত খলিফা বলে অভিমত প্রকাশ করেন। প্রলোভনে বশ করতে না পেরে আল-মনসুর ভ্রাতৃষ্পুত্র ঈশার নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনী মুহম্মদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। মাত্র ৩০০ অনুচরসহ মুহাম্মদ যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন।
মুহাম্মদের মৃত্যুর ফলে আলী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণ প্রশমিত হয়। ভ্রাতার মৃত্যুতে ইব্রাহিম শত্রুর মোকাবিলা করবার জন্য একটি বিশাল বাহিনী গঠন করতে সমর্থ হন। খলিফার বাহিনী ইব্রাহিমের নিকট বারংবার পরাজিত হতে থাকে। এতে আল-মনসুর শঙ্কিত ও বিচলিত হয়ে ঈশাকে পুনরায় ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ইউফ্রেটিস নদীর তীরে উভয় বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইব্রাহিমের সংঘবদ্ধ আক্রমণে খলিফার বাহিনী পশ্চাদগমন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু দীর্ঘকাল সংঘর্ষ পরিচালনা করে খলিফা আল-মনসুর ইব্রাহিমকে পরাজিত এবং নিহত করে আব্বাসীয় খিলাফতের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদ্বয়কে নির্মূল করেন।
বিদ্রোহের সমস্ত উৎসকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য আল-মনসুর মদিনা, কুফা ও বসরায় মুহাম্মদ এবং ইব্রাহিমের সমর্থকদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করেন। মদিনায় হযরত আলীর বংশধরদের যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। মদিনাবাসীদের সুযোগ- সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়; এমনকি মিসর থেকে মদিনায় খাদ্যসামগ্রী সরবরাহও বন্ধ করা হয়। ইমাম জাফর আস-সাদিক সম্পত্তি ফেরত চাইলে তাঁকে নির্যাতন করা হয়। ইমাম আবু হানিফাকে কারারুদ্ধ এবং ইমাম মালিককে বেত্রাঘাত করা হয়। হোবাইরার দুর্গে কারারুদ্ধ আলীর সমর্থকদের অনেককেই হত্যা করা হয়।
অন্যান্য বিদ্রোহ দমন : খলিফা আল-মনসুরকে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কারণ তাঁরা উভয়ে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করে তাঁদের রাজবংশকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। ৭৫০-৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে মসুল ও এর পাশ্ববর্তী এলাকায় হামাদানের আলীপন্থীদের পরিচালনায় একটি বিদ্রোহ দেখা দেয়। কুর্দিদের সহযোগিতায় এই বিদ্রোহ পারস্য এবং সিন্ধুতেও বিস্তার লাভ করে। খলিফা আল-মনসুর দৃঢ়তার সাথে এই বিদ্রোহের মূলোপাটন করেন। তিনি বসরাকে ধ্বংস করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ইমাম আবু হানিফা তাঁকে এই ঘৃণিত কাজ থেকে নিবৃত্ত করেন। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে খলিফা খালিদ ইবন-বার্মাককে মসুলে এবং খালিদের পুত্র ইয়াহিয়াকে আজারবাইজানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
৭৬০ খ্রিস্টাব্দে হিরাটের উস্তাদশীশ (Ustadsis) নবুয়ত দাবি করে সিজিস্তান ও হিরাটে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং একটি বিশাল বাহিনী গঠন করে খোরাসান আক্রমণ করে। উস্তাদশীশের বিদ্রোহ ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং খোরাসান ও সিজিস্তানের এক বিরাট অঞ্চল বিদ্রোহীদের হস্তগত হয়। খলিফার বাহিনী বারংবার পরাজিত হবার পর ইবন-কোজাইমার অধীনে একটি সংঘবদ্ধ বাহিনী বিদ্রোহ দমনে প্রেরিত হয়। ইবন খোজাইমার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিদ্রোহ নির্মূল করা হয় এবং বিদ্রোহী নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। কথিত আছে যে, এই বিদ্রোহী নেতার কন্যাই খলিফা আল-মামুনের মাতা ছিলেন।
আব্বাসীয় শাসনকালের গোড়াতেই উত্তর আফ্রিকায় বার্বার এবং খারিজিগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে ত্রাসের রাজত্ব কাযেম করে। আব্বাসীয় প্রভুত্ব আফ্রিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য আল-মনসুর কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করেন; কিন্তু খলিফার বাহিনী সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। অতঃপর ৭৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইয়াজিদ-ইবন-হাসান মুহাল্লাবের নেতৃত্বে ৬০,০০০ সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সমরকুশলতায় ইয়াজিদ কায়রোয়ান অধিকার করে বিদ্রোহীদের দমন করেন এবং ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকায় খলিফার প্রতিনিধি ও শাসকরূপে আব্বাসীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন।
