প্রথম অধ্যায়: অর্থনৈতিক জীবনের উন্মেষ ও প্রথম নগরায়ন (খ্রীঃ পূঃ আঃ ১৭৫০ অবধি)

প্রথম অধ্যায় – অর্থনৈতিক জীবনের উন্মেষ ও প্রথম নগরায়ন (খ্রীঃ পূঃ আঃ ১৭৫০ অবধি)

এই বই-এর গোড়াতে ‘কথামুখ’-এ বলা হয়েছিল কেন প্রাচীন ভারতের অর্থনেতিক ক্রিয়াকলাপের ইতিহাস খ্রীঃ পূঃ আনুমানিক ২৩০০ থেকে করতে হচ্ছে। বলাই বাহুল্য খ্রীঃ পূঃ ২৩০০-র আগেও অর্থনৈতিক জীবন ও ক্রিয়াকলাপ অবশ্যই ছিল; কিন্তু খ্রীঃ পূঃ ২৩০০ নাগাদ একটি বড় এলাকায় নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির উদ্ভব ঘটায় অর্থনৈতিক ইতিহাস পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু তথ্য ও উপাদান আমাদের হাতে আসে। ২৩০০ খ্রীঃ পৃঃ-এর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে নানা সংস্কৃতির চাক্ষুষ পরিচয় পাওয়া গিয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের প্রয়াসের ফলে। তবে সেই পুরাবস্তু থেকে খ্রীঃ পূঃ ২৩০০-র আগেকার অর্থনৈতিক জীবনের পরিচয় দেওয়া কঠিন কাজ; এবং সে কাজে ঐতিহাসিকের থেকে পুরাতাত্ত্বিকদেরই স্বাভাবিক অধিকার। কিন্তু প্রাক-২৩০০ খ্রীঃ পূঃ-এর অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সামান্য যে পরিচয় পাওয়া যায়, তার সম্বন্ধে প্রথমে দু-চার কথা বলে না নিলে মনে হতেই পারে যে, ২৩০০-১৭৫০ খ্রীঃ পূঃ-তে যে নগরাশ্রয়ী জীবন দেখা দিল তা এক পূর্বপরবিহীন, শিকড়হীন ঘটনা। সেই কারণে প্রাক ২৩০০ খ্রীঃ পূঃ-এর অর্থনৈতিক অবস্থা ও নগরপ্রধান হরপ্পা সভ্যতার সমকালীন সংস্কৃতিগুলির বস্তুগত পরিচয় দেওয়া জরুরী হয়ে পড়ে।

পৃথিবীর নানা দেশের মতই ভারতীয় উপমহাদেশের আদিম মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের গোড়াপত্তন শিকারী ও খাদ্যসংগ্রাহক হিসেবে। প্রাচীন প্রস্তর যুগ (‘প্যালিওলিথিক এজ’, যা তিন ভাগে বিভক্ত: নিম্ন, মধ্য ও ঊর্ধ) ও মধ্যপ্রস্তর যুগ (‘মেসোলিথিক এজ’)-এর মানুষ পাথরের হাতিয়ার দিয়ে শিকার করত। এইরকম পাথরের হাতিয়ার প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গিয়েছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। মানুষ তখন মূলত গুহাবাসী বা বড়জোর অস্থায়ী কোনও বাসস্থান করে থাকত। পাহাড়ের মধ্যে গড়ে তোলা এমনই এক আশ্রয়স্থলের পরিচয় পাওয়া যায় মধ্যপ্রদেশের হোসঙ্গাবাদ জেলার আদমগড়-এ। এখানে আছে মধ্যপ্রস্তর যুগের নানা হাতিয়ার, তারই সঙ্গে আবিষ্কৃত হয়েছে বন্য (সজারু, চিতল হরিণ, সম্বর ও খরগোস) এবং গৃহপালিত (কুকুর, গবাদি পশু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল ও বরাহ) পশুর অস্থি। এই সাংস্কৃতিক স্তরটির উপরিভাগের আনুমানিক কাল খ্রীঃ পূঃ ৫৫০০ (কার্বন-১৪ পরীক্ষা দ্বারা নির্ণীত)। রাজস্থানের ভিলওয়াড়া জেলায় অবস্থিত বাগোড় প্রত্নক্ষেত্রের প্রাচীনতম স্তরে (আঃ ৫০০০-২৮০০ খ্রীঃ পূঃ) পাওয়া গিয়েছে মধ্যপ্রস্তর যুগের নানা নিদর্শন। এখানেও পাথরের তৈরী অতি ক্ষুদ্র হাতিয়ারের (‘মিক্রোলিথ’) সঙ্গে পাওয়া গিয়েছে বন্য ও গৃহপালিত পশুর দেহাস্থি। যেহেতু এই দুই প্রত্নস্থলে বন্য ও গৃহপালিত পশুর দেহাস্থি দেখা যায়, তাই পুরাতাত্ত্বিকরা সঙ্গতভাবেই অনুমান করেছেন যে ঐ দুই এলাকার মানুষ বোধহয় শিকারী থেকে পশুপালকে রূপান্তরিত হচ্ছিল।

শিকারী মানুষের ক্রিয়াকলাপের বিশ্বস্ত পরিচয় দেখা যায় মধ্যপ্রদেশের ভিমবেট্‌কা (ভূপালের ৪৫ কিঃ মিঃ দক্ষিণে) গুহাচিত্রে। ভি. এস. ওয়াকাংকারের বিচারে শিকারী মানুষ এই গুহাবাসে ঊর্ধপ্রস্তর যুগ (‘আপার প্যালিওলিথিক এজ’-খ্রীঃ পূঃ ৮০০০ বা তারও পূর্ববর্তী) থেকেই আস্তানা গেড়েছিল। গুহাচিত্রে রয়েছে (১) নানা জীবজন্তুর ছবি: বাইসন, হাতী, বাঘ, শেয়াল, চিতা, হরিণ, গণ্ডার ও ভালুক; (২) শিকারের দৃশ্য–—শিকারী ও পশু দুই-ই দেখানো হয়েছে; (৩) মুখোশ পরা নর্তকের দল–—এই নাচ বোধহয় আচারভিত্তিক যাদু অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, যা শিকারে সাফল্যের কামনায় অনুষ্ঠিত হত।

ঠিক কোন সময় থেকে ভারতের প্রাচীন মানুষ খাদ্যসংগ্রাহক, পশুপালক থেকে খাদ্যোৎপাদকে রূপান্তরিত হল তার নির্দেশ করা কঠিন। তবে আন্দাজ করা যায় যে নব্যপ্রস্তর যুগেই খাদ্য উৎপাদনের প্রথম প্রয়াস ঘটেছিল। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ জেলায় অবস্থিত কোলদিহাওয়া প্রত্নক্ষেত্রের কথা। এই প্রত্নক্ষেত্রে আবিষ্কৃত হয়েছে ধানের তুষ যা কার্বন-১৪ পরীক্ষায় সপ্তম থেকে পঞ্চম সহস্রকের মধ্যে কোনও এক সময়ে উৎপন্ন হয়েছিল বলে নির্দেশ করা যায়। এছাড়া পুরা উদ্ভিদবিদ্যার (‘প্যালিওবটানি’) বিচারে এই ধান আবাদী শস্য (অথাৎ বুনো ফসল নয়) বলে চিহ্নিত। ভারতীয় উপমহাদেশে ধান চাষের এটিই প্রাচীনতম নিদর্শন।

তবে নব্যপ্রস্তর যুগে কৃষি শুরু হলেও তার ব্যাপকতা দেখা যায়নি; বরং বহু ক্ষেত্রেই মানুষ হয় পশুপালনের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল অথবা পশুপালনের পাশাপাশি কিছু পরিমাণে কৃষিকর্ম করত। দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটকে নব্যপ্রস্তর যুগের পশুপালক সমাজের উপর উল্লেখযোগ্য পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা করেছেন রেমণ্ড অলচিন। ভারতের উত্তর সীমায় কাশ্মীর উপত্যকায় গুফক্রাল-এর উৎখনন থেকে পাওয়া গিয়েছে বন্য ও গৃহপালিত পশুর হাড় এবং আবাদী ফসলের অবশেষ (গম, যব, মসূর, মটর)। আবার উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ জেলায় অবস্থিত মহাগড়াতে আবিষ্কৃত হয়েছে নব্যপ্রস্তর যুগের আয়তাকার একটি খোঁয়াড় (১২.৫ মি. × ৭.৫ মি.)। এই খোঁয়াড়ে গবাদি পশুর ক্ষুরের ছাপ স্পষ্ট। খোঁয়াড়ের কাছেই পাওয়া গিয়েছে কুড়িটি কুঁড়ে ঘরের অবশেষ (কেবলমাত্র ঘরের মেঝে ও খুঁটি পোঁতার গর্তই দেখা যায়। এটি নিঃসন্দেহে পশুপালক গোষ্ঠীর বাসস্থান ছিল।

খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ সহস্রকে বালুচিস্তানে যে স্থায়ী কৃষিনির্ভর, মৃৎপাত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত সংস্কৃতি দেখা দিয়েছিল তা বোঝা যায় কিলি গুল মহম্মদ নামক প্রত্নক্ষেত্রের পুরাবস্তু বিচার করলে। কৃষি অর্থনীতির গোড়াপত্তন হওয়ায় আপেক্ষিকভাবে সরলতর অবস্থা থেকে জটিলতর অর্থনীতিতে রূপান্তরের কথা জানতে হলে মেহেরগড় নামক প্রত্নস্থলটিতে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। বোলান গিরিপথের কাছে ও কোয়েটা শহর থেকে ১৫০ কি.মি. দূরে অবস্থিত এই প্রত্নক্ষেত্র। প্রত্নক্ষেত্রটি সাতটি স্তরে বিভক্ত; তার মধ্যে প্রথম থেকে তৃতীয় স্তর নব্যপ্রস্তর যুগীয় বলে চিহ্নিত। প্রাচীনতম স্তরটির সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে অনুমান করা যায় যে একেবারে গোড়ায় এলাকাটি ছিল ভ্রাম্যমান পশুপালকদের অস্থায়ী আবাস (খ্রীঃ পূঃ ৫১০০)। পরে এখানে গড়ে ওঠে স্থায়ী আবাস, যার পরিচয় পাওয়া যাবে কাদামাটি দিয়ে তৈরী ইঁটের বাসস্থান নির্মাণের ক্ষেত্রে। নব্যপ্রস্তর যুগেই এখানে যে কৃষি অর্থনীতি বিকশিত হয়েছিল, তার অবিসংবাদী প্রমাণ মেহেরগড়ের শস্যাগার। শস্যাগারে কখনও ছয়টি কখনও বা নয়টি করে কক্ষ। এই পর্বের সমাধিতে পাওয়া গিয়েছে তামার তৈরী একটি ক্ষুদ্র পুঁতি–—এটি প্রত্নস্থলটিতে তামা ব্যবহারের প্রাচীনতম নিদর্শন। তবে খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ সহস্রকের আগে মেহেরগড়ের মানুষ তামার নিয়মিত ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়নি। মেহেরগড়ের প্রাচীনতম পর্বতে অবশ্য মৃত্ৰপাত্র ব্যবহারের কোনও নজির নেই। অবশ্য এই পর্বের সবচেয়ে চমকপ্রদ নিদর্শন সমাধিক্ষেত্রে আবিষ্কৃত টার্কোয়াজ পাথরের তৈরী একটি পুঁতি। এই পুঁতি কোনওক্রমেই ঐ অঞ্চলের জিনিস নয় এবং খুব সম্ভব তুর্কেমেনিয়া থেকে তা আনা হয়েছিল। একথা মানলে অনুমান করা যায় খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ সহস্ৰকে মেহেরগড়ের মানুষ দামী/আধা-দামী পাথর ব্যবসাসূত্রে নিয়ে আসত দূরবর্তী এলাকা থেকে। অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতা আবির্ভাবের বেশ কিছু আগেই দূরপাল্লার লেনদেন শুরু হয়ে গিয়েছিল।

মেহেরগড়ের দ্বিতীয় পর্বে আগেকার আমলের সঙ্গে ধারাবাহিকতা যেমন চোখে পড়ে তেমনই নজরে আসে কয়েকটি পরিবর্তন ও নতুনত্ব। এই পর্বেই আবিষ্কৃত হয়েছে তুলো, যা মেহেরগড়ের মানুষ চাষ করতে আরম্ভ করেছিল হরপ্পা সভ্যতার অন্ততঃ দুই হাজার বছর আগে। এ ছাড়া এই পর্বেই দেখা দিল হাতে তৈরী ও কুমোরের চাকায় তৈরী মাটির পাত্র। দূরপাল্লার বাণিজ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যাবে শুধু টার্কোয়াজ থেকে নয়, শঙ্খের (যা আরব সাগর থেকে আনা হয়েছিল) ব্যবহার ও লাপিজ লাজুলি-র (যা কেবলমাত্র বদাখ্‌শান অঞ্চলেই পাওয়া যায়) উপস্থিতি থেকেও। তৃতীয় পর্বের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল। মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও দামী/আধা-দামী পাথর আনার জন্য দূরপাল্লার বাণিজ্যের অব্যাহত প্রচলন।

চতুর্থ থেকে সপ্তম পর্বের কাল পর্যন্ত মেহেরগড়ের বস্তুগত সংস্কৃতি আরও পরিণত হয়েছে। মৃৎপাত্র নির্মাণে বৈচিত্র ক্রমশ বাড়ছে–—একরঙা, দুইরঙা ও বহুরঙা মাটীর পাত্র সেই কথাই প্রমাণ করে। সীলমোহরের আবির্ভাবও লক্ষ্য করা যায় (সীলমোহরগুলি অধিকাংশই পোড়ামাটির, তবে হাড়ের তৈরী একটি সীলমোহরও আবিষ্কৃত হয়েছে)। তারই সঙ্গে দেখা দিচ্ছে পোড়ামাটীর তৈরী নারীমূর্তি। মেহেরগড়ের প্রত্নবস্তু কেবল নতুন তথ্যই আমাদের কাছে তুলে ধরে না, নগরাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতার আগেই যে কৃষি-শিল্প বাণিজ্যকে আশ্রয় করে এক জটিলতর আর্থ-সামাজিক অবস্থা -ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল তারও অকাট্য প্রমাণ দেয়। মেহেরগড়ের বস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যেই বোধহয় আসন্ন নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির পূর্বাভাস ও পদধ্বনি পাওয়া যাবে।

॥ ২ ॥

১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুটা আকস্মিকভাবে নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায় অবস্থিত প্রাচীন মহেঞ্জোদাড়ো নগরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কার ভারতীয় ইতিহাসচর্চা তথা অর্থনৈতিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা, যার ফলে ভারতীয় ইতিহাসের সূচনা প্রাগৈতিহাসিক আমলে নির্দেশ করা সম্ভব হয়েছিল। এই ঘটনার আগে বৈদিক সাহিত্যে যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ পাওয়া যায়, তাকেই পণ্ডিতরা সাধারণত ভারতীয় ইতিহাসের প্রাচীনতম পর্ব বলে মনে করতেন। ভারতে প্রাক-বৈদিক আমলেও যে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল তার সন্দেহাতীত প্রমাণ পাওয়া যায় মহেঞ্জোদাড়োর আবিষ্কারের ফলে। মহেঞ্জোদাড়োর সঙ্গে হরপ্পার আবিষ্কার হওয়ায় প্রাচীনতম ভারতীয় সভ্যতার গুরুত্ব দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়। যেহেতু এই দুই প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায় অবস্থিত ছিল, সেইজন্য সভ্যতাটি সিন্ধু সভ্যতা বলে আখ্যাত হয়। বর্তমানে এই সভ্যতার ভৌগোলিক পরিধি এক বৃহত্তর এলাকা জুড়ে ছিল বলে নির্দ্বিধায় বলা চলে। সাম্প্রতিক কালে পুরাতাত্ত্বিকদের অনলস প্রয়াসের দরুণ এই সভ্যতার চাক্ষুষ নিদর্শন, লক্ষণ ও নমুনা পশ্চিমে মাকরাণ উপকূলের সুৎকাজেনডোর, পূর্বে দিল্লীর নিকটস্থ আলমগীরপুর, উত্তরে আফগানিস্তানের শোর্টুগাই ও দক্ষিণে গোদাবরী উপত্যকায় দাইমাবাদ পর্যন্ত এক বিশাল এলাকায় দেখা যায়। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হবার সময় এই সভ্যতার অধিকাংশ নিদর্শন বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে পরবর্তী চার দশকে ভারতের পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট, এমন কি মহারাষ্ট্রেও এই সভ্যতার চাক্ষুষ প্রমাণ আবিষ্কৃত হয়েছে। তার ফলে এই সভ্যতা যে কেবলমাত্র সিন্ধু উপত্যকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা আর মনে করা যায় না; এই জন্য ‘সিন্ধু সভ্যতা’ আখ্যার বদলে আধুনিক পুরাতাত্ত্বিকরা ‘হরপ্পা সভ্যতা’ নামে অভিহিত করেন; কারণ উনবিংশ শতকে স্যার আলেকজাণ্ডার কানিংহাম হরপ্পা থেকে এই সভ্যতার নিদর্শন সর্বপ্রথম পান, যদিও তার তাৎপর্য তিনি বুঝতে পারেন নি। হরপ্পা সভ্যতার কালনির্ণয় নিয়ে পুরাতাত্ত্বিক মহলে বিতর্ক আছে; তবে এই সভ্যতা যে তাম্রপ্রস্তর যুগের নদীমাতৃক এক সভ্যতা এবং মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার প্রায় সমকালীন ও সমগোত্রীয় এ বিষয়ে বিশেষ মতানৈক্য নেই। অধিকাংশ প্রত্নবিদের বিচারে এই সভ্যতার সময়সীমা খ্রীঃ পূঃ ২৩৫০ থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত; কার্বন ১৪ পরীক্ষা দ্বারা এই কালসীমা নির্দ্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু এই সভ্যতার গতিপ্রকৃতি বোঝার পক্ষে সবচেয়ে প্রধান অন্তরায় লিখিত তথ্যের অভাব। হরপ্পা সভ্যতা যে লিপি ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে ঐ সভ্যতায় ব্যবহৃত সীলমোহরগুলিতে, যেখানে হরফ উৎকীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু এই লিপি এখনও অপঠিত থাকায় সীলমোহরে উৎকীর্ণ লেখতে কি বলা হয়েছিল, তা জানার কোনও উপায় নেই। তাই এই সভ্যতার সম্বন্ধে যাবতীয় আলোচনাই প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর নির্ভরশীল। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেহেতু বহু পরিমাণে পাওয়া গিয়েছে,–—বিশেষত মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পাতে–—তার দ্বারা এই সভ্যতার চরিত্র অন্ততঃ কিছুটা আন্দাজ করা যায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে যে তথ্যটি প্রথমেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, তা হল এই সভ্যতায় বড় মাপের শহরের নিয়মিত ও ধারাবাহিক উপস্থিতি। এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত প্রধান চারটি নগর মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, লোথাল ও কলিবঙ্গান; এ ছাড়াও অনেকগুলি ক্ষুদ্রতর শহরের অস্তিত্ব দেখা যায়। খ্রীঃ পূঃ তৃতীয় সহস্রকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় সহস্রকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত নগরজীবনের ব্যাপক বিকাশ ও প্রাধান্য এই সভ্যতাকে এক বিশেষ চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য দান করেছে। ঠিক কিভাবে এই সভ্যতার জন্ম ও ক্রমবিকাশ ঘটেছিল, তা নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য ও তর্কসাপেক্ষ; লিখিত তথ্যের অভাবই এই সমস্যার প্রধান কারণ। পুরাতাত্ত্বিকরা এই সভ্যতার যে নিদর্শন উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন, তা থেকে মনে হয় এই সভ্যতা প্রথমাবধিই অত্যন্ত পরিণত, উন্নত ও পরিশীলিত। সেই অর্থে এই সভ্যতার আদিমতম রূপ বা শৈশবাবস্থার কথা আমাদের জানা নেই; এই সভ্যতার অনেকগুলি বিস্ময়ের মধ্যে এটি অন্যতম। প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের কাছে অপর এক বিস্ময় এই সভ্যতার ধারাবাহিক–—প্রায় সনাতনী রূপ, যেখানে পরিবর্তন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ নিতান্ত কম; হরপ্পা সভ্যতা যে বিশাল ভূখণ্ডে বিস্তৃত ছিল তার প্রায় সর্বত্র একই রকম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের আভাস পাওয়া যায়। এই ঘটনার মধ্যে পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা কেন্দ্রিকতার লক্ষ্মণ দেখতে পান। প্রায় এক হাজার বছর ধরে একটি সভ্যতায় কেন্দ্রীকরণের এত ধারাবাহিক চেহারা সমকালীন ইতিহাসে প্রায় বিরল বললেই চলে। কিভাবে এই সভ্যতায় কেন্দ্রিকতার ছাপ এত প্রকট হল ও কি জাতীয় সংগঠন এই কেন্দ্রিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল, এ প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া এখনও সম্ভব নয়। সমকালীন মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতায় পুরোহিত সম্প্রদায়ের প্রাধান্যের নজীর আমাদের জানা আছে; তাই অনেক পণ্ডিতের বিচারে হরপ্পা সভ্যতার ক্ষেত্রেও ঐ জাতীয় পুরোহিত সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব কল্পনা করা যুক্তিযুক্ত। স্টুয়ার্ট পিগট সরাসরি এই সভ্যতার নিয়ন্তা হিসেবে একটি সাম্রাজ্যসুলভ রাজনৈতিক সংগঠনের অনুমান করেছেন। যে ব্যবস্থা দ্বারাই এই ধারাবাহিক কেন্দ্রীকরণ হরপ্পা সভ্যতায় ঘটে থাকুক না কেন, তার সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। এ কথা অনুমান করাও অসঙ্গত হবে না যে, এই সভ্যতার বস্তুগত ভিত্তি যথেষ্ট মজবুত না হলে এক অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সংগঠিত সাংস্কৃতিক জীবনের বিকাশ ঘটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ত। ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রথম অথচ বিস্ময়করভাবে পরিণত পর্বটির পরিচয় দেওয়াই এই অধ্যায়ের লক্ষ্য।

