প্রত্যুপকার
এক ব্যক্তি, অশ্বে আরোহণ করিয়া, ইংলণ্ডের অন্তর্গত রেডিং নগরের নিকট দিয়া, গমন করিতেছিলেন। তিনি দেখিতে পাইলেন, একটি বালক, পথের ধারে, কর্দ্দমে পতিত হইয়া রহিয়াছে। তাহার মুখ দেখিয়া, স্পষ্ট বোধ হইল, সে অত্যন্ত যাতনা ভোগ করিতেছে। অশ্বকে দণ্ডায়মান করিয়া সে ব্যক্তি কারণ জিজ্ঞাসা করিলে, বালক কহিল, মহাশয়। পড়িয়া গিয়া, আমার হাত পা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, নড়িতে পারি, বা চলিয়া যাই, আমার এমন ক্ষমতা নাই, এজন্য কাদায় পড়িয়া আছি, উঠিতে পারিতেছি না।
অশ্বারোহী ব্যক্তি অতিশয় দয়াশীল, বালকের অবস্থা দেখিয়া, তাঁহার হৃদয়ে বিলক্ষণ দয়ার সঞ্চার হইল। তিনি অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন, বালককে কর্দ্দম হইতে উঠাইয়া, তাহার উপর আরোহণ করাইলেন, এবং উহার হস্ত ও অশ্বের মুখরজ্জু ধারণ করিয়া, গমন করিতে লাগিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে, তিনি রেডিং নগরে উপস্থিত হইলেন। তাহার পরিচিত এক বৃদ্ধা স্ত্রী ঐ নগরে বাস করিত। তিনি তাহার আলয়ে গমন করিলেন, এবং কহিলেন, দেখ, যাবৎ এই বালক সুস্থ হইতে না পারে, তোমার আশ্রয়ে থাকিবে, ইহার চিকিৎসা ও শুশ্রূষার নিমিত্ত, যে ব্যয় হইবে, সে সমস্ত আমি দিব, আর, তুমি যে ইহার জন্য যত্ন ও পরিশ্রম করিবে, তাহার জন্যও সমুচিত পুরস্কার করিব। বৃদ্ধা সম্মত হইল। তখন তিনি, এক ডাক্তার আনাইয়া, তাঁহার উপর বালকের চিকিৎসার ভার দিলেন, এবং বৃদ্ধার হস্তে কিছু টাকা দিয়া প্রস্থান কবিলেন।
কিছু দিনের মধ্যেই, বালক, চিকিৎসা ও শুশ্রূষার গুণে, সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিল, তাহার শরীর সবল এবং হস্ত ও পদ কর্মক্ষম হইয়া উঠিল। তখন সে আপন আলয়ে প্রতিগমন করিল, এবং সূত্রধারের ব্যবসায় দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করিতে লাগিল।
এই ঘটনার কতিপয় বৎসর পরে, ঐ অশ্বারোহী ব্যক্তি, একদা, রেডিং নগরের মধ্য দিয়া, গমন করিতেছিলেন। এক সেতুর উপরিভাগে উপস্থিত হইলে, অশ্ব, কোনও কারণে ভয় পাইয়া অত্যন্ত চঞ্চল ও নিতান্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিল, এবং আরোহীর সহিত নদীতে লম্ফ প্রদান করিল। সে ব্যক্তি সন্তরণ জানিতেন না, সুতরাং, তাঁহার জলে মগ্ন হইবার উপক্রম হইল। অনেকেই সেতুর উপর দণ্ডায়মান হইয়া, এই শোচনীয় ব্যাপার অবলোকন করিতে লাগিল। কিন্তু কেহই, সাহস করিয়া, তাহার উদ্ধারের চেষ্টা করিতে পারিল না
সেই সেতুর অনতিদূরে, এক সূত্রধার কর্ম্ম করিতেছিল। সে, তদুপরি জনতা দেখিয়া ও কোলাহল শুনিয়া, কর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক, তথায় উপস্থিত হইল, জলপতিত ব্যক্তিকে দেখিবামাত্র জলে ঝম্প প্রদান করিল, এবং অনেক কষ্টে তাঁহাকে লইয়া তীরে উত্তীর্ণ হইল। তদ্দর্শনে, সেতুর উপরিস্থিত ব্যক্তিগণ অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল, এবং সূত্রধারের সাহস ও ক্ষমতার যথেষ্ট প্রশংসা করিতে লাগিল।
এইরূপে প্রাণরক্ষা হওয়াতে, সেই ব্যক্তি প্রাণদাতাকে ধন্যবাদ প্রদান করিয়া কহিলেন, ভাই, তুমি আজ আমার যে উপকার করিলে, তজ্জন্য আমি চির কালের নিমিত্ত, তোমার কেনা হইয়া রহিলাম। এই বলিয়া, তিনি তাহাকে পুরস্কার দিতে উদ্যত হইলেন। তখন সূত্রধার কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিল, মহাশয়। আপনি আমায় চিনিতে পারিতেছেন না। কিছু কাল পূর্ব্বে, আমি ভগ্নহস্ত ও ভগ্নপদ হইয়া, কর্দ্দমে পতিত ছিলাম, আপনি সে সময়ে, দয়া করিয়া, আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন। আপনার কৃত উপকার আমার হৃদয়ে সর্ব্বক্ষণ জাগরূক রহিয়াছে। অধিক কি বলিব, আপনি আমার পিতা আমি অতি অধম, আমি যে কৃতজ্ঞতা দেখাইবার অবসর পাইলাম, তাহাই আমি যথেষ্ট পুরস্কার মনে করিতেছি, আমার অন্য পুরস্কারের প্রয়োজন নাই।
এই বলিয়া, প্রণাম করিয়া, সূত্রধার কর্ম্মস্থানে গমন করিল এবং তিনিও তাহার সৌজন্য ও সদ্ব্যবহার দর্শনে প্রীত হইয়া, স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।