এভাবে খলিফা আল-মনসুর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে সমূলে উৎপাঠিত করে শুধু শান্তি ও শৃঙ্খলাই প্রতিষ্ঠা করেন নি বরং নব-প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খিলাফতকে সুদৃঢ় এবং সুসংহত করেন।
সাম্রাজ্য বিস্তার : অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং নৈরাশ্যজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করে আব্বাসীয় খিলাফতকে নিষ্কণ্টক না করলে রাজবংশ দীর্ঘস্থায়ী হত কিনা সন্দেহ। সাম্রাজ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করে আল-মনসুর রাজ্য জয়ের দিকে মনোনিবেশ করেন। ৭৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত তাবারিস্তানের অধিবাসিগণ ইস্পাহান্দের নেতৃত্বে মুসলমানদের আক্রমণ করলে আল-মনসুর অভিযান প্রেরণ করে তাবারিস্তান ও গীলান আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন। দাইলাম অধিকৃত হলে মাজুসী (Magian) সম্প্রদায়ের লোকেরা মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকার করে। ইসলামের প্রভুত্ব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সম্প্রসারিত হতে থাকে এবং শান্তির নিশ্চয়তা বিধানের জন্য খলিফা বিভিন্ন যুদ্ধ-ঘাঁটি নির্মাণ করেন।
এশিয়া মাইনরের উপজাতীয়গণ নব-প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খিলাফতের আনুগত্য স্বীকার করেনি। খলিফা খালেদ-ইবন-বার্মাককে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলে জর্জিয়া, মসুল, কুর্দিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন নির্বাপিত হয়ে ঐ অঞ্চলগুলো আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের আওতাভুক্ত হল।
উমাইয়া খিলাফত ধ্বংস হলে আস্-সাফা উমাইয়াদের যে নিধনযজ্ঞের সূচনা করেন তা হতে হিশামের জনৈক পৌত্র আবদুর রহমান আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়ে সুদূর স্পেনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানে একটি স্বাধীন উমাইয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। খলিফা স্পেনে আব্বাসীয় আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশায় আফ্রিকার শাসনকর্তার নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনী সেখানে প্রেরণ করেন। আব্বাসীয় বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং আবদুর রহমান আব্বাসীয় সেনাপতির ছিন্ন মস্তকটি গোপনে আল-মনসুরের দরবারে প্রেরণ করেন। আবদুর রহমানের ঔদ্ধত্য এবং নৃশংসতায় খলিফা বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাকে “কুরাইশদের বাজপাখি” (Falcon of the Quraish) বলে অভিহিত করেন। আল-মনসুরের পক্ষে স্পেন বিজয়ের আশা সুদূর পরাহত হয়। যা হউক, স্পেন এবং আফ্রিকার কিয়দংশ ব্যতীত প্রায় সমগ্র আরব সাম্রাজ্য আল-মনসুরের প্রভুত্বাধীনে আসে।
খলিফার মনোনয়ন : খলিফা আবুল আব্বাস আস-সাফ্ফা মৃত্যুর পূর্বে তাঁর ভ্রাতা আল-মনসুর এবং ভ্রাতুষ্পুত্র ঈশাকে যথাক্রমে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। আল-মনসুর ক্ষমতা লাভ করে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করবার পর তিনি ঈশাকে খিলাফতের দাবি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন। ৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে আল-মনসুর তাঁর পুত্র মুহাম্মদকে ‘আল-মাহদী’ উপাধিতে ভূষিত করে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। জনমত গঠন করে তাঁর মনোনয়নকে কার্যকর করা হয় এবং মাহদী জনগণের আনুগত্য লাভ করেন।
খলিফার মৃত্যু : ৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মনসুর বার্ষিক হজ্ব সম্পন্ন করবার জন্য কুফা অভিমুখে রওয়ানা হলে পীড়িত হয়ে একটি দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সামান্য আরোগ্য লাভ করে তিনি মক্কাভিমুখে রওয়ানা হলেন। মক্কার সন্নিকটে বীর মায়ামুনায় এসে ৬৫ বছর বয়সে ২২ বছর যোগ্যতা এবং গৌরবের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। সমাধি অপবিত্র করবার প্রচেষ্ঠাকে ব্যর্থ করবার জন্য একশত কবর খনন করে গোপনীয়তার সাথে একটিতে তাকে সমাহিত করা হয়।