॥ ৩ ॥

প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবনের সূচনাপর্বে এমন একটি পরিস্থিতির আমরা সম্মুখীন, যেখানে নগরজীবনের অত্যুচ্চমান আমাদের অবাক করে। এই পর্বের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে নগরের ভূমিকাই অধিকতর প্রকট: তাই আলোচ্য আমলের অর্থনীতি নগর জীবনের লক্ষণগুলির দ্বারা চিহ্নিত। কিন্তু একথা অস্বীকার করা অসম্ভব যে নগর যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, তা নিরবলম্ব বায়বীয় অবস্থায় টিঁকতে পারে না। মনুষ্যবসতির দুই প্রধান ধারা নগর ও গ্রাম বহু ক্ষেত্রেই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। নগর ও গ্রামের তফাৎ কী কী লক্ষণ দ্বারা শনাক্ত করা যায় তা ভৌগোলিক, সমাজবিদ্যাবিশারদদের কাছে বিশদ আলোচনার বিষয়; কিন্তু স্থানাভাবের কারণে সেই তত্ত্বগত আলোচনায় এখন যাওয়া কঠিন। অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের দিক থেকে গ্রাম ও শহরের মধ্যে মৌলিক যে পার্থক্যটি সহজেই নজরে আসে, তা হল গ্রামাঞ্চলে মূলতঃ কৃষি উৎপাদন ঘটে, আর নগর এলাকায় শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য ও প্রশাসনিক ক্রিয়াকর্ম দেখা যায়। অর্থাৎ এখানে কর্মবিভাজনের প্রধান রেখাটি স্পষ্ট: গ্রামীণ এলাকায় খাদ্যোৎপাদন হয়, আর শহরে নানা বৃত্তিতে নিযুক্ত যে বাসিন্দারা থাকেন তাঁরা সরাসরি খাদ্যোৎপাদনে জড়িত থাকেন না। তাই গ্রাম থেকে শহরে খাদ্য যোগানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকলে নাগরিক অর্থনীতির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতার অর্থনীতি যদিও নগরজীবনকে অনেকাংশেই আশ্রয় করেছিল, কিন্তু শিল্প ও বাণিজ্যের পরিচয় দিলেই এই সভ্যতার অর্থনৈতিক চরিত্র ধরা যাবে না। কৃষি অর্থনীতির সাফল্য না ঘটলে হরপ্পা সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত নগরগুলিতে খাদ্য যোগান অসম্ভব ছিল ও নগরের অস্তিত্বই বিঘ্নিত হত। তাই এই আলোচনায় শিল্প ও বাণিজ্যের সঙ্গে কৃষি অর্থনীতির আলোচনা করা বিশেষ জরুরী। প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য উৎপাদন এবং গ্রামের প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত খাদ্য নগরাঞ্চলে খাদ্য-অনুৎপাদক সম্প্রদায়ের কাছে যোগান দেওয়া, যে কোনও নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক প্রধান অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া।

সিন্ধু উপত্যকায় কৃষিজীবী সমাজের আবির্ভাব ঘটেছিল হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর মত নগরের উদ্ভবের আগেই। খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ সহস্রকে কিলি গুল মহম্মদ (কোয়েটা, পাকিস্তান) ও সন্নিহিত অঞ্চলে কৃষিপ্রধান গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। এই সংস্কৃতিতে অবশ্য নগরজীবনের কোনও চিহ্ন নেই। সাম্প্রতিক উৎখননের দ্বারা বালুচিস্তানের মেহেরগড় থেকে প্রাক হরপ্পা পর্বে নগরজীবনের অস্তিত্ব জানা গিয়েছে। কৃষি অর্থনীতির বিকাশ ছাড়া এই জাতীয় স্থানীয় গ্রামীণ ও নগরসুলভ অর্থনীতির বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়। তবে খাদ্যোৎপাদন ব্যবস্থার সম্যক পরিচয় হরপ্পা সভ্যতার আগে যথেষ্ট পরিমাণে চোখে পড়ে না।

কৃষি অর্থনীতির আলোচনার শুরুতে দেখা যাক হরপ্পীয়রা কি কি ফসল ফলাত। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দুই রকম গমের দানা পাওয়া গিয়েছে; গম কলিবঙ্গানেও আবিষ্কৃত হয়েছে। কলিবঙ্গান থেকে যবের চাক্ষুষ প্রমাণও হাজির করা যায়। লোথাল ও রঙ্গপুরের উৎখনন থেকে দেখা যায় যে কাদামাটিতে ও মৃৎপাত্রে ধানের তুষ লেগে ছিল। এই সাক্ষ্য থেকে হরপ্পা সভ্যতায় ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা স্বীকার করতে হয়। এ ছাড়া হরপ্পা সংস্কৃতির অন্তর্গত বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র থেকে কলাই, তিল ও সর্ষের দানা ও বীজ আবিষ্কার করা হয়েছে। মহেঞ্জোদাড়োতে পাওয়া কাপড়ের একটি টুকরোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। প্রত্নতাত্ত্বিকরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে এই কাপড়ের তুলো ভারতীয় কার্পাসজাত (‘গসসিপিয়াম আর্বোরিয়াম)। অতএব অনুমান করতে বাধা নেই যে হরপ্পীয়রা নানা খাদ্যশস্যের সঙ্গে সঙ্গে কার্পাস-এর মত পণ্যশস্যও উৎপাদন করত; অধিকাংশ পুরাতাত্ত্বিকের মতে কার্পাস উৎপাদনের প্রাচীনতম নিদর্শন হরপ্পা সভ্যতাতেই পাওয়া যায়। অবশ্য সম্প্রতি মেহেরগড়ে উৎখনন চালিয়ে হরপ্পা সভ্যতার অন্ততঃ দুই হাজার বছর আগেই তুলোর উৎপাদন ও বস্ত্রশিল্পের প্রচলন দেখা যায়। এই আবিষ্কারের দ্বারা যে তথ্যটি পরিষ্কার হয়, তা হল ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাংশেই সম্ভবত সর্বপ্রথম কার্পাস উৎপাদন হয়। হরপ্পীয়রা যে নানা প্রকারের ফসল ফলাতে দক্ষ ছিলেন, পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন তা নির্দ্বিধায় প্রমাণ করে।

কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার আলোচনায় এই প্রসঙ্গে ল্যামব্রিকের মতামত বিশেষভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। সিন্ধু উপত্যকা ও সন্নিহিত অঞ্চলের পরিবেশ, জলবায়ু ও কৃষি উৎপাদন বিষয়ে ল্যামব্রিকের ব্যক্তিগত ও গভীর অভিজ্ঞতা থাকার দরুন তাঁর অভিমত যথেষ্ট মূল্যবান। তাঁর মতে সিন্ধু উপত্যকায় এখনও কৃষি উৎপাদনের যে সাবেক পদ্ধতি দেখা যায়, তার সঙ্গে হরপ্পীয়দের উৎপাদন ব্যবস্থার বিশেষ ফারাক ছিল না। এই কথা মেনে নিলে বুঝতে হবে যে হরপ্পীয়দের কৃষিজ সাফল্য অনেকাংশেই সম্ভব হয়েছিল সিন্ধুনদের সন্নিহিত ভূখণ্ডের উর্বরতার দরুন; সিন্ধু উপত্যকায় জমিতে প্রতি বর্ষায় সিন্ধুনদের যে পলিমাটি সঞ্চিত হয়, তা ঐ এলাকার উর্বরতা বজায় রাখতে ও বাড়াতে বিশেষভাবে সহায়ক। ল্যামব্রিকের মতে এখনকার মতই হরপ্পীয়রা গম ও যব রবিশস্য হিসেবে এবং তিল ও কার্পাস খরিফ শস্য হিসেবে ফলাতেন। খরিফ শস্যের জন্য রবিশস্যের তুলনায় বেশী জলের দরকার; তাই হরপ্পা সভ্যতায় বোধহয় নদীর প্রধান খাতের সন্নিহিত ভূখণ্ডের চারিপাশে মাটীর আল ও পাড় দিয়ে জল সংরক্ষণের প্রচলন ছিল। কৃষি উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট কোনও সেচ প্রকল্প ছাড়াই হরপ্পা সভ্যতায় সম্ভবত প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্যবহার করে সেচের জল নিশ্চিত করা হত।

কৃষির উপকরণ কী ছিল, এ নিয়ে পণ্ডিতমহলে মতপার্থক্য বিদ্যমান। দীর্ঘদিন পর্যন্ত হরপ্পা সভ্যতায় লাঙ্গল ব্যবহারের স্পষ্ট নজির জানা ছিল না; তাই দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বী অনুমান করেছিলেন যে এই সভ্যতায় লাঙ্গল ছাড়াই ফসল উৎপাদন করা হত। তিনি ধারণা করেছিলেন যে নিড়ানি জাতীয় কোনও উপকরণের দ্বারা জমিকে চাষের উপযোগী করে তোলার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের দ্বারা এ বিষয়ে আগেকার সংশয় দূর হয়েছে ও নতুন আলোকপাত করা সম্ভব হয়েছে। কলিবঙ্গানের উৎখনন থেকে হরপ্পা আমলের একটি কৃষিক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই কৃষিক্ষেত্রে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি সমান্তরাল দাগ দেখা যায়; আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি রেখাগুলি পরস্পরকে সমকোণে স্পর্শ করেছে। এই দাগগুলি আসলে লাঙ্গলের ফলার দাগ; এর দ্বারা অবিসংবাদিতভাবে প্রমাণ করা গিয়েছে যে হরপ্পীয়রা লাঙ্গল ব্যবহার করতেন। এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় যে একই সঙ্গে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি লাঙ্গল চালাবার পদ্ধতি এখনও রাজস্থান অঞ্চলে দেখা যায়; তার ফলে একই ক্ষেতে এক সঙ্গে ছোলা, তিল ও সর্ষে চাষ করা সম্ভব হয়। অতএব অনুমান করা যুক্তিযুক্ত যে হরপ্পীয়রাও অনুরূপ পদ্ধতিতে লাঙ্গল চালিয়ে একই সঙ্গে বিভিন্ন ফসল ফলাতেন। বহুবিস্তৃত একটি সভ্যতায়–—যেখানে নগরজীবন সুপ্রতিষ্ঠিত–—লাঙ্গলের ব্যবহার থাকা স্বাভাবিকও বটে, কারণ নিড়ানি দিয়ে জমি চাষ করলে প্রচুর পরিমাণ ফসল ফলানো দুরূহ; অথচ যথেষ্ট পরিমাণ কৃষিজ উদ্বৃত্ত ব্যতিরেকে নগরের বৃত্তিধারী মানুষ, ব্যবসায়ী ও প্রশাসকদের পর্যাপ্ত খাদ্যসংস্থান করা কার্যত অসম্ভব।

আগেই বলা হয়েছে নগরে যে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ চলে সেখানে কৃষি উৎপাদনের সুযোগ নেই। ফলে গ্রামাঞ্চলে উৎপন্ন শস্যের উদ্বৃত্ত অংশ শহর এলাকায় আনার ও সরবরাহ করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। এই প্রসঙ্গে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে পাওয়া দুটি বৃহৎ শস্যাগারের উল্লেখ করা চলে। হরপ্পার শস্যাগারটি রাভি নদীর শুষ্ক ও প্রাক্তন খাতের কাছেই অবস্থিত। শস্যাগারটির আয়তন ৯০০০ বর্গফুট; দুটি সারিতে শস্যাগারটি বিভক্ত; প্রতি সারিতে ছয়টি করে শস্য সংরক্ষণ করার মঞ্চ। প্রতিটি মঞ্চ পঞ্চাশ ফুট দীর্ঘ ও বিশ ফুট চওড়া। দুই সারি মঞ্চের মাঝখানে চলাচলের মূল পথ, যা তেইশ ফুট চওড়া ছিল। শস্যাগারের মধ্যে হাওয়া চলাচলের জন্য বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা ছিল এবং এর দ্বারা শস্য শুকনো রাখা যেত। নদীর ধারেই অবস্থিত হওয়ায় নদীপথে আনীত শস্য সহজেই শস্যাগারে মজুত রাখা যেত। শস্যাগারটির ঠিক দক্ষিণে একটি উঁচু পীঠিকা বা মঞ্চের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই পীঠিকার মধ্যে কয়েকটি গোলাকৃতি গর্ত দেখা যায়, যেগুলির ব্যাস দশ ফুট নয় ইঞ্চি থেকে দশ ফুট এগারো ইঞ্চি পর্যন্ত। গর্তগুলির ভিতর থেকে খড়, তুষ, পোড়া গমের দানা, খোসা ছাড়ানো যবের দানা আবিষ্কৃত হয়েছে। পীঠিকায় অবস্থিত গর্তগুলি যে শস্য ঝাড়াই-মাড়াই করার জায়গা ছিল, এ বিষয়ে পণ্ডিতমহলে সন্দেহ নেই। শস্যাগারের সঙ্গে ফসল মাড়াই করার জায়গাটি সংলগ্ন থাকায় ঐ কাজে বিশেষ সুবিধা হত। মাড়াই করার জায়গার লাগোয়া দুই সারি প্রকোষ্ঠ পুরাতাত্ত্বিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই প্রকোষ্ঠগুলি এক কামরা বিশিষ্ট বাসস্থান; কখনও কখনও কামবার সঙ্গে লাগোয়া আঙিনা থাকত। এই কামরাতে কারা থাকতেন নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, কিন্তু তাঁরা যে শহরের বৃহত্তর বাড়িগুলির বাসিন্দাদের তুলনায় দরিদ্রতর ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। অধিকাংশ পুরাতত্ত্ববিদ এই কামরাগুলিকে কুলি বা শ্রমিকদের বাসস্থান বলে অনুমান করেন, যে শ্রমিকরা নিকটস্থ শস্যাগারে শস্য ঝাড়াই বাছাই-এর কাজে যুক্ত ছিল। এই দিক দিয়ে বিচার করলে শস্যাগার, শস্য ঝাড়াই মাড়াই করার মঞ্চ ও শ্রমিকদের বাসস্থান–—এই তিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়; সমগ্র ব্যবস্থার মধ্যে বিন্যাস ও পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট; কেন্দ্রীকরণের ঝোঁকও এ ক্ষেত্রে অনুমান করা যায়। মিশরের তেল এল অর্মণা, দিয়ের এল মদিনা ও গিজেতে অনুরূপ শ্রমিক বসতি ছিল, কিন্তু সেইগুলি হরপ্পার শস্য সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার মত এত বিন্যস্ত ছিল না। শস্যাগারে আনীত শস্য সম্ভবত রাজস্ব হিসেবে গ্রহণ করা হত; স্টুয়ার্ট পিগট ও মটির্মার হুইলারের মতে শস্যাগারটি আধুনিক ব্যাঙ্কের মত শস্য লেনদেন করত। মহেঞ্জোদাড়োতেও যে শস্যাগার পাওয়া গিয়েছে তা আয়তনে হরপ্পার শস্যাগারের সঙ্গে তুলনীয়। চারশ মাইল ব্যবধানে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও দুই শহরের শস্যাগারে আয়তন অনুরূপ হবার ঘটনা অর্থনৈতিক জীবনে নিয়ন্ত্রণের ছাপ বহন করে।

