প্রথমেই পঞ্চম সংস্করণ
এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই যে ‘অচলপত্র’ নামক অধুনালুপ্ত এবং প্রায় বিস্মৃত পত্রিকাটি নিয়ে আমি আগেও লিখেছি, যেমন লিখেছি ‘শনিবারের চিঠি’ কিংবা ‘সচিত্র ভারত’ নিয়ে। এগুলো আমার মনের মতো পত্রিকা। এখনকার সময়ে প্রকাশিত হলে হয়তো আমি এই পত্রিকাগুলোতে লিখতাম কিংবা লেখার চেষ্টা করতাম।
তথাকথিত প্রগতিশীল, সংস্কৃতিবান, আধুনিকমনা সাহিত্য পত্রিকাগুলোর প্রতি আমার দুর্বলতা খুব কম, লিখতে হয় লিখি, লেখার জন্য জায়গা নেই বলে লিখি।
কিন্তু অচলপত্র অনেকদিন উঠে গিয়েছে। শনিবারের চিঠি কিংবা সচিত্র ভারতও তাই। কুমারেশ ঘোষের ‘যষ্টিমধু’ও কুমারেশবাবুর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হচ্ছে না। একটি নতুন কাগজ এখন বাজারে এসেছে, শেখর আহমেদের ‘পত্রপাঠ’ কিন্তু সে পত্রিকা এখনও জমজমাট হয়ে ওঠেনি।
এসব কথা মনে হচ্ছে ‘অচলপত্র সংকলন’ দেখে। অচলপত্র শেষ বেরয় উনিশশো একাত্তর সালে। দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল, সংক্ষেপে দী. কু. সা. সম্পাদিত অচলপত্রের প্রথম প্রকাশ উনিশশো আটচল্লিশ সালে।
তখন আমি নিতান্তই পূর্ব পাকিস্তান নামক এক অধুনালুপ্ত ভূখণ্ডের এক অজ শহরে স্কুলের ছাত্র, ক্লাস এইটের। পরে উনিশশো একান্ন সালে কলেজে পড়তে কলকাতা এসে প্রথম অচলপত্র দেখি।
অচলপত্র তখন মাসিক পত্রিকা ছিল। মলাটে কাঁটামনসার ছবি। বিজ্ঞাপনে বড় করে লেখা,
বড়দের পড়বার এবং
ছেলেদের দুধ গরম করবার
একমাত্র মাসিক
আরও বলা ছিল,
‘অচলপত্র আপনি যত কম ছাপা হচ্ছে ভাবছেন তা নয়,…আসলে আপনারা যা ভাবছেন তার চেয়েও অনেক কম ছাপা হচ্ছে।’
এখানেই দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম, ‘প্রথমেই পঞ্চম সংস্করণ বেরচ্ছে পরে চতুর্থ, তৃতীয়, দ্বিতীয় এবং প্রথম সংস্করণ বেরতে থাকবে।’
আমাকে অবশ্যি আকৃষ্ট করেছিল। অচলপত্র ছিল হালকা হাসির কাগজ। তবে খুব উচ্চমানের নয়।
সিনেমা, রাজনীতি, চিঠিপত্তরের জঞ্জাল, সাহিত্য দুঃসংবাদ, রম্যরচনা, কার্টুন—অচলপত্রে সব কিছুই পরিবেশন করা হত। ঠিক নির্দোষ হাসি নয়, অনেক রচনাতেই ছিল কষায় স্বাদ, তিক্ততা।
দীপ্তেন্দ্রকুমারের শাণিত কলম সবচেয়ে বেশি ঝলসিয়ে উঠত ব্যক্তিগত আক্রমণে, মহাত্মা গান্ধী, বিধান রায় থেকে আরম্ভ করে সজনীকান্ত, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত রেহাই পাননি তাঁর আক্রমণ থেকে। তবে, সবচেয়ে অসামান্য ছিল দী. কু. সা. স্বাক্ষরিত চিত্র সমালোচনা।
‘চিঠি পত্তরের জঞ্জাল’-এর সব উত্তরই সম্পাদকের স্বরচিত কি না বলার উপায় নেই, কিন্তু এর মধ্যে ছড়িয়ে আছে অনেক হীরকখণ্ড। একটি উদাহরণ:
প্রশ্ন: শ্বশুরমশাইরা জামাইদের বাবাজীবন বলেন কেন?
উত্তর: ঠেলার নাম বাৰাজীবন, জানেন না।
আর একটি প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্ন: আপনার লেখা সবচেয়ে কাদের ভাল লাগে, জানেন?
উত্তর: হ্যাঁ, জানি যারা আমার লেখা পড়ে না।
এতকাল পরে এখনও এসব জবাব রীতিমতো শানিত, পঞ্চাশ বছরেও মরচে পড়েনি।
অচলপত্রের প্রধান আকর্ষণ ছিল কার্টুন। নির্দোষ, অরাজনৈতিক কার্টুন একালে দেখাই যায় না, এখনও দুয়েকটা যা কদাচিৎ অমল আঁকেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর পৃষ্ঠায়।
এক ঝাঁক অসামান্য কার্টুনিস্ট পি সি এল, রেবতীভূষণ থেকে প্রমথ সমাদ্দার, অমিয় (Omio), রবীন গত শতকের চল্লিশের-পঞ্চাশের দশকে কাছাকাছি সময়ে দেখা দিয়েছিলেন।
অসংখ্য, অসামান্য কার্টুন ছাপা হয়েছিল অচলপত্রে। অচলপত্র সংকলনে গোটা পনেরো কার্টুন আছে। অনেকগুলো রবীনের আঁকা, তার মধ্যে একটিতে আছে, মেয়ে এক ভদ্রলোককে সঙ্গে করে বাড়িতে বাবার কাছে এসেছে আর বাবাকে বলছে, ‘বাবা! এই সেই ভদ্রলোক যে রোজ আমাকে ফলো করে—আজ ভুলিয়ে নিয়ে এসেছি, শিগগির একটা পুরুত ডাকো।’
রবীনেরই আর একটা কার্টুনে আছে, এক ভদ্রলোক মুচি দিয়ে জুতো মেরামত করেছেন। মুচি মেরামতের দাম চাইতে তিনি মুচিকে বলছেন, ‘আরে পাবি বাবা পাবি। জুতোর আসল দামই দেওয়া হয়নি তো তোর মেরামতের দাম।’
নাথ ব্রাদার্স পরিবেশিত এই সংকলনের একটি চমৎকার ভূমিকা লিখেছেন পিনাকী ভাদুড়ী। পিনাকীবাবু অচলপত্র পত্রিকার অন্যতম লেখক ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন শ্রীমতী জ্যোতির্ময়ী চৌধুরী।
এ রকম একটি সংকলনের প্রয়োজন ছিল। শ্রীযুক্ত পিনাকী ভাদুড়ীর ভূমিকায় উদ্ধৃত দীপ্তেন্দ্রকুমারের একটি কবিতাংশ অবশেষে উপহার দিচ্ছি:
‘আমরা যারা এলাম গেলাম
কেউ কখনও দিইনি সেলাম
শুধুই বিউটিফুলকে ছাড়া।’