রাজ্য শাসন
বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা : বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন করে আল-মনসুর আব্বাসীয় খিলাফতকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রচেষ্টায় প্রশাসনিক সংগঠনে মনোনিবেশ করেন। সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থার দ্বারা সাম্রাজ্য শাসন ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য তিনি একটি কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্টা করেন এবং স্বয়ং শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। নব-প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খিলাফতের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আল-মনসুর ‘বাগদাদ’ নামে অপূর্ব নগরী প্রতিষ্ঠা করে অবিস্মরণীয় কীর্তি রেখে গিয়েছেন। ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহের দাবানল নির্বাপিত করে সম্পূর্ণ নতুন রাজধানীর জন্য তিনি একটি নিরাপদ এবং আদর্শ স্থানের সন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। আবুল আব্বাসের প্রতিষ্ঠিত ‘হাশেমিয়া শহর’ সিরিয়া এবং কুফার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত থাকায় আব্বাসীয়-বিরোধী আলী গোষ্ঠীদের দ্বারা অতর্কিত আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে খলিফা টাইগ্রীস নদীর পশ্চিম তীরে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশে সাসানীয় বংশের প্রাচীন গ্রীষ্মনিবাস মাদাইন অথবা টেসিফোনের নিকটবর্তী বাগদাদ গ্রামকে রাজধানীতে রূপান্তরিত করবার একটি বলিষ্ঠ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সাম্রাজের মধ্যস্থলে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাগদাদ নগরী টাইগ্রীস নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত হওয়ায় নদীপথে সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, আর্মেনিয়া ও এমনকি সুদূর চীনের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার সম্ভবপর হয়। এরূপ আদর্শস্থানে আল-মনসুর সুসমৃদ্ধ বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠিত করে একে ‘দার-উস-সালাম’ বা ‘শান্তি নিবাস’ নামে অভিহিত করেন।
মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি বাগদাদ নগরী ছিল বৃত্তাকার এবং এর অভ্যন্তরে দুটি গোলাকার বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণ করে একে সুরক্ষিত করা হয়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পূর্বে ভূমিতে প্রথমে ভস্ম দ্বারা ছক আঁকা হয় এবং জ্যোতিষির নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকার্য শুরু করা হয়। গোলাকৃতি বাগদাদ দুর্গ নগরীটিকে দুর্ভেদ্য করবার জন্য চতুর্দিকে নালা (Moat) এবং বসরা, কুফা, খোরাসান এবং দামেস্ক নামে চারটি বক্রাকার প্রবেশপথ ছিল। বহিঃপ্রাচীর এবং মধ্যবর্তী প্রাচীরের অন্তর্বর্তী স্থানে রক্ষীবাহিনীর বাসস্থানের ব্যবস্থা ছিল। অভ্যন্তরীণ প্রাচীর এবং মধ্যবর্তী প্রাচীরের অন্তবর্তী স্থানে কর্মচারীদের বাসস্থান ও বাজার ছিল। বাগদাদ নগরীর কেন্দ্রস্থলে নীল গম্বুজবিশিষ্ট মনোরম রাজপ্রাসাদ ( Qubbat-at-Khadra) এবং তৎসংলগ্ন একটি জুমা মসজিদ নির্মিত হয়। এ ছাড়া সরকারি দফতরগুলোও এখানে অবিস্থত ছিল। ৭৬২-৬৩ হতে ৭৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চারি বছর ধরে সিরিয়া, মসুল, পারস্য, কুফা, ওয়াসিতে প্রভৃতি অঞ্চল হতে সংগৃহীত সুদক্ষ কারিগর, শিল্পী ও স্থপতির অক্লান্ত পরিশ্রমে এই সুষমামণ্ডিত আরব্য উপন্যাসের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ নগরী নির্মিত হয়। আল-মনসুরের নামানুসারে রাজধানী বাগদাদ মনসুরিয়া নামেও অভিহিত হয়। তৎকালীন বিশ্বের বিস্ময় এবং মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন গোলাকৃতি বাগদাদ আব্বাসীয় খিলাফতে ইসলামের ইতিহাস তথা মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার কেন্দ্রস্থলরূপে পরিচিত ছিল।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা : আব্বাসীয় বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা আল-মনসুর বিদ্রোহ দমনের জন্য একটি সুসংগঠিত ও নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তিনি দূরাঞ্চল হতে অসন্তোষ ও অরাজকতার সংবাদ আনয়নের জন্য গুপ্তচর বাহিনীও গঠন করেন। গুপ্তচরের মাধ্যমে প্রশাসনিক ব্যবস্থার শৈথিল্য অথবা প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধোচরণ সম্বন্ধে সংবাদ পেয়ে তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। বিশাল রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা কায়েম করবার প্রচেষ্টায় তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল।