উৎখনন থেকে ছাগল, ভেড়া, শূকর, বৃষ, মহিষ (সংখ্যায় কম) প্রভৃতি গৃহপালিত পশুর অস্থি পাওয়া গিয়েছে। তুলনায় উট ও হাতীর হাড় বিরলতর, যদিও এই দুই প্রাণীর প্রতিকৃতি সীলমোহরে দেখা যাবে। দক্ষিণ পাকিস্তানে ও সিন্ধু নদের পশ্চিমে অবস্থিত আম্‌রী-র উৎখনন থেকে গণ্ডারের অস্থি আবিষ্কৃত হয়েছে; গণ্ডারের প্রতিকৃতিও সীলমোহরে উৎকীর্ণ। সীলমোহরে উৎকীর্ণ জীবজন্তুর মধ্যে বৃষ সবচেয়ে বেশী দেখা যায়; এই সভ্যতায় পশুসম্পদ ও বিশেষত গোসম্পদের উপর সম্যক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল বলেই মনে হয়।

॥ ৪ ॥

নগরাশ্রয়ী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য তার কারিগরী শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে দেখা যায়। এবারে হরপ্পা সভ্যতার আমলে কারিগরী শিল্পের আলোচনা করা যাক। পাথর ও ধাতু (লোহা বাদ) দুই ব্যবহারেই হরপ্পা সভ্যতার কারিগররা দক্ষ ছিলেন। পাথরের তৈরী নানা হাতিয়ারের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে ‘ব্লেড’ জাতীয় ক্ষুদ্রাকৃতি ধারালো অস্ত্র বিশেষ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। পাথরের ব্যবহার শিল্পকলা বিশেষত ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও দেখা যায় এবং শিল্পকর্মে পাথর ব্যবহারের দক্ষতা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধাতুর মধ্যে তামার প্রচলন যথেষ্ট ছিল; তামার তৈরী অস্ত্রের মধ্যে বর্শা, ছুরি, ক্ষুদ্র তরোয়াল, তীরের ফলা, কুড়াল ও মাছ ধরার বঁড়শির উল্লেখ করা যায়। তামা দৈনন্দিন প্রয়োজনে ছাড়াও ললিতকলার ক্ষেত্রেও যে লাগানো হত, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মহেঞ্জোদাড়ো থেকে পাওয়া তাম্রনির্মিত নর্তকী মূর্তি। অলঙ্কার তৈরীর করার জন্য সোনার ব্যবহারও অজানা ছিল না। তবে অলঙ্কারের জন্য অন্যতম প্রধান উপাদান ছিল নানা পাথরের পুঁতি; অবশ্য মহেঞ্জোদাড়োতে গোলাকার সোনার পুঁতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কার্নেলিয়ান পাথরের পুঁতির অস্তিত্ব জানা গিয়েছে মহেঞ্জোদাড়ো ও চানহু-দাড়ো থেকে। মূল্যবান পাথরের মধ্যে লাপিসলাজুলী অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। এই পাথর থেকে উৎপন্ন পুঁতি বোধহয় বিত্তবান মানুষের চাহিদা মেটাত।

হরপ্পা সভ্যতায় অন্যতম প্রধান শিল্প ছিল ইঁট তৈরী করা। কাদামাটির ইঁট ও চুল্লীতে পোড়ানো ইঁট দুই-ই ব্যবহৃত হত। যেহেতু হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলিতে বহু ইমারত দেখা যায়, সেখানে ইঁটের ব্যাপক ব্যবহার অস্বীকার করা যায় না। বহু ক্ষেত্রেই ইঁটগুলির মাপ প্রায় অনুরূপ। কলিবঙ্গানের প্রাকারে যে ইঁট রয়েছে তা সাধারণতঃ ৩০ সেঃ মিঃ × ২০ সেঃ মিঃ × ১০ সেঃ মিঃ; পরবর্তীকালে ইঁটের মাপ ভিন্নতর হয় (৪০ সেঃ মিঃ × ২০ সেঃ মিঃ × ১০ সেঃ মিঃ বা ৩০ সেঃ মিঃ × ১৫ সেঃ মিঃ × ৭.৫ সেঃ মিঃ)। হরিয়ানাতে অবস্থিত বানাওয়ালীতে ব্যবহৃত ইঁটগুলির মাপ কলিবঙ্গানের ইঁটের মত। চুল্লীতে পোড়ানো ইঁট সাধারণতঃ জলনিকাশী নালা তৈরীর কাজে লাগান হত। ইমারত ও বসতবাড়ী তৈরীর কাজে ইঁটের ব্যাপক ব্যবহার হরপ্পা সভ্যতার অর্থনীতিকে নাগরিক চরিত্র দান করেছে।

যে শিল্পসামগ্রীর প্রতি পুরাতাত্ত্বিকদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট, তা হল হরপ্পীয় কারিগরদের তৈরী মৃৎপাত্র। অধিকাংশ পাত্রই কুমোরের চাকায় তৈরী; পোড়ানোর পর পাত্রগুলিতে গোলাপী রঙ ধরত, তার উপর দেওয়া হত উজ্জ্বল লাল রঙের প্রলেপ; অবশ্য পীতাভ গাত্রবর্ণযুক্ত পাত্রও দেখা যায়। অলঙ্করণ করা হত সাধারণতঃ কালো রঙে; অলঙ্করণের জন্য সাধারণতঃ জ্যামিতিক নকশাই (সরল, বক্র রেখা, পরস্পরযুক্ত বৃত্ত, চৌখুপী নকশা) বেশী ব্যবহার করা হত। তবে অশ্বত্থাগাছের পাতা, ফুলের পাপড়ি, ময়ূর ও মাছের ছবিও কখনও কখনও মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা হয়েছে। পায়াযুক্ত থালা (ফল রাখার জন্য?), সরু পায়াওয়ালা বাটী, লম্বাটে গড়নের সচ্ছিদ্র পাত্র (ছাঁকার প্রয়োজনে ব্যবহৃত?) এবং সরু পায়াওয়ালা ক্রীমরঙের পানপাত্র আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শেষোক্ত পানপাত্রে কখনও কখনও হরফ উৎকির্ণ থাকতে দেখা যায়; সম্ভবতঃ কারিগরের নাম পানপাত্রে খোদাই করার রেওয়াজ ছিল, যদিও ঐ হরফ এখনও পর্যন্ত অপঠিত। এ ছাড়া মৃৎপাত্রগুলি সমাধিক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হত। তবে এই সমাধিক্ষেত্রগুলির কাল সম্ভবতঃ হরপ্পা সভ্যতার একেবারে অন্তিম পর্বে; তাই এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হল না। সামগ্রিকভাবে দেখলে হরপ্পীয় মৃৎপাত্রগুলিতে প্রায় একঘেয়ে ধারাবাহিকতা দেখা যায়; মাটির পাত্রগুলি নিতান্তই আটপৌরে প্রয়োজনে নির্মিত; বিলাস ব্যসনের জন্য বিশেষ বাসন চোখে পড়ে না।

কারিগরী শিল্পের ক্ষেত্রেও কোথাও কোথাও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের আভাস মেলে। যেমন চকমকি পাথর দিয়ে ব্লেড জাতীয় যে ধারালো ক্ষুদ্রাকার অস্ত্র তৈরী হত তার প্রায় সবটাই নির্মিত হত রোড়ি ও সুক্কুর এলাকায়; সেখান থেকে হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তর্গত গোটা ভূখণ্ডে ব্লেডগুলি বণ্টিত হত বলে রেমণ্ড অলচিন মনে করেন। একটি বিশেষ সামগ্রী একটি অঞ্চলে উৎপন্ন হবার পর বড় এলাকায় তাকে সরবরাহ করার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা অস্বীকার করা কঠিন।