প্রশাসনিক কাঠামোকে সুদৃঢ় করবার জন্য আল-মনসুর কেবলমাত্র স্বয়ং রাজকার্য নির্বাহই করতেন না বরং দামেস্ক হতে রাজধানী মেসোপটেমিয়ার বাগদাদে স্থানান্তরিত হলে কেন্দ্রস্থ হতে রাজ্যের সর্বত্র তিনি স্বীয় প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। তিনি প্রদেশগুলোর সীমানা পুনঃনির্ধারিত করে দায়িত্বসম্পন্ন শাসকদের নিযুক্ত করেন। শাসনকার্যকে দুর্নীতিমুক্ত এবং বিদ্রোহের প্রবণতাকে ধ্বংস করবার জন্য তিনি গভর্নরসহ সকল কর্মচারীর বদলীর প্রথা প্রচলন করেন। তিনি আরবদিগকে বিজিত দেশসমূহে স্থায়ীভাবে বসবাস করবার অনুমতি দেন।
পারস্য প্রথার অনুকরণে আল-মনসুর বিভিন্ন শাসন বিভাগ সৃষ্টি করেন। হিট্টি বলেন, “এখানে (বাগদাদ) খলিফাগণ সাসানীয় খোসরাবাদের ভিত্তিতে একটি প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেন। আরবী ইসলাম পারস্য প্রভাবের নিকট পরাভূত হল; খিলাফত আরব শেখতন্ত্রের পরিবর্তে ইরানী স্বৈরতন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করল।” বাগদাদ প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের সংলগ্নে অবস্থিত থাকায় পারস্য উপাধি সাফা, পারস্য মদ এবং মহিলা, পারস্য সঙ্গীত ও ভাবধারা প্রভৃতি আব্বাসীয় খিলাফতে অনুপ্রবেশ করে। আল-মনসুর সর্বপ্রথম পারস্য শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করেন। তাঁর আমলে ইসলামী রাষ্ট্রে সর্বপ্রথম উজির (Wazir or Vizier) নামে একজন প্রধান কর্মচারীর আবির্ভাব হয়। পারস্যবাসী খালিদ-ইবন- বার্মাককে উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়।
বিশ্বাসঘাতক ও নিষ্ঠুর হলেও আল-মনসুর বিচারকাজ নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালন করেন। প্রাদেশিক রাজধানীতে কাযী এবং রাজধানী বাগদাদে প্রধান কাযী নিযুক্ত করা হয়। মুহাম্মদ-বিন-আবদুর রহমান প্রধান কাযীর পদ অলঙ্কৃত করেন এবং বিশ বছর এই পদে বহাল থাকেন। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি ইমাম আবু হানিফাকে ঐ পদে নিযুক্ত করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন; কিন্তু আবু হানিফা এই পদ প্রত্যাখ্যান করলে আল-মনসুর তাকে কারারুদ্ধ এবং নির্যাতন করেন। নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও খলিফা ন্যায়সঙ্গত বিচারের পক্ষপাতী ছিলেন। কতিপয় উষ্ট্রের মালিকের অভিযোগক্রমে মদিনার কাযীর নির্দেশে খলিফা তাঁর হাজিবকে সঙ্গে নিয়ে কাযীর সম্মুখে উপস্থিত হন। খলিফাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য কাযী তাঁর আসন ছেড়ে উঠেন নি এবং তিনি বিবাদীর পক্ষে রায় দেন। খলিফা বিচারকের ন্যায়পরায়ণতায় খুশি হয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করেন। শাসনকার্যের সুব্যবস্থা ও জনগণের মঙ্গলের জন্য আল-মনসুর নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি জমি জরিপ দ্বারা ভূমির পরিমাণ ও রাজস্ব নির্ধারণ করেন। পুলিশ বাহিনী গঠন করে তিনি প্রজাদের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করেন। তাঁর আমলে বাগদাদে জনসাধারণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। তাঁর রাজত্বের সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় দ্রব্যাদির স্বল্পমূল্যে। এক দিরহাম অথবা ২৫ পয়সায় ১ মণ গো-মাংস, ৩০ সের খাসির মাংস, ৫ সের মধু অথবা ৬ সের ঘৃত পাওয়া যেত।
স্থাপত্যশিল্পে খলিফা আল-মনসুরের অবদান ছিল অপরিসীম। সুরম্য বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা ছাড়াও তাঁর স্থাপত্যকীর্তির বহু নিদর্শন রয়েছে। টাইগ্রীসের পূর্ব-তীরে বাগদাদের অনুকরণে নির্মিত অপর একটি শহর যুবরাজ মাহদীর নামানুসারে মাহদীয়া রাখা হয়। খলিফা বসরা ও কুফা শহরকে সুরক্ষিত করবার জন্য প্রাচীর দ্বারা বেষ্টন করেন। জনসাধারণের মঙ্গলার্থে তিনি বহু রাস্তাঘাট, সরাইখানা, হাসপাতাল, পয়ঃপ্রণালী প্রভৃতি স্থাপন করেন।
চরিত্র
খলিফা আল-মনসুর দীর্ঘকায়, শ্যামবর্ণ, ক্ষীণদেহ এবং পাতলা শ্মশ্রুবিশিষ্ট সুশ্রী দেহের অধিকারী ছিলেন। তাঁর চরিত্রে দোষ-গুণের বিচিত্র সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক, পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, আদর্শবাদী, দূরদর্শী, প্রজাবৎসল; অপরদিকে তাঁকে বিশ্বাসঘাতক, কপট, অত্যাচারী, অকৃতজ্ঞ, কাণ্ডজ্ঞানশূন্য, স্বৈরাচারী শাসক বলে আখ্যায়িত করা হয়। মূইর বলেন, “সর্বগুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতকতা এবং নিষ্ঠুরতার জন্য ইতিহাসের রায় মনসুরের বিরুদ্ধে যাবে।” কর্তব্যনিষ্ঠা, আইনানুরাগী, সংগঠক, কূটনীতিবিদ এবং স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কৃতিত্ব অর্জন করলেও তিনি নির্দয় এবং স্বার্থন্বেষী ছিলেন। তাঁর বংশের স্বার্থে বিপজ্জনক মনে করলে কাকেও রেহাই দিতেন না।” তাঁর চাচা আবদুল্লাহকে তিনি স্বীয় হস্তে বধ না করলেও যে জঘন্য ষড়যন্ত্রে হত্যা করেন তা অবিশ্বাস্য। যার বাহুবলে আব্বাসীয় বংশ প্রতিষ্ঠিত হয় সেই আবু মুসলিমকে তিনি খিলাফতের শত্রু বিবেচিত করে হত্যা করেন। যে আলী সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও প্রচারণায় আব্বাসীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করে, সেই বংশের নেতৃবৃন্দ মুহাম্মদ এবং ইব্রাহিমকে তিনি নৃশংসভাবে হত্যা করতে দ্বিধা করেন নি। আলীর সমর্থকদের নির্মূল করবার ষড়যন্ত্রও ছিল কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত। এমনকি তিনি শঠতার বশবর্তী হয়ে ভ্রাতুষ্পুত্র ঈশাকেও খিলাফত হতে বঞ্চিত করেন। উপরন্তু, ইমাম জাফর আস-সাদিক, ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম মালিকের প্রতি অসদাচরণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতস্বরূপ বলে মনে করা হয়। সুয়ূতি যথার্থই বলেন, “মনসুর সর্বপ্রথম আব্বাসীয় এবং আলীপন্থীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন। কারণ এর পূর্বে তাঁরা সংঘবদ্ধ ছিল।
আমীর আলী আল-মনসুরকে মানুষ হিসেবে বিশ্বাসঘাতক এবং নির্দয় বলে অভিহিত করেন। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা চিন্তাকরলে দেখা যাবে যে, আল- মনসুর ‘কঠোরতা ও রক্তপাত’ (Blood and Iron) নীতি গ্রহণ না করলে কণ্টকাকীর্ণ নব- প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খিলাফত কখনও শত্রুমুক্ত হয়ে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, স্থিতিশীলতা এবং আব্বাসীয় খিলাফতের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের জন্য মনসুর বিশ্বাসঘাকতা এবং নির্যাতনের নীতি গ্রহণ করেন। তুলনামূলকভাবে বলা যায় যে, আস- সাফা বিজাতীয়, রক্তলোলুপ এবং প্রতিহিংসামূলক নীতি গ্রহণ করে অসংখ্য উমাইয়া বংশীয়কে নিধন করেন; কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারী আল-মনসুরের রক্তপাত সুপরিকল্পিত এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থে উদ্বুদ্ধ ছিল। উল্লেখযোগ্য যে, আল-মনসুর পিতা হিসেবে স্নেহশীল, শাসক হিসেবে প্রজাবৎসল, মুসলমান হিসেবে ধার্মিক এবং আদর্শ স্থানীয় ছিলেন। অনৈসলামিক কার্যকলাপ তাঁর দরবারকে কলুষিত করে নাই। মূইর বলেন, “যদি আমরা তাঁর চরিত্রের বিশ্বাসঘাকতার নিকৃষ্ট গুণটি ভুলে যাই তা হলে মনসুর সম্বন্ধে আমাদের কৃতিত্ব-বিচার ভিন্নরূপ হবে।”
কৃতিত্ব
প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা আমীর আলী বলেন, “আস-সাফা বানু আব্বাসের প্রথম নৃপতি হলেও আবু জাফর আল-মনসুরকে আব্বাসীয় বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকার করতেই হবে।” রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা লাভ করবার জন্য কঠোর হস্তে বিদ্ৰোহ দমন দ্বারা শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, রাজ্য বিস্তার দ্বারা সার্বভৌমত্ব সম্প্রসারণ, সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা দ্বারা সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব এবং নিরাপত্তা বিধান, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও শিক্ষা- দীক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা সভ্যতার উন্মেষ প্রভৃতি দিক দিয়ে বিচার করলে আল- মনসুরকে নিঃসন্দেহে আব্বাসীয় বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে।