॥ ৫ ॥

হরপ্পার নগরাশ্রয়ী অর্থনৈতিক জীবনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক তার বাণিজ্য। হরপ্পীয় কারিগররা নানা প্রকার ধাতু ব্যবহারে দক্ষ ছিলেন তার উল্লেখ আগে কবা হয়েছে। কিন্তু সবগুলি ধাতু হরপ্পা সভ্যতার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে পাওয়া যেত না। সেইগুলি দূরদেশ থেকে সাধারণতঃ বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে পাওয়া যেত বলেই মনে হয়। যেমন হরপ্পাতে ব্যবহৃত সোনা সম্ভবত আসত দাক্ষিণাত্য থেকে, যেখানে কর্ণাটকের কোলার স্বর্ণখনি থেকে এখনও ভারতের প্রধান স্বর্ণভাণ্ডার পাওয়া যায়। রূপোর যতটুকু প্রয়োগ দেখা যায়, তা বোধহয় আফগানিস্তান থেকে আনা হত। তামার প্রাপ্তিস্থান ছিল রাজস্থানের ক্ষেত্ৰী অঞ্চল, দাক্ষিণাত্য, বালুচিস্তান এলাকা। মূল্যবান পাথরের মধ্যে জেড পাথর পাওয়া যেত পশ্চিম এশিয়ায়; এ্যাগেট, চ্যালসেডনী, কার্নেলিয়ান আনা হত সম্ভবত সৌরাষ্ট্র ও পশ্চিম ভারত থেকে। লাপিস লাজুলী পাওয়া যেত আফগানিস্তানের বদখশান এলাকায়। আফগানিস্তানের উত্তর পূর্বাংশে অবস্থিত শোর্টুগাই হরপ্পা সভ্যতার এক প্রান্তবর্তী বাণিজ্য কেন্দ্রের ভূমিকা নিয়েছিল; শোর্টুগাইতে লাপিস লাজুলী পাওয়া গিয়েছে এবং শোর্টুগাই বদখ্‌শানের নিকটেই অবস্থিত। নানা ধাতু ও দামী পাথরের প্রাপ্তিস্থান বিচার করে ব্রিজেৎ অলচিন ও রেমণ্ড অলচিন মনে করেন যে ধাতুর ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এক বৃহৎ এলাকা জুড়ে আলোচ্য আমলে বাণিজ্য চলত।

হরপ্পীয়রা যে আরও দূরপাল্লার বাণিজ্যে অংশ নিতেন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পশ্চিম এশিয়ার পুরাবস্তু দ্বারা সমর্থিত। ১৯২৩ সালে সি. জে. গ্যাড মেসোপটেমিয়ার উর থেকে চব্বিশটি সীলমোহর আবিষ্কার করেন, যেগুলি আকারে একেবারে হরপ্পীয় সীলমোহরের মত। এই সীলমোহরগুলি হয় আদত হরপ্পীয়দের তৈরী, নচেৎ হরপ্পীয় সীলমোহরের আদলে মেসোপটেমিয়াতে নির্মিত। যে ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক না কেন, এই সীলমোহরগুলির উপস্থিতি সিন্ধু উপত্যকা ও টাইগ্রীস-ইউফ্রেটিস উপত্যকার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত দেয়। মর্টিমার হুইলারের মতে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে হরপ্পীয় বণিকদের নিয়মিত বসতি গড়ে উঠলে আশ্চর্য হবার নেই।

পুরাতাত্ত্বিক এই নিদর্শনের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়া থেকে পাওয়া কীলকাকার (কুনেইফর্ম) হরফে লিখিত ফলকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা মিলিয়ে দেখা দরকার। এই লেখগুলিতে অক্কাদের রাজা সারগনের সময়ে দূরপাল্লার বাণিজ্যের উল্লেখ আছে। তিনটি অঞ্চলের সঙ্গে অক্কাদের নিয়মিত বাণিজ্য চলত; এই তিন অঞ্চল হল মেলুহা, মগন, তিলমুন বা দিলমুন। এই তিন এলাকার অবস্থিতি নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। তবে হুইলার, অলচিন, আগরওয়াল প্রমুখ প্রত্নবিদ মেলুহাকে নিম্ন সিন্ধু উপত্যকার সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করেন; মগন ও মাকরাণ উপকূল তাঁদের বিচারে সমার্থক এবং তিলমুন/ দিলমুন বর্তমান পারস্য উপসাগরে অবস্থিত বাহরিন অঞ্চল। এর থেকে অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত যে মেসোপটেমীয়া ও হরপ্পা সভ্যতার মধ্যে বাণিজ্য অনেকটাই সমুদ্র বাণিজ্য মারফৎ হত। এই সমুদ্র বাণিজ্যে পারস্য উপসাগর ও বাহরিন অঞ্চলের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মেসোপটেমীয় লেখতে মেলুহা থেকে আগত জাহাজ ও মেলুহা ভাষার দোভাষীর উল্লেখও পাওয়া যায়। অতএব সিদ্ধান্ত করা চলে যে দুই এলাকার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ ও নিয়মিত ছিল। মেলুহা বা নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য, লাপিস লাজুলী, ময়ূর ও কাঠ রফতানি করা হত বলে পশ্চিম এশীয় লেখগুলিতে বলা হয়েছে। এইগুলির মধ্যে লাপিস লাজুলী ছাড়া বাকী সবগুলিই খাঁটি ভারতীয় পণ্য।

সমুদ্র বাণিজ্যের অপর নিদর্শন পাওয়া যায় গুজরাটের লোথালে। লোথালে একটি বৃহদায়তন পীঠিকা পাওয়া গিয়েছে; এটি কাদামাটি দিয়ে তৈরী ইঁটের দ্বারা নির্মিত। পুরাতাত্ত্বিক এস. আর. রাও মনে করেন এই ইমারতটি আসলে প্রাচীন পোতাশ্রয়ের ধ্বংসাবশেষ। গুজরাটের উপকূলে অবস্থিত লোথাল হরপ্পা সভ্যতার সমুদ্র বাণিজ্যের বিশেষ ভূমিকা নিত বলে তিনি অনুমান করেন। তবে শিরীন রত্নাগার এই ইমারতটিকে জাহাজ ভেড়াবার পোতাশ্রয় বা ‘ডক’ বলে মনে করেন না। তবে লোথালের সঙ্গে বহির্ভারতীয় যোগাযোগ অস্বীকার করা কঠিন। কারণ লোথালে বোতামের আকারে সীলমোহর পাওয়া গিয়েছে; এই জাতীয় সীলমোহর প্রায়শই সমকালীন পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় ব্যবহৃত হত। বাণিজ্যিক লেনদেন চলার মাধ্যমে সম্ভবত সীলমোহরগুলি পারস্য উপসাগরীয় এলাকা থেকে লোথালে আসে।

পশ্চিম এশিয়া থেকে পাওয়া কীলকাকার হরফে লিখিত ফলকগুলিতে বলা হয়েছে সারগনের রাজত্বকালে মেলুহার জাহাজ নিয়মিত ভাবে অক্কাদের বন্দরে আসত। এই সমুদ্রবাণিজ্যে পারস্য উপসাগরের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না, মেলুহা ও অক্কাদের মধ্যবর্তী বাহরিন এলাকার তাৎপর্যও যথেষ্ট পরিমাণে লক্ষিত হয়।

হরপ্পা সভ্যতার নগরাশ্রয়ী অর্থনীতিতে বাণিজ্যের বিশেষ ভূমিকা আমাদের নজর এড়ায় না। দূর দূর এলাকার সঙ্গে ব্যবসা বজায় রাখার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার দরকার অবশ্যই ছিল। স্থলপথে যোগাযোগের জন্য সম্ভবতঃ দুই চাকাওয়ালা এক্কা জাতীয় গাড়ী ব্যবহার করা হত; এমন ধারণার কারণ এই যে উৎখনন থেকে পোড়ামাটীর তৈরি অনুরূপ এক্কা গাড়ীর অনুকৃতি বা ‘মডেল’ আবিষ্কৃত হয়েছে। সমুদ্রবাণিজ্যের ক্ষেত্রে লোথালের পোতাশ্রয়টি (যদি সঠিক সনাক্ত করা হয়ে থাকে) অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমুদ্রগামী জলযানের উল্লেখ যে পশ্চিম এশীয় তথ্যসূত্রে জানা যায় সে কথা আগেই বলা হয়েছে; হরপ্পীয়দের জলযানের আকার কেমন ছিল, তা দেখা যায় হরপ্পীয় সীলমোহরে উৎকীর্ণ জলযানের প্রতিকৃতিতে।

সীলমোহরগুলিও বাণিজ্যের জন্যই বিশেষভাবে ব্যবহৃত হত। পুরাতাত্ত্বিকরা অনুমান করেন যে পণ্যসামগ্রীর ওজন ও শুদ্ধতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার জন্যই ব্যবসায়ীরা পণ্যের উপর সীলমোহরের ছাপ দিতেন। মহেঞ্জোদাড়োতে পাওয়া একটুকরো কাপড়ের উপর এইরকম সীলমোহরের ছাপ দেখা যায়। সীলমোহরের ছাপ লাগিয়ে পণ্যসামগ্রীর মান সম্বন্ধে ক্রেতাকে নিঃসন্দেহ করার এই প্রয়াসের মধ্যে উন্নত ধরনের অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনার ও ব্যবস্থাপনার চিহ্ন পাওয়া যাবে। এই প্রসঙ্গে মাপ ও ওজন ব্যবস্থার আলোচনা করাও যুক্তিযুক্ত। ওজনের জন্যে বাটখারার যে নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, তা পরীক্ষা করে দুই রকম ওজন ব্যবস্থার পরিচয় পুরাতাত্ত্বিকরা পেয়েছেন। প্রথম পদ্ধতিতে ‘দ্বণ্যুক’ (বাইনারি) হিসাব দেখা যায়: ১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৬৪ ইত্যাদি; দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ১৬-র গুণিতকের ভিত্তিতে দশমিক ব্যবস্থা চালু ছিল: ৩২০, ৬৪০, ১৬০০, ৩২০০, ৬৪০০, ৮০০০ ইত্যাদি। রৈখিক মাপ নেবার জন্য ‘গজকাঠি’ বা ঐ জাতীয় যে দণ্ড আবিষ্কৃত হয়েছে, তারও মাপ জানা গিয়েছে: ৫১.৮ সেঃ মিঃ থেকে ৫৩.৬ সেঃ মিঃ পর্যন্ত। ওজন ও মাপ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট মান বজায় রাখার জন্য হরপ্পীয়দের প্রয়াস লক্ষ্যণীয়: ওজন ও মাপের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মান বজায় না রাখলে দূরপাল্লার বাণিজ্য চালানো হরপ্পীয়দের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ত। ওজন ও মাপের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ মান বজায় রাখার ব্যবস্থা আলোচ্য অর্থনীতিতে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনাকে স্পষ্ট করে তোলে।