আবুল আব্বাসের মৃত্যুর পর বিদ্রোহের দাবানল জ্বলিয়া উঠলে আল-মনসুর এক ভয়ঙ্কর সঙ্কটের সম্মুখীন হন। ক্ষমতালাভের পূর্বে তিনি ইরাকের শাসনকর্তা হিসেবে নব- প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় খিলাফতের বিরোধী শক্তিগুলোর ক্ষমতা উপলব্ধি করেন। সিংহাসনারোহণ করে সমগ্র মুসলিম রাজ্যের পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেন থেকে পূর্বে পারস্য এবং খোরাসান পর্যন্ত সর্বত্র আব্বাসীয় বিরোধী তৎপরতায় তিনি দিকভ্রষ্ট এবং বিচলিত হয়ে পড়েন। বলা বাহুল্য যে, চার বছরের রাজত্বকালে আস-সাফা আব্বাসীয় বংশকে শত্রুমুক্ত করতে পারেন নি। স্বার্থান্বেষী শাসকবর্গ, বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী, রাজবংশীয় ব্যক্তিদের বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আল-মনসুরকে দিশাহারা করে তোলে। সেই কারণে তাঁকে কঠোর হস্তে উচ্চাভিলাষী পিতৃব্য আবদুল্লাহকে, স্বার্থান্বেষী আবু মুসলিমকে, মাজুসী দলপতি সানবাদকে, ধর্মদ্রোহী রাওয়ান্দিয়া গোষ্ঠীকে, খোরাসানের বিক্ষুব্ধ শাসনকর্তা উস্তাদশীশকে, উত্তর আফ্রিকার বার্বার এবং খারিজী সম্প্রদায়কে দমন করতে হয়। উপরন্তু, আব্বাসীয়দের পরম শত্রু আলীপন্থীদের দলনেতা মুহাম্মদ ও ইব্রাহিমকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থে হত্যা করা হয়।
বিদ্রোহের সকল উৎসের মূলোৎপাটন করে আল-মনসুর রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। ইসলামের সম্প্রসারণ ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে প্রয়োজন ছিল এবং বিদ্রোহী ও আক্রমণকারীদের পরাস্ত করে তিনি তাবারিস্তান, আর্মেনিয়া, কুর্দিস্তান ও উত্তর আফ্রিকায় আব্বাসীয় আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন। স্পেনে প্রতিদ্বন্দ্বী উমাইয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে আল-মনসুরের পক্ষে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ পুনর্দখল করা সম্ভবপর হয় নি, কিন্তু তিনি রোমান সম্রাটের আক্রমণ প্রতিহত করে তাঁকে কর দিতে বাধ্য করেন। নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্য সাম্রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে সুরক্ষিত দুর্গ নির্মিত হয়।
আমীর আলী বলেন, “রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং শাসক হিসেবে আল-মনসুর একপ্রকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।” খলিফার দৈনন্দিন কর্মসূচি হতেই তাঁর অসাধারণ কর্মদক্ষতা, ন্যায়নিষ্ঠা, সততা এবং নিয়মানুবর্তিতার পরিচয় পাওয়া যায়। ইবন-আল-আসীর বলেন, “তিনি পূর্বাহ্নের অধিকাংশ সময় ফরমান জারি, কর্মচারী নিয়োগ ও পদচ্যুতি, সৈন্য ও সীমান্ত সংরক্ষণের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ, রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা বিধানের পন্থা নির্ণয়, প্রজাদের «বস্থা ও বাসস্থানের উন্নতি বিধান, আয়-ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা ইত্যাদি কাজে অতিবাহিত করতেন। অপরাহ্নে পরিবার ও সন্তান-সন্তুতি নিয়ে কাটাতেন। মাগরিবের নামাজের পর তিনি দিনের সংবাদাদি শ্রবণ এবং মন্ত্রিবর্গের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। রাত্রির এক-তৃতীয়াংশ সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কার্যে নিমগ্ন থেকে বিশ্রাম গ্রহণ করতেন। ফজরের নামাজের জন্য তিনি অতি প্রতুষে শয্যা ত্যাগ করতেন। তিনি স্বয়ং সেনাবাহিনী পরিদর্শন করতেন এবং সীমান্ত দুর্গগুলোও প্রয়োজনবোধে পর্যবেক্ষণ করতেন। সেনাবাহিনীকে তিনি বিভিন্ন সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত করেন। হিসাব-নিকাশ তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে করতেন বলে তাঁর উপাধি ছিল ‘আদ-দাওয়ানিকী’ অথবা ‘হিসাবরক্ষক’। বিদ্রোহ দমন, রাজ্যবিস্তারের পর আব্বাসীয় খিলাফতকে সুদৃঢ় এবং সুসংঘবদ্ধরূপে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রচেষ্ঠায় তিনি তৎকালীন বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট গোলাকৃতি দুর্গ-নগরী বাগদাদ নির্মাণ করেন। সামরিক স্থাপত্যশিল্পে এর দুর্ভেদ্যতা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এছাড়া তিনি মাহদীয়া নামে অপর একটি শহর, বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, খাল, পয়প্রণালী স্থাপন করেন। পুলিশ বাহিনী, গুপ্তচর প্রথা, কাযী নিয়োগ, জমি জরিপ, আদমশুমারি প্রভৃতি কার্যকলাপ দ্বারা তিনি শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠন করতে সমর্থ হন। মূইর বলেন, “মোটামুটিভাবে তাঁর শাসনব্যবস্থা বিচক্ষণতা এবং ন্যায়পরায়ণতার সাক্ষ্য বহন করে।”
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং কূটনৈতিক দূরদর্শিতার জন্য আল-মনসুর খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ইসলামের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার সমন্বয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। খোলাফায়ে রাশেদূনের পর উমাইয়া রাজত্বে খলিফাগণ পার্থিব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন; তাঁরা আমীর-উল-মুমেনীন উপাধি গ্রহণ করেন নি। আল-মনসুর উপলব্ধি করেন যে, রাজ্য ক্ষণস্থায়ী এবং সেই কারণে আব্বাসীয় খিলাফতের স্থায়িত্ব বিধানের জন্য তিনি আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের সঙ্গে পার্থিব ক্ষমতার সংযোগ সাধন করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সুন্নী মতবাদ গড়ে উঠে; হানাফী এবং মালেকী মজহাবের উৎপত্তি ও তাঁর উৎসাহে হয়। মুসলিম জাহানের ধর্মগুরুরূপে স্বীকৃতি লাভ করে আল-মনসুর প্রথমত সুন্নী মতবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সমাদৃত হলেন এবং দ্বিতীয়ত, এই মতবাদকে আব্বাসীয় বিরোধী শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হন। আব্বাসীয় শাসনতন্ত্রের প্রকৃত রূপ তিনিই দেন। হিট্টি বলেন, “কৃচ্ছ্রতা এবং কঠোর শিষ্টাচারসম্পন্ন মনসুর তাঁর উত্তরসুরিগণ অপেক্ষা বহুলাংশে ভিন্ন প্রকৃতির ছিলেন। মুয়াবিয়ার নীতিমালা যেভাবে উমাইয়াদের পথ প্রদর্শন করে ঠিক সেভাবে আল-মনসুরের নীতিসমূহ অনেক যুগ ধরে তাঁর বংশধরকে পরিচালিত করে।
আব্বাসীয় রাজবংশের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেই আল-মনসুর ক্ষান্ত হননি; তিনি আব্বাসীয় খিলাফতের স্থায়িত্বকে সুনিশ্চিত করবার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বস্তুত তাঁর বংশধরগণই আব্বাসীয় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে বহুযুগ ধরে রাজত্ব করেন। আমীর আলী বলেন, “মনসুর এশিয়ায় জনপ্রিয়তা অর্জনকারী এক গৌরবোজ্জ্বল খিলাফতের সূচনা করেন।” আবদুল মালিককে “রাজেন্দ্র” (Father of Kings) বলা হয়। কারণ তাঁর চার পুত্র পরবর্তীকালে খলিফা হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। অনুরূপ সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন আল-মনসুর। হিট্টি বলেন, “আস-সাফ্ফার স্থলে তিনিই (মনসুর) নতুন রাজবংশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। যে পঁয়ত্রিশজন আব্বাসীয় তাঁর উত্তরাধিকারী হন তাঁরা তাঁর প্রত্যক্ষ বংশধর ছিলেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ
আব্বাসীয় সভ্যতার গোড়াপত্তন করেন আল-মনসুর। শ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য মাদ্রাসা নির্মাণ করেন এবং তাঁর আমলে সুন্নী সম্প্রদায়ের হানাফী এবং মালেকী নামে দুটি মজহাব গড়ে উঠে। আব্বাসীয় খিলাফতে বিশেষ করে আল-মনসুরের শাসনকালে আরব প্রভাবের পরিবর্তে পারস্য প্রভাব অনুপ্রবেশ করে এবং আব্বাসীয় শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-ব্যবহার, জ্ঞান-বিজ্ঞান, পোশাক- পরিচ্ছদ ও শাসন-ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। আল-মনসুর পারস্য শিরস্ত্রাণ পরিধান করতেন। উজীর বা Vizier নামে পারস্যের একটি প্রাচীন শাসনপ্রথা আব্বাসীয় রাজত্বে প্রবর্তিত হয়। পারস্য স্থাপত্য আব্বাসীয় ইমারতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছাপ রেখেছে। পারস্য কর্মচারী নিযুক্তির ফলে পারস্য শাসন-প্রণালী প্রচলিত হয়। খালিদ-বিন-বাৰ্মাক প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলে পারস্য প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং পরবর্তীকালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বার্মেকী বংশ খলিফা হারুন-অর-রশীদের রাজত্বে বিশিষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