॥ ৬ ॥

হরপ্পা সভ্যতার সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য তার নগরজীবন। হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, লোথাল, কলিবঙ্গানের মত প্রধান শহর যেমন ছিল, সেইরকম বহু ক্ষুদ্রতর নগরের অস্তিত্বও দেখা যায়। নগর পরিকল্পনায় একটি নির্দিষ্ট ছক দেখা যায়। সাধারণত নগরগুলি দুই অংশে বিভক্ত থাকত; নগরের উঁচু এলাকা ও নিম্ন এলাকা। উঁচু এলাকাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধান ইমারতগুলি থাকত; শহরের নিচু এলাকায় সাধারণ লোকের প্রধান বসতি ছিল বলে অনুমান করা হয়। উঁচু শহরের চারপাশে থাকত সুদৃঢ় প্রাকার; হরপ্পাতে প্রকারের কোথাও কোথাও প্রহরীদের নজর রাখার জায়গা দেখা যায়; মর্টিমার হুইলার এই জাতীয় নিরীক্ষণ প্রকোষ্ঠ হরপ্পাতে আবিষ্কার করেন। শহরের উঁচু অংশ বা ‘সিটাডেল’ এলাকায় কখনও কখনও তোরণও লক্ষিত হয়; এই জাতীয় তোরণদ্বার হরপ্পার ‘সিটাডেল’-এর উত্তর ও পশ্চিম দিকে দেখা যায়। প্রাকার ছাড়াও পরিখাও ‘সিটাডেল’-এর চারপাশে ব্যবহার করা হত: বাড়তি সুরক্ষার জন্যই এই জাতীয় পরিখার প্রয়োজন ছিল। হরপ্পার ‘সিটাডেল’ এলাকা আয়তাকার। মহেঞ্জোদাড়োতেও নগর প্রাকারটি হরপ্পার মতই বিশালাকার; তবে প্রাকারের গড়ন হরপ্পার মত শহরের সর্বত্র একরকম নয়। মহেঞ্জোদাড়োতে নগর প্রাকার বহুবার সংস্কার করা হয়েছিল। মহেঞ্জোদাড়োর নগর প্রাকারের ভগ্নাবশেষে কাদামাটীর প্রলেপ লক্ষিত হয়; পুরাতাত্ত্বিকদের বিচারে সিন্ধুনদের বন্যায় মহেঞ্জোদাড়োর নগরকার একাধিকবার বিনষ্ট হয়; এবং সেইকারণে এই শহরের প্রাকারে বহুবার সংস্কার করতে হয়েছিল। কলিবঙ্গানেও অনুরূপ ‘সিটাডেল’ও নিম্ন এলাকা দেখা যায়; শহরের ‘সিটাডেল’ এলাকার পূর্বে নিম্ন এলাকা অবস্থিত ছিল। কলিবঙ্গানের ‘সিটাডেল’টিও আয়তাকার (২৪০ মিঃ × ১২০ মিঃ) ‘সিটাডেল’ঘিরে রাখত যে প্রাকার তা তিন থেকে সাত মিটার পর্যন্ত চওড়া। নগর প্রাকারের অস্তিত্ব লোথালেও দেখা যায়। লোথালের প্রধান শহরটির অবস্থান ছিল সাত মিটার উঁচু একটি ঢিবির উপর: ‘সিটাডেল’টি যথারীতি আয়তাকার (১১৯ মিঃ × ১২৭ মিঃ)। নগর প্রাকারের প্রচলন কেবলমাত্র প্রধান শহরেই ছিল না, রঙ্গপুর, বানাওয়ালী, সুর্কোতাদা, প্রভৃতি ক্ষুদ্রতর নগরের চারপাশেও প্রাকারের সন্ধান পাওয়া যায়।

শহরের ‘সিটাডেল’ এলাকাতেই প্রধান ইমারতগুলি তৈরী করা হয়েছিল। এগুলি বসতবাটী নয়; সাধারণের ব্যবহারের জন্য বা নগরের সামূহিক জীবনযাত্রার প্রয়োজনে এগুলি নির্মিত হয়। এই জাতীয় ইমারতের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখনীয় মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পাতে আবিষ্কৃত শস্যাগারদুটি, যার কথা ইতিপূর্বেই আলোচিত। মহেঞ্জোদাড়োতে বৌদ্ধস্তূপের কাছে একটি বিশাল ইমারত পাওয়া গিয়েছে, যা, সাধারণত পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, পুরোহিত সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এই ইমারতের মধ্যে একটি বিশাল বর্গাকৃতি কামরা (৮০ ফুট × ৮০ ফুট) আছে; কামরাটি খিলানওয়ালা, সারিবদ্ধ বসার আসনের চিহ্নও এখানে আবিষ্কৃত। পণ্ডিতদের মতে এই কামরাটি প্রকৃতপক্ষে একটি সভাগৃহ যেখানে বহু মানুষ সমবেত হতেন। মহেঞ্জোদাড়োতে আর একটি বড় ইমারতের সন্ধান জানা আছে, যা দৈর্ঘ্যে ছিল আড়াইশ ফুট; কোনও কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক এটিকে রাজা বা অনুরূপ কোনও শাসকের প্রাসাদ বলে মনে করেন; তবে যেহেতু মহেঞ্জোদাড়ো বা হরপ্পায় শাসক গোষ্ঠীর সম্বন্ধে নির্দিষ্ট পরিচয় জানা যায় না, ফলে এই ইমারতকে নির্দিষ্টভাবে প্রাসাদ হিসেবে চিহ্নিত করার অসুবিধা আছে। এই প্রসঙ্গে মহেঞ্জোদাড়োর প্রসিদ্ধ স্নানাগারটির উল্লেখ করা অসঙ্গত হবে না। স্নানাগারটি দৈর্ঘ্যে ৩৯ ফুট, প্রস্থে ২৩ ফুট ও গভীরতায় ৮ ফুট। দুদিকে সিঁড়ি দিয়ে স্নানাগারের জলাশয়ে ওঠা-নামা করা যেত। জলাশয়টির চারপাশে ছিল কয়েকসারি ঘর। জলাশয়টিতে স্নানের জন্য জল আসত নিকটস্থ একটি কূপ থেকে; জল নিষ্কাশনের জন্য আলাদা একটি বড় প্রণালী ছিল।

হরপ্পা সভ্যতার নাগরিক জীবনের অন্যতম উল্লেখনীয় দিক তার রাস্তাঘাট। শহরগুলিতে ছোট বড় নানারকম রাস্তা ছিল। প্রধান সড়কগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিম বা উত্তর থেকে দক্ষিণে যেত। রাস্তাগুলি অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরের সঙ্গে সমকোণে যুক্ত ছিল। মহেঞ্জোদাড়োর রাস্তাগুলি চওড়ায় নয় থেকে চৌত্রিশ ফুট পর্যন্ত দেখা যায়; কখনও কখনও প্রায় একটানা আধ মাইল পর্যন্ত প্রধান সড়কগুলি একেবারে সোজা চলে গিয়েছে। বড় রাস্তাগুলি শহরকে অনেকগুলি এলাকায় ভাগ করে দিত। এলাকাগুলির ভিতরে ছোট রাস্তা ও সরু গলি দেখা যায়। রাস্তার উপরে বাড়ীগুলি যাতে চলে না আসে এবং যানবাহন ও মানুষের চলাচলে যাতে অসুবিধা না ঘটে, সেইদিকে সযত্ন ও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হত। কলিবঙ্গানে রাস্তার মোড়ে খুঁটির অবশেষ পাওয়া গিয়েছে; চলন্ত যানবাহনের ধাক্কায় পথের ধারের বাড়ীর যাতে ক্ষতি না হয়, তাই এই ব্যবস্থা করা হয়। লোথালে একটি রাস্তার একধারে পরপর বারোটি বাড়ীর অবস্থান লক্ষ্য করার মত। আর একটি রাস্তার দুই ধারে দুই-বা-তিন কামরা বিশিষ্ট বাড়ী দেখা যায়। এই জাতীয় বাড়ীগুলি দোকান বলে অনুমান করা হয়েহে। রাস্তা গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা দেখা যায় তা সুচিন্তিত নগর বিন্যাসের পরিচয় দেয়।

এবার নগরের বসত বাড়ীগুলির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। সবচেয়ে ছোট বাড়ীগুলিতে দুটি ঘর দেখা যায়। তবে সাধারণ নাগরিকদের বাড়ীতে বেশ কিছু কামরা, রান্নাঘর, স্নানাগার ও আঙ্গিনা থাকত। আঙ্গিনার অস্তিত্ব প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই দেখা যায়। মনে হয় সমকালীন গাৰ্হস্থ জীবনে আঙ্গিনার বিশেষ এয়োজনীয়তা ছিল। কোনও কোনও বাড়ীতে সিঁড়ির চিহ্ন থেকে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে যে ঐ বাড়ীগুলিতে একাধিক তলা ছিল।