আল-মনসুরের রাজত্বকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চর্চা ও গবেষণার দ্বারা প্রভূত উৎকর্ষ সাধিত হয়। খলিফা নিজেও কাব্যরসিক ছিলেন এবং প্রাসঙ্গিক টীকা-টিপ্পনী অথবা তফসীরের চর্চা এবং হাদিস অথবা রাসূলে করীম (স)-এর বাণীসমূহ সংকলনের ব্যবস্থা তাঁর আমলে করা হয়। আল-মনসুর নিজেও সুপণ্ডিত ছিলেন। বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রে তাঁর যথেষ্ট দখল ছিল। আর অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতায় রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল হতে গ্রীক, পাহলবী, সংস্কৃত গ্রন্থ সংগ্রহ করে আরবী ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়। এই সময় সাহিত্য, ইতিহাস, গণিত, চিকিৎসা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের বিশেষ চর্চা শুরু হয়। একথা অনস্বীকার্য যে, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার প্রভাবে সর্বপ্রথম আরব জ্যোতিষ-বিষয়ক গ্রন্থ প্রণতি হতে থাকে। বস্তুত আরব মনীষী মুহাম্মদ ইবন-ইব্রাহিম আল-ফাজারী সংস্কৃতে জ্যোতির্বিদ্যার উপর লিখিত গ্রন্থ “সিদ্ধান্ত’ (Siddhanta ) আরবীতে অনুবাদ করেন। আল-মনসুরের রাজদরবারের অন্যতম জ্যোতিষ ছিলেন ইবন মুকাফ্ফা (Ibn Muqaffa )। অগ্নিউপাসক ইবন মুকাফ্ফা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আল-মনসুরের রাজত্বে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তিনি সংস্কৃত হতে পাহলবীতে অনুদিত “কালিলা ওয়া দামনা” নামক সর্বজনবিদিত পশুপক্ষীর গল্প (Animal fables) আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। হিট্টি বলেন, “কালিলা ওয়া দিমনা সর্বপ্রাচীন আরবি ভাষায় লিখিত সাহিত্য” (“The earliest literary work in Arabic that has come down to us is Kalila-wa – Dimnah”)। এছাড়া ইবন- মুকাফ্ফা ‘খুদাইনামা’ নামক পাহলবী ভাষায় লিখিত একটি রূপকথা, ইতিহাস, জীবন সম্বলিত পুস্তকটি “সিয়ার আল-মূলক আল-আজম’ (Siyar al Mulk – al-Ajam) নাম দিয়ে আরবী ভাষায় অনুবাদ করেন। সংস্কৃত ও পাহলবী ছাড়াও দার্শনিক এরিস্টটল, ইউক্লিড, টলেমী প্রমুখ গ্রীক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞের অনূদিত সারগর্ভ গ্রন্থরাজিও আরবী সাহিত্যের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। আল-মনসুরের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবগণ জ্ঞানভাণ্ডারের বিপুল সম্পদ আহরণ করে আব্বাসীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির স্বর্ণযুগের তথা ইসলামী সভ্যতার পূর্ণ বিকাশের অধ্যায় সূচনা করে।
আল-মনসুরের আমলে পারস্য স্থাপত্যের প্রভাবে আব্বাসীয় স্থাপত্য শিল্পের উন্মেষ হয়। চার বছর ধরে ৪৮ লক্ষ ৬৩ হাজার দিরহাম ব্যয়ে সুরমা বাগদাদ নগরী অথবা শান্তির শহর (দার-উস সালাম) ছাড়াও তিনি ‘কাসর-উল-খুলদ’ (Qasr-ul-Khuld) অথবা অনন্তধাম এবং রাজকুমার মাহদীর জন্য রুসাফা (Rosafa) নামে দুটি প্রাসাদও নির্মাণ করেন। ক্রেসওয়েলের মতে, আল-মনসুর ৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রাক্কায় একটি রাজপ্রাসাদ এবং মসজিদ নির্মাণ করেন। রাক্কার বাগদাদ ফটকের ভল্ট, খিলান, অলঙ্করণ পদ্ধতি নিঃসন্দেহে প্রাচীন পারস্য-স্থাপত্যকীর্তি হতে গ্রহণ করা হয়।
শান্তি, শৃঙ্খলা, শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, শিল্প- সাহিত্য, সমৃদ্ধি ও কৃষ্টির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আল-মনসুর যে অবদান রেখে গেছেন, তাতে নিঃসন্দেহে তাঁকে আব্বাসীয় বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে। তাঁর কৃতিত্বের উল্লেখ করে আমীর আলী বলেন, “বংশের স্থায়িত্ব এবং এর ক্ষমতার প্রভাবের আত্মপ্রকাশ তাঁর দূরদর্শিতার জন্য সম্ভবপর হয়।” আব্বাসীয় খিলাফত আল-মনসুরের কর্মদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, প্রশাসনিক কুশলতা ব্যতীত সাত শত বছর স্থায়ী হতে পারত না। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক হুমকির মোকাবিলা করে আল-মনসুর আব্বাসীয় শক্তিকে শুধু সুসংহত এবং সুপ্রতিষ্ঠিতই করেন নাই বরং তিনি আব্বাসীয় তথা ইসলামী সভ্যতারও পথপ্রদর্শন করেন। হিট্টি যথার্থই বলেন, “আল-মনসুর নীতিজ্ঞানশূন্য হলেও আব্বাসীয়দের মধ্যে নিজেকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ খলিফা বলে প্রমাণিত করেন।”