হরপ্পা সভ্যতার নগরজীবনের এক প্রধান দিক তার পয়ঃপ্রণালী ও জলনিকাশী ব্যবস্থা। শহরে ঢাকা বড় নালা ছিল; তার সঙ্গে যুক্ত ছিল অনেক ক্ষুদ্রতর নালা যা দিয়ে প্রতিটি বাড়ীর জল নিষ্কাশিত হত। স্নানাগারের ব্যাপক ব্যবহারও নাগরিকদের পরিচ্ছন্নতা বোধ ও নাগরিক স্বাস্থ্যসচেতনতার ইঙ্গিত দেয়। জলনিকাশের উন্নত ব্যবস্থা শুধু মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পাতেই নয়, লোথাল ও কলিবঙ্গনেও উপস্থিত। জলনিকাশী ব্যবস্থার উপর এত ব্যাপক ও সার্বিক গুরুত্ব আরোপের নিদর্শন সমকালীন সভ্যতাগুলিতে দেখা যায় না। সুমেরীয় নগরগুলিতে বাড়ীর আঙ্গিনার তলায় ভূগর্ভে প্রোথিত নালীতে নোংরা জল জমা হত; কিন্তু ঐ জল শহরের বাইরে নিষ্কাশন করার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। সেইদিক দিয়ে হরপ্পা সভ্যতার জলনিকাশী ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে অনেক উন্নততর।

॥ ৭ ॥

ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসের আদি পর্বের যে ঘটনাগুলি এই অধ্যায়ে আলোচিত হল তা নিঃসন্দেহে এক অগ্রসর অর্থনৈতিক অবস্থা-ব্যবস্থার পরিচয় বহন করে। এই অধ্যায়ের গোড়াতেই বলা হয়েছিল যে হরপ্পা সভ্যতার সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য তার নগরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা। নদীমাতৃক এলাকায় এই সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও প্রসার ঘটায় প্রথমাবধিই হরপ্পা সভ্যতার কৃষি অর্থনীতি সুদৃঢ় ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যথেষ্ট পরিমাণ ফসল উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলেই তবে নগরের বাসিন্দাদের কাছে গ্রাম থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্যসংস্থান শহরে সরবরাহ করা যেত। কৃষি অর্থনীতির সাফল্যই হরপ্পা সভ্যতার পেশাদারী ও সর্বসময়ের জন্য নিযুক্ত কারিগর ও বণিকদের ক্রিয়াকলাপ অব্যাহত রেখেছিল। বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত নানা রকম কারিগর ও বণিক সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আলোচ্য আমলের অর্থনীতিকে জটিল ও নাগরিক চরিত্র দিয়েছিল। সমকালীন অন্যান্য সভ্যতায় যে নাগরিক অর্থনীতির পরিচয় পাওয়া যায়, তার তুলনায় হরপ্পা সভ্যতার নগরজীবনের একটি মূল পার্থক্য ছিল। এই পার্থক্য দেখা যাবে একেবারে প্রথমাবধিই হরপ্পা সভ্যতার অত্যন্ত পরিণত রূপের মধ্যে এবং এক বিশাল এলাকা জুড়ে মোটামুটি সমানধর্মী অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায়। শস্যাগারের সংগঠন, ইঁটগুলির মাপ ও আকারের ক্ষেত্রে প্রায় সর্বত্র একই রূপ, ওজন ও মাপ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট মান বজায় রাখা, সীলমোহরগুলির ক্ষেত্রে অনুরূপ নির্দিষ্ট মান বজায় রাখা–—এই জাতীয় অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সুসংবদ্ধ ও সংগঠিত ব্যবস্থার অস্তিত্ব অস্বীকার করা কঠিন হবে। অর্থনৈতিক জীবনে এই জাতীয় সংগঠনের লক্ষণ সমকালীন সুমেরীয় ও মিশরীয় সভ্যতায় বিরল। অর্থনৈতিক জীবনে নিয়ন্ত্রণের দরুন এই সভ্যতার ক্ষেত্রে এক উচ্চ নাগরিক মান ও পরিণত রূপ বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু একই সঙ্গে স্বীকার করতেই হবে যে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক জীবনে অভিনবত্বের সুযোগ ছিল অল্প। ফলে অর্থনৈতিক জীবনে যে উচ্চ মান হরপ্পা সভ্যতায় প্রথম থেকে নজরে পড়ে, তা কার্যত কালক্রমে গতানুগতিকতার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে। পরিবর্তনের চিহ্ন হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক তথা সাংস্কৃতিক জীবনে প্রায় নেই বললেই চলে। এর ফলে সম্ভবত এই আমলে উদ্ভাবনী শক্তি বিশেষ বিকশিত হয় নি, এবং তা কার্যত এই সভ্যতার অর্থনৈতিক তথা সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপে জীবনশক্তির ঘাটতি নিয়ে আসে।

উদ্ভবের মতই হরপ্পা সভ্যতার পতনের ব্যাখ্যাও বিতর্কমূলক। অর্থনৈতিক জীবনে জড়ত্ব ও গতানুগতিকতা, উদ্ভাবনী শক্তির অভাব অর্থনীতিতে হয়তো কিছুটা সংকট এনে দিয়ে থাকবে। গাঙ্গেয় উপত্যকায় এই নাগরিক অর্থনীতি যে প্রসারিত হয়নি, তার অন্যতম প্রধান কারণ লৌহ উপকরণের সঙ্গে কোনও পরিচয় হরপ্পীয়রা তাদের দীর্ঘ ছয়শ’ বছরের ইতিহাসে গড়ে তুলতে পারেনি। লোহার উপকরণ না থাকলে গাঙ্গেয় উপত্যকার ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি নিমার্ণ ও স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজের পত্তন ঘটানো দুরূহ ছিল। হরপ্পীয় নগরে পাকা ইমারত, প্রাকার ইত্যাদি তৈরীর জন্য বহু ইঁটের প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। এই ইঁট পোড়াবার জন্য যথেষ্ট জ্বালানীরও প্রয়োজন ছিল। জ্বালানীর জন্য ব্যাপক অরণ্য ধ্বংস করার সম্ভাবনা পুরাতাত্ত্বিক ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বাতিল করেন নি। তার ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়; সিন্ধু উপত্যকা–—যা হরপ্পা সভ্যতার প্রধান এলাকা–—ক্রমশই বৃষ্টিবিহীন ও শুষ্ক হয়ে যেতে থাকে ও ক্রমে মরুপ্রায় হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মহেঞ্জোদাড়োর অবক্ষয়ের পিছনে সিন্ধু নদের বন্যার প্রকোপ যে বড় ভূমিকা নিয়েছিল, সে বিষয়ে পুরাতাত্ত্বিকদের বিশেষ দ্বিমত নেই। নগরাশ্রয়ী অর্থনৈতিক জীবনে বাণিজ্য তথা দূরপাল্লার বাণিজ্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য; হরপ্পীয় ও সুমেরীয় সভ্যতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সংযোগের কথা আগেই বলা হয়েছে। এই সমৃদ্ধ বাণিজ্য সম্পর্ক সম্ভবতঃ খ্রীঃ পূঃ ১৯০০ নাগাদ হ্রাস পায়; তার প্রতিকূল প্রভাব হরপ্পা সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবনে অনুভূত হলে অবাক হবার কিছু নেই।

কতকটা অকস্মাৎই এই বৃহদায়তন সভ্যতা খ্রীঃ পূঃ ১৭৫০ নাগাদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থনৈতিক জীবনে নানা টানাপোড়েন এই সভ্যতার পতনকে হয়তো ত্বরান্বিত করেছিল। ১৭৫০ খ্রীঃ পূঃ নাগাদ শুধু এই সভ্যতার পতনই ঘটল না, এই সময়কার নাগরিক অর্থনীতি একেবারে উধাও হয়ে গেল। এর পরবর্তী পর্যায়ে যে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পরিচয় পাওয়া যাবে তার সঙ্গে হরপ্পীয় অর্থনৈতিক জীবনের কোনও যোগসূত্র নেই। হরপ্পা সভ্যতায় যে নগরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক জীবন দেখা গিয়েছিল, সেই জাতীয় নগরজীবন আবার ভারতে চোখে পড়ে খ্রীঃ পূঃ ৬ষ্ঠ শতকে–—মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায়; কিন্তু হরপ্পার নগরজীবনের সঙ্গে গাঙ্গেয় উপত্যকার নগরায়নের কোনও মিল বা কোনও সম্পর্ক আছে কি না সন্দেহ। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে খ্রীঃ পূঃ তৃতীয় সহস্রকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় সহস্রকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত যে বিস্তৃত নগরাশ্রয়ী জীবন দেখা যায়, তা ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক বিশিষ্ট মর্যাদা পাবার যোগ্য, কিন্তু এই পর্বটি বোধহয় কিছুটা বিচ্ছিন্ন বটে। কারণ এই অতি উন্নত, পরিণত, বৃহদায়তন জটিল নগরাশ্রয়ী জীবনের কোনও পূর্বসূরী নেই, পরবর্তী কালের অর্থনৈতিক জীবনে তার উত্তরাধিকারীও আমাদের অজানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *